লিখেছেনঃ শ্রীশুভ্র, আপডেটঃ December 3, 2019, 12:00 AM, Hits: 1221
ভূমিকা
আধুনিক ভারতবর্ষ আসলেই বর্ষব্যাপী ধর্ষণের মহোৎসব। না ধর্ষণ কথাটি শুনলেই যে নারীর শরীর আর তার বিবস্ত্র সম্ভ্রমের ছবি ফুটে উঠতেই হবে তার কোন মানে নেই। ধর্ষণ শুধুই নারীরই হয় না। ধর্ষণ করা হয় মূলত দুর্বল নিরীহের উপরই। আর সমাজের সকল দুর্বল অংশকেই কোন না কোন ভাবে এই ধর্ষণের শিকার হতে হয় এই ভারতের মহামানবের মিলন তীর্থে। হ্যাঁ, ধর্ষণের সবচেয়ে তীব্র শিকার নারীকেই হতে হয় ঘরে এবং বাইরে। সে কথা যেমন সত্যি, ঠিক সেই ভাবে এ কথাও সত্যি যে সমাজের সর্বত্রই এই ধর্ষণব্যাধি ক্যানসারের মতো বিরাজমান। সমাজের উচ্চবর্ণের হাতে দলিতদের নির্যাতন ধর্ষণেরই আর এক রূপ। শিল্পপতিদের পুঁজির বিকাশের স্বার্থে এক্সপ্লয়টেশন অফ লেবার শ্রমিক ধর্ষণেরই নামান্তর মাত্র। রাজনৈতিক দল ও নেতানেত্রীর স্বার্থ রক্ষায় ভোটারদের মগজধোলাই ও ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল ও দেশের সম্পদের উপর ভোগদখল কায়েম রাখাও ধর্ষণের আর একটি রূপ মাত্র। কেবল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর ধোঁকাবাজীর যে রাজনীতি তা আসলে জনমানসকে ধর্ষণেরই গণতান্ত্রিক রূপ। আইনের চোখে সকলে সমান কথাটি নেহাৎই কথার কথা। জনগণের জন্যে আইনের যে প্রয়োগ তা যে কখনোই রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতিদের বেলায় একই রকম ভাবে প্রয়োগ করা হয় না সে কথা ভারতবাসী মাত্রেই স্বীকার করতে বাধ্য। সাধারণ চোরকে কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু দেশের সম্পদ যারা চুরি করে তাদেরকে কখনোই কোমরে দড়ি পরানো হয় না। অর্থাৎ ভারতবর্ষে আইনও নিয়মিত ধর্ষিত হতেই থাকে। সেটাই এই ভূখণ্ডে আইনের শেষ পরিণতি। এবং সব শেষে গণতন্ত্র! ভারতের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের কায়েমী স্বার্থ এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক। দেশের ধনসম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন ও তা দখলে রাখা। অর্থাৎ সোজা কথায় রাজকোষের চাবিকাঠিটি নিজেদের দখলে রেখে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের আখের গুছিয়ে নেওয়া। আর রাজকোষের এই চাবিটি দখলের লড়াইকেই গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই বলে জনগণকে ধোঁকা দিয়ে চলাটাই স্বাধীন ভারতের মূল চরিত্র। আলোচনার সুবিধের জন্যে সমগ্র বিষয়টি তিনটি বিশেষ দিক থেকে পর্যালোচনা করলে বুঝতে সহজ হতে পারে। মূলত একটি দেশের ছাত্রসমাজ ও নারী জাতিকে যদি নিরন্তর ধর্ষিত হতে হয়, তবে সামগ্রিকভাবে সমগ্র দেশ ও জনমানসই ধর্ষণের শিকার হয়। ছাত্র সমাজ ধর্ষিত হলে স্বাধীন মেধার বিকাশের পথটি রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আর সেটি হলেই কায়েমী স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির পোয়াবারো। পুরোপুরি খোলা ময়দানে বিনা প্রতিপক্ষে খেলে যাওয়া সহজ হয়। তাই স্বাধীন ভারতে ছাত্রসমাজকে পরিকল্পিত ভাবে ধর্ষিত করা হয়। প্রথমেই ছাত্রসমাজকে ধর্ষণের পরিকাঠামোয় বেঁধে ফেলতে পারলেই পরবর্তীতে শ্রমিক ধর্ষণ, গণতন্ত্র ধর্ষণ প্রভৃতি জলের মতো সহজ কাজ হয়ে যায়। বিনা প্রতিরোধে। আজকের ভারতবর্ষে এটাই সমাজবাস্তবতা। আর সামগ্রিক ভাবে একটি ধর্ষিত সমাজবাস্তবতায় নারীজাতি যে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হতেই থাকবে সে আর বেশি কথা কি। কিন্তু কেন হল এমন অবস্থা ভারতবর্ষের? আসুন দেখে নেওয়া যাক পরপর।
ধর্ষিত ছাত্রসমাজ
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির প্রবেশ, দলীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে পঠন-পাঠনের ঘোর অবনতিই সূচিত করে।
জীবনের সমগ্র পরিসরে শিক্ষার্জনের সময়সীমা খুবই সীমিত। সেই সীমিত কালসীমায় যে বিদ্যার্জন এবং মেধার বিকাশ সাধন হয়, তার উপরেই সাধারণত বাকি জীবনের সুখ, শান্তি, কর্ম ও পরিতৃপ্তি নির্ভর করে। নির্ভর করে একটি জাতি, একটি দেশের উন্নতিও। রাজনীতির অঙ্গনে, সে নিজের ব্যক্তিগত আখের গোছানোর দূর্নীতিই হোক কিংবা সুনাগরিকের দেশপ্রেমে অভিষ্ট দেশসেবা ও দেশের উন্নয়ণ প্রক্রিয়ায় সদর্থক ভূমিকা রাখাই হোক; কর্মমুখর হয়ে ওঠার জন্যে সারা জীবন পাওয়া যাবে। কিন্তু শিক্ষার্জনের জন্যে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনই জীবনে পাওয়া যায়।
জীবনের সেই স্বল্প কয়টি দিন, যা কার্যকরী শিক্ষার্জনের জন্যেই নির্দিষ্ট তা কখনই রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্র হতে পারে না। শিক্ষার্জনের এই পর্বটি ছাত্রছাত্রীর মৌলিক মেধা বিকাশের প্রস্তুতি পর্ব। তারা এই কালসীমায় শিক্ষা আহরণ করবে, আত্তীকরণ করবে। সেই অধীত বিদ্যায় তাদের মেধা পুষ্ট হতে থাকবে। বিকশিত হয়ে ওঠার পথে দ্রুত গতিশীল থাকবে। এবং পর্বে পর্বে তাদের মৌলিক চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটবে। পারদর্শী হয়ে উঠবে কোনো না কোনো কার্যকরী বিদ্যায়। যে পারদর্শিতায় তারা তাদের কর্মজীবনে ক্রিয়াশীল থাকবে জীবনের মূলপর্বে। তাই সমগ্র জীবনের প্রেক্ষিতে শিক্ষাজীবনের এই মূল্যবান পর্বটি জীবন গড়ার জন্যেই নির্দিষ্ট থাকা উচিত।
কিন্তু ভারতবর্ষে শিক্ষাক্ষেত্র আজ ছাত্ররাজনীতির অভিশাপের করাল গ্রাসে। কেন এমন হলো? সেটা বুঝতে গেলে একটু ফিরতে হবে ইতিহাসে। বৃটিশ এসে শাসনকার্য পরিচালনা এবং শোষণকার্য চালু রাখার জন্য বশংবদ রাজভক্ত কর্মচারী তৈরীর কারখানা স্বরূপ পত্তন করল আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষাব্যবস্থা সমাজদেহের অন্তর থেকে গড়ে উঠল না। বিদেশী শোষক চাপিয়ে দিলো বাইরে থেকে। ফলে দেশের নাড়ির স্পন্দন থেকে বিচ্যুত, জাতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের সাথে সম্পর্কহীন, স্বদেশের প্রাণের সাথে শিকড়হীন এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি চালু হল, যা মেরুদণ্ডহীন অনুকরণপ্রিয়, নকলনবীশ মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ডিগ্রী সর্বস্ব চাকুরী প্রার্থী তৈরী করে।
ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ালো চাকুরী সন্ধান। মৌলিক মেধা বিকশের জন্যে সমগ্র জীবনের উদ্বোধন নয়। সুচতুর বৃটিশ বুঝেছিল শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে প্রথমেই যদি জাতির মেরুদণ্ডটি ভেঙ্গে দেওয়া যায়, তবে সেই জাতিকে শতাব্দীব্যাপী বশংবদ করে রেখে শোষণ প্রক্রিয়াকে সুনিশ্চিত করা যায়। আর স্বাধীনতার নামে ভারতবর্ষে বৃটিশের তাঁবেদারদের হাতে শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর, স্বদেশী শোষককুল সেই একই শোষণ ব্যবস্থা জারি রাখার উদ্দেশ্য বৃটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থাকেই বজায় রাখল। আগে যেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কারখানায় বৃটিশভক্ত রাজকর্মচারী তৈরী হতো, এখন সেখানেই রাজনৈতিক দলীয় কর্মী তৈরীর ব্যবস্থা শুরু হয়ে গেল।
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল রাখার উদ্দেশ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ নেতাকর্মীর নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের প্রবাহ বজায় রাখার জন্যে শিক্ষাক্ষেত্রকেও রাজনীতির পরিমণ্ডলে নিয়ে আসা হল ছাত্ররাজনীতির নাম করে। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল। আর ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ থাকল রাজনৈতিক দলগুলির হাতে। ছাত্ররা ব্যবহৃত হতে থাকল দলীয় রাজনীতির স্বার্থে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য গৌণ থেকে গৌণতর হতে থাকল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজনৈতিক দলগুলির আখড়ায় পরিণত হল। শিক্ষাক্ষেত্রও হয়ে উঠল রাজনৈতিক দলগুলির অঞ্চল দখলের লড়াইয়ের ময়দান। নষ্ট হয়ে গেল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের পরিবেশ, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক।
শিক্ষাক্ষেত্রে এরফলে নেমে এসেছে এক চরম নৈরাজ্য। এবং সেটা গোটা ভারতেই সত্য হয়ে উঠেছে। সকল রাজ্যের সরকারী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পরস্পরের রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ের একটা বড়ো ময়দান হয়ে উঠেছে শিক্ষাক্ষেত্রগুলি। শিক্ষাঙ্গনের ছাত্ররাজনীতিতে তারই স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে। আর পড়ছে বলেই বারবার বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে মুক্ত চিন্তাশক্তি ও মৌলিক মেধা বিকাশের পথটি। ছাত্ররা হাফপ্যাণ্ট পরা থেকেই দেশের বা রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির দলদাসে পরিণত হয়ে পড়ছে। তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি ছাত্রছাত্রীদেরই স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিরই স্বার্থ এক তাই এই অভিশাপ চলবে।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের চৌঁত্রিশ বছরের শাসন আমলে ছাত্ররাজনীতিকে ক্যাডার তৈরীর প্রক্রিয়া হিসেবে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়ছিল। এবং সাংগঠনিক দৃঢ়তায় ছাত্ররাজনীতিকে কার্যত বিরোধীশূন্য করে, বামফ্রন্টের একচ্ছত্র আধিপত্য রাজ্যে এক বিরোধীশূন্য গণতান্ত্রিক পরিসরের সংস্কৃতির পত্তন করেছিল। ছাত্র থেকে শিক্ষক, পঠনপাঠন থেকে কর্মসংস্কৃতি সর্বত্র বামরাজনীতির ছাত্রসংগঠনটি নিশ্ছিদ্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তাতে শিক্ষাবিস্তার হোক না হোক, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কাজটি হয়ে ছিল নিখুঁত। পরিবর্তনের কাণ্ডারীরা এইখান থেকেই ক্ষমতা দখলের সূত্রটি গ্রহণ করে।
পরিবর্তনের কাণ্ডারীরা ক্ষমতায় এসেই রাতারাতি বাম আমলের চৌঁত্রিশ বছর ধরে গড়ে তোলা আধিপত্য দুদিনের মধ্যেই কায়েম করতে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সরাসরি পেশিশক্তির আস্ফালনের উপর নির্ভর করতে শুরু করল। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা দিতে থাকল বিভিন্ন কলেজে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে। অধ্যাপক-অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই যে শিক্ষাক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এর জন্যে বর্তমান সরকারি দলের প্রত্যক্ষ মদত নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। এবং এই প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এক কলেজ থেকে আর এক কলেজে। এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে।
এবং রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে ব্যবহৃত পেশিশক্তিই সরাসরি ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারী দলের তাঁবেতে নিয়ে আসতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে স্বাভাবিক পঠনপাঠনের পরিবেশ। সমস্ত রাজ্য জুড়ে এই যে পেশিশক্তির দাপটের আস্ফালন আছড়ে পড়ছে শিক্ষাঙ্গনের চত্বরে, অবশ্যই এর পেছনে সরকারী দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। তারা ভাবছেন, বাম আমলের সাড়ে তিনদশকের রাজত্বের অন্যতম স্তম্ভ এই ছাত্ররাজনীতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে তাদেরও দীর্ঘমেয়াদী সময়সীমায় শাসন ক্ষমতা দখলে রাখা সহজসাধ্য হবে। তাই গণতন্ত্রের পরিসরে স্বৈরতন্ত্রের অভিলাষ চরিতার্থের এই প্রয়াস চলছে।
এই যে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির অভিশপ্ত নাগপাশ গ্রাস করে ফেলেছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে, এখানেই কপাল পুড়েছে সাধারণ মানুষের। এর পরিণতি ভবিষ্যতে যে ভয়াবহ সে কথা সহজেই অনুমেয়। যে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ সেই শিক্ষাব্যবস্থার আগাগোড়া ঘূণে ধরে গেলে সে জাতির উন্নতি কোনোদিনও সম্ভব নয়। নয় বলেই উন্নত বিশ্বের জাতিগুলির শিক্ষাব্যবস্থা এই ঘূণ থেকে মুক্ত। সেসব দেশে শিক্ষাক্ষেত্র রাজনৈতিক কলুষতা মুক্ত। শিক্ষাক্ষেত্র সেখানে জাতির ভবিষ্যত সুনাগরিক গড়ে তোলার অঙ্গন। মৌলিক মেধা বিকাশের সুবিস্তৃত মুক্ত পরিসর। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পীঠস্থান।
সুচতুর বৃটিশের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা, ও তাদের তৈরী করে দেওয়া ভোট সর্বস্ব ক্ষমতালোভী গণতন্ত্রের যুগলবন্দীর ফল ফলেছে আজ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই। সেই ফলেরই অভিশপ্ত ফসল এই ছাত্ররাজনীতি সারা দেশ জুড়ে আজ তাণ্ডব চালাচ্ছে। কিন্তু এই অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে গেলে সমাজ বিপ্লব ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। যে রোগ সমাজদেহের ভিতরে শিকড় ছড়িয়েছে সমাজদেহের গভীর থেকে তার মূলোৎপাটন করতে গেলে সমাজ সংস্কার করতে হবে আগাগোড়া। আর সেই সমাজসংস্কার সম্ভব একমাত্র সমাজ বিপ্লবের পথ ধরেই। এই অভিশপ্ত ছাত্ররাজনীতির কবল থেকে শিক্ষাঙ্গনকে মুক্ত করতে না পারলে ভারতের ভবিষ্যত যে অন্ধকার সে কথা বিতর্কের ঊর্ধ্বেই।
ধর্ষিতা নারী
শোনা যায় ভারতবর্ষে প্রতি পনেরো মিনিটে একটি করে ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে! এরসাথে শ্লীলতাহানী-যৌনহয়রানী যোগ করলে পরিসংখ্যানটি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে! শারীরিক সক্ষমতায় মেয়েরা দুর্বল বলেই যে এঘটনা ঘটে তা নয়! পুরুষের মনস্তত্ত্বে নারী মানেই ভোগ্যপণ্য স্বরূপ! মূল কারণটা নিহিত আছে এখানে! আর এই মানসিকতা থেকে প্রায় কেউই মুক্ত নন! তারা সবাই যে ধর্ষণে উৎসাহ পাচ্ছেন সর্বদা, তা নয়! কিন্তু সমাজের সকল শ্রেণীতেই নারী মানেই পুরুষের ইচ্ছাধীন, পুরুষের কামনা-বাসনা মেটানোর নরম ক্ষেত্র! পারিবারিক সূত্রেই এই বোধ উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে বেড়ে ওঠে একটি বালক! ফলে সামাজ বাস্তবতার প্রতিফলনে এই জমিতেই জমে ওঠে তার মূল্যবোধ!
ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের মধ্যেই নারীকে পুরুষের ভোগ্য করে রাখার প্রচলন চলে আসছে আবহমান কাল ধরেই! ফলে যারা বলেন পশ্চিমী খোলা দুনিয়ার খোলামেলা পোশাকের সংস্কৃতি এই সব অপসংস্কৃতির মূলে তারা সঠিক বলেন না! যে দেশে একদিকে দেবদাসী প্রথা আর একদিকে একটি পুরুষের বহুবিবাহ সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা ছিল বহু শতাব্দীব্যাপী এবং আজও কোনো কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পুরুষের বহুবিবাহ প্রথা আজও প্রচলিত সেখানে নারীর উপর পুরুষের ক্ষমতায়ন স্বতঃসিদ্ধ হবেই! ফলে ভালো-মন্দ সকল পুরুষের মধ্যেই নারীকে ভোগ করার মানসিকতাতেই পুরুষার্থ বোধটি ষোলো আনা কাজ করে! এই সামাজিক পটভূমিতেই পারিবারিক সংস্কৃতির বিন্যাসে বেড়ে উঠতে থাকে ছেলেরা!
ভারতবর্ষের অধিকাংশ জাতিতেই অধিকাংশ সম্প্রদায়েই পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে, নারী মানেই পুরুষের পোষ্য! পুরুষের ইচ্ছাধীনেই নারীর স্বাধীনতার পরিসর! এখানেই পুরুষের মানসিকতায় নারীর প্রতি কোনো সম্মানবোধ গড়ে ওঠার পরিসর থাকে না! ফলত ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক সমাজবাস্তবতার উত্তরাধিকার সূত্রেই নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান কোনোকালেই দেওয়া হয় নি! বর্তমানে স্বাধীন ভারতবর্ষের সমাজে নারীর অবস্থানের মৌলিক কোনো পরিবর্তন আজও সূচিত হয়নি! হয়নি বলেই বধূ নির্যাতন, বধূ হত্যার এত বাড়বাড়ন্ত! যে সমাজে নিজের স্বামীর কাছে, শ্বশুর বাড়িতেই নারীর জীবনের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে পথে-ঘাটে তার সুরক্ষার নিশ্চয়তা কে দেবে!
ফলে ভারতবর্ষে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! এই রকম সামাজিক প্রেক্ষিতেই সুপ্ত থাকে এই জঘন্যতম অপরাধের বীজ! উপযুক্ত জলবায়ু পেলেই তা অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে! পিতৃতান্ত্রিক এই সমাজে শিশুদের শৈশব থেকেই প্রায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক মেলামেশার ক্ষেত্রগুলিকেই যথাসম্ভব সঙ্কুচিত করে রাখা হয়! আর এই পর্যায়ে সবচেয়ে বড় অভিশাপ হয়ে দেখা দেয় ছেলেদের, মেয়েদের আলাদা আলাদা স্কুল-কলেজগুলি! জ্ঞান উন্মেষের সূচনা লগ্ন থেকেই সম্পূর্ণ এই অপ্রাকৃতিক অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগে শিশুমন সুস্থ হয়ে বিকশিত হবার সুযোগ পায় না! গড়ে ওঠে অজানা কৌতূহলের হাত ধরে একটা অসম্ভ্রমবোধের মানসিকতা! স্বাভাবিক মেলামেশার অভাবে শ্রদ্ধাবোধ জাগে না!
সামাজিক উৎসবে, পার্বণেও এই লিঙ্গভেদের দূরত্বের কারণে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা সহজ স্বচ্ছন্দ হয় না! ফলে একটা অজানা আকর্ষণ ক্রিয়াশীল থাকে! যে আকর্ষণটা মূলতই বয়সসন্ধি জনিত শারীরিক উত্তেজনা প্রসূত! যেখানে মানসিক সৌকর্য গড়ে ওঠার পরিসর থাকে না সমাজ বাস্তবতার পরিকাঠামোতেই! এই যে মানসিক সৌকর্য, এরই পরিশীলিত নিরন্তর অনুশীলনে গড়ে ওঠে পরস্পরের সম্বন্ধে শ্রদ্ধাজনিত সম্ভ্রমবোধের! যা থেকে সৃষ্টি হয় দরদের! গড়ে ওঠে দায়িত্ববোধ! সামাজিক প্রেক্ষিতে সুস্থ নৈতিকতার বাস্তবায়নে যা সবচেয়ে জরুরী! কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতবর্ষের সমাজের সকল স্তরেই এই জরুরী বিষয়টাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত! এই অবহেলার পথরেখা ধরেই সমাজে দানা বাঁধে অসুখ!
এই যে সামাজিক অসুখ এরই অন্যতম ভয়ংকর প্রকাশ এই ধর্ষণ! মানুষের সমাজে এর থেকে জঘন্য অপরাধ আর হয় না! অথচ এই অপরাধের ফলে সমাজে প্রায় একঘরে হয়ে পড়ে ধর্ষিতা নারী! সমাজ তাকে আর আশ্রয় দেয় না সসস্মানে! এই যে সমাজের ভূমিকা, যেখানে সে ভিকটিমের পক্ষে ততটা সহানুভূতিশীল নয়, এই ভূমিকাই অপরাধীদের উৎসাহ দেয় অপরাধে! একটি সমাজ যখন তার নৈতিক দায়বদ্ধতার দায় এড়িয়ে উদাসীন থাকে, বুঝতে হবে সেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পচন! সেই পচন থেকেই সৃষ্টি হয় দূর্নীতির! জন্ম নেয় অপরাধী! ফলে ধর্ষণের ঘটনার দায় সমাজের ওপরও বর্তায়! আমরা স্বীকার করি আর না করি! আর সেই সুযোগে দুর্নীতির পালে হাওয়া লাগিয়ে অবাধে বিচরণ করে বেড়ায় অপরাধীরা!
ভারতবর্ষের সমাজে ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বস্তরে যে অনৈতিকতা এবং আদর্শহীনতার বাড়বাড়ন্ত তারই প্রতিফলন — একদিকে গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলতন্ত্রের ক্ষমতা নিয়ে ব্যভিচার যার ফলে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, আর অন্যদিকে অপরাধীদের অবাধ স্বাধীনতা ও দুঃসাহস! অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সাংঘাতিক রকমের ধর্ষকদের আশ্রয়স্থল। ধর্ষণের এত বাড়বাড়ন্ত এই সমস্ত কারণেই আজ এতখানি সমাজবাস্তব! ফলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে কোনো সামাজিক আন্দোলনের অভিমুখকেই এই সমগ্র বাস্তবতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে! কোনো একটি ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত নির্দিষ্ট অপরাধীর চরমতম শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে পারলেই কিন্তু আন্দোলন সফল হবে না! ধর্ষণমুক্ত সমাজ দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন ছাড়া সম্ভব নয়!
আবার দূর্নীতিমুক্ত প্রশাসন নির্ভর করে সুস্থ, সবল, সুন্দর, দায়িত্বশীল সমাজের উপর! যে সমাজ গড়ে ওঠে সুশিক্ষিত সুনাগরিকের ভিতের উপর! ফলে দেখা যাচ্ছে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ার চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে সুশিক্ষিত সুনাগরিকের সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে! তাই এই সামাজিক আন্দোলনের মূল অভিমুখ থাকা দরকার সার্বিক সুশিক্ষার প্রসারের দিকে! যে শিক্ষার ভিত্তি হবে সমস্ত রকম লিঙ্গ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে! যে শিক্ষার সূত্রপাত হতে হবে একেবারে প্রতিটি সংসারের নিজস্ব চৌহদ্দী থেকে! সমাজে, সম্প্রদায়ে, স্কুল-কলেজে, কর্মক্ষেত্রে যে শিক্ষাকে করতে হবে সর্বত্রগামী! সামাজিক অসুখকে সমাজের অন্তর থেকে না সারালে শুধুমাত্র ওপর থেকে কটা আইন প্রণয়ন করে হবে না!
যে কোনো আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা রক্ষা করার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের! যে দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রশাসন যত বেশি নিরপেক্ষ থাকতে পারে, সে তত বেশি দক্ষ হয়! এই নিরপেক্ষতা আর দক্ষতার বিষয়ে ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের সুখ্যাতি কেউ করবে না! কিন্তু এদেশের প্রশাসনের প্রতিটি অলিন্দে যে পরিমাণ দুর্নীতির চর্চা হয়, তাতে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে সাধারণ মানুষের অবস্থা জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ নিয়ে বেঁচে থাকার মতো! ফলে এই রকম সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নারীর সুরক্ষার বিষয়ে নিশ্চিত নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে কে? আইন-আদলতও তো দুর্নীতির ঊর্ধ্বে নয়! পুলিশ সরকারী দলের আজ্ঞাবহ! স্বভাবতই এই অবস্থায় রক্ষকও ভক্ষক হয়ে উঠবে সেটাই খুব স্বাভাবিক! এবং অপরাধীরাও ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক মঞ্চকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে সক্ষম হবে! ভারতবর্ষের সমাজে এটাই বাস্তব চিত্র! এই প্রেক্ষিতেই মোকাবিলা করতে হবে ধর্ষণের মতো নারকীয় অপরাধকে! ফলে কাজটি যে চূড়ান্ত কঠিন তা বলাইবাহুল্য! শুধুই আইন-আদালতের উপর ভরসা করে থাকলে কপাল চাপড়াতে হবে! কারণ সর্ষের মধ্যেই যে অনেক সময়ে ভুতের উপদ্রপ! আর এইখানেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সদর্থক সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয় উপযোগিতার! সমাজের সর্বত্র দুর্নীতির পচন ধরলেও এখনও বহু মানুষ সুনীতির পক্ষে, আদর্শের পক্ষে জীবন সংগ্রাম করে চলেছেন! প্রয়োজন শুধু সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠার!
সামাজিক আন্দোলনের স্বার্থে চিন্তাশীল সুনাগরিকদের প্রবলভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলতে হবে সামগ্রিক প্রতিরোধ! এই প্রতিরোধী গণ-আন্দোলনের অভিমুখ একদিকে যেমন সমাজের ভিতর থেকে শুদ্ধিকরণের প্রস্তুতিতে ক্রিয়াশীল থাকবে, সেই সঙ্গে একই সাথে সরকারী প্রশাসনের দায়বদ্ধতা, সুদক্ষতা এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির উপর নিরন্তর গণতান্ত্রিক চাপ বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকবে! প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও প্রয়োজনে অকার্যকর আইনের সংশোধন করে সংঘটিত অপরাধগুলির দ্রত সুবিচার সম্পন্ন করার বিষয়ে সংঘবদ্ধ সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম! বিভিন্ন গণ-সংগঠনগুলির এই ব্যাপারে সামনে এগিয়ে আসা উচিৎ!
সংগঠিত প্রতিরোধী এই সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার নিতে হবে নারীদেরকেই! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঘরে-বাইরে নারী আজও শেষ পর্য্যন্ত পুরুষের উপরেই নির্ভরতার জীয়ন কাঠিটি ন্যাস্ত রাখে! আর তখনই মুখ থুবড়ে পড়ে সমস্ত প্রয়াসের মূল কার্যকারিতা! তাই নারী আন্দোলনের প্রবক্তাদের নিজেদের এই পুরুষ নির্ভরতা কাটিয়ে উঠে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে হবে দ্রুত! নেতৃত্ব দিতে হবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সুনাগরিকদের আত্মবিশ্বাসী প্রত্যয়ে! সামাজিক ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার সূত্রেই ধর্ষণ মুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব! এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার হাত ধরেই সম্ভব দেশের সামগ্রিক উন্নতির বাস্তবায়ন! সামাজিক সুস্থতা আজ তাই নারী আন্দোলনের উপরই নির্ভরশীল!
ধর্ষিত স্বাধীনতা
বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারত অতিক্রম করে এল সাত সাতটি দশক। একটি দেশের পক্ষে খুব একটা বেশি সময় না হলেও একেবারেই কম সময় নয় কিন্তু। মধ্যবর্তী সময়ে নানান ঘটনার ঘনঘটার ভিতর দিয়ে ভারতবর্ষ আধুনিক যুগে পা রেখে দাঁড়িয়ে! কিন্তু প্রশ্ন জাগে আমরা ভারতীয়রা কতটা আধুনিক হতে পেরেছি? পেরেছি কি স্বাধীনতার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে? পেরেছি কি আধুনিক উন্নত বিশ্বের সমগোত্র হয়ে উঠতে! বিশ্বসভায় তাদের সাথে একাসনে বসতে? পরিসংখ্যানতত্ব অনুযায়ী হয়ত নানা মুনির নান মত হতে পারে! কিন্তু এটাও ঠিক আজকের ভারত অনেকগুলি ভারতেরই মুখচ্ছবি। সেখানে টাটা-বিড়লা-আম্বানীদের ভারতের সাথে আসি যাই মাইনা পাই-এর ভারত থেকে একশ দিনের কাজের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভারতও রয়েছে। শোষক ও শোষিতের ভারত, ঠগবাজ ও ঠকে যাওয়াদের ভারত। গুছিয়ে নেওয়া ও না গুছিয়ে নিতে পারার ভারত সব একসাথেই স্বাধীনতার সাতটি দশক অতিক্রম করে ফেলল। কিন্তু ভেবে দেখার সময় এসেছে স্বাধীনতার জন্যে শহীদ হওয়া হাজার হাজার মানুষগুলি স্বাধীনতার যে স্বপ্নগুলি দেখেই আত্মত্যাগ করেছিলেন একদিন, আজকের এই এতগুলি রকমের ভারত কি সেই স্বপ্নগুলিরই সার্থক প্রতিচ্ছবি? না কি স্বাধীন ভারতের সাতটি দশক সেই স্বপ্নগুলি থেকে ক্রমাগত দূরবর্তী পথে গড়িয়ে যাওয়ারই প্রতিচ্ছবি? স্বাধীন ভারত আজকে সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের যে ধাপে অবস্থান করছে, সেটাই কি সাত দশকের স্বাভাবিক ও কাম্য অর্জন? বিশেষ করে এই একই সময়সীমায় চীনের তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত প্রভূত উন্নতি! যুদ্ধ বিদ্ধস্ত জাপানের বিস্ময়কর ভাবে ঘুরে দাঁড়ানো! এই বিষয়গুলি কি আমাদের ভেবে দেখার সময় আসে নি?
স্বাধীনতার স্বরূপ ও বিকাশ সকল দেশেই একভাবে সম্ভব হয় না! হয়ওনি! অন্তত ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই সেটা অনুধাবন করা অসম্ভব নয়! কিন্তু তবু ভারতবর্ষের মতো সুপ্রাচীন এবং উন্নত সভ্যতার একটি ভূখণ্ড সম্বন্ধে আশার মাত্রাটি তীব্র হওয়ারই কথা! বিশেষ করে ভারতবর্ষ এবং চীনের প্রাচীনত্বের ঐতিহাসিকতা প্রায় সমান্তরাল যেখানে! আর ঠিক এই জায়গাতেই অনুসন্ধান করা প্রয়োজন কোন কোন বিষয়ে আমাদের দূর্বলতা রয়ে গিয়েছে আজও! যে যে বিষয়গুলি আমাদের কাম্য সমৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রবলভাবে! দুর্ভাগ্যের বিষয় ভোট সর্বস্ব রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে আমাদের অবস্থা হয়েছে, থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোরের মতোই!
আধুনিক ভারতের এই সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের যে গর্ব সেই গর্বের অন্তরালে প্রকৃত বাস্তবতাকে কি আমরা চোখ-কান বুঁজেই ভুলে থাকতে চাই না? গণতন্ত্রের মূল কথা কি? জনগণের সার্বিক উন্নয়ন। শাসন ক্ষমতার প্রতিটি স্তরেই জনগণের অবাধ অংশগ্রহণ। রাষ্ট কর্তৃক জনগণের সুরক্ষা-সমৃদ্ধি-সুশাসন নিশ্চিতকরণ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার এই সাত দশকে এই বিষয়গুলি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে ঠিকমত? ভেবে দেখতে হবে সেইটি। প্রতিদিনের খবরের কাগজে আমরা যে ভারতবর্ষের ছবি দেখতে পাই, সেই ছবিগুলি আমাদের সামনে ঠিক কোন সত্য তুলে ধরে? বস্তুত আমরা সবাই জানি আজকের ভারতবর্ষে গণতন্ত্র আর প্রহসন এই শব্দদুটি এমনই সার্থক ভাবে জুড়ে গিয়েছে যে এই দুটিকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না কিছুতেই। কথাটা একটু ভুল হয়ে গেল না কি? এই দুটি শব্দকে কি সত্যিই আর আলাদা করতে চায় আজকের ভারত? চাইলে তবেই না পারা আর না পারার প্রশ্ন! ভারতীয় গণতান্তিক প্রহসনের দুইটি দিক। এক দিকে এই প্রহসনের ননীমাখন খাওয়ার জন্যে সংসদীয় সিঁড়ির প্রতিটি ধাপেই পরস্পরকে কনুইয়ের গুঁতোতে কাৎ করে ফেলে পরের ধাপে উঠে আরও বেশি পরিমাণে মাখনের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম। যাকে গালভরা পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা। আর অন্য দিকে গণতন্ত্রের গড়িয়ে পড়া উচ্ছিষ্ট ননীমাখন খাওয়ার জন্যে আপামর জনসাধারণের দীর্ঘ লাইন। হ্যাঁ, সেই লাইনেও কেবলই বেলাইন প্রবণতায় সকলেই চলেছে সকলের আগে। এই কি বিগত সাত দশক ব্যাপী সময় সীমায় স্বাধীন ভারতের মূল চিত্র নয়? আর এই চিত্রেরও বাইরে পড়ে থাকে আরও একটি বিস্তৃত ভারত। একশ দিনের কাজের লাইনেও যাদের দাঁড়ানোর উপায় রাখা হয় না। যে ভারতকে আমাদের করে-কম্মে খাওয়া, আমারটা আমি গুছিয়ে নিয়েছি বলতে পারা ভারতবর্ষের সাথে মেলানো যায় না কোনভাবেই। স্বাধীনতার সাত সাতটি দশক তাদের উপর দিয়েও বয়ে চলে গিয়েছে কিন্তু।
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান। স্বাস্থ্য-শিক্ষা-জীবিকা। যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রতিটি জনগণের এই মৌলিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত নয়, সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে তন্ত্রের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হোক না কেন, কোন দেশের পক্ষেই তা কাম্য হতে পারে না। সাত দশকের স্বাধীন ভারত যে এই প্রাথমিক ও প্রধান বিষয়টিতেই পিছিয়ে পড়ে রয়েছে, পিছিয়ে পড়ে রয়েছে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশগুলির থেকে সেই বিষয়ে কারুরই কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। অনেকেই ভাবতে পারেন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতবর্ষকে নিঃস্ব করে দিয়ে চলে যাওয়ার পর, সেই শূন্য অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে সাতটি দশক যথেষ্ট নয়। তাঁদেরকে একটু, একই সময় সীমায় চীন-জাপান-জার্মানীর উত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই হয়তো যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে কেন একই সময় সীমায় আমরা এই তিনটি দেশ থেকে এত পিছিয়ে রয়েছি। আজকে কেউই উন্নত বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে চীন-জাপান-জার্মানীকে এক সাথে রাখলেও ভারতবর্ষকে সেই সারিতে স্থান দিতে পারে না। আজকে ভাবতে হবে এই লজ্জার উৎসটি ঠিক কোথায়? ঠিক কোন কোন কারণগুলি জনগণের সার্বিক ও কাম্য উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে? কেননা একটি দেশে কজন টাটা, বিড়ালা, আম্বানী বেড়ে উঠলো সেটাই শেষ কথা নয়, শেষ কথা দেশের আপামর জনসাধারণের জীবন যাপনের মান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গড় আয় ও ব্যায় ক্ষমতা এবং সঞ্চয় ও বিনিয়োগে অংশগ্রহণের সামগ্রিক চিত্রই। আমাদেরকে সেই সেই কারণগুলির উপরেই জোর দিতে হবে, যেগুলি এই বিষয়গুলি থেকে জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশকেই ক্রমাগত দূরবর্তী অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিসংখ্যানবিদরা নানান পরিসংখ্যায় অনেক তর্ক করতে পারেন। রাজনীতিবিদরা সেই পরিসংখ্যানের নির্বাচিত খতিয়ান দেখিয়ে জনসাধানরণকে বিভ্রান্ত করতে পারেন নানান ভাবে। কিন্তু খুব সাধারণ ভাবেই একটি কথা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় জনসাধারণকে জনসম্পদে পরিণত করতে না পারলে কোন দেশই কোনভাবে কাম্য উন্নয়ন ঘটাতে পারে না। এখন ভারতবর্ষের মুশকিল হচ্ছে জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-ভাষা ও শ্রেণী বিভক্ত এই ভূখণ্ডে জনসাধারণ বলতে কেউই অখণ্ড কোন সত্তা অনুভব করনে না। করতে পারেন না। ঠিক যেমনটি করতে পারে চীন, জাপান, জার্মানির মতো দেশগুলিও। যারা বিগত সাত দশকেই উন্নত দেশগুলিকে ধরে ফেলেছে সার্বিক ভাবেই। ভারতীয় ভূখণ্ডে এই বোধ জাত-পাত-শ্রেণী বিভাজিত মানসিকতায় খণ্ডিত। তাই সমগ্র জনসাধারণের কথা মাথায় রাখতে পারি না আমরাও। সব রকম দুর্নীতির প্রসঙ্গ ছেড়ে দিলেও, এই মূল জায়গাটিতে এসে আমরা বিভ্রান্ত সকলেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য হল এটি একটি দেশ নয়! অনেক দেশের সমাহার! এটি একটি ভূখণ্ড। সঠিক ভাবে বলতে গেলে ভারতীয় উপমহাদেশ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার শাসন ও শোষণের সুবিধার্থে ভারতবর্ষকে একটি শাসনতন্ত্রে বেঁধে ছিল! এই যে এত বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি, ভাষা সমন্বিত এতগুলি দেশ মিলে ভারতবর্ষ, তাকে একটি সাধারণ শাসনতন্ত্রের অধীনে একটি দেশের রূপ দিলে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় জাতীয়তাবাদী স্বরূপটি ঠিকমতো গড়ে উঠতেই পারে না! বিশ্বে কোনো কালেই এমন নজীর নেই কোথাও! ফলে সবাই যে যার আখের গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত! যে কোনো দেশ একজাতি, এক সংস্কৃতি, এক ভাষা না হলে, তার কোনো জাতীয়তাবাদী দেশীয় চরিত্র গড়ে ওঠে না! এটাই ভারতবর্ষের মূল প্রতিবন্ধকতা! আর ঠিক এই কারণেই সমগ্র জনসাধারণ বলতে যে সমগ্রতার অনুভব জেগে ওঠার কথা, তা জায়মান নয় কোন ভারতীয়রই চেতনায়। সেই কারণেই জনসাধারণ মানেই যে জনসম্পদ নয়, জনসাধারণকে যে জনসম্পদে রূপ দিতে হয় প্রতিনিয়ত নিরন্তর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, সেই বোধ ও ন্যূনতম প্রাথমিক ধারণাটুকুও গড়ে ওঠেনি আমাদের। না, স্বাধীনতার সাত সাতটি দশক অতিক্রম করেও নয়। আর সেইটাই প্রতিফলিত হয়ে থাকে আমাদের সকল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল অর্থনৈতিক প্রকল্পসহ যাবতীয় কার্যক্রমে।
এখন প্রশ্ন হলো, জনসাধারণকে জনসম্পদে পরিণত করার প্রাথমিক শর্তগুলি কি কি? আগেই বলা হয়েছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকার কথা। প্রাথমিক এই মৌলিক অধিকারগুলি প্রতিটি দেশবাসীর জন্যে সুরক্ষিত করতে না পারলে জনসম্পদ আসবে কোথা থেকে? প্রতিটি উন্নত দেশ কিন্তু এই জায়গাতেই হাত দিয়েছিল সকলের আগে। কথায় বলে গোড়ায় জল না দিয়ে আগায় জল দিলে আখেরে লাভ হয় না। আসলেই, আমাদেরও হয়েছে ঠিক তাই। আর এইখানেই রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্যই হলো স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া। যাতে প্রতিটি দেশবাসীকে এই স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যায় সমান গুরুত্বে। জনসম্পদ উন্নয়নের এইটাই চাবিকাঠি। এর কিন্তু কোন বিকল্প নাই। না স্বাধীন ভারতের নজর কোনদিনই এইদিকে পড়ে নিই। অনেকেই তর্ক করতে পারেন বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খতিয়ান দেখিয়ে। বলতে পারেন সরকারী বিদ্যালয় ও হাসপাতাল থেকে শুরু করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কথাও। বলতে পারেন সরকারী স্বনির্ভর নানার পরিকল্পনার কথাও। এমনকি বলতে পারেন দু টাকা কেজি চালের মতো বিভিন্ন সরকারী দান-খয়রাতির কথাও। না, এর কোনটাই যে যথেষ্ট ও কার্যকী নয় আদৌ, সেই চিত্রই আসলে স্বাধীনতার প্রথম সাত দশকের প্রধানতম চিত্র এই ভারতবর্ষের।
একটি পরাধীন ভূখণ্ডের স্বাধীনতা যখন অর্জনের পথে না হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পেছনের দরজা দিয়ে হয়, তখনই সেই ভূখণ্ডের ভবিষ্যৎ ঠিক হয়ে যায়। যতদিন না সেই ভূখণ্ডে প্রকৃত সমাজ বিপ্লবের সূচনা হচ্ছে ততদিন এই দুর্গত অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে না। ভারতীয় এই ভূখণ্ডে যাকে আমরা ভারতবর্ষ বলে একটি সংসদীয় গণতান্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দেখতে পাচ্ছি ঠিক সেইটিই ঘটেছে। আর তাই এখানে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বৃটিশের বদলে যে শ্রেণীর হাতে ক্ষমতার পতাকা উঠেছে, তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই ভারতীয় সংবিধান তার বর্তমান আকৃতি পেয়েছে। এই মূল সত্যটি না বুঝলে বাকি সব অর্থহীন। তাই একটি দেশের জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নের যে চিত্র আমরা উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই দেখতে পাই, ভারতবর্ষে তা দেখা যায় না। যায়নি স্বাধীনতার সাত সাতটি দশকেও। আর সেই কারণেই বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সরকারী বরাদ্দের যৎসামান্যই নির্ধারিত হয় স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেও। এবং সেই বরাদ্দও নানান ধরণের দুর্নীতির বেড়াজাল ডিঙিয়ে বৃহত্তর জনসাধারণের কাছে যেটুকু গিয়ে পৌঁছায় তাতে আর যাই হোক জনসম্পদ তৈরীতে তা আদৌ যথেষ্ট নয় কোন ভাবেই। তাই প্রতিবছর এই প্রধানতম জায়গাটিতেই বিপুল ঘাটতির বোঝা নিয়ে ধুঁকতে থাকে সেই ভারতবর্ষই যে ভারতবর্ষকে আমাদের করে কম্মে খাওয়া, আমারটা আমি গুছিয়ে নিয়েছি ভারতবর্ষ অনুভবই করতে পারে না। স্বাধীন ভারতের এও এক বড়ো ট্র্যাজেডি।
স্বাধীন ভারতের বিগত সাতটি দশক প্রতিটি দেশবাসীর জন্যে সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করার বিপরীতে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের জন্যে দুর্নীতির রামরাজত্বে অংশগ্রহণের ছাড়পত্র পাইয়ে দেওয়ার এক বিচিত্র ইতিহাস। এবং সেই ইতিহাসকেই শাইনিং ইণ্ডিয়ার প্রচারে বেশ সফল ভাবেই কাজে লাগানোর ধারাবাহিকতায় উদ্যোগী প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই। কেননা প্রত্যেকেরই লক্ষ্য একটাই। ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে জনগণের টাকার উপর একচ্ছত্র অধিকার কায়েম। তাই প্রতিটি দলই আদতে পূর্ববর্তী সরকারের সার্থক অনুসরণকারী। গ্রেট ইণ্ডিয়ান সার্কাসের এই হলো সাত দশক ব্যাপী মেগা শো, মেগা হিট। ঠিক এই মেগা হিট, মেগা শোয়ের অন্তরালে পড়ে রয়েছে সেই ভারতবর্ষ যাদের কাছে স্বাধীনতা মানে একটি বিশেষ দিনের বিশেষ পতাকা উত্তোলন ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনরকম পরিসংখ্যান তথ্যের খতিয়ান দেখিয়েও ঢাকা দেওয়ার উপায় নেই এই চরম সত্যকে।
দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে গল্পে আমাদেরকে বিভোর রাখা হয় প্রতিদিন, তাই যদি সত্য হতো, তবে তো কথাই ছিল না। কিন্তু আমাদের এই নাগরিক জীবনের চারপাশে আমরা প্রতিদিন যে বিত্ত-বৈভবের আস্ফালন থেকে উদ্ভাসন প্রত্যক্ষ করি, তাতে করে আমাদের নাগরিক ঠুলি পরা চোখে ভারতীয় সমৃদ্ধির গল্প যতই সত্য হয়ে উঠুক, সেই সত্য দিয়ে ঢাকা দেওয়া যাবে না সমগ্র ভারতবর্ষের সামগ্রিক দৈন্যদশাকে। জনসাধারণের দশ শতাংশ মানুষের সচ্ছলতার চিত্রে যারা ভুলে থাকতে অভ্যস্ত বাকি অংশের বৃহত্তর চিত্রটিকেই, তাদের আর যাই হোক দেশপ্রেমিক বলা যায় না কোন ভাবেই। এটাই আমাদের অন্যতম অসুখ। আমরা বস্তুত কেউই দেশপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারিনি বিগত সাত দশকব্যাপী তথাকথিত স্বাধীনতার চর্চাতেও। কিন্তু কেন? এই বিষয়টির মূল গুরুত্বও ভারতবাসী হিসেবে আমাদের চেতনায় ধরা দেয়নি আজো। বস্তুত ঐতিহাসিক ভাবেই ধরা দেয়নি। দেয়নি ইতিহাসের অতি স্বাভাবিক নিয়মেই। ভারতবর্ষ একটি সমগ্র দেশ হিসাবে আমাদের চেতনায় কখনোই জায়মান হয়ে ওঠে নি। কিন্তু কেন?
জাতীয়তাবোধের উৎসরণ ব্যতীত স্বাধীনতার সুফল দেশের সর্ব শ্রেণীর জনগণের জন্য সুনিশ্চিত করা যায় না! যেতে পারে না। বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশগুলির উন্নয়নের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাজাতির প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসাই দেশীয় উন্নতির ভিত্তি স্বরূপ! আর সেই স্বাজাত্য প্রেমই পারে গোটা জাতিকে এক সূত্রে বেঁধে রাখতে। ঠিক এইখানেই পিছিয়ে পড়েছে ভারতবর্ষ। এতগুলি স্বতন্ত্র জাতি তাদের স্বাতন্ত্র্য অতিক্রম করে ভারতীয় জাতীয়তার মোহকল্পনায় ঐক্যবদ্ধ হবে, সে নেহাতই কষ্টকল্পনা। স্বভাবতই তা হয়ওনি। আর সেই একতাবোধের অভাবেই ভারতীয় জাতিসমূহে দূর্নীতির প্রাদুর্ভাব! দুঃখের বিষয়, এই সরল সত্যটি আমরা আজও বুঝি না!
স্বাধীনতার পর গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এই যে দুর্নীতির ব্যাপক বিকাশ তার মূলে এই কারণগুলিই মূল নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়েছে। একদিকে দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও অন্যদিকে এক শ্রেনীর বিত্তশালীর হাতে দেশের সম্পদের উপর একচ্ছত্র অধিকার। আর সেই অধিকার চর্চার জন্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা। দেশের সার্বিক বিকাশের পক্ষে যা প্রধান অন্তরায়! ফলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি আজও সুরক্ষিত নয়! আজও প্রতিটি ভারতীয়র শিক্ষার অধিকার, সুস্বাস্থ্যের অধিকার, জীবিকার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সুরক্ষিত নয়। সামাজিক সুরক্ষার ধারণা এদেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সুনিশ্চিত ধারণাও।
মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির পাশা খেলা স্বাধীন ভারতবর্ষের মুখ্য চরিত্র। যেহেতু কোনো জাতীয়তাবাদী চরিত্র গড়ে ওঠেনি স্বাধীন ভারতের পরিসরে, তাই রাজনৈতিক দলগুলির অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ করার মতো উপযুক্ত শক্তি গড়ে উঠতে পারে না দেশের মর্মমূল থেকে। এটাই গ্রেট ইণ্ডিয়ান ট্র্যাজেডী! এবং এখানেই ভারতবর্ষের প্রধান দূর্বলতা। রাজনৈতিক দলগুলিকে হাত করে দেশীয় সম্পদের উপর বৈদেশিক স্বার্থের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা ঠিক এই কারণেই সহজ! বস্তুত বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদের ধূয়ো তুলে এই কাজটিই বর্তমানে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে! উন্নততর ভারতের নকল ফেস্টুনের আড়ালে।
ফলত ভারতের স্বাধীনতা যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণের মনে, তা যে আজও অধরাই রয়ে যাবে, সে তো কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটাই ঘটার ছিল! কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা কি করব? ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে এই অন্ধকার ভারতবর্ষই কি উপহার দিয়ে যাব? না কি আমাদের নাগরিক কর্তব্য বোধের মানবিক তাগিদে, অন্ধকারের উৎসের দুর্বলতাগুলি দূর করে আমাদের সাধ্যমত আলো প্রজ্জ্বলনের প্রয়াসে শামিল হব যৌথ উদ্যোগের ঐক্যসূত্রে! সামাজিক পরিসর থেকে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সকল স্তরে এই বোধ সম্ভূত আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ না নিলে, ইতিহাস হয়তো আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না কোনোদিনই!