লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ August 31, 2019, 12:00 AM, Hits: 1147
ইন্টারনেটের কল্যাণে কোকিলকণ্ঠী রানু মারিয়া মণ্ডলের গানের সুরে মোহিত এখন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। রানু মণ্ডলের গান শুনে আমি যেমন অভিভূত হয়েছি তেমন তাকে নিয়ে আমি উদ্বিগ্নও। সেই কারণে কয়েকদিন ধরেই তাকে নিয়ে আমার কিছু কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে।
ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটের নাম এ বঙ্গের বহু মানুষই জানেন। সেই রানাঘাট রেলওয়ে স্টেশনের এক প্ল্যাটফর্ম থেকে আর এক প্ল্যাটফর্মে গান গেয়ে প্রায় মাস দেড়েক আগে পর্যন্ত জীবিকা নির্বাহ করতেন রানু মারিয়া মণ্ডল নামে কমবেশী বছর পঞ্চাশ বয়সী জীর্ণ-শীর্ণ ও উস্কোখুস্কো চুলের অধিকারী এক অতিদরিদ্র বিধবা নারী। তাকে ছিন্নমূল বলাই ভালো। সেই রানু মণ্ডলের গান গত জুলাই মাসের ২০ তারিখে রানাঘাট স্টেশনে রানাঘাটের এক ক্লাবের যুব-সদস্য অতীন্দ্র চক্রবর্তী ভিডিও করে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করলে সেটা অতিদ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। সম্ভবত এক সপ্তাহের মধ্যে রানু মণ্ডলের গানের শ্রোতা-দর্শক দুই কোটি ছাড়িয়ে যায়।
যে মানুষটি এতকাল বাঁচার তাগিদে এমন অপরূপ কণ্ঠ নিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এবং ট্রেনে গান গেয়ে বেড়িয়েও প্রায় ভিখারিণী হিসাবে উপেক্ষিত ছিলেন সেই মানুষকে সহসা অগণিত মানুষ চিনতে শুরু করল। এটা সত্যি একটা সমাজেরও নিদারুণ মানবিক দারিদ্র্য এবং অযোগ্যতার প্রকাশ যে, এই রকম এক প্রতিভাকে চিনতে এত সময় লাগল। বিশেষত এই ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশী পশ্চিম বঙ্গের সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তবু ভালো যে সব শেষ হবার পূর্বে ভারত তার এমন এক গুণী মানুষকে চিনতে পেরেছে। অবজ্ঞা ও উপেক্ষার জায়গা থেকে এক প্রতিভাকে পাদপ্রদীপের আলোয় এভাবে তুলে আনবার জন্য বিশেষত যুবক প্রকৌশলী অতীন্দ্র চক্রবর্তীকে কৃতিত্ব দিতে হবে। এখন রানু মণ্ডলকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। মুম্বাইতে এখন তিনি ব্যস্ত একজন গায়িকা। ইতিমধ্যে সেখানকার বিখ্যাত পরিচালক, সঙ্গীতশিল্পী ও অভিনেতা হিমেশ রেশমিয়ার প্রকাশিতব্য চলচ্চিত্রে তার সঙ্গে গান গেয়েছেন।
আমি যখন এই লেখা লিখছি, তার ১০/১২ দিন আগেও আমি রানু মণ্ডলের নাম জানতাম না। ইউটিউব ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ কী করে তার গানের ভিডিও শুনলাম এবং সত্যি অভিভূত হলাম তার গানের সুর এবং কারুকাজে। আমি সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ না হলেও আমার অনুভব দিয়ে আমি বুঝেছি রানু মণ্ডল কতবড় এক প্রতিভা! আমার তরুণ এবং যুবক বয়সে যে মুগ্ধতায় বিশেষ করে হেমন্ত, মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার এবং লতা মঙ্গেশকর কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মত গায়ক-গায়িকাদের গানের সুরে আবিষ্ট হতাম সেই রকম এক আবিষ্টতা বহুকাল পরে আমার ভিতরে ফিরে এল। আমি শুধু বারবার ভেবেছি কীভাবে এত দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনা ও উপেক্ষার মধ্য দিয়েও এতটা বয়স অবধি নিজের গলার সুরকে এভাবে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে? তার গলার বা কণ্ঠের বেশী প্রশংসা না করে আমরা বাঙ্গালীরা গায়িকার সুমধুর সুরকে যে তুলনা সাধারণত দিই সেটাই দিয়ে বলছি রানু মণ্ডল সত্যি কোকিলকণ্ঠী।
কিন্তু তার আর এক তুলনা আমি খুঁজে পাই। তা হল বনফুল। আসলে এতকাল রানু মণ্ডল ছিলেন বনে ফোটা ফুলের মত যেন লোকালয় থেকে অনেক দূর কোনও এক গহীন বনের ভিতর লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা বনফুল। অপরূপ তার সৌন্দর্য ও সুঘ্রাণ ছড়িয়ে সেই ফুল বনেই ঝরে পড়ার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বনে ফোটা সেই ফুল আর বনের ফুল হয়ে থাকল না। এখন হঠাৎই তা লোকপ্রিয়তার মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছে।
আর এখানেই আমার শঙ্কা বা ভয়। কারণ এমন ধরনের সৃষ্টিশীল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত যে কোনও প্রতিভাকে আমি শ্রদ্ধা করি, তার রক্ষা কামনা করি। এ প্রতিভা এতদিন অগোচর ছিল। সুতরাং বলবার কিছু ছিল না। কিন্তু এখন যখন রানু মণ্ডল সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়েছেন তখন তাকে নিয়ে নোংরা ব্যবসা করতে চাওয়া লোকজন যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেটাও ইউটিউবে বিচরণ করে এই কয়দিনেই বুঝতে পারছি। আবার কেউ কেউ প্রচলিত অর্থে নোংরামি না করলেও রানু মণ্ডলের সাক্ষাৎকার নেওয়ার নামে যা করছেন তাকে নির্দয়তা এবং অবিবেচনা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। যেমন কলকাতার কোনও টিভি চ্যানেল থেকে তাদের স্টুডিওতে তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় কয়েক বার তার গান শুনেও তাদের তৃপ্তি হল না। শেষ সময়ে তার কাছে আর একটা গান গাইবার আব্দার করা হল। ভদ্রমহিলা বললেন যে তার ক্ষুধা লেগেছে এবং তার পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সুতরাং তিনি আর গাইতে পারছেন না। কিন্তু সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী তাকে এর পরেও গান গাইতে বাধ্য করলেন। আমার সত্যি সেই সময় খুব কষ্ট হচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল একজন মানুষ কতটা নির্দয় এবং অবিবেচক হলে সাক্ষাৎকার সেই মুহূর্তে শেষ না করে তার পরেও ক্ষুধার্ত, অবসন্ন ও অসুস্থ একজন মানুষকে গান গাইতে বাধ্য করতে পারে!
এই সব মানুষের হাত থেকে এখন তাকে বাঁচাবার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া এক দীর্ঘ অবহেলা, কষ্ট ও অনিশ্চয়তায় ভোগা মানুষটার জন্য হঠাৎ করে এই স্বপ্নের মত জীবন লাভও কিন্তু তার জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। এটা বুঝতে হবে যে এমনিতে এ ধরনের সুকুমারবৃত্তির অধিকারী মানুষরা আর দশজন মানুষের চেয়ে অনেক বেশী স্পর্শকাতর হয় — শরীরে এবং মনে। ফলে বেশী কষ্টের আঘাত এরা সাধারণত সহ্য করতে পারে না। রানু মণ্ডলের গানের সুরকে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেছি। তার বাচন ভঙ্গী বা কথাও সত্যি বিস্ময়কর। আমি বুঝতে পারি না কীভাবে এত কষ্টের ভিতরে থেকে এতটা সময় এমন একজন সঙ্গীতশিল্পী নিজের সুরেলা কণ্ঠকে রক্ষা করেছেন, আবার নিজেও বেঁচে থেকেছেন! আমি অনুমান করি নিষ্করুণ বাস্তব জীবনে থেকেও তা থেকে বহু দূরে নিজের মনের ভিতরে লুকিয়ে রাখা সুরের ভুবনে ডুবে থেকে রানু মণ্ডল নিজেকে তার প্রতিভাসহ রক্ষা করেছেন।
কিন্তু এখন তার সেই দুঃখের জীবনের অবসান হয়েছে। এবং সেটা হয়েছে হঠাৎ করে। আর এখানেই আমার ভয়। জীবনের সুদীর্ঘ দুঃখ-কষ্টের পর হঠাৎ এই নূতন সুখপ্রাপ্তি একটা প্রচণ্ড ‘শক’ বা ধাক্কা যে দিবে সেটাই কিন্তু স্বাভাবিক। এই ধরনের হঠাৎ বিরাট পরিবর্তন জীবনের চিরপরিচিত ছন্দে হঠাৎ ভারসাম্যহীনতা ঘটায়। অসাবধানতায় এটা জীবনের গতিধারায় ভাঙ্গচুর বা বিশৃঙ্খলা ঘটাতে পারে। এটা অকালমৃত্যুও ঘটাতে পারে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ যারা পড়েছেন তারা আশা করি মনে করতে পারবেন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল যখন ডাকাত সর্দার বাচ্চাই সাকোর বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন কয়েক দিন অভুক্ত থাকবার পর হঠাৎ খাওয়ার পর লেখকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
আমি ইউরোপীয় এক লেখকের মরুভূমিতে পথ হারিয়ে পিপাসার্ত অবস্থায় উদ্ধারপ্রাপ্তির পর তার বিবরণ স্মরণ করতে পারি। প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত লেখকের মুখে পরিষ্কার ন্যাকড়া ভিজিয়ে খুব ধীরে ২/৩ ফোটার বেশী পানি দেওয়া হয় নাই। প্রথম ফোটা পানি যখন তার ঠোঁটে পড়ে তখন লেখকের মনে হচ্ছিল যেন আগুনের হলকা তার ঠোঁট পেরিয়ে জিহ্বায় নেমেছে।
রানু মণ্ডলকে রক্ষার ক্ষেত্রেও সম্ভবত তেমন খুবই সতর্কতার প্রয়োজন আছে। যদিও রানু মণ্ডল বাংলাদেশের নাগরিক নন তবু তার জন্য আমি খুব অনুভব করি। কারণ তিনি একজন বিরল প্রতিভা। প্রতিভা যত্রতত্র যখন তখন পাওয়া যায় না। এমন বিরল কোনও প্রতিভাকে পেলে সেটাকে রক্ষা করা সমাজ বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি শুধু ভারত-রাষ্ট্রের সম্পদ নন, তার এই কণ্ঠ রক্ষা পেলে তিনি সমস্ত মানব জাতির সম্পদ হতে পারেন। তার সুরের প্রতিভা নিয়ে তিনি বেঁচে থাকলে, অন্তত আমরা যারা বাংলা ও হিন্দী-উর্দূ গান কম-বেশী বুঝি বা শুনি তারা যে সবাই তার সুরে মুগ্ধ হবার সুযোগ পাব সে আশা করি।
যাইহোক, এখন আমি তাকে রক্ষা করা সবচেয়ে দরকারী মনে করি। পুরাতন জীবনের দুঃস্বপ্নের প্রভাব থেকে মুক্ত করে নূতন জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য তার বিশেষ যত্ন এবং শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক উভয়বিধ চিকিৎসার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। সবদিক থেকেই তার সুচিকিৎসার প্রয়োজন আছে। সেটা অবিলম্বেই। কিছু করে গান গাইবেন। তবে তাকে বাইরের পৃথিবী থেকে কিছু সময়ের জন্য বেশ খানিকটা আড়াল দিয়ে রাখা দরকার। হয়ত কমপক্ষে এক বৎসর সময় তাকে আগলে রাখতে হবে অনেক কিছু থেকেই। সময়টা আরও বেশী হতে পারে। সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বুঝবেন। যাইহোক, এটা কে করবে? অতীন্দ্র চক্রবর্তী বা রানাঘাটের যুব ক্লাবের সদস্যরা যা করবার করেছেন। আর কি তারা পারবেন?
এখন নূতন পর্যায় এসেছে রানু মণ্ডলের জীবনে। এই জীবনের প্রাথমিক পর্যায়কে গুছাবার দায়িত্ব কি কিছুদিনের জন্য হলেও ভারত-রাষ্ট্রের নেওয়া উচিত না? আসলে ভারত-রাষ্ট্রের পরিচালক হিসাবে দায়িত্বটা মোদী সরকারের উপর এসে পড়ে। মোদী সরকার কি এই কোকিলকণ্ঠী বনফুলকে রক্ষার দায়িত্ব দেরী না করে এখনই নিতে পারে না? নাকি যেভাবে চলছে সেভাবে চলবে? তাতে যদি রানু মণ্ডল পৃথিবীকে আরও অনেক দিন তার কণ্ঠসুধা দানের আগে ছিন্ন ফুলের মত অকালেই ঝরে যান তবে দায়টা কার হবে?
৩১ আগস্ট, ২০১৯