লিখেছেনঃ শ্রীশুভ্র, আপডেটঃ April 13, 2020, 12:00 AM, Hits: 1177
সম্প্রতি মার্কীন প্রবাসী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে আমরা বাঙালিরা বেশ নড়ে চড়ে বসেছি। একই অর্থনীতি বিষয়ে অমর্ত্য সেনের পর দ্বিতীয় নোবেল বিজয়। স্বভাবতঃই আমাদের উচ্ছ্বাসের মাত্রা একটু বেশিই হবে। বিশেষ করে যিনি আবার অমর্ত্য সেনের মতোই মার্কীন নাগরিক। ফলে আমাদের আনন্দ ও শ্লাঘার পরিমাপও অপরিমেয়। বিষয়টা আমাদের কাছে বাঙালির বিশ্বজয়ের মতোই বড়ো খবর। হ্যাঁ, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপকের নানান বিবৃতির পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের নানান মত-অভিমত। রাজনীতি আমাদের ভাবনা-চিন্তার পরিসরকে এমন অমোঘ ভাবেই নিয়ন্ত্রিত করে যে, আমরা যাদের যাদের ভোট দিই, তাদের প্রচারিত বাণীকেই প্রতিধ্বনিত করি। আর যাদের যাদের ভোট দিই না, তাদের কথার মূল্যও দিই না। এটাই বর্তমান সংস্কৃতি বাঙালি জাতির। বাঙালির আরও একটি বিশিষ্ট প্রকৃতিই হলো সাহেবদের দেশ থেকে আসা স্বীকৃতি ও পুরস্কারের মূল্যেই আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিচার করে থাকি। ফলত বাঙালির কাছে নোবেলের মূল্য কম নয়। অভিজিৎ কেন নোবেল পেলেন, তার চর্চিত বিষয়ের গুরুত্ব কি ও কতখানি, সেসব বিষয়ে আমাদের আগ্রহ সীমিত। তিনি নোবেল বিজয়ী অতএব তিনি বিখ্যাত। সেই নিরিখেই আমাদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা। বস্তুত অর্থনীতির মতো জটিল ও অনন্ত একটি বিষয় দেশ-কাল নিরপেক্ষ ভাবেই সকলের বোধগম্য বিষয় নয়। তাই নোবেল বিজয়ীর লেখা বই হু হু করে বিক্রী হতে থাকবে, তেমনটাও নয়। কিন্তু অর্থনীতির যাঁরা ছাত্র ও শিক্ষক তাঁদের ভিতরেও কজন নোবেল বিজয়ীর লেখা বইগুলি পড়বেন ও চর্চা করবেন সন্দেহ আছে, বা তাঁর গবেষণার বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন। ফলে বিষয়টা অর্থনীতির নয়। বিষয়টা নোবেল বিজয়ীর অর্থনীতির উপর করা গবেষণা আমাদের দেশের কোন কাজে লাগবে তা নিয়েও নয়। বিষয়টি নোবেল বিজয়ের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা নিয়েই। এই নিয়েই আমরা বিভোর। কিন্তু সেখানেই যদি শেষ হতো তবু কথা ছিল। না, রাজনীতি এসে বিষয়টি আরও ঘুরিয়ে দিল। রাজনৈতিক শিবিরের লাভ-লোকসান হিসাব-নিকাশের উপর দাঁড়িয়ে নোবেল বিজয়ীর ব্যক্তিগত জীবনই হয়ে উঠলো আলোচনা-বিতর্কের মূল বিষয়। এখানেই বাঙালি হিসাবে আমাদের অনন্যতা। কোথায় থাকলো অর্থনীতির প্রসঙ্গ। কোথায় গেল দারিদ্র্য দূরীকরণের নানান তত্ত্ব ও তার প্রায়োগিক মডেলের কার্যকরী সুবিধা কিংবা অসুবিধার আলোচনা-বিচার-বিশ্লেষণ; সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক, জনসচেতনতা প্রসার ইত্যাদি। মুখ্য বিষয় হয়ে উঠলো অভিজিতের কয়জন স্ত্রী!
ফলে বাঙালি এবারের পুজোয় কোলাহল মুখর হয়ে ওঠার বেশ একটা মুখোরচক রসদ পেয়ে গেল। কিন্তু তার ভিতরেও অভিজিৎ মূলত তিনটি খুব প্রণিধানযোগ্য কথা বলেছেন। প্রথম যে কথাটি হয়তো অনেকেরই নজর এড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে, সেটি হলো; তিনি বলেছেন ভারতবর্ষে তাঁরা দারিদ্র্য দূরীকরণসহ অর্থনীতির নানান বিষয় নিয়ে যেসব পরীক্ষ-নিরীক্ষা করে থাকেন, সেগুলি কিন্তু বিভিন্ন সরকারী পরিকল্পনার সহযোগী অংশ হিসাবেই করা হয়। এবং সেই বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো সরকার ও তার বিশেষ রাজনৈতিক দর্শন ও মতবাদ বিচার্য বিষয় নয় আদৌ। মূল বিষয়টি জনকল্যাণের সাথেই জড়িত। সেই অভিমুখে তাঁদের কাছে কোন সরকারই অচ্ছুৎ নয়। ফলে অমুক সরকারের তমুক মতবাদকে সমর্থন করি না, অতএব সেই সরকারের প্রণীত পরিকল্পনায় অংশ নেবো না, এমন কোন আদর্শে বিশ্বাসী নন অভিজিৎ। তিনি অত্যন্ত দ্ব্যার্থহীনভাবেই এই কথা সুস্পষ্ট করে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কাছে দারিদ্র্য দূরীকরণের অভিমুখে জনকল্যাণই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। যে কোন শুভবোধ সম্পন্ন মানুষই মনে হয় এইবিষয়ে অভিজিতের মতের ও পথের সমর্থনে পিছুপা হবে না।
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি তিনি বলেছেন বলে শোনা যাচ্ছে, অন্তত সংবাদ মাধ্যমের সূত্র অনুযায়ী, সেটি হলো বর্তমানে ভারতবর্ষে জননেতার অভাবের কারণেই দেশবাসীকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে পেতে হয়েছে। যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য নিঃসন্দেহে। স্বভাবতই মনে হয় অভিজিতের এই মন্তব্যকে যদি একজনও সমর্থন করেন নিঃসন্দেহে তিনি প্রবাদপ্রতীম অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মহাশয়।
তৃতীয়ত, যে বিষয়টি তিনি নোবেল বিজয়ের সাথে সাথেই দ্ব্যর্থহীন ভাবে ব্যক্ত করেছিলেন, সেটি হলো, তাঁর কথায় ভারতবর্ষের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় গরিব মানুষের হাতে বেশি করে টাকা দিতে হবে। ধনী বা বড়োলোকদের হাতে নয়। ধনী ও বড়োলোক অবস্থাপন্ন শ্রেণীর মানুষ ছাড়া আপামর ভারতবাসীই যে তাঁর এই কথাকে একবাক্যে সমর্থন করবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলি যে এই বিষয়টিকেই অড়ালে সড়িয়ে দিতে, বা বলা ভালো মানুষের মন থেকে ভুলিয়ে দিতেই অন্যান্য অপ্রাসঙ্গিক বিতর্কগুলিকে উস্কে দিতে উঠে পড়ে লাগবে, সেকথাও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
আমাদের আলোচনার বিষয় মূলত অভিজিতের এই তৃতীয় কথাটিকে ঘিরেই। প্রাথমিক ভাবে মনে হতেই পারে গরিবের হাতে বেশি টাকা দিলে একটা বড়ো সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যেতে পারে। কারণ প্রথমত, গরিব মানুষ একটু ভালো ভাবে খেয়ে-পরে বাঁচবে। তারপর শখ-আহ্লাদ পূর্ণ করতে সে কিছুটা হলেও হাতের টাকা ধরে না রেখে ব্যয় করবে। কারণ দারিদ্র্যের প্রাথমিক ধর্মই হলো পেট ভরলেই একটু ফূর্তির অবসর খোঁজা। ফলে সেই অতিরিক্ত অর্থটুকু ব্যায় করা মানেই বাজারে নতুন করে চাহিদার সৃষ্টি হওয়া। চাহিদা বাড়লে স্বভাবতই যোগান বৃদ্ধি করে বেশি মুনাফার লোভে শিল্প-বাণিজ্যে আরও বিনিয়োগ বাড়বে। বর্ধিত বিনিয়োগ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে। নতুন কর্মসংস্থানের হাত ধরে নতুন ভোক্তার সৃষ্টি হবে। ফলে আবারও নতুন করে চাহিদার সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ চাহিদা যোগান, উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং নতুন চাহিদা সৃষ্টি। অর্থনীতির যে চক্রটি ঠিকমত সচল থাকলে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি ভারসাম্যযুক্ত থাকে, সেই চক্রটির চাকায় তেল দিতেই গরিবের হাতে বেশি করে টাকার যোগান দেওয়ার কথা বলতে চেয়েছেন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়।
অবশ্যই আমরা সাধারণ মানুষ যারা অর্থনীতির অ আ ক খ কিছুই জানি না, তারা খুব সহজেই ভাবতে শুরু করবো ঠিকই তো। ঠিক কথা। এমনটাই তো হওয়ার কথা। এবং এই পথেই গরিব মানুষ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে। পাঠককে স্মরণে রাখতে অনুরোধ করবো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক কিন্তু একবারও বলেননি যে এই পথে গরিব মানুষের দারিদ্র্য দূর হবে। তিনি শুধু ভারতীয় অর্থনীতির বর্তমান বেহাল মন্দার দশায় প্রাথমিক ভাবে কি করণীয়, সেই কথাটুকুই বলেছেন। সংকটজনক রোগীকে স্যালাইন দেওয়ার মতো। স্যালাইন যেমন কোন রোগের প্রতিষেধক নয়, তেমনই গরিবের হাতে একটু বেশি টাকা দিলেই দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর হবে না। অর্থনীতি মোটেই এমন সরল অঙ্কের পথে হাঁটাহাঁটি করে না। পাঠককে একথাও স্মরণে রাখতে অনুরোধ করবো, গরিবের হাতে বেশি টাকা দেওয়ার কথা বলার পাশাপশি বড়োলোকের হাতে বেশি টাকা না দেওয়ার কথাও বলেছেন তিনি অত্যন্ত সুস্পষ্ট করেই। এবং কখন বলেছেন, না যখন তাঁরই ভুতপূর্ব সহপাঠিনী বর্তমানে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দেশের শিল্পপতিদের হাতে অতিরিক্ত প্রায় ১৭০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেওয়ার সুবন্দোবস্ত করে ফেলেছেন মোটা শতাংশ হারে কর মকুব করার কথা ঘোষণা করে।
অর্থাৎ সদ্য নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রাথমিক ভাবে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে যে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক তার বিপরীত ব্যবস্থা গ্রহণ করে বসে আছেন। কারণ তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। ফিরে এসেছেন মূলত যাঁদের ভোটে সেই গরিব মানুষেরই ক্রয় ক্ষমতা সবচেয়ে তলানীতে। সরকারের বক্তব্য শিল্পমহলের হাতে অতিরিক্ত অর্থের জোগান দেওয়ায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে উৎপাদন ক্ষেত্রে। ফলে নতুন কর্মসংস্থান হবে। নতুন উপভোক্তার সৃষ্টিতে নতুন করে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে জোগানও বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কে দেবে? সরকার নিশ্চয়ই নয়। অতিরিক্ত কর মকুবের ফলে উদ্বৃত্ত নীট মুনাফা শিল্পপতিরা যে উৎপাদন ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করবেন তার নিশ্চয়তা কি। তারা তো সেই অর্থ বিদেশেও বিনিয়োগ করতে পারেন। বিদেশী ব্যাঙ্কে সঞ্চিত করেও রাখতে পারেন। এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদার অভাবে তারা বরং নতুন বিনিয়োগের ঝুঁকিই নেবেন না। অর্থনীতির প্রাথমিক তত্ত্ব তো সাধারণ বুদ্ধিতে তাই বলে নাকি? বাজারে চাহিদা না থাকলে শিল্পপতিরা সেই বাজারে বিনিয়োগ করতে যাবেন কেন? শিল্পপতিদের হাতে অতিরিক্ত ১৭০ হাজার কোটি টাকা তুলে দিলেই তো আর বাজারে নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয় না। ঠিক সেই কারণেই নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রাথমিক ভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় গরিবের হাতে টাকা দিতে বলেছেন। বড়োলোকেদের হাতে নয়। যাতে বাজারে কার্যকরী চাহিদার সৃষ্টি হয়। যে কথা বর্তমান প্রবন্ধে পূর্বেই বিস্তারিত বলা হয়েছে।
অভিজিৎ যে কথাটি বলেছেন, বাজার অর্থনীতির সেটি একেবারেই গোড়ার কথা। গরিবের হাতে ন্যূনতম পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় থাকে না। অর্থাৎ আর্থিক মন্দার দিকেই গড়িয়ে যেতে থাকে অর্থনীতি। এখন গরিবের হাতে ন্যূনতম টাকা থাকলেই কিন্তু হবে না। থাকতে হবে ন্যূনতম পর্যাপ্ত টাকা। ন্যূনতম টাকা থাকা মানে গরিব মানুষের দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার পর হাতে আর কিছুই না থাকা। ফলে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার কোন উপায় থাকবে না। আর এই ভোগ্যপণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করাই ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার গোড়ার কথা। সেই কারণেই ন্যূনতম পর্যাপ্ত টাকা থাকা চাই গরিব মানুষেরও হাতে। যে টাকায় ন্যূনতম ভোগ্যপণ্যের জন্য ব্যয় করতেই হাতের টাকা ফুরিয়ে যাবে। সঞ্চয়ের জন্য বিশেষ কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। আর মানুষ একবার ভোগ্যপণ্যের জন্য সামান্যতম ব্যয় করতে পারলেই দিনে দিনে সেই ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে। এটা মানুষের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য। গরিবের এই স্বপ্নই বাজার অর্থনীতিতে শস্তায় শ্রমের জোগান সুনিশ্চিত করে। বাজার অর্থনীতির সমৃদ্ধি অর্থাৎ ফুলেফেঁপে ওঠার জন্য সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম প্রধান শর্ত। ফলে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার স্বার্থেই গরিবের হাতে ন্যূনতম পর্যাপ্ত টাকার জোগান থাকা জরুরী। আর সেটি নিশ্চিত না করতে পারলে, গরিব মানুষ দুবেলা দুমুঠো অন্নসংস্থান করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হলেই তার ভিতর আর ভোগ্যপণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হবে না। এবং বাজার অর্থনীতিতে শস্তার শ্রমের জোগানও নিশ্চিতভাবে সুরক্ষিত থাকবে না। ঠিক এই কারণেই ধনতন্ত্রের গোড়ার কথাই হলো গরিব মানুষের হাতে ন্যূনতম পর্যাপ্ত টাকার জোগান নিশ্চিত করা। ভারতবর্ষে সেই শর্তটুকুই বর্তমানে পুরণ না হওয়ায় অভিজিৎ গরিব মানুষের হাতে বেশি টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন। কথাটি নতুন কিছু নয়। ধনতন্ত্রের গোড়ার কথা।
ধনতন্ত্রের আরও একটি পূর্ব শর্ত রয়েছে। সেটি হলো গরিবকে গরিব করেই রাখা। কারণ গরিব মানুষ যদি পর্যাপ্তের বেশি অর্থ রোজগার করতে পারে, তবে প্রথমে সে সঞ্চয়ের পথে হাঁটবে। তারপর সে পর্যাপ্ত শিক্ষা অর্জনে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকবে। শিক্ষার সুযোগে তার কর্মদক্ষতা ও মেধা বিকাশের সাথে সাথে সে কম পরিশ্রমে অতিরিক্ত অর্থ রোজগারের পথ খুঁজে পাবে। তখন কিন্তু সে আর শস্তায় শ্রমের জোগান দেবে না। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির যেটি গোড়ার কথা। ফলে ধনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে গেলে, গরিবের হাতে টাকার জোগান যেমন ন্যূনতম ভাবে পর্যাপ্ত রাখতে হবে ঠিক তেমনই ভাবে গরিব মানুষকে দারিদ্র্যের চক্রে বেঁধেও রাখতে হবে ঠিকমত।
অনেকর মনে হতে পারে, ধনতান্ত্রিক দুনিয়া বলতে আমরা যেটা বুঝি, সেই প্রথম বিশ্বের দুনিয়ার চিত্রটা তো ঠিক এইরকম নয়। খুবই সত্য। আসলে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে ধনতন্ত্রের সাথে ওয়েলফেয়ার ইকনমির সংযুক্তি ঘটানো হয়েছে। সেই কারণেই সেই দেশগুলিতে সাধারণ মানুষ মূলত দারিদ্র্যসীমার উপরে অবস্থান করে। কিন্তু তাই বলেই যে তারা ধনতন্ত্রের ননী-মাখনের পুরো ভাগ পায় তা নয় আদৌ। তাদের জীবনযাপনের মান যথেষ্ট উন্নত হলেও অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের নিচের ধাপেই তাদের অবস্থান। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সাথে তাদের তফাৎ হলো এই যে, তারা সেইভাবে অর্থনৈতিক শোষণের স্বীকার হয় না যেভাবে তৃতীয় বিশ্বের গরিবরা হয়ে থাকে। এইকারণেই প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের শ্রেণীবিভাজন। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি দুই বিশ্বেরই চালিকা শক্তি হলেও তৃতীয় বিশ্বে ধনতন্ত্র ওয়েলফেয়ার ইকনমির সূত্র অনুসরণ করে না। তাই তৃতীয় বিশ্বের জন্য এক নিয়ম। আর প্রথম বিশ্বের জন্য আরেক নিয়ম। ধনতন্ত্রের মূল কাণ্ডারীরা বুঝতে পেরেছিল, ধনতন্ত্রের সাথে ওয়েলফেয়ার ইকনমিকে সংযুক্ত করতে না পারলে, দেশে দেশে সোভিয়েতের মতো বিপ্লব হয়ে যেতে পারে। ফলে মূলত কমিউনিজমকে ঠেকাতেই তাদের এই পথ নিতে হয়েছে। ফলে সোভিয়েত বিপ্লবের সুফল আজও ভোগ করছে প্রথম বিশ্বের সাধারণ মানুষজন।
এইখানেই প্রশ্ন ওঠে, সেই একই সম্ভাবনা বা ভয় তো আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতেও বর্তমান থাকা উচিৎ। কিন্তু বাস্তবে তাতো দেখা যাচ্ছে না। কারণটি কি? ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির শোষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত গরিব মানুষ তো কই এখানে সমাজ বিপ্লবের পথে হাঁটতে যাচ্ছে না। যাচ্ছে না তার কারণ অবশ্যই একমাত্রিক নয়। কারণ বহুবিধ। সেটি অর্থনীতি বিশারদদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে সাধারণ ভাবে কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করা যেতেই পারে। ঐতিহাসিক ভাবেই ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে সমাজজীবনে ধর্মের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে এবং সাথে সাথে সর্বজনীন শিক্ষাদীক্ষার প্রসার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে সাধারণ ভাবে মানুষের ভিতর প্রাথমিক শিক্ষার আলোটুকু বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সুদূর প্রসারী ফলে সাধারণ ভাবে মানুষ তার অধিকার ও দায়িত্ব, প্রত্যাশা ও কর্তব্য, সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে। ফলে তাদেরকে আর অশিক্ষার চক্রে আবদ্ধ করে রেখে ধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখার উপায় থাকে না। থাকেনি বলেই তাদের দাবিদাওয়াগুলিকে অগ্রাহ্য করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং শাসন কার্য চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয় নি প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে। এরই ফলেই সোভিয়েত বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিয়ে বাকি দেশগুলি ধনতন্ত্র ও ওয়েলফেয়ার ইকনমির সংযোগ ঘটাতে বাধ্য হয়। যার ফলে সেই সব দেশগুলিতে সাধারণ ভাবে দারিদ্র্যসীমার নীচে জনসংখ্যা অত্যন্ত কম।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি অধিকাংশই প্রথম বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কলোনি হয়েই আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পর্বে প্রবেশ করেছে এবং সাম্রাজ্যবাদী ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নাগপাশে আটকিয়ে পড়েছে। যেখানে ধর্মকে অর্থনৈতিক শোষণ প্রক্রিয়ার প্রধানতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করাটাই রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আর সেইটি সফল ভাবে করতে গেলে একটি অথর্ব শিক্ষা ব্যবস্থার পত্তন করতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের অধিকৃত কলোনিগুলিতে ঠিক সেটাই করেছে। যে শিক্ষা ব্যবস্থা গুটিকয়েক সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী, আদর্শহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত বুদ্ধিমান ও চতুর প্রজাতির মানুষ তৈরী করবে। এবং তারাই আবার বৃহত্তর সমাজকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে রাখতে সফল হবে সুনিপুণ ভাবে। শিক্ষার অভাবের বিশাল ফাঁকা জায়গাটি ভরাট করে রাখবে নিরন্তর ধর্মের আফিম খাইয়ে। আর এই কাজেই কার্যকরী ভুমিকা নেবে দেশের রাজনীতি। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাবে ওয়েলফেয়ার ইকনমিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে শস্তার শ্রমের জোগানকে শতাব্দীব্যাপী সুনিশ্চিত করতে। আর তা হলেই কেল্লাফতে। অতিরিক্ত মুনাফা ও ধনস্ফীতির বৃত্তটাকে ব্যাপকতর করে এইভাবেই হাতে গোনা কয়েকজনের পকেটেই বন্দী করে ফেলা সম্ভব তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে।
তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি সেই গুটিকয়েক হাতে গোনা কয়েকজনের স্বার্থ রক্ষার্থেই পরিচালিত ও বিকশিত। তাই তাদের স্বার্থেই দারিদ্র্যকে চিরস্থায়ী করে রাখা দরকার। সেই জন্যেই গরিবের হাতে ন্যূনতম পর্যাপ্ত টাকার জোগান দিতে হবে এই চক্রটিকে সক্রিয় করে রাখতেই। আবার অন্য দিকে অশিক্ষা এবং অথর্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে কায়েম করে রেখে তারই সাথে ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার বিদ্বেষ বিষ রোপণ করে যেতে হবে নিরন্তর; কারণ তা না হলে দারিদ্র্য চিরস্থায়ী হবে না। এটাই তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিতে ধনতন্ত্রের প্রায়োগিক রূপ। অত্যন্ত সফল এবং কার্যকর ভাবে।
আমরা যারা অর্থনীতির কোন বিষয়েই কোন জ্ঞান রাখি না, তাদের হয়তো কেন, নিশ্চিতভাবেই জানা নাই, বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা দারিদ্র্যের এই চক্র সম্বন্ধে কে কতটা গবেষণা করেছেন। কিংবা এই চক্র থেকে মুক্তির কে কিভাবে কোন হদিশ দিয়েছেন। অনেকেই মার্কস, এঙ্গেলসের নাম স্মরণ করে সেই মুক্তির লক্ষ্যে বিকল্প পথ ও তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসাবে আমরা সেই বিষয় জানিই বা কি, আর বুঝিই বা কতটুকু। অন্তত বিশ্বজুড়ে সাম্যবাদের পতন ও ধনতন্ত্রের এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের চোখে অতি সহজেই ঠুলি পরিয়ে দেওয়া সম্ভব। আর হচ্ছেও ঠিক সেটিই।
ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে যেখানে ধনতন্ত্রের এই বিশ্বায়ন সমস্ত পরিসরই জবর দখল করে রেখে দিয়েছে, সেখানে দারিদ্র্যদূরীকরণ অর্থনীতির নিছকই গালভরা কিছু মডেল মাত্র তার বেশি কিছু নয়। এই দেশগুলির রাজনীতি ও শিল্পনীতি কোনভাবেই দেশের বৃহত্তর সমাজকে দারিদ্র্যসীমার নীচ থেকে উপরে টেনে তুলবে না। আর কোন ভাবে, বিশেষ বিশেষ কোন দেশ যদি সেই চেষ্টা করা শুরুও করে তবে প্রথম বিশ্বের দেশগুলি কোনভাবেই সেই প্রয়াসকে সফল হতে দেবে না। সবরকম ভাবেই সেই প্রচেষ্টাকে সমূলে বিনাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তা না করলে তারা নিজেদের দেশের ধনতান্ত্রিক মডেলের সাথে ওয়েলফেয়ার ইকনমি সিস্টেমকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। বুঝতে হবে সেই নিগূঢ় সত্যটুকু।