লিখেছেনঃ শ্রীশুভ্র, আপডেটঃ July 1, 2017, 12:00 AM, Hits: 7053
বেশ খুব ভালো কথা। বুঝলাম আপনি ঈশ্বর বিশ্বাসী ধার্মিক মানুষ। আপনার চেতনায় আপনার ঈশ্বরভাবনা পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। স্বভাবতই আপনার মনে এই বিষয়ে কোন সংশয় নাই। না আমাদের মতো অজ্ঞ মনুষ্যকুলেরও সে বিষয়ে কোনই সংশয় নাই। মানে আমি আপনার নিঃসংশয় ঈশ্বর বিশ্বাসের কথাই বলছিলাম আর কি। তা সেই ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রসঙ্গেই জানতে ইচ্ছা করে আপনার ঈশ্বর কি সর্বশক্তিমান? এই জগৎ সংসার তো তিনিই চালান না কি? আপনারাই তো বলে থাকেন, মানুষ নিমিত্ত মাত্র। সকলেই ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন। এমনই তাঁর শক্তি যে এই বিশ্বজগতের সমস্ত কিছুরই সৃষ্টিকর্তা তিনি। না এই বিষয়ে কোন ঈশ্বর বিশ্বাসীরই মনে কোন সংশয় নাই। থাকার কথাও নয়। বিশ্বাসের ধর্মই তো তাই। সমস্ত সংশয়ের উর্দ্ধে মানসিক নিশ্চিন্তি দেওয়া। আমরা যখন কাউকে একান্ত ভাবেই বিশ্বাস করি, তখন কি আর দুঃস্বপ্নেও ভাবি, সেই মানুষটিই কোন একদিন পিছন থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও পারে? আদৌ ভাবি না। ভাবলে তো আর বিশ্বাসই করতে পারতাম না তাকে তাই না? তাই বিশ্বাসভঙ্গের আঘাত এত বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। সে যাই হোক একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেই বিশ্বাসভঙ্গের আঘাত পাওয়ার নাকি কোন সম্ভাবনা থাকে না। এমনটাই তো প্রচলিত বিশ্বাস তাই না? আর সেই ঈশ্বর বিশ্বাসই আমাদের শিখিয়ে থাকে ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান। সকল কিছুর স্রষ্টা। আর আপনিও সেই কথাই বলবেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু এইখানে এমন কতগুলি বেয়াড়া প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চায় যে কি বলবো! জানি সেই প্রশ্নগুলির মুখোমুখি হতে চান না কোন ঈশ্বরবিশ্বাস মানুষই। তাই তো তাদের আপ্তবাক্য, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’।
আচ্ছা বেশ না হয় তর্ক বিতর্ক থেকে দূরেই থাকা যাক আপাতত। আপনি বরং আপনার ঈশ্বরবিশ্বাসের শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে বলুন দেখি, আপনার ঈশ্বরের ধর্ম কি? মানে আমরা জানতে চাইছি, আপনার ঈশ্বর ঠিক কোন সম্প্রদায় ভুক্ত? ইহুদী? হিন্দু? খৃষ্টান? মুসলিম? শিখ? ধরে নিলাম আপনার ঈশ্বর যখন, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই তিনি আপনারই সম্প্রদায়ভুক্তই তো হবেন। অর্থাৎ তিনি হয় ইহুদী নয় হিন্দু নয় খৃষ্টান নয় মুসলিম নয় শিখ! এবং তিনিই সর্বশক্তিমান। এবং তিনিই এই বিশ্বচরাচরের সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা! সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ একমাত্র তাঁরই হাতের মুঠোয়। সেও ভালো কথা। কিন্তু তাহলে বাকি সম্প্রদায়গুলির বিশ্বাস মতোন তাঁদের ঈশ্বরগুলির কি হবে? তারও তো আপনার মতোই নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ঈশ্বর নিয়ে ঠিক এই একই মতে বিশ্বাসী তাই না? তাহলে আমাদের মতো সাধারণ বুদ্ধির মানুষগুলি কি করবে? কার বিশ্বাসকে কাদের বিশ্বাসকে বিশ্বাস করবে বলুন তো? তহলে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, ইহুদী ঈশ্বর, হিন্দু ঈশ্বর, খৃষ্টান ঈশ্বর, মুসলিম ঈশ্বর, শিখ ঈশ্বর- কোন ঈশ্বর সত্যি?
জানি অনেকেই হয়তো বলবেন, সমস্যা কি, এক এক সম্প্রদায়ের এক এক ঈশ্বর। এই যেমন এক একটি রাষ্ট্রের এক এক জন রাস্ট্র প্রধান! সবাই সত্য। তাই তো? আপনিও কি তাই বলবেন? যদি বলেনই, তবে তো প্রশ্ন জাগবেই আপনার সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাহলে কি করে এই জগৎ সংসার বিশ্বচরাচর একাই সৃষ্টি করলেন? আর করলেনই বা যদি তবে এতগুলি বাকি ঈশ্বরও কি তাঁরই সৃষ্টি? সর্বনাশ! সেই কথা একবার যদি বলে ফেলেন, বাকি ঈশ্বরগুলির একান্ত ভক্তরা কি শুনবে আপনার কথা? মানবে আদৌ? কিংবা ধরুন, এই একই কথা অন্য সম্প্রদায়ের অন্য ঈশ্বরে বিশ্বাসী ভক্তকুলরাও যদি বলেন আপনাকে? মানবেন তো? আপনার সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আসলে অন্য সম্প্রদায়ের অন্য কোন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের হাতে গড়া? যাহ! কি গোলমেলে কথা তাই না? আপনার বিশ্বাসের ঈশ্বর; তিনিই নাকি অন্য সম্প্রদায়ের কোন এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সৃষ্টি? আচ্ছা এও কখনো হতে পারে? ভাবুন একবার। ঈশ্বরেরও তবে আছেন সৃষ্টিকর্তা? তাও আবার অন্য ধর্মের অন্য সম্প্রদায়ের? তাজ্জব ব্যাপার মশাই। না না তাই কখনো হতে পারে না কি? আপনার একান্ত বিশ্বাসের সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বলে কথা। তিনি কি আর কখনো অন্য কোন সৃস্টিকর্তার হাতের পুতুল হতে পারেন? না! কখনোই নয়। তাই না? বেশ ভালো কথা। সেটাই না হয় মানলাম। আপনার ঈশ্বরই সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। যিনিই এই বিশ্বচরাচরের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। আমাদের যাদের সাধারণ বুদ্ধিশুদ্ধি নিয়ে চলতে ফিরতে হয়, তাদের আবার আরেক ফ্যাসাদ। সব কিছুতেই প্রশ্ন। তাহলে অন্য সম্প্রদায়ের ঈশ্বরদের কি হবে? কোথায় যাবেন তাঁরা। তাঁরাও তো নাকি সর্বশক্তিমান! তাঁরাও নাকি সৃষ্টি করেছেন এই বিশ্ব সংসারের সমস্ত কিছু। কি কাণ্ড! একটিই বিশ্বচরাচর জগৎসংসার। তার নাকি এতগুলি সৃষ্টিকর্তা! একটি সন্তানের একাধিক জন্মদাত্রী!!
না না ভুলেও ভাববেন না বিতর্ক সৃষ্টি করে কারুর ঈশ্বর বিশ্বাসে ফাটল ধরানোর অপচেষ্টা চলছে! বিতর্ক কোথায় দেখলেন আপনি? আপনার কথার প্রেক্ষিতেই আপনার একান্ত বিশ্বাসের সুদৃঢ় গণ্ডীতেই দেখুন, এইসব প্রশ্নগুলি কেমন সপ্রশ্ন জিজ্ঞাসু মনে চোয়ে আছে আপনারই দিকে। প্রশ্নগুলি কিন্তু অন্য কারুরই নয়। আপনারই একান্ত বিশ্বাসের অনুসিদ্ধান্তগুলি থেকে উঠে আসা অতি সাধারণ বুদ্ধিশুদ্ধির খুবই ন্যায্য ও নিরীহ কতগুলি প্রশ্ন মাত্র। আপনার ভয় পাওয়ার তো কোন প্রশ্নই নাই। আপনি তো আর একশ নম্বরের অঙ্কের প্রশ্নপত্র হাতে ধরে পরীক্ষার হলে বসে নাই। তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়ালো একবার দেখে নেওয়া যাক। একাধিক সম্প্রদায়ের একাধিক বিশ্বাসের ঈশ্বরের মধ্যে কোন ঈশ্বর সেই সর্বশক্তিমান যিনিই এই জগৎসংসারের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা? যার হাতেই সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ? আপনার বিশ্বাসের ঈশ্বর? না অন্য কোন সম্প্রদায়ের কথামতো সেই সেই সম্প্রদায়ের ঈশ্বর? আচ্ছা বিষয়টি আবার এমন নয়তো? এই সকল সম্প্রদায়ের সবকটি ঈশ্বরের যৌথ টিমওয়ার্কের সৃষ্টি এই বিশ্বচরাচর? এই যেমন বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানদের নানান গোষ্ঠীর মতো কোন ব্যাপার। জি সেভেন কি জি টুয়েন্টি, ন্যাটো কি কমনওয়েল্থ? তবে তো ল্যাঠা চুকেই যায়। না না, তাই বা কি করে হয় বলুন? আপনার একান্ত বিশ্বাসের ঈশ্বর যে সর্বশক্তিমান। তিনিই নাকি একার হাতে এই জগৎসংসার সৃস্টি করে নিয়ন্ত্রণ ও পালন করছেন। বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি যদি নানান সম্প্রদায়ের একাধিক ঈশ্বরের টিমওয়ার্কই হয়, তবে তো কোন একটি সম্প্রদায়ের কোন একজন ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠা আর সম্ভব নয়। কি বলেন? হুঁ খুবই মুশকিলের কথা।
সত্যই মুশকিলের বিষয়। এক ঈশ্বর না কি একাধিক ঈশ্বর? এতগুলি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একান্ত বিশ্বাসের সর্বশক্তিমান সব ঈশ্বর। সহজ কথা তো নয়? কার কথা অবিশ্বাস করবেন আপনি? কারুর কথাই বিশ্বাস না করলে না হয় একটি পথ খোলে। অনেকেই যে পথটিকে নাস্তিকতার পথ বলে গালমন্দ করেন। কেউ কেউ ধর থেকে মুণ্ডও নামিয়ে দিয়ে ধর্ম রক্ষা করে থাকেন প্রকাশ্য দিবালোকে। না সে পথ তো আমাদের নয়। আমরা সাধারণ বুদ্ধিশুদ্ধির সাধারণ প্রশ্ন করার মানুষ। আমরা জানতে চাই, কোন সম্প্রদায়ের বিশ্বাসই এই জগৎসংসার বিশ্বচরাচর সৃষ্টির নেপথ্যের মহাসত্যকে ধারণ করে আছে। কোন ঈশ্বরই প্রকৃতপক্ষে সর্বশক্তিমান। যার হাতের ইশারয় চলছে এই বিশ্বজগৎ। আমাদের খোঁজ তো তাকে নিয়েই। তাকে না পেলে তো এই জীবনই বৃথা। কি বলেন? আমরাও তো তাই তারই খোঁজে ব্যস্ত দেখুন কেমন আকুল হয়ে।
তাহলে বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও এখনো কিন্তু আমাদের সেই প্রথম প্রশ্নের উত্তরটুকু অধরাই রয়ে গেল দেখুন। কার ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। কোন ঈশ্বর এই জগৎসংসার বিশ্বচরাচরের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা। কোন সম্প্রদায়ের ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণাধীন আমাদের এই জীবন ও জগৎ। বিশ্ব ও সৃষ্টি?
বেশ না হয় মেনেই নিলাম, ঠিক আছে আপনার একান্ত বিশ্বাসের সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরেরই সৃষ্টি এই বিশ্ব ও জগৎ। আমি আপনি, স্বধর্মী বিধর্মী সকলেই। মেনে নেওয়া তো সহজ। কিন্তু একটি উত্তর মেনে নিলেই যে আরেকটি প্রশ্নের জন্ম হয়। কি মুশকিল! আপনার ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমানই হবেন, তবে তো তার শক্তির থেকে বড়ো আর কিছুই হতে পারে না, তাই না? যেমন দেখুন আপনার সর্বশক্তিমান সেই মহাশক্তিধর ঈশ্বরই তো ১৯৪৫ সালের হিরোশিমা নাগাসাকির মানুষ ও জীবজন্তুদের সৃষ্টি করেছিলেন, ঠিক যাদেরকে তৎকালীন মার্কীণ রাস্ট্রপতির নির্দেশে এটোম বোমায় ধ্বংস করে দেওয়া হলো অমন বীভৎস ভাবে। কি করলেন আপনার সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর? রক্ষা তো আর করলেন না তার নিজের সৃস্টি করা কোটি কোটি জীবকুলকে? না কি এটোম বোমার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো ক্ষমতা ছিল না আপনার ঈশ্বরের? কিন্তু আপনিই তো ঠিক জানেন তার সর্বশক্তিমান ক্ষমতা। তবে কেন সেদিনের সেই বীভৎস লগ্নে তিনি চুপ করে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে ছিলেন পলাশীর প্রান্তরের মীরজাফরের মতো? অর্থাৎ দেখুন প্রশ্ন কিন্তু এখানে মাত্র দুটি। হয় আপনার ঈশ্বরের থেকে তৎকালীন মার্কীন যুদ্ধ-অপরাধী প্রেসিডেন্ট বেশি শক্তিশালী ছিলেন, যিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন নিরপরাধ নিরস্ত্র অসতর্ক সাধারণ মানুষের ওপর বীভৎস এটোম বোমা ছোঁড়ার। আর নয়তো, তিনি চিরকালই ক্ষমতাধরদের পক্ষ নিয়ে চুপটি করে সাধারণ মানুষের বিড়ম্বনা উপভোগ করেন।
না তাই কি আর হতে পারে। আপনিই তো মানেন, আপনার ঈশ্বর পরম কল্যাণময়। দুর্বলের রক্ষাকর্তা আর অপরাধীর শাস্তিদাতা। মানুষই তো বিপদে পড়লে প্রথমেই ঈশ্বরের স্মরণ নেয়। তবু কিন্তু দেখুন, নিজের বাড়িতে আগুন লাগলে আপনি কিন্তু তাই বলে ঠাকুর ঘরে বা উপাসনালয়ে না ছুটে আগে দমকলে খবর দেন। কি আশ্চর্য্য! দুর্ঘটনায় পড়লে সবার আগে হাসপাতালে দৌড়ান মন্দিরে মসজিদে গীর্জায় গুরুদ্বারে না গিয়ে। না এটা ঠিক, সেই মুহূর্তে আপনি ঈশ্বরের কাছে না গিয়ে মানুষের কাছেই ছুটবেন। কারণ আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তবে এটাও ঠিক সেই সাথে আপনি আপানর ইস্টদেবতার নামও নেবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নামই নেবেন। শুধু দৌড়াবেন সঠিক বিশেষজ্ঞ মানুষের কাছে। সেই মুহূর্ত্তে আপনিই জানেন কাজের কাজ কোথায় গেলে কার কাছে গেলে হবে। সেটা জানেন আপনার অভিজ্ঞতা থেকে, সেটা জানেন আপনার সাধারণ বুদ্ধি থেকে। আপনার ঈশ্বর বিশ্বাস থেকে নয়। হ্যাঁ বিপদমুক্ত হয়ে গেলেই আপনি বুঝতে পারেন আপনার একান্ত বিশ্বাসের ঈশ্বরের পরম কল্যাণেই ঘটেছে এই বিপদমুক্তি। মানুষের মধ্যে দিয়েই ঈশ্বর তার কল্যাণহস্তের সেবা পৌঁছিয়ে দিয়ে থাকেন তাঁর ভক্তদের কাছে। আশা করি এই নিয়ে কোন বিতর্ক নাই!
কিন্তু ভাবুন তো সেই দিনটির কথা। মার্কীণ মুলুকের সেই গগনচুম্বীর দুই অট্টালিকা যখন আগুনের পিণ্ড হয়ে গলে পড়ছিল। সেই প্রায় চার হাজার নিরপরাধ অসতর্ক নিরস্ত্র মানুষগুলি যখন নিজেকে বাঁচানোর কোন রাস্তা খুঁজে না পেয়ে নিজ নিজ ইস্টদেবতার নাম জপছিলেন। কেউ কেউ ইস্টদেবতার উপর ভরসা করতে না পেরেই একশ তলা থেকে ঝাঁপ দিচ্ছিলেন আগুনের হল্কা থেকে বাঁচার জন্যে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে? তখন ঐ প্রায় চার হাজার অসহায় মানুষের একান্ত বিশ্বাসের সর্বশক্তিমান পরমকল্যাণময় ঈশ্বর বা ঈশ্বররা কি করলেন? তার বা তাদের একান্ত ভক্তদের বাঁচানোর জন্যে? নাকি সেই অসহায় মানুষগুলিকে বাঁচানোর মতো আদৌ কোন ক্ষমতাই ছিল না আপনার সর্বশক্তিমানের? তাহলে আপনার পরমকল্যাণময় ঈশ্বর হয়তো সত্যই সর্বশক্তিমান নয়। হলে তো নিশ্চিত তার আপন সৃষ্ট মনুষ্যকুলকে বাঁচাতে পারতেন সহজেই তাই না? নাকি তিনি সত্যইই সর্বশক্তিমান। কিন্তু, পরমকল্যাণময় নন। তাই তিনি সেদিনের অপরাধীরা ঠিক যেমনটি যেভাবে ঘটাতে চেয়েছিল, সেটাই হতে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি দুষ্টচক্রের সাথেই পরোক্ষে হাত মিলিয়েছিলেন সেই মীরজাফরের মতো? আবার দেখুন আপনিই কিন্তু বলে আসছেন, আমরা নিমিত্ত মাত্র। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই আমাদের মধ্যে দিয়ে তার সব ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেন। “সকলই তোমার কর্ম, লোকে বলে করি আমি” সাধক রামপ্রসাদও যেমন ভাবতেন আর কি। তবে তো বলতেই হয়, সেদিনের সেই চারহাজার নিরপরাধ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়াটাই ছিল আপনার একান্ত বিশ্বাসের ঈশ্বরের একান্ত ব্যক্তিগত অভিপ্রায়। যে অভিপ্রায় তিনি কতগুলি মানুষের একটি টিম বানিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন সেদিন? না কি সেদিনের মৃত সকলেই পরম নাস্তিক ছিলেন বন্ধু? হ্যাঁ তাহলে অবশ্য বলার কিছুই নাই। অবিশ্বাসীদের জন্যে পরমকল্যাণময়ের করাই বা কি আছে? আর করবেনই বা কেন?
মানুষের ইতিহাস যুদ্ধ বিগ্রহ খুন জখম লুঠতরাজ দুর্বলের উপর প্রবলের শোষণ শাসন ও নির্যাতনের ইতিহাস। সেই মানুষেরই তো সৃষ্টিকর্তা আপনার একান্ত বিশ্বাসের পরমকল্যাণময় ঈশ্বর নাকি? অর্থাৎ জগৎজোড়া শোষক লুঠেরা খুনি এর সবাইও আপনার একান্ত বিশ্বাসের ঈশ্বরেরই তো সৃষ্টি? মানুষের ইতিহাস জুড়ে যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, হচ্ছে, হবে সবই কি তবে আপনার একান্ত বিশ্বাসের সর্বশক্তিমান ঈশ্বরেরই ইচ্ছার কাহিনী? তিনি তবে সর্বশক্তিমান হলেও আদৌ পরমকল্যাণময় নন কিন্তু। কিংবা যদি সত্যই পরমকল্যাণময় হন, তবে তিনি আদৌ সর্বশক্তিমান নন। কারণ শক্তি থাকলে তো তিনি এই বিশ্বে কোথাও কখনো কোন অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতেই দিতেন না। তার রাজত্বে সংঘটিতই হতে পারতো না তো কোনরকম অপরাধ। অন্যায়। তাই না? আপনি ঈশ্বরভক্ত মানুষ, আপনি বলবেন ঈশ্বরের লীলা বোঝা দায়। আপনি এও বলবেন, এই ভাবেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে পীড়নের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর তার প্রিয় ভক্তদের নিজের কাছে টেনে নিয়ে থাকেন। কারণ আপনি জানেন ঈশ্বরের বিচার সভার বিধানে স্বর্গ ও নরকেরও সংস্থান রয়েছে। যার যা কর্ম ফল, সেই মতো পরকাল তার। এসবই আপনার জানা কথা। পৃথিবীতে মানুষ আসে তার আগের জন্মের কৃতকর্মের শাস্তি স্বরূপ। এমন কথাও বলবেন আপনি। বেশ, তবে তো বোঝাই যায় এই বিশ্বভুবন সৃস্টিকর্তারই তৈরী জেলখানা স্বরূপ! বিশ্বাসের কি অপর মহিমা! তাই না। সব প্রশ্নেরই চটজলদী উত্তর প্রস্তুত। কিন্তু উত্তরগুলির ভিতর যে পারস্পরিক বৈপরীত্ব বিদ্যমান, বিশ্বাস ও ভক্তির লীলাই এমন, যে খেয়াল থাকে না আমাদের সেটাই। না থাকুক ক্ষতি নাই, বরং বিশ্বাসের ভিত জোরালো হয়েই ওঠে তাতেই।
আর সেই জোরালো ভিতেই দাড়িয়ে আপনি ও আপনার মতো সবাই, নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ঈশ্বরের মাহাত্য নিয়ে অন্য সম্প্রদায়ের ঈশ্বরের সাধারণত্ব প্রচারে কোলাহলে মুখরিত করে তুলবেন দশদিক। কারণ আপনই জানেন আপনার ঈশ্বরই সর্বশ্রেষ্ঠ। আপনিই জানেন আপনার ঈশ্বরই একমাত্র সত্য। আপনি শুধু এইটুকুই জানেন না, এই দুটি জানাই পরস্পর অসত্য। একটি সত্য হলে অন্যটি অসত্য হয়ে পড়ে। কারণ সেটি জানতে গেলে যুক্তি লাগে। বিশ্বাসে কুলিয়ে ওঠার রাস্তা থাকে না। আর আপনি ও আপনার মতো আমরা সবাই এই না জানা নিয়েই পরস্পরের সাথে কলহ হানাহানি করে মানুষের ইতিহাস লিখে চলবো ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত স্বার্থের অনুপাতে। যাকে আমারা বলবো মানুষের ইতিহাস। যে ইতিহাস আপনার মতে সর্বশক্তিমান পরমকল্যাণময়ের একান্ত ইচ্ছার বিস্তৃত ক্যানভাস। আমরা যেখানে নিমিত্ত মাত্র।