লিখেছেনঃ ডঃ লেনিন আজাদ, আপডেটঃ May 18, 2019, 12:00 AM, Hits: 869
বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাসে যা কিছু ঘটেছে তার মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এমন একটি মাইল ফলক হিসাবে পরিগণিত হতে পারে যা গোটা জাতির চিন্তা-ভাবনার জগতে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। ভাষা আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির পর ৪৫ বছর কেটে গেছে, কিন্তু এখনও তা কোন কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে নি। এ কথা সত্যি যে, মাঝখানে বাংলাদেশ নামে একটি খণ্ডিত জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে যে কোটি কোটি বাঙ্গালী বসবাস করছেন তাদের কাছে এ আন্দোলনের তাৎপর্য সামান্যই। একমাত্র পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে এ ব্যাপারে কিছু উচ্ছ্বাস আছে, কিন্তু ভাষার দাবীতে এ দেশে যে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচিত হয়েছিল সে ইতিহাসের অংশীদার কিংবা ধারক হিসাবে এরা কেউ কখনও তেমন এগিয়ে আসে নি।
’৪৭ সালের দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতির এক বিশাল ভূখণ্ডকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে একটি অংশকে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের অধীনস্থ করা হয়, বাকী অংশকে ভারতের কয়েকটি প্রদেশের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত করা হয়। এভাবে একটি বিশাল জাতিকে বিপন্ন করা হলেও এর কোন কার্যকর প্রতিবাদ সেদিন ওঠে নি। পশ্চিম বাংলাসহ সকল অঞ্চলের বাঙ্গালীরা নতুন শাসকের অধীনস্থ হয়ে আশু সমস্যার মীমাংসার জন্যে তৎপর হয়ে উঠেছে। পিছন দিকে ফিরে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করা ছাড়া কেউ তেমন কিছু করে নি। পূর্ব বাংলার জনসাধারণ ছিল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাদের ভাষার ওপর আক্রমণ এলে তারা ফুঁসে উঠেছিল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, ঘটিয়েছিল গণ-অভ্যুত্থান। কিন্তু যে জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এই ব্যাপক বিদ্রোহ তা কতটুকু সফল হয়েছিল সে প্রশ্ন এখন নির্বিঘ্নে করা যায়।
বাঙ্গালী জাতির অন্যতম প্রধান অংশ আজ বাংলাদেশে বাস করে। বেশ কিছু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ এ দেশে বাস করলেও এখানকার শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ মানুষ বাঙ্গালী। ফলে বাঙ্গালী জাতির বিপন্ন অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য যদি কোন আন্দোলনের প্রয়োজন হয় তাহলে সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার প্রধান দায়িত্বই হল এখানকার জনসাধারণের। অতীতে তারা তার প্রমাণও রেখেছেন। ভাষা আন্দোলনের মত একটি মহান জাতীয় আন্দোলনের রূপকার তারাই। কিন্তু সে আন্দোলন মসৃণ কোন পথ বেয়ে আগায় নি। বার বার এসেছে সংকট। সাম্প্রদায়িকতাসহ নানা ধরনের প্রশ্ন এসে সে সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে। বাঙ্গালীর জাতীয় প্রশ্নটি বার বার ধর্মীয় প্রশ্ন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে, কিন্তু বার বারই তার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত জাতীয় প্রশ্নটিকে অমীমাংসিত রেখে একটি ভুল ধারণাকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আর সে বিভ্রান্তির কারণেই এখনও পর্যন্ত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ধারণা নানা ধরনের সংকটে নিমজ্জিত। সে যাহোক, বিষয়টি নানা ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত। সে সকল বিষয়কে স্থগিত রেখে আপাতত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও তার অন্তর্গত সংকট সম্পর্কে আলোচনা করাই হবে এ প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য।
বাঙ্গালী জাতির জন্য এটা বড় বেদনাময় অধ্যায় যে, ১৯৪৭ সালে যখন বাঙ্গালী জাতিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হচ্ছে তখন কয়েকজন বাঙ্গালী অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও সে পরিকল্পনাকে বাঙ্গালী জনসাধারণের কোন অংশ তেমন সমর্থন করে নি। অবিভক্ত ভারতের ্লোগানের সমর্থকদের অনেকে এ ্লোগান পর্যন্ত দিয়েছে, ভারতকে ভাগ করা না হলেও বাংলাকে বিভক্ত করতে হবে। অবশ্য এর পটভূমি রচনা করেছিলেন অখণ্ড বাংলার অন্যতম প্রবক্তা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজেই। কেননা অখণ্ড বাংলার প্রধান মন্ত্রী থাকা কালে কলকাতা নগরে যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল তার জন্য ইতিহাস তাঁকেই দায়ী করে। এছাড়াও, পাকিস্তানের দাবীতে সারা ভারতবর্ষের যারা আন্দোলন করছিলেন তাদের সবাইকে একটিমাত্র রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যিনি প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তিনি স্বয়ং সোহরাওয়ার্দী। ফলে শরৎ বসু, আবুল হাসিম প্রমুখ প্রভাবশালী বাঙ্গালী নেতৃবৃন্দ এ আন্দোলনের সাথে থাকলেও তা জনসাধারণকে আকর্ষণ করতে পারে নি। পৃথিবীর অন্যতম একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মাতৃভূমি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, তাতেও কারোর প্রাণে কোন বেদনা নেই। কি অসম্ভব বাস্তবতা! অথচ মাত্র তিন যুগ আগেই বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের বৃহৎ অংশ দেশব্যাপী এক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলে বঙ্গভঙ্গকে রোধ করেছিল।
বৃটিশরা তাদের ‘বিভক্ত কর এবং শাসন কর’ নীতির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত ক’রে পূর্ব বঙ্গ ও আসামকে নিয়ে এক নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠা করে। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের অবিরত আন্দোলনমুখী কর্মকাণ্ড ও বৃটিশ রাজকে চ্যালেঞ্জ করার শাস্তি স্বরূপ ইংরেজরা এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নতুন প্রদেশের রাজধানী ঢাকা ও বিকল্প রাজধানী চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করার ফলে কলকাতাকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের রমরমা অবস্থার সামনে এক মহা বিপর্যয় নেমে আসে। পূর্ব বাংলার মুসলমান জমিদাররা এ ব্যবস্থাকে সানন্দে গ্রহণ করে। তারা পূর্ব বঙ্গের ব্যাপক মুসলমান সমাজকে ভিন্ন ধারায় সংগঠিত করার লক্ষ্যে মুসলমানদের মুখপাত্র হিসাবে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯০৬ সালে সমগ্র ভারতবর্ষ ভিত্তিক মুসলমানদের স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয় এবং তা ঢাকাতে বসেই। এই প্রথম ভারতবর্ষের নাগরিকদের সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত করার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক উদ্যোগ সম্পন্ন হল।
ভারতবর্ষের রাজধানী শহর কলকাতার মধ্যবিত্তরা কিন্তু বাংলা বিভক্তির বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে নি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রচণ্ডভাবে এর বিরোধিতা করেন। সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্যাপকভাবে কবিতা, গল্প, নাটক লিখে কিংবা গান গেয়ে ও নাটক মঞ্চস্থ করে এ কথাই স্পষ্ট করে তুলে ধরেন যে, বাংলা নামের ‘মা’কে কি নিষ্ঠুরভাবে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে। সম্ভবত এ সময়ই ভাষা আন্দোলনপূর্ব সময়ে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় হৃদয়কে স্পর্শ করার মত বাংলা ও বাঙ্গালীর স্তুতিসমৃদ্ধ সাহিত্য রচিত হয়। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে সশস্ত্র রূপ ধারণ করলে কিছু তরুণকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর সে সাহসী সন্তানদের বীরত্বগাথা ও আত্মত্যাগের মহত্ত্ব যখন কবিতার ভাষায় আর গানের সুরে দীপ্তিময় হয়ে ওঠে তখন এর আবেদনকে আর কোন বাঙ্গালী অস্বীকার করতে পারে নি। সে সময়ের দু’একটি গান এখনও পর্যন্ত সমগ্র বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর কাছে প্রচণ্ড জনপ্রিয় গান হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে। সে আন্দোলনকে কি সংখ্যায় মানুষ সমর্থন করেছিল কিংবা কোন অঞ্চলের মানুষ সমর্থন করেছিল সে প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে, তবে সেই বঙ্গবঙ্গ বিরোধী আন্দোলনই ছিল আসলে সমগ্র বাঙ্গালীর জাতীয় ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি জাতীয় আন্দোলন। আর সমগ্র বাঙ্গালীকে প্রতিনিধিত্ব করার মত স্বাজাত্যবাদী ধারণার উন্মেষ সেখান থেকেই। কিন্তু তা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৬ বছর।
সে সময় ভারতের অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্র ক্রমশ পশ্চিম ভারতের দিকে স্থানান্তরিত হওয়ায় বৃটিশ শাসকদের জন্য কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তর করাও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। ভারতের বৃটিশ শাসকরা জানত এটাও কলকাতার মধ্যবিত্তদের জন্য বড় উৎকণ্ঠার কারণ ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় রাজধানী স্থানান্তরের উদ্যোগ নিলে কলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্তরা সারা ভারত ব্যাপী এক তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবে। কিন্তু বঙ্গ বিভাগকে কেন্দ্র করে কলকাতার মধ্যবিত্ত সমাজ বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনায় এমনভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছে যে, যে কোন কিছুর বিনিময়ে তারা বাংলা বিভাগকে রদ করতে বদ্ধ পরিকর। আর সেটাই হচ্ছে রাজধানী স্থানান্তরের মোক্ষম সময়। কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তর আর বঙ্গভঙ্গ রদ প্রায় একই সময় ঘটেছিল। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার ফলে কলকাতা কেন্দ্রিক মধ্যবিত্তের অহং পরিতৃপ্ত হয়েছিল সত্য, কিন্তু শত বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা ভারতবর্ষের রাজধানী তাদের চোখের ওপরে কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে গেল। এতে বঙ্গভঙ্গ রদের বিজয়ের আনন্দ ক্রমশ ফিকে হয়ে যেতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেন্দ্রও ক্রমশ উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে এক পর্যায়ে রাজধানী নয়াদিল্লী কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।
বাঙ্গালীর এ অসহায়ত্বকে সর্বপ্রথম সফলভাবে উপলব্ধি করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আর এ উপলব্ধি তাঁকে বাংলার জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর এ অনুপ্রেরণার সামনে বাধ সাধে মধ্যবিত্ত জনসমাজে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য। বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ঐক্যের আহ্বান সমগ্র বাঙ্গালীকেই প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। চিত্তরঞ্জন দাশ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখ্য প্রতিনিধি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের লক্ষ্যে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে এক সাড়া জাগানো ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন। এ চুক্তিতে মুসলমান মধ্যবিত্তের অনগ্রসরতা দূর করার বিশদ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্ভবত এ চুক্তির কারণেই ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত আইন সভা নির্বাচনে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত রাজনৈতিক দল স্বরাজ্য দল বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। আর বিজয়ী আইনসভা সদস্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে স্বরাজ্য দল যখন একটি প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে ঠিক তখন বাংলায় ঘটে ভিন্ন ধরনের ঘটনা।
চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে যখন বাংলায় সত্যি সত্যি বেঙ্গল প্যাক্ট কার্যকর হতে থাকে, বিশেষত কলকাতা সিটি কর্পোরেশনে যখন অধিক মাত্রায় মুসলমান সমাজভুক্তদের নিয়োগদান শুরু হয় তখন হিন্দু মধ্যবিত্তের অনেকে এর বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। অবশ্য, ইতিপূর্বেই স্বরাজ্য দলের প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করতে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বঙ্কিম চন্দ্রের সাহিত্যকে বিশেষভাবে সামনে আনা হয়। বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্তের একাংশ বঙ্কিমের সর্বভারতীয় হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা সম্বলিত সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে পঠন-পাঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করতে থাকে। বাংলায় চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করার প্রশ্নে বঙ্কিম সাহিত্য হয়ে ওঠে হিন্দু মৌলবাদীদের হাতিয়ার। বঙ্কিম মাতমের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকেও সে সময় ক্বচিৎ কলম ধরতে দেখা গেছে। হিন্দু মৌলবাদীদের এসব কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জনসাধারণের ওপর প্রচণ্ড প্রভাব এবং নীতিনিষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার কারণে তাঁরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি। কিন্তু ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের আকস্মিকভাবে মৃত্যু ঘটে। আর এর মধ্য দিয়েই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর অসাম্প্রদায়িক স্বজাত্যবাদী ধারণার প্রতিভু স্বরাজ্য দল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।
বাঙ্গালী জাতির জন্য এর পরের ইতিহাসটা বড় করুণ। স্বরাজ্য দলের অধিকাংশ হিন্দু সদস্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে ফিরে যান। আর মুসলমান সদস্যগণ মুসলিম লীগের দিকে ধাবিত হন। অবশ্য, মাঝখানে বাঙ্গালী মুসলমান সদস্যগণ বাংলায় প্রজা আন্দোলন গড়ে তুলে কৃষকদের মধ্যে এক ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করেন। সারা বাংলার জমিদার ও মহাজনগণ প্রজা আন্দোলনকে বিরোধিতা করলেও সে বিরোধিতার রাজনৈতিক রূপ খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। বিশেষত প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠার সময় অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নিয়ে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ এবং বাঙ্গালী হিন্দুদের মধ্যকার বিশিষ্ট সব ব্যক্তিত্বের সমর্থনের কারণে তিরিশের দশকের গোড়ায় বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রায় দলমত নির্বিশেষে প্রজা আন্দোলনকে সমর্থন করতে থাকে। ফলে ১৯৩৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে কলকাতার মত হিন্দু মধ্যবিত্ত প্রধান নগরেও প্রজা সমিতির সভাপতি বিশিষ্ট মওলানা স্যার আব্দুর রহিম কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনে সক্ষম হন। তখনও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন নি। জিন্নাহর অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বিশিষ্ট ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টি আইন পরিষদে প্রজা সমিতিকে সমর্থন দান করে। এরই ফলশ্রুতিতে আইন পরিষদের স্পিকার মনোনীত হন মওলানা আব্দুর রহিম।
কিন্তু কংগ্রেস ও মধ্যবিত্তের একাংশের মধ্যে ক্রমাগত বৃটিশ উপনিবেশের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ও অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকলে অখণ্ড ভারতের আদর্শিক ভিত্তি কি হবে তা নিয়ে একটি সংকট দেখা দেয়। সে সংকট নিরসনের একটি পথ ছিল বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ অনুসরণে একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে। কিন্তু কংগ্রেসের ঘোষিত রাজনীতির সাথে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বক্তব্যটি সংগতিপূর্ণ ছিল না। ফলে, দলগত অবস্থান থেকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন তুললে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকেই বিরোধিতা আসতো না, অসাম্প্রদায়িক চেতনা সম্পন্ন অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত নেতা-কর্মীরও বিরোধিতার সম্ভাবনা ছিল। ফলে অখণ্ড ভারত রাষ্ট্র গঠনের সামনে আদর্শিক সংকট যতোই দেখা দিক, কংগ্রেসের পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের স্লোগান দেওয়া সম্ভব হয় নি। বড়জোর ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় স্লোগানের মাধ্যমে সমগ্র ভারতকে দেবী মাতা বলে কল্পনা করার সুযোগকে গ্রহণ করা হয়েছিল, যাকে তারা অনেকটা হিন্দু ধর্মের মাতৃপূজার সাথে মিলিয়ে জনগণের মধ্যে একটি আনুভূতিক আবেদন সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছিল। আর কংগ্রেসের মত বৃটিশ ভারতীয় পরিধি সম্পন্ন একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক আবেদনময় স্লোগান হিন্দু মৌলবাদীদের এতটা প্রভাবিত করে যে, তারা এ সময় রাজনৈতিক দাবী হিসাবে একটি সর্বভারতীয় হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্টার স্লোগান দেয়।
এ বিষয়গুলি কৃষক-প্রজা পাটির্, ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টি ও মুসলিম লীগে কর্মরত মুসলিম নেতৃবৃন্দের মাঝে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ক্রমশ রাজনৈতিক কর্মীগণ নির্দিষ্ট একটি রাজনীতির অনুসারী হয়ে উঠতে থাকেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ইন্ডিপেনডেন্ট পার্টির কাজ বাদ রেখে জোরে-শোরে মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। অধিকাংশ কংগ্রেসী মুসলিম লীগারের কংগ্রেসী সত্তাটি বিমূর্ত হয়ে ওঠে। ক্রমশ গোটা ভারতের রাজনীতি মেরুভূত হতে থাকে ধর্মের ভিত্তিতে। কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ হিসাবে ক্রমশ মুসলিম লীগ সামনে চলে আসতে থাকে। বাঙ্গালী মুসলিম জমিদারদের দল ইউনাইটেড মুসলিম পার্টিসহ সারা ভারতের মুসলমানদের ছোট বড় অসংখ্য সংঘ, সমিতি ও গোষ্ঠী মুসলিম লীগে যোগদান করে। কৃষক প্রজা সমিতির সভাপতি স্যার আব্দুর রহিমের পদাংক অনুসরণ করে একে একে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট প্রজা সমিতি নেতা মুসলিম লীগে যোগদান করেন। তারপরও কৃষক প্রজা পার্টির প্রচণ্ড প্রভাবের কথা বিবেচনা করে অনেকেই প্রজা সমিতি ত্যাগ করেন নি। কিন্তু ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর দেখা গেল কৃষক প্রজা পার্টির টিকিটে পাস করা একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিষদ সদস্যকে মুসলিম লীগে যোগ দিতে। অবস্থা এমন হল যে, মুসলিম লীগে যোগদান না করে টিকে থাকা দায় হয়ে উঠলো। ফলে প্রজা পার্টি নেতাগণ তাদের মুখ্য দাবী জমিদারী উচ্ছেদের দাবীকে মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোতে অন্তর্ভুক্ত করার শর্তে মুসলিম লীগে যোগদান করার মনস্থ করে। তারা এ লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালান, কিন্তু ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত বাংলা মুসলিম লীগের দাবী হিসাবে উক্ত দাবীকে গ্রহণ করার শর্তে গোটা প্রজা পার্টি মুসলিম লীগে যোগদান করলো।
এভাবে অন্তত বাংলাতে মুসলমান ও হিন্দু জনসাধারণ দুই প্রধান রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পক্ষে মেরুভূত হয়ে পড়লো। এর পরবর্তী ঘটনাগুলি অনেক পরিষ্কার। সীমাহীন নির্মমতা নিয়ে বার বার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, লক্ষ মানুষের প্রাণহানী, হিন্দু মহাসভার বাংলা বিভক্তির জোর দাবী, সে দাবীতে হিন্দু মহাসভার মত ক্ষুদ্র দলের উদ্যোগে লক্ষ মানুষের সমাবেশ ইত্যাদি ঘটনা বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে এমন একটি কঠিন অবস্থার মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো যে, তার ভূখণ্ড ও জনসাধারণ ৪/৫টি ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে এটা জেনেও তারা অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার পক্ষে দাঁড়ায় নি।
ভূখণ্ড ও জনসাধারণই শুধু ভাগ হয় নি, ভাগ হয়েছে তার সম্পদও। বাংলার মুসলমান প্রধান অংশটি এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হল যে তার তিন দিকের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরার বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী তিনটি স্বতন্ত্র প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে অপাংক্তেয় শক্তিতে রূপান্তরিত হল। আর মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি পাকিস্তান নামের এমন একটি দেশের অন্তর্ভুক্ত হল যার অপর অংশের সাথে দূরত্ব সহস্র মাইলেরও অধিক। বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভূখণ্ডের এই প্রধান অংশটি তার রাজধানী ও বিত্তবান জনগোষ্ঠীকে হারিয়ে এমন একটি দুর্দশাগ্রস্ত গ্রামীণ সমাজ নিয়ে পাকিস্তানের একটি প্রদেশের মর্যাদা পেল যে, পুরো আড়াইশত বছর ধরে মুর্শিদাবাদ আর কলকাতা নগরীর পশ্চাদ্ভূমি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসা এ গ্রাম সমাজের পক্ষে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পশ্চিম পাঞ্জাব কেন্দ্রিক অপেক্ষাকৃত উন্নত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে এঁটে ওঠার কোন ক্ষমতাই আর থাকলো না। সাতচল্লিশ সালের দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে পাঞ্জাবও দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। কিন্তু তার প্রকৃতি বাংলার মত করুণতম ছিল না। এ রকম বৃহৎ একটা জাতিকে এভাবে লণ্ডভণ্ড করে ফেলার নজীর পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা তা বলা কঠিন। কেননা, এখানকার জনগোষ্ঠীর একাংশের রাজধানী আছে কিন্তু পশ্চাদ্ভূমি নেই, দ্বিতীয় অংশের পশ্চাদ্ভূমি আছে কিন্তু রাজধানী নেই, তৃতীয় অংশ শত বছর ধরে আসামে বাস করেও রয়ে গেল পরবাসী হয়ে, আর চতুর্থ অংশ ভারতীয় ইউনিয়নের একটি প্রদেশের মর্যাদা পেয়েও রয়ে গেল প্রচণ্ড রকমে অবহেলিত পশ্চাৎপদ জেলার মতই। কেউ কারো বাঁচার সংগ্রামের সাথী নয়। ভারতীয় ইউনিয়নে যারা আছেন তারা হয়তবা বহু দূরে দূরে অবস্থান করেও ভারত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পরস্পরের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর প্রধান ভূখণ্ডের মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানোর প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকলেও বাকীরা কার্যকরভাবে একমাত্র একাত্তর সাল ছাড়া আর কখনও তাদের পাশে দাঁড়াতে পারেন নি।
একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামেও যারা অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতো সেই কমিউনিস্ট বন্ধুদের অনেকের ভূমিকা ছিল একেবারে নির্লিপ্ত। নিঃসন্দেহে সেসকল এলাকার বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার আশ্রয়চুøত জনগোষ্ঠীকে আপনজনের মতই আশ্রয় দিয়েছিল; কিন্তু রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে যারা পূর্ব বঙ্গীয়দের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের অনেকেই তখনও অখণ্ড ভারতীয় হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার ব্যথা ভুলতে পারে নি। মাত্র ২৫ বছরেই বাকীদের অনেকে বাঙ্গালী সত্তার চেয়েও ভারতীয় সত্তার অর্চনা করতে বেশী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বাইরে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে যারা সেদিন পূর্ব বঙ্গীয়দের সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের জীবনে আগের ২৫ বছরে কোন সংগ্রাম ছিল না। তাঁদের সমর্থনের পিছনে যতটা কারণ ছিল পাকিস্তান বিভক্তির ইচ্ছা, ততোটা বাঙ্গালী প্রীতি ছিল না। আর এ কারণেই কমিউনিস্টদের বিপ্লবী অংশের সমর্থন কার্যকর রূপ নিয়ে কখনও আত্মপ্রকাশ করে নি। তাছাড়া, ভারতীয় বাঙ্গালীদের কার্যকর সমর্থনের কোন ক্ষমতাও ছিল না। কেননা, একমাত্র নকশালবাড়ীর কৃষক অভ্যুত্থান ছাড়া সেখানকার গোটা বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করার মত কোন বিজয়ের ঐতিহ্য ছিল না। দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে শুধু পরাজয়ের গ্নানি বইতে বইতে তারা পার করেছিলেন ২৫টি বছর। যারা বিজয়ী গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত করেছিলেন সেই কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বিজয়াভিযানের সামনে পূর্ব বঙ্গীয় গণমানুষের সশস্ত্র সংগ্রাম এমন চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে যে, তা তাদের সংগ্রামের সামনে শুধু বাধা হয়েই দেখা দেয় নি, উপরন্তু ভারতীয় বাঙ্গালীদের সংগ্রামী মেজাজকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বিদ্রোহী প্রবাহকেই বিপন্ন করে ফেলে। ফলে পূর্ব বঙ্গীয়দের সশ্রস্ত্র সংগ্রামের পাশে থেকেও ভারতীয় রাজনীতিতে বাঙ্গালীর জাতীয় প্রশ্নকে সামনে তুলে ধরার মত কোন রাজনৈতিক শক্তি তখন পর্যন্ত ভারতে অনুপস্থিত ছিল। ফলে তখন পর্যন্ত বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনা বিকাশের একমাত্র ক্ষেত্র ছিল পূর্ব বঙ্গ।
দেশ বিভাগের পর পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের হওয়াকে যারা মেনে নিতে পারেন নি তাঁরা প্রধানত দুটি ধারায় বিভক্ত ছিলেন। পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে এঁদের একটি অংশ তথা কংগ্রেসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য থাকলেও তাঁদের প্রভাব ছিল একান্তভাবেই হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা অন্তত আইন পরিষদের সভাগুলিতে পূর্ব বঙ্গের সমস্যা সম্পর্কে খুব জোরালো বক্তব্য উত্থাপনের মাধ্যমে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
অন্যদিকে কমিউনিস্টরা প্রথমে দেশ বিভাগকে মেনে নেয় নি। কিন্ত আটচল্লিশ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়ার পর থেকে তারা এমন এক আত্মঘাতী ও হঠকারী লাইন অনুসরণ করেন যে, পূর্ব বঙ্গের কিছু অংশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীকে নিয়ে অসংখ্য খণ্ড বিদ্রোহের জন্ম দিলেও তার প্রত্যেকটির পরিণতি হয় নির্মম পরাজয়। সে বিদ্রোহে বাঙ্গালীর কোন প্রশ্ন ছিল না, তা ছিল সংখ্যালঘু ও একেবারেই পিছিয়ে পড়া কিছু মানুষের জমি ও ফসলের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। জাতীয় ক্ষেত্রে উক্ত সংগ্রামের পক্ষে কোন রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে না তুলেই স্থানীয় এ ধরনের সশস্ত্র বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড করার ফলে ত্যাগ ও নিষ্ঠার বিবেচনায় মহান এ প্রচেষ্টাগুলিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তি অতি সহজেই ভারতীয় চক্রান্ত বলে অবলীলাক্রমে বর্ণনা করলো, অথচ সেই জঘন্য মিথ্যাচারকে বিরোধিতা করার মত সাহস প্রদর্শনের ক্ষমতা কারো হল না। এত হত্যা, লুণ্ঠন ও নির্যাতন হল, কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদের সভাগুলিতে কেউ বিষয়গুলি উচ্চারণ পর্যন্ত করলেন না। রাজশাহীর নাচোলের পিছিয়ে পড়া অধিবাসীদের সংগ্রাম অভ্যুত্থানে রূপ নিল, সে অভ্যুত্থানের বিস্তার ঘটলো গ্রামের পর গ্রাম, ইউনিয়নের পর ইউনিয়ন, কিন্তু তার পরও প্রাদেশিক ক্ষেত্রে এর কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হল না। পুরো আটচল্লিশ সাল এবং উনপঞ্চাশ সালের একটি পর্ব পর্যন্ত এ ধরনের বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড অসংখ্য ঘটেছিল। এর কোন রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সে সময় প্রাদেশিক পর্যায়ে দেখা যায় নি, অথচ মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির নেতৃত্বে ঢাকাতে যে কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠে হঠাৎ করেই তা সচেতন মহলকে সচকিত করে তোলে।
প্রসঙ্গটি ছিল বাংলা ভাষা। বিষয়টি প্রথম উত্থাপন করেন পাকিস্তানবাদী চিন্তার একান্ত অনুসারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ শিক্ষক।
এরপর প্রসঙ্গটি আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, মাত্র চার বছরের মাথায় প্রসঙ্গটি নিয়ে ঢাকা শহরে এক গণ-অভ্যুত্থান ঘটে যায়, বিদ্যুৎবেগে তা গ্রাম গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব বঙ্গের সমগ্র জনসাধারণ ভাষা প্রশ্নকে তাদের বাস্তব সমস্যা হিসাবে দেখে। দমন-পীড়নের একটি পর্যায়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারও অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলার দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়।
ভাষা প্রশ্নে সেই আন্দোলন, নির্যাতন, রক্তক্ষরণ, হত্যা, গুলি ইত্যাদি নিয়ে গত পঁয়তাল্লিশ বছরে বাঙ্গালীর স্তুতি প্রকাশক প্রচুর গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক, ছড়া ইত্যাদি রচিত হয়েছে, বিশ্লেষণ ধর্মী অসংখ্য প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। কিছু কিছু গান, কবিতা কিংবা নাটক প্রতিটি শ্রোতা কিংবা দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, শিল্পের বিবেচনায় কোন কোনটি কালোত্তীর্ণ। নিশ্চয়ই এসকল গান, কবিতা, নাটক কিংবা প্রবন্ধ বাঙ্গালী জাতির আত্মবিকাশের আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ দেশে যে রাজনীতি অনুশীলিত হয়ে আসছে তার মধ্যে কি কখনও একটি বারের জন্যেও গোটা বাঙ্গালীকে লক্ষ্য করে কোন বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে? সেরকম উদাহরণ পাওয়া যাবে না।
অনেকে বলে থাকেন, ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে ২১ দফা রচিত হয়েছিল তাতে ছিল বাঙ্গালীর জাতীয় আকাঙ্ক্ষার স্পষ্ট প্রতিফলন। কিন্তু আসলেই কি তা-ই ছিল ? তার মধ্যে ছিল আসলে পাকিস্তানী কাঠামোর মধ্যে থেকে সম্ভাব্য সর্বাধিক পরিমাণ স্বায়ত্তশাসনের দাবী। তাতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুসারে স্বশাসিত ও ‘সভরেইন’ করার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করা হলেও মুদ্রা, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার দায়িত্বকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করে দাবীটির মধ্যে একটি আত্মবিরোধ সৃষ্টি করা হয়েছে। উপরন্তু ২১ দফা কর্মসূচীর নীতিগত ভিত্তি ছিল এমন যে, তার ভিত্তিতে এখানে স্বতন্ত্র একটি দেশ গঠন করা হলেও তা হত একটি ক্ষুদ্র পাকিস্তান রাষ্ট্র। এমনকি, শেখ মুজিবরের ৬ দফা কর্মসূচী বর্ণিত রাষ্ট্রকাঠামো রূপায়নের ক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করা হয় লাহোর প্রস্তাব। ফলে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা যে রাষ্ট্রের পত্তন ঘটিয়েছে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পাকিস্তানই রয়ে গেছে। সংবিধান যা বাহাত্তর সালে রচিত হয়েছিল তা অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের হলেও তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল তার রূপ ছিল বাংলাদেশী, বাঙ্গালী জাতির আত্মবিকাশের কোন স্বপ্ন তাতে ফুটে ওঠে নি; ভারত রাষ্ট্রে অবরুদ্ধ বাঙ্গালীদের অন্তত তিনটি ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে যে ভূখণ্ড, পূর্ব বঙ্গের প্রধান অংশ, পশ্চিম বঙ্গের অংশ বিশেষ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত বর্তমান বাংলাদেশকে নিয়েই তার সকল চিন্তা। শেখ মুজিব, যিনি নাকি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী তিনি স্বপ্নেও কোনদিন বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরের বাঙ্গালীকে নিয়ে কখনও চিন্তা করেছেন বলে জানা যায় না। তাহলে এ দেশে বহুল কথিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মুখ্য স্বরূপটি কি?
কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মাটি ও মানুষকে নিয়ে যে সভ্যতার পত্তন ঘটে, যে সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্য তৈরী হয়, সেই সব কিছু মিলে গড়ে ওঠে একটি জাতি। বাঙ্গালী জাতিও তেমনই একটি ভূখণ্ড, জলবায়ু, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে তার অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে, প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে, বার বার করে বহিঃশত্রুর আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে হয়েছে, কখনও বাঙ্গালী অন্যের কাছে বিজিত হয়ে বিভক্ত-বিচ্ছিন্ন হয়েছে, আবার কখনও বিজয়ী হয়ে গোটা জাতিকে একত্রিত করেছে। কিন্তু তার পরও অব্যাহত রয়ে গেছে বাঙ্গালী জাতি গঠনের প্রবাহমান ধারা। বাঙ্গালী জাতি ভিন্ন জাতির অনেক কিছুকে গ্রহণ করেছে, নিজের করে নিয়েছে, আবার অনেক কিছুকে প্রত্যাখান করেছে। এসব কিছু মিলেই বাঙ্গালী জাতির এমন একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে যে অন্য জাতি থেকে বাঙ্গালীকে সহজেই আলাদা করা যায়। দৈহিক বৈশিষ্ট্য, গায়ের রং-এ রয়েছে তাদের নানা বৈচিত্র্য, তবুও তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়; তার কারণ হল তাদের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জাতি গঠনের সংগ্রাম।
ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙ্গালী জাতির এ ঐতিহ্যের কারণেই বৃটিশরাজ তাকে বিভক্ত করে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য বারংবার চেষ্টা করে। অঞ্চলগতভাবে বিভক্ত করার চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সম্প্রদায়গতভাবে বিভক্ত করার প্রচেষ্টা নেয়। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ কিংবা বিশ্বরাজনীতির চালে পড়ে বাঙ্গালীর ভূখণ্ডটি ১৯৪৭ সালে একাধিক ভাগে ভাগ হয়ে যায়, কিন্তু তৎকালীন কোন রাজনীতি এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয় নি। যারা অখণ্ড বাংলার স্বপ্ন দেখেছিল তাদের সে স্বপ্নের পিছনেও বাঙ্গালীর আত্মবিকাশের কোন আকাঙ্ক্ষা ছিল না, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ কোন দার্শনিক শক্তি বা হাতিয়ার হিসাবে তাদের কাছে ধরা দেয় নি; আর সে কারণেই বাঙ্গালীর আবাসভূমি বিভাজিত হওয়ার পর অখণ্ড বাংলার প্রস্তাবকগণ চিরতরে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন, শামিল হয়ে যান ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে।
হিন্দু মধ্যবিত্তের মধ্যে কিছু বাঙ্গালীত্ব কাজ করলেও তাদের মুসলমান সহযাত্রীগণ তখনই ছিলেন পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী; বাঙ্গালীর নিজস্ব আবাসভূমি নয়, পূর্বাঞ্চলের একটি বিশাল অঞ্চল নিয়ে একটি স্বতন্ত্র পাকিস্তান গড়ে তোলার স্বপ্নই ছিল তাদের অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠার পিছনে অনুপ্রেরণার মূল উৎস। তাদের মধ্যে বাঙ্গালী হিসাবে গর্ববোধ কাজ করে নি, করেছে সম্প্রসারণবাদী দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক বৃহৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। আর সে কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর একটি জাতিকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে ফেলা সত্ত্বেও বাংলার প্রধান অংশ পূর্ব বাংলা থেকে এর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ ওঠে নি। সকলে বাংলার অপরাপর অংশের উপরকার দাবী চিরতরে ছেড়ে দেন।
বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর তৎকালীন প্রজন্ম জাতীয়-আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘোরে পড়ে কিংবা কোন ধর্মীয় উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে জাতির বিভক্তিকে মেনে নিয়েছিল বলে একটি জাতির অপমৃত্যু ঘটতে পারে না। বহুধা বিভক্ত বাঙ্গালী স্ব স্ব অবস্থান থেকে এখনও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। মাঝখানে গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলার এই খণ্ডিত ভূখণ্ডকে বাংলাদেশ আর সেখানকার জনসাধারণকেই বাঙ্গালী জাতি বলে চিত্রিত করা হচ্ছে। এ এক নির্মম ভুল, এ রকম একটি ভ্রান্তিকে সত্য বলে চালানোর অধিকার কারো থাকতে পারে না।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামেও এক বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করা হচ্ছে, একটি পাকিস্তানবাদী ধারণাকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উপর আরোপ করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদ, যা একটি জাতির আত্মবিকাশের স্বপ্ন জাগায়, জাতীয় বিকাশের পরিপন্থী সকল কিছুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার, বিদ্রোহ করার দর্শনগত ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, স্বকীয় শক্তি হিসাবে গোটা জাতিকে উত্তরিত হওয়ার অনুপ্রেরণা দান করে ─ সেই জাতীয়তাবাদ যখন একটি জাতির নামের সাথে যুক্ত হয় তখন তা কোন ক্রমেই জাতির কোন খণ্ডাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বাঙ্গালীর যে অংশ আজ ভারত রাষ্ট্রের দ্বারা অবরুদ্ধ, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সে অংশকে মুক্ত করে গোটা জাতির একত্রে অবস্থানকেই নির্দেশ করে। কয়েক খণ্ডে খণ্ডিত আজ বাঙ্গালী জাতি। একত্রিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার জন্মগত। সেই একত্রীকরণের সংগ্রামই হবে আজ বাঙ্গালী জাতির মূল সংগ্রাম। এ এক প্রবাহমান লড়াই। সমগ্র বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর যুগপৎ লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই তা একদিন অর্জিত হবে। সে সংগ্রামে অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ।
নিঃসন্দেহে সাতচল্লিশ সালের বাঙ্গালী জাতির মহা বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা একটি ভাল অর্জন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালীর এটা বাসস্থান। বাঙ্গালী জাতির একত্রীকরণের সংগ্রামে ভূখণ্ডটি একটি ভিত্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু এতোটুকুতেই সন্তুষ্ট হলে চলবে না। আমাদের পূর্বসূরীরা যে দাবী প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন তা আবার অনেক জোরালোভাবে উত্থাপন করতে হবে। যারা সকল বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অধিকারকে পাশ কাটিয়ে মাতৃভূমির খণ্ডাংশকে নিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ অনুশীলন করতে চাইছেন তাঁদের বিরুদ্ধেও এক জোরালো লড়াই প্রয়োজন। কেননা, বাংলা ভূখণ্ডের এ খণ্ডিত জাতিকে নিয়ে যাঁরা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন তাঁদের জাতীয়তাবাদ একান্তভাবেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ভাবার্থের দিক থেকে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের সাথে পার্থক্য যার অতি সামান্য। এ বিষয়ে কারো সামান্যতম সংশয়ই হল বাঙ্গালীর মত একটি বিশাল জাতির অপমৃত্যু পক্ষে কাজ করার শামিল। তাই আজ যাঁরা বাঙ্গালীর আত্ম উন্নয়ন কামনা করেন, একটি উন্নত জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চান, তাঁদের আর জাতির কোন খণ্ডাংশকে নিয়ে ভাবলে চলবে না, বরং সমগ্র বাঙ্গালীর স্বার্থকে ধারণ করে এমনই এক মতাদর্শ সামনে আনতে হবে যা বাঙ্গালীর সামগ্রিক বিকাশকে নিশ্চিত করতে পারে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ হবে সে আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলক মতাদর্শ।