লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ June 30, 2020, 12:00 AM, Hits: 1113
(প্রাক-কথন : অনেক প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি ধর্মকে মোকাবেলা করেই আধুনিক পুঁজিবাদের জন্ম। বার্ধক্যে আসার পর সেই পুঁজিবাদ তার মৃত্যুর কারণ সমাজতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে আবার ধর্মের শরণ নেয়। কমবেশি সকল ধর্মই সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে থেকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষার জন্য কাজ করেছে। তবে এই লেখায় সমাজতন্ত্র তথা প্রগতির বিরুদ্ধে এবং প্রতিক্রিয়ার পক্ষে কীভাবে ইসলাম ক্রিয়া করেছে, সেই বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য ধর্ম নিয়েও কমবেশি একই ধরণের চিত্র পাওয়া যাবে। অন্য সকল ধর্ম যাদের নিকট সমস্যা, তারা সেটা নিয়ে লিখবেন। এখানে যেহেতু ইসলাম নিয়ে বলা হয়েছে বিধায় অন্যান্য ধর্মকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নাই।)
ধর্ম প্রশ্নে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে পার্থক্য কি? না, কোনো পার্থক্য নাই। ধর্ম প্রশ্নে উভয় মতবাদই অভিন্ন মত ধারণ করে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ উভয়ই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ অগ্রজ, সমাজবাদ অনুজ। আধুনিকতা ধর্মকে নাকচ করে দেয়। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের মধ্যে পার্থক্যের জায়গা হল সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে। পুঁজিবাদ সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় বিশ্বাস করে আর সমাজবাদ সামাজিক মালিকানায়। পুরানা সংস্কার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতাকে নির্মমভাবে ছিন্ন-ভিন্ন করে বুর্জোয়া শ্রেণির হাত ধরে পৃথিবীতে প্রথম আধুনিকতার প্রসার ঘটে, সেটা পশ্চিম ইউরোপে। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ, দু’টো মতবাদই এসেছে পশ্চিম ইউরোপ থেকে। ধর্ম প্রশ্নে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাদের কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে বলেছেন, ‘ইতিহাসের দিক থেকে বুর্জোয়া শ্রেণি খুবই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি শোভন সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। যে সব বিচিত্র সামন্ত বাঁধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার স্বভাবসিদ্ধ ঊধ্বর্তনদের কাছে, তা এরা ছিঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের অনাবৃত স্বার্থের বন্ধন, নগদ টাকার বাঁধন ছাড়া আর কিছুই এরা বাকি রাখেনি। আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফ জলে এরা ডুবিয়ে দিয়েছে ধর্ম-উন্মাদনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্যবৃত্তির উৎসাহ ও কূপমণ্ডুক ভাবালুতা। লোকের ব্যক্তিমূল্যকে এরা পরিণত করেছে বিনিময়মূল্যে, অগণিত অনস্বীকার্য সনদবদ্ধ স্বাধীনতাকে এরা পরিণত করল ওই একটি মাত্র নির্বিচার স্বাধীনতায়, যার অর্থ হল - অবাধ বাণিজ্য। এক কথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভ্রমে যে শোষণ এতদিন ঢাকা ছিল, তার বদলে এরা এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ, সাক্ষাৎ পাশবিক শোষণ।’
মধ্যযুগের শেষ নাগাদ ইউরোপে ইসলামিক দুনিয়ার বিস্তার ঘটতে থাকে। খ্রীষ্টীয় ৮ম শতাব্দী থেকে ইসলামের যে অভিযান ইউরোপের উপর আছড়ে পড়ছিল (৭১১ খ্রীষ্টাব্দে তারিকের নেতৃত্বে ইসলামী আরব বাহিনী স্পেনে প্রবেশ করার পর সেখানে ইসলামের বিজয় অভিযান শুরু হয়) তার আঘাতে ইউরোপের প্রতিরোধের শক্তি চূর্ণ হতে পারত। পরবর্তীকালে তুর্কী মুসলিমরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলও জয় করে (১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দ), যা ইস্তানবুল নাম নিয়ে আজ অবধি তুরস্কের অধিকারে আছে।
একদা রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী ইস্তান্বুল জয় করে অটোম্যান শাসক দ্বিতীয় মোহাম্মদ ‘কায়সারে রুম’ (রোমের সম্রাট) উপাধি গ্রহণ করেন। এই পদবীর দাবিদার ছিলেন রুশ সম্রাট জারও। উপাধির যথার্থতা প্রদর্শনের জন্য মোহাম্মদ ইতালির একাংশ দখল করে নেয়। ইস্তান্বুল বিজয়ে ১১০০ বছরের খ্রিষ্টীয় রোমান বাইজেন্টাইন সাম্রাজের পতন হয়। তুর্কিরা বিশ্বের এ অঞ্চলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানরা বেলগ্রেড জয় করে। হাঙ্গেরির বড় অংশও হয় পদানত। ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অবরোধ করে, তবে সফল হয়নি। ট্রানসিলভানিয়া ও মোলদাভিয়া তুর্কিদের অধীনে আসে। তিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া স্পেন থেকে তুর্কিদের দখলে যায়। তুর্কিরা ইউরোপের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি বড় শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং একপর্যায়ে ফ্রান্সের সাথে অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে ওঠে। স্পেন, ইতালি ও অস্ট্রিয়ার মোকাবেলায় তুর্কিরা ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডের সাথেও সামরিক জোট বেঁধেছিল।
১৭০৯ সালে রুশদের হাতে পরাজিত হয়ে সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লস ইস্তান্বুলে রাজপ্রাসাদে আশ্রয় নেন এবং পাঁচ বছর সেখানে কাটান। তার প্রেরণায় সুলতান আহমদ ১৭১০ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাদের পরাস্ত করেন। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রুশ-তুর্কি যুদ্ধ চলতেই থাকে। তুর্কি সাম্রাজ্যের পতনের পালা এবং আধুনিকায়ন দুটোই চলছিল একত্রে। ইউরোপকে দাঁড়াতে হয়েছে ইসলামকে মোকাবেলা করেই।
ইসলাম সুদীর্ঘ কাল পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপী দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। সমগ্র উত্তর আফ্রিকা, ইউরোপের স্পেন, পূর্ব ইউরোপের এক উল্লেখযোগ্য অঞ্চল, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া থেকে ভারত এবং সাগর পার হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সুবিশাল ভূভাগ ইসলামের অধীনে চলে যায়। ইউরোপের খ্রীষ্টান অধ্যুষিত স্পেন থেকে ইসলাম চূড়ান্তভাবে উৎখাত হয় ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে সেখানে খ্রীষ্টান শক্তির হাতে মুসলমানদের শেষ ঘাঁটি গ্রানাডা রাজ্যের পতন হলে। পশ্চিম ইউরোপ প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত ইসলামী আগ্রাসনকে প্রতিরোধে সমর্থ হয়। খ্রীষ্টান অধ্যুষিত রাশিয়া মোঙ্গলদের ইসলামে ধর্মান্তরিত অংশ গোল্ডেনহোর্ড শাসকদেরকে ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে মুসলিম শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। একটা পর্যায়ে ইউরোপ পাল্টা আঘাত হানে। ১০৯৬ থেকে শুরু হয়ে ১২৯১ পর্যন্ত প্রায় দুইশত বৎসর জেরুজালেমে ব্যর্থ ধর্মযুদ্ধের পর খ্রীষ্টানধর্ম শাসিত ইউরোপ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে সূচিত এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রবল রূপ পরিগ্রহ করে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে প্রবলতর শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়। এরপরেই ইউরোপের ইসলামী জগতের উপর পাল্টা আঘাত আসে।
পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীর চতুর্দিকে ইউরোপের দেশগুলির আবিষ্কার ও বিজয় অভিযান শুরু হয়। দুই আমেরিকা মহাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও এশিয়াসহ পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগ ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনে চলে যেতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে ইসলামী দেশগুলিরও প্রায় সবাইকে আগে বা পিছে একই পরিণতি ভোগ করতে হয়। ইসলাম ও মুসলমানদের আধিপত্যের যুগ শেষ হয়।
অপর দিকে পশ্চিম ইউরোপ, যেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণি, যে বুর্জোয়া শ্রেণি আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফজলে ডুবিয়ে দেয় ধর্ম-উম্মাদনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্যবৃত্তির উচ্ছ্বাস ও কূপমণ্ডুক ভাবালুতা। সেই বুর্জোয়া শ্রেণিকে নিজ নিজ দেশে যে ধর্মীয় কুসংস্কারকে উম্মোচিত করতে হয়েছে, তখন তার সামনে ছিল খ্রীষ্টীয় ধর্ম। তাই তাকে ইসলামকে মোকাবেলা করতে হলেও, তার অসঙ্গতিকে উম্মোচন করতে হয়নি।
অপরদিকে ইসলামি জগতের আগ্রাসন মার খাওয়ায় পর, তার বিলয় ঘটতে থাকে আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানে। এরপর ইতিহাসের দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয় ইসলামি দুনিয়ার উত্থানপর্ব। এসকল ঘটনাপর্বে নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি থেকে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে বুর্জোয়া শ্রেণি, ততদিন তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এরপর থেকেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ইসলামি শক্তি সব সময় পরস্পরের পরিপূরক হয়েই কাজ করেছে, বিশেষত সমাজতন্ত্র মোকাবেলার প্রশ্নে।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় শ্রমিক বিপ্লব সংঘটনের পর বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির বুকে কাঁপন ধরে যায়। আসন্ন শ্রমিক বিপ্লবের হাত থেকে বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে ইসলাম।
এশিয়া-ইউরোপ-ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকার কত দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল, কিন্তু ইসলামি দুনিয়ার কোথাও সমাজতন্ত্র অভিমুখী শ্রমিক বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, এমনকি গণতান্ত্রিক আধুনিক সমাজও সেসব দেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। ইসলামপন্থী দলসমূহ তাদের ধর্মীয় অনুশাসনের কল্পিত সমাজ গড়তেই রাজনীতি করেছে, যে সমাজ শেষবিচারে মুনাফা ভিত্তিক ও ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক হলেও আধুনিক নয়। শুরু থেকে ইসলাম পণ্য অর্থনীতি এবং আধুনিক যুগে পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই ঘোরতর সমর্থক হয়ে থেকেছে। ধর্মের কোন অনুশাসন পালনে কী পরিমান নেকি বা সওয়াব পাওয়া যাবে, তার যে লোভনীয় বর্ণনা দেওয়া হয়েছে মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থে, সেটা অনুসারীদের মধ্যে একটা বাণিজ্যিক মনস্তত্ত্ব গড়ে তোলে। যেন বড় ডিসকাউন্টে সস্তায় পণ্য কেনার মতই সুযোগ।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলোও যে সবসময় প্রগতিশীল আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে কিংবা নিকৃষ্ট গণশত্রুদের হাত ধরে চলেছে, এমন উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষে থেকেছে এমন উদাহরণ একটিও পাওয়া যাবে না।
কুখ্যাত নরপিশাচ জেনারেল ইয়াহিয়ার পাশে ছিল জামায়াত ও মুসলিম লীগ, আরেক গণশত্রু জেনারেল এরশাদের সঙ্গে ছিল আটরশির পীর। ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রধান চর মোনাইয়ের পীরও এরশাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল জামায়াত নেতা গোলাম আজমসহ বিভিন্ন ইসলামিক দল। ইসলামপন্থীরা সাতচল্লিশে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল, নিকট অতীতে সংগঠিত হয়েছিল খালেদা জিয়ার ছায়ায়। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফী এখন শাসকদলের ঘনিষ্ঠজন।
বাংলাদেশের বাইরে আফগানিস্তান, ইরাক, ইরানে ও পাকিস্তানে ইসলামিক শক্তি সব সময় সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করছে। খোদ সৌদি আরবই টিকে আছে মাকিন সাম্রাজ্যবাদের অনুকম্পায়-অনুগ্রহে। আফগানিস্তানে আশির দশকে সোভিয়েত হস্তক্ষেপে গঠিত হয়েছিল ‘সমাজতান্ত্রিক’ সরকার। ওই সরকারের পতনের জন্য মার্কিনী অস্ত্রে-অর্থে-বন্ধুত্বে বলীয়ান হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিল সেদেশের ইসলামপন্থী দলগুলো। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় মার্কিনী মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিল তারা।
সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে ইসলামপন্থী দলগুলো তার কারণ কি হতে পারে? সমাজতন্ত্র নাস্তিক্যবাদী দর্শন বলে? পুঁজিবাদ নিজেও একটি নাস্তিক্যবাদী আধুনিক মতাদর্শ। ধর্ম প্রশ্নে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য হল, পুঁজিবাদ ভণ্ডামীর আড়ালে ধর্মের অন্তঃসারশূন্যতাকে লুকিয়ে রাখে আর সমাজতন্ত্র তাকে উন্মোচিত করে দেয়। নাস্তিক্যবাদ উছিলা মাত্র, ইসলামের সঙ্গে পুঁজিবাদের সখ্যর মূল জায়গা হল সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা। কারণ মুনাফা, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং অবাধ শোষণ-লুণ্ঠনের সঙ্গে ইসলামের গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
দেশের সকল মসজিদ-মাদরাসার পরিচালনা কমিটিতে কারা থাকে? সাদা চোখেই লক্ষ্য করা যায়, সমাজের টাউট-বাটপাড়-লম্পট, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, জনগণের সম্পত্তি আত্মসাৎকারী, সর্বোপরি গণশত্রুরাই সকল মসজিদ-মাদরাসার পরিচালনা কমিটিতে বড় বড় পদ দখল করে আছে।
আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকজুড়ে ইসলামিক স্কলাররা যে বক্তব্য রাখতেন, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রপাগাণ্ডা। গ্রামগঞ্জের ধর্মসভাগুলোতে অশিক্ষিত মোল্লারা পর্যন্ত কার্ল মার্কস, ডারউইনের ভুল ধরত। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, এমনকি গণতন্ত্র ও নারীমুক্তির বিরুদ্ধে সীমাহীন বিষোদ্গার করা হত। মোল্লা বা আলেমরা সমাজতন্ত্রের বিকৃত উপস্থাপন ও অপব্যাখ্যা দিয়ে চলতেন। এমনকি বুর্জোয়া দলগুলোও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এত উচ্চকণ্ঠ ছিল না। এসব ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে ছিল সামরিক সরকারগুলোর গভীর সখ্য। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোই শুধু নয়, মসজিদ, মাদরাসা ও অরাজনৈতিক ধর্মসভাগুলো ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রপাগাণ্ডার আখড়া। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্টরা ছিল তাদের টার্গেট। জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহতদের বেশিরভাগই বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী।
এবার বাংলাদেশের বাইরের প্রসঙ্গে আসা যাক। যে গণ-অভ্যুত্থান দ্বারা ইরানের সম্রাট রেজাশাহ পাহলভী উচ্ছেদ হলেন, সেখানে কমিউনিস্টদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ ছিল। ইরানের তু দে পার্টি ওই অভ্যুত্থানে বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছিল। ইসলামপন্থী দল এবং খোমেনীর সঙ্গে একটি সমঝোতাও তৈরি হয়েছিল। অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কমিউনিস্ট নিধন শুরু করে খোমেনীর দল। মুসলিম জনসমাজও কমিউনিষ্ট নিধন যজ্ঞে অংশ নেয়, সমর্থন করে। ইন্দোনেশিায়ার দেশপ্রেমিক সুকর্ণ সরকারকে উচ্ছেদ করতে এগিয়ে এসেছিল ইসলামপন্থী দলগুলো। হাত মিলিয়ে ছিল কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল সুহার্তোর সঙ্গে। চীন বিপ্লবের পর সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়া চিয়াং কাইশেক ও তার দল, বেলুচিস্তানের কসাই বলে খ্যাত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘাতক প্রধান জেনারেল টিক্কা খানসহ এশিয়ার তাবৎ কুখ্যাত প্রতিক্রিয়াশীলরা জড়ো হয়েছিল, তারা সুকর্ণের সহযোগী কমিউনিস্ট নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। ওই ঘটনায় প্রায় ১০ লক্ষ কমিউনিস্ট ও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, ট্রেড ইউনিয়নকর্মীসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা কমিউনিস্ট এবং অন্য বামপন্থীদের ‘‘বিপজ্জনক নাস্তিক’’ বলে প্রচার করত। তাদের সমূলে উৎখাত করার জন্য নাগরিকদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ চালাত। চীনে সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হয় বিপ্লব বিরোধী বেঈমানরা। তারা দলে দলে আসতে থাকে ইন্দোনেশিয়ায়। পৈশাচিক উল্লাসে তারাও এসে যোগ দেয় খুনী, বিশ্বাসঘাতক এবং দেশদ্রোহী জেনারেল সুহার্তোর ছায়াতলে। চীন থেকে আসা বেঈমানরা কাজ করত গোয়েন্দাগিরির। এই গণহত্যা পরিচালনাকারী সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল ইসলামপন্থী দল ও জনতা। একাত্তরে বাংলাদেশেও পাকহানাদাররা যে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ করেছিল সেটাও ইসলামিক জোশেই।
ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যে ধর্ম একটা জনগোষ্ঠীকে অসহিষ্ণু ও কূপমণ্ডুকে পরিণত করে। একই সঙ্গে সেই জনগোষ্ঠীক ধর্ষণ ও গণহত্যায় উৎসাহিত করে তোলে। রাষ্ট্রপ্রধান ধর্ষক হলেও সাধারণ মুসলমান সেটা মেনে নেয় এবং বলতে পারে, ‘রাজা-বাদশারা ও রকম একটু করেই থাকে।’
২০০১ সালের নাইন বাই ইলেভেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনায় ইসলামিক জঙ্গিদের দায়ী করা হয়। তাদের শায়েস্তা করার জন্য আফগানিস্তানে হামলা চালায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সহযোগীরা। এর আগে ইরাক দখল করে নেওয়া হয়। এই হামলা ও দখলদারিত্বকে নাম দেয়া হয় ’ওয়ার অন টেরর’। অর্থাৎ নিজের সৃষ্ট শত্রুকে নিধন করার আয়োজনের নাম ‘ওয়ার অন টেরর’। যে শত্রু একদা বন্ধু ছিল, একদা যাকে অস্ত্রে, অর্থে, বন্ধুত্বে বলীয়ান করা হয়েছিল, যে শত্রু বন্ধুর চেয়ে বড় বন্ধু, যে শত্রুর নিয়ন্ত্রণে থাকা তেল ক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত তেল সম্পদ পানির চেয়ে সস্তা দামে কেনা যায় সেই শত্রুরূপী বন্ধু কিংবা বন্ধু রূপী শত্রুর নাম আলকায়দা, তালেবান, আইএস প্রমুখ। স্নায়ু যুদ্ধের পর্বে যারা ছিল ছিল হরিহর আত্মা সেই হরিহর আত্মারা যখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয় তখন তাদেরকেও সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করে। কারণ ওই ছুতা ধরে তাদের দমন, রাজ্য দখল, তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলে আধিপত্য কায়েম ও যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। সোভিয়েত নাই, কিন্তু যুদ্ধের জন্য যুতসই শত্রু দরকার। যে শত্রু সমস্যা হয়ত তৈরি করবে কিন্তু নিজের বিপদের কারণ হবে না। কারণ যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদ বাঁচে না, আগে যুদ্ধের জন্য অস্ত্রের দরকার হত, এখন অস্ত্রের জন্য যুদ্ধের দরকার হয়। যেমন দরকার হয় শত্রুর।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একদিকে যেমন পরিচালনা করছে ‘ওয়ার অন টেরর’, অপরদিকে তারই পৃষ্ঠপোষকতায় টিকে আছে সৌদি ওহাবিজম। একদিকে ইসলামকে টিকিয়ে রাখছে অপরদিকে ইসলামি জঙ্গি দমনের নামে ওই অঞ্চলে কায়েম করছে মার্কিন আধিপত্য।
সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যখন তারই বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বরত, তখন তাকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে চিনতে চাইছেন অনেকে। যেহেতু কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের জাত শত্রু, সেহেতু কমিউনিস্টদের সঙ্গে ওই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, ইসলামিক জঙ্গিদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই চাইছেন অনেকে। তাদের ধারণা এতেই সামাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই প্রবল গতি পাবে। কিন্তু তারা এই বুঝটি সামনে আনছেন না যে, ওই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা যে সমাজ কায়েম করতে চান সে সমাজ আরো নিকৃষ্ট, তারা সমাজে যে ভাবাদর্শ ছড়িয়ে দিতে চায়, সেটা আরো পশ্চাৎপদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল। তারা এই বুঝটা সামনে আনতে চান না যে, উভয় পক্ষের স্বার্থের জায়গা মিলে গেলে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা যে কোনও সময়ে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী শক্তিতে পরিণত হতে পারে। তারা এই বুঝটা সামনে আনতে চান না যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জঙ্গিভীতি সৃষ্টির আগে থেকেই ইসলাম একটি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ছিল। সাম্রাজ্যবাদের ইসলামভীতির (Islamophobia) সঙ্গে ইসলামকে গ্রহণ বা বর্জনের সম্পর্ক নাই। এতে ইসলামের চরিত্র পাল্টায় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি করে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য অনেকে ইসলামিক শক্তিকে স্পেস দিতে চাইছেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক চারিয়ে উঠেছে। এতে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সমাজে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে ইসলামিক শক্তির প্রবল উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও ইসলামিক শক্তি কখনোই রাজনীতিতে স্বতন্ত্রভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। কখনো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, কখনো সামরিক শাসক, কখনো খালেদা জিয়ার ওপর ভর করে দাঁড়াতে চেয়েছে। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়ার পরে ওই ইসলামিক শক্তি এতিম হয়ে গেছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থেকে তাদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে চলেছে, একটি অংশ ‘রাষ্ট্র-চিন্তা’র মত সাংগাঠনিকভাবে দুর্বল একটি রাজনৈতিক উদ্যোগের ছায়ার নীচে আশ্রয় নিতে চাইছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে, খালেদাকে উচ্ছেদ করে হাসিনা আর হাসিনাকে উচ্ছেদ করে খালেদা — এমন পাল্টাপাল্টির যুগ শেষ হয়ে গেছে। বিএনপি-এর নি:শেষ হওয়াই আওয়ামী লীগের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে যাচ্ছে। এই বিপদ শুধু আওয়ামী লীগের জন্য নয়, একই সঙ্গে এই বিপদ এই রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণির জন্যও বটে। মহা সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ অনুন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সরকার। এই সংকট সামাল দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নাই। সেই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সংকট। সম্প্রতি ভাইরাসেরও বিশ্বায়ন ঘটেছে। বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এই সংকটকে আরো তীব্রতর করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে কোভিড-১৯ ভাইরাস হল দুর্যোগ, আর পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ হল দুর্যোগপ্রসবিনী।
এই বাস্তবতায় উচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাষ্ট্র ও সরকারের জায়গায় একই চরিত্রের রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠা সংকটের সমাধান নয়। ঊনসত্তরে আইউব উচ্ছেদে ইয়াহিয়া আর নব্বইয়ে এরশাদ উচ্ছেদের পর খালেদা কোনো সমাধান আনেনি। বরং এই উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও সরকারের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার জনগণের রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। দরকার নিজেদের মত করে আধুনিকতার নির্মাণ। একই সঙ্গে জনগণের সম্পদ আত্মসাৎকারী শোষণজীবী-লুণ্ঠনজীবী যে শ্রেণি রাষ্ট্রে, প্রশাসনে, সরকারে ও সমাজে শিকড় গেড়ে বসে আছে, সেই শ্রেণির মুলোৎপাটনে কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়ন প্রয়োজন। দরকার সর্বব্যাপী একটা জাগরণ, শুধু বাংলাদেশকে নয় উপমহাদেশকে বিবেচনায় নিয়ে জাগরণের কাজ শুরু করা দরকার। শিল্প, সাহিত্য,নন্দনতত্ত্ব, নাটক-থিয়েটারসহ সর্বক্ষেত্রে সেই জাগরণের স্পন্দন অনুরণিত হওয়া চাই।
প্রতিটি সংকট একটি মোড় ঘোরাবার সময়। কোনদিকে মোড় ঘুরবে সেটা কারা কতটা প্রস্তুত তার ওপর নির্ভর করে। পৃথিবী জোড়া এই সংকটে পৃথিবীব্যাপী পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেই পরিবর্তনের জন্য সবদিক থেকে প্রস্তুতি নেওয়াটাই আসল কথা।