লিখেছেনঃ সুষুপ্ত পাঠক, আপডেটঃ June 26, 2019, 12:00 AM, Hits: 1245
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের গবেষণার উদ্দেশ্য ছিলো ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে দায়মুক্তি দেয়া। তাদের গবেষণায় হাইলাইট করা হয়েছে জঙ্গিবাদে যারা জড়ায় তাদের ৫৬ ভাগ সাধারণ বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী, বাকী ২২ ভাগ মাদ্রাসা ও ২২ ভাগ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থী। এই পরিসংখ্যান একটি অংক মাত্র, প্রকৃত সত্য নয়। গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের মধ্যে প্রত্যেকের শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড ধরে এই পরিসংখ্যান বলে বাংলা মাধ্যমের ছাত্ররা বেশি জঙ্গি হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রমে এমন কি আছে যা পড়ে এরা জঙ্গি হয়ে পড়ছে? সেরকম কিছু যে নেই সেটা সকলেই জানে। তাহলে কেন বাংলা মাধ্যমকে এখানে টেনে আনা হচ্ছে? মাদ্রাসাতে জিহাদের উপর কোর্স পড়ানো হয়। সেখানে কাফের, মুশরিক হিসেবে অমুসলিমদের থেকে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ ও অমুসলিমদের নিকৃষ্ট পড়ানো হয়। জিহাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে আল্লার আইন বাস্তবায়ন করার জন্য প্রত্যেকে মুসলমান তার জান-মাল আল্লার কাছে বিক্রয় করেছে জান্নাতের বিনিময়ে সে বিষয়ে সব মাদ্রাসার ছাত্র একাডেমিকভাবে শিক্ষিত। তাহলে তাদের মধ্যে মাত্র ২২ ভাগ কেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে যেখানে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে ৭৮ ভাগ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এসব বুঝতে হলে আগে আমাদের বুঝতে হবে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে। মাদ্রাসায় পড়তে যাওয়া ছোট ছোট বাচ্চাগুলো তাদের শিক্ষা জীবনের একদম শুরু থেকেই হুজুরদের রাজনীতির সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে। যে কোন ইস্যুতে, নাস্তিক দমন, ইজরাইল, কাস্মির ইস্যুতে তারা রাজপথে বড় হজুরদের রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করে থাকে।
আপনি এমনটা কোন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখতে পাবেন? প্রাইমারি বা হাই স্কুলের শিক্ষকদের কি কোন রাজনৈতিক পার্টি করে স্কুলের সব শিক্ষার্থীদের সেই রাজনীতির ঢাল বানানোর কোন সুযোগ আছে? নেই। মাদ্রাসাগুলো বাংলাদেশে প্রচলিত আইন কানুনের তোয়াক্কা করে না। কওমি মাদ্রাসাগুলোর কোন শিক্ষার্থীর বিচ্ছিন্নভাবে জঙ্গিবাদে জড়ানোর সুযোগ নেই। আর্মি কেনটোনমেন্টের মত মাদ্রাসাগুলো বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। একটা স্কুলে ঢোকা যতটা সহজ মাদ্রাসাগুলোতে সাধারণ প্যান্ট শার্ট পরা মানুষের প্রবেশ সহজ নয়। এসব মাদ্রাসার প্রধান যিনি তিনি দেখা যায় বড় কোন মাদ্রাসার পিন্সিপালের শিষ্য। আহমদ শফীর শত শত ছাত্র সারাদেশে কওমি মাদ্রাসার পিন্সিপাল হয়েছে। এরা তাদের নেতা বা ইমাম মনে করেন আহমদ শফীকে। সাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ছিলেন বাংলাদেশে অন্যতম কওমি মরুব্বী। তার সময়কালে আফগান যুদ্ধে বাংলাদেশের মাদ্রাসা ছাত্ররা মুজাহিদ হিসেবে জিহাদে অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলো। শাহরিয়ার কবিরের এই বিষয়ে গবেষণালব্ধ তথ্য আছে যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন। টেররিজম ইউনিটের গবেষণা ইউনিট কি শাহরিয়ার কবিরের সেই গবেষণাপত্র দেখেছিলেন?
যাই হোক, এই যে আফগান যুদ্ধে মাদ্রাসার ছাত্ররা যোগ দিয়েছিলো, এটা তো কওমি মরুব্বিদের অনুমতি ছাড়া সম্ভব হয়নি। এইসব জিহাদ ফেরত মুজাহিদ মাদ্রাসা ছাত্ররা জিহাদে আরো তালিম গ্রহণ করে বাংলাদেশে ফিরে হুজি, জেএমবি, আনসারুল্লাহর মত জঙ্গি দল গঠন করেছিলো। জসিমউদ্দিন রাহমানী একজন মুফতি। সে মাদ্রাসা ছাড়া কি মুফতি হয়েছিলো? তার জিহাদের উপর যে বইটি আনসারুল্লাহ জন্য পাঠ্য করা হয়েছিলো সেই বইতে কুরআন হাদিস থেকে জিহাদ কতল কতখানি জরুরী এবং ইসলামে নামাজ রোজার চেয়ে জিহাদ কতটা জরুরী তার অর্থেনটিক সোর্সসহ লেখা। মাদ্রাসাগুলোতে কেউ চাইলেই জিহাদের ডাক দিয়ে ছাত্রদের বের করতে পারবে না। যে কারণে আফগান ফেরত মুজাহিদরা বিভিন্ন মসজিদে ইমামের চাকরি করার সময় সাধারণ স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্রদের ইসলামী শিক্ষার তালিম দিতে মনোযোগী হয়। তাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো যে, জিহাদ কেবলমাত্র মাদ্রাসার ছাত্রদের দায়িত্ব নয়, সকল মুসলমানের এতে অংশগ্রহণ যে বাধ্যতামূলক তা মুসলমানদের কাছে ছড়িয়ে দেয়া। আফগান ফেরত মুজাহিদরা বিদেশী অর্থায়নে দেশে নিজ উদ্যোগে জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে সাধারণ সমাজ জীবনের মানুষদের নিয়ে। সকল ধর্মভীরু মুসলমান পরকালের আজাবকে ভয় করে। সেই ভয়ংকর আগুন আর সাপ বিছার কামড়ের হাত থেকে বাঁচার সহজ ফর্মূলা হচ্ছে আল্লার পথে কাজ করা। নামাজ পড়তে যাওয়া ধর্মান্ধ যুবকদের জিহাদের পথে আনা তাদের জন্য কঠিন হয়নি।
কিন্তু এইসব আফগান ফেরত মুজাহিদরা তাদের পূর্ব পঠিত মাদ্রাসায় গিয়ে ছাত্র রিক্রুট করার কোন সুযোগ পেতো না। হাটহাজারী মাদ্রাসা ঢাকা শহরকে অচল করে দিয়েছিলো আহমদ শফী বাবুনাগরিদের হুকুমে। এরা কালকে জিহাদের ডাক দিলে ঢাকা শহরে অসংখ্য লাশ পড়তে থাকবে। যে ৫৬ ভাগ বাংলা মিডিয়াম ছাত্রদের জঙ্গি দেখানো হচ্ছে তা কিন্তু কেবলমাত্র গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের ব্যাকগ্রাউন্ড শিক্ষা পরিচয় মাত্র। অর্থ্যাৎ জিহাদের ডাক হাটহাজারী থেকে আসলে তাতে স্কুলগুলো শিক্ষার্থী খুঁজেও পাওয়া যাবে না। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে জঙ্গিদের ৫৬ ভাগই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া! কারণটা আগেই বললাম, যেহেতু কাজই করা হয়েছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। সারা দেশের মাদ্রাসা ছাত্ররা তাদের মাত্র কয়েকজন মুরব্বীর নির্দেশে পরিচালিত হয়। হাটহাজারী নির্দেশ দিলের যাত্রাবাড়ী, কাঁচপুরের কয়েক হাজার মাদ্রাসা ঐ এলাকায় মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। কিন্তু পরিসংখ্যা অনুযায়ী তো এটা বাংলা মাধ্যমের ছাত্রদের করার কথা? মাদ্রাসাগুলি জঙ্গি ও জঙ্গিবাদে পরিপূর্ণ। কওমি হুজুরদের মধ্য থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় কিছুদিন আগেই তালিকা করেছিলো জঙ্গিবাদ ছড়ানো ওয়াজকারীদের। মাদ্রাসার ছাত্ররা বিচ্ছিন্নভাবে গুলশান হামলার মত কোন অভিযানে যোগ দিবে না। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমেও তারা যাবে না। তাদের ইমাম যেদিন বলবে জিহাদের সময় হয়েছে বাংলাদেশ দখল করো সেদিনই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ তারা জানে ইমামের ঘোষণা ছাড়া জিহাদ হয় না। আর ইমাম যিনি হন তার প্রতি মুসলমানদের মধ্যে সর্বমান্য হতে হয়। সেরকম সর্বমান্য হুজুর কওমিতে চিরকাল দুই-চারজন থাকেনই। তাদের কেউ কেউ ৯০ দশকে শ্লোগান দিয়ে ঢাকায় ছাত্রদের পাঠিয়েছিলো, ‘আমরা সবাই তালেবান বাংলা হবে আফগান’! এসব আপনারা সব ভুলে গেছেন…।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের গবেষণায় আরেকটি বিষয় বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ ছড়িয়েছে বিশেষত ফেইসবুক। মাদ্রাসার ছাত্রদের যেহেতু ফেইসবুক মোবাইল চালানোর অনুমতি নেই তাই তারা এসব থেকে দূরে রয়েছে। অথচ ঢাকা টিব্রিউন নিউজ করেছে ৬৫ ভাগ কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা সব ধরণের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে থাকে। আসল কথা হচ্ছে ফেইসবুককে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভবিষ্যতে জনগণের মত প্রকাশের এই মাধ্যমকে কঠরভাবে দমন করার একটা উপাদান খাড়া করে রাখা হলো। মাদ্রাসাকে নিষ্পাপ সার্টিফিকেট দিয়ে ফেইসবুককে দোষারোপ করাটা তারই লক্ষণ্। মাদ্রাসা সিলেবাসে একজন ছাত্রকে মুজাহিদ তথা আল্লার সৈনিক হয়ে গড়ে উঠার জন্য কুরআনের সাড়ে চারশো জিহাদের আয়াত ও তার উপর ভিত্তি করে যে হাদিসগুলো রয়েছে তার সবগুলি অধ্যয়ন করেই একজন মাদ্রাসা ছাত্র মুফতি হয়। পারিবারিক অশান্তি, নি:সঙ্গতা, বেকারত্ব মানুষকে জঙ্গি করে তুলে না। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের গবেষণায় এটাকেও জঙ্গি হওয়ার কারণ দেখানো হয়েছে। এটাও শুভংকরের ফাঁকি! কেউ হতাশ অসুখি হলে কেন অমুসলিমদের প্রতি আক্রোশ, ঘৃণা পোষণ করবে? মানুষ জীবনে হতাশ, অসুখি হলে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। মানুষ যখন চরমভাবে সাংসারিক জীবনের উপর হতাশ হতে থাকে তখন সে আধ্যাত্মিকতার চরম স্তরে চলে যেতে চায়। তাই হিন্দু ধর্মের চরম আধ্যাত্মিক স্তর সন্ন্যাসী, খ্রিস্ট ধর্মের ফাদার, নান হয়ে ঐসব ধর্মের হতাশ, অসুখি মানুষ সব ভুলতে চায়। একজন মুসলমানের কাছে তার ধর্মের চরম স্তর হচ্ছে আল্লার রাস্তায় শহীদ হয়ে আল্লার শাসন কায়েম করার জন্য লড়াই করা। কাজেই পারিবারিক অসুখি কেউ জঙ্গি হলে তার দায়টা কার উপর গিযে পড়ল? আইএসের যোগ দেয়া ডাক্তার পরিবারের সব সদস্য সিরিয়া গমনসহ যতগুলো আইএস কেস বাংলাদেশে রয়েছে তাদের কারোর পরিবারে চরম অসুখি নি:সঙ্গতা ছিলো তার কোন প্রমাণ নেই। সব পরিবারই বলেছে তারা বাচ্চাদের সঙ্গে বন্ধুর মত মিশতেন। ধর্মে মনোযোগী হওয়ায় তারা খুশিই হয়েছিলেন…।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের গবেষণা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মজিবুর রহমানের মতে, ‘‘মাদ্রাসা শিক্ষায় ধর্মীয় বিষয় স্পষ্ট, তাই তাদের বিভ্রান্ত করার সুযোগ কম। বাংলা বা ইংরেজি মাধ্যমে সেটা না থাকায় তাদের বিভ্রান্ত করা সহজ। তাই কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের গবেষণায় যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এরকম শিক্ষকের সংখ্যাই বেশি। সলিমুল্লাহ খান টিভি টকশোতে বলেছিলেন, মাদ্রাসার হুজুররা এত জ্ঞানী যে তাদের সঙ্গে কথা বলার মত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ শিক্ষকও খুঁজে পাওয়া যাবে না…। ইসলাম সম্পর্কে এদের হয় বিন্দু পরিমাণ পড়াশোনা নেই নতুবা এরা তাদের পৈত্রিক ধর্মকে জঙ্গিবাদ থেকে আড়াল করতে চাইছে। টেররিজম ইউনিটের গবেষণা অত্যন্ত দু:খজনকভাবে ব্যর্থ হবে। কারণ এতে আসল জিহাদের আঁতুরঘরকে আড়াল করা হয়েছে। ধর্মকে বাদ দিযে যেমন মৌলবাদ দমন করা যায় না, তেমন ইসলামকে বাদ দিয়ে জঙ্গিবাদকে দমন করা যায় না। এই সত্য মানতে না পারলে আমাদের আশাবাদী হওয়ার মত সামনে আর কিছু নেই।