লিখেছেনঃ সুজিত দাস, আপডেটঃ October 3, 2009, 12:00 AM, Hits: 15314
(মডারেট ইসলামী বাংলাদেশে হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যলঘুদের দুর্ভোগ, নিপীড়ন ও জাতিগত নির্মূলকরণের ভয়ঙ্কর চিত্র।)
“বলা হয় যে, মৃতরা তাদের কাহিনী শোনানোর জন্য বেঁচে থাকে না; কিন্তু জাতিগত নির্মূলকরণের বেলায় এটা সত্য নয়। এ ক্ষেত্রে মৃতরা তাদের কাহিনী বলে; বরং জীবিতরা কিছু বলতে চায় না।” - হরোউইৎস্, ২০০১, পৃঃ ২২৪]
এখন আমরা হিটলারের ’ইহুদী প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান’ হিসাবে ইহুদীদের উপর পরিচালিত গণহত্যা সম্পর্কে জানি। এ ইতিহাস লেখা হয়েছে মানুষের রক্তে। ভিন্ন ধর্মমতে বিশ্বাসী হত্যাকারীরা গত চার দশক ধরে একটি দেশে অন্য ধরনের ’চূড়ান্ত সমাধান’ করে চলেছে। আমি বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর পরিচালিত জাতিগত নির্মূল অভিযানের কথা বলছি। এবং হ্যাঁ, হরোউইৎসের কথা অনুসারে, প্রতিটি মৃত মানুষের কথা সতর্কতার সঙ্গে শুনতে হবে। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে বলার মত মর্মান্তিক কাহিনী। তাদের দিকে মনোযোগ দিন, আপনি তাদের নীরবতার মাঝে এক অভ্রান্ত গুঞ্জন শুনতে পাবেন। এগুলো হচ্ছে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সংখ্যালঘু অবস্থানের কারণে তাদের উপর যে দুর্দশা আর অন্যায় হয়েছে তার কাহিনী। যারা আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার মত যথেষ্ট ভাগ্যবান তারা মানসিকভাবে এমন ভেঙ্গে পড়েছে যে, তাদের সবাইকে জীবন্মৃত বলা যায়। আজ শুধু ক্ষতিগ্রস্তরা নয় বরং মানবিকতাও নিজেই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উচ্চস্বরে কাঁদছে।
বাংলাদেশ সরকার লোকগণনা সংক্রান্ত বহু দলিল প্রকাশ করেছে। ১৯৪১ সালে জনসংখ্যার ২৮ দশমিক ৩% ছিল সংখ্যালঘু। এর মধ্যে হিন্দু ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৮০ হাজার এবং ৫ লাখ ৮৮ হাজার ছিল অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যলঘু যেমন - বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও প্রকৃতি পূজারী। ১৯৯১ সালের লোকগণনা অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সংখ্যা ২১৯ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে; পক্ষান্তরে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেড়েছে ৪ দশমিক ৫%। জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক হার বজায় থাকলে ১৯৯১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দাঁড়াত ৩ কোটি ২৫ লাখ; কিন্তু বাস্তবে এ সংখ্যা ১ কোটি ২৫ লাখ (এর অর্থ হচ্ছে ২ কোটি হিন্দুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। (সামাদ ১৯৯৮)।
কীভাবে পঞ্চাশ বছরে ওই দু’কোটি মানুষ উধাও হয়ে গেল বাংলাদেশ সরকার কি তার সন্তোষজনক সদুত্তর দিতে প্রস্তুত আছে?
তারা কি হাউদিনির যাদুর মত বাতাসে মিলিয়ে গেছে?
না! ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ইসলামপন্থী পাকিস্তানী সরকার এবং তাদের বাঙ্গালী দাললেরা বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে নির্মূলের জন্য টার্গেট করেছিল, যেমনটি ইহুদীদের করা হয়েছিল হিটলারের জার্মানীতে। ২ কোটি হিন্দুর অনেককে সে সময় অজ্ঞাত স্থানে গণকবরে স্থায়ী বিশ্রাম দেওয়া হয় অথবা কোন রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় লাশ হিসাবে পুড়িয়ে ফেলা হয় অথবা তাদের মৃতদেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। অনেককে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। তাদের অনেক মহিলাকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করে পতিতায় পরিণত করা হয়। এবং তারপরও, মুসলমান গুণ্ডারা তাদের সবকিছু লুঠ করে কপর্দকহীন অবস্থায় তাদেরকে বাড়ীঘর ও জমি থেকে জোর করে বের করে দেওয়ায় তাদের অনেকে বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেন।
দুঃখজনক হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অত্যাচারের পিছনে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন ছিল। তথাকথিত মুসলমান বুদ্ধিজীবী এবং ’ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতিবিদরা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন এক দৃষ্টিভঙ্গীর পৃষ্ঠপোষকতা করছেন এবং সাধারণ বাংলাদেশী মুসলমানদের বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে, জাতিগত সংখ্যলঘুরা অভিবাসী, তারা ভূমিপুত্র নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন জেলাগুলোতে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাউন্ট হোল্ডারদের বেশী পরিমাণ নগদ অর্থ ব্যাংক থেকে তোলার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্যবসার জন্য ঋণ দেওয়া বন্ধ রাখতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে (সামাদ, ১৯৯৮)। বাংলাদেশে এটা একটা অলিখিত বিধান যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে রাষ্ট্রপ্রধান, সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর, বিদেশে বাংলাদেশী মিশনে রাষ্ট্রদূত, অথবা প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মত সপর্শকাতর পদগুলোতে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। বেসামরিক ও সামরিক চাকুরীতে নিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক ঋণ ও বাকী দেওয়ার ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে বৈষম্য করা হয়। (সাহা, ১৯৯৮, পৃঃ ৫]। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোও মেনে নিতে পারে না যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ তাদের নেতা হতে পারেন। বাংলাদেশে কোনও একটি ক্ষেত্রের শীর্ষে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘু খুঁজে পাওয়া বিরল ঘটনা।
বাংলাদেশ সরকার কি এ সত্য অস্বীকার করতে পারে যে, সংখ্যলঘুরা তাদের স্বদেশভূমিতে ’আইনত চিহ্নিত শত্রু,’ যেখানে তারা বহু প্রজন্ম ধরে বাস করছে?
এটা একটা লজ্জা! সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার সব সময় মিথ্যার ধূম্রজালের আড়ালে নিপীড়ন, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সমুদয় ঘটনা লুকানোর চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশ সরকার প্রণোদনা দিয়ে ইসলাম ধর্মে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণকে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসাহিত করে। বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ১৯৯১ সালের ২৮ নভেম্বর জারি করা ২/এ-৭/৯১-৯২ সার্কুলার মোতাবেক নও-মুসলিমদেরকে তথাকথিত পুনর্বাসনের নামে রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ থেকে নগদ অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়। (প্রেস রিলিজ)
এ নিবন্ধ লেখার জন্য নিবন্ধকার অনেক বাংলাদেশী উদ্বাস্তু ও উদার মুসলমানের সাক্ষ্যৎকার নিয়েছেন, তাদের ওয়েব সাইট সার্চ করেছেন, বহু সংবাদপত্র, বই ও নিবন্ধ পড়েছেন। এই নিবন্ধে এমন সব তথ্য তুলে ধরা হবে যেগুলো সম্পর্কে বিশ্ব সচেতন নয়।
শুরুতে, আসুন দেখা যাক বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘুদের কতটা স্বাধীনতা দিয়েছে। ১৯৭২-এর সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতাকে মৌলিক রাষ্ট্র নীতি হিসাবে ঘোষণা করেছিল। ৪১নং ধারা বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। ১২নং ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা নীতির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশ একটি বহু-ধর্মীয় সমাজে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৭ সালে এই ধারা বাতিল করা হয় এবং সামরিক শাসকদের অধীনে সাধিত সাংবিধানিক পরিবর্তনসমূহ ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ঘটায়। জিয়াউর রহমানের আমলে (১৯৭৬-১৯৮১) সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী কার্যকর করা হয়। এই সংশোধনীর আওতায় ’সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ দ্বারা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রতিস্থাপিত হয় [ধারা ৮ (১)]। সংশোধিত ধারা ৮.১ (ক)-তে বলা হয়েছে ঃ ’সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি নিরংকুশ আস্থা ও বিশ্বাস হবে সকল কাজের ভিত্তি।’ জেনারেল হু, মো, এরশাদ ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। বস্তুত এই সংবিধানের শুরু হয়েছে ’বিসমিল্লাহ্ হির রাহ্মানির রাহীম’ দিয়ে।
২৭-২৯ নং ধারা সকল নাগরিকের সমান সুযোগ চিহ্নিত করে। ৪৪ নং ধারা দ্ব্যর্থহীনভাবে মৌলিক অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয় এবং ফৌজদারী দণ্ডবিধির ২৯৫-২৯৮ বিধি ধর্মীয় স্থান ও ধর্মীয় আচরণের বিরুদ্ধে হামলা থেকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব কখনো পর্যাপ্ত নয়। সপ্তম জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাত্র ১১ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলা সদস্য ছিলেন। সব মিলিয়ে, জাতীয় সংসদে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর আসন ছিল মাত্র ৪.২৪ শতাংশ, যদিও তারা মোট জনসংখ্যার ১২%। বাংলাদেশে গণতন্ত্র হচ্ছে ধনী ব্যক্তিদের খেলা। প্রায় ৭৫% নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রথম অথবা দ্বিতীয় পেশা ব্যবসা (বর্মন ও অন্যান্য)।
নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে (একটি রাজনৈতিক দলও সংখ্যলঘুদের সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে আসে নাই (সাহা, ১৯৯৮, পৃঃ ৫)। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এক প্রতিবেদনে (১৯৯৯, পৃঃ ১৯২) জানিয়েছেঃ
’সাংবিধানিক সংশোধনীসমূহ সরকারী নীতি ও আচরণে মুসলমানদের প্রতি প্রকাশ্য পক্ষপাতিত্বের জন্ম দিয়েছে এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যকে উৎসাহিত করেছে।... রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কর্তৃক ইসলামের ক্রমবর্ধমান রাজনীতিকীকরণের ফলে ধর্মীয় সংখ্যলঘুরা ভয় পাচ্ছেন যে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় বৈষম্য তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করবে এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়াবে।’
বাংলাদেশ ’তালেবানিস্তান’ হওয়ার পথে রয়েছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, প্রকৃতি পূজারী নির্বিশেষে সংখ্যালঘুদেরকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করে এ প্রক্রিয়াকে সহায়তা যোগাচ্ছে। ইসলামী চরমপন্থীরা প্রায়শ সংখ্যলঘুদের সাংস্কৃতিক স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য তাদের মন্দির, গীর্জা ও লাইব্রেরীগুলিতে হামলা চালায়। ইসলামী চরমপন্থীরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশে একটি ছায়া সরকার গঠন করেছে। ’আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগানে বাংলাদেশের রাজপথগুলি এখন প্রকম্পিত। অনেক আগেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটেছে এবং ইসলামী উন্মাদনার জয় হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান ১৯৪৬ সালে কুখ্যাত নোয়াখালী দাঙ্গার (১০ অক্টোবর ১৯৪৬) মধ্য দিয়ে শুরু হয়। কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার পূর্ণিমার রাতে ২১৮ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়, ১০ হাজারের বেশী হিন্দু বাড়ী লুট করা হয়, ২০০০-এর বেশী হিন্দুকে জোর করে মুসলমান বানানো হয়, কয়েক হাজার হিন্দু রমণী ধর্ষিতা হন এবং শত শত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়। এসব ঘটনার দুঃখজনক দিক হচ্ছে তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্ণর মিঃ বরোজ বলেছিলেন, এটা স্বাভাবিক যে হিন্দু মহিলারা শত শত মুসলমান কর্তৃক ধর্ষিতা হবেন, কারণ এরা মুসলমান রমণীদের চেয়ে বেশী সুন্দরী (রায়, ২০০৭, পৃঃ ১২০, ১৬৫)।
তৎকালীন মুসলমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৯৭১ সালে ৯ মাসব্যাপী পরিচালিত গণহত্যায় ৩০ লাখ বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়, এক কোটি হিন্দু শরণার্থী হয়ে ভারতে পালিয়ে যান (কেনেডী, ১৯৭১, পৃঃ ৬-৭) এবং ২ লাখ নারী ধর্ষিতা হন ( রায়, ২০০৭, পৃঃ ২৯৮)। ইহুদীদের বিরুদ্ধে হিটলার পরিচালিত গণহত্যার সময় যেমনটি ঘটেছিল তেমনভাবে হিন্দু পরিবারসমূহের প্রতিবেশী মুসলমানরা হিন্দুদের বাড়ীর গায়ে হিন্দু বুঝাতে হলুদ রঙে ইংরাজী ’এইচ’ চিহ্ন লিখে রাখত, যাতে ঘাতক পাকিস্তানী সৈন্যরা সহজে তাদের টার্গেট চিনতে পারে। (শ্যানবার্গ, ১৯৯৪)। ১৯৭১ সালে তৎকালের পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার গরিষ্ঠ সংখ্যক শিকার হচ্ছে হিন্দু, প্রায় ৮০%, এর পর রয়েছে মুসলমান (১৫%) এবং খ্রীষ্টান (৫%) রায়, ২০০৭, পৃঃ ৩১২)।
বাংলাদেশে ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতন ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। ইসলামপন্থী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের তস্করেরা এবং তাদের ইসলামী মিত্র জামাআতে ইসলামী হিন্দু, খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধদের পিটুনি দিয়ে চলেছে। জাতীয়তাবাদী ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনীতিতে জড়িত হওয়া ঘোরতরভাবে অপছন্দ করে। হিন্দুদেরকে ভয় দেখিয়ে অথবা ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে নির্বাচনে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয় ( দি ডেইলী স্টার, ৪ জানুয়ারী, ২০০৬)। প্রায়ই হিন্দুদেরকে ভয় দেখানো হয় যে তারা ভোট দিলে তাদের মহিলাদের সমভ্রমহানি ঘটবে, তাদেরকে বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য করা হবে। হিন্দুদেরকে ভোট প্রদানে বিরত রাখার তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে শারীরিকভাবে বাধা দেওয়া। জাতীয়তাবাদী-ইসলামপন্থী দুর্বৃত্তরা পাহারা দেয় যাতে হিন্দুরা ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারে। প্রধানত গ্রামীণ এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে। (রায়, ২০০৭, পৃঃ ৩৫৯, ১৫২। অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য সরকার কিছুই করে না।
নারী ও শিশুদের অপহরণ ও ধর্ষণ, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরকে জোর করে বিয়ে করা, জিজিয়া করের নামে টাকা আদায়, জোর করে ধর্মান্তর করা এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে হত্যা করা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই হিন্দু বিধবাদেরকে নিজ হাতে তাদের গরু হত্যা করে এবং তার মাংস রান্না করে সবার সামনে খেয়ে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয় (রায়, ২০০৭, পৃঃ ১২০, ১২৫)।
শারীরিক নিরাপত্তার জন্য অনেক পরিবার বহু আগে থেকে তাদের ’স্বদেশভূমি’ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কারণ এই ’হিন্দু গণহত্যা’ পুরোপুরি ইচ্ছাকৃত এবং প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে সরকার কর্তৃক সমর্থিত। এর লক্ষ্য হচ্ছে সকল সংখ্যালঘুকে নিশ্চিহ্ন করে বাংলাদেশকে খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা। পরিস্থিতি এতটা উদ্বেগজনক যে, বাংলাদেশে সংখ্যলঘুদের দুর্দশা বর্ণনা করে প্রকাশিত এক নিবন্ধের (২৯ নভেম্বর, ২০০৩) শিরোনাম ছিলঃ ’বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যলঘু ঃ কেবলমাত্র বহির্গমন লাউঞ্জই নিরাপদ।’ (উদ্ধৃতি, দত্ত, ২০০৫)। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর একটা তালিকা নীচে দেয়া হলঃ
হিন্দু মহিলারা (৮ থেকে ৭০ বছর বয়সী) প্রায়ই গণধর্ষণের শিকার হন। প্রায় ২০০ হিন্দু মহিলা একই স্থানে এক রাতে ভোলার চরফ্যাশনে মুসলমানদের গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন (দি ডেইলী স্টার, ১৬ নভেম্বর, ২০০১)।
ইসলামী সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু খ্রীষ্টানদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করে বলেছে, কর দিতে না পারলে তাদের স্ত্রী, বোন ও কন্যাদেরকে মুসলমানদের হাতে তুলে দিতে হবে। (সূত্র ঃ ক্রিশ্চিয়ান সলিডারিটি ওয়ার্ল্ডওয়াইড, ১৩ ডিসেম্বর, ২০০১)।
মুসলমান সন্ত্রাসীরা মা ও মেয়েকে একত্রে একই বিছানায় ধর্ষণ করেছে, বাবা-মা এবং সন্তানদেরকে এ দৃশ্য দেখতে বাধ্য করেছে, তারা সন্তানদের সামনে মা’দেরকে ধর্ষণ করেছে। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২, ২২ এপ্রিল, ২০০২)।
১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী প্রতিবেশী গ্রামগুলোর প্রায় ৪০০ মুসলমান কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সোবাহান গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায়। মুসলমানরা তাদের মনে করিয়ে দেয় যে, ’সরকার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করেছে। সুতরাং তোমাদের হয় মুসলমান হয়ে যেতে হবে নতুবা দেশত্যাগ করতে হবে।’ তারা লুটপাটের পর প্রতিটি হিন্দু বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। মন্দিরগুলো ধ্বংস করে এবং মহিলাদের উপর গণধর্ষণ চালায়। (সূত্র, বৈষম্যের শিকার বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়, মতিউর রহমান ও আজিজুল হক সম্পাদিত, ১৯৯০, উদ্ধৃতি দত্ত, ২০০৫)।
প্রায়ই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চালান। যেমন, গোপালপুরে থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন ’মাঝরাতে একটি মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি ২টি আশ্রম, ১টি কালী মন্দির ও ৩টি বাড়ী ভাংচুর করে। এ সময় তাদের প্রহারে ৭/৮ জন আহত হয়’ (দি ডেইলী স্টার, ৩ জুন, ২০০৩।
২০০৪ সালের ২৮ আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মঙ্গলছড়িতে বিডিআর ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা মিলে গ্রামটিতে লুটপাট চালায়, মহিলাদেরকে গণহারে ধর্ষণ করে, বৌদ্ধ মন্দিরগুলো ধ্বংস করে এবং ৪০০ কাঁচাবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। এই স্থানীয় বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ১৯৪৭ সালে ছিল সেখানকার মোট জনসংখ্যার ৯৭%। ২০০১ সালে তাদের সংখ্যা ৫০% এর নীচে নেমে আসে। (মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত কান্ট্রি রিপোর্ট, ২০০৪)।
পুলিশ সাধারণত সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের ধর্ষণের শিকার হওয়া কাউকে ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে দেয় না। যদি ধর্ষণের শিকার কেউ থানায় গিয়ে অভিযোগ করে তাহলে পুলিশ নড়াচড়া করতে কয়েকদিন দেরী করে যাতে ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়। তারপর পুলিশ কর্মকর্তারা নিজেরা ধর্ষিতাকে সাজা দেয়। মামলার চেষ্টা করলে ধর্ষিতাকে হত্যা অথবা অপহরণের হুমকি দেওয়া হয়। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০০২)।
২০০৩ সালের ১৯ নভেম্বর দক্ষিণ সাধনপুর গ্রামের একই পরিবারের ১১ জন সদস্যকে (৪ দিনের এক শিশুসহ) জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় (বন্দো, ২০০৪, পৃঃ ১৩)।
কয়েক হাজার হিন্দু মন্দির ইতিমধ্যে পর্যায়ক্রমে ধ্বংস করা হয়েছে। (১৯৯২ সালেই ৩৫২)। জামায়াতে ইসলামী নেতা দেলোয়ার হোসেন সাইদী ঘোষণা করেছেন যে, মুসলমান সাধকদের ছাড়া বাকি সব মূর্তি ধ্বংস করে ফেলতে হবে। (বলডুইন, ২০০২)। ঢাকার সংস্কৃত ও হিন্দু ধর্মীয় বিশ্ববিদ্যালয় (সারস্বত সমাজ) দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বন্ধ। ১৯৭১-এর আগে পর্যন্ত এটা চালু ছিল। হিন্দু শিক্ষা ব্যবস্থা নির্মূল করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এর জমি ও অন্যান্য সম্পদ বাজেয়াফত করে। পক্ষান্তরে মাদ্রাসাগুলোর উন্নয়নের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। ( রায়, ২০০৮)।
নিম্নোক্ত সারণীতে বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার ও এ সবের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে :
ক্রমিক নং |
সহিংসতার শ্রেণী |
সহিংসতার ধরণ |
তাৎক্ষণিক প্রভাব |
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব |
১. |
রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য |
চাকুরী ও সমৃদ্ধি অর্জনে বাধা প্রদান এবং রাজনীতিতে জড়ানোকে নিরুৎসাহিত করা। |
সামাজিক মর্যাদাহানি, বেকারত্ব, সমৃদ্ধির কোন সুযোগ না থাকা। |
সামাজিক পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা ধারণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক হয়ে যাওয়া।
|
২. |
আইনগত নিপীড়ন |
১৯৭২-এর অর্পিত সম্পত্তি আইন, ন্যায়বিচার ও পুলিশ সুরক্ষা প্রায়ই পাওয়া যায় না। |
সম্পত্তি হানি, জবরদস্তি দ্বারা কৃষিজমি বেদখল হওয়া। |
দারিদ্র্য, গণ-দেশত্যাগ, বাধ্যতামূলক দেশান্তরী ও উদ্বাস্তু হওয়া। |
৩. |
শারীরিক নিপীড়ন |
শারীরিক ভাবে হেনস্থা করা, নারী অপহরণ ও ধর্ষণ। |
ভয়, আত্ম-মর্যাদা হারিয়ে ফেলা। |
গণ দেশান্তর, বাধ্যতামূলক দেশত্যাগ, উদ্বাস্তু হওয়া। |
৪. |
. মানসিক নির্যাতন |
ইসলামীদের পক্ষ থেকে মৃত্যুর হুমকি, ধর্ষণের হুমকি, লুটপাটের হুমকি। |
ভয়, নিরাপত্তহীনতা, মানসিক বৈকল্য। |
গণহারে দেশত্যাগ, বাধ্যতামূলক দেশান্তর।
|
৫. |
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অবদমন |
মন্দির ধ্বংস করা, জোর করে ধর্মান্তরিত করা, জোর করে বিয়ে করা। |
সামাজিক ও ধর্মীয় গণহত্যা। |
ঐতিহ্যগত পরিচয় হারিয়ে ফেলা, ধর্মীয় স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলা, হতাশা। |
৬. |
আর্থিক নিপীড়ন |
জিযিয়া কর হিসাবে অর্থ আদায়, মুক্তিপণের জন্য শিশু অপহরণ লুটপাট। |
ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, সম্পতি হারানো। |
দারিদ্র্য, গণ- দেশত্যাগ, বাধ্যতামূলক দেশান্তর, উদ্বাস্ত হওয়া। |
৭. |
সংগঠিত গণ-অত্যাচার |
নৃশংস আচরণ, ইসলাম অনুমোদিত অত্যাচার, ধর্ষণ। |
ধর্মীয় হত্যকাণ্ড, নিষ্ঠুর দুর্ভোগ। |
জনসংখ্যা হ্রাস, গণ- দেশত্যাগ, বাধ্যতামূলক দেশান্তর, উদ্বাস্ত হওয়া। |
৮. |
পূর্বনির্ধারিত গণ-হত্যা |
১৯৭১-এর কুখ্যাত গণহত্যা, ১৯৪৬-এর নোয়াখালী গণহত্যা, ইসলাম অনুমোদি গণহত্যা। |
গণ-মৃত্যু, এতিমদের সংখ্যাবৃদ্ধি। |
সম্প্রদায় নিজেকে টেকসই হিসাবে পুনর্গঠিত করতে পারে না এবং অস্থিতিশীল হয়ে যায়, দারিদ্র্য বাড়ে, গণ- দেশত্যাগ ঘটে, উদ্বাস্তু ও ঘরছাড়া হয় জীবিতরা। |
৯. |
তথ্য গোপণ করা |
সৎ সাংবাদিক শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট লোকজনকে হত্যা করা হয়, মানবাধিকার তদন্তকারীদেরকে আটক করা হয়। |
বর্বরতা অপ্রকাশিত থাকে। গণমাধ্যমে নীরবতা বিরাজ করে, সেন্সরশীপ আরোপ করা হয় এবং ক্ষমতাসীনরা টাকা দিয়ে গণমাধ্যমকে বশ করে। |
বিশ্ব উদাসীন থাকে এবং জাতিগত নির্মূলকরণ নির্বিঘ্নে চলতে থাকে।
|
বাংলাদেশ সরকার এ সমস্ত ’বৈধভাবে চিহ্নিত শত্রুদের’ জমি যে কোন সময় আইনগতভাবে দখল করে নিয়ে তাদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করতে পারে। বাংলাদেশে একজন হিন্দুর জমি অধিগ্রহণ করে তা একজন মুসলমানকে দিয়ে দেওয়া আইনগতভাবেই বৈধ। অর্পিত সম্পত্তি আইন আসলে পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনের অনুরূপ। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়। প্রকাশ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাকিস্তান তখন শত্রু সম্পত্তি আইন পাস করে। এ আইনের লক্ষ্যবস্তু ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। এই আইন হিন্দুদের সম্পত্তি শত্রুসম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করে দখলে নেওয়ার জন্য সরকারকে ক্ষমতা দেয়। স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ শত্রু সম্পত্তি আইন পাল্টে অর্পিত সম্পত্তি আইন করেছে। কিন্তু এতে পরিষকার বলা হয়েছে যে, আইনটির শিরোনাম ছাড়া আর কিছু পাল্টানো হয় নাই। এই আইন হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মনে দারুণ ভীতি সঞ্চার করেছে। তারা এখন তাদের নিজ দেশে বহিরাগত, রাষ্ট্রের শত্রু। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় প্রায় ৫ জন নাগরিকের ১ জন ছিলেন হিন্দু। আজ এই অনুপাত ১০-এর মধ্যে ১-এর চেয়েও কম। অর্পিত সম্পত্তি আইন এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশঙ্কা হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়ার দুই প্রধান কারণ। (আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ১৯৯৯, পৃঃ-১৯২)।
অর্পিত সম্পত্তি আইন কতটা অমানবিক এবং এ ধরনের আইন কতটা অবমাননাকর?
এক মুহূর্তে চিন্তা করুন, মার্কিন অথবা কানাডীয় আইন সরকারকে ক্ষমতা দিয়েছে যে, অখ্রীষ্টানদের জমি ও সম্পত্তি বাজেয়াফত করে সেগুলো খ্রীষ্টানদেরকে দিয়ে দেওয়া যাবে; অথবা ভারত সরকার বা ইসরায়েলী সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মুসলমানদের জমি কেড়ে নিয়ে সেগুলো যথাক্রমে হিন্দু ও ইহুদীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। এটা কল্পনা করা কঠিন নয় যে, সেক্ষেত্রে অত্যন্ত সঙ্গত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানবাধিকার গ্রুপ, এনজিও, মিডিয়া এবং সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ উঠবে। প্রতিটি সৎ নাগরিক এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন।
সৌভাগ্যক্রমে এ ধরনের কোন অনৈতিক আইনের অস্তিত্ব সভ্য দুনিয়ায় নাই। ফলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনকে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে হচ্ছে না। কিন্তু কয়েক দশক ধরে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ ধরনের বর্বর আইন চালু আছে। তাদের আইন এবং উপরে বর্ণিত কাল্পনিক আইনের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে, এ দু’টি দেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আইনগুলি অমুসলিমদের সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য প্রণীত।
অর্পিত সম্পত্তি আইনে দখল করা সম্পত্তি দ্বারা বাংলাদেশে প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দল উপকৃত হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে দখল করা সম্পত্তির ৪৫% গেছে মধ্যডানপন্থী বিএনপির ভাগে, মধ্যবামপন্থী আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৩১% (এই অনুপাত উল্টে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে); ১৫% পেয়েছে ইসলামপন্থী দলগুলো এবং বাকিগুলো গেছে জাতীয় পার্টি ও অন্যদের কব্জায় (বেনকিন)। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অর্পিত সম্পত্তির আওতায় হিন্দুদের ২০ লাখ একরের বেশী জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। (বরকত ও জামান ১৯৯৮)।
সংবাদপত্রের অপর এক রিপোর্ট অনুসারে আদিবাসী সম্প্রদায় ইতিমধ্যে তাদের ৮০% জমি হারিয়েছে। জোরালো রাজনৈতিক মদতপুষ্ট স্থানীয় গুণ্ডারা এসব জমি দখল করেছে। সরলপ্রাণ আদিবাসীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞ। স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত দলিল এবং আইনী বিধান সম্পর্কে তাদের তেমন একটা ধারণ নাই। ফলে তারা সহজেই সুযোগ সন্ধানীদের খপ্পরে পড়ে যায়। (ভৌমিক ও ধর ১৯৯৯)। ময়মনসিংহের গারো উপজাতিদের অস্তিত্ব ইতিমধ্যে হুমকির সমমুখীন। কারণ সরকার তাদের প্রাকৃতিক অরণ্য রাবার বাগানের জন্য নিয়ে নিয়েছে।
অপর একটি রিপোর্ট অনুসারে (বরকত ও শফিকুজ্জামান, ১৯৯৬, পৃঃ ৭) এই আইনের কারণে ১৯৬৪ সাল থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫৩৮ জন হিন্দু ’উধাও’ হয়ে গেছে। একই রিপোর্টে হিসাব করে দেখানো হয়েছে যে, উধাও হওয়ার হার সব সময় এক রকম ছিল না। ১৯৬৪-৭১-এ এই হার ছিল দৈনিক ৭০৩ জন, ১৯৭১ এবং ১৯৮১ সালের মধ্যে দৈনিক গড়ে ৫৩৭ জন এবং ১৯৮১-৯১ সালে দৈনিক গড়ে ৪৩৯ জন (ত্রিবেদী, ২০০৭)। অপর একটি রিপোর্টে প্রাক্কলন করা হয়েছে যে, প্রতিদিন গড়ে ৫০০ জনের বেশী হিন্দু সীমান্ত পার হচ্ছে (চৌধুরী, ১৯৯৮, পৃঃ ২১৪)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে ব্যাপক সমীক্ষা চালিয়ে এই উপসংহারে পৌঁছেন যে, ১৯৯৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ হিন্দু পরিবার এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এই আইনের আওতায় ইতিমধ্যে হিন্দুদের মালিকানাধীন জমির অর্ধেকের বেশী বাজেয়াফত করা হয়েছে (বেনকিন, ২০০৮)।
এখানে জমি দখলের আরেকটি সাধারণ পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশী মুসলমানরা অধিকাংশই হচ্ছে ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক। পক্ষান্তরে হিন্দুদের অনেকে ধনী কৃষক। তাদের আছে প্রচুর কৃষি জমি, যেগুলো মুসলমান চাষীরা চাষ করে। হিন্দুরা যখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তখন কতিপয় মুসলমান তাদের রক্ষক হিসাবে আবির্ভূত হয়। এর বিনেময়ে তারা ঐ হিন্দুদের কাছ থেকে কিছু জমি নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয়। কিছুদিন পর তাদের আর দেখা যায় না। তাদের স্থানে অপর একদল ’রক্ষক’ এসে হাজির হয়। তারাও কিছু জমি জলের দরে কিনতে চায়। এভাবে পর্যায়ক্রমে হিন্দু তার জমাজমি হারিয়ে ভারতে গিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। পদ্ধতিটা হচ্ছে যতটুকু সম্ভব তার জমি নামমাত্র দামে বৈধ করে নিয়ে নেওয়া (রায়, ২০০৭, পৃঃ ১৬৫)।
২০০১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এই আইনে বাজেয়াফত করা সব জমি প্রকৃত মালিককে ফেরত দিবার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু কোন হিন্দু তাদের জমি ফেরত পায় নাই। এর পিছনে দু’টি কারণ আছে।
প্রথমত, এ ধরনের আইন বাতিলের কোন ইচ্ছা শাসক দলের নাই। এখনও অর্পিত সম্পত্তি আইন বলবত আছে এবং সক্রিয়ভাবে আইনটিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মেয়াদের শেষ লগ্নে ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন পাস করেছিল। প্রত্যেকে মনে করে যে, এটা একটা ফাঁকা উদ্যোগ। আওয়ামী লীগ সরকার জানত যে, এ আইন কখনও কার্যকর হবে না।
কিছু একটা করার জন্য তাদের হাতে পাঁচ বছর সময় ছিল। কিন্তু তারা কিছুই করে নাই। এটা ছিল একটা লোক দেখানো তৎপরতা। বস্তুত, আওয়ামী লীগ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মত অর্পিত সম্পত্তি আইনের সমান সুবিধাভোগী। সুতরাং কোন জমি ফেরত দেওয়া হয় নাই (বেনকিন, ২০০৯)।
দ্বিতীয়ত, আইনী ব্যবস্থায় প্রায় প্রত্যেক স্তরে দুর্নীতির ছোঁয়া লেগেছে। আইনী প্রক্রিয়ার ব্যাপক অপব্যবহার চলছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী এ ধরনের অন্যায় আচরণ বিচার বিভাগের উপর আস্থা ক্ষুণ্ন করছে। কেরানী ও পিয়নরা প্রায়ই ঘুষ খেয়ে রেকর্ড-পত্র এলোমেলো করে ফেলে, দলিল সরিয়ে ফেলে, এমনকি কখনও কখনও এগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। এমনকি বাংলাদেশে বিচারকদের ঘুষ খাওয়া অথবা অন্যান্য অন্যায় সুযোগ নেওয়া সাধারণ ব্যাপার (তালুকদার, ১৯৯৪, পৃঃ ১০১)। পুলিশও দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ শ্রেণী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বস্তুত, বার্লিন ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০০১ ও ২০০২-এ বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ দেশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এটা বুঝতে কষ্ট হবে না যে, আদালতের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বেশী সংখ্যক হিন্দু আইনের সুবিধা পাবে না।
কী আশ্চর্য! একজন বাংলাদেশী কর্মকর্তা এমনকি অর্পিত সম্পত্তি আইনকে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ’সুরক্ষার’ একটি ধরন হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আবার আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কাজী আজিজুল হক বলেছেন, অনেক হিন্দু তাদের জমাজমি পরিত্যাগ অথবা বিক্রি করে ’স্বেচ্ছায়’ চলে গেছে (বেনকিন)। বিশ্ব কি ভুলে গেছে যে, অসংখ্য জার্মান ইহুদী ১৯৩০-এর দশকে ’স্বেচ্ছায়’ তাদের সম্পত্তি হস্তান্তর করেছিল?
নিয়তির নির্মম পরিহাস! ১৯৭১ সালে নবীন বাংলাদেশ ছিল ভারতের কাছে গভীরভাবে ঋণী। ভারতের সমর্থন ছাড়া দেশটি কখনও স্বাধীন হতে পারত না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনও বাংলাদেশে জাতিগত নির্মূল অভিযানের পূর্ণাঙ্গ রূপ স্বীকার করে না; কারণ তথ্যগুলো প্রায়ই অপ্রকাশ্য থেকে যায়। প্রায়ই মানবাধিকার তদন্তকারীদেরকে আটকে রাখা হয়। মিডিয়ার উপর অনেক সময় সেন্সরশীপ থাকে অথবা মিডিয়াকে কিনে ফেলা হয়। সৎ সাংবাদিকদের খুন করে ফেলা হয়। তাই, গোটা বিশ্ব এ ব্যাপারে উদাসীন। তাদের নিষিক্রয়তা দুষকর্মগুলোকে সমান তালে চালিয়ে যেতে এসবের হোতাদেরকে উৎসাহিত করছে। তবে এসব সত্ত্বেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাহায্যপুষ্ট আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন কমিশন কিছু দলিল পেয়েছে। এ ধরনের অত্যাচার ও নিপীড়ন সম্পর্কে তদন্ত চালাবার জন্য বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা একটি ’তথ্য অনুসন্ধানী কমিশন’ গঠন করেছে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশী সংবাদপত্রগুলো সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনাসমূহ প্রকাশ করতে শুরু করেছে। সংখ্যালঘু নিপীড়নের তথ্যসমূহ চাপা রাখতে ইসলামী মৌলবাদীরা অনেক সাংবাদিককে হত্যা করেছে। তারা খুন করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট সদস্যদেরকে এবং সেই সঙ্গে উদারমনা মুসলমানদেরকে। এদের অনেককে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে।
ফারইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ-এর হংকং ভিত্তিক সিনিয়র সাংবাদিক এবং দি ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের কন্ট্রিবিউটর লেখক বার্লিন লিন্ট্নার গভীর হতাশার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন কীভাবে বাংলাদেশে কর্তৃপক্ষ প্রথমে তাকে সে দেশে ভ্রমণের জন্য ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল। তার প্রথম রিপোর্ট নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যাওয়াই এর কারণ। তাকে ই-মেইলে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, তিনি যদি আবার বাংলাদেশ সফরের দুঃসাহস দেখান তবে তাকে সাংবাদিক ডানিয়েল পার্ল্-এর ভাগ্য বরণ করতে হবে (জঙ্গীরা তাকে পাকিস্তানে অপহরণের পর হত্যা করেছিল)। লিন্টনার উল্লেখ করেছেন যে, ইসলামী মৌলবাদের উত্থান এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এই অঞ্চল এবং তার বাইরের জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে (গুহ মজুমদার, ২০০৩)।
আমেরিকান জুরি অ্যাসোসিয়েশনের কানাডীয় শাখার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম স্লোন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন। একজনের হাতের আঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছে, আরেক জনের গোটা হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে, কয়েক জনের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে এবং বেশ কয়েক জনের পায়ে অথবা পেটে লোহার রড ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি মহিলা ও নারী শিশুদের উপর পরিচালিত গণ-ধর্ষণের হৃদয় বিদারক কাহিনীও বর্ণনা করেছেন। এসব ঘটনা প্রায়শই ঘটেছে আক্রান্তদের বাবা অথবা স্বামীর সামনে (বলডুইন,২০০২)।
তসলিমা নাসরীন তার ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ’লজ্জা’য় একটি হিন্দু পরিবারের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যা তিনি নিজ চোখে দেখে বিস্ময়ে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। মুসলমান আলেমরা তাকে হত্যার ফতোয়া দিয়েছিল। প্রাণভয়ে তিনি ইউরোপে পালিয়ে যান। এখনো তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
লন্ডনে অবস্থানকারী কলামিস্ট ও উদার মানবাধিকার কর্মী আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, ’সংখ্যালঘুদের উপর কী ঘটেছে তা দেখার পর আমি নিজেকে একজন মুসলমান বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাই (গুহ মজুমদার, ২০০৩)।
এটা বেদনাদায়ক যে, উত্তরাধিকারের অভিন্ন শিকড়, সংস্কৃতি ও ধর্মের অংশীদার হয়েও ভারতের হিন্দুরা বাংলাদেশে তাদের স্বধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে উদাসীন। এটা ভারতীয়দের জন্য (বিশেষ করে সেসব বৃদ্ধ, অথর্ব এবং মেরুদণ্ডহীন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের জন্য) চরম অমর্যাদাকর এবং প্রকৃত লজ্জার ব্যাপার যে, তারা ইসলামী বাংলাদেশে হিন্দু উচ্ছেদ অভিযানের ঘটনাবলী নীরবে দেখেই যাচ্ছেন। স্বধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে যখন ভারতীয়রাই নীরব তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আর কী আশা করা যায়! অথচ এটা ভারতীয়দের জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকার সময় নয়। ভারতের মাটিতে হিন্দু শরণার্থীদের অব্যাহত অনুপ্রবেশের ঘটনা আমরা কীভাবে উপেক্ষা করি? এর মূল কারণ হচ্ছে, এই সমস্যা প্রকাশ্যে মোকাবিলার এবং ভারতে মুসলিম ভোট-ব্যাংক ভিত্তিক রাজনীতিকে উপেক্ষা করার সাহস মেরুদণ্ডহীন ভারতীয় রাজনীতিবিদদের নাই।
হিন্দু শরণার্থীদেরকে জোরালো আইনী সুরক্ষা দিতে হবে। এতে তাদের মানবাধিকার, তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, চলাফেরার স্বাধীনতা এবং কর্মসংস্থানের উন্নততর সুযোগ নিশ্চিত হবে। তাদের অনেকে উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে সৃজনশীল অবদান রাখার যোগ্যতা রাখেন। এক সময় তারা বাংলাদেশে ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু এখন ভবঘুরে দিন মজুর অথবা রিকশা চালকে পরিণত হয়েছেন। আরো খারাপ অবস্থায় পড়ে তাদের কেউ কেউ হাড় জিরজিরে শরীর নিয়ে আবর্জনা পরিষকারের কাজ করছেন। শরণার্থী সম্প্রদায়ের প্রতিটি ধ্রুপদী সংজ্ঞা তাদের বেলায় প্রযোজ্য। বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায় তাদেরকে মর্মবেদনা আর দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছু দেয় নাই। কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সভ্য সমাজের কাছ থেকে তারা কিছু প্রত্যাশা করতে পারে। ইতিহাস সাক্ষী, মহান জাতি ভারতীয়রা কখনও কাউকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে নেয় নাই। তাহলে কেন এই উদাসীনতা? সুযোগ পেলে তারা সমৃদ্ধি অর্জন করবে।
সৃষ্টিকর্তার নিষ্ঠুর রসিকতার মত অনেক মুসলমানও উন্নততর জীবনযাত্রা অর্জন এবং ইসলামী সন্ত্রাসবাদ বিস্তার করার জন্য হিন্দু শরণার্থীর ছদ্মবেশে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদেরকে ইতিবাচকভাবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে।
বাংলাদেশে বর্ণবাদী শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিলের জন্যও ভারত সরকারের চাপ সৃষ্টি করা উচিত। এই উদ্ভট আইন মানবিক মর্যাদার প্রতিটি নীতিকে আঘাত করে। এই আইন বলবত থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বৈধ বলে গণ্য হবে। যেসব শরণার্থী এই আইনের কারণে স্থাবর সম্পত্তি হারিয়েছেন তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যে পর্যন্ত ভারত সরকার, যাকে এই ঘৃণ্য আইনের শিকারদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে হয়েছে, কোন পদক্ষেপ না দেয় ততদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছুই করবে না। ফাঁকা বুলি আওড়ানো, খোঁড়া অজুহাত দেখানো এবং সিদ্ধান্তহীন আনুষ্ঠানিক বৈঠক করার সময় শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে শুধু পদক্ষেপ দিতে নয়, উপরন্তু দ্রুত পদক্ষেপ দিতে বাধ্য করতে হবে। চেষ্টা যতটা চালানো হবে তার চেয়ে বেশী জোর দিতে হবে ফল অর্জন করার উপর। ফল অর্জন করতে হলে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের অবশ্যই তাদের ব্যক্তিগত অহমিকা দূরে সরিয়ে রাখতে হবে এবং স্বীকার করে নিতে হবে যে আমাদের লক্ষ্য ও বাংলাদেশী হিন্দুদের কল্যাণ ব্যক্তি হিসাবে আমাদের যে কারও চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি জনগণের জন্য কোন কাজ সম্পন্ন করতে পারি তবে কারা এর জন্য সাফল্য অথবা প্রশংসা পেল তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের অনেকেই নিজেকে অথবা নিজ নিজ সংগঠনকে যে কোন ভাল কাজের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। অবশ্যই সেটা সেই কাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। ভারতীয় রাজনীতিবিদদের অবশ্যই একটি ছত্রছায়া সংগঠন গড়ে তুলতে হবে যা প্রতিবেশী দেশগুলোতে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধে যাবতীয় তৎপরতার সমন্বয় সাধন করবে। কোন ব্যক্তি বা গ্রুপকে তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হবে না; তবে যদি আমরা এ সমস্ত মানুষকে সাহায্য করার ব্যাপারে সফল হতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত হতে হবে। এটা শুধু হিন্দুদের ব্যাপার নয়; বরং ভারতের শিখ, খ্রীষ্টান ও অন্যরাও যদি সমতায় বিশ্বাস করে তবে তাদেরকেও প্রকাশ্যে চেষ্টা চালাতে হবে যেন ভারতের প্রতিবেশীরা সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারের প্রতি সমমান দেখায়।
সর্বশেষ, এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সভ্য দুনিয়াকে এই মানবিক ট্র্যাজেডি বন্ধের দাবী জানাতে হবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যরা প্রায়শই বিশ্বের বিভিন্ন অংশে মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকারী গ্রুপ গঠনের দাবী জানায়; কিন্তু এ ব্যাপারে তারা নীরবতা পালন করে আসছে। অনুরূপভাবে, জাতিসংঘ, ন্যাটো এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনকে সব ধরনের আন্তর্জাতিক গোলযোগপূর্ণ এলাকায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারাও এই ইস্যুতে নীরব।
এই নিবন্ধের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের সকল চিন্তাশীল নাগরিক, সৎ ও সাহসী সাংবাদিক, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা, বিশ্বজনীন জনমত সৃষ্টিকারী, মানবাধিকার গ্রুপ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে যেন তারা দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যলঘু সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের সদয় দৃষ্টি দেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান, হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লংঘনের জন্য দায়ী নিপীড়কদেরকে অবশ্যই উচিত সাজা দিতে হবে। মানব জাতি ইতিহাসে অসংখ্য জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। ইসলামের ১৪০০ বছরের লিখিত ইতিহাস খুললে দেখা যায়, এর প্রতিটি পৃষ্ঠা থেকে রক্ত ঝরছে। মুসলিম বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে তা নূতন নয়। আধুনিক যুগে সভ্য দুনিয়া তাদেরকে সময়মত মোকাবিলার ব্যাপারে শৈথিল্য দেখিয়েছে। সাধারণত মৃতদেহের সতূপ অতি উঁচু না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা হয় না। যদি বাধা দেওয়া না হয় তবে বাংলাদেশী মুসলমানরা খুব শিগগিরই সংখ্যালঘুদেরকে সে দেশের মাটি থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ করে ইসলামী ইতিহাসে আরেকটি গৌরবময় অধ্যায় যুক্ত করবে। তারা কি সফল হবে? দেখা যাক।
References
Books, Journals and Newspapers:
১. Ain O Shalish Kendra (1999); Human Rights in Bangladesh 1998 Report, Dhaka, Bangladesh.
২. Bando, Ramen (2004); Ethnic Cleansing in Bangladesh. Campaign against atrocities on minorities in Bangladesh. Sahitya Porishad, London.
৩. Barkat A. Zaman S (1998); Vested Property Act: Political and Economic Consequences. A paper presented at a seminar on ‘Political Economy and Legal Aspects of the Vested Property Act’ on 15 March 1998, Grameen Research Trust, Dhaka.
৪. Barkat, Abul & Shafiquzzaman (1996); Bangladesher Grameen Samaje Arpito Sampattite Ainer Probhab: Ekti Anusandhan (In Bengali language). A report submitted to the National Seminar of Association for Land Reform and Development, 13 April 1996.
৫. Bhoumic, Nim Chandra; Dhar, Basu Dev (1999); Adivasi Upojadider Dabi Nie Shongothon (in Bengali language). A report published on The Prothom Alo on 24 February 1999.
৬. Cowdhury, Afsan (1998); Disasters: Issues and Responses, in Bangladesh Environment: Facing the 21st Century. Society for Environment and Human Development, Dhaka.
৭. (Dr.) Benkin, Richard L (2009); Private e-mail exchange with the present author.
৮. Dutta, Nabendu (Director, Bangladesh Hindu, Buddhist, Christian Unity Council, U.S.A.) (2005); The 11th Session of the Working Groups on Minorities. The United Nations High Commissioner for Human Rights. U. N., Geneva, May 30-June 3, 2005.
৯. Horwitz, Donald (2001); The Deadly Ethnic Riot. University of California Press, Los Angeles.
১০. Kenedy, Edward (1997); Crisis in South Asia, A report by Senator Edward Kennedy to the Subcommittee investigating the Problem of Refugees and their Settlement, Submitted to U. S. Senate Judiciary Committee, November 1, 1971, U.S. Gov. Press.
১১. Prof./Dr. Saha, S. S. (1998): Manadhikar O Bangladesher Sangkhalaghuder Samasya (Original in Bangla). Published in Dainik Ittefaq on 22 July 1998, Dhaka.
১২. Roy, Tathagata (2007); A Suppressed Chapter in History. The Exodus of Hindus from East Pakistan and Bangladesh 1947-2006. Bookwell Publishers. New Delhi.
১৩. Schanberg, Sydney (1994); The Pakistani Slaughter That Nixon Ignored. New York Times, May 3, 1994.
১৪. Talukder, S. M. Hasan (1994); Independence of Judiciary in Bangladesh: Law and Practice, Book Syndicaate, Dhaka.
১৫. Trvedi, Rabindranath (2007); The legacy of enemy turned vested property act in Bangladesh, Published on Asia Tribune on 29 May 2007.
Internet:
১. Baldwin, Ruth (2002): The ‘Talibanization’ of Bangladesh. Published in The Nation Magazine on 17 May/2002. URL: http://www.thenation.com/doc.mhtml?i=special&s=baldwin20020517 (Last accessed 28 June 2009)
২. Barman, Dalem Ch; Rahman, Golam; Siddique, Tsneem (nd); Democaracy report for Bangladesh. URL: www.idea.int/publications/sod/upload/Bangladesh.pdf (Last accessed 27 June 2009).
৩. (Dr.) Benkin, Richard L (2008); Repeal Bangladesh’s Racist Vested Property Act, International Analyst Network, an outline portal for analysis in the areas of Counter-Terrorism, the Middle-East, Geopolitics and Energy Security. Published on 1st August 2008. URL: http://www.analyst-network.com/article.php?art_id=2322 (Last accessed 03 May 2009.
৪. (Dr.) Benkin, Richard L (nd); Part ONe: The Roots of Ethnic Cleansing in a Quite Case of Ethnic Cleansing in Bangladesh. URL: http://www.interfaithstrength.com/Roots.htm (Last accessed on 03 May 2009)
৫. (Dr.) Benkin, Richard L (nd); Part |Two: Islamist Attacks and Government Collusion in A Quiet Case of Ethnic Cleansing in Bangladesh URL: http://www.interfaithstrength.com/Collusion.htm (Last accessed 03 May 2009)
৬. Guha Mozumder, Suman (2003); Bangladesh ruling party accused of ethnic cleansing. URL: http://www.rediff,com/us/2003/feb/19bang.htm (Last accessed 04 July 2009)
৭. Press Release (nd): European Union Blasted for Ignoring Hindu Abuse in Bangladesh. URL: http://www.hvk.org/articles/0703/50.httml (Lst accessed 27 June 2009)
৮. Roy, Amarendra (2008) MInorities and the Right to Education. A report submitted at The Forum on Minority Issues, 2008 (15-18 Decmber 2008). Conference in the United Nations CH-1201 Geneva, Switzerland. (Last accessed 27 June 2009)
৯. Samad, Saleem (1998)L State of Minorities in Bangladesh: From Seclar to Islamic Hegemony; Mukto-mona. URL: http://www.mukto-mona.com/Articles/saleem/secular_to_islamic.htm (Last accessed 04 July 2009)
The author can be contacted at counter.jihad (at) yahoo.co.uk
(নিবন্ধটি Sujid Das লিখিত Humanity Assassinated: Ethnic Cleansing of Minorities in Islamic Bangladsh -এর বাংলায় ভাষান্তর। এটি ইসলাম ওয়াচ (www.islam-watch.org)-এ ১২ জুলাই, ২০০৯ তারিখে প্রকাশিত হয়। কারিগরী সমস্যার জন্য মূল নিবন্ধে প্রকাশিত চিত্রগুলি এখানে দেওয়া গেল না। - বঙ্গরাষ্ট্র)
সম্পাদকের মন্তব্য ঃ
নিবন্ধটি একজন ভারতীয়ের দৃষ্টি থেকে লেখা হলেও এবং এতে দু’য়েকটি ঘটনা প্রসঙ্গে কিছু অতিরঞ্জন থাকলেও (যেমন বলা হয়েছে, ’প্রায়ই হিন্দু বিধবাদেরকে নিজ হাতে তাদের গরু হত্যা করে এবং তার মাংস রান্না করে সবার সামনে খেয়ে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয়।’ কিছু ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে পারে। কিন্তু এটা ব্যাপক ও সর্বজনীন ঘটনা নয়।) এটিতে বাংলাদেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর মুসলিম সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কর্তৃক বিশেষত ১৯৪৭ সাল থেকে যে হৃদয় বিদারক অত্যাচার পরিচালনা করা হয়েছে এবং এখনও যার ধারাবাহিকতা শেষ হয় নাই তার একটি ভগ্নাংশ মাত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রকৃত চিত্র আরও অনেক অনেক বেশী ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ, যা সম্ভবত কোনও বিবরণ দিয়েই তুলে ধরা সম্ভব নয়। যারা ভুক্তভোগী একমাত্র তারাই এর প্রকৃত রূপ জানেন ও বুঝেন। কিন্তু তারাও যত দ্রুত সম্ভব তিক্ত ও অবর্ণনীয় বেদনাদায়ক সমৃতি ভুলে যেতে চান। কবির ভাষায়, ’কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!’ এক সময় সত্যিই সবকিছু বিসমৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আমরা মনে করি জাতি হিসাবে, ধর্ম-সম্প্রদায় হিসাবে নির্মোহভাবে আমাদের আত্মবিচারের প্রয়োজন সর্বাধিক। তার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের চেহারাটা কি দেখবার প্রয়োজন সর্বাধিক নয়? আমরা মনে করি এই নিবন্ধ আংশিকভাবে হলেও সেই আয়নার প্রয়োজন পূরণ করে। সুতরাং সেই বিবেচনা থেকে আমরা নিবন্ধটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করলাম। একটি উন্নত ও মানবিক সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন বোধ থেকেই আমরা এ দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষদের উপর পরিচালিত নির্যাতনের বিষয়টিকে তুলে ধরতে চাই। সুতরাং নিবন্ধ, প্রতিবেদন, মতামত ও অভিজ্ঞতার বিবরণের মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য আমরা আমাদের লেখক ও পাঠক সবার নিকট আহ্বান জানাচ্ছি।
শামসুজ্জোহা মানিক ৩ অক্টোবর, ২০০৯
অনলাইন ঃ ৩ অক্টোবর, ২০০৯