লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক , আপডেটঃ October 20, 2021, 12:00 AM, Hits: 832
ইসলামের জিহাদী অনুসারীরা এবার হিন্দুদের দুর্গাপূজার উৎসবের সময় কয়েক দিন ধরে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে হিন্দুদের মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসগৃহ এবং সেই সঙ্গে তাদের শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাণ্ডব চালালো তা ইসলামের চিরায়ত রূপকেই নূতন রূপে দৃশ্যায়িত করল মাত্র। সুতরাং নিরীহ-নির্দোষ হিন্দুদের উপর দিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, মারধর এবং অগ্নিসংযোগের অভিযান বয়ে গেল। সরকার এবং জাতীয় মিডিয়া প্রকৃত অবস্থা চেপে যাওয়ায় সংবাদের জায়গা স্বাভাবিক নিয়মে নিয়েছে গুজব। এখন গুজব হোক আর প্রচার হোক আমি সামাজিক প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত নানান সূত্রে যা জানতে পেরেছি তা এক ভয়াবহ অবস্থার চিত্র তুলে ধরে। কয়েক দিন সরকার এবং প্রশাসন প্রায় সর্বত্র নির্বিকার চিত্তে নির্দোষ মানুষদের উপর এই অভিযান প্রত্যক্ষ করল। যথানিয়মে ঘটনা ঘটবার পর এক সময় সরকার, পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী হিন্দুদের ক্ষতস্থানে কিছু সান্ত্বনার মলম লাগানো হল। এসব আমরা আগেও অসংখ্যবার এ দেশে দেখেছি। রামু, নাসিরনগর, ভোলা কয়টা জায়গার নাম করব? সুতরাং আমরা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করি যে, চিরকালের মতো এবারও প্রকৃত দোষীরা পার পেয়ে যাবে এবং নূতন আরেক ঘটনা ঘটাবার জন্য প্রস্তুতি নিবে। অর্থাৎ বিচার এবং শাস্তি অতীতে যেমন হয় নাই এবারও তেমন হবে না। তবে হামলার মূল নায়কদেরকে এড়িয়ে কিছু ধরপাকড়ের তামাশা হতে পারে। বিশেষত এবার যখন বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা নিয়ে সারা পৃথিবী সোচ্চার হয়েছে এবং এমনকি জাতিসংঘও তদন্ত চেয়েছে তখন একেবারে চুপ করে বসে থাকা তো যাবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক প্রতিপক্ষ তো আছেই। তাদের ঘায়েল করার এমন সুযোগ কি সবসময় আসে? আর শয়ে শয়ে বা হাজার হাজার বেনামী অভিযুক্তের সংখ্যা পুলিশের অভিযোগের খাতায় ঢুকাতে পারলে যে উপরি আয়ের সুযোগ পাওয়া যেতে পারে তার আকর্ষণই বা অনেকের নিকট কম কী?
বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন কাঁদছে। দুর্গাপূজার মন্দিরে স্পষ্টতই ভূয়া কুরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে গত কয়েক দিন সারাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে নারকীয় হামলা ও বর্বরতা চালানো হয়েছে তা এক কথায় মর্মস্পর্শী। এই ঘটনা শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখজনক নয়, বরং যে কোনও বিবেকসম্পন্ন মানুষের জন্যও দুঃখজনক।
তবে গতানুগতিক বুলি না কপচে সমস্যার একেবারে মূলে হাত দিয়ে প্রশ্ন করাটা আমি উচিত মনে করছি যে, ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে বঙ্গের বিভাজন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ দেশ তথা বাংলাদেশ ভূ-খণ্ড থেকে অমুসলিম এবং বিশেষত হিন্দু বিতাড়নের যে ধারা চলছে তা থেকে মুক্তির কি কোনও পথ আসলে আছে? থাকলে সেটা কী?
এ প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম জনমিতির পরিবর্তনকে একটু বুঝার চেষ্টা করা যাক। ব্রিটিশ শাসনকালে অনুষ্ঠিত ১৯৪১-এর লোকগণনায় যেখানে এ দেশের জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ বা প্রায় ৩০ শতাংশ হিন্দু ছিল এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৪-এও যেখানে হিন্দু জনসংখ্যার শতকরা হার ছিল ১৩.৫০ শতাংশ সেটা এখন অনুমান ৮.৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। পাকিস্তান কালে না হয় এ দেশ থেকে হিন্দু বিতাড়ন অথবা দেশত্যাগের কারণে এভাবে হিন্দু সংখ্যাহ্রাসের কারণ আছে, কিন্তু তথাকথিত সেকিউলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও কেন ধর্মীয় জনসংখ্যায় এ ধরনের ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতা? মুসলিমদের জন্মহার যে তুলনায় খুব বেশী সেটা সর্বজন বিদিত। কিন্তু তাই বলে সেটা নিশ্চয় এমন নয় যে, হিন্দু জনসংখ্যায় এভাবে বিরাট ভারসাম্যহীনতা ঘটাতে পারে, তাও আবার এত অল্প সময়ের ব্যবধানে। এই প্রশ্নের সহজ উত্তর রয়েছে হিন্দুদের অব্যাহত দেশত্যাগের মধ্যে। তারা দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তর এবারকার দুর্গাপূজার সময়কার সারা দেশব্যাপী হিন্দুদের উপর পরিচালিত হামলার পর আর নূতন করে খুঁজবার প্রয়োজন নাই। আসলে বাংলাভাগের পর থেকে সংখ্যালঘু এবং দুর্বল হবার কারণে হিন্দুদের উপর মুসলিমদের যে অব্যাহত নির্যাতন ঘটেছে তার পরিণতি হচ্ছে হিন্দুদের এভাবে দেশত্যাগ। সব সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার যে খুব দৃষ্টিগোচর হয় তা নয়। কিন্তু নানান রূপে এটা সদাসর্বদা অব্যাহত থাকে।
এবং এখন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এটা অব্যাহত থাকবে ততদিন যতদিন এ দেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশাপাশি সংখ্যাগুরু মুসলিমরা থাকবে। সমস্যাটা হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রীষ্টানদের দিক থেকে নয়। আসলে মুসলিমরা সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে পারে না। এমনকি মুসলিমদের এক গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীর সঙ্গেও শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে না। সুতরাং পাকিস্তানে সংখ্যালঘু শিয়াদের উপর প্রায়শ সুন্নীদের হামলার ঘটনা ঘটে। এমনকি সেটা শিয়াদের মসজিদে নামাজের সময়ও বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ঘটতে পারে। এখন আমরা একইভাবে আফগানিস্তানের বিভিন্ন শিয়া মসজিদে সুন্নীদের দ্বারা নৃশংস বোমা হামলার ঘটনা সম্পর্কে জানছি। কোনও হামলায় শতাধিক নিহত এবং শত শত মুসল্লি আহত কিংবা পঙ্গু পর্যন্ত হচ্ছে। অর্থাৎ মুসলিমরা নিজেদের মধ্যেও শান্তিতে থাকতে পারে না। যে কোনও ছুতা ধরে হোক তাদেরকে হামলা এবং খুন করতে হবে। বিশেষত দুর্বল এবং সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায় পেলে তো কথাই নাই। যে কোনও ছুতায় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠন করবে, তাদের নারীদেরকে অপহরণ এবং ধর্ষণ করবে। জিহাদের লভ্য মাল বা গণীমতের মাল হিসাবে এসবই তাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বৈধ। যে ধর্ম ধর্মের অজুহাতে অন্যের সম্পদ এবং নারী লাভের এমন বিধান দিয়েছে সেই ধর্মের অনুসারীদের কাছ থেকে এমন আচরণ ছাড়া আর কীই বা আশা করা যায়? যে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জিহাদ তথা যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগ ও হিংস্রতার মধ্য দিয়ে সেই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাই মুসলিমদের এমন সহিংস করে তুলে। গত কয়েক দিন আমরা সেই সহিংসতারই সামান্য কিছু নমুনা দেখলাম।
সমস্যা হচ্ছে আজকের যুগে এভাবে বেশী দিন নির্বিবাদে লুঠতরাজ, হত্যা এবং নারী অপহরণ কিংবা ধর্ষণ করা যায় না। বিশেষ করে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ প্রযু্ক্তির এই যুগে এ ধরনের বর্বরতার চর্চার বিরুদ্ধে দ্রুত বিশ্বজনমত ফুঁসে উঠে। বাংলাদেশে সংঘটিত এই বর্বরতার বিরুদ্ধে পৃথিবীর দেশে দেশে হিন্দুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ রাজপথে নেমেছে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘ থেকেও বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা ও বর্বতার বিরুদ্ধে নিন্দা ও তদন্তের দাবী জানানো হয়েছে। এটা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য শুধু নয়, অধিকন্তু রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্যও অতীব লজ্জার। অবশ্য সংশ্লিষ্টদের লজ্জাবোধ যদি থাকে তবে।
যাইহোক, এবার হয়ত একটু বেশী প্রচার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য অসম্মান, নিরাপত্তাহীনতা সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে আছে এবং থাকবে। যতদিন্ এ দেশে সংখ্যালঘু অমুসলিম বিশেষত হিন্দুদের পাশাপাশি সংখ্যাগুরু মুসলিমরা থাকবে ততদিন। তাহলে কি হিন্দু এবং বৌদ্ধসহ সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ দেশ ত্যাগই একমাত্র পরিণতি এবং সমাধান? তারা গেলে তাদের জায়গা-জমি, চাকুরী, ব্যবসা এবং অবশিষ্ট অর্থ-সম্পদ বেশ কিছু সংখ্যক মুসলিমের করায়ত্ত হবে। অনুমান করি এখন বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা দুই কোটির কাছাকাছি। সুতরাং সব একত্র করতে পারলে জায়গা-জমিসহ সম্পদের পরিমাণ একেবারে কম হবে না। সেগুলি দখল করতে পারলে মুসলিমদের কয়েক দিন হয়ত ভালোই চলবে। তারপরই অবশ্য শুরু হবে নিজেদের মধ্যে হানাহানি এবং খুনাখুনি। মোটামুটি এটাই তো মুসলিম পৃথিবীর চিত্র। পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত দেশে দেশে কম-বেশী এই চিত্রই আমরা দেখতে পাই।
বাংলাদেশও তার বাইরে নাই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গালগল্প দিয়ে মুসলিমরা অনেক দিন চালালেও বুঝাই যায় এটার মধ্যে কতটা সত্য আছে, আর কতটা ধাপ্পা। একদিকে বলা হয় একাত্তরের যুদ্ধটা ছিল বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। অপর দিকে অক্ষুণ্ন রাখা হয় ধর্মপরিচয়ের ধারাবাহিকতা। সুতরাং ‘আমি বাঙ্গালী আমি মুসলমান’, বিসমিল্লাহ, আল্লাহ সর্বশক্তিমান, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সবই জায়গা করে নিয়েছে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারায়। এভাবে রাষ্ট্রের জন্য সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে আত্মঘাতী বৈপরীত্য। বললেই হত যে, একাত্তরের যুদ্ধটা হচ্ছে পাকিস্তানের মুসলিম ধারাকেই এগিয়ে নিবার যুদ্ধ, এবং এর সঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে অবস্থিত বাঙ্গালী জাতি-পরিচয়ের কোনও সম্পর্কই নাই। অর্থাৎ এ কথা বললেই হয় যে, একাত্তরের যুদ্ধ বাঙ্গালী মুসলিমদের মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। মুখে যা-ই বলা হোক বাস্তবে সেটাই করা হয়েছে। তাহলে এই রাষ্ট্রের জন্য এখন কী করণীয় হতে পারে? ইসলামী বিধান মেনে হিন্দুদেরকে মুসলিম হতে বলা আর নইলে জিজিয়া কর দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে সাময়িকভাবে এ দেশে বাস করার অধিকার দেওয়া। অবশ্য এ সবই সাময়িক বন্দোবস্ত মাত্র। শেষ পর্যন্ত মুসলিম না হলে হিন্দুদেরকে ভারতে যাবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। যেটা শেষ পর্যন্ত ঘটবেই সেই অনিবার্যতাকে আগেই বুঝে সেই অনুযায়ী কর্মপন্থা নির্ধারণ করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
এ ছাড়া বিকল্প যেটা থাকে সেটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ ধারার বাইরে অবস্থিত তৎকালীন পূর্ব বাংলার বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভিতর বাঙ্গালী জাতির ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে চেতনা ছিল সেই চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশকে ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার পথ গ্রহণ। এতকাল চেপে রাখা এই সত্যকে বুঝতে হবে যে, ষাটের দশকে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙ্গালীর ধর্মমুক্ত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি বামপন্থী বা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মই এ দেশে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কাজটা তত সহজ ছিল না। কারণ এই পথ বাঙ্গালী জাতিকে ধর্মমুক্ত করতে গিয়ে তাকে ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবে নিবে। এই প্রজন্ম বাঙ্গালীর একটা জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করতে পারলেও তারা সফল হয় নাই। আসলে তাদেরকে ধারণ করার মতো অগ্রসর সমাজ-জমি যেমন তখনও তৈরী হয় নাই তেমন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও তখন তাদের বিরুদ্ধে ছিল। একদিকে, তাদের নিজেদের অনভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বহীনতা, এবং অপর দিকে, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী অবস্থান এবং সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলাকে তিন দিক থেকে পরিবেষ্টন করে রাখা বিশাল ভারতের বৈরিতা তাদের সাফল্যের কোনও জায়গাই সেই কালে রাখে নাই। তবু তারাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের পথপ্রদর্শক এবং নির্মাতা। অন্যরা বাধ্য হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়ে তাদের কর্মফল আত্মসাৎকারী মাত্র। আর তাই দেশের এই হাল।
যাইহোক, বাংলাদেশে ধর্মের সমস্যা বুঝতে হলে আমাদেরকে এ কথা বুঝতে হবে যে, অন্যান্য বৃহৎ ধর্মের মতো ইসলাম শুদ্ধ সামাজিক ধর্ম নয় যে, ইসলামকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে দিলে তা সেটা নির্বিবাদে মেনে নিবে। এটা আপাদমস্তক রাজনৈতিক ধর্ম। সুতরাং রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত বা সেকিউলার ঘোষণা করলেই তাতে সমস্যা ফুরিয়ে যায় না। এই ঘটনাই তুরস্কে ঘটেছে। আজ থেকে শতাব্দী কাল পূর্বে মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্কে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে উচ্ছেদ করলেও সেটা পুনরায় দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এসেছে। কারণ ইউরোপের খ্রীষ্টান সমাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মপন্থা মুসলিম সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। খ্রীষ্টধর্মের বিপরীতে ইসলাম মূলত রাজনৈতিক এবং সামরিক ধর্ম। সুতরাং ইসলামের সমাজে খ্রীষ্টান সমাজের অনেক অভিজ্ঞতাই অচল। আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের প্রশ্নে ইউরোপকে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। আধুনিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় মুসলিম সমাজেও ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই অপরিহার্য। কিন্তু ইসলামের বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার কারণে সেই লড়াইয়ের পদ্ধতি ইউরোপীয় পদ্ধতি থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য।
যাইহোক, আজকের যুগ ধর্মের আধিপত্যের যুগ নয়। আরও বিশেষ করে ইসলামের মতো সামরিক-রাজনৈতিক ধর্ম আজকের যুগে একেবারে অচল। বিগত কয়েক দিনে বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর হামলা চালিয়ে মুসলিমরা সমস্ত পৃথিবীর সামনে ইসলামের স্বরূপ আর একবার উন্মোচিত করেছে। এ দেশে হিন্দু বা অমুসলিম সম্প্রদায় থাকলে তাদের উপর ভবিষ্যতে যে মুসলিমদের আরও হামলা ঘটবে সে ভবিষ্যদ্বাণী আমরা বর্তমান এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি। কেন মুসলিমরা এমন করে এটা বুঝতে হলে ইসলামকে নির্মোহভাবে বুঝতে হবে। কুরআন, হাদীস এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানই ইসলামকে বুঝার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। কিছু মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে ভিন্ন কিংবা মানবিক বা যুক্তিবাদী হতে পারে, কিন্তু সামাজিকভাবে মুসলিমরা কীভাবে ইসলামের মৌল শিক্ষা এবং ঐতিহ্যের বাইরে যাবে? প্রয়োজনে তারা অবিরাম শান্তির বাণী শুনাবে, ইসলাম শান্তির ধর্ম এ কথা বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলবে। জিহাদের ধর্ম হিসাবে এসবই ইসলামের ‘আল তাকিয়া’ বা প্রতারণার অংশ। এগুলি তাদেরকে অবিরাম বলতে এবং অবিরামভাবে তার বিপরীতটা করতে হবে। জিহাদ মানে তো ইসলামী যুদ্ধ। হাদীসের দরকার নাই। ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ কুরআন খুললে দেখা যাবে এটা নানান ছুতায় কীভাবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও সন্ত্রাস করাকে বৈধতা এবং এমনকি বাধ্যতা দিয়েছে।*
---------------------------
* কুরআনের ৯ নং সূরা তাওবার ২৯ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘ .... যাহারা আল্লাহে ঈমান আনে না ও শেষ দিনেও নহে এবং আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন তাহা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দীন অনুসরণ করে না; তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিবে, ....।’ (এখানে কুরআনের সকল অনুবাদের উৎস : আল কুরআনুল করীম, প্রকাশক : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা- ১২০৭, ছত্রিশতম মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০০৭।)
কুরআনের বহু আয়াতেই যুদ্ধ ও সহিংসতার পক্ষে বক্তব্য পাই। যেমন, ‘ তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়। কিন্তু তোমরা যাহা অপসন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা ভালবাস সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্ জানেন আর তোমরা জান না।’ (২:২১৬)।
বুঝাই যায় যে প্রথম পর্যায়ে মুসলমানদের মধ্যে ধর্মের প্রসারের জন্য সহিংসতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে জনমত বা আপত্তি ছিল তা দূর করার জন্য মুহাম্মদ আল্লাহর নামে এই ওহী হাজির করেন। কিংবা দেখা যাক এই আয়াত, ‘যাহারা কুফরী করে আমি তাহাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করিব; সুতরাং তোমরা আঘাত কর তাহাদের স্কন্ধে ও আঘাত কর তাহাদের প্রত্যেক আঙ্গুলের অগ্রভাগে।’ (৮:১২)। আমরা যুদ্ধের সপক্ষে কুরআনে বহু আয়াত দেখি, যথা, ২:১৯৩, ৮:৩৯, ৮:৬০, ৯:৫, ৬৬:৯, ইত্যাদি। বস্তুত কুরআন মুহাম্মদের কর্তৃত্ব ও একনায়কত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদানে অস্বীকারকারী তথা ইসলামে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ, হিংসা ও যুদ্ধের নির্দেশ পূর্ণ এমন একটি গ্রন্থ যে এটিকে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রদর্শন, যুদ্ধ ও হিংসার নির্দেশিকা বললে বেশী বাড়িয়ে বলা হয় না। এক কথায় ইসলামে অবিশ্বাস ও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের মূল সুর।
----------------------------
ব্যক্তি মুসলিমকে দিয়ে সব সময় সামাজিক বা সামষ্টিক মুসলিমকে বুঝা যাবে না। ইসলামের ধর্মীয় বিধানে যা আছে, যা ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অঙ্গীভূত হয়ে আছে তা দিয়ে মুসলিম সমাজের মন-মনন ও আচরণকে বুঝতে হবে। মুসলিম সমাজ গঠনের ডিএনএ-র ভিতরে যা আছে সামাজিকভাবে মুসলিম তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কী করে? দাঁড়ালে কি আর সেই সমাজ মুসলিম থাকবে?
বাংলাদেশে হিন্দু তথা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রতিক এবং সর্বশেষ মুসলিম হামলার পর ইসলাম এবং মুসলিম নূতন করে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে। আজকের ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে যে এসব এভাবে করে পার পাওয়া যায় না এ কথা জেনেও পুলিশ-প্রশাসন এবং সরকারের নাকের ডগায় থেকেই দুর্বৃত্তরা প্রায় নির্বিবাদে কয়েক দিন তাণ্ডব চালিয়েছে। সামান্য কিছু জায়গায় কিছু মুসলিম রুখে দাঁড়ালেও হানাদারদের শক্তির তুলনায় সেটা ছিল নগণ্য। সরকার এবং পুলিশ কী করেছে সে প্রসঙ্গে আমি এখানে যেতে চাই না। তবে যা কিছু ঘটেছে তার দায় সরকার, পুলিশ এবং প্রশাসনকেই নিতে হবে।
এখন প্রতিকারের প্রশ্নে গেলে ধর্ম তথা ইসলামের প্রশ্নে যেতে হবে। বাংলাদেশের মতো একটা ইসলামী সমাজে রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক বা মৃক্ত করার করণীয় সম্পাদন প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বাধীনতা এবং অধিকার দাবী করে। সেটা করতে না চাইলে কিংবা তার বিরোধিতা করলে বরং হিন্দুসহ এ দেশের সকল অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবার পরামর্শ দিতে হবে। অবশ্য যেতে যদি হয় তবে সময় থাকতে এখনই দেশ ছেড়ে যাওয়া উচিত নয় কি?
তবে আমি এমন মতের ঘোর বিরোধী। বরং আমি চাইব হিন্দুরা রুখে দাঁড়াক এবং ষাটের দশকের বিপ্লবী পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশকে যারা ধর্মমুক্ত এবং লোকবাদী রাষ্ট্র হিসাবে পুনর্নির্মাণ করতে চাইবে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক নূতন পথের যাত্রা শুরু করুক। ভয়ের কিছু নাই। ধর্মের বিভীষিকার কাল পৃথিবীব্যাপীই শেষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও নানান রূপে এবং নানান কৌশলে বিশেষত ইসলামকে ব্যবহার করে গত পঞ্চাশ বৎসর ধরে যে দুর্বৃত্তায়িত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেটা এখন দেউলিয়াত্বের চরম সীমায় পৌঁছেছে। এখন বাংলাদেশ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে দেশ হয় পথ পরিবর্তন করবে, নয় ধ্বংস হবে। ইতিমধ্যে অনেক দিক থেকেই বাংলাদেশ নিজেকে একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এখন বাকী আছে তার ধ্বংস। পথ পরিবর্তন না করলে এই রাষ্ট্রের বিলুপ্তি এখন অনিবার্যতা হয়ে দেখা দিবে। যারা ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় অর্থ-সম্পদ এবং পরবর্তী প্রজন্মকে পাচার করে সেখানে নিজেদের দ্বিতীয় আবাস গড়েছে তাদের না হয় ভাবনা নাই। বিপদ দেখলে তারা দেশ ছেড়ে পালাবে। কিন্তু সবার তো ব্যাংক ব্যাল্যান্স কিংবা সেকেন্ড হোম বিদেশে নাই। তাদের জন্য বিকল্প ভাববার সময় হয়েছে। তাদেরকে ঠিক করতে হবে এই রাষ্ট্রের পুনর্গঠন তারা করবেন কি করবেন না সেই বিষয়। আর সে কাজ করতে চাইলে ইসলামের স্বরূপ উন্মোচনের গুরুত্বও অনুধাবন করতে হবে।
১৯-২০ অক্টোবর, ২০২১