লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ September 15, 2020, 12:00 AM, Hits: 868
(১) বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বের কারণ
এটা খুব লক্ষ্যণীয় একটা বিষয় যে, এ দেশের সাধারণ মানুষ কোন দিনই সামরিক শাসন তেমন একটা পছন্দ করে না। সাধারণত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার কারণে সামরিক শাসন আসে। এই রকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক শাসনের প্রতি বিরক্ত আমজনতার মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সামরিক শাসনের প্রতি সমর্থন থাকলেও সেটা নষ্ট হতে বেশী সময় লাগে না। ছাত্র-মধ্যবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপক অংশ তথা নাগরিক সমাজের ব্যাপক অংশের মধ্যে প্রথম থেকেই সামরিক শাসনের প্রতি যে বিরোধিতা থাকে তা কিছু দিনের মধ্যে শহরের সর্বসাধারণ এবং গ্রামেরও সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে শুরু করে। ফলে রাজনৈতিক দলের শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ক্রমবর্ধমান হারে জনগণের অংশ গ্রহণ ঘটে।
ব্যাপারটাকে আমাদের দেশের জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা কিংবা গণতন্ত্র প্রীতি হিসাবে সাধারণত ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে ঘটনাটার ভিন্ন তাৎপর্য বেরিয়ে আসে। তখন বুঝা যায় যে, আমাদের সমাজের জনগণের এই মানসিকতার প্রধান কারণ সমাজতাত্ত্বিক। আসলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও সেনাশাসনের তুলনায় আপাত দৃষ্টিতে যত নিকৃষ্টই হোক রাজনৈতিক দলের শাসন চায়। এবং একটু খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায় যে, এই চাওয়াটা মূলত সামাজিক প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত। রাজনৈতিক সচেতনতার ব্যাপার আছে বৈকি। তবে সেটা রাজনৈতিকভাবে সচেতন স্বল্প সংখ্যক ছাত্র-মধ্যবিত্তের মধ্যে আর দলগত স্বার্থের কারণে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জনসমাজের নিম্ন চেতনার মানের দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যায় রাজনীতি সচেতনতার পরিবর্তে ভিন্ন কোনও সামাজিক কারণ কাজ করে এ ক্ষেত্রে। কাজেই প্রশ্ন আসে সেই সামাজিক কারণটা কী হতে পারে? আর সেটা খুঁজে বের করতে গেলেই আমরা এক বিস্ময়কর সমাজসত্য আবিষ্কার করব।
আর তখন দেখতে পাব যে, কারণটা হচ্ছে আমাদের দেশে রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের জীবন্ত যোগাযোগের প্রায় একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে রাজনৈতিক দল। রাষ্ট্র শাসনের ব্যবস্থা শুধু যে আমলাতান্ত্রিক তা-ই নয়, উপরন্তু জনগণের নিকট বহিরাগত বা বিদেশী চরিত্রের। এক এলাকার মানুষকে আমলা-পুলিশ হিসাবে পাঠানো হয় আর এক এলাকার মানুষকে শাসন করতে। ফলে গ্রাম ও শহরের সর্বসাধারণের কাছে পুলিশসহ প্রশাসনের আমলা বা সদস্যরা বহিরাগত এবং অচেনা। সুতরাং এই শাসনের চরিত্র মর্মগতভাবে বিদেশী, বিজাতীয়।
ব্রিটিশরা এ দেশ শাসনের জন্য যে আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল সেটা ছিল জনগণের প্রতি নির্লিপ্ত, নিপীড়ক, উদ্ধত এবং জনগণের নিকট বহিরাগত। দুই দুইবার স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ — এতকিছুর পরেও দেশ শাসনের ব্যবস্থা হিসাবে ব্রিটিশ শাসকদের রেখে যাওয়া সেই আমলাতন্ত্রই প্রায় অপরিবর্তিত রূপ নিয়ে রয়ে গেছে। তার বহিরাগত চরিত্র সম্পূর্ণরূপে পূর্বের মতই রয়েছে। কিন্তু তার দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে। দুর্নীতির প্রসারের ফলে তার নিপীড়ক এবং উদ্ধত চরিত্র বহু বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তনীয়ভাবে কিন্তু আরও নিকৃষ্ট রূপ নিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান কথিত স্বাধীন রাষ্ট্রটিতে বিদ্যমান।
এই অবস্থায় প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রটাই সাধারণ মানুষের জন্য হয়ে দাঁড়ায় বহিরাগত বা বিদেশী, উদ্ধত, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নিপীড়ক। এই দুর্নীতিগ্রস্ত, উদ্ধত, নিপীড়ক, অচেনা ও বিদেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সহজ এবং প্রায় একমাত্র মাধ্যম হিসাবে যেমন রাজনৈতিক দল দেখা দেয় তেমন এই রাষ্ট্রের দমন, পীড়ন এবং উদ্ধত ও বহিরাগত চরিত্রের শাসনকে যতটা সম্ভব সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ করার হাতিয়ার হিসাবেও দেখা দেয় কেন্দ্র্র থেকে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত জনগণের সঙ্গে অসংখ্য বন্ধনে আবদ্ধ নেতা-কর্মীদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল। অপর দিকে, জনগণের সঙ্গে জীবন্ত যোগাযোগ রক্ষার জন্য রাষ্ট্র বা শাসন যন্ত্রের নিকটও রাজনৈতিক দল অপরিহার্য হয়ে উঠে। রাজনৈতিক দল না থাকলে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আর কোন কার্যকর সেতুবন্ধন থাকে না। ফলে আমলা-পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতায় অবস্থাটা যে শুধু জনগণের জন্য অসহনীয় উঠে তা-ই নয়, অধিকন্তু জন-বিচ্ছিন্নতার ফলে রাষ্ট্রের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠে। অর্থাৎ এ দেশে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে প্রায় একমাত্র মধ্যস্থতাকারী সামাজিক প্রতিষ্ঠান। জনগণের স্থানীয় স্বশাসনের ব্যবস্থার দুর্বলতার ফলে রাষ্ট্রশাসন যেমন আমলাতান্ত্রিক রয়ে গেছে তেমন এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ ও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাতেও প্রধানত রাজনৈতিক দল রয়ে গেছে। বিপদে ও প্রয়োজনে জনগণের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি কিংবা সংলাপের ভূমিকা পালনে যেটুকু হোক ভূমিকা পালন করে রাজনৈতিক দল বা তার নেতা-কর্মীরা। আবার আমলাতন্ত্রের পক্ষ থেকে জনগণের উপরও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সহজ হাতিয়ার হয়ে দেখা দেয় বিশেষত বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলি।
(২) পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলের দুর্বলতার কারণ
বর্তমান পাকিস্তানের মত রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের কার্যকর অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আছে বলে রাজনৈতিক দল যেমন সমাজের ভিতর দৃঢ়মূল হতে পারে না তেমন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের নিকটও ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে না। সেখানে সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আছে উপজাতি-গোত্র প্রধানরা, জমিদার বা বৃহৎ ভূস্বামীরা এবং প্রধানত পুরাতন বৃহৎ জমিদার বা ভূস্বামীদের মধ্য থেকে উদ্ভূত ধনিকরা ।
উপজাতি বা ট্রাইবের ব্যাপারটা অনেকে জানেন। পাকিস্তানের এক উল্লেখ্য অঞ্চলে উপজাতীয় বা গোত্র প্রধানরা নিজ উপজাতি বা গোত্রের উপর বিপুল কর্তৃত্ব রাখে এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আইয়ুব সরকারের সময় ভূমি সংস্কারের ফলে খুব বড় জমিদারী ভেঙ্গে গেলেও পাঞ্জাব, সিন্ধুর মত প্রদেশে এখনও কম বা বেশী বড় জমির মালিক যেমন অনেক রয়েছে তেমন পুরাতন জমিদারদের বংশগত প্রভাব-প্রতিপত্তির জেরও এখন পর্যন্ত সমাজে নানানভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। এমন একটা জমিদার পরিবার সিন্ধু প্রদেশের ভুট্টো পরিবার। পূর্ববর্তী বৃহৎ জমিদারদের বংশধররা সেখানে কলকারখানা প্রতিষ্ঠা কিংবা নানান ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে নূতন ধরনের বা পুঁজিবাদী অর্থনীতিতেও জায়গা করে নিয়েছে। এভাবে তাদের পূর্ববর্তী সামাজিক প্রভাবও নূতন পর্যায়ে রক্ষা পেয়েছে। এই ধনিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক রক্ষা দ্বারা সেখানে জনসমাজকে রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। বস্তুত স্বল্পসংখ্যক উপজাতীয় প্রধান, ভূস্বামী এবং ধনিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সুসম্পর্ক অথবা এই শ্রেণীগুলির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলে সেখানে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখা সম্ভব হতে পারে। এই রকম অবস্থায় রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের তুলনায় আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র হিসাবে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ অথবা নিয়ন্ত্রণ সেখানে খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে রয়েছে।
অবশ্য এই সঙ্গে ধর্মের ভূমিকাকেও আমাদের হিসাবে নিতে হবে। ইসলাম মূলত সামরিক বৈশিষ্ট্যমূলক রাজনৈতিক ধর্ম হওয়ায় ইসলামী সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে সেনাবাহিনীই রাষ্ট্রশাসনে প্রধান নির্ধারক শক্তি হয়। পাশ্চাত্য আধিপত্য এই অবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনলেও ইসলামের মূল প্রবণতা অনুযায়ী সমাজ যে কোনও সময় রাজনৈতিক দলের শাসন থেকে সেনা শাসনে চলে যেতে পারে। যেহেতু সমাজ তথা জনমানস বেসামরিক এবং রাজনৈতিক শাসন কিংবা গণতন্ত্রের অনুকূল নয় সেহেতু রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থা হয়ে থাকে দুর্বল, অস্থিতিশীল এবং ভঙ্গুর। সমাজে মোল্লা তথা ধর্মীয় শক্তি এবং ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধির সমান্তরালে যে কোনও ধরনের অসামরিক কর্তৃত্বের দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান এর একটা মূর্ত দৃষ্টান্ত। বিশেষত মোল্লা এবং মসজিদগুলিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সেখানে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায় দেখতে পায়।
অর্থাৎ উপজাতীয় প্রধান, বৃহৎ ভূস্বামী, বৃহৎ ধনী এবং মোল্লা ও মসজিদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সহজেই সেখানে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ফলে রাজনৈতিক দল সেখানে রাষ্ট্রের নিকট সর্বদা অপরিহার্য হয় না। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় যে, পাকিস্তানের মত দেশে জনগণের এক বৃহৎ অংশ যেখানে উপজাতি বা এই ধরনের বংশ ও রক্ত বন্ধনগত সংগঠনে দৃঢ়বদ্ধ, যেখানে বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ এবং সেই সঙ্গে গ্রাম থেকে নগরে আগত শ্রমজীবীদেরও এক বৃহৎ অংশ বৃহৎ ভূস্বামী অথবা তাদের উত্তরাধিকারী বা বংশধর ধনীদের প্রতি অনুগত এবং যেখানে জনগোষ্ঠীর খুব বড় অংশের উপর মোল্লা শ্রেণীর প্রভাব গভীরভাবে ক্রিয়াশীল সেখানে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে এদের অবস্থান থাকায় রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন এবং সুযোগও রাষ্ট্র ও সমাজ এই উভয়ের জন্যই গৌণ হয়ে পড়ে।
(৩) প্রাক-ব্রিটিশ বঙ্গের সামাজিক বৈশিষ্ট্য
কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এ কথা আদৌ প্রযোজ্য নয়। মূল কারণ সমাজ বিন্যাসের ভিন্নতা। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বঙ্গীয় ভূমির প্রায় সবটা অতীতে শত শত অথবা হাজার হাজার বৎসর ধরে অস্থিতিশীল এবং ভাঙ্গন প্রবণ ছিল। পশ্চিম বঙ্গের এক বৃহদাংশ অনেক আগে থেকে কিছু বেশী স্থিতিশীল হলেও পূর্ব বঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশভুক্ত অঞ্চলের প্রায় সবটা কিছু কাল আগেও অস্থিতিশীল ছিল। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নামের বৃহৎ নদীগুলি শুধু নয়, উপরন্তু মাঝারী ও ছোট বহু সংখ্যক নদীর প্রমত্ততার আঘাতে এ বঙ্গের ব্যাপক অঞ্চল ছিল অস্থিতিশীল। আজও চর গঠন ও ভাঙ্গন প্রক্রিয়ায় এ বঙ্গের বৃহৎ অংশ ভূমি গঠনের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের ভিতর সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। কিন্তু যে ভূমি গঠন হয়েছে সেটাও সুদীর্ঘ কাল হয়ে থেকেছে নদীর অবিরাম গতিপথ পরিবর্তনের ফলে অস্থির। নদীগুলিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণের ফলে অতীতের মত নদী ভাঙ্গন এখন না ঘটলেও আজও প্রতি বৎসর নদী ভাঙ্গন বহুসংখ্যক মানুষকে বাস্তুচ্যুত বা স্থানচ্যুত করছে।
অতীত বঙ্গের জন-জীবনের এক চিত্র ফুটে উঠে এক কালের খুব জনপ্রিয় এক গানের কথায়, ‘এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা/ সকাল বেলায় আমীর রে ভাই ফকীর সন্ধ্যা বেলা।’ এখন আর এই গানের কথা বঙ্গের বৃহত্তর অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য না হলেও ইংরেজ শাসনের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কম-বেশী প্রযোজ্য ছিল। ইংরেজ শাসকরা তাদের উন্নততর সভ্যতা ও প্রযুক্তির সাহায্যে এখানে নদীর গতিপথের উপর যথেষ্ট পরিমাণে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বাঁধ, রেল লাইন, রাজপথ, সেতু ইত্যাদি নির্মাণের ফলে নদীগুলির গতিধারা আর অবাধ থাকতে পারে নাই। ইংরেজদের দ্বারা সূচিত নদী নিয়ন্ত্রণ এখন আরও অনেক দূর এগিয়েছে।
কিন্তু এই পরিবর্তন খুব সাম্প্রতিক। সেদিন পর্যন্ত বঙ্গের ভূমি নির্ভর তথা কৃষি নির্ভর জন-বসতি ও জন-সমাজ ছিল অস্থিতিশীল এবং সমাজ সংস্থা ছিল শিথিল। নদী ভাঙ্গন জন-বসতি ও সমাজকে ছত্রভঙ্গ করত এবং আজও কিছু পরিমাণে করে। ভাঙ্গন কবলিত গ্রাম বা বসতির লোকজন যার যার পরিবার নিয়ে যে যে দিকে পারত চলে যেত এবং আজও যায়। এই অবস্থায় দৃঢ়বদ্ধ সমাজ গঠনের অবকাশ অতীতে খুব সামান্যই ছিল। সমাজ বিন্যাসের শিথিলতা বা বিশৃঙ্খলাকে আরও শক্তি যোগাত বন্যা ও জলাভূমির প্রাচুর্য। নদী-খাল-বিল এবং বন্যার প্রভাব এক এলাকার সঙ্গে অপর এলাকার যোগাযোগেও বিরাট বাধা সৃষ্টি করে রাখত। এর ফলে বৃহৎ এলাকাব্যাপী সমাজ গঠনও দুঃসাধ্য হয়ে থাকত।
এই অবস্থায় উপজাতীয় সমাজের দৃঢ়বদ্ধতা বঙ্গের ভূমি নির্ভর জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কোন কালেই ছিল না। এই কারণে দৃঢ়বদ্ধ সমাজ শৃঙ্খলার অধিকারী বেদে সম্প্রদায়ের মত জনগোষ্ঠীগুলি শুধু যে ভাসমান এবং যাযাবর ছিল তা-ই নয়, উপরন্তু তারা কৃষি নির্ভর সমাজেরও বাইরে বাস করত। বেদেরা এখনও স্থিতিশীল সমাজের অঙ্গীভূত নয়। আসলে দীর্ঘস্থায়ী এবং দৃঢ়বদ্ধ শৃঙ্খলা ঐতিহ্যিকভাবে বঙ্গ বা বাংলার সমাজের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বহির্ভূত।
অবশ্য ইংরেজ শাসনামলের পূর্বেও এখানে সভ্যতা ছিল, রাষ্ট্রও ছিল। সমাজ সংগঠন ছিল বলে রাষ্ট্র এবং সভ্যতা গড়ে তুলা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সমাজ সংগঠন ছিল ক্ষুদ্র এলাকা ভিত্তিক এবং সাধারণভাবে অস্থিতিশীল বা শিথিল, ফলে দুর্বল। এই অবস্থায় এখানে ভিতর থেকে সাধারণত রাষ্ট্র গড়ে উঠতে বা গড়ে উঠলেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে নাই। বরং রাষ্ট্র সাধারণভাবে ছিল বিদেশী কিংবা বহিরাগতদের দ্বারা আরোপিত অথবা সংগঠিত কিংবা বহিরাগতদের সহায়তায় পরিচালিত।
তখনও রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল শাসন কার্য পরিচালনা ও রক্ষার জন্য জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষার। একইভাবে জনগণেরও প্রয়োজন ছিল রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বা যোগাযোগ রক্ষার। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে মোগল সম্রাট এবং পরবর্তী সময়ে কার্যত স্বাধীন নওয়াবরা শাসন কার্য পরিচালনা করতেন বিভিন্ন পর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাহায্যে। রাষ্ট্র জনগণ বা সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষার চেষ্টা করত। যেমন ছিল পঞ্চায়েত। এ ছাড়া ছিল ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠান যেমন পীর-আউলিয়া, মোল্লা, মসজিদ, ব্রাহ্মণ পুরোহিত, হিন্দু ধর্মীয় গুরু, মন্দির ইত্যাদি।
তবে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যোগাযোগের জন্য খুবই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কার্যকর ছিল জমিদার এবং পঞ্চায়েত। সে কালের জমিদাররা কিন্তু ইংরেজ আমলের জমিদারদের মত জমির মালিক ছিল না। তারা ছিল নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের খাজনা আদায়কারী এবং সেই সঙ্গে বিচার ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষারও দায়িত্বপ্রাপ্ত। এভাবে তারা ছিল রাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের অংশ বা অধীনস্থ এবং সেই সঙ্গে প্রশাসনিক বিভাগেরও অংশ। কিন্তু জমিদাররা রাষ্ট্রের নিয়মিত বেতনভুক এবং এক এলাকা থেকে অপর এলাকায় বদলীযোগ্য কর্মচারী ছিল না। প্রজাদের কাছ থেকে রাষ্ট্র কর্তৃক ধার্যকৃত খাজনার একটা নির্দিষ্ট অংশ তারা নিজেদের ব্যয় নির্বাহের জন্য পেত। নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডে বংশ পরম্পরায় দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায় জমিদাররা হত সেখানকার জনগণের সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এবং ফলে এলাকার জনগণের ভাগ্যের উপর তাদের ভাগ্যও অনেকাংশে নির্ভর করত। এ কারণে এলাকার উন্নয়নে যেমন তাদের তাগিদ থাকত তেমন এলাকায় ফসল হানি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে অর্থ বরাদ্দ এবং খাজনা মওকুবের জন্য তারা রাজ দরবারে উদ্যোগী ভূমিকা রাখত।
অন্যদিকে, পঞ্চায়েত ছিল সমাজের এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাকে অস্বীকার করার কোন উপায় রাষ্ট্রের ছিল না। অথচ এটা আইনী বা আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান সেই অর্থে ছিল না। এটা ছিল প্রথা নির্ভর। গ্রাম, শহর বা নগর, মহল্লা, এলাকা, পেশা, বর্ণজাতি ইত্যাদি কোন স্থান বা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের জন্য স্বেচ্ছাসম্মতি বা মতৈক্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠান এটি। এটা দীর্ঘস্থায়ী বা স্বল্পস্থায়ী যে কোনটা হতে পারত। পঞ্চায়েত প্রকৃতপক্ষে সমাজের সম্মিলিত ইচ্ছা প্রকাশের প্রথাগত রূপ ছিল। এগুলি ছিল সমাজের স্ব-শাসনের নিজস্ব যন্ত্র। রাষ্ট্র জন-সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগের জন্য যেমন পঞ্চায়েতের সম্মতি ও মতামতকে গুরুত্ব দিত তেমন পঞ্চায়েতের মাধ্যমে জনগণের অনেক সমস্যা ও ইচ্ছাও রাষ্ট্র বা রাজকর্মচারীদের কাছে পৌঁছাত।
এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সংযোগের জন্য ইংরেজ শাসনের পূর্বকালে আমরা জমিদার এবং পঞ্চায়েত এই দুই প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা দেখতে পাই। সমাজে ধর্ম বা ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব নানান রূপে ক্রিয়াশীল থাকলেও উত্তর বা পশ্চিম ভারতের তুলনায় ধর্মীয় শ্রেণী কিংবা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বাংলায় অনেক দুর্বল ছিল বলেই বুঝা যায়। এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, বঙ্গে ইসলাম প্রচারে শাহজালালের মত জিহাদী পীর বা ইসলামী ধর্মগুরুদের ভূমিকা থাকলেও বঙ্গে পাঞ্জাবের আহমদ আল ফারুকী আল্ সিরহিন্দী বা আল্ফ্ সানি মুজাদ্দিদ (১৫৬৪-১৬২৪) নামে সমধিক পরিচিত গোঁড়া মুসলিম ধর্মীয় নেতার মত কোনও ধর্মীয় নেতার উত্থান ঘটে নাই। উত্তর ভারতের আলেম সমাজের উপর তার ছিল প্রবল প্রভাব। মুজাদ্দিদ সম্রাট আকবরের (শাসনকাল ১৫৫৬-১৬০৫) উদার ধর্মীয় নীতির প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি জাহাঙ্গীরের শাসনকালেও বিদ্যমান ধর্মীয় উদারনীতির বিরোধিতা করেছিলেন। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মোগল শাসনকালে উগ্র ইসলামবাদীদের দ্বারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হাঙ্গামার কথাও আমরা জানতে পারি। বঙ্গে সুলতানী ও মোগল শাসনকালে কিছু করে ইসলামীকরণ ঘটলেও তার ধরন উত্তর এবং বিশেষত পশ্চিম ভারত থেকে অনেক ভিন্ন ছিল। ইসলামের আক্রমণাত্মক রূপ এখানে কমই দৃশ্যমান হত।
অবশ্য সংগঠিত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব অতীতে বৃহৎ বঙ্গে চিরকালই তুলনায় যথেষ্ট দুর্বল ছিল। নানান ধরনের লোকজ এবং এলাকাভিত্তিক ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এ দেশের সাধারণ মানুষ তুষ্ট থাকত। মোগল বা নওয়াবী আমলে যখন বঙ্গের ইসলামীকরণ অনেকটাই হয়েছে তখনও সাধারণ মুসলমানরা নানান দেব-দেবীর পূজা যেমন করত তেমন বহিরাগত মুসলমান শাসকদের সঙ্গে তাদের ছিল দুস্তর ব্যবধান। এই অর্ধ-মুসলমানদের বহিরাগত আশরাফ মুসলমানরা মুসলমান হিসাবে স্বীকৃতি পর্যন্ত দিত না। অন্যদিকে, সাধারণ হিন্দুরাও বহুকাল পর্যন্ত ছিল প্রথাগত ও দৃঢ়বদ্ধ বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ব্যবস্থা থেকে কম-বেশী দূরবর্তী। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, মধ্যযুগে জাতপাত বিরোধী বৈষ্ণব আন্দোলন সমাজে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাছাড়া এ দেশে বাউলসহ বিভিন্ন উদার কিংবা মানুষ কেন্দ্রিক মতবাদগুলি সমাজের নীচ তলায় বহমান ছিল। সর্বোপরি দেশজ হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় ব্যবধান বহুকাল পর্যন্ত খুব একটা দৃষ্টিগোচর ছিল না। এখানে আর একটা কথা বলে রাখা উচিত হবে যে নওয়াবী শাসন কালেও মুসলমানরা বঙ্গে সংখ্যালঘু ছিল। ব্রিটিশ শাসন কালে প্রথম যে লোকগণনা হয় সেটা হয় ১৮৭২ সালে। তখনও মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু। ১৮৭২-এর লোকগণায় বাংলার মোট জনসংখ্যা ছিল ৩,৬৭,৬৯,৭৩৫। এর মধ্যে মুসলমান ছিল ১,৬৩,৭০,৯৬৬ জন। হিন্দু এবং অন্যান্য ছিল ১,৮১,০২,৩৪৮ জন। পরবর্তী লোকগণনাগুলিতে মুসলমানদের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায়।*
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ব্রিটিশ শাসনকালে মুসলমানদের এই দ্রুত বা আকস্মিক সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণগুলি সম্পর্কে আমি আমার লিখা গ্রন্থ ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’-এ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। এটি ব-দ্বীপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত। তবে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পুলিশ কর্তৃক ব-দ্বীপ প্রকাশন বন্ধ করা হয়েছে। অবশ্য এটি ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রের (www.bangarashtra.net/org) গ্রন্থাগার বিভাগে দেওয়া আছে। আগ্রহী পাঠক সেখান থেকে এটি পড়তে পারেন।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যাইহোক, মধ্যযুগে বৃহৎ বঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের দুর্বলতার কারণে সংগঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিংবা মোল্লা বা পুরোহিত শ্রেণীও ছিল দুর্বল। ফলে সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা কিংবা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তাদের ভূমিকা পালনের সুযোগও ছিল কম। বরং জমিদার এবং পঞ্চায়েত ছিল সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়ের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
(৪) ব্রিটিশ শাসনের ফল
ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ফলে এই দুইটি প্রতিষ্ঠানই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পুরাতন জমিদারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে নূতন জমিদার শ্রেণী প্রতিষ্ঠা করা হল তারা হল জমির মালিক। সরকারকে নির্দিষ্ট খাজনা প্রদানের বিনিময়ে তারা নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের মালিক হয়ে বসল। কিন্তু জমিদারীর উন্নয়ন, বিচার, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদির দায়িত্ব থেকে তারা মুক্ত হল। এসব দায়িত্ব বা ক্ষমতা নিল রাষ্ট্র নিজে অর্থাৎ এলাকায় বহিরাগত প্রশাসক, পুলিশ, আদালত ইত্যাদি। স্বাভাবিকভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্বহীন এই অলস খাজনাভোগেী জমিদারদের এক বৃহদাংশই কলকাতাবাসী হল। এক দিকে, নিজ এলাকা থেকে দূরে বসবাস, এবং অপর দিকে, এলাকার উন্নয়ন ও প্রশাসনে ভূমিকা না থাকার ফলে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম কিংবা মধ্যস্থতাকারী হিসাবে তাদের গুরুত্ব বা ভূমিকা থাকল না।
অপর দিকে, পুরাতন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিপর্যয়ের ফলে পঞ্চায়েতও ধ্বংস হল। পঞ্চায়েত ছিল জন-সমাজের নিজস্ব শক্তি ও গতিশীলতার প্রথা ভিত্তিক রূপ। ফলে জন-সমাজের নিজস্ব শক্তিভিত্তি যখন ধ্বংস হল তখন পঞ্চায়েতের রক্ষা ব্যবস্থাও আর রইল না। দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি ক’রে এবং কুটীর শিল্প ধ্বংস ক’রে ইংরেজ শাসকরা সমাজ ও অর্থনীতিতে বিপর্যয় ঘটালো। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের অল্প পরই বাংলা তারিখ অনুযায়ী ’৭৬-এর মন্বন্তর খ্যাত মহা দুর্ভিক্ষ (১৭৭০ খ্রীঃ) সৃষ্টি করে ইংরেজ শাসকরা তাদের নিজেদের হিসাব অনুযায়ীই সমগ্র বাংলার জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। ইংরেজ গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের মতে বাংলার তিন কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি মানুষ এই দুর্ভিক্ষে মৃত্যু বরণ করে। দুর্ভিক্ষে জনপদের পর জনপদ বিরান হয়ে গেল। বিশাল অঞ্চল ব্যাপী কৃষিক্ষেত্রসমূহ পতিত হয়ে জঙ্গলে পরিণত হল। মোগল ও নওয়াবী আমলে বাংলার রেশম ও সূতি বস্ত্র, বিশেষ করে মসলিন বস্ত্রের খ্যাতি ছিল পৃথিবী জোড়া। ’৭৬-এর মন্বন্তরে এই শিল্পে নিয়োজিত লোকজনের প্রায় অর্ধেক প্রাণ হারায়। কুটীর-শিল্প অর্থনীতির উপর এর ফল হল ভয়ানক। অন্যদিকে, ব্রিটিশ শাসকদের বিভিন্ন কর্মনীতি দ্বারা কুটীর শিল্পকে ধ্বংস করা হল। এভাবে সমাজ ও অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। পরিণতিতে সমাজ পুরোপুরি কৃষি নির্ভর হয়ে আরও অনেক বেশী পিছিয়ে গেল। একটা হিসাব দিলেই ইংরেজ শাসনের ধ্বংসাত্মক দিক স্পষ্ট হবে। মোগল বা নওয়াবী আমলে বাংলার জনসংখ্যার মাত্র ৬০% ছিল কৃষি নির্ভর এবং ৪০% ছিল কুটীর শিল্প, বাণিজ্য এবং অন্যান্য পেশা নির্ভর। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর কৃষি নির্ভরতার হার ৬০%-এর পরিবর্তে ক্রমশ ৯০%-এরও বেশী হল।
এই ধরনের সামাজিক বিপর্যয় ছিল সমাজের স্বশাসনমূলক ব্যবস্থা হিসাবে বিদ্যমান পঞ্চায়েত মূলক প্রতিষ্ঠানের উপর প্রচণ্ড আঘাত। তবু হয়ত পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারত। কিন্তু যখন উপনিবেশিক রাষ্ট্র তার বহিরাগত আমলাতান্ত্রিক পুলিশ ও প্রশাসন এবং তার নিজস্ব আইন-আদালতকে সর্বস্তরে জন-সমাজের উপর চাপিয়ে দিল তখন জন-সমাজের স্ব-শাসনের ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েতের ভূমিকা ফুরালো।
কিন্তু সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব কমাতে না পারা কিংবা সমাজের উপর নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করতে না পারা ছিল ইংরেজ শাসনের জন্য বিপজ্জনক। সুতরাং পঞ্চায়েতের পরিবর্তে ইংরেজ শাসক শ্রেণী তার নিয়ন্ত্রণাধীন জন-প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার দিকে মনোযোগ দিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় হাত দেওয়া হল। ক্রমে ইউনিয়ন বোর্ড, পৌরসভা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল। স্থানীয় সরকার হিসাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলি আপাতদৃষ্টিতে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক হলেও এগুলি ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনস্থ এবং অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা কিংবা তার প্রতিনিধিত্ব করা এগুলির পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সুতরাং রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়ে গেল। শুধু পুলিশ, মিলিটারী, সিভিল প্রশাসন দিয়ে ইংরেজদের পক্ষে এই ব্যবধান পূরণ করা সম্ভব ছিল না। জনগণের নিকট এগুলি ছিল উদ্ধত, ভীতিপ্রদ, অচেনা, বিদেশী, ফলে অগ্রহণযোগ্য। অন্যদিকে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনস্থ সীমিত ক্ষমতার অধিকারী ইউনিয়ন বোর্ড, পৌরসভা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান উপনিবেশিক রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণ করলেও জন-সমাজের চাহিদা পূরণে অক্ষম ছিল।
এমন এক শূন্যতায় বাংলার জন-সমাজের ভিতর থেকে মাথা তুলতে শুরু করল রাজনৈতিক দল। অবশ্য এটা ঠিক যে, প্রথম দিকে ইংরেজ শাসক শ্রেণীর শর্ত সাপেক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা এবং এমন কি উদ্যোগও ছিল এই ধরনের দল গঠনে। যেমন ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম নামে একজন সাবেক ইংরেজ প্রশাসকের নেতৃত্বে। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পিছনেও ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় ছিল। একটা পর্যায়ে তারা এই দলগুলিকে নিয়মতন্ত্রের মধ্যে আবদ্ধ রাখবার প্রয়োজনে প্রাদেশিক পর্যায়ের শাসনে নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণের সুযোগ দিল। ১৯১৯ সালের আইনে যেটুকু সুযোগ দেওয়া হল ১৯৩৫-এর আইনে সেই সুযোগকে কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রসারিত করা হল।
দল এবং দলীয় কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনকে নিয়মতন্ত্রে আবদ্ধ রাখবার প্রয়াস যে সর্বদা সফল ছিল তা নয়। তবু ইংরেজরা সাধারণভাবে সফল ছিল এবং ১৯৪৭-এ যখন ভারত ছাড়তে বাধ্য হল তখন নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের হাতে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের শাসন ভার দিয়ে গেল।
(৫) রাজনৈতিক দলের উত্থানের সামাজিক বাস্তবতা
বস্তুত ভূ-প্রাকৃতিক কারণে ঐতিহাসিকভাবে বাংলার সমাজ সংগঠনের দুর্বলতা এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের আগ্রাসনে সমাজের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানসমূহের ধ্বংস অথবা অবক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট শূন্যতার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলের ভূমিকাকে বিবেচনা না করলে উভয় বঙ্গের বাঙ্গালী সমাজে রাজনৈতিক দলের এত প্রবল প্রতাপ বা প্রভাবের কারণ আমরা ধরতে পারব না। রাজনৈতিক দলের প্রবল ভূমিকা যেমন আমরা এ বঙ্গে দেখি তেমন আর একভাবে পশ্চিম বঙ্গেও দেখি। বিশেষত বাংলাদেশে বাঙ্গালী জাতি গঠন প্রক্রিয়ার নিয়ামক শক্তি হিসাবে রাজনৈতিক আন্দোলন ও দলের ভূমিকা বুঝতে পারা এ দেশের রাজনীতির সমস্যা বুঝতে পারার জন্য অপরিহার্য।
বিষয়টাকে স্পষ্টতর করার জন্য পুনরুক্তি করে বলছি, ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পর রেলপথ, বাঁধ, সেতু, রাজপথ ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে নদী ভাঙ্গন নিয়ন্ত্রণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এই প্রথম এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকরভাবে একটা বিশৃঙ্খল, ছত্রভঙ্গ বা ছড়ানো-ছিটানো ও অস্থিতিশীল জন-সমষ্টিকে বৃহৎ আয়তনে দৃঢ়বদ্ধ সমাজ গঠনের আওতায় আনা সম্ভব হয়। সেই ধারাই আজ অবধি চলছে। এভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা বৃহত্তর পরিসরে অখণ্ড সমাজ ও জাতি গঠনের প্রক্রিয়া নূতন গতি ও শক্তি লাভ করে এ কালে এসে।
অর্থাৎ একটি ঐক্যবদ্ধ ও সংহত সমাজ ও জাতি গঠন এ দেশে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা মাত্র। অতীতে বঙ্গ কিংবা বাঙ্গালা নামে কথিত একটি ভূমিখণ্ডে বসবাসকারী মানুষরা যেমন ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠী হিসাবে ভূমিকা খুব কম সময়েই নিয়েছে তেমন জাতি হিসাবেও আত্মপরিচিতিকে তারা অতীতে সেভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর বাঙ্গালী জাতি হিসাবে উঠে দাঁড়াবার প্রয়াস প্রথম দেখা দেয় ইংরেজ শাসনকালে এসে।* সেই যাত্রা শুরু হয় কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে। একটা পর্যায়ে ধর্ম এসে বিপর্যস্ত করে সেই যাত্রাকে। তবে প্রকৃত বিচারে এই যাত্রা থেমে থাকল না। শুধু তার ভরকেন্দ্র সরে গেল। ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সংহত সমাজ হিসাবে বাঙ্গালী জাতি গঠনের এই প্রয়াসের ভরকেন্দ্র সরে আসে পশ্চিম বঙ্গ থেকে পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব বঙ্গের রাজধানী ঢাকায়।
--------------------------------------------------------------------------------------------
* ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’ নামক গ্রন্থে এ বিষয়ে আমি আলোচনা করেছি ।
--------------------------------------------------------------------------------------------
ব্রিটিশ শাসন কালে নদী শাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নগরায়নের মাধ্যমে বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের যে প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তা এ বাংলায় ভিন্ন আঙ্গিকে দ্রুততর গতি ও নূতন মাত্রা লাভ করে। বৃহত্তর সমাজ গঠনের মূল ভাবাদর্শিক জায়গায় প্রথমে ইসলাম ধর্ম থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সেই ভাবাদর্শের জায়গা দখল করে। আসলে এই বিষয় বুঝা অত্যাবশ্যক যে, বাংলাদেশে বৃহৎ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের ব্যাপারটা জাতি গঠনের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সকল আত্মদ্বন্দ্ব, সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি নিয়েও যে কাজটা চলছে সেটা হচ্ছে ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে একটা ঐক্যবদ্ধ ও সংহত বাঙ্গালী জাতি গঠন। সুতরাং ’৫২ এসেছে, ’৭১ এসেছে।
আর সকল ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের নায়ক এ দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কিংবা শক্তি হয়েছে। অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাতেই এ দেশে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা সীমাবদ্ধ নয়, বরং বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও জাতি গঠনের নেতৃত্বকারী ভূমিকাও অর্পিত হয়েছে তার উপর। ভূ-প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক ইত্যাদি কারণে সেই ধরনের আর কোনও প্রতিষ্ঠান এ দেশে এই ভূমিকা পালনের উপযোগী না হওয়ায় রাজনৈতিক দলকে তা নিতে হয়েছে।
অর্থাৎ বৃহৎ আয়তনে সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ এবং সেই সমাজের অভিব্যক্তি ও আত্মপরিচয়ের প্রয়োজনে জাতি এবং সেই জাতির আত্মরক্ষা ও স্ব-শাসনের প্রয়োজনে রাষ্ট্র গঠনের নায়ক হতে পারে এখানে একমাত্র রাজনৈতিক দল।
(৬) রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতা
আর এখানেই তার আজ অবধি ব্যর্থতা। আর ব্যর্থতা আছে বলেই সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের এই দুর্দশা। এখন পর্যন্ত তা উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার স্বরূপ বহিরাগত চরিত্র বিশিষ্ট একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং জনসমাজের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা বজায় রেখে উপনিবেশিক লুণ্ঠন ও শোষণের ব্যবস্থার ভাগী হিসাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। রাজনৈতিক দল উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোয় যেমন পরিবর্তন আনে নাই তেমন নূতন সমাজ ও জাতি গঠনেও তা প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখে নাই। সে নূতন ব্যবস্থা নির্মাণের নায়ক না হয়ে লুণ্ঠন, দমন ও পীড়ন মূলক পুরাতন উপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংরক্ষক মধ্যবর্তীর ভূমিকা পালনেই সন্তুষ্ট। কারণ সেটা তাকে নগদ বস্তুগত লাভ দেয়। তার ক্ষুদ্র দৃষ্টি ও ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষা আজও তাকে ধরে রেখেছে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অধস্তন ও সহযোগী রূপে। সুতরাং ইতিহাস নির্মাণে নায়কোচিত ভূমিকার পরিবর্তে তার এই দাসসুলভ ভূমিকা।
প্রশ্ন আসবে, কেন তার এই ব্যর্থতা। একটা বিষয় আছে, সেটা হচ্ছে এই সমাজ বা জাতিসত্তার উত্তরাধিকার হিসাবে উন্নত সমাজ, সভ্যতা ও নিজস্ব রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাব। অস্থিতিশীল ভূ-প্রকৃতির আবেষ্টনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল বা শিথিল সমাজ সমষ্টি নিয়ে ঐতিহাসিক কাল ধরে গড়ে উঠা একটা সমাজের কাছ থেকে দ্রুত সবকিছু আশা করা উচিত নয়। কম অথবা বেশী যেমনই হোক অভিজ্ঞতা ছাড়া মানুষের পক্ষে সঠিক ধারণা এবং পরিপক্বতা অর্জন করা সম্ভব নয়। সুতরাং একটা উন্নত ও যুগোপযোগী নেতৃত্ব গঠনের জন্য এই সমাজকে একটা পর্যায় পার হতেই হত। ১৯৭২ থেকে ২০১৭ অর্থাৎ আজ পর্যন্ত পঁয়তাল্লিশ বৎসরের সময়টাকে বেশী দীর্ঘ মনে হলেও হয়ত এই কারণে এই অপচয়কে এ জাতিকে মেনে নিতে হচ্ছে।
ব্যর্থতার অপর একটি কারণ হচ্ছে ভূ-প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এই সমাজের গরিষ্ঠ অংশের মধ্যে উন্নত চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রের যে অভাব রয়েছে তা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে জনগণের অংশগ্রহণ সমৃদ্ধ দলগুলিকে। তবে গরিষ্ঠের নিকৃষ্টতা দিয়ে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয় নির্বাচন নির্ভর জনপ্রিয় বৃহৎ দলগুলি।
বিশেষত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন সমাজের ভিতর প্রাধান্যকারী নিকৃষ্টতাকে ধারণের প্রতিযোগিতায় নির্বাচন নির্ভর দলগুলিকে নামতে বাধ্য করে। কিংবা আরও সঠিকভাবে বলতে হয় সমাজের ভিতর বিদ্যমান নিকৃষ্টতার প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলিই নির্বাচনী রাজনীতির মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্তা হিসাবে দাঁড়ায়। মজার ব্যাপার হল গরিষ্ঠ জনগণ সমর্থিত এই বৃহৎ দলগুলির কোনটিই দলের ভিতর গণতন্ত্র চর্চা করে না; বরং এগুলির প্রতিটিই আপাদমস্তক একনায়কী, স্বৈরতান্ত্রিক। এও গরিষ্ঠ জনগণের চরিত্র ও আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি, যা দলের ভিতর দিয়ে মূর্ত হয়। এর মূল উৎস অবশ্য সমাজের পশ্চাৎপদতার পাশাপাশি ইসলামের ধর্ম-সংস্কৃতি। তবে সেটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
যাইহোক, যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি বাঙ্গালী জাতি হিসাবে বঙ্গ নামক ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বিকাশ খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। নিশ্চয় এই বিকাশের পিছনে দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভূমিকা আছে। সেটাকেও আমাদেরকে হিসাবে নিতে হবে। কিন্তু ভাষাকে অবলম্বন করে সংঘবদ্ধ বাঙ্গালী জাতি রূপে আত্মপ্রকাশের তাড়না এই জনগোষ্ঠীর জন্য সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। এর প্রথম প্রকাশ আমরা ব্রিটিশ শাসনকালে দেখি। সেটা ছিল কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে বাঙ্গালীর জাতি হিসাবে আত্মবিকাশের কাল। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মীয় বিভাজন এই বিকাশের গতিধারায় একটা পর্যায়ে ছেদ ঘটায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারতে বাঙ্গালী জাতির বিভাজন এই গতিধারায় শুধু ছেদ নয় উপরন্তু বিপর্যয়ও ঘটায়। কিন্তু সেটা ছিল সাময়িক।
বরং নূতন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিকাশ প্রক্রিয়া প্রবলতর রূপ নিয়ে সূচিত হল। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে বিকাশমান বাঙ্গালী জাতি চেতনার আঘাতে পূর্ব বাংলার বুক থেকে পাকিস্তান উচ্ছেদ হল। তবে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তি যেমন ক্রিয়াশীল রয়ে গেল তেমন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যে উপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা পাকিস্তান লাভ করেছিল সেটাও রয়ে গেল। আর এভাবে যে রাজনৈতিক দল এ দেশে সংঘবদ্ধ, সংহত এবং উন্নত সমাজ সংগঠনের মূল কারিগর হতে পারত সেই কারিগরের ভূমিকা পালনে তা ব্যর্থ হল। ফলে আজকের যুগের উপযোগী উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ এবং জাতি নির্মাণ যেমন হল না তেমন এই সমাজ এবং জাতির অভিব্যক্তি স্বরূপ লোকবাদী বা সেকিউলার এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণও হল না।
লোকবাদ বা সেকিউলারিজম প্রতিষ্ঠা দূরে থাক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা ধর্মীয় শ্রেণীর শক্তিবৃদ্ধি ঘটে চলেছে। ফলে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, বাঙ্গালী জাতি গঠনের প্রক্রিয়া কি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে চলেছে। এবং সেই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক।
এটা লক্ষ্যণীয় একটা ঘটনা যে, এ দেশে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত কালপর্যায়ে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রতিটি সামরিক সরকার ধর্মকে সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করেছে। সেটা আইয়ুব, ইয়াহিয়া থেকে জিয়া এবং এরশাদ পর্যন্ত প্রতিটি সামরিক শাসকই করেছে। প্রকৃতপক্ষে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই সামরিক প্রতিনিধিরা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মকেই সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে দেখেছে। বিশেষত ধর্মীয় শক্তি তথা মোল্লা শ্রেণীকে নিজেদের পক্ষে নিয়ে জনসমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে তারা ধর্মকে দেখতে পায়। তবে আজকের পাকিস্তানের জন্য এটার যতই কার্যকরতা থাক পূর্ব বাংলা কিংবা বাংলাদেশের জন্য এটা তেমন একটা কার্যকর হাতিয়ার যে নয় সেটা ইতিহাস প্রমাণ করেছে।
জেনারেল জিয়াউর রহমানের একটা সাফল্য ছিল। তিনি একটি কার্যকর রাজনৈতিক ভিত্তি দাঁড় করাতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি বা বিএনপি গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু সেটাকে আওয়ামী লীগ সরকারের চরম স্বৈরাচার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা এবং দুঃশাসনের পটভূমিতে দেখতে হবে। শুধু এইটুকু যথেষ্ট ছিল না। বরং একটা কার্যকর রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি গঠনের জন্য তাকে পেতে হয়েছে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপকে। ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ছিল এ দেশে পাকিস্তান কাল থেকেই আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের পতন পরবর্তী কালে এবং ভাসানীর মৃত্যুর পর এই দল বিএনপি গঠনে জিয়ার সহযোগী হয়ে বিএনপিতে বিলীন হল। আর এভাবে বিএনপি লাভ করল সংগ্রামমুখর এক দীর্ঘ রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। সুতরাং অন্য কারও সঙ্গে জিয়ার শাসনকে মিলানো যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন সেনা শাসক এবং রাজনীতিতে নবাগত ও অনভিজ্ঞ। রাজনীতি ও জনসমাজের সঙ্গে তারও ছিল বাস্তব ও মানসিক দূরত্ব বা ব্যবধান। ফলে জাতীয় রাজনীতি এবং নিজ দলের রাজনীতিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার সহজ হাতিয়ার হিসাবে তিনিও আর সব সামরিক শাসকের মত ধর্মকে তার জন্য সবচেয়ে সহায়ক হাতিয়ার হিসাবে দেখতে পান। এটা ছিল ধর্ম নিয়ে এক ধরনের খেলা, যেটা এ দেশের সব শাসকই কম আর বেশী আজ অবধি খেলে আসছে। তবে এটা এ দেশে কাউকে যেমন দীর্ঘ মেয়াদে সুফল দেয় নাই তেমন তাকেও দেয় নাই। তিনি তার শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেন নাই। বরং ক্ষমতা দখলের অল্প কালের ভিতরই তার অধস্তন সেনা কর্মকর্তাদের হাতে নিহত হন।
(৭) ধর্মীয় শক্তির উত্থান সম্ভাবনা কতটুকু?
এটা লক্ষ্যণীয় যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ধর্মের শক্তি যেখানে কমবার কথা সেখানে বরং উল্টাটাই ঘটেছে। সামাজিক ক্ষেত্রে যেমন ধর্মের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান তেমন রাজনীতিতেও তা ক্রমবর্ধমান। শেখ মুজিব থেকে শুরু করে খালেদা, হাসিনা পর্যন্ত সকল শাসকই ধর্মকে যার যার মত করে ব্যবহার করেছেন। অথচ রাজনৈতিক দলগুলির জন্য জনসংযোগের ঘাটতি পূরণের জন্য ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। তারা জনসমাজ থেকেই উত্থিত কিংবা ঘনিষ্ঠভাবে জনসমাজের সঙ্গে সংযুক্ত। তাহলে তাদের প্রয়োজনটা কোথায়? এর সহজ উত্তর আমরা খুঁজে পাব রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলে। প্রকৃতপক্ষে একটি লুণ্ঠনমূলক, নিপীড়ক এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রের সহযোগী হিসাবে তাদের উত্থান ও ক্ষমতায় আরোহণ ঘটে। কোনও বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় নূতন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতায় আরোহণ নয় যে তাদের রাষ্ট্রশাসনের ভিত্তি হবে ন্যায়-নীতি বোধ ও দেশপ্রেম। সুতরাং তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার উপায় যেমন দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত সঞ্চয় তেমন ক্ষমতাকে রক্ষার উপায়ও হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-বিত্তের পরিমাণ বৃদ্ধি। আর তাদের সৃষ্টি ও বিকাশের সমগ্র প্রক্রিয়ার পিছনে থাকে আমলাতন্ত্র তথা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নানান ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা অথবা সহায়তা। বিনিময়ে আমলাতন্ত্রও পায় ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের কাছ থেকে নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা এবং পৃষ্ঠপোষকতা। এভাবে সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং রাজনীতিকদের ঐক্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রটি জনগণের উপর এক ভয়ঙ্কর নিপীড়ন, দমন এবং অন্যায়-অবিচারের হাতিয়ার হয়ে উঠে। গণতন্ত্রের নামেই এক ভয়ঙ্কর দমন এবং লুণ্ঠনের ব্যবস্থা চেপে বসে জনগণের উপর।
এই রাজনীতিকরা রাজনীতিকে নেয় অর্থ-বিত্ত উপার্জন অথবা রক্ষার সহজ মাধ্যম হিসাবে যেখানে ন্যায়-নীতি কিংবা আদর্শের প্রকৃতপক্ষে বালাই থাকে না। নিজেদের অনৈতিকতাকে আড়াল দিবার এবং জনগণের সমর্থন পাবার জন্য তাদের প্রয়োজন হয় ধর্মের। সামরিক শাসকদের নিকট ধর্মের প্রয়োজন হয় বিশেষত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং সেই সঙ্গে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে নিজেদের শাসনকে গ্রহণযোগ্যতা দিবার জন্য। কিন্তু রাজনীতিকদের নিকট মধ্যবর্তী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধর্ম বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব সামান্যই। কারণ তারা নিজেরা এক অর্থে যথেষ্ট জন-সম্পৃক্ত। সুতরাং ধর্ম হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে তাদের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও দুঃশাসনকে আড়াল ও বৈধতা দিবার হাতিয়ার। এটা তাদের জনগণকে প্রতারণার হাতিয়ার।
এ দেশে ধর্ম যে, যে কোনও ধরনের লুণ্ঠন ও জবরদস্তি মূলক শাসনকে টিকিয়ে রাখবার জন্য অত্যন্ত সহায়ক সেটা বিজাতীয়, বিদেশী এবং বিধর্মী ইংরেজরাও ভালো বুঝেছিল। সুতরাং তারাও এ দেশ শাসনের সময় নানানভাবে ধর্মকে সংরক্ষণ করেছিল। তবে ধর্ম এবং ধর্মীয় শ্রেণীগুলিকে তারা তাদের শাসনের উপযোগী এবং অধীনস্থ করে নিয়েছিল। অনেকের হয়ত জানা আছে যে, বঙ্গের গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস নিজ উদ্যোগে ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটিকে পরবর্তী সময়ে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা নাম দেওয়া হয়। প্রথম দেড় বৎসর তিনি এর ব্যয়ভার নিজে ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন। অবশ্য পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র এটি পরিচালনার ব্যয়ভার নিলে তিনি তার ব্যয়ের অর্থ ফেরত পান। এটি নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, এই মাদ্রাসা ছিল ইংরেজ শাসিত বঙ্গে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ব্যয়ে পরিচালিত প্রথম কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
যাইহোক, আমাদের দেশের রাজনৈতিক শাসকরাও ধর্মকে ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝে। এটা যে পশ্চাৎপদ ও ধর্মাচ্ছন্ন জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সহজ হাতিয়ার সেটা তারা মনে করে। বিশেষত বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ধর্মের শক্তি ক্রমবর্ধমান হয়েছে। সারা দেশের সর্বত্র মসজিদ-মাদ্রাসা গজিয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশেষত সৌদী আরবের পেট্রডলার প্রবাহের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
ধর্মের এই রমরমা অবস্থা ধর্মীয় শক্তিগুলির মনে ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগাতে পারে। অন্য অনেকেও মনে করতে পারেন যে, ধর্মীয় শক্তি হয়ত এ দেশে ক্ষমতা দখল করবে। কিন্তু সেটা খুব কঠিন একটা কাজ হবে ধর্মীয় শক্তির পক্ষে। কারণ এ দেশে জনগণ ধর্ম দ্বারা অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রিত হলেও ধর্মীয় শক্তি এ দেশে জন-সমাজের নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে গড়ে উঠতে পারে নাই বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণেই। আলোচনার প্রথম পর্যায়ে যে কথা বলেছিলাম তার উল্লেখ করে বলতে হয় যে, এখানে সমাজ ও জাতি গঠনে রাজনৈতিক দল যে ভূমিকা পালন করছে সেটা অন্য কারও পক্ষে নেওয়া সম্ভব না। ধর্মীয় শক্তির ভূমিকা এ দেশে মূলত সহযোগী কিংবা অধীনস্থের হয়ে থেকেছে। এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, ব্রিটিশ ভারতে মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ধর্মীয় শক্তি তথা মোল্লাদের পরিবর্তে মুসলিম উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে মুসলিম লীগের নেতৃত্বেই হয়েছিল। মোল্লা বা ধর্মীয় শ্রেণীর উত্থান সম্ভাবনাকে আমি একেবারে নাকচ করি না। তবে সেটা এখনও গৌণ একটা সম্ভাবনা। বরং বাংলাদেশে চলমান সমাজ ও জাতি গঠনের গতিধারার দিকে দৃষ্টি দিলে এটাই মনে হয় যে, রাজনৈতিক দলের ভূমিকা এখানে আর কারও পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বন্ধনমুক্ত এবং প্রকৃত অর্থে একটা স্বাধীন, উন্নত ও লোকবাদী জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠনের যে প্রক্রিয়া বিশেষত ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে রূপ নিয়েছিল সেই প্রক্রিয়া আজ অবধি অসম্পূর্ণ হয়ে আছে। এই প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করার ঐতিহাসিক ভূমিকা এ দেশে রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে আর কারও পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত সেই ভূমিকা পালনের উপযোগী রাজনৈতিক দল বা শক্তি গড়ে না উঠবে ততদিন পর্যন্ত এই দেশকে বর্তমানের অন্ধকার পথের যাত্রী হয়েই থাকতে হবে।
(বঙ্গরাষ্ট্র-এ প্রথম প্রকাশ : ৩ জুন, ২০১৭)