লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ February 6, 2019, 12:00 AM, Hits: 1534
বিষয়সূচি :
(১) আফগানিস্তানের গল্প
(২) জাহালমের গল্প
(৩) শামসুল আলম চঞ্চলের গল্প
(৪) সৎ ও নীতিনিষ্ঠদের দুর্গতি
(১) আফগানিস্তানের গল্প
জাহালামের গল্প বলার আগে সৈয়দ মুজতবা আলীর গ্রন্থ ‘দেশে-বিদেশে’-এর একটা শরীর শিউরে উঠা ঘটনার কথা দিয়ে শুরু করি। কিংবা ধরা যাক এটা ঘটনা হলেও একটা গল্পই। গল্পটা আফগানিস্তানের। লেখক ব্রিটিশ আমলে আফগান সরকারের আমন্ত্রণে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি এ সম্পর্কে জানতে পারেন।
আফগানিস্তানের বাদশাহ বা আমীর হাবীব উল্লাহ্ তখন জালালাবাদ শহরে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় তিনি কোনও উপলক্ষ্যে জালালাবাদের কারাধ্যক্ষকে নির্দেশ দিলেন জেলের সব বন্দীকে যেন তার সম্মুখে উপস্থিত করা হয়। তার সম্মুখে বন্দীদের উপস্থিত করা হলে তিনি বিভিন্ন জনের কথা শুনলেন এবং বহুসংখ্যক কয়েদীর সাজা কমালেন এবং অনেককে মুক্তি দিলেন। এই সময় একজন বন্দী তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই বন্দীকে বাদশাহর সামনে আনা হলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হল ‘তুই কে’? সে উত্তর দিল, ‘আমি তো পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।’ যে কথাই জিজ্ঞাসা করা যাক সে শুধু একটা কথাই বলে চলে যে সে পঁয়তাল্লিশ নম্বরের।
বাদশাহ ছিলেন দৃঢ় সংকল্পের মানুষ। বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করে বাদশাহ বুঝলেন যে লোকটা উন্মাদ নয়। সুতরাং তিনি এই কয়েদীর ব্যাপারটায় কৌতূহলী হলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সবাইকে একে একে ডেকে জিজ্ঞাসা করে সত্যটাকে বের করার কাজ শুরু করলেন। অনুসন্ধানে যেটা বেরিয়ে এল সেটা হচ্ছে একদল ডাকাতকে এক জেল থেকে আর এক জেলে অর্থাৎ জালালাবাদ জেলে নেওয়ার পথে সরাইখানায় বিশ্রাম নেওয়ার সময় একজন কয়েদী পালিয়েছিল। তখন যে পাহারাদাররা তাদেরকে নেওয়ার দায়িত্বে ছিল তারা ভাবল এর জন্য তাদের কঠোর শাস্তি হবে। হয়ত তাদের ফাঁসি হবে অথবা গুলি করে মারা হবে। আর কিছু না হোক জেল তো হবেই! কী করা যায়? তারা একটা বুদ্ধি বের করল। রাস্তা থেকে একজন নিরীহ গোছের কাউকে ধরে শূ্ন্য জায়গা অর্থাৎ সংখ্যা পূরণ করা হবে।
রাতটা তারা পার করল। পরদিন অন্ধকার থাকতে খুব ভোর বেলায় তারা বের হল। সেই সময় প্রয়োজনীয় কাজ সারতে গ্রামের এক সাধারণ মানুষ রাস্তার কাছাকাছি এসেছিল। রাস্তার পাশে একা পেয়ে তাকে ধরে আচ্ছামত ভয় দেখিয়ে বলল যে, সে পঁয়তাল্লিশ নম্বরের। কেউ জিজ্ঞাসা করলে এটাই যেন সে সবাইকে বলে। আর বন্দী তালিকায় নম্বর অনুযায়ী নাম তো লিখাই আছে। সুতরাং নম্বর মনে রাখলেই চলবে। জেলে এনে তাকে অন্যদের সঙ্গে ঢুকানো হল। সেখানে ষোলো বৎসর কারাবন্দী হয়ে থাকল। সে জেলে অনেককে বুঝাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয় নাই। কারা কর্মকর্তারা জানলেও নিজেরা ঝামেলায় পড়ার ভয়ে এ নিয়ে উচ্চবাচ্চ করতে চায় নাই। আর সেই লোকের নিকট জনেরাও তার পরিণতি সম্পর্কে জানতে না পারায় কিছুই করতে পারে নাই। এভাবে একটা জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে গেল। এবং বেঁচে থেকেও মরে গেল।
অবশেষে বাদশাহর অনুসন্ধানে ষোলো বৎসর পর সত্য বেরিয়ে এল, যখন সে প্রায় পুরাপুরি পাগলে পরিণত হয়েছিল এবং কিছু জিজ্ঞাসা করলে নিজের আসামী নম্বর ছাড়া আর কিছু বলত না।
(২) জাহালমের গল্প
এবার আসা যাক জাহানমের গল্পে। সংবাদপত্রে প্রচারের কল্যাণে জাহালমের ঘটনা এখন অনেকেরই জানা। তবে আমি তার ঘটনাটা তার মুখ থেকে শুনেছিলাম যখন আমি ‘ইসলাম বিতর্ক’ প্রকাশের দায়ে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় বন্দী হয়ে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাই তখন। তার আগে প্রায় পাঁচ মাস আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছিলাম। এরপর বাকী সাড়ে তিন মাস আমি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলাম।
এই সাড়ে তিন মাস সময় যুবক জাহালম আর আমি একই ওয়ার্ড তথা একই ঘরে ছিলাম। সেই সময় তার সঙ্গে পরিচয় এবং তার করুণ কাহিনী জানা। সাড়ে আট মাস বন্দী থাকার পর আমি প্রায় সোয়া দুই বছর আগে জামিনে বের হই। আমার ধারণা ছিল জাহালম এতদিনে এই মিথ্যা মামলার দায় থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংবাদ থেকে জানতে পারলাম যে, না সে এতদিনও বন্দী ছিল। তিন বৎসর জেল খাটার পর সে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাত ১২টার পর অর্থাৎ ৪ ফেব্রুয়ারীতে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে। ৩ ফেব্রুয়ারীর দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে ‘জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আজই মুক্তি দিতে নির্দেশ’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেটা আমি হুবহু কিছুটা তুলে দিই :
‘সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের করা সব মামলা থেকে নিরীহ জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আজই মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন এক নির্দোষ লোককে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না।
‘আজ রোববার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত এই ভুল তদন্তের সঙ্গে কারা জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন বলে জানান।
‘সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক হিসাবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। চিঠি পাওয়ার পর দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে পাঁচ বছর আগে জাহালম বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। বাংলায় লিখতে পারলেও ইংরেজিতে লিখতে জানেন না। কিন্তু নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমের কথা সেদিন দুদকের কেউ বিশ্বাস করেননি।
‘এরপর ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের এসব মামলায় জাহালম গ্রেপ্তার হন। তিনি জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন।’
এখানে আর একটু বলা দরকার যে, এর আগে জাহালম বিচারককেও সে যে আবু সালেক নয় এবং সে যে কোনওভাবেই সোনালী ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে যুক্ত নয় সে কথা বলেছিল। তবে দুদক, বিচারপতি কেউই তার কথায় কর্ণপাত করে নাই।
জাহালমের ঘটনাটা আমাকে মাঝে মাঝে প্রায় মধ্যযুগীয় আফগানিস্তানের ঘটনাটার কথা মনে করিয়ে দিত এবং এখনও দেয়। আফগানিস্তানের সেই বর্বর পুলিশদের যেমন একজন নম্বরের দরকার ছিল আধুনিক(!) এবং একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের দায়িত্বে নিযুক্ত লোকদেরও তেমন একজন ‘আবু সালেকের’ দরকার ছিল। সেটার জন্য জাহালম ছিল একজন মোটামুটি ভালো বাছাই। কারণ সে প্রায় অশিক্ষিত, দরিদ্র এবং নিরীহ শ্রমিক।
এটা বোধগম্য যে আবু সালেক একা সাড়ে ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নাই। এটা অনুমান করা দোষের হবে না যে, স্তর এবং পদমর্যাদা ভেদে ১০ লাখ ২০ লাখ করে এই টাকার একটা অংশ তো আরও অনেককেই দিতে হয়েছে। অর্থাৎ আরও অনেকেই এই আত্মসাতের সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিল অথবা পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছিল এমনটা অনুমান করা যায়। সুতরাং খোঁজখবর করেই জাহালমকেই একজন আবু সালেক হিসাবে রাস্তা থেকে ধরে আনা হয়েছে। আবার সেই অর্থের জোরেই তাকে এতকাল জেলে রাখা গেছে।
আমি জেলে থাকা অবস্থায় জাহালমকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। অবশ্য আইনগত বিষয়ে এবং সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশ করার বিষয়ে কিছু ভূমিকা নিতেও আমি চেয়েছিলাম। তবে তখন তার ভাই শাহানূর এ বিষয়ে দায়িত্ব নেওয়ায় আমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে না বলে সে আমাকে জানিয়েছিল। তবে আমি সবচেয়ে জোর দিয়েছিলাম জাতীয় সংবাদপত্র বা টিভি-এর কোনও রিপোর্টারকে ধরার ব্যাপারে। তার ভাই যে সে ব্যাপারেও উদ্যোগী সে কথা আমাকে জানিয়েছিল। অবশ্য সাংবাদিকদের ব্যাপারেও তাকে সতর্ক করেছিলাম। কারণ টাকার লোভে ঘটনাকে চেপে রেখে আবু সালেককে ব্ল্যাক মেইল করে টাকা কামাবার ধান্দা করার মত সাংবাদিকের অভাব যে এ দেশে নাই সেটা যেমন আমার জানা ছিল তেমন তাকেও এ ব্যাপারে তার ভাইকে সতর্ক করতে বলেছিলাম।
আমার মনে হয়েছিল সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশ ছাড়া এ দেশে অনেক অন্যায়ের কোনও প্রতিকারই পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই সংবাদ বের হতেও এত সময় লাগতে পারে? আমার ধারণা ছিল জাহালম অনেক আগেই ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এখন জানলাম যে সে সময়ের হিসাবে ২০১৯-এর ৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে ছাড়া পেয়েছে। এতদিন লাগল সংবাদপত্রে তার উপর সংবাদ বের হতে, যার ফলে উচ্চ আদালতে তার জন্য আবেদন করা সম্ভব হল! এতদিন কেন লাগল? অনুমান করি জাহালমের ভাই শাহানূরকে যথাযথ সাংবাদিকের কাছে পৌঁছাতে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। হয়ত ধান্দাবাজ সাংবাদিক কিংবা সাংবাদিকরা তাকে ঘুরিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আবু সালেকের গাঁট থেকে আরও কিছু পয়সা খসেছে। বেচারা আবু সালেক! যে দেশের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনাকে তুচ্ছ ঘটনা হিসাবে উড়িয়ে দিতে পারেন সে দেশে আবু সালেককে সাড়ে আঠারো কোটি টাকা মারতে গিয়ে কতজনকে না ভাগ দিতে হয়েছে! শান্তিতে যে টাকাটা ভোগ করবে তারও উপায় নাই! এখন তো আরও বিপদ! আরও কতজনকে ভাগ দিতে হবে কে জানে! এ দেশে এ সব ঠিক মত করলে কিছু হয় না। তবে ব্যাপারটা বেশী চাউর বা প্রচার হওয়ায় এখন কিছু বেশী সমস্যা হলেও হতে পারে।
যাক, তবু আমি খুশী হয়েছি। একজন নির্দোষ যুবক তিন বৎসর কারাবাসের পর উচ্চ আদালত কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ হিসাবে ঘোষিত হবার পর মুক্তি পেল। হয়ত সাড়ে তিন মাস সময় একত্রে থাকার ফলে এক ধরনের আবেগগত সংশ্লিষ্টতা জন্মেছিল। সেই জন্য আমার খুশীটা একটু বেশীই।
যাইহোক, জাহালমের প্রসঙ্গ আনলাম বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের প্রকৃত চিত্রটা তুলে ধরতে। এটা যদি দানবীয় না হয় তাহলে কোনটাকে দানবীয় বলা যাবে? এবার আর একটা গল্প বলা যাক। সেটা শামসুল আলম চঞ্চলের গল্প।
(৩) শামসুল আলম চঞ্চলের গল্প
এটা মূলত আমারও গল্প বটে। কারণ গল্পের শুরুটা আমার ঘটনা দিয়ে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের ঘটনা। আমার মালিকানাধীন প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ব-দ্বীপ প্রকাশন বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গনে ফেব্রুয়ারীর মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত একুশে বই মেলায় স্টল বরাদ্দ পায়। মেলা চলার মাঝামাঝি সময়ে আমি হঠাৎ করে তীব্র অসুস্থতায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ি। এবং হঠাৎ করেই ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে ব-দ্বীপ প্রকাশন থেকে ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটা সংকলন গ্রন্থ সম্পর্কে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে বিভিন্ন ইসলামবাদী সংগঠন এবং ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা শুরু করে। খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী ছাত্র শিবির ইত্যাদি সংগঠন আমার গ্রেফতারের দাবীতে সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয় এবং ঐদিন বই মেলায় ছোটখাটো মিছিল করে। মিছিল থেকে ব-দ্বীপ প্রকাশনের স্টল পুড়িয়ে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া আমার মোবাইলে বিভিন্ন হুমকি আসতে থাকে।
আমার যে খুব ভয় ছিল তা নয়। কারণ আমি এ ধরনের হুমকি সম্পর্কে সচেতন থেকেই বই প্রকাশ করতাম। আমার মনে হত কাউকে না কাউকে সত্য প্রকাশ করতে হয়। আর সেটা করার জন্য যে সময় হওয়া দরকার সেটা হয়েছে।
যাইহোক, ব-দ্বীপ প্রকাশনের কর্মীদের কাছ থেকে বইমেলায় সমস্যা সম্পর্কে জানবার পর এবং আমার ফোনে আসা বিভিন্ন ফোন এবং ম্যাসেজ থেকে আমি সমস্যার প্রবলতা সম্পর্কে জানলাম। তখন আমার মনে হল পুলিশকে অন্তত ঘটনাটা জানিয়ে রাখা উচিত হবে। না, পুলিশের কাছ থেকে কোনও রক্ষা পাবার চিন্তা আমার মধ্যে সেভাবে ছিল না। কারণ তার আগে ইসলামী জঙ্গীদের সম্পর্কে পুলিশী কার্যক্রমে উৎসাহিত হবার কোনও কারণ ছিল না। তবে পুলিশ যাতে তাদেরকে না জানাবার জন্য আমাকে দায়ী করতে না পারে সেই জন্য আমি বইমেলা যে থানার অন্তর্ভুক্ত সেই শাহবাগ থানায় একটা জিডি করার সিদ্ধান্ত নিই।
সেই দিন সকাল বেলা পর্যন্ত আমি গুরুতর অসুস্থ ছিলাম। দুপুর থেকে একটু সুস্থ হতে থাকলেও মীরপুরে আমার বাসগৃহ থেকে দূরত্বের কারণে শাহবাগ থানায় যাওয়া আমার জন্য খুব কষ্টসাধ্য মনে হওয়ায় আমি আমার ছোটভাই শামসুল আলম চঞ্চলকে ডাকি। সে পাওয়ার প্ল্যান্ট ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে সেই সময় খুব ব্যস্ত থাকত। সে ছিল ঘোড়াশালে অবস্থিত সেই সময়ে নির্মাণধীন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহৎ পাওয়ার প্ল্যান্টের কনসাালট্যান্ট টিমের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর। তার ব্যস্ততা সহজেই ধারণা করা যায়। ফলে সে সময় দিতে চাইছিল না। কিন্তু আমার বারংবার অনুরোধে আমার লিখা এবং সই করা জিডিটা নিয়ে থানায় জমা দিতে রাজী হল।
কিন্তু পুলিশ জিডি তো নিলই না উপরন্তু তাকে গ্রেফতার করল। ঐদিন সন্ধ্যায়ই পুলিশ সদলবদলে আমার বাসস্থানে এসে আমাকে গ্রেফতার করে এবং আমার বাসগৃহ লণ্ডভণ্ড করে কম্পিউটার, মোবাইলসহ বিপুল পরিমাণ বইপত্র এবং বই নেওয়ার সুবিধার জন্য বাক্সও নিয়ে যায়। এরপর ব-দ্বীপ প্রকাশনের অফিসে আমাকে নিয়ে সেখান থেকেও বিভিন্ন লেখকের বহু সংখ্যক বই জব্দ করে এবং অফিস সিলগালা করে দেয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। যাক, আমার প্রসঙ্গ এখানে থাক।
বই মেলার কর্মীদেরকেও পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে যায়। অবশ্য বইমেলার জন্য চুক্তিভিত্তিক নারী কর্মীদেরকে পুলিশ গ্রেফতার করে নাই। আর পুরুষ কর্মীদেরকে একরাত থানা হাজতে রেখে পরদিন সকালে ছেড়ে দেয়। তবে আটক রাখল যে ছাপাখানায় বইটা ছাপা হয়েছিল সেই ছাপাখানার মালিক ফকির তসলিম উদ্দীন কাজল, আমার ছোটভাই চঞ্চল এবং আমাকে।
যদিও আমি বাকী দুইজনকেই ছেড়ে দিতে বলি তবে কে শুনে কার কথা! সবচেয়ে বিস্ময়কর হল চঞ্চলের গ্রেফতার। সে তো ব-দ্বীপ প্রকাশনের কেউ নয়। মানলাম আমার জিডি নিয়ে যাওয়ায় তার দোষ হয়েছে। কিন্তু সেই জন্য তাকে ব-দ্বীপ প্রকাশনের সেল্স এক্জিকিউটিভ বা বিপণন কর্মকর্তা হিসাবে মামলায় ফাঁসাতে হবে? শুধু তা-ই নয়, তার বিরুদ্ধে ৫৭(২) ধারায় মামলা দিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারী সকালের দিকে আদালতে তুলে কাজল এবং আমার সঙ্গে পুলিশ তার বিরুদ্ধেও রিমান্ড চাইল। মামলাটা সাইবার ক্রাইমের। সুতরাং সাইবার ট্রাইব্যুনালে আমাদেরকে তুলা হল।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল তার ব্যাপারে সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকের মন্তব্য। চঞ্চল যে ঘোড়াশাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মত নির্মাণাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত একটা বড় এবং নামকরা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একজন বিশিষ্ট ইঞ্জিনীয়ার এবং ব-দ্বীপ প্রকাশনে যে সে চাকুরী করে না ফলে এই মামলার আসামীই যে সে হতে পারে না দলিলপত্র সহকারে এই যুক্তি তুলে তার উকিল তার রিমান্ডের বিরোধিতা করলে বিচারক যে মন্তব্য করলেন সেটা আমার কাছে এখনও চমকপ্রদ মনে হয়। তিনি ছোট্ট মন্তব্য করলেন, ‘এটা ধর্মানুভূতির ব্যাপার। জামিন দেওয়া যাবে না।’ আমার পাঁচদিন, কাজলের দুই দিন আর চঞ্চলের একদিন থানায় পুলিশ হেফাজতে রিমান্ড হল। এইবার বুঝুন পাঠক! না, আমি এ প্রসঙ্গে আর কোনও মন্তব্য করব না।
চঞ্চলের মত একজন উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনীয়ারের যখন এই অবস্থা তখন জাহালমের মত মানুষদের এ দেশে কী অবস্থা হতে পারে? ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে মৌলিক চিন্তা ও লেখার জন্য আন্তর্জাতিক পণ্ডিত মহলে তার পরিচয় সম্পর্কে পুলিশ বা সরকার ও প্রশাসনের ধারণা না থাকতে পারে। তবে আমার সঙ্গে তার যৌথভাবে লিখা ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং ‘বাংলা আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র মত গবেষণামূলক দুইটি মৌলিক গ্রন্থের জন্য এ দেশের শিক্ষিত এবং ইতিহাস বোদ্ধা মহলে তার একটা পরিচিতি আছে।
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে মৌলিক কাজের বাইরেও চঞ্চলের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার জন্য বলি, সে ঢাকার মোহাম্মদপুর সরকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে। সেখান থেকে পাশ করে বুয়েটে ভর্তি হয় এবং বুয়েট থেকে পাশ করে ইঞ্জিনীয়ার হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু করে। এটা বুঝাই যায়, সে যাদের সঙ্গে লেখাপড়া করেছে তাদের অনেকে সমাজের অনেক উপরে অধিষ্ঠিত হয়েছে। একটা উদাহরণ দিতে ইচ্ছা করছে যেটা আমি জানি। বর্তমান সেনা প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ এবং চঞ্চল মোহাম্মদপুর উচ্চবিদ্যালযে একত্রে নবম এবং দশম শ্রেণীতে লেখাপড়া করেছিল। এই রকম আরও অনেকে সমাজের উপর তলায় অধিষ্ঠিত হলেও চঞ্চলকে থানায় পুলিশের কাছে আমার একটা জিডি বহনের অপরাধে শুধু রিমান্ডে যেতে হয় নাই, তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এক মাসের বেশী কাল বন্দী থাকতে হয়েছিল। এক মাস বারো দিন কারাভোগের পর সে জামিন পায়। তবে মামলা থেকে তার নিস্তার ঘটে নাই। এখনও সে আমার এবং কাজলের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারার মামলার আসামী হিসাবে আদালতে নিয়মিতভাবে হাজিরা দিয়ে চলেছে। গ্রেফতার থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যে আনুষঙ্গিক হয়রানি এবং অর্থব্যয় তার হয়েছে সে প্রসঙ্গে না-ই বা গেলাম। এ হল একদিক। অন্যদিকে, জেলে থেকে কাজে অনুপস্থিত থাকার কারণে তাকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র থেকেই বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ তাকে কর্মচ্যুতও করা হল এভাবে।
আর একটু না বললেই নয় বলে বলি। চঞ্চলকে গ্রেফতারের অল্প পরেই মীরপুর থানা থেকে একজন পুলিশ তার বাসগৃহে হাজির হয়ে তার স্ত্রীকে কায়দা করে ভয় দেখালো। অবস্থাটা চিন্তা করা যাক। একদিকে স্বামী থানায় রিমান্ডে বা জেলে। চারদিকে সন্ত্রাসের পরিবেশ। সবাই ভীত। সেই সময় তার হাতে টাকাও নাই। তবু তাকে পঁচিশ হাজার টাকা যোগাড় করে সেই টাকা দিয়ে পুলিশকে ঠাণ্ডা করতে হয়েছে। লুঠের একটা মোচ্ছব আর কী!
উপরের দুইটা ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করলাম শুধু সরকারের নয়, উপরন্তু এই রাষ্ট্রের স্বরূপ যতটা সম্ভব বুঝবার জন্য। অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ সবচেয়ে ভালো বুঝে। সেটা আমাদেরকে কী বুঝাচ্ছে? এখানে আমি দুইটি অভিজ্ঞতার কথা বললাম। বিশেষ করে জেল জীবনের অভিজ্ঞতার কথা আরও অনেক বলা যায় যেটা একটা রাষ্ট্রের আরও অমানবিক এবং ভয়াবহ চিত্রকে তুলে ধরবে। অনেকে আমাকে জেল জীবনের অভিজ্ঞতার উপর লিখতে বলেছেন। বিশেষ করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভিজ্ঞতা লিখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমি যখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারগার থেকে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হই তার অল্পদিন পরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হয়। শুনেছি নূতন কারাগারে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। যাইহোক, যা অতীত হয়ে গেছে তা নিয়ে লিখবার তেমন একটা প্রেরণা না পাওয়ায় লিখা হয় নাই। যদি কখনও উৎসাহ বোধ করি তবে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখব। এই রাষ্ট্রের চরিত্র বুঝার ব্যাপারে সেটাও যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে।
আমার আরও অনেক অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি এই রাষ্ট্রের স্বরূপ তুলে ধরার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা যারা সৎ এবং নীতিনিষ্ঠ জীবন যাপন করতে চান এই সমাজ এবং রাষ্ট্র তাদের কী ভয়াবহ প্রতিদান দেয় সে প্রসঙ্গে আমি দুই একটি গল্প বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব।
(৪) সৎ ও নীতিনিষ্ঠদের দুর্গতি
এটা অনেক দিন আগে শুনা কথা। ঢাকা বিমান বন্দরে কাস্টম্স ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ারডিং এজেন্ট হিসাবে একজন কাজ করত। তার কাছ থেকে সত্তরের দশকের শেষ দিকে অথবা ’৮০-এর একেবারে প্রথম দিকে শুনা ঘটনা এটা। ঢাকা বিমান বন্দরে একজন খুব সৎ কাস্টম্স ইন্সেপেক্টর ছিলেন। তার কারণে অন্য দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমস্যা হচ্ছিল। সুতরাং তারা তাকে চক্রান্ত করে একটা মিথ্যা দু্র্নীতির মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। যথারীতি তার চাকুরীচ্যুতি এবং বিচার হয় এবং আইনের শাসন অনুযায়ী তার সাত বৎসরের কারাদণ্ড হয়। হতে পারে বহুকাল আগে শুনা, সেই জন্য কারাদণ্ডের মেয়াদের কথা বলতে কিছু ভুল হতে পারে। হতে পারে মেয়াদটা আরও কিছু বেশী ছিল। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এ থেকে রাষ্ট্রের ভিতরের চিত্র অনেকটা বেরিয়ে আসে বৈকি! আমি যখন গল্পটা শুনি তখন সেই ভদ্রলোক জেলে ছিলেন।
আর একটা ঘটনা একজন আদ্যোপান্ত সৎ চীফ ইঞ্জিনীয়ারের পরিণতি সংক্রান্ত। ঘটনার বিবরণ শুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আহমেদ কামালের কাছ থেকে। এটিও অনেক আগে শুনা। হয়ত নব্বই দশকের ঘটনা। ভদ্রলোক ছিলেন গণ-পূর্ত তথা পাবলিক ওয়ার্ক্সের চীফ ইঞ্জিনীয়ার। তার নাম মনে নাই। যাইহোক, ডঃ কামালের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন খুব বেশী রকম সৎ। কামালের ভাষায় মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সৎ একজন কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। এই সততার পুরস্কার পেতে তার দেরী হয় নাই। বিশেষ করে পাবলিক ওয়ার্ক্সের মত জায়গায় ক্ষমতার শীর্ষে তার মত সৎ লোকের অবস্থান মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে যে কারোরই গাত্রদাহের কারণ হতে পারে। সেটাই হল। সাজানো দুর্নীতির অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল। কামালের কাছ থেকে সেই সময়কার একটি বেদনাজনক অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনেছিলাম। কামালসহ ভদ্রলোকের কয়েকজন বন্ধু চাকুরীচ্যুত ইঞ্জিনীয়ারের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার বাসগৃহের খোঁজখবর নিয়ে নিজেদের গাড়ীতে করে সেখানে যান। সেই সময় ভদ্রলোক এক বস্তির ভিতরে একটা টিনের বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। কামাল এবং অন্যরা বড় রাস্তায় কার রেখে অনেকটা নোংরা কাঁচাপথ পায়ে হেঁটে বিভিন্ন জনকে জিজ্ঞাসা করে বস্তির ভিতরকার তার সেই কাঁচাঘরে উপস্থিত হন। যতদূর মনে পড়ে কামালের বর্ণনা অনুযায়ী ঘরের মেঝে ছিল কাঁচা বা মাটির। যাইহোক, বন্ধুরা ভদ্রলোকের ঘরের সামনে এলে তাদের ডাকে ভদ্রলোক বেরিয়ে আসেন। কামালের বর্ণনা অনুযায়ী ভদ্রলোককে দেখে একজন ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ মনে হচ্ছিল। তার চুল ছিল উস্কোখুস্কো এবং দৃষ্টিতে ছিল উদ্ভ্রান্ত মানুষের ছায়া। তারা যেমন তাকে এই অবস্থায় দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন তেমন এই বিবরণ শুনে আমিও ব্যথিত হয়েছিলাম। পরবর্তী কালে সেই ভদ্রলোকের কী হয়েছিল তা আর জানি নাই।
আর একটা গল্পের কথা বলে আজকের আলোচনা শেষ করব। এটা ১৯৮২ সালের কিছু পরের সময়কার গল্প। জানি না এটা গুজব অথবা বানানো গল্প কিনা। তবু মনে হল এটা বলা উচিত। আজকের যুগে না হোক পরের যুগে পরের প্রজন্ম খুঁজে বের করতে চাইতে পারে সত্যকে। অনেক কথাই মানুষ ভুলে যায়। এ গল্পও হয়ত এতদিনে সবাই ভুলে গেছে।
যাইহোক, পল্পটা বেশ স্পর্শকাতর। তখন জেনরেল এরশাদ সেনাবাহিনীর বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সেই সময় ঢাকা বিমান বন্দরের ইন্সপেক্টরের পদমর্যাদার একজন কাস্টম্স কর্মকর্তা চোরাচালানের দুই কোটি টাকার ঘড়ি আটক করেন। আমি সেই সময় শুনেছিলাম এই অপরাধে তাকে সেনাসদস্যরা গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং বন্দী অবস্থায় প্রচণ্ড রকম অত্যাচার করে হত্যা করে। আমি শুনেছিলাম ভদ্রলোককে ভদ্রভাবে ঘড়ি ছেড়ে দিতে বললেও তিনি তা না করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। আর রাষ্ট্রের কিছু নিজস্ব নিয়ম থাকে। ফলে একবার নথিভুক্ত হলে পরে করার আর বিশেষ কিছু থাকেও না। হয়ত সেই কারণে কাস্টম্স কর্মকর্তা আর কিছু করেন নাই বা করতে পারেন নাই। যাইহোক, আমি এও শুনেছিলাম যে সেনাবাহিনীর তৎকালীন হাইকম্যান্ডের কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত ছিল। নামও শুনেছিলাম একজনের। এখন নাম মনে নাই। দুষ্ট লোকেরা এর সঙ্গে এরশাদ পত্নী রওশন এরশাদের নামও জড়িয়ে কথা বলত। এরশাদের দুর্নীতির বহু কথাই শুনেছি যেগুলি বিশ্বাস না করার কারণ নাই। তার দুর্নীতি সর্বজন বিদিতও বটে। কিন্তু তাদের নিকট যে পরিমাণটা খুব সামান্য সেই ২/১ কোটি টাকার জন্য ঘড়ি চোরাচালান করতে হবে প্রেসিডেন্ট পত্নীকে! আমার বিশ্বাস করতে সেদিন যেমন কষ্ট হয়েছিল তেমন আজও হয়। আমার কাছে এটা আজগুবি মনে হত। কারণ প্রেসিডেন্ট পত্নী অন্যভাবে অনেক সহজেই অনেক বেশী টাকা সংগ্রহ করতে পারতেন। সামান্য ২/১ কোটি টাকার জন্য তাকে চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে? তবু সে সময় বিভিন্ন জনের কাছে কথাটা শুনেছিলাম বলে এখানে তার কথা উল্লেখ করলাম। সত্য-মিথ্যা যাচাই করার সুযোগ এবং ক্ষমতা আমার কোথায়? কিন্তু যে দেশে সত্যের জায়গা নাই, তথ্য জানবার বা পাবার অধিকার বা সুযোগ নাই সে দেশে গুজবই যে সংবাদ বা তথ্যের জায়গা নিবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? গুজবের আরও কিছু বাকী আছে। সেটাও বলি।
তখন অনেককে বলাবলি করতে শুনতাম যে সেই কাস্টম্স ইন্সপেক্টরকে হত্যার পর তার মরদেহ গ্রামে কবর দিয়ে সেনাসদস্যদের দিয়ে কিছুদিন পর্যন্ত পাহারা দেওয়ানো হয়েছিল। অর্থাৎ মৃতদেহ পচে যাওয়া পর্যন্ত। উদ্দেশ্য, হত্যার চিহ্ন যাতে পাওয়া না যায়। আসলে কি তাই? মেডিক্যাল পরীক্ষায় কি শরীর পচলেই কিছু বুঝা যায় না? হয়ত সবটাই রটনা বা বানানো গল্প। হয়ত নেহাতই গালগল্প হলেও তখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে একটা মহল এ ধরনের গল্প ছড়িয়েছিল। তবে আমি মনে করি এসব রটনা বা প্রচার যা-ই হোক, এক সময় তার পিছনের সত্যটাকে বের করে আনা উচিত হবে।
একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এই আলোচনা শেষের আগে মোল্লাদের প্রসঙ্গে একটু কথা বলা উচিত মনে করছি। একটুতেই ধর্মানুভূতিতে আঘাতের জন্য মোল্লাদের কাতরতার যে উন্মত্ত প্রকাশ আমরা দেখি রাষ্ট্রের এই দানবীয় রূপের বিরুদ্ধে তাদের কি কখনও কোনও ভূমিকা কি আমরা দেখতে পেয়েছি? সুতরাং অন্যায়ের শিকার কোনও মানুষের জন্য তাদের কোনই ভূমিকা কেউই কখনও দেখতে পাবেন না। তাই জাহালমরা যখন বিপদে পড়ে তখন হয়ত কখনও এগিয়ে আসে কোনও একজন সাংবাদিক বা আর কেউ। ইসলাম রক্ষায় কাতর এইসব লোককে ন্যায় ও মানবতা রক্ষার লড়াইয়ে আমরা যে দেখি না সেটা থেকে শিক্ষার আছে।
যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে বলি উপরের গল্প কয়টা বলার উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রটা কোন অধঃপাতে গিয়ে পৌঁছেছে সেদিকে দৃষ্টিটাকে নেওয়া। অবশ্য আমার কাছে এমন আরও অনেক গল্প আছে যেগুলি আমার নিজের দেখা বা নিজ জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া শুনা গল্প তো আছেই আরও অনেক। হয়ত সময় নিয়ে এক সময়ে কিছু করে বলব সেসব। তবে আজ কথা শেষ করার আগে বলব উপরে যে সামান্য কয়টি গল্প বললাম সেগুলি কি একটা দানবীয় রাষ্ট্রের রূপকেই উপস্থিত করে না? হয়ত অনেকে বলবেন, এখনও আরও বাকী আছে, সামনে আরও দানবীয় রূপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে রাষ্ট্র আজ যেটুকু দানবীয় রূপ নিয়েছে সেটুকুই বা ভয়াবহতায় কম কী? আজও যে অতি সামান্য কিছু সংখ্যক সৎ এবং ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বা ক্ষমতায় আছেন তারাই বা কতদিন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবেন? অনেকে কোণঠাসা হয়ে কোনও রকমে টিকে আছেন। বাকীরা হাল ছেড়ে দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হয়ত স্রোতে গা ভাসিয়েছেন। কেউ হয়ত নিয়ম-নীতিনিষ্ঠ জীবন যাপন করতে চেয়ে দেশত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে হয়ত কেউ কেউ বলবেন আগেই বা কী এমন ভালো ছিল? অর্থাৎ পাকিস্তান কালে। ভালো তখনও ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রের এমন ভয়াবহ রূপ যে ছিল না সে কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। কারণ সে কালটাকে আমি ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছিলাম। যে পাকিস্তান থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি এবং যুদ্ধ আমি করেছিলাম সেই পাকিস্তানের তুলনায় আজকের রাষ্ট্রের অধঃপাত যে আমার জন্য কতটা বেদনার সেটা আমি জানি। এখন রাষ্ট্রের এই যে অধঃপাত, এই যে দানবীয় রূপ ধারণ সেটা যে একদিনে হয় নাই সে কথাও বুঝতে হবে। আর খোলা মনে আজ এ কথা মানতে হবে যে, যে দানবীয় রাষ্ট্রটাকে আমরা আজ দেখছি সেটার সূচনাটা ১৯৭২-এর একেবারে গোড়া থেকে কিংবা ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকেই। অর্থাৎ তার জন্মলগ্ন থেকেই। সুতরাং এই অধঃপাতের জন্য সবচেয়ে বড় দায় কার বা কাদের সেটা আশা করি ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না।
রচনা : ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯