লিখেছেনঃ মুশতাক হোসেন, আপডেটঃ February 9, 2010, 6:43 PM, Hits: 7941
কর্নেল আবু তাহের ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত এমন একজন সামরিক কর্মকর্তা যিনি সচেতনভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মূলতঃ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার সুসপষ্ট লক্ষ্য নিয়েই আবু তাহের ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবহিনীতে যোগ দিয়েই তিনি সবচাইতে ভালো ও চৌকশ প্রশিক্ষণ নেবার দিকে মনোনিবেশ করেন। অন্যান্য বাঙ্গালী সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তাকে তিনি উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য।
মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন তাহের সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্স করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে কোয়েটার ইনফেন্ট্রি স্কুলে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি চরম প্রতিকূলতা জয় করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধকে গতানুগতিকভাবে গ্রহণ করেন নি। মুক্তিযুদ্ধের বেশ আগে থেকেই তিনি এ বিষয়ে স্বচ্ছ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি চেয়েছেন একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং জনযুদ্ধের মাধ্যমেই দেশ স্বাধীন করা সম্ভব বলে মত পোষণ করতেন।
তাই ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করার পরেই তিনি ছাত্র ও কৃষকদেরকে নিয়ে এক বিশাল গণবাহিনী গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। উদ্দেশ্য ছিল সারা দেশের প্রতিটি গ্রামে গণবাহিনীকে ছড়িয়ে দেয়া, যারা জনগণকে নিয়ে মুক্ত এলাকা গড়ে তুলবে। মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বাংলাদেশ দ্রুত শত্রুমুক্ত হওয়ায় একটি পূর্ণাঙ্গ জনযুদ্ধ বিকশিত হতে পারে নি। একটি অসম্পূর্ণ জনযুদ্ধ, মিত্র বাহিনীর প্রাধান্যপূর্ণ সহযোগিতা ও সমাজের বৈপ্লবিক রূপানতরে অনাগ্রহী নেতৃত্বের কারণে আমাদের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পায়নি। যার কারণে এখনো পর্যনত এ দেশের সামরিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রথা-প্রতিষ্ঠান-পদ্ধতি মূলতঃ ব্রিটিশ-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক ধাঁচেই রয়ে গেছে। কর্নেল তাহের এ বিষয়টি নিয়ে খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মুখপত্র ‘গ্রেনেড’-এর উদ্বোধনী সংখ্যায় ’মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে তার সে মনোভাব ফুটে উঠেছে।
স্বাধীনতার এ দুর্বলতার কারণে স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠানিকতা পায়নি। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের এ দুর্বলতা পূরণ হওয়া সম্ভব ছিল কেবলমাত্র সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সে কারণেই তাহের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর বিপ্লবী প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হন। জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার লক্ষ্য ছিল একটি বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অভিমুখী গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
১৯৭৪ সনের ১৭ মার্চের পর থেকে বিশেষ করে জাসদের জন্য প্রকৃতপক্ষে প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল। ১৭ মার্চ জাসদ একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করে। ঘেরাওয়ে রক্ষী বাহিনীর নিবিচারে গুলীবর্ষণে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত হন, গ্রেপ্তার হন জাসদের শীর্ষ নেতৃত্বসহ অনেকে নেতা-কর্মী। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪এর ডিসেম্বরে জরুরী অবস্থা এবং ১৯৭৫ সনের জানুয়ারী থেকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালূ হয়।
জাসদসহ সহযোগী সংগঠনসমূহ কার্যতঃ বেআইনী হয়ে যাবার কারণে বিকল্প সাংগঠনিক ব্যবস্থা হিসেবে জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব সামনে চলে আসে। পুলিশী নজরদারী এড়িয়ে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও বিপ্লবের থিসিস প্রণয়নের কাজে হাত দেয় জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া। পাশাপাশি রক্ষী বাহিনী ও সরকার সমর্থক সশন্ত্র কর্মীদের হামলা মোকাবেলার পাল্টা ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও যুব কর্মীদেরকে নিয়ে বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করা হয়। বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অভ্যনতরে গড়ে তোলা হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। কর্নেল তাহের জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে বিপ্লবী গণ বাহিনী বিশেষ করে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সামরিক অধিনায়কের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তার সাথে একজন রাজনৈতিক কমিশার থাকতেন, যিনি গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থার রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করতেন।
একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করার রাজনৈতিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া। এমনি এক মুহুর্তে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা ঘটালো রক্তাক্ত সামরিক ক্যুদেতা। হত্যা করলো সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ তার পরিবারবর্গ ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দেরকে। বাকশাল সরকারকে উৎখাত করে জারী করা হল সারা দেশে কারফিউ ও সামরিক শাসন। জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে এ ষড়যন্ত্রমূলক ক্যুদেতাকে মোকাবেলার সিদ্ধানত গ্রহণ করে। একটি অনিবার্য় বিপ্লবকে ঠেকিয়ে দিতে বাকশাল বিরোধী গণআন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুকে পরিবার-পরিজনসহ নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড ঘটিয়ে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের দালালগোষ্ঠী সামরিক বাহিনীর অংশবিশেষকে ব্যবহার করে এ ক্যুদেতা সংঘটিত করেছে বলে জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে মূল্যায়ন করে। তাই সিদ্ধানত হয় জাসদসহ সহযোগী সংগঠনসমূহ, বিপ্লবী গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাংগঠনিক তৎপরতা তীব্রতর করে ষড়যন্ত্রকারীদের হত্যা-নৈরাজ্য-বিশৃংখলার বিরুদ্ধে শ্রমিক-ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থান ত্বরান্বিত করার।
আবার ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঘটানো হল আরেকাট সামরিক ক্যুদেতা। এটা জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার কাছে একেবারেই সপষ্ট হয়ে গেল যে, বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানকে সংগঠিত হয়ে উঠতে না দেয়ার জন্যই এ পাল্টা ক্যুদেতা। তাই এবার সিদ্ধানত হল আর দেরী নয়, ষড়যন্ত্রকারী সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের আঘাত হানতে হবে দ্রুততার সাথে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ ঢাকা মহানগরীর রাজপথ, সেনানিবাসের সৈনিকদের মাঝে জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়ে প্রকাশ্যেই রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে থাকে। এ ধরণের তরল পরিস্থিতির মাঝে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরাও বসে ছিল না। আমলাতন্ত্র, সেনাবাহিনী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকদের দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার প্রেক্ষাপট তৈরীর জন্য আরো নৈরাজ্য উস্কে দিতে তারা সক্রিয় হয়। জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া কর্তৃক বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থান আহ্বানের পাশাপশি ধর্মকেন্দ্রিক ও ভারত বিদ্বেষী রাজনৈতিক উস্কানীমূলক প্রচারণা ও গুজব-ও ছিল প্রবল। শুধু প্রচারণা ও গুজবই নয়, ৩ নভেম্বরের ক্যুদেতার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ১৫ আগস্টের সামরিক খুনী চক্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ ৪ নেতাকে হত্যা করে।
উস্কানী ও গুজবের ফলও ফললো খুব তাড়াতাড়ি। জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্ততি নেয়া হচ্ছিল হত্যা-নৈরাজ্য-বিশৃংখলাকারী দেশী-বিদেশী য়ড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ১০ নভেম্বর ১৯৭৫ দেশব্যাপী হরতাল পালন করা এবং এর মাধ্যমে জনগণকে বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত করা। কিন্তু এ সিদ্ধানত প্রকাশ্যে ঘোষণা করার আগেই দেশী-বিদেশী য়ড়যন্ত্রকারীদের একটি অংশ ৬ নভেম্বর দিবাগত রাতেই সৈনিকদের মাঝে ভীতিকর গুজব ছড়িয়ে তাদেরকে বিদ্রোহ সংঘটনের উস্কানী দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ ধরণের তরল পরিস্থিতির মাঝে আরেকটি রক্তাক্ত ক্যুদেতা ঘটানো এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও এর রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নির্মূল করা।
এ ধরণের জটিল পরিস্থিতিতে কি করা যেতে পারে তা নিয়ে ১৯৭৫এর ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকে জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার অবিরাম বৈঠক চলে। এ সময় জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়া ও বিপ্লবী গণবাহিনী নেতৃত্বের এক উল্লেখযোগ্য অংশ সাংগঠনিক দায়িত্বের কারণে ঢাকার বাইরে ছিলেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী সিদ্ধানত নেবার জন্য ঢাকাস্থ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসলেন। প্রথমেই প্রশ্ন উঠল এত দ্রুত বিপ্লবী গণঅভ্যূত্থানের ডাক দেয়া সম্ভব কি না। জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য ন্যূনতম সময়টুকুও পাওয়া যাচ্ছিল না! বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দিলেন যে, সে রাতেই (৬ নভেম্বর দিবাগত রাতে) সৈনিক-জনতার অভ্যূত্থান সংগঠিত না করলে ষড়যন্ত্রকারী মহলের কাছে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে এবং জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়াসহ এদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ১৯৬৫তে সংগঠিত ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো স্টাইলে গণহত্যার শিকারে পরিণত হবেন। পক্ষানতরে ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ন্ত্রণের আগেই জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার যতটুকু শক্তি আছে তাই নিয়ে যদি সৈনিক-জনতার অভ্যূত্থান সংঘটিত করা যায় তবে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটবে তা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথকে সুগম করতে পারবে। তবে ষড়যন্ত্রকারী দেশী-বিদেশী চক্রকে প্রতিহত করতে ১৫ আগস্টের ক্যুদেতার নায়ক খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পথ বন্ধ করতে হবে, এবং সৈনিকদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে মোশতাকের বিকল্প হিসেবে নেতৃত্বে বসালে ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হবে। প্রশ্ন উঠল জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পক্ষ থেকে কর্নেল আবু তাহেরের পক্ষে এ দু’জনের বিকল্প হিসেবে নেতৃত্বে আসা সম্ভব কিনা। কর্নেল তাহের নিজেই এ ধরণের প্রস্তাবকে নাকচ করলেন এই বলে যে, জনগণ এ ধরণের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত নয় এবং জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পক্ষে এককভাবে নেতৃত্ব নেবার মত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেই। তবে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ না থাকায় (তৎকালীন মূল্যায়ন) এবং কর্নেল তাহেরের শুভানুধ্যায়ী হওয়ায় তাকে নিয়ে জাসদের বিপ্লবী প্রক্রিয়ার পক্ষে সমাজতন্ত্র অভিমুখী গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা সমস্যা হবে না।
বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পরিকল্পনা ও সমন্বয় অনুযায়ী সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান সূচিত হল ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১টায় (অর্থাৎ ৭ নভেম্বর), হাজার হাজার সৈনিক সেনানিবাস ছেড়ে বাইরে ঢাকার রাজপথে বেরিয়ে এল ভোররাত থেকে সকাল পর্যনত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা, তেজগাঁ-পোস্তগোলা থেকে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের সমর্থনে জাসদ ও সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের নেতৃত্বে হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা ভোর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। প্রকৃত অর্থেই সিপাহী-জনতার মহামিলন ঘটে ঢাকার রাজপথে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ছিল এ মহামিলনের কেন্দ্রবিন্দু।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ষড়যন্ত্রকারীরাও বসে ছিল না। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা কর্তৃক তড়িৎ গতিতে পরিস্থিতির নেতৃত্ব নিয়ে নেয়ায় তারা প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়লেও বিদেশী দূতাবাসের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় তারা দ্রুত মাঠে নেমে পড়ে। সমস্ত সরকারী অফিস-আদালত থেকে খন্দকার মোশতাকের ছবি নিয়ে এসে রাস্তায় নামানো হয় মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে। ১৫ আগস্টের ক্যুদেতার সংগঠক সামরিক চক্র সিপাহীদের ট্রাকে ট্রাকে সে ছবি তুলে দেয়। জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে বিপ্লবী সিপাহীরা যখন তাকে নিয়ে সিপাহী-জনতার সাথে মিলিত হতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসছিল, তখন ঐ সামরিক চক্রের এক হোতা জিয়াউর রহমানকে সুকৌশলে নিজের ইউনিটে নিয়ে যায় এবং পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার তৎপরতা শুরু করে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে, ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা-নৈরাজ্যের জন্য ঘাতকদের লেলিয়ে দেয় এবং সৈন্যদের মধ্যে উস্কানীদাতাদের ঢুকিয়ে দেয়। অন্যদিকে ঐ চক্র কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সিপাহী-জনতার সমাবেশকে ফাঁকা গুলী ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ চক্রটিই পরদিন ৮ নভেম্বর বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে জাসদ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের সমাবেশে হামলা চালিয়ে পন্ড করার চেষ্টা করে এবং গুলী করে তৎকালীন ছাত্রনেতা জনাব আ ফ ম মাহবুবুল হককে হত্যা করার চেষ্টা চালায়। সিপাহী বিপ্লবের চাপে জাসদের শীর্ষ নেতৃত্বকে মুক্তি দিলেও ২ সপ্তাহ পরে তাদেরকেসহ কর্নেল তাহের এবং সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করে। ছয় মাসের মাথায় গোপন বিচারের প্রহসনে ২১ জুলাই ১৯৭৬ তাহেরকে ফাঁসী দিয়ে হত্যা এবং নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এভাবেই প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রকারীরা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানকে দমন করে এবং বাংলাদেশকে এক দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে নিক্ষেপ করে।
মুশতাক হোসেন : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ১৯৮৯-৯০
অনলাইন : ৭ নভেম্বর, ২০০৮