Banner
একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা ─ শামসুজ্জোহা মানিক (পুনঃপ্রকাশিত)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ August 30, 2017, 12:00 AM, Hits: 1505

 

{নিবন্ধটি ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থে’ এবং ‘নির্বাচিত’ বিভাগে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি ( জাতি ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ক সংকলন )’ থেকে নেওয়া।}

আলোচনার শুরুতে আমি বলে নিই যে, যদিও গারো জনগোষ্ঠীর সদস্যগণ নিজেদের মান্দি, মান্দে বা আচিক নামে অভিহিত করেন তথাপি অ-গারো লোকেরা এই শব্দের সঙ্গে তেমন একটা পরিচিত না হওয়ায় এবং মান্দি, মান্দে ও আচিক এই তিনটির কোনটি গারোদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে এবং এককভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত এ নিয়ে গারোদের মধ্যে এখন পর্যন্ত তেমন একটা ঐক্যমত গড়ে না উঠায় আমি গারো শব্দই ব্যবহার করছি।

লক্ষণীয় যে, আমি গারো শব্দের পর উপজাতি বা ট্রাইব শব্দ ব্যবহার না করে জাতিসত্তা ব্যবহার করেছি যা মূলত ইংরাজী ন্যাশনালিটি-এর সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করতে চেয়েছি। প্রথমত, উপজাতি বা ট্রাইব যে ধারণা প্রদান করে গারো জাতিসত্তা অন্তত বাংলাদেশে সেই ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমি মনে করতে পারছি না। কারণ, উপজাতি সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন এখন গারোদের মধ্যে সামান্য অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়। পরিবর্তন বহু বিষয়ে হয়েছে । এমন কি সমাজ গঠনেও। যা আছে তাকে অতীতের অবশেষ বলা যায়। হয়ত বলা হবে মাতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা, সন্তানদের মাতৃগোত্র অনুযায়ী পরিচয় প্রথা এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। সম্পত্তির স্বাভাবিক উত্তরাধিকার এখনও মাতৃ বা নারী সূত্রে। এছাড়া ছেলেদের অনেকেই এখনও বিয়ে করে স্ত্রীর বাড়ীতে গিয়ে ওঠে।

কিন্তু এগুলি উপজাতি সমাজের নয়, বরং একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে। আর গোত্রগত কিছু বিধিবিধান থাকলে যদি সেটা জাতিসত্তা বা জাতি না হয়ে উপজাতি বা ট্রাইব হওয়া বোঝায় তবে ভারতবর্ষের হিন্দুদের জাতি না বলে উপজাতি বা ট্রাইব বলা উচিত। তবে সেক্ষেত্রে হিন্দুদের বাঙ্গালী বা ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিক উপজাতির সদস্য বলতে হয়। উপজাতির স্তরে পড়ে নেই উপরন্তু জাতি-রাষ্ট্র গঠন করেছে এমন বহু সমাজেও পিতৃতান্ত্রিক গোত্র এবং পরিবার ব্যবস্থার শক্তিশালী অস্তিত্ব আছে।

যাইহোক, উপজাতি থেকে জাতিসত্তা এবং এমন কি রাজনৈতিক জাতিরও উদ্ভব ঘটতে পারে। ইতিহাসে এক বা একাধিক উপজাতি থেকে এমনটা বহু কাল ধরে ঘটেছে। সুতরাং সমাজ বিকাশের স্তর বিবেচনায় আমার মতে গারো জনগোষ্ঠী একটি জাতিসত্তা। বাংলাদেশে এটি একটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা। বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিছু অঞ্চলে স্মরণাতীত কাল থেকে বাস করে আসায় এবং প্রতিবেশী সংখ্যাগুরু বাঙ্গালী জাতিসত্তার তুলনায় উপজাতীয় কিংবা গোষ্ঠীগত সামাজিক ঐতিহ্য ও প্রথাকে অধিকতর পরিমাণে সংরক্ষণ করায় গারোদেরকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তাও বলা যায়। প্রতিবেশী অন্যান্য জাতিসত্তা থেকে তাদের সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও পার্থক্য বিবেচনা করে সহজভাবে বোঝার জন্য তাদেরকে একটি জাতি বলতেও আমার আপত্তি নেই, যদিও সেটা হয়ত ইংরাজী নেশন-এর সমার্থক হবে না।

যাইহোক, বাংলাদেশ এবং ভারতের মেঘালয়ের সকল গারো বৃহত্তর একটি জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভাষার পার্থক্য কিছু আছে, ধর্মের পার্থক্যও কিছু আছে। অধিকাংশ খ্রীষ্টান হলেও সবাই নয়। প্রাচীন সাংসারেক ধর্মালম্বীও কিছু আছে। অবশ্য বাংলাদেশে তুলনায় খুব কম। মেঘালয়ে তুলনায় বেশী। বাংলাদেশে খুব সামান্য সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী গারো আছে। আবার খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ক্যাথলিক, ব্যাপ্টিস্ট ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাজন আছে। এতক্ষণ ধরে আমি গারো জাতিসত্তা সম্পর্কে আমার বক্তব্য বলার ক্ষেত্র তৈরী করলাম। এখন গারো জাতিসত্তা সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক কিছু ভাবনা ও প্রশ্ন উপস্থিত করব কিছু বিষয়ে ভাবার জন্য। এই সঙ্গে বলে রাখি এখানে খুব সংক্ষেপে কিছু প্রশ্ন এবং বক্তব্য উত্থাপন করায় কিছু বিষয় অস্পষ্ট থেকে যেতে পারে। তবু আমি গারো সমাজ সম্পর্কে আমার সাম্প্রতিক অনুসন্ধান থেকে উঠে আসা কিছু উপলব্ধির বিষয় এইসব প্রশ্ন ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপস্থিত করার লোভ সামলাতে পারছি না।

 

এক অমিত শক্তিধর জাতিসত্তার ইতিবৃত্ত

সাম্প্রতিক কালের অনুসন্ধানে আমি গারো জাতিসত্তার ইতিহাস যেটুকু জেনেছি তাতে এক আশ্চর্য শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর ইতিহাস আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। গারো জাতিসত্তার নিজস্ব লিপি না থাকায় তার ইতিহাস ছিল মৌখিক। বিভিন্ন লোকগাথা , সঙ্গীত ও আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাদের অনেক হাজার বছরের ইতিহাস নানান রূপে সংরক্ষিত হয়েছিল এতকাল। ইদানীং কালে সেগুলো কিছু লেখা হয়েছে এবং সেগুলো থেকে ইতিহাস ব্যাখ্যার চেষ্টা আছে। বলা যায় মীথ অথবা পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা উপকথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসকে বোঝার বা পুনর্গঠনের চেষ্টা রয়েছে এসবে।

স্বাভাবিকভাবে বিভিন্ন জন এটা বিভিন্ন ভাবে করেন। আমিও চেষ্টা করেছি আমার মত করে গারো জাতিসত্তার ইতিহাসকে বুঝতে। আর তখন আমি দেখতে পেয়েছি মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের এক বিশাল ও সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব কীভাবে গারো সমাজের বিভিন্ন গল্পকথার মধ্যে লুকিয়ে আছে। এছাড়া বাঙ্গালীর বিভিন্ন লোককাহিনী এবং হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীও আমাদের এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে বুঝতে সাহায্য করে।

বিভিন্ন গারো উপকথা থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করেন গারো জাতিসত্তা আদিতে তিব্বত থেকে বিভিন্ন পথ ধরে অভিগমন করে উত্তর বঙ্গ, বৃহত্তর আসাম, মিয়ানমার বা বার্মা ইত্যাদি বহু দেশ হয়ে শেষ পর্যন্ত গারো পাহাড় এবং সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে অভিবাসন করে। এ প্রসঙ্গে আমার মনে হয়েছে গারোরা তিব্বত অথবা অন্য কোথা থেকে মূলত এসেছে সেটা বড় কথা নয়। এমন কি গারো জাতিসত্তা আদৌ এক উৎসজাত কোনও একটি উপজাতি বা নৃগোষ্ঠী কিনা সেই প্রশ্নও আমার মনে জেগেছে।

প্রথমত, অবিমিশ্র Race বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ধারণা ভুল। তথাপি কিছু মোটা বা প্রশস্ত বর্গ বা গ্রুপে মানব গোষ্ঠীকে ফেলা যায়। যেমন মোঙ্গলীয়, ককেশীয়, নিগ্রোয়েড ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গারো সমাজের নৃগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যের তুলনায় সমাজ-কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হল মাতৃতন্ত্র। এই মাতৃতন্ত্রের এমন তুলনা ভারতবর্ষে আছে কিনা আমার জানা নেই। এমন কি খাসিয়ারাও এমনভাবে মাতৃতান্ত্রিক নয় বলে আমার মনে হয়েছে।

গারো জনগোষ্ঠীর বিশাল অঞ্চল ব্যাপী অভিগমন বা মাইগ্রেশন-এর ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি যে চিত্র দেখতে পাই তা মূলত কোনও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর নয়, বরং মাতৃতন্ত্রের অভিগমন বা মাইগ্রেশন। বিশাল অঞ্চলে মাতৃতন্ত্রের পরাজয় ঘটে চলেছিল পিতৃতন্ত্রের হাতে। সুতরাং মাতৃতন্ত্র পিছু হটে চলেছিল। কিন্তু আত্মসর্মপণ করে নি। অবশেষে তা আশ্রয় নেয় মেঘালয়ের দুর্গম, দুর্ভেদ্য গারো পাহাড়ে এবং গারো পাহাড়কে কেন্দ্র করে প্রাচীন উত্তর ময়মনসিংহ, গোয়ালপাড়াসহ সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে।

এইভাবে কয়েক হাজার বৎসর ধরে পিতৃতন্ত্র প্রভাবাধীন সমাজগুলোর আক্রমণ ও আগ্রাসন প্রতিহত করে মাতৃতন্ত্র দৃঢ় অবস্থান নিয়ে টিকে থাকে প্রায় আধুনিক কালের সূচনার সময় পর্যন্ত। পিতৃতান্ত্রিক বাঙ্গালী সমাজের অনেক লোককাহিনীর কামরূপ-কামাখ্যা মূলত সেই গারো ভুখণ্ড যেখানে গেলে নাকি ডাকিনী নারীরা পুরুষদের মন্ত্রবলে ভেড়া বানিয়ে রাখত। মাতৃতন্ত্র বিদ্বেষী ও ধ্বংসকারী পিতৃতন্ত্র মাতৃতন্ত্রের প্রতি তার ভীতি ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য এইসব গালগল্প তৈরী করত। স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর স্বর্গ যেখানে নেই, নারী ধর্ষণ ও দলনের মধ্যে যে সমাজের পুরুষেরা ঘৃণা, লজ্জা ও অসম্মান ব্যতীত গৌরবের কিছু দেখে না তেমন এক সমাজের প্রতি নারী-দ্রোহী পুরুষতন্ত্রের ঘৃণা ও ভয় এমন সব গল্পের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে সেটাই স্বাভাবিক।

 

মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের দ্বন্দ্ব

খুব সংক্ষেপে বললে নারীর হাতে কৃষির উদ্ভব। এ কথা সমাজতত্ত্বের ছাত্রদের জানা যে, আদিতে কৃষি ছিল বাড়ীর আশপাশে এবং মূলত নারীরা সেটা করত। আমরা এটাকে উদ্যান বা বাগিচা চাষ বলতে পারি যেখানে গর্ত করে বীজ বপন করা হত। কৃষি যন্ত্র বলতে কাঠ বা পাথরের সূঁচালো বা ধারালো বস্তু। বস্তুত জুম চাষ এই বাগিচা চাষের রকমফের মাত্র। বলার সুবিধার জন্য আমি লাঙ্গল চাষের পূর্বের সব কৃষিকে জুম নামে অভিহিত করছি। যদিও আজকালকার জুমের সঙ্গে পাহাড়ের গাছ কাটা ও পোড়ানো এবং চাষের জমি স্থানান্তরের সম্পর্ক আছে তবু যে কোনও ধরনের আদি বাগিচা চাষ পদ্ধতিকে এক ধরনের জুম চাষ বলা যায় বলে আমার ধারণা। যাইহোক, জুম চাষের সঙ্গে সহজ হাতিয়ার ব্যবহার এবং ক্ষুদ্রায়তন কৃষির সম্পর্ক আছে। এই কৃষির যুগটা ছিল মাতৃতন্ত্রের যুগ। আমার ধারণা, যে নারীরা জুম বা বাগিচা পদ্ধতিতে বাড়ীর আশপাশে প্রথম কৃষি প্রবর্তন করেন তাঁরাই ধীরে ধীরে উৎপাদন ব্যবস্থা তথা অর্থনীতিকে ব্যবহার করে সমাজে নিজেদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব নিরংকুশ বা দৃঢ়বদ্ধ করেন। এইভাবে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং সভ্যতার ঊষা লগ্ন কেটেছে নারীর কোলে। লাঙ্গল আবিষ্কার মাতৃতন্ত্রকে ধ্বংস করে। এবার মানব সমাজ ক্ষুদ্রায়তন কৃষি থেকে বৃহদায়তন কৃষিতে প্রবেশ করে। লাঙ্গল চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় দেহশক্তি, বেশী পরিমাণ জমিতে শ্রমদানের জন্য বেশী সময়ের প্রয়োজন, বাড়ী থেকে দূরে দীর্ঘ সময় শ্রমদান ইত্যাদি বিষয় নারীর তুলনায় পুরুষের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং লাঙ্গল-চাষ মাতৃতান্ত্রিক সমাজের অবসান অনিবার্য করে।

লাঙ্গলের সঙ্গে এল জল সেচ, এল বিপুল খাদ্য উৎপাদন, ফলে অনেক বেশী উদ্বৃত্ত উৎপাদন। এর ফলে সমাজে যেমন শ্রম বিভাগের জটিলতা ও বৈচিত্র্য বাড়ল তেমন সভ্যতার বিকাশ সহজতর ও অনিবার্য হল। মানব সমাজ উপজাতি সমাজ থেকে উঠে এল রাষ্ট্রে। অর্থাৎ লাঙ্গল চাষের সঙ্গে রাষ্ট্রের উদ্ভব জড়িত। যেমন এর সঙ্গে আছে নিয়মিত সেনাবাহিনী ও যুদ্ধেরও কম বেশী বিজড়ন। এই যুদ্ধের সংগঠন ও চরিত্র আদিম সমাজের যুদ্ধের সংগঠন ও চরিত্র থেকে ভিন্ন। আদিম সমাজে যুদ্ধ দ্বারা এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে বিতাড়িত করত অথবা হত্যা করত অথবা পরাজিত ও বন্দী করে নিজ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করত। এখন মানুষ শিখল যুদ্ধ দ্বারা শুধু শত্রু সম্পত্তি ও জায়গা অধিকার করতে নয়, উপরন্তু পরাজিত শত্রুকে বন্দী ও অধীনস্থ করে তার শ্রমশক্তি জবরদস্তিমূলকভাবে ভোগ করতে।

গারো সমাজ অতীতে কখনও প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্র গড়ে নি। যখন কেউ গড়েছে তখন সে বা তারা আর গারো থাকে নি। এমন কি গারো সমাজে উপজাতীয় ব্যবস্থাধীনেও কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল না। তাই গারো পাহাড় অঞ্চলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে (১৮৭২-’৭৩) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত দখল কায়েমের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি গারো গ্রাম ছিল কোনও কোনও গারো পণ্ডিতের ভাষায় একেকটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র (মিল্টন এস, সাংমা, হিস্ট্রী এন্ড কালচার অফ দি গারো)। এটুকু সহজে অনুমেয়, কয়েক হাজার বৎসর ধরে চারপাশের পিতৃতন্ত্রের প্রবল চাপে শেষ পর্যন্ত মাতৃতন্ত্রও তার আদি রূপে থাকতে পারে নি। তার সমাজ সংগঠনে পুরুষের প্রাধান্য কিছু করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, যা মাতৃতন্ত্রের শক্তি হ্রাস করছিল। এর প্রমাণ মেলে গারো সাংসারেক ধর্মে যেখানে পুরোহিত বা পূজারী পুরুষ। তাছাড়া গ্রাম প্রধান হিসাবে যাকে ধরা হত সেই আকিং নক্‌মাও ছিল পুরুষ। আমার অনুমান এসব মাতৃতন্ত্রের আদি কিংবা নির্ভেজাল রূপের ক্ষয়ের সাক্ষ্য দেয়। সম্ভবত গারো সমাজে মাতৃতন্ত্রের পতন বিদেশী শক্তির হাতে গারো জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক পতনের অনেক পূর্বেই শুরু হয়েছিল।

তবু সব মিলিয়ে মাতৃতন্ত্র টিকে ছিল। তার একটা ফল হিসাবে রাষ্ট্র ছিল না। তার বদলে ছিল স্বাধীন গ্রাম সমাজ। লাঙ্গল চাষও ছিল না, ছিল জুম চাষ।

অতীতে যখন আজকের উন্নত প্রযুক্তি ছিল না তখন নারী তার কিছু দেহ বৈশিষ্ট্যের কারণে খুব বেশী দূরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারত না। গর্ভধারণ ও সন্তান পালনের জন্য তার শ্রমদান ও সময় দানের ক্ষেত্রও ছিল গৃহ কেন্দ্রিক এবং গৃহের নিকবর্তী এলাকা ভিত্তিক। সুতরাং নারীর নেতৃত্বে বৃহৎ সমাজ গঠন ছিল অসম্ভব। ব্যক্তি-নারী হয়ত নেতৃত্ব দিতে পারত, কিন্তু সমষ্টি-নারীর পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় নারী-সমাজের নিয়ন্ত্রণাধীনে যে সমাজ গঠিত হত তা একটি গ্রাম বা ক্ষুদ্র এলাকা ভিত্তিক হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তাই নারীর নিয়ন্ত্রণাধীন বা মাতৃতন্ত্রাধীন গারো রাষ্ট্র (?) ছিল একটি করে একক গ্রাম। এই গ্রাম শাসনও ছিল গণতান্ত্রিক। তাই মিল্টনের মত গবেষকের মতে এই গ্রাম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র।

অর্থাৎ গারো সমাজ ছিল অসংখ্য স্বাধীন গ্রামের সমষ্টি যার কোনও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব ছিল না। তাহলে অসংখ্য খণ্ডে খণ্ডিত গারো সমাজকে কোন শক্তি একটি অখণ্ডতা বা ঐক্যের অনুভূতি দান করেছিল? কিছু রীতিনীতি ও বিশ্বাস, যার মর্মে ছিল মাতৃতন্ত্র। মাতৃতন্ত্র তাদের অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

ভাষার নৈকট্য থাকলেও সব গারোর ভাষা যে অভিন্ন বা কাছাকাছি তা কিন্তু নয়। অঞ্চল ভেদে, গোষ্ঠী ভেদে ভাষার কিছু পার্থক্য ছিল এবং আজও আছে। কিন্তু অধিকাংশ গারোর ভাষা মোটামুটি কাছাকাছি এবং পরস্পরের বোধগম্য। তবে ‘আতং’ এবং ‘মেগাম’ গোষ্ঠী দুইটির ভাষা ভিন্ন। তবু ‘আতং’ এবং ‘মেগামরাও’ গারো।

আমার ধারণা গারো স্বাতন্ত্র্যের মূল রহস্য অন্যদের তুলনায় মাতৃতন্ত্রের প্রতি তার অনেক বেশী দৃঢ় আনুগত্যের ভিতর। খাসিয়ারাও এতটা মাতৃতন্ত্রী নয়। আমার অনুমান সমগ্র অঞ্চলে মাতৃতন্ত্রের অবক্ষয় গারো সমাজেই সবচেয়ে শেষে শুরু হয়েছে।

আমার আর একটা অনুমান যে, যে প্রাচীন মানুষরা জুম বা বাগিচা চাষের মাধ্যমে প্রথম কৃষি আবিষ্কার এবং কৃষি-সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল গারোরা তাদের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী। অর্থাৎ গারো সমাজের পিছনে সম্ভবত আছে হাজার হাজার এমনকি হয়ত লক্ষ বৎসরের কৃষি আবিষ্কার এবং সেই সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গঠনের প্রয়াসের ইতিহাস। সম্ভবত এই ইতিহাস সবচেয়ে বেশী তারা ধারণ করে বলে গারোরা এত রক্ষণশীলতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত জুম চাষকে লালন করেছে এবং লাঙ্গল চাষে যায় নি। অর্থাৎ জুম চাষ করলেই সমাজ মাতৃতন্ত্রী হবে এমন নয়। যারা জুম চাষের প্রথম উদ্ভাবক ও সংগঠক সম্ভবত তারাই ছিল মাতৃতন্ত্রী। অন্যরা ছিল আদিম শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী গোষ্ঠী মাত্র যারা পরবর্তী কালে বিদ্যমান জুম চাষ গ্রহণ করে নিয়েছিল। এরা অন্যের উদ্ভাবিত পদ্ধতি গ্রহণকারী বলে সম্ভব ও প্রয়োজন হলে এরা সহজে লাঙ্গল নির্ভর কৃষি পদ্ধতিও গ্রহণ করে নিয়েছিল। আর তাই এরা জুম চাষ করলেও পিতৃতন্ত্রী রয়েছে বা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, পৃথিবীর বহু দেশে জুম চাষ নির্ভর পিতৃতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী আছে। বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর অনেকে এখনও জুম চাষ নির্ভর অর্থনীতিতে থাকলেও তারা পিতৃতান্ত্রিক। চাকমা নারীদের পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারও নেই।

তাই গারো জনগোষ্ঠী শুধু খাদ্যোৎপাদনের ব্যবস্থা হিসাবে জুম চাষকে আঁকড়ে থাকে নি, তারা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্যও এত দীর্ঘ কাল এমনকি সমভূমি অঞ্চলে বসবাস করেও জুম চাষকে আঁকড়ে ছিল। সম্ভবত এখন পর্যন্ত সাধারণভাবে গারো কৃষকরা লাঙ্গল নির্ভর কৃষিতে তাদের প্রতিবেশী বাঙ্গালী কৃষকদের মত দক্ষ নয়।

সহজ-সরল মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষায় গারোরা কতখানি দৃঢ় ছিল তা আরও ঘটনায় বোঝা যায়। জুম চাষে উৎপন্ন তূলা বা অন্যান্য ফসলের বিনিময়ে পার্শ্ববর্তী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে তারা যুদ্ধের লৌহাস্ত্র এবং কুড়াল-দা ইত্যাদি সংগ্রহ করত। কিন্তু নিজেরা কর্মকার হয় নি। সভ্যতার সেই স্তরে প্রবেশকে তারা সযত্নে এড়িয়ে গেছে যে স্তরে প্রবেশ করলে বর্বর পিতৃতন্ত্র এবং তার আনুষঙ্গিক নারী দলন এবং নারীর ক্ষমতা হরণ সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিবে।

গারো সমাজের অস্তিত্ব মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে সুদীর্ঘ কাল অব্যাহত রেখেছে। এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত নানানভাবে প্রভাব ফেলেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতার স্মৃতিতে এবং গল্প-কাহিনীতে। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী পরশুরামের মাতৃহত্যার উপাখ্যানের আড়ালে মাতৃতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের সংঘাতের ইতিহাস লুকিয়ে আছে বলে আমি অনুমান করি। ব্রহ্মপুত্র নদী বিধৌত অববাহিকা ব্যাপী বিশাল অঞ্চলে লাঙ্গল চাষের সঙ্গে জল সেচ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, মাতৃতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং পিতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যে সম্পর্কিত ছিল পরশুরামের মাতৃহত্যার কাহিনী থেকে সেটা অনুমান করা যায়। পরশুরাম কুঠার দ্বারা মাতৃহত্যা করে অভিশাপ মুক্ত হবার জন্য তিব্বতের মানস সরোবরে ্নান করেন এবং অতঃপর সেখান থেকে লাঙ্গল দিয়ে রেখা টেনে এনে ব্রহ্মপুত্র নদী প্রবাহিত করেন মেঘনা নদী পর্যন্ত। অনুমান করি কুঠারের সাহায্যে মাতৃহত্যা ধাতব অস্ত্র ব্যবহারের সাহায্যেও মাতৃতন্ত্র উচ্ছেদ বোঝায়। যাইহোক, এটি স্পষ্ট যে, পিতৃতন্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে মাতৃতন্ত্র উচ্ছেদ করে নি। তাকে যুদ্ধ করে মাতৃতন্ত্রকে পরাজিত এবং লাঙ্গল নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল।

কিন্তু গারো সমাজ যত সীমাবদ্ধ অঞ্চলেই হোক সুদীর্ঘ কালব্যাপী পিতৃতন্ত্রের আক্রমণ ও আগ্রাসনকে মোকাবিলা করেছিল। একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধটা কিন্তু প্রধানত গারো পুরুষদেরকেই করতে হয়েছিল। কারণ, এই কাজ প্রধানত পুরুষদের। মাতৃতন্ত্রী হলেও গারো যোদ্ধা পুরুষদের শৌর্য-বীর্য কম ছিল না। ইংরেজরা তাদের নৃমুণ্ড শিকারী বলেছে। তাদের আক্রমণের ভয়ে আশপাশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের মানুষরা সন্ত্রস্ত থাকত বলে জানা যায়। যতো দূর জানা যায় গারো গ্রামগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক আক্রমণ ও যুদ্ধ লেগে থাকত।

অবশ্য আমার অনুমান মাতৃতন্ত্রের কারণে গারোদের পক্ষে খুব বেশী যুদ্ধ নির্ভর হবার উপায় ছিল না। হয়ত আদিম কিছু বিশ্বাস ও রীতির কারণে কিছু ক্ষেত্রে নৃমুণ্ড কেটে আনা হত, এছাড়া আত্মরক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে হত। কিন্তু গারো সমাজ প্রতিবেশী অন্যান্য সমাজের তুলনায় একটি শান্তিপ্রিয় সমাজ ছিল বলে আমি অনুমান করি। আমার আরও অনুমান গারো সমাজকে হাজার হাজার বৎসর ধরে প্রায় অব্যাহতভাবে সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধ করতে হয়েছে তা হল তার মাতৃতন্ত্রকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ।

তবে যুদ্ধটা ছিল খুব অসম। কারণ, শুধু সংস্কৃতি বা আদর্শ দিয়ে উন্নততর প্রযুক্তির আক্রমণকে প্রতিহত করা যায় না। আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত গারো পাহাড়ের দুর্গমতা এবং প্রাকৃতিক আনুকূল্যকে ব্যবহার করে গারো পাহাড়কে ঘিরে মাতৃতন্ত্রের একটা বলয় রক্ষা করা গিয়েছিল। কিন্তু এক সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বন্দুক নিয়ে এবং গারো পাহাড়ের মরণব্যাধি ম্যালেরিয়া যা বহিরাগত অ-গারোদের জন্য ছিল মৃত্যু দূত স্বরূপ তার বিরুদ্ধে কুইনাইন ঔষধ নিয়ে গারো পাহাড়ে প্রবেশ ক’রে ভারতবর্ষে ক্ষয়িষ্ণু মাতৃতন্ত্রের শেষ দুর্গের পতন ঘটাতে সক্ষম হল।

এবার মাতৃতান্ত্রিক সমাজ পরিপূর্ণরূপে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার অধীনস্থ হল। ইতিপূর্বে আমার অনুমানের কথা বলেছি যে, মাতৃতন্ত্রে তার অনেক আগে থেকে ক্ষয় ঘটছিল। এ প্রসঙ্গে সাংসারেক ধর্মের কথা উল্লেখ করেছি যাকে আদি গারো ধর্ম বলা হয়। অথচ এর পুরোহিত নারী নয়, পুরুষ।

ধর্মে যেহেতু সমাজ ব্যবস্থার একটা প্রতিফলন ঘটে সেহেতু এ থেকে মাতৃতন্ত্রের দুর্বল বা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত আদি মাতৃতন্ত্রে সাংসারেক ‘থরম’* ছিল না। বাইরের পিতৃতান্ত্রিক ধর্মের প্রভাবে এই ধর্মের উদ্ভব ও প্রসার গারো সমাজে ঘটেছিল এমন সম্ভাবনাকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না।

----------------------------------------------------------------
* এটা স্পষ্ট যে, ধর্মের গারো প্রতিশব্দ থরমের উদ্ভব এভাবেঃ ধর্ম > ধরম > থরম।
----------------------------------------------------------------

মাতৃতন্ত্রের অবক্ষয়ের নমুনা হিসাবে আমি ইতিপূর্বে গ্রাম প্রধান হিসাবে কথিত আকিং নকমার কথা উল্লেখ করেছি। অর্থাৎ পরিবারে নারীর প্রাধান্য থাকলেও সমাজে পুরুষ প্রধান্যে এসেছে। এই কারণে গ্রামের অন্যান্য নক্‌মা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও ছিল পুরুষ। তবে নক্‌মা বা গ্রাম প্রধান যে-ই হোক সমাজ ছিল গণতান্ত্রিক। গ্রামের সবাই একত্রে বসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত।

যাইহোক, অনুমান করি মাতৃতন্ত্র অনেক আগে থেকে দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়ছিল কিছু করে। ব্রিটিশ শাসন ছিল মাতৃতন্ত্রের উপর পিতৃতন্ত্রের শেষ বিরাট আঘাত। এর একটা ফল হল বিস্ময়কর দ্রুত গতিতে পিতৃতান্ত্রিক খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার।

 

মাতৃতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

এই অবস্থায় গারো সমাজ ও মাতৃতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমার সামনে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এখানে গারো জনগোষ্ঠীর এখন আর নিজস্ব এবং নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড নেই। তার গ্রামগুলোও ছিন্নভিন্ন। পাকিস্তান আমল থেকে গারোদের উপর সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের দিক থেকে যেসব নির্যাতন ও আক্রমণ হয়েছে সেসবের উল্লেখ আমি এখানে নাই বা করলাম।

গারো সমাজের নিজস্ব সামাজিক নেতৃত্ব আছে বলেও মনে হয় না। একদিকে ইউরোপ কেন্দ্রিক খ্রীষ্টান মিশনারী চার্চ এবং অপর দিকে খ্রীষ্টান এনজিও এখন গারো সমাজের মূল নিয়ন্ত্রণ হাতে রেখেছে। খ্রীষ্টানদের মধ্যকার চার্চগত বিভিন্নতা বা পার্থক্য আবার গারোদের মধ্যে বিভাজন ও অনৈক্য বৃদ্ধি করেছে।

গারো সমাজকে আমার বর্তমানে নেতৃত্বহীন ও অনকেটা বিশৃঙ্খল বা এলোমেলো হয়ে পড়া বলে মনে হয়েছে। অবশ্য এটাও সত্য যে, গারো সমাজকে চিনতে ভুল করা বিশেষ করে আমাদের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। কারণ, আমরা পিতৃতন্ত্রের দৃষ্টিতে সমাজকে বিচার করি। তার সঙ্গে জড়িত আছে সমাজের ঐক্য ও শৃঙ্খলা বলতে কেন্দ্রীয় একক কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থার উপস্থিতির ধারণা। কিন্তু এই ধরনের কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ছাড়াই গারো সমাজ কয়েক হাজার বৎসর সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল ছিল বলে তা পিতৃতন্ত্রের সকল আক্রমণ প্রতিহত করে এত কাল টিকেছিল।

কিন্তু তবু গারো সমাজকে আমার বিশৃঙ্খল মনে হয়েছে। তা পুরাতন শৃঙ্খলা অনেকাংশে হারিয়েছে। কিন্তু নূতন, উন্নততর ও নিজস্ব শৃঙ্খলা সেভাবে গড়তে পারে নি। তার মধ্যে লক্ষ্যহীনতাও কাজ করছে। গারোদের অনেকে গারো সমাজের দুর্গতির জন্য মাতৃতন্ত্রকে দায়ী করছেন। কিন্তু সামাজিক বিষয়ে গারো নারীদের সাধারণভাবে উদাসীন মনে হয়েছে। অনেক গারো পুরুষও সামাজিক ক্ষেত্রে গারো নারীদের ভূমিকা চান না। হয়ত ভাবছেন জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে হলে পিতৃতান্ত্রিক হতে হবে।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে পিতৃতন্ত্র হলে কি গারো জাতিসত্তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকবে? গারোরা খ্রীষ্টান হওয়ায় এমনিতেই তাদের বাঙ্গালীকরণ চলছে খ্রীষ্টান বাঙ্গালী ছেলে বা মেয়ে বিয়ের মাধ্যমে। চারপাশের আবেষ্টন বাংলা ভাষার। সুতরাং সবাই ক্রমে বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হচ্ছে। এরপর যখন মাতৃতন্ত্রের সম্পূর্ণ অবসান ঘটবে তখন গারো স্বাতন্ত্র্য এবং পরিচয় থাকবে কি? গারো জনগোষ্ঠী কি পুরোপুরি বাঙ্গালী হবে না? বাঙ্গালী জাতিসত্তা গঠনের ইতিহাসের দিকে একটু মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে যে, বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে বাঙ্গালী নামে খুব নূতন একটা পিতৃতান্ত্রিক জাতিসত্তার বিকাশ ঘটিয়ে চলেছে আজও। বৃহত্তর দিনাজপুর-রংপুরের রাজবংশী বা পূর্বতন কোচরা এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। সম্ভবত একই কথা খাটে হাজংদের ক্ষেত্রেও কিছু পরিমাণে।

যে সমস্ত গারো নারী বা পুরুষ পিতৃতন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দেখছেন তাদেরকে বাঙ্গালী সমাজের দুর্গত অবস্থাটা বিবেচনা করতে বলব। পিতৃতান্ত্রিক বাঙ্গালী বাংলাদেশের কেমন উন্নতি ঘটিয়ে চলেছে? দ্বিতীয়ত, যারা গারোদের সংখ্যাল্পতার জন্য হতাশ তাদেরকেও ভাবতে বলব সংখ্যার তুলনায় গুণগত মানের দিকটা। বাঙ্গালী সংখ্যায় পৃথিবীতে যে স্থানে আছে উন্নতির বিচারে তার ধারে কাছে আছে কি?

গারো জাতিসত্তা নিয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ ও ভাবনার একটা কারণ আছে। তা হল আমি মনে করি লাঙ্গল নির্ভর বৃহদায়তন কৃষি এবং নগর সভ্যতার বিকাশ থেকে এ পর্যন্ত ছয় সাত হাজার বৎসর পিতৃতন্ত্র যে ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও ধ্বংসের শক্তি বিকশিত করেছে পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে তা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে প্রযুক্তির প্রচণ্ড বিকাশ নারীর দেহগত অনেক সীমাবদ্ধতা দূর করেছে এবং করছে, ফলে কিছু দৈহিক সুবিধার কারণে উদ্ভূত পুরুষ প্রাধান্যের অনিবার্যতাকে অপ্রাসঙ্গিক করছে, অপর দিকে পুরুষের ধ্বংসপ্রবণ চরিত্র-বৈশিষ্ট্য পরমাণু প্রযুক্তির এই অগ্রগতির কালে পুরুষের হাত থেকে সমাজ ও সভ্যতার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের অবসানও অনিবার্য করছে। এমন একটা সমাজ আসতে হবে যেখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার সমবণ্টন হবে। নতুবা মানব জাতি আত্মঘাতী পরমাণু যুদ্ধে বিলুপ্ত হবে। যে পুরুষ তার মেধা ও দেহশক্তি বলে সভ্যতাকে এই স্তরে এনে দাঁড় করিয়েছে এখন তাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে নেওয়াই তার নিয়তি। কারণ, পুরুষ তার সকল বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা, দেহশক্তি ও ধূর্ততা দিয়ে সভ্যতাকে এভাবে দাঁড় করিয়েছে। এই প্রবৃত্তিগুলোকে সংযত করার ক্ষমতা তার জন্য সহজাত নয়। ঐ কাজ মূলত নারীর। সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির জগতে নারীর বিশেষ মর্যাদা ও স্বাধিকার না থাকলে পুরুষের এই ধ্বংস প্রবণতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে সমাজ ও সভ্যতার ধ্বংস ঘটাবে।

অর্থাৎ আমার মনে হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতা এখন নূতন আর একটি স্তরে উন্নীত হবার অপেক্ষায়। বিগত ছয়, সাত হাজার বৎসরের সভ্যতার যে ভয়ঙ্কর নির্যাতনকারী ও দলনকারী রূপ রয়েছে তা থেকে এখন তার মুক্তির প্রয়োজন। তলোয়ার ও চাবুকের শাসন থেকে মানুষের সভ্যতার মুক্তি চাই। কাজটা সম্পূর্ণ না হলেও অনেকাংশে, হয়ত বা এখন প্রধানত নারীর। উন্নত পৃথিবীতে নারীবাদ নিয়ে যে বিতর্ক উঠছে তার পিছনে এমন একটা আর্তি কাজ করছে। মুক্তি তো শুধু নারী খুঁজছে না, পুরুষও খুঁজছে। আসলে প্রয়োজনটা মানব সমাজের, মানব জাতির।

গারো সমাজ কি পিতৃতন্ত্রের পথ ধরে এখন সমাজ ও সভ্যতার শিখরে আরোহণ করতে চায়? সেটা বোধ হয় আর সম্ভব নয়। কারণ, ঐ দৌড় প্রতিযোগিতায় তা অনেক দেরীতে যোগ দিয়েছে। গারো সমাজ যত উন্নতি করুক এ পথে তার অবস্থান হবে খুবই পিছনে। তবে এ পথে আমি গারো সমাজেরই বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখি। যদি তা হয় তবে আমার মতে তাতে ক্ষতিটা গারো সমাজের যতটা তার চেয়ে অনেক বেশী মানুষের আগামী সমাজ ও সভ্যতার। কেননা, আগামী যে গণতান্ত্রিক পৃথিবী গড়ে উঠতে পারে তার আবির্ভাবে নারীর ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি ধারণা করি। হয়ত প্রচলিত অর্থে তা মাতৃতান্ত্রিক নয়। তবে এক অর্থে তা হবে মাতৃতন্ত্রের এক ধরনের পুনর্গঠন। সেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে ক্ষমতার এমন ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন ঘটবে যাতে করে কিছু ক্ষেত্রে নারীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমি ধারণা করি। বর্তমান পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে তুলনায় আমার এটাকে এক ধরনের মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতা বলতে ইচ্ছা করে। জানি না তার রূপ কেমন হবে। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মানব সমাজ সেদিকে যাচ্ছে। গারো সমাজ লাঙ্গল আবিষ্কারের পর গড়ে ওঠা বর্বর পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতা থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে সর্ব প্রযত্নে রক্ষা করে চলেছিল মাতৃতন্ত্রকে। সভ্যতার এক ভয়ঙ্কর পর্বের কয়েক সহস্র বৎসরের নির্দয়তা, হিংস্রতা ও কদর্যতার গ্লানি থেকে তা মুক্ত। কৃষি আবিষ্কারের পর তা এক জায়গায় থেমে ছিল। সভ্যতা এখন নূতন করে নারীর আশ্রয় নিয়ে নূতনতর সৃষ্টিশীলতার স্তরে যেতে চাইছে যেখানে মানুষ মানুষের উপর আর ঐভাবে নির্দয় হবে না। সুউন্নত প্রযুক্তির আবিষ্কার ও ক্রমবিকাশ এই নির্দয়তাকে শুধু অপ্রয়োজনীয় নয় অধিকন্তু অসম্ভবও করছে।

 

উপসংহার

আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে গারো সমাজের পুনর্জাগরণের জন্য তার জাতীয় স্বাতন্ত্র্য বোধকে জাগাবার প্রয়োজন আছে। এই স্বাতন্ত্র্যের মর্মে আছে তার ঐতিহ্যিক মাতৃতন্ত্র। তবে, মাতৃতন্ত্রকে পুরাতন রূপে ফিরিয়ে আনা বা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাকে আধুনিক যুগোপযোগী করার কথা ভাবতে হবে। অর্থাৎ মাতৃতন্ত্রেরও পুনর্গঠনের প্রয়োজন আছে। এছাড়া গারো সমাজের পক্ষে উন্নত জাতি হিসাবে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। সেটা বাংলাদেশ বা মেঘালয় কোথায়ও নয়।

এদিক থেকে দেখলে আমি জাতীয়তাবাদী। গারোর জন্য আমি গারো জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। যেমন আমি বাঙ্গালীর জন্য বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তবে আমি একই সঙ্গে জাতি সমন্বয়বাদেও বিশ্বাসী। আমি মনে করি আমরা সকল জাতির স্বাতন্ত্র্য ও অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত হয়ে একটি জাতিসংঘ গঠন করতে পারি। জাতিসংঘ তো এখন এক আন্তর্জাতিক বাস্তবতা। এটাকে কি অন্যান্য পর্যায়েও আমরা অনুসরণ করতে পারি না? প্রতিটি ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে যদি সমাজ বা জাতি গঠন করা যায় তবে প্রতিটি জাতির স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে কেন জাতিসংঘ বা রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা যাবে না, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন করেছে?

যাইহোক, গারো সমাজের বিস্ময়কর যে শক্তি আমি তার মাতৃতন্ত্রে দেখেছি, সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে আমি গারো জাতির বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে দেখতে পাই। হয়ত এটা আমার চাওয়া। আমি জানি না মানুষের আগামী নূতন ও উন্নততর সভ্যতা নির্মাণে গারো জাতির কাছ থেকে কোনও দিশা আসবে কি না।

রচনাঃ ১৯৯৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ