Banner
বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান — শামসুজ্জোহা মানিক (পুনঃপ্রকাশিত)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক , আপডেটঃ September 24, 2020, 12:00 AM, Hits: 1070

(‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ পুনঃপ্রকাশ উপলক্ষ্যে লেখকের কথা : গ্রন্থটি রচিত হয় ১৯৮৯ সালে। এটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর ‘গ্রন্থগার’ বিভাগের ‘রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থে’ প্রথম প্রকাশিত হয় ৩০ নভেম্বর ২০০৮ সালে। একত্রিশ বৎসরাধিক কাল পূর্বে লিখিত এই গ্রন্থের বহু বিষয়ে আমার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অপরিবর্তিত রইলেও স্বাভাবিকভাবে কিছু বিষয়ে আমার ধারণা অপরিবর্তিত থাকে নাই। তথাপি বাঙ্গালী জাতির উপর লিখিত গ্রন্থটির সামগ্রিক গুরুত্ব বিবেচনা করে এটিকে নূতনভাবে পাঠকের দৃষ্টিতে নিতে চেয়ে ‘নিবন্ধ’ বিভাগে এটি পুনঃপ্রকাশ করা হল। — ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০)

বিষয়সূচী :

মুখবন্ধ

প্রথম পরিচ্ছেদ : শুরুর কথা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : বাংলাদেশের সঙ্কটের পরিমাপ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : সঙ্কটের কারণ কি?

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : বিত্তবান ও বিত্তহীন যেখানে এক

পঞ্চম পরিচ্ছেদ : সহজ পথের প্রতি মোহ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : বঙ্গে ইসলাম প্রসারের কারণ

সপ্তম পরিচ্ছেদ : ধর্মান্তরিত মুসলমান বাঙ্গালীর ভূমিকা

অষ্টম পরিচ্ছেদ : মুসলমান বাঙ্গালীর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য

নবম পরিচ্ছেদ : প্রকৃতির সন্তান

দশম পরিচ্ছেদ : নদী ভাঙ্গনের সমস্যা

একাদশ পরিচ্ছেদ  : নীতির সমস্যা

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : পরিবর্তনশীল সমাজ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কি টিকবে?

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : গোঁড়া ধর্মীয় শক্তি কি ক্ষমতা দখল করতে পারবে?

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : মার্কসীয় বিচার পদ্ধতির প্রশ্ন

ষোড়শ পরিচ্ছেদ : হিন্দু বাঙ্গালীর কথা

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : হিন্দু বাঙ্গালীর ভ্রান্তি

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর অবস্থা

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ :  শেষ কথা

সংযোজন

মুখবন্ধ

“বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান” নাম দিয়ে গ্রন্থটি লেখার সময় ১৯৮৯ সালের ৯ মে থেকে ১৫ জুন। সময়ের হিসাবে এটা ঊনিশ বৎসরেরও কিছু বেশী সময় অর্থাৎ প্রায় দুই দশক বা কুড়ি বৎসর আগের লেখা। এই দীর্ঘ সময়ে শুধু যে দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তা-ই নয়, অধিকন্তু আমার চিন্তা বা ধারণাতেও কম-বেশী পরিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া এটা অনেক দিন আগে অনেক ভিন্ন প্রেক্ষিতে লেখা। স্বভাবিকভাবে কিছু জায়গায় প্রয়োজন বোধে বর্জন এবং পরিমার্জন বা সংস্কার করতে হয়েছে। তবে গ্রন্থের নাম যেমন অপরিবর্তিত রেখেছি তেমন মূল রচনায় বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটাই নি। একই সঙ্গে অপরিবর্তিত রেখেছি কাল প্রেক্ষিত। তবে পাঠকের সুবিধার জন্য এবং আমার পরবর্তী চিন্তা বা ধারণাকে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন স্থানে টীকা ব্যবহার করেছি, কখনও তার আয়তন কিছু বৃহৎ হয়েছে। এ ছাড়া একটা উল্লেখযোগ্য আলোচনা গ্রন্থ শেষে “সংযোজন” হিসাবে যোগ করেছি। বিশেষত সাম্প্রতিক কালে পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে এই গ্রন্থের যে সীমাবদ্ধতা আমার চোখে ধরা পড়েছে সেটি সংশোধনের চেষ্টা হিসাবে “সংযোজন” অধ্যায়টি যোগ করেছি।

গ্রন্থটি লেখার পর থেকে এর পাণ্ডুলিপি বা তার ফটোকপি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে পড়তে দিয়েছিলাম। যারা পড়েছিলেন তাদের প্রায় সকলেই বইটির উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন। কারও কারও ক্ষেত্রে সেটা ছিল আবেগ-উচ্ছ্বাসের পর্যায়ে। কয়েক জন গ্রন্থটি প্রকাশ করতে চাইলেও বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে আমি রাজী হই নি। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক ১৯৮৯-তে এটি পড়ে তার সম্পাদিত পত্রিকা “লোকায়ত”-এ এক সংখ্যাতেই সম্পূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে তখন এরশাদের আধা-সামরিক শাসন বজায় থাকায় আমি এটির প্রকাশ ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে আগ্রহী হই নি।

পরবর্তী কালেও তেমন কোন ঝুঁকি আছে মনে না করলেও গ্রন্থটি প্রকাশে উৎসাহ পেতাম না। চারদিকের পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হত এই ধরনের বইয়ের আগ্রহী পাঠক সেভাবে পাবার সময় এখনও হয় নি। ফলে সম্ভবত ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আহমেদ কামাল এটি পড়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে চাইলেও আমি নিজে উৎসাহ পাই নি। সম্ভবত ১৯৯২ সালে পশ্চিম বঙ্গ থেকেও গ্রন্থটি প্রকাশের প্রস্তাব পাই।

কিন্তু আমার সর্বদা মনে হয়েছে এই গ্রন্থ প্রকাশ ও বাজারজাতকরণের জন্য উপযুক্ত মনোভূমি দুই বঙ্গের কোনওখানেই এখনও তৈরী হয় নি। সুতরাং পাণ্ডুলিপির ফটোকপি বিভিন্ন সময়ে কিছু সংখ্যক মানুষকে পড়তে দিয়েছি তাদের প্রতিক্রিয়া বা মতামত নিবার জন্য। তবে বিগত ৮/৯ বৎসর আর কাউকে পড়তে দেওয়া হয় নি। ইতিমধ্যে বাঙ্গালী জাতি সংক্রান্ত আমার বিভিন্ন লেখা বা বক্তব্যে এই গ্রন্থের অনেক উপাদান উঠে এসেছে। ফলে ক্রমে এই গ্রন্থ সম্পর্কে আমার উৎসাহও স্তিমিত হয়। তাছাড়া অনেক অতীত সময়ের প্রেক্ষিতে লেখা বলে এটিকে প্রকাশের উপযোগী করার জন্য যে সময় ও শ্রম দিতে হবে সে কথা ভেবেও আর উৎসাহ পাই নি।

কিন্তু গ্রন্থের কথা ভুলি নি। তবে মাঝে মাঝে ভেবেছি এই পাণ্ডুলিপি আর কোনও কাজে লাগবে কি না। গ্রন্থটির ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবার জন্য অল্প কিছু দিন আগে বহু দিন পর পাণ্ডুলিপিটি পড়তে শুরু করি। এবং পড়তে গিয়ে মনে হল ঊনিশ-কুড়ি বৎসর আগে লেখা হলেও এবং এর কিছু বিষয় পরবর্তী কালের কিছু সংখ্যক লেখায় উঠে এলেও গ্রন্থ হিসাবে এর উপযোগ এখনও যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। বাঙ্গালী জাতির চরিত্র, সঙ্কট, সমস্যা ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে এখানে এমন অনেক বিষয় উঠে এসেছে যা আর কোথায়ও উঠে আসে নি। সুতরাং গ্রন্থের বক্তব্যে অভিনবত্ব এখনও ফুরায় নি। তাছাড়া একটি মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে জাতিসত্তার সঙ্কট বিষয়ে যেভাবে আলোচনা করা সম্ভব বিভিন্ন ছোট বা মাঝারী, এমনকি বৃহৎ প্রবন্ধেও সেভাবে আলোচনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমার বাঙ্গালী সংক্রান্ত কোন প্রবন্ধের আলোচনাই এই গ্রন্থের গুরুত্বকে ম্লান করতে পেরেছে বলে মনে হয় নি। বরং মনে হয়েছে পরবর্তী কালে প্রকাশিত বা লিখিত আমার জাতিসত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বক্তব্যকে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিবার জন্য এই গ্রন্থের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

গ্রন্থটি, প্রকৃতপক্ষে, জাতি হিসাবে, জনগোষ্ঠী হিসাবে এবং সমাজ ও সম্প্রদায় হিসাবে আমাদের নিজেদেরকে স্বচ্ছ আয়নার সামনে উপস্থিত করার প্রয়াস। উদ্দেশ্য, যে সঙ্কটে আমরা আছি তা থেকে উত্তরণের পথ বের করা। সুতরাং এই গ্রন্থে বাঙ্গালী হিসাবে কঠোর আত্মসমালোচনা থাকলেও তার উদ্দেশ্যকে নেতিবাচক মনে করার কোনও কারণ নেই। কোনও কিছুই চিরকাল এক রকম থাকে না। সুতরাং জাতি ও সমাজ হিসাবে আমাদের যে সকল সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি আছে সেগুলিকে দূর করাও সম্ভব বলে আমি মনে করি। তবে তার জন্য আগে সেগুলিকে চিহ্নিত করতে এবং সেগুলির কারণ বা উৎস নির্ণয় করতে পারতে হবে।

লেখক, ৩০ নভেম্বর ২০০৮

প্রথম পরিচ্ছেদ : শুরুর কথা

মূলত সমগ্র বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে ঘিরেই আমাদের এই আলোচনা। অর্থাৎ পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা সহ সমগ্র বঙ্গদেশের বাঙ্গালী জাতিসত্তার সঙ্কট ও তার উৎস এবং সঙ্কটের প্রতিকার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন আমাদের এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। তবে সঙ্কটের প্রতিকার সন্ধানের পথে যাত্রার পূর্বশর্ত হচ্ছে এই সঙ্কটের স্বরূপ এবং উৎস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জন। সুতরাং আমরা সেই দিকের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিব।

বাঙ্গালীর যে কোনও অংশের সমস্যাই শেষ পর্যন্ত সমগ্র জাতিসত্তার সমস্যা। সুতরাং আমরা এই সমগ্র জাতিসত্তার বিষয়টি চিন্তায় নিয়েই আলোচনা করব। তা না হলে আমাদের সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গী এবং আলোচনা হবে খণ্ডিত ও একপেশে এবং আমরা আজকের কোনও সমস্যারই সঠিক সমাধান খুঁজে পাব না।

যদিও আমাদের আলোচনা সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে নিয়ে তবু তার প্রধান অংশ জুড়ে থাকবে পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বাঙ্গালী ও তার সমস্যা এবং আমরা আলোচনা শুরুও করব এখানকার বাঙ্গালীকে নিয়েই। কারণ আমাদের সমগ্র আলোচনার মূল প্রেক্ষিত আজকের বাংলাদেশ। আমরা বাংলাদেশের আজকের সঙ্কটের উৎস খুঁজে বের করতে পারলে যেমন খুঁজে পাব সমগ্র বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস তেমন এখানে সঙ্কটের প্রতিকার পেলে পাব সমস্ত বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটেরও প্রতিকার।

বাংলাদেশের সঙ্কট বলতে মূলত মুসলমান বাঙ্গালীর সঙ্কট বুঝতে হবে। কারণ এখানে শুধু যে বিরাট সংখ্যাগুরু জনসংখ্যাই মুসলমান তা-ই নয়, উপরন্তু এই ভূখণ্ড আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্রে আবদ্ধ আছে তা বঙ্গেরই এক বিভক্ত অংশ, যা ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের উদ্ভবের পিছনে পূর্ব বঙ্গের মুসলমান বাঙ্গালীর ধর্মসম্প্রদায়গত স্বাতন্ত্র্যবোধ ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছিল। এই অবস্থায় ১৯৭১-এ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশ যেমন তার ১৯৪৭-এর ধর্মসম্প্রদায়গত বিভক্তির ঐতিহ্যকে বহন করছে তেমন বিপুল সংখ্যাগুরু মুসলমান বাঙ্গালী অধ্যুষিত হয়ে তার ধর্মসম্প্রদায়গত বৈশিষ্ট্যকেও বহন করছে।

বাঙ্গালীর সঙ্কট তাই মুখ্যত ধর্মসম্প্রদায় ভিত্তিক বাঙ্গালীর সঙ্কট। এটা মুসলমান বাঙ্গালীর সঙ্কটকে যেমন বোঝায় তেমন বোঝায় হিন্দু বাঙ্গালীরও সঙ্কটকে। সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে যখন সাধারণভাবে বাঙ্গালী উঠতে পারে নি তখন তাকে ও তার সঙ্কটকে বুঝতে হলে আমাদেরকে তাকে শুধু বাঙ্গালী হিসাবে নয়, উপরন্তু ধর্ম-সম্প্রদায়গতভাবেও বিচার করতে হবে।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : বাংলাদেশের সঙ্কটের পরিমাপ

এখন বাংলাদেশের কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করি। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটি দাঁড়িয়ে আছে তার সঙ্কটের পরিমাপ বা গুরুত্বের কথা বোঝাতে গেলে যে ভাষা ব্যবহার করা যায় সেটা এই রকম হলে বোধহয় এখন আর বেশী বলা হবে না যে, এই রাষ্ট্র যেন নিজের ভারে নিজেই ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে। তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, সামাজিক সঙ্কট আজ এমনই সর্বাত্মক, গভীর এবং প্রচণ্ড।

আসলে রাষ্ট্রটা এখন পর্যন্ত টিকে আছে বিদেশের ঋণ ও সাহায্যের উপর। এই রাষ্ট্রে অনেক আগেই ব্যাপক বিপর্যয় ও ধ্বংস ঘটত যদি ঋণ এবং বিশেষত ভিক্ষার আকারে এত ব্যাপক আয়তনে বৈদেশিক অর্থ না আসত। অনুদান নামক ভিক্ষার পরিমাণ এখন এমনই বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে এই ভিক্ষার উপরও রাষ্ট্রের নির্ভরতা এমনই বৃদ্ধি পেয়েছে যে বস্তুত রাষ্ট্রটিকে একটি ভিক্ষুক রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করাই এখন সঠিক। এই ভিক্ষুক রাষ্ট্র ও তার অধিপতিরা জাতিটিকেও একটি ভিক্ষুক জাতিতে পরিণত করেছে।

কিন্তু সঙ্কট বাড়ছে এই ভিক্ষা এবং সাহায্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এবং তাকে ক্রমবর্ধমানভাবে হারিয়ে দিয়েই। জনসংখ্যার বিপুল ও ভয়াবহ বিস্তার, প্রলয়ঙ্করী বন্যা, খরা এবং ব্যাপক জনসংখ্যার নিঃস্বকরণের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সর্বাত্মক আধিপত্য। এখন সমাজের সর্বস্তরে ছলে-বলে-কৌশলে আত্মস্বার্থ আদায় করা আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ-বিত্ত এবং ক্ষমতাই এখন আদর্শ বিচারের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থ, বিত্ত ও ক্ষমতার জন্য এখন শঠতা, প্রতারণা, ভাঁওতা ও নৃশংসতা গুণে পরিণত হয় যদি সফল হওয়া যায়। বস্তুত সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে সেই সবচেয়ে যোগ্য ও আদর্শ কিংবা মহৎ যার আছে অগাধ টাকা কিংবা বিরাট ক্ষমতা এবং আছে প্রদর্শন করার মতো জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসময় ভবন, গাড়ী এবং অনুষঙ্গ, এবং সেই সঙ্গে তার অর্থের কিছু অংশ ছিটানোর মত মন।

এটা ঠিক যে, এত কিছু যার হয় তাকে ঈর্ষা করার মত লোকও অনেক সৃষ্টি হয় এবং তার শত্রুও অনেকে হয়। কারণ সে তো সফল। কিন্তু সাধারণভাবে এই ঈর্ষা বা শত্রুতার পিছনের কারণটি কিন্তু এই নয় যে, তার ক্ষমতার ব্যবহার কিংবা অর্থ-বিত্ত সঞ্চয় অন্যায় বা নীতিহীন পথে হয়েছে, বরং এই যে, অন্যেরা তার মত ক্ষমতা পায় নি বা তাকে ব্যবহারের সুযোগ পায় নি নিজের স্বার্থে এবং অর্থ-বিত্তও অর্জন করতে পারে নি তার মত। কিংবা এই ঈর্ষা বা শত্রুতার পিছনের কারণ হয়ত আরেক ক্ষমতাবান ও বিত্তবানের প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত। সেক্ষেত্রে এই সফল লোকটি হয়ত তার আরও উপরে আরোহণ কিংবা স্বার্থের পথে বাধা।

আসলে সমাজে সাধারণ মূল্যবোধ অনুযায়ী সেই আদর্শের কোনই মূল্য নেই যা অর্থ-বিত্ত এবং সেই অর্থ-বিত্ত রক্ষার ক্ষমতা বা শক্তি না দেয়। যে আদর্শ দ্রুত এসব কিছু দিতে পারে না সেই আদর্শকে সাধারণ মানুষ যে শুধু করুণা করে কিংবা অবজ্ঞা করে তা-ই নয়, বরং তাকে ভয় করে, এমন কি অনেক সময় ঘৃণাও করে। মনে করে যে, আসলে বাইরে আদর্শের বুলি আওড়ায় কিন্তু সুযোগ পায় না বলে দুর্নীতি করে না। কিন্তু সুযোগ পেলে ছাড়বে না। যে কারণে আমাদের দেশে যে কোনও সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করা যাক নীতি প্রসঙ্গে সে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে এই উত্তর দিবে, “যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ”। কিংবা বলবে “সুযোগ না পেলে সবাই সাধু, সুযোগ পেলে সবাই চোর”। মানুষ সম্পর্কে এমন কি তার নিজেরও সম্পর্কে সাধারণ জনগণের এই মূল্যায়ন থেকে এই জনগণ সম্পর্কেও আমাদের বুঝবার অনেক কিছু আছে। অর্থাৎ সুযোগ পেয়েও যে কোনও মানুষ চুরি বা দুর্নীতি না করতে পারে এই ধারণাই তাদের মাথায় সাধারণত কাজ করে না।

হাঁ, এর পরেও কিছু ব্যতিক্রম হঠাৎ তাদের চোখে পড়ে। তখন তারা হিসাব মিলাতে পারে না। কিন্তু দেখে যে এই সব মানুষ ক্ষমতায় থেকেও কিছু করতে পারে না, এমন কি ক্ষমতার ব্যবহারও করতে পারে না, কিংবা থাকে দারিদ্র্যে। তখন মনে করে যে, আসলে এরা অযোগ্য, বুদ্ধিহীন। এদের প্রতি সাধারণ মানুষের ঠিক শ্রদ্ধাবোধ যেটাকে বলে সেটা সব সময় থাকে না। যদি এদের দ্বারা কোনও কাজ হয় তবে সেটা আদায় করার জন্য ভক্তি দেখায়। কিন্তু কাজ আদায় হলেই সরে যায় এবং মোটামুটি তার কথা ভুলে যায়। অনেক সময় যে লোকটিকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে তাকে ঠকিয়ে দিয়ে নিজে জিতেছে মনে করে তৃপ্তি পায়। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে নীতিবান লোকটিকে বোকা এবং নিজেকে চালাক বা বুদ্ধিমান মনে করে আনন্দ পায়। আর যদি নীতিবান লোক দ্বারা কোনও কাজ না হয় তবে তার কাছ থেকে যারা কিছু আশা করে তারা তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তার সম্পর্কে সর্বত্র নিন্দা করেও বেড়াতে পারে।

শেষ পর্যন্ত যেটা দাঁড়াচ্ছে সেটা হল যে, সমাজের মূল আদর্শ হল দ্রুত সম্পদ অর্জন করা। এর জন্য যা করা যায় সেটাই বৈধ বা ন্যায়। শুধু প্রত্যক্ষভাবে আর একজনের গায়ে আঘাত না করলেই হল। তা হলে শত্রু সৃষ্টি হবে। সুতরাং এই কাজটি যে যত কৌশলে করতে পারবে সে তত বেশী সফল হবে। তবে আঘাত করেও যদি তাকে অর্থ বা প্রতিদান দেওয়া যায় তবে অনেকেই অতীত ভুলে গুণগ্রাহীতে পরিণত হবে। তবে হাঁ এই সমাজে কারও উপকার করলে সাধারণত তার থেকে দূরে থাকতে হয়। অন্তত তাকে উঠবার সুযোগ দিলে। কারণ সাধারণত সে এই দানের প্রতিদান দিবে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আঘাত দ্বারা। কারণ এই সমাজে সাধারণত কেউ কারও অধীন থাকতে চায় না। কাজেই কৃতজ্ঞতার ঋণ শক্তিমানকে খুব পীড়া দেয়। এতে সে যে নৈতিকভাবে বা মনস্তাত্ত্বিকভাবে আর একজনের অধীনে থাকে এটা তার মনস্তত্ত্বের জন্য অসহনীয় হয়ে থাকে। এই কারণে এই সমাজে যারা শক্তিমান তারা যখন কাউকে দয়া করে তখন সাধারণত তাকে বা তাদেরকে এমনভাবে সাহায্য করে যাতে তারা চিরদিন তাদের দয়ার ভিখারী হিসাবে জীবন ধারণ করতে বাধ্য হয়।

অর্থাৎ সাধারণভাবে দুর্নীতি কিংবা নীতিহীনতার এক অবাধ রাজত্ব আজ সমাজ ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এমনইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জাতীয় ও সামাজিক সঙ্কটকে সার্বিক ও প্রচণ্ড করে তুলেছে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : সঙ্কটের কারণ কি?

বাংলাদেশের আজকের সঙ্কট ও তার কারণ নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। এটাকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছেন। যাঁরা আল্লাহ্‌য় বিশ্বাসী গোঁড়া মুসলমান তাঁরা মনে করছেন যে, মুসলমান আল্লাহ্‌র পথ থেকে সরে গেছে বলে এই অবস্থা। সুতরাং তাঁরা প্রতিকার হিসাবে দিচ্ছেন যে ওষুধ সেটা হল আরও ভালো করে নামাজ, রোজা করা এবং আরও কঠোরভাবে আল্লাহ্‌র বা কোরআন-হাদীসের অনুশাসন মেনে চলা। এখন সারা দেশে ব্যাপক জনমানসে এই ধারণাই কাজ করছে এবং তার ফলে বেড়েছে এবং বাড়ছে মসজিদ এবং মসজিদে নামাজীর সংখ্যা। বাড়ছে ধর্মচর্চা। এতেও তো সঙ্কট কমছে না। বরং বাড়ছে। তখন ব্যাখ্যা আসে যে, এইভাবে কষ্ট দিয়ে আল্লাহ্‌ এ দেশে মুসলমানের ঈমান বা বিশ্বাস পরীক্ষা করছেন। এই পরীক্ষায় জিততে পারলেই সব সঙ্কট দূর হবে। 

এই ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিপরীতে আছে অর্থনৈতিক শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের ব্যাখ্যা। অবশ্য অর্থনৈতিক শ্রেণীতত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের মধ্যে আছে বহু মতপার্থক্য। এ দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণে যেমন আছে মতভেদ তেমন এ দেশের সঙ্কটের উৎস নির্ণয়েও আছে তাঁদের বিভিন্ন মত বা ধারণা। কিন্তু এটা ঠিক যে মূলগতভাবে তাঁরা এক, সেটা হল সবকিছুকেই মূলত অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদ দ্বারা বিচারের পদ্ধতি। এদের বিচারে আমাদের দেশে যে শ্রেণীটি অর্থ-বিত্তের মালিক সেই ধনিক শ্রেণী হল সমস্ত সঙ্কটের উৎস। সুতরাং এদেরকে উৎখাত করলেই সব সমস্যারও সমাধান হবে। ধনীর সঙ্গে গরীবের, বিত্তবান বা সম্পত্তিবানের সঙ্গে নির্বিত্ত বা সম্পত্তিহীনের দ্বন্দ্বের সহজ ছকে তাঁদের সমস্ত সামাজিক সমস্যা আবদ্ধ থাকে। সুতরাং এই দ্বন্দ্বের অবসানের সঙ্গে সমস্ত সামাজিক সমস্যার সমাধানও তাঁদের মতে হয়ে যায়।

অবশ্য এটা ঠিক যে, এ দেশের ধনিক বা উচ্চবিত্ত শ্রেণী এক পৈশাচিক রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে। এবং এটাও ঠিক যে, এই শ্রেণীর হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে না পারলে কিছুই বাঁচবে না। একে এই সমাজের নেতৃত্বের ও কর্তৃত্বের আসনচ্যুত করাতে আছে সঙ্কটমুক্তি, জনগণের মুক্তি। কিন্তু সেটা কি শুধুই একটি অর্থনৈতিক কাজ? অর্থাৎ এর সম্পত্তি বা অর্থ ও বিত্ত কেড়ে নিলেই কি সমস্যার মীমাংসা হবে? নাকি এর কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিলেই সব সমস্যার মীমাংসা হবে? আর তা করতে হলেও বা কোন পদ্ধতিতে তা করতে হবে?

প্রকৃতপক্ষে এ দেশের ধনিক বা উচ্চবিত্তটি তো এই সমাজেরই ফসল, এই সমাজের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ারই ফল। সুতরাং এই উচ্চবিত্তের জন্মের কারণ শুধু বাইরে বা উপরে খুঁজে কী লাভ? এর এক গভীর উৎস আছে সমাজ এবং সমাজ মানসেরই ভিতরে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : বিত্তবান ও বিত্তহীন যেখানে এক        

আসলে এ দেশে উচ্চবিত্ত কিংবা ক্ষমতাবানরা অনেকাংশে বিত্তহীন ও ক্ষমতাহীন সাধারণ দরিদ্র মানুষেরই আকাঙ্ক্ষার সর্বোচ্চ রূপ। জনগণের সকল দুর্ভোগের জন্য দায়ী করা হয় মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত নেতৃত্বকে। কিন্তু একজন কোটিপতি শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী কিংবা সামরিক অথবা বেসামরিক আমলা কিংবা একজন বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে একজন অশিক্ষিত শ্রমিক কিংবা কৃষক এমনকি ভূমিহীন কৃষকেরও, যে গ্রামে দিন মজুরী করে বেঁচে থাকে, পার্থক্য কোথায় এবং কতটুকু? একজন ধনীর সঙ্গে একজন গরীবের অবশ্য পার্থক্য আছে সামাজিক অবস্থানে। যেমন পার্থক্য আছে মর্যাদার ও সুযোগের ক্ষেত্রে শিক্ষিত ও অশিক্ষিততে। কিন্তু চেতনা বা নীতিবোধে একজন শিক্ষিত ও ধনীর সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই একজন অশিক্ষিত ও দরিদ্রের পার্থক্য খুব সামান্যই আছে।

এ দেশে একজন শিক্ষিত সাধারণত যেটা অর্জন করে সেটাকে মনুষ্যত্বের শিক্ষা কিংবা নৈতিকতার শিক্ষা না বলে টেকনিক্যাল বা পদ্ধতিগত কিংবা প্রযুক্তিগত শিক্ষা বলা যায়। একজন মিস্ত্রী যেমন জানে কোনটার সঙ্গে কোনটা জোড়া দিতে হয় কিংবা কোন বস্তু বা মশলার সঙ্গে কোন বস্তু বা মশলা কতটা মিশাতে হবে ব্যাপারটা তেমন। যে অর্থে আমাদের দেশে সাধারণভাবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়াররা মিস্ত্রী ছাড়া আর কিছু নয় সেই অর্থে আমাদের দেশে শিক্ষিত ব্যক্তিরাও সাধারণ মিস্ত্রী ছাড়া আর কী? নীতি ও বিবেক বিবর্জিত স্বার্থসর্বস্ব এই শিক্ষিত মিস্ত্রীরা মূর্খ ও বোকা শ্রমজীবী জনগণের তুলনায় অনেক বেশী চালাক ও বুদ্ধিমান বলে অনেক ক্ষেত্রেই তাদেরই সমপর্যায়ের নীতি ও মূল্যবোধের অধিকারী শ্রমজীবী ও দরিদ্র জনগণকে ঠকিয়ে সহজেই উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। একজন মধ্যবিত্ত বা বিত্তবানের সঙ্গে নির্বিত্তের তফাৎটা তাই সাধারণত নীতিবোধ বা চেতনার নয় এটা হল ক্ষমতা ও অক্ষমতার, যোগ্যতা ও অযোগ্যতার।

অর্থাৎ এ দেশে আজকের ধনিক বা উচ্চবিত্ত যে পথ ধরে এই পর্যায়ে এসেছে সেই পথ হল এ দেশেরই ব্যাপক জনগণের দ্বারা সমর্থিত পথ । প্রায় সবাই যে পথ ধরে ছুটতে চেয়েছে অথবা যে পথকে মনের ভিতর গ্রহণ করে নিয়েছে সেই পথ ধরে সবচেয়ে বেশী দক্ষতার সঙ্গে ছুটে যারা সবাইকে পিছে ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছে তারাই হয়েছে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, অর্থ-বিত্তের অধিকারী। এই প্রতিযোগিতায় যারা হেরে যায়, মার খায়, জখম হয়, সর্বস্বান্ত হয় তারা ঈর্ষা অথবা অসন্তোষ নিয়ে অনেক সময় আক্রমণ করে কিংবা রুখে দাঁড়ায়। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগুলোকে কিন্তু পথটিকে নয়, পদ্ধতিটিকে নয়। কাজেই মাঝে মাঝে পরিবর্তন হলেও শেষ পর্যন্ত কিছু ব্যক্তি বদলায়। কিন্তু সকল পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে এই একই অধঃপতিত রূপ নিয়ে ক্ষমতাধর কিংবা বিত্তবানরা বারবার সামনে আসছে। যত বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা তত বাড়ছে যে কোনও মূল্যে অর্থ-বিত্ত কিংবা ক্ষমতা সঞ্চয়ের উন্মাদনা।

এ দেশে সৎ কে? অনেক বামপন্থী রাজনীতিক যে জনগণ শব্দটিকে পূজা করেন তাঁরা বলবেন যে, জনগণ হচ্ছে সৎ আর ধনীরা অসৎ। এটা ঠিক যে, সততার সঙ্গে শ্রমের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শ্রম দ্বারা উপার্জনই সততা আর শ্রম ব্যতিরেকে এবং ফাঁকির মাধ্যমে সেটা অসততা। শ্রমজীবী জনগণ তো শ্রমী। সুতরাং তারা সৎ।

কিন্তু যখন এই শ্রমে থাকে না আনন্দ এবং এটা তারা করে নেহায়েৎ বাধ্য হয়ে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষায় থাকে ফাঁকি তখন শ্রমজীবীরাও চরিত্রের বিচারে সৎ থাকে না। তখন সৎ ব্যাপারটা সুযোগের অভাবের ব্যাপার হয় মাত্র। এমন অবস্থায় একজন সাধারণ শ্রমিক কিংবা কৃষক সুযোগ পেলে খুব বেশী হলে তা-ই হতে পারে যা হয়েছে আজ এ দেশের ক্ষমতাধর আমলা কিংবা ধনিক।

যে ভণ্ডামি, ফাঁকি ও প্রতারণা এ দেশের সাধারণ মানুষের অন্তরে সাধারণভাবে লালিত হয় তারই কি প্রতিফলন ঘটে না এ দেশের সফল নেতাদের মধ্যে? এ দেশের সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর চরিত্রের প্রকাশ ঘটে না কি তাদের এক সময়ের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবে? জিয়া কিংবা এরশাদ কি সেই দুর্নীতিপরায়ণ ও নীতিহীন ক্ষমতা কিংবা অর্থলিপ্সু মানসের প্রতিনিধি নয়? অবশ্য জিয়া সম্পর্কে আর্থিক দুর্নীতির কথা শোনা যায় নি। কিছু সর্বময় ক্ষমতার এই কেন্দ্রটিতে অর্থের আসক্তি না থাকলেই বা কী আসে যায়? আর এই ক্ষমতা রক্ষার জন্য জিয়া যা করেছিলেন তা কতখানি সৎ বা নৈতিক এবং ন্যায়সঙ্গত? জিয়ার রাজনীতির চালিকা শক্তি কি ছিল দেশপ্রেম নাকি তা ছিল ক্ষমতাপ্রেম?

আসলে এ দেশে নীতিবোধের বিচারে সাধারণভাবে বিত্তহীন ও বিত্তবান মূলত এক। বিষয়টিকে ক্ষমতা ও সামর্থ্যের পার্থক্য হিসাবে দেখাই ঠিক হবে। ব্যতিক্রম যারা তারা এ সমাজে ব্যতিক্রমই। তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্ন হল লংকায় যাওয়া এবং সাধ্য অনুযায়ী ছোট কিংবা বড় রাবণ হওয়া। এই জন্যই তারা এমন প্রবাদ বাক্য বলতে ও শুনতে পছন্দ করে যে, “যে যায় লংকায় সেই হয় রাবণ।” যারা রাবণ হবে না তেমন লোকেরা তাদের পছন্দ নয় বলেই তারা এদের নেতা হয় না বা হতে পারে না। তবে যারা উপরে উঠে যায় তাদের পীড়ন যখন অসহনীয় হয় তখন চায় তাদের পতন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও বাছাই হয় এমন নেতৃত্বের যারা একই কাজ করবে। অর্থাৎ এখানে সংগুপ্ত থাকে একই চুরি বা লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় সম্পদ আত্মসাৎ বা অর্জনের কিংবা অল্পায়াসে সবকিছু পাবার সহজ পথের প্রতি মোহ।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ : সহজ পথের প্রতি মোহ

সাধারণত এ দেশের মানুষ আকৃষ্ট হয় সহজপ্রাপ্তির প্রতি। অর্থাৎ কষ্ট করে কোনও কিছু পেতে চায় না। পেতে চায় সহজে, অনায়াসে কিংবা অল্পায়াসে। এই প্রবণতা থেকে তারা এমন পথ অনুসরণ করে যে পথ তৈরী করতে হয় না, বরং তৈরী পাওয়া যায়। সুতরাং প্রবণতাটা হয়ে ওঠে তৈরী জিনিস সহজে পাবার বা আত্মসাতের; সৃষ্টির নয়। কারণ সৃষ্টিতে আছে কষ্ট, শ্রম। কোনও কিছু সৃষ্টি বা গঠনের জন্য কষ্ট করতে বা শ্রম করতে না চাইবার ফলে এরা শুধু পরের দিকে অর্থাৎ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শুধু যে দেহশ্রমকেই ভয় করা হয় তা-ই নয়, ভয় করা হয় মানসিক শ্রমকেও। অর্থাৎ এ দেশের সাধারণ জনমানসে দৈহিক শ্রম ও মানসিক শ্রম উভয়ের প্রতিই থাকে একটা অনীহা ও অপছন্দ। এইজন্য বৃহৎ আবিষ্কার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সাধনা কিংবা চিন্তার ক্ষেত্রে গভীর সাধনা এই জনগোষ্ঠীর ভিতর তেমন একটা দেখা যায় না। বেঁচে থাকতে হলে কিছু দৈহিক শ্রম করতেই হয়। অন্তত শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে। সেটুকু বাধ্য হয়েই করে। কিন্তু উন্নত জীবন গঠনের জন্য যে মানসিক শ্রম করতে হয় সেটুকুর প্রতি অনীহা তীব্র। গভীর ও জটিল চিন্তার জন্য যে মানসিক শ্রম দিতে হয়, ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে লেগে থাকতে হয় তার প্রতি এই মানুষের কোনও আকর্ষণ নেই, বরং আছে বিকর্ষণ ও অনীহা।

ঐতিহাসিকভাবে দেশটা সাধারণভাবে সহজ সাধনার। উত্তর ভারতের বৌদ্ধ সাধনাও এ দেশে এসে সহজ সাধনা বা সহজিয়া পথে অধঃপতিত হয়েছিল। তার মধ্যে বৌদ্ধ দর্শন বা ধর্মের উন্নত চিন্তা ও সাধনার বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট ছিল না। সাধারণ ভোগবাদকে আবরণ দেওয়া হয়েছিল রহস্যবাদ ও অলৌকিক কল্পকথা দ্বারা। সপ্তম, অষ্টম শতাব্দীর চর্যাপদ, দোহা সাহিত্য থেকে আমরা আদি বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও চিন্তার যে পরিচয় পাই তা আমাদেরকে এ দেশের অতীতকে বুঝতে খুবই সাহায্য করে।

বৌদ্ধপাল রাজবংশের পর দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক থেকে আগত গোঁড়া হিন্দু সেন রাজবংশ বাংলায় তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করার পর এ দেশে বর্ণজাতিভেদমূলক* হিন্দু ধর্মকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা শুরু হয়।

------------------------------------------------

­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­ * হিন্দু সমাজ ও ধর্মের জাতিভেদ প্রথার caste বা জাতিকে (চলিত ভাষায় “জাত”) বুঝাতে গিয়ে আমি বর্ণজাতি শব্দটি ব্যবহার করেছি। মূল হিন্দু ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী হিন্দু সমাজকে চার বর্ণ বা ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী প্রতি বর্ণের মর্যাদা ও পেশা নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয়। মর্যাদায় সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণ ব্রাহ্মণের পেশা ধর্মচর্চা ও পূজায় পৌরোহিত্য করা। মর্যাদাগতভাবে ব্রাহ্মণের নীচে অবস্থিত ক্ষত্রিয়ের পেশা রাষ্ট্র শাসন ও যুদ্ধ করা। তার নীচে অবস্থিত বৈশ্যের পেশা ব্যবসা করা। সমাজে সবার নীচে অবস্থিত শূদ্ররা হল বিভিন্ন বৃত্তির শ্রমজীবী। কিন্তু এটা একটা কাগুজে তত্ত্বগত ভাগ মাত্র। বাস্তবে হিন্দু সমাজ এই তাত্ত্বিক বর্ণগত ভাগকে অবলম্বন করে পেশা ও মর্যাদার অপরিবর্তনীয় স্তর বিন্যাস অনুযায়ী অসংখ্য “জাতি” বা জাতে বিভক্ত। তত্ত্বের বর্ণ নির্ভর “জাতি” বিভাজনকে বুঝাতে গিয়ে আমার জানা মতে বিনয় ঘোষ প্রথম “জাতিবর্ণ” শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু বর্ণাশ্রমের তত্ত্বগত কাঠামোকে অবলম্বন করে গড়ে উঠা জাতিভেদ প্রথাকে বুঝাবার জন্য আমি “বর্ণজাতি” শব্দটি ব্যবহার করেছি। এতে করে নৃতাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক জাতি অর্থে বর্তমানে বহুল প্রচলিত জাতিকে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতি থেকে পৃথক করা সহজ হয়। - ­ লেখক, ১ নভেম্বর, ২০০৮

----------------------------------------------- 

কিন্তু পূর্ব বঙ্গ দীর্ঘদিন হিন্দু সমাজ বিধানের বাইরেই থেকেছে যথেষ্ট পরিমাণে। একদিকে সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম এবং প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির পূজা ব্যাপক জনগণের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল, অন্যদিকে বেদ ও ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম ও ব্যবস্থার সঙ্গে সংঘাত ও মিলনের প্রক্রিয়ায় ছিল বিভিন্ন ধরনের লোকজ বিশ্বাস ও দেবদেবী প্রভাবিত হিন্দু সমাজের ধীর বিস্তার। সেন রাজত্বে হিন্দু সমাজ ও ধর্মের এই বিস্তারের কালটাতে বঙ্গের পশ্চিম থেকে হিন্দু ধর্ম যত পূর্বে এগিয়েছে তাকে তত বেশী লোকজ সহজিয়া রূপের সঙ্গে আপোস করতে হয়েছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দু বর্ণজাতিভেদ প্রথার কঠোর শৃঙ্খল সমাজকে আবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় সমাজ ও রাষ্ট্র শাসনের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখে উপরের তলায় দৃঢ় সামাজিক অনুশাসন রক্ষা করতে পারলেও নীচের দিকে তা ছিল ক্রমবর্ধমানভাবে শিথিল। বিশেষত নদী-খাল-বিল-জলা সমাকীর্ণ ও বন্যাপ্লাবিত পূর্ব বঙ্গ কিংবা আজকের বাংলাদেশে সমাজ কাঠামোই ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এর ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থাই এখানে সুদীর্ঘকাল কোনও সমাজকে দৃঢ়বদ্ধ কিংবা সৃশৃঙ্খল হতে দেয় নি।

এই যে সহজ পথের পথিক জনগণ যারা ছিল অর্ধবৌদ্ধ কিংবা যাদেরকে হিন্দু বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থা সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল এ দেশে মুসলিম বিজয়ের পর তারাই মুখ্যত নূতন ধর্ম ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : বঙ্গে ইসলাম প্রসারের কারণ

অনেকে মনে করেন এবং বলেন যে, বঙ্গের নিম্নবর্ণের অত্যাচারিত হিন্দু জনগোষ্ঠীই প্রধানত মুসলমান হয়েছিল। এটা মোটেই ঠিক নয়। এখানে বর্ণ ব্যবস্থা কিংবা বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থার নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ইসলামের প্রসারের প্রধান কারণ নয়। বরং সমাজকে বর্ণজাতিভেদ প্রথার কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে বা রাখতে না পারাই ছিল ইসলামের প্রসারের প্রধান কারণ।

আসলে বর্ণজাতিভেদ প্রথা ভারতীয় কৃষি সভ্যতার একটি বিশেষ রূপ। তাই ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থা যেখানে দুর্বল বা অস্থিতিশীল থেকেছে, যেখানে কৃষি সমাজ দুর্বল থাকায় সমাজ থেকেছে চলমান কিংবা ভাসমান অর্থাৎ যাযাবর কিংবা অর্ধ যাযাবর তেমন সব স্থানে ইসলাম ধর্ম জনগণের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে।

পশ্চিম ভারতবর্ষে (যা এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত) এবং পূর্ব বঙ্গে ইসলামের এই বিস্তার উপরোক্ত বক্তব্যকে সঠিক প্রমাণিত করে। বর্ণজাতিভেদের নির্যাতনের তীব্রতা যদি ইসলামের সাফল্যের প্রধান কারণ হত তবে যে সব অঞ্চলে বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থা ছিল নিম্ন বর্ণের জনগণের জন্য সবচেয়ে নিপীড়ক ও উগ্র সেই উত্তর, মধ্য কিংবা দক্ষিণ ভারত মুসলমান সংখ্যাগুরুতে পরিণত হত। তা হয় নি। কারণ এই সব অঞ্চলে নিম্ন বর্ণের এবং অস্পৃশ্য হিন্দু জনগণের উপর ব্রাহ্মণের আদর্শিক বা মনস্তাত্ত্বিক এবং বৈষয়িক এই উভয়গত নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব ছিল সুদৃঢ়। এখানে হিন্দু বর্ণজাতিমূলক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের প্রাচীর ভাঙ্গতে পারে নি বলেই ইসলাম ব্যর্থ হয়েছে।

কিন্তু আমরা দেখেছি বঙ্গের ক্ষেত্রে বিশেষত তার পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। এমন কি সেন রাজাদের দ্বারা এখানে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা জাতিভেদ প্রথা দৃঢ়বদ্ধ করার চেষ্টা হয় সেটিও উত্তর ভারতীয় রূপকে রক্ষা করতে পারে নি। মাছ-মাংস আহারের প্রতি লোভ বর্জন করতে না পারায় বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ চিরকালই তার প্রতিবেশী উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণদের দ্বারা ঘৃণিত ও অস্বীকৃত।

সুতরাং আমরা দেখছি যে, হিন্দু সমাজ কাঠামো বহির্ভূত কিংবা তার মধ্যে দুর্বলভাবে রক্ষিত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী থেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ শুরু হয়।

এ দেশে ইসলাম প্রসারের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ “বাংলার মুসলমানের কথা” নামক প্রবন্ধে বলছেন, “বৌদ্ধদের অথবা বৌদ্ধ সমাজ থেকে সদ্য-হিন্দু সমাজে-আগতদের মুসলমান-ধর্ম গ্রহণে আনুকূল্য করেছিল যে সব কারণ, সে-সবের মধ্যে এই দু’টির কথা ভাবা যেতে পারেঃ বৌদ্ধদের মতোই এই নবাগত ধর্ম মূলত নিরাকারবাদী ও জাতিভেদহীন, আর বৌদ্ধদের অনুরূপ অলৌকিকতা-প্রীতি ও গুরুপূজা এই নবাগত ধর্মে ছিল। বাংলার লোকদের প্রকৃতি যে পরিবর্তনলোলুপ, তার একটি প্রমাণ ইংরেজ আমলেও মিলেছে : খৃষ্টান ধর্ম এ দেশে ব্যাপ্ত হতে পারেনি সংস্কার-আন্দোলনের ফলে হিন্দু আর মুসলমান দুই সমাজেই,­ কিন্তু বাংলায় ইউরোপের প্রভাব যত ব্যাপক ও গভীর, ভারতের অন্যান্য প্রদেশে আজো তত নয়।”

(শাশ্বত বঙ্গঃ কাজী আবদুল ওদুদ)

এটা ঠিক যে, বৌদ্ধধর্ম নিরাকারবাদী। কিন্তু মহাযানবাদী বৌদ্ধ ধর্ম বঙ্গে এসে যেভাবে সহজযান ও তন্ত্র সাধনায় অধঃপতিত হয়েছিল তাতে এখানে নিরাকারবাদের আর বিশেষ কোনও প্রভাব থাকার কারণ ছিল না। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দু ধর্মে খুব বেশী পার্থক্য থাকার কথা নয়। পার্থক্য যেটা খুব বড় হয়ে ছিল সেটা জাতিভেদ প্রথা। কিন্তু বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা এবং অলৌকিকতা প্রীতির দ্বারা বৌদ্ধ সমাজও বর্ণজাতি ভেদভিত্তিক হিন্দু সমাজের দিকে ঝুঁকি ছিল নিঃসন্দেহেই।

বৌদ্ধ পাল রাজত্বের পতনের পর কর্ণাটক হতে আগত হিন্দু ব্রাহ্মণ (পরবর্তী কালে রাজ্যশাসন দ্বারা ক্ষত্রিয়ে পরিণত) সেন রাজবংশের রাজত্ব কালে বৌদ্ধ ধর্মের উপর পীড়ন করা হয় যথেষ্ট। অনেকে অনুমান করেন যে, এই নিগৃহীত ও ক্ষুব্ধ বৌদ্ধরা আনুমানিক ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে শেষ সেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের উপর বখতিয়ার খলজীর বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। কিন্তু এটা মনে করার কোনও যুক্তি নেই। বিজয়ীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং প্রাক্তন হিন্দু শাসকদের প্রতি ঘৃণা ও ক্ষোভ থেকে এ দেশের বৌদ্ধ কিংবা নিম্নবর্ণের হিন্দু কিংবা সভ্য সমাজের আওতা বহির্ভূত জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এমন মনে করার যুক্তি খুবই দুর্বল। যদি হিন্দু অত্যাচারেও তারা নিজ বৌদ্ধ বা উপজাতীয় ধর্মকে আঁকড়ে থাকতে পারত তবে ইসলামের বিজয়ের পর বরং আরও নিশ্চিন্তে অতীত ধর্মকে আঁকড়ে থাকত। আসলে এটাই যুক্তি সঙ্গত যে, এ দেশে প্রধানত সেই জনগোষ্ঠীই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে যারা শাসক বা শক্তিমানের ধর্মকে গ্রহণ করতে ভালোবাসে। এদের পূর্ব পুরুষরা যদি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে থাকে তবে সেটা মুখ্যত এটা শাসক শ্রেণীর ধর্ম ছিল বলে। যেমন পাল রাজবংশ ছিল বৌদ্ধ। এবং তারা একটা দীর্ঘ সময় বঙ্গে শাসন করে।

এ বিষয়েও সন্দেহের কোনও কারণ নেই যে, সেন বিজয় এ দেশে হিন্দু ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিল। তবে দু’টি কারণে হিন্দুধর্ম এ দেশে দৃঢ়বদ্ধ হতে পারে নি বলে মনে করার কারণ আছে। একটি হল সেন রাজত্ব বা হিন্দু রাজত্ব খুব দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপার ছিল না। আর একটি হল নদী বিধৌত পূর্ব বঙ্গের সমাজ কাঠামো ছিল অস্থিতিশীল এবং দুর্বল, ফলে দৃঢ়বদ্ধ কৃষি সমাজের ভারতীয় রূপ বর্ণাশ্রম বা জাতিভেদ প্রথা হিসাবে সাধারণভাবে পরিচিত বর্ণজাতি ব্যবস্থা এ দেশে কখনই শক্তিশালী হয়ে সমাজকে বা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। দৃঢবদ্ধ সমাজ কাঠামো দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত এই জনগোষ্ঠীই শাসক বদলের সাথে সাথে ধর্ম বদল করেছে এমন মনে করাই যুক্তিযুক্ত। যখন বিদেশী মুসলমানদের দ্বারা সেন রাজত্ব ধ্বংস হল এবং স্থানীয় হিন্দু রাজারা উৎখাত হল তখন অর্ধসভ্য জনগোষ্ঠী কিংবা সমাজের নিম্নস্তরের এবং প্রান্তস্থ জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ ক্রমে নূতন রাজাদের ধর্ম গ্রহণ করল।

অবশ্য এর সঙ্গে অলৌকিকতা-প্রীতি ও গুরুপূজার ব্যাপারও ছিল যেটার কথা ওদুদ বলেছেন। বিশেষ করে যে সব পীর-দরবেশ বা মুসলমান সাধুরা ইসলাম প্রচারে এ দেশে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁরা এ দেশের জনগণের এই প্রবণতাকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। এ দেশের সহজযানবাদী কিংবা সহজিয়া ও তান্ত্রিক বৌদ্ধদের মধ্যে এবং হিন্দুদের মধ্যে গুরুভক্তির যে প্রচণ্ড প্রভাব ছিল সেটা মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের হাতিয়ার হয়েছে। এই গুরুবাদের মূল কথা গুরুর কাছেই থাকে আসল সত্য এবং গুরুর হাতেই মুক্তি। হাজার বৎসরের পুরাতন সহজযানবাদী বৌদ্ধ ধর্মমতে গুরুবাদ ছিল প্রবল। বৌদ্ধ সহজযানবাদী এবং নাথ যোগীগণ বৌদ্ধ ধর্মের সহজ রূপ তখন প্রচার করে বেড়াচ্ছিলেন জনগণের মধ্যে। এর সহজপন্থা ও গুরুবাদ বুঝলে আমরা পরবর্তী হাজার বৎসরের বাঙ্গালীর অনেক কিছুই বুঝব সহজে। এ প্রসঙ্গে আমরা ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর “বাংলা সাহিত্যের কথা” (প্রথম খণ্ড : প্রাচীন যুগ, প্রকাশিত ১৯৬৩) থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। “বৌদ্ধ সহজিয়াগণ পটমঞ্জরী, বঙ্গাল প্রভৃতি লোকপ্রিয় রাগে গান করিয়া তাঁহাদের মত প্রচার করিলেন। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন­

‘কিং তো মন্তে কিং তো তন্তে কিং তো কাণবাখানে।’

(বৌদ্ধগান, ৫৩ পৃঃ)

‘তোর তন্ত্রে কী কাজ? তোর মন্ত্রে কী কাজ? তোর ধ্যান ব্যাখ্যানে কী কাজ?’ এস, সহজ ধর্মে এস।

‘সহজ এক্কু পর অত্থি তহিঁ ফুড় কাহ্ন পরিজানই।

সত্থাসম বহু পঢ়ই গুণই বঢ় কিং পি ন জানই।’

(ঐ, ১২৭ পৃঃ)

‘সহজ এক পরম। কাহ্ন তাহা স্পষ্ট জানে। মুর্খ শাস্ত্র আগম বহু পড়ে গণে, কিছুই জানিতে পারে না।’ কিন্তু সহজ কী? তাঁহারা বুঝাইলেন­

‘ভণ কইসেঁ সহজ বোলবা জায়

কাঅ বাক চি অ জসু ণ সমায়।’

(ঐ, ৬১ পৃঃ)

‘বল, সহজ কেমনে বলা যায়, যাহাতে কায়বাক্‌ চিত্ত প্রবেশ করিতে পারে না?’

তবে উপায় কী? উপায় গুরু।

‘লূই ভণই গুরু পুচ্ছি অ জাণ।’

‘লূই বলেন, গুরুকে জিজ্ঞাসা করিয়া জান।’

(ঐ, ৬১ পৃঃ)

“.....বৌদ্ধ গানগুলিই পরবর্তী কালের বৈষ্ণব মহাজন পদাবলী ও মুসলমানী মারফতী গানের পূর্বরূপ (proto-type)। এক সময়ে নাথগণের চর্যাগীতি সমস্ত ভারতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। পারস্য সাহিত্যের গযলগীতিরও পূর্বরূপ এই চর্যাগীতি।” (পৃষ্ঠাঃ ১৪)।

সুতরাং আমরা সহজ সাধনা ও গুরু নির্ভরতার প্রতি বাঙ্গালী চিত্তের আকর্ষণ দেখতে পাই অনেক প্রাচীন কাল থেকেই।

এই গুরুদের মানুষের বিশ্বাস অর্জনের একটি বড় উপায় বিভিন্ন কৌশল বা কেরামতি প্রদর্শন যেগুলোকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে মনে করা কিংবা বলা হত। মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে এবং উত্তরকালে পীর-দরবেশদের ধর্মপ্রচারের অনেক কাহিনী আমরা জানি। এইসব কাহিনী থেকে আমরা “অলৌকিক ক্ষমতাধর” পীর-দরবেশ সম্পর্কে যেটুকু জানতে পারি তা থেকে দেখি যে, এদের অনেকেই ছিল সশস্ত্র ইসলাম প্রচারক। তাদের সঙ্গে থাকত সশস্ত্র অনুচর দল বা বাহিনী। প্রয়োজনে তারা যুদ্ধ করত প্রতিপক্ষের সঙ্গে, স্থানীয় হিন্দু শাসকদের সঙ্গে।

এ দেশের সাধারণ মানুষদের একটা বড় অংশ এইসব ধর্ম প্রচারকদের মনস্তাত্ত্বিক কিংবা “অলৌকিক” এবং ব্যবহারিক বা লৌকিক ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত হত। এবং তার সঙ্গে এদের প্রচারিত ধর্ম ছিল বিজয়ী নূতন রাজাদের ধর্ম। সুতরাং শক্তির পূজারী এই মানুষেরা গ্রহণ করতে শুরু করে নূতন ধর্ম ইসলাম। তাদের অতীতের গুরুবাদ এবার পরিণত হল পীরবাদে। অতীতের গুরুদের মত এই নূতন ইসলামী গুরুরাও তাদের পরকালের এবং অনেক ক্ষেত্রে ইহকালেরও অনেক চিন্তাভাবনার দায়িত্ব নিজেদের মাথায় নিয়ে তাদেরকে নিশ্চিন্ত করল। এইভাবে তাদের সহজ পথে চলার আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হল। এই ইসলাম তাই তাদের অতীতের সহজযানবাদীর মত অনেকটা সহজযানবাদী হয়েই তাদের কাছে দেখা দিল। আর যেহেতু এটা বিজয়ীর ধর্ম সুতরাং এটাই শ্রেষ্ঠ। এর সঙ্গে জঙ্গীত্ব বা সমরবাদ যুক্ত হওয়ায় পরনির্ভর এই মানুষগুলোর নিকট ইসলাম নূতন শক্তি ও তাৎপর্য নিয়ে দেখা দিল। অতীতের অহিংস বা নিষ্ক্রিয়তামূলক ধর্মগুলির পরিবর্তে আক্রমণের তেজ ও মনোভাব নিয়ে আগত এই ধর্মের প্রভাব হল প্রবল। সব সময় সাফল্য যাদের কাছে সবচেয়ে বড় আদর্শ, নগদ লাভ যাদের জীবনের পরমার্থ তাদের কাছে ইসলামের আবেদন হল অপ্রতিরোধ্য। বরং এটা গ্রহণ ক’রে শাসকের কাছাকাছি হবার, কাল্পনিক ও বাস্তব শক্তিমানের (আল্লাহ্‌ ও শাসকের) আশ্রিত ও অংশ হিসাবে নিজেদের ভাববার তৃপ্তি এতে পাওয়া যায়। আর এইভাবে স্বদেশের উপর বিদেশের প্রভুত্বের গৌরবের অংশীদার হবার (বাস্তবে নয়, কল্পনায়) সহজ পথ যাদের কাছে পরম কাম্য ও আরাধ্য প্রধানত তারাই হল এ দেশে ইসলাম গ্রহণকারী। কোনও মহৎ কারণে নয়, মহৎ সাধনা দ্বারা নয়, বরং সুযোগ-সুবিধা এবং গৌরব সহজে লাভ করার প্রেরণা থেকেই সাধারণভাবে তারা স্বধর্ম ত্যাগী হয়েছে।

সপ্তম পরিচ্ছেদ : ধর্মান্তরিত মুসলমান বাঙ্গালীর ভূমিকা

বঙ্গে নীচতলা থেকে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছিল মুসলিম শাসনামলে তাদের কোনও সামাজিক মর্যাদা ছিল না বহিরাগত মুসলমানদের কাছে। এইসব ধর্মান্তরিতরা সাধারণত ছিল কৃষক, দরিদ্র, পশ্চাৎপদ, বেদে (বাদিয়া) কিংবা ভাসমান ধরনের লোকজন। এইসব বাঙ্গালী মুসলমানকে বিদেশী বা বহিরাগত শাসক মুসলমানরা ঘৃণা করত আতরাফ বা ছোটলোক হিসাবে। মুসলমান শাসকেরা নিজেদের মনে করত এবং বলত আশরাফ, অর্থাৎ অভিজাত বা সম্ভ্রান্ত।

দেশী মুসলমানরাও নিজেদের এই নীচত্ব নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল না। বরং তারা যে তাদের প্রতিবেশী হিন্দুর তুলনায় তাদের প্রভু মুসলমান আশরাফদের কারণে শ্রেষ্ঠ এই বোধেই তাদের ছিল আনন্দ। এ দেশে হিন্দু জনগণের উত্থানের শক্তির বিরুদ্ধে তারা ছিল একটা অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ বা বাধা।

এদের না ছিল সমাজ সচেতনতা না ছিল আত্মমর্যাদাবোধ। তাই বিদেশী বা বহিরাগত মুসলিমদের বৈদেশিক উত্তরাধিকার নিয়ে গৌরব ও অহংকার এবং তাদের প্রতি ঘৃণাও তাদেরকে পীড়িত করত না।

১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম শাসনামলে বহিরাগত মুসলমান সম্প্রদায় আশরাফ বা অভিজাত হিসাবে নিজেদের যে স্বতন্ত্র সমাজ বা শ্রেণী গঠন করেছিল সেখানে এ দেশী মুসলমানের সাধারণভাবে কোন প্রকার প্রবেশাধিকার ছিল না। এ দেশের আতরাফ মুসলমানদের সঙ্গে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক বাস্তবে নিষিদ্ধ ছিল। তাছাড়া মেলামেশাও ছিল খুবই সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। অবস্থাটা ছিল এই রকম যে, এ দেশের মানুষ ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট এবং যে যত পশ্চিম থেকে আগত সে সাধারণত তত অভিজাত ও উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হত। বঙ্গের বাইরে উত্তর ভারত থেকে আগত মুসলমান হলেও তার মর্যাদা থাকত। এই মর্যাদা ক্রমেই বাড়ত যত বেশী পশ্চিম থেকে আসা যেত তত। এবং পশ্চিম থেকে আগত সেই বংশ তত বেশী শ্রেষ্ঠ বা সম্ভ্রান্ত বা শরীফ বিবেচিত যে বংশে স্থানীয় রক্তের মিশ্রণ না ঘটে যত বেশী থাকত বৈদেশিক পশ্চিমের রক্তের বিশুদ্ধতা।

এই বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণী বাংলা ভাষাতে কথাও বলত না। কালক্রমে তারা তাদের বিভিন্ন বৈদেশিক ভাষার সাহায্যে এবং উত্তর ভারতের হিন্দীর আদিরূপ হিন্দুস্তানী ভাষার সঙ্গে সংমিশ্রণে যে ভাষা গড়ে তুলেছিল সেই উর্দূকে পরিণত করেছিল নিজেদের মাতৃভাষায় এবং পারিবারিক ভাষায়। সেই সঙ্গে চল ছিল ফার্সীর, যা ছিল মুসলিম শাসনামলে এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। ব্রিটিশ রাজত্বেও কিছুকাল পর্যন্ত এটা ছিল ইংরাজীর পাশে এ দেশের অন্যতম সরকারী ভাষা।

অবশ্য এটা ঠিক যে, শত শত বৎসর শাসনের সময় বহিরাগত মুসলমান শাসকেরা সর্বক্ষেত্রে স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংশ্রব বর্জন করে চলতে পারত না। অনেক বহিরাগত মুসলমান সৈনিক কিংবা ব্যবসায়ী বা ভাগ্যান্বেষী এ দেশেই তাদের স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধ্য হত এবং এ দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির স্রোতে মিশে যেত। কিন্তু এই ধারা ছিল প্রাক ব্রিটিশ কালে যথেষ্ট সংকুচিত ও গৌণ। কেবলমাত্র ব্রিটিশ বিজয় দ্বারা রাজ্যচ্যুতিই এ দেশের বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীকে সাধারণ বাঙ্গালীর সমাজ, ভাষা ও সংস্কৃতির সাধারণ ধারায় বিলীন হতে বাধ্য করে। রাষ্ট্র ক্ষমতা গেল। সুতরাং তার সম্পদ আহরণের উপায় গেল। রাষ্ট্র ক্ষমতা গেল। সুতরাং পশ্চিম থেকে বহিরাগত মুসলমানদের আগমনও বন্ধ হল এবং গেল স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার উপায়ও।

রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম অভিজাততন্ত্রের অবস্থা বোঝাতে গিয়ে আমরা ১৮৭১ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত Our Indian Mussalmans গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টারের কথা উদ্ধৃত করতে পারি যেখানে তিনি বলছেন, “১৭০ বৎসর পূর্বে বঙ্গে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের পক্ষে দরিদ্র হওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল; আজ ধনী থাকাই তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব।”

সুতরাং আমরা দেখছি যে, বাইরের মুসলমানদের আভিজাত্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্পদের একমাত্র ভিত্তি ছিল তালোয়ারের শক্তির জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতার উপর দখল। রাষ্ট্রের উপর বহিরাগত মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে এ দেশের সম্পদ ও জনগণের শ্রমশক্তি লুণ্ঠনের অবাধ সুযোগ দিয়েছিল। যখন এই বহিরাগত এবং তাদের বংশধর মুসলমান শাসক-শোষকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা হারালো তখন তারা সম্পদও হারালো, ফলে হারাতে থাকল এ দেশের নিম্ন শ্রেণীর বা আতরাফ তথা ছোট জাতের সাধারণ মানুষ থেকে তাদের বিরাট দূরত্ব।

আসলে রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুতি বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর এ দেশে স্বতন্ত্র অবস্থানের ভিত্তিকেই ধ্বংস করল। তখন তারা নেমে যেতে বাধ্য হল তাদের দ্বারা ঘৃণিত নিম্ন শ্রেণীর মুসলমান বাঙ্গালী জনগণের মধ্যে। তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য হারিয়ে তারা এবার এই মুসলমান জনগণের উপর সামাজিক নেতৃত্ব রক্ষা করার জন্য নূতন উদ্যোগ নিল। ফলে যে মুসলমান জনগণ এতদিন অর্ধ-মুসলমান হিসাবে ছিল তাদেরকে রক্ষণশীল ও পূর্ণ মুসলমান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করল। ওহাবী, ফরায়েজী ইত্যাদি আন্দোলন এর দৃষ্টান্ত।

এইসব ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের পূর্বে এ দেশে সাধারণ মুসলমান জনগণের উপর দেশীয় হিন্দু সংস্কৃতি ও প্রথার প্রভাব গভীর ছিল। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে শুধু যে সাধারণ মুসলমান অংশ নিত তা-ই নয় অনেক দেব-দেবীর পূজা তারা নিজেরাও করত। উইলিয়াম হান্টার তাঁর গেজেটিয়ারে “বলেছেন, কিছু দিন পূর্বেও বাংলায় অনেক মুসলমান দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী প্রভৃতি হিন্দু দেব-দেবীর পূজা করত” (শাশ্বত বঙ্গঃ কাজী আবদুল ওদুদ)। কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর “মুসলমানের পরিচয়” প্রবন্ধে বলছেন, “বাংলার কোনো কোনো সম্ভ্রান্ত মুসলমানও দুর্গা পূজা করতেন একথা সুপ্রসিদ্ধ। এর বড় কারণ বোধ হয় এই যে ওহাবী প্রভাবের পূর্বে মুসলমানদের মানসিক অবস্থা প্রতীকচর্চার একান্ত বিরোধী ছিল না। পীরের কবরে বিশেষ ভক্তিপ্রদর্শন, দিনক্ষণ পুরোপুরি মেনে চলা, সমাজে এক শ্রেণীর জাতিভেদ স্বীকার করা, এসব ব্যাপারে মুসলমানের মনোভাব প্রায় হিন্দুর মতোই ছিল। তাছাড়া মুসলমান লিখিত কাব্যে প্রতিমা পূজারির ভক্তিনিবেদনের সৌন্দর্য অনেকদিন থেকে বর্ণিত হয়ে আসছিল; কাব্য-কল্পনায় আর বাস্তব জীবনে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলার চেষ্টা অনেক সময় মানুষের সমাজে হয়। ” ( শাশ্বত বঙ্গ)।

১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দে লেখা এই একই প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদ বলছেন, “বাংলাদেশের নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানদের বেশভূষা যে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সঙ্গে তুলনায় স্বতন্ত্র রকমের ছিল ­ এখনও যেমন আছে ­ সে কথা সিয়ারুল মোতা’ আখেরীন-এর অনুবাদক প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্বে উল্লেখ করে গেছেন। তিনি তাদের নামে মাত্র মুসলমান বলেছেন কেননা তারা মুসলমানী রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।”

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রসার বঙ্গে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। একদিকে মুসলিম অভিজাত শ্রেণী ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষাকে তাদের মাতৃভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং এইভাবে এ দেশের সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর সঙ্গে নিজেদের এক বিরাট দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়, অন্যদিকে নিম্ন শ্রেণীর মুসলমান জনগোষ্ঠীকে দেশজ ও হিন্দু সংস্কৃতি ও প্রথার প্রভাব মুক্ত করতে থাকে। তখন পর্যন্ত এ দেশের মুসলমান সমাজেও এক ধরনের বর্ণজাতিভেদ প্রথা ছিল। উপারের তলায় ছিল আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণী। সেখানে পাঠান, মোগল, শেখ, সৈয়দ ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগ থাকলেও এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিতরা অধিকতর আভিজাত্যের অধিকারী হলেও সেখানে একত্রে আহার কিংবা নিজেদের বিভিন্ন স্তরের বা গোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃবিবাহ নিষিদ্ধ বা ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু নিম্ন শ্রেণীর আতরাফ এবং অস্পৃশ্য বা অস্পৃশ্য প্রায় আরজাল (মেথর, ঝাড়ুদার, বাদিয়া ইত্যাদি) শ্রেণীর সঙ্গে অভিজাত শ্রেণীর একত্র আহার কিংবা বিবাহ সম্পর্ক ছিল ধর্মত না হলেও বাস্তবে নিষিদ্ধ। এইসব শ্রেণীর মধ্যে আবার ছিল বিভিন্ন জাত যেগুলো কর্ম বা পেশা দ্বারা হিন্দু বর্ণজাতিভেদ প্রথার caste বা জাতের মত। এই ধরনের জাতিভেদ বা শ্রেণীভেদ ব্যবস্থায় উচ্চ শ্রেণী নিম্ন শ্রেণীর জনগণের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্ক এবং একত্র আহার বর্জন করত এবং ঘনিষ্ঠ মেলামেশাও যতোদূর সম্ভব এড়িয়ে চলত। এটা ঠিক যে হিন্দু বর্ণজাতিভেদ প্রথার মত মুসলমান সমাজের বৈষম্য ও পার্থক্য ততটা অনড় ও কঠোর ছিল না, অনমনীয় ছিল না। কারণ ইসলাম ধর্ম নীতিগতভাবে এই ধরনের শ্রেণীভেদকে স্বীকার করে না।

তবে এটাও ঠিক যে, এই শ্রেণীভেদ ছিল যথেষ্ট পরিমাণেই এবং তা ছিল হিন্দু বর্ণজাতিভেদ প্রথার প্রায় অনুরূপ হয়ে। এ সম্পর্কে আমরা এ, কে, নজমুল করিমের Changing Society in India and Pakistan গ্রন্থে বিশদ তথ্য ও বর্ণনা পাই। এই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, “সুতরাং আমরা দেখছি বাংলায় (ভারতের অন্যান্য সব অঞ্চলের মতই) মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতরে বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং শ্রেণী কম বা বেশী হিন্দুদের বর্ণ বা জাতিভেদ ব্যবস্থার মত করে সংগঠিত হয়েছিল।”

রাষ্ট্রহারা মুসলমান অভিজাত শ্রেণী সমাজের নিম্নতলে অবস্থিত তাদের তুলনায় বিপুল সংখ্যাগুরু মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর নিজেদের নৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করার জন্য বর্ণজাতিভেদমূলক শ্রেণীভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করল এবং সেই সঙ্গে তাদের ভিতর থেকে দেশজ সমস্ত প্রভাব দূর করার চেষ্টা শুরু করল। এইভাবে শুরু হল ইসলামীকরণের ধারা। সাধারণ মানুষের জন্য আগে যেটা (ইসলাম) ছিল একটা সাধারণ পরিচয় কিংবা বহিরাগত মুসলিম শাসকদের প্রতি সামাজিক ও নৈতিক আনুগত্যের ব্যাপার এখন সেটা পরিণত হল নিয়মিত আচার-অনুষ্ঠানের কঠোর শৃঙ্খলায়।

রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর শত্রু এখন দুইটা। একটা হল যাদের কাছ থেকে তারা এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল সেই উচ্চ বর্ণের হিন্দু আর একটা যাদের কাছে তারা ক্ষমতা হারিয়েছে সেই ইংরেজ। হিন্দু এখন তাদের আর প্রজা নয়, তাদের দ্বারা শাসিত নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে হিন্দুর অবস্থা তাদের চেয়ে উন্নত হয়েছে। উচ্চবিত্ত হিন্দুর সম্পদ, জমি, শিক্ষা এসব অনেক কিছুই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তার চেয়ে অনেক বেশী।

হিন্দুর প্রতি এখন এই ক্ষমতাচ্যুত বহিরাগত মুসলমানের ঘৃণা ও বিদ্বেষ। ভিন্ন যে কোনও ধর্ম ও ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি ইসলাম ও মুসলমানের যে সহজাত ঘৃণা ও বিদ্বেষ, এবং বিশেষভাবে বহুদেবতা ও মূর্তি পূজার প্রতি ইসলামের যে ভয়ানক আক্রমণাত্মক মনোভাব তার কারণেও হিন্দুর প্রতি এই মুসলমানের যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ এতকাল ছিল তা এখন নূতন মাত্রা পেল। কারণ এতকাল সে তার দ্বারা শাসিত হলেও এখন আর শাসিত নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে উল্টোটাই। এবং তার উপর অতীতের আধিপত্য ফিরিয়ে আনার কোনও পথও সে আর দেখছে না।

হিন্দুর প্রতি এই বহিরাগত মুসলমানের ঘৃণা এবং ক্রোধ। কারণ এখন হিন্দু জাগ্রত ও উন্নত। বস্তুত উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু জাগরণ দ্বারা মারাঠা, শিখসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার যে জাগরণ শুরু হয় তা-ই এই উপমহাদেশে এবং বঙ্গেও বহিরাগত মুসলিম শাসন ধ্বংসের প্রকৃত ও প্রধান কারণ। মীর জাফরের নেতৃত্বে বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণী বিদেশী ইংরেজ শক্তির কাছে বঙ্গের রাষ্ট্র ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল স্বেচ্ছায় নয়, অনিচ্ছায়। এটা তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। এটা না করলে তারা হয় পরবর্তীতে হিন্দু বাঙ্গালী জনগণ দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হত আর নয় হিন্দু ও ইংরেজের সম্মিলিত শক্তির দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হত।

এখানে হিন্দুদের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাগরণের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল এটা বোঝা যায়। অনেক পূর্ব থেকে চৈতন্যের বর্ণজাতিভেদ বিরোধী বৈষ্ণব আন্দোলন এবং বাউল জাতীয় বিভিন্ন উদার মানবতাবাদীদের সামাজিক আন্দোলনগুলি এ দেশের নিম্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যে নূতন ও প্রবল গতিশীল সামাজিক শক্তির উদ্ভবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল। এই ক্ষেত্র যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুত ছিল বলে ব্রিটিশ জয়ের পর ব্যাপক সামাজিক-অর্থনৈতিক ধ্বংস ও বিপর্যয়ের পরও অল্প সময় পরই বঙ্গে হিন্দু সমাজ থেকে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগরসহ বহু সংখ্যক বৃহৎ মানুষ জন্ম নিতে পেরেছিলেন এবং ভিরোজিওর মতো আধুনিক কালের লোকবাদী বিপ্লবী চিন্তার অগ্রদূত এখানে একটা উর্বর ক্ষেত্র পেয়েছিলেন।

অবশ্য এটা ঠিক যে, ব্রিটিশ বিজয়ের পূর্বে তথা নওয়াবী আমলে বঙ্গে হিন্দু জাগরণ তখনও বাঙ্গালীর নূতন সামাজিক-রাজনৈতিক জাগরণের পূর্ণ রূপ লাভ করতে পারে নি। কিন্তু তার লক্ষণগুলো দেখা দিয়েছিল। এমন অবস্থায় বহিরাগত মুসলমান শাসক শ্রেণীর ক্ষমতা চলে যেতে পারত এ দেশী বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর কাছে। আবার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে হিন্দু বণিক ও রাষ্ট্রীয় আমলাদের একাংশকে যেভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেখা যায় তাতে এই একই পদ্ধতিতে ক্ষমতা ভাগ করে নিবার উদ্দেশ্যে হিন্দু নেতৃত্বের ইংরেজের সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও সমঝোতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সম্ভবত এ দেশে উপর তলায় বহিরাগত মুসলমান শাসক ও উদীয়মান হিন্দু প্রজার মধ্যকার বিরোধ ও প্রতিযোগিতাকে ব্যবহার করেই ইংরেজ এত সহজে বঙ্গ জয় করতে পেরেছিল। সম্ভবত মীরজাফর অর্থাৎ তার নেতৃত্বাধীন মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর প্রধান অংশ তখনই পুতুল নওয়াব অর্থাৎ পুতুল শাসক শ্রেণী হতে রাজী হয়েছিল যখন দেখেছিল যে, তার পক্ষে আর বেশী দিন এ দেশের শাসন ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব নয়। সুতরাং যুদ্ধ প্রায় হয়ই নি। উদ্দেশ্য, শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর দ্বারা ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধার যত বেশী অংশ সম্ভব রক্ষা করা।

বহিরাগত মুসলমান শাসক অভিজাত শ্রেণীর এই আশা সম্পূর্ণ না হলেও অংশত পূর্ণ হয়েছিল। যদিও ইংরেজরা জমিদারী বন্দোবস্ত দ্বারা বঙ্গে মুসলমান অভিজাততন্ত্রের প্রধান অংশকে ধ্বংস করেছিল তথাপি তাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নি, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তাকে বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এটা তো জানা যে, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনে নিয়োগ দান এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইংরেজের বিবেচনার একটা প্রধান মানদণ্ডই ছিল বংশ মর্যাদা অর্থাৎ শাসক হিসাবে উত্তরাধিকার। বিশেষত সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিয়োগ দান কিংবা পদোন্নতির ক্ষেত্রে বংশমর্যাদা তথা সামাজিক প্রতিষ্ঠাকে খুবই গুরুত্ব দেওয়া হত। অবশ্য এক কালের স্বৈরাচারী শাসকদের জন্য এই সীমিত সুযোগ যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু মারাঠা বা শিখ উত্থানের মতো কোনও উত্থান দ্বারা নির্মূল হবার সম্ভাবনা থেকে কি এটা তাদের জন্য অনেক ভালো ছিল না?

এটা ঠিক যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর মুসলমানদের প্রতি কিছু সময়ের জন্য ইংরেজের বিরূপতা বেড়েছিল। কারণ এই বিদ্রোহে হিন্দু থাকলেও মুসলমানের ভূমিকা ছিল বেশী। তাছাড়া ওয়াহাবী আন্দোলনের সময় দীর্ঘ কাল বিশেষত পশ্চিমের সীমান্ত এলাকায় ইংরেজের সঙ্গে ওয়াহাবী মুসলমানদের যুদ্ধ চলে এবং এই যুদ্ধের পক্ষে প্রচার ও প্রস্তুতি চলে বঙ্গ পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে। সুতরাং সেই সময় শাসক ইংরেজ মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর প্রতি সন্দিহান ছিল। কিন্তু ইংরেজ ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হতে রাজী ছিল না। সে জানত হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় প্রধান সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব ব্যবহার ও রক্ষা করতে পারার উপর বিশাল ভারতবর্ষে তার ক্ষমতার স্থায়িত্ব নির্ভর করে। সুতরাং হিন্দুদের উপর তলার মত মুসলমান অভিজাত শ্রেণীও তার কৃপা দৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় নি। একটা পুরাতন শাসক শ্রেণীকে হুবহু আগের অবস্থায় রাখলে নূতন শাসক শ্রেণী শাসক শ্রেণী হিসাবেই থাকতে বা আসতে পারে না। সুতরাং সে মুসলমান অভিজাত শ্রেণীকে আয়ত্তে রাখার জন্য যতটুকু ধ্বংস করা দরকার ছিল সেইটুকুই করেছে তার বেশী নয়।

ইংরেজের সহযোগী হয়ে মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর একটা বড় অংশ ভূস্বামী হিসাবে নিজেদেরকে সংগঠিত করল এবং এর একটা অংশ ইংরাজী বিদ্যা শিখে সরকারী চাকুরীর সুযোগ-সুবিধা নিল। এইভাবে মুসলমান অভিজাত শ্রেণী ইংরেজের অধীনে নূতন উচ্চ ও মধ্য শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত হল। আর সমাজের নীচের তলায় যে ব্যাপক মুসলমান জনগণ ছিল তাদের মধ্য থেকেও লেখাপড়া শিখে একটা নূতন মুসলমান মধ্য শ্রেণী গড়ে উঠল।

পুরাতন মুসলিম অভিজাততন্ত্র এখন রূপান্তরিত নূতন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে আর এর সঙ্গে মিলিত হল আতরাফ হিসাবে যারা এক সময় ঘৃণিত ছিল সেই ব্যাপক সংখ্যাগুরু বাঙ্গালীর মধ্য থেকে উদীয়মান শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত হিসাবে পরিচিত নূতন শ্রেণীটি।

এইভাবে বঙ্গের মুসলমানদের মধ্য থেকে সাধারণভাবে মধ্যবিত্ত হিসাবে পরিচিত নূতন শ্রেণী জন্ম নিল। এদের বংশ পরিচয় থেকে অতীত সূত্র মুছতে বা ম্লান হতে শুরু করল। যাদের পশ্চিমের বিদেশী রক্তসূত্র আছে তারা যেমন আর দেবতার আসনে থাকছে না তেমন যাদের বিদেশী রক্তসূত্র নেই সেই বিপুল সংখ্যাগুরুও আর অস্পৃশ্য ও পতিত জনের কাতারে থাকছে না। রাষ্ট্রের ভাষা এখন ফার্সীর পরিবর্তে ইংরাজী, যা এখন সব শিক্ষিতকেই কম বা বেশী জানতে হচ্ছে। সমাজের সাধারণ ভাষা বাংলাও এখন প্রায় সবারই সাধারণ ভাষা। শুধু তা-ই নয় এতদিন এটা যাদের পারিবারিক ভাষা ছিল না এখন ক্রমেই সেটা তাদের বাড়ীতেও প্রবেশ করতে শুরু করল। অনেক ক্ষেত্রে এক বা দুই প্রজন্মেই অতীত ভাষাগত ঐতিহ্যের সূত্রকে ছিন্ন করে বাংলা ভাষা পারিবারিক ভাষায় পরিণত হল। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেল পিতা বা মাতা যেখানে নিজেদের কিংবা সমসম্পর্কের লোকদের মধ্যে উর্দূতে কথা বলছে সেখানে তাদের সন্তানরা শুধু যে উর্দূ বলে না তা-ই নয়, এই ভাষা বুঝতেও পারে না। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষার আবেষ্টন পরাজিত ও ধ্বংস করল বাইরের ভাষার শক্তিকে।

এখন সবাই সাধারণভাবে বাঙ্গালী হল ঠিক, কিন্তু এই বাঙ্গালীর মাথা হল বহিরাগত মুসলমানেরই। তার গৌরব এ দেশের উপর অর্থাৎ নিজেরই উপর বৈদেশিক মুসলমান হানাদার ও আক্রমণকারীদের শাসন ও বলাৎকার নিয়ে। সাধারণ মুসলমান যে এ দেশেরই সন্তান, হাজার বৎসর ধরে যে ভাষা ও সংস্কৃতিতে সে গড়ে উঠেছে এবং যে ভাষা ও সংস্কৃতিকে সে নিজে গড়ে তুলেছে সেটাকে সে তার গৌরবের সামগ্রী না করে আরেক জনের মৃত অতীতকে এবং তার নিজের অতীতের পরাজয় ও অগৌরবকে এখন সে নিজের গৌরবের বিষয় হিসাবে নিল। এই মুসলমান বাঙ্গালীর নেতা হল বঙ্গে নওয়াব সলিমুল্লাহ, সোহ্‌রাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দীনদের মত উর্দূভাষী মুসলমান অভিজাতরা কিংবা এদের সহযোগী ও অনুগামী বাংলাভাষী মুসলমান মধ্য ও উচ্চবিত্ত।

এই মুসলমান নেতৃত্ব সারা ভারতের মুসলমান নেতৃত্বের অংশ হিসাবে দেখা দিল যারা বহিরাগত মুসলমান শাসনের ঐতিহ্য অনুসরণ করে মুসলমানের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিল। জাগ্রত হিন্দু ভারতে কিংবা বঙ্গে তাদের আধিপত্য ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব ছিল না। তার উপর ব্রিটিশ প্রবর্তিত এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচনমূলক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠার ফলে সংখ্যালঘু মুসলমান উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পক্ষে আর কোন দিনই অখণ্ড ভারতে পূর্ণ ক্ষমতা দখলের উপায় রইল না।

বঙ্গের এই মুসলমান নেতৃত্ব অন্তরে বাঙ্গালী নয়। কারণ এখানে তারা বাস করলেও এই দেশটা তাদের গৌরবের সামগ্রী নয়। বরং যে আরব, ইরান, মধ্য এশিয়া এবং পশ্চিম থেকে এসে যুদ্ধ জয় দ্বারা এ দেশকে তারা দখল ও শাসন করেছে বলে মনে করে সেই বিজয় এবং আরব ও পশ্চিম নিয়ে এদের গৌরববোধ। এরা অন্তরে আরব কিংবা ইরানবাসী। এরা যে শুধু বঙ্গকেই নিজেদের প্রকৃত স্বদেশ মনে করতে রাজী ছিল না তা-ই নয়, গোটা ভারতই এদের কাছে ছিল না স্বদেশ। সুতরাং এদের পক্ষে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী হবার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমন কি হিন্দুদের মতো ভারতীয় জাতীয়তাবাদীও হওয়া সম্ভব ছিল না। তবু এদের পক্ষে এ দেশ কিংবা উপমহাদেশ ত্যাগ করে পশ্চিমে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সুতরাং হিন্দুদের সর্বভারতীয় রাষ্ট্র গঠনের বিপরীতে এদেরকে দাবী করতে হল মুসলমান সংখ্যাগুরু অঞ্চলে মুসলমানদের স্বতন্ত্র ভারতীয় রাষ্ট্র গঠনের। এরা দাবী করল সমস্ত মুসলমানের জন্য ভারতে আলাদা দেশ। এটাই দেখা দিল পাকিস্তান আন্দোলন রূপে। হিন্দুদের অখণ্ড ভারত যেটা মর্মবস্তুতে হিন্দু ভারত, তার বিপরীতে পাকিস্তান হয়ে দাঁড়াল মুসলমান ভারত।

হিন্দু-মুসলমানের এই দ্বন্দ্বে বঙ্গ দেশে যেটা তলিয়ে গেল সেটা হল বাঙ্গালী জাতিসত্তার ঐক্যচিন্তা এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ।

অষ্টম পরিচ্ছেদ : মুসলমান বাঙ্গালীর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য

আমরা জানি সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী এ দেশেরই বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু বা সমজাতীয় অধিবাসী যারা বিদেশী বিজয়ী শাসকদের ধর্ম ইসলাম গ্রহণ করেছিল বিভিন্ন সময়ে। এই ধর্মান্তরিত দেশী মুসলমানের সংখ্যাই বহিরাগত মুসলমানদের তুলনায় বহুগুণে বেশী। আবার এই দেশী ধর্মান্তরিতদের ব্যাপক সংখ্যাগুরু অংশই ছিল নিম্নশ্রেণীর মানুষ। উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার লোভসহ বিভিন্ন কারণে ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের সংখ্যা ছিল খুব কম। উচ্চ শ্রেণীর ধর্মান্তরিতরা বহিরাগত মুসলমান অভিজাততন্ত্রের মত নিম্নশ্রেণীর ধর্মান্তরিতদের থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখত। এটা ঠিক যে, কালক্রমে নানানভাবে বহিরাগত মুসলমানদের সঙ্গে দেশী মুসলমানদের এবং উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানদের সঙ্গে নিম্ন শ্রেণীর মুসলমানদের মিশ্রণ ঘটতে থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক উত্থান-পতন এই সব মিশ্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এমন কি বহিরাগত মুসলমান আধিপত্যের যুগেও যে, বহিরাগতরা সবক্ষেত্রে এই মিশ্রণ এড়াতে পারত না কিংবা এড়াত না এটা নিশ্চিত। কারণ অনেক ক্ষেত্রে এদেশ থেকে তাদের স্ত্রী সংগ্রহ না করে উপায় থাকত না। তাছাড়া নানানভাবে নানান উপলক্ষ্যে মিশ্রণ ছিল একটা অনিবার্য ফল। তবে সে যুগে শাসক ও শাসিতে দূরত্ব এবং বহুক্ষেত্রে উভয়ের স্বাতন্ত্র্য ছিল সাধারণ নিয়ম। কিন্তু মুসলমান আধিপত্যের অবসানে প্রভুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের হাতিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তচ্যুত হবার পর মুসলমান শাসক গোষ্ঠীর যে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার উপায় থাকত না সে কথা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি।

এই সামগ্রিক সংমিশ্রণের প্রক্রিয়ায় একদিকে বহিরাগত মুসলমান ও তার সংস্কৃতি দ্বারা দেশী মুসলমান বাঙ্গালী যেমন প্রভাবিত হয়েছে তেমন দেশী মুসলমান বাঙ্গালীর চরিত্র ও মন-মানসিকতা দ্বারা বহিরাগত মুসলমানরাও প্রভাবিত হয়েছে। এবং যেহেতু মুসলমান বাঙ্গালীরাই সংখ্যায় বিপুল অধিকাংশ সুতরাং শেষ পর্যন্ত এদের প্রভাবই হয়েছে চূড়ান্ত ও নিয়ামক। এদের ভাষা বাংলা হয়েছে শেষ পর্যন্ত সবার ভাষা। যতই ইসলামী সংস্কৃতি ও আচার চর্চা করা যাক, অবোধ্য কিংবা দুর্বোধ্য আরবীর যতই চর্চা করা যাক শেষ পর্যন্ত বোধ্য ও মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে অনেক হাজার বৎসরের বাঙ্গালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আবেষ্টন গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে সমস্ত বাঙ্গালী সমাজ ও মনকেই। অনেক ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও হিন্দু এবং দেশজ বিভিন্ন উপাদান ঢুকে পড়েছে মুসলমান বাঙ্গালীর বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি এমন কি বিশ্বাসেও। লেখক কর্তৃক এমন ঘটনার কথা জানা আছে যে, প্রচণ্ড উগ্র ও রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা মৌলবীর এবং অন্যান্য পুরুষের নিষেধ অগ্রাহ্য করে সকল বিবাহের সময় চারদিক মুখরিত করে বিয়ের গীত নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠান করেছে। বাধা দিলে মেয়েরা এভাবে বলেছে, “আমরা সব সময় আপনাদের সব কথা মানি। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাদের কথা আমরা মানব না।” শেষ পর্যন্ত রক্ষণশীল আহ্‌লে হাদীস বা মুহাম্মদী মুসলমান কর্তৃত্বও প্রবলভাবে নৃত্য-সঙ্গীত এবং দেশজ লোকাচারের বিরোধী হয়েও এইখানে হার মেনে চুপ করে গেছে।

কাজেই শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে হাজার বৎসরের বাঙ্গালীরই। সুতরাং এ দেশের বাঙ্গালী মুসলমানের চরিত্র বৈশিষ্ট্য বুঝতে গেলে আমাদের প্রধানত বুঝতে হবে এ দেশের নিম্ন শ্রেণীর ও সাধারণ মুসলমানের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য। এই সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর মধ্যেই আছে আজকের সকল সঙ্কটের একটি প্রধান উৎস। এদের মন-মানসিকতা, প্রবণতা ও চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং সেগুলোর কারণ অনুসন্ধান তাই আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এগুলো থেকে যেমন পাব সঙ্কটের একটি প্রধান উৎসের সন্ধান তেমন আমরা খুঁজে বের করতে পারব সঙ্কট প্রতিকারের উপায়ও।

নবম পরিচ্ছেদ : প্রকৃতির সন্তান

মানুষের সমাজ বিকাশ ও মানসিকতা গঠনে প্রকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বস্তুত মানুষ প্রকৃতির এক অভিব্যক্তি। হাজার হাজার বৎসর ধরে নির্দিষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানে বাস করলে সেই ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা মানুষের আচার-ব্যবহার, কর্মধারা এমন কি চিন্তা ও মনও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। আজকের বাংলাদেশের মুসলমান বাঙ্গালীর মধ্যেও আমরা দেখব পূর্ব বঙ্গের এই ভূ-প্রকৃতির গভীর প্রভাব। বস্তুত এ দেশের ভূ-প্রকৃতিক আবেষ্টনে অনেক হাজার বৎসর ধরে যে বাঙ্গালী গড়ে উঠেছে তাকে বুঝতে হলে এ দেশের ভূমি ও প্রকৃতিকেও আমাদের বুঝতে হবে এবং এই বাঙ্গালীকে বুঝতে হবে এই ভূমি ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়েই। মানুষ ও প্রকৃতি এই উভয়ের সংঘাত ও মিলনের ধারায় গড়ে উঠেছে আজকের বাঙ্গালীর যে চরিত্র-বৈশিষ্ট্য সেগুলোকে ঠিক মত বুঝতে পারলে আমরা আমাদের অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারব।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে বঙ্গের এই অঞ্চল মূলত ব-দ্বীপ – অসংখ্য ব-দ্বীপের সমষ্টি এক বৃহৎ ব-দ্বীপ অঞ্চল। অসংখ্য নদীর স্রোতধারা বয়ে গেছে এই ভূভাগের উপর দিয়ে। বলা উচিত হাজার হাজার নদী, খাল, বিল এই দেশকে জালের মত ঘিরে রেখেছে। বৎসরের ৫/৬ মাস সময় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এ দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এবং সেই সঙ্গে হয় কম বা বেশী বন্যা।

আসলে পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশকে নিয়মিত বাৎসরিক বন্যার দেশ বলাই ভালো। কারণ শুধু যে এ দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তা-ই নয়, উপরন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের বিপুল জলপ্রবাহ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে এই ভূ-খণ্ড দিয়েই। নেপাল, ভূটান ও তিব্বত এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল, সিকিম, ত্রিপুরা, নাগাল্যাণ্ড, মণিপুর, মিজোরাম এবং পশ্চিম বঙ্গের উত্তরাংশের অধিকাংশ এবং কোনও কোনও এলাকার সম্পূর্ণ বৃষ্টি ও পার্বতের বরফগলা জলস্রোত এই পথ দিয়েই সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। পশ্চিম বঙ্গ দিয়ে যেটুকু জলস্রোত যায় তার তুলনায় বহুগুণ বেশী জলস্রোত যায় পূর্ব বঙ্গ দিয়ে। কাজেই বর্ষার সময় বাইরের আসা পানির সঙ্গে এখানকার বৃষ্টির পানি মিলে নীচু সমস্ত অঞ্চলকেই প্লাবিত করে। অতীতে যখন এত বাঁধ, রাস্তা, সেতু, রেল-লাইন এবং গ্রাম ও নগর বা জনবসতি ছিল না তখন বৃষ্টির জলরাশি এবং উত্তর থেকে নদীপথে আগত জলপ্রবাহ নদী, খাল, বিল এবং নিম্ন ভূমি দিয়ে সহজেই সমুদ্রে প্রবাহিত হয়ে যেতে পারত বলে বন্যার এতো রুদ্র ও ক্ষতিকর রূপ, যা এখন আমরা ঘন ঘন দেখছি, এ দেশকে কমই দেখতে হত। অবশ্য অতীত কালে গাছের আধিক্য বা বনের অবস্থানও বন্যার আঘাতকে অনেকটা প্রতিহত করত। বন থাকায় বৃষ্টির পানি যেমন উঁচু ভূমি থেকে হঠাৎ করে নীচের দিকে ছুটে আসতে পারত না তেমন নদীখাত ছেড়েও হঠাৎ করে চতুর্দিক প্লাবিত করতে পারত না। আর বন নিধন ও সর্বত্র চাষের ফলে ভূমিক্ষয় নীচু জমিগুলোকে যেমন ভরাট করেছে অনেকখানি তেমন উঁচু জমিগুলোকেও নীচু করেছে যথেষ্ট পরিমাণে। ফলে এখন বন্যা অনেক বেশী ক্ষতির কারণ হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ যা-ই হোক এটাই সবচেয়ে বড় কথা যে, কম-বেশী নিয়মিত বাৎসরিক বন্যা বা প্লাবনের দেশ এটা।

মূলত বন্যা আর নরম পলির দেশ এটা। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের কিছু অংশ এবং সিলেট অঞ্চলের সামান্য কিছু সীমান্তবর্তী এলাকা বাদে এবং দিনাজপুর-গাইবান্ধা-জয়পুরহাট-নওগাঁ-বগুড়ার একাংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র ভূমি ও ঢাকা-জয়দেবপুর-মধুপুরের লাল মাটি অঞ্চল বাদে আর সবটা গঠিত হয়েছে নরম পলির দ্বারা। দেশটার প্রায় সবটাই এক সময় সমুদ্রগর্ভে ছিল এবং নরম পলি পড়ে হাজার হাজার বৎসর ধরে দেশটার অধিকাংশ গড়ে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দক্ষিণের এক বিরাট অঞ্চলের বয়স কয়েক হাজার এমন কি কয়েক শত বৎসর মাত্র।

এই রকম এক দেশের আর এক বৈশিষ্ট্য হল নদীর ভাঙ্গন। হাজার হাজার বৎসর ধরে এর নদীগুলি অবিরাম খাত পরিবর্তন করে কিংবা তীর ভেঙ্গে এবং নূতন তীর গড়ে এসেছে। অসংখ্য গ্রাম, শহর ধ্বংস করেছে বলে পদ্মাকে বহুকাল ধরে বলা হয় কীর্তিনাশা। কিন্তু পদ্মাকে এই উপাধি দেওয়া হলেও এ দেশের প্রায় সব নদীই কীর্তিনাশা।

নদীগুলোর প্রমত্ততা ও নাব্যতা অবশ্য এখন আর আগের মত নেই। ভূ-প্রকৃতির প্রতি দৃকপাতহীন রেলপথ, রাস্তা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ দ্বারা জল-প্রবাহের সহজ গতি যেমন রুদ্ধ হয়েছে তেমন নদীগুলোও অনেক নিয়ন্ত্রিত ও শান্ত। হয়ত বনাঞ্চল নিধন বৃষ্টিপাতও অনেক কমিয়ে দিয়েছে পূর্বের তুলনায়। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বেও যেসব নদীতে বা স্থানে স্টীমার চলত এখন সেখানে অনেক জায়গায় বারোমাস নৌকাও ভালোভাবে চলে না। যশোর শহরের ভিতর দিয়ে যে মৃতপ্রায় নদী বয়ে গেছে তার নাম ভৈরব। আমার কৈশোরে যশোরে থাকতে প্রাচীনদের কাছে শুনতাম যে, বর্ষায় এই ভৈরব নদীর গর্জন শোনা যেত বহু দূর থেকে। আর বারোমাসই এটি ছিল নাব্য ও খরস্রোতা। স্রোতের প্রচণ্ডতা ও গর্জনের ভৈরব রূপকে প্রকাশ করার জন্যই হয়ত তার নাম দেওয়া হয়েছিল ভৈরব। কিন্তু সেই ভৈরব নদী বার্ধক্য দশায় এখন নিজেকে কোনও রকমে ক্ষীণ স্রোত দ্বারা টিকিয়ে রাখলেও তার উপরটা ভরে থাকে কচুরিপানায়। ভৈরবের মত দশা বাংলাদেশের অনেক নদীরই। কিন্তু এ দেশের মানুষ ও তার মনকে অনেক হাজার বৎসর ধরে গড়েছে বা প্রভাবিত করেছে বর্ষা, বন্যা আর প্রমত্ত নদীগুলো।

দেশটা অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং জলাভূমির জন্য বৎসরের বেশীর ভাগ সময় থাকে আর্দ্র বা ভেজা। জলবায়ু আর্দ্র এবং সেই সঙ্গে গরম বা উষ্ণ। শীতের দুই মাস এবং বসন্তের ফাল্গুন মাসে শীত বা ঠাণ্ড থাকে বটে, কিন্তু বাকী নয় মাসই কম বা বেশী গরমের কবলে থাকে। তবে এই গরম মরুভূমি বা শুষ্ক দেশের মত গা জ্বালা করা বা ধারালো নয়, বরং গা সিদ্ধ করা বা ভোঁতা। আর্দ্রতার সঙ্গে উষ্ণতা মিলে একটা ভ্যাপসা গরম পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখে বৎসরের বেশীর ভাগ সময়। বিশেষ করে বসন্তের চৈত্রমাস এবং গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ এবং হেমন্তের কার্তিক মাস পর্যন্ত মাসগুলোর সূর্যের প্রচণ্ড রোদ যথেষ্ট পীড়াদায়ক। সুতরাং তখন গাছের ছায়ার নীচে কিছু ঠাণ্ডা বাতাস হাজার বছর ধরেই এ দেশের মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এই রকম গরম দিনগুলোতে মানুষ খোলা জায়গায় গাছের ছায়ায় শরীর জুড়ানো বাতাসে নিদ্রার আকর্ষণ অনুভব করেছে বেশী।

জীবন এখানে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় সহজ। এখানে নরম পলিমাটি উর্বর। অল্প পরিশ্রমে তাতে ফসল ফলে। তাছাড়া এ দেশের ভ্যাপসা গরম এবং রোদের তীব্রতা মানষকে দ্রুত ক্লান্ত করে, কর্মশক্তি হরণ করে শুষ্ক গরম বা উষ্ণ এবং শীতপ্রধান দেশের তুলনায় অনেক দ্রুত। এমতাবস্থায় এ দেশের মানুষ হয় তুলনামূলকভাবে অলস ও আরামপ্রিয়।

তার মানে এই নয় যে এ দেশের মানুষ পরিশ্রম করে না। একেবারে শ্রম না করলে সাধারণ মানুষ খাবে কী করে, বাঁচবে কী করে? সুতরাং বাঁচবার জন্যই তাকে শ্রম করতে হয়, জমি চাষ করতে হয়, ফসল ফলাতে হয়, মাছ ধরতে হয়, ঘর তৈরী ও মেরামত করতে হয়, জঙ্গল সাফ করতে হয়। এগুলি তাদেরকে হাজার হাজার বৎসর ধরে করতে হয়েছে। কিন্তু এক সময় আবাদে পরিশ্রম খুব বেশী ছিল না। কারণ জমি যে শুধু উর্বর ছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু নদী তীরবর্তী এলাকাগুলির বহু জায়গায় চাষেরও বিশেষ একটা প্রয়োজন হত না। অনেক জমিতে বর্ষার বা বন্যার পানি নেমে গেলে নরম পলিমাটিতে অল্প চাষে কিংবা বিনা চাষে ধানের বীজ ফেলে বা রোয়া লাগিয়ে দেওয়া হত। আমনের আবাদ ছিল খুব সহজ। বিশেষ কোনও যত্ন বা পরিচর্যার প্রয়োজন হত না, যেটা আজও হয় না। বন্যার উপযোগী ধান গাছগুলো পানি বাড়ার সাথে সাথে বড় হত। জনসংখ্যাও তো তখন খুব কম ছিল আজকের তুলনায়। ফলে যা ফসল হত তা তখনকার মানুষের জন্য যথেষ্টই ছিল। আর ছিল মাছ ও শাকের প্রাচুর্য।

এ দেশের ভূমি এবং প্রকৃতি এমন যে জীবনের একটা নির্দিষ্ট মান প্রকৃতিই সাধারণভাবে নিশ্চিত করে দিত যাতে মানুষ প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বাঁচতে বাধ্য হত। এ দেশে জমির উর্বরতার মান বা ফসলের পরিমাণ মোটামুটি নির্দিষ্ট। এর জন্য খুব একটা শ্রম করতে হয় না। প্রায় প্রতি বৎসর বন্যার পলি পড়ে নদী তীরবর্তী বিশাল ভূভাগ উর্বর হত। ফলে সারের প্রয়োজন ছিল কম। কিছু জমিতে গোবর সার দিতে হত। কিন্তু এ দেশে জমির যতই যত্ন করা যাক ফসলের পরিমাণ সাধারণত তাতে খুব বেশী হয় না। আধুনিক উন্নত চাষাবাদেও আমরা দেখেছি যে, এ দেশে ফসল বা ধানের ফলন জাপান, থাইল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশের চেয়ে কত কম। তাছাড়া এই উন্নত ও যান্ত্রিক পদ্ধতির আবাদে যে বিপুল ব্যয় হয় তাতে কৃষি আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে তেমন একটা লাভজনক থাকে না।

এ থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের মাটির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যা যদি বৃষ্টি বা জলসেচ পায় তবে ফসলের একটা মোটামুটি নির্দিষ্ট মাত্রাকে অনুমাদন করে, তার বেশী নয়। কিন্তু একটু যত্ন করলেই আবার খুব কমও এখানে ফলে না। বহু অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এখানে মাটির উর্বরতা বা ফলনের সীমাবদ্ধতা দেখতে পেয়েছি। এর কারণ কী হতে পারে?

সম্ভবত এর পিছনে দু’টি কারণ আছে। প্রথমত, এ দেশের মাটির বুনিয়াদ বা ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। প্রায় সবটাই পলিদ্বারা গঠিত। বেশীর ভাগ এলাকার মাটি আবার দোআঁশ। অর্থাৎ বালির পরিমাণ যথেষ্ট। এর ফলে মাটিতে যত সারই দেওয়া যাক তা দ্রুত চুইয়ে সহজেই তলিয়ে যায়। কাজেই প্রচুর সার দিলেও তার ক্রিয়া বেশী সময় থাকতে পারে না। বিশেষত এ দেশের অতিবর্ষণ এই চোয়ানিকে সাহায্য করে। এর ফলে জমির সার বা সারালো অংশ ফসলের শিকড়ে না থেকে চলে যায় তারও নীচে। দ্বিতীয়ত, অতিবর্ষণ বা প্রচুর বৃষ্টিপাত জমির উপরের দিকের সারের বড় অংশ ধুয়ে নিয়ে যায় নদী, খাল দিয়ে সমুদ্রে।

এই অবস্থায় এখানে প্রধানত শ্রম নয় বরং প্রকৃতি ফসল বা কৃষি উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে খুব বেশী রকম। ফলে কৃষিজীবী কিংবা প্রকৃতি নির্ভর মানুষ হয় খুব বেশী ভাগ্যবাদী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক কারণেই শ্রম বিমুখতা, যা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনায় বলেছি। এখানে মানুষ একটা নিম্ন মাত্রায় শ্রম করেছে। সে জেনেছে যে, এটুকু করলে তার চলে যাবে আবার তার বেশী করে খুব একটা লাভও নেই।

দশম পরিচ্ছেদ : নদী ভাঙ্গনের সমস্যা

এ দেশের মানুষ হাজার হাজার বৎসর ধরে প্রাকৃতিক কারণে ভাগ্যবাদী হয়েছে কিংবা যেটাকে অনিবার্য মনে করেছে তেমন সমস্ত বৃহৎ ঘটনাকে মেনে নিয়েছে। কারণ যখন বন্যা আসে কিংবা যখন নদী ভাঙ্গন তার বসত-ভিটা বা জমি নদীগর্ভে নিয়ে যায় তখন সে জেনেছে যে তার কিছু করার নেই। তখন সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে তার উঁচু বাসগৃহে কিংবা নৌকায় অথবা নূতন নদীচর বা এলাকায় গিয়ে বসত করেছে। বর্ষা ও বন্যার দিনগুলিতে যখন তার বিশেষ কিছু করার থাকে না সে তখন নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছে, মাছ ধরেছে, গান গেয়েছে, হাট-বাজার করেছে। আজকের দিনে অবস্থাটা ঠিক তেমন নেই। কিন্তু এটা তো সাম্প্রতিক পরিবর্তন। এখানে আমি হাজার বছরের বাঙ্গালীর জীবনযাত্রার কথা বলছি।*

-----------------------------------------------

* ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট অফিসার জে,সি, জ্যাক ১৯১৫ সালে সমাপ্ত তার বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ “বাংলার একটি জেলার অর্থনৈতিক জীবন” (The Economic Life of A Bengal District)-এ বাঙ্গালীর জীবনের এই দিককে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্ট, আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা­ ১২০৭ কর্তৃক ১৯৯৩ সালে এটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়।

-----------------------------------------------

অতীতের বাঙ্গালীর কাছে বন্যা যেমন ছিল অপ্রতিরোধ্য এবং তার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বাইরের শক্তি দ্বারা সংঘটিত (যেমন বৃষ্টি বা বাইরের আগত জলপ্রবাহ দ্বারা) অনিবার্য ঘটনা তেমন ছিল সামাজিক-রাজনৈতিক বৃহৎ পরিবর্তন বা ঘটনাগুলিও। সে মনে করেছে বন্যা যেমন আসে বাহির থেকে এইসব পবিবর্তনও তেমন আসে বাহির থেকে। কোনওটাতেই নিজের বিশেষ কোনও ভূমিকা সে দেখে নি। বন্যার বিরুদ্ধে মারামারি না করে যেমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রক্ষা করেছে বা তার স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময় কাটিয়েছে কিংবা নদী ভাঙ্গনের শিকার হলে সেখান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নূতন জায়গায় গিয়ে ঘর বেঁধেছে ঠিক তেমনই সে এইসব সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিবর্তনেও নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে এগুলির সঙ্গে যতটা সম্ভব তাল মিলিয়ে এবং এগুলির সুযোগ নিয়ে কিংবা এগুলি থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে। সে জেনেছে যে, বন্যা এক সময় নিজস্ব নিয়মেই চলে যায়, বর্ষাও চলে যায় এবং মাঠ, পথ শুকায়, তখন আসে তার ফসল তোলার সময়, ঠিক একইভাবে এইসব বৃহৎ সামাজিক-রাষ্ট্রিক উপদ্রব বা পরিবর্তনের ঢেউও এক সময় মিলিয়ে যায় এবং তার আয়ত্ত বহির্ভূত বাইরের শক্তি দ্বারাই তার উপর নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলিও এক সময় স্থানচ্যুত হয়। সুতরাং তার করার কী আছে? তার জীবন দর্শনের চমৎকার প্রকাশ বোধ হয় এই গানটিঃ

এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে

এই তো নদীর খেলা,

সকাল বেলায় আমীর রে ভাই

ফকীর সন্ধ্যাবেলা।

সে তা-ই থাকে শুধু পরিবর্তনের সুযোগ নিবার অপেক্ষায়। নিজেকে পরিবর্তন সংগঠনকারী শক্তি হিসাবে ভাবতে সে শিখে নি।

সুতরাং বাঙ্গালীর মধ্যে এসেছে প্রচণ্ড রকম ভাগ্যবাদ বা অবস্থা নির্ভরতা এবং সেই একই সঙ্গে নিদারুণ সুবিধাবাদ বা সুযোগ সন্ধান। সে পরিস্থিতিকে বদলাবার কষ্ট করতে চায় নি। পরিস্থিতি বা অবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের জন্য লড়াইয়ের সাহসী অথচ অনিশ্চিত পথ তাকে আকৃষ্ট করে নি, বরং পরিস্থিতির সুযোগ নিতেই সে থেকেছে অনেক বেশী তৎপর।

এখানে ১৯৬৯-এর আইয়ুব বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের পর ইয়াহিয়ার শাসনামলের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়। এটি আমার নিজ অভিজ্ঞতা। তখন অল্প দিন হল সামরিক আইন হয়েছিল এবং গণ-অভ্যুত্থান থেমে গিয়েছিল। আমি তখন গণ-আন্দোলন সংগঠিত করতে ব্রহ্মপুত্র নদী অববাহিকার বিভিন্ন এলাকায় ভ্রমণ করছিলাম। সেই সময় এক এলাকার আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা, কলেজের একজন ছাত্র লীগ নেতার সঙ্গে আলোচনায় আন্দোলনের প্রয়োজন তুলে ধরলে তার উত্তর ছিল চমকপ্রদ। তা ছিল এই ধরনের, ‘বন্যা এলে বাঘ যেমন উঁচু জায়গায় লুকায় এখন আমরাও তেমন লুকিয়ে আছি। সময় আসুক, তখন আমরা আবার আন্দোলনে ঝাঁপ দিব।’ অর্থাৎ আন্দোলনের জন্য পরিস্থিতি তৈরী করার শ্রম দিতে বা ঝুঁকি নিতে সে রাজী ছিল না। আসলে তার উত্তর ছিল এই জাতির সংখ্যাগুরু জনগণের মানসিকতার সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী প্রকাশ।

সামাজিক পরিস্থিতি তো কাউকে সৃষ্টি করতে হয়। এটা আপনা আপনি সৃষ্টি হয় না। ফলে এই মানসিকতার পরিণতি হয় বাইরের শক্তি দ্বারা সংঘটিত ঘটনাবলীর উপর নির্ভরতা এবং সেই সঙ্গে এই ঘটনাবলী ঘটাবার বাইরের শক্তির উপরও নির্ভরতা। এ দেশের সাধারণ মানুষ সামাজিক ঘটনাবলীকেও ধরে নিয়েছে প্রকৃতির মত, বন্যা, ঝড় ও বৃষ্টির মত তার আয়ত্ত বা ক্ষমতা বহির্ভূত এবং বাইরের উৎসজাত ঘটনা হিসাবে। এর ফলে সে হয়েছে বাহিরের — বহির্দেশীয় শক্তির, হানাদার ও অনুপ্রবেশকারী শক্তির সহজ ক্রীড়নক বা পুতুল। অনেক সময় সে তার প্রতিবেশীর লুণ্ঠন ও উৎসাদনে বহিরাগতকে সাহায্যও করেছে এই আশায় যে এতে সে বাঁচবে, কিংবা প্রতিবেশীর লুণ্ঠন ও উৎসাদনে বহিরাগত আগ্রাসী ও লুণ্ঠনকারীদের সঙ্গে নিজেও যুক্ত হয়েছে সহজপ্রাপ্তি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে না চেয়ে। এইভাবে বাহির থেকে যারা শক্তি নিয়ে আসতে পেরেছে সে তাদের সহজ অনুচর বা সহযোগী হয়েছে, এবং তাদের বিরুদ্ধে না লড়ে তাদেরকে প্রভু হিসাবে মেনে নিয়েছে।

একাদশ পরিচ্ছেদ : নীতির সমস্যা

সুতরাং আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি তা হল বাঙ্গালীর নীতিবোধের সমস্যা, মূল্যবোধ বা নৈতিকতার সমস্যা। নীতির কাজ মূলত মানুষকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করা, সেই সঙ্গে প্রকৃতি ও জীবজগতের সঙ্গেও যুক্ত করা। অর্থাৎ নীতির সমস্যা মানুষকে মানুষসহ তার আবেষ্টনের সঙ্গে যথাযথভাবে যুক্ত করার সমস্যা।

সুতরাং নৈতিকতা দ্বারা গড়ে উঠে পরিবার, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, সমাজ, জাতি এবং মানব জাতির সংহতি। মানুষ যেমন পরিবর্তনশীল, পরিবর্তনশীল তার পরিবেশ, পরিস্থিতি, জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থা তেমন মানুষের ঐক্য বা সংহতি রক্ষা করতে গিয়েও পরিবর্তিত হয় নীতিবোধ বা নৈতিকতা। কিন্তু এই নীতি পরিবর্তনে একটা নিয়ম বা শৃঙ্খলা থাকাই স্বাভাবিক বা বাঞ্ছনীয়। কিংবা এই পরিবর্তন যখন তখন হওয়া ক্ষতিকর হয় সমাজের জন্য। এতে কোনও বৃহত্তর সমাজ বা গোষ্ঠী গড়ে তোলা যায় না বা দেখা দেয় সামাজিক বিশৃঙ্খলা। এর ফলে সহজেই আসে বা চেপে থাকে বাহিরের সমাজ বা শক্তির আগ্রাসন ও আধিপত্য।

বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় সঙ্কট হল এই নীতির সঙ্কট। এটা আজকের নয়, বরং হাজার হাজার বছরের। অর্থাৎ সুদীর্ঘ কাল ধরে এখানে গোষ্ঠী ও বৃহত্তর সমাজ গঠনই ভালভাবে করা যায় নি। এটাও এ দেশের প্রকৃতির কারণে। অতীতে নদীগুলো যখন ছিল শাসনহীন এবং সেতু ও বাঁধের বন্ধন মুক্ত তখন এ দেশে নদীর ভাঙ্গন ছিল আজকের তুলনায় বহুগুণ বেশী।

এই নদীর ভাঙ্গনে জনবসতি অবিরাম ছত্রভঙ্গ হয়েছে। সাধারণত একটা পাড়া বা গ্রাম একবারে ভাঙ্গে না। ভাঙ্গে একটু একটু করে। আর সেই সঙ্গে একটা বা কয়েকটা পরিবার উঠে যায় ভিন্ন এলাকায়, হয়ত নদী যেখানে নূতন চর গড়ছে বা গড়েছে সেখানে। কিন্তু গোটা গ্রাম বা প্রতিবেশীরা এভাবে একখানে উঠে যেতে নাও পারে। কারণ ভাঙ্গন হয়ত চলে কয়েক বৎসর ধরে একটু একটু করে, অথবা কিছু ভেঙ্গে তারপর থেমে থাকে কয়েক বৎসর। এই রকম অবস্থায় একটা গ্রাম বা তার একাংশ এক জায়গায় স্থানান্তরিত হবে এমন নয়। বরং যে যেখানে সুবিধা পায় সেইখানে ছড়িয়ে যায়। এইভাবে চর বা নদী তীরবর্তী মানুষ বারবার ছড়িয়েছে, বিভিন্ন স্থানে বসতি করেছে। এর ফলেও বৃহৎ কোনও উপজাতি বা গোত্র বা সমাজ গড়ে উঠে না। অবশ্য এটা ঠিক যে ভাসমান বেদে বা বাদিয়াদের মধ্যে গোত্রবদ্ধতা দেখা যায়। কিন্তু তারা ছিল সম্পূর্ণরূপে ভাসমান ও যাযাবর। আজও তারা অনেকাংশে তা-ই। এতটা যাযাবর হলে মানুষের পক্ষে কৃষিজীবী হওয়া সম্ভব নয়। আর এটাও ঠিক যে এই যাযাবর গোষ্ঠীগুলিও ছিল ক্ষুদ্র, আজও তা-ই। বৃহৎ কোনও শৃঙ্খলা এ ক্ষেত্রেও দাঁড়াতে পারে নি। অর্থাৎ বঙ্গের ভূমি সংলগ্ন এবং কৃষি নির্ভর জীবন আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত সর্বদাই বৃহৎ শৃঙ্খলা বিরোধী হয়ে থেকেছে। এই বাস্তবতায় বৃহৎ ও দৃঢ়বদ্ধ সমাজ গড়ে উঠবে কী করে?

এ দেশে সমাজ জীবন যে অতীতে কোনও কালেই দৃঢ়বদ্ধ ছিল না তার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় গ্রামগুলোর বিন্যাসে। গ্রামের নির্দিষ্ট কোনও কেন্দ্র থাকে না, বোধগম্য সীমানাও থাকে না। বাড়ীগুলো সাধারণত থাকে বিশৃঙ্খল বা এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। অথচ পশ্চিম বঙ্গের পশ্চিম প্রান্ত থেকে যত পশ্চিমে যাওয়া যায় গ্রামের বিন্যাসকে দেখতে পাওয়া যায় তত দৃঢ়বদ্ধ। পথের দু’পাশে সারি সারি সাজানো থাকে বাসগৃহ। কিন্তু গ্রাম বা বসতির বিশৃঙ্খল রূপ হল বৃহত্তর বঙ্গ বিশেষ করে এই বঙ্গের এক বিরাট বৈশিষ্ট্য। গ্রামের রূপ বলে দেয় যে তার সামাজিক কর্তৃত্ব দুর্বল। বস্তুত এর জন্য এ দেশের ভূ-প্রকৃতিই মূলত দায়ী। মানুষ এখানে সমাজকে অনেকখানি অস্বীকার করেই বাঁচতে পেরেছে। কিংবা এটা বলা আরও সঠিক হবে যে, মানুষ এখানে দৃঢ়বদ্ধ সমাজই গঠন করতে পারে নি জমির নিম্নতা, জলমগ্নতা, বৃষ্টির আধিক্য ও নদীর ভাঙ্গনের দরুন। মানুষ একা নিশ্চয় বাঁচতে পারে নি। কিংবা একটা পরিবারও নিশ্চয় একা বাঁচে নি। সুতরাং সাধারণভাবে মানুষ বা পরিবার গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েই বেঁচেছে। কিন্তু এই সমাজ বা গোষ্ঠী হয়েছে ক্ষুদ্র, দুর্বল, এবং সাধারণভাবে হয়েছে অত্যন্ত পরিবর্তনশীল বা অস্থিতিশীল, সুতরাং অস্থায়ী। নদী ভাঙ্গনের দরুন বাড়ীঘরের ভাঙ্গন কিংবা বৃষ্টি ও বন্যার জলে প্রতিবেশীদের মধ্যে যোগাযোগের দুরূহতা বা বিচ্ছিন্নতা দ্বারা এই সমাজ বা গোষ্ঠী বন্ধন শিথিল হয়েছে, কখনও ভেঙ্গেই গেছে। নদী ভাঙ্গা মানুষেরা হয়ত তাদেরই মত নূতন পরিচিত নদী ভাঙ্গা গৃহস্থদের সঙ্গে নিয়ে নূতন চরে ঘর বেঁধে গড়েছে নূতন গ্রাম এবং সমাজ।

এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব অনেক অভিজ্ঞতা আছে। যদি কারও কৌতূহল হয় তবে বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বড় বড় নদী অববাহিকায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন এ রকম অজস্র সমাজগোষ্ঠী ও গ্রাম বা পল্লী গঠনের ঘটনা। এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মা, মেঘনার চর বা তীর ভাঙ্গা হাজার হাজার কিংবা লক্ষ লক্ষ পরিবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে আজও। দিনাজপুর, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু নূতন গ্রাম ও পল্লী গড়ে তুলেছে ভাটি অঞ্চলের এই অভিগামীরা। অর্থাৎ ভূ-প্রকৃতির কারণে জনসংখ্যার বিরাট অংশের অবিরাম অভিগমন বা ‘মাইগ্রেশন’ এ দেশের একটা বড় বৈশিষ্ট্য।

এই রকম অবস্থায় সামাজিক মূল্যবোধ কিংবা নৈতিকতা দাঁড়াবার জন্য স্থির ভূমি পায় না। ফলে সমাজ চিন্তার তুলনায় ব্যক্তির আত্মস্বার্থ সর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গীই প্রবল হয়। সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ খুব প্রবল হয়ে থাকে। এই রকম এক সামাজিক পরিবেশেই এই ধরনের লোক প্রবাদগুলো খুব জনপ্রিয় এবং অহরহ কথিত হয়ঃ যেমন “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা”, “আপনা (নিজে) বাঁচলে বাপের নাম” কিংবা “আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে দরকার কী” ইত্যাদি।

এটা ঠিক যে, অতিরিক্ত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের জন্য সমাজে রক্ষণশীলতা বা অনড়তা কম থাকে কিন্তু সেটা বৃহৎ বা মহৎ কিছুর জন্ম দেয় না। কারণ বৃহৎ চিন্তাকে ধারণ করতে যে বৃহৎ ব্যক্তি বা মনের প্রয়োজন হয় তা জন্ম নিতে পারে না বৃহৎ সামাজিক ক্রিয়া না থাকায়। যেখানে সমাজ কোনও সুশৃঙ্খল ও দৃঢ়বদ্ধ রূপ নেয় না সেখানে বৃহৎ সামাজিক ক্রিয়ারও প্রশ্ন আসে না। সুতরাং এ দেশে জনসমাজ বা মানুষ বৃহৎ কোনও ব্যক্তি তথা তার বৃহৎ চিন্তা বা কর্মধারাকে লালন করে নি। এই রকম এক সমাজ দুর্বলভাবে সমাজবদ্ধ কিংবা বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসমূহের অস্তিত্বের কারণে সৃষ্টিশীল থাকে বটে তবে সেটা এখানকার প্রকৃতির মতই আগাছা সৃষ্টিকারী।

মানুষের মধ্যে থেকেছে প্রকৃতির কারণে একটা শ্রমবিমুখতা, পলায়নী মনোবৃত্তি, থেকেছে ভাগ্যবাদ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব, দায়িত্বশীলতার অভাব। শ্রমবিমুখতা কিন্তু ভোগবাদ থেকে অনেক ক্ষেত্রে এসেছে অবিশ্বাস্য রকম নীতিহীনতা, অসততা, ধূর্ততা ও ঠকামি। সে এখন শ্রম করছে বটে, কিন্তু সেটা অবস্থার চাপে পড়ে। জনসংখ্যার চাপে এবং সামাজিক কারণেও। কিন্তু তার হাজার বৎসরের অন্তর্গত প্রেরণা বিনা শ্রমে বা অল্প শ্রমে ভোগপরায়ণ। সে জেনেছে বেশী শ্রম করেও লাভ নেই। বন্যা, ঝড় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় তার সমস্ত শ্রমের ফলকে যে কোনও সময় ধ্বংস করতে পারে। আর ইতিপূর্বে যেটা বলা হয়েছে সেটা হল বৎসরের একটা বিরাট সময় তাকে বন্যার বা বৃষ্টির কারণে বসে কাটাতে হত; আর আছে শরীর ক্লান্ত করা গরম, যা তাকে টেনেছে দিবা নিদ্রা আর শরীরকে কম খাটাবার চিন্তার দিকে।

এই রকম মানুষ আত্মস্বার্থ রক্ষায় তৎপর হতে গিয়ে হয়েছে ধূর্ত, কিন্তু হ্রস্বদৃষ্টি। সে দূরে দেখতে বা চিন্তা করতে পারে না। সে তো জানে নি তার বাড়ী ভবিষ্যতে কোথায় থাকবে, তার চাষের জমি আদৌ নদীর ভাঙ্গন বাঁচিয়ে টিকবে কিনা। এমন অবস্থায় তার জীবনের মূলমন্ত্র হয়েছে, “নগদ যা পাও হাত পেতে নাও।” নগদবাদ তার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে থেকেছে। নগদ যা পাওয়া যায় এবং যে ভাবে পাওয়া যায় সেটাই তার কাছে একমাত্র দেখবার বিষয় হয়ে থেকেছে। তাতে কার কী হল, তারই বা দূর ভবিষ্যতে কী পরিণতি হবে সে সব ভাববার মনই তার থাকে নি। তার অনিশ্চিত প্রকৃতি এবং জীবন তার সেই মন রাখে নি।

এই বাঙ্গালী শুধু যে কাজে অলস তাই নয়, সে চিন্তায়ও অলস। দেহের মত মনকেও সে বেশী খাটাতে চায় নি। তার খুবই সংকীর্ণ ও অলস জীবনে সে কল্পনা বা চিন্তা করতে ভালোবেসেছে। কিন্তু এই চিন্তার মধ্যে গভীরতা থাকবার কথা নয়। কারণ চিন্তার গভীরতার সঙ্গে থাকে কর্মের গভীরতা ও জটিলতা। তার সহজ, সাধাসিধা, ঢিলাঢালা জীবন ও কাজের মতই তার চিন্তাও থেকেছে সহজ, সাধাসিধা ও ঢিলাঢালা। এটাকে বরং বলা যায় ভাবালুতা। হাঁ, এই বাঙ্গালী ভাবালু। এই বাঙ্গালী ভাবতরঙ্গে ভেসেছে ঠিক তবে সেটা নিরাপদ নৌকায় বসে কিংবা খুব বেশী হলে তাতে কিছু সাঁতারও কেটেছে। কিন্তু ভাবতরঙ্গের গভীর জলে ডুবুরির মত ডুব দেবার সাহস বা শক্তি তার ছিল না। তাই ভাবসাগরের তলদেশ হতে মূল্যবান মুক্তা সে কোনও দিনই তেমন একটা তুলতে পারে নি। যারা পেরেছে তারা এর ব্যতিক্রম। তারা ভিন্ন বাঙ্গালী।

আজও সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী বেশী ভাবতে চায় না। কষ্টের পথকে সে যেমন এড়াতে চায় তেমন বেশী গভীর চিন্তাকেও সে চায় এড়াতে। সুবিধাবাদ, কষ্টের প্রতি বিমুখতা এই সহজ পথের পথিক বা সহজিয়া বাঙ্গালীর চিন্তার গভীরে প্রোথিত। জীবনে মহৎ বা বড় কিছু পেতে হলে যে সচেতন কষ্ট ও দায়িত্বশীল শ্রম করতে হয় তাকে সে যে শুধু ভয় পেয়েছে তা-ই নয় ঘৃণাও করেছে। সুতরাং তেমন পথ যারা দেখিয়েছে তাদেরকে সে এড়িয়ে চলেছে। ঘৃণা ও অবজ্ঞাও করেছে। অবশ্য চিন্তাহীনতার একটা প্রধান উৎস ইসলাম ধর্ম নিজেও। কোরান-হাদীসের কঠোর অনুশাসন বা বিধিবিধান দ্বারা নির্দিষ্ট ছকের বাইরে ভাববার ও যাবার পথ রুদ্ধ করে রাখায় স্বাধীন চিন্তার বিকাশ এমনিতেই দুরূহ কিংবা এমনকি অসম্ভব হয়ে থাকে। এটা প্রকৃতপক্ষে সামরিক বা সহিংস একনায়কী ও স্বৈরতান্ত্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপযোগী ধর্ম। এই অবস্থায় ইসলাম মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে বিনষ্ট করে। তার উপর ইসলামের বিকাশধারায় যে লুণ্ঠনপরায়ণ, স্থূলভোগবাদী, ধর্ষণকারী ও নারী সম্ভোগবাদী বেদুঈন ঐতিহ্য বদ্ধমূল রয়েছে তার প্রভাব হয়েছে এই পরনির্ভর এবং বহিরাগত শক্তির অন্ধ পূজারী মানুষদের উপর প্রবল। শুধু তা-ই নয় এই ধর্ম মানুষের কল্পনায় স্বর্গের যে স্থূল ভোগচিত্র অঙ্কন করেছে সেটাও মানুষের উন্নত চেতনার বিকাশে আদৌ সহায়ক হয় না। ইসলামের স্বর্গ বা বেহেশ্‌ত প্রকৃতপক্ষে পুরুষের উচ্ছৃঙ্খল ভোগ ও লাম্পট্যের কল্পিত এক জগৎ যেখানে রয়েছে বাহত্তর জন চিরকুমারী হুর বা অপরূপ সুন্দরী তরুণী যাদের সতীচ্ছদ প্রত্যেক বার সঙ্গম শেষে পুনরায় ফিরে আসবে, সেবাদানের জন্য আছে চিরকিশোর বালকগণ এবং অফুরান মদ। এই রকম অবস্থায় ইসলাম ধর্ম সহজিয়া বাঙ্গালীকে উন্নততর জীবনবোধের সন্ধান দিবার পরিবর্তে আরও অধঃপতিত করেছে।

’৭১-এর যুদ্ধের সময়ের একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায় এই বাঙ্গালীর চরিত্র বোঝার জন্য। লেখক স্বয়ং এই ঘটনার সাক্ষী। ’৭১-এর এপ্রিল মাসের ঘটনা সেটা। তখনকার রংপুর জেলার ব্রহ্মপুত্র নদী তীরবর্তী রউমারী থানার পুলিশ কর্তৃপক্ষ তখন পাকিস্তানের অনুগত ছিল। একদিন গভীর রাতে বিদ্রোহী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈনিক এবং বিভিন্ন ধরনের মুক্তিযোদ্ধারা (এদের মধ্যে উক্ত এলাকার বামপন্থী তরুণ কর্মীরাও ছিল) ভারতের বিএসএফ-এর সাহায্য নিয়ে থানা আক্রমণ করে। গোলাগুলির সময় থানা ও বাজার এলাকার লোকজন আতংকিত হয়ে অন্ধকারে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করে। মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রভাত হবার পূর্বে থানার চারপাশ ও বাজার থেকে পলায়ন করে। এই থানা এলাকার লোকজন ছিল ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগ ও ছয় দফার সমর্থক। কিন্তু এক রাতের দৌড়াদৌড়ির কষ্টে লোকদের মত ঘুরে গেল। অবশ্য আসল কারণ তো মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতা এবং পাকিস্তানপন্থী পুলিশ বাহিনীর সাফল্য। যাইহোক, সকাল বেলায় থানা বা বাজার এলাকায় শত শত এবং হাজার হাজার ক্ষিপ্ত লোক একত্র হয়ে চীৎকার করতে লাগল কেন তাদের রাতের ঘুম এভাবে নষ্ট করা হয়েছে এবং এভাবে কেন তাদেরকে হয়রান করা হয়েছে? কেন তারা বৌ-বাচ্চা নিয়ে এভাবে সারারাত দৌড়াদৌড়ি করেছে? কেউ কেউ একথাও বলল যে, যদি থানা আক্রমণ করাই হবে তবে সে কথা তাদেরকে আগে জানানো হয় নি কেন? তাহলেই তো আর তারা এত ভয় পেত না?

এরপর শত শত লোক মুক্তিযোদ্ধাদের পাকড়াও এবং পাকিস্তানপন্থী থানা পুলিশের হাতে তুলে দিবার অভিযানে বহির্গত হল। হতে পারে যে এই সংখ্যা ছিল ২/৩ হাজার। এটা অবশ্য অনুমান মাত্র। তবে দূর থেকে থেকে আমার কাছে সংখ্যাটা এই রকমই মনে হয়েছিল। এই তল্লাশী অভিযানে তাদের দ্বারা কয়েকজন ধৃত ও নির্দয় প্রহারে আহত হয় । অবশ্য এরপর ঐ রাতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থানার পতন ঘটে। এবং এক রাতের ঘুম নষ্ট হওয়ায় পাকিস্তানপন্থীতে পরিণত হওয়া এই শত শত কিংবা হাজার হাজার মানুষ পুনরায় তাদের আনুগত্য বদলে ফেলে। ভারত সীমান্তবর্তী এই থানায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কোনও দিনই যেতে পারে নি। কাজেই তারা গেলে এই জনগণের পরবর্তী আনুগত্যের রূপ কী দাঁড়াত তা বোঝার উপায় আর থাকে নি।

’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু লোক আমাকে এ কথা বলেছে, “যদি জানতাম নৌকায় ভোট দিলে এমন গোলমাল হবে তা হলে কি আর নৌকায় ভোট দিতাম?” বহু জায়গায় যখন পাকিস্তানী বাহিনীর শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায় তখন গ্রামের জনগণের একটা বৃহৎ অংশ তাদের প্রতি সমর্থন দিতে শুরু করে, বিশেষত মুক্তিবাহিনীকে স্থান থেকে চলে যেতে বলত এই ভয়ে যে তাদের অবস্থানের ফলে এলাকায় পাক বাহিনীর অত্যাচার হবে। আমরা জানি বহু জায়গায় মুক্তি বাহিনী অস্ত্রের পাল্টা ভয় দেখিয়ে জনগণকে বাধ্য করেছে সাহায্য করতে। উপরন্তু এই অস্ত্রশক্তি দেখেই জনগণ মুক্তিবাহিনীর প্রতি আস্থাশীল থেকেছে কিংবা হয়েছে এবং পাক বাহিনীর প্রতি আর আনুগত্য সরায় নি বা দেয় নি।

লোক প্রবাদে বলে, এ দেশের মানুষ “শক্তের ভক্ত, নরমের যম”। এ দেশের মানুষ অহরহ এ কথা বলে, “বাঙ্গালীর জন্য দরকার ডাণ্ডা।”

কিন্তু আসলে কি তাই? সত্যিই কি বাঙ্গালী কঠোর শাসন পছন্দ করে? কঠোর শৃঙ্খলা পছন্দ করে? আসলে বাঙ্গালী সাধারণত কারোরই শাসন বা শৃঙ্খলা মানতে পছন্দ করে না। তার নিজের শাসন তো নেই-ই কিন্তু পরের শাসনও তার পছন্দ নয়। কোনও শৃঙ্খলাই সে পছন্দ করে না বলে সে নিজে যেমন এই শৃঙ্খলা বা শাসন জন্ম দিতে পারে না তেমন তার কপালে কিন্তু জোটে শক্তিশালী পরের এই শাসনই। অনিবার্যভাবে এই শক্তিশালী বা প্রবল শাসক এসেছে বা আরোপিত হয়েছে বাহির থেকে। কারণ তার ভিতর থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ কোনও সামাজিক শক্তি বা নেতৃত্বই গড়ে উঠতে পারে না এটা গড়ায় তার অংশ বা ভূমিকা থাকে না বলে। এই বাঙ্গালীকে যতদিন পরাক্রান্ত শাসক দাপটের সঙ্গে শাসন করতে পেরেছে ততদিন সে তাকে বিনা প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে মেনেছে কিন্তু যে মুহূর্তে তার শাসকের শাসন বাইরের ভিন্ন শক্তির আক্রমণে কিংবা তার নিজের ভিতরের দ্বন্দ্বের কারণে শিথিল হয়েছে তৎক্ষণাৎ এই সুযোগ সন্ধানী বাঙ্গালী তার সুযোগ নিয়ে সমস্ত শাসনকে অমান্য করেছে এবং তাকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতায় পরিণত করেছে। পরিস্থিতির সুযোগ নেবার জন্য সে হয়ত যোগ দিয়েছে নূতন বিজয়ী শক্তির সঙ্গে। হুজুগে মাতা স্বভাবের বাঙ্গালী নূতন বিজয়ীর পক্ষেও মেতেছে বন্যার মত।

বাঙ্গালী চরিত্রে তার প্রকৃতির বন্যা বা জোয়ার-ভাটার প্রভাব দেখা যায় খুব বেশী রকম। বন্যা যখন আসে তখন চারদিক ডুবিয়ে, ভাসিয়ে আসে। বাঙ্গালী যখন কোনও কিছুতে মাতে তখন তার অবস্থাও হয় এই রকম চারদিক প্লাবিত করা বন্যা বা জোয়ারের মত। কিন্তু বন্যার জোয়ার তো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একসময় জল নেমে যায়। বাঙ্গালীর চিত্তেও স্বল্পস্থায়ী আবেগের জোয়ারের পর যখন ভাটার টান ধরে তখন তাও হয় সমান অপ্রতিরোধ্য। এই জোয়ার-ভাটার প্রভাব বাঙ্গালীকে করেছে যেমন পরিবর্তনশীল তেমন অস্থির। সে যে-ই হোক বিজয়ী হলে তার মত এত সমাদর আর কোনও দেশে জোটে কি না সন্দেহ। তবে বেশীদিন সে কারও উপর তুষ্ট থাকে না। কারণ তার মনোবাঞ্ছা পূরণ করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে উপর বা বাহির থেকে কেউ আসে না। আর বাস্তবিক তাকে তুষ্ট করে বেশী দিন চলাও কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সে সব শাসনই নীরবে মানতে পছন্দ করে যদি শাসকের সেই রকম ক্ষমতা থাকে। তা না থাকলে তার সবচেয়ে পছন্দ বিশৃঙ্খলা বা তার ক্ষুদ্র জীবনের স্বাধীনতা।

এই বাঙ্গালীর কি বীরত্ব আছে? তার হিংস্রতা এবং সহিংসতা আছে, কিন্তু বীরত্ব নয়। শুধু যে কষ্টকে সে ভয় পায় তা-ই নয় মরতেও তার নিদারুণ ভয়। হয়ত এ দেশে প্রকৃতি যেমন মানুষের অতি জন্ম দিয়েছে তেমন অতীতে মানুষের অতি মৃত্যু দ্বারা জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। আজ যেখানে শুধু বাংলাদেশেই এগারো কোটি* লোক বাস করছে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে সমগ্র বঙ্গের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র তিন কোটি, যার একতৃতীয়াংশ ৭৬-এর মন্বন্তরে (১৭৬৯-৭০-এর মহাদুর্ভিক্ষ) মৃত্যু বরণ করে । অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আজকের বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ছিল খুব বেশী হলে পৌনে দুই কোটি থেকে দুই কোটি। আসলে অস্বাস্থ্যকর ও জলা এই ভূখণ্ডে মানুষ জন্মাত যেমন ব্যাধিতে মরতও তেমন। এখনকার চিকিৎসা বিজ্ঞান তখন ছিল না। কাজেই প্রচুর সন্তানোৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মৃত্যুর যে আধিক্য ছিল তার দ্বারা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হত। মানুষের মনে এই অবস্থার প্রভাব ছিল গভীর। তাই স্বেচ্ছায় বীরের মৃত্যুর তুলনায় প্রকৃতির বিধান অনুযায়ী রোগে ভুগে বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর প্রতিই এই বাঙ্গালীর আকর্ষণ থেকেছে বহুগুণ বেশী।

 -----------------------------------------------

* ১৯৮৯ সাল বা গ্রন্থ লেখার সময়কার হিসাব অনুযায়ী।

----------------------------------------------- 

সুতরাং তেমন সাহস বা বীরত্ব তার আসবে কোথা থেকে? তবে সহিংসতা তার আছে বৈকি! নিষ্ঠুরতাও আছে। সহিংস ও নিষ্ঠুর হয়েই তো তাকে এই জঙ্গলাকীর্ণ ও সাপ, বাঘের দেশে বাঁচতে হয়েছে। তবে যার উপর তার জেতার সম্ভাবনা নিশ্চিত শুধু তার উপরই তার এই সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা। যাকে সে নিজের ক্ষতির সম্ভাবনা না রেখে ধ্বংস করতে পারবে মনে করেছে শুধু তার প্রতিই তার সমস্ত বীরত্ব প্রকাশ পেয়েছে। দুর্বল তাই এখানে নির্দয়তার সহজ শিকার।*

------------------------------------------------

 * ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন ইংরেজ প্রশাসক বাঙ্গালী সমাজ ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের উপর তাদের প্রতিবেদনে বাঙ্গালীর হীনমন্যতা, অতিলোভ, নিদারুণ অসততা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, স্বার্থêপরতা, নিষ্ঠুরতা, সুবিধা আদায়ের জন্য সবলের পায়ে পড়া স্বভাব এবং দুর্বলের উপর নিষ্ঠুরতার কথা বলেছেন। তাদের বিবরণ অনুযায়ী এগুলিই হল বাঙ্গালীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অন্তত এই বঙ্গে বাঙ্গালীর এই সকল বৈশিষ্ট্য আজও তার চরিত্রের প্রধান দিক হয়েই রয়েছে । – লেখক

------------------------------------------------

কিন্তু এই বাঙ্গালীর নিষ্ঠুরতাও সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদৃঢ় নয়। কারণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনও অস্বাভাবিক প্রবণতাকে রক্ষা করতে যে প্রবল মানসিক শক্তি ও শ্রম দরকার সেটাই তার ছিল না বা নেই। তাই বাঙ্গালী প্রতিহিংসা বা ঘৃণাও খুব বেশীদিন পুষে রাখতে পারে না। আসলেই তো সব সহজ পথে চাওয়া এবং পাওয়াই হচ্ছে এই সহজিয়া বাঙ্গালীর চিরদিনের স্বপ্ন।

এই বাঙ্গালীর আনুগত্য বা সমর্থনও তাই অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল। সে কখন তার আনুগত্য সরাবে এটা অনেক সময়ই আগে থেকে বোঝা যায় না। যতদিন শক্তির ভারসাম্য পক্ষে থেকেছে সাধারণত ততদিনই বাঙ্গালীর আনুগত্য থেকেছে আর যখন শক্তির ভারসাম্য বিপক্ষে চলে গেছে তখন দ্রুত তার সমর্থন ও আনুগত্যও চলে গেছে। ব্যক্তি, নীতি কিংবা আদর্শ যেটাই তার কাছে ক্ষমতাহীন মনে হয় বা মনে হয় না আশু লাভজনক তার পক্ষে এই বাঙ্গালী থাকে নি।

চেষ্টা অর্থাৎ শ্রম দ্বারা কোনও কিছু অর্জন করার মত মন তার তেমনভাবে নেই। তার সাধারণ প্রবণতা হল আত্মসাতের, চুরির। সে চুরি করতেই বেশী পছন্দ করে। ফাঁকি দিয়ে পাওয়াতেই তার আনন্দ। এতে সে লজ্জার কিছু দেখে না। শুধু ধরা না পড়লে বা বিপদে না পড়লে হল। তার মেলা লোককথায় চুরি, ঠকামি ও প্রবঞ্চনাকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। নীতিহীন ও নির্বিবেক অনেক সফল নিষ্ঠুরতা ও শঠতাকে বাঙ্গালী তার লোককথায় জনপ্রিয় করেছে। শুধু শিয়াল পণ্ডিতের কাহিনী নয় আরও অনেক কাহিনীতে এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। বাঙ্গালীর একটি প্রিয় প্রবাদবাক্য হল এইটি, “চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা।”

এই সহজিয়া বাঙ্গালী ফাঁকিবাজ কিংবা চোর এবং ঠক। সে প্রকাশ্য দস্যু বা প্রকাশ্য লুণ্ঠনকারী কম হয়েছে তার সে সাহস নেই বলে। তবে যদি তার মনে হয়েছে যে কেউ পরাস্ত হচ্ছে বা ভবিষ্যতে প্রতিশোধ নিতে পারবে না তবে লুণ্ঠনে ও দস্যুতায় তার উৎসাহ দেখা গেছে অনেক সময়েই। ’৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত হিন্দু বাঙ্গালী ও উর্দূভাষীদের উপর তাকে বহুবারই লুঠতরাজ চালাতে দেখা গেছে। এবং স্বাধীনতা উত্তর কালে আজ অবধি ধর্মীয় এবং জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘু জনগণের উপর বাঙ্গালী মুসলমানদের লুণ্ঠন, জবরদখল ও উৎসাদন অভিযান আমরা কম প্রত্যক্ষ করি নি।

তবে এটা ঠিক যে, বাঙ্গালী বেশী নিষ্ঠুরতা বা রক্তপাত পছন্দ করে না। অন্তত বেশী দিন সহিংসতা বা ‘ভায়লেন্স’ তার সহ্য হয় না। কারণ তার দুর্বল মন তাতে ভীত হয়, ভেঙ্গে পড়ে সহজে।

আসলে এই বাঙ্গালীর মন নরম, কোমল। তার মাটি কোমল। পলিমাটি শুধু কোমল নয়, শুষ্ক লাল মাটি এত যে শক্ত তাও পানি পেলেই একেবারে গলে যায়। পাথর এ দেশে নেই, পর্বত নেই। কিছু পাহাড় আছে। তাও তো প্রধানত মাটির এবং দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে সামান্য এলাকায়। লোহাও এখানে আসে বাহির থেকে। এ দেশে শক্ত বা দৃঢ় পদার্থ সবই যেমন আসে বাহির থেকে এ দেশের মানুষের জীবনে ও চরিত্রে দৃঢ়তার সমস্ত উপাদানই যেন তেমন আসে বাহির থেকে। অবশ্য মাটি নয়, বরং ভূ-প্রকৃতির প্রভাবে যে শিথিল, অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল ব্যক্তি ও সমাজ জীবন গড়ে উঠেছে সেটাই এই তথাকথিত নরম বা অদৃঢ় মন গড়ে উঠার প্রধান কারণ।

এই বাঙ্গালীর চরিত্রে দৃঢ়তা নেই, অথচ লোভ আছে; ত্যাগ নেই, আছে ভোগবাদ। সুতরাং তার ভীরু স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতা তার চরিত্রে যে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে তার সঙ্গে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল আছে বিষধর সাপের। এই বাঙ্গালী সিংহ কিংবা বাঘের মত সাহসী নয়। বরং সাপের মত ভীরু, কিন্তু হিংস্রতায় পরিপূর্ণ। তাই সে সাপের মত হঠাৎ করে ছোবল দেয়। কিন্তু এটা সব সময় পরিকল্পিত নয়। অনেক সময়ই সে এটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে করে। তারপর এই বাঙ্গালী পালায় সাপের মত। সর্প চরিত্রের সঙ্গে এই ধরনের বাঙ্গালী চরিত্রের এত মিল বলেই হয়ত এই সেদিন পর্যন্ত সর্পদেবতা মনসা ছিল শুধু নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুর নয়, উপরন্তু সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীরও মান্য ও প্রিয় দেবতা। সাপের প্রতি যেমন তার ভীতি তেমন ভক্তি ও আকর্ষণও। আজও সাপের কাহিনী যুক্ত সিনেমা বা চলচ্চিত্র এই বাঙ্গালীর খুব প্রিয়।

আসলে এ দেশের প্রকৃতির মধ্যে রয়েছে একটা নিকৃষ্টতা। তাই এ দেশে এলে উচ্চ ও বলিষ্ঠ মানুষ কয়েক প্রজন্মে খাটো ও দুর্বলতর হয়। এ দেশে উৎকৃষ্ট ছাগল বা গরুর বংশধর নিকৃষ্ট হতে থাকে অথবা বেশীদিন বাঁচে না। প্রকৃতির এই নিকৃষ্টতা হয়ত এ দেশের মানুষকে হীনমন্য করেছে। তার নিজের উপর আস্থা বা শ্রদ্ধা কোনওটাই তো নেই-ই বরং যা কিছু বিদেশের তা-ই তার কাছে সাধারণত উৎকৃষ্টতার প্রতীক হয়ে দেখা দেয়।

কিন্তু মানুষ প্রকৃতির দাস নয়। তাকে সে বদলাতেও পারে। প্রকৃতির আবেষ্টনকে সে নিজেও পরিবেষ্টন, জয় ও পরিবর্তন করতে পারে। নরম পলিমাটি মানুষ দ্বারা পরিণত হতে পারে বলিষ্ঠ ও কঠিন ইটে এবং নরম পলিমাটিতে গড়ে উঠতে পারে বৃহৎ নগরসমূহ, ভবন এবং ভারী যানবাহন চলার উপযোগী প্রশস্ত পাকা রাজপথ।

কিন্তু সেসব হচ্ছে একটা মানবিক ও সচেতন প্রক্রিয়ার কথা যার দ্বারা যেমন প্রকৃতি হয় পরিবর্তিত তেমন মানুষ এবং তার চরিত্রও হয় পরিবর্তিত। আমার এই আলোচনার উদ্দেশ্য হল এ দেশের প্রকৃতির এবং সেই সঙ্গে তার কোলে লালিত ও সুদীর্ঘ পরাধীনতায় বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ বুঝতে পারা যাতে সেগুলিকে বুঝে আমরা বের করতে পারি এমন একটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া যার দ্বারা আমরা উন্নততর রূপে এই ভূ-প্রকৃতি ও সমাজ এবং বিশেষত মানুষকে রূপান্তরিত বা পরিবর্তিত করতে পারব। এই জন্য আমাদের নির্মোহ ও আবেগমুক্ত হয়ে এই ভূ-প্রকৃতি ও জনগোষ্ঠীকে বুঝতে বা বিশ্লেষণ করতে হবে।

ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা এ দেশের মানুষের অনেক নিকৃষ্ট দিক সম্পর্কে জ্ঞাত। এটা ঠিক যে, এই দেশ চিরকাল উর্বর এবং সমৃদ্ধ। কিন্তু এটাও ঠিক যে তার ছিল প্রায় হাজার বৎসরের পরাধীনতা। সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে প্রাচীন বাঙ্গালীর যে জগৎ জোড়া খ্যাতি তা মুখ্যত তার কৃষি বা ধান উৎপাদনের জন্য নয়, বরং তার তুলনাহীন বস্ত্র ও কুটীর শিল্পের জন্য। অর্থাৎ বাঙ্গালী তখন শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছে যখন সে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছে প্রকৃতির গভীর আবেষ্টন থেকে শহরে বা নাগরিক জীবনে কিংবা শিল্পে। সেখানে সে কিছুটা হলেও প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত শক্তি হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে।

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : পরিবর্তনশীল সমাজ 

সব সমাজই পরিবর্তনশীল। সুতরাং বাঙ্গালীর সমাজও তা-ই। তবে এ দেশের ভূ-প্রকৃতির অতি পরিবর্তনশীলতা তার চরিত্রে পরিবর্তনপ্রিয়তা এনেছে খুব বেশী রকম। এই বেশী পরিবর্তনপ্রিয়তা তাকে এবং তার সমাজকে করেছে অস্থিতিশীল এবং দুর্বল। তার সমাজ এবং মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাহিরের শক্তিসমূহ হস্তক্ষেপ করেছে খুব বেশী রকম। উপরন্তু বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ও সুদীর্ঘ আধিপত্য এই সমাজের দুর্বলতা ও নিকৃষ্টতাকে শুধু রক্ষাই করে নি, উপরন্তু এগুলিকে বৃদ্ধিও করেছে বহু গুণে।

শুধু লুণ্ঠন ও শোষণের উদ্দেশ্যেই বাহিরের শক্তিগুলো এখানে আসে নি বা হস্তক্ষেপ করে নি। উপরন্তু এখানে ভিতর থেকে কোনও স্বাধীন সামাজিক শক্তির অভ্যুদয় রোধ করাও তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থেকেছে। বস্তুত এর প্রাকৃতিক উর্বরতাই আবার এ দেশকে দিয়েছে একটা বিপুল সম্ভাবনা। এখানে একবার কোনও ক্রমে ভিতর থেকে একটা স্বাধীন ও সুশৃঙ্খল সামাজিক নেতৃত্ব জন্ম নিতে পারলে এই প্রাকৃতিক ভিত্তি তাকে যোগাবে উন্নয়ন ও বিকাশের বিপুল রসদ। সেক্ষেত্রে দেশটা অনেক আধিপত্যশীল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্যই হুমকি হয়ে দেখা দিবে।

সুতরাং বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র থেকেছে। বাঙ্গালী এর সহজ শিকারও হয়েছে তার চরিত্রগত দুর্বলতার জন্য যেগুলো আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।

বাঙ্গালী জাতির শক্তিকে খর্ব করার জন্য ব্রিটিশ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে একবার বঙ্গভঙ্গ করেছিল। কিন্তু তখন হিন্দু নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নূতন মুসলমান বাঙ্গালী নেতৃত্ব উঠে দাঁড়াতে না পারায় ব্রিটিশ সফল হয় নি। কিন্তু সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রের মোহ হিন্দু বাঙ্গালীর জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিল। বৃহত্তর ভারতের ঐক্যচিন্তার মধ্যে যে হিন্দু চেতনা ছিল তা এ দেশের মুসলমান বাঙ্গালীকে হিন্দুর কাছ থেকে সরিয়ে দিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর উত্তরাধিকারী নূতন মুসলিম নেতৃত্বকে সাহায্য করেছিল। বিশেষত নূতন মধ্যবিত্ত মুসলমান বাঙ্গালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখতে পেল হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্তকে। সেই সঙ্গে কাজ করল শাসকদের প্রশ্রয় ও উস্কানি।

মুসলমান বাঙ্গালীর দেশপ্রেম ছিল না। সেটা তার ধর্ম এবং চরিত্র-বৈশিষ্ট্যই শেখায় নি। আমাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, প্রথমত এই ধর্ম এসেছে প্রধানত বিদেশী বিজয়ী হানাদারদের তলোয়ারের শক্তিতে। সুতরাং এই ধর্মের প্রতি আনুগত্যের শুরুতেই আছে বৈদেশিক আগ্রাসন, আধিপত্য ও লুণ্ঠনের প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ। এই ধর্ম শুরুতেই দিয়েছে স্বদেশের উপর বিদেশের ও বৈদেশিকদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা বা চেতনা। সর্বোপরি এই ধর্ম দেয় আরবের প্রতি, আরবের ভাষা, সংস্কৃতি, আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য। এর ফলে জাতির আত্মবিশ্বাস, গৌরববোধ ও জাতি চেতনাই জাগ্রত হবার কোনও স্বাভাবিক পথ পায় না। কাজেই ইসলামের প্রবল প্রভাবের কালটাতে মুসলমান বাঙ্গালীর মধ্যে দেশপ্রেম ছিল না।

কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালী অনেক সাধনা ও কষ্টে এবং তার শিক্ষা ও সংষ্কৃতি দ্বারা সেটা অর্জন করেছিল। তবে তার এই দেশপ্রেম যতটা হল বঙ্গ প্রেম তার চেয়ে বেশী হল ভারত প্রেম। কিন্তু ভারত কখনই এক জাতির দেশ নয় এবং সেখানে এক জাতির সাধারণ মানুষের সঙ্গে আরেক জাতির সাধারণ মানুষের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও ভাষাগত যোগ নেই। বস্তুত মানুষের সংযোগের সর্বপ্রধান মাধ্যম ভাষার বিচারে একজন তামিল, কর্ণাটকী, বিহারী কিংবা পাঞ্জাবী বা পাঠান একজন বাঙ্গালীর প্রায় ততটাই নিকট যতটা নিকট একজন চীনা কিংবা ফরাসী বা ইরেজ। তবু হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্ব সমস্ত ভারতকে তার চেতনার ভিত্তি হিসাবে পেতে গিয়ে সে এমন এক বিশাল ক্ষেত্রে নিজের চিন্তা ও কর্মকে ছড়িয়ে দিল যেখানে তার ব্যবহারিক ও মনস্তাত্ত্বিক উভয় প্রকার গতিই হারিয়ে ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, ঘটনার উপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। এইভাবে সে হারালো তার স্বাধীন উদ্যোগ ও নেতৃত্বের সুযোগও।

মুসলমান বাঙ্গালী নেতৃত্ব এক অর্থে এই হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্বেরই অনুসারী হল মাত্র। অর্থাৎ সে তার অতীতের মুসলমান প্রভুদের সর্বভারতীয় রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে খুঁজে নিল। অবশ্য মুসলমানের জন্য তখনও সেটাই স্বাভাবিক ছিল, যেহেতু তখনও সে নিজেকে বাঙ্গালী মনে করে নি। এই অবস্থায় যখন ভারতীয় হতে গিয়ে কেউ হল হিন্দু এবং কেউ হল মুসলমান তখন তার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা ১৯৪৭-এ দ্বিতীয়বার বঙ্গভঙ্গ করল। এবার করল সফলভাবে। বঙ্গদেশ বিভক্ত হয়ে হিন্দু প্রধান পশ্চিম বঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হল ভারত রাষ্ট্রের আর মুসলমান প্রধান পূর্ব বঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হল পাকিস্তান রাষ্ট্রের।

বাঙ্গালী জাতিসত্তা বিভক্ত হল। কিন্তু এই বিভক্তির মধ্যেই বাঙ্গালীর বাঙ্গালী জাতি হিসাবে জন্মের ভিত্তিও থেকে গেল। ভারতে হিন্দু বাঙ্গালী হল নিদারুণভাবে সংখ্যালঘু। কিন্তু পাকিস্তানে বাঙ্গালীই হল সংখ্যাগুরু। পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু বাঙ্গালীর উপর উর্দূভাষী মোহাজের এবং পাঞ্জাবী শাসক শ্রেণী যখন উর্দূকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিতে চাইল তখন মুসলমান বাঙ্গালীর মধ্যে বাঙ্গালী হিসাবে চেতনা ও শ্রেষ্ঠত্ব বোধ জেগে উঠল। এর ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় পর পরই ১৯৪৮ থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হল। এটা ১৯৫২-তে জাতীয় অভ্যুত্থানে পরিণত হল।

বস্তুত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সচেতন বাঙ্গালী জাতিসত্তা হিসাবে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী জন্ম নিল। তবে এই নবজন্মের অগ্রনায়ক হল ছাত্র সম্প্রদায়। বস্তুত এই ছাত্র সম্প্রদায়ই এ দেশে চিরায়ত বাঙ্গালীর সহজিয়া দাসসুলভ সুযোগ সন্ধানী ও হীন স্বার্থ সর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গীকে ভেঙ্গে নূতন চেতনার পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জাতির সকল দোষ তাদের মধ্যেই সবচেয়ে কম আর গুণগুলি সবচেয়ে বেশী করে রূপ নিয়েছে। বাঙ্গালীর চেতনায় যে উর্বরতা আছে তার গুণে আধুনিক জীবন এবং শিক্ষা ছাত্রদের চেতনায় ফলিয়েছে অমূল্য ফসল। বিদেশ নিভর্রতার কারণে হোক আর শক্তিমানের অনুকরণপ্রিয়তার কারণে হোক কিংবা চিত্তের অস্থিরতা বা পরিবর্তনশীলতার কারণে হোক সাধারণভাবে বাঙ্গালী নূতন জিনিস তুলনামূলকভাবে দ্রুত গ্রহণ করতে পারে। ছাত্রদের জন্য এই গ্রহণ হয়ে দাঁড়াল আধুনিক, যুক্তিবাদী এবং গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা, যা তারা তাদের পাশ্চাত্য নির্ভর আধুনিক শিক্ষা দ্বারা পেয়েছে।

নূতন চিন্তা-চেতনায় সংগঠিত ছাত্র ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ক্রমেই পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াল এবং এর পরিণতি হল ১০৭১-এ পাকিস্তানের বিভক্তি এবং গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীন পূর্ব বঙ্গের উদ্ভব।

এর জন্য যে বাঙ্গালীর খুব বেশী সাধনা ছিল তা নয়। ১৯৬৬-তে যখন আওয়ামী লীগ ছয় দফা কর্মসূচী দিয়েছিল তখন তা ছিল পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী, যেখানে কয়েকটি প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের দাবীকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৮-’৬৯-এ যখন বামপন্থী ছাত্ররা স্বাধীন পূর্ব বঙ্গের স্লোগান দিতে শুরু করেছিল তখনও সেটা জনগণের ব্যাপক অংশের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। আসলে সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী তখনও ছিল প্রথমে পাকিস্তানী বা মুসলমান এবং তারপর বাঙ্গালী। তবে তার অস্তিত্বের কারণেই তার পক্ষে আর বাঙ্গালী সত্তাকে ছাড়া সম্ভব ছিল না। ইসলামের আবেদন তার কাছে যতই থাক আদর্শের চেয়ে বৈষয়িক স্বার্থই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং ছাত্র এবং মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী যেমন মেনে নিতে রাজী হয় নি উর্দূ ভাষাকে নিজের ভাষা হিসাবে তেমন পাকিস্তানের অবাঙ্গালীদের বঞ্চনা ও নির্যাতনমূলক শাসন, শোষণ এবং ঘৃণা ও অমর্যাদা তাদের কাছে এক সময় অসহ্য হয়ে উঠল। তখন তারা বিদ্রোহ করে বসল।

তবে সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর জন্য এতটা কাম্য ছিল না। ’৭১ এ যখন সে যুদ্ধে জড়াল তখন সে ঘটনার শিকার। এত বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি তার চিন্তায়ই ছিল না। কিন্তু বামপন্থী ছাত্র এবং জনগণের বৃহৎ সংগঠিত অংশের প্রভাবে ও চাপে স্বাধীনতার ক্রমবর্ধমান চিন্তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগের জন্য আপোসের পথ থাকে নি আর পাকিস্তানের জন্যও উপায় থাকে নি বাঙ্গালীকে দমন করতে গিয়ে যুদ্ধ এড়াবার।

এই যুদ্ধকে ভারত স্বাধীনভাবে আগ্রসর হতে দেয় নি। সুতরাং পাকিস্তানীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে এ দেশের এবং আন্তর্জাতিক জনমতকে পক্ষে এনে এবং পলাতক আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এবং ভারতে শরণার্থী বিপুল জনসংখ্যার সমর্থন ও নৈতিকতাকে ব্যবহার করে যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করল এবং দ্রুত বিজয়ের মধ্যে এটাকে শেষ করল। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পূর্ব বঙ্গস্থ পাক বাহিনী ঢাকায় ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে এখানে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হল।

এখন যেভাবেই হোক বাঙ্গালী পেল একটা নিজস্ব রাষ্ট্র। যদিও এখনও বাঙ্গালী তার বহিরাগত ও আরোপিত ইসলামের ধর্মীয় চেতনা দ্বারা প্রভাবিত থাকল তবু একটা রাষ্ট্র সে পেল যেটা বিদেশীদের রাষ্ট্র নয়, বরং এ দেশের বাঙ্গালীর। এই বাঙ্গালী পূর্ণাঙ্গ বাঙ্গালী না হতে পারে, কিন্তু তার অর্জনের অভিমুখ হল বাঙ্গালীত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ। কারণ এ ছাড়া বাঙ্গালী হিসাবে তার ইতিহাসের প্রথম এই অর্জনকেই রক্ষা করতে পারবে না।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্টা এ দেশের মুসলমান বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছে। কারণ স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার কোনও অভিজ্ঞতাই তার কোনও দিন ছিল না। এমন দায়িত্ব পালনের চরিত্রই সে এতকাল অর্জন করে নি। আসলে এ যাবৎ কাল সে যা কিছু পেয়েছে পেয়েছে প্রধানত অন্যের দ্বারা। তার নিজের সৃষ্টি বিশেষ কিছু নেই। পাকিস্তান সে পেয়েছিল বিনা ত্যাগে ও সংগ্রামে এবং শাসক ব্রিটিশের “ভাগ করো, শাসন করো” এই নীতির প্রয়োজনে এবং উর্দূভাষীদের নেতৃত্বে। তবে মহান ভাষা আন্দোলন তার ব্যতিক্রম। ’৭১-এর যুদ্ধে সে বিশেষ ত্যাগ ছাড়া ভারতের দ্বারা জয় করেছে। ’৭১-এ কষ্ট বা ত্যাগ যা করেছে তাও প্রধানত হিন্দুরা এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও এ দেশে এই হিন্দু বাঙ্গালীই আজও হয়ে আছে সবচেয়ে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত।

একটা স্বাধীন জাতি হতে যে বিরাট ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন তা সাধারণভাবে এ জনগোষ্ঠী কিংবা তার নেতৃত্ব করে নি। কিন্তু কোথায়ও ত্যাগ ও সাধনা নিশ্চয় আছে তা না হলে সমাজে এত পরিবর্তন এলো কি করে? সেটা ব্রিটিশ ভারতে করেছিল মুখ্যত হিন্দু বাঙ্গালী আর পাকিস্তান আমলে সেটা করেছিল প্রায় সম্পূর্ণই কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীরা এবং সমাজতন্ত্র দ্বরা প্রভাবিত ছাত্র ও তরুণ সম্প্রদায়। হিন্দু বাঙ্গালীর নেতৃত্বকে ধ্বংস করেছে ব্রিটিশ শাসক এবং হিন্দী ও উর্দূভাষী ভারতীয় নেতৃত্ব সম্মিলিতভাবে। আর বামপন্থী নেতৃত্ব এবং উদীয়মান শক্তিকে ’৭১ পূর্ব, মধ্য ও উত্তর পর্বে ধ্বংস করেছে ভারত রাষ্ট্র ও পাকিস্তান এবং সেই সঙ্গে আমেরিকা ও চীনের ভূমিকা। আসলে সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর দুর্বল চরিত্রের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে এখানে স্বাধীন ও উন্নত নেতৃত্ব গঠন বা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে বারবার বাইরের শক্তি ধ্বংস করেছে। তারা এখানে সর্বদাই সমাজের ভিতরের দালাল ও অধঃপতিত নেতৃত্বকে দাঁড় করিয়ে তাকে চাপিয়ে দিয়েছে সমাজের উপর।

এইভাবে দেশটা হয়ে থাকে পরনির্ভর ও পরনিয়ন্ত্রিত। জনগণের এই পরনির্ভর মানসিকতা দ্বারা এ দেশের বিপ্লবী নেতৃত্বও সাধারণত কমবেশী প্রভাবিত হয়েছে। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে এ দেশের বামপন্থী শক্তির রাশিয়া বা চীন নির্ভরতায়। এ দেশে কমিউনিস্টরা হয়েছে হয় অন্ধ রুশপন্থী আর নয় অন্ধ চীনপন্থী। ফলে তারা স্বাধীনভাবে এ দেশে নিজেদের কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করতে চায় নি বা পারে নি।

এর কারণ হয়ত এই যে, এ দেশের কমিউনিস্টরা অবচেতনে বা অর্ধচেতনেই এ দেশের জনগণের মধ্যে শক্ত জমি খুঁজে পায় নি। অস্থির, দুর্বলচিত্ত, পরনির্ভর ও দাস মনোবৃত্তি সম্পন্ন জনগণকে হয়ত তারা অবচেতনে কিংবা অর্ধচেতনে ভয় পেয়েছে, অবিশ্বাস করেছে, সেখানে প্রয়োজনীয় সমর্থন না পাওয়ায় অসহায় ও দুর্বল বোধ করেছে। ফলে তখন মানসিক অসহায়তা ও দুর্বলতা ঘুচাতে আশ্রয় খুঁজেছে বিদেশ নির্ভরতার ভিতর। যদিও তাদের বিদেশী তত্ত্ব তাদেরকে শিখিয়েছে জনগণকে অন্ধভাবেই পূজা করতে এবং সেটা তারা করেছেও প্রকাশ্যে, সাড়ম্বরে, কিন্তু যখন ব্যাপক জনগণের জোয়ার দেখা দিয়েছে তখন তারা ভয় পেয়েছে এবং জনজোয়ার থেকে সরতে গিয়ে সরে গেছে নিজেদের কষ্টে তৈরী পথ থেকেই। ১৯৬৯-’৭০এর দিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এক শক্তিশালী পার্টিতে পরিণত হলেও এর নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবদের জোয়ারে গলে যাবার ভয় প্রকাশ করত। বস্তুত বামপন্থীদের ভূমিকা এ দেশে জাতীয়তাবাদের সংগঠন ও বিকাশে আওয়ামী লীগের তুলনায় অনেক বেশী। কিন্তু জনগণ আওয়ামী লীগের প্রতিই বেশী ঝুঁকেছিল। কারণ এটাই এ দেশের জনগণের মন-মানসিকতা ও চরিত্র সম্পন্ন উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পার্টি ছিল। এই মধ্যবিত্তের একাংশই রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে আজকের উচ্চবিত্তে পরিণত হয়েছে। আসলেই উদীয়মান মধ্যবিত্তের পার্টি আওয়ামী লীগ ছিল সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর আদর্শ পার্টি। সুবিধাবাদ, দুর্নীতি ও শঠতা দ্বারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বেই সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী চরিত্র অথবা আকাঙ্ক্ষার শ্রেষ্ঠ প্রতিফলন ঘটেছিল যেমন তা এক সময় ঘটেছিল আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি মুসলিম লীগে। সুতরাং সঙ্গত কারণেই মুসলমান বাঙ্গালী জনগণের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশই আওয়ামী লীগের সহজিয়া পথে জমায়েত হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ ছিল পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী দ্বারা, সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লালিত। আওয়ামী লীগই হতে পারত যে কোনও প্রবল বিদেশী শক্তির সবচেয়ে সহজ ক্রীড়নক। সুতরাং আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের পর্যায়ে প্রতিবেশী প্রবল রাষ্ট্র ভারতের ক্রীড়নক হল।

এ দেশের বামপন্থীদের দোষ দিয়েও বিশেষ লাভ নেই। কারণ তারা প্রাণপণ যুদ্ধ করলেও এ দেশের জনমানস এবং ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধে এত দ্রুত সফল হত না। অথচ এটাই সত্য যে এ দেশের সাধারণ মানুষ কষ্ট কিংবা দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামকে যেমন ভয় করে তেমন যারা বৃহৎ কোনও স্বপ্ন নিয়ে কষ্টকর ও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের পথ অনুসরণ করে তাদের প্রতি শুধু যে বিমুখ হয় তাই নয় এমনকি অনেক সময়ই তাদের বিরুদ্ধ হয়। তবে এটা ঠিক যে, বামপন্থীরা গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে পূর্ব থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সংগঠিত করলে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে ভূমিকা নিলে স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশী পরিমাণে দেখা দিত যেটাকে হয়ত তারা পরবর্তী সময়ে কাজে লাগাতে পারত।

এ দেশের গ্রাম ও কৃষিনির্ভর গণ-মানুষের মনের জমি চিরকালই দুর্বল ও অস্থিতিশীল। এই কারণে এ দেশে যারা বৃহৎ কিছু করতে চেয়েছে বা বড় হতে চেয়েছে তারা ভিতর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বাহিরের। যারা শুধু ভিতরের শক্তিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সমর্থন ও সহযোগিতার অভাবে তারা হয় শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়েছে আর নয় বাহিরে চলে গেছে কিংবা বাহিরের শক্তির সঙ্গে হাতে মিলিয়েছে সাফল্যের আশায়। এই জন্য অমিততেজা বাঙ্গালী বীর নায়ক সুভাষ বসু শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী ও পররাজ্যগ্রাসী জার্মানী ও জাপানের আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে চেয়ে।

এটা ঠিক যে, কিছু উন্নত নগর জীবন, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার চেতনা এবং আধুনিক শিক্ষা এখানে উন্নত চিন্তা ও ব্যক্তির উপাদান জন্ম দিচ্ছে দীর্ঘ কাল ধরেই। কিন্তু সেসব কিছুই চারপাশের বৈরী কিংবা প্রতিকূল আবেষ্টনের দরুন ঠিকমত দানা বাঁধতে এবং বিকাশ ও বিস্তার লাভ করতে পারে নি। বরং অবিরাম জন্মপ্রাপ্ত এইসব উন্নত উপাদানকে বিদেশী শক্তিগুলি তাদের শক্তি দ্বারা অব্যাহত ধারায় আত্মস্থ বা আত্মসাৎ করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। হয়ত এই বাস্তবতায় নওয়াবী আমলে এ দেশের উদীয়মান বাঙ্গালী নেতৃত্ব বহিরাগত মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে নিজেরাই যুদ্ধ করে তাদেরকে উৎখাত করার পথ বেছে না নিয়ে বিদেশী ব্রিটিশ বণিক-আমলার সঙ্গে সহযোগিতা দ্বারা বহিরাগত মুসলমান শাসকদেরকে উৎখাত করার পথ বেছে নিয়েছিল। এ দেশ অহিংসাবাদী চৈতন্যের জন্ম হয়। পাঞ্জাবের গুরু গোবিন্দের মতো সুদৃঢ় ও জঙ্গী সমাজ সংগঠক কিংবা মারাঠা বীর শিবাজীর মতো বীর ও যোদ্ধা রাষ্ট্র সংগঠকের জন্ম এ দেশে হয় নি।

জনগোষ্ঠীর দুর্বল মানসিকতা এ দেশে অস্বাভাবিক পরগাছাবৃত্তি, অনুকরণবৃত্তির জন্ম দিয়েছে। এ দেশে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব কিছুই আসে বাহির থেকে। প্রায় সবই এখানে আরোপিত হয়। এখানে ধর্ম বা মতবাদ তথা আদর্শ আসে বাহির থেকে। রাজনীতিও তা-ই। এখানকার সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে বাইরের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কিংবা সাহায্যে। যে যত বিদেশের সার্টিফিকেট প্রাপ্ত সে এখানে তত খ্যাত-বিখ্যাত ও প্রশংসিত। বস্তুত এখানকার সবকিছু এত বেশী আরোপিত যে এখানে কোনও কিছুই ভিতর থেকে দাঁড়াবার পথ পায় না। বর্তমান রাষ্ট্রটিও একটি আরোপ। এটা প্রধানত ভিতর থেকে গড়ে ওঠে নি। ভিতরে এর প্রতিষ্ঠার উপাদান থাকলেও সেটা বাইরের হস্তক্ষেপে চাপা পড়ে বর্তমান বিকৃত ও ধর্মসাম্প্রদায়িক রূপ নিয়েছে।

পরগাছাবৃত্তি ও আরোপ সম্পর্কে আফজালুল বাসার “বাংলাদেশে নেতৃত্বের সমস্যা”য় যা বলছেন তা এখানে উল্লেখ করার মত। তিনি বলছেন,

“আমি বলতে চাই যে, এ দেশে জমিদারি প্রথা আরোপ করা হয়েছিল, এ দেশে ধনতন্ত্রকে আরোপ করা হয়েছে। ’৪৭ সনের এবং ’৭১ সনের স্বাধীনতা আরোপিত। শেখ মুজিবের রাষ্ট্রয়াত্তকরণ আরোপিত, জিয়া-এরশাদের শিল্পায়ন ও ব্যক্তিমালিকানা উৎসাহ আরোপিত। সাম্রাজ্যবাদ তার নিজের স্বার্থেই বাজার খোঁজে — ­বাংলাদেশ তার পাকাপাকি এক বাজার —­ শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত।” ......

“এসব প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি বলতে চাই যে : এ দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের উৎস সকল সময় এই দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক শর্তসমূহের বিকাশের প্রয়োজনে উদ্ভূত নয়। এই দেশ তাই পরগাছা দেশ। অর্থনৈতিকভাবে পরগাছা এবং রাজনৈতিকভাবে পরগাছা। এ দেশে তাই দেখা যায় চীনপন্থী, রুশপন্থী, ভারতপন্থী, সৌদীপন্থী, আমেরিকাপন্থী; এ দেশের বিপ্লবও রাশিয়া কিংবা চীনপন্থী, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ এবং ‘আফগান কায়দায় বিপ্লব করব’ —­ এসবই হচ্ছে পরগাছা বৈপ্লবিক মানসিকতা,­ যার মধ্যে পর প্রতারণা এবং আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছু নেই। আমাদের দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের ব্যর্থতার অনেক কারণ এইসব ভুল ধারণার মধ্যেই নিহিত।” (লোকায়ত, ষষ্ঠ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জুন ১৯৮৮)

আসলে সব সমাজেই অভ্যন্তরীণ বিকাশে বাইরের শক্তিরও একটা ভূমিকা থাকে। শুধু অভ্যন্তরীণ কারণে কোনও কিছুরই বিকাশ এমন কি জন্মই হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাইরের একটা তাড়না বা প্রেরণা কিংবা উপাদান। এটাকে আমরা আরোপ বলতে পারি। কিন্তু স্বাধীন বিকাশ বা জন্ম বাইরের এই আরোপকে ভেঙ্গে নিজের মত করে নেয়, বাইরের প্রেরণাকে নিজের মত করে বিশ্লেষণ করে তাকে ছড়িয়ে দেয় নিজের ভিতরে। এইভাবে বাইরের সাহায্যে চলে তার সংশ্লেষ ক্রিয়া। কিন্তু এ দেশের সমাজ বা সাধারণ মানুষ সেই কষ্ট করতে চায় না। এত শ্রম ও চিন্তা বা সাধনা করার ধৈর্য তার নেই। তার চাই সব তৈরী। এই সহজিয়া মানুষ তাই মাছের মত বাইরের টোপ দেখলেই লাফ দিয়ে পড়ে গিলে খায়। এবং তাতে তার পরিণতি যা হবার তা-ই নয়। সে বারবার বিদেশী শক্তির ভৃত্য হয়, বারবার লাঞ্ছিত হয়, নিগৃহীত হয়, পরীক্ষার বিষয়বস্তু হয়, গিনিপিগ হয়। কিন্তু যার কাছে নিজের ব্যক্তিগত আপাত লাভটাই সবচেয়ে বড় কথা, বাইরের চাকচিক্য সবচেয়ে মূল্যবান সে ধ্বংসের পূর্বে শিখবে কেন? যখন শেখে তখন তো আর তার কিছু করার থাকে না। এদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান তারা বিদেশের শক্তির সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে দিয়ে গৌরব বোধ করে। প্রয়োজনে নিজেদেরকে ভিন্ন সমাজ বা দেশের অংশ করে নিতেও তাদের বাধে না। এইভাবে এ দেশ আজ পরিণত হয়েছে এমন এক রাষ্ট্রে যা বিদেশকে যোগাচ্ছে শুধু সস্তা শ্রমশক্তি নয় সেই সঙ্গে প্রচুর মেধা এবং নানান রকম সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অফুরন্ত সুযোগ। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র এবং এনজিও মিলে এবং আরও অজস্রভাবে অনুপ্রবেশ দ্বারা দেশটা এখন বিভিন্ন বিদেশী পরীক্ষার জন্য এক বিশাল সামাজিক গবেষণাগারে পরিণত হয়েছে যেখানে এখন তাদের জন্য আছে এগারো কোটি মানুষ-গিনিপিগ।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ কি টিকবে?

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রায় আঠারো বৎসর হয়েছে। এই সময়ে দেশে বহু কোটিপতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় সবারই উত্থান হয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে। গড়ে উঠেছে ঢাকার মত বিরাট নগর এবং চট্টগ্রাম, খুলনার মত কয়েকটি নগর এবং বড় শহর। গড়ে উঠেছে বহু উচ্চ ভবন, উন্নত রাজপথ। অসংখ্য বাড়ীতে এসেছে টেলিভিশন, ভি সি আর। দেশের সীমিত সম্পদের সঙ্গে বিদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা এসে যুক্ত হয়ে দেশে সীমিত পর্যায়ে যেমন হয়েছে সুউচ্চ উন্নয়ন তেমন গড়ে উঠেছে একটা ক্ষুদ্র কিন্তু সুউচ্চ বিত্তশালী শ্রেণী। অর্থাৎ এই উন্নয়নের প্রশস্ততা বা ব্যাপ্তি নেই কিন্তু আছে উচ্চতা। এটি উচ্চ, কিন্তু শীর্ণ। সামরিক ও বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং বিভিন্ন ধরনের সুবিধাভোগীদের দ্বারা গঠিত আমলাতান্ত্রিক ধনিক শ্রেণীকে অবলম্বন করে রাষ্ট্রটা সকল শাসন ও শোষণের কেন্দ্রশক্তি হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে অস্বাভাবিক দারিদ্র্য পীড়িত কোটি কোটি মানুষের উপর। একদিকে অবিশ্বাস্য প্রাচুর্য ও উচ্ছৃংখল ভোগবিলাস, আরেকদিকে অবিশ্বাস্য ও প্রচণ্ড দারিদ্র্য আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা।

দেশের জনসংখ্যা এখন এগারো কোটি। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশে এই জনসংখ্যা আতংকজনক হলেও তা এখানেই থেমে নেই বরং আরও দ্রুত গতিতে বেড়ে চলছে।*

------------------------------------------------

* ১৯৮৯ অর্থাৎ গ্রন্থ লেখার কাল অনুযায়ী জনসংখ্যার এই হিসাব। বর্তমানে বাংলাদেশের আয়তন বলা হয় ৫৬ হাজার বর্গমাইল। আয়তনের এই বৃদ্ধি হয়েছে সমুদ্র গর্ভে বাংলাদেশ সংলগ্ন নূতন ভূমিখণ্ডের ক্রমবর্ধমানভাবে উত্থানের ফলে। পাকিস্তান কালে এ দেশের আয়তন বলা হত ৫৪ হাজার বর্গমাইল। অর্থাৎ নদী বাহিত পলি দ্বারা ভূমি গঠন প্রক্রিয়ায় বিগত প্রায় ৬০ বৎসর সময়ে বাংলাদেশের আয়তন প্রায় দুই হাজার বর্গ মাইল বৃদ্ধি পেয়েছে। — লেখক, ২০ অক্টোবর, ২০০৮

----------------------------------------------

সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনার কথা শত সহস্র কণ্ঠে চীৎকার করলেও কোনও ফল হচ্ছে না। শুধু যে দারিদ্র্য এই জনসংখ্যার কারণ তা-ই নয়, বরং প্রধান কারণই হল ধর্মীয় মূল্যবোধ। ইসলাম ধর্ম এ দেশের মানুষের উন্নত মানুষ হিসাবে চেতনার বিনাশ ঘটিয়ে, তার চিন্তাশীলতাকে ধ্বংস করে, দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে, তার সাংস্কৃতিক জীবন কেড়ে নিয়ে, তার মধ্যে দেশাত্মবোধের স্ফুরণের পথ রুদ্ধ করে তাকে করেছে অধঃপতিত, দেশগৌরবহীন, সমাজ চেতনাহীন এবং ভাগ্যবাদী। এ দেশের প্রকৃতিদত্ত ত্রুটি ও নিকৃষ্টতাগুলিকে অসহিষ্ণু ইসলাম ধর্ম আরও ভালোভাবে লালন ও শক্তিশালী করেছে। আল্লাহ্‌র অনুগত দাস হতে গিয়ে বাস্তবে মানুষ হয়েছে প্রকৃতির অনুগত দাস। মানুষ হিসাবে তার স্বাধীন ব্যক্তিসত্তার জাগরণের পথ থাকে নি। ধর্মের কঠোর অনুশাসন ও সংস্কৃতিহীন শুষ্ক জীবন যাপন তার চেতনার বিকাশ ঘটায় নি বলে এ দেশের প্রকৃতিজাত নিকৃষ্টতার বিরুদ্ধে লড়াই না করে সে হয়েছে তার সহজ ও নিশ্চেষ্ট শিকার। আত্মসমর্পণকারী এই মানুষ ভাগ্যবাদী হয়ে, আল্লাহভক্ত হয়ে, স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাহীন হয়ে অধঃপতিত হয়েছে এ দেশের প্রকৃতিজাত নিকৃষ্টতায়। ইসলাম যেমন জাতি হিসাবে তাকে গৌরব বোধ দেয় নি, নিজের সঠিক জাতীয় পরিচয় চিনতে দেয় নি তেমন তাকে দেয় নি দায়িত্বশীলতা বা দায়িত্ববোধ। আল্লাহ্‌ যখন জন্ম দিয়েছেন তখন আহারও দিবেন তিনিই। এই রকম যার চেতনার নমুনা তার দ্বারা পরিবার পরিকল্পনা আশা করাই মূর্খতা । উপরন্তু এই ধর্ম নৃত্য-গীতের মত বিদেনাদনের সহজ ও সুন্দর পথ বিনষ্ট করে দিয়ে মানুষকে চালিত করে স্থূল সম্ভোগের দিকে। সুতরাং একদিকে অসচেতনতার কারণে জন্মনিরোধ ব্যবহারে অনাগ্রহ এবং অপর দিকে বিবাহিত জীবনে দায়িত্বহীন ও যথেচ্ছ যৌনাচার জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে।

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ধর্ম মানুষ কর্তৃক জন্মনিয়ন্ত্রণ বিরোধী। আল্লাহর ইচ্ছার কাছে চূড়ান্ত ও সার্বিক নির্ভরতা এই ধর্মের মূল কথা । ইসলামের নবী জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে বলছেন, “কেয়ামত পর্যন্ত যত লোক সৃষ্টি হওয়া (আল্লাহ্‌তাআলার নিকট) নির্ধারিত রহিয়াছে তাহার প্রত্যেকটি লোক অবশ্য জন্মলাভ করিবেই।” (বোখারী শরীফ)। ইসলামের অনুশাসন এত দৃঢ় ও সতর্ক যে, তার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে স্বাধীন ও বিজ্ঞানবাদী চিন্তা-চেতনার উদ্ভব ঘটানো অত্যন্ত দুরূহ। বিশেষত সমাজের নীচের তলায়, অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত ও ধর্মশাসিত মানুষের চেতনা এমনইভাবে আবদ্ধ হয়ে থাকে যে, সেখান নূতন ও সৃষ্টিশীল কিছুই জন্ম নিতে পারে না। ধর্মের কঠোর ও অন্ধ বিশ্বাসসর্বস্বতার দাবী পূরণ করতে গিয়ে স্বাধীন চিন্তাশক্তি মৃত্যু বরণ করে। কুর্‌আনে বলা হচ্ছে, “তোমরা যদি কৃতক্ততা প্রকাশ কর ও বিশ্বাস কর তবে তোমাদের শাস্তিতে আল্লাহ্‌র কি কাজ?” (৪ : ১৪৭)। “তোমরা কি তোমাদের রাসূলকে সেইরূপ প্রশ্ন করিতে চাও যেইরূপ পূর্বে মুসাকে প্রশ্ন করা হইয়াছিল? এবং যে-কেহ বিশ্বাসের পরিবর্তে অবিশ্বাসকে গ্রহণ করে নিশ্চিতভাবে সে সরল পথ হারায়।” ( ২ : ১০৮) “ হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ্‌কে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হইয়া কোন অবস্থায় মরিও না।” (৩ : ১০২)। “আল্লাহ্‌কে ভয় করিবে, আল্লাহ্‌ শাস্তি দানে কঠোর।” ( ৫ : ২)। আরও বলা হচ্ছে, “যাহারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহাতে বিশ্বাস করে, আর উহাই তাহাদিগের প্রতিপালক হইতে প্রেরিত সত্য; তিনি তাহাদিগের মন্দ কর্মগুলি ক্ষমা করিবেন এবং তাহাদিগের অবস্থা ভাল করিবেন।” (৪৭ : ২ )। “ যাহাকে ইচ্ছা তিনি (আল্লাহ্‌) শাস্তি দেন এবং যাহাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন এবং আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে শক্তিমান।” (৫: ৪০)। “হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং তাহার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর।” (৫৭ : ২৮)। কিংবা বলা হচ্ছে , “এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নহে। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি উহারা জানিত!” (২৯ : ৬৪)।*

------------------------------------------------

*এই গ্রন্থে কুর্‌আনের সকল আয়াতের উদ্ধৃতি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক কুর্‌আনের অনুবাদ গ্রন্থ “ আল কুর্‌আনুল করীম” থেকে নেওয়া।

------------------------------------------------

কুর্‌আন, হাদীসের কঠোর বিধিনিষেধ দ্বারা মানুষের চেতনায় পরলোক মনস্কতা ও পরলোক ভীতি এমনইভাবে দৃঢ়বদ্ধ করা হয়েছে যে, এই চেতনায় আধুনিক জীবন চিন্তা, বিজ্ঞান মনস্কতা ও যুক্তিবাদ প্রবেশের তেমন কোনও সুযোগই পায় না। এই সঙ্গে ইসলাম নারীর অবস্থানকে কঠোরভাবে বেঁধে রেখেছে বিভিন্ন ধর্মীয় সামাজিক বিধি-নিষেধ দ্বারা।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষত নারীর স্বাধীনতা এবং উন্নত চেতনা অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া কখনই জন্মহার বৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ইসলাম নারীকে দিয়েছে অবরোধ এবং অমর্যাদা। তাকে যেমন দেয় নি স্বাধীনতা তেমন দেয় নি দায়িত্বশীলতা। নারীর এই অবনত ও পশ্চাৎপদ অবস্থান নিয়ে এ দেশ যেন কোনও কালে জন্মসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ আশা না করে।

এমন অবস্থায় আমাদের দেশ বিপুল সঙ্কটজর্জর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিদেশের সাহায্যের উপর। বস্তুত রাষ্ট্রটা শুধু যে প্রধানত বিদেশের সাহায্যে জন্ম নিয়েছে তা-ই নয় উপরন্তু এটা টিকেও আছে প্রধানতই বিদেশের সাহায্যে। শুধু উন্নয়ন পরিকল্পনার টাকাই আসছে না বিদেশ থেকে, এমন কি বাৎসরিক বাজেটের এক বৃহদাংশও আসছে বিদেশ থেকে। অর্থাৎ বাইরের রাষ্ট্র চালাচ্ছে বলেই এই রাষ্ট্র এখন টিকে আছে। তবে এ টেকা এখন কোনও মতে। কয়েকটি ক্ষুদ্র বিন্দুতে জৌলুসের আলো যতই জ্বলুক দেশের বিস্তীর্ণ চারপাশকে ঘিরে আছে জমাট অন্ধকার। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতে চলেছে অনুন্নয়ন, অশিক্ষা, অপুষ্টি ও অপরাধ। চতুর্দিকে এখন দুর্নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নতির সর্বশ্রেষ্ঠ পথ।

অস্বাভাবিক পরিস্থিতিকে আরও অবনত করছে ক্রমবর্ধমান ও অস্বাভাবিক বন্যা ও খরা। দেশে এবং উত্তরের দেশগুলোতেও ব্যাপক বননিধন এবং দেশের ভিতরে অপরিকল্পিত ও দায়িত্বহীনভাবে রাস্তা, রেললাইন, সেতু ও নগর, শহর নির্মাণ ও বসতিস্থাপনের ফল এখন ফলতে শুরু করেছে । প্রকৃতিকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার করতে না জানলে যা হয় তা-ই হয়েছে। এর সঙ্গে ভারতের ফরাক্কা বাঁধ এবং অন্যত্র বাঁধ এবং বাংলাদেশকে কাবু রাখার তৎপরতা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

বিকল্প নেতৃত্বের শক্তিও নেই যা এই অবস্থায় দেশের হাল ধরবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বলতে যা বোঝায় তা এখন বহু বিভক্ত। উল্লেখ করার মতো দল এখন অন্তত এক ডজনের কাছাকাছি আছে। অবশ্য প্রধান দল দু’টো ­ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। কিন্তু কারোরই সাংগঠনিক অবস্থান কিংবা জনসমর্থন এতটা ভালো নয় যে কার্যকরভাবে রাষ্ট্রের হাল ধরতে পারে।

দেশের এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে বাড়ছে ভাগ্যবাদ এবং সেই সাথে পীরের প্রভাব এবং ধর্মের প্রভাব। ব্যাপক মানুষ নামাজ, রোজার দিকে ঝুঁকছে এবং আরও ধর্মান্ধ হচ্ছে। এর ফল হচ্ছে আরও ক্ষতিকর। ধর্মের প্রভাবে জনগণের সুস্থ চিন্তার বিকাশ ঘটানো কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

এ দেশের গণমানুষের প্রাচীন নিকৃষ্টতা দূর করার এক বিরাট হাতিয়ার হল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার প্রসাব। কিন্তু শিক্ষার প্রসার যতটা হচ্ছে অশিক্ষারও হচ্ছে ততটা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি অবস্থাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখছে। অন্যদিকে যে সংস্কৃতি চর্চা সাধারণ জনগণের চেতনার মানকে উন্নত করতে পারত ইসলাম সংস্কৃতি চর্চাকে বন্ধ কিংবা নিরুৎসাহ করায় জনগণের চেতনা বরং অধঃপতিত হচ্ছে তার আদিম অবস্থানে। হিন্দু জনগণের নিম্নতর অংশ তাদের ধর্মীয় বর্ণজাতিভেদের ক্ষতিকর প্রভাব সত্ত্বেও যে সংস্কৃতি চর্চা দ্বারা উন্নততর চরিত্র ও মন-মানসিকতা অর্জন করতে পারে নিম্নতর শ্রেণীর কিংবা সাধারণ মুসলমান এই সংস্কৃতি চর্চার অভাবেই সেটা পারে না। তার ধর্মের কারণে চিত্রকলা, অভিনয়, নৃত্য ও সঙ্গীত বর্জন বা এগুলির প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ তার চেতনাকে যেমন শুষ্ক ও স্থূল করে তেমন তাকে নিক্ষেপ করে বিকৃত মানসিকতার পঙ্কে। সে এতে করে নিজে যেমন অধঃপতিত হয় তেমন অধঃপতিত করে সমগ্র সমাজকে।

এটা ঠিক যে, এ দেশে নগরায়ন হচ্ছে, শিক্ষার বিস্তারও হচ্ছে এবং রেডিও, টেলিভিশন ও শিক্ষার প্রসার মানুষের চেতনাকে উন্নততর করছে। কিন্তু এগুলির ফল পাচ্ছে খুব সীমিত একটা জনসংখ্যা। এবং প্রগতি বিরোধী শাসকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে এগুলি সমাজে অশিক্ষা-কুশিক্ষাও ছড়াচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণে। উপরন্তু জনসংখ্যার বিপুলতর আয়তন যারা ক্রমবর্ধমানভাবে সৃষ্টি করছে সেই সংখ্যাগুরু সাধারণ মানুষ ­দরিদ্র, অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ মানুষ ক্রমেই তাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা দ্বারা অধিকার করছে সমগ্র সমাজকে। এইভাবে তারা হয়ে আছে সমগ্র সমাজের পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়া, সংকীর্ণতা ও দৈন্যের এক অব্যাহত সরবরাহ ভাণ্ডার। গ্রাম অবিরাম অধিকার করছে শহরকে, পশ্চাৎপদতা অধিকার করছে আধুনিকতাকে, অনুন্নয়ন উন্নয়নকে, দুর্নীতি নীতিকে এবং প্রতিক্রিয়া প্রগতিকে।

প্রকৃতপক্ষে দেশ একটা দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে। এই যে একদিকে আধুনিকতা ও উন্নয়ন আরেকদিকে পশ্চাৎপদতা ও অনুন্নয়ন, একদিকে শিক্ষা ও আরেকদিকে অশিক্ষা, একদিকে বিত্ত আরেকদিকে বিত্তহীনতা বা নিঃস্বতা এ সবই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এখানে সমগ্র উন্নয়ন ও আধুনিকতার ধারাই মূলত বিকৃত। বিকৃত আজ থেকে নয়, বরং শত শত বৎসর ধরে। কারণ এখানে যা কিছু উন্নয়ন ও বিকাশ হয়েছে তা প্রধানত ভিতরের তাগিদে ও চেষ্টায় নয়, বরং তা প্রধানত বাহিরের শক্তির প্রয়োজনে, বাহিরের শক্তির আধিপত্য কিংবা স্বার্থের প্রয়োজনে। ফলে এখানে উন্নয়নের যে সিঁড়ি তৈরী হয় তা সাধারণত তৈরী হয় বহিঃশক্তির দ্বারা। এ দেশে যারা উপরে উঠে বা উন্নতি করে তারা সাধারণত সেই সিঁড়ি বেয়েই উঠে। অর্থাৎ উন্নতির পথ হয়ে দাঁড়ায় এই বাইরের আরোপকে ব্যবহার ও রক্ষা করা। যারা উপরে উঠতে চায় তারা এই আরোপের পথকেই আরাধনা করে। যারা অনেক উপরে উঠে তাদের অনেকে যখন নিজেদের প্রকৃত গ্লানির অবস্থাটা অনুভব করে তখন তাদের মধ্যে কেউ কেউ অবস্থাটা বদলাতে চেয়ে পথটাকে ধ্বংস করতে বা পথ পরিবর্তন করতে চায়। অর্থাৎ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু তখন উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা সবাই মিলে পথটাকে বাঁচাতে চায়। অর্থাৎ যারা উপরে উঠে নি বা যারা আরও উঠতে চায় এবং এই পথের সুফল ভোগ করতে চায় তাদের সবারই আরাধ্য হল দাসত্বের পথটা।

এ দেশে বিদেশীদের দাসত্বের পথ ধরেই সাধারণভাবে সবাই উপরে উঠেছে। এই পথ ধরে ছোটার প্রতিযোগিতায় যে যত ধূর্ততার সঙ্গে, নিষ্ঠার সঙ্গে বাইরের প্রভুকে তুষ্ট করেছে এবং যে যত দুর্নীতি করতে পেরেছে, নিজের দেশের দুর্বলতর মানুষদেরকে লুণ্ঠন ও শোষণ করতে পেরেছে সে এ দেশে তত বড় হয়েছে। এ দেশে বিত্তবান তো এরাই। এরাই উন্নত হয়। এরাই তাদের সুবিধার জন্য নগর গড়ে, সুরম্য ভবন তৈরী করে, প্রশস্ত রাজপথ বানায়। শুধু নিজেদের প্রয়োজনে নয়, বিদেশীদের প্রয়োজনে এবং স্বার্থেও, বিদেশীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থেও। কষ্টার্জিত নয় তাদের কোনও কিছুই। দেশের মানুষের দারিদ্র্য তাদের সহায়। এই দারিদ্র্য দ্বারা তারা পায় সস্তায় অজস্র চাকর-চাকরানী, বিভিন্ন ধরনের কাজের লোক এবং সুযোগ-সুবিধা। এই দারিদ্র্য দেখিয়ে বিদেশের কাছ থেকে ভিক্ষা করে এনে তা নিজেরা আত্মসাৎ করে।

এমন অবস্থায় এ দেশে উন্নয়নের এমন এক প্যাটার্ন বা ছক গড়ে উঠেছে যাতে বিশাল গ্রামকে লুণ্ঠন ও শোষণ করার জন্য মুষ্টিমেয় নগর ও শহর গড়ে ওঠে, বিপুল অশিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিত মানুষকে দমন ও শোষণ করার জন্য মুষ্টিমেয় শিক্ষিত তৈরী হয় এবং সারাদেশকে মূঢ়, অশক্ত ও পদানত রাখার জন্য সুউচ্চ উন্নয়নের সীমিত কেন্দ্র তৈরী হয়। তাই এ দেশে উন্নয়ন, শিক্ষা, আধুনিকায়ন সবই যে শুধু বিকৃত তা-ই নয় অত্যন্ত সীমিত। চারপাশের দুস্থ ও দুর্গত জীবনের এক বিশাল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে স্বল্প পরিসর উন্নতির এক আকাশভেদী চূড়া।

সুতরাং আমরা এমন এক দুষ্টচক্র দেখতে পাচ্ছি যার এক প্রান্তে আছে বিত্তবান ­ সে উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত যা-ই হোক, আর এক প্রান্তে আছে নিম্নবিত্ত ও নির্বিত্তের বিশাল দল।

যদিও আজকের বিত্তবানের বড় অংশই উঠে এসেছে নিম্নবিত্ত ও নির্বিত্তের দল থেকে এবং এ দেশের বিত্তবান সাধারণ নিম্নবিত্ত ও নির্বিত্ত জনগণের সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে (হয়ত আরও উন্নততর রূপে) তবু এই বিত্তবানের মত এত সীমাহীন লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ ও নির্বিবেক নয় নির্বিত্ত জনগণ।

সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, এ দেশের সাধারণ মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্যের যত ত্রুটি ও নিকৃষ্টতাই থাক এক সময় এ দেশের সাধারণ মানুষ এত বেশী লোভী ও দুর্নীতিপরায়ণ ছিল না। তখন সাধারণ মানুষ অনেক বেশী তুষ্ট ছিল এখনকার তুলনায়। এর জন্য আজকের বিত্তবান কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণীই সবচেয়ে দায়ী। কারণ তারা সাধারণ মানুষের দুর্বলতাকে পুঁজি করে যেমন বড় হয়েছে তেমন অনুসারী জনগণের সামনে রেখেছে বা তৈরী করেছে মন্দ দৃষ্টান্ত যা সাধারণ মানুষেরও দুর্বলতা ও দোষগুলিকে বাড়িয়েছে বহু পরিমাণে। এর পরিণতিতে আজ সর্বত্র একদিকে অভাব যত বাড়ছে এবং আরেকদিকে জীবনের মান যত উন্নত হচ্ছে তত বাড়ছে লোভ ও দুর্নীতি।

এ দেশে সাধারণ মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে অধঃপতন ঘটিয়েছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তান দ্বারা এ দেশে হিন্দু বিতাড়ন এবং হিন্দুর সম্পদ ও সম্পত্তি আত্মসাৎ বা জবরদখলের যে জোয়ার এবং ধারা এসেছে তা এ দেশের সাধারণ মানুষের যেটুকু ভালো দিক ছিল তারও অনেকটাই ধ্বংস করেছে। সাধারণ বাঙ্গালী চরিত্রে যে লোভ বা ফাঁকি বা নীতিহীনতা সুযোগের অভাবে, প্রশ্রয়ের অভাবে ছিল ছোট হয়ে, সুযোগ পেয়ে, প্রশ্রয় ও উস্কানি পেয়ে বড় হতে হতে তা-ই আজ আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে।

পাকিস্তান তাকে প্রথম দ্রুত বড়লোক হবার শিক্ষা দিয়েছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তাকে রাতারাতি বড়লোক হবার শিক্ষা দিয়েছে। শুধু হিন্দুর সম্পদ নয়, এবার উর্দূভাষীর সম্পদও তার লুণ্ঠনের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। এইভাবে মুসলমান বাঙ্গালীর যে নেতৃত্ব বা প্রতিনিধি আজ সমাজে উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তের রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে তার ভিতরটায় যে কোনও মূল্যে আরও অর্থ-বিত্ত সংগ্রহের অন্তহীন লালসা ছাড়া আর কিছু নেই।

এটা ঠিক যে, সাধারণ মানুষদের সবাই তাদের নেতৃত্বের মত নীতিহীন নয়। এতটা নীতিহীন হবার সুযোগও তাদের নেই। কিংবা তারা নয় বিত্তবানের মত শ্রমবিমুখ। কিন্তু যে দুষ্টচক্রে আজ দেশ আবদ্ধ হয়ে আছে সেটা তারা ভাঙ্গবে কী করে? এই সাধারণ মানুষদের যে মানসিক বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমরা দেখেছি, তাদের ভিতর যে দায়িত্ববোধহীনতা, কষ্টবিমুখতা এবং সহজ, ঝামেলামুক্ত ও আয়েশী জীবনের প্রতি আসক্তি ও তজ্জনিত পরনির্ভরতা রয়েছে সেগুলি কি ভিতর থেকে এই দুষ্টচক্র ভাঙ্গার শক্তি গড়ে উঠতে সাহায্য করবে?

বিত্তবান এই দুষ্টচক্র ভাঙ্গবে না। কারণ তার জীবনের সম্পদ, সম্ভাবনা ও আরও উন্নতির ভিত্তিই এই দুষ্টচক্র। সুতরাং এই দুষ্টচক্র যাতে কেউ ভাঙ্গতে না পারে সেই দিকেই বরং সে লক্ষ্য রাখবে। যদি দেশের ভিতরে পরিস্থিতির অবনতির জন্য কারো জীবন অনিশ্চিত হয়ে যায় কিংবা কারো কাছে এখানে জীবন অসহনীয় মনে হয় তবে তাকে বদলাবার জন্য কষ্ট ও ঝুঁকি নিবার বদলে চলে যাবে বিদেশে। অজস্র অর্থ আর সংযোগের জোরে সে পথ তো তার সামনে খোলাই আছে। অন্তত এই স্বপ্ন ও সম্ভাবনা তাকে মোহাবিষ্ট করে রাখার জন্য যথেষ্ট।

এমন অবস্থায় দুষ্টচক্র থাকবে অব্যাহত। দেশের সঙ্কট বাড়বে। বিশৃঙ্খলা বাড়বে। শূন্যতা বাড়বে। বৈধ উপায়ে নূতন কোনও সামাজিক নেতৃত্ব যথাযথভাবে গড়ে উঠতে পারবে না শাসক শ্রেণীর বিরোধিতা, বিদেশীদেরও বিরোধিতা এবং জনগণের দিক থেকেও প্রয়োজনীয় লালনের অভাবের জন্য। এমন অবস্থায় কী হবে?

একটা সম্ভাবনা হল ক্রমবর্ধমান ব্যাপক সঙ্কট ক্ষমতাসীন শ্রেণী বিশেষত সেনাবাহিনীর মধ্যেই বিভক্তি ঘটাবে। সে ক্ষেত্রে দেশ ব্যাপক গৃহযুদ্ধে জড়াবে এবং রাষ্ট্রটা বিভক্ত হবে দুই বা ততোধিক বিবদমান শক্তিতে বা অঞ্চলে। কিংবা এমন হতে পারে যে, ব্যাপক আয়তনে গৃহযুদ্ধ হবে না সেনাবাহিনীর ঐক্য বজায় থাকায়। কিন্তু তা না হলেও ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে দেশকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখবে এবং ব্যাপক মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও বিশৃঙ্খলায় ব্যাপক লোক ও সম্পদ ক্ষয় হবে।

এমন অবস্থায় প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত কি সুযোগ নিবে না? এমনিতেই তা নানা দিক দিয়ে বাংলাদেশকে কোণঠাসা করে রেখেছে। তখন হয়ত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে পুরোপুরি পুতুল বা তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করবে কিংবা তার অংশ বিশেষ দখলও করে নিবে। শুধু ভারত নয়, বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র যার যার স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতিকে জটিলতর করতে পারে। এমন কি বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র হিসাবেই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলুপ্তির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ যে একটা গণ-অভ্যুত্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তেমন মনে হয়। সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও ক্রোধের চাপে বর্তমান বহুধা বিভক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। কিংবা নূতন সংহত নেতৃত্ব জন্মলাভ করতে পারে। মোট কথা পরিণতি যা-ই হোক খুব সম্ভবত এমন একটা গণ-অভ্যুত্থান এগিয়ে আসছে যার আঘাতে দেশের রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। যদি কোনও সুসংহত নেতৃত্ব দেখা না দেয় তবে তেমন অবস্থায় বাংলাদেশ আর একটি মাত্র রাষ্ট্র হিসাবে থাকবে না। কিংবা তার পরিণতি হবে বর্তমান লেবাননের মত।*

------------------------------------------------

­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­*এই ভবিষ্যৎ বাণীর দেড় বৎসর পর এরশাদের আধা-সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে, যার আঘাতে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। তবে আমার শঙ্কা বাস্তবায়িত হয় নি। সকল সঙ্কটের ভিতর দিয়েও দেশ এখন পর্যন্ত টিকে আছে, যদিও বিপদাশঙ্কা রয়েই গেছে। - লেখক, ২৩ অক্টোবর, ২০০৮

------------------------------------------------

তবে রাষ্ট্রের পরিণতি যা-ই হোক বর্তমান সামাজিক-রাষ্ট্রিক অবস্থা যতদিন চলবে ততদিন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর সংখ্যায় জনগণ ক্রমবর্ধমান কষ্ট, বিপর্যয় ও মৃত্যুর শিকার হয়ে চলবে। এ দেশে এক নূতন শক্তির উদ্ভব দ্বারা একটা বিশাল ও নূতন ধরনের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত হবার পূর্ব পর্যন্ত এই ধ্বংসাত্মক অবস্থা চলবে। যে দুষ্টচক্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে দেশ আজ দুর্যোগ-দুর্গতির এই প্রায় চূড়ান্ত অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে তা থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন এমনই এক নূতন সামাজিক শক্তির যা এই দুষ্টচক্রের মধ্যকার নয় কিংবা যা এই দুষ্টচক্র ভেঙ্গেই প্রথমে নিজেকে সংগঠিত করতে সমর্থ হবে।

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : গোঁড়া ধর্মীয় শক্তি কি ক্ষমতা দখল করতে পারবে?

যেহেতু আমাদের সামাজিক সমস্যা অনেকখানিই নৈতিক বা চারিত্রিক সেহেতু এখানে নৈতিক বা আদর্শিক শক্তি হিসাবে মৌলবাদী ইসলামী বা গোঁড়া ইসলামী শক্তির ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা থাকে। বস্তুত উৎপাদন সম্পর্ক বা অর্থনীতিতে বিশেষ কোনও পরীক্ষা আর বাকী নেই। মুজিব শাসনে সমাজতন্ত্র হিসাবে কৃষি বাদে শিল্প অর্থনীতিতে ব্যাপক জাতীয়করণ করা হয়। সেই ব্যর্থ অভিজ্ঞতা যেমন দেশের আছে তেমন আছে বিরাষ্ট্রীয়করণের কিংবা বিরাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত অর্থনীতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। বস্তুত এখানে শুধু মালিকানা সম্পর্কের মধ্যেই মূল রোগ নেই। এখানকার বিত্তবান এমন এক পথ ধরে উঠে এসেছে যে সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ উভয়কেই ব্যবহার করতে সক্ষম। সমাজতন্ত্রেও তার অরুচি নেই যদি রাষ্ট্রের কাঁধে দায়িত্ব তুলে দিয়ে অবাধে লুটপাটের সুযোগ পাওয়া যায়। আসলে তাদের শোষণের মূল পদ্ধতি উৎপাদন পরিচালনা নয়, বরং বাইরের শক্তি দ্বারা সৃষ্ট ক্ষমতা যন্ত্র তথা রাষ্ট্রকে ব্যবহার কিংবা সহযোগিতা দ্বারা অর্থ, সম্পদ ও সম্পত্তি জবরদখল, আত্মসাৎ এবং বৃদ্ধি। এ দেশের বিত্তবানের সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদির সবটিরই বা কোনওটির চর্চা বা পক্ষপাতিত্ব নির্ভর করে মূলত বিদেশের নিয়ন্ত্রণকারী বা দাতা রাষ্ট্রগুলির অভিলাষের উপর। এইভাবে এ দেশে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, অর্থনৈতিক পদ্ধতির গুরুত্ব থাকলেও তার তুলনায় অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ নীতিবান বা আদর্শবাদী নেতৃত্ব গঠন।

এই রকম এক অবস্থায় ধর্মীয় শক্তি মাঠে নেমেছে ইসলামী আদর্শ বা নৈতিকতার আহ্বান নিয়ে। দেশের দুর্গতি ও সঙ্কটের সঙ্গে মানুষের ভাগ্যনির্ভরতা ও পরলৌকিকতা যত বাড়ছে তত বাড়ছে জনগণের মধ্যে ধর্মচর্চা। এর সুযোগে জামাতে ইসলামীর মতো ধর্মোন্মাদ বা গোঁড়া ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।

এমন অবস্থায় প্রশ্ন আসে এ দেশে উগ্র ধর্মীয় শক্তির ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা কতটুকু? কিন্তু এ দেশে ধর্মীয় শক্তি নূতন করে ক্ষমতা দখল করবে কী করে? এরা তো ক্ষমতাতেই আছে! পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা দ্বারা তাদের এ কালে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা শুরু হয়। মাঝখানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও সেটা ছিল বহিরাবরণ। ভিতরের বস্তু ছিল ইসলাম ধর্ম ও তার মূল্যবোধসমূহ। কিন্তু ১৯৭৫-এ জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে পরবর্তী সময়ে এই আবরণটুকুও ফেলে দেন। জেনারেল এরশাদ শাসনের ইসলামী রূপকে আরও স্পষ্টতর করেছেন মাত্র।

আধুনিক যুগে রাষ্ট্র চৌদ্দশত বৎসর পূর্বের মত করে চালানো সম্ভব নয়। সুতরাং মুহাম্মদের মত করে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র আজকের যুগে গঠন করা সম্ভব নয়। যেটা সম্ভব তা হচ্ছে ইসলামের কিছু নিয়ম বা আইনগুলোকে দৃঢ়তার সঙ্গে অনুসরণ করা। যেমন রাষ্ট্র থেকে নামাজ, রোজা পালনের দিকে লক্ষ্য রাখা বা এগুলো পালনকে উৎসাহ দান এবং বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। বর্তমানে এরশাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র এটা করছে। কিন্তু সুদ প্রথা বাদ দিলে অন্তত পুঁজিবাদী অর্থনীতি অচল হবে। সুতরাং আরও ইসলামীকরণ করতে হলে ইসলামে নিষিদ্ধ সুদ প্রথা রক্ষা করেই নামাজ, রোজা ও মেয়েদের পর্দা প্রথা বাধ্যতামূলক করতে হবে, চুরি করলে হাত কাটার বিধান চালু করতে হবে ইত্যাদি।

এ দেশের সাধারণ মানুষ ধর্মচর্চায় আগ্রহী। কিন্তু ধর্মীয় বিধান কঠোরভাবে চালু করবে এমন কোনও উগ্র ও কঠোর ধর্মীয় শক্তিকে তারা ক্ষমতায় দেখতে চাইবে এমন সম্ভাবনা খুব কম। এর কারণ যে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যুক্তিবাদী কিংবা ইহলোকবাদী তা কিন্তু নয়। আসলে তারা যে কোনও কঠোর শৃঙ্খলাকে ভয় করে। সেটা ধর্মীয় শৃঙ্খলাই হোক আর রাজনৈতিক-সামাজিক শৃঙ্খলাই হোক। এদের এই সহজিয়া প্রবণতার জন্য ওয়াহাবী, ফরায়েজী, পাকিস্তান ইত্যাদি এত আন্দোলনের পরও তারা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মুসলমানদের মত শুষ্ক ও কঠোর হয় নি। অতীতে সমাজের উপর তলায় নারীদের কঠোর পর্দা প্রথা থাকলেও নীচের দিকে এটা জনপ্রিয় ছিল না। এখন তো এটা নোয়াখালী, চট্টগ্রামের মত এলাকার বাইরে কোথায়ও কড়াকড়িভাবে নেই বলাই ভালো।

ইসলামে সঙ্গীতের স্থান নেই। কিন্তু শত চেষ্টাতেও এ দেশের মানুষকে কোনও দিনই সঙ্গীত বিমুখ করা যায় নি। এটা ঠিক যে গ্রামে হিন্দু পাড়াগুলোতে এখনও রাত্রে কাজ শেষে মাঝে মাঝে গান-বাজনার যেমন আসর বসে মুসলমানদের মধ্যে তেমনটা হয় না। তবে গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষ গান শুনতে ভালোবাসে। বিশেষত ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল গানসমূহ এ দেশের সাধারণ মানুষের মনে একটা বড় স্থান দখল করে রেখেছে। এগুলোকে একেবারে বাদ দিয়ে একেবারে শুষ্ক, নিরানন্দ হতে এ দেশের সাধারণ মানুষ রাজী হবে না। সুতরাং কঠোর ইসলামী শক্তির সাফল্যের সম্ভাবনা তেমন একটা দেখা যায় না। উপরন্তু প্রতিবেশী বিশাল ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতাও এখানে কঠোর ইসলামী শক্তির উত্থানকে অসম্ভব করবে। একদিকে জনগণের বৃহৎ অংশের অনীহা, এবং অপরদিকে ভারত রাষ্ট্র কর্তৃক বিরোধিতা এখানে উগ্র ও কঠোর ইসলামী শক্তির সাফল্যের পথে বিরাট বাধা।*

------------------------------------------------

* কিন্তু এই ধরনের বিচারের মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যায়। সেটা হচ্ছে এখানে বহিঃশক্তির ভূমিকাকে হিসাবে নেওয়া হয় নি। বিশেষত বর্তমানে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত শুধু ভুল নয়, অধিকন্তু বিপজ্জনকও। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মত কোনও রাষ্ট্র এখানে তার বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটাবার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য উগ্র কোনও ইসলামী শক্তিকে ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে দেখতে চাইতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ তেমন একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে আছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু মানুষের মানসিকতা নির্ধারক উপাদান হিসাবে ভূমিকা নাও রাখতে পারে। সেটা সব সময় রাখেও না। এমন কি আমাদের দেশেও সব সময় রাখে নি। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধই তার প্রমাণ। ­— লেখক, ২৪ অক্টোবর, ২০০৮

----------------------------------------------- 

তবে সবচেয়ে বড় কথা এ দেশের সহজিয়া সাধারণ মানুষ কোনও কঠোর শৃঙ্খলাই পছন্দ করে না। এটা শুধু ধর্মীয় শক্তির জন্যই প্রয়োজ্য নয়। এটা লোকবাদী ও বিজ্ঞান মনস্ক রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখানকার জনগণ সবকিছুর যে সহজ ও দ্রুত সমাধান চায় তার ফলে কোনও দৃঢ়বদ্ধ ও আদর্শবাদী সামাজিক শক্তি গড়ে তোলার কষ্টসাধ্য পথে তারা সহজে যেতে চাইবে না। তার বদলে প্রচলিত সামাজিক-রাষ্ট্রিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের শ্রেণীর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমর্থন ও আনুগত্য পরিবর্তন ও প্রদান করার সহজ পথ বেছে নিতে চাইবে। অর্থাৎ পরিবর্তনটা হতে হবে উপর থেকে। তখন তারা নিরাপদে বা কম ঝুঁকি নিয়ে সমর্থন জানাবে। যখন কোনও উপরতলার শক্তিকে তাদের কাম্য মনে হবে এবং তার শক্তি বা সাফল্য সম্পর্কে তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি হবে তখন হয়ত তারা তার জয়কে ত্বরান্বিত করতে বন্যার মত সমর্থন দিবে। ফলে জন-জোয়ার সৃষ্টি হবে। তবে তার স্থায়িত্ব হবে অল্প। যদি এটাকে ব্যবহার করে কোনও শক্তি দ্রুত সফল হতে পারে বা তার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে তবে তার ভাগ্য ভালো। সেটা না পারলে যখন জনগণের হুজুগ শেষ হবে তখন আর তার কিছুই করার থাকবে না।

কিন্তু এইসব পরিবর্তন উপরতলার পরিবর্তন। এমন অবস্থায় শাসক শ্রেণী কিংবা ক্ষমতা যন্ত্র থেকেই কাউকে এসে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। এই রকম অবস্থায় সামাজিক সঙ্কট কিংবা পরিস্থিতির জটিলতা যখন দৃঢ় হস্ত দাবী করবে তখন সেই দাবী মেটাতে ক্ষমতা যন্ত্র থেকে সেনাবাহিনী ছাড়া আর কে আসবে? অবশ্য যদি জন-জোয়ারের ধাক্কায়ও তা টিকে থাকে। তেমন ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর এক গোষ্ঠী থেকে আর এক গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতার হাত বদল হবে। অবশ্য বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ কিংবা রাষ্ট্রের বিভক্তি বা ভাঙ্গন যদি এই প্যাটার্নকে বদলায় তবে ভিন্ন কথা। ভারতের এই রকম সামরিক হস্তক্ষেপ দ্বারাই ঢিলাঢালা রাজনৈতিক শক্তি হয়েও ১৯৭১-এ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা যন্ত্র থেকে যে-ই আসুক, এমন কি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ গোষ্ঠীও যদি তা হয়, এ দেশের প্রয়োজন কি মিটাতে পারবে? দেশের জনগণকে সঙ্কটমুক্ত করার জন্য আজ আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত যে দৃঢ়বদ্ধ ও কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ সামাজিক শক্তির প্রয়োজন সেই শক্তি তো আর প্রচলিত ব্যবস্থার ভিতরে সংগঠিত এবং তার সুবিধা ভোগী কোনও গোষ্ঠী বা শ্রেণী থেকে আসতে পারে না।

যাইহোক, সব দিক বিবেচনা করলে এইটিই অনিবার্য মনে হয় যে, একটি নূতন ও বিপ্লবী সামাজিক শক্তির দ্রুত উদ্ভব ও বিকাশ না ঘটলে এ দেশের উন্নয়ন দূরে থাক এই দেশের ঐক্য বা স্বাধীনতাই আর বেশী দিন টিকবে না।

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : মার্কসীয় বিচার পদ্ধতির প্রশ্ন

আমরা যেভাবে এ দেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশে প্রকৃতি ও তার দ্বারা প্রভাবিত লোকচরিত্রের বিষয়টি বুঝতে চাচ্ছি মার্কসীয় বিচার পদ্ধতি সেটিকে অনুমোদন করে না। মার্কসীয় বিচার পদ্ধতি শুরু করে অর্থনীতি বা উৎপাদন ব্যবস্থা দিয়ে। এ সম্পর্কে এঙ্গেলস বলছেন, “. . . . কোনো নির্দিষ্ট জাতির বা নির্দিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হল সেই ভিত্তি যার ওপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতিটির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যান-ধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাদের ধর্মীয় ভাবধারা পর্যন্ত এবং সেই দিক থেকেই এগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে, এতদিন যা করা হয়েছে সেভাবে উল্টো দিক থেকে নয়।” (কার্ল মার্কসের সমাধি পার্শ্বে বক্তৃতা : ফ্রেডারিক এঙ্গেলস)। কিন্তু সমাজ ও ইতিহাস বিচারের এই পদ্ধতি একপেশে এবং সেহেতু ভুল।

আমাদের দেশে মার্কসবাদীরা যে ব্যর্থ হয়েছে সেটি এই কারণে নয় যে তারা মার্কসবাদ বোঝেন নি, কিংবা তা বোঝায় ও প্রয়োগে আন্তরিক ছিলেন না, কিংবা তাঁরা ছিলেন সুবিধাবাদী ও নীতিভ্রষ্ট, বরং তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন এই কারণে যে, তাঁরা শুধু মার্কসবাদ বোঝার ও চর্চা করার কারণেই এ দেশ ও সমাজটাকে বোঝেন নি। এটা ঠিক যে, অর্থনীতির দিকটা বুঝতে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে অর্থনীতি ও তার বিকাশের মাত্রা প্রধান ও নির্ধারক উপাদান হয়ে ওঠে। এবং এটাও ঠিক যে, অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা বাদ দিলে কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটাই যেমন একমাত্র নির্ণায়ক নয় তেমন অনেক ক্ষেত্রে এটা গৌণ ভূমিকায়ও থাকতে পারে। আমরা দেখি যে, একই অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রা নিয়েই, উৎপাদনের একই উপকরণ ও মালিকানা রূপ নিয়েই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী কিংবা জাতি বিভিন্ন রকম বা ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, আদর্শ, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, ধর্মীয় ভাবধারা ইত্যাদি সংগঠিত করে। আবার প্রায় একই ধরনের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, আদর্শ, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং ধর্মীয় ভাবধারা নিয়েও বিভিন্ন সমাজ বা জাতি অর্থনৈতিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান করতে পারে এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় পৃথক হতে পারে।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ধর্মীয় ভাবধারা এবং এমনকি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা উৎপাদন সম্পর্ক প্রায় এক রকম হলেও দু’দেশের উৎপাদন কিংবা অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রা এক রকম নয়। আবার শিল্পকলা কিংবা সংস্কৃতির মাত্রা কিংবা স্তরেও নেই অভিন্নতা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় অনেক পিছনে পড়ে আছে আবার শিল্পকলা ও সংস্কৃতির মাত্রা বাংলাদেশে পাকিস্তানের তুলনায় অনেক উন্নত। কিংবা ভারত রাষ্ট্রের ভিতরই রয়েছে অঞ্চল ভেদে বহু রকম পার্থক্য। অথচ উৎপাদন সম্পর্ক সর্বত্রই মূলত এক। কোথায়ও অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রা অনেক উন্নত, কিন্তু শিল্পকলা ও সংস্কৃতির বিকাশের মাত্রা তা নয়। যেমন পাঞ্জাব অর্থনৈতিক বিচারে পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় অনেক বেশী উন্নত। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে শিল্পকলা, সাহিত্যে। আবার একই পাঞ্জাবে মূলত সম অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রার অধিকারী হয়েও পাঞ্জাবী জনগোষ্ঠী বিভক্ত শিখ ও হিন্দু ধর্ম সম্প্রদায়ে। এখানে ধর্মীয় ভাবধারা এসে সমাজ বা জাতিকে বিভক্ত করেছে। আবার এই ধর্মীয় কারণে বৃহত্তর পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিম পাঞ্জাব অন্তর্ভুক্ত হয় পাকিস্তানের আর শিখ ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাঞ্জাব অন্তর্ভুক্ত হয় ভারতের। আবার দুই বিপরীতমুখী উৎপাদন মালিকানা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রা প্রায় কাছাকাছি । বরং মার্কসীয় সূত্র অনুযায়ী যেখানে সোভিয়েত অর্থনীতির থাকা উচিত ছিল অগ্রগামী বাস্তবে সেটি না হয়ে তার বিপরীতটিই ঘটছে।

সুতরাং একটি দেশ বা সমাজকে বুঝতে হয় অনেকগুলি দিক থেকে। বিভিন্ন দিকের বিভিন্ন উপাদান নিয়ে এবং বিভিন্ন উপাদানের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটা সমাজ বা জাতি গড়ে ওঠে। তবে সব কিছুর মধ্যেই একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে একটা উপাদান বা দিকই সাধারণত প্রধান নির্ধারক হয়ে থাকে।

আমাদের সমাজ গঠন ও বিকাশেরও অনেকগুলি দিক আছে। আমাদের সমাজের সমস্যা ও তার সমাধান বুঝতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে এই সমাজের বিভিন্ন উপাদান বা বৈশিষ্ট্যকে এবং অভিজ্ঞতা থেকে টেনে আনতে হবে বিভিন্ন ধারণা বা মূল্যায়ন যেগুলো সমাধান দিতে সাহায্য করবে। তবে আমরা এই আলোচনায় প্রধান গুরুত্ব দিয়েছি সেই মানবিক দিকটা বোঝার উপর যার গভীর ও প্রবল প্রভাব রয়েছে মানুষের এই সমাজ গড়ে উঠবার ক্ষেত্রে। সেখানে আমরা পেয়েছি এই জনগোষ্ঠীর বিশেষ মানসিক ও ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্য বা প্রবণতা সমূহ যেগুলো না বুঝলে তার কোনই সমস্যাকে যেমন সঠিকভাবে বোঝা যায় না তেমন খুঁজে পাওয়া যায় না এইসব সমস্যা সমাধানের পথও।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ : হিন্দু বাঙ্গালীর কথা

আমরা মুসলমান বাঙ্গালীর যে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলি যে, এ দেশের হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে অতীতে কম বা বেশী ছিল না তা যেমন নয় তেমন এখনও যে এগুলি হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে নেই তা নয়। তবে এটা ঠিক যে, হিন্দুরা দীর্ঘকাল ধরেই মানসিক ও চারিত্রিক দিক থেকে মুসলমান বাঙ্গালীর চেয়ে অনেকটা ভিন্ন এবং উন্নতও। তবে সেই ভিন্নতা ও উন্নতি এতটা ছিল না যাতে বাঙ্গালী হিসাবে তাদের খুব বেশী পৃথক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা দিত। যদি তেমন কিছু হত তবে দেশটার ইতিহাস ভিন্ন রূপ হতে পারত। আমরা জানি মুসলমান শাসনামলে বঙ্গ হিন্দু সংখ্যাগুরু ছিল। এমন কি ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম পর্যায়েও হিন্দুর সংখ্যাই ছিল বেশী। ব্রিটিশ শাসকদের ১৮৭২-এর লোকগণনায় আমরা বঙ্গে হিন্দু বাঙ্গালীর সংখ্যা বেশী দেখতে পাই। কেবলমাত্র পরবর্তী লোকগণনায় বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার এই ভারসাম্য বদলে যায় এবং মুসলমান বাঙ্গালী সামান্য কিছু পরিমাণে সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠে। নীচের লোকগণনার বিবরণ থেকে আমরা এই পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাব।

লোকগণনা

বাংলা ভাষাভাষী বাংলায় মোট জনসংখ্যা

বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা

বাংলায় হিন্দু জনসংখ্যা

 

১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দ

 

 

৩,৬৭,৬৯,৭৩৫

 

 

১,৬৩,৭০,৯৬৬

 

 

১,৮১,০২,৩৪৮ 

সঠিক সংখ্যা হবে ১ কোটি ৬৮ লক্ষ। কারণ এই সংখ্যার মধ্যে সর্বপ্রাণবাদীদেরকেও ধরা হয়েছে।

১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ       

 

   

 

৩,৫৬,০৭,৬২৮

 

 

 

১,৭৮,৬৩,৪১১

 

 

 

১,৭২,৫৪,১২০

(সিলেটকে পৃথক করে আসামের সঙ্গে সংযুক্তির ফলে বাংলার মোট জনসংখ্যা হ্রাস পায়। ১৮৮১ সালে সিলেটের জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ।)

১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দ

৩,৮২,৭৭,৩৩৮

১,৯৫,৮২,৪৮১,

১,৮০,৬৮,৬৫৫

উপরোক্ত হিসাবে আমরা দেখছি যে, ১৮৭২ সালে বঙ্গে মুসলিম বাঙ্গালী জনসংখ্যা হিন্দুদের থেকে ৫ লক্ষাধিক কম ছিল। ১৮৯১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যাকে ১৫ লক্ষ দ্বারা অতিক্রম করে যায়। পূর্ব বঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ।

এটা স্পষ্ট যে বহিরাগত মুসলিম শাসন পতন এবং অমুসলিম ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ধর্মান্তরকরণ মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণ ছিল না। কারণ তখন আর এটা রাজধর্ম বা শক্তিমানের ধর্ম নয়। ফলে শক্তিমানের পূজারীদের নিকট এর আর নূতন করে আকর্ষণ সৃষ্টি হবার কারণ ছিল না। বরং এটাই যুক্তিসঙ্গত যে শক্তিমান বিজয়ী ও রাজধর্মে যাদের ধর্মান্তরিত হওয়া সম্ভব বা স্বাভাবিক ছিল তারা ইতিপূর্বেই তা হয়েছিল। উপরন্তু ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিতর ধর্মসংস্কার আন্দোলন যে নবতর গতি ও শক্তি লাভ করে তার ফলে হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে লোক সংগ্রহ সুকঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং ভিন্ন কারণে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় বৃদ্ধি পায় যা বঙ্গে তাদেরকে সংখ্যাগুরুতে পরিণত করে। বিভিন্ন কারণে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে জন্মহার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এমনিতেই অনেক বেশী। কারণগুলির মধ্যে তৎকালে হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত বিধবা বিবাহে নিষেধাজ্ঞা, সন্ন্যাস ও ব্রহ্মচর্যের প্রভাব এবং মুসলমানদের মধ্যে তৎকালে বহুবিবাহের প্রাবল্য, অধিক সন্তানের জন্মদান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।*

------------------------------------------------

* বঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা ভারসাম্য পরিবর্তনের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে আমি পরবর্তী কালে ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’ এবং ‘বাংলাদেশের সঙ্কট ও উত্তরণের পথ’ এই প্রবন্ধ দুইটিতে কিছু বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করেছি। - ­ লেখক ২৫ অক্টোবর, ২০০৮

-----------------------------------------------

তবে যে সকল কারণেই মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটুক না কেন এই সিদ্ধান্ত টানাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয় যে, এ দেশের সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালীর খুব বড় অংশ দীর্ঘকাল ছিল অনেকাংশে সভ্য সমাজ বহির্ভূত এবং নদীর ভাঙ্গনপ্রবণ তীরভূমি ও চরাঞ্চলের অধিবাসী।

এই ধারণার পক্ষে একটা বড় যুক্তি হল যে, ব্রিটিশ আমলে এ দেশের শহরগুলিতে মুসলমান ছিল খুবই কম। আর গ্রামগুলিতেও যেসব মুসলমান বাস করত তাদের মধ্যে কৃষক এবং তাঁতীর (জোলা) বাইরের পেশার মানুষ ছিল খুব কম। এমন কি পাকিস্তান হবার পরও মুসলমানের মধ্যে ধোপা, নাপিত, কামার, মুচি বা চর্মকার, কুমার বা কুম্ভকার, কাঠমিস্ত্রী বা ছুতার, কাঁসারী, স্বর্ণকার, ময়রা (মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারী), দোকানদার, ঝাড়ুদার, ইত্যাদি পেশা বা বৃত্তির মানুষ খুব কমই দেখা যেত। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হিন্দুদের দেশত্যাগের প্রক্রিয়ায় শূন্যতা পূরণ করতে মুসলমানদের মধ্য থেকে এইসব পেশায় ব্যাপক অংশ গ্রহণ শুরু হয়। নিশ্চয় এখনও অনেকে পাকিস্তান আমলের প্রথম দিককার এবং ব্রিটিশ আমলের শেষ দিককার এই বৈশিষ্ট্য স্মরণ করতে পারেন। তখন এমন অনেক এলাকা ছিল যেখানে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে কৃষক এবং সাধারণ মজুর ছাড়া কামার-কুমার জাতীয় একজন বৃত্তিজীবী মুসলমানকেও দেখতে পাওয়া যেত না। এ ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে ছিল কিছু সংখ্যক ভূস্বামী বা জমিদার, জোতদার ও সম্পন্ন জমির মালিক এবং মোল্লামৌলবী। অবশ্য ঢাকা, কলকাতার মত শহরে উল্লেখ্য পরিমাণ মুসলমান জনসংখ্যা ছিল, যাদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন বৃত্তির মানুষ। তাছাড়া দর্জী, কাগজী* (হাতে কাগজ প্রস্তুতকারী) ইত্যাদি পেশায় মুসলমান সম্প্রদায়ই অগ্রণী ছিল। কিন্তু তবু সাধারণভাবে বিভিন্ন বৃত্তিতে মুসলমান জনগোষ্ঠীর অবস্থান ছিল হিন্দুদের তুলনায় খুব পিছিয়ে। এবং অনেকগুলি পেশা বা বৃত্তিতে বহু অঞ্চলেই মুসলমান জনগোষ্ঠীর কোনও অস্তিত্ব ছিল না বলাই সঠিক। ব্রিটিশ শাসনকালে বঙ্গে মুসলমান বললে পেশাগতভাবে যে চেহারা মনশ্চক্ষে ভেসে উঠত যৎ সামান্য ব্যতিক্রম বাদে সেটা ছিল কৃষক, জোলা, মুটে-মজুর আর গাড়োয়ান-কোচোয়ানের চেহারা। এর সঙ্গে যোগ করা যাক শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমানদের দৈন্যদশা।

------------------------------------------------

­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­* অতীতে কাগজ হাতে প্রস্তুত করা হত। এটা ছিল কুটীর শিল্প। এই শিল্পে নিয়োজিতদের বলা হত কাগজী। কাগজ থেকে কাগজী।

----------------------------------------------- 

এই অবস্থার সহজ ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, সাধারণভাবে মুসলমানরা সভ্য এবং বঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল কৃষি সমাজে প্রবেশ করেছে অনেক পরে। বরং তারা দীর্ঘকাল কৃষি এবং বস্ত্রবয়ন এই দুই আদি উপকরণ নিয়ে কোনও রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার পর্যায়েই ছিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কিছুটা হলেও স্থিতিশীল অঞ্চল বা গ্রাম থেকে দূরে নদীর ভাঙ্গাগড়ার আওতার ভিতর অবস্থিত খুব বেশী অস্থিতিশীল গ্রাম বা চরাঞ্চলের মানুষদেরই খুব বড় অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এই সিদ্ধান্তই যুক্তিসঙ্গত যে, সভ্যতা বহির্ভূত ভাসমান ও অস্থিতিশীল কৃষি জীবনে ছিল বলেই ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকটাতেও সভ্যতা সংশ্লিষ্ট আর কোন বৃত্তিতে মুসলমানদের এই অনুপস্থিতি বা ন্যূনতা। অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষায় “চইরা” বা কোথায়ও “চরুয়া” মানুষ যাদেরকে বলা হয় তারাই ছিল ইসলামে ধর্মান্তরিত এ দেশের মানুষদের প্রধান এবং এমনকি খুব বড় অংশ। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কালে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের চাপে এবং উন্নততর ও তুলনায় স্থিতিশীল জীবনের আকর্ষণে তারা ক্রমে স্থিতিশীল গ্রাম ও শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তবে লক্ষণীয়ভাবে শহরবাসী হতে বাঙ্গালী মুসলমানের আরও অনেক সময় লেগেছিল। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত।

আমরা দেখছি যে, এক সময় হিন্দু সংখ্যাগুরু ছিল। কিন্তু তখনও তারা ভিন্ন কিছু করতে পারে নি। অতীতের মুসলমান যুগের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দিই তবে দেখব বিপুল সংখ্যাগুরু হয়েও হিন্দু বাঙ্গালী নিজেদের খণ্ড-বিখণ্ডতা, বিশৃঙ্খলা, কাপুরুষতা, অসচেতনতা ও পশ্চাৎপদতার বেড়ীতে আবদ্ধ ছিল বলেই অতি সংখ্যালঘু বহিরাগত মুসলান শাসকদেরকে পরাজিত করতে পারে নি।

তবে এটা ঠিক যে, দীর্ঘদিন ধরেই বাঙ্গালী সমাজে চলছিল উজ্জীবনের একটা প্রয়াস। এই প্রয়াস উল্লেখযোগ্য আয়তন নিয়ে শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্যের বর্ণজাতিভেদ বিরোধী বৈষ্ণব আন্দোলন দ্বারা। পরবর্তী কালে আউল-বাউলদের বিভিন্ন ধারা এসে যুক্ত হয়ে নূতন সমাজ চিন্তাকে অধিকতর জোরদার করছিল। শুধু যে হিন্দু সমাজে নূতন চিন্তার স্ফুরণ ঘটছিল তা-ই নয়, নীচ তলার বা সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী সমাজেও পড়ছিল তার প্রভাব। বাউল আন্দোলনে তুলনায় আধুনিক কালেও আমরা এটা লক্ষ্য করি। বস্তুত তখন সমাজের নীচ তলায় হিন্দু-মুসলমানে বিশেষ একটা ভেদ ছিল না। কারণ বহিরাগত শাসক মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে ছিল সবারই দুস্তর ব্যবধান যার কথা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি। এই অবস্থায় সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় দ্বারা সাধারণ মুসলমানও যে প্রভাবিত হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তাছাড়া হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা দেশজ বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের অধিকারী জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে ধর্মান্তরিত হবার কারণে এ দেশের মুসলমানদের ব্যাপক অংশই তাদের মধ্যে বহন করেছিল হিন্দু অথবা দেশী সমাজের বহু প্রবণতা, রীতিনীতি ও বিশ্বাস।

হিন্দুরা মুসলমান শাসন কালেও ছিল শিক্ষা, বাণিজ্য ও বিভিন্ন কারিগরী বৃত্তিতে সাধারণভাবে মুসলমান বহিরাগত ও অভিজাত শাসকদের চেয়েও অনেক অগ্রসর। এই সহজ বিষয়টা আমাদের বুঝতে হবে যারা এ দেশে মধ্য-এশিয়া বা পশ্চিম থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসত তারা সাধারণত হত তাদের নিজ সমাজেরও তুলনায় নিকৃষ্টতর ও হীনতর মানুষ। শিক্ষা-দীক্ষায় সাধারণভাবেই তাদের উন্নত অবস্থান থাকার কারণ ছিল না। সেটা যাদের থাকত তারা ছিল অত্যল্প সংখ্যক মানুষ। বহিরাগত মুসলমানরা ছিল সাধারণত যোদ্ধা বা সমরবাদী এবং অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্রের অধিপতি। তাদের প্রধান যোগ্যতা ছিল বাহুবল বা সামরিক শক্তি। সুতরাং তারা সামরিক শক্তির উপর সবচেয়ে বেশী জোর দিত। সেনাবাহিনী ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে এবং প্রধানত তাদের অংশগ্রহণে গঠিত। প্রশাসনের উপর তলাও ছিল তাদের দখলে। কিন্তু লেখাপড়ার কাজ, কেরানী, হিসাব রক্ষকের কাজ মুসলমান শাসন কালেও করত প্রধানত হিন্দুরা। শিক্ষার কারণে রাজস্ব আদায়ের মত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলিতে হিন্দুদের ভূমিকা ছিল খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত রাষ্ট্র পরিচালনায় যেখানে শিক্ষা এবং বিদ্যার প্রয়োজন হত সেখানে সাধারণত হিন্দুদেরই প্রাধান্য কিংবা সংখ্যাধিক্য ছিল। হিন্দুরা ফার্সী ভাষা শিখে নিয়েছিল যা ছিল তখনকার রাষ্ট্রভাষা। সুতরাং শিক্ষায় হিন্দুরা সেকালে এমনকি বহিরাগত মুসলমানদের তুলনায়ও অগ্রগামী ছিল পরবর্তী কালের মতই। এ ছাড়া যে কথা একটু আগেই বলেছি বাণিজ্য এবং কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন কারিগরী বৃত্তিতে তাদের অগ্রগণ্য ভূমিকা ছিল বঙ্গে।

এইভাবে হিন্দুরা নিজেদের তৈরী করছিল উন্নততর রূপে। বিশেষত তাদের উচ্চতর বর্ণ বা শ্রেণীর কথ্য ভাষায় বহু কথিত ‘জাত’ হিসাবে পরিচিত উপবর্ণ বা গোত্র-গোষ্ঠীগুলি শিক্ষায় ও চিন্তায় এ দেশের ভূ-প্রকৃতির ও সমাজের নিকৃষ্ট প্রভাব ও সীমাবদ্ধতাগুলি ক্রমশ কাটিয়ে উঠছিল যার এক ধরণের আকস্মিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসন কালে এসে। দীর্ঘ পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধশতাব্দী কালের ভিতর নবজাগরণ হিসাবে পরিচিত যে উত্থান সূচিত হয় সেটা কীভাবে সম্ভব ছিল?* সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আধুনিক জাতি গঠনের পথে এটি ছিল বাঙ্গালীর প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ।

------------------------------------------------

* এটা লক্ষণীয় যে, বঙ্গের নবজাগরণ যেটাকে বলা হয় তার প্রধান পুরোহিত হিসাবে পরিচিত রামমোহন রায় পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ বিজয়ের অল্প দিন পর জন্ম গ্রহণ করেন। তার জন্ম ১৭৭২-এ এবং মৃত্যু ১৮৩২-এ।

----------------------------------------------- 

কিন্তু যদিও এটা ঠিক যে, বর্ণজাতিভেদ প্রথার সামাজিক প্রাচীরের আড়াল নিয়ে উচ্চতর বর্ণ বা শ্রেণীগুলি নিম্নস্তরের সাধারণ মানুষের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে এবং একটা দৃঢ়বদ্ধ শৃঙ্খলার মধ্যে নিজেদেরকে রেখে উন্নততর রূপে সংগঠিত করছিল এবং অন্তত এ ক্ষেত্রে বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থা তাদেরকে একভাবে সাহায্য করেছিল তবু বর্ণজাতিভেদ প্রথার বিষময় ফলও আবার এর ফলে ফলেছিল। কারণ উচ্চতর বর্ণজাতির মানুষরা উন্নত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিম্নতর বর্ণজাতির জনগণ সেই উন্নতির স্পর্শ পায় নি উচ্চতর বর্ণজাতির সঙ্গে অনতিক্রম্য ব্যবধান এবং উচ্চতর বর্ণজাতির চিরস্থায়ী প্রাচীর ঘেরা অবস্থানের দরুণ। এর ফলে শেষ পর্যন্ত চারপাশের নিকৃষ্টতার আবেষ্টন উচ্চতর জনগোষ্ঠীর বিকাশকে শুধু যে রুদ্ধ করেছে তা-ই নয়, উপরন্তু নিম্নতর জনগোষ্ঠী নিজের নিকৃষ্ট অবস্থার প্রভাবে ফেলে তাদেরকেও করেছে পঙ্গু ও অধঃপতিত।

তবে উচ্চতর ও নিম্নতর সহ সকল হিন্দুর জন্য বর্ণজাতিভেদ প্রথার সবচেয়ে বড় অভিশাপ যেটা হয়েছে সেটা হল এর ভিতরের অনিবার্য কাপুরুষতা ও অসামরিকতা। এই কাপুরুষতা ও অসামরিকতা আসে অসংখ্য স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন উপবর্ণে বা গোত্র-গোষ্ঠীতে সমাজের বিভক্তি থেকে। আসলে বর্ণজাতি প্রথা কোনও না কোনও রূপে রক্ষা করে আদিম গোত্রবদ্ধতা এবং উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য চেতনাকে। ব্যবস্থাটা দাঁড়িয়ে থাকে ধর্মীয় শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণ বর্ণজাতির শ্রেষ্ঠত্বের উপর এবং এই ব্যবস্থায় থাকে বিভিন্ন “জাত” বা উপবর্ণের কিংবা গোত্র-গোষ্ঠীর পেশা বা কর্তব্যের নির্দিষ্টতা এবং মর্যাদার স্তরভেদ। বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ ব্যবস্থার প্রতি উপবর্ণ বা গোত্র-গোষ্ঠীগুলির আকর্ষণের একটি খুবই বড় কারণ তাদের স্বাতন্ত্র্য বা স্বতন্ত্র সত্তার প্রতি স্বীকৃতি দান। নিম্নতর caste বা উপবর্ণগুলি কিংবা ‘জাতগুলি’ তাদের ঘৃণিত অবস্থানের জন্য দুঃখ পেলেও সেটা মেনে নেয় শুধু পূর্বজন্ম দ্বারা নির্ধারিত বিধান বা কর্মফলবাদের প্রতি তাদের বিশ্বাসের কারণে নয়, বরং সেই সঙ্গে সমাজে তাদের স্বতন্ত্র সত্তাকে রক্ষা করা হয় বলেও।*

------------------------------------------------

* এই বিষয়টি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্ণজাতিমূলক সমাজ ব্যবস্থা উপর থেকে জোর করে চাপানো বা বলপ্রয়োগ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা নয়। বরং এটা সমাজের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর সেই কারণেই সাধারণভাবে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ছাড়াই এই ধরনের একটি ব্যবস্থা হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে টিকে থেকেছে। এই কথা আমরা যেন মুহূর্তের জন্যও ভুলে না যাই যে হিন্দু ধর্ম ইসলামের মত অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় যে ধর্ম ত্যাগ করলেই তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া আছে। বরং হিন্দু ধর্মে ব্যক্তিগতভাবে ধর্মগ্রহণের কোন প্রথাগত বিধান নেই, অথচ যে কেউ ইচ্ছা করলে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এখানে আছে ব্যক্তি, পরিবার এমনকি গোষ্ঠীকেও জাতিচ্যুত তথা বর্ণজাতিচ্যুত কিংবা সমাজচ্যুত করার বিধান। এক সময় হিন্দু সমাজে সে কাজ কথায় কথায় করা হত। তাই এখানে এক অর্থে প্রবেশের জন্য একটা দরজাও খোলা নেই, কিন্তু বেরিয়ে যাবার জন্য রয়েছে প্রায় সব দরজা খোলা। অথচ এই ধর্ম বা ব্যবস্থা এত দীর্ঘকাল প্রবল প্রতাপে টিকে আছে। হাজার হাজার বছর ধরে এই ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার জন্য সমাজের ভিতর থেকে কম আন্দোলন, কম চেষ্টা হয় নি। বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব থেকে শুরু করে অসংখ্য বৈরী আন্দোলনের ঝড় যুগে যুগে বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। তাতে মাঝে মাঝে বর্ণজাতি রূপ মহীরূহের দুই-চারটা ডাল-পালা কখনও ভাঙ্গলেও তার শিকড়কে কেউই কখনই সমাজ-জমি থেকে উপড়াতে পারে নি। বরং প্রবল ঝড় স্তিমিত হলে সমাজের আরও গভীরে তা শিকড় ছড়িয়েছে এবং ঊর্ধ্বে আবারও নূতন ও প্রবল ভাবে ডালপালা বিস্তার করেছে। 

বস্তুত ভারতবর্ষের আদিম উপজাতি ও গোত্র সমাজগুলি মূলত স্বেচ্ছামূলক ও শান্তিপূর্ণ ভাবেই কৃষি নির্ভর সভ্য সমাজে স্ব স্ব আদিম সমাজের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যসহ প্রবেশ করে ধীর গতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এভাবে ব্যাখ্যা করলে হিন্দু সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ বা বিবর্তন রহস্য বোঝা যায়। তখন বোঝা যাবে কেন এবং কীভাবে বর্ণজাতি কাঠামো আদিম গোত্র ও উপজাতি কাঠামোর অনুরূপ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে আদিম সমাজে ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক বর্ণজাতি ব্যবস্থা ছিল না; কারণ সেখানে একটি বৃহত্তর সমাজে বিভিন্ন উপজাতির ঐক্যবদ্ধ এবং পরস্পর সংলগ্ন ভাবে অবস্থানের প্রয়োজন যেমন ছিল না তেমন সভ্যতার প্রয়োজনে বিভিন্ন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণেরও প্রয়োজন ছিল না। আদিম উপজাতিগুলি সভ্য সমাজে প্রবেশ ক’রে নিজেদের আদিম উপজাতীয় অনেক বিশ্বাস, প্রথা বা আচার-অনুষ্ঠান রক্ষার পাশাপাশি বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনে বেদ ও ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয় এবং সমষ্টিগতভাবে বংশপরম্পরায় পেশা বা বৃত্তিগত স্বাতন্ত্র্য গ্রহণ করে নিয়ে আদিম সমাজ-জীবনের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যকে রক্ষার পথ খুঁজে নেয়। সভ্য সমাজে আদিম সমাজের অনেক বৈশিষ্ট্যকেই রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তবু আদিম সমাজের ঐতিহ্যের অনেক কিছুই এতে রক্ষা পায়। সবচেয়ে বড় কথা আদিম সমাজ চেতনায় যে গোত্রবদ্ধতা বা গোষ্ঠীবদ্ধতা ছিল নিয়ামক শক্তি হয়ে এবং সেই সঙ্গে ছিল বিশেষত এক উপজাতির সঙ্গে আর এক উপজাতির প্রায় সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব এই ব্যবস্থায় সেগুলি রক্ষা পায়। এভাবে বর্ণজাতি কাঠামোতে সংরক্ষিত হয় গোষ্ঠীগুলির স্ব স্ব ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, পরস্পর বিচ্ছিন্নতা এবং আদিম সমাজের এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য গোষ্ঠীর ভিতর ব্যক্তিসত্তার বিলীনতা। হিন্দু সমাজের বিশ্বাস, প্রথা বা আচার-অনুষ্ঠানে আজ অবধি তাই এত আদিমতার প্রভাব, স্ববিরোধ এবং অসম মর্যাদাভিত্তিক বর্ণজাতি বা গোষ্ঠীগুলির পরস্পর বিচ্ছিন্নতা এবং আধুনিক যুগের এতসব পরিবর্তনের পরও কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক পরিচয় বা ঠিকানার চেয়েও বর্ণজাতিগত পরিচয় বা ঠিকানার অনেক বেশী গুরুত্ব । — ­ লেখক ২৩ অক্টোবর, ২০০৮

-----------------------------------------------

এখন যে সমাজ এই রকম অজস্র স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন সত্তা নিয়ে গঠিত হয় সেখানে সাহস ও সামরিক প্রবণতা রক্ষা করা মানে পারস্পরিক সশস্ত্র দ্বন্দ্বে সকল স্বতন্ত্র সত্তা বিশিষ্ট গোত্র-গোষ্ঠী বা উপবর্ণগুলির ধ্বংস দ্বারা গোটা সমাজের ধ্বংসপ্রাপ্তি। সুতরাং এই রকম সমাজ যুদ্ধ বা সামরিক কাজের জন্য ক্ষত্রিয়ের মত একটা নির্দিষ্ট বর্ণের বা শ্রেণীর বিভিন্ন উপবর্ণ রক্ষা করতে বাধ্য হয়। ফলে সমগ্র সমাজ পড়ে থাকে নির্বীর্যতায় ও কাপুরুষতায়। সমাজে অহিংস বা অসামরিক চেতনাকে আদর্শায়িত করতে গিয়ে সমাজ নেতা ব্রাহ্মণ হয়েছে অহিংস ও নিরস্ত্র বা অসামরিক। এমন অবস্থায় ক্ষত্রিয়ের “তেজও” বেশী দিন থাকতে পারে না। চারপাশের আদর্শায়িত সামাজিক নির্বীর্যতা ও অহিংসা দ্বারা তা অবিরাম অধিকৃত হয়। এই অবস্থায় মনস্তাত্ত্বিক ও বাস্তব ক্ষেত্রে শূন্যতা পূরণ করতে প্রয়োজন হয় অবিরাম ধারায় বাইরের সমাজ থেকে নূতন নূতন সামরিক বা সশস্ত্র শক্তির আগমন । এইসব বহিরাগত সামরিক শক্তি সমাজের প্রতিষ্ঠিত ক্ষত্রিয় শাসক শ্রেণীর অধীনস্থ বা অঙ্গীভূত হতে পারে।

অর্থাৎ বর্ণপ্রথা বা জাতিভেদের ব্যবস্থায় সমাজের উপর বৈদেশিক আধিপত্য রোধের সর্বশ্রেষ্ঠ পথই হল আবার বৈদেশিক যোদ্ধা শক্তির আগমন যা সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যাবে। কিন্তু এই আগমন এবং অঙ্গীভবন সর্বদা সমাজ কর্তৃত্ব কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে হয় না। তখন এই আগমন পরিণত হয় বৈদেশিক বৃহৎ যোদ্ধা শক্তির সশস্ত্র আক্রমণ ও আগ্রাসনে। সমাজ তার সীমিত সামরিক শক্তি নিয়ে (কারণ বৃহত্তর জনগণ অসামরিক) সর্বদা এই ধরণের বৈদেশিক আক্রমণ রোধ করতে পারে না। তখন তার পরিণতি হয় নূতন বৈদেশিক শক্তির অধীনতা। নূতন শাসকরাও আবার সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে এক সময় একই পরিণতি বরণ করে। সুতরাং বর্ণপ্রথা ভিত্তিক হিন্দু সমাজ হয়ে দাঁড়ায় বৈদেশিক আধিপত্যাধীন দেশীয় সমাজ।

কাজেই আমরা মুসলমান অভিযানের পূর্বে যে ছক বা প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি তাতে সাধারণত বাইরের আক্রমণকারী এবং শাসকরা এসে ক্ষত্রিয় শাসক হিসাবে দেশ শাসন করত এবং দেশের সমাজের অঙ্গীভূত হয়ে যেত । যখন তার শক্তি হ্রাস পেত তখন পুনরায় নূতন শক্তি বাহির থেকে এসে তার স্থান দখল করত।

বস্তুত মুসলমান যুগের মুসলমান হানাদার ও শাসকরা এই ধরনের ক্ষত্রিয়দের উত্তরসূরি। বলা যায় অনেক ক্ষেত্রেই বংশধর। মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান থেকে অতীতে যারা আসত ইতিপূর্বে তারা হিন্দু সমাজের মধ্যে হারিয়ে যেত। কিন্তু সেইসব অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের প্রসারের পর এখন আর নূতন হানাদার-শাসকরা ক্ষত্রিয় হিসাবে হিন্দু সমাজের মধ্যে হারিয়ে যায় নি, বরং ইসলাম ধর্ম দ্বারা তারা এ দেশে থেকেও বৈদেশিক শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা রক্ষা করতে পেরেছিল।

বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম এই দেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের সুদীর্ঘ কালের বৈদেশিক অধীনতার প্রধান উৎস হয়ে ছিল। হিন্দু ধর্ম যেমন বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য গড়তে দেয় না তেমন দেয় না সংহত জাতি গঠন করতেও। প্রকৃত অর্থে এই ধর্ম দ্বারা দেশ চেতনাই গড়ে উঠতে পারে না। এটা দেয় না বর্ণজাতি বা “জাতের” বাইরে জাতিচেতনা। এই ধর্মে শাসক যে কোনও দেশের বা ভাষার হতে পারে। সে ক্ষত্রিয় হলেই হল। অথবা যে শাসন করবে সেই ক্ষত্রিয়। ব্রাহ্মণ তার শাসনকে সামজের পক্ষ থেকে বরণ করে নিয়ে নিজের প্রাধান্য ও শোষণের ব্যবস্থা বজায় রাখবে। আর সাধারণ জনগণ শাসকের শাসন, শোষণ ও দলন সহনীয় মাত্রায় থাকলেই নিজেদের মহা ভাগ্যবান মনে করবে। হয়ত এ দেশে বহিরাগত মুসলমান শাসকেরাও হিন্দুদের দৃষ্টিতে ছিল ক্ষত্রিয়ই। তবে এই ক্ষত্রিয়রা ছিল “দুরাচারী”। কারণ তারা বেদ, ব্রাহ্মণ ও গরুকে মানত না। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারে নি দীর্ঘকাল। পারে নি নিজেদের মধ্যে উন্নততর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ চেতনা গড়তে পারে নি এবং দেশাত্মবোধ জাগাতে পারে নি বলে।

বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম হিন্দুকে প্রতিরোধ শক্তিহীন ও সাহসহীন যেমন করেছে তেমন এর পরিণতিতে করেছে ষড়যন্ত্রপ্রিয় ও কূট এবং খুব বেশী চাপা বা গোপন স্বভাবের। সে সরল, স্পষ্ট ও খোলামেলা হয় নি। শক্তি ও সাহস পায় নি বলে শুধু বুদ্ধির প্যাঁচ কষেছে, বিশেষত তার নেতৃত্ব হিসাবে ব্রাহ্মণ কিংবা উচ্চবর্ণের হিন্দু। বর্ণজাতিভেদ তার গতি কেড়ে নেওয়ায় সে হয়েছে অতিরিক্ত রক্ষণশীল ও অনড়। এই দুর্বলতা নিয়ে সে যখন তার প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে তখন সহজ পথ হিসাবে প্রতিবেশীকে দমন করতে চেয়ে অনেক সময় ডেকে এনেছে বাইরের জবরদস্তির শক্তিকে বা সহযোগী হয়েছে তার। এইভাবে তার কপালে লেখা হয়েছে চিরন্তন দাসত্বের নিয়তি।

বর্ণপ্রথা বা বর্ণজাতিভেদ হিন্দুর সমাজ জীবনকে যেমন তেমন তার মননকেও ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে দেওয়ায় সে হয়েছে অতীব রক্ষণশীল। সুতরাং হিন্দুর চিন্তা থাকে ক্ষুদ্র গণ্ডীতে সীমিত হয়ে এবং তা যতই উন্নত হোক সামাজিক গতিশীলতা এবং সমর্থনের অভাবে তা বেশী দূর এগোয় না। এই খানটাতে মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুর তফাৎ হল মুসলমান নূতন ও ভিন্নধর্মী চিন্তার প্রতি আক্রমণাত্মক, সে যে শুধু নূতন বা ভিন্ন ভাবে চিন্তা করতে অক্ষম তা-ই নয়, উপরন্তু তেমন কোনও চিন্তাকে সমাজের ভিতর থেকে উঠতেই দেয় না, তাকে গোড়াতেই আক্রমণ করে ধ্বংস করে, কিন্তু হিন্দু নূতন ও ভিন্নধর্মী চিন্তাকে সহ্য করে, তবে সেই সাথে তার রক্ষণশীলতার প্রাচীর দ্বারা তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখে, একটা ক্ষুদ্র ও নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা গণ্ডীর ভিতর আবদ্ধ করে রাখে। ফলে বৃহত্তর সমাজ থেকে সমর্থন ও সহযোগিতা পায় না বলে এই নূতন ও ভিন্নধর্মী চিন্তা শুকিয়ে মরে কিংবা হারিয়ে যায় অথবা পঙ্গু ও দুর্বল হয়ে থাকে ।

হিন্দু ধর্মের প্রভাবে হিন্দুর চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি হয় ধীর এবং নিষ্ক্রিয় ধরনের। সর্বত্র সক্রিয় পদ্ধতির বদলে নিষ্ক্রিয় পদ্ধতি নিতে গিয়ে হিন্দু দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলাতে পারে নি। এবং ধীর ও স্থবিরপ্রায় গতির কারণে সহজেই পরাজিত ও অধিকৃত হয়েছে।

বর্ণজাতি ব্যবস্থা হিন্দুকে আত্মরক্ষার একটা শক্তি দিয়েছে, কিন্তু সঠিক বা ইতিবাচক অর্থে প্রতিরক্ষার শক্তি দেয় নি, ফলে পাল্টা আঘাত করার শক্তি দেয় নি। এর ফলে এ দেশে অতীতে যেভাবেই হোক হিন্দুর সকল বুদ্ধি ও উন্নত চিন্তা যদি কখনও সৃষ্টি হয়েছে তবে সে সব হিন্দুর তেমন একটা কাজে লাগে নি। বরং বাহুবল দ্বারা হিন্দুর কীর্তি আত্মস্থ করে প্রায় সর্বদা বাহিরের শক্তিই সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে।

হিন্দু শুধু বর্ণজাতিভেদের দ্বারা অশক্ত হয়েই মুসলমানের হাতে মার খায় নি, অধিকন্তু জাতীয়তাবাদকে ধরতে পারে নি, ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে ভাষাভিত্তিক কিংবা বৃহত্তর জাতি চেতনাকে অস্ত্র করতে পারে নি বলেও মুসলমানের উগ্র বিদেশ নির্ভর তত্ত্ব বা মতবাদ এবং বিদেশ নির্ভরতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মত কোনও মনস্তাত্ত্বিক শক্তি খুঁজে পায় নি। তেমন কোনও দেশ প্রেমিক বা স্বজাতি প্রেমিক আদর্শ সে দাঁড় করাত পারে নি বলে দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানের আক্রমণাত্মক বৈদেশিক চেতনার হাতে মার খাওয়া ছাড়া তার গতি থাকে নি।

অবশ্য প্রকৃতপক্ষে হিন্দু চেতনার মধ্যে কখনই রাজনৈতিক অর্থে দেশপ্রেম বা জাতিচেতনা দাঁড়াতে পারে না। হিন্দু চেতনার মূল উৎস হল বর্ণজাতিমূলক চেতনা যার শীর্ষে থাকে ব্রাহ্মণ সত্তা। হিন্দু সমাজের কেন্দ্রীয় শক্তি হচ্ছে ব্রাহ্মণ বর্ণ বা বর্ণজাতি। ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের মধ্যে এবং ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক ধর্মবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের ঐক্যের মূল সূত্র। ব্রাহ্মণ হিন্দু সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণজাতি। সমাজ থেকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে ব্রাহ্মণ যেমন নিজের বর্ণজাতিগত স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্বের উপর জোর দেয় তেমন সমগ্র সমাজকে বর্ণজাতিতে বিভক্ত করে রাখার উপরও জোর দেয়। বস্তুত ব্রাহ্মণকে কেন্দ্রে রেখে অজস্র উঁচু ও নীচু বর্ণজাতি বা জাতে বিভক্তিই ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য।

ফলে হিন্দুর “জাতের” বাইরে, প্রকৃত অর্থে, জাতি নেই। তার দেশ বা জন্মভূমি হল, প্রকৃত অর্থে, তার জাতের বাসভূমি। এমন অবস্থায় বৃহত্তর জাতি কিংবা দেশ বলতে হিন্দু সাধারণত যেটি বুঝেছে সেটি হল ব্রাহ্মণ পরিচালিত সমস্ত জাতের সম্মিলিত সমাজ এবং এই সমাজের বাসভূমি। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত ইংরাজী ভাষায় “নেশন” বলতে যেটা বোঝানো হয় হিন্দুর কাছে তেমন কিছু নেই। হিন্দু সমাজই হল হিন্দুর কাছে নেশন বা জাতি। ভাষাগত প্রশ্ন বা জাতীয় ভিন্নতা তাই তার কাছে বিবেচ্য নয়। এতে যে এক ভাষার জনগোষ্ঠীর বা মানুষের সঙ্গে আরেক ভাষার জনগোষ্ঠীর বা মানুষের সংযোগ, ভাব বিনিময় ও সম্মিলন কম হয় বা হয় না এবং দূরত্ব থেকে যায় সেটা হিন্দুর চেতনায় সমস্যা সৃষ্টি করে না। কারণ তার ধর্ম দিয়েছে শুধু একটা বৃহৎ সমাজে নয়, এমন কি ক্ষুদ্র সমাজ হিসাবে একই গ্রামে পারস্পরিক সংযোগহীন এবং বৈষম্যের সম্পর্কভিত্তিক বহুসংখ্যক জাত বা গোষ্ঠীর সহাবস্থান। যদি সবাই যার যার গোষ্ঠীগত অপরিবর্তনীয় নির্দিষ্ট দায়িত্ব নিয়ে, যার যার গোষ্ঠীগত অনতিক্রম্য স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতা রক্ষা করেই একত্র বসবাস করতে পারে তবে ভাষাভিত্তিক জাতি চেতনা বা ধারণার প্রয়োজনটা তার কোথায়? এমন অবস্থায় বহু জাতির সমাজ হয়েও অনেক বর্ণ, উপবর্ণ বা জাতের সমন্বয়ে বৃহত্তর বর্ণ বা জাত হিসাবে হিন্দু সমাজ দেখা দিয়েছে হিন্দুর কাছে জাতি হিসাবে আর অসংখ্য ভাষাভিত্তিক জাতির বাসভূমি হওয়া সত্ত্বেও ভারত দেখা দিয়েছে হিন্দুর কাছে এক দেশ হিসাবে।

বিষয়টাকে আরও সহজবোধ্য করার জন্য সাধারণ হিন্দু যেভাবে বর্ণজাতিকে বা “জাতিকে” দেখেছে সেটা উল্লেখ করা যায়। আপনি যদি একজন আগন্তুক বা নূতন ব্যক্তি হন তখন একজন সাধারণ হিন্দু আপনার পরিচয় জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করতে পরে “আপনার জাতি কি?” কিংবা “আপনার জাত কি?” আপনাকে বুঝতে হবে যে সে শুধু আপনার ধর্মীয় নয়, উপরন্তু আপনার বর্ণজাতিগত পরিচয়ও জানতে চেয়েছে। যদি আপনি হিন্দু না হয়ে মুসলমান কিংবা খ্রীষ্টান বা আর কোনও ধর্মাবলম্বী হন এবং সেই অনুযায়ী উত্তর দেন তাহলে হয়ত আর কোন প্রশ্ন আসবে না। কিন্তু যদি আপনার উত্তর হয় যে, আপনি হিন্দু, তখন আপনার কাছে পুনরায় প্রশ্ন আসতে পারে যে, “আপনার জাতি কোনটা?” অর্থাৎ আপনি কোন জাতি বা জাতের হিন্দু। এবার বুঝতে হবে যে, সে আপনার জাত কিংবা বর্ণ-উপবর্ণ বা caste জানতে চেয়েছে। অর্থাৎ আপনি ব্রাহ্মণ, নাকি বৈদ্য, অথবা কায়স্থ, নাকি আর কিছু।*

------------------------------------------------

* আমার এ ধরনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হতে এ কথা বলছি। হিন্দুদের সঙ্গে মিলামিশা করতে গিয়ে দেখেছি শুধু বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নয়, উপরন্তু সমাজ জীবনের আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দুদের কাছে সাধারণভাবে বর্ণজাতিগত পরিচয়ের গুরুত্ব কতখানি। - ­ লেখক

------------------------------------------------

ভাষা ভিত্তিক কিংবা অঞ্চলগত জাতি চেতনা হিন্দু সমাজে অতীতে কোনও কালে সেভাবে ছিল না। সুতরাং আমরা দেখছি যে, ভারত চেতনা আর বর্ণজাতিবাদী হিন্দু চেতনা সমার্থক। আমরা দেখেছি যে, এই ভারত চেতনার দ্বারা লালিত হয় হিন্দু চেতনা, যা পরিণতিতে রক্ষা করে ব্রাহ্মণ এবং বর্ণজাতি চেতনাকে। ফলে গড়ে উঠতে পারে না প্রকৃত জাতি চেতনা, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মশক্তি। এই অবস্থায় হিন্দুর নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় পরনির্ভরতা অথবা পরপ্রভুত্ব।

আজও হিন্দুর অবস্থাটা মূলত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। যদিও আজ ভারত রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন এবং শক্তিশালী তবু সেখানে বৈদেশিক নির্ভরতা ও নিয়ন্ত্রণ সুগভীর। বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির উপর নির্ভর করে ভারত-রাষ্ট্র যে উন্নয়ন অর্জন করেছে তার ভিত্তিতে আছে প্রচণ্ড বৈষম্য, সংখ্যাগুরু জনগণের সীমাহীন পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য এবং সেই সঙ্গে আছে বিভিন্ন বহিঃশক্তির গভীর নিয়ন্ত্রণ এবং অনুপ্রবেশ।

বস্তুত ভারতের উন্নয়ন হিন্দু ধর্মের কারণে বা ভারতের অখণ্ডতার কারণে হয় নি, বরং সেখানে জনগণের মধ্যে বর্ণজাতিভেদমূলক হিন্দু ধর্মের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ পূর্বের তুলনায় হ্রাস পাবার কারণেই হয়েছে। সেখানে জনগণের যে উত্থান হয়েছে সেটাও বাধাপ্রাপ্ত এবং সীমিত হয়ে আছে হিন্দু ধর্মের প্রভাবের কারণে। ধর্মের এই প্রভাবের একটি প্রধান উৎস হয়ে আছে ভারত রাষ্ট্র ও ভারত চেতনা। অর্থাৎ ভারতীয় জনগণের চেতনায় প্রকৃত বিপ্লব আনতে হলে, ভারতীয় জনগণের অফুরন্তু ও বিপুল শক্তিকে মুক্ত করতে হলে বর্ণজাতিবাদী হিন্দু ধর্মচেতনার নিগড় ভেঙ্গে ফেলতে হবে। আর এ কাজ করার অর্থ হয়ে দাঁড়ায় ভারত রাষ্ট্রের নিগড়ে আবদ্ধ সকল জাতিসত্তার স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ ।

ভারত রাষ্ট্রের আপাত স্বাধীনতা দেখে আমাদের প্রভাবিত হওয়া উচিত হবে না। ভারতবর্ষে বৈদেশিক আক্রমণ, আগ্রাসন ও শোষণের যন্ত্র হিসাবে ভারতে রাষ্ট্র বহুকাল ধরে যে ভূমিকা পালন করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা সংগঠিত ও অর্পিত আজকের ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকা মূলত সেই ঐতিহ্যকেই ভিন্ন রূপে রক্ষা করছে এবং তার গর্ভে ধারণ করছে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও আগ্রাসনের বীজ। বর্তমান ভারত-রাষ্ট্র বৈদেশিক শোষণ ও আধিপত্যের এক বিশাল ও অতিকায় অভ্যন্তরীণ যন্ত্র হিসাবে ভূমিকা পালন করছে যেখানে ভারত রাষ্ট্রের আমলা, রাজনীতিক এবং ধনিকরা বিদেশীদের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে নিজ দেশের কোটি কোটি জনগণকে নির্দয়ভাবে দলন, দমন ও শোষণ করছে। ভারত রাষ্ট্র তার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতির কোটি কোটি শ্রমজীবী, গরীব ও পিছিয়ে থাকা মানুষকে দমন করে রেখে অল্প সংখ্যক বিত্তবান ও ক্ষমতাবানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম ও প্রাচুর্যের ব্যবস্থা করছে। ফলে একদিকে রয়েছে সুবিপুল উন্নতি ও সুপার টেকনোলজি, আর একদিকে রয়েছে অসহনীয় দারিদ্র্য, অস্পৃশ্যতা, নারী নিগ্রহ, অশিক্ষা এবং অবিশ্বাস্য পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যে দুষ্টচক্রে আজ আবদ্ধ হয়ে আছে অন্তর্বস্তুতে প্রায় সেই একই ধরনের আর এক দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে আছে বিশাল ভারত রাষ্ট্রের সুবিপুল জনগণ। বাংলাদেশের মত ভারতের জনগণেরও এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসবার প্রধান পথ হল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : হিন্দু বাঙ্গালীর ভ্রান্তি                            

হিন্দু বাঙ্গালীর অগ্রগতিকে শুধু হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্যগুলিই শ্লথ করে নি, উপরন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙ্গালী চরিত্রের সহজিয়াবাদ। তবে এটা ঠিক যে, ব্রিটিশ যুগে আমরা হিন্দু বাঙ্গালীর জাগরণ দেখতে পাই। হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতিভেদ ও অন্যান্য কুসংস্কার ও কুপ্রথা ভারতের অন্যান্য দেশের চেয়ে বঙ্গে আগে কমতে আরম্ভ করেছিল। বিশেষত বঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু বাঙ্গালীর অগ্রগামী ভূমিকা হিন্দু বাঙ্গলীর চরিত্রে ও মানসিকতায় উন্নয়নের সুস্পষ্ট চিহ্নবাহী ছিল। হিন্দু যখন অনেক এগিয়ে গিয়েছিল তখন ইংরেজ শাসক হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমান বাঙ্গালীকে দাঁড় করালো।

হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্বও মারাত্মক ভুল করেছিল। সে স্বপ্ন দেখেছিল সারা ভারত ব্যাপী অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্রের। এর পিছনে ছিল তার হিন্দু চেতনা।

উপমহাদেশে সুদীর্ঘ পরাধীনতা থেকেও এই চেতনা আসা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত সুদীর্ঘ মুসলমান আধিপত্যে ধর্মসম্প্রদায়গতভাবে হিন্দুর যে নিগ্রহ ও অবমাননা হয়েছে তা পরবর্তীকালে বাঙ্গালী হিন্দুর মধ্যে ধর্মসম্প্রদায়গত অনুভূতি ও অভিমানকে শক্তি যুগিয়েছে নিশ্চয়। কিন্তু মুসলিম শাসনামলে বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণীর শাসনকেন্দ্র ছিল ভারতেরই ভিতর। বহিরাগত মুসলমানদের ভারতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল দিল্লী। সঙ্গতভাবেই ভারতে যখন হিন্দু জাগরণ শুরু হচ্ছিল তখন মুসলমান আধিপত্য থেকে মুক্তির প্রেরণা বিভিন্ন ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটাচ্ছিল এবং সেটা আঘাত করছিল ভারতব্যাপী রাষ্ট্র চিন্তাকে। অর্থাৎ ভারতব্যাপী মুসলমান আধিপত্য দান করছিল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে। এরই প্রকাশ দেখতে পাই মারাঠা উত্থানে এবং নূতন ধর্মের আড়ালে শিখ উত্থানে।

কিন্তু ভারতের জাতিসত্তাগুলির স্বতন্ত্র বিকাশের মাঝপথে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারত জয় করল তখন এই বিকাশমান জাতীয়তাবাদও মাঝপথে থেমে গেল। বাংলায় এটা জন্মই নিতে পারল না। তার উপর ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্র বা রাজধানী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত কলকাতায় থাকায় হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্ব ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের যে সুফল পেল তা তাকে করল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ভারতীয় রাজনীতি, চাকুরী, আইন ব্যবসা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সে যে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হল তাতে সে নিজেকে বাঙ্গালী যতটা ভাবল তার চেয়ে বেশী ভাবল ভারতীয় রূপে। সে হল আগে ভারতীয় তারপর বাঙ্গালী। তার স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করা। সে ধরেই নিল যে তা থাকবে তার নেতৃত্বে।

হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্ব ভারতীয় হতে গিয়ে হল হিন্দু। কারণ বহু জাতিসত্তার ভারতে সকল জাতিসত্তার মধ্যে ধর্ম ছাড়া আর তেমন কোনও বন্ধন নেই যা তাদেরকে এক রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ করতে বা রাখতে পারে। সুতরাং ব্রিটিশের অস্ত্রশক্তি বিদায় নিলে তার স্থান নিবার জন্য থাকে মূলত ধর্মের মাধ্যমে প্রাপ্ত ঐক্যের অনুভূতি ও প্রেরণা।

ভারত চেতনার প্রভাব পড়ল হিন্দু বাঙ্গালীর ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলিতে। ফলে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করল পুনর্জাগরণবাদী হিন্দু চেতনা। শেষ পর্যন্ত সংস্কার আন্দোলন ব্যর্থ হল বর্ণজাতিভেদ এবং হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিগুলিকে সম্পূর্ণ দূর করতে। হিন্দু জনগণকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করতে এবং সেকিউলার বা ইহলৌকিক চেতনায় দীক্ষিত করতে বিশেষভাবে তার বর্ণজাতি প্রথাকে আঘাত করতে হত। কিন্তু সেটা করলে সমগ্র প্রচলিত হিন্দু ধর্মই ভেঙ্গে পড়ে এবং সে ক্ষেত্রে হিন্দু বাঙ্গালী হারায় ভারতীয় জাতিগুলির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা।

এইভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হিন্দু বাঙ্গালীর সামাজিক আন্দোলনগুলিকে বিপ্লবী আন্দোলন হতে না দিয়ে পরিণত করল দুর্বল সংস্কার আন্দোলনে। ব্রাহ্ম সমাজের মতো নূতন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসমূহ ব্যর্থ হল। হিন্দু বাঙ্গালী হল স্ববিরোধের শিকার। একদিকে তার চেতনায় দোলা দেয় বিজ্ঞান, আধুনিকতা, গণতান্ত্রিক ও লোকবাদী মূল্যবোধ, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, আর এক দিকে সে সজোরে আঁকড়ে ধরে ভারত চিন্তা ও ব্রাহ্মণ্যবাদী-বর্ণজাতিবাদী হিন্দু ধর্মকে।

ব্রিটিশ শাসক যখন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে নিল ভারতীয় সাম্রাজ্যরাষ্ট্রের ঐতিহ্যিক সদর দফতর দিল্লীতে তখন হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্ব ভারতীয় রাজনীতির উপর তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে আরম্ভ করল। এবার নেতৃত্ব চলে গেল উত্তর ভারতের হিন্দী-উর্দূ ভাষীদের প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হিন্দী-উর্দূ কেন্দ্রিক নেতৃত্বের হাতে। এই নেতৃত্বের সবাই হিন্দী-উর্দূ ভাষী না হলেও তারা প্রধানত এই দুই ভাষা দ্বারা প্রভাবিত এবং এদের খুব কাছাকাছি। যেমন মারাঠী, পাঞ্জাবী, রাজপুত ইত্যাদি। হিন্দী-উর্দূ ভাষা ও তার প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত নেতৃত্বকে আমরা হিন্দী-উর্দূ কেন্দ্রিক নেতৃত্ব বলতে পারি। হিন্দী-উর্দূ ভাষার মধ্যে তফাৎটা মূলত অক্ষরের। দুই ভাষার ব্যাকরণ বা নিয়মগুলি প্রায় একই রকম। তবে হিন্দী ভাষা যেখানে সংস্কৃত প্রভাবিত উর্দূ সেখানে ফার্সী, আরবী প্রভাবিত। আর এই ভাষার পার্থক্যেও আছে ধর্মসম্প্রদায়গত ব্যাপার। হিন্দু সম্প্রদায় যেখানে হিন্দী ভাষা ব্যবহার করে মুসলমানরা সেখানে ব্যবহার করে সাধারণত উর্দূ।

হিন্দু বাঙ্গালী নেতৃত্ব হিন্দী-উর্দূ কেন্দ্রিক নেতৃত্ব বিশেষত হিন্দী কেন্দ্রিক নেতৃত্বের কাছে হেরে গেল। কংগ্রেস পরিণত হল হিন্দী কেন্দ্রিক নেতৃত্বের সংগঠনে। কিন্তু তবু হিন্দু বাঙ্গালীর মোহ ভাঙ্গল না। সে আঁকড়ে ধরে থাকল ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্রবাদকে। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান বাঙ্গালীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ল ক্রমে। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় হিন্দু বাঙ্গালী মুসলমান বাঙ্গালীর যে সমর্থন পেয়েছিল তা ক্রমেই হারাল। হিন্দু নেতৃত্বের ভারতীয় (অর্থাৎ হিন্দু) জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসাবে মুসলামানদের স্বতন্ত্র (অর্থাৎ মুসলিম) ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে থাকল। ১৯৪০-এ এসে মুসলিম ভারতীয় জাতীয়তাবাদই মুসলিম লীগের পাকিস্তান প্রস্তাবে রূপ নিল।

ইসলাম ও হিন্দু এই দুইটি তো শুধু দুইটি ধর্ম নয়, দুই স্বতন্ত্র সংস্কৃতিও বটে। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের আবরণে এসেছে আরব-ইরানের সংস্কৃতি ও তার আধিপত্য। ইসলামের মাধ্যমে আরব-ইরান কেন্দ্রিক সংস্কৃতি ভারতের প্রেক্ষিতে রূপ নিয়েছে উত্তর ভরতীয় উর্দূ সংস্কৃতিতে। এটাই ক্রমে রূপ নিয়েছে উত্তর ভারত কেন্দ্রিক উর্দূভাষী শাসকদের আধিপত্যের বাস্তবতায়। এরই বিপরীতে হিন্দুধর্ম যে ভারতীয় সংস্কৃতির চেতনা হাজির করেছে তা বাস্তবে দেখা দিয়েছে উত্তর ভারতের হিন্দী ভাষীদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের বাস্তবতায়। সর্বভাতীয় চিন্তার ফলে বাঙ্গালী হিন্দু নেতৃত্ব গুরুত্ব দিল এই উত্তর ভারতীয় হিন্দু কর্তৃত্বের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কাঠামো গড়ে তোলা বা রক্ষার উপর। এটাই পরবর্তী কালে হিন্দী ভাষীদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের রূপ লাভ করে। বাঙ্গালীর জাতি রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা মাথায় থাকলে ধর্মমুক্ত ও লোকবাদী এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী যে সংস্কৃতি কাঠামো গড়ে তোলার চিন্তা ও প্রয়াস দেখা দিতে পারত সেটি আর হয় নি।

বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে হিন্দু বাঙ্গালী অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিল। এর জন্য হিন্দু বাঙ্গালী বিপুল শ্রম ও আত্মত্যাগ করে। কিন্তু ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন দেখে শেষ পর্যন্ত তাকে দিতে হল আরও বিপুলতর মূল্য। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বিপুল কষ্ট ও ত্যাগের কোনও প্রতিদান সে পেল না। ১৯৪৭-এ বঙ্গ বিভক্ত হল। হিন্দু সংখ্যাগুরু পশ্চিম বঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হল ভারত-রাষ্ট্রের। কিন্তু পূর্ব বঙ্গের সোয়া চার কোটি বাঙ্গালী জনগণের এক বিপুল অংশ ছিল হিন্দু। দেড় কিংবা পৌনে দুই কোটি জনসংখ্যার বিরাট অংশ হল দাঙ্গা ও নির্মমতার শিকার। বিভিন্ন দাঙ্গায় ও ক্রমিক নির্যাতনে হিন্দুর ব্যাপক অংশই তাদের জন্ম-জন্মান্তরের ভিটা ও জমি-জমা ত্যাগ করে ক্রমাগতভাবে ভারত রাষ্ট্রে চলে যেতে বাধ্য হল। এই দেশ ত্যাগ ১৯৭১-এ চূড়ান্ত রূপ নেয়। ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ’৭১-এ দেশত্যাগী হিন্দুরা ফিরে এলেও তাদের উপর মুসলমানদের নির্যাতন ও উৎপীড়ন আজও বিভিন্নভাবে অব্যাহত আছে। ফলে আজও চলছে তাদের দেশ ত্যাগ।*

------------------------------------------------

* ১৯৯৪ সালের স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইয়ারবুক অনুযায়ী ১৯৪১ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। ১৯৫১ সালে তা দাঁড়ায় ২২ শতাংশে, এবং ১৯৬৪ সালে (পাকিস্তান আমলে প্রাপ্ত সর্বশেষ হিসাব) ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে। ১৯৭৪ সালে, অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ৩ বছর পর এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ১৯৯১ সালে হিন্দুরা ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ আর মুসলমানরা ৮০ দশমিক ৩ শতাংশ। -­ লেখক, ৮ নভেম্বর, ২০০৮

----------------------------------------------- 

 ­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর অবস্থা

পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী বলতে প্রধানত হিন্দু বাঙ্গালীকেই বুঝতে হবে। সেখানে স্থানীয় অনেক মুসলমানও অবশ্য আছে যাদের খুব কম সংখ্যাই পূর্ব বঙ্গে এসেছে। এখানকার মুসলমানের অনেক ক্ষেত্রে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানের সঙ্গে মিলের তুলনায় পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুর সঙ্গেই বরং মিল বেশী। পশ্চিম বঙ্গের মানুষ পূর্ব বঙ্গ থেকে অনেক বিষয়ে ভিন্ন। তাদের স্থিতিশীল ভূ-প্রকৃতির গুণে তারা পূর্ব বঙ্গের মানুষের মত এত বেশী হুজুগে, আবেগ প্রবণ এবং অস্থির বা অস্থিতিশীল নয়। সেই সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের মানুষের মধ্যে পূর্ব বঙ্গের মানুষের চেয়ে উদ্যম, উৎসাহ ও প্রাণশক্তি বা তেজও কম। অবশ্য পশ্চিম বঙ্গের স্থানীয় বাঙ্গালীর তুলনায় পূর্ব বঙ্গ হতে আগত হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে এগুলি অনেক বেশী আছে। পশ্চিম বঙ্গে সাহসী ও জঙ্গী চরিত্র বস্তুত পূর্ব বঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী নিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে অধিকতর গতিশীল চিন্তা ও মনন। এর পিছনে অবশ্য পূর্ব বঙ্গের ভূ-প্রকৃতির ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম বঙ্গের বৃহত্তর অঞ্চলের ভূমির তুলনায় প্রায় সমগ্র পূর্ব বঙ্গের ভূমির অনেক বেশী উর্বরতা যেমন ফসলের প্রাচুর্য ও তজ্জনিত সম্পদ দিয়েছে তেমন এখানকার অস্থিতিশীল ও ভাঙ্গনপ্রবণ ভূ-প্রকৃতি মানুষকে গতিশীল, সংগ্রামী ও সাহসী করেছে। প্রধানত পূর্ব বঙ্গত্যাগী শরণার্থী বা বসতিস্থাপনকারী হিন্দু বাঙ্গালীই কলকাতা ও পশ্চিম বঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড স্বরূপ। এমনকি ব্রিটিশ শাসন কালেও অবিভক্ত বঙ্গে প্রধানত এই পূর্ব বঙ্গ থেকে আগত হিন্দু বাঙ্গালীরাই কলকাতাকে কেন্দ্র করে সমগ্র সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মে নেতৃত্ব দিয়েছে। অর্থাৎ এই বিচারে পূর্ব বঙ্গের মানুষের সম্ভাবনা ও শক্তি অনেক বেশী। তবে এটা প্রধানত সত্য হিন্দুদের জন্য যারা আজ পশ্চিম বঙ্গের সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এদের গতিশীল ও উদ্যমী চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মননশীলতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য ও আদর্শপ্রিয়তা। এদের চারিত্রিক উন্নয়ন ও শক্তির একটি উল্লেখ্য উৎস হল তুলনামূলকভাবে নারীর স্বাধীনতা।

কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালীর অবস্থা ভারতেও শোচনীয়। পশ্চিম বঙ্গ আজ ভারতে সবদিক থেকেই কোণঠাসা। বিশাল ভারত রাষ্ট্রের চাপে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর শক্তি আজ নিষ্পিষ্ট ও অবদমিত। বাঙ্গালী আজ পশ্চিম বঙ্গে করার কিছু পাচ্ছে না। পশ্চিম বঙ্গে শিল্প বিকাশ রুদ্ধ, বেকার সমস্যা ভয়াবহ, উন্নয়ন সীমিত। পশ্চিম বঙ্গের কমিউনিস্ট ও বামফ্রণ্ট সরকার পশ্চিম বঙ্গের জীবনী শক্তিকে কোনও রকমে বাঁচিয়ে রাখার পথ দিতে পারছে; কিন্তু তার বেশী নয়। ফলে সেখানে সমাজ জীবনে চলছে অবক্ষয়। একদিকে ক্ষুদ্র এলাকায় জনসংখ্যার চাপ এবং ক্রমাগতভাবে পূর্ব বঙ্গ থেকে প্রায় সবকিছু হারানো হিন্দু জনসংখ্যার কম-বেশী আগমন, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক শ্রেণীর বঞ্চনা ও শোষণ পশ্চিম বঙ্গকে এক নিরুপায় অবস্থায় নিয়ে গেছে। হিন্দু বাঙ্গালীর ভারতীয় হতে চাওয়ার এই হল পরিণতি! ভারতের স্বাধীনতার জন্য তার অবদান ও ত্যাগের এই হল মর্মান্তিক প্রতিদান! সত্যি হিন্দু বাঙ্গালী দুর্ভাগা। তার দুঃখ সর্বত্র। উভয় বঙ্গেই।

কিন্তু তবু হিন্দু বাঙ্গালী এখনও তার ভারতীয়ত্বের মোহ ছাড়তে পারছে না। এইখানে বোঝা যায় যে, হিন্দু বেশী রক্ষণশীল। মুসলমান বাঙ্গালী যেমন ১৯৪৭-এ পাকিস্তান এনে ১৯৪৮ সালেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য দাঁড়াতে শুরু করেছিল হিন্দু বাঙ্গালী পশ্চিম বঙ্গে তা পারে নি। অবশ্য ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু বাঙ্গালীর ছিল দীর্ঘ ত্যাগ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমান বাঙ্গালী যেটা করে নি। পাকিস্তান তার মাগনায় পাওয়া। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রয়োজনে পাওয়া। এর জন্য তাকে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয় নি। বরং রাজশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে প্রতিবেশী হিন্দুর বিরুদ্ধে দাঙ্গা করতে হয়েছে। হিন্দুর জন্য ভারতের স্বাধীনতা তেমন মুফতে পাওয়া নয়। সুতরাং হিন্দু বাঙ্গালী যতই বঞ্চিত হোক এই ত্যাগ ও সাধনার রাষ্ট্রসত্তা ও তার অন্তর্গত হিন্দু মর্মবস্তুর প্রতি তার গভীর আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। এটা না থাকাই বরং অস্বাভাবিক হত।

অবশ্য হিন্দু বাঙ্গালীর এই ভারত চেতনার জন্য মার্কসবাদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ হিন্দু বাঙ্গালীর উপর মার্কসবাদের প্রভাব খুব বেশী। হিন্দু বাঙ্গালীর অগ্রণী ও প্রগতিশীল অংশ এবং একটা বড় অংশ দীর্ঘকাল ধরে মার্কসবাদ চর্চা করছে। কিন্তু মার্কসবাদ জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য বোঝে না। বস্তুত মার্কসবাদের কাছে জাতীয়তাবাদ কিংবা জাতীয় সংগ্রাম হল একটা কৌশলগত হাতিয়ার মাত্র যেটা তারা তৈরী করে না কিন্তু থাকলে সেটাকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। সুতরাং যেসব দেশে সংহত জাতি গঠন হয়েছে কিংবা জাতিসত্তার চেতনা দৃঢ়বদ্ধ ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত সেইসব দেশে মার্কসবাদ ক্ষতিকর নাও হতে পারে। যেমন চীন, ভিয়েৎনাম ইত্যাদি। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের মত উপমহাদেশে যেখানে সংহত জাতি গঠনের প্রাথমিক কাজই সম্পূর্ণ হয় নি এবং বিভিন্ন জাতিগুলি বিভিন্ন ধর্মের চেতনা এবং অসংখ্য বর্ণজাতি দ্বারা বিভক্ত, অসংগঠিত বা বিশৃঙ্খল হয়ে আছে সেখানে মূলত ভাষাভিত্তিক সুসংহত জাতি গঠনের কর্তব্য বাদ দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও প্রকৃত সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিপ্লব সম্ভব নয়। এখানে সাধারণভাবে ভাষাভিত্তিক দৃঢ়বদ্ধ জাতি গঠন ও জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তথা জাতীয়তাবাদের প্রক্রিয়াকে অবলম্বন করে সমাজ পরিবর্তন ও মানবিক উজ্জীবনের বিশাল কর্মকাণ্ড সংগঠিত করা সম্ভব। কিন্তু আন্তর্জাতিকতাবাদ সর্বস্বতার কারণে মার্কসবাদ জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য বুঝতে অক্ষম। মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে বলছেন, “মেহনতীদের দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা কেড়ে নিতে পারি না।” মার্কসবাদের “জাতীয়” ব্যাপারটা প্রকৃতপক্ষে এইটুকু যে, শাসকশ্র্রেণী তাকে যে ভূ-রাজনৈতিক সীমারেখা দিয়ে দেয় তা তার মধ্যে কাজ করবে সেখানকার রাষ্ট্র্র ক্ষমতা দখলের জন্য। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে মার্কস-এঙ্গেলস বলছেন, “প্রলেতারিয়েতকে যেহেতু সর্বাগ্রে রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করতে হবে, দেশের পরিচালক শ্রেণীর পদে উঠতে হবে, নিজেকেই জাতি হয়ে উঠতে হবে, তাই সেদিক থেকে প্রলেতারিয়েত নিজেই জাতি, যদিও কথাটার বুর্জোয়া অর্থে নয়।”

অর্থাৎ কমিউনিস্ট বিপ্লব যখন দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে তখন সেই বিপ্লব রূপ বা form-এই শুধুমাত্র জাতীয় হয়, মর্মবস্তুতে বা content-এ নয়। কারণ এর পরই এই “জাতীয়” বিপ্লবের কমিউনিস্ট ইশতেহারের ভাষায়, “জয় করবার জন্য আছে সমগ্র পৃথিবী।”

লেনিন অবশ্য জাতিসত্তার একটা স্বীকৃতি এবং অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু সেটা প্রকৃতপক্ষে কমিউনিজমের অধীন বিভিন্ন ইউনিট হিসাবে। এগুলো আগে থেকেই আছে বলে এগুলোকে মেনে নেওয়া হয় এবং মেনে নিয়ে এগুলোকে নেওয়া হয় কমিউনিজমের কাঠামাতে যার অভিমুখ হল একটি বৃহত্তর জাতীয় সত্তার মধ্যে সকলের বিলুপ্তি বা বিলীনতা। যেটা বাস্তবে সোভিয়েত ইউনিয়নে হয়ে দাঁড়িয়েছে সকল জাতিসত্তার রুশীকরণ। সুতরাং মার্কসবাদের তত্ত্বে যা-ই লেখা থাক সোভিয়েত বিপ্লব বাস্তবে হয়েছে রুশ জাতীয়তাবাদী বিপ্লব এবং সেখানে মার্কসবাদ দেখা দিয়েছে অনেকাংশে রুশ জাতীয়তাবাদের বাহক ও আবরণ হিসাবেও।*

------------------------------------------------

* এই গ্রন্থ লেখার অল্প কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তিপূর্ণভাবে ভেঙ্গে যায় এবং সেটা ভাঙ্গে মূলত রাশিয়ার উদ্যোগে। - লেখক

------------------------------------------------­­­­­­­­­­­­­­­­­­

যাইহোক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবং এটা একটা তত্ত্বের বাস্তবে ভিন্ন রূপ গ্রহণের ব্যাপার। কিন্তু আমাদের এখানে সংহত জাতি এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারটা খুবই সচেতন এবং সুসংগঠিত প্রয়াস দাবী করে। যেহেতু জাতি ও জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন মার্কসবাদে নেই সেহেতু মার্কসবাদ উপমহাদেশের জনগণকে তেমন কোনও সাহায্য করে নি, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মূল করণীয় সম্পাদনের পথে বাধা হয়ে ক্ষতির কারণও হয়েছে। এটা ঠিক যে ধর্মাচ্ছন্ন উপমহাদেশে ধর্মবিরুদ্ধ মার্কসবাদ ধর্মমুক্ত কিংবা সেকিউলার চেতনার বিকাশ ও বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু ধর্মবিরোধী হলেও ভারতীয় ঐক্য সাধনার সহায়ক হয়ে মার্কসবাদ শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ধর্মেরও সহায়ক হতে বাধ্য হয়েছে। ভারতীয় ধর্মকে তা আঘাত করতে পারে নি। ধর্মই ভারতের ঐক্য রক্ষার প্রধান আদর্শিক শক্তি। সুতরাং মার্কসবাদের প্রয়োজনটা কোথায়? এমন অবস্থায় মার্কসবাদকে গৌণ অবস্থানে থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। অবশ্য এই কারণেই আবার পশ্চিম বঙ্গে প্রাধান্য অর্জনকারী মার্কসবাদী রাজনীতি একটা পর্যায়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে জাতীয়তাবাদী হয়ে যেতে পারে।

যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু বাঙ্গালী এত দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরেও যে জাতীয়তাবাদী হতে পারছে না সেটা তার উপর ধর্মীয় ও মার্কসীয় রাজনৈতিক প্রভাবের ফলও বটে। মুসলমান বাঙ্গালীর সঙ্গে তার এই জায়গায় বড় তফাৎ। মুসলমান বাঙ্গালী আদর্শকে জীবনের চেয়ে বড় বলে আঁকড়ে থাকে না। কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালী যেটাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে সেটাকে মরণপণ করে আঁকড়ে ধরে। এর একটা বিরাট মূল্য আছে বৈকি। কারণ বাঁচাটাই বড় কথা নয়, বরং কীভাবে বাঁচা হয় সেটাই বড় কথা। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, যে আদর্শ জীবনের কোনও কাজে লাগে না, উন্নতভাবে বাঁচার সহায়ক হয় না সে আদর্শের কোনই মূল্য নেই বা থাকা উচিত নয়। কারণ জীবন আদর্শের জন্য নয়। বরং আদর্শই জীবনের জন্য। কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালী প্রধানত তার ধর্মীয় কিংবা আদর্শিক রক্ষণশীলতার কারণে ভারতের দিক থেকে এত দীর্ঘ কালব্যাপী এত বৈষম্য ও অবিচারের পরেও তার স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়াবার চিন্তা করতে পারছে না। যে কোনও কিছু সম্পর্কে ধৈর্য বা অপেক্ষা করে দেখার একটা প্রয়োজন থাকে। ভারত রাষ্ট্র সম্পর্কেও ধৈর্য ও অপেক্ষা করে দেখার যে প্রয়োজন থাকে সম্ভবত সেই প্রয়োজন আজ নয়, বরং আরও পূর্বে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর জন্য শেষ হয়েছে। এটা প্রমাণিত যে, ভারত রাষ্ট্র পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীকে বিকাশের সুযোগ দিবার ক্ষমতা রাখে না।

অবশ্য পূর্ব বঙ্গের মুসলমান বাঙ্গালীর মুসলমানীও পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনার বিকাশে প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করছে। কারণ এখানে মুসলমান বাঙ্গালী আজও দাঁড়িয়ে আছে প্রধানত বাঙ্গালী হয়ে নয়, বরং মুসলমান হয়ে যে মুসলমান মাথা থেকে পা পর্যন্ত হিন্দু বিদ্বেষী এবং যথেষ্ট পরিমাণে দেশজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিদ্বেষী। সুতরাং হিন্দু বাঙ্গালী কীভাবে ভরসা পাবে? সে যদি পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীর সমর্থন না পায় তবে একা তার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে কী ভাবে এবং কোন ভরসায় দাঁড়াবে বিশাল ভারত রাষ্ট্রের বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে? সুতরাং আজ পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর মুক্তি অনেকখানিই নির্ভর করছে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীর উপর যেমন ইতিপূর্ব ১৯৭১-এ পূর্ব বঙ্গের স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙ্গালী জনগণের সাহায্য ও সমর্থনের উপর।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : শেষ কথা

বাঙ্গালী কী ভাবে তার পুনরেকত্রীকরণ অর্জন করবে সে সম্পর্কে এখনই নির্দিষ্ট কিছু বলা যায় না। তবে আমরা এটুকু বুঝছি যে, পশ্চিম বঙ্গ নয় বরং পূর্ব বঙ্গই পুনরেকত্রীকরণের সূচনাবিন্দু। এখানেই যত বিকৃত ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রূপেই হোক “বাঙ্গালীর” একটি রাষ্ট্র প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেটি ভারত রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কারণে বাঙ্গালীর জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে নি। এখন রাষ্ট্রটিকে সঠিক রূপ দিতে গেলে এটিকে পুনর্গঠন করা ছাড়া উপায় নেই। বাঙ্গালীর জাতীয় এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে মর্মবস্তু লুকিয়ে আছে ইসলামী ধর্ম-সাম্প্রদায়িক এবং আমলাতান্ত্রিক আবরণের নীচে সেটাকে মুক্ত করতে হবে ইসলামী ধর্ম-সাম্প্রদায়িক এবং আমলাতন্ত্রের আবরণটিকে ধ্বংস করে।

এটা করতে গিয়ে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর সঙ্গে। পূর্ব বঙ্গকে বাঙ্গালীর পরিপূর্ণ স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে এখান থেকে বাঙ্গালীর নূতন সমাজ ও রাষ্ট্র পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরার বাঙ্গালী জনগণের সামনে উপস্থিত করবে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও পুনরেকত্রীকরণের বাস্তবতা।

সেক্ষেত্রে পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা তথা ভারতের বাঙ্গালী জনগণ পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চাইলে পূর্ব বঙ্গের রাষ্ট্র তাদেরকে নৈতিক ও বাস্তব সমর্থন দিবে। তখন উভয় বঙ্গের জনগণের প্রতিনিধিগণ নিজেদের মধ্যে স্বেচ্ছামূলক ও শান্তিপূর্ণ আলাচনার মাধ্যমে উভয় বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণ দ্বারা বাঙ্গালীর অখণ্ড ও স্বাধীন বঙ্গ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রই বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়ার সূচনাবিন্দু। বস্তুত এখান থেকেই বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ প্রক্রিয়ার সূচনা দ্বারা বাঙ্গালী জাতির যাবতীয় সঙ্কট মোচনের পথে যাত্রা শুরু করা সম্ভব। সুতরাং এখানকার সমস্যাগুলি বুঝতে গিয়ে মুসলমান বাঙ্গালী এবং তার সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাগুলি উপলব্ধি করা একটি অত্যাবশ্যক করণীয় হিসাবে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়।

মুসলমান বাঙ্গালীর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতা এবং সামাজিক, রাষ্ট্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনার সময় আর একটি বিষয় আমাদের চিন্তায় রাখা দরকার। সেটা হল মুসলিম সমাজে স্বৈরতন্ত্র একটা সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে ধর্মের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। ইসলামে প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজ স্বতন্ত্র কোনও সত্তা নয়। অর্থাৎ রাজনীতি ও ধর্ম একীভূত। মর্মগতভাবে কিংবা অন্তর্বস্তুতে, এবং ধর্মীয় বিধানে তো বটেই, সমস্ত ইসলামী বা মুসলিম রাষ্ট্রই ধর্মীয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল ইসলামী অনুশাসন রক্ষা ও পালন করা এবং ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটানো। ইসলামের নিরংকুশ একতন্ত্র যে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে সেটা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক স্বৈরতন্ত্র থেকে পৃথক কোনও জিনিস নয়। স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তি বা আমলাতন্ত্র এবং বিশেষত তার সেনাবাহিনী বা সামরিক শক্তি হল মুসলমান সমাজের কেন্দ্র বা নেতৃত্ব।

এই রকম অবস্থায় স্বৈরতন্ত্রে অভ্যস্ত ও পীড়িত জগণের চিন্তা-চেতনার মান হয় খুব নীচু। সামাজিক ও ধর্মীয় শক্তি কুর্‌আন ও হাদীস দ্বারা যেভাবে মুসলমান সমাজের চিন্তা-চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাতে সমাজে স্বাধীন কোনও চিন্তা-চেতনার উদ্ভব কিংবা বিকাশ সম্ভব হয় না। বিশেষত নীচের দিকে। কুর্‌আনে বলা হচ্ছে, “আল্লাহ্‌ ও তাহার রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকিবে না। কেহ আল্লাহ্‌ এবং তাঁহার রাসূলকে অমান্য করিলে সে তো স্পষ্টই পথভষ্ট হইবে। ” (৩৩ঃ৩৬)।

এমতাবস্থায় সমাজে ভিন্ন কিংবা নূতন চিন্তা বা মতের বিকাশ দূরের কথা জন্মলাভই অসম্ভব হয়। ফলে মুসলমান সমাজ-মানস হয় বন্ধ্যা, ঊষর। কুর্‌আন-হাদীসের বিধান সাধারণ মুসলমানের চেতনাকে লৌহকঠিন শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে। সুস্থ ও নূতন চিন্তা, যুক্তিবাদী ও মানবিক চিন্তার জন্ম ও লালনের কোনও জমিই সমাজ জীবনের কোথায়ও রাখা হয় না। এই ধরনের চিন্তার প্রতি সমাজকে সর্বক্ষণ করা হয় অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক। নূতন চিন্তা ও শক্তির জন্ম ও বিকাশের জন্য সমাজে যে ধৈর্য, সহনশীলতা ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন হয় সেসবের কোথায়ও কোনও অস্তিত্ব না রাখায় নূতন বা ভিন্ন কোনও কিছুই কোথায়ও মূর্ত হতে পারে না গোড়াতেই তাকে নির্মূল করা হয় বলে। এমন কি তেমন কিছু জন্মের বাস্তবতাও সমাজে রাখা হয় না চিন্তার জগৎকে নিরবচ্ছিন্ন সুকঠোর নিয়ন্ত্রণ ও অবদমন দ্বারা। এজন্য মুসলমান সাধারণত চিন্তাশীল হয় না। কিন্তু সমাজের উপর তলা বিশেষত শাসন কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত শাসকরা শাসন ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে গিয়েই কিছু না কিছু চিন্তা করতে বাধ্য হয়। ভিন্নধর্মী সমাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে তাকে বহু কিছু গ্রহণ করতেও হয়। কিন্তু এইসব নূতন বা ভিন্ন চিন্তা সাধারণত সমাজের ভিতর থেকে ওঠে না, বরং আসে বাহির থেকে এবং এইসব চিন্তা সমাজের ভিতরে বিস্তার পায় না বলে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে উপর তলাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।

বস্তুত নূতন বা উন্নত চিন্তাগুলো মুসলমান সমাজে আসে বাইরের “কাফের” ও “শত্রুদের” কাছ থেকেই। মুসলমান ধর্ম তো মূলত সৃষ্টি বা উৎপাদনের ধর্ম নয়, আত্মসাৎ বা দখলের ধর্ম। শত্রু “কাফেরদের” সম্পদ যেমন মুসলমান শাসকেরা বা রাষ্ট্র দখল ও আত্মসাৎ করে শত্রু “কাফেরদেরকে” ঘৃণা করেই ঠিক তেমন “কাফেরদের” চিন্তা বা ধারণার অনেক কিছুকে লাভজনক বা একান্ত প্রয়োজনীয় মনে হলে ঘৃণার সাথেই সেগুলিকে গ্রহণ বা আত্মসাৎ করতে পারে। ঘৃণার সঙ্গে ভোগ বা আত্মসাৎ করার এই প্রবণতা সাধারণভাবে মুসলমানদের মজ্জাগত। এর ফলে সাধারণ মুসলমান সৃষ্টিশীল হয় না, হতে পারে না।

এমন অবস্থায় বাইরের বিপজ্জনক অথচ একান্ত প্রয়োজনীয় চিন্তা বা পদ্ধতিগুলির গ্রহণ কিংবা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকে শাসনকেন্দ্র তথা রাষ্ট্রের হাতে। এই রকম অবস্থায় সাধারণত নূতন সামাজিক চিন্তা বা শক্তি যখন আত্মপ্রকাশ করতে চায় তখন তা সমাজের নীচতলা থেকে রসদ সরবরাহ পায় না বলে সমাজের ভিতর থেকে বা নীচ থেকে উঠে না এসে প্রধান শাসককে অবলম্বন করে উঠে দাঁড়াতে চায়। সমাজের প্রয়োজন খুব বেশী তীব্র হলে এবং প্রচলিত স্বৈরাচারী শাসক সেই প্রয়োজনকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে না চাইলে নূতন স্বৈরাচারী শাসক এসে তাকে সরিয়ে দেয়।

ইসলামী সমজের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল তার সামরিক প্রবণতা এবং সামাজিক-রাষ্ট্রিক নেতৃত্বে যোদ্ধাদের বা সেনাবাহিনীর প্রাধান্য। এর মূল কারণ হল এই যে, ইসলাম প্রসার লাভ করেছে প্রধানত যুদ্ধ দ্বারা। ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ একজন এমন ধর্মনেতা যিনি জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ দ্বারা ভিন্নধর্মাবলম্বী বা “কাফেরদেরকে” পরাজিত করে আরবে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুর্‌আন এই যুদ্ধের পক্ষে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, “ হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও উহাদিগের প্রতি কঠোর হও; উহাদিগের আবাসস্থল জাহান্নাম, উহা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!” (৯ : ৭৩)। “হে মুমিনগণ! কাফিরদিগের মধ্যে যাহারা তোমাদিগের নিকটবর্তী তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ কর এবং উহারা তোমাদিগের মধ্যে কঠোরতা দেখুক। জানিয়া রাখ আল্লাহ্‌ মুত্তাকীদিগের (ধার্মিকদের) সহিত আছেন।” (৯ : ১২৩)। “তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদিগের নিকট উহা অপ্রিয়; কিন্তু তোমরা যাহা পছন্দ কর না সম্ভবত তাহা তোমাদেরই জন্য কল্যাণকর এবং যাহা পছন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্‌ জানেন; তোমরা জান না।” (২ : ২১৬)। “যদি তোমরা অভিযানে বাহির না হও তবে তিনি (আল্লাহ্‌) তোমাদিগকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিবেন এবং তোমরা তাঁহার কোনই ক্ষতি করিতে পারিবে না।” (৯ : ৩৯)।

হাদীসে আমরা দেখি যে, মুহাম্মদ বলছেন, “আমার প্রতি আদেশ হইয়াছে লড়াই করিবার জন্য লোকদের বিরুদ্ধে যতক্ষণ না তাহারা সাক্ষ্য দেয় যে, নাই কোন মাবুদ খোদা ভিন্ন এবং মোহাম্মদ তাঁর রসূল এবং কায়েম করে নামাজ এবং আদায় করে যাকাত। যখন তাহারা উহা করিবে, তাহারা নিজেদের রক্ত ও ধন বাঁচাইবে আমা হইতে ইসলামের প্রাপ্য* বাদে এবং তাহাদের বিচার থাকিবে (আন্তরিকতা সম্বন্ধে) খোদার কাছে।” (তজরীদুল বুখারী। প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, প্রথম সংস্করণ। পৃষ্ঠাঃ ১৮-১৯)।

­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­------------------------------------------------

* “রক্ত সম্পর্কে” ইসলামের প্রাপ্য এই যে, তিনটি কাজের কোন একটি কাজ করিলে ইসলাম প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয় । (১) অন্যায়ভাবে কাহাকেও হত্যা করিলে; (২) বিবাহসূত্রে যৌন-মিলন হওয়ার পর যিনা করিলে; (৩) ইসলাম ত্যাগ করিলে। ধন সম্বন্ধে ইসলামের প্রাপ্য হইতেছে যাকাৎ।’ ­ - “তজরীদুল বুখারী”।

----------------------------------------------- 

মুহাম্মদ আরও বলছেন, “তোমরা শুনিয়া ও জানিয়া রাখিও, নিশ্চয় বেহেশ্‌ত তরবারির ছায়াতলে।” (বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, মাওলানা শামসুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক কর্তৃক অনূদিত; হামিদিয়া লাইব্রেরী; ঢাকা; প্রকাশঃ ১৯৬৭। পৃষ্ঠাঃ ৩০)

সুতরাং আমরা দেখছি যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠায় ও প্রসারে নৈতিক ও ধর্মীয়ভাবেও তলোয়ার বা যুদ্ধের এবং বলপ্রয়োগের গুরুত্ব কত বেশী। মুহাম্মদ শুধু ধর্মনেতা ছিলেন না তিনি একই সঙ্গে ছিলেন একজন সমরনেতা বা যোদ্ধা। কুর্‌আন ও হাদীস পড়লেই জানা যায় মুহাম্মদ কীভাবে অস্ত্রশক্তি ও বলপ্রয়োগ দ্বারা আরবে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন।

এরই অপরিহার্য অংশ হিসাবে ছিল পরাজিতদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং নারী-পুরুষ-শিশুসহ সকলকে দাস-দাসীতে পরিণত করা। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধবন্দী নারীদেরকেও “গনিমতের মাল” হিসাবে মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করা হত এবং তারা হত নূতন প্রভুদের সম্ভোগের পাত্রী। এ রকম ক্ষেত্রে ইসলামে ধর্মীয় বিধান দ্বারা নারী ধর্ষণকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ যুদ্ধ কিংবা ক্রয় দ্বারা অধিকারভুক্ত দাসী সম্ভোগের সপক্ষে কুর্‌আনে সুস্পষ্ট অনুমোদন আছে। যেমন, কুর্‌আনের ২৩ নং সুরা মুমিনুন-এর ৫ ও ৬ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, “...... (৫) যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, (৬) নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসিগণ ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না, .....।” কিংবা ৩৩ নং সুরা আহযাব-এর ৫২ নং আয়াতে বলা হচ্ছে ,“(৫২) ইহার পর, তোমার জন্য কোন নারী বৈধ নহে এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নহে যদিও উহাদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করে; তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে। আল্লাহ্‌ সমস্ত কিছুর উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন।” অথবা ৭০ নং সুরা মা’আরিজ-এ বলা হচ্ছে, “(২৯) এবং যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, (৩০) তাহাদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না­।” ইত্যাদি। এ ছাড়া বহুসংখ্যক হাদীস থেকে আমরা “অধিকারভুক্ত দাসীদের” প্রতি এই ধরনের অধিকারের ব্যাপক প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারি। এটা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের অনুমোদনক্রমে নারী ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়।

ইসলামী পৃথিবীর দেশে দেশে বিরাজমান সর্বব্যাপী ভয়াবহ দুর্নীতি, সহিংসতা, অমানবিকতা, পশ্চাৎপদতা, স্বৈরতন্ত্র ও নারীর দুর্গত অবস্থার মূল উৎস যে ধর্ম সেটা বুঝার জন্য বেশী বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্যের দরকার হয় না। মুক্ত মন নিয়ে ও একটু মনোযোগ দিয়ে কুর্‌আন, হাদীস এবং সেই সঙ্গে ইসলামের ইতিহাস পড়াই যথেষ্ট।

আরবে যেভাবে যুদ্ধের পথ ধরে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলত সেই একই পথে আরবের বাইরের দেশগুলিতেও ইসলামের প্রসার ঘটেছে। সেই সঙ্গে সাধারণভাবে যুদ্ধজয় ও বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণের প্রক্রিয়ায় মুসলমানরা লাভ করেছে স্বৈরতা, বলপ্রয়োগ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের শিক্ষা। কিন্তু একবার ইসলামীকরণ হয়ে গেলে বিশেষত লুণ্ঠন ও ধর্ষণের শিক্ষা দ্বারা অর্জিত অর্গলমুক্ত লুঠেরা ও ধর্ষক চরিত্র সমাজের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। সুতরাং তখন এই চরিত্রকে সংযত রাখার উপায় হিসাবে দেখা দেয় কঠোর একনায়কী স্বৈরশাসন এবং নারীর জন্য কঠোর অবরোধ। ধর্মীয় বিধান দ্বারা দুইটিই ইসলামী সমাজ চেতনায় দৃঢ়বদ্ধ হয়ে থাকে। সুতরাং এর অব্যাহত চর্চায় সমস্যা হয় না।

ইসলামে স্বৈরতন্ত্র প্রসঙ্গে যে কথা একটু আগেই বলেছি সেটাকেই আরও স্পষ্ট করার জন্য বলতে হয় যে, বস্তুত ইসলামে ভিন্নমত ও ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি সামান্যতম স্বীকৃতি নেই। আল্লাহ্‌র নিরঙ্কুশ একত্ব ও স্বেচ্ছাচারের ধারণার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামের মূল ঘোষণায় বলা হচ্ছে আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তার রাসূল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ্‌)। বলা হচ্ছে আল্লাহ্‌র অংশীদার নেই (লা শরীক আল্লাহ্‌)। কুর্‌আনে বারংবার বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্‌ যা খুশী তা-ই করেন বা যা ইচ্ছা তা-ই করেন বা করতে পারেন। যেমন, “আল্লাহ্‌ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন।” (৩ : ৪০)। “যাহাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করিবেন এবং যাহাকে খুশী শাস্তি দিবেন।” (২ : ২৮৪)। “ তিনি যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা শাস্তি দান করেন।” (৩ : ১২৯)। “আল্লাহ্‌ যাহাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা কি তাহাকে সৎ পথে পরিচালিত করিতে চাও? এবং আল্লাহ্‌ কাহাকেও পথভ্রষ্ট করিলে তুমি তাহার জন্য কখনও কোন পথ পাইবে না।” (৪ : ৮৮)। “তোমার প্রতিপালক যাহার জন্য ইচ্ছা তাহার রিয্‌ক বর্ধিত করেন এবং যাহার জন্য ইচ্ছা উহা সীমিত করেন; তিনি তাঁহার বান্দাদিগের সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত, সর্বদ্রষ্টা।” (১৭ : ৩০)। “আল্লাহ্‌ যাহাকে হেয় করেন তাহার সম্মানদাতা কেহই নাই; আল্লাহ্‌ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন।” (২২ : ১৮)। “ আমি ইচ্ছা করিলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করিতাম; কিন্তু আমার এই কথা অবশ্যই সত্যঃ আমি নিশ্চয়ই জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করিব।” (৩২ : ১৩)। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র আচরণ বা কাজে নিয়ম-নীতি খুঁজাটাও অন্যায়। এই ধরনের বিশ্বাস অথবা বিশ্বচেতনা বাস্তবে চরম, নিরঙ্কুশ ও প্রতিকারহীন সামাজিক-রাষ্ট্রিক স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কী স্বেচ্ছাচার জন্ম দেয়। এটা প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছাচারী একনায়কের শাসনের ভিত্তির উপর গোটা সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করে। কারণ অসংযত একনায়কতান্ত্রিক চেতনা সৃষ্টি দ্বারা বাস্তবে সমাজকেই এই ধরনের ব্যবস্থার উপযোগী করা হয়।

অন্যদিকে ইসলামে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব নেই, এটা থাকতেও পারে না। কারণ ইসলামী তত্ত্ব মতে মানুষসহ যাবতীয় সৃষ্টি আল্লাহ্‌র দাস। এখানে খ্রীষ্টধর্মের মত ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক প্রেমময় পিতা ও পুত্রের সম্পর্কের অনুরূপ নয়। বরং এটা দাস-প্রভু (মালিক) ও দাস (বান্দা)-এর সম্পর্ক। বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর, স্বর্গ ও নরকের ধারণার স্থান নেই। ফলে এটা ধর্ম হিসাবে অন্য সকল ধর্ম থেকে ভিন্ন। অন্যদিকে বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম প্রধান এই ধর্ম দুইটি মূলত যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে নি। শুধু তা-ই নয়, যীশু খ্রীষ্ট এবং বুদ্ধ দুইজনই ছিলেন অহিংসাবাদী এবং বলপ্রয়োগ-বিরোধী। তবে খ্রীষ্টধর্মে পরবর্তী কালে বলপ্রয়োগ প্রবেশ করেছিল। কিন্তু সেটা ছিল খ্রীষ্টানদের উপর শত শত বৎসর ব্যাপী ভয়ঙ্কর নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া। এর উপর মুসলমানরা যখন যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ দ্বারা খ্রীষ্টধর্মকে মূল আরব ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে সাধারণভাবে উৎখাত করে তখন ইউরোপে কেন্দ্রীভূত খ্রীষ্টধর্ম অধিকতর মারমুখী রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশেষত আরব মুসলিমদের স্পেন বিজয় এবং ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণকারী মুসলমানদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ব্যাপী যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে ইউরোপে খ্রীষ্টানদের মারমুখী বা আক্রমণাত্মক রূপ গ্রহণ অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তা সত্ত্বেও খ্রীষ্টধর্মের ভিতর তুলনামূলকভাবে যে সহিষ্ণুতা ছিল এবং সেই সঙ্গে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে মধ্যযুগে রাজা বা সম্রাটের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ ক’রে যে ধরনের সামন্তবাদী সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছিল তার ফলে সেখানে ভিতর থেকে গণতান্ত্রিক চেতনা ও প্রতিষ্ঠানের বিকাশ সম্ভব হয়। তবে এর জন্য ইউরোপকেও ধর্মীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ কালব্যাপী কঠোর লড়াই করতে হয়েছে যেমন তাকে লড়তে হয়েছে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে।

কিন্তু ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা সম্পূর্ণরূপে বহিরারোপিত। ধর্মের নিয়ন্ত্রণের কারণে এটা সমাজ-তলে কোনও দৃঢ় অবলম্বন পায় না। ধর্মের চরিত্র এবং বিকাশ ও বিস্তার পদ্ধতির কারণে ইসলামী সমাজ গভীর ও প্রবলভাবে একনায়কী সমরতন্ত্র নির্ভর সমাজ হিসাবেই বিকাশ লাভ করেছে। এর যতটুকু পরিবর্তন সেটুকুই হয়েছে অমুসলিম বা বাইরের সমাজের বিজয় এবং চাপে।

ইসলামের প্রতিষ্ঠায় অস্ত্রশক্তির যে গুরুত্ব তার ফলে ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব চলে গেছে মূলত যোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর হাতেই। ইসলামের ব্যবস্থায় সকল শাসকই মূলত যোদ্ধা বা সৈনিক। কাজেই মুসলমান সমাজে সংরক্ষণ অথবা পরিবর্তনের প্রধান শক্তি সাধারণত সেনাবাহিনী হয়। মুসলমান সমাজের স্বাভাবিক নেতা হচ্ছে রাষ্ট্রের সশস্ত্র বা সামরিক গোষ্ঠী। একে বলা যায় সামরিক আমলাতন্ত্র। তবে সামরিক আমলাতন্ত্র একা নয়, এর সঙ্গে সম্পর্কিত বেসামরিক আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন যন্ত্র ও বিচার বিভাগ। মূলত এগুলি নিয়েই রাষ্ট্রযন্ত্র। কাজেই মুসলমান সমাজের নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব হল মূলত সামরিক প্রাধান্যযুক্ত রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র বা সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নিজেই। এই রাষ্ট্রের অধীনস্থ ও অংশ হিসাবে কাজ করে মোল্লাতন্ত্র । এটাই সমগ্র মুসলিম পৃথিবীর চিত্র। আধুনিক যুগে কোথায়ও কোথায়ও কিছু সময়ের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব এসে সামরিক আমলাতন্ত্রের তুলনায় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও সেটা হল বহিরাবরণ এবং সাময়িক রূপ। ইসলামী সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য সেটা নয়। এটাকে বরং আরোপ বলাই ভালো, যা আধুনিক পৃথিবীর উন্নত ও আধিপত্যকারী “কাফের” সমাজগুলোর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণেরই ফল মাত্র।

বাংলাদেশেও আমরা মুসলমান সমাজের এই বৈশিষ্ট্যেরই একটা প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি। পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত পূর্ব বঙ্গে রাজনীতিকদের তুলনায় সেনাবাহিনীই নেতৃত্বে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মুজিবের শাসনামলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি আরোপ। ভারতের সেনাবাহিনী দ্বারা আরোপ। এই অবস্থায় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মত বৈদেশিক শক্তিগুলি এই বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করছে এ দেশে তাদের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য। কারণ এই সেনাবাহিনী বা সামরিক প্রাধান্যযুক্ত রাষ্ট্রযন্ত্রই হল সমস্ত মুসলিম সমাজে জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় শক্তি। আবার ক্ষেত্র বিশেষে মুসলিম সমাজের পরিবর্তন কিংবা অগ্রগতিরও প্রধান শক্তি হয়ে দেখা দেয় এই সেনাবাহিনী। যেহেতু জনগণের মধ্য থেকে সমাজ পরিবর্তনের শক্তির উদ্ভবের বাস্তবতা থাকে না কিংবা থাকলেও তা হয় খুব সীমিত সেহেতু যখন সামাজিক পরিবর্তন রাষ্ট্রের বা শাসকদের জন্যই খুব প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয় তখন সেটা সংগঠিত হয় উপর তলা থেকে সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্র দ্বারা। তুরস্ক, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত মুসলিম দেশেরই এটা একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ প্রতিক্রিয়া ও প্রগতি উভয়েরই প্রধান মাধ্যম হিসাবে দেখা দেয় সেনাবাহিনী। বেসরকারী রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতৃত্ব বা শক্তি এ ক্ষেত্রে সাধারণত সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশ তথা পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি এবং সংকটমুক্তির পথ বা করণীয় বিশ্লেষণের সময় আমাদেরকে এই দিকটি বিশেষভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। এ দেশের বাঙ্গালীর সহজিয়া ও চইরা চরিত্রের সঙ্গে মুসলিম স্বৈরতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্য সম্মিলিত হয়ে এখানে একটি বিশেষ জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।

আমাদের মত দেশে আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী হচ্ছে গণ-বিরোধী স্বৈরতন্ত্র, প্রতিবিপ্লব, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের কেন্দ্রীয় শক্তি। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের উপর সকল স্বৈরাচারী শোষণ, নির্যাতন ও অন্যায়ের কেন্দ্র। সুতরাং জনগণের মুক্তি তথা গণতান্ত্রিক বিপ্লব দাবী করে এই সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিলুপ্তি। আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী কিংবা রাষ্ট্র দ্বারা শিল্পায়ন বা আধুনিকায়ন কিছু হয় না তা নয়। কিন্তু সেটা বেশী দূর অগ্রসর হতে পারে না সেনাবাহিনীর গণবিরোধী ও স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রের দরুণ। জনগণকে স্বৈরাচারী পদ্ধতিতেই শোষণ, লুণ্ঠন ও দমনের প্রয়োজনে একটা সীমিত ও কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন বা শিল্পায়ন হয়। উদ্দেশ্য শাসকদের তুলনায় জনগণকে পশ্চাৎপদ ও দুর্বল অবস্থানে ধরে রাখা। অর্থাৎ উন্নয়নের চরিত্রও হয় স্বৈরতান্ত্রিক। বিশেষত আরব দেশগুলিতে বা মধ্যপ্রাচ্যে সেনাবাহিনী বা আমলাতন্ত্র ক্ষেত্র বিশেষে যেটুকু প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পেরেছে সেটুকু প্রগতিশীল ভূমিকাও এদেশের বর্তমান সেনাবাহিনী বা আমলাতন্ত্র কর্তৃক পালন করা এক অসম্ভব ব্যাপার। মধ্যপ্রাচ্যের মত এ দেশে সেনাবাহিনী বা আমলাতন্ত্র নিরংকুশ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে গড়ে ওঠে নি কিংবা গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে জনগণের সামনে প্রতিভাত হয় নি বলে এ দেশে সামরিক আমলাতন্ত্রের পক্ষে জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করা কিংবা জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া অসম্ভব। এর জন্ম ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রয়োজনে, এর অস্তিত্ব ও বিকাশ নয়া উপনিবেশবাদের প্রয়োজনে।

এমন অবস্থায় এ দেশের সামরিক আমলাতন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের তুলনামূলকভাবে স্বাধীন মুসলিম সমাজের সামরিক আমলাতন্ত্রের গুণগুলো না পেয়ে প্রধানত দোষগুলোই পেয়েছে। সুতরাং এ দেশে উন্নয়ন ও শিল্পায়নকে বাধামুক্ত করতে হলে এবং গণতন্ত্রে কিংবা জনগণের কল্যাণের ধারায় নিতে হলে সেনাবাহিনী তথা রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকল্প ধারায় নেতৃত্ব গঠন করেই অগ্রসর হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এমন অবস্থায় গণ-বিপ্লবের নিজস্ব নেতৃত্ব গড়ে তুলার উপর নির্ভর না করে উপায় নেই। এই নিজস্ব নেতৃত্ব গড়তে গিয়েই এ দেশে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের অগ্রণী বাঙ্গালী শক্তির সম্মিলন দ্বারা নূতন বাঙ্গালী সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠনের সূত্রপাত ঘটবে।*

------------------------------------------------

* বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংক্রান্ত আলোচনার সময় তার ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী ও পাকিস্তানী ইসলামী ঐতিহ্যের পাশাপাশি ১৯৭১-এর বাঙ্গালীর লোকবাদী জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করায় তার ভূমিকাকে হিসাবে না নেওয়াও হবে ভুল। এটা আমাদেরকে একচক্ষু হরিণের মত ভ্রান্ত অবস্থানে নিবে। এটা ঠিক যে আমার মূল চিন্তা এই অর্থে অপরিবর্তিত রয়েছে যে, বিদ্যমান সেনা কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে এ দেশে সমাজের মৌল পরিবর্তনের পক্ষে কারও পক্ষেই বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয়। তবে এ দেশের স্বাধীনতা রক্ষা বা আমূল পরিবর্তন সংঘটনে সেনাবাহিনী থেকে কোনও বিপ্লবী শক্তির উত্থান অসম্ভব নয়। ’৭১-এ একঝাঁক বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা যেমন বেরিয়ে এসেছিলেন সেখান থেকে তেমন তাহেরের মত বিপ্লবী বীর সৈনিকও এসেছিলেন সেখান থেকেই। - ­ লেখক, ২৬ অক্টোবর, ২০০৮

------------------------------------------------

শুধু এ দেশের নয় উপরন্তু সমগ্র মুসলিম সমাজের আর এক বৈশিষ্ট্য এই সমাজে আরও প্রবল ও গভীরভাবে চেপে আছে বাঙ্গালী সহজিয়া চরিত্রের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণে। তা হল ভোগবাদ। অবশ্য এ সম্পর্কে কিছু পূর্বে আলোচনা করেছি। বিশেষত মুসলমান মধ্য ও উচ্চ শ্রেণীর তথা মুসলমান সামাজিক নেতৃত্বের যে প্রচণ্ড সুবিধাবাদী ও ভোগসর্বস্ব চেতনা গড়ে উঠেছে তাতে করে এখানে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সমর্থন পাওয়া দুঃসাধ্য। অন্যদিকে মুসলমান শ্রমজীবী জনগণ হল শক্তির পূজারী। আসলে তো তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে বহিরাগত মুসলমানের তলোয়ারের শক্তি দেখেই।

মুসলমান সমাজে ত্যাগ ও মহত্তর সামাজিক আদর্শের বিশেষ কোনই মূল্য নেই। যতই সংযমের কথা বলা যাক ব্যক্তিগত ভোগই হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। কুর্‌আন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বিধান অনুযায়ী ইহকালে চারটা পর্যন্ত বিবাহের অধিকার, সংখ্যাহীন যুদ্ধবন্দী বা অর্থবন্দী দাসী সম্ভোগের অধিকার এবং যুদ্ধলব্ধ লুটের মাল লাভের ব্যবস্থা, এবং পরকালে স্বর্গে উচ্ছৃংখল ভোগ ও যৌন সম্ভোগের চিত্র মুসলিম মানসের গভীরে ভোগবাদকে প্রোথিত করেছে। সাধারণ মুসলিম মানস অবতলে যে সত্তাটি বাস করে সেটি প্রকৃতপক্ষে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বের যুদ্ধবাজ বা সহিংস লুঠেরা ও ধর্ষক বেদুঈন মানস। অর্থাৎ এখানে জনগণের বিপুলভাবে গরিষ্ঠ অংশ মর্মগতভাবে উন্নত কোনও মানবিক চেতনার পরিবর্তে অসভ্য অথবা অর্ধসভ্য বেদুঈন মানসকে ধারণ করে। এটিকে ইসলাম ধর্ম তার রক্ষা ও সম্প্রসারণের প্রয়োজনে একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ ও লালন করে। সুতরাং এই সমাজে পরিবর্তনের প্রকৃত শক্তি জনগণের অংশ গ্রহণ বা প্রয়াস দ্বারা নীচ থেকে সহজ উপায়ে গড়ে উঠতে পারে না। অর্থ-বিত্তের অধিকারী শ্রেণীগুলি সামাজিক স্বার্থে কোনও ত্যাগ স্বীকারে খুব কমই আগ্রহী হয়। যাতে তার বাস্তবের ইহকালে বা কল্পিত পরকালে প্রত্যক্ষ বৈষয়িক লাভ হবে না এমন কোনও সামাজিক কর্মে অর্থ বা সম্পদ দিতে এমন কি মধ্যবিত্তও সাধারণত রাজী হয় না। এই বাস্তবতায় এ বঙ্গের বাঙ্গালী এককভাবে কীভাবে বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের শক্তি গঠন করবে? পশ্চিম বঙ্গে এ বঙ্গের মানুষের তুলনায় অনেকখানি উন্নত চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠা মানুষদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় কী? কাজেই বাংলাদেশকে সকল বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে এখানে পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরা থেকে যে সব বাঙ্গালী প্রত্যাবর্তন অথবা আবাসন করতে ইচ্ছুক হবে তাদের পুনর্বাসনের সর্বাত্মক দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে।*

 -----------------------------------------------

* পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ১৯৮৯-তে মূল গ্রন্থে “ বাঙ্গালীর ঐক্য” নামক পরিচ্ছেদে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম আমার নিকট পরবর্তী কালে সেটি ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে হয়। সুতরাং গ্রন্থের এই একটি পরিচ্ছেদ বাদ দিয়েছি। বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব ও জাতি গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি ২০০৭-এর ২-২৪ জুলাইতে লেখা এবং ২০০৭-এর ২৯ জুলাই তারিখে বঙ্গরাষ্ট্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ “বাংলাদেশের সঙ্কট ও উত্তরণের পথ”-এর শেষ পরিচ্ছেদ “বাঙ্গালীর জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের করণীয়”-তে কিছু নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করেছি। আগ্রহী পাঠক সেটি পড়তে পারেন। সুতরাং এ নিয়ে এখানে আর বিস্তারিত আলোচনা করছি না।

------------------------------------------------

­যাইহোক, বাঙ্গালী জাতিকে বিভক্ত করে তার কোনও কিছুই ভালোভাবে সংগঠিত করা যে সম্ভব নয় ’৪৭ থেকে উভয় বঙ্গের অভিজ্ঞতা সেটাই প্রমাণ করে। অখণ্ড নেতৃত্ব সংগঠন দ্বারা অখণ্ড বাঙ্গালী জাতি ও সমাজ গঠনই বাঙ্গালীর মুক্তির উপায়। সেখানেই রয়েছে জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ।

ভবিষ্যৎ এই বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র হবে অখণ্ড ও স্বাধীন বঙ্গ। এই বাঙ্গালী হিন্দুও হবে না, মুসলমানও হবে না। কারণ এই উভয়ের শুধু মিলন নয়, বিকাশও অসম্ভব। এই বাঙ্গালী হবে এই উভয় ধর্ম-সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠেই বাঙ্গালী। এই বাঙ্গালী পরদেশ, পরজাতির দাসত্বে নিজের গৌরব খুঁজে পাবে না। জাতি হিসাবে বাঙ্গালী জগৎ সভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। পৃথিবী ও মানব জাতির অংশ হয়েও, সকল জাতি ও মানুষের সমতা ও উন্নয়নে বিশ্বাসী হয়েও এই বাঙ্গালী জাতি তার সকল স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তাকে বিলীন করে দিয়ে নিঃস্ব ও পরবশ্য হবে না। অনেক শত ও সহস্র বৎসরের সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্যের পথ ধরেই হবে তার অগ্রযাত্রা। কিন্তু তার অগ্রযাত্রা হবে নূতনের দিকে, উন্নয়নের দিকে, পরিবর্তন ও সমৃদ্ধির দিকে। তার অগ্রযাত্রা হবে মনুষ্যত্ব ও চেতনার ক্রমবর্ধমান স্বাধীন বিকাশ ও বিস্তারের দিকে।

রচনাঃ ৯ মে-১৫ জুন, ১৯৮৯।

-------------------------------------------------------------------------------

সংযোজন

প্রায় কুড়ি বৎসর আগে যখন এই বই লেখেছিলাম তখন বাঙ্গালীর যে চরিত্র বিশ্লেষণ করেছিলাম তা থেকে আজকের বাঙ্গালীর চরিত্র খুব বেশী ভিন্ন যে হয় নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে চরিত্রগতভাবে এ বঙ্গের বাঙ্গালীর ক্রমিক অধোগতি আরও অনেক দূর এগিয়েছে। অবশ্য আধুনিক পৃথিবীর চাপ, প্রভাব ও তাড়নায় তার বস্তুগত উন্নতি পূর্বের তুলনায় অনেকখানি হয়েছে। এই উন্নতি বা উন্নয়নকে আমরা বহিরারোপিতও বলতে পারি, যা এ সমাজের দৈন্য ও পরনির্ভরতাকেও অনেকাংশে তুলে ধরে। এই কারণে উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও সম্পদ বণ্টনে রয়েছে পর্বত প্রমাণ বিকৃতি, বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা।

এ বঙ্গের বাঙ্গালী সমাজের চরিত্রে যে সকল সবলতা ও দুর্বলতা বিদ্যমান সে সকলের প্রতিফলন তার রাষ্ট্র বাংলাদেশেও ঘটেছে। তার চরিত্রের সকল ত্রুটি, দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশকে তার জন্মলগ্ন থেকে অধিকার করে রেখেছে। গ্রন্থে ইতিপূর্বে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে অস্তিত্ব সঙ্কটের কথা বলেছিলাম সেটি প্রায় কুড়ি বৎসর সময় পার হয়ে আজ চরমতর পর্যায়ে পৌঁছেছে মাত্র।

বাঙ্গালীর রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৩৭/৩৮ বৎসর পর এখন যখন তার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা ক্রমবিস্তৃত হচ্ছে এবং দেশী, বিদেশী বিভিন্ন চক্রান্তের মুখে রাষ্ট্র হিসাবেই তার অস্তিত্ব ভয়ানক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তখন খোলা মনে এবং নির্মোহভাবে আমাদের আত্মবিচারের প্রয়োজন খুব বেশী। কারণ এ ছাড়া আমরা আমাদের রাষ্ট্রটিকে রক্ষার কোনও দিশাই খুঁজে পাব না। অথচ বাঙ্গালীর অনেক ত্রুটির মধ্যে প্রকৃত আত্মানুসন্ধান বা আত্মবিচারের অভাব একটি। আমরা জাতি হিসাবে পরের সমালোচনা ও ত্রুটি সন্ধানে যেমন উন্মুখ আত্মসমালোচনায় তেমন পরাঙ্মুখ।

বাঙ্গালীর এই চরিত্র বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে প্রবলতর ভাবে যুক্ত হয়েছে মুসলমান হিসাবে নির্মোহ আত্মসমালোচনাকে ভয় এবং বিরোধিতার প্রবণতা। বরং মুসলমান এবং তার ধর্ম ইসলামের কোন রকম নির্মোহ বিশ্লেষণ বা সমালোচনাই মুসলমানের চরিত্রে সাধারণভাবে নেই। যদি থাকে তবে সেটা অন্তর্গত নয়, বরং বাহিরের চাপে বা প্রভাবজাত। কারণ মুসলমানের চেতনায় এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র সত্য ধর্ম। এবং স্বভাবত অলোকবাদী ধর্মে যুক্তির কোনও স্থান নেই, থাকতেও পারে না।

সুতরাং সে মনে করে ব্যক্তি হিসাবে মুসলমান ভুল বা দোষ করলেও মুসলমান হিসাবে সে যেমন সকল ত্রুটি ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে তেমন তার ধর্ম ইসলামও সকল ত্রুটি ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আর এভাবে মুসলমান নিজের শত-সহস্র সীমাবদ্ধতা, ক্ষুদ্রতা, নীচতা, ত্রুটি এবং দুর্বলতার প্রতি আশ্চর্য রকম অন্ধ হয়ে থাকতে পারে। পরিণতিতে প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে তার এই দুর্দশা; শুধু এ দেশে নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে।

এ দেশের জনগণের ব্যাপকতর বা গরিষ্ঠ অংশের স্বরূপ আমি ব্যাপকায়তনে প্রথম প্রত্যক্ষ করি ১৯৭১-এ। বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ সংগঠিত করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে আমি প্রত্যক্ষ করেছি বিশেষত বাঙ্গালী মুসলমান জনগণের ভূমিকা। সারা দেশের প্রতিটি গ্রাম ও শহরের কথা বলতে পারব না। তবে বহু সংখ্যক গ্রাম ও কিছু সংখ্যক শহর সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। তা থেকে আমার মনে হয়েছে সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও বিহারী বা হিন্দুর বাড়ী ও সম্পদ লুঠ করে নি এমন বাঙ্গালী মুসলমান দেশের বেশীর ভাগ এলাকাতেই তুলনায় সংখ্যালঘু ছিল। বড় শহরগুলোর ব্যাপার কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। কারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ভিতর লুঠেরা চরিত্র তুলনায় কিছুটা কম দেখেছি। তাছাড়া শহরে হিন্দুর সংখ্যা তখন খুব কম ছিল। একইভাবে কিছু সংখ্যক শহর ছাড়া অন্যান্য শহরে বিহারীরা সাধারণভাবে সংখ্যাল্প ছিল। আর গ্রামে তাদের বাস সেভাবে ছিল না বলাই ভাল। তবে লুণ্ঠনের শিকার হিন্দু এবং বিহারী সর্বত্রই ছিল। অবশ্য পাকিস্তানী সেনার সঙ্গে মিলে বিহারী মুসলমানদের বেশ বড় অংশ সাধারণভাবে বাঙ্গালী এবং বিশেষভাবে হিন্দুদের উপর হত্যা, অত্যাচার এবং লুণ্ঠন অভিযান পরিচালনা করেছিল, যখন ’৭১-এর দিনগুলিতে ক্ষমতার ভারসাম্য তাদের পক্ষে ছিল। বিহারীদের লুঠেরা ও আক্রমণাত্মক চরিত্র গঠনে তাদের ধর্ম যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

যাইহোক, এ দেশের জন-চরিত্রের সমস্যা বুঝবার প্রয়োজনে ’৭১ প্রসঙ্গে এখন আমি দুইটি ভিন্ন এলাকার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করব। আমি দিনাজপুর জেলার এমন এক প্রভাবশালী পল্লীর কথা বলতে পারি আমার জানা মতে যার তিনটি পরিবার ছাড়া আর সকল মুসলমান বাঙ্গালী পরিবারের কোন না কোন সদস্য ’৭১-এ পার্শ্ববর্তী হিন্দু বাঙ্গালী পল্লীগুলির বাড়ী ও সম্পত্তি লুণ্ঠনে অংশ নিয়েছিল।

আমি বর্তমান লালমণিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি সাধারণ মুসলামান বাঙ্গালীর চরিত্র অনুধাবনের সুবিধার জন্য। ১৯৭১-এর ঘটনা এটা। তখন লালমণিরহাট জেলা ছিল না। এটা ছিল তৎকালীন রংপুর জেলার অংশ, আর আদিতমারী ছিল কালীগঞ্জ থানার অংশ। লালমণিরহাট তখন ছিল বহুল পরিমাণে বিহারী অধ্যুষিত একটি ছোট শহর এবং রেলওয়ে জংশন। এটি এখনও জংশন। এই জংশন থেকে একটি রেললইন পশ্চিম দিকে সাত মাইল দূরবর্তী আদিতমারী স্টেশন হয়ে আরও কিছু দূর উত্তর-পশ্চিম হয়ে প্রায় সোজা উত্তরে সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম-বুড়ীমারীর দিকে চলে গেছে। আদিতমারী থেকে প্রায় সাত মাইল উত্তরে ভারত সীমান্ত। রেললাইনটা সীমান্ত রেখা থেকে কম-বেশী এই দূরত্ব কয়েক মাইল বজায় রেখে ক্রমে সীমান্ত থেকে দূরত্ব কমিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে গেছে।

ঘটনাটা ২৫ মার্চের পরপরই। তখন সারা দেশে এক দিকে পাক বাহিনীর আক্রমণ ও হত্যা অভিযান চলছে এবং অপর দিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এই সময় আদিতমারী স্টেশনের উত্তরের সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকার বিভিন্ন গ্রামের শত শত বা কয়েক হাজার লোক এসে স্টেশন এলাকায় বিহারীদের উপর হামলা করে। আদিতমারীর স্টেশন মাস্টার ছিলেন বিহারী এবং সেখানে রেলওয়ের কয়েকজন বিহারী কর্মচারীসহ আরও কয়েকটি বিহারী পরিবার বাস করত। আদিতমারী স্টেশন সংলগ্ন এলাকাটি ছিল আমার কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন এলাকার ভিতর। কিন্তু যারা হামলা করে তারা ছিল মূলত আমাদের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত এবং কিছু দূরের এলাকার লোকজন এবং তারা ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক। এই হামলাকারীরা বিহারীদের বাড়িঘরে ব্যাপক লুঠতরাজ চালায়, ধারালো অস্ত্রে অনেককে জখম করে এবং ফিরত যাবার সময় স্টেশন মাস্টারের কিশোরী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়, যার আর কোন খোঁজ কোনও দিন পাওয়া যায় নি। অনুমান করা চলে ধর্ষণ শেষে তাকে হত্যা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আমাদের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সদ্য যোগ দেওয়া কয়েকজনও এই হামলায় শরীক হয় এবং এমনকি একজন শিক্ষিত যুবক তাতে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নেয়। তবে দূরবর্তী স্থানের বাসিন্দা হওয়ায় এবং অল্প দিন হল আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল শিথিল। যাইহোক, ’৭১-এর ২৫ মার্চের পর তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে দেশের সাধারণ স্রোতে গা ভাসায়।

এই প্রসঙ্গে এ কথাও বলে রাখা উচিত হবে যে, যে দূরবর্তী গ্রামগুলোর লোকজন এই হামলা চালিয়েছিল তারা ছিল সাধারণভাবে ভাটিয়া অধ্যুষিত গ্রামগুলির বাসিন্দা, অর্থাৎ ভাটিয়া। তৎকালীন রংপুর জেলার বহু এলাকার মত আদিতমারীর বহু সংখ্যক গ্রাম হয়ে পড়েছিল ভাটিয়া অধ্যুষিত। স্থানীয় লোকজন ভাটি অঞ্চলের মানুষ অর্থে দক্ষিণ দিক থেকে আগত অভিবাসীদেরকে ভাটিয়া বলত। ঐ এলাকায় সাধারণত তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানের লোকজন বসতি স্থাপন করেছিল। এদের এক বড় অংশ ছিল নদীভাঙ্গা এলাকার লোকজন। তাছাড়া রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর অনাবাদী বা পতিত জমি ছিল। ফলে ভাটি অঞ্চলের বহু সংখ্যক দরিদ্র মানুষ নিজেদের স্বল্প পরিমাণ জমি-ভিটা যা ছিল তা চড়া দামে বিক্রি করে দিয়ে রংপুর-দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় সস্তা দামে অনেক বেশী পরিমাণ জমি কিনে এখানে বসতি করত। এভাবে বহু গ্রাম সম্পূর্ণরূপে ভাটিয়া অধ্যুষিত হয়ে পড়েছিল। বিশেষত হিন্দু পল্লী-গ্রামগুলি হত এদের লক্ষ্যবস্তু। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরেও অনেক দিন পর্যন্ত রংপুর-দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নিরঙ্কুশভাবে হিন্দু অধ্যুষিত পল্লী-গ্রাম ছিল অসংখ্য। আদিতমারীর সীমান্তবর্তী পল্লী-গ্রামগুলিও এক সময় হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। কিন্তু মুসলমান বিশেষত ভাটিয়া মুসলমানদের অত্যাচারে তারা দেশ ছাড়া হতে বাধ্য হয়। স্বল্প মূল্যে অথবা বিনা মূল্যে জমি বিক্রি করে বা ফেলে রেখে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ভারতে চলে যায়। আদিতমারীতে আমরা খুব অল্প সংখ্যক ভাটিয়াকে বামপন্থী কৃষক আন্দোলনে পেয়েছিলাম। বরং স্টেশন সংলগ্ন পল্লীগুলিতে হিন্দুদের ভিটা জবরদখলকারী দুর্বৃত্ত ও সমাজ-বিরোধীদের, যারা ছিল ভাটিয়া, তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদেরকে এলাকা ছেড়ে চিরকালের জন্য পালাতে বাধ্য করি।

তবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা অল্প কিছু সংখ্যক ভাটিয়া কর্মী ও সমর্থক পেয়েছিলাম। তারা সাধারণভাবে এ ধরনের লুঠতরাজে অংশ নেয় নি। তাদের পল্লীগুলি ছিল আদিতমারীর কৃষক আন্দোলনের মূল কেন্দ্রের কিছুটা নিকটবর্তী। ফলে যোগাযোগ ছিল মোটামুটি ঘনিষ্ঠ। কিন্তু দূরবর্তী ও নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ভাটিয়াদের ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। তারা বরং ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছিল।

আদিতমারী এলাকা সেই সময় আমার কর্মস্থল হলেও আমি যুদ্ধ সংগঠিত করার প্রয়োজনে ঘটনার কয়েক দিন পূর্বে, ২৫ মার্চেরও পূর্বে, দূরবর্তী কোনও একটি জায়গায় গিয়েছিলাম। যেদিন ঘটনা ঘটে সেদিনই আমি ফিরে আসার পর ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারি এবং আমার কাজের মূল এলাকার লোকজনকে আক্রান্ত ও আহত বিহারীদের সাহায্যার্থে ভূমিকা নিতে দেখি।

সেই সময় দেখতে পাই হিন্দু পল্লীগুলিতে বিহারীদের উপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ ও উল্লাসের পরিবর্তে আতঙ্ক। কারণ তারা সঠিকভাবেই আঁচ করতে পেরেছিল যে, ঐ সব উৎসাহী আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং “জাতীয়তাবাদী” বাঙ্গালীদের পরবর্তী আক্রমণের শিকার হবে তারা। এবং তা-ই ঘটল।

কয়েক দিনের ভিতর পাক বাহিনী রংপুর-লালমণিরহাটের অধিকাংশ এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল। সঙ্গে সঙ্গে ঐ এলাকার ‘জয়বাংলা ওয়ালা বাঙ্গালীরা’ ‘আল্লাহু আকবর ওয়ালা মুসলমান’ হয়ে গেল। বিহারীদের উপর যারা ইতিপূর্বে আক্রমণ করেছিল ৪/৫ দিন পর তারাই প্রথম হিন্দু পল্লীগুলিতে আক্রমণ করল, হিন্দুদের ভিতর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের কাউকে কাউকে ধারালো অস্ত্রে জখম করল, লুটপাট চালালো। ইতিপূর্বে বিহারীদের উপর আক্রমণে নেতৃত্ব দানকারী যে যুবকের কথা উল্লেখ করেছি তাকে অবশ্য এদিকে আর দেখা যায় নি। হয়ত চক্ষুলজ্জার খাতিরে পরিচিত এলাকায় আর হামলা করতে আসে নি। অবশ্য তার সম্পর্কে আর কিছু জানি নি বা শুনি নি। কেউ কিছু বলতে পারে নি।

যাইহোক, তারপর আরও বৃহত্তর আয়তনে ভাটিয়া-স্থানীয় নির্বিশেষে মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য এলাকার পর এলাকা জুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পল্লীর পর পল্লী, গ্রামের পর গ্রাম থেকে এক দিকে পাক হানাদার বাহিনী এবং বিহারী এবং অপর দিকে বিভিন্ন দূরবর্তী এলাকার এবং প্রতিবেশী মুসলমানদের আক্রমণ থেকে প্রাণ ও সম্মান বাঁচাবার জন্য হিন্দুরা যে যেভাবে যেটুকু পারে সঙ্গে নিয়ে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় নিকটবর্তী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিল। শুধুমাত্র কৃষক সমিতির দৃঢ়বদ্ধ এলাকার অল্প কিছু সংখ্যক হিন্দু কর্মী মুসলমান কর্মীদের পাহারায় তাদের কিছু সম্পদ নিয়ে ভারতে যেতে পারল। বাকীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পথে পথে বাঙ্গালী মুসলমানদের লুণ্ঠনের শিকার হয়ে নিঃস্ব অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিতে পারল। এই ব্যাপকায়তনে লুণ্ঠনে যারা অংশ নিল তাদের বেশীর ভাগই কিন্তু গ্রামের সাধারণ কৃষক এবং দরিদ্র মানুষ। গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত ছেলেরা কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের লুঠতরাজে অংশ নিলেও তাদের সংখ্যা সাধারণত তুলনায় খুব কম ছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রে তারা নেতৃত্ব দিত। তবে অধিকাংশ লুণ্ঠনকারীই সাধারণত মাঝারী ও দরিদ্র কৃষক, দিন মজুর ছিল। তাছাড়া গ্রামের চোর-ডাকাতরাও সাধারণত যে যেখানে যেভাবে পারত রাস্তায় পাহারা দিত সীমান্তগামী হিন্দুদের সর্বস্ব কেড়ে নিবার জন্য। এমনকি ভারতে পলায়নকালে অনেক সময় মুসলমানরাও লুন্ঠনের শিকার হত। তবে এই বিষয়টাও জানা দরকার যে তুলনায় খুব কম সংখ্যক মুসলমান বাঙ্গালীকেই ভারতে শরণার্থী হতে হয়েছিল, বিশেষত সবকিছু ফেলে দিয়ে এবং সপরিবারে।

তবে পুনরায় এ কথা বলা উচিত যে, আদিতমারী-কালীগঞ্জের সীমান্তের নিকটবর্তী যে সব গ্রাম ভাটিয়া অধ্যুষিত ছিল সেখানকার লোকজনই অনেক বেশী সংখ্যায় লুঠতরাজে অংশ নিয়েছিল। তৎকালীন রংপুরের স্থানীয় মুসলমান গ্রামবাসীদের সংখ্যাগুরু অংশ সর্বদা ও সর্বত্র এমন ধরনের লুঠতরাজে অংশ নিয়েছিল ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং স্থানীয় অধিবাসীদের লুঠতরাজে অংশ নিবার সংখ্যাটা একেবারে প্রথম দিকের কয়েক দিন বেশ কম ছিল। এটা কিছু পরের দিকে বেড়েছিল যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ ভেঙ্গে পড়ে। আসলে তখন লোভ একটা সংক্রামক ব্যাধির মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন ও সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত বহু সংখ্যক গ্রামের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ, সম্ভবত তারাই এসব গ্রাম বা পল্লীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, এসব লুঠতরাজে অংশ নেয় নি, বরং বিরোধিতা করত। তবে সামগ্রিক অঞ্চলগত এবং জাতীয় পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তাদের বিশেষ কিছু করার ছিল না।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা উচিত হবে যে, দেশের সব জায়গায় পল্লী বা গ্রামের সংখ্যাগুরু বা বেশীর ভাগ লোক যে লুণ্ঠনে অংশ নিত ব্যাপারটা কিন্তু তেমনও নয়। কিন্তু এ ধরনের লুঠতরাজের বিরুদ্ধে প্রবল, সক্রিয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত জনমত যে অনুপস্থিত ছিল বিষয়টাকে সেভাবে দেখলে এই ধরনের ঘটনার ব্যাপকতার প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবন করা যাবে। বস্তুত এই রকম এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির পরিবর্তন সূচিত হয় ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্রুত পাল্টা আক্রমণ এবং প্রবেশ শুরু হলে। ততদিনে অবশ্য শুধু আদিতমারী এলাকার নয়, বরং সারা দেশের হিন্দুরা নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল।

যাইহোক, আদিতমারী রেলওয়ে স্টেশন এবং রেল লাইনের কিছু দূরবর্তী উত্তর দিকের সীমান্ত বরাবর সেই বিরাট এলাকার মানুষদের ভূমিকার যে বিবরণ ইতিপূর্বে দিয়েছিলাম তাদের পরবর্তী ভূমিকা পাকিস্তানের সহযোগী শক্তি হিসাবে দেখা দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেই সুযোগ তাদেরকে দেয় নি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং বিশেষ করে নিকটবর্তী বিহারী অধ্যুষিত লালমণিরহাটের বিহারীরা। কারণ ইতিপূর্বে তারা বিহারীদের রক্তে হস্ত রঞ্জিত করেছিল এবং সহায়-সম্পদ লুঠ করেছিল। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে থাকতে বাধ্য হয়। এবং সীমান্তবর্তী ঐ এলাকায় মুক্তি বাহিনীর চাপের কারণে পাক বাহিনীর প্রবেশ প্রায় ছিল না। ফলে এটা প্রায় মুক্ত অঞ্চল হিসাবে থেকে যায়। সেখানে ছিল মুক্তি বাহিনীর প্রায় অবাধ চলাচল এবং নিয়ন্ত্রণ। পাক বাহিনী ট্রেনে করে যাতায়াত করত এবং সীমান্তবর্তী ঐ এলাকাগুলিতে ট্রেন থেকে নামলেও রেল লাইন থেকে উত্তর তথা সীমান্তের দিকে বেশী দূর যেত না। প্রকৃতপক্ষে রেল লাইন হয়ে পড়েছিল উভয় পক্ষের নিয়ন্ত্রিত এলাকার মধ্যে বিভাজন রেখা।

যাইহোক, ’৭১-এর যুদ্ধের সময় সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার বাঙ্গালী, বিহারী, হিন্দু-মুসলমান ইত্যাদি মানুষের আচরণ ও ভূমিকা কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার অথবা শুনার ও জানার সুযোগ হয় আমার। স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে সারা দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে আমাকে বিপুল ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। একাধিকবার অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম। তবে ’৭১ ছিল আমার জাতি ও ধর্মসম্প্রদায় বা সমাজকে চিনবার ও বুঝবার জন্য আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, যখন ক্ষুদ্রায়তনে ও বৃহদায়তনে তাদের চরিত্র ও ভূমিকা আমার সামনে ধরা পড়ে।

তারপর থেকে জনগণ শব্দ সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়ে আমি বছরের পর বছর চিন্তা করেছি এবং আরও বিভিন্ন অভিজ্ঞতা এবং অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছি যে, জনগণের জন্য সহানুভূতির অর্থ এই হওয়া উচিত নয় যে তাদেরকে পূজা করতে হবে। মানুষ নিয়ে যেহেতু জনগণ গঠিত সেহেতু দোষ-গুণ সমন্বিত মানুষের মতই তাদের আচরণ হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় যে উপলব্ধি আমার ভিতর পূর্বের তুলনায়ও অনেক বেশী দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে তা হল মুসলিম সমাজের সাধারণ মানুষ বা জনগণ অন্য যে কোনও ধর্মীয় বা সংস্কৃতির সমাজের মানুষ বা জনগণ থেকে বহু বিষয়েই খুব বেশী ভিন্ন। ইসলাম ধর্ম মানুষের চিন্তা-চেতনার উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে সে সম্পর্কে ইতিপূর্বে মূল গ্রন্থে আলোচনা করেছি। সুতরাং এ সম্পর্কে আর আলোচনা করব না। ভূ-প্রাকৃতিক কারণে দুর্বল এবং চইরা বাঙ্গালী চরিত্রের সঙ্গে ইসলামের প্রভাব যুক্ত হওয়ায় আরও যে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে সে সম্পর্কেও পূর্বে কিছু আলোচনা করায় এ বিষয়েও পুনরুক্তি করতে চাই না।

মুলসমান এবং হিন্দু নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালীর মুক্তি ও উন্নতির পথ হিসাবে আমি দেখতে পেয়েছি লোকবাদী জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর আত্মপ্রতিষ্ঠাকে, যার অনিবার্য পরিণতি হবে অখণ্ড বা ঐক্যবদ্ধ বঙ্গ-রাষ্ট্রে স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে সমগ্র বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ। ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ ও বাঙ্গালীর যে বিভাজন ঘটেছিল তার অবসান হবে এভাবে। এইভাবে আমি জাতীয়তাবাদকে দেখতে পেয়েছি ধর্মের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত করে একটি যুক্তি নির্ভর, বিজ্ঞান মনস্ক এবং লোকবাদী সমাজ ও জাতি প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসাবে। এবং সেইভাবে এই গ্রন্থে বাঙ্গালীর সঙ্কটের প্রতিকার সন্ধান করেছি।

কিন্তু প্রায় দুই দশক পর আজ যখন এই গ্রন্থ পুনরায় পাঠ করি তখন প্রতিকার সন্ধানের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সীমাবদ্ধতা আমার চোখে ধরা পড়েছে। সেটি হচ্ছে ধর্ম বিশেষত ইসলাম ধর্মের সমস্যাকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমি শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদের উপর গুরুত্ব দিয়েছি। অর্থাৎ একটা সর্বাত্মক সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি এখানে সামাজিক দিকটাকে যথাযথভাবে ধরি নি বা আলোচনায় আনি নি। ইসলামের সমস্যাকে মোকাবিলা ও সমাধানের জন্য সবচেয়ে কার্যকর যে সামাজিক শক্তি সমাজের অভ্যন্তরেই নিহিত রয়েছে তাকেই ধরতে না পারার বিষয় এটা। অথচ ঐ একই সালে অর্থাৎ ১৯৮৯-তে লিখিত “জাতির মুক্তি কোন পথে” এবং “মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ” নামক গ্রন্থে এই বিষয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সেটি হচ্ছে নারীর মুক্তির পূর্বশর্ত স্বরূপ নারীর স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়। ১৯৯৬-তে লেখা “রাজনীতির পুনর্বিন্যাস”-এ আমি আরও বিস্তারিতভাবে এই বিষয় আলোচনা করেছি। বস্তুত নারীর স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামোর প্রশ্ন বাদ দিয়ে কোনও মুসলিম সমাজেই সমাজ বিপ্লব সম্পন্ন করা অসম্ভব।

কিন্তু বাঙ্গালীর জাতিগত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দিকটাকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তার সামাজিক দিকটাকে এই গ্রন্থে অবহেলা করা হয়েছে। এখন যতদূর মনে পড়ে তখন নারীর বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ভিন্ন লেখায় আনতে চেয়েছিলাম। এক গ্রন্থে একই সঙ্গে সব বা বিভিন্ন বিষয়ের উপর সম গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে এ বিষয়ে ইঙ্গিত থাকা উচিত ছিল। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতা কাঠামোকে সামনে আনার গুরুত্ব এবং তাগিদ পরবর্তী কালে যেভাবে জোরালো হয়েছিল এই গ্রন্থ লেখার সময়ে সেটা ততটা জোরালো ছিল না।

এটা অবশ্য বহুকাল ধরে আমার কাছে স্পষ্ট যে, সমগ্র মানব জাতির জন্য নারীর স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও মুসলিম সমাজের জন্য এটিই প্রকৃতপক্ষে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা ঠিক যে বহু সংখ্যক মুসলিম দেশে নারীর স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামো গড়ার চিন্তা ব্যতিরেকেই রাষ্ট্র বিপ্লব হয়েছে। পুরাতন রাজতন্ত্রের বদলে একদলীয় অথবা বহুদলীয় রাজনৈতিক শাসন এবং পুরাতন পশ্চাৎপদ প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার বদলে আধুনিক যন্ত্রশিল্প নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থাও প্রবর্তিত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে অনেক দেশেই কম-বেশী ভূমি সংস্কারও হয়েছে। সাধারণভাবে এইসব পরিবর্তনে নেতৃত্ব এসেছে সেনাবাহিনী থেকে। এবং এই সকল পরিবর্তন ঘটেছে প্রধানত আন্তর্জাতিক চাপে। আসলে আধুনিক সভ্যতার সূত্রপাত ও বিকাশে ইসলামী সমাজের স্বকীয় কোনও ভূমিকাই নেই। বরং বলা উচিত ইসলামী সমাজ আধুনিক সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে পাশ্চাত্যের অধীনতায় অথবা চাপে।

কিন্তু তারপরেও দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক কিছু বাধ্যতামূলক অগ্রগতির পর প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশের পশ্চাদগতি ঘটছে। এ ছাড়া ব্যাপক দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, নারী নির্যাতন এবং সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের ক্রমবিস্তার বা ব্যাপকতা মুসলিম পৃথিবীর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন কি গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থার দেউলিয়াত্বও প্রায় সর্বত্র প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। কামাল পাশার দেশ তুরস্কের পশ্চাদগতি এবং নির্বাচনের মাধ্যমে গোঁড়া বা মৌলবাদী ইসলামী শক্তির ক্ষমতায় আরোহণ তার একটি মূর্ত দৃষ্টান্ত।

চরম প্রতিক্রিয়াশীল, আক্রমণাত্মক, সহিংস, স্বৈরতন্ত্রী এবং একনায়কী ধর্মের শক্তিকে প্রতিহত করার যথাযথ সামাজিক শক্তিকে ধরতে না পারা এবং তাকে যথাযথ সামাজিক ভূমিকায় আনতে না পারাই এর প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজের মূল সমস্যাটা ধরতে পারার জন্য এটা বুঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলাম শুধু পুরুষের ধর্ম নয়, উপরন্তু এটা চরম স্বৈরতন্ত্রী, একনায়কী, সহিংস এবং আক্রমণাত্মক পুরুষের ধর্ম, যেখানে সমাজ তথা মানব জাতির অর্ধেক অংশ নারী পুরুষের ভোগ ও সম্ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুত স্বেচ্ছামূলক পদ্ধতির পরিবর্তে জবরদস্তি বা চাপ প্রয়োগ ও যুদ্ধ নির্ভর এবং উৎপাদনশীলতার পরিবর্তে লুণ্ঠন নির্ভর একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের উত্থান ঘটাবার প্রক্রিয়ায় যে ধর্ম প্রবর্তিত হয় তার প্রভাব সমগ্র চেতনাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে আছে যে পুরুষ চেতনার পক্ষে একা এই জায়গা থেকে নিজেকে বা সমাজকে মুক্ত করা অসম্ভব। সামাজিক বিবেচনায় ইসলাম নিরঙ্কুশ পুরুষের ধর্ম যেখানে নারী সত্তার অস্তিত্ব থাকে না। ফলে এটা নম্রতা ও সহিষ্ণুতার পরিবর্তে সহিংসতা ও আক্রমণাত্মকতার উপর সর্বাধিক জোর দেয়। এটা এমন এক একনায়কী পুরুষবাদী ধর্ম যেখানে সমাজের ক্ষেত্রে একজন একনায়কী সামরিক পুরুষ শাসকের অধীনে সমগ্র সমাজ এবং পরিবারের ক্ষেত্রে একজন একনায়কী পুরুষের অধীনে তার এক বা একাধিক স্ত্রী এবং অধিকারভুক্ত দাসী বা নারীগণ অবস্থান করে। এই অবস্থায় পুরুষ ও সমগ্র সমাজ চেতনাকে এমন একটি ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত ক’রে লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক চেতনা প্রতিষ্ঠা করার প্রধান শর্ত সমাজের অর্ধেক অংশ বা শক্তি নারীর মুক্তি। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সমাজে সামাজিক বিপ্লবের তাৎপর্য হচ্ছে সর্বস্তরে পুরুষের পাশাপাশি সমাধিকারের ভিত্তিতে নারীর স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা। নারীর এই স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে বাঙ্গালীর লোকবাদী জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি দিবাস্বপ্ন হয়েই থাকবে।

বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের কারণ এবং সঙ্কট প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধানের সময় নারীর বিষয়টিও তা-ই অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। এখানে সেই বিষয়ে কিছুটা ইঙ্গিত দিলেও এটি বিশদ ও স্বতন্ত্র আলোচনার দাবী রাখে। সুতরাং এই বিষয়ে আর আলোচনা করে গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাই না।

৮ নভেম্বর,২০০৮ 

------------------------------------------------------------

‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রথম প্রকাশ ৩০ নভেম্বর, ২০০৮

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ