লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান, আপডেটঃ February 14, 2019, 12:00 AM, Hits: 1882
প্রাককথন
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১১ বার জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে দলীয় সরকার তথা ক্ষমতাসীনদের অধীনে থেকে নির্বাচিত হয়েছে ৭টি সংসদ। এগুলো হল; প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, দশম ও একাদশ সংসদ। অপরদিকে ৫ম সংসদ কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীন, ৭ম ও ৮ম সংসদ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন এবং ৯ম সংসদ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ৭টি সংসদ নির্বাচনে প্রতিটিতেই ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হয়েছে। অপরদিকে দলীয় সরকার বহির্ভূত প্রতিটি নির্বাচনে অব্যবহিত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে।
দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। এই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১১জন সদস্যসহ সর্বমোট ২৯৩ আসনে জয়লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধে সদ্য বিজয়ী আওয়ামী লীগ তখন জনপ্রিয় দল। তথাপিও এই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। প্রশাসনিক ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার, দলীয় বাহিনীর যথেচ্ছ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ঢালাও হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটে। এমনকি কিছু আসনে ফলাফল পরিবর্তনের অভিযোগও রয়েছে। মনোনয়ন পত্র জমাদানে বাধা প্রদান, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিতে বিরোধীদের উপর চাপপ্রয়োগ, সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গুম-খুন, জাল ভোট প্রদান, ব্যালট ছিনতাই, নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেওয়া, অর্থাৎ নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সরকারি ও দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ চলা শুরু। ২য়, ও ৩য় সংসদ নির্বাচনে উপরে বর্ণিত কারচুপি বা ভোট জালিয়াতির কার্যক্রমগুলো আরও ব্যাপক মাত্রা পায়। এর সাথে যুক্ত হয় নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাব, বুথ দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরা তথা ভোট ডাকাতি, ভীতি সৃষ্টিকর সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও ভোটের বাক্স ছিনতাই এবং ক্ষমতাসীন সরকারের নিজ দলের পক্ষে ইচ্ছেমত ভোটের ফলাফল সাজানো ও প্রকাশ করা ইত্যাদি। অন্যদিকে ৪র্থ, ষষ্ঠ ও দশম সংসদ নির্বাচন ছিল একতরফা, প্রধান বিরোধী দলসহ বেশিরভাগ দল এসব নির্বাচন বর্জন করে। এগুলো ছিল প্রধানত ভোটারবিহীন নির্বাচন। বিশেষ করে ষষ্ঠ ও দশম সংসদ নির্বাচন হয় অস্বাভাবিক পরিবেশে, ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ ছিল না। ৬ষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুব কম, প্রদত্ত ভোট ছিল মাত্র ২১%। অন্যদিকে, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ফলে দেশের মোট ৯১৯৬৫৯৭৭ জন ভোটারের মধ্যে ৪৭৯২৭০৩৯ জন ভোট প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। উক্ত ৭টি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তারা দলীয় সরকারের পুতুল হিসেবে চিহ্নিত হয়।
দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে কারচুপি বা ভোট জালিয়াতি বা ভোট ডাকাতি অতীতের সকল রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। এই নির্বাচন মুলত প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন। টিআইবি ‘একাদশ সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দৈবচয়ন ভিত্তিতে তারা গবেষণার জন্য ৫০টি আসন বেছে নেয়। এর মধ্যে নির্বাচনের দিন ৪৭ আসনে কোন না কোন নির্বাচনী অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে টিআইবি। অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ৪১ আসনে জাল ভোট, ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নিরব ভূমিকা, ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল মারা, ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্য সিল মেরে জাল ভোট, ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়া ইত্যাদি। নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা পালনে তথা স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, সব দলের নির্বাচনী সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, সব দলের প্রার্থী ও নেতা কর্মীর নিরাপত্তা সমান ভাবে নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ ইত্যাদি। এবারের নির্বাচনের ভয়াবহ দিক হল : প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ, রাষ্ট্রের প্রায় সকল অঙ্গ জালিয়াতির নির্বাচনের অংশ হয়েছে যা ইতিপূর্বের কোন নির্বাচনে দেখা যায় নি। থানাগুলোতে নির্বাচন পরবর্তী ভোজের আয়োজন হতে দেখা গেছে। এ থেকে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে অনুমান করা যায় কেন্দ্রীয় পরিকল্পনায় দেশব্যাপী এই ভোট জালিয়াতি সম্পাদনের জন্য বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। আবারো প্রমাণিত হল, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয় না।
নির্বাচনী ফলাফলে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয় না
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকতে পারে না বা নির্বাচনী ফলাফলে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হয় না এটা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট। তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হল বিচারপতি আঃ রউফ এর নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এই কমিশন অস্থায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। অথচ এই কমিশনই দলীয় সরকারের অধীন পক্ষপাতিত্বের উপনির্বাচন করে এমন বদনাম কুড়ায় যে তা নির্বাচন মাগুরা স্টাইল বলে কুখ্যাতি অর্জন করে। অন্যদিকে, দলীয় সরকার বহির্ভূত সবকয়টি নির্বাচনে অব্যবহিত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয়েছে। এসব নির্বাচন যে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়েছে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে স্বক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতে সরকার গঠিত হতে পারে না – এই দিকটা আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে বাস্তবতার নিরিখে, অভিজ্ঞতার ফল হিসেবে। ফলে নির্বাচন কমিশনকে কিভাবে আরও সক্ষম ও শক্তিশালী করে তোলা যায়, কিভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা যায় এবং কি হলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে ক্ষমতা চর্চা করতে পারবে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে মোক্ষম মনে করা হয়। কিন্তু দলীয় সরকার কোন ক্ষমতা বলে নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানাতে সক্ষম হয় সেদিকটা তেমন আলোচনায় আসে নাই। এখন এদিকটায় আলো ফেলতে হবে। জালিয়াতি বা কারচুপির নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রাণ ভোমরা খুঁজে পেতে হবে। দ্বিতীয় হল নির্বাচনের পদ্ধতিগত দিক বা electoral system যার আলোচনা এদেশে খুব একটা হয় নি। বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় এমনকি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে সরকার গঠিত হবার সুযোগ কম এ বিষয়টি সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতি বিশেষজ্ঞ বা রাজনীতিবিদদের কাছে তেমন গুরুত্ব পায় নি। ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় যে নির্বাচনী ব্যবস্থা আমরা অনুসরণ করে আসছি, সেখানে কোন গলদ আছে কি না তা ভেবে দেখার সময় এসে গেছে।
বহুল আলোচ্য বিষয় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়। এদেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও রাজনীতিবিদদের অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দেখতে চান। তাদের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন হতে হবে বিতর্কের ঊর্ধ্বে, মেরুদণ্ড হতে হবে সোজা; যাতে চাপ কিম্বা হুমকির মুখেও প্রভাব মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন। তাদের আক্ষেপ, ভারতের টি এন সেশনের মত সাহসী ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন কেন সম্ভব হয় না। কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়ন করলে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হতো। কেননা, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়ন করতে হবে”। তাদের মতে নির্বাচন কমিশনে পছন্দের লোক বসাতে চায় বলেই রাজনৈতিক দলগুলো ৪৮ বছরে আইনটি প্রণয়ন করে নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন তৈরি করা হলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে কি না তা এমুহূর্তে বলার উপায় নেই। কেননা, এর বাস্তব প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। তবে পরের আলোচনায় আমরা দেখতে পাব, বিদ্যমান রাষ্ট্র সংস্কার না করে কোন ধরনের আইন প্রণয়ন করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব নয়।
মন্দের ভাল হিসেবে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান কমিটি বা সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠনের পক্ষে ওকালতি করে আসছেন। এবারের নির্বাচনে তারা নিশ্চয় এর উত্তর পেয়ে গেছেন। কেননা, বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম জালিয়াতি ও প্রতারণার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল যে নুরুল হুদা নির্বাচন কমিশনের অধীনে সেটা সার্চ কমিটির মাধ্যমেই গঠিত হয়েছে। এই নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান করে ৬ সদস্যের অনুসন্ধান বা সার্চ কমিটি গঠন করেন। কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য শিরীন আকতার। অনুসন্ধান কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নাম আহ্বান করেন। বিশিষ্ট নাগরিকেরা দলনিরপেক্ষ, সাহসী, দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করার সুপারিশ করেন। অনুসন্ধান কমিটি রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নাম পাওয়ার পর ১০ সদস্যের একটি তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতিকে প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতি এদের মধ্য থেকে বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠন করেন।
বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করে বা সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব নয় এটা স্পষ্ট। বস্তুত, এসব প্রস্তাব দেয়ার মধ্য দিয়ে তারা যা আড়ালে রাখেন বা এড়িয়ে যান তাহল বিদ্যমান একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোভিত্তিক রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সংবিধান সরকার প্রধান তথা একব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা অর্পণ করেছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী এই ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। তিনি একই সাথে দলের প্রধান ও সংসদ নেতা। বাংলাদেশে যেসব দল ক্ষমতায় গিয়েছে সেসব দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের কোন বালাই নেই। কার্যত, দলের প্রধানের হাতে দলের সকল ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। আবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের কোন সাংবিধানিক সুযোগ নেই। সংবিধানের ৭০ ধারা সংসদ সদস্যদের মুখ বন্ধে কাজ করছে। অর্থাৎ সরকার প্রধানের ইচ্ছেমত সংসদে আইন প্রণীত হয়। সংবিধানের ১৪২ ধারা বলে সংসদকে (কার্যত প্রধানমন্ত্রীকে) জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করার অধিকারসহ যে কোন আইন প্রণয়নের অধিকার দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সকল রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত। যদিও বাহ্যত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিয়ে থাকেন, প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সংবিধান বা শাসনতন্ত্রের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কোন পরামর্শ দিয়েছেন কি না, তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। সংবিধানের ১১৮(৫) ধারা বলছে, “সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে কর্মের শর্তাবলী রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন সেইরূপ হইবে; তবে শর্ত থাকে যে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকেরা যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোন নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না”। অর্থাৎ কার্যত অসীম ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশন গঠন ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল হতে বাধ্য। তাই সংবিধান তথা রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো সংস্কার না করে দলীয় সরকারের অধীনে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন আশা করা অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। এই একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা মানে আরও সুচারুভাবে ভোট ডাকাতির নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষমতা প্রদান।
সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় নির্বাচনী ব্যবস্থা বা electoral system
বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তকগণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আলোচনার এজেণ্ডা করলেও নির্বাচনী ব্যবস্থা তাদের কোন মনোযোগ লাভ করে নি। অথচ এদেশের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের যুগান্তকারী রায় দিয়ে আসছেন। এই ভূখণ্ডের জনগণ ২টি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, ২ বার স্বাধীনতা এনেছেন। এই দুটো পরিবর্তনে নির্বাচন নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। এর একটি হল, ১৯৪৬ সালের নির্বাচন এবং অন্যটি ১৯৭০ সালের নির্বাচন। তবে এই দু’টি নির্বাচনই ছিল গণপরিষদ নির্বাচন।
নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা না হওয়ার একটি ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার সূত্রপাত ব্রিটিশদের হাতে, ভারতবর্ষের পরাধীনতার কালে। ভারতীয় উপমহাদেশের শাসনব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বংশবদ শ্রেণি ও নেতৃত্ব গড়ে তোলা, তাদের পেছনে জনসমর্থনকে তথাকথিত নিয়মতান্ত্রিকতায় আটকে রাখা, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার দাবীতে যারা সশস্ত্র লড়াই গড়ে তোলার পক্ষে তাদের মোকাবেলা করা – এরকম বিবিধ কারণে ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী এদেশে প্রথমে স্থানীয় শাসকদের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে।
সশস্ত্র সংগ্রামের ধারাকে মোকাবেলা করা, এবং ব্রিটিশদের অনুগতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য অথচ তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার কৌশল হিসেবে ব্রিটিশরা নির্বাচনকে ব্যবহার করায় এদেশের আপসহীন সংগ্রামীদের কাছে খোদ নির্বাচনী ব্যবস্থাটিই একটি নেতিবাচক বিষয় হয়ে ওঠে এবং এই নেতিবাচক ধারণার সাথে মার্কসবাদীদের ‘বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিপ্লবের তত্ত্ব’ যোগ হওয়ায় এ প্রবণতা এমন মাত্রায় বৃদ্ধি পায়, যাতে খোদ নির্বাচনই এদেশে বিপ্লবী ঘরানার অনেকের কাছে বিরোধিতার বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে এরা নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি, অগণতান্ত্রিকতা ইত্যাদি পর্যালোচনার প্রয়োজন বোধ করেন নি। স্বাভাবিকভাবে এর ফল হয়েছে মারাত্মক। ব্যবস্থা হিসেবে বিদ্যমান নির্বাচন পদ্ধতির যতটুকু সুফল তার সবটুকুই একচ্ছত্র ভোগ করেছে এখানকার শাসকগোষ্ঠী, কখনো নির্বাচন করে, কখনো না করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের নির্বাচনী ব্যবস্থা
নির্বাচনী ব্যবস্থা হল একগুচ্ছ আইনের সমষ্টি যা বিভিন্ন নির্বাচন ও গণভোট কি প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে এবং তার ফলাফল কিভাবে প্রকাশিত হবে তা নির্ধারণ করে। নির্বাচন রাজনৈতিক হতে পারে যেমন রাষ্ট্রপতি বা সংসদ সদস্য নির্বাচন, তেমনি অরাজনৈতিক হতে পারে যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন। কোন নির্বাচন একজন বিজয়ীর জন্য অনুষ্ঠিত হয় যেমন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, আবার কোন নির্বাচন বহু বিজয়ীর জন্য প্রযোজ্য যেমন সংসদ নির্বাচন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এই দু’ধরনের ভোটে বিশ্বে নির্বাচন হচ্ছে, তবে বেশিরভাগ রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই নিবন্ধে শুধুমাত্র পপুলার ভোটে তথা জনগণের সরাসরি ভোটে সংসদ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনী ব্যবস্থা আবার বৈচিত্র্যে ভরা। দেশে দেশে একই নির্বাচনী ব্যবস্থার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সংখ্যার বিচারে অর্থাৎ বেশি রাষ্ট্র অনুসরণ করছে মোটা দাগে এমন তিন ধরনের নির্বাচনী ব্যবস্থা উল্লেখ করা যায়, যথাঃ ১. নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, ২. সংখ্যানুপাতিক বা দলকেন্দ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা ও ৩. মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা।
১. একজন সদস্যের জন্য একটি নির্বাচনী এলাকা (Single-member constituencies) বা বিজয়ী দল সব পুরস্কার পাবে ব্যবস্থা (Winner–take-all system):
এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচনী আসন এলাকায় বিভক্ত করা হয়। প্রার্থীরা একটি নির্দিষ্ট আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। নির্দিষ্ট আসনের নির্বাচকমণ্ডলী ঐ আসন থেকে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী তথা একজন ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে থাকে। অর্থাৎ এটি ব্যক্তি নির্বাচন করার ব্যবস্থা।
নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে আবার প্রধান দুইভাগে ভাগ করা যায়, এক –সবচেয়ে বেশি প্রাপ্ত ভোট ব্যবস্থা বা সবচেয়ে বেশি ভোটে বিজয়ী ব্যবস্থা (Plurality system), দুই– সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট বিজয়ী ব্যবস্থা (Majoritarian system).
এক. Plurality system বা First-Past-the-Post পদ্ধতি - এই ভোট ব্যবস্থায় একটি আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন (ভোটের পরিমাণ যত কমই হোক না কেন), অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি এগিয়ে থাকেন তিনি ঐ আসনের জন্য নির্বাচিত ঘোষিত হন। তার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের রায়ের প্রয়োজন পড়ে না। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৪২টি রাষ্ট্রে এই ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাভুটি হয়ে থাকে। এর বেশিরভাগ রাষ্ট্রই একসময় ব্রিটিশ বা আমেরিকান উপনিবেশ ছিল।
Plurality system বা First-Past-the-Post পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল সংসদে সকল নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। এমন কি প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের প্রতিনিধিত্বও থাকে না। এতে তিন বা ততোধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে একজন প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের ৫০% শতাংশের বেশি ভোট তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় না পেয়েও নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ধরা যাক মোট প্রদত্ত ভোট ১০০ এবং তিনজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে প্রথমজন পেলেন ৪০ ভোট, দ্বিতীয় জন পেলেন ৩৫ ভোট এবং তৃতীয়জন পেলেন ২৫ ভোট। এক্ষেত্রে যিনি সর্বাধিক সংখ্যক অর্থাৎ ৪০ ভোট পেয়েছেন তিনি বিজয়ী হন। এর মানে ঐ আসনের সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের (৪০%) রায়ে তিনি নির্বাচিত হলেন। কেননা, বাকি দুইজনের প্রাপ্ত মোট ভোট হল ৬০ (৩৫+২৫) অর্থাৎ ৬০% যা বিজয়ী প্রার্থীর থেকে অনেক বেশি। একইভাবে এই ব্যবস্থায়, মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকেরও কম ভোটে তথা সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিকের রায়ে সরকার গঠিত হতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে কম বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্বাচনের একটি হল ১৯৯১ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে সরকার গড়ে বিএনপি। তারা আসন পায় ১৪০টি। অথচ প্রায় ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ৮৮টি। পাকিস্তানের উদাহরণও ভিন্ন নয়। পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবে বিতর্ক নেই। এই নির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআই ভোট পেয়েছে ৩২ শতাংশ। কিন্তু তারা আসনের ৪৩ ভাগ অর্থাৎ ১১৬টি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী পিপিপি ও মুসলিম লীগ পিটিআইয়ের চেয়ে ৬ ভাগ বেশি ভোট পেলেও ৯টি আসন কম পেয়েছে। হিসাবে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন ভোটারের মধ্যে ৪ জনেরও কম ইমরানের প্রার্থীদের পছন্দ করেছে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার পিটিআই বিরোধীদের ভোট দিয়েছে। অর্থাৎ ইমরানের সরকার সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিক সমর্থিত সরকার। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের দাবীদার ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গড়েছে। অনেকগুলো দল নিয়ে তাদের যে জোট সেটা ভোট পেয়েছে মোট ৩৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৬২ ভাগ ভোটার তাদের বিপক্ষে ছিল। এসব তথ্য থেকে আমরা দেখতে পাই, এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় নিয়ে সরকার নাও গঠিত হতে পারে। তেমনি এই ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট আসনের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জনমতের এধরনের অন্যায্য প্রতিফলন ঘটতে পারে। অথচ গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতে সরকার গঠন করার কথা।
দুই. Majoritarian system –এটিও নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা। তবে এই ব্যবস্থায় একজন প্রার্থীকে জয়ী হতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় নিশ্চিত করতে হয়। এ ব্যবস্থায়ও বৈচিত্র্য রয়েছে, বিভিন্ন মডেল দেখা যায়। যেমন, প্রথম রাউন্ড নির্বাচনে একটি আসনের কোন প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে পুনরায় নির্বাচন সংগঠিত করা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম রাউন্ডএ সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ২ জন প্রার্থীকে দ্বিতীয় রাউন্ডএ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয়া হয়। অর্থাৎ দ্দ্বিতীয় রাউন্ডএ ফয়সালা হয়ে যায়। আবার এ ব্যবস্থায় অন্যভাবেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কেউ যদি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পান, তাহলে যে প্রার্থী সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছেন তাঁকে বাদ দিয়ে পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এবারও কোন একজন প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে সর্বনিম্ন ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকে বাদ দিয়ে পুনরায় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। এভাবে কোন একজন প্রার্থীর ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন চলতে থাকে। আবার কিছু রাষ্ট্র preferential instant-run off voting পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচন করে থাকে। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার দুইয়ের অধিক প্রার্থীদের মধ্য থেকে ২ জনকে ভোট প্রদান করতে পারবে। একজন প্রথম পছন্দ, আরেকজন দ্বিতীয় পছন্দ। প্রার্থীদের প্রথম পছন্দের প্রদত্ত ভোট গণনা হবে। এতে কোন প্রার্থী ৫০%-এর বেশি ভোট না পেলে সবচেয়ে কম ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীর দ্বিতীয় পছন্দের ভোট ওই প্রার্থীর প্রাপ্ত ভোটের সাথে যোগ করা হবে। এতেও কোন প্রার্থী ৫০% ভাগের বেশি ভোট না পেলে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন প্রার্থীকে দেয় দ্বিতীয় পছন্দের ভোট একইভাবে যোগ করা হবে। এবং কোন প্রার্থীর ৫০% এর বেশি ভোট না হওয়া চলতে থাকবে। এ পদ্ধতিতে দ্বিতীয় নির্বাচন এড়ানো যায়। সাধারণত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে Majoritarian system এর প্রয়োগ বেশি দেখা যায়। ব্যাপক সংখ্যক প্রার্থী নির্বাচনে এ ব্যবস্থার প্রয়োগ ব্যয়বহুল,জটিল এবং কষ্টসাধ্য। তাই সংসদ সদস্য নির্বাচনে Majoritarian system এর প্রয়োগ কম দেখা যায়। বর্তমানে ২০টি রাষ্ট্র দুই রাউন্ড Majoritarian system-এ আইন প্রণেতা নির্বাচন করে থাকে।
Majoritarian system-এ সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ও সরকার গঠন সম্ভব হয়। তবে এ ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল সংসদে সকল নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। অর্থাৎ অন্য প্রার্থীদের পক্ষে ভোট প্রদানকারী নাগরিকদের রাষ্ট্র পরিচালনায় (প্রতিনিধির মাধ্যমে সংসদীয় কার্যক্রমে শরিক হয়ে) অংশগ্রহণ থাকে না।
২. সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থাঃ
এই ব্যবস্থায় কোন দল নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পেল, তার ভিত্তিতে সংসদে তার আসন ও অবস্থান নির্ধারিত হয়। নির্বাচকমণ্ডলী কোন ব্যক্তিকে নয়, দলকে ভোট প্রদান করে থাকে। তাই এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি বিশেষ নয়, দলকেই নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারাদেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায় আনুপাতিক হারে পার্লামেন্টে সে পরিমাণ আসন সে দলের হিসসায় যায়। অন্ততপক্ষে একটি আসন পেতে যে পরিমাণ ভোটের প্রয়োজন হয় সে পরিমাণ ভোট না পেলে ঐ দলকে আসন বণ্টনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এভাবে আসন বণ্টনের পর যে দল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পায় সে দলকে সরকার গঠনের অনুরোধ জানানো হয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম আসন সংখ্যার অধিকারী দল সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। তবে সরকার গঠন করতে সর্বাধিক সংখ্যক আসন প্রাপ্ত দলকে কমপক্ষে ৫১% আসন লাভ করতে হয়। এমন সংখ্যক আসন না পেলে সর্বাধিক সংখ্যক আসন প্রাপ্ত দলকে নিকটতম সমমনাদের সাথে কোয়ালিশন বা জোট করে সরকার গঠন করতে হয়। নির্বাচনের আগে অংশগ্রহণকারী দলকে গলাবদ্ধ খামে তাদের মনোনীত বা বাছাই করা ব্যক্তিদের তালিকা নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। অবশ্য কোন কোন দেশে তালিকা প্রকাশ্য থাকে। নির্বাচনে একটি দল যতসংখ্যক আসন লাভ করে, ঐ দলের তালিকার প্রথম থেকে ক্রম অনুসারে ততসংখ্যক ব্যক্তিকে সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ পদ্ধতিও দুইভাবে বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়। এক. পুরো দেশকে একক ইউনিট হিসাবে ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। সারাদেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায় আনুপাতিক হারে পার্লামেন্টে সে পরিমাণ আসন সে দলের হিসসায় যায়। দুই. সারা দেশকে কতগুলো বৃহৎ নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়। অর্থাৎ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকা নিয়ে বড় নির্বাচনী এলাকা গঠন করা হয়। প্রতিটি এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো স্বতন্ত্রভাবে ঐ এলাকার জন্য প্রার্থীর তালিকা ঠিক করে থাকে। ঐ এলাকার ভোট গণনায় যে দল যে সংখ্যক ভোট পায় আনুপাতিক হারে পার্লামেন্টে সে পরিমাণ আসন সে দলের হিসসায় যায়। সকল এলাকার প্রার্থী যোগ করে একটি দলের মোট প্রার্থী সংখ্যা নির্ধারিত হয়। আমাদের পাশের দেশ শ্রীলংকায় এধরনের সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শ্রীলংকার মডেলে প্রত্যেক নির্বাচনী জেলায় থাকে একাধিক সদস্য বাছাইয়ের সুযোগ। কোন জেলায় কতজন সংসদ সদস্য থাকবে সেটা নির্ধারণ করা আছে। জনসংখ্যা অনুপাতে সংসদ সদস্য ৪ থেকে ১৯ জন পর্যন্ত হয়ে থাকে। অবশ্য সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বের লক্ষ্যে শ্রীলংকার জাতীয় নির্বাচনে দুই স্তরের আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোট ২২৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৯৬ জন ২২টি নির্বাচনী জেলা থেকে নির্বাচিত হন। বাকি ২৯ আসন সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। জার্মানি, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসসহ ৮৯ দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে। এরমধ্যে ৮০টি দেশে তালিকাভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা বিদ্যমান।
৩. মিশ্র পদ্ধতি
এতে সংসদ সদস্যদের একাংশ এক সদস্যের জন্য এক নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিভিত্তিক, অপরাংশ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ভোটারদের একইসাথে দুটি ভোট প্রদান করতে হয়। ভোটার এক ভোট দেয় নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীকে, এক ভোট দেয় দলকে। নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক প্রাপ্ত আসন এবং আনুপাতিক হারে প্রাপ্ত আসন মিলে একটি দলের প্রাপ্ত মোট আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন প্রাপ্ত দল সরকার গঠন করে। আবার দুই কক্ষের পার্লামেন্ট রয়েছে এমন রাষ্ট্রের এক কক্ষে নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিভিত্তিক এবং অন্য কক্ষে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর ৩৪টি দেশে মিশ্র পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের পাশের দেশ নেপালে এমন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘প্রতিনিধি সভা’র ২৭৫ সদস্যের মধ্যে ১৬৫জন ১৬৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে বাংলাদেশের মতই নির্বাচিত হয়ে থাকে। এসময় পুরো দেশকে একটি আসন ধরে দলগুলোর নামেও ভোট হয়। দলগুলোর ভোটের হিস্যা থেকে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি সভার বাকি ১১০ জন সদস্য নির্বাচিত হয়। এভাবেই গঠিত হয় ২৭৫ আসনের প্রতিনিধি সভা যেখানে প্রত্যেক দলকে এক তৃতীয়াংশ নারী আসন দ্বারা পূরণ করতে হয়। আবার বিভিন্ন জন জাতির প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজ-এর র্যাঙ্কিং অনুসারে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে স্বীকৃত উত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ৩৫টি যেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট গঠিত হয়ে থাকে। এরমধ্যে ২২টি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা, ৭টি মিশ্র পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থা এবং ৬টিতে Winner–take-all system এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যত অতিকথা
বাংলাদেশে ৩৩০ সদস্যের এককক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত আছে। এর মধ্যে ৩০০ আসন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং ৩০টি সংরক্ষিত নারী আসন। এখানে Plurality system বা First Past the Post পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রচলিত প্রধান প্রধান অতিকথাগুলো হল;
১. সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে সরকার গঠিত হয়।
২. জনগণ তাদের প্রতিনিধি মনোনীত করার অধিকার ভোগ করেন।
৩. সরকার জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকে কারণ ৫ বছর পর তাদের পুনরায় জনগণের রায় নিতে হয়।
প্রকৃত পক্ষে উপরে প্রচারিত ধারণাগুলো হয় অসত্য অথবা অর্ধসত্য বা মিথ্যা। প্রকৃত সত্য হল, এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে একজন প্রার্থী নির্বাচিত হবে বা সরকার গঠিত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে এ চিত্রই বেরিয়ে আসে। যেমন;
অতিকথা একঃ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে সরকার গঠিত হয়
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে কম বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনস্থ তিনটি নির্বাচন। এগুলো হল যথাক্রমে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে সরকার গড়ে বিএনপি। তারা আসন পায় ১৪০টি। অথচ প্রায় ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ৮৮টি। যদি ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হতো তাহলে বিএনপি আসন পেত ৯৩টি, আওয়ামী লীগ পেত ৯৬টি। ১ শতাংশ বেশি ভোট পাওয়ার পরেও আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে ৫২টি আসন কম পেয়েছিল। তেমনি ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে ৪০.২১% ভোটে পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় মাত্র ৬২টি বা ২১% আসন। আর বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫.১৫% ভোটে পেয়ে আসন পেয়েছে ২০৮টি অর্থাৎ ৬৯%। এই নির্বাচনে মাত্র ৪.৯৪% বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসনের চেয়ে ১৪৬টি বেশি অর্থাৎ ২৩৫% বেশি আসন পায় বিএনপি-জামায়াত জোট। এসময় বিএনপি এককভাবে ভোট পেয়েছিল ৪১ শতাংশ এবং আসন পায় ১৯৩টি। ১ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েও বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগ ১৩১টি আসন কম পায়।
আবার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪% ভোট পেয়েছিল, আর আসনের সংখ্যা ছিল ১৪৬টি। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ১১৬টি। ভোটের ব্যবধান ৩.৮%। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে ৩০টি আসন বেশি লাভ করে। তেমনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯% ভোট পেয়েছিল, তার প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল ২৩০টি। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.২% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০টি। ভোটের ব্যবধান প্রায় ১৬%। অথচ আসনের ব্যবধান ২০০টি।
বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রে এইরূপ বঞ্চনা আরও মারাত্মক। যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৪.২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াত ১৭টি আসন পায়। কিন্তু জাতীয় পার্টি ৭.২৬ শতাংশ ভোট পেয়েও আসন লাভ করে ১৪টি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ঐ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন পেত ২২টি। ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আরেক ছোট দল সিপিবি ১ লক্ষ ১৯ হাজার ভোট পেয়ে কোন আসন লাভ করেনি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সিপিবি ১টি আসন লাভ করতে পারত। ভোটের আনুপাতিক হারে আসন দেয়া হলে অন্যান্য ছোট দলগুলোরও আসন পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ছোট দলগুলো আরও বেশি ভোট পাবে। কেননা প্রার্থী না থাকার কারণে অনেক আসনেই তাদের সমর্থকদের ভোট বড় দলগুলো পেয়ে থাকে।
তাই বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় বা সরকার গঠিত হয় বলে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে তার মধ্যে বড় ধরনের একটি ভাওতাবাজি রয়েছে। আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখনই বলা যাবে যখন ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৫১ জন কারো পক্ষে থাকবে বা সমর্থন করবে। তেমনি প্রদত্ত ভোট ১০০% ধরে সরকার গঠনে কমপক্ষে ৫১% ভোট পেতে হবে, উপরের বিশ্লেষণে দেখা গেল সরকার গঠন করা দলগুলো এই পরিমাণ ভোট পায় নি।
অতিকথা দুইঃ জনগণ তাদের প্রতিনিধি মনোনীত করার অধিকার ভোগ করেন
বাংলাদেশের সংসদ সদস্যগণ জনগণের প্রতিনিধি নন, তিনি দলীয় প্রধিনিধি। বিদ্যমান আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কোন সংসদ সদস্যই আর জনগণের প্রতিনিধি থাকতে পারেন না। দলের (বড় দলগুলোর ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে দলের প্রধানের) সিদ্ধান্তের বা স্বার্থের বাইরে জনগণের কিংবা তার নির্বাচক মণ্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না। কারণ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সংসদ সদস্য যদি তার নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়, তাহলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। এমন কি ভোটাভোটির সময় সংসদে অনুপস্থিত থাকলেও বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন বলে ধরে নেয়া হবে। অর্থাৎ সংসদে সংসদ সদস্যরা কলাগাছ হিসেবে থাকবেন এবং দল যা বলবে সে অনুযায়ী তিনি হ্যাঁ বা না বলবেন। যদিও সংসদের আলোচনায়, বিতর্কে একজন সংসদ সদস্য তাঁর দলকে নয়, যাদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের প্রতিনিধিত্ব করার কথা।
অতিকথা তিনঃ সরকার জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকে কারণ ৫ বছর পর তাদের পুনরায় জনগণের রায় নিতে হয়
বিদ্যমান আইন ও সংবিধান অনুযায়ী সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী কারো কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না। এতে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের জনগণের নিকট জবাবদিহির কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নি। মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যগণ সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর নিকট দায়বদ্ধ থাকেন। তিনি রাষ্ট্রপতির ঊর্ধ্বে বিরাজ করেন। সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার প্রধানকে অভিশংসন করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে সরকার প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রিকে অভিশংসন করার বিধান নেই। প্রতি ৫ বছর পর পর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় নেয়ার যে বিধান সংবিধানে রয়েছে সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্য সরকারে আসীনরা জনগণের মাঝে কৃত্রিম বিরোধ, বিভ্রান্তি ও বিভক্তি তৈরিতে সচেষ্ট থাকেন। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার উচ্চ পদস্থদের অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগদানের বিনিময়ে সেই সব সংস্থাকে জনগণ ও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে দমন ও নিশ্চিহ্ন করার অন্যায় কাজে ব্যবহার করেন। বস্তুত বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় জনগণ হল শুধু একদিনের বাদশাহ। ভোটের দিন জনগণ রাজা আর বাকি সব দিন তাদের নামে জনপ্রতিনিধিরা দেশ চালায়। অবশ্য বাংলাদেশের অনেক নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না অর্থাৎ ভোটারবিহীন নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়। এদেশে অনেকগুলো নির্বাচনের উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে ভোটারের উপস্থিতি খুব কম ছিল বা ভোটারদের ভোট দেবার সুযোগ দেয়া হয় নি। অর্থাৎ ৫ বছর পর নির্বাচনের আয়োজন করা হয় জনগণের রায় নেয়ার জন্য নয়, নিয়ম রক্ষার জন্য। বস্তুত, নির্বাচনের নামে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া হয়, প্রতারণা করা হয়।
বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থার বিবিধ কুফল
শুধুমাত্র সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণের রায়ে সরকার গঠন যে হয় তা নয়, উপরন্তু আমাদের মতো দেশে বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার বিবিধ কুফল দৃশ্যমান। যথাঃ
১. সবচেয়ে বেশি ভোটে বিজয়ী ব্যবস্থায় ভোটারদের মধ্যে সামান্য পরিবর্তন হলে ফলাফলে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। একটি আসনে জয়লাভ করতে ৫ থেকে ১০ হাজার জাল ভোট যথেষ্ট। তাই এই ব্যবস্থা ভোটের দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। এ জালিয়াতির একটি বড় কারণ হল, যেনতেন প্রকারে যদি এক ভোটেও তাদের মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করা সম্ভব হয়, তাহলে তাদের পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হয়। একবার সরকার গঠিত হলে জাল-জালিয়াতির অভিযোগ চাপা পড়ে যায়। নির্বাচনী মামলার পদ্ধতি জটিল এবং এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া ৫ বছরের মধ্যে সম্ভব হয় না। সুতরাং জালিয়াতি করে মনোনীত প্রার্থীকে নির্বাচিত করা গেলে সহজেই ৫ বছর সরকার পরিচালনা সম্ভব হয়। সরকার পরিচালনায় এত লাভ হয় যে সব দলই জালিয়াতির মাধ্যমে দলের প্রার্থীদের নির্বাচিত করতে উৎসাহিত হয়। এজন্য এরা গণপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুক্ষিগত করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়। জেতার জন্য সবধরনের অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না। অপরদিকে জালিয়াতির নির্বাচনে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। ফলে এলাকায় অপরিচিত কালো টাকার মালিক দুর্নীতিপরায়ণ আমলা–ব্যবসায়ীদের দলের নমিনেশন পেতে এবং সংসদ সদস্য হতে বাধা থাকে না। তাই সৎ, যোগ্য ও পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদদের দলের নমিনেশন ও সংসদ সদস্য হওয়া দুরুহ হয়ে পড়ে। এভাবে গড়ে উঠেছে চর দখলের মত জালিয়াতি নির্বাচনের রাজনীতি। যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ভোটে নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই প্রবণতা কমার সম্ভাবনা কম।
২. এই নির্বাচনী ব্যবস্থার আরেকটি কুফল হল; দলের কর্মসূচি নয়, নির্বাচনী মেনিফেস্ট নয়, উন্নয়ন কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করা হয়। একজন সংসদ সদস্যের কাজ শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করা, উন্নয়ন কাজ নয়- তা আড়াল করা সম্ভব হয়। যেহেতু এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় সাংসদ একটি বিশেষ ভৌগোলিক এলাকা থেকে নির্বাচিত হন, সেহেতু তাঁকে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। নির্বাচন কালে যেমন উন্নয়ন কাজের প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, তেমনি নির্বাচিত হয়ে নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন কাজে ভূমিকা রাখতে হয়। এর ফলে স্থানীয় সরকারের কাজকর্মে তাঁকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তাই সাধারণত আসনভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার দুর্বল হয়ে যায়। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার দুর্বল থাকার অন্যতম একটি কারণ বিদ্যমান সবচেয়ে বেশি ভোটে বিজয়ী নির্বাচনী ব্যবস্থা। উন্নয়ন কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেই তারা ক্ষমতায় গিয়ে নিজের নির্বাচনী এলাকাকে নিজের খাস তালুক বা জমিদারী মনে করার পরিবেশ খুঁজে পায়।
৩. ফরাসি সমাজ বিজ্ঞানী দুবার্গার বলেন, যেখানে একটি ভোট বেশি পেলে আসন লাভ করা যায়, সেখানে প্রতিযোগিতা প্রধানত দুটি প্রধান দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। দেশ পরিচালনায় ক্ষুদ্র দলগুলোর ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশেও নির্বাচনী প্রতিযোগিতা দুটি দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। আমাদের দেশের জনগণের মনে ভোট নষ্ট বা পচে যাওয়ার একটি ধারণা বিরাজ করছে। তারা মনে করে, যে প্রার্থী জিতবে না, তাকে ভোট প্রদান মানে ভোট নষ্ট করা। এ ধারণা থেকে তারা সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকে। ফলে প্রধান দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দল একজন অযোগ্যকেও প্রার্থী করলে তাঁর জেতার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ এরা কলাগাছ দাঁড় করালেও জিতে থাকে। ফলে এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় সৎ ও যোগ্য রাজনীতিবিদদের ভূমিকা রাখার সুযোগ কমে যায়।
৪. সংঘাতের রাজনীতি এদেশের রাজনীতির বিশেষ দিক যার শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। সংঘাতের রাজনীতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। বংশগত রাজনীতির দ্বন্দ্বের জন্য সংঘাতের রাজনীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় যেখানে নির্বাচনে জয়-পরাজয় একমাত্র বিষয় হয়ে আছে সেখানে তা দলগুলোর ভেতর বৈরী সম্পর্ক গড়ে তোলার ভূমিকা পালন করছে। বিবদমান দলগুলোর নেতাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। এই পরিস্থিতি হিংসাত্মক কার্যকলাপকে উৎসাহিত করছে। এই সংঘাতের রাজনীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দুই বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে লেনদেনের প্রয়োজন রয়েছে যা বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় সম্ভব নয়।
৫. আমাদের দেশ বিভিন্ন প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে আছে যা রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথে অন্যতম বাধা। এ জন্য বলা হয় বাংলাদেশে রাষ্ট্র গঠন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। রাজনৈতিক কারণে এখানে বিরাজ করছে মানুষে মানুষে বৈরী সম্পর্ক। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা এই বিভক্তিকে উস্কে দিয়ে থাকে, অন্তত বিভক্তি ঘোচাতে সাহায্য করে না। তাই এমন নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে সবদল বিজয়ী হবে। আবার রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল নাগরিকের অংশগ্রহণ থাকবে, নাগরিকদের মধ্যেকার বিভক্তি লোপ পাবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথ খুলে যাবে।
৬. এই ব্যবস্থায় সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ক্ষুদ্র জাতি সত্তার নির্বাচিত প্রতিনিধিত্ব থাকার সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে যায়। ধরা যাক, একটি দেশে ৫ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। যদি তারা সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, তাহলে তাদের ভোট নির্বাচনের ওপর আদৌ কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে তারা ৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব পাবে। একই কথা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বস্তুত সবচেয়ে বেশি ভোটে বিজয়ী ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংসদে প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা সহজ বা স্বাভাবিক নয়।
বিভক্তি ঘুচিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা
জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলনে সংসদ ও সরকার গঠনে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। তেমনি বিভক্তি ঘুচিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিও সচেতন নাগরিকদের মনোবেদনার কারণ হয়ে উঠেছে। অনেকে মনে করছেন এমন একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রয়োজন যে ব্যবস্থায় সবাই বিজয়ী হবেন, তাহলে বৈরী সম্পর্ক বিকাশের পরিবেশ থাকবে না। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে কিছু ছোট দল, রাজনৈতিক গ্রুপ এবং ব্যক্তি বিকল্প হিসেবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। একারণে মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থা এখনও আলোচনায় তেমনভাবে উঠে আসে নি যতটা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে হচ্ছে। সংসদ সদস্য নির্বাচনে Majoritarian system প্রয়োগ জটিল, ব্যয়বহুল এবং বাস্তবসম্মত নয়। তাই এ ব্যবস্থা আলোচনায় আসেনি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলো নিম্নরূপঃ
প্রথমত, সাধারণ জাল-জালিয়াতির প্রবণতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি আসন লাভ করার জন্য প্রায় ৩ লক্ষ ভোট জাল করতে হবে। সুতরাং সাধারণ জাল-জালিয়াতি নয়, ভোট ডাকাতি করতে হবে। আবার কারো জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা না থাকাতে সম্ভাব্য সংসদ সদস্যের নির্দিষ্ট কোন এলাকায় জাল-জালিয়াতি করার বৈষয়িক শর্ত থাকে না। তাই এ ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে সাধারণ জাল-জালিয়াতি অনেক কমে যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে দলগুলো আনুপাতিক হারে আসন লাভ করে এবং আইনসভায় সকল ভোটারের প্রতিনিধিত্ব থাকে। ফলে এব্যবস্থায় কেউ হারে না, সবাই বিজয়ী হয়। আবার আনুপাতিক হারে নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ে। কোয়ালিশন সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য দলগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে হয়, সংঘাতের বদলে সমঝোতার পথ খুঁজতে হয়। তাই বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে রাজনৈতিক সংঘাত হ্রাস পাবে বা কমে যাবে। দেশ সংঘাতের রাজনীতির দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। বিভক্তির রাজনীতির অবসানের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যের পরিবেশ গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পথ খুলে যাবে।
তৃতীয়ত, ছোট ছোট দলের নির্বাচনে আসন লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। ছোট ও বিকাশমান দল সরকারে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তেমনি সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতি সত্তার প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়। সংসদে সকল ধারার রাজনীতির মিথষ্ক্রিয়ার সুযোগ ঘটে। সুতরাং, এ ব্যবস্থায় দেশের সকল জনগোষ্ঠীর মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ও মূল্যায়ন ঘটে। তাই নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলোর দেশের সকল জনগোষ্ঠীর প্রতি অধিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। ফলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়।
চতুর্থত, সংসদ সদস্যদের কাজ আইন প্রণয়ন, নীতিমালা বা পরিকল্পনা প্রণয়ন; এলাকার উন্নয়ন কাজে হস্তক্ষেপ নয়। এলাকার উন্নয়ন কাজ করার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে এলাকার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়ার সুযোগ কমে যায়, তাই সাংসদগণের আইন প্রণয়নকে মুখ্য কাজ হিসেবে বেছে নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ফলে সুস্থ রাজনীতি বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
পঞ্চমত, ব্যক্তি, নেতা ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে যৌথ নেতৃত্বের চর্চা ও গুরুত্ব বাড়বে। প্রকৃত ও যোগ্য রাজনীতিবিদ আইনসভার সদস্য হতে পারবে।প্রকৃত অর্থে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা হবে।
ষষ্ঠত, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সকল ভোটের মূল্যায়ন হয়, ভোট পচা বা নষ্ট হবার সুযোগ থাকে না। আসনভিত্তিক ব্যবস্থার মত ব্যক্তির জয়-পরাজয় মুখ্য থাকে না। ভোটারগণ উন্নয়নের ফুলঝুরি নয়, দলের কর্মসূচি বুঝে ভোট দানে উৎসাহী হবেন। ফলে রাজনীতি হবে জনমুখি, কর্মসূচিকেন্দ্রিক। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছে কি না এর উপরে সরকারের জনপ্রিয়তার বিচার হবে।
শেষের কথা
বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে পড়েছে। এগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করার বিন্দুমাত্র সামর্থ্য রাখে না। অথচ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারলে গণক্ষমতাতন্ত্র তথা প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তেমনি, রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের (শাসন, আইন ও বিচার বিভাগ) ভেতর ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে একজনের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করা আছে, তাঁকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে। এই ক্ষমতা কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার থেকে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা দুরূহ। এই ক্ষমতা কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে কোন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার অর্থ ওই একব্যক্তিক ক্ষমতা কাঠামোকে শক্তিশালী করা। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার করেও ঈপ্সিত ফল লাভ আশা করা যাবে না যদি না গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়। কোন নির্বাচনী ব্যবস্থাতেই ভোট ডাকাতি রোধ করা বা জনমতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব নয় যদি না বিদ্যমান একব্যক্তিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন সম্ভব হয়। সুতরাং বাংলাদেশের অগ্রসর রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য হতে হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সংবিধান সভা বা গণপরিষদ নির্বাচন।