লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ September 18, 2020, 12:00 AM, Hits: 1008
পুনঃপ্রকাশের ভূমিকা : ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী তারিখে বাংলাদেশে একটি অঘোষিত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিএনপি সমর্থিত অধ্যাপক ইয়াজউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন নেতৃত্বাধীন অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়। জেনারেল মইন ইউ আহমেদ নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এই পটপরিবর্তনের পিছনে আবার ভূমিকা ছিল ক্ষমতাধর বিভিন্ন বৈদেশিক রাষ্ট্রের। অবশ্য সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করে। তবে ফখরুদ্দীন নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজনৈতিক দলের সংস্কার এবং বিএনপি-আওয়ামী লীগের মত বৃহৎ দলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দলীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন সংঘটন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার মাধ্যম এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনে তুমুল শোরগোল তোলা হয়। সেই পরিস্থিতিতে এই রচনাটি লিখা হয় ২০০৭-এর ২-২৪ জুলাই সময়ে এবং এটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৭-এর ২৮ জুলাইতে। ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর ‘নিবন্ধ’, ‘গ্রন্থাগার’ এবং ‘নির্বাচিত’ বিভাগে পূর্বে প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশে এখনকার পরিস্থিতিতে গ্রন্থটির তাৎপর্য অনুভব করে এটিকে ‘নিবন্ধ’ বিভাগে পুনঃপ্রকাশ করা হল। — লেখক
বিষয়সূচী :
(১) সংস্কার এবং প্লাস-মাইনাস
(২) বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া
(৩) সমাজ সঙ্কটের উৎস অনুসন্ধান
(৪) দুর্বৃত্তায়নের শ্রেণীগত ভিত্তি
(৫) স্বাধীনতার সঙ্কট
(৬) সমাজের সঙ্কট
(৭) বাঙ্গালীর জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের করণীয়
(১) সংস্কার এবং প্লাস-মাইনাস
জন্মলগ্ন থেকে অস্তিত্বের যে সঙ্কট বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তাড়া করে আসছে সেই সঙ্কট আজ গভীরতর ও প্রবলতর রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে মাত্র। যাঁরা ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারীতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা দ্বারা এই সঙ্কট দূরীভূত হয়েছে মনে করছেন তাঁরা সঙ্কটের স্বরূপ এবং তার কারণ সম্পর্কে কোন সঠিক ধারণার অধিকারী বলে আমি মনে করি না। সঙ্কটের মূল যেহেতু অনেক গভীরে সেহেতু উপরে বা বহিরাবরণে কিছু প্রলেপ বা সংস্কার দ্বারা এটা দূর হতে পারে না। বরং তা প্রবলতর ও ব্যাপকতর বিস্ফোরণের দিকে দেশকে নিয়ে যাবে এবং যে বিপর্যয়ের দিকে দেশ এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে তা থেকেও দেশকে ফেরাতে পারবে না। সুতরাং দেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হলে সঙ্কটের গভীরে প্রবেশ করে তার উৎস বা কারণ অনুসন্ধান ছাড়া প্রতিকারের আর কোন উপায় নাই। কিন্তু সে ধরনের চেষ্টা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন একটা চোখে পড়ে না। বরং প্রায় সময়ই কিছু গতানুগতিক ও সস্তা কথা দিয়েই দেশের সঙ্কটকে ঢাকা দেবার চেষ্টা চলছে।
বাংলাদেশে এখন রাজনীতি আইনত নিষিদ্ধ হলেও রাজনৈতিক দলের সংস্কার এবং নেতা-নেত্রীদের যোগ অথবা বিয়োগ নিয়ে সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত সব মহলই সোচ্চার এবং যার যার মত করে তৎপর। বিয়োগ বা মাইনাস শব্দ এখন খুব বেশী উচ্চারিত হচ্ছে। এই শব্দ দ্বারা এখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে এই দুই দল পুনর্গঠনকে বোঝানো হচ্ছে।
যাইহোক, ইদানীং বহু কথিত দুই নেত্রী মাইনাস থেকে রাজনীতিতে প্লাস-মাইনাস কথাটা বেশ চালু হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে প্লাস-মাইনাসের খেলায় জাতীয় পার্টিও যোগ দিয়েছে। এদিকে বিএনপি-এর দলত্যাগীদের নিয়ে বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং অলি আহমদের নেতৃত্বে সদ্য গঠিত এলডিপি ইতিমধ্যে ৩/৪ টুকরা হয়েছে। তবে মোটামুটিভাবে ধরলে দলটি এখন দুইভাগে বিভক্ত।
বাংলাদেশে বৃহৎ এবং রাজনীতিতে এককভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম এমন দল দুইটি -- একটি আওয়ামী লীগ, অপরটি বিএনপি। এই দল দুইটির গঠন প্রকৃতি এমন যে তার প্রধান দুই নেতা বা নেত্রীর বাইরে গিয়ে কার্যকরভাবে কোন দল গঠন করা কিংবা প্রাথমিকভাবে দল গঠনে কিছু চমক সৃষ্টি করতে পারলেও যে সেই দলের অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব নয় তার অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত এলডিপি। আমার অনুমান সেখানে আরও ভাঙ্গন অপেক্ষা করছে।
সুতরাং যাঁরা দুই নেত্রীকে মাইনাস করে দল গঠন বা পুনর্গঠনের মাধ্যমে লীগ-বিএনপি-এর বিকল্প গড়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা যে পণ্ডশ্রম করছেন সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। যদি তাঁদের চেষ্টা আন্তরিক হয় তবে বলতে হবে যে তাঁরা এ দেশে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা দল গঠনের পিছনে যে জন-মানস কাজ করে তাকে হিসাবে নেন না। এই কারণে শুধু অর্থের জোরে যেমন কার্যকরভাবে দল গঠন করা যায় না তেমন শুধু ক্ষমতার জোরেও তা করা যায় না। সেসব চেষ্টা এ দেশে কম হয় নাই। বাংলাদেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি সালমান এফ রহমান সে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর বন্দুকের জোরে নয় বৎসর ক্ষমতা এবং অর্থের অঢেল ব্যবহার দ্বারাও এরশাদ একটি কার্যকর দল গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন। গণ-আন্দোলন দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হবার সাথে তাঁর দলও প্রকৃত অর্থে পথের ধূলায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
সুতরাং শুধু অর্থ বা ক্ষমতা কিংবা উভয়ের সমন্বয় নয়, বরং আরও কিছু লাগে একটা জন-ভিত্তিক এবং ব্যাপক জন-সমর্থিত রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য। বস্তুত সেই আরও কিছুটা একটা বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে অর্থ এবং ক্ষমতাকে একেবারে গৌণ বিষয়ে পরিণত করতে পারে এবং এমন একটা বিশেষ ব্যক্তিত্বের উত্থান বা জন্ম ঘটাতে পারে যাকে সামনে বা কেন্দ্রে রেখে তার দল হয়ে ওঠে বিপুলভাবে জন-নন্দিত অথবা দল না থাকলে তার নেতৃত্বে দল গঠিত হলে তা পরিণত হয় ব্যাপক জন-নন্দিত ও গণ-ভিত্তিক দলে।
আসলে এই ব্যক্তি শুধু বিশেষ একটা ব্যক্তি নয়, এটা একটা সামাজিক শক্তির বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে রাজনৈতিক অভিব্যক্তিও বটে। পাকিস্তান আমলের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা এমন দুই প্রধান ব্যক্তি পাই যাদের একজন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং অপর জন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে ফজলুল হকের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর তাঁর গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং বিশেষত তাঁর মৃত্যুর পর তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে ভাসানী এবং সোহরাওয়ার্দী দুই প্রধান নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এঁরা উভয়ে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা। পাকিস্তান আন্দোলনে উভয়ের বিশেষ অবস্থান ও ভূমিকা এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে উভয়ের অবস্থান তাঁদেরকে পাকিস্তান আমলে এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দুই জন-নন্দিত নেতায় পরিণত করে।
শেখ মজিবুর রহমানের উত্থান শুরু হয় প্রথমে ভাসানী এবং পরে সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী হিসাবে। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর মুজিব আওয়ামী লীগের নেতায় পরিণত হলেও ব্যাপক জন-নন্দিত নেতায় পরিণত হতে তাঁকে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯৬৬-তে ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে। কিন্তু সেটা ব্যাপক আকার ও শক্তি লাভ করে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান দ্বারা, যার স্রষ্টা মূলত ভাসানী। ভাসানী বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেন নাই তাঁর সহকর্মী কমিউনিস্টদের বাধার কারণে। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়লাভ মুজিবকে বিরাট শক্তি ও মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু জনগণের আবেগ জাগানিয়া রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী নেতা বা নায়কে পরিণত হবার জন্য ঐটুকু যথেষ্ট ছিল না। তার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল একটা যুদ্ধ এবং অনিবার্য যুদ্ধের পূর্বে একটি ঘোষণা। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুজিবের সবই হারিয়ে যেতে পারত যদি তিনি ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তারিখে রেসকোর্সের মাঠে তাঁর ভাষণে উচ্চারণ না করতেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঠিক একই ভাবে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের পরবর্তী উত্থানের পটভূমি সৃষ্টি হয় ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ তারিখে অনুপস্থিত শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। জিয়াউর রহমান ঐ ঘোষণার পূর্বে স্বাধীন বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব বাংলার জন্য কাজ করা দূরে থাক আদৌ চিন্তা করেছিলেন এমন কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য জানা নাই। অথচ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সংখ্যক বাঙ্গালী অফিসার তার বেশ কিছু কাল পূর্ব থেকে যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য কাজ করছিলেন সে কথা অনেকেরই জানা। এদের মধ্যে আমরা মোয়াজ্জেম হোসেন এবং কর্নেল তাহেরের নাম উল্লেখ করতে পারি। কিন্তু ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাক-বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে তৎকালীন সামগ্রিক বাস্তবতায় একজন মেজরের বেতার ঘোষণার গুরুত্ব ছিল প্রভূত। ঘটনাক্রমে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র তখনও বিদ্রোহী বাঙ্গালী সেনা এবং জনতার অধিকারে আর চট্টগ্রামে হাতের কাছে বাঙ্গালী মেজর একজন পাওয়া গেল। তিনি হলেন জিয়াউর রহমান। পাক সেনায় এর উপর পদে বাঙ্গালী এমনিতেই প্রায় ছিল না। সুতরাং প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বহীনতা ও বিশৃঙ্খলার সময়ে একজন মেজরের বেতার ঘোষণা সকল বাঙ্গালী সামরিক অফিসার ও সাধারণ সৈনিকদের প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এটা অনুপ্রাণিত করেছিল তখন স্বাধীনতাকামী সকল বাঙ্গালীকেও।
বস্তুত সকল ক্রটি এবং সীমাবদ্ধতা নিয়েই বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের প্রধান শক্তি বিদ্রোহী বাঙ্গালী সৈনিকদের আবেগের অভিব্যক্তি ঘটল জিয়ার ঘোষণার মাধ্যমে। একটি ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে চট্টগ্রামে তার উপস্থিতি এবং একটি বেতার ঘোষণা পরবর্তী কালে জিয়ার একজন রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী নায়কে পরিণত হবার ভিত্তি রচনা করে। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই জেনারেল জিয়া ১৯৭৫-এ মুজিব সপরিবারে নিহত এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা দখলের পর রাজনৈতিক দল গঠন করলেন।
সুতরাং মুজিবের রাজনীতিতে যে ফাঁকি ছিল সেই ফাঁকির ফাঁক দিয়েই জিয়ার উত্থান। স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘোষণা ও পরিচালনার দায়িত্ব যদি মুজিব নিতেন তবে জিয়ার উত্থানের কোন সুযোগই থাকত না। এমনকি চট্টগ্রাম বেতারের ঘোষণারও তেমন কোন প্রভাব পড়ত না। ফলে জনগণের মনের আসনে যে রাজকীয় মর্যাদা নিয়ে জিয়া বসতে পেরেছিলেন সেটাও আর সম্ভব হত না।
ইতিহাসের কতকগুলো লগ্ন বার বার আসে না। তাই ১৯৭১-এর ৭ মার্চ কিংবা ২৭ মার্চ একবারই আসে। আর তাই পরবর্তী কালে যে যত চেষ্টা করুক বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় মুজিব বা জিয়ার জায়গা নিতে পারে না। আর তা না পারলে এ দেশে আর ব্যাপক গণ-ভিত্তিক ও জন-সমর্থিত দল করা যায় না। তাই এরশাদ পারেন নাই। নয় বৎসর বন্দুকের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রেখে এবং ক্ষমতা এবং অর্থের সুবিধা দু’হাতে ছিটিয়েও তিনি সেই ধরনের দল গঠন করতে পারেন নাই। সুবিধাভোগী এবং বিত্তবানদের যে শ্রেণীভিত্তি তিনি গঠন করেছিলেন সেটারও বেশীর ভাগ তার সমর্থক হয় নাই বা তার সঙ্গে থাকে নাই। বেশীর ভাগই চলে গেছে বিএনপি-এর পক্ষে বা সঙ্গে।
আর এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনীতিতে আবেগের ভূমিকা। অর্থাৎ শুধু অর্থ বা ক্ষমতা দিয়ে সবকিছু হয় না। কোন কিছু সৃষ্টির পিছনে আবেগেরও প্রয়োজন হয়। সব সমাজ ও মানুষের জীবনে আবেগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যত যুক্তিবাদী হোক তার মধ্যে কম অথবা বেশী আবেগ থাকে। এই আবেগ দিয়ে তার অনেক কর্মকাণ্ড প্রভাবিত হয়। আবেগের পিছনেও যুক্তি কিংবা স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। কিন্তু আবেগ একটা নিজেস্ব শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয় বলে মানুষ যুদ্ধে অকাতরে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে। কারণ সহজ যুক্তি মানুষকে বাঁচতে বলে। কাজেই এ ক্ষেত্রে যে ধরনের হোক আবেগের প্রাধান্যের প্রয়োজন হয়। বৃহত্তর আদর্শের জন্য আত্মনিবেদনও শুধু যুক্তি দিয়ে হয় না। এ ক্ষেত্রে যুক্তির বিশেষ ভূমিকা থাকলেও এই যুক্তিকে আবেগের শক্তিতে পরিণত করা ছাড়া কোন মানুষের পক্ষে জীবনব্যাপী আদর্শের সাধনায় আত্মনিবেদন করা সম্ভব হয় না।
তবে বাঙ্গালী বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশ-ভূখণ্ডের বাঙ্গালী চিরকালই যুক্তিবুদ্ধির চেয়ে অনেক বেশী আবেগ তাড়িত। ঐতিহাসিক কাল ধরে তার আবেগ ভয় এবং নগদ সুবিধাপ্রাপ্তির বোধ তথা লোভ দ্বারা খুব বেশী প্রভাবিত। বৃহৎ কিছু নির্মাণ তার সামর্থ্যের বাইরে। তার ইতিহাসের বৃহৎ জাতীয় যুদ্ধ বলতে ’৭১। এই প্রথম সে ব্যাপক আয়তনে ভয় এবং ক্ষুদ্র লোভকে অস্বীকার করতে শিখেছে। সুতরাং একবার এই যুদ্ধ সংঘটিত হবার পর এবং যার সাহায্যে এবং যেভাবে হোক তাতে জয় লাভের পর এটা তার ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে এক বিরাট আবেগের উৎসে পরিণত হয়েছে।
সুতরাং ’৭১-এর যুদ্ধ জয় এবং স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা মুজিব এবং জিয়াকে এ দেশের বাঙ্গালীর আবেগ জাগানিয়া দুইটি নামে পরিণত করেছে। এই দুই ব্যক্তি কেন্দ্রিক দুই দল বা ধারার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও পার্থক্য একটি রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার ভিতরকার স্ব-বিরোধ এবং অসঙ্গতির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই দুই ব্যক্তির উত্থান ও প্রতিষ্ঠার মধ্যে যে ফাঁক ও ফাঁকি আছে তা এ দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বিকাশ ধারাকে গভীরভাবে অধিকার করে আছে। বিশেষত মুজিব ও জিয়াকে যেভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীক করা হয়েছে তার ভিতরকার ফাঁক ও ফাঁকি উভয়কে পরসপরের সহযোগী বা পরিপূরক না করে পরসপর বিরোধী, এমনকি বৈরী করেছে। এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঘিরে যে মিথ্যা ও ফাঁকির সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে এই বিরোধ সেই সৌধের অন্তর্নিহিত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ফাঁক ও ফাঁকি নিয়ে আমার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। সুতরাং এখানে এ বিষয়ে বিশাদ আলোচনা করতে চাই না। তবে কিছু পরে এ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করেছি।*
----------------------------------------------------------------
* আমার লেখা গ্রন্থ ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’-এ আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের এই সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তবে সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য পাঠক আমার লেখা প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা’, ‘বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়ন’ এবং The Crisis of Bangladesh পড়তে পারেন। সবগুলিই এই ওয়েব সাইটে দেওয়া আছে।
----------------------------------------------------------------
এই ফাঁক ও ফাঁকি সম্ভব হয়েছে একটা জনগোষ্ঠী বা জাতিসত্তা হিসাবে এ দেশের বাঙ্গালীর পশ্চাৎপদতা ও নানাবিধ দুর্বলতার কারণে। কিন্তু যে কারণই কাজ করুক এটাই বাস্তবতা। এবং এটাও ঠিক যে, এই বাস্তবতার পিছনের সবটাই ফাঁকি নয়। কারণ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও ছয় দফা কর্মসূচীর রাজনীতি থেকে স্বাধীনতার রাজনীতি ও যুদ্ধ যতই ভিন্ন হোক স্বাধীনতার রাজনীতি ও যুদ্ধ গড়ে তোলায় স্বায়ত্তশাসন কিংবা ছয় দফা আন্দোলন ও তার রাজনীতির প্রভাব বা সহায়তা কম ছিল না। এবং ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণে যত অসপষ্টতা ও দ্ব্যর্থতা নিয়ে হোক বলতে পেরেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তারপর তার ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটিয়ে পাক বাহিনীর আক্রমণ অভিযানের সময় স্রেফ বাড়ীতে বসে থেকে পাক বাহিনীর হাতে ধরা দিলেন। এইভাবে তিনি ছয় দফার সঙ্গে স্বাধীনতার রাজনীতি ও যুদ্ধের যে ব্যবধান বা ফাঁক সৃষ্টি করলেন সেই ব্যবধান বা ফাঁক দিয়ে উঠে এলেন জিয়া। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তরণ ঘটাতে মুজিবের ব্যর্থতা জিয়াকে জন্ম দিল। হয়ত এই জন্মের মধ্যেও প্রভূত ফাঁক ও ফাঁকি আছে। তবু এটাই ছিল এ সমাজের সেই সময়কার মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা, যা জিয়া পূরণ করতে পেরেছিলেন।
মুজিবের আত্মসমর্পণ ও মুজিবের নামে হলেও জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা মুজিব ও লীগ রাজনীতির অবসান ঘটতে পারত যদি যুদ্ধ দেশের ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে পারত। অবশ্য সে ক্ষেত্রে জিয়ার ভবিষ্যৎ উত্থান সম্ভাবনারও পরিসমাপ্তি হতে পারত। কিন্তু সেসব কিছুই ঘটার কারণ ছিল না। এমন একটি যুদ্ধ করার জন্য সে কালে বাঙ্গালীর ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং প্রস্তুতি ছিল না। তার উপর ছিল তিন দিক পরিবেষ্টনকারী বিরাট রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকা। সুতরাং ভারতের আশ্রয় ও নিয়ন্ত্রণে থেকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী অনুপস্থিত মুজিবের নামে আওয়ামী লীগ নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা করল।
কাজেই বাস্তব হচ্ছে স্বাধীনতার জন্য যে আদর্শ ও রাজনীতি প্রয়োজনীয় ছিল তা লীগ নেতৃত্ব এবং জিয়া কারোরই ছিল না। তাঁরা উভয়ে কোন প্রকার প্রস্ততি ছাড়া স্বাধীনতার যুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতায় আরোহণের পর তাঁদের উভয়ের ভূমিকা দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার চালক রূপে। মুজিব এবং জিয়া উভয়ে একটি দুর্নীতিগস্ত ও দুর্বৃত্ত শাসক ও নেতত্বৃকারী শ্রেণী বা উচ্চবর্গের বিকাশ ঘটাবার কাজটাই যার যার মত করে করেছিলেন।
অবশ্য মুজিব এবং জিয়া যেমন এক প্রক্রিয়ার ফল নন তেমন লীগ এবং বিএনপিও এক জিনিস নয়। উভয় দলের গঠন প্রক্রিয়াও এক নয়। উভয়ের রাজনীতিতেও নীতিগতভাবে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। কিন্তু তাতে কী? চরিত্রে মূলত উভয়ে এক। পার্থক্য যা কিছু আছে তা মূলত কাগজে-কলমে বা কখনও মুখের কথায়। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে উভয়ের অবস্থান একই সমতলে।
জনগণের আবেগ ও সমর্থন এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে উভয় দলেরই অত্যন্ত শক্তিশালী শ্রেণীভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে। এ দেশের বিত্তবান এবং নেতৃত্বকারী শ্রেণী বা শ্রেণীগুলি সাধারণ ভাবে এই দুই দলের পিছনে। জনগণ বা ভোটারদের ব্যাপকতম অংশও এই দুই দলের পিছনে। দলের ভিতরে পরিবারতন্ত্রকে দেখতে হবে এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে। রাজকীয় মর্যাদার অধিকারী দুই নেতার পরিবার প্রকৃতপক্ষে তাদের অবর্তমানে দুই দলের অখণ্ডতা ও সংহতি এবং জন-সমর্থন রক্ষার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
অনেকের কথা থেকে বোঝা যায় যে, তাঁরা মনে করছেন ১১ জানুয়ারীর পর দেশে এমনই পরিবর্তন ঘটেছে যে, এখন রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ করা সম্ভব। তাঁদের কথা শুনে মনে হয় আইন করে দিলেই এটা হয়ে যাবে।
এটা সপষ্ট যে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারই চাইছে লীগ এবং বিএনপি এই দল দুইটিতে হাসিনা-খালেদার নেতৃত্বের অবসান ঘটাতে এবং তা না পারলে দল দুইটিকে এমনভাবে ভাঙ্গতে যাতে হাসিনা-খালেদার পক্ষে আর বিশেষ কিছু করার শক্তি না থাকে। কিন্তু ১১ জানুয়ারী এখন পর্যন্ত এমন কোন পরিবর্তন ঘটায় নাই যে হাসিনা-খালেদার নেতৃত্বের অবসান ঘটবে। সেটা ঘটার কারণ দেখি না। কারণ লীগ এবং বিএনপি-এর যে শ্রেণীভিত্তি এত কাল ধরে তৈরী হয়েছে সেই ভিত্তিতে প্রকৃতপক্ষে হাত পড়ে নাই। অন্যদিকে জনগণের যে আবেগের জায়গায় উভয় দলের অবস্থান সেই জায়গায় পরিবর্তন ঘটাবার মত এমন কোনও আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিবর্তনের কর্মসূচীও সরকার উপস্থিত কিংবা বাস্তবায়ন করে নাই যে জনগণ কোনও নূতন দল বা নেতৃত্বের পিছনে যাবার তাগিদ অনুভব করবে।
এখন প্রচার মাধ্যমে জোরালো প্রচার চলছে যে বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ভেঙ্গে খালেদাকে বাদ দিয়ে পৃথক বিএনপি গঠন করা হবে। তা যদি করা যায়ও তবে কী হবে? কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত নেতা-কর্মী বিচার ও শাস্তির ভয়ে অথবা সরকারের চাপে হোক এবং বাকিরা খালেদা-তারেকের প্রতি ক্ষোভ থেকে হোক অথবা ক্ষমতার ভাগ লাভের আশায় হোক তাঁর সঙ্গে গেলেও সেটা কয়দিনের জন্য হবে? নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে এলডিপি কয়েক মাসের মধ্যে কয়েক টুকরা হয়েছে। আগামীতে আরও কয় টুকরা হবে তা কে বলতে পারে? মান্নান ভূঁইয়ারও দলের তেমন পরিণতি হতে কয়দিন লাগবে? কয়জন তাকে নেতা মানবে? কয়দিন মানবে? কেন মানবে? বেশী দিন লাগবে না দল ভেঙ্গে আরও দল হতে অথবা খালেদার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-তে ব্যাপক সংখ্যক নেতা-কর্মীর ফিরতে। অবশ্য তিনি যদি আদৌ তেমন সংখ্যক নেতা-কর্মী সঙ্গে পান তবে।
লীগের সংস্কারের সামনেও যে একই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে সে কথা বলা যায়। মাইনাস হাসিনাপন্থী সংস্কারপন্থীরা যা-ই বলুন বা করুন লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী-সমর্থক আছে এবং থাকবে হাসিনার পিছনে। কারণ তিনি মুজিব কন্যা।
মুজিব কিংবা জিয়া কি বছর বছর জন্ম নেয়? তা হলে তো প্রতি বৎসর একটা করে ’৭১ ঘটতে হয়! না, সেই মর্যাদা পাবার মত নেতা তার পরিবারের বাইরে লীগ বা বিএনপি থেকে আর আসবে না। অন্তত বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ভিতর সেটা আর সম্ভব নয়।
বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় লীগ-বিএনপি-এর বাইরে আর কোনও রাজনৈতিক দলেরও তাই প্রবল শক্তি নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রশ্ন ওঠে না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে গড়ে ওঠা কোন দল যেমন লীগ-বিএনপি-এর মোকাবিলায় দাঁড়াতে পারবে না তেমন সেনাবাহিনী সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে দল গঠন করলেও সেটা দাঁড়াতে পারবে না। এরশাদের অভিজ্ঞতা এত দ্রুত ভুললে চলবে কেন?
দুর্নীতির দায়ে বিচার? সেনাপতি আইয়ুব ক্ষমতা দখলের পর অনেক রাজনীতিকের মত মুজিবকেও দুর্নীতির দায়ে গ্রেফাতর করে বিচারে সোপর্দ করেছিলেন। সেনাপতি জিয়াও ক্ষমতা দখলের পর দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চালিয়েছিলেন। ক্ষমতা দখলের পর সেনাপতি এরশাদও দুর্নীতি বিরোধী অভিযান চালিয়ে অনেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। এবং দুর্নীতির দায়ে কারও কারও শাস্তিও হয়েছিল। তাতে কী হয়েছে? এমন এক শাস্তিপ্রাপ্ত রাজনীতিক মওদুদ তো এরশাদের মন্ত্রী এবং আরও অনেক কিছু হলেন!
আমাদের দেশে এসব অনেক পুরানো খেলা। কাজেই বর্তমান কাণ্ড-কারখানা ও শোরগোল দেখে-শুনে ভবিষ্যৎ পরিবর্তন সম্পর্কে নিশ্চিত হবার কিছু নাই।
কেউ যদি মনে করেন, হাসিনা-খালেদার ব্যক্তিগত দুর্নীতি প্রমাণ করে তাঁদের সাজা দিলে লোকে সেটা বিশ্বাস করবে বা মানবে তাহলে ভুল করবেন। অনুসারী-সমর্থকরা বলবে, ‘এসবই সাজানো। নেত্রী নির্দোষ।’ আর যদি অভিযোগের যৌক্তিকতা স্বীকার করে তবে বলবে, ‘নেত্রীর কী দোষ? তাকে ভুল বুঝিয়ে দুর্নীতি করেছে কিছু সংখ্যক দুর্নীতিবাজ চ্যালা-চামুণ্ডা।’ তারা নন্দঘোষ খুঁজে পাবে। এমনকি নেত্রীর দোষ বা অপরাধ অকাট্য মনে হলে অনেকেই নির্বিকারভাবে বলবে, ‘রাজনীতি করতে গেলে একটু এদিক ওদিক তো হতেই পারে! কিন্তু তিনি কি নিজের স্বার্থে সেটা করেছেন?’ এরশাদের লাম্পট্য সম্পর্কে তাঁর সমর্থক নিম্নবর্গের মানুষের মন্তব্য শুনেছি, ‘রাজারা ওসব করে থাকে। ওসব ধরতে নাই।’ এটাও সেই আবেগের জায়গা। যে কোন কারণে সেটা আর সহজে নষ্ট করা যায় না। এর জন্য লাগে অনেক বড় পরিবর্তন বা আঘাত, যা মূলসহ ধ্বংস করে বা উপড়ে ফেলে পুরাতন আবেগের উৎসটাকে এবং তার জায়গায় সৃষ্টি করে নূতন আবেগ ও তার উৎস।
লীগ-বিএনপি-এর এত কাল ধরে এতসব নষ্টামির জন্য এসবেরই মূলে রয়েছে যে দুই ব্যক্তি এবং তাঁদের নষ্ট আদর্শ ও রাজনীতি সেই দুই ব্যক্তি মুজিব ও জিয়াকে দায়ী না করে তাঁদের চ্যালা-চামুণ্ডাদেরকে দায়ী করে যে দেশে ইয়া বড় বড় পণ্ডিত অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক সাবেক আমলা অনবরত বাণী বিতরণ করেন সেই দেশে জনগণ মনে অধিষ্ঠিত হাসিনা, খালেদাকে সিংহাসনচ্যুত করা এতই সহজ!
অবশ্য লীগ-বিএনপি-এর যাঁরা এখন সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার তাঁরাও সম্ভবত এই বাস্তবতা বোঝেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত কী হবে তা বলা কঠিন। তবু হয়ত ১১ জানুয়ারীর পূর্বের অবস্থায় দেশ আর ফিরবে না। কিন্তু তাতে কী? পূর্বের মত কিছুই আর হয় না। যেই দিন যায় সেই দিন ফিরে না। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন কি দেশে আসবে? যেটুকু সংস্কার রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে করা হচ্ছে সেগুলোই বা কতটুকু টেকসই বা সুফলদায়ক হবে? অতীতের পরিবর্তনগুলি জনগণের জন্য কতটা কল্যাণকর আর কতটা অকল্যাণকর হয়েছে সেই হিসাব করলে কি খুব বেশী আশাবাদী হবার কারণ থাকে?
আসলে হিসাবে নিতে হবে একটি দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত শ্রেণী হিসাবে এ দেশের নেতৃত্বকারী শ্রেণীগুলির মূল অংশের উত্থানকে। কয়েকজন রাজনীতিবিদ এবং বন বিভাগ বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মুষ্টিমেয় কয়েকজন বেসামরিক আমলার গ্রেফতার ও বিচার এই শ্রেণীকে ক্ষিপ্ত অথবা শঙ্কিত করতে পারে, কিন্তু তার অস্তিত্বের ভিত্তিকে মোটেই দুর্বল করতে পারে না। বরং প্রত্যাঘাত হানার জন্য যে এই শ্রেণী তৈরী হচ্ছে না তা আমরা কী করে বলি?
কিছু রাজনৈতিক সংস্কারে এই শ্রেণীর চরিত্র বদলাতে পারে না। সুতরাং তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী দল দুইটির চরিত্রও বদলাতে পারে না। এই শ্রেণী ও তার অন্তর্গত আদর্শ ও রাজনীতিকে না বদলে এই চরিত্র বদল অসম্ভব। অন্যদিকে, বুঝতে হবে যে, এই শ্রেণীর বিদ্যমান আধিপত্য এবং তার আর্থ-সামাজিক ভিত্তির অবসান ছাড়াও এই ধরনের চরিত্র বদল একটি অবাস্তব কল্পনা।
তবে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ভিত্তির অবসান ঘটাবার পূর্বশর্ত হল বিদ্যমান আদর্শ ও রাজনীতির পরিবর্তে একটি নূতন আদর্শ ও রাজনীতির প্রতিষ্ঠা। সেই কাজের দিকে কি আদৌ কোন দৃষ্টিপাতের লক্ষণ বর্তমান সংস্কার বিতর্কের মূল ধারায় দেখা যায়? সেটা যেমন নাই, তেমন নাই যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান দুর্বৃত্তায়নের উত্থান সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কেও আলোচনা। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রশ্নে যে ফাঁক ও ফাঁকির বিষয়ে ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম সেই বিষয়ও এ দেশের সংস্কার আলোচনায় একেবারে অপাংক্তেয় হয়ে আছে। যেহেতু সমস্যার গভীরে গিয়ে সমস্যার মূলটিকে খোঁজার চেষ্টা হয় না সেহেতু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার সমস্যা বোঝার চেষ্টাও এ দেশে আজ অবধি প্রায় সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত রয়েছে।
(২) বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া
আমি এ কথা আমার বিভিন্ন লেখায় বার বার বলার চেষ্টা করেছি যে, বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়নের মূলে রয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিশেষ গঠন প্রক্রিয়া। এই সত্য এ দেশে বোঝার চেষ্টা খুব কমই হয় যে, স্বাধীনতার চিন্তা একটা ঘোষণা দ্বারা একদিনে সৃষ্টি করা যায় না। এমনকি এটা এক মাস বা এক বৎসরেও সৃষ্টি করা যায় না। বরং একটা সমাজের ভিতর এমন চিন্তার জন্ম ও বিকাশের পিছনে প্রয়োজন হয় দীর্ঘ কালের শ্রম ও চেষ্টার, যার পিছনে আবার থাকতে হয় সমাজ বাস্তবতা। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালী জাতি চেতনার যে অঙ্কুরোদ্গম ঘটায় সেটি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ষাটের দশকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয়।
কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনার বিকাশের জন্য শুধু বাঙ্গালী চেতনার বিকাশ যথেষ্ট ছিল না। কারণ বাঙ্গালী জাতি চেতনার সঙ্গে ধর্ম চেতনার সংমিশ্রণ থাকলে বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তার বিকাশ সম্ভব হত না। সে ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতর স্বায়ত্তশাসন হতে পারত বাঙ্গালী মুসলমানের সর্বোচ্চ চাওয়া। কিন্তু এই চাওয়ার বাইরে বাঙ্গালী চেতনাকে নেবার জন্য যে আদর্শ বা রাজনীতির প্রয়োজন ছিল সেটা ছিল এ দেশের সমাজতন্ত্রী তথা বামপন্থীদের ভিতর। বিশেষত ষাটের দশকে বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের উত্থান এ দেশের রাজনীতিতে ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র ভাবনার যে জোয়ার সৃষ্টি করে তার পরিণতি হল বাঙ্গালীর স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
প্রকৃতপক্ষে যে বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী তরুণ প্রজন্ম পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের বুকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি ও আন্দোলন গড়েছিল তাদের রাজনৈতিক আদর্শে ধর্মের কোন জায়গা ছিল না। তাদের মধ্যে অনেকে ছিল ধর্ম বিশ্বাস মুক্ত, বাকিরা সকলে ততটা অগ্রসর না হলেও রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক ও মুক্ত করার পক্ষপাতী ছিল। অর্থাৎ একটা লোকবাদী দর্শন বা সেকিউলার আদর্শগত প্রেরণা কাজ করেছিল তাদের স্বাধীনতার রাজনীতির পিছনে। বিভিন্ন কারণে এই প্রজন্মের শক্তি স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উপর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। সেই কারণগুলো সম্পর্কে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নাই। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, সনাতন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের অন্ধ আন্তর্জাতিকতাবাদ ও শ্রেণীতত্ত্ব এবং ’৭১-এ ভারতের ভূমিকা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের সাফল্যের পথে ছিল দুই বড় বাধা, যা অতিক্রমে করার ক্ষমতা ঐ কাল এবং সমাজের বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্মের ছিল না।
এই প্রজন্ম যেমন ছিল লোকবাদ বা সেকিউলারিজমে বিশ্বাসী তেমন ছিল সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। পুরাতন বামপন্থী নেতৃত্ব সমাজতন্ত্র ও লোকবাদে বিশ্বাসী হলেও তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে পুরাতন নেতৃত্বের পার্থক্যের মূল জায়গাটা হল জাতীয়তাবাদ। পুরাতন নেতৃত্ব জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে শ্রেণী সংগ্রামকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছিল ব্যক্তি মালিকানার সম্পূর্ণ বিলোপবাদী নিরংকুশ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসের কারণে। অথচ তাদের বিপ্লবের কর্মসূচী ছিল জন-গণতন্ত্রের, যেখানে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ বা ব্যক্তি মালিকানার মধ্যে একটা অন্বয় বা সহাবস্থান ঘটেছিল। এটা এক ধরনের মিশ্র অর্থনীতি, যা বিপ্লবের পর চীন অনুসরণ করেছিল। চীনে ষাটের দশকে মাওয়ের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মিশ্র অর্থনীতির পথ পরিহার করে নিরংকুশ সমাজতন্ত্রের পথ নেওয়া হলেও সেটা ব্যর্থ হয়। প্রায় দশ বৎসর স্থায়ী সাংস্কৃতিক বিপ্লব শেষে চীন পুনরায় জন-গণতন্ত্রের অর্থনীতির পথ অনুসরণ করে অধিকতর মুক্ত পুঁজিবাদের পথে যাত্রা শুরু করে। সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের এই সমন্বিত ব্যবস্থাকে নাম দেওয়া হল সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। এই ব্যবস্থায় অর্থনীতির প্রধান ঝোঁক হল রাষ্ট্রীয় মালিকানার তুলনায় ব্যক্তি মালিকানার দিকে।
এ দেশের প্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে সমাজতন্ত্রের নিরংকুশ প্রয়োগ ক্ষতিকর হলেও তার একটা সীমিত প্রয়োগ এ দেশে সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদ নির্ভর আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাবার জন্য পাকিস্তান আমলে যেমন অপরিহার্য ছিল তেমন আজও রয়েছে। কারণ এ দেশে অধীনস্থ বা নির্ভরশীল পূঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে যে দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত শ্রেণীর উত্থান হয়েছে সেই শ্রেণীকে ধ্বংস করতে হলে সমাজতন্ত্রের প্রয়োগ ছাড়া উপায় নাই। তবে পাশাপাশি সমাজতল থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারী পর্যায়ের উদ্যোক্তা গঠনের মাধ্যমে স্বাধীন, সৎ ও স্বদেশ নির্ভর ব্যক্তি পুঁজি গড়ে তুলতে হবে। এই পুঁজি হবে চরিত্রে জাতীয় পুঁজি। আর এভাবে গড়ে উঠতে পারে একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী।
কমিউনিস্ট নেতৃত্ব এ দেশের প্রেক্ষিতে এ ধরনের একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী গঠনের গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা না বোঝায় তারা অতীতে কখনই এ দেশে সঠিক ভূমিকা নিতে পারে নাই। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম জাতীয় পুঁজি গঠনের এই গুরুত্ব উপলব্ধি করায় তারা এ দেশে জাতীয়তাবাদ তথা জাতি-রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বও উপলব্ধি করে। কিংবা উল্টাভাবেও বলা যায়, তারা এ দেশে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্ব উপলব্ধি করায় তার একটি নেতৃত্বকারী শ্রেণী হিসাবে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী ও তার পুঁজির গুরুত্ব উপলব্ধি করে। সুতরাং বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম যেমন ছিল জন-গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তি তেমন তারা ছিল এ দেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও লোকবাদেরও প্রকৃত শক্তি। বিশেষত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এ দেশে পাকিস্তানের ইসলামী ভাবাদর্শের সবচেয়ে কার্যকর ও শক্তিশালী প্রতিষেধক হওয়ায় তাদের লোকবাদী দর্শন একটি শক্তিশালী অবলম্বন লাভ করে।
আসলে একটা নষ্ট ও বিকৃত বা দেউলিয়া সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং তার আদর্শের অনুসারী হয়ে কিংবা তার সঙ্গে আপস করে কখনই একটা আদর্শনিষ্ঠ, সৎ ও দেশ প্রেমিক সামাজিক বা রাজনৈতিক শক্তি গড়া যায় না। এটা গড়ে ওঠে এই ধরনের ব্যবস্থা ও আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করেই। যে কোনও নূতন আদর্শ গড়তে চাই পুরাতন আদর্শের বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম এবং তার সঙ্গে একটা ছেদ। সেটা মুজিব এবং আওয়ামী লীগের ছিল না বলেই তাদের এই ব্যর্থতা এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে দুর্বৃত্তায়নের হোতা রূপে আবির্ভাব।
পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ ছিল পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের একনিষ্ঠ অনুসারী। আমি ভাসানীর গড়া এবং নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কথা বলছি না। আমি বলছি সোহরাওয়ার্দী-মুজিব নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কথা, যার প্রকৃত জন্ম ১৯৫৭-তে। কারণ ঐ বৎসর আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পতাকা ঊর্ধ্বে ধরে রাখতে চেয়ে ভাসানী তাঁর গড়া আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করেন।
আন্যদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখা উচিত যে, লীগের রাজনীতিতে মুখের কথায় যতই সেকিউলারিজম থাক তার অন্তর্গত প্রেরণা হয়ে থেকেছে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক। এটা লীগের কর্মকাণ্ডে সর্বদাই প্রকাশ পেয়েছে। ৬ দফা কর্মসূচীও লাহোর প্রস্তাবকে ভিত্তি হিসাবে মেনে নিয়েই পাকিস্তানের ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭-এ ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্র্র্ভুক্ত হওয়ায় পাকিস্তানের কাঠামোভুক্ত যে কোন ধরনের স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে কোন না কোনভাবে ধারণ ও লালন করতে বাধ্য ছিল। লীগ এবং ন্যাপ উভয়ের স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতির জন্যই এ কথা প্রযোজ্য।
তবে লোকবাদী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও কৌশলগত কারণে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন না গড়ে প্রকাশ্যে প্রথমেই স্বাধীনতার কর্মসূচী দেওয়া হত ভুল। কারণ যে জনগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদেরকে হঠাৎ করে ধর্মীয় ভাবাদর্শমুক্ত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল একটা কার্যকর ও শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন গড়ে তুলে তার আড়ালে লোকবাদী আদর্শ ভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলা। তা হলে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন তার বিকাশের একটা পর্যায়ে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে বিস্ফোরিত হত তখন লোকবাদী জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শক্তি স্বাধীনতা যুদ্ধের নিয়ামক শক্তিতে পরিণত হতে পারত।
ঘটনাটা মূলত সেভাবে ঘটলেও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে ন্যাপের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় তার মূল নিয়ন্ত্রণ চলে যায় লীগের হাতে। বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার রাজনীতি সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিল। কিন্তু বামপন্থী জাতীয় নেতৃত্বের সমর্থন ও আশ্রয় না পাওয়ায় তারা হল নেতৃত্বহীন। এ ছাড়া ছিল অনভিজ্ঞতা। স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে গিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দিল মত ও পথের ভিন্নতা। এই রকম অবস্থায় তাদের মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়ে উঠল না। তবু তারা হল স্বাধীনতার চেতনা বিস্তারের ঝটিকা বাহিনী।
এই বাস্তবতায় লীগের নেতৃত্বে হলেও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের এমন বিকাশ হল যে পাকিস্তান কাঠামো আর তাকে ধারণের উপযুক্ত ছিল না। কারণ এই স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের ভিতর তখন বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের প্রভাবে লোকবাদী ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রবল ও ক্রমবর্ধমান শক্তিরূপে বিকশিত হতে শুরু করে। এমন অবস্থায় যখন সংঘাত ও বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হল তখন জনগণের বিপুল গরিষ্ঠ অংশ স্বাভাবিকভাবে মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগের নিকট থেকে নেতৃত্ব প্রত্যাশা করল। এর পরের ঘটনা সবার জানা। সুতরাং তা নিয়ে এখানে আর আলোচনার প্রয়োজন নাই।
বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া কখনই নূতন শক্তি গড়ে ওঠে না। সুতরাং পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় ভাবাদর্শ এবং পাশ্চাত্য নির্ভর তথা অধীনস্থ পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ছাড়া নূতন ব্যবস্থা নির্মাণের শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। এই সংগ্রাম বামপন্থীদের থাকলেও লীগের ছিল না। জনমতকে ব্যবহার করতে চেয়ে জাতীয়তাবাদের কিছু আবেদন ব্যবহার করলেই জাতীয়তাবাদী আর জনস্রোতের প্রবল প্রবাহ দেখে সমাজতন্ত্রের সাইনবোর্ড লাগালেই সমাজতন্ত্রী হওয়া যায় না। তাই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর লীগের জাতীয়তাবাদ যেমন বাস্তবে ধর্ম সাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করেছে তেমন লীগের সমাজতন্ত্রও বাস্তবে লুণ্ঠণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
বস্তুত লীগ রাজনীতির মূল প্রবণতা ছিল বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের স্বার্থ সংরক্ষণ। যার ফলে তার মধ্যে একই সঙ্গে ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ এই উভয়ের বিজড়ন ঘটেছিল। আজ অবধি তার সকল কর্মকাণ্ড মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করলে এই ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই কারণে ’৭১ পরবর্তী কালেও লীগের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশ রাষ্ট্র ভিত্তিক। অর্থাৎ ’৪৭-এ বাংলা বিভক্তিকে অস্বীকার করে তার উদ্ভব ও বিকাশ নয়, বরং সেটাকে মেনে নিয়ে এবং সেটাকে অবলম্বন করেই তার উদ্ভব ও বিকাশ। সুতরাং তা ধর্ম-সাম্প্রদায়িক কাঠামোবদ্ধ। এই জাতীয়তাবাদ খণ্ডিত। এটার ভিত্তি বাংলা ও বাঙ্গালীর ধর্মভিত্তিক বিভাজন। সুতরাং এ দেশের প্রেক্ষিতে খণ্ডিত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার নামান্তর।
এইখানে তা জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সমগোত্রীয়। কিন্তু লীগ এ ক্ষেত্রেও স্পষ্ট বা পরিচ্ছন্ন নয়। লীগের রাজনীতির যে মাত্রাহীন সুবিধাবাদ তার প্রয়োজনে তার এই অস্পষ্টতা। লীগ তার চরিত্রের সুবিধাবাদী বৈশিষ্ট্যের কারণে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী সাম্প্রদায়িকতাবাদ এই উভয়ের মধ্যে এমন এক সেতু রেখে দিয়েছে যাতে তার প্রয়োজনে যখন যেদিকে খুশী তখন সেদিকে যাওয়া যায়। এই প্রয়োজনে শেখ মুজিবের যুদ্ধাপরাধী এবং রাজাকার-আলবদরদের বিচার না করা বা ক্ষমা করে দেওয়া। লীগের এই চরিত্র বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি মাথায় হেজাব পরে শেখ হাসিনার মাজার জিয়ারত করে বেড়ানোর মধ্যে। এই চরিত্রের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে কয়েক মাস পূর্বে ফতোয়াবাজী এবং ইসলামী অনুশাসন কায়েমের লক্ষ্যে খেলাফত মজলিশের সঙ্গে লীগের চুক্তি সম্পাদন।
এদিক থেকে জিয়া এবং বিএনপি বরং অনেক বেশী স্বচ্ছ এবং নীতিনিষ্ঠ। স্পষ্টভাবে এবং সরবে বলেকয়েই তার ইসলামী রাজনীতির অনুসরণ, যদিও সেটার সঙ্গে ইসলামী অনুশাসন পালনের বিশেষ কোন সম্পর্ক নাই। বরং এটা হচ্ছে অজ্ঞ, মূর্খ, মূঢ় এবং ধর্মাচ্ছন্ন গরিষ্ঠ জনগণকে ক্ষমতা ও বৈষয়িক স্বার্থে প্রতারণামূলভাবে ব্যবহারের প্রয়োজন সম্ভূত।
অপর দিকে রাজনীতিতে ইসলাম ব্যবহারের আর একটা দিক আছে যেটা না বুঝলে এ দেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের একটা বিশেষ তাৎপর্য বোঝা যাবে না। সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম দ্বারা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ রুদ্ধ করে রেখে ভারতের স্বার্থ সংরক্ষণ। যেহেতু পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা রাজ্য প্রধানত বাঙ্গালী অধ্যুষিত সেহেতু বাংলাদেশ বাঙ্গালী জাতির লোকবাদী রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হলে তার প্রবল প্রভাব পড়বে সেখানে। স্বাভাবিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পুনরেকত্রিত বাংলাকে ভারত দেখতে চায় না। কারণ তাতে ভারতের অঙ্গহানি ঘটবে। কাজেই এখানে রাজনীতিতে ইসলাম ব্যবহার ভারতের জন্যও কাম্য। যারা এখানে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্মের পতাকা তুলে ভারত এবং হিন্দুর বিরোধিতা করে তারা ধর্মের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির বিভক্তিকে স্থায়ী রূপ দান দ্বারা ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বলে তাদের পিছনেও থাকে ভারতের গোপন বা প্রকাশ্য প্রশ্রয় ও সমর্থন। এ বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহের কারণ নাই যে, এ দেশে ধর্মীয় রাজনীতির অনুসারীরা জ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে ভারত রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সহযোগী।
দেশের রাজনীতিতে সংস্কার সংক্রান্ত যেসব আলোচনা ও বিতর্ক চলছে তাতে উপরের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা ছাড়া আদৌ কি সঠিক দিক নির্দেশ লাভ করা সম্ভব? বস্তুত দেশ যে গভীর সঙ্কটে রয়েছে তা থেকে মুক্তি পেতে হলে আজ অনেক কিছু নূতন করে বিচার করার প্রয়োজন সর্বাধিক। সুতরাং সমস্যার আর একটু গভীরে গিয়ে আমরা তার তলদেশে যেতে চেষ্টা করতে পারি। এভাবে আমরা সমাজ বাস্তবতার আরও গভীরে গিয়ে আমাদের আজকের সঙ্কট ও সমাস্যাগুলোর উৎস অনুসন্ধানে বাধ্য হই।
(৩) সমাজ সঙ্কটের উৎস অনুসন্ধান
বর্তমানে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার নিয়ে সারা দেশে যে হৈচৈ চলছে তাকে একটা হাস্যকর তামাশা ছাড়া আর কিছু বলা যায় কি? এ হচ্ছে একদল গাধাকে ঘোড়া বানাবার মারফতী জিকির। যাদের জন্ম এবং বিকাশ নীতি-নৈতিকতাহীনতা, সুবিধাবাদ ও দুর্বৃত্তায়নের মধ্য দিয়ে এবং যারা আপাদমস্তক একটি দুর্নীতি ও লুণ্ঠন মূলক ব্যবস্থার অংশীদার, নেতা, কর্মী, পরিচালক তারা এখন দলে সংস্কার ঘটিয়ে সব সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে যাবে? এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার যে, সকল সমস্যার মূলে রয়েছে যে আদর্শ এবং রাজনীতি তাতে পরিবর্তন বা সংস্কার না ঘটিয়ে দলগুলোর সংস্কার নিয়ে এখন প্রায় সকলে ব্যস্ত।
প্রচার মাধ্যমে উপস্থিত প্রায় সবাই এখন সংস্কারের পক্ষে। দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে কোথায় কী সংস্কার ঘটানো দরকার তা নিয়ে প্রায় সবাই সোচ্চার। সরকারের কর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে বড়-মাঝারী বিভিন্ন দলের নেতারাও এখন সোচ্চার সংস্কার নিয়ে। এমন কি হাসিনা-খালেদাও এর বাইরে না। বিশেষত যাঁরা বিগত ৩৫ বৎসর বিভিন্ন সময় ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করেছেন তাঁদের মধ্যে এখন সংস্কার সবচেয়ে জনপ্রিয় আলোচ্য সূচী। এঁদের সঙ্গে আছেন অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক, সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা ইত্যাদি নানান পেশার ব্যক্তিবর্গ, যাঁরা হামেশা সংস্কার দাবীতে প্রচার মাধ্যম সরগরম করে রাখছেন।
বুঝলাম, দলে সংস্কার হবে। কিন্তু রাজনীতি বা আদর্শের সংস্কারের কী হবে? না, সে বিষয়ে ২/৪ জন বাদে প্রায় কারও কোন উচ্চবাচ্য নাই। কারণ তাতে যে শুধু দুই নেত্রী মাইনাস হন তা-ই নয়, উপরন্তু নিজেরাও প্রায় সকলেই মাইনাস হয়ে যান। এই কারণে দল এবং প্রতিষ্ঠানের কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন আর কিছু সংস্কারের বাইরে এদের আর কোন সংস্কার নাই। যেন সমস্যাটা শুধু কিছু ব্যক্তি আর সংগঠন এবং রাষ্ট্রের কিছু প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পদ্ধতির মধ্যেই আছে, দর্শন বা আদর্শের মধ্যে নাই এবং নাই মূল আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। সুতরাং নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনে কিছু রদবদল ইত্যাদি কিছু সংস্কারের পর এখন জোর দেওয়া হয়েছে দলের সংস্কারের উপর।
বিভিন্ন ধরনের সংস্কারকে আমি অপ্রয়োজনীয় বলছি না। কিন্তু মূল আদর্শ ও রাজনীতির পরিবর্তন না ঘটিয়ে এসব সংস্কার দ্বারা কি কোন ফল পাওয়া যাবে? দুর্বৃত্তপনা এবং দুর্নীতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটা নেতৃত্বকারী শ্রেণীর চরিত্র এতেই বদলে যাবে? এ দেশের উচ্চবিত্তের প্রায় পুরোটা এবং মধ্যবিত্তেরও সুবৃহৎ অংশই যে দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনতন্ত্রের ফসল মাত্র এই সত্য না বুঝলে কোন কালেই এ দেশে দুর্বৃত্তায়ন ও লুণ্ঠনতন্ত্র উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না।
হাঁ, বর্তমানের সংস্কার দ্বারা অল্প কিছু সময়ের জন্য কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন কিছু পরিমাণে হ্রাস করা যেতে পারে। কিন্তু এমন ঘটনা তো এ দেশে প্রায় প্রতিটি সামরিক শাসনের সময় ঘটেছে। তারপর কী হয়েছে? এবারও সেটাই হবে, তবে অনেক ব্যাপকতর আয়তনে এবং ভয়ংকর মাত্রায়।
বস্তুত দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎসটিকে চিহ্নিত না করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কায়া বাদ দিয়ে ছায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের মত। সুতরাং সেদিকে দৃষ্টিটা দেওয়া দরকারী। এ দেশে আমরা দুর্বৃত্তায়নের মূল উৎস হিসাবে যেগুলিকে চিহ্নিত করতে পারি সেগুলির একটি হচ্ছে ধর্ম, অপরটি পুঁজিবাদ। ধর্মকে ব্যবহার করে আধুনিক কালে এই শ্রেণীর উদ্ভব হয় প্রকৃত পক্ষে ইংরেজ শাসনামলে। ইংরেজ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগ ছিল এদের প্রধান রাজনৈতিক দল। অবশ্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে মুসলিম লীগের অনেক সময় লাগে। কিন্তু ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্রমবিকাশের ফলে হিন্দু সম্প্রদায় প্রভাবাধীন কংগ্রেসের পরিবর্তে মুসলিম লীগ হয়ে উঠে মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যাপক অংশের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল।
ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতির প্রাবল্যের ফলে বাংলায় বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে অখণ্ড বাংলার চেতনা দাঁড়াতে পারে নাই। অখণ্ড ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তার মূলে ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। কারণ ব্রিটিশ ভারতে তারাই ছিল সংখ্যাগুরু। সুতরাং এর বিপরীতে মুসলিম লীগ নিয়ে এল মুসলমান সংখ্যাগুরু অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী। এই দুই ধর্মের বোধ ও সংঘাতে বাঙ্গালী জাতি তখন আচ্ছন্ন। সুতরাং জাতি-রাষ্ট্রের বোধ তখন দাঁড়াবে কী করে? জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে উন্নত যুক্তিবাদী ও লোকবাদী চেতনার প্রয়োজন ছিল তা বাংলায় তো বটেই এমন কি ভারতবর্ষেরও কোথায়ও জন-সমাজের প্রবল ধর্মাচ্ছন্নতার কারণে কার্যকরভাবে দাঁড়াতে পারে নাই। চিত্তরঞ্জন দাশের মত রাজনীতিক এবং কাজী আবদুল ওদুদের মত চিন্তাবিদরা এই কারণে তাঁদের বাঙ্গালী জাতির স্বাতন্ত্র্য এবং জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাকে জনপ্রিয় করতে কিংবা স্থায়িত্ব দিতে পারেন নাই। ধর্মীয় রাজনীতির প্রবল জোয়ারে তাঁদের চিন্তা এবং কর্ম তলিয়ে গেছে।
এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এক সময় বাংলা এবং ভারত ভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙ্গালী মুসলমানের ভূমিকা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। নেতৃত্ব যেখান থেকেই আসুক বাংলার মুসলমানরাই ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের প্রধান শক্তি।
বাংলার যে বহিরাগত আশরাফ শ্রেণীর নেতৃত্বে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজ সাধারণভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই শ্রেণীর গরিষ্ঠ অংশের চরিত্র ঐতিহাসিকভাবেই ছিল নিকৃষ্ট এবং দেশদ্রোহী। মুসলিম লীগের কর্মকাণ্ডেও আমরা তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখি। অভিন্ন ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য ও দ্বন্দ্বের সম্পর্কের ভিত্তিতে স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার পরিবর্তে ব্রিটিশের সহায়ক শক্তি হিসাবে কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল করার দিকেই তার মূল ঝোঁক ছিল। বিনিময়ে ছিল ব্রিটিশ শাসকদের উচ্ছিষ্ট প্রত্যাশী।
আমি বলি না যে কংগ্রেস ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের দল। কংগ্রেসের সৃষ্টিও ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষকতা এমনকি নেতৃত্বে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ভিতর বিদেশী ব্রিটিশ শাসন বিরোধী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা বিপুল শ্রম, ত্যাগ ও আত্মদান করেছিল। সুভাষ চন্দ্র বসুর মত বিপ্লবী নেতা অল্প দিনের জন্য হলেও এ দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগের ক্ষেত্রে সেসব কিছুই ছিল না। এ হচ্ছে নিদারুণ সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানী একটি রাজনৈতিক দল।
আশরাফ শ্রেণীর নেতৃত্বে বাংলার মুসলমান জনগণের বিপুল গরিষ্ঠ অংশই এমন একটি রাজনৈতিক দলের পিছনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এই শ্রেণীর যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তেমন কোন ঐতিহ্যই নাই শুধু তা-ই নয়, বরং এই শ্রেণীর পূর্বপুরুষরাই মীর জাফরের নেতৃত্বে এ দেশকে একটা চক্রান্তের মাধ্যমে ইংরেজ বণিকদের হাতে তুলে দিয়েছিল। অথচ তারা ছিল তখন এ দেশের শাসক শ্রেণীর বিপুলভাবে গরিষ্ঠ অংশ। একটা সামরিক রাষ্ট্রের বিপুলভাবে গরিষ্ঠ অংশই ছিল নওয়াব সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে চক্রান্তে মীর জাফরের পক্ষে। এ থেকে তৎকালীন বহিরাগত মুসলিম চক্রের মনেভাব বোঝা যায়।
এটা সপষ্ট যে বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি সামান্যতম ভালবাসা এবং আকর্ষণ এই বহিরাগত মুসলমান শাসক শ্রেণীর বিপুল গরিষ্ঠ অংশের ভিতর ছিল না। অবশ্য সেটা থাকার কারণও ছিল না। বাংলার আর্দ্রতা, ভ্যাপসা গরম, ঝড়, বন্যা, জল-জলা-কাদা, নদী ভাঙ্গন, পিপড়া, উই, মশা, মাছি এবং আরও যাবতীয় পোকা-মাকড়, আর ম্যালেরিয়া, কলেরা, ডায়রিয়া, কালাজ্বর, বসন্ত ইত্যাদি ছাড়াও যত প্রকার সম্ভব প্রধানত জল বাহিত ব্যাধির ব্যাপকতার কারণে বাংলাকে বিদেশীরা কোন কালেই বাসযোগ্য মনে করত না। এখানে এসে তারা অনেক সময় মরতও প্রায় মশা-মাছির মত। ইউরোপের মানুষরা যে এ দেশে এসে ব্যাপক সংখ্যায় মারা যেত সে সম্পর্কে ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ের উল্লেখ করেছেন। মোট কথা বাংলা বিদেশীদের নিকট বসবাসের জন্য আকর্ষণীয় ছিল না। বাংলার বিপুল সম্পদ এবং খাদ্যশস্য ও ফলমূলের প্রাচুর্যের কারণে এই জন্য বিদেশীরা বাংলাকে বলত ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ নরক। মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার মরুভূমি অথবা শুষ্ক ভূমি থেকে আসা ভাগ্যান্বেষী মুসলমানদের নিকট বাংলা সত্যিই ভাল জিনিসে পরিপূর্ণ নরক বা দোজখ ছাড়া আর কিছু ছিল না।
আমরা জানি মোগল যুগে কোন রাজপুরুষ সহজে বাংলায় বদলী হয়ে আসতে চাইত না, এবং এটা ছিল তাদের জন্য এক প্রকার শাস্তিমূলক বদলী। এই কারণে মোগল সম্রাটরা যাদেরকে এখানে শাসন কার্যের দায়িত্ব দিয়ে পাঠাতেন তারা কত দ্রুত ফিরে যেতে পারবে সেই চেষ্টায় থাকত এবং এখানে যেসব সম্পদ সংগ্রহ করতে পারত সেগুলি উত্তর ভারতে তাদের স্থায়ী বাসস্থানে পাঠিয়ে দিত।
আসলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বা ভারতের আর কোথায়ও জায়গা না পাওয়া কিংবা সেখান থেকে তাড়া খাওয়া বহিরাগত মুসলমানরা আশ্রয় নিত বাংলার পলল জলাভূমিতে। মোগলদের হাতে পরাজিত পাঠানদের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত আশ্রয় নেয় এই জলাভূমিতেই। এই সব তাড়া খাওয়া অথবা আর কোথায়ও জায়গা না পাওয়া ভিন্ন এমনকি প্রায় ক্ষেত্রেই বিপরীত ভূ-প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের লোকদের এ দেশকে ভালবাসার যে কোন কারণ ছিল না তা শুধু মীর জাফর আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায় নাই উপরন্তু এ দেশের মুসলিম নেতৃত্বের পরবর্তী কালের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েও প্রকাশ পেয়েছে।
এ দেশের মাটি ও মানুষ কোনটার প্রতিই তাদের আনুগত্য ছিল না। বরং এগুলিকে নিজেদের স্বার্থে ঘৃণার সঙ্গে শুধু ব্যবহার করেছে। এটা ঠিক যে তারা এ দেশে দীর্ঘকাল নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধতা এবং ভাষা ও সংস্কৃতির অনেক কিছু রক্ষা করতে পারে নাই। বরং তারা কালক্রমে এ দেশের ধর্মান্তরিত মুসলিম সমাজের সঙ্গে মিশে গেছে। বিশেষত ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত হবার ফলে তারা আর তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার উপায় পায় নাই। কিন্তু সেই সঙ্গে তারা তাদের চরিত্র ও মানসের অনেক নিকৃষ্টতা যেমন এই সমাজের ভিতর সঞ্চার করেছে তেমন নিজেরাও এ সমাজের অনেক নিকৃষ্টতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে গিয়ে সেগুলিকেও আত্মস্থ করেছে।
ঐতিহাসিক কাল ধরে বাঙ্গালীর অনেক দুর্বলতা ও নিকৃষ্টতা সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত। এই দুর্বলতার কারণে বৃহৎ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে সাধারণভাবে বাংলার অধিবাসীদের পিছিয়ে থাকতে দেখা যায়। তবু কিছু বৃহৎ নির্মাণ হয়েছে উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গকে কেন্দ্র করে। যেমন পাল সাম্রাজ্যের মূল ভূমি ছিল উত্তর-পশ্চিম বঙ্গ এবং বিহারের একাংশ এবং রাজধানী ছিল উত্তর বঙ্গের গৌড়ে। আর বাংলার জল ও জঙ্গলাকীর্ণ পূর্বাঞ্চল ছিল নদী ভাঙ্গনপ্রবণ এবং অস্থিতিশীল চরসমষ্টি মাত্র। গোটা বাংলাই এক অর্থে চরসমষ্টি হলেও এ কথা সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য বাংলার পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে। নদী ভাঙ্গনের প্রভাব অনেকাংশে কাটিয়ে উঠে এবং স্থিতিশীল ভূমি গঠনের মধ্য দিয়ে পশ্চিম বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল অনেক কাল ধরে স্থিতিশীল ভূমিতে পরিণত হলেও পূর্ব বাংলার ব্যাপক অঞ্চল সাম্প্রতিক কালে বাঁধ, সেতু, সড়ক ইত্যাদি দ্বারা নদী শাসনের মাধ্যমে কিছুটা স্থিতিশীল ভূমিতে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও নদী ভাঙ্গনের দরুন এখনও পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের বৃহৎ নদী এবং সমুদ্র তীরবর্তী এক বৃহৎ অঞ্চল অস্থিতিশীল।
বাংলার পূর্বাঞ্চলের নদী বিধৌত এবং জলা-জঙ্গল বেষ্টিত পলল চরভূমির মানুষরাই প্রধানত ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল। সেটা উন্নত কোন বোধ থেকে এ কথা মনে করার কারণ নাই। বরং সে কালের প্রেক্ষিতে উন্নত সমাজ ও সভ্যতা বহির্ভূত, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাম ও চরের অধিবাসী এবং নদী ভাঙ্গা মানুষরা ছিল চিন্তা-চেতনায় অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা মানুষ। অস্থিতিশীল ভূ-প্রকৃতি এবং অসংখ্য নদীর আবেষ্টন যেমন তাদের সমাজকে করে রাখত ক্ষুদ্র গণ্ডীবদ্ধ তেমন করে রাখত অস্থির, আকস্মিক ও দ্রুত পরিবর্তনশীল। চর বা নদী ভাঙ্গন যে কোন সময় বসতি বা গ্রামগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিত। এই অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত ভূ-প্রকৃতির আবেষ্টনের ভিতর বাস করা মানুষেরা বৃহৎ সংগঠন, সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ার ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। বৃহৎ রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীল ও সভ্য সমাজের নীতি-নিয়ম এসবই তাদের কল্পনা ও সামর্থ্যের বাইরে ছিল। নিজেদের ভিতর থেকে বৃহৎ কোন শক্তি গড়ার ক্ষমতা ছিল না বলে তারা ছিল বাইরের শক্তির পূজারী। সুতরাং তারা নিজেদের দুর্বলতা পূরণ করতে চেয়েছে প্রবল বহিরাগত শাসকের অনুগত হয়ে। শাসকের ধর্ম, সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করে নিতে চেয়েছে, অবশ্য তাদের বোধ-বুদ্ধি এবং সামর্থ্য অনুযায়ী। তাই বৌদ্ধ পাল শাসন কালে তারা অর্ধ বৌদ্ধ, হিন্দু সেন শাসন কালে তারা অর্ধ হিন্দু আর মুসলমান শাসন কালে তারা অর্ধ মুসলমান। হাঁ, এই মুসলমান এক আল্লাহ্র পাশাপাশি মনসা, ওলাওঠা, শীতলা, কালী, চণ্ডী ইত্যাদি দেবতায় বিশ্বাস এবং পূজাও ভক্তি সহকারে করত এই সেদিন পর্যন্ত। মুসলিম শাসন কালে বহিরাগত মুসিলম শাসকরা এদেরকে মুসলমান হিসাবে স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতে নারাজ ছিল। কেবলমাত্র রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত হবার পর আশরাফ শ্রেণী এই দেশজ ধর্মান্তরিত অর্ধ মুসলমানদেরকে মুসলমান করার জন্য ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের উপর জোর দেয়। ফলে ওয়াহাবী, ফরায়েজী ইত্যাদি আন্দোলন সংগঠিত হল। পাকিস্তান আন্দোলনকেও এর ধারাবাহিকতায় ফেলতে হবে। এভাবে বৃহত্তর দেশ, সমাজ, জাতি ও ভাষা সম্পর্কে অচেতন বাংলার এই মানুষগুলো মুসলমান হল।
প্রধানত সভ্যতা বহির্ভূত মানুষরা যে ইসলাম গ্রহণ করেছিল তা বুঝা যায় নিকট অতীতেও কৃষি ও বস্ত্র বয়নের বাইরে আর কোন পেশা বা বৃত্তিতে শ্রমজীবী ও নিম্নবর্গের মুসলমানদের প্রায় অনুপস্থিতি অথবা সংখ্যাল্পতা থেকে। প্রবীণদের মধ্যে যাঁরা ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ দিক কিংবা পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকের কথা স্মরণ করতে পারেন তাঁরা অনেকে জানেন তৎকালে সভ্যতা সংশ্লিষ্ট অনেকগুলি পেশায় মুসলমানদের প্রায় দেখা যেত না। যেমন কর্মকার (কামার), কুম্ভকার (কুমার), চর্মকার (চামার), সূত্রধর (ছুতার), কাংসকার বা কাঁসারী (কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র নির্মাতা), রজক (ধোপা), নরসুন্দর (নাপিত) ইত্যাদি। কলকাতা, ঢাকার মত শহর ছাড়া আর প্রায় সব ছোট শহর এবং গ্রাম বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষাবাদ এবং তাঁতে কাপড় বুনার বাইরে আর কোনও বৃত্তিতে মুসলমানদের প্রায় অনুপস্থিতি বা সংখ্যাল্পতা ছিল লক্ষণীয়। অবশ্য দর্জি, রাজমিস্ত্রীর পেশায় মুসলমানদের মধ্যে অনেককে দেখা যেত। এছাড়া নিম্নবর্গের বাকিরা প্রায় সকলে ছিল গাড়োয়ান, কোচোয়ান, মুটে-মজুর শ্রেণীর লোকজন।
মনে হয় এই একটি ঘটনা থেকে মধ্যযুগের সমাজ ও সভ্যতায় দেশজ মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থান কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়। বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে এরাই ছিল বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ থেকে বাংলার মধ্যযুগের মুসলিম সমাজের সামগ্রিক চিত্রটাও অনেকটা বেরিয়ে আসে। বস্তুত উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। এই সময় থেকে হিন্দুদের দেশ ত্যাগের ফলে শূন্যতা পূরণের জন্য মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন বৃত্তি গ্রহণ শুরু হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই দেশজ বাঙ্গালী মুসলমান হঠাৎ করে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তার ভাষা ও বাঙ্গালী সত্তা সম্পর্কে সচেতন হল। কিন্তু সেটাও কোন উন্নত আদর্শ বা চেতনা তাড়িত কারণে নয়, বরং নেহায়েত নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে। অজানা উর্দূ ভাষার কারণে যখন তাদের চাকুরীর বাজার এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখতে পেল তখন তারা জাতি সচেতন হয়ে পড়ল। এও বাঙ্গালীর অতিরিক্ত সুবিধাবাদের বহিঃপ্রকাশ।
এ দেশের গরিষ্ঠ বাঙ্গালী জনগণের চরিত্রে সুবিধাবাদ, উন্নত নীতি-নৈতিকতার অভাব এবং সবকিছু সহজে ও অত্যন্ত দ্রুত পেতে চাওয়ার মনোভাব অত্যন্ত প্রবল। ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা, ভীরুতা, ধৈর্যহীনতা, সংকীর্ণতা এগুলো গরিষ্ঠ বাঙ্গালী চরিত্রের প্রধান দিক। কাজেই এ দেশে ভিতর থেকে জনগণের চেষ্টায় যেসব পরিবর্তন ঘটেছে সেগুলি সবই সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙ্গালী জনগণের শ্রম ও আত্মদানের ফল। কিন্তু যখন ফল নিকটবর্তী বা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় তখন গরিষ্ঠ বাঙ্গালীরও ব্যাপক অংশ ঝাঁপিয়ে পড়ে সমর্থন যোগায় এবং ফলে অংশ নিতে চায়।
এর হয়ত ভাল দিক আছে। যখন পরিবর্তন হয় তখন সেটা সহজে বা দ্রুত হয়। অনেক সময় বিরাট পরিবর্তন হয়। কিন্তু সেসব নীচে নয়, ভিত্তিমূলে নয়, উপরে। ফলে এসব পরিবর্তন হয় ভাসমান, ভঙ্গুর এবং অস্থিতিশীল। অনেক সময়ই এই সব পরিবর্তনের ফল গরিষ্ঠের জন্য ভাল হয় না। ফলে অনেক সময় এইসব পরিবর্তন আশাভঙ্গের কারণ ঘটায়।
এই যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দীর্ঘকাল নির্বিকার, নির্লিপ্ত, নিষিক্রয় থেকে এভাবে হঠাৎ করে একটা সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন পরিবর্তনের পক্ষে সমর্থন জানায় তার ফলে পরিবর্তনের প্রকৃত শক্তি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে, দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠার অবকাশ পায় না। দীর্ঘকাল ভাল কিছু সমর্থনের অভাবে পড়ে থাকে, ক্ষীণ হয়, মৃতপ্রায় হয় এবং প্রায় হারিয়ে যেতে বসে। যে অবস্থা হয়েছিল কুড়ি এবং ত্রিশের দশকে বাঙ্গালী জাতি চেতনার এবং যেটা চল্লিশের দশকে প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সেটা ’৫২-তে এসে এ বাংলায় প্রবল জোয়ারে পরিণত হল। এ থেকে এমন এক গতিধারা বেগবান হল যে শেষ পর্যন্ত তার ধাক্কায় পাকিস্তানই ভেঙ্গে গেল। সেটাও যারা পাকিস্তান ভেঙ্গে বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির সাধনা করছিল তাদের জন্য ধ্বংস অথবা বিপর্যয় ছাড়া আর কোন সুফল বয়ে আনে নাই।
বস্তুত হঠাৎ করে প্রায় সবাই যখন একটা পথের দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন বিপদ হয় তাদের যারা দীর্ঘ শ্রম ও ত্যাগ দ্বারা এই পথ নির্মাণ করে। যেহেতু সুদীর্ঘ কাল তারা প্রায় কোন প্রকার জনসমর্থন পায় না অথবা পেলেও যেটুকু পায় সেটুকু খুবই লঘিষ্ঠের সমর্থন সেহেতু তাদের শক্তির তেমন একটা বিকাশ হয় না। কিন্তু কতকগুলো ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা সময় আসতে পারে যখন গরিষ্ঠ জনগণ কিংবা তাদের সনাতন নেতৃত্বের নিকট এই পথকে তাদের জন্য লাভজনক বা সুবিধাজনক মনে হয়। তখন গরিষ্ঠ জনগণ তাদের সনাতন নেতৃত্বের অধীনে হঠাৎ সেই পথের দিকে ছুটতে শুরু করে। আর এভাবে একদল সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী নেতা গরিষ্ঠ জনগণের সাহায্যে যারা পথের মূল নির্মাতা তাদেরকেই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে পথ নিজেরা দখল করে। সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপার হয়েছিল এ দেশে। সমাজতন্ত্র বিরোধিতাকারী মুজিব হঠাৎ করে সমাজতন্ত্র দখল করে তার নেতা হয়ে বসলেন এবং সমাজতন্ত্রের বিপ্লবী শক্তিকে ধ্বংস করলেন। কিন্তু যে আদর্শ তিনি গড়েন নাই, তার অনুশীলন করেন নাই সেটাকে তিনি ধারণ করবেন কী করে? অন্যের গড়া আদর্শ দখল ও আত্মসাৎ করে নিজের নামে চালাতে গিয়ে তিনি নিজেই মারা পড়লেন।
এখন দলগুলোতে সংস্কারের হট্টগোল চলছে। এও গরিষ্ঠ বাঙ্গালীর সুবিধাবাদী এবং নীতি-নৈতিকতাহীন চরিত্রের এক প্রকাশ। এতকাল সংস্কারের খেয়াল ছিল না। বরং নেতা-নেত্রীর গুণগান গেয়ে মুখে ফেনা তুলত। সেদিন যে নৈতিক বোধহীনতা ও সুবিধাবাদ থেকে তারা সে কাজ করত আজও সেই একই বোধ কাজ করছে এর ভিতর। সেদিন ছিল নেত্রীর কৃপা বঞ্চিত এবং ফলে সুবিধা বঞ্চিত হবার ভয় এবং সুবিধা প্রাপ্তির লোভ। আজ সেই একই বোধ কাজ করছে আর এক দিক থেকে। মেরুদণ্ডহীন এই লোকগুলোর তাদের সকল অপকর্মের আশ্রয় স্বরূপ তাদের নেত্রীর পাশে আজ দাঁড়াবার সাহস নাই। কারণ সরকার আর সেনাবাহিনীর ভয়। দুর্নীতিলব্ধ সম্পদ হারাবার ভয়, জেলে যাবার ভয় আজ তাদের সংস্কারের মূল প্রেরণা হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে আছে লোভ, যদি এই পট পরিবর্তন তাদের জন্য নূতন সুযোগের দরজা খুলে দেয়!
কিন্তু এখন সংস্কার নিয়ে মাতামাতি দেখে নিশ্চিত হলে ভুল করা হতে পারে। জোয়ার-ভাটা আর নদী ভাঙ্গনের এই দেশে মত ঘুরতে কতক্ষণ লাগে! যদি সরকারের উপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কোন কারণে সেভাবে দেখা দেয় অথবা সরকারের জন্য সঙ্কট ঘনীভূত ও দৃশ্যমান হয় তবে এই সংস্কারপন্থীদের সুর পাল্টাতে কতক্ষণ লাগবে?
হাঁ, গরিষ্ঠ বাঙ্গালী মনের জটিলতা বুঝতে হবে। সে খুবই অস্থির আবার খুবই ধৈর্যশীল। সবলের অত্যাচার-পীড়নের বিরুদ্ধে সে খুবই ধৈর্যশীল। হয়ত যতক্ষণ অবস্থা নিজের পক্ষে আসতে না দেখবে ততক্ষণ সে সব অত্যাচার সহ্য করবে মুখ বুজে এবং বিনা প্রতিবাদে। এ ক্ষেত্রে তার মনোভাব বা দর্শন খুব সহজ। দিন চিরকাল এক রকম থাকে না। সে তো জানেই, হাঁ, এ দেশে বাস করে হাজার হাজার বৎসর ধরেই সে জেনে এসেছে কোন নদীর কোন তীরই স্থির নয়। নদী তার আপন নিয়মে একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে। এর কোনটাই তার ইচ্ছাধীন নয়। সুতরাং বৃথা চেষ্টায় তার লাভ কী? সে সুযোগ সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করে না, বরং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। সুতরাং সুযোগ এলে দল বেঁধে হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঐ চর দখলের মত। অবশ্য সুযোগ তৈরীর সাধনা করার মত মানুষও এ সমাজে আছে। কিন্তু, সে রকম মানুষ কয়জন হয় এ সমাজে? তাদের সংখ্যা খুবই কম। চৈতন্য, লালন, সুভাষ, ভাসানী -- এরা কয়জন? আর এরা কি এ দেশের মূলধারার কেউ? এদের অনুসারী কয়জন হয়েছে এ দেশে?
পূর্ব বাংলায় ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের আগে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আকস্মিক ও প্রচণ্ড বিস্ফোরণকে হিসাবে না নিলে সমাজ ও ইতিহাসের অনেক গভীর সত্যকে বুঝতে ভুল হতে পারে। ১৯৬৮-এর শেষ দিকে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলন দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলন নূতন গতি ও শক্তি লাভ করে। এই ঘটনা ছিল পাকিস্তানের শাসন কেন্দ্রের সঙ্কটের বহিঃপ্রকাশ। ভাসানী এটা বুঝতে ভুল যেমন করেন নাই তেমন এ দেশের জন-মানস সম্পর্কে তাঁর যে গভীর উপলব্ধি ছিল তা থেকে সঠিক সময়ে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিতেও ভুল করেন নাই। ১৯৬৮-এর ৬ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দান থেকে তিনি যে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান সেটাই ১৯৬৯-এর জানুয়ারীতে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হল। একই ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে শুধু বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ফল হিসাবে বিচার করাও হবে ভুল। তার পিছনে ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকাকেও দেখতে পারতে হবে।
তারপরেও হয়ত বলা হবে তৎকালীন ঐ সব আন্দোলন শুরুর জন্য যে বিপ্লবী বা বামপন্থী শক্তি সমাজে ক্রিয়াশীল ছিল, এমনকি যার অবশেষ ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে এরশাদ বিরোধী গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্তও টিকে ছিল, তা এখন নাই। ফলে প্রয়োজন হলেও আন্দোলনের প্রাথমিক অভিঘাত হানবে কে?
এই বিবেচনা থেকে কেউ যদি গরিষ্ঠ জনগণ সমর্থিত এইসব নীতি-নৈতিকতা বর্জিত বৃহৎ দলগুলোর নেতা-কর্মীদের অনেকের মেরুদণ্ডহীন আচরণ থেকে স্থির কোন সিদ্ধান্ত টানেন তাহলে ভুল করবেন। কারণ ছোটখাটো টর্নেডো-বন্যা দেশের ভিতরে সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু বিশালায়তনে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বা বন্যা এ দেশে আসে বাহির থেকেই। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আসে বঙ্গোপসাগরের আকাশ আর জল সীমা পার হয়ে, আর বন্যা আসে হিমালয় আর উত্তর জনপদ ভূমির গা বেয়ে।
(৪) দুর্বৃত্তায়নের শ্রেণীগত ভিত্তি
বাংলাদেশে রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে যে শ্রেণী নেতৃত্ব দিচ্ছে এ দেশের দুর্বৃত্তায়ন ও তজ্জনিত সঙ্কটের দায়-দায়িত্বও তাদের উপর বর্তায়। সুতরাং সঙ্কটের স্বরূপ বোঝার জন্য শাসক বা নেতৃত্বকারী এই শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের গঠন প্রক্রিয়া বোঝা অত্যাবশ্যক। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী বা উচ্চ শ্রেণীকে কমিউনিস্টরা সাধারণত বুর্জোয়া বলেন। অবশ্য শুধু কমিউনিস্ট বলে কথা নয়, বরং শিক্ষিত শ্রেণীর অনেকে এভাবে এই শ্রেণীকে অভিহিত করেন। এ হচ্ছে ইউরোপের অভিজ্ঞতা বা কেতাবী বিদ্যা থেকে প্রাপ্ত ধারণা অনুযায়ী এ দেশের বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করা। এটা অতীতের জমিদারের নায়েব বা পাইক-পেয়াদাদেরকে জমিদারের মর্যাদা দানের মত ব্যাপার। বস্তুত এই ধরনের নামকরণ দ্বারা ধরে নেওয়া হয় ইউরোপে মূলত বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণীর নেতৃত্বে যেভাবে সেখানকার উচ্চ বা সামগ্রিক শাসক শ্রেণী গড়ে উঠেছে আমাদের দেশেও ব্যাপারটা তেমন।
এটা বোঝা জরুরী যে, ইউরোপের বুর্জোয়া এবং এ দেশের উচ্চবিত্ত বা উচ্চ শ্রেণীর মধ্যে বহিরঙ্গে কিছু মিল থাকলেও অন্তর্বস্তুতে কোন মিল নাই। এই দুইটি দুই ভিন্ন শ্রেণী। উভয়ের জন্ম ও বিকাশ ধারাই সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ইউরোপের পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণী উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে এবং তার অনুগ্রহজীবী হয়ে এবং ধর্ম আর সামন্তবাদের আশ্রয়ে জন্ম ও বিকাশ লাভ করে নাই। প্রথমত, ইউরোপ কারও উপনিবেশ ছিল না। দ্বিতীয়ত, আধুনিক পুঁজি ও বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব যে পশ্চিম ইউরোপে সেখানে রাষ্ট্রের চরিত্র ছিল প্রধানত সামন্তবাদী। রাজার কেন্দ্রীয় শাসন ছিল সামন্ত ভূস্বামীদের উপর এমনভাবে নির্ভরশীল যে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের প্রাধান্যে আসার উপায় ছিল না। ইউরোপে এই সামন্ত ব্যবস্থা বা সামন্ত ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে। তৃতীয়ত, বুর্জোয়া ইউরোপের ভিত্তি রচনা করেছিল রেনেসাঁ বা নবজাগরণ যার মূল প্রেরণা এসেছিল মধ্যযুগীয় অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার আর প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে। এর প্রভাবে পরবর্তী কালে ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ধর্ম সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে। বস্তুত রেনেসাঁ থেকে ইউরোপে দর্শন চিন্তার ক্ষেত্রে দুইটি শক্তিশালী ধারা বিকাশ লাভ করে -- একটি ক্যাথলিক চার্চের কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে উদারনৈতিক খ্রীষ্টীয় ধারা, অপরটি সম্পূর্ণরূপে ধর্ম বিশ্বাস মুক্ত এবং পুরোপুরি লোকবাদী। দর্শনের বিচারে দ্বিতীয় ধারা ভাববাদের বিপরীতে বস্তুবাদী। ফরাসী ও রুশ বিপ্লব এই ধারাকে প্রাধান্য দেয়। বিশেষত রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে লোকবাদী ও বস্তুবাদী দর্শনের ধারাটি রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নিরংকুশ প্রাধান্য অর্জন করে। এর ফলে রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্র লোকবাদী ও বস্তুবাদী আদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে এতটা না হলেও ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সরিয়ে দিয়ে ব্যক্তির অধিকারের সীমায় রেখে দেওয়া হয়। ধর্ম মানা না মানা ব্যক্তির ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন দায়িত্ব বা অধিকার নাই। এই হল পশ্চিম ইউরোপে লোকবাদী তথা সেকিউলার রাজনীতি চর্চার মর্মবাণী।
তবে ইংল্যান্ডের মত কোন কোন দেশে সীমাবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের মত খ্রীষ্ট ধর্মকে সীমাবদ্ধভাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে রাখা হয়েছে। সুতরাং ইংল্যান্ডে প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান হচ্ছেন ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণী। যদিও ইংল্যান্ডের রাষ্ট্র শাসনে ধর্মের ভূমিকা নাই বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতি পরিচালিত হয় লোকবাদী তথা জাগতিক ও যুক্তিবাদী আইন ও অনুশাসন দ্বারা তবু উপরোক্ত ঘটনা লোকবাদ ও ধর্মের মধ্যে একটা আপসেরও দৃষ্টান্ত। এটা একটা জগাখিচুড়িও বটে। ইংল্যান্ডের গণতন্ত্রের উপর একটি চরম পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল পরিবারতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের মুকুট পরিয়ে রাখার মত।
আমার ধারণা ইংল্যান্ডে রাষ্ট্রে ধর্মের এই অবস্থান রক্ষা করা হয়েছে ধর্মভীরু, পশ্চাৎপদ জনগণ এবং বিশেষ করে উপনিবেশের পশ্চাৎপদ সমাজগুলির ধর্মভীরু ও পশ্চাৎপদ মানুষদেরকে ধর্মের অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-লুণ্ঠন ও শাসনকে নিরাপদ রাখার স্বার্থে। বস্তুত ধর্ম যে পশ্চাৎপদ এবং অজ্ঞ-অন্ধ-ভাগ্যবাদী মানুষদেরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ হাতিয়ার এই সত্য বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য বিস্তারে সমর্থ ইংল্যান্ডের শাসক শ্রেণীর না বোঝার কারণ ছিল না।
একই প্রয়োজনে তারা বংশীয় রাজতন্ত্রকে রক্ষা করেছে। প্রথমে এটার প্রয়োজন ছিল নিজ সমাজের সাধারণ গরিষ্ঠ মানুষকে সহজে নিয়ন্ত্রণের জন্য। পরবর্তী সময়ে এর প্রয়োজন থেকেছে ভারতবর্ষের মত উপনিবেশসমূহকে সহজে নিয়ন্ত্রণের জন্য। কারণ ভারতবর্ষের মত প্রাচ্যের এইসব অধীনস্থ সমাজ সুদীর্ঘ কাল রাজতান্ত্রিক শাসনে অভ্যস্ত ছিল। সুতরাং ইংল্যান্ডেশ্বর বা ইংল্যান্ডেশ্বরীর শাসন তাদের নিকট বোধগম্য একটা বিষয় ছিল। অপর দিকে, এইসব দেশের স্থানীয় অধীনস্থ রাজারা ছিল তাদের শাসন রক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি। প্রকৃত ক্ষমতা থাকত ইংরেজ বা ব্রিটিশদের হাতে। কিন্তু স্থানীয় বংশগত রাজাদেরকে সামনে রেখে প্রজাদের আনুগত্য সহজে পাওয়া যায় বলে স্থানীয় রাজতন্ত্রগুলিকে নামে হলেও যতটা সম্ভব রক্ষা করা হত। আর এই সকল রাজার শীর্ষে যদি ইংল্যান্ডের রাজা বা রাণীকে দেখানো না যায় তবে চলবে কী করে?
ধর্ম ও রাজতন্ত্রের প্রতি ফরাসী বিপ্লবের আপসহীনতার প্রভাব ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোতেও পড়েছিল। কারণ ফরাসী বুর্জোয়ারা যেখানে গেছে সেখানে তাদের সক্রিয় ও আপসহীন লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাবধারাকেও নিয়ে গেছে। আর এটা স্বাভাবিক যে অধীনস্থ সমাজ বা জনগণ শাসকের দর্শন, সংস্কৃতি ও আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়, কখনও গভীরভাবে। সুতরাং ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বাণীতে অনুপ্রাণিত ভিয়েৎনাম এবং আলজিরিয়ার জনগণ দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে ফ্রান্সকে বিতাড়ন করে।
পরাধীন জাতির সশস্ত্র সংগ্রামের ধাওয়া খেয়ে পালানোর অভিজ্ঞতা ইংল্যান্ডের সম্ভবত বার্মা বা মিয়ানমার ছাড়া আর কোথায়ও হয় নাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ইংল্যান্ডকে পরাজিত হয়ে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল মূলত স্বজাতীয়দের হাতে পরাজয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপ থেকে অভিবাসীরা গিয়ে অভিবাসন করেছিল। সুতরাং তাদের বিদ্রোহ ছিল মূলত একই জাতির মূল ভূমি থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্য বিদ্রোহ। তবু এই বিদ্রোহে রাজতন্ত্রের কোন জায়গা থাকে নাই। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজতন্ত্রের বদলে প্রজাতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
যাইহোক, ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে হয় সেখানে তা জন্ম নিয়েছিল একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তি রূপে। সামন্ত শাসিত গ্রামগুলোর বাইরে শহরগুলোতে বাণিজ্য ও কারখানা শিল্পের উদ্যোক্তা রূপে এই শ্রেণীর উদ্ভব। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নূতন নূতন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন, বাণিজ্যের প্রয়োজনে নূতন নূতন দেশ ও মহাদেশ জয় ও আবিষ্কার, পাল তোলা উন্নততর জাহাজ ও উইন্ডমিল থেকে যন্ত্রের ক্রম বিকাশের মাধ্যমে বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তা ক্রমাগত এগিয়েছে ক্রমবর্ধমান শক্তি ও তেজ নিয়ে। সামন্তবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে তা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সামন্ত অর্থনীতির ভিত্তি পশ্চাৎপদ কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিক যান্ত্রিক কৃষি ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করেছে।
এই শ্রেণীর আদি পুরুষেরা মধ্যযুগের অন্ধকার বিদীর্ণ করে জ্বালিয়েছিলেন রেনেসাঁর আলো। এই আলো জ্বালাতে গিয়ে তাদেরকে ধর্মকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল। কারণ মধ্যযুগের অন্ধকারের মতাদর্শিক ভিত্তি ছিল ধর্ম। এই শ্রেণী তাই ধর্মকে কখনও নিজ উপযোগী করতে চেয়ে তাকে সংস্কার করেছে, কখনও তাকে সম্পূর্ণরূপে বিরোধিতা করেছে এবং সর্ব ক্ষেত্রেই ধর্মের শাসনকে নিজ রাষ্ট্র থেকে অপসারণ করেছে। এ এক পরাক্রান্ত শ্রেণী, যা মানব ইতিহাসকে সম্পূর্ণ নূতন রূপ দান করেছে। পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া তাই মানব ইতিহাসের এক মহানায়ক শ্রেণী, যা মানব জাতিকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে তার অনেক ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এক অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছে।
এই শ্রেণী কারও অধীনস্থ নয়। বরং সবাইকে তা অধীনস্থ কিংবা নিজ নেতৃত্বাধীন করে নিয়েছে। বিদ্যমান রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ধর্ম কোনটারই আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে তার বিকাশ নয়। বরং সবগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করেই তার বিকাশ। এবং সবগুলিকেই তা নূতন করে গঠন করেছে কিংবা সংস্কার করেছে। সুতরাং এগুলির কোনটারই তা অধীনস্থ বা সহযোগী কিংবা হাতিয়ার নয়। বরং প্রয়োজনে সবগুলিই তার হাতিয়ার। ধর্মকেও প্রয়োজনে তা ব্যবহার করে। কিন্তু নিজ রাষ্ট্র শাসনে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে রাখে। তাই ব্যক্তির জীবনে ধর্মের যে স্থানই থাকুক রাষ্ট্রীয় আইন চলে জাগতিক নিয়মে।
এই বুর্জোয়াদের সঙ্গে মেলানো যাক আমাদের দেশের তথাকথিত বুর্জোয়াদেরকে। এই তথাকথিত বুর্জোয়াদের উদ্ভব ও বিকাশ তথা উত্থান প্রক্রিয়ায় ধর্মের ভূমিকা যে একটা প্রধান নির্ধারক উপাদান সে বিষয়টা আশা করি ইতিপূর্বেকার আলোচনা থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। এই ‘বুর্জোয়ারা’ তাই ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত ও বিকশিত নয়, বরং তার ভাবধারা ও আশ্রয় পুষ্ট।
ইংল্যান্ডের পুঁজির প্রয়োজনে এখানে ইংরেজ শাসনামল থেকে যে পুঁজির জন্ম ও বিকাশ তা ইউরোপের স্বাধীন ও লড়াকু পুঁজির চরিত্র পাবে কোথা থেকে? এ পুঁজি হল প্রথমে ইংল্যান্ড এবং পরবর্তী কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের বহুজাতিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীনস্থ। হাঁ, এটা নেহায়েতই অধীনস্থ বা পরাধীন পুঁজি। এই অধীনস্থ পুঁজির মালিককে কি বুর্জোয়া বলা যায়? এই ধরনের পুঁজিকে আর একটা শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, সেটা হচ্ছে মুৎসুদ্দি। সুতরাং এ দেশের সম্পত্তিবান শ্রেণীগুলিকে যদি কখনও বুর্জোয়া বলতে হয় তবে বলা উচিত অধীনস্থ বা মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া। বস্তুত মুৎসুদ্দি পুঁজির মালিক কিংবা সম্পত্তিবান অর্থে এটা ধনিক শ্রেণী। এটাকে বুর্জোয়া না বলাই সঙ্গত।
ধর্ম এবং পাশ্চাত্য পুঁজির মত অপর একটি উপাদান এ দেশের ধনিক শ্রেণী গঠনে খুবই নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে যেটাকে চিহ্নিত করতে না পারলে এই মুৎসুদ্দি পুঁজির স্বরূপ উপলব্ধি করা অসম্ভব হবে। সেটি হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ দেশে ধনিক শ্রেণীর বিকাশে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভূমিকা তার জন্মলগ্ন ব্রিটিশ শাসন কাল থেকেই শুরু হয়। অর্থাৎ একটি উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীনে তার জন্ম ও বিকাশের প্রাথমিক কাল অতিবাহিত হয়েছে।
প্রাক ব্রিটিশ শাসন কালে তথা মধ্যযুগেও এ দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল আমলাতান্ত্রিক, যার সামরিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রধান। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালিত হত সেনাবাহিনী এবং সামরিক শাসকের নেতৃত্বে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বাদশাহ্, সুলতান ইত্যাদি পদবীধারী সম্রাট বা রাজারা ছিলেন মূলত সামরিক শাসক। সেনাবাহিনী থাকত তাদের প্রত্যক্ষ পরিচালনায়। মধ্যযুগীয় আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতর থেকে আধুনিক পুঁজি দূরে থাক, কোন ধরনের কার্যকর ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থাও বিকাশ লাভ করে নাই। যাইহোক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজির বিকাশ সম্পর্কে বলতে পারি যে, ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী এ দেশে তার অধীনে পুরাতন সামরিক প্রাধান্যবিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তে এমন একটি নূতন এবং বেসামরিক প্রাধান্যবিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যা এ দেশে ব্রিটিশ পুঁজি ও শাসনের অধীনস্থ ও সহযোগী হিসাবে একটি বিত্তবান শ্রেণী গড়ে তোলে। এই বিত্তবান শ্রেণীর ভিতর উৎপাদনশীল পুঁজি খুবই দুর্বল একটা উপাদান মাত্র এবং এটিও স্বাধীন কোনও সত্তা নয়।
ব্রিটিশ শাসন অবসানের পরেও ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গেল। এই বাস্তবতায় সমাজ অভ্যন্তরে ধর্ম এবং উপরে চাপানো আমলাতন্ত্র এই উভয়ের চাপে এ দেশে স্বাধীন, প্রবল এবং প্রকৃত উৎপাদনশীল পুঁজি এবং বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ অসম্ভব হয়ে থাকে। সুতরাং ধর্ম এবং আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চাপে ন্যুব্জ এবং পাশ্চাত্য পুঁজির অধীনস্থ যে পুঁজিপতি এবং বিত্তবান শ্রেণীকে আমরা এ দেশে দেখতে পাই তাকে আমরা ধর্মীয় বা ধর্মাশ্রয়ী আমলা-ধনিক শ্রেণী হিসাবে উল্লেখ করতে পারি। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই পুঁজির উদ্ভব, বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করায় তাকে আমরা আমলাতান্ত্রিক বা আমলা পুঁজি বলতে পারি। ধর্মের আশ্রয় বা সাহায্যে কিংবা আবেষ্টনে গড়ে ওঠে বলে তা ধর্মীয় বা ধর্মাশ্রয়ী। নিজের দুর্বলতা বা পঙ্গুত্বের কারণে এই পুঁজি পাশ্চাত্য পুঁজির অধীনে থাকতে বাধ্য হয় বা তাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং ধর্ম এই দুইটি তাই এ দেশে পাশ্চাত্য রাষ্ট্র ও পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য রক্ষায় খুবই সহায়ক দুইটি হাতিয়ার।
এ দেশে ধর্মাশ্রয়ী আমলা-ধনিক পুঁজি বা শ্রেণী গঠনে দুইটি পদ্ধতির সঙ্গে আমরা বিশেষ ভাবে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিচিত। একটি সামরিক, অপরটি রাজনৈতিক বা তথাকথিত গণতান্ত্রিক। সামরিক শাসনের সময় রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য নিরংকুশ রূপে প্রকাশ পায়। তখন সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ও নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণরূপে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। কিন্তু নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক শাসন কালে বেসামরিক আমলারা জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে শাসন করলেও শাসন কেন্দ্রে নির্বাচিত সরকার ও সংসদ থাকে। কিন্তু সামরিক অথবা রাজনৈতিক সকল পর্যায়েই অব্যাহত থাকে পুলিশী এবং সন্ত্রাসী আমলাতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি। এই শাসন পদ্ধতিকে ব্যবহার ক’রে ক্ষমতাসীন রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ীরা অর্থ-বিত্ত সংগ্রহ করে। এই শ্রেণীর প্রধান অংশই লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, নীতি-নৈতিকতাহীন এবং সন্ত্রাসী। সুতরাং এটি মর্মগতভাবেই একটি দুর্বৃত্ত শ্রেণী।
এই শ্রেণীর বিকাশে এ দেশে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম উচ্চবর্গ বা এলিট এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী বাঙ্গালী জাতি ভিত্তিক অখণ্ড রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন না করে ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিল। মুসলমান তখন শিক্ষায়, সম্পদে অনেক পিছিয়ে থাকলেও সংখ্যার জোরে বিশেষ করে নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থার কারণে অখণ্ড বাংলার নেতৃত্ব যে তাদের হাতেই চলে যেত এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন কারণ নাই।
সংখ্যালঘু ধর্ম-সম্প্রদায় হলে না হয় তাদের বাংলা ভাগের আন্দোলনের যৌক্তিকতা খোঁজার চেষ্টা করা যেত। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে না গিয়ে গেল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পথে। আর এর মধ্য দিয়ে আধুনিক কালে একটা দুর্বৃত্ত শ্রেণী রূপে আত্মবিকাশের পথে বাংলার মুসলমান উচ্চবর্গ এবং উদীয়মান মধ্য শ্রেণী ১৯৪৭ সাল থেকে যাত্রা শুরু করল।
যাদের উত্তরাধিকার নিয়ে এ কালে এই শ্রেণীর যাত্রা শুরু তাদের পূর্বসূরি বহিরাগত মুসলমান শাসক অভিজাত বা আশরাফ শ্রেণী প্রকৃতপক্ষে একটা হানাদার এবং লুণ্ঠনজীবী শ্রেণী ছাড়া আর কিছু ছিল না। তাই যুদ্ধ বিদ্যা বাদে আর প্রায় সকল ক্ষেত্রে তারা তাদের হিন্দু প্রজাদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। যে ফার্সী ভাষায় তারা রাজকার্য পরিচালনা করত সে ভাষাতেও তাদের খুব কম সংখ্যকেরই দক্ষতা ছিল। হিন্দুরা এ ভাষা শিখে নেওয়ায় দাফতরিক কাজে সাধারণত হিন্দুদেরকে নিয়োগ দেওয়া হত। শিক্ষা এবং নির্ভরযোগ্যতার কারণে রাজস্ব বিভাগ পরিচালনায় হিন্দুদেরকে খুব বেশী গুরুত্ব দেওয়া হত। বিশেষ করে মোগল ও নওয়াবী আমলে আমরা রাজস্ব বিভাগে হিন্দুদের নিরংকুশ প্রাধান্য সম্পর্কে জানতে পারি। বাণিজ্যও ছিল সাধারণভাবে হিন্দুদের হাতে। অবশ্য আরবী ভাষা শিক্ষায় মুসলমানদের অগ্রগামিতা ছিল। তবে সেটা ধর্মীয় শিক্ষা হিসাবে। সংস্কৃতের টোলের পণ্ডিতের মত মুষ্টিমেয় পণ্ডিত বা আলেম আরবী ভাষার চর্চা করত, যার সঙ্গে দৈনন্দিন কাজকর্মের সম্পর্ক ছিল না। এটা ধর্মের বাইরে আর কোন জ্ঞানের বাহন ছিল না। আলেমদের তবু আরবী ভাষার মানে কিছু হলেও জানতে হত। বাকিদের জানার দৌড় তো নামাজ বা প্রার্থনার জন্য তোতা পাখীর মত কিছু আরবী শব্দ উচ্চারণ পর্যন্ত।
অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাংলায় আগত মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে সাধারণ ভাব বিনিময়ের জন্য হিন্দীর আদি রূপ হিন্দুস্তানীকে অবলম্বন করে উত্তর ভারতে গড়ে তোলা উর্দূ ভাষা শিখে নিয়েছিল। তবু এখানে এটা শিক্ষার বাহন সাধারণভাবে ছিল না। এটা ছিল মূলত আশরাফ বা উচ্চবর্গের নিজেদের ভিতর কথ্য ভাষা হিসাবে প্রচলিত।
এই হল বহিরাগত মুসলমান শাসনামলে মুসলমান উচ্চবর্গের অবস্থা। এদের গরিষ্ঠ অংশের না ছিল শিক্ষা, না ছিল উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ড, না ছিল বাণিজ্য, না ছিল উন্নত চরিত্র ও চিন্তা। তাহলে এতদিন এরা এ দেশ শাসন করল কীভাবে? এক কথায় এর উত্তর অস্ত্রের জোরে। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, শুধু অস্ত্রের জোরে দেশ জয় এবং দীর্ঘ কাল শাসন করা যায় কি? করা যে যায় এমন উদাহরণ পৃথিবীতে অজস্র আছে। করা যায় যদি থাকে যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শিতা, আক্রমণকারীদের ভিতর দৃঢ়বদ্ধ সাংগঠনিক-সামাজিক সংহতি এবং সাহস। এ দেশের হিন্দুদের ভিতর অভাব ছিল এগুলিরই, যার জন্য দায়ী তাদের বিশেষ ধর্ম এবং এই ধর্ম নির্ভর বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ সংস্থা। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বাংলার অস্থিতিশীল ভূ-প্রকৃতির প্রভাব। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বহিরাগত মুসলমানদের ভিতর বিভক্তি বা বিভাজন থাকা সত্ত্বেও বিশেষ ধর্ম তাদেরকে যে সাংগঠনিক তথা সামাজিক সংহতি দিয়েছিল তার জোরে তারা নিতান্ত সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও অজস্র ভাগে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন বিপুল সংখ্যাগুরু হিন্দুদের উপর শত শত বৎসর আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিল।
কিন্তু যে ধর্মের ভিত্তিতেই এ দেশে আসুক বহিরাগত এই শ্রেণীটি আসলে কী? এটা একটা হানাদার এবং লুণ্ঠনজীবী শ্রেণী। এ দেশে তাদের কোন কোন শাসক কিংবা ব্যক্তির যত মহত্ত্ব বা গুণ থাকুক শ্রেণীটি লুণ্ঠনজীবী মাত্র। আর কোন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও প্রধানত অস্ত্র ক্ষমতার জোরে যারা বাহির থেকে এসে একটা দেশ শাসন করে তারা মূলত লুণ্ঠনজীবী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। এইখানে ২/৪ জন ব্যক্তি ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তা দিয়ে মূল শ্রেণীটির চরিত্র পরিবর্তন হতে পারে না। গায়ের জোরে এ দেশ দখল করে গায়ের জোরে টিকে থাকার উপরই যে তাদের অন্তত গরিষ্ঠ অংশের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল সেটা বোঝা যায় সমাজের অন্যান্য পেশায় তাদের হীনতা বা ন্যূনতা থেকে।
কিন্তু দুর্বল আদি বাঙ্গালীদেরই উপর এদের যত বীরত্ব। তাই ইংরেজদের শক্তি দেখে তাদেরকে মোকাবিলা না করে চক্রান্তের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে তারা তাদের নওয়াব আর রাষ্ট্র সবই তুলে দিল। এই বহিরাগত, লুণ্ঠনজীবী মুসলিম চক্রের বংশধর এবং তাদের ধর্ম ও ভাবাদর্শের এ দেশীয় উত্তরাধিকারীরা পরবর্তী কালে ইংরেজ যাবার কালে স্বাধীন ও অখণ্ড বাংলার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব না নিয়ে হতে চাইল খণ্ডিত বাংলার একাংশের দখলদার। হাঁ, তাহলে যোগ্যতা অর্জনের কোন সাধনা না করে এবং বিনাশ্রমে এ দেশের হিন্দুদের সবকিছু দখল করে রাতারাতি বড়লোক হওয়া যায়। হিন্দুর চাকুরী, বাড়ী, জমি, সম্পদ ইত্যাদি সবকিছু জবরদখলের এমন মওকা এরা ছাড়বে কেন? এই শ্রেণীর যে অন্তর্গত লুণ্ঠনবৃত্তি তার জন্য তাদের দরকার ছিল জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত ভাগ করে অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ধর্মের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করা।
অন্যদিকে এ দেশের পশ্চাৎপদ, অজ্ঞ, মূঢ়, বহিঃশক্তির পূজারী, ভাগ্যবাদী এবং ধর্মাচ্ছন্ন সাধারণ মুসলমানদেরকে নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছামত ব্যবহারের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার হিসাবে তারা দেখতে পেয়েছিল ধর্মকে। এই শ্রেণীর প্রতীক হল সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্র উপন্যাস ‘লাল শালু’র নায়ক মজিদ। একটা জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের ভার নেবার জন্য পীরের মাজারের যদি এতই প্রয়োজন হয় তবে সে মাজার উদ্ভাবনের জন্য মজিদদের অভাব কেন হবে?
তবে এই মজিদরা একালে এসে অনেকেই ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং অনেকে আবার স্যুট-টাইয়ে অভ্যস্ত। এদের অনেকে প্রয়োজনে কখনও সেকিউলার, কখনও ধর্মভীরু। অনেকের আবার ইসলাম চর্চা ও রক্ষার জন্য জিহাদের পাশে নিয়মিত মদ্যপান ছাড়া চলে না। মনে রাখতে হবে এটা এমন একটা শ্রেণী যাদের মধ্যে মুখের কথায় যত পার্থক্য এবং নিজেদের মধ্যে যত দলাদলি ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাক কাজে এবং চরিত্রে এদের মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নাই। সহজে, বিনা শ্রমে অথবা অল্প শ্রমে, নীতি-নৈতিকতাহীনভাবে দ্রুত বিপুল অর্থ-বিত্তের অধিকারী হতে গিয়ে এই শ্রেণী দুর্নীতি, প্রতারণা, মিথ্যাচার, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, আত্মবিক্রয় এবং দেশের স্বার্থ বিক্রয় ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আজকের দুর্বৃত্ত শ্রেণীর পূর্ণাবয়ব নিয়েছে। তারেক রহমান, গিয়াস উদ্দীন আল মামুন তো এই শ্রেণীরই আদর্শ নায়ক। রাতারাতি বড়লোক হবার যে দৃষ্টান্ত বা আদর্শ তাদের পূর্বসূরি বা অগ্রজরা স্থাপন করেছিল সেই আদর্শের পথ অনুসরণ করেই এদের উত্থান।
এই শ্রেণীর পরিণতিরও প্রতীক এরা। এদের কাল যে ফুরিয়ে এসেছে সেটা স্পষ্ট। এরা এখন যাবে। কিন্তু দেশটাকেও সাথে করে নিয়ে যাবে না তো? আড়াইশ’ বছর আগে এদের পূর্বসূরিরা মীর জাফরের নেতৃত্বে চক্রান্তের মাধ্যমে পরাধীনতা বেছে নিয়েছিল। তেমন চক্রান্ত যে আজও নাই তা-ই বা বলি কী করে? এ দেশের পূর্ববর্তী সরকারগুলো বিদেশীদের সঙ্গে দেশের স্বার্থ পরিপন্থী যে সকল চুক্তি বিভিন্ন সময় করেছিল তা নিয়ে অনেক কথা এ দেশে উঠেছে। বিশেষত ২০০১-এ ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকার করিডোর, গ্যাস, বন্দর বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চেয়েও পারে নাই জনগণের বাধার কারণে। কিন্তু যেগুলো দিয়েছে সেগুলোই বা কম কী? দিয়েছে গ্যাস ও কয়লা উত্তোলনে বিশেষ সুবিধা, দিয়েছে রূপালী ব্যাংক কিংবা ধ্বংস করেছে পাট শিল্পের সবচেয়ে বড় স্থাপনা আদমজী পাটকল।
১১ জানুয়ারীর পট পরিবর্তনের পর শুরু হল দেশের সমুদ্র বন্দর, গ্যাস, বিমান বন্দর, ব্যাংক ইত্যাদি বিদেশীদের হাতে তুলে দেবার নবতর উদ্যোগ। মুহামমদ ইউনূস তো নোবেল পুরস্কার হাতে নিয়েই ছুটে এলেন এ দেশের সব কয়টা দরজা-জানালা-বেড়া-প্রাচীর খুলে ভেঙ্গে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-অর্থনীতি সবকিছু বিদেশের কাছে তুলে দেবার দায়িত্ব পালন করতে।
হাঁ, এ দেশের অস্তিত্বকে ঘিরে যে চক্রান্ত চলছে সেটা সপষ্ট। আর এই চক্রান্তে যোগ দেবার জন্য এ দেশের শাসকদেরই একটা অংশ, এমনকি সেটা অনেক সময়ই যে গরিষ্ঠ হয়, মুখিয়ে থাকে এই বাস্তবতাকে ১৭৫৭-এর পলাশীর অভিজ্ঞতার পর এবং ১৯৫৬-’৫৭ এর ‘শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে’ এবং ‘০+০+০=০’ এই বক্তব্য দেবার পর অস্বীকার করি কী করে?
এমন কি আজ থেকে প্রায় নয় শত বৎসর পূর্বে আনুমানিক ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে বহিরাগত মুসলিম হানাদারদের দ্বারা বাংলার স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নবদ্বীপ প্রায় বিনা যুদ্ধে দখল চক্রান্ত ও বিশ্বাসঘাতকতার ফল কিনা তা নিয়ে আমার মনে প্রবল সন্দেহ আছে। কথিত আছে তুর্কী হানাদার বখতিয়ার খলজী রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নবদ্বীপে অশ্ব ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে দিনের বেলায় মাত্র ১৮ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রবেশ করে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করেন। এই সংবাদ শুনে লক্ষ্মণ সেন যুদ্ধ না করে রাজপ্রাসাদের খিড়কির দরজা দিয়ে গঙ্গা নদী তীরে বাঁধা নৌকায় উঠে পূর্ব বঙ্গের দিকে পলায়ন করেন।
মানলাম লক্ষ্মণ সেন বিনা যুদ্ধে পালিয়ে ছিলেন। এবং তখন তাঁর বয়স আশি। কিন্তু বয়স যতই হোক লক্ষ্মণ সেন ভীরু রাজা ছিলেন না। তিনি বহু যুদ্ধজয়ী বীর। সুতরাং তাঁর পালানো আমার কাছে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। কারণ তুর্কী মুসলমানরা তখন উত্তর ভারত জয় করে পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। বাংলার বৃহৎ অঞ্চল ব্যাপী ছিল রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য। নিশ্চয় শুধু রাজ্য রক্ষার জন্য নয়, উপরন্তু রাজধানী রক্ষার জন্যও প্রতিরক্ষার আয়োজন ছিল। অথচ একটা আক্রমণকারী বাহিনীর মূল অংশকে অনেক পিছনে ফেলে রেখে মাত্র ঊনিশ জনের অশ্বারোহী দল বিনা বাধায়, ছদ্মবেশে এবং সবার অজ্ঞাতে রাজধানীতে ঢুকে রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করল! এটা কীভাবে সম্ভব যদি সেনাবাহিনী এবং রাজপুরুষদের অধিকাংশ অথবা এক বৃহদাংশ আগেই আক্রমণকারীদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য গোপন সমঝোতায় না যায়? এটাই যুক্তিসঙ্গত যে রাজা লক্ষ্মণ সেন যখন বুঝেছিলেন যে তাঁর সেনাবাহিনী এবং রাজ পুরুষরা বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক পক্ষ পরিবর্তন করেছে তখন বিনা যুদ্ধে রাজধানী পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ সেনাবাহিনী ছাড়া তিনি যুদ্ধ করবেন কাকে নিয়ে?
সদ্য বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিউটেনিস বিদায় নেবার প্রাক্কালে বাঙ্গালীদের অতিথিপরায়ণতার প্রশংসা করে বলেছিলেন বাঙ্গালীদের চক্রান্তপ্রিয়তার কথা। এতে অনেক ভদ্রলোক খুব ক্ষুব্ধ হন এবং কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন প্রচার মাধ্যমে। তা, আমাদের গুণগুলো শুধু বলতে হবে? দোষ বলা যাবে না? ঠিক আছে, বিদেশীরা বললে আমাদের খারাপ লাগবে। কিন্তু আমরা নিজেরাও কি আমাদের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অন্ধ থাকব? অন্ধ থাকলে কি আমাদের রাষ্ট্রের স্বাধীনতা বিনষ্টকারী যেসব চক্রান্ত চলছে সেগুলোকে আমরা ব্যর্থ করতে পারব? বস্তুত যে কোন চক্রান্ত ব্যর্থ করার জন্য শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে চক্রান্ত ও চক্রান্তকারীদের স্বরূপ উন্মোচন করা। এবং এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বাইরের চক্রান্তের চেয়ে ভিতরের চক্রান্তই বেশী বিপজ্জনক। কারণ একটা রাষ্ট্র থাকলে তার বিরুদ্ধে বাইরে কিছু না কিছু চক্রান্ত থাকতেই পারে। কিন্তু বাইরের চক্রান্ত সহজে ফলপ্রসূ হয় ভিতরে তাতে যোগ দেবার মত শক্তি থাকলে। কাজেই সেদিক থেকে আজ আমাদের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
(৫) স্বাধীনতার সঙ্কট
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন গুরুতর হুমকির সমমুখীন। ১৯৭১-এর পর থেকে বাঙ্গালী জাতির জীবনে অনেক সঙ্কট ও বিপদ এলেও এত বড় সঙ্কট আর বিপদ কখনও এসেছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের বিরাট ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব, গ্যাস-কয়লার মত খনিজ সম্পদ প্রাপ্তি এবং আরও প্রাপ্তির সম্ভাবনা এবং বঙ্গোপসাগরের গর্ভ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বর্গ মাইল তথা বাংলাদেশের কাছাকাছি আয়তনের এক বিশাল ভূখণ্ডের উত্থান প্রক্রিয়া বাংলাদেশের সামনে যেমন বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তেমন এগুলিই এখন তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা সতর্ক না থাকি এবং এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন ও রক্ষার জন্য যোগ্য হতে না পারি।
একটা দেশের স্বাধীনতার বিলুপ্তি বা পরাধীনতার জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা দুর্বলতা প্রয়োজনীয় হয় এমন ধারণা করা হবে ভুল। সমৃদ্ধ একটা দেশও তার রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বের জন্য যে পরাধীন হতে পারে তার দৃষ্টান্তের জন্য এই বাংলা ভূমিই যথেষ্ট।
মোগল ও নওয়াবী আমলে বাংলা ছিল খাদ্যশস্য, ফল, চিনি, গুড়, মধুর দেশ। এ ছাড়া ছিল উন্নত হস্তশিল্প। বিশেষ করে বাংলার মসলিন বস্ত্র ছিল জগৎ বিখ্যাত। বাংলা থেকে বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে চাল, চিনি, গুড়, মধু এবং বিভিন্ন কারিগরী পণ্য রফতানী হত। রফতানী পণ্যের মধ্যে মসলিন বস্ত্রের স্থান ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য নয়, এর বিপুল চাহিদা ছিল ইউরোপেও। বাংলার এই সমৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রের আয়ও ছিল বিপুল। এই রকম একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতি থাকা সত্ত্বেও একটা অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত, লুণ্ঠনপরায়ণ এবং দেশাত্মবোধহীন শাসক শ্রেণীর কারণে এ দেশ ইংরেজদের পদানত হল। এবং সেটা হল এই শাসক শ্রেণীর গরিষ্ঠ অংশের চক্রান্তের মাধ্যমেই এবং প্রায় বিনা যুদ্ধে।
বাংলাদেশে এমন একটা শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে যাদের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর কোন প্রয়োজন নাই। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি বহুকাল ধরে এ কথা অনেককে বলতে শুনেছি যে, এ রাষ্ট্র টিকবে না কিংবা এর কোন প্রয়োজন নাই। এটা যে সবাই হতাশা বা ক্ষোভ থেকে বলেন তা কিন্তু নয়। কারও কারও ক্ষোভ বা হতাশা থেকে কথাটা বেরিয়ে এলেও কেউ কেউ সত্যিই মনে করেন বাংলাদেশ থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না কিংবা মনে করেন এটা না থাকলেই ভাল হবে।
এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশ সচিবালয়ের এক আমলা আমাকে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ টিকবে না।’ তার মতে এটা ভারত নিয়ে নিবে। তারপর এক পর্যায়ে বললেন, ‘আমার অবশ্য কোন চিন্তা নাই। আমার সব কয়টা ছেলেকেই আমি আমেরিকায় সেট্ল করিয়েছি।’ আজ থেকে প্রায় বারো বৎসর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের কাছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার প্রয়োজনের কথা বললে তার উত্তরে তিনি আমাকে যে কথা বললেন তা আমার হুবহু মনে আছে, ‘কী যে বলেন, মানিক ভাই! আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে রাষ্ট্রের সীমান্তের কী প্রয়োজন?’ রাষ্ট্র, জাতি ইত্যাদি ধারণা যে পশ্চাৎপদ এমন বক্তব্য বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে জানার সুযোগ আমার আরও হয়েছে।
তা ঠিক, রাষ্ট্রের কী প্রয়োজন! এদের অনেকের অর্থ চলে গেছে ইউরোপ-আমেরিকায়। অনেকেরই পরবর্তী প্রজন্ম আর এ দেশে নাই। এদের অনেকে নিজেরা পাশ্চাত্যের নানান দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে রেখেছে। অনেকে নানান কাজে দিল্লী, লন্ডন, নিউইয়র্ক ঘুরে বেড়ান যখন তখন। নানান অর্থকারী কাজে তাঁরা ঘুরেন। কেউ বিদেশীদের সঙ্গে ব্যবসা করেন, কেউ কনসালটেন্সি করেন, কেউ এ দেশের বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করলেও ছুটি নিয়ে মাঝে মাঝে বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তি ভিত্তিক চাকুরী করেন।
বাস্তবিক, এদের কাছে বাংলাদেশের অর্থ নাই। উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র গড়ার জন্য স্বপ্ন দেখা এবং তার জন্য প্রাণপাত করার তো প্রশ্নই ওঠে না। বৃহৎ কিছুই এরা গড়ে না। এরা সব সময় তৈরী জিনিস খোঁজে এবং দেখতে পেলে তাতে ভাগ বসায়। রাষ্ট্র রক্ষা ও পরিচালনার ঝুঁকি ও ঝামেলা এড়াতে চেয়ে এদের পূর্বসূরিরা ব্রিটিশদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আবার ব্রিটিশের ভাগ করো, শাসন করো নীতির প্রয়োজনে প্রায় বিনা শ্রমে ও বিনা ত্যাগে এদের পাকিস্তান পাওয়া। তারপর যা কিছু পেয়েছে প্রায় সবই বিনা শ্রমে বা স্বল্প শ্রমে পেয়েছে। হিন্দু বাঙ্গালীর তৈরী করা প্রায় সবকিছু এরা দখল এবং ভোগ করেছে। এর পর বাংলাদেশও এরা প্রায় বিনা শ্রম অথবা স্বল্প শ্রম ও স্বল্প ত্যাগে পরের সাহায্যে পেয়েছে। সেখানেও কাজ করেছে বিহারী ও উর্দূভাষীদের সম্পদ লুণ্ঠনের এবং তাদেরকে তাড়িয়ে রাতারাতি বড়লোক হবার প্রেরণা। স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি গড়ায় কোন ভূমিকা না রেখেই অবস্থার চাপে যুদ্ধে যোগ দিয়ে এরা তার সকল কৃতিত্বের দাবীদার হয়। অবশ্য ভারতের আশ্রয় ও সমর্থন সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর এদের প্রায় সবার যোগদান। এভাবে স্বাধীনতার রাজনীতি যারা গড়েছে তাদেরকে ধ্বংস করে তাদের সকল শ্রম ও আত্মদানের ফল এরাই আত্মসাৎ করেছে। যুদ্ধের ফলে যারা মূল্য দিয়েছে তারা এই লুণ্ঠনজীবীরা নয়। বেশীর ভাগই হিন্দু, বামপন্থী এবং সাধারণ মানুষ।
না, এরা তৈরী করে না। এদের চরিত্রেই সেই জিনিস নাই। এরা চরিত্রগতভাবে লুণ্ঠনজীবী। প্রকাশ্যে লুণ্ঠনের সুযোগ না পেলে এরা চুরি করে। এরা নিজেদের স্বার্থে অকাতরে মিথ্যাচার করে, প্রতারণা করে। এরা প্রতারণা ও আত্মসাতের প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় বিশ্বাসঘাতকতা করে।
হাঁ, এরা জাত বিশ্বাসঘাতক। এই লুণ্ঠনজীবী বিশ্বাসঘাতকদের নিকট এ দেশের স্বাধীনতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন তাদের সামনে ইউরোপ-আমেরিকার দরজা খুলে গেছে। সেখানে তারা চলে যাচ্ছে এবং যাবে। তবে এত সহজে সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য এমন দেশ তারা পাবে কোথায়? সুতরাং তারা এখানেও থাকে এবং প্রয়োজনে থাকবে। কিন্তু বিদেশের অমরাবতীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তাদের হাতছানি দেয়। সেখানে বাংলাদেশের মত এত ক্ষুদ্র আর দুর্বল দেশের মানুষ হয়ে সুবিধা পেতে কিছু বেশী সমস্যা হয় না কি? তাহলে ভারতের মত এক বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের আশ্রয়টাই কি বেশী লাভজনক নয়? এতে করে যেমন ভারতের বৃহৎ ধনিক এবং শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে তেমন পাশ্চাত্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বার্গেইন করে সেখানেও নিজেদের সুবিধা বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষত ১১ সেপ্টম্বরের পর থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় মুসলমান পরিচয়ের কারণে যে সমস্যা হচ্ছে তা লাঘবে অ-মুসলিম ভারতের আশ্রয় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ এবং উচ্চবর্গের অনেকের গুরু অথবা পরামর্শদাতা হিসাবে খ্যাত সিরাজুল আলম খান সম্প্রতি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত থাকার দরকার নাই। খুব বেশী হলে যেটা দরকারী সেটা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। তিনি আরও বলছেন, ‘যদি মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় তাহলে রাজনৈতিক সীমান্তের কী প্রয়োজন?’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরাজী পত্রিকা ‘প্রোব’-এর ১৬-২১মার্চ, ২০০৭, ভলিউম ৫, সংখ্যা ৩৪-এ ‘আড্ডা উইথ দাদা’ শিরোনামে সিরাজুল আলম খানের একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এটির আংশিক অনুবাদ ২০ মার্চ ২০০৭ তারিখে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘আমাদের সময়’-এর শেষ পৃষ্ঠায় ‘স্বাধীনতা মানে শুধু বিদেশী তাড়ানো নয় : সিরাজুল আলম খান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত সিরাজুল আলম খানের মতের সঙ্গে আমার গুরুতর মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর এই স্পষ্ট ও অকপট উচ্চরণের জন্য তাঁকে আমি অভিনন্দন জানাই। কারণ এটা এই ধরনের চিন্তার বিরুদ্ধে মতাদর্শিক লড়াই চালাতে সাহায্য করে। বস্তুত এই উচ্চারণ এ দেশের নেতৃত্বকারী শ্রেণীর একটি বড় অংশের চিন্তার প্রকাশ।
কিন্তু তাঁর বক্তব্য প্রসঙ্গে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। তাঁর অনেক ভাবশিষ্যের মতে তিনিই ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের মূল রূপকার, যিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর কয়েক জন অনুসারী নিয়ে গোপন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন। বলা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে এই গোপন নিউক্লিয়াসে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।* নিশ্চয় এটা তাঁরও বক্তব্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তিনি পাকিস্তান ভেঙ্গে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন তার দর্শনগত ভিত্তি কোনটা ছিল? লোকবাদ তথা সেকিউলারিজম নাকি ধর্ম? ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম হলে নিশ্চয় পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রয়োজন হয় না। পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যেই একটা সমাধান খোঁজা যেত। তার জন্য স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট। স্বাধীনতার প্রয়োজন কেন হবে?
----------------------------------------------------------------
* দেখুন : প্রকাশকের কথা, নির্বাচনী ইশতেহার, ড.মুহামমদ ইউনূস-এর ৭-দফা ভিত্তিক ‘শান্তি-চুক্তি’ এবং আমার ১৪-দফা প্রস্তাব, সিরজুল আলম খান, প্রকাশক - মোঃ সাখাওয়াত হোসেন, প্রকাশ স্থানঃ বাড়ী - ৩৪, রাস্তা - ২৭(পুরাতন), ধানমন্ডি, ঢাকা ১২০৯, প্রকাশকাল জানুয়ারী ২০০৭।
----------------------------------------------------------------
রাজনীতিতে ধর্মকে অস্বীকার করে লোকবাদী আদর্শ নিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আর কোনও যৌক্তিকতা থাকে কি? আর ধর্মীয় মতাদর্শ ও তার ধর্ম-সম্প্রদায়গত পরিচয়ের বিপরীতে লোকবাদ নিয়ে দাঁড়াতে গেলে স্বাভাবিকভাবে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নটি কি সামনে চলে আসে না? অর্থাৎ সামনে চলে আসে পাকিস্তানবাদ তথা ইসলামী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এটা হচ্ছে ইসলামী বা মুসলমান সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রের বিপরীতে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়। আর এভাবে যখনই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন সামনে আসে তখন সামনে আসে ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে বাংলা ও বাঙ্গালীকে বিভক্তির রাজনীতি ও ভাবাদর্শকে প্রত্যাখান করার প্রশ্নও। বস্তুত এ ছাড়া বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বলা আত্মপ্রতারণা অথবা পরপ্রতারণার নামান্তর। এই কাজটিই এ দেশে এ যাবৎ কাল করে আসা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি বাংলা ও বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের যৌক্তিক এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের ধারেকাছেও আছে? যদি না থাকে তবে কি ষাটের দশকের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও আজ অবধি অসমাপ্ত ও অপূর্ণাঙ্গ নয়? মূল যে কাজ অসমাপ্ত রয়েছে তাকে সম্পূর্ণ করার কাজ বাদ দিয়ে রাষ্ট্রটিই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে সুতরাং এখন এটাকে ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এমন বক্তব্যদানকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?
তাহলে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের দাবী যদি সত্যিই হয় যে তিনি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গোপন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন তবে তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে তিনি উন্নত ও লোকবাদী কোন দর্শন চিন্তা থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার রাজনীতি করেন নাই? বরং তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে কোনভাবে পাকিস্তান ভাঙ্গা। যদি পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বা যে নাম দিয়ে হোক স্বাধীন রাষ্ট্র করাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে দর্শনগত ভিত্তির অভাবের কারণে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে ভারত-রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়া এই ধরনের রাষ্ট্রের আর কোন্ গতি থাকে?
না, আমি এ কথা বলি না যে রাষ্ট্র, জাতি বা জাতীয়তা কোনটিই চিরন্তন সত্তা। সবই সময় ও মানুষের প্রয়োজনে আসে আবার সময় ও মানুয়ের প্রয়োজনে যায়। সুতরাং বাংলাদেশও এক সময় রাষ্ট্র হিসাবে না থাকতে পারে। কিন্তু সেটা কি স্বাধীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলে যে আদর্শ ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক চাহিদা ক্রিয়াশীল ছিল সেটার পরিপূর্ণতা সাধন না করেই এবং বৃহত্তর আয়তনে বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির অধিকতর বিকাশ সাধন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আয়োজন সমাপ্ত না করেই হতে হবে? ঠিক আছে, আমরা ইউরোপের মত এই উপমহাদেশেও একটা আঞ্চলিক সংঘ বা ইউনিয়ন গঠন করব। কিন্তু ইউরোপের জাতি-রাষ্ট্রগুলির বিকাশ ও পূর্ণতা সাধনের যে স্তরে পৌঁছাবার পর সেখানে এই কাজে হাত দেওয়া হয়েছে আমরা কি সেই স্তরে পৌঁছাবার অনেক পূর্বেই সেই কাজে হাত দিতে চেষ্টা করব? এবং এ প্রসঙ্গেও মনে রাখতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলির প্রত্যেকটিই তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছে। ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন অর্জন তাদের কারোরই লক্ষ্য নয়।
হয়ত ভবিষ্যতে এক সময় বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ সম্পন্ন করার পর ভারতীয় বা দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রসংঘ কিংবা জাতিসংঘ গঠন করার প্রয়োজন দেখা দিবে। কিন্তু সেটা কি আজ আমাদের ভাবনার বিষয় হবে? আসলে বাঙ্গালীর উন্নত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের যে গুরু দায়িত্ব ইতিহাস আমাদের উপর অর্পণ করেছে সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ও চরিত্র বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চবর্গ বা নেতৃত্বকারী শ্রেণী তথা শাসক শ্রেণীর নাই বলে তাদের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ সিরাজুল আলম খানের নিকট থেকে আমরা এ ধরনের বক্তব্য পাই।
(৬) সমাজের সঙ্কট
বস্তুত বাংলাদেশের সঙ্কটের মূল শুধু উচ্চবর্গের মধ্যে খুঁজে লাভ নাই। এ দেশের জনগণের গরিষ্ঠ অংশের মধ্যেও এর মূল রয়েছে। কৃষক, শ্রমিক এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষসহ নিম্নবর্গের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে যে পশ্চাৎপদতা, ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, মূঢ়তা, যুক্তিবুদ্ধির অভাব, সবকিছু সহজে পেতে চাওয়ার প্রবণতা এবং ধর্মাচ্ছন্নতা রয়েছে তার সুযোগ নেবার মত মানুষের অভাব হবে কেন? সুতরাং যারা যত বেশী জনগণের এইসব দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে পারে তারা সাধারণত তত বেশী উপরে উঠে। এই কারণেও আমাদের দেশের নেতৃত্বকারী শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের কিংবা উচ্চবর্গের এতটা নিকৃষ্টতা। এই শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী জন-সমর্থিত ও বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির নিকৃষ্টতারও এটা একটা বড় কারণ।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এইসব ক্রটি ও দুর্বলতার কারণ নিশ্চয় আছে। এর একটি প্রধান কারণ হচ্ছে ভূ-প্রকৃতি। সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। কিছু পুনরক্তি হলেও বিষয়টা স্পষ্ট করার জন্য বলতে হচ্ছে যে, এই ভূ-প্রকৃতি হাজার হাজার বৎসর ধরে এ দেশের মানুষের জীবনকে অস্থিতিশীল করেছে। নদী তীরের অবিরাম পরিবর্তন বা ভাঙ্গন এবং ভূমি ও জলবায়ুর আর্দ্রতা কোনও কীর্তি বা নির্মাণের দীর্ঘস্থায়িত্বের পথে প্রচণ্ড রকম বাধা হয়ে থাকে। অতীতে এ জলবায়ুতে কাগজ বা চামড়া কিংবা পাতায় লেখা বই বা দলিলপত্র সুদীর্ঘ কাল সংরক্ষণ ছিল অসম্ভব। নদী ভাঙ্গনের দরুন জনবসতির ঘন ঘন ছত্রভঙ্গ ও স্থানান্তরিত হওয়া এবং গ্রন্থ ও দলিলাদি সংরক্ষণ করতে না পারার ফলে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যেমন দুঃসাধ্য হয়ে থাকত তেমন জনগোষ্ঠীকেও করে রাখত সহজেই আত্মবিস্মৃতিপরায়ণ।
অন্য দিকে নদীর অপর একটি প্রভাবের কথা মনে রাখতে হবে। নদী ও জলাভূমির আবেষ্টনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকাকেন্দ্রিক জীবন যাপন মানুষকে করে রাখত ক্ষুদ্র গণ্ডীবদ্ধ। বস্তুত অজস্র নদীর আবেষ্টনে বাংলার সুবৃহৎ অঞ্চল গড়ে ওঠা। প্রতিটি বৃহৎ তো বটেই এমন কি মাঝারী নদীও এক এক এলাকাকে নদীর অপর পারের এলাকা থেকে বহু দূরবর্তী করে রাখত। আজকের মত সেতু, পাকা সড়ক তো আর দূর অতীতে ছিল না। এই অবস্থায় অতীতে বাংলার সাধারণ মানুষের পক্ষে বৃহৎ সমাজ সংগঠন করা ছিল প্রায় অসম্ভব কাজ। এ কাজ যখন হয়েছে তখন সেটা হয়েছে সাধারণত বহিরাগতদের হস্তক্ষেপে।
বস্তুত ভিতর থেকে বৃহদায়তনে সমাজ সংস্থা গড়তে না পারায় বাঙ্গালী বা বাংলার অধিবাসীরা সুদীর্ঘ কাল হয়ে থেকেছে বিদেশী বা বহিরাগতদের অধীনস্থ। নিজেদের দুর্বলতা পূরণ করতে চেয়েও বাঙ্গালীরা হয়েছে বিদেশীদের শরণাপন্ন। তাই শত শত বৎসর ধরে আমরা দেখতে পাই বিদেশী হলেই বাংলায় তার অতি কদর। বিদেশের সবই তার কাছে ভাল এবং আদরণীয়। নিজ ভূ-প্রকৃতির নিকৃষ্টতা ও বৈরিতা তাদের মনে যে হীনমন্যতা জন্ম দিয়েছে তা তাদেরকে এভাবে বিদেশী শক্তিমানদের কৃপাপ্রার্থী করেছে। এটা তাকে দিয়েছে শুধু বাস্তব দাসত্ব নয়, উপরন্তু মানসিক দাসত্বও।
অন্যদিকে এই ভূ-প্রকৃতি বাঙ্গালীকে চিরকাল ভাগ্যবাদী, ভীরু ও অলৌকিক শক্তির করুণাপ্রার্থী করেছে। অবিরাম নদী ভাঙ্গন, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস তার মন ও চরিত্রে অদ্ভূত রকম অস্থিতিশীলতা ও স্ববিরোধ সৃষ্টি করে। সে প্রচণ্ড গতিশীল হয়। কারণ তাকে যে কোন পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়। কিন্তু সে প্রবল বৈরিতা বা প্রবল শক্তিকে মোকাবিলা করার সাহস করে না। কারণ সে জানে নদী যখন তীর ভাঙ্গে, ঝড়-বন্যা, জলোচ্ছ্বাস যখন আসে তখন তার কিছু করার থাকে না কোন রকমে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করা ছাড়া। সে তখন শুধু সময়ের অপেক্ষায় থাকে। নদী ঘর নিয়ে গেলে নূতন চর বা ভূমিতে ঘর বাঁধে। বন্যা-ঝড় সরে গেলে সে তখন তার করণীয় নির্ধারণ করে। এই অবস্থা তাকে যে শুধু সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকা চরিত্রের অধিকারী করে তা-ই নয়, উপরন্তু তাকে করে ভীরু, ভাগ্যবাদী, অলৌকিক শক্তির করুণা প্রার্থী এবং ধর্মাচ্ছন্ন।
এমন মানুষ যে ভূ-প্রকৃতির অসহায় ক্রীড়নক মাত্র, বৃহৎ সামাজিক ক্রিয়া যার কল্পনা এবং সামর্থ্যের বাইরের বিষয় সে কী করে যুক্তিবাদী হবে, বৃহৎ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের বিষয় নিয়ে ভাববে? তার জন্য শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করার তো প্রশ্নই উঠে না। ব্যক্তিগতভাবে এই মানুষের অনেক গুণ থাকতে পারে, কিন্তু সামাজিকভাবে সে নিকৃষ্ট। তাই সে অতিথিপরায়ণ হলেও ষড়যন্ত্রপ্রিয়। কারণ তার চরিত্রের দুর্বলতার কারণে সে শক্তিমানের সামনে প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করে না। দ্বিমত হলে সে চুপ করে থাকে বা সম্মতি জানায়। কিন্তু আড়ালে গিয়ে ঘোঁট পাকায় কিংবা শক্তিমানের প্রবলতর প্রতিদ্বন্দ্বী পেলে তার সঙ্গে গোপনে হাত মেলায় বা তাকে সমর্থন দেয়।
তার সব ভাবনাই নগদকে ঘিরে। ঘর ভেঙ্গে গেলে তা নির্মাণ বা মেরামত করতে পারে, ক্ষুদ্র পরিসরে সামাজিক জীবন গড়তে পারে, হয়ত সেটাও অস্থায়ী ভিত্তিতে। কিন্তু বৃহৎ কিছু নির্মাণের স্বপ্ন দেখবে কী করে? তার সব ভাবনা আশু বা নগদ লাভ ও ক্ষতিকে ঘিরে। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সামাজিক কল্যাণের জন্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান তাই কয়জন দেয়? এ জীবনকে সুন্দর ও মহৎ করার জন্য কিছু দিতে তার নিদারুণ কার্পণ্য। অথচ রাস্তার ধারে মসজিদ বা মাদ্রাসার জন্য চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে মাইকে চীৎকার করতে পারলে বাস থামিয়ে হলেও যাত্রীরা তাতে দান করার জন্য উন্মুখ থাকে। কারণ তাতে মৃত্যুর পরপারে নগদ লাভের সমূহ সম্ভাবনা! কল্পনার মহাশক্তিকে খুশী করতে পারার এমন সুযোগ কয়জন হাতছাড়া করতে চায়?
এটা ঠিক যে ভূ-প্রকৃতির বৈরিতা আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির কল্যাণে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে কমতে শুরু করেছে। সেতু, বাঁধ, রাস্তা, রেলপথ ইত্যাদি নদীগুলির স্বেচ্ছাচার এবং প্রতিবন্ধকতাকে অনেকাংশে দূর করেছে। ফলে বৃহৎ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের মত চিন্তা ও কর্মকাণ্ড দাঁড়াবার মত কিছু করে জমি পাচ্ছে। পাকিস্তান আমলে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬০-এর দশকে স্বাধীনতার আন্দোলন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ তার ফলে সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু এই পরিবর্তন বাঙ্গালীর জীবনে তুলনায় খুব সাম্প্রতিক ঘটনা। অপর দিকে এই পরির্তনের সপক্ষে সমাজের ভিতর থেকে যে মতাদর্শ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠা অত্যাবশ্যক তার পথে একটা প্রধান বাধা পূর্ব থেকে সমাজে ক্রিয়াশীল হয়ে থেকেছে। সেটা হচ্ছে ধর্ম। বস্তুত এ দেশের ভূ-প্রকৃতি এবং সমাজ সংগঠনের দুর্বলতা জনগোষ্ঠীর চরিত্রে যে নিকৃষ্টতা সঞ্চার করেছে তাকে আরও বৃদ্ধি করেছে ধর্ম। বিশেষত ইসলাম ধর্ম এ দেশে যে প্রক্রিয়ায় এসেছে তার কারণেও এই নিকৃষ্টতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম বহিরাগত হানাদার ও লুণ্ঠনজীবীরা অস্ত্রের বলে এ দেশে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলাম প্রসারের ভিত্তি রচনা করেছে। এটা স্বাভাবিকভাবে সমাজ বিকাশের গতিধারায় অশুভ প্রভাব ফেলেছে। শুধু তাই নয়, ইসলাম প্রচারকারী অনেক পীর বা আউলিয়ারা যে সশস্ত্র অনুচর বেষ্টিত যোদ্ধা ছিল সে কথাও আমাদের জানা উচিত। শুধু সিলেটের শাহ জালাল বা দিনাজপুরের চেহেল গাজী বা চল্লিশ গাজী নন বহু সংখ্যক পীরই ছিলেন যোদ্ধা ধর্ম প্রচারক যাঁরা ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনে অস্ত্রও ধরতেন বা যুদ্ধ করতেন।
তবে এ রকম অনেক ধর্ম প্রচারক উত্তর ও দক্ষিণ ভারত চষে বেড়িয়েও বিশেষ সুবিধা করতে পারেন নাই। বহিরাগত মুসলিম শাসন কেন্দ্র উত্তর ভারতের দিল্লীতে প্রায় সাত শত বৎসর থাকার পরেও ঐ অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসার তুলনায় নগণ্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে হয়েছে। অথচ বাংলায় তা এমনভাবে বিস্তার লাভ করল কেন?
এর নানান ব্যাখ্যা নানান জন দিয়েছেন। সেগুলো নিয়ে এখানে আলোচনার প্রয়োজন নাই। তবে রিচার্ড এম ইটন নামক জনৈক পাশ্চাত্য পণ্ডিত এক অভিনব আবিষ্কার করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন! শুষ্ক অঞ্চল এবং মরুভূমি থেকে আসা এই পীরেরা নাকি বাংলায় জলাভূমির ধান চাষের (wet rice cultivation) বিস্তৃতি ঘটিয়ে এখানে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে যে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তার ফলেই নাকি এখানে ইসলামের এই প্রসার!*
----------------------------------------------------------------
* Eaton, Richard M. 1994, The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760. Delhi : Oxford University Press.
----------------------------------------------------------------
অভিনব আবিষ্কার বটে! মানুষ ও সমাজ বোঝার চেষ্টা না করে অর্থনীতির ভিতর সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা পাণ্ডিত্যের এমন গর্ভস্রাবই ঘটায়!
না, বাংলায় ইসলাম প্রসারের জন্য জোর-জবরদস্তির বিশেষ প্রয়োজন হবার কোন কারণ ছিল না। একবার অস্ত্রের জোরে বাংলা জয় করতে পারলেই হল। তারপর শক্তিমান বিজয়ীর ধর্ম গ্রহণ করতে এ দেশে জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশের মধ্যে হুড়াহুড়ি শুরু না হওয়াই তো বিস্ময়কর! অবশ্য সেই ইসলামও তাদের মত ইসলাম যার সঙ্গে ইসলামী রীতিনীতি ও অনুশাসনের প্রায় কোন সম্পর্কই সুদীর্ঘ কাল ছিল না। ছিল না বলে সাধারণ মুসলমান এ দেশে সুদীর্ঘ কাল তার প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে প্রায় একাকার হয়ে থেকেছে। এই মুসলমানদেরকে যে ইংরেজ শাসনামলে বিভিন্ন রক্ষণশীল সংস্কার আন্দোলন ও প্রয়াসের মধ্য দিয়ে ইসলামের দৃঢ় অনুশাসনের অধীনে আনতে হয়েছে সে বিষয়ে ইতিপূর্বে বলেছি। এইভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা হারানো বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর বংশধর বা উত্তরাধিকারীরা এই গরিষ্ঠ মুসলমান জনগণের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব মজবুত করে। এভাবে ধর্ম হয়ে উঠল তাদের হারানো ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মূল হাতিয়ার।
এই জনগোষ্ঠীর ভিতর জাতি বোধ কোন কালেই ছিল না। বাঙ্গালা নামক সুলতানী রাজ্য বা প্রদেশ কিংবা মোগল প্রদেশে বাস করার সুবাদে বিদেশীদের কাছে তাদের পরিচয় বাঙ্গালী বা বাঙ্গাল। কিন্তু তাদের আত্মপরিচয়ের জন্য ধর্ম বা জাত আর গ্রাম বা শহরের নামের বাইরে আর কী পরিচয়ের প্রয়োজন ছিল? প্রথমে ধর্ম, তারপর ‘জাত’, সেটা হিন্দু-মুসলমান সবার জন্যই প্রযোজ্য। বিশেষত নিম্নবর্গের মুসলমানদের ক্ষেত্রে জাতের পরিচয় হিন্দু সমাজের মতই প্রায় সমান গুরুত্বের ছিল, যেটা অনেক সময় ধর্মের সাধারণ পরিচয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে ইসলামে ‘জাত’ বা বর্ণজাতিভেদের স্থান না থাকায় পরবর্তী কালে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন দ্বারা সেটাকে দূর করে ইসলামী পরিচয়কে সামনে আনা গেছে।
হাঁ, ইসলাম ধর্ম আজও এ বাংলার বাঙ্গালীর পরিচয়ের প্রধান দিক হয়ে আছে। আর তাই এটা তার আবেগেরও সবচেয়ে বড় জায়গা। ধর্মের আবেগ গরিষ্ঠ বাঙ্গালীর কাছে জাতীয়তার আবেগের চেয়ে অনেক বড়। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয়তার আবেগ এ দেশের স্বাভাবিক হুজুগের নিয়মে স্তিমিত হয়ে যেতেই পাক হানাদার আর তার এ দেশীয় দোসরদের প্রতি ঘৃণাও স্তিমিত হতে সময় লাগে না। সুতরাং মুজিবের পক্ষে সম্ভব হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করা এবং দালালদের ক্ষমা করা।
জিয়া এসে এই ধর্মকেই আরও এগিয়ে নেন। যে জাতি বোধের ভিত্তিতে ’৭১-এর যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তাকে বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। অর্থাৎ জাতীয়তার পরিচয়ের জায়গা নিল নাগরিক পরিচয়। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নূতন নামকরণ বাংলাদেশ দ্বারা বাঙ্গালী জাতিকে অস্বীকার করা হল। এটা পাকিস্তানের ইসলামী রাজনীতি ও আদর্শের কৌশলী প্রতিষ্ঠা। অবশ্য সংবিধানে আল্লাহ্য় বিশ্বাস এবং বিসমিল্লাহ্ জুড়ে দিয়ে সেটা কৌশল না করে স্পষ্ট করা হল।
আওয়ামী লীগ কতখানি লোকবাদী বা প্রকৃত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী কিনা সে প্রশ্নে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ অন্তত মুখে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বলতে বাধ্য হয়। এটা না বললে ’৭১-এ তার ভূমিকা নিয়ে গৌরব করার কিছুই থাকে না। কিন্তু এ দেশের গরিষ্ঠ মানুষ যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে নাই তার প্রমাণ ভোট সংখ্যার হার। অন্তত ভোটারদের ষাট শতাংশেরও বেশী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ইসলামী আবেদনের সমর্থক। বিএনপি, জাপা ও জামাতের ভোট একত্র করলেই সেটা সপষ্ট হয়।
অবশ্য এটা ঠিক যে, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে যেভাবে লুটতরাজ, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন করেছিল তাতে করে সাধারণ মানুষের মনে লীগের সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রতিও বিতৃষ্ণা বা ভীতি আসতে পারে। কিন্তু এটাই বাস্তব যে লীগের বিকৃত ও মেকী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জায়গাটা এ দেশে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও লোকবাদী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ নিতে পারে নাই। এ থেকেও গরিষ্ঠ জন-চেতনার মান সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
এই গরিষ্ঠ জনগণের নীতি-নৈতিকতা বোধ উন্নত নয়। ফলে এদের প্রতিনিধিত্বকারীরাও উন্নত নীতি-নৈতিকতা বোধের অধিকারী হয় না। না, গরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারীদের কথা আমি বলছি না। যেহেতু গরিষ্ঠ জনগণ নিজেদের প্রকৃত স্বার্থ ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয় সেহেতু যারা তাদেরকে সে বিষয় সম্পর্কে সচেতন করতে চায় এবং সে কাজকে ব্রত হিসাবে নিয়ে তার জন্য প্রাণপাত করে তাদেরকে তাদের পছন্দ নয়। কারণ মহৎ ও বৃহৎ কিছু অর্জনের জন্য যে শ্রম ও ত্যাগের প্রয়োজন হয় তার প্রতি তাদের নিদারুণ ভয় ও ঘৃণা। সুতরাং ঐসব লোকের কাজের ফল ফলবার অবস্থা দেখতে পেলে সেটার উপর ভাগ বসাতে চেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেও তাদেরকে এই গরিষ্ঠ জনগণের নিজেদের নেতা বা প্রতিনিধি হিসাবে পছন্দ নয়। বরং যারা সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে গরিষ্ঠ জনগণের চিন্তা-চেতনা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বিনা মূল্যে রাতারাতি সব পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় তারাই তাদের প্রতিনিধি বা নেতা হয়।
এই অবস্থায় লীগ-বিএনপি যে গরিষ্ঠ জনগণের সমর্থনে এবং ভোটারদের গরিষ্ঠের ভোটে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসে তাতে বিস্ময়ের কী আছে? এবং ক্ষমতায় এসে এরা যে দুর্নীতির মহোৎসবে নামে তাতেই বা বিস্ময়ের কী আছে? এ দেশে গরিষ্ঠ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে সেটাই তো তাদের জন্য স্বাভাবিক করণীয়!
অনেকের অভিযোগ দলের ভিতর গণতন্ত্র না থাকায় এইসব দলের এই হাল। যেন দলে গণতন্ত্র থাকলে সব ঠিক হয়ে যেত! কিন্তু চোর-ডাকাতদের গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র দিয়ে দেশ ও জাতির কী যায় আসে? দলের ভিতর গণতন্ত্র থাকলে এরা যা করে গণতন্ত্র না থাকলেও তা-ই করে। তার প্রমাণ লীগ-বিএনপি-এর গঠনতন্ত্র। লীগের গঠনতন্ত্র গণতান্ত্রিক। বিএনপি-এর গঠনতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে একনায়কতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? চরিত্রে ও কর্মে উভয় দলে পার্থক্য কতটুকু? এবং বাস্তবে বিএনপি-এর মত লীগও একনায়কতান্ত্রিক।
এ দেশে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায় যে কোন গণভিত্তিক ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল একনায়কতান্ত্রিক হয়ে পড়তে বাধ্য। উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করলেও গরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন লাভ করতে পারলে সেটা একনায়কতান্ত্রিক হতে বাধ্য হবে। যারা এই প্রক্রিয়াকে বাধা দিতে চেষ্টা করবে তারা নিজেরাই মূল ধারা তথা নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়বে। কারণ এটা ব্যক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষ এবং সামাজিক চাহিদার ব্যাপার।
বস্তুত এর উৎস শুধু সমাজের পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা ইত্যাদিতে নাই, বরং এর সবচেয়ে বড় উৎস রয়েছে ইসলাম ধর্ম ও তার সংস্কৃতিতে। ইসলামী মানসের সঙ্গে গণতন্ত্রের মূল প্রেরণার কোন সম্পর্ক নাই। কারণ গণতন্ত্রের মূল প্রেরণা ক্ষমতার বিভাজ্যতা বা পৃথকীকরণ। এই কারণে গণতন্ত্রে ভিন্নতাকে স্বীকৃতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু ইসলামে সকল ক্ষমতা নিরংকুশভাবে এক কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত। কারণ ইসলামে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে আল্লাহ্র ক্ষমতা নিরংকুশ ও অবিভাজ্য। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা আল্লাহ্ সম্পর্কে ধারণার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। ইসলামে এই ক্ষমতার সামান্যতম বিভাজ্যতা বা অংশীদারিত্ব এমন গর্হিত অপরাধ যার কোন ক্ষমা নাই। ভিন্নতার প্রতীক শয়তান তাই ঘৃণ্য। ইসলামের এই চিন্তা পদ্ধতি সবাইকে এক ছাঁচে ফেলতে চায়, যার জন্য সর্বত্র প্রয়োজন হয় একের নিরংকুশ ও প্রশ্নহীন শাসন। এটা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র প্রযোজ্য।
ইসলামের এই ধর্ম-সংস্কৃতির কারণে ইসলামের পৃথিবীতে গণতন্ত্র নাই। যেসব দেশে ইউরোপ-আমেরিকার চাপে অথবা প্রভাবে গণতন্ত্র চর্চার চেষ্টা হয় সেগুলো সবই ‘গ্রীন হাউস কালচার’ বা কাচ ঘেরা ঘরে কৃষির মত একান্ত সীমাবদ্ধ, এবং শো কেসে রাখা প্রদর্শণীর বিষয় মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলি তামাশা এবং সবগুলির ক্ষেত্রেই কোনটাই জন-সমাজে দৃঢ়মূল নয়।
এ দেশে গরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না এমন কমিউনিস্ট বা বামপন্থী দলগুলোর ভিতরই বরং গণতন্ত্রের চর্চা সবচেয়ে বেশী রয়েছে। মার্কসবাদী আদর্শ থেকে উদ্ভূত সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার ধারণাকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও এসব দল প্রয়োগ পদ্ধতি এবং অনুশীলনে বরং যে কোন বৃহৎ দলের চেয়ে অনেক বেশী গণতান্ত্রিক। এ প্রসঙ্গে আমরা ওয়ার্কার্স পার্টি এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নাম উল্লেখ করতে পারি। এদের রাজনীতির ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে আমরা এ প্রসঙ্গে বলতে পারি যে, দল দুইটির পরিচালনায় গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মূল রয়েছে লোকবাদী আদর্শের প্রতি বিশ্বাস ও রাজনীতিতে ধর্মমুক্ত সংস্কৃতির চর্চা। এই একই কারণে পাকিস্তান আমলে আমরা ন্যাপের ভিতর গণতন্ত্রের শক্তিশালী চর্চা দেখতে পেতাম।
গরিষ্ঠ জনগণ বা ভোটার সম্পর্কে আমার এই ধরনের ব্যাখ্যা থেকে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন তবে কি আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না? কিংবা গরিষ্ঠ মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করি না? সে ক্ষেত্রে আমার উত্তর হবে, হাঁ, অবশ্যই আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি! কিন্তু গরিষ্ঠের সম্মতি থাকলেই সেটা আমার কাছে গণতন্ত্র হয় না। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলব, লঘিষ্ঠ-গরিষ্ঠ বলে কথা নয়। আমি সবার অধিকারে বিশ্বাস করি। তবে সেটা অবশ্যই দায়িত্বহীন অধিকার নয়। অর্থাৎ আমি দায়িত্বহীন কিংবা দায়িত্ব বোধহীন অধিকারে বিশ্বাস করি না।
গরিষ্ঠের শাসন কিংবা সমর্থন যদি গণতন্ত্র কিংবা ন্যায়-অন্যায় বিচারের মানদণ্ড হত তাহলে হিটলার গণতন্ত্রী ও ন্যায়বান হন। কারণ তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মানদের ভোটেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। শত্রুরা যে যা-ই বলুক তিনি ছিলেন বিপুল গরিষ্ঠ জার্মানদের প্রাণপ্রিয় নেতা। সুতরাং তিনি গণতান্ত্রিক! না আমাদের এমন গণতন্ত্রের প্রয়োজন নাই।
না, নির্বাচনের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনই সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি অংশ মাত্র। আরও অনেক কিছু নিয়েই গণতন্ত্র। এবং প্রত্যেকটি সমাজ বা জাতি যে তার কল্যাণের জন্য গণতন্ত্রের নিজস্ব রূপ উদ্ভাবন বা প্রতিষ্ঠা করবে সেটাই যুক্তিসঙ্গত। এবং এই রূপও ক্রমবিকাশশীল ও পরিবর্তনশীল। বাংলাদেশের জন্যও আমাদের গণতন্ত্রের সেই রূপ অন্বেষণ করতে হবে যা গরিষ্ঠ জনগণকে ক্রমশ সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলে গণতন্ত্রকে ক্রমবিকাশমান করবে।
কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের জন্য প্রকৃত অর্থে এবং দূর প্রসারীভাবে কল্যাণকর এমন কর্মনীতি ও কর্মসূচীর প্রতি গরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নাও থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর কোন্ ব্যবস্থা বা আদর্শ প্রথমেই গরিষ্ঠের সমর্থন লাভ করে? ভাল অথবা মন্দ যে যা-ই বলুক নূতন আদর্শ বা ব্যবস্থা প্রথমে নিতান্ত সংখ্যালঘুর বিষয়ই হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে এটা গরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে অথবা প্রতিষ্ঠিত হবার পর এটা গরিষ্ঠের জন্য লাভজনক বা কল্যাণকর হয়ে দেখা দিলে এটা তখন গরিষ্ঠের সমর্থন লাভ করে। বস্তুত গণতন্ত্র কোন কোন সময় গরিষ্ঠতার উপর নির্ভর না করে মূলনীতির উপরও নির্ভর করে। জনগণের প্রকৃত কল্যাণবাদী মূলনীতিকে যারা এগিয়ে নিতে পারে তারাই জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি। গণতন্ত্র তাদের মাধ্যমেই আত্মবিকাশ ঘটাতে পারে।
বাঙ্গালী জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নটা এ দেশের জনগণের প্রকৃত কল্যাণের স্বার্থে এমনই একটা মূলনীতির প্রশ্ন যে প্রশ্নে এই মুহূর্তে সংখ্যাগুরুত্ব-লঘুত্বের কোন মূল্য নাই। এবং যারা এই প্রশ্নে অটল থেকে এগিয়ে যেতে পারবে ভবিষ্যৎ তাদেরই হবে। কারণ ইতিহাসের অভিমুখ সেই দিকে। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই আজকের প্রধান করণীয়। বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথও এই প্রশ্নের উত্তর লাভের মধ্যে নিহিত রয়েছে বলে আমি মনে করি।
(৭) বাঙ্গালীর জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের করণীয়
১৯৪৭-এর বাংলা বিভক্তি বাঙ্গালী জাতির যে মহাবিপর্যয় ঘটিয়েছিল তার জের আমরা আজও টেনে চলেছি। এই বিভক্তি এবং ভারত ও পাকিস্তানে বাংলা ও বাঙ্গালীর অন্তর্ভুক্তির ফলে একটা উন্নত ও শক্তিশালী জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর বিকাশ নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বিভক্তির ফলে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী হারিয়েছে কৃষি সমৃদ্ধ পূর্ব বঙ্গ এবং পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী হারিয়েছে তুলনায় শিল্প সমৃদ্ধ পশ্চিম বঙ্গ। বিশেষত ধর্ম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ধারাবাহিক নির্যাতনে হিন্দু বাঙ্গালী যেভাবে পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ড ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তাতে পূর্ব বঙ্গ এবং মুসলমান বাঙ্গালী সবচেয়ে বড় যে সম্পদ হারিয়েছে সেটা হচ্ছে উন্নততর চরিত্র এবং নীতি-নৈতিকতা।
হিন্দু চরিত্রে অনেক দুর্বলতা থাকলেও কতকগুলি ক্ষেত্রে তারা বরাবরই তাদের প্রতিবেশী মুসলমানদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। এর সবচেয়ে বড় কারণ হিন্দু নেতৃত্বের উন্নততর শিক্ষা, চেতনা ও সংস্কৃতিগত অবস্থান। মধ্যযুগে বহিরাগত মুসলিম শাসনামলেও যে হিন্দুরা শিক্ষা, বিভিন্ন ধরনের কারিগরী বৃত্তি, বাণিজ্য ইত্যাদিতে অনেক এগিয়ে ছিল সে কথা ইতিপূর্বে বলেছি। বিদ্যমান ধর্মীয় গোঁড়ামি ভাঙ্গার আন্দোলনও তাদের মধ্যে মধ্যযুগ থেকেই চলতে দেখা যায়। এর বহিঃপ্রকাশ সবচেয়ে প্রবলভাবে ঘটে চৈতন্যের ‘জাত-পাত’ বিরোধী বৈষ্ণব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তবে তখনও বর্ণজাতি ব্যবস্থার বাঁধন সমাজকে শক্তভাবে বেঁধে রেখেছিল। এর ফলে হিন্দু সমাজ থেকে কোন নূতন কিংবা উদারনৈতিক শক্তি প্রবল রূপ নিয়ে দাঁড়াতে পারে নাই। এই অবস্থায় হিন্দুদের পক্ষে নিজ সমাজের রূপান্তর ঘটানো যেমন সম্ভব হয় নাই তেমন বহিরাগত মুসলিম শাসনের সঙ্কট ও পতন কালের শূন্যতা পূরণ করাও সম্ভব হয় নাই। এই শূন্যতা পূরণ করল বিদেশী ইংরেজরা। এ ক্ষেত্রে বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণীর গরিষ্ঠ অংশের মত হিন্দু নেতৃত্বও হল ইংরেজদের সহযোগী। তবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর তাদের পূর্ব থেকেই অর্জিত যোগ্যতা ও অবস্থান বলে তারাই হল এই পরিবর্তনের সুবিধাভোগী। হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত জন্ম নিল এই সময়।
বস্তুত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে হিন্দু বাঙ্গালী সমাজ নূতন যুগ চেতনা নিয়ে জেগে উঠতে শুরু করে ইংরেজ শাসন কালের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে। রামমোহন (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রীঃ), বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) হাত ধরে আধুনিক পৃথিবীর পথে হিন্দু বাঙ্গালীর যে যাত্রা শুরু হয় তার অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাঙ্গালীর ইতিহাসে তার দান অতুলনীয়। যে ভাষাকে অবলম্বন করে জাতি হিসাবে বাঙ্গালী চেতনার বিকাশ সেই বাংলা ভাষা প্রকৃতপক্ষে এই সময়েই বর্তমান রূপ লাভ করে। অতীতে বাঙ্গালীর সাহিত্য বলতে বাংলা ভাষার আদি রূপের কবিতা। অর্থাৎ বাংলা গদ্য প্রায় ছিল না। যেটুকু ব্যবহার ছিল তা ছিল খুব সীমিত। কিছু ক্ষেত্রে চিঠি এবং জমি-জমার দলিল হিসাবে। মধ্যযুগে স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যে রাজকার্য পরিচালনা করার জন্য বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হত। কিন্তু রাজকীয় দলিল বা চিঠিপত্রে যে বাংলা ব্যবহার করা হত তাকে অন্তত আজ আমাদের নিকট সাবলীল ভাষা মনে হয় না।
এ থেকে আমরা প্রাচীন বাংলা ভাষার দৈন্য দশা ধারণা করতে পারি। সাধারণ মানুষের মধ্যে অঞ্চল বা এলাকা ভেদে বাংলার বিভিন্ন রূপের যে প্রচলন ছিল সেগুলোকে অবলম্বন করে কাব্য এবং কাব্যধর্মী পুথিই হচ্ছে আদি বাংলা সাহিত্য। এই জায়গা থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও তার গদ্য সৃষ্টির কৃতিত্ব সম্পূর্ণরূপে কলকাতা কেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের। বিশেষত সাবলীল ও আাধুনিক বাংলা গদ্য সৃষ্টির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব যার তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরকে আাধুনিক বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। সুতরাং আধুনিক বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বর্তমান বাঙ্গালী জাতি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে যদি এ কথা বলা যায় তবে হয়ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বলতে চাওয়া হবে বাঙ্গালী জাতির জনক বা পিতা। তবে সে বলাটা ঠিক হবে না। কারণ জাতি বা জাতিসত্তা গঠনে কোন ব্যক্তি ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তে বিশেষ ভূমিকা পালন করলেও জাতি গঠন একটা দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিকাশ বা বিবর্তনের ফল। ব্যক্তির নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, কিন্তু জাতি বা জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুতরাং আধুনিক বাংলা ভাষা গঠনের যে প্রক্রিয়া অনেক কাল পূর্ব থেকে চলে আসছিল তাকে এ কালের উপযোগী করে একটা পরিণত রূপদানের প্রধান নায়ক হিসাবে আমরা বিদ্যাসাগরকে দেখতে পারি।
যেটাকে বাংলার নবজাগরণ বা নবজাগৃতি বলা হয় সেটাই প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে বাঙ্গালী জাতি চেতনার সূচনা কাল। তার পূর্বে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীত্বের যতটুকু বোধই থাকুক তা তেমন কোন শক্তি ও ব্যাপ্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারে নাই। বাঙ্গালী পরিচয় তখন প্রায় সম্পূর্ণরূপে দিল্লীর সম্রাটদের বাঙ্গালা নামক প্রদেশের অধিবাসী বা বসিন্দা হবার কারণে। এই অধিবাসীদের ভাষাও ছিল নানান ধরনের। রাষ্ট্রের ভাষা ফার্সী। বহিরাগত মুসলিম অভিজাত বা উচ্চবর্গের ভাষা উর্দূ। আর অঞ্চল ভেদে অজস্র আঞ্চলিক ভাষা। প্রতিটি নদী পার হলেই যেন এক একটি ভিন্ন ভাষা। কিছু দূরবর্তী এক এলাকার মানুষের সঙ্গে অপর এলাকার মানুষ একত্র হলে কেউ কারও ভাষা বোঝে না এমনই অবস্থা। নোয়াখালী, চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের ভাষার সঙ্গে উত্তর বঙ্গের মানুষের ভাষার প্রায় কোন মিল ছিল না। রংপুরের মানুষ বাংলার দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষের ভাষার চেয়ে বরং পার্শ্ববর্তী আসাম অঞ্চলের অসমীয়া ভাষার সঙ্গে তার ভাষার বেশী মিল খুঁজে পেত। মেদিনীপুরের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে সিলেট বা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় বরং উড়িষ্যার উড়িয়ার বেশী নৈকট্য। এই হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাষার অবস্থা। এরপর আছে ধর্মের দুই বৃহৎ বিভাজন আর বর্ণজাতি বা ‘জাতের’ গণ্ডীবদ্ধ অগণন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র সমাজ বা গোষ্ঠী। এরপর জাতি বা জাতিসত্তা থাকে কোথায়? জাতি বোধ জাগবে কী উপায়ে?
অবশ্য আধুনিক বাংলা ভাষা গঠনের পূর্ব কালে তার বিকাশে ত্রিপুরা রাজ্য ও পাবর্র্ত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজ্যের রাজাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে মনে হয়। কারণ এই দুই স্বাধীন রাজ্যের রাষ্ট্রভাষা ছিল বাংলা। বিশেষত বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং বাংলাদেশের পূর্বতন বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার একাংশ নিয়ে গঠিত ত্রিপুরা রাজ্য ছিল এক সময় তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী এবং স্বাধীন রাষ্ট্র। সম্ভবত ত্রিপুরার রাজভাষা হিসাবে অবস্থান বাংলা ভাষার প্রাথমিক বিকাশ ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বাংলা ভাষার আদি পর্বের সূচনা কাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতের বিভিন্নতা আছে। হতে পারে সেটা পাল আমল। অথবা সেন আমল। সেটা যখনই হোক বাংলা ভাষার আদি রূপের বিকাশে সেন রাজাদের রাজধানী নদীয়া বা নবদ্বীপের সংস্কৃত পণ্ডিতদের যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তেমনটাই মনে হয়। সম্ভবত সংস্কৃত, পালি এবং বিভিন্ন স্থানিক বা আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে অঞ্চল ভেদে বাংলা ভাষার বিভিন্ন আদি রূপের যে বিকাশ ঘটছিল নবদ্বীপে সেটা একটা বিশেষ রূপ গ্রহণ করেছিল।
সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় দ্বাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপ সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। সংস্কৃত ভাষায় কাব্য, হিন্দু ধর্ম, দর্শন ও ন্যায় শাস্ত্র চর্চায় তখন সেন রাজসভা খ্যাতির শিখরে। সম্ভবত সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রভাবে স্থানীয় দেশজ ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের যে সংমিশ্রণ ঘটে তাতে করে সেখানে স্থানিকভাবে বাংলা ভাষার একটা বিশেষ রূপ গড়ে উঠেছিল। বখতিয়ার খলজীর নবদ্বীপ বা নদীয়া বিজয়ের পর রাজা লক্ষ্মণ সেন পূর্ব বাংলার বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন এবং এখানে তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়। ফলে নবদ্বীপ হতে রাজ-পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সংস্কৃত পণ্ডিতদেরও অন্তত এক প্রধান অংশ যে বিক্রমপুরের রাজসভায় আশ্রয় নেন সেটা বোধগম্য। ইংরেজ শাসনামলে বিক্রমপুর অঞ্চলের হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানানুরাগের যে ব্যাপ্তি দেখা যায় সেটা সম্ভবত সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।
তবে জানা ইতিহাস অনুযায়ী আদি বা প্রাচীন বাংলা ভাষা উল্লেখযোগ্য কোন রাজ্যের রাজ-ভাষার মর্যাদা লাভ করে প্রথমে ত্রিপুরায়। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলেছি। বাংলায় বহিরাগত মুসলিম বিজয়ের পর এখান থেকে অনেক পণ্ডিত ও রাজপুরুষ তৎকালীন বৃহত্তর ত্রিপুরার হিন্দু রাজ্যে আশ্রয় নেন বলে জানা যায়। সম্ভবত সেখানে সংস্কৃত, নবদ্বীপ-বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষা এবং বৃহত্তর ত্রিপুরা রাজ্যের আঞ্চলিক ও লোকজ বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণে আদি বাংলা ভাষার একটি ধারা গড়ে ওঠে যা সেখানে রাজকার্যের ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
অবশ্য কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সেন রাজাদের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর।* এ প্রসঙ্গে তাঁরা সেনযুগের তাম্রশাসনসমূহের কথা বলেন। কিন্তু সেই তাম্রশাসনগুলি কোন সময়কার এবং কোন প্রেক্ষিতে এ কথা না জানলে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। বরং এটা সম্ভব যে বিক্রমপুর ছিল অপ্রধান রাজধানী যেখান থেকে এই তাম্রশাসনসমূহ প্রচারিত হয়। কিংবা রাজধানী নদীয়া এবং রাজ্যের পশ্চিম ও প্রধান অংশ হাত ছাড়া হবার পর নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন বোধ থেকে লক্ষ্মণ সেনসহ পরবর্তী সেন রাজারা পরবর্তী রাজধানী বিক্রমপুর থেকে তাম্রশাসন প্রদান বা প্রচারের উপর বেশী গুরুত্ব দেন, যেগুলি পাওয়া গেছে।
----------------------------------------------------------------
* দেখুন : ড. মুহম্মদ আবদুর রহিম, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. এ, বি,এম, মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস, নওরোজ কিতাবিস্তান , ৫ বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০ পঞ্চম সংস্করণ, মে, ১৯৯৫, পৃষ্ঠাঃ ১৩৪
----------------------------------------------------------------
তবে ঐতিহাসিকরা সাধারণভাবে নবদ্বীপ বা নদীয়াকেই মূল রাজধানী হিসাবে উল্লেখ করেন। আমি নিজেও এই ধারণার সঙ্গে একমত। কারণ সেন রাজ্য বাংলার অধিকাংশ অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত বৃহৎ রাষ্ট্র ছিল। এমন একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কেন্দ্র বা রাজধানী হিসাবে জলাভূমি-জঙ্গল বেষ্টিত, বন্যা ও নদী ভাঙ্গন প্রবণ এবং অস্থিতিশীল চর-ভূমি কেন্দ্রিক বিক্রমপুরকে বেছে নেবার কারণ দেখি না। যাতায়াতের অসুবিধার দরুন এখান থেকে সমগ্র রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা ছিল দুরূহ। বিক্রমপুর একটা বৃহৎ রাজ্যের আউটপোস্ট হতে পারে, কিন্তু রাজধানী হবার উপযুক্ত নয়। বরং সব দিক বিবেচনা করলে নদীয়াই রাজধানী হবার যোগ্য। সুতরাং নদীয়া বা নবদ্বীপকে রাজধানী ধরে নেওয়াটাই আমাদের এই আলোচনার জন্য অধিকতর যৌক্তিক ও নিরাপদ বলে মনে করি। এটাই যুক্তি সঙ্গত যে, নদীয়া পতনের পর বিক্রমপুরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়।
যাইহোক, আমরা মধ্যযুগে বাংলা ভাষার প্রাথমিক উদ্ভব বা বিকাশে কালপরম্পরায় সম্ভাব্য অন্তত তিনটা প্রধান কেন্দ্রের কথা অনুমান করতে পারি, নদীয়া, বিক্রমপুর এবং ত্রিপুরা।
সম্ভবত আদি কিংবা প্রাচীন বাংলা ভাষার ইতিহাসে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ ত্রিপুরাতেই প্রথম। মধ্যযুগে বাংলা ভাষা কোন কোন সুলতান এবং আরাকানের রাজসভার কোন কোন মন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলেও সেটা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে নয়।
রাষ্ট্রভাষার শক্তি ও মর্যাদা আলাদা। সুতরাং এমনটা যুক্তিসঙ্গত যে ত্রিপুরার রাজ ভাষা হবার ফলে বাংলা ভাষার যে মর্যাদা ও গুরুত্ব সৃষ্টি হয় তা প্রাচীন বাংলাকে বিস্তার লাভের শক্তি দেয়।
সম্ভবত ইংরেজ শাসনামলে কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী এই ভাষার একটি রূপের সঙ্গে নিকটবর্তী নদীয়া-শান্তিপুর-চব্বিশ পরগনার আঞ্চলিক ভাষার সম্মিলনে আধুনিক বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটায়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে যে কোন ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দ সম্ভার সবচেয়ে বেশী। কলকাতার এই বাংলাই ক্রমে অবিভক্ত বাংলার সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর অভিন্ন ভাষা হয়ে ওঠে। এবং এভাবে এটা আধুনিক কালে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পরিণত হয়।
ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত কলকাতাকে কেন্দ্র করে নিজেদের জন্য সর্বজনীন ব্যবহারোপযোগী সাহিত্যের ভাষা প্রতিষ্ঠা করে যে কাজটা করল সেটা হয়ে দাঁড়াল বাঙ্গালীর ইতিহাসে জাতি হিসাবে প্রথম প্রকৃত যাত্রারম্ভ। তার অনেক সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা ছিল। সেটা ছিল বিদেশীদের অধীন আরেক পরাধীনতার কাল। ফলে সীমাবদ্ধতা ছিল অনিবার্য। তার উপর ছিল হিন্দু ধর্মের কিছু অন্তর্গত দুর্বলতা, যেমন বর্ণজাতিভেদ। হিন্দু সমাজ ও ধর্মের সংস্কারের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তার মূল ভিত্তি বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থায় বিশেষ কোন আঘাত করতে না পারার ফলে হিন্দু সমাজে যে দুর্বলতা রয়ে গেল তার ফলে তার পক্ষে রাষ্ট্রচিন্তার জায়গায় দৃঢ় পদক্ষেপ দেওয়া সম্ভব হয় নাই। উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে বরং হিন্দু সমাজের আরও ক্ষতি করলেন। কারণ ধর্মের প্রভাবে হিন্দু সমাজ পশ্চাদগামী হল এবং বর্ণজাতিভেদ নবতর শক্তি লাভ করল। ফলে রাষ্ট্র সাধনার জন্য হিন্দু সমাজ অধিকতর অনুপযোগী হল। এভাবে আধুনিক কালে এসে বাংলা ভাষা এবং বাঙ্গালী জাতি গঠনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করে হিন্দু মধ্যবিত্ত আটকে গেল।
এই জায়গা থেকে বাঙ্গালী মুসলমান যাত্রা শুরু করতে পারত। কিন্তু মুসলিম সমাজ ও তার নেতৃত্বকারী শ্রেণী সম্পর্কে যে আলোচনা করেছি তা থেকে তার এই দায়িত্ব পালনে অযোগ্যতা স্পষ্ট হয়েছে। এই নেতৃত্বকারী শ্রেণী বিশেষত মধ্যবিত্ত এক আশ্চর্য স্ববিরোধের ফসল। তাই নিজ বাঙ্গালী সত্তাকে অস্বীকার করে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই বাঙ্গালী সত্তাকে অবলম্বন করে দাঁড়ালো পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। ভাষার চেতনা থেকে এল তার জাতি চেতনা। এই চেতনা থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু ১৯৭১-এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতির নামে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই দেখা দিল জাতিসত্তা ও ধর্মসত্তার প্রশ্নে তার আত্মদ্বন্দ্ব। পুনরায় ধর্ম আসতে শুরু করল তার জাতীয়তা তথা জাতিসত্তার জায়গা নিতে। এই আত্মদ্বন্দ্ব যে শুধু একটা বা দুইটা শ্রেণীর তা-ই নয়, উপরন্তু একটা সমাজ তথা জন-সমষ্টিরও। সবার ভিতর এই আত্মদ্বন্দ্ব ছিল তা আমি বলি না। কিন্তু শাসক শ্রেণী এবং সমাজ বা জনগণের গরিষ্ঠ অংশই এই আত্মদ্বন্দ্বের অধীনস্থ ছিল।
১৯৭৫-এ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বের এক ধরনের নিরসন হল। তবে সেটা আরেক ধরনের আত্মদ্বন্দ্বের সূচনা ঘটালো। জিয়া এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে এই শ্রেণী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র থেকে বাঙ্গালী জাতীয়তাকে বর্জন করল। এভাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আদর্শিক ভিত্তিকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রকে নিরবলম্ব করা হল।
আসলে এক নিদারুণ স্বার্থান্ধ, নীতি-নৈতিকতাহীন ও দায়িত্ববোধহীন শাসক বা নেতৃত্বকারী শ্রেণী হলে যা হয় তা-ই হয়েছে। মুহূর্তেই ভোল পাল্টে ফেলে তা। তার সবটাই নগদ বা তাৎক্ষণিক সুবিধার প্রয়োজনে। কিন্তু এ ধরনের নীতি-নৈতিকতাহীন, সুবিধাবাদী ও ভ্রষ্টাচারী শাসক শ্রেণী যে বেশী দিন টিকতে পারে না সেটা স্পষ্ট। যে প্রতারণা, মিথ্যাচার, অযোগ্যতা, অন্যায় ও ফাঁকির মধ্য দিয়ে এই শ্রেণীর যাত্রাপথ নির্মিত হয়েছিল তাতে করে আত্মদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ধ্বংসই তার স্বাভাবিক পরিণতি। লীগ-বিএনপি-এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এই শ্রেণীর আত্মদ্বন্দ্বকে একটা বিশেষ রূপ দিয়েছে। লীগ-বিএনপি না থাকলে ভিন্নভাবে এই আত্মদ্বন্দ্ব তাকে ধ্বংস করবে।
তবে এই আত্মদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ইতিহাসের অভিমুখ বাঙ্গালী জাতি গঠনের পূর্ণতা ও তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে। বাঙ্গালী জাতি গঠনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এখন এটাকে সম্পূর্ণতা দেবার প্রয়োজন। সেই কাজের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে বাঙ্গালীর পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া। এ কাজে বাধা হয়ে ছিল একটি নীতি-নৈতিকতাহীন যে শাসক শ্রেণী তার এখন চূড়ান্ত সঙ্কট শুরু হয়েছে। সুতরাং বাঙ্গালী জাতি গঠনের পূর্ণতা সাধন ও তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ এখন অনেক সহজতর।
আমি পুনরায় জোর দিয়ে বলতে চাই বাঙ্গালী জাতির একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার নিয়ে ষাটের দশকে স্বাধীনতার গোপন ও প্রকাশ্য আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল ১৯৭১-এ স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল তার ফলশ্রুতি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বাঙ্গালী জাতিকে তার কাঙ্ক্ষিত ফল এনে দিতে পারে নাই। যে জাতি গঠন প্রক্রিয়া ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতা এবং ১৯৪৭-এ বাংলার বিভক্তি দ্বারা বিপর্যস্ত হয়েছিল সেই বিপর্যয় থেকে বাঙ্গালী জাতিকে মুক্ত করে অসমাপ্ত জাতি গঠন প্রক্রিয়াকে নূতন করে এগিয়ে নেবার কাজটিকে উপেক্ষা করা হল। ১৯৭২-এর সংবিধানে সেকিউলারিজম এবং জাতীয়তাবাদকে অন্যতম মূলনীতি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও সেসবই ছিল কাগুজে ঘোষণা মাত্র। তবু বিষয়টিকে অস্বীকার করা হয় নাই যেটা আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সামরিক সরকারগুলি করেছে। জিয়া করেছে, এরশাদ করেছে। আর এভাবে তারা দেশকে নিয়েছে উল্টা পথে।
আজ সেখান থেকে দেশকে পুনরায় বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হবে। এর জন্য শুধু ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা যথেষ্ট নয়, অধিকন্তু বাঙ্গালী জাতি ও বাংলার পুনরেকত্রীকরণকে তার লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু বাঙ্গালী জাতি গঠনের কাজটিকে এগিয়ে নিতে হলে প্রথমেই বাংলাদেশকে বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে হবে। এর ফলে পৃথিবীর সকল বাঙ্গালী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের অধিকারী হবে এবং যারা বাংলাদেশে বাস করতে চাইবে তারা নাগরিকত্ব নিয়ে এ দেশে বাস করতে পারবে।
কিন্তু শুধু এইটুকু দিয়ে বাঙ্গালী জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কাজ ’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি ঘোষণার মত একটি কাগুজে ঘোষণা মাত্র হবে, যদি আমরা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করতে না পারি। এই কর্মসূচী দ্বারা রাষ্ট্রকে বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কারণে উচ্ছেদ হওয়া ভূমি সন্তানদেও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে হবে। এই কর্মসূচী অনুযায়ী বাঙ্গালী জাতির অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে একটি মৌল অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল সেই অঙ্গীকার পূরণ এবং এ দেশ হতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মূলোৎপাটনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পালনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৭-এ ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত, তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ এবং বর্তমান গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে ধর্মের ভিন্নতা বা পরিচয়ের কারণে এ দেশের ভূমি সন্তান হিন্দুসহ যে সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বিতাড়িত অথবা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন তাদের এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের সকলকে এ দেশের নাগরিক হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং তাদের ইচ্ছা সাপেক্ষে সরকারী দায়িত্ব ও ব্যয়ে এ দেশে পুনর্বাসন করতে হবে। এই সঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়সহ ধর্মীয় সংঘালঘু সম্প্রদায়সমূহের প্রতি বৈষম্য এবং নির্যাতনমূলক অর্পিত সম্পত্তি আইনকে নিঃশর্তভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে বাতিল করতে হবে।
বস্তুত, প্রধানত এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন দ্বারাই সম্ভব বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে মহত্তম ও বৃহত্তম বিপ্লবের সূচনা ঘটানো। এই ঘটনা পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরাসহ ভারতের বাঙ্গালীদের সামনে বাঙ্গালী জাতির ভরকেন্দ্র স্বরূপ এক নূতন বাংলাদেশকে উপস্থিত করবে। ফলে সেখানে প্রবল রূপে জেগে উঠবে বাঙ্গালী চেতনা। এটা ভবিষ্যতে উভয় বাংলার শান্তিপূর্ণ ও স্বেচ্ছামূলক পুনরেকত্রীকরণের বাস্তবতা সৃষ্টি করবে।
অন্যদিকে, এই ঘটনা পশ্চিম বাংলায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশের সপক্ষে এমন এক সমর্থন ও আবেগ সৃষ্টি করবে যার ফলে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ বিরোধী যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ সুকঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং এই কর্মসূচী বাংলাদেশকে বাঙ্গালী জাতি গঠনের মূল ভূমিতে পরিণত করে শুধু বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতই করবে না, অধিকন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাকেও অনেক বেশী সংহত ও নিরাপদ করবে।
বস্তুত এই কর্মসূচীর প্রয়োজন ও অপরিহার্যতা একটা দুর্বৃত্তায়নমুক্ত নেতৃত্বের শ্রেণী এবং সমাজ ও জাতি নির্মাণের জন্যও। এটা হচ্ছে এই কর্মসূচীর বস্তুগত তাৎপর্য। কারণ ’৪৭ থেকে যে শ্রেণীর প্রাথমিক পর্যায় চলেছিল ’৭১ পর্যন্ত এবং ’৭১-এ রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাবার পর থেকে আজ অবধি যার বিকাশ ও পরিণতি সেই দুর্বৃত্ত শাসক শ্রেণীর পরিবর্তে নূতন একটি আদর্শনিষ্ঠ শাসক শ্রেণী গঠনের উপাদান এ সমাজে খুব সীমিত। কেন এবং কীভাবে সীমিত সেটা আশা করি ইতিপূর্বেকার আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে। এখানে সৎ, দেশ প্রেমিক, নীতিনিষ্ঠ ও যোগ্যতা সম্পন্ন লোকজন নাই তা নয়, কিন্তু তারা এতই সংখ্যালঘু যে এখানে শুধু সমাজ অভ্যন্তরের উপর নির্ভর করে তাদের শক্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে। বরং এমন সম্ভাবনাই খুব বেশী যে প্রাথমিক একটা পর্যায়ের বেশী তারা আর অগ্রসর হতে পারবে না। বিশেষত এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বহিঃশক্তির চক্রান্তকে হিসাবে রাখতে হবে।
পাকিস্তান আমলে এ দেশে সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট রাজনীতিতে তাত্ত্বিক যতই দুর্বলতা বা ভুল থাকুক এ দেশে এই রাজনীতিকে অবলম্বন করে মধ্যবিত্ত, শ্রমিক ও কৃষকের সৎ, ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ এবং অগ্রণী অংশ সংগঠিত হয়েছিল। সংখ্যালঘু হলেও তারা ছিল প্রবল ও কার্যকর শক্তি। এর বিপরীত ধারার শ্রেণী ও গণ-সমাবেশ ঘটেছিল মুসলিম লীগ এবং প্রধানত আওয়ামী লীগে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ ও দেশ প্রেমিক আন্দোলনের ক্ষয় ও বিপর্যয়ের ফলে মধ্যবিত্তসহ জনগণের ভিতর ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ ও সৎ সামাজিক শক্তিসমূহেরও ক্ষয় ও বিপর্যয় ঘটেছে।
এটা শুধু তাদের ভুলের কারণে হয়েছে এ কথা বলা ভুল হবে। বরং এ ক্ষেত্রে বেশী দায়ী দুর্বৃত্তায়নের প্রয়োজনে শাসক শ্রেণীর আক্রমণাত্মক এবং নীচু স্তরের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড। যেমন মুজিব যেটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে, তার অধীনস্থ বা সহযোগী না হয়ে বিরোধী হলে আক্রমণ করে ধ্বংস করা। কিন্তু জিয়ার পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। তিনি মুজিবী আক্রমণে সৃষ্ট বামপন্থীদের অসহায়ত্ব বা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদেরকে নীতি ও আদর্শ বিসর্জন দিয়ে আত্মবিক্রয় করতে বাধ্য বা প্রলুব্ধ করেছিলেন। এরশাদও এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন।
পদ্ধতি যা-ই হোক ফল তো প্রায় অভিন্ন। একটা সৎ, দেশ প্রেমিক ও নীতি-নৈতিকতানিষ্ঠ কার্যকর সামাজিক শক্তির প্রায় বিলুপ্তি, যা দেশকে আজকের এই পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। সত্যি! এটা একটা আত্মঘাতী শাসক শ্রেণী। এবং শুধু শ্রেণীকে দায়ী করে লাভ নাই। নিজের প্রকৃত ভাল-মন্দ বুঝতে অক্ষম একটা আত্মঘাতী সমাজও এটা, যা এখন ধ্বংসের কিনারায় উপস্থিত হয়েছে।
এই অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করা এবং নূতন অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ার জন্য আজ প্রয়োজন নূতন ও জন-কল্যাণবাদী আদর্শ ও কর্মসূচী নির্ভর একটি রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব। মনে রাখতে হবে এ দেশে মধ্যযুগ অবসান কালের পশ্চিম ইউরোপের মত স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণী ও তার নেতৃত্বে সামাজিক রূপান্তর বা অগ্রগতি কল্পনা করে লাভ নাই। সেখানকার সেই শূন্যতা ও বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতি, সেই বিশ্ব পরিস্থিতি কিছুই আর নাই। পশ্চিম ইউরোপে যে কাজ করেছিল উদীয়মান বুর্জোয়া বা পুঁজিপতি শ্রেণী সেই কাজের দায়িত্ব আমাদের দেশে নিতে পারে একমাত্র দেশ প্রেমিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল। এর উদাহরণ দেশে দেশে ছড়িয়ে আছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, বর্তমান চীন, ভিয়েৎনাম, কিউবা, মালয়েশিয়া তার সফল কয়েকটি দৃষ্টান্ত।
এটা ঠিক যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক বিশাল অঞ্চলের মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল বিশাল। তার ভূমিকা শেষ করে তা চলে গেছে। তার সীমাবদ্ধতা ও ক্রটি-বিচ্যুতি কোথায় ছিল সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। চীন, ভিয়েৎনাম, কিউবার রূপান্তরও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে। চীন, ভিয়েৎনামে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই পুঁজিপতি ও মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেণীর বিকাশ হচ্ছে। মালয়েশিয়াতেও কাজটা রাজনৈতিক নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছে আর একভাবে।
তাদের সবার থেকে আমাদের মত ও পথের অনেক ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু একটা সৎ, নীতি-নিয়মনিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক ও যোগ্য রাজনৈতিক শক্তি গঠনের উপরই নির্ভর করছে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত সমাজ, বাঙ্গালী জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠনের কাজ। এই রাজনৈতিক শক্তি গঠনে পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা হতে পারে আমাদের জন্য বিরাটভাবে সহায়ক, বলা যায় আমাদের জন্য মানবিক সম্পদ ভাণ্ডার। অন্তত যারা এখান থেকে গেছে তাদের একটা অংশকে ফিরিয়ে এনে আমরা আমাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারি।
পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙ্গালী চরিত্র যে এখানকার চেয়ে নীতি-নৈতিকতা ও সততার প্রশ্নে অনেক উন্নত সে বিষয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন নাই। তার প্রমাণ সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। পশ্চিম বাংলায় সিপি(এম)-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের ত্রিশ বৎসর এক নাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা থেকে আমাদের অনেক কিছু বোঝার ও শেখার আছে। সেখানেও বাঙ্গালী চরিত্রের অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঙ্গালী চরিত্রের সুবিধাবাদ, হুজুগ প্রবণতা এবং সহজিয়া মনোভাব যে সেখানকার বাঙ্গালী অনেকাংশে কাটিয়ে উঠেছে তা স্পষ্ট।
পশ্চিম বাংলা বা ত্রিপুরার বামফ্রন্ট নেতৃত্বের অন্তত মূল অংশের সততা নিয়ে তেমন কোন প্রশ্ন নাই। এটাও আমাদের জানা দরকার যে পূর্ব বাংলা থেকে যারা গেছেন তারাই সেখানে রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য বা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজেদের যোগ্যতা বলে। সেখানে বামপন্থীরা কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণীর সহায়তা নিয়ে ক্ষমতায় যান নাই। বরং বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রের প্রবল বাধাকে অতিক্রম করেই বামপন্থীদেরকে ক্ষমতাসীন হতে হয়েছে। এর জন্য লেগেছে জনগণের গরিষ্ঠ অংশের সমর্থন -- আন্দোলনে এবং নির্বাচনে। ভারতের ধনিক শ্রেণী বামফ্রন্টের ক্ষমতাবসানের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেও ব্যর্থ হয়েছে।
হয়ত প্রশ্ন তোলা হবে পশ্চিম বাংলা বা ত্রিপুরায় বাঙ্গালীর মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার কতটুকু বিকাশ হয়েছে যে তারা এখানে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে পশ্চিম বাংলা ১৯৪৭-এর পর থেকে বাঙ্গালী জাতি চেতনার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার মূল ভূমি নয়। সেটা এ বাংলাই। তবে সেখানে বাঙ্গালী চেতনার যেটুকু বিকাশ হয়েছে সেটুকুই এই মুহূর্তে আমাদের জন্য যথেষ্ট। কারণ কাজটা আমরা করব এবং কাজটা হবে এ বাংলার বাঙ্গালীর নেতৃত্বেই।
সংখ্যালঘু সমাজ বা জাতিসত্তার সাহায্য নিয়ে সংখ্যাগুরু জাতিসত্তা বা জনগোষ্ঠী কর্তৃক উন্নত জাতি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গঠনের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা নিকটবর্তী মালয়েশিয়ার দৃষ্টান্ত টানতে পারি। মালয়েশিয়ার মূল বা আদিবাসী জাতিসত্তা হচ্ছে মালয়ী, যারা মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০%। বাকী প্রায় ২০% চীনা এবং প্রায় ১০% ভারতীয় অভিবাসীরা। ব্রিটিশ শাসন কালে ব্রিটিশরা সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলার প্রয়োজনে চীনা ও ভারতীয়দের নিয়ে যায়। মালয়ীরা সেই সময় ছিল যথেষ্ট পরিমাণে কর্ম বিমুখ। উর্বর জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে মালয়ীরা তাদের কৃষি ভিত্তিক আয়েশী জীবনের বাইরে যেতে না চাওয়ায় ব্রিটিশ শাসকরা বহিরাগতদের নিয়ে গিয়ে শিল্প নির্ভর অর্থনীতি গড়ায় মনোযোগ দেয়। বিশেষত রাবার প্ল্যান্টেশনে বিপুল সংখ্যক চীনা ও ভারতীয় শ্রমিক নিয়োগ করা হয়।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পরিশ্রমী ও উদ্যমী চীনা অভিবাসীরা তৎকালীন মালয়ের অর্থনীতি ও সমাজে একটা শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলে মালয়ে স্বাধীনতার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যে শক্তিশালী গেরিলা যুদ্ধ গড়ে ওঠে তার মূল ভিত্তি ছিল চীনাদের মধ্যে। মালয়ী জাতিসত্তার ভিতর তার উল্লেখযোগ্য ভিত্তি বা অংশগ্রহণ ছিল না। প্রচুর রক্তক্ষয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকরা বিদ্রোহ দমনে সমর্থ হয়। এর পর মালয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশরা চলে যায়। একটা পর্যায়ে মাহাথির মোহামমদ ক্ষমতায় এসে বিশেষত এই চীনা জাতিসত্তাকে মালয়ী জাতিসত্তা এবং মালয়েশিয়া রাষ্ট্রের উত্তরণে প্রধান সহায়ক শক্তি হিসাবে ব্যবহার করেন। অনেকে হয়ত জানেন তিনি কীভাবে মালয়ী ভিন্ন অন্য যে কোনও বহিরাগতের জন্য কোন শিল্প বা অর্থনৈতিক উদ্যোগে মালয়ীদেরকে অংশীদার হিসাবে সঙ্গে নেওয়া বাধ্যতামূলক করেন। এভাবে বিশেষ করে চীনা জনগোষ্ঠীর গতিশীলতা, উদ্যোগ ও কর্মনিষ্ঠা মালয়ীদের ভিতর সঞ্চারিত হয়। এর ফলে মালয়ী জাতিসত্তা আজ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
আমার ধারণা একই বিবেচনা থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসানের পর তাদেরকে সেখানে নূতন রাজনৈতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন। উদ্দেশ্য, এভাবে শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও অর্থনীতিতে অতীব পশ্চাৎপদ সংখ্যাগুরু আফ্রিকানদেরকে এই সবেই বিপুলভাবে উন্নত ইউরোপীয়দের সাহায্য নিয়ে উন্নত করা। পদ্ধতি মালয়েশিয়া থেকে ভিন্ন হতে পারে কিন্তু উদ্দেশ্য অভিন্ন। যদি শ্বেতাঙ্গ বিতাড়ন করা হত তবে সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থা উগান্ডা বা কঙ্গোর মত দেশগুলোর মত হতে পারত। কারণ এর ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হত তা পূরণের সাধ্য সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের হত না।
বাংলাদেশের রূপান্তর বা উন্নয়ন প্রসঙ্গে হয়ত বলা হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসাবে এখানেও তো প্রায় দুই কোটি হিন্দু আছে। আমরা কি তাদেরকে আমাদের জাতি গঠনের কাজে লাগাতে পারি না? তা হয়ত পারি। কিন্তু তাদেরকে আমি এ দেশের গরিষ্ঠ মুসলমানদের থেকে বেশী ভিন্ন মনে করি না। গরিষ্ঠের প্রবল চাপে তারাও অনেকাংশে গরিষ্ঠের চরিত্র গ্রহণ করেছে। তাছাড়া এ বাংলার ঐতিহ্যগত কিছু ত্রুটি থেকে তারা মুক্ত হতে পারে নাই যেটা এখান থেকে ভারতে দেশান্তরী হবার ফলে সেখানে অভিবাসী বাঙ্গালীরা অনেকখানি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশেষত এ বিষয় মনে রাখা দরকার যে, ’৪৭-এর পর থেকে এ বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীদের শ্রেষ্ঠ অংশের প্রায় সবটা ভারতে চলে গেছে।
অবশ্য সবচেয়ে বড় কথা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে আন্তরিকভাবে ধারণ করতে চাইলে পুনর্বাসনের উপরোক্ত কর্মসূচী গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। এটা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের একান্ত নৈতিক দাবী। আজকের পরিস্থিতিতে প্রকৃত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যাচাইয়ের কষ্টিপাথর এটাই। এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র ’৪৭-এর সর্বনাশা বিভাজনকে অতিক্রম করে বাঙ্গালী জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠনের পথে আমরা প্রকৃত অর্থে যাত্রা শুরু করতে পারব।
আমার এই বক্তব্যে আমি এ কথা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই, মূল নেতৃত্ব দিতে হবে এ বাংলার অগ্রণী বাঙ্গালীদেরকেই। এখানে পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরা থেকে আগত বা প্রত্যাগত বাঙ্গালীরা হবেন সহযোগী শক্তি। স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরাও এক সময় নূতন সমাজ ও নেতৃত্বের অংশে পরিণত হবেন।
প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালী জাতি গঠনের গতিধারাকে বুঝলে আমরা সহজে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারব। হিন্দু বাঙ্গালীর নেতৃত্বে ইংরেজ শাসনামলে কলকাতাকে কেন্দ্র করে আধুনিক বাংলা ভাষা ও আধুনিক বাঙ্গালী জাতি গঠনের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তা ছিল বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চেতনা বর্জিত। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ও বাঙ্গালী বিভক্ত হলেও পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে মুসলমান বাঙ্গালী বাংলা ভাষা ভিত্তিক জাতি গঠন প্রক্রিয়াকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে তার ভিতর রাষ্ট্র চেতনা সংযুক্ত করে। এর ফলে সংঘটিত হয় ষাটের দশকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পূর্ব বাংলার বুকে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে মুসলমান বাঙ্গালী তার ধর্মীয় সীমাবদ্ধতায় আটকে গেছে। এই জায়গা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে নূতন বাঙ্গালী জাতি এবং তার অভিন্ন ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের আরব্ধ কাজকে সম্পূর্ণ করার সুযোগ আজ আমাদের সমমুখে উপস্থিত হয়েছে।
২০০৭-এর ১১ জানুয়ারীতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা শুধু বিদ্যমান নির্বাচন নির্ভর রাজনীতির দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে নাই, এটা এ দেশে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৩৫ বৎসর কাল কখনও গরিষ্ঠ ভোটার সমর্থিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে, কখনও সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কখনও খণ্ডিত জাতীয়তাবাদের আড়ালে পরোক্ষভাবে ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক এবং কখনও সরাসরি ধর্ম ও ধর্ম-সম্প্রদায় ভিত্তিক যে রাজনীতি অনুসৃত হয়েছিল তারও চরম ও চূড়ান্ত দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে। এই রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে নবতর বাঙ্গালী জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠন আজ সময়ের দাবী। এই দাবী পূরণ করা ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকেও আর রক্ষা করা সম্ভব নয়। আজ থেকে প্রায় ৭২ বৎসর পূর্বে ২৮ মার্চ, ১৯৩৫-এ লেখা ‘ব্যর্থতার প্রতিকার’ নামক প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ বাঙ্গালীর ঐক্য ও নব জাতি গঠন প্রসঙ্গে যে কথা বলেছিলেন তাঁর সেই কথা দিয়েই এখানে শেষ করতে চাই, ‘এইখানেই বড় প্রয়োজন সৃষ্টিধর্মী নব নেতাদের। অতীতের প্রতি তাঁরা হবেন শ্রদ্ধান্বিত, তার পূজারি কখনো নয় — তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সেই জন্য সুপ্রাচীন ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমান’-এর মিলন তাঁদের কাম্য হবে না, কেননা তা অসত্য ও অসম্ভব, তাঁদের কাম্য হবে একটি নব জাতি গঠন — যার সূচনা নানা ভাবে বহুকাল ধরে দেশে হয়েছে, দেশের এ কালের জীবনের জন্য যার প্রয়োজনের অন্ত নেই। মনোজীবন ও রাষ্ট্র-জীবন এই দুই ক্ষেত্রেই অশ্রান্তভাবে চলবে তাঁদের সৃষ্টির কাজ। এ কালের যে ধর্ম-সম্প্রদায়গত রাষ্ট্র-জীবন সেটি কদাচ তাঁদের সমর্থনের বিষয় হবে না, কেননা, তার ফলে এ দেশের অভিশাপ-রূপ জাতি-ভেদ নব নব সম্ভাবনা লাভ করে চলবে; তাঁদের সাধনার বিষয় হবে জনসাধারণের সর্বাঙ্গীন উৎকর্ষ, কেননা, তারই ভিতরে নিহিত রয়েছে দেশের রাষ্ট্র-জীবনের, অথবা জীবনের, সত্যকার বিকাশ সম্ভাবনা।’
রচনা : ২ জুলাই- ২৪ জুলাই ২০০৭
‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রথম প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০০৭