লিখেছেনঃ লানারিয়া অ্যামবার্কিরা। ভাষান্তরে : ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ June 11, 2018, 12:00 AM, Hits: 2980
বর্তমানে উদারতাবাদ বা উদারনীতি বা নয়াউদারনীতিবাদকে নেতিবাচক হিসেবে মানুষ দেখে থাকে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে উদারনীতিবাদ নাগরিককে মুক্ত করতে চায়, ক্ষমতাসীনদের নাগপাশ থেকে তাকে স্বাধীন করে দিতে চায়। অথচ কীভাবে আধুনিক উদারনীতিবাদ শাসকদের শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠল? কেনই বা এই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাপারটি দেখার জন্য একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োজন হয়ে পড়ল? সেখানেই আলোচনার সূচনা করা দরকার।
যতটা সম্ভব স্বাধীনতা
উদারনীতি হল কমবেশি ফরাসী বিপ্লবের ফলশ্রুতি। এই বিপ্লব হল নিপীড়ক অভিজাতের বিরুদ্ধে নিন্মশ্রেণী ও মধ্যশ্রেণীর দ্রোহ। নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা ন্যয়সঙ্গত বিদ্রোহ। সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতা ছিল তার স্লোগান।
সামন্তীয় শাসকদের উচ্ছেদ করার পর, সময়টা ছিল এমন একটি সমাজ নির্মান করা যেখানে ব্যক্তি যতটা সম্ভব সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। সেই অর্থে নাগরিকরা যাতে সুমহান স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে, উদারীকরণ (নয়াউদারীকরণ) সেই সমাজের জন্য লড়াই করে। যেমন নাগরিক অধিকার ব্যক্তিকে সুরক্ষিত করবে এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমিত পর্যায়ে রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেই অর্থে উদারনীতিবাদ আমাদের জন্য মঙ্গলবার্তাই বহন করে আনে।
ফর্মূলাটি হল, যতটা সম্ভব ব্যক্তির সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ইকুয়াল টু যতটা সম্ভব সরকারের ক্ষমতার সীমিতকরণ। অথচ এই ফর্মূলাই আধুনিক সময়ে শোষণ-বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। কেন এমনটা হচ্ছে?
মুক্ত বাজার
উদারতাবাদ চায় ক্ষমতার নাগপাশ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করে দিতে। সেটা হয়ে উঠবে মুক্ত বাজার। এই ধরণের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভাবা হয়, জনগণ আর রাজা-রাজড়াদের খেয়ালখুশীর শিকলে বাঁধা থাকবে না। প্রত্যেকেই পাবে ন্যায্য মজুরি। মুক্ত বাজারে যে কেউ স্বীয় স্বার্থ অন্বেষণ করতে পারে। এর ফলে গড়ে উঠতে পারে যৌথ সম্পদ। একে বলা হয় ‘বাজারের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলাফল (the self-regulating effect of a market)। আর সেখানেই লুকিয়ে আছে সমস্যা। কারণ মুক্তবাজারে আমরা সম্ভবত সামন্তীয় শাসকদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু আমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করেছি নতুন শাসক। যার নাম হল ‘বাজার’। এই স্বয়ংক্রিয় বাজার নিজেই নতুন শাসকদের পবিত্র পানপাত্রে পরিণত হয়েছে।
আজকের বাস্তবতায় উদারতাবাদের অর্থ দাঁড়িয়েছে কিছু মানুষের স্বাধীনতা আর অধিকাংশের জন্য স্বল্প মজুরি। এতে দিন দিন বাড়ছে আধুনিক দাসত্ব। দক্ষতা এবং ফুলে ফেঁপে ওঠা মুনাফা হল পুঁজিবাদী পদ্ধতির সর্বোত্তম পণ্য।
অধিক উদারীকরণে উপার্জনের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ে। মানুষ মানুষকে কামড়ে খেতে চায় এবং অপরের দৈনন্দিন ব্যয়ের সুযোগ নিতে চায়। সেখানে প্রত্যেকেই প্রতিযোগী। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সেই প্রতিযোগিতাময় সমাজে সকলকেই স্বাগত জানানো হয়।
নয়া বৈষম্য
উদারীকরণ আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে চায় যে, সফলতা হল ব্যক্তির মেধা এবং প্রচেষ্টার ফল। তারা বলে, ‘প্রতিটি মানুষই সমান’। কিন্তু মানুষের জন্মই যে ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরে, সেই বাস্তবতাটা শুরুতেই অস্বীকার করতে চায়। হ্যাঁ, সকল মানুষ সমান, কিন্তু তার আর্থ-সামাজিক অবস্থান তো সমান নয়। সেখানে একজনের পারিপার্শ্বিকতা এবং জন্মগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনা যোগ্য। যদি কেউ উন্নত বিশ্বে জন্ম গ্রহণ করেন, যদি তার ধনী বাবা-মা থাকেন তাহলে তিনি ভাগ্যবান। এর বিপরীতে যদি কেউ একটা গরিব দেশে জন্ম গ্রহণ করেন, তার বাবা-মা যদি গরিব হন, সেক্ষেত্রে ওই বাস্তবতাই তার ভাগ্য নির্ধারণ করে। এটাই একজনের জীবনকে একদম প্রথম থেকেই পৃথক করে দেয়।
অপরদিকে, উদারীকরণ প্রথমে শুরু হয়েছিল একটা মহৎ ধারণা নিয়ে। উদারীকরণের সামগ্রিক ধারণার মধ্যে নতুন করে বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। একদিকে টাকার কুমির, অপরদিকে নিঃস্ব মানুষ। যারা ধনী তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, একটা নতুন অভিজাত বর্গ হিসেবে তাদের আবির্ভাব ঘটে।
প্রত্যেকের সফলতার দায় তার নিজের উপর বর্তায়। সেখানে ব্যক্তির বাজার দর বাড়ানোর জন্য অবশ্যই তাকে নিজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। একজনের সফলতার পেছনে অনেকের অর্থ ব্যয় হয়। উদারীকরণ হলো অভিজাতদের জন্য এবং অভিজাতদের দ্বারা প্রণীত নীতি। সেখানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বিবেচনার বাইরে রাখা হয়। এক শতাংশ মানুষ বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের ওপর শোষণের ছড়ি ঘোরায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নয়া উদারীকরণ নীতি একটা নতুন শক্তি সঞ্চয় করে। তাৎক্ষণিকভাবে উদারীকরণের সঙ্গে একটা সমঝোতা বা সমন্বয় সাধন করে নেয়। এর পরেই ছুটতে থাকে লাগামহীনভাবে।
সামাজিক এবং ব্যক্তিক নৈতিকতায় উদারীকরণের প্রভাব কতটুকু? আমরা এর সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক রূপ সবখানেই দেখতে পাই। সামাজিক বন্ধন এবং সংহতি যেন নিয়ম মেনে ভেঙ্গে গেছে। বাজার প্রতিযোগীতা শুধু শিক্ষা ও শ্রমবাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নাই। এটা সামাজিক জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য সেবাও একটি পণ্যে পরিণত হয়েছে। ফলে একজন নার্সের দক্ষতা পরিমাপ করা হয় তার কর্মঘন্টা দিয়ে। অথচ তার দরকার একজন বয়স্ক নারী অথবা পুরুষকে গোসলে সহযোগিতা করা। পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। সামান্য কিছু সংখ্যকের লোভের জন্য লাখ লাখ মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছেন, তারা শোষণ, নির্যাতন ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে রয়েছেন। পুরো আদিবাসী গোত্রকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে, অগণিত বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এখনো হচ্ছে। বহু প্রজাতির বন্য প্রাণী বিলুপ্তির হুমকির মধ্যে রয়েছে। আমাদের এই গ্রহটির প্রায় সবটুকুই লুট হয়ে গেছে। এটা বিষাক্ত হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে, শুধু ঘোষণাটিই বাকি রয়েছে।
‘বিজয়ীরাই সবটুকু নেবে’ এমন মানসিকতা নিয়েই সমাজ গড়ে ওঠে। এই মানসিকতার ফলে সমাজে অনেক বাজে ব্যাপার ঘটে চলেছে। মানুষকে মানুষের সম্মান দেওয়ার যে স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল, সেখান থেকে প্রচুর মানুষ সরে পড়ছে, সেই প্রবণতায় ভীষণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে সে সব সংস্কৃতি।
অপমান, অপরাধ, লজ্জা, ব্যর্থতার ভীতি, দগ্ধানি, অশান্তি, হতাশা, আত্মহত্যা — এগুলো হল এই সমাজের বৈশিষ্ট্য। মিথ্যাচার, প্রতারণাকে ভাল চোখে দেখা হয়, অন্যথায় যে কারো কপালে জোটে ক্ষমাহীন শাস্তি। সংখ্যালঘুদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা চলে। আর পরনিন্দা করলেই অনেকেই নিশ্চিত হয়ে যান যে, ‘নিজেরা অনেক বড় হয়ে গেছেন।’এভাবেই তারা মানুষে মানুষে স্বাভাবিক সম্পর্ককে ধূলিসাৎ করে দেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের শুধু প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্কই তার বৈশিষ্ট্য নয়, কারণ সে তো সামাজিক প্রাণী। মানুষ সমাজ ছাড়া কি বসবাস করতে পারে? সমাজে বসবাস করতে হলে অপর ব্যক্তির সহযোগিতার দরকার হয়। সেখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে দরকার হয় সহযোগিতার। নয়া উদারীকরণবাদ যেন আমাদের টেনে রসাতলে নিয়ে গেছে। অর্থই যদি নৈতিকতার মানদণ্ড হয় তাহলে সেখানে কোনো অপকর্ম সংঘটনে কেনো বাধা নাই। সবকিছুই করা জায়েজ।
নতুন দৃষ্টিভঙ্গী
সংক্ষেপে বলা চলে, যাবতীয় শোষণ-লুণ্ঠন থেকে আমাদের মুক্ত করার দায়িত্ব পড়েছিল যাদের ওপর, তারাই ফের বিশ্বজুড়ে নতুন করে একই প্রত্যয় আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আমাদের আধুনিক সরকারগুলো পুঁজিবাদ ও উদারীকরণবাদের সমর্থক। এতে আমরা যে গণতন্ত্রে বসবাস করছি, সেটা গণতন্ত্র নয়, তার নিছক কল্পনা। প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা বসবাস করছি একটা গোষ্ঠীর শাসনে। সেটা একটা চোরের শাসনও বটে। যাকে গণতন্ত্র বলে লেভেল এঁটে দেওয়া হয়েছে।
“বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক নৈতিকতার ব্যাপারে আমাদের কঠোর সমালোচনা জারি রাখতে হবে। সেখানে পক্ষপাতহীন এবং ন্যায়বিচারকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। যে নির্মান অসাম্যের বেড়ে ওঠাকে রুদ্ধ করে দেয়, শ্রমকে পর্যাপ্তভাবে পুরস্কৃত করে, অধিকতর ন্যায্যভাবে সম্পদ বন্টন করে এবং বাজারে প্রবেশাধিকারকে সীমিত করে দেয়।” বলেছেন, রোক্সেন ভ্যান আইপেরেন, নেদারল্যান্ড।
একটা নতুন বিশ্বদৃষ্টি খুঁজে বের করার এটাই সময়, যা আমাদের সকলের জীবনের যা কিছু পবিত্র, তার ওপর আলো ফেলবে।
লেখক : লানারিয়া অ্যামবার্কিরা। তারিখ :১০.০৪.১৮।
(নিবন্ধটি লেখক Lanaria Amberkira-এর লেখা The Immorality of Neoliberalism-এর বাংলায় ভাষান্তর। এটি www.pravdareport.com-এ ৯ মে ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত প্রকাশিত হয়। — অনুবাদক)