লিখেছেনঃ আজাহারুল ইসলাম, আপডেটঃ July 25, 2008, 12:00 AM, Hits: 5101
পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার লিপি আবিষকারের পর পরই মানুষ তার আবিষকার, চিনতা ও কর্মের অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান প্রভৃতিকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়েছে সেগুলিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। প্রতিটা মহৎ সমাজই সেই প্রচেষ্টা চালিয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে সমাজ এগিয়ে গেছে। এভাবে চিনতা ও মননের সমৃদ্ধির ফলে জাতি সামনে এগিয়ে বৃহৎ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছে, সমৃদ্ধি অর্জন করেছে; জাতীয় ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে, জাতি বিকশিত হয়েছে। কিন্তু প্রাচীনকালের সেই যুগে কাগজের আবিষকার হয় নাই, ছাপাখানার তো কথাই উঠে না। যদিও তখন অনেক ভাষার লিপি তৈরী হয়ে গেছে। সেই সব লিপিতে মানুষ কষ্টসাধ্য শ্রম দিয়ে হাতে লিখে তাদের জ্ঞানকে সঞ্চয় করেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে। লিখেছে গাছের পাতায়, পশুর শুকনো চামড়ায়। সংরক্ষিত করেছে পরম যত্নে। আমাদের এই উপমহাদেশেও তালপাতা বা ভূর্জপত্রে লেখার প্রচলন ছিল। কিন্তু সংরক্ষণের সমস্যা বিশেষত বাংলা মুলুকে ছিল একেবারেই প্রকট। একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। প্রাচীন ঈস্রাইলী সমাজের চিনতাবিদ, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসকদের দ্বারা লিখিত প্রাচীন পুঁথি-পত্রের বিপুল নিদর্শন ঈস্রাইলের প্রাচীন রাজধানী জেরুজালেমের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পাহাড়ের গোপন গুহায় বড় বড় মাটির পাত্রের মধ্যে সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কয়েক হাজার বছর পূর্বের সেই সংরক্ষিত লিপি এত যুগ পরেও অজানা অনেক ইতিহাসের সন্ধান দিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিকিৎসা শাস্ত্রের সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। সেগুলো লেখা ছিল ছাগ বা উটের চামড়ায়। আর তার বিপুল অধিকাংশই পাঠযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়েছে, কারণ সেটি ছিল শুষক অঞ্চল, যার জলবায়ু লেখার সামগ্রীকে সুদীর্ঘ আড়াই-তিন হাজার বছরেও খুব বেশী নষ্ট করতে পারে নাই।
কিন্তু আমাদের এই বৃষ্টিবহুল স্যাঁতসেঁতে ভিজা জলবায়ুর দেশ বাংলাদেশে তেমন কিছুই দীর্ঘকাল সংরক্ষিত করা সহজ ছিল না সেই প্রাচীন যুগে। এই জলবায়ুতে জন্মানো সহস্র রকম কীট-পতঙ্গ, বিশেষ করে উই পোকা, ইঁদুরের মত নীরব অথচ চরম বিধ্বংসী প্রাণীর হাত থেকে প্রাচীন যুগের পচনশীল বা সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এমন কিছু সংরক্ষণ করা কি সম্ভব ছিল? ছিল না। কিন্তু তার চেয়েও আরও অনেক বেশী বিপর্যয়কর ছিল এই অঞ্চলের ভূ-গঠন প্রক্রিয়া। ভূ-গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলছি এই কারণে যে গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদনদীর পলিদ্বারা গঠিত এই অঞ্চলের ভূমিখণ্ডের গঠন প্রক্রিয়া এমন যে, নদীবাহিত পলিতে একদিকে চর পড়ে ভূমি গঠন হচ্ছে, অন্যদিকে ইতিপূর্বে গঠিত চর বা ভূমিখণ্ড ভেঙ্গে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলা এদেশের বহু হাজার বছরের প্রাচীন বা চিরনতন খেলা। ফলে দীর্ঘ কালের পরিক্রমায় এ অঞ্চলের সভ্যতার সাক্ষী যেমন সাধারণত টিকে থাকতে পারে না তেমন মানুষের মনোজগতেও এই ভাঙ্গা-গড়ার ছাপ খেলা করে। তাই বাস্তবে যেমন স্থায়িত্বের সৌধ প্রতিষ্ঠিত থাকতে চায় না তেমন মনোজগতেও কোন কিছুর উৎকর্ষ অর্জন বা রক্ষা করা খুবই কঠিন। চিনতার ধারাবাহিকতার অভাবে চিনতা শক্তির উন্নতি সাধন হয় না। তাই জাতীয়ভাবেই বাঙ্গালী সমাজে উন্নত চিনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। বৃহৎ কোন অর্জন দূর অতীতে বেশী অর্জিত হয় নাই। বাঙ্গালী অতীতে তাই সাধারণত বৃহৎ, শক্তিশালী ও সুরক্ষিত রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারে নাই। ফলে প্রায়শ অতি সহজেই বিদেশী শক্তি বাংলাকে পদানত করে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করেছে, লুণ্ঠিত হয়েছে সমগ্র জাতি। লুণ্ঠনের এ প্রক্রিয়া চলেছে দীর্ঘ কাল ব্যাপী। এই লুণ্ঠনে শামিল হয়েছে নানা জাতের, নানা ধর্মের, নানা ভাষা ও নানা দেশের মানুষ। যেন সর্বংসহা ধরিত্রীর মত পড়ে পড়ে মার খেয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ ।
সংরক্ষণ সমস্যার কারণে বাংলা মুলুকের বিস্তারিত ঘটনা জানা না গেলেও অতীতের একটা বড় ঘটনার খবর আমরা জানি। অতীতের বড় ধরনের গৌরব করার মত এই ঘটনাটা অত্যনত গুরুত্বপূর্ণ। আজ থেকে প্রায় সাড়ে বারোশ’ বছর পূর্বে তৎকালীন বাংলার বোধ সম্পন্ন মানুষেরা এক জায়গায় মিলিত হয়ে, আজকের কথায় বলা যায়, একটা জাতীয় সমেমলন বা কনভেনশনের মাধ্যমে একজন সৎ, যোগ্য ও বিচক্ষণ লোককে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করেছিল (আনুমানিক ৭৫৬ খ্রীঃ)। সেই নির্বাচিত রাজা হলেন গোপাল। ভাবতে অবাক লাগে সোয়া এক হাজার বছর আগে এই এলাকার মানুষ নিজেরা সমিমলিতভাবে রাজা নির্বাচিত করেছিল!
সাম্প্রতিক কয়েক শতাব্দীর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এবং নদীশাসন, বেড়ীবাঁধ, বড় বড় রাস্তা তৈরী ইত্যাদির মাধ্যমে নদীকে ধীরে ধীরে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করার ফলে অধুনা গড়ে ওঠা নগর-শহর-বন্দর রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। বড় বড় রাস্তা ও রেল পথ নির্মাণের ফলে আধুনিক যোগাযোগের কল্যাণে নদী উপকূল থেকে অনেক দূরেও বিরাট বিরাট শহর গড়ে উঠেছে, প্রাচীন কালে যা সম্ভব হ’ত না। কারণ প্রাচীন কালে এক সময় নদী বা জল পথই ছিল সভ্যতা গড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় যাতায়াতের সহজ মাধ্যম। আবার সেই নদীই এক সময় গ্রাস করে ফেলত সেই শহরকেই - বিশেষ করে পলিমাটির গড়া এই বঙ্গ-ব-দ্বীপ অঞ্চলে।
ঊনবিংশ শতকে এসে বাঙ্গালীর নবযাত্রার শুরু রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে ইংরেজ দখলদারদের অধীনে। ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে খানিকটা সম্পর্ক স্থাপিত হয় বটে, কিন্তু তা ছিল পরাধীন জাতির ভীরু দুর্বলতা নিয়ে, সংকীর্ণ একটা গণ্ডীর মধ্যে যার ব্যাপ্তি সীমাবদ্ধ ছিল। চিত্তের স্বাধীনতার অভাবে হৃদয়ের জমাট অন্ধকার পুরাপুরিভাবে কাটে নাই। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপ-মহাদেশ থেকে ইংরেজ বিতাড়নের সময় বাঙ্গালী জাতি হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে নাই। সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হল ১৪ শত মাইল দূরের অচেনা, ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে। সেখানে সেই ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের দ্বারা শাষিত-শোষিত-লাঞ্ছিত হলো ২৪ বছর ধরে। বিজাতীয়রা প্রথমেই মোক্ষম আঘাত হানলো ভাষার উপর। তাদের ধারণা ছিল ভাষাকে ভুলিয়ে দিতে পারলেই ভাষাহীন পশুর মত এদেশের মানুষের উপর শাসন-শোষণ চালাতে পারবে শত শত বছর ধরে। কিন্তু তাদের অংকের ভুল ধরা পড়লো। ভাষার উপর আঘাত মানতে পারে নাই বাঙ্গালী। ’৫২-তে জীবন দিয়ে সে অংকের ভুল ধরিয়ে দিলো এদেশের মানুষ।
সেই ’৫২-র পথে যাত্রা শুরু ক’রে বাঙ্গালী ’৭১-এ এসে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজেদের একটা আলাদা ঠিকানা নির্মাণ করে নিল ’৪৭-এর দ্বি-জাতিতত্ত্বের ঘেরা টোপ ভেঙ্গে। কিন্তু কী হ’লো বাঙ্গালীর জাতীয় ঐক্যের? প্রতিষ্ঠিত কি হয়েছে বাঙ্গালীর জাতীয় ঐক্য? কই জাতীয় ঐক্যতো হ’লো না! মুসলিম সম্প্রদায় সেদিন যেমন বাঙ্গালীর ঐক্য না গড়ে দেড় হাজার মাইল দূরের মানুষের সাথে ঘর বেঁধেছিল, হিন্দু সম্প্রদায়ও তেমনি ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবী না করে ধর্মকে মর্মমূলে স্থাপন ক’রে হাজারো মাইল ব্যাপী বিস্তৃত বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে মিলে এক বিশাল সাম্রাজ্য পত্তনের অংশীদার হয়েছিল। ধর্ম নিরপেক্ষতার নামের আড়ালে ধর্মের পথেই ঐক্য অর্জন ক’রে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে কি বাঙ্গালী জাতির আত্মা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাঁদে? জানি না। কিন্তু আমাদের অস্তিত্বের একটা অর্জন হলেও, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলেও আমাদের চিত্তের অর্জন কতটুকু হয়েছে? হাজার মাইল দূরের বিজাতীয় প্রতারকদের সঙ্গে ঘর বাঁধার সময় হাজার হাজার বছর ধরে একই ভূমিতে পাশাপাশি বসবাসকারী লাখো বাঙ্গালী সনতানকে শুধু ধর্মের কারণে বিতাড়িত করা হয়েছিল বা নানা অত্যাচারে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। তাদের কাছেতো আমাদের পাপের বোঝা রয়েই গেল! ক্ষমা চাওয়া তো হ’লো না! জাতির মধ্যে তো তা’হলে কখনও ঐক্য বা সহানুভূতির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে না। স্বাধীন জাতির মহৎ প্রাণের মানুষ হিসাবে তাই আজ অবশ্য, অতি অবশ্যই ভুল শুধরে নিতে হবে। আমার মাতৃভূমির আরেক সনতান, আমার আর এক ভাই যাদেরকে আমরা দেশত্যাগে বাধ্য করেছিলাম ধর্মের ভিন্নতার কারণে, তাদের কাছে, নিজেদের বিবেকের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। চিত্তের উৎকর্ষ কি আমাদের হবে না? চিনতার শক্তি কি আমরা বাড়াতে পারবো না? সে দিন আর কত দূরে? চিনতার শক্তিকে বিকশিত ক’রে চিত্তের উৎকর্ষ সাধন মহৎ জাতি ও তার উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একানত প্রাথমিক দাবী।
অনলাইন : ২৫ জুলাই, ২০০৮