Banner
ইডেন ছাত্র লীগ এবং বাবুল-বনজ প্রসঙ্গ : পাপের ভরা কি এখনও পূর্ণ হয় নাই? — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 2, 2022, 12:00 AM, Hits: 840

 

বিষয়সূচী :

(১) ইডেন কলেজের পরিস্থিতির কদর্যতা ও ভয়াবহতা

(২) ভাবছিলাম এখন এ নিয়ে লিখব না

(৩) বনজ কুমারের ব্যাপারটা কী?

(৪) আওয়ামী লীগ সরকারের যাবার সময় কি হয়েছে?

(৫) একটু ভিন্নভাবে ভাবা যাক

 

(১) ইডেন কলেজের পরিস্থিতির কদর্যতা ও ভয়াবহতা

ইডেন সরকারী মহিলা কলেজের ছাত্র লীগ নেতৃত্বের যে বীভৎস কর্মকাণ্ডের চিত্র এখন সমগ্র জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে, তা যে কোনও বিবেকবান মানুষের মনকে ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করার জন্য যথেষ্ট। এই কলেজের ছাত্রী সংখ্যা এখন ৩৫ হাজার। এ দেশের নারীদের জন্য এত বৃহৎ এবং ঐতিহ্যবাহী একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতরের যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা সত্যিই অতীব ঘৃণ্য এবং হৃদয় বিদারক। শুধু যে সিট বাণিজ্য কিংবা টেন্ডারবাজী থেকে শুরু করে নানাবিধ অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগের মধ্যে এই নেতৃত্বের কর্মকাণ্ড সীমিত তা নয়, আন্দোলনকারী ছাত্রীদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় ছাত্র লীগ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের যোগসাজশে ইডেন কলেজের ছাত্রীদের অনেককেই বেশ্যাবৃত্তি বা পতিতাবৃত্তিতে যোগ দিতে বাধ্য করে। ছাত্রীদের অভিযোগ অনুযায়ী বেশ্যাবৃত্তির চক্রটিকে পরিচালনা করে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্র লীগ সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা এবং সাধারণ সম্পাদক মোসাঃ রাজিয়া সুলতানা।

প্রথম দিকে এ দেশের মূলধারার প্রচারমাধ্যমে ভিতরের কদর্য এই ঘটনাকে যতই চাপা দিবার চেষ্টা হোক এটা এখন সর্বত্র প্রচার হয়ে গেছে। তাতে জানা যাচ্ছে যে, ইডেনের নারী নেতারা তাদের বাছাই করা কলেজ ছাত্রীদের আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পুরুষ মন্ত্রী, সাংসদ, নেতা এবং এমনকি বিভিন্ন ধনী ব্যক্তির নিকট তাদের মনোরঞ্জনের জন্য যেতে বাধ্য করে। তারা যেসব সুন্দরী ছাত্রীদের টার্গেট করে তাদের বেশীর ভাগই আসে আবার মফস্বল থেকে। ঢাকায় এদের থাকার জায়গা এবং শক্তিশালী অভিভাবক না থাকার সুযোগ তারা নেয়। তারপর দেয় বিভিন্ন পর্যায়ের পুরুষদের মনোরঞ্জনের প্রস্তাব। যে সব ছাত্রী রাজী হয় না কলেজের হোস্টেল কক্ষে নিয়ে তাদের উপর চলে দলবদ্ধভাবে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন এবং জোর করে উলঙ্গ করে পরবর্তী সময়ে ব্ল্যাকমেইল করার উ্দ্দেশ্যে চিত্র গ্রহণ, হোস্টেল থেকে বহিষ্কার ইত্যাদি। এভাবে ছাত্র লীগ নেতৃত্বের এই চক্র ইডেন মহিলা কলেজের মত বাংলাদেশের ঐতিহ্যশালী এবং খ্যাতিমান একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পরিণত করেছে শিক্ষিত বেশ্যা তৈরীর প্রতিষ্ঠানে। কী মর্মান্তিক! কী কদর্য! কী ঘৃণ্য!

এখন সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, এই কর্মকাণ্ড এখন প্রকাশ পেলেও এটা শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবার পর থেকেই। অর্থাৎ ১১/১২ বৎসর পর আওয়ামী লীগের পাপ ইডেন কলেজের ছাত্রীদের এক আন্দোলনের বিস্ফোরণের মাধ্যমে প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এই বিস্ফোরণটাও ঘটিয়েছে ইডেন কলেজ ছাত্র লীগের আর এক অংশ, যাদের কে্উ কেউ কলেজ ছাত্র লীগের নেতৃত্বে থাকলেও এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করে হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে। এখন বেরিয়ে আসছে ইডেন গার্লস কলেজে কী এক ভয়ঙ্কর পাপ এবং অপরাধের রাজত্ব কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ সেটা। এতে কোনও সন্দেহ নাই যে, ইডেনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। বরং এটা আওয়ামী লীগ এ দেশে যে দানবীয় দুর্বৃত্ত শাসন কায়েম করেছে তারই একটা খণ্ডাংশের প্রকাশ মাত্র। এখন অনুমান করা যায় সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও কীভাবে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী এবং মাস্তানীর পাশাপাশি ইডেন ধরনের বাধ্যতামূলক বেশ্যাবৃত্তির প্রসার ঘটানো হয়েছে। এই অনুমান যদি কেউ করে তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে কী করে? বরং এই অনুমানটাই তো হবে একান্ত যৌক্তিক।

 

(২) ভাবছিলাম এখন এ নিয়ে লিখব না

ভাবছিলাম শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে যৌথভাবে ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’ নামে যে বই লিখায় হাত দিয়েছি সেটা সম্পূর্ণ করার আগে অন্য দিকে আর মন দিব না। বইটার দুই খণ্ড লিখে প্রকাশ করেছি আমরা। এখন তৃতীয় খণ্ড লিখার কাজ চলছে। যারা বইটা পাঠ করছেন বা করেছেন তারা বুঝবেন কতটা কঠিন এবং জটিল একটা কাজে আমাদের মনকে নিমগ্ন রাখতে হয়। স্বাভাবিকভাবে আমার অন্য কোনও বিষয় নিয়ে মনকে ব্যস্ত করার ইচ্ছা ছিল না। আমার মূল কাজের বাইরে কিছু খবর রাখতে হয়। সুতরাং বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যমে কিছু করে খবর পড়ি এবং শুনি। কিন্তু লেখার ব্যাপারটা ভিন্ন। এতে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়।

কিন্তু ইডেনের সাধারণ ছাত্রীদের কান্না এবং ক্ষোভ দেখবার এবং জানবার পর আমার পক্ষে আর নিরাসক্ত থাকা সম্ভব হল না। জানি লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে প্রতিকার এবং প্রতিবিধান কিছুই হবে না। হয়ত বড় জোর কিছু নামকা ওয়াস্তে শাস্তির প্রলেপ দেওয়া হবে আওয়ামী লীগের হাইকম্যান্ড থেকে। এবং দিবে তো তারাই যারা মূলত এই পাপচক্রের হোতা এবং স্রষ্টা। সুতরাং সেই ভরসায় আমি লিখছি না। বরং নিজের মনের ভিতরের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য এই লেখা।। কিছুটা ক্ষোভের প্রকাশ যেমন ঘটবে তেমন আমাদের সমাজের মৌল সমস্যাগুলির উপর নূতন করে কিছু আলোকপাত করতে চাওয়াও এই রচনার উদ্দেশ্য। তবে পরবর্তী পর্যায়ে যাবার আগে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আর একটা বিষয়ের উপর কিছু কথা বলতে চাই। আসলে আমি যে প্রসঙ্গকে এই আলোচনায় আনতে চাই সেটার সঙ্গেও এ্টা সম্পর্কিত। প্রসঙ্গটা নিজ স্ত্রী মিতু হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দী পুলিশের সাবেক এসপি বাবুল আক্তার এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই-এর বর্তমান প্রধান বনজকুমার মজুমদার সংক্রান্ত।

 

(৩) বনজ কুমারের ব্যাপারটা কী?

পিবিআই সম্পর্কে আলোচনা ঝুঁকিপূর্ণ। তার উপর এটা বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ শাসিত বাংলাদেশ। তবে আমার কাছে বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে বলে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করতে চাইছি মাত্র। এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার ব্যাপারটা সম্পর্কে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম। পরে জানলাম যে বাদী এসপি বাবুল নিজেই স্ত্রী হত্যার আসামী। এ ব্যাপারে পিবিআই প্রধান বনজ কুমারের প্রেস ব্রিফিংও দেখেছিলাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার ছিল না। এ নিয়ে তেমন মাথাও ঘা্মাই নাই। অসংখ্য ঘটনার ভীড়ে বাবুল-মিতুর ঘটনাও তলিয়ে গেছিল। আর আমার বই লিখবার ব্যস্ততার ব্যাপার তো ছিলই।

আনুমানিক ১২/১৩ দিন আগের ঘটনা। তার আগে ৭/৮ দিন ধরে কয়েক বার বাবুল আক্তারের উপর ইলিয়াস হোসাইনের একটা সম্ভবত এক ঘন্টার ইউটিউব ভিডিও-এর নোটিশ আসছিল। কিন্তু আমি ইলিয়াস হোসাইনের ভিডিও দেখি না। পড়া ও শুনার ক্ষেত্রে আমি খুব রক্ষণশীল মানুষ না হলেও তার উগ্র ইসলামবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং অনেক সময় অরুচিকর বক্তব্যের জন্য বহুদিন ধরেই আমি তার ভিডিওর বক্তব্য শুনি না। সুতরাং তার অন্যসব ভিডিও-র মত এই ভিডিওকেও এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ১২/১৩ দিন আগে আলোচনার বিষয়বস্তু পড়ে দেখবার পর শুনবার আগ্রহ হল। এবং শুনতে গিয়ে আমি স্তম্ভিত এবং অভিভূত হলাম।

ইলিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গী এবং চিন্তাধারাকে আমি যতই অপছন্দ করি তার তথ্য চয়ন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব এবং সংবাদ পরিবেশনের দক্ষতা আমাকে অভিভূত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এবং আমি এসপি বাবুল আক্তারের বিষয়টাকে সম্পূর্ণ নূতন করে ভাবতে বাধ্য হলাম। এখন আমার মনে প্রশ্ন এসেছে, রাষ্ট্র এবং সরকার কি এত বড় একটা অন্যায় এবং অপরাধ করেছে বাবুল আক্তার এবং তার স্ত্রী মিতুর প্রতি? আসলে কি কোটি কোটি টাকার আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিবার কারণে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের শিকার করা হয়েছে এসপি বাবুল আক্তারকে? এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই কি বাবুলকে ফাঁসানোর জন্য বাবুলের স্ত্রী মিতুকে হত্যা করা হয়, যাতে জড়িত বনজ কুমারসহ পুলিশ বিভাগের একটা অংশ?

ভিডিওটা লক্ষ লক্ষ লোক দেখেছে। আমি যখন দেখি তখনই ওটার ভিউ হয়েছিল কম-বেশী সাড়ে ঊনিশ লক্ষ। অর্থাৎ প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ এটা ১২/১৩ দিন আগে শুনেছিল। এখন সেই সংখ্যা সম্ভবত আরও বহু লক্ষ বেড়েছে। এখন দেখছি পিবিআই ইলিয়াস, বাবুল ইত্যাদি কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীটা বাংলাদেশ নয়, শেখ হাসিনা বা বনজ কুমারের শাসনাধীনও নয়। আর ইলিয়াসের মত যারা বিদেশে থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে বনজ কুমার দূরের কথা বাংলাদেশ-রাষ্ট্রেরও কিছু করার নাই। সুতরাং তাদের মুখ বন্ধ করার কোনও উপায়ই নাই। বরং এই ধরনের মামলা এবং হুমকি শুধু বনজের জন্য্ নয়, অধিকন্তু সরকারের জন্যও সমস্যা বৃদ্ধি করতে পারে। এখন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নয়, অধিকন্তু কোটি কোটি মানুষ বিষয়টা জানবে এবং এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিবে।

বস্তুত কয় লক্ষ বা কয় কোটি পাবলিক জানল সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল পুলিশ এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর এর কী প্রভাব পড়বে সেটা। বিশেষত সমগ্র পুলিশ বিভাগের উপর এখন এই ভিডিওর প্রভাব পড়তে বাধ্য। আমি জানি না কোন উপায়ে এই প্রভাবকে রাষ্ট্র মোকাবিলা করবে। সবচেয়ে বড় কথা ইলিয়াসের প্রতিবেদনে যদি কিছুমাত্র সত্যতা থাকে তবে সেটার ফল হবে কিন্তু দূরপ্রসারী এবং মারাত্মক। এখনই হয়ত বনজ কুমার বা রাষ্ট্র বুঝবে না কিছু, এর ফলটা কিন্তু সাধারণ হবে না।

আমরা অনেক কিছু না জানতে বা না বুঝতে পারি। কিন্তু ইলিয়াসের প্রতিবেদনের সত্যতা থাকলে সেটা পুলিশ সদস্যরা যেমন জানবে তেমন এক সময় সমগ্র জাতিও জানবে। সমস্যা হচ্ছে যদি এটা সত্য হয় তবে তার একটা খুব খারাপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে যেটা হচ্ছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক। এমনিতেই একদল হিন্দু-বিদ্বেষী উগ্র সাম্প্রদায়িক লোক পাশ্চাত্যে থেকে সরকার বিরোধী প্রচারের সাথে উগ্র ইসলামী সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রচার করে চলেছে, যার মধ্যে সত্য ও মিথ্যা সবই আছে। প্রদীপ দাসের মত দুর্বৃত্ত হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তারও অভাব এ দেশে নাই, যারা তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা এইসব সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের হাতে ইন্ধন যোগান দেয়। আমি জানি না পিবিআই প্রধান বনজ কুমার আসলে দোষী, নাকি বাবুল আক্তার দোষী। শুধু এটুকু বলতে পারি যেটাই সত্য হোক এক সময় সেটা বেরিয়ে আসবে। তবে ইডেন কলেজ প্রসঙ্গে বনজ সংক্রান্ত ঘটনা উল্লেখ করলাম বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্কটের প্রকৃত রূপটাকে তুলে ধরার জন্য।

বনজ কুমার প্রসঙ্গটাকে আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছি এই কারণে যে, আমি এখন আর বাবুলের কথিত অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত নই। যদি বাবুল দোষী এবং বনজ নির্দোষ হন তবে সেটা নিয়ে সমস্যা হবে না। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে এ দেশে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকেই কেমন বিপদ নেমে আসতে পারে সে সম্পর্কে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বাবুল আক্তারের বিষয়টাকে আমি এত গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।

সময়টা ১৯৯৩-’৯৪। সেই সময় আমি কিছুদিন দিনাজপুর জিলাস্থ আমার পৈত্রিক গ্রামে ছিলাম। সেই সময় স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে দুর্নীতিবাজদের একটা চক্র গড়ে উঠে, যারা নানানভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ারে পরিণত করেছিল। এই চক্রের মূল হোতা ছিল তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপির জিলা নেতা আশরাফুল আলম। এখন সে কী তা জানি না, তবে এক সময় সে দিনাজপুর জিলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন একজন নিরীহ হিন্দু ভদ্রলোক। তাকে জিম্মি করে তারা লুটপাট চালাচ্ছিল। একটা উচ্চবিদ্যালয় যে এভাবে লুঠের হাতিয়ার হতে পারে তা আগে আমার জানা ছিল না। সরকারী বরাদ্দ লুঠ, এসএসসি পরীক্ষার অনুমোদনকে ব্যবহার করে ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি কত উপায়ে যে অর্থ হাতানো যায় সেই প্রথম জানলাম।

প্রধান শিক্ষক এসব পছন্দ করছিলেন না। তার ভয় ছিল এসবে তার কোনও অংশ বা ভূমিকা না থাকলেও প্রধান শিক্ষক হিসাবে এসব দুর্নীতির সাথে তার নাম জড়িয়ে যেতে পারে। সুতরাং তিনি আমার সাহায্য চাইলেন। আমি ঐ বিদ্যালয়ের মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম। সুতরাং প্রধান শিক্ষক যেমন আমার সাহায্য চেয়েছিলেন তেমন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আমারও সহানুভূতি এবং সমর্থন তৈরী হয়েছিল প্রধান শিক্ষকের প্রতি।

গ্রামের একটা হাইস্কুল থেকে আর কয় লাখ টাকা আত্মসাতের পথ বের করা যায়! বিএনপি নেতা আশরাফুল আলম আর কত টাকা সেখান থেকে ভাগে পেত! সে তো জিলার নেতা। কিন্তু তাকে তো ক্ষমতার শক্তিভিত্তি গড়তে হবে স্থানীয় এবং জিলা বিএনপি রাজনীতিতে জায়গা করবার অথবা রক্ষা করবার জন্য।

সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ে তার অধীনে একটা দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তুলতে চাইছিল। তখন বিএনপির শাসনকাল। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়া। তার বড় বোন খুরশিদ জাহান হক চকোলেট দিনাজপুর জিলা বিএনপির একজন নেতা এবং দিনাজপুর জিলার ফুলবাড়ী এলাকা থেকে নির্বাচিত সাংসদ।

আমি জানতাম যে, আশরাফুল আলম তার খুব প্রিয়ভাজন। এরপরেও আমি আশরাফুলের কীর্তি জানিয়ে এবং প্রতিকার চেয়ে তাকে একটা পত্র দিই। ফল হল আশরাফুল এবং তার বাহিনী প্রধান শিক্ষক এবং আমার উপর হামলা করে। চকোলেটকে তখন বলা হত দিনাজপুরের প্রধান মন্ত্রী। এলাকায় আমার জন্য যতই জনসমর্থন এবং সহানুভূতি থাক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের সমর্থন নিয়ে আমি লড়ব কী করে? আমি তখন নিজে কোনও দল করতাম না, এখনও করি না। তবে মতভেদ সত্ত্বেও বামপন্থীদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষত বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংগ্রামটা যখন একটা আন্দোলনের রূপ নিল তখন ওয়ার্কার্স পার্টির জিলা নেতৃত্ব দৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। বিশেষত এলাকার হিন্দু জনগণ এই আন্দোলনে দৃঢ়ভাবে প্রধান শিক্ষক এবং আমার পাশে ছিল। ফলে তাদের উপরও হামলা হয়েছিল। এখানে এ কথা বলা উচিত হবে যে, এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আমার প্রধান সহযোগী শক্তি ছিল বিদ্যালয় সংলগ্ন হিন্দু পল্লীর হিন্দু জনগণ।

যাইহোক, এরপর বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে বলি যে, ওয়ার্কার্স পার্টির বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে বিশেষ করে হিন্দু পল্লীটা রক্ষা পায়। আমি জেদ করে এলাকায় পড়ে না থেকে ঢাকায় চলে আসবার সিদ্ধান্ত নিই। আমি থাকলে সেখানে লড়াই তীব্রতর হত এবং হিন্দুদের উপর বিপর্যয় নেমে আসতে পারত। এবং সেটা আমার উপরেও। এরপর ওয়ার্কার্স পার্টির উপর এলাকা এবং বিশেষত হিন্দুদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিয়ে আমি এলাকা ত্যাগ করি। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষক হেমন্ত মোহন্তকে বিএনপির দুর্বৃত্ত চক্র বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে। পরে তাকে কিছুদিনের জন্য কারাগারেও নেয়।

আমারও কারাবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল চকোলেটের নির্দেশে। তখন আমি ঢাকায়। ঢাকায় বিএনপিতে আমার কিছু শুভানুধ্যায়ী ছিল। পরে জেনেছিলাম তারা তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলে আমার ডিটেনশন অর্ডার বাতিল করিয়েছিলেন।

বৎসরে সামান্য কয়লাখ টাকার জন্য যখন কিছু মানুষ এত নীচে নামতে পারে তখন নিয়মিত কোটি কোটি টাকার অর্থ পাবার লোভ কয়জন সামলাতে পারে? বিশেষ করে বাংলাদেশের মত দুর্বৃত্ত কবলিত দেশে। সুতরাং বনজ কুমার এবং তার সহযোগীদের সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই।

তবে তারা যদি সৎ হন এবং তাদের বিরুদ্ধে ইলিয়াসের অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয় তবে তা নিয়ে বনজ বা কারো্রই ভাববার কারণ নাই। বিশেষত পুলিশ বিভাগের বড় অংশই তাদের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবে। পুলিশের ব্যাপারটা সামান্য হলেও আমি কিছু বুঝি। কারণ আমার প্রয়াত পিতা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। ডিএসপি (ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পোলিস) এবং এসডিপিও (সাবডিভিশনাল পোলিস অফিসার) পদে দীর্ঘদিন কর্মরত থেকে তিনি ১৯৭০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। পুলিশের বদনাম এখনকার মত না হলেও তখনও ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন সৎ পুলিশ কর্মকর্তা। স্বাভাবিকভাবে পুলিশ বিভাগেও সকলে তাকে সেভাবে জানত। কিছুটা উদার হলেও তিনি ছিলেন নামাজ-রোজাসহ নিয়মিত ধর্মচর্চাকারী মুসলিম। বিশেষত তার ধর্মীয় চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে আমি একমত হতাম না। কিন্তু একজন সৎ পুলিশ অফিসার হিসাবে তাকে যেমন গর্ব করতে দেখতাম তেমন এই গর্ব আমি নিজেও বোধ করি যে আমার পিতা একজন সৎ এবং ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা সৎ এবং মানবিক হলে কত মানুষ যে কতভাবে উপকৃত হয় সেটা আমি কিছুটা হলেও দেখেছি এবং বুঝেছি। আমি নিজে পুলিশ বিভাগের লোকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চললেও তাদের মধ্যে সৎ অফিসার হিসাবে আমার পিতার মর্যাদা দেখেছি।

যাইহোক, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ থাক। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি সৎ হয় তবে সেটা যেমন গোপন থাকে না তেমন অসৎ হলে সেটাও গোপন থাকে না। বাবুল বা বনজ কে কেমন সেটা আমরা না জানতে পারি। তবে সমগ্র পুলিশ বিভাগই জানে বা এখন জানবে। যদি ইলিয়াসের প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য সত্য হয় তবে সরকারের জন্য সেটা ভয়ানক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কারণ পুলিশরাও কিন্তু মানুষ। ফলে তারা নিজেরা যে যেমন হোক তাদের কিছু অহঙ্কারের লোককে রক্ষা করে নিজেদের গৌরব বোধকে তৃপ্ত করতে চাইতে পারে। বাবুল আক্তার এবং বনজ কুমার প্রসঙ্গে এর বেশী আর কিছু বলতে চাই না।     

 

(৪) আওয়ামী লীগ সরকারের যাবার সময় কি হয়েছে?

আমার বিবেচনায় বাবুল আক্তার এবং ইডেন কলেজ এই দুই ইস্যু এখন আওয়ামী লীগের সামনে অশনি সঙ্কেত উপস্থিত করেছে। বাবুলকে যদি চক্রান্তের শিকার করা হয়ে থাকে তবে এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভয়ানক। পাশ্চাত্য থেকে ইলিয়াস হোসাইন যদি এভাবে কিছু না বলতেন তবে হয়ত একজন বাবুল আক্তার সময়ের স্রোতে হারিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন তো আর সেটা হবার জো নাই। সত্যটা যেভাবে হোক দ্রুত সবার সামনে বেরিয়ে আসবে। যদি সেটা বাবুলের পক্ষে যায় তবে সেটা শুধু বনজের জন্য বিপর্যয়কর হবে না, সরকারের জন্যও ভয়ানক ক্ষতিকর হতে পারে।

তবে বাবুল-বনজের ক্ষেত্রে ‘যদি’র ব্যাপার আছে। কিন্তু ইডেনের ক্ষেত্রে তো সেটা নাই। সুস্পষ্ট, প্রকাশ্য অভিযোগ ইডেনের ছাত্রীদের কাছ থেকেই। এবং এখানে আর কোনও লুকোছাপা নাই। একটা শাসক দল এবং তার শাসনাধীন রাষ্ট্র কোন পর্যায়ে নেমে গেলে তারা সবাই মিলে পঁয়ত্রিশ হাজার ছাত্রীর পদচারণামুখর এবং গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী একটা সরকারী মহাবিদ্যালয়কে বেশ্যা বা পতিতা তৈরী ও সরবরাহের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে এবং সেটাও নিরীহ সাধারণ ছাত্রীদের উপর নির্যাতনের স্টীমরোলার চালিয়ে! ধিক, আওয়ামী লীগকে!

ইতিমধ্যে ইডেনের ঘটনা এমনইভাবে প্রচার হয়েছে যে, সরকার হয়ত লোকদেখানো কিছু ব্যবস্থা নিবে। বিশেষত শেখ হাসিনা নিজে হয়ত শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করবেন। কিন্তু তার এবং তার দল এবং সরকারের যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। এ দেশের মানুষের অনেক দোষ আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নারীর মর্যাদা তার আবেগের খুব বড় একটা জায়গা। এই জায়গায় আঘাত করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাকিস্তানের পক্ষপাতী বাঙ্গালী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ১৯৭১ সালে প্রবল পাকিস্তান বিরোধী শক্তিতে পরিণত করেছিল। ঠিক এই জায়গায় স্বাধীনতার একান্ন বছর পর বাঙ্গালীর অনুভূতিতে আওয়ামী লীগ আর একভাবে আঘাত করেছে। কারণ যে মেয়েরা ছাত্র লীগ নারী নেতাদের নির্দেশে পরপুরুষদের মনোরঞ্জন করতে যেত তারা সেটা স্বেচ্ছায় নয়, বরং নির্যাতনের মুখে বাধ্য হয়ে যেত। প্রকাশ্যে এবং সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীদের মুখ থেকে এই একটি অভিযোগই যথেষ্ট আওয়ামী লীগের সমস্ত নৈতকতার ভিত্তিকে চূর্ণ করার জন্য। এই অবস্থায় আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকবার এতটুকু নৈতিক জায়গা থাকে না।

তবু লীগ ক্ষমতায় আছে এবং আরও কিছুদিন হয়ত থাকবে। নির্বাচনে লীগ শাসনের অবসান হবে না। কারণ লীগের ছত্রছায়ায় যে সুবিধাভোাগী চক্র গড়ে উঠেছে তা সহজে ক্ষমতা ছাড়বে না। ইডেন কলেজের ছাত্র লীগ নেতৃত্ব তো তারই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ মাত্র। তাহলে পথ থাকে গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের। আমাদের দেশে সবশেষ গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল ১৯৯০-তে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মত তারও স্ট্রাইকিং ফোর্স বা ঝটিকা বাহিনী ছিল মূলত ধর্মমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বামপন্থী তথা মার্কসবাদী ধারার ছাত্ররা। তাদের ঘাঁটি ছিল এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হাসিনা সরকার যাতে পরিণত করেছে সেটাকে বলা যায় ঢাকা বিশ্বমাদ্রাসা। আসলে মাদ্রাসা এবং প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার সমমান প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা ছাত্রদের প্রায় অবাধে ভর্তি হবার সুযোগ করে দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু ঘটিয়েছে।

সংক্ষেপে ঢাবি নাম ঠিক আছে। তবে সেটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না বলে এখন বলা যেতে পারে ঢাকা বিশ্বমাদ্রাসা। একদিকে আওয়ামী লীগের হেলমেট-হাতুড়ি বাহিনী, অপর দিকে দুনিয়াদারী জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে বোরখা-হিজাবধারী এবং মোল্লা-নামাজী তৈরীর কারখানা থেকে আধুনিক যুগচেতনায় উদ্বুদ্ধ প্রজন্মের উত্থান আশা করে লাভ নাই। অবশ্য অনুমান করা যায় আজকের এই বিশ্বমাদ্রাসা থেকেও আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় নানানভাবে তৈরী হচ্ছে ইডেন কলেজের মত রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল ও বাসগৃহে ব্যস্ত সময় পার করা ছাত্রী বাহিনী। হিজাব-বোরখার আড়াল থাকলেই তো হল!

হাসিনা সত্যি কীর্তিমান! তার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান করবে কে? মোল্লারা? এটা আফগানিস্তান নয়। এখানে পরিস্থিতিই ভিন্ন। এখানে চিরকাল মোল্লারা শাসক কিংবা বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান শ্রেণীর অধস্তন এবং কৃপা প্রার্থী হিসাবে দিনাতিপাত করে। শাসকদের কাছে এদের দরকার আছে। পুলিশ-মিলিটারী-আইন-আদালতের মত এদেরও প্রয়োজন আছে পশ্চাৎপদ, অজ্ঞ-মূর্খ, বিচারবুদ্ধিহীন এবং হুজুগে মাতা জনগণকে কব্জায় রাখবার জন্য। সেই প্রয়োজন থেকে শাসকরা এদেরকে ব্যবহার করে। এ কাজ এ দেশে সবাই করেছে। মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা, হাসিনা সবাই যার যার মত করে করেছে এবং আজ অবধি করছে। মোল্লারা যখন বেশী লাফালাফি করে তখন বুঝতে হবে যে, এদের পিছনে পুলিশ, প্রশাসন অথবা শাসকদের কোনও না কোনও অংশ অথবা সবাই মিলে আছে।

মোল্লাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকা ইসলামের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যও নয়। ইরান বা আফগানিস্তান ব্যতিক্রম। ইরানের ইসলাম শিয়া ইসলাম। সুন্নী তথা মূলধারার ইসলামের সঙ্গে ওটাকে মিলাতে চেয়ে লাভ নাই। আর আফগানিস্তানের ইতিহাসও ভিন্ন। এটা নিয়ে অতীতে কিছু লিখলেও ভবিষ্যতে আমার আরও আলোচনার ইচ্ছা আছে। তবে তার জায়গা এটা নয়। আর একটা কথা, আফানিস্তানে তালিবানী মোল্লাদের উত্থানের সর্বাধিক কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতে হয় তবে সেটা দিতে হবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যকে। তবে সে প্রসঙ্গও এখানে নয়। বাংলাদেশে বড় জোর তুরস্কের মত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত শ্রেণী থেকে এরদোগান ধরনের ইসলামবাদী আসতে পারে। সেদিক থেকে হাসিনা খারাপ কী? তার চেয়ে বড় ধর্মনিরপেক্ষ এবং একই সাথে তার চেয়ে বড় ইসলামবাদী এ দেশে কে আছে? হাসিনার আওয়ামী লীগ সবেতেই আছে। আসল কাজ তো একটাই – লুটপাট করা এবং বিদেশে টাকা পাচার করা। যারা জামাত-হেফাজতের ভয় দেখান তারা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আওয়ামী লীগের মত দলকে ক্ষমতায় রাখবার স্বার্থে চালাকি করেন, আর নয় সামাজিক বাস্তবতা বুঝতে পারেন না।

অবশ্য লীগ সরকারের জন-সমর্থন কিংবা নৈতিক ভিত্তি শূন্যের কোঠায় নামলেই বা ক্ষতি কী? লীগ ঠিকই জানে গণ-আন্দোলন ও পরিণতিতে গণ-অভ্যুত্থানের সম্ভাব্য বিকাশের পথকে রোধ করতে পারলে রাস্তার শক্তি দ্বারা তার পতন ঘটানো যাবে না। সেই শক্তি যে মাদ্রাসার ছাত্ররা এ দেশে হয় না সেটাও লীগ ভালোভাবে জানে। মোল্লা, মাদ্রাসা এগুলা হচ্ছে জুজু। ওটার ভয় মাঝে মাঝে ক্ষমতার স্বার্থেই দেখাতে হয়। আধুনিক যুগ চেতনা দ্বারা কম-বেশী প্রভাবিত যে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ দেশে গড়ে উঠেছে তাদেরকে কবজায় রাখবার জন্য মাঝে মাঝে সেই জুজুকে রাস্তায় না নামালে চলবে কেন?

যাইহোক, ঢাকা বিশ্বমাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে লীগ সরকার আপাতত গণ-অভ্যুত্থানের পথ রুদ্ধ করেছে বলে মনে হয়। হাতুড়ি-হেলমেটধারীদের পাহারায় থাকা হিজাব-বোরখা-টুপি-দাড়িধারী কিংবা মুসল্লি ছাত্র-ছাত্রীরা এই সরকারের জন্য তেমন কোনও হুমকি নয়। সুতরাং সরকারের দূরদৃষ্টির প্রশংসা করতে হয় বৈকি! এ দেশে রাস্তার আন্দোলনে যারা ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসাবে ভূমিকা রাখে তারা প্রায় নাই হয়ে গেলে সরকারের জন্য ভাবনা অনেক কমে না কি?

 

(৫) একটু ভিন্নভাবে ভাবা যাক

এ দেশের চিরায়ত ছকে ফেলে আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের চিত্রটাকে কল্পনা করা যাক। সুতরাং ধরা যাক সকল বাধা উপেক্ষা করে গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে সরকারের পরিবর্তন ঘটালো। তাতে কী হবে? তত্ত্বাবধায়ক হোক, অন্তর্বর্তী হোক, জাতীয় হোক কিংবা যে নাম নিয়ে হোক একটা সরকার আসবে এবং জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে তার অধীনে একটা নির্বাচন হবে এবং এরপর যথানিয়মে একটা নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়ত তার আগে সংবিধানে পরিবর্তনও আনা হবে। কিন্তু তাতে কী হবে?

গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ছকে ফেলে এ দেশে যারা স্বৈরতন্ত্রের অবসান কিংবা দুর্নীতিমুক্ত এবং ন্যায় ও আইনের শাসনভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা আশা করেন, দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, তারা এ দেশের সমস্যার মূল জায়গাটাকেই বুঝতে পারেন না।

ধরা যাক একটা গণ-আন্দোলনের ফলে লীগ সরকারের পতন হল এবং তারপর একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পর নূতন সরকার এল। তাতে কী হবে? প্রথমত অল্প কিছুদিন হয়ত উন্নতির কিছু লক্ষণ দেখ দিবে। তারপর কী হবে? যা ছিল তা-ই ফিরে আসবে। আমাদের দেশে অতীতে যা বারবার হয়েছে, তা-ই পুনরায় হবে। এ হচ্ছে একটা চক্র। একবার এ দল, আর একবার ও দল। ফল মূলত এক।

হয়ত বলা হবে, সিস্টেম বদলালে সব ঠিক হবে। আসলে মানুষ বদলের কাজটা বাদ দিয়ে যারা সিস্টেম বদলের ফর্মুলা দেন তারা সমস্যার মূলটাকেই ধরতে চান না বা পারেন না। সিস্টেম গড়ে কে? মানুষ। চালায় কে? মা্নুষ। পাশ্চাত্যের উন্নত, গণতান্ত্রিক, ন্যায় ও সমাধিকার ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা গড়তে চাইলেই হল? পাশ্চাত্যে এই রকম ব্যবস্থা যারা গড়ে তুলেছে তাদের পাশে আমাদের দেশের মানুষদের দাঁড় করালেই সমস্যাটাকে বুঝা যায়।

পাশ্চাত্যের সিস্টেম এ দেশে অচল। কারণ ঐ সিস্টেম চালাবার মানুষ এ দেশে নাই। ব্রিটিশ শাসকরা বন্দুকের জোরে যেটুকু উন্নত সিস্টেম রেখে গিয়েছিল দেশের লোকদের হাতে পড়ে সেটুকুও ৭৫/৭৬ বৎসরে জরাজীর্ণ হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। দেশীরা নিজেদের মত করে সিস্টেম পুনর্গঠনও করছে। ভোটের মাধ্যমে হোক আর যেভাবেই হোক এ দেশের সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষরা ক্ষমতা হাতে পেলে নিজেদের প্রয়োজনে সিস্টেমকে বদলাতও সময় নেয় না। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশও নিজেদের চিরপরিচিত সিস্টেমের প্রত্যাবর্তনে স্বস্তি বোধ করে।

কিছু শিখবার জন্য অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। সেটা কি আমাদের কম হল? আমাদের নিজেদেরই আছে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর যু্দ্ধ, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান। আরব দেশগুলির অল্প কিছুদিন আগে সংঘটিত আরব বসন্তের অভিজ্ঞতা থেকেও কি কিছু শিখবার নাই?

সোজা কথায় বলতে চাই মুসলিম সমাজের জনগণ থেকে ইতিবাচক তেমন কিছু আশা করে লাভ নাই। যতক্ষণ ধর্মবিশ্বাসমুক্ত কিংবা আধুনিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছাত্র বা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আন্দোলন সীমিত থাকে ততক্ষণ সব ঠিক থাকতে পারে। কিন্তু যখন মুসলিম সমাজ থেকে গণশক্তি জেগে উঠে তখন প্রধানত সমাজের অশুভ ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি জেগে উঠে এবং প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের মূলধারা থেকে প্রগতির শক্তিকে স্থানচ্যুত করে।

এর মূল নিহিত ধর্মে। এই কারণে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত পশ্চিম ইউরোপ কিংবা রাশিয়া এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত চীন, ভিয়েৎনামের মত সমাজগুলিতে গণ-আন্দোলন অথবা গণ-অভ্যুত্থান পরিণত হতে পারে প্রগতি, গণতন্ত্র অথবা জনকল্যাণবাদী চেতনায় সমুন্নত সমাজতন্ত্র অভিমুখী গণ-বিপ্লব বা সামাজিক বিপ্লবে। আর এর বিপরীতে আফগানিস্তান কিংবা ইরানের মত মুসলিম দেশগুলির গন-বিপ্লব রূপ নেয় ইসলামী প্রতিবিপ্লবে।

এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় বিষয়টাকে কিছু করে আলোচনা করেছি। আর এ লেখাটাকে আমি দীর্ঘ করতে চাই না। সুতরাং খুব সংক্ষেপে মুসলিম সমাজ এবং তার আন্দোলনের সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। আসলে বিষয়টাকে নিয়ে নূতন করে ভাববার প্রয়োজন খুব বেশী। যারা সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে আন্দোলনের বিষয় নিয়ে ভাবেন তাদের জন্য এই ভাবনার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী।

আমি আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে বলি মুসলিম সমাজের সমস্যাকে বুঝতে হলে ধর্ম এবং তার সমস্যাকে বুঝতে হবে। বিশেষত বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান এবং মুসলিম এই তিন সমাজের মৌল বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যা সহজে বুঝার একটা উপায় হল বুদ্ধ, যীশু এবং মুহাম্মদ এই তিন ধর্মপ্রবক্তাকে পাশাপাশি স্থাপন করা। একবার কল্পনা করা যাক তো বুদ্ধ কিংবা যীশু তলোয়ার হাতে ঘোড়ার পিঠে চেপে তার ধর্ম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে চালাচ্ছেন শত্রুদের হত্যা, তাদের সম্পদ ও নারী লুণ্ঠন এবং দাসকরণ। শত্রু-সম্পদ লুণ্ঠন, নারীদের বন্দীকরণ, দাসকরণ ইসলামের ধর্মীয় বিধানেই বৈধ বা ন্যায়সঙ্গত। না, এ ধরনের চর্চার কোনও স্থানই বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান ধর্মে নাই।

এই প্রধান তিন ধর্মের মধ্যকার আরও অনেক পার্থক্যকে আলোচনায় আনা যায়। সেসবে না গিয়ে এক কথায় বলি বৌদ্ধ ও খ্রীষ্ট ধর্ম যেখানে স্থিতিশীল, সভ্য ও কৃষিজীবী মানুষদের ধর্ম হিসাবে বিকাশ লাভ করেছে ইসলাম সেখানে বিকাশ লাভ করেছে প্রধানত পশুপালক, যাযাবর ও অর্ধ-যাযাবর তথা আরব বেদুইনদের ধর্ম হিসাবে। সুতরাং মুসলিম সমাজ-সত্তার গভীরে বাস করে এমন আরব বেদুইন সত্তা যা চরিত্রগতভাবে হিংস্র আক্রমণাত্মক, লুঠেরা এবং নারী ধর্ষক। ব্যক্তি মুসলিম ভিন্ন হতে পারে, আধুনিক এবং প্রগতিশীল চেতনায় সমুন্নত হতে পারে। তবে সমাজ সেটা হবে কী করে? এই অবস্থায় মুসলিম সমাজে যখন গণ-জাগরণ ঘটে তখন সেটা মর্মগতভাবে পরিণত হয় বর্বর ও হিংস্র আরব বেদুইন চেতনার জাগরণে। সুতরাং আরব দেশগুলির আরব বসন্তের এমন করুণ পরিণতি। সমাজে ইসলামকে রক্ষা করে মানবিক চেতনায় সমুন্নত মানুষ সৃষ্টি? নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা? গণতন্ত্র এবং স্বাধীন ও উন্নত অর্থনীতি? নৈবচ নৈবচ।

আসলে অমুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে যারা মুসলিম সমাজে প্রগতির কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে চাইবে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে ব্যর্থতার করুণ পরিণতি। মুসলিম সমাজে বিপ্লব বা প্রগতিশীল পরিবর্তনের স্বপ্ন যারা দেখবেন তাদেরকে প্রথমেই বুঝতে হবে যে, এখানে মূল সমস্যা সামাজিক ভাবাদর্শ তথা ধর্ম। আর সেই ধর্ম হল ইসলাম। এটা বুঝা হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের পথে পদক্ষেপের প্রথম শর্ত। অর্থাৎ নূতন সমাজ এবং রাষ্ট্র নির্মাণের প্রথম এবং প্রধান কাজই হচ্ছে ইসলাম ধর্ম থেকে মুক্তর শক্তির উত্থান ঘটানো। সেটা কি পশ্চাৎপদ, ভাগ্যবাদী ও ধর্মাচ্ছন্ন মুসলিম আমজনতার উপর নির্ভর করে করা সম্ভব?

এটা সম্ভব নয় বলে মুসলিম সমাজে পরিবর্তনের শক্তিটা আসে বাহির থেকে অথবা বাহির থেকে আসা উন্নত যুগ-চেতনা দ্বারা প্রভাবিত এলিট শ্রেণী বা উচ্চবর্গ থেকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে। আজ হয়ত গত শতাব্দীতে তুরস্কের খেলাফত উচ্ছেদের তাৎপর্য বুঝা কঠিন হবে। কিন্তু এই অসম্ভব প্রায় কাজটা সম্পন্ন করেছিলেন তুরস্কের একজন সেনানায়ক মোস্তফা কামাল পাশা।

একশত বছর পর ইসলামের প্রাণকেন্দ্র সৌদী আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তেমন কিংবা তার চেয়েও বেশী যুগান্তকারী আঘাত হানতে শুরু করেছেন ইসলামের উপর। এখন তিনি সৌদী আরব সরকারের প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছেন। অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতাও এখন তার হাতে। এর আগে তিনি তবলীগ নিষিদ্ধ করেছিলেন। এখন তিনি যদি হাদীসসমূহকে খারিজ করেন তবে ইসলামের জন্য ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসবে। শুধু কুরআন নিয়ে ইসলাম কয়দিন টিকবে? হাদীস বাদ দিলে ইসলামের ব্যবহারিক মূল্য অনেকাংশে ফুরাবে। যুবরাজ সালমান হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন।

আসলে একশ’ বছর আগে তুরস্কে কামাল পাশার সংস্কারের তাৎপর্য ছিল প্রধানত রাজনৈতিক। সেটা ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে খর্ব করেছিল। কিন্তু দার্শনিক তথা ধর্মীয়ভাবে ইসলামের প্রতাপ খর্ব হয় নাই। কামালের সংস্কারে ইসলাম রাষ্ট্র থেকে বিদায় নিলেও সমাজ থেকে নয়।

এবং ইসলামের কেন্দ্র সৌদী আরবে ইসলাম ছিল তার প্রায় সনাতন রূপ নিয়ে বিদ্যমান। শুধু সমাজে নয়, রাষ্ট্রেও। তাই সমাজ এবং রাষ্ট্র ছিল শরীয়া শাসিত। কিন্তু এখন সংস্কারের সুনামি সৌদী আরবের দেড় হাজার বছরের ব্যবস্থাকে তছনছ করে চলেছে। এখন যদি সৌদী সরকার হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শরীয়াকে অস্বীকার বা নিষিদ্ধ করে তবে ইসলামের কী হবে?

এটা স্পষ্ট যে, যে পরিবর্তন সৌদী আরবে শুরু হয়েছে সেটা এত সহজে থামবে না। আরও বৃহত্তর পরিবর্তনের জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

তবে যারা শুধু ‘গণ’ ‘গণ’ করেন, এ প্রসঙ্গে তাদেরকে আমি বলতে চাই যে, তুরস্কের মত সৌদী আরবের পরিবর্তনও কোনও ‘গণ’ ‍ঘাটায় নাই, বরং রাজপরিবার থেকে আগত একজন যুবরাজই ঘটিয়েছেন এবং এখনও ঘটিয়ে চলেছেন। সালমানের সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তার ভূমিকার গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় কোথায়?

তবে মুসলিম সমাজে সকল সংস্কার শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে যদি বিপ্লব করা না যায়। আর সেই বিপ্লব মূলত ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব। এই বিপ্লব কামাল পাশা করতে পারেন নাই বলে সেখানে ইসলামবাদী রাজনৈতিক নেতা এরদোগানের উত্থান ঘটেছে। এখন দেখা যাক সৌদী আরবে সালমান আরও কতদূর যেতে পারেন।

আমাদের দেশেও সমাজ বিপ্লবের শক্তিকে নীচ তলা থেকে নয়, বরং উপর তলা তথা উচ্চবর্গ বা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত থেকে আসতে হবে। বিপ্লবটা যেখানে মূলত ধর্মের বিরুদ্ধে সেখানে রাজপথে ধর্ম থেকে মুক্তির আন্দোলন দাঁড়াবে কী করে?

তার মানে এই নয় যে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে রাজপথে আন্দোলন হবে না। সেগুলিরও প্রয়োজন আছে এবং সেগুলিও চলবে। কিন্তু সেগুলি থেকে প্রত্যাশাটা কম রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। মূল কাজটা দার্শনিক অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক। এটাকে আন্দোলন বললে বলতে হবে ‍বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন, আর বিপ্লব বললে বলতে হবে বুদ্ধির মুক্তির বিপ্লব। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও বিপ্লব থাকবে বৈকি, তবে সবই অগ্রসর হবে বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন ও বিপ্লবের হাত ধরে এবং তার অধীনস্থ হয়ে।

রচনা – ২৯ সেপ্টেম্বর – ২ অক্টোবর, ২০২২

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ