লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ June 1, 2019, 12:00 AM, Hits: 1792
মানুষ সামনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা পায় তার অতীত ইতিহাসের ভিতরকার গৌরবময় উত্তরাধিকার থেকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষে তাদের উপনিবেশিক শাসনকালে এখানকার জাতিসমূহ ও জনগণকে এই গৌরবের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে চিরপদানত করে রাখার উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষের এক মিথ্যা ইতিহাস রচনা করেছিল। এই মিথ্যা ইতিহাস আমাদেরকে শিখিয়েছিল যে, আর্যরা ভারতবর্ষে বহিরাগত, তারা ছিল পশুপালক, যাযাবর এবং বর্বর। এবং তারা এও শিখিয়েছিল যে আর্যরা ছিল ইউরোপীয়দের মত শ্বেতাঙ্গ এবং উন্নত নাসা, ইত্যাদি।
এখানে ‘আর্য’ প্রসঙ্গে এটি স্পষ্ট করা দরকার যে, ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যেভাবে জাতিবাচক অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন সেটি সম্পূর্ণরূপে একটি ভুল ও বিকৃত অর্থে শব্দটির ব্যবহার। এই শব্দ বরাবর ভারতবর্ষে ব্যবহৃত হয়েছে গুণবাচক অর্থে। শুধু হিন্দু নয়, উপরন্তু উপমহাদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ এবং জাতির মানুষ আবহমান কাল ধরে সভ্য, ভদ্র, শ্রেষ্ঠ, গুণী, ধার্মিক ইত্যাদি বুঝাতে আর্য শব্দ ব্যবহার করেছে। সুতরাং হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ভারতীয় সকল ধর্মের প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে আমরা গুণবাচক অর্থে আর্য শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই।
কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী এবং ইউরোপীয়দের হাতে পড়ে এই গুণবাচক শব্দটি নির্ভেজাল এবং উগ্র জাতিবাচক শব্দে পরিণত হয়েছে। তারা ভারতবর্ষ জয় করে এখানকার গৌরবময় অনেক সম্পদের মত ঋগ্বেদের প্রকৃত সত্যকে যেমন লুণ্ঠন বা অপহরণ করেছে তেমন আর্য শব্দটিকেও লুঠ করে নিয়ে গিয়ে তাদের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার মহাকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করেছে।
আর্য তথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর এ পর্যন্ত পাওয়া আদি গ্রন্থ ঋগ্বেদ, যা কিনা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আদি ধর্মগ্রন্থ, তার ভ্রান্ত, বিকৃত ও প্রতারণাপূর্ণ এক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তারা এক নির্জলা মিথ্যাচারকে ইতিহাসের নামে চালিয়ে দিয়েছে। যেহেতু তারা শাসক এবং উন্নততর ও পরাক্রমশালী এক সভ্যতার অধিকারী সেহেতু পরাধীন ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক শিক্ষিত মহল ও পণ্ডিতদের প্রায় সকলে এই মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে প্রতারিত হয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হল ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা এই উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেবার প্রায় ৭২ বৎসর পরেও এই একই মিথ্যা তত্ত্ব বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ ভারতীয় ইপমহাদেশে ইতিহাসের নামে চলছে।
অথচ মুক্তমন নিয়ে ঋগ্বেদ পাঠ করলে যে কোনও পাঠকের ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গের বেদ ব্যাখ্যার এই অন্তঃসারশূন্যতাকে ধরতে পারার কথা। ঋগ্বেদের কোথায়ও এ কথা বলা নাই যে, তার রচয়িতা আর্যরা সপ্তসিন্ধু অঞ্চল তথা ভারতবর্ষে বহিরাগত। বরং ঋগ্বেদ রচয়িতা ঋষিরা বারবার সপ্তসিন্ধুকে নিজেদের আবাসভূমি বলেছেন। শুধু তা-ই নয়, ঋগ্বেদ থেকে বেরিয়ে আসে উন্নত নগর সভ্যতার চিত্র। ঋগ্বেদের ঋষিদের দ্বারা বর্ণিত বিশাল বিশাল ভবন, নগর, লাঙ্গল ও জলসেচ নির্ভর উন্নত কৃষি ব্যবস্থা, বস্ত্র বয়ন, ধাতু শিল্প, সমুদ্র বাণিজ্য, ইত্যাদি কোনটিই যাযাবর পশুপালক অথবা অসভ্য আর্য সমাজের চিত্র অঙ্কন করে না।
বস্তুত ঋগ্বেদের মনোযোগী পাঠ যে কোনও সংস্কারমুক্ত পাঠককে ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করবে। বাইবেল (নূতন এবং পুরাতন নিয়ম), কুরআন ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের মত ঋগ্বেদও যে একটি সমাজের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনে রচিত একটি ধর্মগ্রন্থ মাত্র এই সহজ সত্য বুঝবার জন্য বেশী বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। যেটার প্রয়োজন সেটা হচ্ছে সত্যনিষ্ঠা অথবা স্বাধীন মন। কোনও ধর্মগ্রন্থ যেমন বহিরাগতদের আক্রমণের সময় রচিত হয় না তেমন ঋগ্বেদও কোনও বহিরাক্রমণের ফসল নয়। বরং সিন্ধু সভ্যতার জনগোষ্ঠীর একাংশের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে ভাষায় রূপ দিতে চেয়ে ঋগ্বেদের ঋষিদের মন্ত্র রচনা। সুতরাং ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতারই সৃষ্টি। তবে কেউ যদি ঋগ্বেদে সিন্ধু সভ্যতার হুবহু প্রতিচ্ছবি খুঁজতে চান তবে তিনি ভুল করবেন। কারণ এটি সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময়ে একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি। এবং এর পটভূমিতে ছিল এমন একটি সামাজিক আন্দোলন যা সমাজকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। তাই সিন্ধু সভ্যতার নির্দিষ্ট কাল এবং স্থান প্রেক্ষিতে ফেলেই ঋগ্বেদকে বিচার করতে হবে।
ইংরেজরা বিদায় নিয়েছে কতকাল আগে। তবু একটা ভুল তত্ত্ব আজও এ উপমহাদেশের ইতিহাস রচনার মূল ভিত্তি হয়ে আছে। বিশেষত ১৯২০-এর দশকে সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর থেকে ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ বহুকাল পূর্বে ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দ্বারা বহু প্রচারিত ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে ধূলিসাৎ করলেও এখনও তারা যেমন এ কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় যে আর্যরা মোটেই ভারতবর্ষে বহিরাগত বা হানাদার জনগোষ্ঠী নয়, বরং এখানকারই স্থানীয় অধিবাসী তেমন তাদের অন্ধ অনুসারী উপমহাদেশীয় পণ্ডিতরাও সে কথা স্বীকারের সৎ সাহস রাখেন না।
সাম্প্রতিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার এই অঞ্চলে বাইরের জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অভিগমন ঘটে নাই। অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিকরা এবিষয়ে একমত যে, এখন থেকে প্রায় দশ হাজার বৎসর পূর্বে এই অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠীসমূহ বসতি স্থাপন করে তাদের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থেকেছে। অর্থাৎ এই সুদীর্ঘ কালপর্বে এই বিশাল অঞ্চলে এই সভ্যতার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অথচ ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে খ্রীষ্টপূর্ব ১২ শতক থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৫ শতকের মধ্যে কোন এক সময় ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ ও আবাসন ঘটে। এভাবে নৃতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের বিচারে ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণতত্ত্ব সম্পূর্ণ রূপে বাতিল হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজ বিকাশের ব্যাখ্যায় দেখা দেয় শূন্যতা।
এ শূন্যতা পূরণে এতকাল ইউরোপীয় ভ্রান্ত ইতিহাস ব্যাখ্যার জের টেনে যে গোঁজামিল দেওয়া হচ্ছিল তাকে বিরোধিতা করে আমরা দু’জন শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমি গ্রন্থাকারে বক্তব্য উপস্থাপন করি। প্রথমে আমি ঋগ্বেদের উপর অধ্যয়নের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে এটি কোন আক্রমণকারী পশুপালক ও যাযাবর জনগোষ্ঠীর গ্রন্থ নয়, বরং এটি সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের একাংশ দ্বারা সংগঠিত একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সময় রচিত মন্ত্রসমূহের সমন্বয়ে গঠিত ধর্মগ্রন্থ। আমার এই ধারণার ভিত্তিতে এবং মহাভারত ও প্রাচীন পার্সীদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাসহ প্রাচীন আরও কিছু গ্রন্থ অধ্যয়নের পর ১৯৯০ সালে আমি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করি। তবে এটি অপ্রকাশিত রয়ে যায়। পরে আমার সঙ্গে নূতন উপলব্ধি ভিত্তিক অনুসন্ধানে শামসুল আলম চঞ্চল যোগ দেন। আমরা উভয়ে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যসমূহের উপর ব্যাপক অধ্যয়ন করি এবং তার ভিত্তিতে আমরা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদ এবং আর্যদের সম্পর্কের বিষয়ে অধিকতর সুনিশ্চিত হই।
আমরা দু’জন সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। ১৯৯৩ সালে শামসুল আলম চঞ্চল আমার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে The Indus Civilization and the Aryans নামে একটি প্রবন্ধ তৈরী করে সিন্ধু সভ্যতার বিষয়ে বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি-এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের নিকট পাঠান। রফিক মোগল এই প্রবন্ধকে একটি সফল প্রয়াস হিসাবে উল্লেখ করে এটিকে যথাশীঘ্র প্রকাশের জন্য তাগিদ দিয়ে উত্তর দেন। এর পর আমরা যৌথভাবে ১৯৯৫ সালে The Aryans and the Indus Civilization নামে একটি ইংরাজী বই এবং ২০০৩ সালে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামে একটি বাংলা বই প্রকাশ করি। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা উচিত যে, আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী আমাদের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভারতের কিছু সংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক এবং বেদ পণ্ডিত তাদের মতৈক্যের কথা জানান। যেমন সিন্ধু সভ্যতার উপর ভারতের বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ এস, আর, রাও এবং ভারতের বিখ্যাত বেদ পণ্ডিত ডঃ ভগবান সিং, ইত্যাদি।
১৯৯০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমাদের দু’জনের ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই সত্যটিও ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে যে ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব ইউরোপীয় পণ্ডিতদের অনিচ্ছাকৃত জ্ঞানতাত্ত্বিক ভ্রান্তি থেকে উদ্ভূত নয়, বরং এর পিছনে ক্রিয়াশীল ছিল এবং আজও আছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য রক্ষার অপরাজনীতি অব্যাহত রাখার কুটকৌশল। ভারতীয় উপমহাদেশের কাছে নিজেদের সভ্যতার ঋণ অস্বীকার করতে চেয়ে ইতিহাসের নামে পাশ্চাত্যের এই কুটকৌশল ও মিথ্যাচার। কারণ প্রায় পৌনে চার হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পরবর্তী কালে সেখানকার অধিবাসীদের একাংশ ইউরোপে গিয়ে সেখানে তাদের উন্নততর ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। ফলে বৈদিক ভাষা তথা সংস্কৃতের উত্তরসূরি হিসাবে ইংরাজী, ফরাসী, জার্মান, লাতিন, রুশ ইত্যাদিসহ ইউরোপের অধিকাংশ ভাষা জন্মলাভ করেছে যেগুলিকে ভাষা পণ্ডিতরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলেন।
বিশেষত ঋগ্বেদের ভ্রান্ত ও মিথ্যা ব্যাখ্যা প্রদান ছিল পাশ্চাত্য আধিপত্য রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনীয়। ভারতবর্ষের মিথ্যা ইতিহাস তৈরী করে তারা এই উপমহাদেশের জনগণকে বুঝাতে চেয়েছে যে দাসত্বই তাদের নিয়তি এবং উপমহাদেশের গৌরবের কিছু নাই। এই উপমহাদেশের মানুষ যারা তারা সর্বদা বিদেশী আক্রমণকারীদের দ্বারা পরাজিত ও অধীনস্থ হয়ে থাকবে এটাই যেন স্বাভাবিক! ফলে তারা ভ্রান্ত ইতিহাস বোধ সৃষ্টি করে ভারতবর্ষ তথা উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি ও জনগণের মনে হীনতা বোধ সৃষ্টি করে রাখতে চেয়েছে। অথচ এটিই সত্য যে আর্যরা শুধু যে সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা এবং অধিবাসী তথা ভারতবর্ষের দেশজ মানুষ তাই নয়, উপরন্তু তারাই প্রায় পৌনে চার হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হলে এই উপমহাদেশ থেকে সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত গিয়ে সেখানে সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে। শুধু তাই নয়, সিন্ধু-সরস্বতী নদী তীরবর্তী অঞ্চলকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল ভূভাগে তারা প্রাচীন পৃথিবীর এমন এক সভ্যতা নির্মাণ করেছিল যার কোনও তুলনাই প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিকরা মূলত একমত হয়েছেন যে, প্রাচীন পৃথিবীর সমকালীন বাকী আর তিনটি সভ্যতা যেমন মিসর, মেসোপটেমিয়া এবং চীনের চেয়েও অনেক বৃহৎ অঞ্চল ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত সিন্ধু সভ্যতা ছিল একমাত্র প্রাচীন সভ্যতা, যা ছিল জনকল্যাণবাদী এবং মূলত শান্তি নির্ভর বা অহিংস।
আমাদের উত্তরাধিকার হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার গৌরবময় ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের নির্মাতা হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী হিসাবে গুণবাচক অর্থে কথিত ‘আর্যদের’ গৌরবময় ঐতিহ্যকে তুলে ধরাকে আমরা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য মনে করি। ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে বিরোধিতা করা ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদে এবং আমাদের জাতীয় গৌরব বোধ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেও আমরা অপিরহার্য মনে করি। বিশেষত আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাঙ্গালী জাতি সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যকে অনেক বেশী ঘনিষ্ঠভাবে ধারণ করে। কারণ আমরা মনে করি সংস্কৃতের প্রাচীনতর রূপ যে বৈদিক ভাষায় ঋগ্বেদ লেখা সেটি ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা। এবং ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ভাষার শব্দ সম্ভার অন্য যে কোন ভাষার চেয়ে বেশী। ফলে ইতিহাসের নামে প্রতিষ্ঠিত এক বিরাট মিথ্যাচারকে উৎখাত করা ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতার নিকটতম উত্তরাধিকারী হিসাবে বাঙ্গালী জাতির অবশ্য কর্তব্য। আমরা আরও মনে করি পাশ্চাত্যের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের দেশে বিদ্যমান সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী ব্যবস্থা ও তার অবশেষসমূহের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরই অংশ।
শুধু এইটুকুই নয়। সিন্ধু সভ্যতার পুনর্মূল্যায়ন আমাদের সামনে সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নেও এক নূতন দিশা উপস্থিত করে। এ পর্যন্ত যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছে তার ভিত্তিতে এক বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত এমন এক গণতান্ত্রিক, জনকল্যাণবাদী এবং মূলত শান্তিনির্ভর সভ্যতার চিত্র বেরিয়ে এসেছে যা যে কোনও মানুষকে বিস্মিত করবার জন্য যথেষ্ট। শুধু তাই নয়, প্রাচীন পৃথিবীর একমাত্র ধর্মমুক্ত সভ্যতা ও রাষ্ট্রের চিত্রও উপস্থিত করে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান এবং ঋগ্বেদের মনোযোগী পাঠ আমাদের সামনে প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণ বিকাশ বা গৗরবময় কালের যে চিত্র হাজির করে সেটা মোটেই ধর্ম নির্ভর কোনও সভ্যতার নয়, বরং লোকবাদী তথা ধর্মমুক্ত একটি সভ্যতার চিত্র। সুতরাং একটি গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, জনকল্যাণবাদী এবং লোকবাদী বা ধর্মের আধিপত্যমুক্ত রাষ্ট্র নির্মাণের প্রশ্নেও আজ সিন্ধু সভ্যতা হয়ে উঠে আমাদের জন্য অপরিমেয় প্রেরণার উৎস। তবে তার জন্য প্রয়োজন নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও ঋগ্বেদ পাঠের সক্ষমতা।*
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* সিন্ধু সভ্যতার উপর শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার ইংরাজী ও বাংলায় যৌথভাবে কয়েকটি লেখা আছে, যেগুলিতে আর্য ও ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা আছে। যেমন The Aryans and the Indus Civilization (Link: http://www.bangarashtra.net/article/848.html), ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ (Link: http://www.bangarashtra.net/article/853.html), Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval (Link: http://www.bangarashtra.net/article/1385.html). তবে সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম, যুদ্ধ এবং রাষ্ট্রশাসন ইত্যাদি সম্পর্কিত আমার কিছুটা সাম্প্রতিক এবং বিশদ আলোচনার জন্য আগ্রহী পাঠক পাঠ করতে পারেন ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’ (Link: http://www.bangarashtra.net/article/1333.html) । অবশ্য সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, রাষ্ট্রশাসন এবং ভাষাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার আরও সাম্প্রতিক যৌথ লেখাটি হচ্ছে একটু পূর্বেই উল্লেখিত Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval (Link: http://www.bangarashtra.net/article/1385.html)। এটি বঙ্গরাষ্ট্রে ২ জুলাই ২০১৮-তে প্রকাশিত হয়।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------