লিখেছেনঃ বার্ট্রান্ড রাসেল, আপডেটঃ July 19, 2019, 12:00 AM, Hits: 1198
অনুবাদ – আলমগীর হুসেন
এ প্রশ্নটি আচমকা এমন এক দল মানুষের মাঝে উদয় হলো, যারা সাধারণত রাজনীতির বাইরে অন্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে পছন্দ করে। এটা নিশ্চিত যে, আজ কেউই এমন প্রশ্ন তুলবে না যে, “আমি কৃষিবাদী নই কেন” কিংবা “আমি সমাজবাদী গণতন্ত্রী নই কেন”। আর কৃষিবাদী না হলেও তা কোন চিন্তাধারা বা জীবনদর্শন প্রতিফলিত করে না, কিন্তু কমিউনিস্ট না হওয়ার অর্থ তুমি অকমিউনিস্টও বটে; কমিউনিস্ট না হওয়া স্বাভাবিক অর্থে কিছু না মানা নয়, তা একটা বিশ্বাসকেও প্রতিফলিত করে।
ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নটা আমার জন্য স্বস্তি আনয়ণ করে, কেননা আমি কমিউনজমের সাথে বাক-বিতণ্ডা বা রেষারেষি পরিহারের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। বরং আমার দৃষ্টিতে আমি কেন কমিউনিস্ট নই এবং কেন একজন কমিউনিস্ট হতে পারি না, সেটা ব্যাখ্যা করাই শ্রেয় মনে করি। আমি একজন কমিউনিস্ট হলে তা আমার জন্য সহজ হতো। তাহলে আমি ভাবতে পারতাম যে, আমি সর্বাধিক সাহসিকতার সাথে পৃথিবীর স্বার্থে অবদান রাখছি; ভাবতে পারতাম আমি অবস্থান নিচ্ছি ধনীদের বিরুদ্ধে গরীবদের পক্ষে, ঝুলি-ভর্তি টাকাওয়ালাদের বিরুদ্ধে ক্ষুধার্তদের পক্ষে; আমি জানতে পারতাম এটা-সেটার ব্যাপারে কিভাবে ভাবতে হবে, কিসব ঘৃণা করতে হবে, কি উপেক্ষা করতে হবে। তৎপরিবর্তে আমি যেন কণ্টকময় জঙ্গলে এক উলংগ মানুষের মতঃ আমার হাত খালি, কোন জীবনতত্ত্ব দ্বারা তা পূর্ণ নয়; পৃথিবীকে সাহায্য করার ব্যাপারে অক্ষমতা বোধ করছি, এবং অনেক ক্ষেত্রেই জানি না আমার বিবেককে কিভাবে রক্ষা করব। কিন্তু আমার মন যদি গরীবদের পক্ষে থাকতো… আমি তাহলে কমিউনিস্ট নই কেন?
কেননা আমি গরীবদের পক্ষে।
আমি এমন যন্ত্রণাদায়ক ও বর্ণনার অতীত দারিদ্র্য দেখেছি, যা আমার সবকিছুকে তিক্ত করে তুলেছে। আমি যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই রাজপ্রাসাদ ও যাদুঘর থেকে দরিদ্রদের জীবন পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে দেখেছি এক লজ্জিত অসহায় দর্শকের ভূমিকায়। কেবল দেখাই যথেষ্ট নয়, সহানুভূতিই পর্যাপ্ত নয় — আমার উচিত তাদের জীবন গ্রহণ করা, কিন্তু আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত। এক দংশনাত্মক অমানবিক দারিদ্র্য কোন একক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে নি। কারও ফাস দিয়ে মরার কিংবা এক টুকরো ময়লা কাপড় ঝুলানোর মত একটা পেরেকও নেই, এমন সব দুর্বিসহ বস্তিগুলোর ব্যাপারে সমাজতন্ত্র সতর্ক দূরত্ব থেকে তাদের কাছে পৌঁছাতে চায় — এ গলাবাজী তুলে যে, সামাজ-ব্যবস্থাই সবকিছুর জন্য দায়ী; দুই বছরে, না-হয় বিশ বছরে ‘বিপ্লব’-এর পতাকা উন্মোচিত হবেই, এবং তারপর?……
***
কি ঘটবে দুই বছর বা বিশ বছর পর? কেউ কি এতটা নির্বিকারভাবে গ্রহণ করতে সক্ষম যে, কেউ এমন অবস্থায় আরও দু’টো শীতকাল, দু’টো সপ্তাহ বা দু’টো দিনও অতিবাহিত করুক? বুর্জোয়ারা যে এখানে সাহায্য করতে পারে না বা চায় না, সেটা আমার কাছে খুবই অবাককারী, কিন্তু একইভাবে অবাককারী সমাজতন্ত্রও, যা সাহায্যের পরিবর্তে আনয়ণ করে বিপ্লবের পতাকা। সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক কথা হচ্ছে শাসন করা, রক্ষা করা নয়। তার বিশাল শ্লোগান হচ্ছে ক্ষমতা করায়ত্ত্বকরণ, সহায়তাকরণ নয়। সমাজতন্ত্র যেভাবে তাদেরকে দেখে, তা হচ্ছেঃ দারিদ্র্য, ক্ষুধা, কর্মহীনতা ইত্যাদি অসহনীয় যন্ত্রণা ও লজ্জা নয়, বরং কালো শক্তি করায়ত্ত্বকরণের জন্য স্বাগতম মোক্ষম অস্ত্র, যা ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে ফেনিয়ে তোলা হয়। “সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী”। না, তা নয়। বরং আমরা সকলেই দায়ী — সে আমরা মানব দারিদ্র্যের উপর পকেটে হাত গুজেই দাঁড়িয়ে থাকি, কিংবা বিপ্লবের লাল পতাকা হাতে।
গরীব জনতা কোন শ্রেণী নয়, বরং তারা আসলে শ্রেণীহীন, বিবর্জিত ও অসংগঠিত জনতা; তারা কখনোই সিংহাসনে বাস করবে না, যেই তাতে বসুক না কেন। ক্ষুধার্তরা রাজত্ব করতে চায় না, চায় খেতে; দারিদ্র্যের ব্যাপারে বলি — কে শাসন করে বা না-করে তাতে কিছুই আসে যায় না; যা আসে যায়, তা হচ্ছে মানুষ হিসেবে আমরা কেমন অনুভব করি। দারিদ্র্য কোন প্রতিষ্ঠান নয়, না শ্রেণী; তৎক্ষণাত মানবিক সাহায্যের আবেদন খুঁজতে গিয়ে আমি কেবলই দেখি শীতল শ্রেণী শাসনের ত্তত্ব। আমি কমিউনিস্ট হতে পারি না, কেননা তার নৈতিকতা সাহায্য করার নৈতিকতা নয়। কেননা তা সমাজের আসল সমস্যা, যা হচ্ছে দারিদ্র্য, তা উপড়ে না ফেলে সামাজিক ব্যবস্থা উপড়ে ফেলার জারি গায়। এবং যদি তা আদৌ গরীবদেরকে সহায়তা করতে চায়, সেটা শর্তাধীন — প্রথমে আমাদেরকে শাসনের সুযোগ দিতে হবে এবং তারপর (সম্ভবত) তোমাদের পর্ব আসবে। দুঃখজনক যে, এ শর্তাধীন সহায়তাও লিখিতভাবে সুনিশ্চিত নয়।
***
গরীব জনতা কোন দল নয়। এক হাজার মজুর একজন মজুরকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করতে পারে; কিন্তু এক হাজার দারিদ্র্য-পীড়িত মজুর একজন দরিদ্র মজুরের জন্য এক টুকরো রুটির ব্যবস্থাও করতে পারে না। একজন গরীব, ক্ষুধার্ত ও অসহায় ব্যক্তি সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন। তার জীবন নিজেকে ঘিরেই, অন্যদের সাথে সংগতিবিহীন। এটা একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার, কেননা তা একটা বিপর্যয়, যদিও তা অন্যান্য ব্যাপারগুলোর মতই — এক ছেড়া কাপড় আরেক ছেড়া কাপড়ের কাছে যেমন। সমাজকে যেভাবেই ঘুরানো হোক না কেন, গরীবরা আবারও নীচেই পড়বে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে।
আমি একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ধারে-কাছেও না, তথাপি আমি দলবদ্ধতার মূল্যে বিশ্বাসী নই। সর্বোপরি কেউউ, আমি আশা করি, মনে-প্রাণে ভাবে না যে, দলবদ্ধ জনতা শাসন করবে। তারা কেবলই কোন বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য বস্তুগত অস্ত্র মাত্র। তারা কেবলই রাজনৈতিক অস্ত্র, ঠিক যেমনটি অন্যান্য রঙের পার্টির সদস্যরা, তবে আরও কঠোর ও নিষ্ঠুর অর্থে। জনতাকে কোন প্রকারের আকারে রূপ দিতে ঢলাঢলির প্রয়োজন পড়ে, যাতে তারা দলবদ্ধ অস্ত্রে পরিণত হয়; তাদেরকে কোন বিশেষ কাপড়ের বা মতবাদের পোষাক (ইউনিফর্ম) পরাতে হয়। দুঃখজনক যে, কেউ কোন বিশেষ মতবাদের ইউনিফর্ম আঠারো মাস পরার পর কদাচিৎ খুলে ফেলতে পারে।
আমি সমাজতন্ত্রকে গভীরভাবে সম্মান দেখাতে শুরু করব, যদি তা মজুরদের কাছে এসে সততার সাথে বলেঃ “আমি তোমাদের কাছ থেকে কিছু চায়, কিন্তু তোমাদেরকে দেওয়ার কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না; আমি চাই তোমরা আমার জন্য একটা জিনিস হও, দল হও, বস্তু হও, ঠিক যেমন করে তোমরা একটা জিনিস বা বস্তু কোন ফ্যাক্টরীতে; তোমরা কেবল মানবে ও নীরব থাকবে, ঠিক যেভাবে তোমরা মান ও নীরব থাক ফ্যাক্টরীতে। প্রতিদান হিসেবে যখন সবকিছু বদলে যাবে তখন তোমরা যা আছ তাই থাকবে; তোমাদের অবস্থা অধিক ভাল কিংবা মন্দও হতে পারে — কোনটা আমি তার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না; বিশ্বের ব্যবস্থা তোমাদের প্রতি না হবে অধিক দানশীল না দয়ালু, তবে অধিক ন্যায্য।” আমার বিশ্বাস বেশীরভাগ মজুর এমন প্রস্তাব গ্রহণে যথেষ্ট ইতস্তত করবে — এবং তবু তা অত্যন্ত সৎ পন্থামূলক হবে এবং কে জানে যে, সে প্রস্তাব অত্যন্ত নৈতিকতামূলক হওয়ায় তা অন্যান্য প্রস্তাবের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
গরীব জনতাকে প্রতিশ্রুতি খাওয়ানো তাদেরকে ডাকাতি করার সামিল। সম্ভবত তাদের জীবন সহজতর হবে তাদের জন্য চীনামাটির পাত্রের উপর একটা মোটাকাটা রাজহংস একে দিলে। তবে বাস্তবে একশ’ বছর আগের মত আজও কারো হাতে একটা চড়ুই পাখি সরকারী ভবনের উপর বসে থাকা একটা পায়রার চেয়েও ভাল এবং কারো চুলায় আগুন রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর বসা একটা লাল মোরগের চেয়েও ভাল। তদুপরি যে ব্যক্তির মাঝে শ্রেণী-সচেতনতা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, সে নিজ চোখকে অবহেলা করে বিশ্বাস করে যে, এখানে যা আছে তার চেয়ে সে অনেক বেশী পাবে। কেননা সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতিত জীবনের মানদণ্ডে আমরা খুব একটা স্বচ্ছল জাতি নই, যা সবাই সাধারণত উল্লেখ করতে ভুলে যায়।
স্বভাবতই তারা বলে যে, গরীবদের হারানোর কিছুই নেই। কিন্তু যাই ঘটুক না কেন, আসলে গরীবদেরই ঝুকি সবচেয়ে বেশী, কেননা তারা আরেকটু হারালেই শেষ রুটিটুকুও হারাবে; গরীবদের পেটের ভাতের ঝুঁকি নিয়ে কারো পরীক্ষা করা উচিত নয়। কোন বিপ্লবই সামান্য সংখ্যক মানুষের উপর চেপে সফল হয় না, তৎপরিবর্তে তা সফল হবে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ঘাড়ে চেপে। হোক যুদ্ধ, মুদ্রা বিপর্যয় কিংবা অন্যকিছু, সবক্ষেত্রেই গরীবদেরকে ভোগ করতে হয় সবচেয়ে প্রাথমিক ও সাংঘাতিক প্রতিফল। এবং যথেষ্ট সহজেই বলা যায় যে, দারিদ্র্যের কোন সীমা-পরিসীমা নেই, না আছে কোন তলা। বিশ্বের সবচেয়ে পচা জিনিস ধনীদের মাথার উপরের ছাদ নয়, বরং গরীবদের মাথার উপরের ছাদ। পৃথিবীকে জোরে একটি ঝাকুনি মার এবং দেখবে কে ধ্বংসস্তুপের মাঝে পড়ে আছে।
কথা হচ্ছে, কি করতে হবে? আমার মতে, আমি “বিবর্তন” শব্দটিতে তেমন ভরসা পাই না। আমি মনে করি, দারিদ্র্যই পৃথিবীতে একমাত্র জিনিস, যা বিবর্তিত হয় না বরং কেবলই বিশৃংখলভাবে বৃদ্ধি পায়। তবে দরিদ্রদের বিষয়কে আগামীতে কোন বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা পর্যন্ত মুলতবী করা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদেরকে যদি সাহায্য করতেই হবে, তা এখনই শুরু করতে হবে। তবে এ কাজটা করার জন্য আজকের বিশ্বের যথেষ্ট নৈতিক সম্বল আছে কি না, সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। সমাজতন্ত্র বলে যে, তা নেই। আসলে মূলত এ প্রত্যাখ্যানের মাঝেই আমাদের বিরোধ। আমি বলি না যে, আমাদের এ সামাজিক আবর্তে যথেষ্ট পরিপূর্ণ ন্যায়-পরায়ন মানুষ রয়েছে, তবে আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই ন্যায়-পরায়নতার ছিটে-ফোটা রয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি যে, কিছুটা অব্যাহত প্রচেষ্টা ও যথেষ্ট হস্ত দোলানির পর আমরা যথেষ্ট শালীন ন্যায়-পরায়নতায় একমত হতে পারি। অথচ সমাজতন্ত্র বলে যে, এমন মতৈক্য অসম্ভব। মনে হয় তা মানুষের মূল্যবোধকে সেভাবেই সন্দেহ করে। যাহোক সে সম্পর্কে পরে আলোচণা হবে। আজকের সমাজ হোচট খেয়ে পড়ে নি, যখন সে কর্মহীন, বৃদ্ধ ও অসুস্থদের জন্য কোন না কোন প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেছে। আমি বলছি না তা যথেষ্ট, বরং গরীব ও আমি উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে যে, আজ অনেক কিছুই কার্যক্ষেত্রেই করা সম্ভব হয়েছে সে বিপ্লবের পতাকা উন্মোচিত হওয়ার গৌরবোজ্জ্বল মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা না করে।
গরীবদের বিষয় যে বর্তমানের কাজ, আগামী ব্যবস্থার নয়, তাতে বিশ্বাস করার অর্থ কমিউনিস্ট বণে যাওয়া নয়। বরং বিশ বছর পরে আসতে পারে এমন বিপ্লবের চেয়ে আজকে চুলোর এক টুকরা রুটি ও আগুন বেশী গুরুত্বপূর্ণ — এমনটি বিশ্বাস করা বড় ধরনের অকমিউনিস্ট মনোভাবের প্রতীক।
***
সমাজতন্ত্রের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ও সর্বনিম্ন মানবীয় বিষয় হচ্ছে ইহার আজব বিষন্নতা। যত জঘন্য তত ভালঃ কোন সাইকেল চালক কোন বধির দাদীমাকে আঘাত করে, তা বর্তমান ব্যবস্থার পচনশীলতার প্রমাণ; যদি ভুলক্রমে কোন মজুরের অঙ্গুলি মেসিনের চাকায় আটকে যায়, তাহলে চাকাটি তার আঙ্গুল পিস্ট করছে না, করছে বুর্জোয়া এবং তারা তা করবে রক্তপিপাসু আনন্দের সাথে। যারা কোন না কোন ব্যক্তিগত কারণে কমিউনিস্ট নয়, তাদের হৃদয় পাশবিক ও জঘন্য, যেন আলসারের মত; সমগ্র বর্তমান ব্যবস্থার মাঝে একবিন্দু ভালও নেই, সবকিছুই খারাপ। এক লোক-গীতিকায় (কমিউনিস্ট কবি) জিরি উলকার লিখেছেনঃ “হে গবীরবৃন্ধ, তোমাদের অন্তরের গহীনে আমি দেখতে পাই ঘৃণা।” এমনটি বলা জঘন্য, তবুও কৌতূহলের বিষয় যে, তা বলা পুরোপুরি বেঠিক। গরীব মানুষের অন্তরের গহবরে ঘৃণা-বিদ্বেষের পরিবর্তে রয়েছে চমৎকার ও সুন্দর উৎফুল্লতা। মেসিনে কর্মরত মজুর কাজের ফাকে কৌতুক কাটে ফ্যাক্টরীর মালিক ও পরিচালকের চেয়ে অধিক আনন্দের সাথে; নির্মাণ-কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে প্রধান নির্মাতা বা মালিকের চেয়ে বেশী মজা করে; এবং বাড়ির ভিতর দেখা যাবে মালিকিনীর চেয়ে ঘর পরিষ্কারে রত গৃহকর্মিনীই বেশীরভাগ সময় গুন-গুনিয়ে যাচ্ছে। কাজেই তথাকথিত মজুর-গোষ্ঠী স্বভাবতই প্রধানত এক উৎফুল্ল ও বাচ্চা-সুলভ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাদের জীবন সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক হতাশাবাদ ও বিষাদ-পূর্ণ ঘৃণা তার মাঝে কৃত্রিমভাবে নোংরা পাইপ দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরূপ বেপরোয়া বিষাদের আমদানীকে বলা হয় “জনতাকে বিপ্লববাদের দিকে প্রশিক্ষিতকরণ” বা “শ্রেণী-সচেতনতা ঘনীভূতকরণ”। সামান্য সহায়-সম্বল সম্পন্ন গরীব জনতাকে তাদের জীবনের প্রাথমিক আনন্দ-উল্লাসটুকুও হরণ করা হয় — ভবিষ্যৎ উন্নত জীবনের জন্য সেটাই হচ্ছে তাদের জন্য সমাজতন্ত্রের প্রথম প্রতিদান।
সমাজতন্ত্রের আবহ হচ্ছে বীভৎস ও অমানবিক; সেখানে হিমায়িত বুর্জোয়া ও বিপ্লবী অগ্নির মাঝে কোন মধ্যবর্তি তাপমাত্রা নেই; সেখানে কিছুই নেই যাতে মজুর সমাজ তাদেরকে নির্বিঘ্ন আনন্দের সাথে প্রবৃত্ত করতে পারে। পৃথিবীতে না আছে কোন মধ্যাহ্নভোজ না নৈশভোজ; কেবলই গরীবদের জন্য পচা রুটি অথবা ধনীদের মেদ-ভুড়ি। সেখানে কোনই ভালবাসা নেই, কেননা সেখানে কেবলই আছে ধনীদের বিকৃত যৌনাচার কিংবা গরীবদের সন্তান প্রসব। বুর্জোয়া তার নিজস্ব পচা-দুর্গন্ধ শুকে, মজুর তার খাদ্য, নির্মল বাতাস তিরোহিত। আমি জানি না সাংবাদিক ও লেখকগণ বিশ্বের এরূপ অবান্তর চিত্রে নিজেদেরকে বিশ্বাসী ক’রে তুলতে সমর্থ হয়েছে কি না, নাকি তারা জেনে-শুনে মিথ্যে বলে। আমি কেবলই জানি যে, এক নির্বোধ ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তি, যেমনটি হচ্ছে মজদুর সমাজ, এক ভীষণ বিকৃত জগতে বাস করে, যার কোনই মূল্য নেই তার কাছে — কেবলমাত্র তাকে ভেঙ্গে-চূড়ে ফেলা, উপড়ে ফেলা ছাড়া। কিন্তু এমন বিশ্ব যেহেতু এক নিছক কল্পনামাত্র, কাজেই এখনই উচিত সে কল্পিত ভাবনা ভেঙ্গে ফেলা, তার শিকড় উপড়ে ফেলা, দৃষ্টান্তস্বরূপ কোন প্রকারের বিপ্লবী কর্ম দ্বারা। সে কাজ আমি আগ্রহের সাথে সমর্থন করব। কোনই সন্দেহ নেই যে, আমাদের অশ্রুময় উপত্তকায় রয়েছে অশেষ বর্ণনার অতীত বিপর্যয়, অত্যাধিক ভোগান্তি, অপর্যাপ্ত কল্যান এবং সামান্য আনন্দ। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বকে অত্যাধিক রঙ্গিন আভায় অঙ্কিত করি না, কিন্তু যখনই আমি অমানবিক নেতিবাচকতা ও সমাজতান্ত্রিক নির্মমতার মুখোমুখী হই, তখনই আমার উচ্চ-স্বরে প্রতিবাদ ক’রে বলতে ইচ্ছে করেঃ তা সঠিক নয়, এবং সবকিছু সত্ত্বেও তার চিত্র এমন নয়।
আমি খুব কম মানুষই দেখেছি যারা কিনা একটা পেয়াজের জন্য সামান্য পরিত্রাণ পাবে না, কিংবা যাদের উপর ঈশ্বর সামান্য অপ্রমত্ত ও দয়াশীল হয়ে অগ্নি ও সালফার উদ্গীরণ করবেন। পৃথিবীতে প্রকৃত পাপাচারের চাইতে অনেক বেশী আছে সংকীর্ণ-মনতা; তথাপি সেখানে রয়েছে যথেষ্ট সহমর্মিতা ও বিশ্বাস, বন্ধুত্ব ও সদিচ্ছা, যাতে ক’রে যে কেউ মানব-বিশ্বের উপর লাঠি চালাতে পারে না। আমি বর্তমান বা আগামী মানবজাতির পরিপূর্ণ উৎকর্ষে বিশ্বাসী নই; পৃথিবী কখনোই স্বর্গরাজ্য হবে না – হোক সে বোঝাপড়ার মাধ্যমে কিংবা বিপ্লবের, এমনকি মানবজাতিকে নিঃচিহ্নকরণের মাধ্যমেও। কিন্তু আমরা যদি কোনক্রমে পাপ-প্রবণ আমাদের সকলের মাঝেকার সুপ্ত ভাল প্রবণতাগুলোকে একত্রিত করতে পারি, তাহলে আমি মনে করি আমরা পৃথিবীকে আজকের দুনিয়া থেকে অধিক দয়াশীল ক’রে তুলতে পারি। কেউ হয়ত বলতে পারে, এটা এক নির্বোধের দর্শন, তবু আমি সেসব নির্বোধদের মাঝে, যারা মানুষকে ভালবাসে, কেননা তারা মানুষ।
এমন বলা খুবই সহজ, যেমন বনটি কালো কিন্তু কোন গাছই সেখানে কালো নয়, বরং তা লাল বা সবুজ, কেননা তা কেবলই পাইন বা ফির (দেবদারু জাতীয়) বৃক্ষে পূর্ণ। এমনটি বলা খুবই সহজ যে, সমাজ খারাপ; কিন্তু যাও এবং সেখানে খুঁজে দেখ কিছু মানুষ যারা মৌলিকভাবে দুর্বৃত্ত। একবারের জন্য হলেও পৃথিবীকে নিষ্ঠুর সর্বজনীনকরণ-বিহীনভাবে বিচার করে দেখ; কিছু সময় পর দেখবে তোমার চিন্তাধারার এক বিন্দুও খুঁজে পাবে না। সমাজতন্ত্রের এক মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে বিশ্ব সম্পর্কে কৃত্রিম বা ইচ্ছাকৃত অজ্ঞতা। কেউ যদি বলে সে জার্মানদেরকে ঘৃণা করে, আমি বলব যাও তাদের মাঝে গিয়ে বাস করে দেখ। এক মাসের মধ্যেই আমি তাকে আবার জিজ্ঞেস করব সে তার জার্মান বাড়িওয়ালীকে ঘৃণা করে কি না, সে রাস্তায় মুলা-বিক্রেতা জার্মান ব্যক্তির গলা কাটতে চায় কি না, কিংবা কঠোর পরিশ্রমী সে দেয়াশলাই বিক্রেতা জার্মান দাদীমাকে গলা টিপে হত্যা করতে চায় কি না। মানব চরিত্রের একটা সর্বনিম্ন নৈতিক উপহার হচ্ছে সর্বজনীনকরণের উপহার, যা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলোর সারমর্ম গ্রহণ করার পরিবর্তে সেগুলোকে ঢেকে বা মুছে ফেলার চেষ্টা করে। সমাজতান্ত্রিক লেখায় কেউ পৃথিবী সম্পর্কে আর কিছু পড়তে পাবে না, কেবল সেগুলো ছাড়া, যার কোনই অর্থ নেই। যাদের কাছে কেবল মতামত-প্রবণতা জ্ঞানের শীর্ষ বিবেচিত নয়, তাদের কাছে তা কখনোই যথেষ্ট মনে হবে না।
বিদ্বেষ, অজ্ঞতা, সার্বিক বিশ্বাসহীনতা — এসবের মাঝেই সমাজতন্ত্রের শারীরিক জগৎ নিহিত। চিকিৎসামূলক নিরীক্ষা বলবে যে, এটা এক রোগাক্রান্ত নেতিবাচকতা। কেউ যদি দলবদ্ধ হয়, তার এ রোগে আক্রান্ত হওয়া সহজ, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তা যথেষ্ট নয়। রাস্তার কোণে ভিক্ষুকের পাশে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াও এবং দেখ পথচারীদের মধ্যে কারা পকেট থেকে পয়সা বের করছে — দশ জনের মধ্যে সাত জন হবে দারিদ্র্যের সীমায় বসবাসকারী, বাকী তিন জন মহিলা। এ ঘটনা থেকে প্রায় অনিশ্চিতভাবে একজন সমাজতন্ত্রী এ সত্যতা উদ্ঘাটন করবে যে, বুর্জোয়াদের রয়েছে নির্দয় মন। কিন্তু আমি উদ্ঘাটন করি অন্যকিছু — যা অধিক সুন্দর, যে মজুরদের সাধারণত রয়েছে কোমল হৃদয় এবং বিশেষভাবে দয়াশীলতা, ভালবাসা ও নিবেদিত প্রাণ। সমাজতন্ত্র তার শ্রেণী-বিদ্বেষ দ্বারা সে মানুষগুলোকে বানাতে চায় হণ্যে কুকুর। গরীবেরা এমন অমর্যাদার দাবীদার নয়।
***
আজকের দুনিয়ার প্রয়োজন নেই বিদ্বেষের, প্রয়োজন সদিচ্ছার, সহায়তার জন্য প্রস্তুতি, ঐক্যমত্য ও পারষ্পারিক সহযোগিতা; তার প্রয়োজন অধিক করুণাশীল পরিবেশ। আমার মতে এতটুকু সহজ-সরল ভালবাসা ও আন্তরিকতা দ্বারা আমরা বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারি। আমি বর্তমান দুনিয়াকে সমর্থন করি তা ধনীদের দুনিয়া বলে নয়, বরং তা গরীবদেরও, এবং যারা মাঝখানে আছে তাদেরও এবং যারা আজকাল শহর জীবনের যাতাকল ও মজুরদলের মাঝে আছে তাদেরও — যারা কম-বেশী সফলতার সাথেই মানব মূল্যবোধগুলোর অধিকাংশ অব্যাহত রাখছে, বাঁচিয়ে রাখছে।
আমি কিংবদন্তীর সর্বোচ্চ মার্গের দশ হাজারের সাথে পরিচিত নই, কাজেই আমি তাদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারি না। কিন্তু আমি সে শ্রেণীর উপর মন্তব্য করতে পারি, যাদেরকে বলা হয় বুর্জোয়া এমনভাবে যে, তা আমার মাঝে এনেছে নোংরা নেতিবাচকতার ইংগিত। আমি এরূপ বলি যে, এটা আমাকে কিছুটা তাদেরকে সমর্থনের অধিক অধিকার দেয়, যাদের অকৃতকার্যতা ও অপরাধের প্রতি আমি অবশ্যই অন্ধ নই। মজদুর জনতা এ শ্রেণীকে উড়িয়ে দিতে পারে না, পারে কেবল তাতে প্রবেশ করতে। সকল প্রকল্পমূলক প্রতারণা সত্ত্বেও কোন মজদুর সংস্কৃতি নেই; আজকাল সার্বিকভাবে কোন লোক-সংস্কৃতিও নেই, নেই কোন সম্ভ্রান্ত সংস্কৃতি, ধর্মীয় সংস্কৃতি — সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের যা কিছুই রয়েছে, তা নির্ভর করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর, তথাকথিত বুদ্ধিজীবি শ্রেণী। কেবলমাত্র মজদুর জনতা নিজেকে এ সংস্কৃতির অংশ ভাবলে, কেবল যদি সে বলেঃ “আমরা বর্তমান বিশ্বকে নিয়ে নেব এবং তার ব্যবস্থাপনা করব বিদ্যমান সকল মূল্যবোধ দ্বারা” — তবেই কেবল আমরা হাত মেলাতে পারি এবং চেষ্টা করে দেখতে পারি। তবে সমাজতন্ত্র যদি কথিত বুর্জোয়া সংস্কৃতির সবকিছুকেই অর্থহীন শিবির হিসেবে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে এগিয়ে চলে, তাহলে বিদায়। তাহলে একটুখানি কাণ্ডজ্ঞান ও দায়িত্ববোধ সম্পন্ন সকলেই ভাবতে শুরু করে — কতটা নষ্ট করা হবে।
****
আমি ইতিমধ্যেই বলেছি যে, সত্যিকার দারিদ্র্য কোন প্রতিষ্ঠান নয়, তা এক বিপর্যয়। সবকিছুর মওজুদ রাখলেও আমরা মানুষকে বাঁচাতে পারব না দুর্ভাগ্যের কোল থেকে, রোগ-শোক থেকে, ক্ষুধা ও শীতের যন্ত্রণা থেকে, সহায়ক হাতের প্রয়োজনীয়তা থেকে। আমরা যাই করি না কেন, দুর্যোগ মানুষের সামনে নৈতিক দায়িত্ব উপস্থাপন করে, সামাজিক দায়িত্ব নয়। সমাজতন্ত্রের ভাষা কঠোর; তা সহানুভূতি, সদিচ্ছা, সহয়তা ও মানব সংহতির মূলোবোধের কথা বলে না; তা আত্ম-বিশ্বাসের সাথে বলে যে, সেখানে সংবেদনশীলতার কোনই স্থান নেই। সংবেদনশীলতার এ অভাব আমার কাছে সবচেয়ে জঘন্য জিনিস, যেহেতু আমি ততটাই সংবেদনশীল যতটা একজন গৃহকর্মী, একজন নির্বোধ বা শালীন ব্যক্তি। কেবল বদমাস ও গলাবাজরা সংবেদনশীল নয়। সংবেদনশীলতা না থাকলে তুমি প্রতিবেশীকে এক গ্লাস পানি দিবে না; শুধুই যুক্তি-ভিত্তিক উদ্দেশ্য তোমাকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ করবে না অন্য কাউকে এবং পিছলে-পরা কোন ব্যক্তিকে টেনে তুলবে না।
****
এরপর রয়েছে সহিংসতার কথা। আমি কোন চিরকুমারী নান নই যে, “সহিংসতা” নামটি শুনতেই আমি ক্রুশের প্রতীক দেখাব। আমি স্বীকার করছি যে, কখনো কখনো আমি কোন ব্যক্তি পেটাও করে মজা পাব, যদি সে একের পর এক ভুল কারণ উত্থাপণ করে কিংবা মিথ্যা বলে। তবে দুঃখজনক যে, তা অসম্ভব — কেননা হয় আমি তাকে পিটানী দেওয়ার জন্য অতিশয় দুর্বল কিংবা সে তাকে প্রতিরক্ষা করতে অক্ষম। দেখতে পাবে যে, আমি আসলে কোন মস্তান নই, তবে বুর্জোয়া যদি চেচাতে শুরু করে যে, মজদুরকে ফাসিতে ঝুলিয়ে দাও, তাহলে আমি অবশ্য উঠে দৌঁড়ে যাব তাদেরকে সাহায্য করতে, যাদেরকে ফাসি দেওয়া হচ্ছে। কোন শালীন ব্যক্তিই হুমকি-দাতার সাথে হাত মেলাতে পারে না। যে গুলি ও ফাসির নির্দেশ দেয়, সে মানব সমাজকে ব্যাহত করে — সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, বরং প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক সততাকে লঙ্ঘন করে।
মানুষ আমাকে “আপেক্ষিকতাবাদী” বলে আমার একাগ্র ও আপাতঃ ভারী বুদ্ধিবৃত্তিক অপরাধের কারণে যে, আমি সবকিছুই বোঝার চেষ্টা করি। আমি সব ধরনের মতবাদ ও সাহিত্য নিয়ে সময় কাটাই, যার মধ্যে রয়েছে নিগ্রো কাহিনী। এবং আমি এক রহস্যময় আনন্দের সাথে আবিষ্কার করি যে, কিছুটা সহনশীলতা ও সরলতার দ্বারা আমরা সব মানুষের সাথেই কিছু সহমতে আসতে পারি, তাদের চামড়ার রঙ বা ধর্মীয় বিশ্বাস যাই হোক না কেন। মনে হয়, কিছু সাধারণ মানবীয় যুক্তি ও সর্বজনীন মানবীয় মূল্যবোধের আধার রয়েছে সব মানুষের মাঝে, যেমন ভালবাসা, হাস্য-রস, ভাল খাবার উপভোগ, আশাবাদীতা, এবং অন্যান্য অনেক কিছুই, যা বিনা আমরা কেউই বাঁচতে পারি না। এবং তারপর আমি কখনো কখনো আতঙ্কিত হয়ে উঠি যে, আমি সমাজতন্ত্রের সাথে একমত হতে পারি না। আমি তার আদর্শ বুঝি, কিন্তু তার পদ্ধতি বুঝি না। কখনো আমার মনে হয়, আমি যেন কোন আজব ভাষায় কথা বললাম, এবং তার চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন আইনের অধীন। যদি কোন জাতি বিশ্বাস করে যে, মানুষের একে অপরকে সহ্য করা উচিত, এবং আরেক জাতি মনে করে যে, মানুষের উচিত একে অপরকে ভক্ষণ করা, তবে সে ভিন্নতা যথেষ্ট সুস্পষ্ট কিন্তু সর্বতোভাবে মৌলিক নয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র যদি বিশ্বাস করে যে, কোন বিশেষ কারণে মানুষকে ফাসিতে ঝুলানো ও গুলি করা তেলাপোকা মারার চেয়ে সাংঘাতিক কোন বিষয় নয়, আমি তা বুঝতে অক্ষম, যদিও আমাকে বলা হয়েছে তা চেক ভাষায়।
বিশৃংখলার প্রতি আমার ভীষণ জঘন্য অনুভূতি রয়েছে, এবং একটা বাস্তব আশঙ্কা যে, এভাবে আমরা কখনোই একমতে আসতে পারব না। আজ পর্যন্ত আমার বিশ্বাস যে, কিছু কিছু নৈতিক ও যৌক্তিক ধারনা, যার মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে চিনে। সমাজতন্ত্রের পদ্ধতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ভঙ্গের লক্ষ্যে বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রচেষ্টা; এটা মানব বিশ্বকে ভেঙ্গে টুকরো-টুকরো করার এক প্রচেষ্টা — যা একে অপরের সাথে সম্পর্কহীন এবং একের অপরকে বলার কিছুই নেই। যা এক পক্ষের জন্য ভাল, তা অন্য পক্ষের জন্য কখনোই ভাল হতে পারে না, হবে না; যেন অপর পাশের মানুষগুলো মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিকভাবে এক নয়। আমার কাছে সবচেয়ে গোঁড়া কোন কমিউনিস্টকে পাঠাও আমাকে কাত করতে — সে যদি তৎক্ষণাৎ আমাকে মেরে না ফেলে, তাহলে আমার বিশ্বাস, আমি তার সাথে অনেক ব্যক্তিগত বিষয়েই একমতে পৌঁছাব — যদিও যতক্ষণ-না বিষয়গুলো সমাজতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত না হয়। কিন্তু সমাজতন্ত্র নীতিগতভাবে অন্যদের সাথে এমন বিষয়েও অমত পোষণ করে, যা সমাজতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত নয়। সমাজতন্ত্রের কাছে স্প্লীনের কার্য সম্পর্কে কথা বল, এবং সে বলবে যে, তা হচ্ছে বুর্জোয়া বিজ্ঞান। একইভাবে পাওয়া যাবে বুর্জোয়া কবিতা, বুর্জোয়া রোমাঞ্চ, বুর্জোয়া মানবতাবাদ ইত্যাদি। এবং কমিউনিস্টদের মাঝে প্রত্যেক বিষয়ে বিশ্বাসের যে দৃঢ়তা দেখা যায়, তা যেন অতি-মানবীয়; এমন নয় যে সে প্রত্যয় খুব প্রশংসনীয়, বরং তারা তা দিয়ে সে কোনক্রমেই তিক্ত-বিরক্ত হয় না। অথবা সম্ভবত তা কোন আত্ম-প্রত্যয়, বরং কিছু ধর্মাচার জাতীয় বিধান, অথবা সর্বোপরি কোন পেশাদার কৌশল।
আমার বিশেষ দুঃখ সেসব মজুর জনতার জন্যই, তাদেরকে বাকী শিক্ষিত সমাজ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় কোন বদলা ছাড়াই — একমাত্র বিপ্লবের আনন্দ ছাড়া। সমাজতন্ত্র মজদুর জনতা ও বাকী বিশ্বের মাঝে এক প্রাচীর খাড়া করে দেয়। সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবিগণ — তোমরাই রঙ্গিন বেষ্টনী পরে দাঁড়াও তাদের ও অন্য সবকিছুর মাঝে, যা নতুন আগন্তুকদের হিস্যা হিসেবে প্রস্তুত। কিন্তু এরপরও শান্তির পায়রাদের জন্য স্থান রয়েছে — যদিও তোমাদের মাঝে না হলেও তোমাদের মাথার উপর কিংবা সরাসরি উপর থেকে।
***
অন্তত এতটুকু বলতে পেরে আমি অনেক হাল্কা বোধ করছি, যদিও ইহাই সবকিছু নয়। আমি কোন দলাদলিতে নেই এবং সমাজতন্ত্রের সাথে আমার তর্ক কোন আদর্শগত তর্ক নয়, বরং ব্যক্তিগত বিবেক-বিবেচনার। আমি যদি তর্ক করতে পারি — অন্যদের নীতির সাথে নয় — বিবেক-বিবেচনার সাথে, তাহলেই আমার বিশ্বাস আমাদের একে অপরকে অন্তত বুঝা অসম্ভব হবে না। এবং তাই হবে অনেক।
প্রিটোমনস্ট ম্যাগাজিন, ২ ডিসেম্বর ১৯২৪