লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ February 20, 2021, 12:00 AM, Hits: 1384
কে অভিজাত? কেইবা উচুকোটির মানুষ? যদি মুখের ভাষায় চিনতে চান, তাহলে কিভাবে চিনবেন তাকে? শুদ্ধভাবে বাংলা বললে? না, শুদ্ধভাষায় বাংলা বললে তাকে সমাজের উচুকোটির মানুষ হিসেবে এখন আর বিবেচনা করা হয় না। তাহলে সমাজের উচু দরের মানুষ বিবেচনা করার মাপকাঠি কি?
উচুদরের মানুষ প্রমাণ করতে হলে আপনাকে বাংলায় এক বাক্যের কুড়িটি শব্দের মধ্যে দশটি ইংরাজী বলতে হবে। এভাবে কথা বললে আপনি সমাজের উচুদরের মানুষ প্রমাণ করতে পারবেন। চাইকি ট্রেনবাসের টিকিট কাটতে যাবেন, হাসপাতালে রোগীভর্তি করতে যাবেন, কোনো সরকারি অফিস আদালতে যাবেন, সেখানে কাজ উদ্ধার করতে চাইলে আপনাকে এভাবে আধা বাংলা আধা ইংরাজী ভাষায় কথা বলে প্রমাণ করতে হবে যে আপনি শিক্ষিত ও ক্ষমতাধর মানুষ বটে। এভাবে আধা বাংলা আধা ইংরাজী বলে প্রমাণ করতে হবে আপনি স্মার্ট ও আধুনিক মানুষ। অপরদিকে শুদ্ধ ও আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলবে কারা। ‘অশিক্ষিত’ কিংবা স্বল্প শিক্ষিতরা। এই অবস্থা ইদানিংয়ের। আর এর আগে?
এর আগেও এই অঞ্চলের কথিত উচুদরের মানুষ প্রমাণ করতে স্মরণ নিতে হত উর্দু ফার্সি ও আরবির। বলতে হত, তাদের পূর্ব পুরুষ এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য থেকে। ইরান, আরব, তুরস্ক, উজবেকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান। রান্না হবে কাবাব পরোটা কোর্মা পোলাউ। কথায় কথায় ফার্সি উর্দু, তা না হলে তো আর কিসের অভিজাত। তাহলে বাংলা? সে তো নীচুজাতের ভাষা!
তার আগে ‘সংস্কৃত’ ভাষাজ্ঞান ছাড়া সমাজের অভিজাত প্রমাণ করা যেত না। কথায় কথায় সংস্কৃত ভাষার শ্লোক আওড়ানো ছাড়া জানাশোনাদের কাতারে যাওয়া যেত না। তুলসী দাস, কালীদাস থেকে উদ্ধৃতি দিতে হত হরহামেশা। আর বাংলার জায়গা তো কেবল ‘ম্লেচ্ছ’জনের কাছে। সমাজের নীচুস্তরের প্রকৃতজনের কাছে।
এভাবে হিন্দু ব্রাহ্মনরা বলবে সংস্কৃত আর আশরাফ মুসলমানরা বলবে ফার্সি উর্দু। নিজের এলাকা চেনার আগে মুসলমানরা চিনবে মক্কা মদিনা আর বাগদাদ, আর হিন্দুরা চিনবে গয়া কাশি বৃন্দাবন। দেশিয়দের মধ্যে যারা নিজেদের জাতে তুলতে চাইত, তাদের মধ্যে প্রবলরূপে এই প্রবণতা ছিল। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকত এবং অনুসরণ ও অনুকরণ করত কথিত অভিজাতদের। যেন বাংলা ভাষার কোনো বাপ মা নেই। এই ক্ষোভে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম গালাগালি করে বলেছিলেন-
‘বঙ্গেতে জন্মি যে জন হিংসে বঙ্গবানী/সেজন কাহার জন্ম, নির্ণয় ন’ জানি।’
বোঝা যায় বাংলা কোনো দিনই অভিজাতের দরবারে, জলসা ঘরে কিংবা হেরেমে জায়গা পায়নি। জন্মের পর থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে খুবই কম সময়ই। যক্ষের ধনের মত, চোখের মনির মত, হৃদয়ের আকুলতা আর ভাবের আবেগ দিয়ে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছে সাধারণ মানুষ। অন্ত্যতজনই বাংলাভাষার মা বাপ। মাতৃগর্ভের শিশুর মত তারাই নিজ গর্ভে লালন করেছেন, বিকশিত করেছেন বাংলাভাষাকে।
এই ভাষার যাদু ও অমিত শক্তি রয়েছে। যার সন্ধান পাওয়া গেছে, আরও সন্ধান বকেয়া পড়ে আছে। যে ভাষার পরশে জেগে উঠেছিল তদান্তিন পূর্ববাঙলায় জাতীয় মুক্তির আন্দোলন। যার ধারাবাহিকতায় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, তারপরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান এবং একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ। যে ভাষার গর্ভ থেকে একটি দেশের জন্ম হয়েছে, একটি রাষ্ট্র নির্মানের দিকে ইতিহাসকে ঠেলে দিয়েছে। সেই ভাষার অমিত শক্তি সহজেই আঁচ করা যায়।
ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন ভাষাতে আভিজাত্য খুঁজতে যাওয়ার যে প্রবণতা ছিল পূর্ববাংলার হিন্দু ও মুসলমাদের মধ্যে, তার মুখে প্রথম চপটোঘাত হানে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন। নিজভাষার মধ্যে যে মানিক রতন আছে, তার সন্ধান করার তাগিদ দিয়েছে অমর একুশে। বহু আগেই যা উপলব্ধি করেছিলেন মধু কবি। ‘হে বঙ্গজ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।’ বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বিদেশমুখীনতা থেকে অভিজাত মানুষকে ‘বাংলাদেশে’ ফিরিয়ে আনে। এই ভাষার অমিত তেজের সন্ধান দেয়। জানান দেয়, আমরাও পারি। গর্ব করার মত ভাষা সংস্কৃত আমাদের আছে। এজন্য বাইরের দিকে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকার দরকার নাই। সেই অর্থে একুশ মানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।
এর আগে ঊনিশ শতকে এই ভাষার পরশে জেগে উঠেছিল কলিকাতা। সেই নগরকে ঘিরে এসেছিল বাংলার রেনেসা। বঙ্কিম, মধুসুদন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখরা ছিলেন সেই রেনেসার প্রাণপুরুষ।
এই ভাষার যে এত শক্তি, এত সৌন্দর্য, তা সত্তে¡ও সেখানে কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। এই ভাষাকে বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষার উপযোগি করে গড়ে তোলা হয়নি। বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষা বাংলাতে যে সম্ভব সেটা বিজ্ঞানি জগদীশ চন্দ্র বসু বলে দিয়েছেন। এছাড়া বহু বিষয়ের ওপর উচ্চ শিক্ষা এখনো ইংরাজীতে হয়। বাংলা ভাষার সেই সব বিষয় এখনো উপযোগি করে গড়ে তোলা হয়নি। বাংলা ভাষাকে উচ্চ শিক্ষার উপযোগি ভাষা হিসেবে গড়ে তোলার আয়োজন অতিশয় যৎকিঞ্চিত। অর্ধশতক ধরে যথাযথভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা পাওয়ার পর এতদিন সেই গ্যাপ পূরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কেন হয়নি? তার গ্রহণযোগ্য জবাব খোঁজা দরকার। কারণ এখন তো সবখানেই বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার রয়েছে। কারণ বাঙালী সবভাষা শিখবে, তার আগে শিখবে বাংলা ভাষা। সম্মান করবে সকল ভাষাকে। অন্যান্য জাতিসত্তার ভাষাকেও দেবে মর্যাদার আসন। মাথা তুলে দাঁড়াক বাংলাদেশ। সেই কাজে হাত দেওয়ার এখনি সময়।
ইমেইল : imam.gazzali@gmail.com