লিখেছেনঃ শ্রীশুভ্র, আপডেটঃ September 19, 2017, 12:00 AM, Hits: 1726
এক
আমরা প্রায়শই দুঃখ করি, আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা আমাদের শিকড় থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি দিনে দিনে। বিশেষত আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যারা আজ বেড়ে উঠছে ঘরে বাইরে, তারা যেন শিকড়হীন এক অস্তিত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যায়, এই একই ক্ষোভ ছিল আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মেরও। আমাদের সম্বন্ধে। আমাদের বেড়ে ওঠার কালে। অর্থাৎ বিষয়টি আজকের সমস্যা নয়। প্রতি কালেই এই একই কথা শোনা যায় নবীন প্রজন্মের সম্বন্ধে। অর্থাৎ এইটুকু নিশ্চিত যে, বিষয়টি প্রতি যুগেরই এক বাস্তব সমস্যা। সাধারণত দেখা যায়, আমাদের বয়স বাড়ার সাথে, যতই আমারা বার্দ্ধক্যের দিকে ঢলে পড়তে থাকি, ততই যেন এই ক্ষোভ বড় বেশি সঞ্চারিত হতে থাকে আমাদের মানসিক পরিসরে। সংসার জীবনের পড়ন্ত বেলায় আমরা যেন ধীরে ধীরে আমাদের শিকড় সম্বন্ধে একটু একটু করে হলেও সচেতন হয়ে উঠতে থাকি। যে সচেতনতা আমাদের যৌবনে বিশেষ দেখা যায় না। যায় না বলেই আমাদের সম্বন্ধে আমাদেরই পূর্ববর্তী প্রজন্মেরও একটি ক্ষোভ জায়মান হয়ে উঠতো আমাদের নবীন বয়সের কালে। কিন্তু জীবনের পড়ন্ত বেলায় আমাদের মননের দিগন্তে সেই শিকড়ের প্রতি একটি ভালোলাগার বোধ গড়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। এ যেন অনেকটা বয়সের সাথে হারানোদিনের স্মৃতির প্রতি নস্টালজিক অনুভুতি। ফেলে আসা সেইসব দিনের নানান রকমের রীতিনীতি লোকাচার ধর্মকর্ম সংস্কৃতির প্রতি আমাদের মনন প্রক্রিয়ায় নতুন করে যেন একটা ভালোবাসা ভালোলাগা ফিরে ফিরে আসতে থাকে। আর তখনই আমারা অনুভব করি আমাদের নিজেদের শিকড়ের প্রতি একান্ত একটি টান। সেই সময়ে আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ঠিক যে টানটার অভাব দেখে আমরা কখনো কখনো ক্ষুব্ধও হয়ে উঠে থাকি।
কিন্তু এই যে আপন শিকড়ের প্রতি টান, সেই টান কতটা আমাদের ভাবাবেগ সম্ভূত আর কতটা বস্তুনিষ্ঠ, সম্ভবত খেয়াল থাকে না আমাদের সে কথাই। পড়ন্ত বয়সে হারানো দিনের রেওয়াজগুলি নিয়ে স্মৃতিরোমন্থনের আনন্দ এক জিনিস। আর সমাজ সংসার জাতীয় জীবনে একটি জাতির শিকড়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা আর এক বিষয়। এই যে শিকড়ের প্রতি টানের অনুভবের কথা দিয়ে শুরু করেছি আমরা আলোচনা, সেই শিকড় সম্বন্ধেই বা আমাদের ধ্যানধারণা কতটা সুস্পষ্ট? আমাদের পারিবারিক জীবনের আচার-আচরণগুলির বংশগত ঐতিহ্যগুলিকেই তো আমরা আমাদের শিকড় বলে অনুভব করি না কি? কিন্তু সেই সব বংশগত পারিবারিক সংস্কৃতিগুলি, কখনো সখনো যেগুলিকে আমাদের নিজস্ব কৌলিন্য বলেও শ্লাঘা বোধ করি আমরা, সেইগুলিই কি আমদের শিকড় শুধু? নাকি আমাদের জাতিগত, সম্প্রদায়গত, দেশজ সাংস্কৃতিক পরম্পরাও আমাদের শিকড়ের অংশ? এই দেশজ শিকড়ের সাথে পারিবারিক বংশগত শিকড়ের সম্পর্কসূত্রই বা ঠিক কি রকম? তারা কি পরস্পর অভিন্ন? না কি তাদের মধ্যেও রয়েছে বিস্তর অমিল কিংবা গরমিল। না আমরা অধিকাংশ সময়েই এত কিছু ভেবে দেখতে অভ্যস্ত নই। তাৎক্ষণিক ভাবে যে বিষয়গুলির ভালোলাগা স্মৃতি আমাদের ভাবাবেগকে উদ্দীপ্ত করে, আমরা সেইগুলিকেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড় বলে ভাবতে অভ্যস্ত।
কিন্তু শিকড় কি শুধুই ভালোলাগা স্মৃতিরোমন্থনের সামগ্রী মাত্র? তা নিশ্চয়ই নয়। আমাদের সম্প্রদায়গত, জাতিগত দেশজ ঐতিহ্যের যে পরম্পরা সেখানেই তো আমাদের মূল শিকড়। আবার এই যে সাংস্কৃতিক পরম্পরা যা মূলত গড়ে ওঠে সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে এক একটি জাতির জীবনে তার দেশজ লোকাচারের আবহমান বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তা যে অবিমিশ্র সুখেরই ইতিহাস তাও কিন্তু নয় আসলে। ঐতিহ্য মানেই যে সুন্দর, উন্নত, মাঙ্গলিক তাও নয়। অনেক খারাপ ঐতিহ্যও উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা বহন করে থাকি। বস্তুত যা আমাদের শিকড় স্বরূপই বটে। তাই বলছিলাম, শিকড় মানেই অবিমিশ্র সুখানুভুতির বিষয় নয়। এখন একটু একটু করে বিষয়গুলির ভিতরে ঢুকেই দেখা যাক। আমরা বাঙালি। তাই আমাদের জাতিগত, সম্প্রদায়গত, দেশগত লোকাচারের ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমাদের মূল শিকড় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে পারে। আবার যেহেতু আজকের বাঙালি জাতির ভিতর দুটি সম্প্রদায়েরই প্রাধান্য মূলত, তাই আলোচনার সুবিধার্থে আমরা সেই দুই সম্প্রদায়ের শিকড়ের উপরেই আলোকপাত করার প্রয়াস করবো। ঐতিহাসিক ভাবেই যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাচীনত্ব অনেক বেশি, তাই সাবার আগে দেখে নেওয়া যাক সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের শিকড়ের প্রাথমিক কিছু পরিচয়।
বস্তুত পাল সাম্রাজ্যের অবসানের পর সেন বংশের রাজত্ব কালেই বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। পাল আমলের বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে সেন আমল থেকেই প্রায় ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া শুরু হয়। সেন আমলেই হিন্দু ধর্মের নানান বিধান দিয়ে সমগ্র জনগোষ্টীকে একটি নিয়মতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা শুরু হয়। যার মুখ্য দৃষ্টান্ত ছিল কৌলিন্য প্রথা। যে প্রথা কালে কালে সমগ্র জাতির জীবনের নিয়ন্ত্রক হয়ে দেখা দিয়েছিল। শুরু হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের শোষণ। পাল আমলের আগে থেকেও হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ, বর্ণভেদ প্রথা ইত্যাদি বিশেষ ভাবেই প্রচলিত ছিল। সেন আমলে এসে সেই সব প্রথা যেন সমগ্র সমাজের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে বসল। এই সকল ইতিহাস অল্পবিস্তর আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই ইতিহাসের পরতে পরতেই যে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের নিদারুণ অভিশাপ জড়িয়ে আছে সে কথা অধিকাংশ সময়েই মনে থাকে না আমাদের অনেকেরই। উচ্চবর্ণের হিন্দু আর নিম্নবর্ণের হিন্দুর মধ্যে অনতিক্রম্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক দূরত্বের যে ইতিহাস, তাই আমাদের সম্প্রদায়গত ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সামগ্রীর মধ্যে পড়ে কিন্তু। আর সেখানেই আমাদের মূল শিকড়ও বটে। আজকের সমাজও যে শিকড় থেকে খুব বেশি দূরবর্তী নয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ব্যাপক শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদের প্রচলন তা শুধুই অর্থনেতিক নয়। শুধুই সামাজিক নয়। বস্তুত তা প্রায় জতিগত হয়ে পড়েছিল কালের নিয়মে। আর তাই কথায় কথায় আমরা জাতপাতের বিভাজনের কথাও বলে থাকি। এই যে বিভাজন, একটি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে, যা মূলত অর্থনৈতিক হলেও অনেক বেশি বর্ণবিভাজন ভিত্তিক সামাজিক সেখানেই আজকের আমাদেরও মূল শিকড়। কজন আমরা মনে রাখি সেই কথা? বা আমাদের ভাবনা-চিন্তার সূত্রপাত করি সেই উৎসমূল থেকে? এই বিভাজনই আমাদের ঐতিহ্যগত পরম্পরা যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই বহন করে চলেছি আবহমান কাল ধরে। তাই আমাদের সংস্কৃতির শিকড়ের গভীরতা অনেক দূর অব্দি বিস্তৃত। আমাদের ভাবতে হবে সেইখান থেকেই। আমাদের শৈশবের পারিবারিক আচার-বিচারের ভিতরেই আমাদের শিকড়ের সীমানা সীমাবদ্ধ নয় আদৌ।
কোন সমাজ যখন ধর্মীয় বিধিনিষেধের জালে গোটা সমাজটিকেই জড়িয়ে ফেলে তখনই শুরু হয় অন্ধকার যুগের। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, যুক্তি-তর্কের পরিসর অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আর বিভিন্ন আচার-বিচারের পৌনঃপুনিক ব্যবহারই হয়ে ওঠে মুখ্য। দমবন্ধ করা সেই পরিবেশে মানুষের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে রীতি ও রেওয়াজ। সেন আমলের সময় থেকেই বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় নেমে আসা অন্ধকার যুগের হাজার বছর ব্যাপী স্থায়িত্বের মধ্যেই আমাদের বাঙালিত্বের মূল শিকড়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে আজকের বাংলার সমাজজীবন সেই সেন আমলেই থেমে আছে। ঐতিহাসিক ভাবেই সেটা সম্ভব নয়। হয়ওনি তেমনটা। বিগত হাজার বছরের অনেক বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই আমাদের সমাজ আজকের রূপ পেয়েছে। কিন্তু এই যে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মুক্ত পরিসরের থেকেও বংশানুক্রমিক চলে আসা রীতি-রেওয়াজের প্রতি অধিকতর বিশ্বস্ত থাকার প্রবণতা যা অল্পবিস্তর সব বাঙালিরই জাতধর্ম বা অন্তরপ্রকৃতি, হ্যাঁ সেখানেই বাঙালির আসল শিকড়। বস্তুত বংশানুক্রমিক রীতি-রেওয়াজগুলির অধিকাংশই ধর্মীয় বিধিনিষেধ থেকে সৃষ্টি হওয়া আচার-বিচারজাত। যার সাথে জড়িত অন্ধবিশ্বাস। যাকে আবার ধর্মবিশ্বাস বলেই ধরা হয় থাকে। যে বিশ্বাসগুলির সাথে যুক্তি-তর্কের, জ্ঞানবিজ্ঞানের সম্পর্ক প্রায় নাই বললেই চলে। দুঃখের বিষয় সেই বিশ্বাসগুলিই সমাজের বুকের ওপর জাঁকিয়ে বসে থাকে আমাদের সংস্কৃতির শিকড়ের রূপ ধারণ করে।
আইন করে বন্ধ করার আগে সহমরণ প্রথা আর কুলীন ব্রাহ্মণের বহুবিবাহ প্রথাকে বাংলার হিন্দু সমাজের প্রধানতম রীতি বলেই ধরা হতো। আমরা যদি একটু ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করি, দেখবো এই দুটি বদপ্রথা সমাজ বিবর্তনের পথে মানুষের চেতনা উন্মেষের হাত ধরে অবলুপ্ত হয়েছিল না আদৌ। সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহনের একক প্রচেষ্টায় বৃটিশের তৈরী করা আইন দিয়েই বলপূর্বক রোধ করা হয়েছিল সহমরণ প্রথা। ঠিক সেইরকমই হিন্দু ম্যারেজ এক্টের বদান্যতায় বন্ধ করা হয় বহুবিবাহ প্রথাও। অর্থাৎ আমারা বলতে চাইছি, ওপর থেকে বিদেশী শাসক কিংবা স্বদেশী রাষ্ট্র কর্তৃক আইন করে বদপ্রথা রীতি-রেওয়াজগুলি বন্ধ করা এক বিষয়। আর সমাজের ভিতর থেকে সমুন্নত চেতনার উন্মেষে সমাজ বিবর্তনের পথে রীতি-রেওয়াজ-প্রথার পরিবর্তন পরিমার্জন আর এক জিনিস। প্রথম ক্ষেত্রে আইনি বলে সমাজকে চাবকে সোজা করলেও ভেতরে ভেতরে সমাজ খুব একটা অগ্রসর হয় না, হতে পারে না। বাইরে থেকে বলপূর্বক যে কাজটা সাধিত হয়, ভিতরে ভিতরে মানুষের চেতনার বিবর্তনের জন্যে সেই কাজটা করতে কিন্তু প্রয়োজন সুস্থ চেতনার উন্মেষের হাত ধরে দিনে দিনে ঘটে চলা সমাজবিবর্তনই। কোন সমাজের শিকড় যদি সেই সমাজ বিবর্তনের হাত ধরেই পুস্ট হতে থাকে, একমাত্র তবেই সেই সমাজ উন্নততর সমাজব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। ঠিক যে ঘটনা ঘটে ছিল ইউরোপের দেশগুলিতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের বাংলার সমাজজীবনে ঠিক তেমনটি ঘটে নি। ঘটলে আজও বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটত না। আজও পণপ্রথার বলি হতে হতো না নিরীহ গৃহবধুকে। আজও বিধবা বিবাহের নামে সমাজ কুন্ঠিত থাকতো না। আজও বিবাহবিচ্ছিনা নারীর সমাজিক সম্মান খুব বেশি নয়। এবং আজও পাত্র চাই পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, নমঃশুদ্রের বিভাজন দেখা যেত না। অথচ এই প্রতিটি বিষয়ের জন্যেই কিন্তু নির্দিষ্ট আইন প্রচলিত করা হয়েছে। কিন্তু সেটা বাইরে থেকে। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। তারও সবিশেষ প্রয়োজন আছে অবশ্যই। সেটি না থাকলে সমাজের অবস্থা হতো আরও ভয়াবহ। কিন্তু সমাজ বিবর্তনের পথে যদি এই আইনগুলি গড়ে উঠতো ইউরোপের দেশগুলির মতোই একমাত্র তবেই আমাদের সংস্কৃতির যে শিকড় নিয়ে আমাদের আলোচনা, তা নিজের গরিমাতেই পুষ্ট হয়ে উঠতে পারতো। সমাজও হয়ে উঠত সুস্থ সবল আধুনিক। আর তখন আমরাও গর্ব করতে পারতাম আমাদের সংস্কৃতির শিকড় নিয়ে।
বাংলায় মুসলমান শাসনামলে বিদেশী ধর্ম হিসাবে ঢুকে পড়া ইসলামের বিস্তারের সাথেই বাংলার সমাজজীবনে ঘটে এক ব্যপক পরিবর্তন। বস্তুত যা কালানুক্রমিক বিবর্তনের হাত ধরেই ঘটে। ঘটে সমাজজীবনের একেবারে অভ্যন্তর থেকেই। ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোন ফরমানের হাত ধরে নয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের শাসন-শোষণ-অত্যাচার-নির্যাতন ও অবিচারের হাতে বংশানুক্রমিক ধরে মার খাওয়া নিম্নবর্ণের হিন্দুশ্রেণীর মধ্যে ইসলাম যেন অবতীর্ণ হয়েছিল ত্রাতার ভুমিকায়। অনেকেই বিশ্বাস করেছিল ইসলামই তাদের মুক্তির দিশারী। ইসলামই পারবে তাদেরকে বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার শোষণ ও নিপীড়ন থেকে বাঁচাতে। তাই ইসলামের কাছেই আশ্রয় নিতে ছুটেছিল তারা দলেদলে। এই ইতিহাসও আমারা জানি সকলেই। ইসলাম সম্বন্ধে তাদের এই বিশ্বাসের কারণ ঘটেছিল ইসলামের বিশ্বভ্রাতৃত্ব বোধের সাথে পরিচয়ের সূত্রে। তারা দেখেছিল ইসলাম সকলকেই সমান মর্য্যাদায় গ্রহণ করে। ইসলামে নাই কোন জাতপাতের শ্রেণীবিভাজন। হিন্দু সমাজের যে বিভাজনের অভিশাপে তারা বংশানুক্রমিক ভাবে শৃঙ্খলিত ছিল। তাই সেই শৃঙ্খল কেটে মুক্তির অভীপ্সায় তারাই সাদরে বরণ করে নিল বিদেশাগত ইসলামকেই। শুরু হলো নতুন এক যুগের। শুরু হলো নতুন ইতিহাস।
কিন্তু যে অর্থনেতিক ক্ষমতা ও শিক্ষাদীক্ষার সুযোগ হাতে থাকলে সমাজের উপরিতলে উঠে আসা যায়, সেই ক্ষমতা ও সুযোগ ইসলামের কাছে আশ্রয় নিতে ছুটে আসা এইসব মানুষগুলির হাতে তুলে দেওয়ার মতো কোন জাদুকাঠি ছিল না ইসলাম ধর্মের হাতে। থাকার কথাও নয়। তাই নিম্নবর্ণের হিন্দু হিসাবে তাদের সামাজিক অবস্থান যা ছিল, ইসলামের আশ্রয় এসেও তাতে বিশেষ কোন রকমফের হলো না। সেই অর্থনৈতিক শোষন অব্যাহত থাকল। সামজিক বিভেদ প্রকট হলো আরও। জাতি হিসাবে বাঙালি বিভক্ত হয়ে পড়লো দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ে। সৃষ্টি হলো পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অশ্রদ্ধার পরিসর। সৃষ্টি হলো সাম্প্রদায়িক দূরত্বের। পরবর্তীতে ইউরোপ আগত বৃটিশের কূটকৌশলে যে দূরত্ব পরিবর্তিত হয়ে গেল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে। আর সেইখানেই পুষ্ট হতে থাকল আধুনিক বাঙালির শিকড়।
ওদিকে বিদেশাগত ইসলামের হাত ধরে নব্য গঠিত মুসলমান সমাজের অন্দরে গড়ে উঠতে থাকল নতুন এক শিকড়। যা পুস্ট হতে থাকল আরবের সংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গে। কালক্রমে বাঙালি মুসলমান যে সংস্কৃতির মধ্যেই নিজের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের কল্পনায় বিভোর হয়েই মনে করতে শুরু করলো আরবের সংস্কৃতির মধ্যেই তার মূল শিকড়। সেও এক শিকড়হীনতার ঘটনা। আপন শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়ে কাল্পনিক শিকড়ে আপন অস্তিত্বের নোঙর ফেলার এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। এবং এই ঘটনা বিশেষ ভাবে গতি পেল বৃটিশের সুকৌশলী ডিভাইড এণ্ড রুল নীতির হাত ধরেই। ঠিক যেমনটি ঘটে ছিল তথাকথিত বাংলার নবজাগরণের ঘটনায়। বৃটিশের কাছে পদানত হয়ে বাঙালি বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের উচ্চবিত্ত শ্রেণী নিজেদের শিকড়ের সন্ধানে গিয়ে পৌঁছালো সনাতন ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যধর্মের মর্মমূলে। নিজের পরিচয় তৈরী করে নিল অখণ্ড ভারতীয়তায়। যা আসলে হিন্দুত্বেরই নামান্তর। ফলস্বরূপ বাঙালি বর্ণহিন্দু সম্প্রদায় তার হাজার বছর ব্যাপী বাঙালিত্বকে বিসর্জন দিয়ে বরণ করে নিল হিন্দু ভারতীয়ত্বকে। বিশ্বাস করতে শুরু করলো সেই ভারতীয়ত্বই তার মূল শিকড়। ঠিক যেমনটি কিছুটা পরবর্তী কালে বিশ্বাস করতে শুরু করবে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর মানস; আরবের ইসলামই তার মূল শিকড় বলে। বাংলার সমাজ এই পথেই সুস্পষ্ট দুটি পৃথক পথে বিভক্ত হয়ে পড়লো কালের গতিপ্রকৃতির কবলে পড়ে। আর এইখানেই বিশেষ করে লক্ষ্য করার বিষয় এইটাই যে, এই দুই সম্প্রদায়ই তাদের বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে ভারতীয় ও মুসলিম পরিচয়েই তাদের শিকড় বলে বিশ্বাস করে নিল। এবং সুদৃঢ় ভাবেই। নিয়তির পরিহাসে শিকড়হীন হয়ে পড়লো একটি সমগ্র জাতি।
এটাই আমাদের ইতিহাস। আর তাই এই বিচ্ছিন্নতাই আমাদের সংস্কৃতি। যার দৃষ্টান্ত আমাদের সকল কর্মে। সকল উদ্যোগে। সকল স্বপ্নে। এখানেই আমাদের শিকড়। আর এটাই বাঙালির আসল পরিচয়। যার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আজকের দুই বাংলা! আর মাঝখানের সুবিস্তৃত ঐ কাঁটাতার!
দুই
বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণবিভাজনের হাজার হাজার বছরব্যাপী সংস্কৃতির প্রকোপে, এক এক বর্ণের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারও এক এক রকম। তাদের মানসপটে আপন আপন শিকড়ের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কল্পনাও তেমনই বিভিন্ন। কুলীন ব্রাহ্মণের মানসপটের শিকড়ের সাথে কায়স্থ, বৈদ্যের শিকড় কখনোই এক নয়। এক নয় নমঃশূদ্রের শিকড়ও। সমাজিক বিবাহের পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের অভিভাবকীয় প্রচেষ্টায় যার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ধরা পড়ে। ফলে এই বর্ণভেদ আজও আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের অস্থিমজ্জায় শিকড় গেড়ে এমন ভাবেই বসে আছে যে তাকে অস্বীকার করা মিথ্যাচারেরই নামান্তর হবে। আবার এই শিকড় যে আমাদের গর্বের বিষয়ও নয়, এই নিয়ে আত্মশ্লাঘারও যে কোন জায়গা নাই, কজন আমরা স্মরণে রাখি সেই সত্যটুকু? কত সহজেই না সময়ে অসময়ে বলে ফেলি, আমাদের বংশে ইনটার কাস্ট ম্যারেজ হয় না। ভেবেও কি দেখি তখন, সেটি কত বড়ো কলঙ্কের বিষয়। কতটা লজ্জার একজন মানুষ হিসাবেই। হ্যাঁ, এই নির্লজ্জটুকুও আমাদেরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আর এক উত্তরাধিকার। আমাদের শিকড় স্বরূপ। অনেকেই বলবেন এ শুধু তো বাঙালি হিন্দু সমাজেরই চিত্র নয়। সমগ্র ভারতীয় হিন্দু সমাজেরই চিত্র। খুবই সত্য কথা। এও সত্য, বাঙালি হিন্দু সমাজ ভারতীয় হিন্দু সমাজের থেকে অনেক লিবারাল। যে কারণে অধিকাংশ ভারতীয় হিন্দুই বাঙালি হিন্দুকে হিন্দুই মনে করে না। কিন্তু তাই বলে আজও আমাদের অস্থি-মজ্জায় যে বর্ণবিভাজনের অভিশাপ জড়িয়ে আছে, তাকে অস্বীকার করা যায় কি?
ঐতিহাসিক ভাবেই এই বর্ণবিভাজনের সাথেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সম্পর্ক বিদ্যমান। হ্যাঁ, অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদের কথাই এখানে আমাদের বলার কথা। এই শ্রেণীভেদ আজ যে কতখানি প্রাসঙ্গিক, সে কথা তো বিতর্কেরই উর্দ্ধে। আমাদের শিকড় সেই শ্রেণীভেদেরও শিকড়। যা থেকে আমরা কেউই মুক্ত নই। বা আরও নির্দিষ্ট করে বলা ভালো মুক্ত হতেই চাই না। এবং এই যে না চাওয়া, বস্তুত সেই না চাওয়ার সংস্কৃতিতেই তো আমাদের মন মানসিকতার নোঙর! যে যেরকম অর্থনৈতিক শ্রেণীতে পৌঁছিয়ে গিয়েছি, তার থেকে নিম্নতর শ্রেণী বিন্যাসের সাথে নিজেদেরকে কল্পনা করা আমাদের অধিকাংশের পক্ষেই অসম্ভব। ফলে আমাদের সমাজ ও স্বদেশ সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা আমাদের বর্ণভেদ ও শ্রেণীভেদের দৃষ্টিকোণ থেকেই গড়ে ওঠে। এবং তার সাথেই যুক্ত হয় আমাদের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার। আর যার সুদূর প্রসারী ফলসরূপ আমাদের চেতনায় আজও কোন অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা গড়ে ওঠে নি। উঠবে না হয়তো কোন কালেই। জাতিগতভাবে এইখানেই আমাদের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ। আর সেই অভিশাপের মূলই হলো আমাদের সংস্কৃতির শিকড়। যে অভিশাপের ফল স্বরূপ আমরা কোনদিনই সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারবো না উন্নত বিশ্বের দেশগুলির সাথে।
আমাদের বাঙালিদের শিকড় সম্বন্ধে আর একটি মাত্র দিকের উল্লেখ করেই এই আলোচনার সমাপ্তি টানবো। সেটি হলো আবিশ্ব প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের শিকড়। বস্তুত পৃথিবীর সব কয়টি প্রধান ধর্মের মূলেই এই পিতৃতন্ত্রের কায়েমী ব্যবস্থা। এবং ধর্মগুলির অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো এই অন্যায় পিতৃতন্ত্রকে বজায় রাখা। তাকে পরিপুষ্ট করে শক্তিশালী করে তোলা। ঘরে বাইরে নারীদেরকে পুরুষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা। হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, শিখ ইত্যাদি সব কয়টি ধর্মেরই এই একই চরিত্র। এখন ইউরোপ-আমেরিকার খৃষ্টান অধ্যূষিত দেশগুলির সমাজ ব্যবস্থা ধর্মের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে অনেক আগে থেকেই বেরিয়ে আসার কারণে এবং জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার শতাধিক বৎসর ব্যাপী ইতিহাসের দৌলতে এই অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছে। আমরা বাঙালিরা যে কাজটি এখনো শুরুই করতে পারি নি। অনেকেই এখানে তর্ক করতে পারেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উনিশ-বিশ পারা না পারা নিয়ে, কিন্তু সমগ্র বাংলার বিস্তৃত সমাজজীবনের দিকে অখণ্ড দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে সত্যই আজও কি ভয়াবহ অন্ধকারে পড়ে আছি আমরা। পড়ে আছি কারণ আজও আমরা এই পিতৃতান্ত্রিক শিকড়েই জড়িয়ে রেখেছি নিজেদেরকেই। সজ্ঞানেই হোক আর অজ্ঞানেই হোক। এই বিষয়ে আমাদের অধিকাংশেরই সচেতনাতা প্রায় নাই বল্লেই চলে। ঘরে বাইরে আজও নারী পুরুষের অধীনস্থ। স্বেচ্ছায় হোক কি বাধ্য হয়েই হোক। আমরা বলছি সমাজের অধিকাংশ নারীর কথা। সমাজের উপরিতলের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হাতে গোনা কজনের কথা নয়। এই যে পুরুষেরই অধীনস্থ থাকার মানসিকতা ও সংস্কৃতি, এর থেকে নারী নিজেও মুক্ত নয়। আর পুরুষ তো জৈবিক ও উত্তরাধিকার সূত্রেই নারীকে অধীনস্থ রাখার বিষয়ে সদাতৎপর। এই অধীনতার সবচেয়ে বড়ো সামাজিক দৃষ্টান্তই হলো বিবাহ সূত্রে নারীর শ্বশুরালয়ে গমন। ঠিক যে কারণে পুরুষের ঘর জামাই হয়ে থাকার নজিরকে লজ্জার বিষয় বলেই ধরা হয়ে থাকে। এই যে সামাজিক ঐতিহ্য কি হিন্দু কি মুসলিম সম্প্রদায়ের বাঙালির মধ্যে বিদ্যমান, এইখানেই কিন্তু আমাদের পিতৃতন্ত্রের শিকড়! শিকড় নারীর স্বাধীনতাকে খর্ব করে রাখার ঐতিহ্যের। শিকড় নারীকে পুরুষের অধীনস্থ করে রাখার মানসিকতার সহস্রাব্দ ব্যাপী ঐতিহ্যেরও।
তাই শিকড়ের টানে শিকড়ের কাছে ফিরে আসতে চাওয়ার, আমাদের বয়সের পড়ন্ত বেলার সেই নস্টালজিক ভাববেগকে সরিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে নিজস্ব শিকড়ের সন্ধান করাটাই আজকে অনেক বেশি জরুরী বলে মনে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই কাজটি ব্যক্তিগত ভাবেই হোক কিংবা সম্প্রদায়গত ভাবেই হোক আমরা কখনোই করি নি। করি না। করি না কারণ সেটাই আমাদের জাতিগত চরিত্র বাঙালি হিসাবে। এখানেই আমরা অন্যান্য উন্নত জাতিগুলির তুলনায় অনেক পিছনে পড়ে আছি। আপন জাতিগত শিকড়ের পরিচয় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে সামগ্রিক ভাবে কোন জাতিই জাতিগত চেতনায় উত্তীর্ণ হতে পারে না। আর পারে না বলেই তখন তাদের চেতনায় দেশ হয়ে পড়ে খণ্ডিত সমাজ মাত্র। নিজ নিজ গোষ্ঠী ভিত্তিক খণ্ড চেতনার মধ্যেই নিজ দেশের পরিসীমা দাঁড়িয়ে যায়। সমগ্র দেশের অস্তিত্ব তাদের খণ্ডিত গোষ্ঠী চেতনায় কোনদিনই ধরা দেয় না। দেয় না বলেই স্বাদেশিকতার বোধ গড়ে ওঠে না সমাজ সংসারের কোন স্তরেই। তখনই খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ে থাকে একটি সমগ্র দেশ। যে কোন সময়েই বিদেশী শক্তি যে ভুখণ্ডকে পরাধীন করে ফেলতে পারে চাইলেই। বাংলার দুই হাজার বছরের ইতিহাস সেই খণ্ড খণ্ড পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী চেতনারই ইতিহাস। তাই বারে বারেই বিদেশী শক্তির হাতে পরাভূত হয়ে তদের হাতের পুতুল হয়েই থাকতে হয়েছে আমাদের। আজ তারই রকম ফের দেখা যাচ্ছে মাত্র। মূলত আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেই একই তিমিরেই।