লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ March 17, 2019, 12:00 AM, Hits: 1500
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির ও প্রহসনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার টানা তৃতীয় দফা ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট ছিনতাই করে নিয়েছে। এবারের নির্বাচনে ভোট ডাকাতির কাজে শুধু তার দল বা জোট নয়, এতে সরাসরি অংশ নিয়েছে সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রশাসন, যারা শেখ হাসিনার সরকারকে আদাজল খেয়ে জিতিয়ে এনেছে। এখানে দল (আওয়ামীলীগ, ১৪ দল ও মহাজোট) সরকার এবং রাষ্ট্র অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার একাকার। ভোট ডাকাতি আর নির্লজ্জ প্রহসনের এমন নির্বাচন বাংলাদেশের কেন, পাকিস্তান কালপর্বের ইতিহাসে আর কখনো সংঘটিত হয়নি। এই ভোট ডাকাতির দায় কোনো ক্রমেই এড়াতে পারে না এই রাষ্ট্র প্রশাসন। বিরোধী দলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের জোর করে ঘরে আটকে রাখা আর বের হলেই তার ওপর ক্ষমতাসীন দলের ও একই সঙ্গে প্রশাসনের হামলার এমন নির্লজ্জ নজির আগে কখনো দেখা যায়নি। গুটিকয়েক সরকার সমর্থক ও বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট, ১৪দল ভুক্ত সুবিধাভোগী নেতাকর্মী ছাড়া কেউ ওই নির্বাচনকে সমর্থন করেনি। এই সরকার গায়ের জোরে জিতেছে, পাশাপাশি হারিয়ে ফেলেছে ক্ষমতায় থাকার নৈতিক বৈধতা।
নির্বাচনের নামে প্রহসন ও ভোট ডাকাতির সংস্কৃতি এখন ষোলকলায় পূর্ণ হয়েছে। এখন সুষ্ঠু নির্বাচনতো দূরের কথা, মানুষের ভোট দেওয়ারই অধিকারটুকুও অবশিষ্ট নাই। সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে, নির্বাচন মানেই প্রহসন, নির্বাচন মানেই প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ভোট ডাকাতি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব নয়, শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে আরো সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সকল পথ বন্ধ। নির্বাচনের নামে প্রহসনের এবং ধোকা দেওয়ার আয়োজনে মানুষের আস্থার অবশেষটুকুও নাই। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে, শাসকশ্রেণি যাদের চাইবে আর ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের ‘আর্শিবাদ’ যারা অর্জন করবেন তারাই নির্বাচিত হবেন। এটাই নির্বাচিত হওয়ার শর্ত। কারণ জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে কিংবা কোনো দিনই সে অধিকার ছিল না।
বাংলাদেশে অতীতের কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। একানব্বয়ের নির্বাচন আপেক্ষিকভাবে অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে সুষ্ঠু হয়েছিল, কারণ ওই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল গণঅভ্যৃত্থানের পটভূমে। এরপর এদেশে কোনো দিনই স্বাভাবিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি।
ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে ১৯৯২-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এতে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং যতটুকু বাকি ছিল সেটা আওয়ামী লীগ নিজেই হরণ করে নিয়েছে।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে পেশী শক্তির প্রয়োগ করা হয়েছিল। তখন কুমিল্লার মুরাদনগরে সম্ভব্য বিজয়ী প্রার্থী ছিলেন জাসদের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদ। ওই আসনের ব্যালট বাক্স নিরাপত্তার নামে হেলিকপ্টারে করে বঙ্গভবনে এনে গণনা করা করে খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে জিতিয়ে আনা হয়েছিল। সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও হ্যাঁ/না ভোটও নেওয়া হয়েছিল। সেখানেও ছিল সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য। স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে তৃতীয়, চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছিল টাউট-বাটপারদের জিতিয়ে আনার পদক্ষেপ। ১৯৯৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিরপুরে একটি আসনে এবং ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরার একটি আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জোর করে হারিয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ। এ কারণে ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত মিলে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানায় এবং তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এজন্য ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত হরতাল হয় ৪১৬ দিন। সেই দাবি মেনে খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২২ জুন এক সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন সম্পর্কে ‘পুকুর চুরি’র অভিযোগ তোলেন। এরপর ২০০১ সালের ২ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়, তখন ‘স্থূল কারচুপির’ অভিযোগ তুলে শেখ হাসিনা সেই নির্বাচন প্রত্যাখান করেন।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না, এমন অভিযোগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ভোটারবিহীন নির্বাচনে একতরফা ভাবে প্রায় সকল আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। টানা তৃতীয় দফায় (২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর) জোর-জবরদস্তি করে ভোট নিয়ে ক্ষমতায় আসে। অর্থাৎ এদেশে সকল নির্বাচনের ব্যাপারেই ঘোরতর আপত্তি জানায় বুর্জোয়াদের নানা অংশ। বর্তমান স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান ও অগণতান্ত্রিক আইনকানুনের বদৌলতেই এরকম জোর-জবরদস্তির নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকার পাকা ব্যবস্থা করতে পারে শাসক শ্রেণির দলগুলো। বর্তমানে টানা তৃতীয় দফায় আসা বর্তমান সরকার সভা-সমাবেশ ও কথা বলার অধিকার পুরোপুরি রুদ্ধ করে দিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে জারি করা হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক আইন। সব মিলে একটি ফ্যাসিবাদ জগদ্দল পাথরের মত পাকা হয়ে বসে আছে জাতির কাঁধে। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে জাতি মুক্তি চায়।
এমন পরিস্থিতি কি নতুন? না এই পরিস্থিতি নতুন নয়, তবে আগের চেয়ে আরো ঘনীভূত। আমাদের মতে বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট এতটাই ঘনীভূত হয়েছে যে, তাকে আর স্বাভাবিক পথে জারি রাখা সম্ভব হচ্ছে না, বরং তাকে জারি রাখতে চরম ফ্যাসীবাদী দমননীতির পথ গ্রহণ করছে শাসক বুর্জোয়াশ্রেণির দলগুলো। সেই সংকট কেন এত তীব্র আকার ধারণ করল? কারণ জনগণ আর এই শোষণ ও লুণ্ঠনমূলক শাসনব্যবস্থা মেনে নিচ্ছে না। আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি দেশ কখনো এমন ফ্যাসীবাদী শাসন মেনে নেবে না। জনগণ এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি? আমরা মনে করি, জনগণের নীরব ক্ষোভ সরব হয়ে ওঠার ভাষা পেলেই সেই সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ বের হতে পারে। এই সংকট কি শুধু নির্বাচন কেন্দ্রিক? হ্যাঁ, নির্বাচনকেন্দ্রিক তো বটেই, তবে এটা মূলত শোষণমূলক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যবস্থা জারি রাখার সঙ্কট। নির্বাচনী ব্যবস্থা হল এই সঙ্কটের একটা দিক। এরসঙ্গে শোষণ-লুণ্ঠন, অর্থ পাচার, বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি ও অনিয়মের গভীর যোগ রয়েছে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণ শাসক শ্রেণির সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। বরং শোষণমূলক ও লুণ্ঠনমূলক এই শাসন ব্যবস্থা উচ্ছেদের ভিতর এই সঙ্কটের সমাধান নিহিত রয়েছে। সেই সমাধানের ওপর নির্ভর করে অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
আমাদের মতে, এই সংকটের কারণ নিহিত রয়েছে এই উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে। আর রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভুত প্রকাশ ঘটে সংবিধানের মাধ্যমে। এই সংবিধানের বলেই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার বদলে, গণতন্ত্রের নামে এই শাসকেরা গড়ে তুলেছে স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণ রোধ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধান ও বাঁচার মত মজুরি নিশ্চিত করতে এই রাষ্ট্র অক্ষম। মালিকরা শ্রমিকদের বঞ্চিত করলে এই রাষ্ট্র নীরব থাকে, আর এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বললেই শ্রমিকদের ওপর নেমে আসে রাষ্ট্রের নির্যাতন। এই রাষ্ট্রের আইন কখনোই শ্রমিকদের পক্ষে নয়। এই সংবিধান হচ্ছে বৈষম্য ও স্বৈরতন্ত্রের সুতিকাগার।
সুতরাং এই সংবিধানের প্রশ্নটি বিবেচনার বাইরে রেখে দেশের এই সঙ্কটের সমাধান করা সম্ভব নয়। এই সংবিধান জারি রেখে সুষ্ঠু ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ বিশেষত শ্রমজীবী নর-নারীর পক্ষে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা ও নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। এই সংবিধানের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ ও অর্থ পাচার সম্ভব। শোষণ-লুটপাট, চুরি-দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনুমোদিত।
বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের পুনরুজ্জীবন। ফলে যে কাজটি উপনিবেশিক শাসকেরা করত বাইরে থেকে এসে, একই কাজ দেশের ভেতর থেকে করছে দেশীয় শাসকেরা। উপনিবেশিক শাসক ও দেশীয় জনগণ যেমন ছিল মুখোমুখি, তেমনি বর্তমানের শাসক ও জনগণও মুখোমুখি, পরস্পরের প্রতিপক্ষ। বিশেষত শ্রমজীবী নরনারীর সরাসরি শত্রুশিবিরে অবস্থান নিয়েছে এই রাষ্ট্র ও সরকার। জনগণকে প্রতিপক্ষ শিবিরে রেখে এই শাসকশ্রেণি মূলত আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন নির্ভর, পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্ভর এবং দলের মাস্তান নির্ভর হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। জনগণ তাদের প্রতিপক্ষ। যে বৈশিষ্ট্য ছিল উপনিবেশিক শাসকদের। তাই তখন উপনিবেশিক শাসকদের যে দৃষ্টিতে দেখা হত, বর্তমানের দেশীয় শাসকদেরও একই কারণে একই দৃষ্টিতে দেখার দায় পড়ে গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। এই দায় সাধারণ মানুষ যত উপলব্ধি করবে, দেশের মেহনতীদের রাজনীতি ততই এগিয়ে যাবে।
এই সঙ্কটের সমাধান হিসেবে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে ইতিমধ্যেই ‘বাম ঐক্য ফ্রন্ট’ সংবিধান সভার নির্বাচনের রাজনীতি হাজির করেছে। সম্প্রতি নির্বাচনের পর সেই রাজনৈতিক লাইন আরো তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।
আমাদের দাবি অনুযায়ী, আন্দোলনকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হতে পারে বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকার সংবিধান সভার নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অতীতের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচির ভিত্তিতে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। তার আগে বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে কাজগুলো করবে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি নির্বাচনের মাধ্যমে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই সংবিধান হল স্বৈরতন্ত্রের জননী। যে স্বৈরতন্ত্র ফ্যাসীবাদে রূপ নিয়েছে। এখনো বামপন্থী বলে পরিচিত একটি মহলে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে মোহ রয়েছে। সেই কারণে এই সংবিধানের অধীনে শুধু যে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অসম্ভব, তাই নয় এই সংবিধানের মাধ্যমে কীভাবে আমাদের জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও অর্থ পাচার অনুমোদিত হচ্ছে, বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে, তার সংক্ষিপ্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
অর্থ পাচার ও জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন
ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ উৎস পটনায়েক সম্প্রতি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রেসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে সরাসরি বলেছেন, ব্রিটিশরা এই দুই শতাব্দীতে ভারতীয়দের শোষণ করে ৪৫ ট্রিলিয়ন (৪৫ লাখ কোটি) মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ লোপাট করেছিলেন। এই অর্থ বাংলাদেশের বর্তমান বাজেটের ৯০০ গুণ। ব্রিটিশরা যে এত অর্থ লুটে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা বেআইনি পথে নেয়নি। নিয়েছিল আইনি পথেই। অর্থাৎ লুটপাটকেই আইনি বৈধতা দিয়ে এমন পুকুর চুরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবে আইনি পথেই শুধু পুকুর চুরি নয় ভারতবর্ষের মহাসাগরটিই চুরি করে নিয়েছিল এই সাদা সাহেবরা। ওই লুণ্ঠনমূলক আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা ও সমীহ করার মনোভাবের কারণেই, ব্রিটিশদের সেই লুটপাটের বৈধতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল লুটপাটের একটি জনসম্মতি।
“বাহাত্তরের সংবিধানের একাদশ ভাগে অর্থাৎ একেবারে শেষ দিকে একটি প্রায় অনুল্লেখ্য অনুচ্ছেদ হলো ১৪৯, যাতে বলা হয়েছে- ‘এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকরীতা অব্যাহত থাকিবে, তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে।’
‘প্রচলিত আইন’র অর্থ হল, এই সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা এর অংশ বিশেষে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সক্রিয় থাকুক বা না থাকুক, এমন যে কোনো আইন। অর্থাৎ সংবিধানটি গৃহীত হওয়ার পূর্বে যা ছিলো, সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরও তাই আছে- অর্থাৎ পাকিস্তানী আমলে যে সব আইন, বিধি-বিধান জারী ছিলো, যা ছিলো ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত- তাই দুই দুইবার স্বাধীনতার পরও দাড়ি, কমা সমেত বাংলাদেশে জারী রাখা হলো। একাত্তরে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে একটা উপনিবেশিক আইনের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হল স্বাধীনতাবিরোধী পদক্ষেপ। যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন ও রাজাকারদের ক্ষমা করে দেওয়ার চেয়েও সেটা ঘৃণিত অপরাধ। পাকিস্তানের সামরিক, বেসামরিক আমলা নির্ভর উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই লড়াই করে, তাকে পরাস্ত করে, আবার সেই পাকিস্তানী রাষ্ট্রকেই কার্বন কপি করে বাহাত্তরের সংবিধানে খাড়া করা হল। সেই আইনের পুনরুজ্জীবনের ফলে বাংলাদেশেও দেদারসে চলছে অর্থ পাচার। আওয়ামী লীগ সরকারের গত দুই টার্মের শাসনামলে, অর্থাৎ গত ১০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সুইস ব্যাংক, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজে এর রিপোর্টে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সংস্থাটির আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (দেশীয় মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবেই পাচার হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া চলছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই।
আইন প্রণয়ন ও অর্থ সংক্রান্ত পদ্ধতির বিধান নির্ধারিত করা আছে অনুচ্ছেদ ৮০-৯২ এ। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮১ অনুযায়ী কর আরোপ, নিয়ন্ত্রণ, রদবদল, মওকুফ, সরকার কর্তৃক ঋণ গ্রহণ, গ্যারান্টিদান কিংবা সরকারের আর্থিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত আইন সংশোধন ইত্যকার যাবতীয় বিল অর্থবিলের আওতাভুক্ত করা হয়েছে। সহজভাবে বললে রাষ্ট্র কিভাবে, কার কাছ থেকে কত টাকা আদায় করে, কার জন্য কত টাকা খরচ করবে, তা নির্ধারণের জন্য যে বিল আনা হয় তাকে অর্থ বিল বলা হয়। সংবিধানের ৮৩ নং অনুচ্ছেদ যদিও সংসদ সদস্য কর্তৃক পাশকৃত আইনের অনুমোদন ছাড়া এ কাজটি করার ক্ষমতা কাউকে দেয়নি কিন্তু অনুচ্ছেদ ৮১(৩) অনুযায়ী স্পীকার কোনো বিলকে অর্থ বিল হিসাবে সার্টিফিকেট দেওয়ার পর এ বিষয় চূড়ান্ত এবং এ সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। রাষ্ট্রের অর্থ যে কোন ভাবে খরচ করলে, আত্মসাৎ করলে, লুণ্ঠন করলেও তার বৈধতার এক চমৎকার আইনী প্রক্রিয়া।
’৭২ এর সংবিধানে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সীমার মধ্যে অবস্থিত সকল প্রকার খনিজ ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীর উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা’ ঘোষণা করা হয়েছে ১৪৩ নং অনুচ্ছেদে এবং পরবর্তী অনুচ্ছেদ অর্থাৎ ১৪৪ অনুচ্ছেদে সরকারকে বিভিন্ন প্রকার কারবার বা ব্যবসা পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণ করেছে এবং অনুচ্ছেদ ১৪৫-এ প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্বে বিভিন্ন চুক্তি বা দলিল করার ক্ষমতা অর্পণ করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে কোনো অনুচ্ছেদ যুক্ত করেনি। কোনো চুক্তি, হোক তা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক তা সম্পাদনের পূর্বে বা পরে জনগণের কোনো মতামত গ্রহণের জন্য কোনভাবেই জনগণের কাছে বা তার প্রতিনিধির কাছে উপস্থাপনের কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। সেজন্য ’৭২ এর সংবিধান অনুযায়ী তেল-গ্যাস-কয়লা রপ্তানি, অন্য কোনো রাষ্ট্রের সাথে কোনো প্রকার চুক্তি, হোক তা ট্রানজিট বা করিডোর, কোনো কিছুর জন্যই চুক্তির আগে বা পরে তা কোথাও আলোচনার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই।
এই সংবিধান অনুযায়ী ব্যাংক-বীমা লুটপাট করা যায়, লুটপাটকৃত অর্থের উৎস না জানিয়েই বিনিয়োগ করা যায়। সংবিধান অনুযায়ীই যেমন বিনা বিচারে খুন করা যায়, সংবিধান অনুযায়ী তেমন বিনা বিচারে আটক রেখে নির্যাতন করা যায়। তেমনি যত খুশি লুটপাট করে অর্থ সম্পদের মালিক হওয়া যায় (অনু: ৪২) এর সকল কিছুর পক্ষে আইন তৈরি করাই আছে, আর না থাকলে ইচ্ছা করলেই তৈরি করা যায়। ’৭২ এর সংবিধান কোনভাবেই তার প্রতিবন্ধক নয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অনুমোদন
২০১৮ সালের জানুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত এই পাঁচ মাসে বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছে ২২২ জন। এরমধ্যে র্যাবের হাতে ৬৪ জন এবং পুলিশের হাতে ১৩৯ জন। এছাড়া বিজিবি’র হাতে একজন, কোস্টগার্ডের হাতে দুইজন এবং ডিবি পুলিশের হাতে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এভাবে ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছরে মোট বিচার বর্হিভূত হত্যার শিকার হয়েছে ৩ হাজার ২০৯ জন। এসব হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২-এ বলা হয়েছে- ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ তার অর্থ দাঁড়ায়- আইনের মাধ্যমে ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করা যাবে না, অর্থাৎ আইন নির্ধারিত পদ্ধতিতে তা করা যাবে। অর্থাৎ আইনের মাধ্যমে একজনকে হত্যা করা যাবে। এভাবেই ‘ক্রসফায়ার’ এর মতো বর্বর ব্যবস্থাটিও সংবিধানসম্মত হয়ে রয়েছে। কারণ দেখানো যায় ‘ক্রসফায়ার’ও আইনসম্মত। এর ফলে প্রতিপক্ষকে হত্যা করা যায়, বিরোধীদের মত প্রকাশকে বড় ধরণের ঝুঁকির মধ্যে রেখে দেওয়া সম্ভব হয় এই সংবিধান অনুযায়ী। সরকার পুরাদস্তর স্বৈরশাসন হওয়ার উপাদান এসব আইনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে এ যাবৎ হত্যা করা হয়েছে, সিরাজ সিকদার, মোফাখখার চৌধুরী, ডা. টুটুল সহ অসংখ্য কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের।
এই পদ্ধতিতে ১৮৯৮ সালের ব্রিটিশ প্রবর্তিত ফৌজদারী কার্যবিধি বা সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইন তার ৪৬ ধারা অনুযায়ী বিচারে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে এমন অভিযোগে অভিযুক্ত আসামীকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে ছাড়া পুলিশ কাউকে হত্যা করতে পারবে না। তবে এমন কোন ঘটনা ঘটলে ১৮৬১ সালে প্রবর্তিত পি.আর.বি-এর ১৫৭ নং রেজুলেশন অনুযায়ী একটি প্রশাসনিক তদন্তে গুলি ছোঁড়ার ঘটনাটিকে লঁংঃরভরবফ করলেই হত্যাকাণ্ডটি আইন অনুযায়ী হয়ে যায়। সেই জন্য পুলিশের/র্যাবের গুলিতে নিহত প্রত্যেককে সন্ত্রাসী ও খুনের মামলার আসামী হতে হয়। এভাবে প্রতিপক্ষকে দমন করার আইনি বৈধতা দেয় সংবিধান। ফলে বাংলাদেশের সংবিধান দেশের সরকারকে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার হওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।
প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা
সংবিধানের ১ম ভাগের অনুচ্ছেদ ৭-এ পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’। কিন্তু বাক্যটি একটি সেমিকোলন (;) চিহ্ন দিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘এই ক্ষমতা কেবল সংবিধানের অধীনে ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে’। সংবিধানের ৪র্থ ভাগের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। অর্থাৎ সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যে সকল ক্ষমতা দিয়েছে বলে প্রাথমিক পাঠে মনে হয় তার কোনটাই তার এখতিয়ারাধীন নয়, সবই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োগ করতে বাধ্য। বিচারপতি বা নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ, যে কোন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর দণ্ড মওকুফ, কোনো কিছুই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতীত করার ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ-প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি নিজে কোন সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নেবেন সেই ক্ষমতা সংবিধান তাকে দেয়নি। যদি প্রধানমন্ত্রীর কোনো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড বা পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক নির্ণয়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কিংবা বাংলাদেশের সংবিধানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হয় তাহলে তার বিচার কে করবে? এই বিচারের সুযোগ আমাদের সংবিধানে নেই। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ইমপিচ বা অভিশংসন করা যায়। আর আমাদের আছে এমন সংবিধান যাতে প্রধানমন্ত্রীকে ইমপিচ করা দূরে থাক সাংবিধানকিভাবে তার কাছে জবাবদিহিতা চাইবার ও আদায় করবার কোন সুযোগ নেই, ব্যবস্থাও নেই।
সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী করেছে (অনু: ৫৫), মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী নিয়োগ ও নিয়োগের অবসান ঘটানোর এখতিয়ারও সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকেই দিয়েছে [অনু: ৫৬(১) ও ৫৮(২)]। মন্ত্রীসভাকে যদিও যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ করা হয়েছে [অনু: ৫৫(৩)], কিন্তু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ [(১) কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে] উল্টো সংসদকে দলের কাছে জিম্মি করে দিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী যদি দলীয় প্রধান হন তবে সংবিধান তার কাছে যে ক্ষমতা অর্পণ করেছে তা মিশরের ফারাওদের জন্যও ঈর্ষণীয়। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে উচ্চকণ্ঠে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিকানা জনগণের বলে ঘোষণা করলেও তা ভোগ করার সকল ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।
এই সংবিধান প্রণয়নের অথরিটি নিয়ে আগেও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল এবং বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল, এখনো সেই প্রশ্ন খারিজ হয়ে যায়নি। তারপরে ১৭ বার সংশোধনী এনে ৭২’এর সংবিধানকে চরম স্বৈরতন্ত্রী রূপ দেওয়া হয়েছে।
এই মুহূর্তে আমাদের আশু দাবি
১ ভোট ডাকাতির একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাতিল কর। ২. স্বৈরতন্ত্রের সুতিকাগার, ব্যক্তিমালিকানা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অর্থপাচারের অনুমোদনদানকারী শোষণমুলক-লুণ্ঠনমূলক বর্তমান সংবিধান বাতিল কর। ৩. বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিক সংবিধান সভার নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ কর। ৪. রাষ্ট্রীয় দমন পীড়ন হত্যা গুম বন্ধ কর, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত কর।
বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ হবে
ক. শিল্প কারখানা গড়ে তোলা। বন্ধ কারখানা চালু করা। বৃহৎ কারখানা, বৃহৎ ব্যবসা, ব্যাংক, বিমা, জাতীয়করণ করা। জমি জাতীয়করণ করা, যৌথ সমবায় গঠন করে কৃষকের কাছে জমি লিজ প্রদান, কৃষি ও শিল্প মজুরের সঙ্গতিশীল মজুরি, সকল হাতে কাজের ব্যবস্থা গ্রহণ, সর্বোচ্চ ও সর্বনিন্ম বেতন ক্রমান্বয়ে সমান সমান করার পদক্ষেপ গ্রহণ।
খ. যুদ্ধাপরাধীদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, তাদের ভোটাধিকার বাতিল ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ ও জনগণের সম্পদ আত্মসাৎকারী রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এনজিও লর্ড ও ধর্মীয় পীরদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, তাদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, ভোটাধিকার বাতিল ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা।
গ. ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ, নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, সকল জাতির ভাষার সম অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সকল অসম চুক্তি বাতিল ও তাদের সকল পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা, পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা, কোরবানীর চামড়া, ফেৎরা, ধর্মীয় অনুদান ও জাকাতের অর্থ জমা রাখার জন্য জাকাত ফান্ড গঠন করা, সেই অর্থ ভিক্ষুক পতিতা হিজড়া ও নদী ভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত হওয়াদের কর্মসংস্থান, চিকিৎসা ও পুর্নবাসনে ব্যয় করা।
ঘ. বাহাত্তর থেকে এ যাবৎ যারা বিচার বহির্ভূত হত্যার ও গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। নিখোঁজদের উদ্ধার করে তাদের স্বজনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ওই সব হত্যা ও গুমের বিচারকাজ শুরু করা। সামরিক বাহিনীতে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য হত্যার ঘটনায় বিচারকাজ শুরু করা।
ঙ. সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবি দাওয়া সমূহ, যেমন স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার, তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর, সুন্দরবন ও খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি দাওয়া সমূহ বাস্তবায়নে সুনিদ্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ।
চ. ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সকল গোপন চুক্তি প্রকাশ করা, চিকফা সহ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অমর্যাদাকর চুক্তি বাতিল করা, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া, সীমান্ত হত্যা ও চোরাচালান, বিশেষত মাদক চোরাচালান বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, সৌদি যুদ্ধ জোট থেকে বেরিয়ে আসার পদক্ষেপ গ্রহণ।
ছ. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বাণিজ্যিকরণ বন্ধ করা, নামে মাত্র মূল্যে চাষীদের কৃষি উপকরণ প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা।