Banner
বাংলাদেশের ভূমি : জবর দখল ও ভ্রষ্টাচারের চর্চা ও বিধি-বিধান - মোঃ নুর হোসেন পাটওয়ারি

লিখেছেনঃ মোঃ নুর হোসেন পাটওয়ারি, আপডেটঃ April 4, 2009, 12:00 AM, Hits: 8900

১৯৭১ সালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের যে রাষ্ট্রের আবির্ভাব, সেই রাষ্ট্রের অধিকাংশ ভূমিই তিস্তা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও আরও অসংখ্য নদ-নদীর বাহিত পলিমাটি দ্বারা সৃষ্ট। তাই এই ভূমির উর্বরতা শক্তির তীব্রতা পৃথিবীর অন্যান্য যে কোন পাথুরে ভূমির চাইতে বহুগুণ বেশী। তাই আবহমান কাল থেকে এই ভূমিই বাঙ্গালীর পরম নির্ভরতার জায়গা। বাঙ্গালীর প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ফলমূল, মৎস্য ইত্যাদি সার্বিক প্রয়োজন এই ভূমি এত কাল যোগান দিয়ে এসেছে। যে ভূমিকে অবলম্বন করে বাঙ্গালী বেঁচে আছে সেই ভূমির আকর্ষণে দ্রাবিড়, মোঙ্গল, অস্ট্রিক, আর্য, মোঘল, পাঠান, প্রভৃতি জাতি এদেশে এসেছে এবং এদেশের ভূমি ও সম্পদ কুক্ষিগত করেছে এবং ভূমিপুত্র কৃষককে ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছে বা তাদের উৎপাদিত ফসলের উপর ভাগ বসিয়ে তাদেরকে শোষণ করেছে। বাংলার আদি জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলার বাহির থেকে আসা অনেক জনগোষ্ঠী কালক্রমে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। বিষয়ের ব্যাপকতা স্মরণে রেখে শুধুমাত্র মোঘল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বাংলার ভূমি ও ভূমি প্রশাসনের দুর্বলতার বিষয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।

প্রাচীন কালের ধারাবাহিকতায় মোঘল যুগে এদেশের ভূমির উপর এ দেশের কৃষকের একচ্ছত্র অধিকার ছিল না। কৃষক ইচ্ছা করলেই তার দখলী জমি অন্য কারও কাছে বিক্রয় করতে পারতো না। নানা ধরনের রাষ্ট্রীয় ও গোষ্ঠীগত বাধা ছিল। আবার মোঘল বাদশাহ্‌ও এই ভূমির চূড়ান্ত মালিক ছিল না। কেননা তখন শহরের বহু জমি বাদশাহ্‌ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে খরিদ করে নিজের কাজে লাগাতেন। এমনকি দুর্গ, মসজিদ, কবর স্থান, মন্দির তৈরীর জন্যও বাদশাহ্‌ জনগণের কাছ থেকে জমি খরিদ  করতেন। কিন্তু বাদশাহ্‌ যেহেতু দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করেন সেইহেতু ভূমি রাজস্ব পাবার সার্বভৌম অধিকার ছিল বাদশাহের হাতে। জমিদার একটি ফার্সি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে ভূমির ব্যাপস্থাপক বা তত্ত্বাবধায়ক; মালিক নয়। জমিদার নামক প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল মূলত বাদশাহের খাজনা আদায় করা। অবশ্য জমিদার এর বিনিময়ে আদায়কৃত খাজনার শতকরা দশ ভাগ কমিশন হিসাবে পেতেন। এছাড়াও তখন জমিদারদের একটি বাড়তি দায়িত্ব ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণ বেশী থাকার কারণে, এবং কৃষিই যেহেতু মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত সেই কারণে, সরকারী আমলারা কৃষককে গ্রামে ধরে রাখার জন্য মুচলেকাবদ্ধ ছিল। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষি ঋণ প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল। তাই কৃষকরা তখন তাদের জমি বিক্রি করতে না পারলেও জমিতে উৎপাদিত ফসল তারা বিক্রি করতে পারতো; এবং যেহেতু জমিদারদের কাজ ছিল সরকারের পক্ষে রাজস্ব আদায় করা সেহেতু তারা কৃষককে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারতো না বা কৃষকের ভূমি নিজের খাস দখলে নিতে পারতো না। মূলত মোঘল আমলে জমিদার ও কৃষকের জমির উপর পারসপরিক দায়বদ্ধতা ছিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতবর্ষ থেকে মশলা এবং অন্যন্য পণ্য আমদানী ক’রে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করার জন্য মোঘল সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করে। ক্রমে ক্রমে তারা ভারতবর্ষের সম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং এরই প্রেক্ষাপটে তারা ১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভ করে বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মূলত তিনটি কারণে বাংলায় নতুন ধরনের ভূমি রাজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা প্রচলন করতে প্রয়াসী হয় :

(১) সমগ্র ভারতবর্ষকে জয় করার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন

(২) দালাল শ্রেণী সৃষ্টি

(৩) ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের বাজার তৈরী

১৭৬৫ সালের ১২ই আগস্ট মোঘল বাদশাহ শাহ্‌ আলমের নিকট থেকে কোম্পানী যখন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে, তখন এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কোম্পানী অতিরিক্ত ভূমি রাজস্ব সংগ্রহের জন্য  নতুন ধরনের জমিদারী প্রথার সূচনা করলে ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চ তারিখে ইংল্যান্ডের আদলে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে স্থায়ীভাবে প্রবর্তন করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের ফলে প্রত্যেক জমিদার তার এলাকায় ভূমির একচ্ছত্র মালিকানা লাভ করে। জমিদারগণ কৃষকের নিকট থেকে খাজনা আদায়, নদী-জলাশয় প্রভৃতিতে মৎস শিকারের জন্য জলকর, গো চারণের জন্য ঘাসকর, ফল বাগান থেকে ফলকর, বনজ সম্পদ আহরণের জন্য বনকর, খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য খনিকর আদায় করতো। ১৭৯৩ সালের ১৪ নং রেগুলেশন দ্বারা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোং নিয়ম করে যে, জমিদারগণ বৎসরের শেষে নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব পরিশোধ না করলে তাদেরকে কারারুদ্ধ করা এবং তাদের সম্পত্তি ক্রোক করে নিলাম করা হবে। ফলশ্রুতিতে জমিদারগণ নির্দিষ্ট বর্ধিত খাজনা আদায় করে কোম্পানীকে প্রদানের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। জমিদারকে জমির মালিক হিসাবে ঘোষণা করার ফলে এবং জমিদারকে প্রজাদের সঙ্গে চুক্তি করার অধিকার প্রদানের ফলে, জমিদাররা ইচ্ছামত খাজনা ধার্য করতো। প্রজারা জমিদারদের ধার্যকৃত খাজনা প্রদানে ব্যর্থ হলে তদের গরু, বাছুর, লাঙ্গল সহ সকল সম্পত্তি ক্রোক এবং বিক্রি ক’রে বসতবাটি থেকে উচ্ছেদ করতো। এভাবেই একটি বেনিয়া গোষ্ঠী বাংলার শাসন ক্ষমতা দখল ক’রে আবহমান কাল ধরে চলতে থাকা সমৃদ্ধিকে কৌশলে ধ্বংস করে ফেলে। যে জমিদারগণ মোঘল আমলে ছিল রাজস্ব কর্মচারী মাত্র, যারা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি তথা কৃষককে গ্রামে ধরে রাখার জন্য মুচলেকাবদ্ধ ছিল, তাদেরকেই বৃটিশরা জমির মালিকানা স্বত্ব প্রদান করে জমির মালিক বানিয়ে তাদেরকে বাংলা থেকে সম্পদ লুট করার এজেন্ট বানিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ফকির  বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ  প্রভৃতি।

১৮৫৭ সালে বৃটিশ রাজা ভারতবর্ষের শাসনভার কোম্পানীর নিকট থেকে বুঝে নেন। জমিদারদের ইচ্ছে মত খাজনা বৃদ্ধি ও আদায় এবং রায়তকে তার জমি থেকে উচ্ছেদ করা থেকে বিরত রাখার জন্য ১৮৮৫ সালে ’বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন’ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে বলা হয় দখলী স্বত্বের রায়তকে তার জোত-জমি থেকে আদালতের ডিক্রী ব্যতীত উচ্ছেদ করা যাবে না। রায়ত যে উদ্দেশ্যে জমি পত্তন নিয়েছিল তার পরিপনী্থ কোন কাজ করে জমির ক্ষতি করলে বা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করলে ভূম্যধিকারী রায়তকে উচ্ছেদ করার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করতে পারত। এই আইনের অধীন বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য প্রজার ক্ষেতের ফসল ভূম্যধিকারী কর্তৃক ক্রোক নিলাম করার বিধান বাতিল করা হয় নি বরং তা অব্যাহত ছিল। এই আইন ভূম্যধিকারীকে কতিপয় কারণে খাজনা বাড়াবার অধিকার দেয় এবং কতিপয় কারণে প্রজাকে খাজনা কমাবার অধিকার দেয়। খাজনা বাড়ানো বা কমানো যেত আদালতের ডিক্রীর মাধ্যমে। কিন্তু খাজনা একবার বাড়ানো হলে পরবর্তী পনের (১৫) বৎসরের মধ্যে খাজনা বাড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়। এই আইনে খাজনার অতিরিক্ত টাকা বা আবওয়াব প্রজার নিকট থেকে আদায় করা নিষিদ্ধই শুধু করা হয় নি বরং আবওয়াব আদায় করলে জমিদারদের জরিমানা করার বিধান করা হয়েছে।

জমিদারী ব্যবস্থা উৎখাতের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম হয়। ১৯৩৭ সালে ’বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভা নির্বাচন’-এ একে ফজলুল হক জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দিয়েও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেন নি। ফলে মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশনে মন্ত্রীসভা গঠন করতে হয়। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের লক্ষ্যে এ কে ফজলুল হক ১৯৩৮ সালে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে ’ভূমি রাজস্ব কমিশন’ গঠন করেন। জমিদারী প্রথা সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বহাল রাখা যুক্তিসঙ্গত কিনা এবং সরকারের সাথে প্রকৃত চাষীদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কৃষি জমিতে সর্বপ্রকার উপরস্থ স্বার্থে সরকারের পক্ষে অধিগ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত ও সম্ভব কিনা, তা তদন্ত করার জন্য ফ্লাউড কমিশনকে ক্ষমতা দিয়েছিলেন এ কে ফজলুল হক । সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০ সালে তাদের দাখিলি প্রতিবেদনে জমিদারী প্রথা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিলোপ করে প্রজাদের সরাসরি সরকারের অধীনে আনয়নের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু ’প্রাদেশিক আইন সভা’-এর অনেক সদস্যের বিরোধিতার জন্য জমিদারী প্রথা তখন বিলোপ করা সম্ভব হয় নি। ইতিমধ্যে শেরে বাংলার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা ১৯৪৩ সনে পদত্যাগ করার পর খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ দলের সদস্যদের দ্বারা মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। উল্লেখ্য মুসলিম লীগ দলের নীতি ছিল জমিদারী প্রথা রক্ষা করা। অবশেষে দীর্ঘ চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে ১৯৫৬ সালের ২রা এপ্রিল বিজ্ঞাপ্তিমূলে ১৯৫০ সনের ’রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন’ কার্যকর করা হয়। ১৭৯৩ সনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা প্রজাদের ভূমির উপর চিরকালীন প্রথাসমমত অধিকার খর্ব করে, সরকারের অধীনে থেকে জমিদারের অধীনে ন্যস্ত করার একশত তেষট্টি বৎসর পর ১৯৫৬ সনে, প্রজাগণ আবার সরকারের অধীনে সরাসরি ন্যস্ত হয়েছিল। আর এভাবেই জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল। জমিদারদের স্বত্ব-স্বার্থ অধিগ্রহণের পূর্বে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১,৭৬,৭৪,৬০৯,০০ টাকা এবং অধিগ্রহণের পর রাজস্ব আসে ১০,৬৬,৩৬,৩৬৭,০০ টাকা।

জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ফলে প্রজাগণ বহুল পরিমানে ভূমিকর, জলকর, ঘাসকর, বনকর ও প্রভৃতি আবওয়াব প্রদানের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং দেশের নাগরিকত্ব অর্জনের সমমান লাভ করে তথা জমিদারদের অধীনতা থেকে মুক্তি পায়।

বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের অবির্ভাবের পর, ভূমিকেন্দ্রিক শত শত বৎসরের সকল জুলুম, অত্যাচার রহিত করে, বাঙ্গালীর প্রাণপ্রিয় ভূমির উপর বাঙ্গালীর চিরকালীন অধিকার প্রতিষ্ঠার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। এবং এরই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে ৯৬ নং আদেশ দ্বারা ’রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন’ সংশোধন করে ২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমির খাজনা মওকুফ করা হয়।

রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ৯৮ নং আদেশ দ্বারা কোন পরিবারের জমি রাখার ঊর্ধ্ব সীমা ১০০ বিঘা হিসাবে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়াও বিধান করা হয় যে, জমি বন্ধক রেখে ঋণ নিলে ৭ বৎসর পর সেই ঋণ থেকে মুক্তি ঘটবে, যাকে বলা হয় ’খাই খালাসি বন্ধক’।

১৯৮৪ সনে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ দ্বারা জনগণকে আরও স্বস্তি দেয়া হয়। এই অধ্যাদেশে বলা হয় যে, কেহ ৬০ বিঘার উপর কৃষিজমির মালিক হতে পারবে না; উদ্দেশ্য সম্পদের সুষম বণ্টন। বেনামীতে জমি হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হল।

পল্লী এলাকার কোন জমির মালিক তার কোন জমি বাস্তু বা বসতবাড়ি হিসাবে ব্যবহার করলে কোন কর্মকর্তা, আদালত বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উক্ত ভূমি আটক, ক্রোক, বাজেয়াপ্ত, বিক্রয় সহ সর্বপ্রকার আইনগত প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি লাভ করবে। এবং ঐরূপ জমির মালিককে কোনভাবেই উক্ত জমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। পল্লী এলাকায় কোন খাস জমি পাওয়া গেলে সরকার তা ভূমিহীন কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে বন্দোবস্ত দিবেন। এ ছাড়াও বর্গাদারদের স্বার্থ সরক্ষণের জন্য শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর উপনিবেশিক আমলের সকল অত্যাচার নির্যাতন ও শোষণমূলক বিধি-বিধান অপসারণ করে উদার, টেকসই, উন্নয়ন মূলক আইন-কানুন প্রণীত হলেও, সেই আইন শুধুমাত্র বইয়ের পাতাতেই দেখা যায়। যাই হোক, আমি এখন ভূমি প্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়ের কিছু বাস্তব সমস্যা আলোচনা করবো।

রাষ্ট্রের পক্ষে সকল ভূমির মালিক ডেপুটি কালেক্টর বা D.C. সাহেব। ডিসি সাহেবের অধীনে প্রত্যেক থানায় একজন রাজস্ব কর্মকর্তা থাকেন। যার পদবী Assistant Commissioner of Land বা A.C. Land। সহকারী কমিশনার তার এলাকার সকল তহসিল অফিসের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত।

প্রত্যেক থানায় যে সকল তহসিল কার্যালয় আছে, সেখানে তহসিলদারদের ও সহকারী তহসিলদারদের দ্বারা কাজের তদারকি করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং তাকে সহায়তা করার জন্য আছেন আমিন ও কানুনগো। A.C. Land-এর কাজের তদারক করেন জেলা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। আবার জেলা প্রশাসকের কাজের তত্ত্বাবধান করেন বিভাগীয় কমিশনার। বিভাগীয় কমিশনারের কাজের তত্ত্বাবধান করেন ভূমি আপীল বোর্ড - বোর্ডের কাজের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করেন ভূমি মন্ত্রণালয় বা ভূমি সচিব এবং এর উপর ভূমি মন্ত্রী।

এখন আসা যাক, সর্বনিম্ন রাজস্ব কর্মচারী তহসিলদারের কাছে। তহসিল অফিসে ভূমির রেকর্ড থাকে (যেমন সিএস, এসএ, আরএস)। তহসিল অফিসে ভূমি রেকর্ড দেখতে গেলে টাকা দিতে হয়। তহসিল অফিসের অন্য কাজ হচ্ছে খাজনা নেওয়া। অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা না হলে খাজনার রশিদ দেওয়া হয় না। খাজনার রশিদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা কেবল একজন আইনজ্ঞই জানেন। খাজনার রশিদ ছাড়া কোন বাড়ীর উপর লোন নেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়াও যে সমস্ত জমি একসনা বন্দোবস্ত রয়েছে সে সমস্ত জমির খাজনা হয়তোবা ৫ টাকা কিন্তু রশিদ কাটার জন্য ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।

এবার আসা যাক, এসি ল্যাণ্ড অফিসে। খতিয়ানে অর্থাৎ ভূমির স্বত্ব লিপিতে উত্তরাধিকার বা হস্তান্তরের জন্য নাম প্রতিস্থাপনের জন্য এসি ল্যাণ্ডের নিকট কেইস ফাইল করতে হয়। এবং এখানে আমিন, কানুনগোকে টাকা না দিলে তারা পেপার তহসিলদারের নিকট ফরওয়ার্ড করে না। অতঃপর আবার তহসিলদারকে উপর্যুপরি অর্থ প্রদান করলে  তা রিপোর্ট আকারে পুনরায় এসি ল্যাণ্ড অফিসে পাঠানো হয়। এর মানে এসি ল্যাণ্ড ও অন্যান্য কর্মচারীকে পয়সা না দিলে জমির নাম জারি বা মিউটেশন হবে না।

খাস জমি উদ্ধার, খাস জমি ভূমিহীন বসতবাটিহীন লোকদের মধ্যে বিতরণ, জলমহাল ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি কার্যের দায়িত্ব সহকারী কমিশনারের (ভূমি) উপর থাকার কারণে, উক্তরূপ সকল কার্যের জন্য বহুল পরিমাণে অর্থের সমাগম ঘটে এসি ল্যাণ্ড-এর পকেটে। এছাড়া ডিসি ও তহসিলদাররাও অনুমোদন ও প্রতিবেদন দাখিলের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ পকেটস্থ করেন। এই সুযোগে প্রতাপশালী ব্যক্তিরা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে সরকারী খাস জমি উদরস্থ করে। তহসিলদার থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই এতে লাভবান হয়।

২০০৭-এর ১/১১-এর পর দেখা গিয়েছে ঢাকা শহরের অনেক সরকারী জমি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হয়তবা বাচ্চাদের  খেলার জন্য নকশাকৃত জমি অথবা অন্য কোন কাজের জমি, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বন্দোবস্ত দিয়েছে। সেই সমস্ত জমিতে এখন বিরাট বিরাট অট্টালিকা, মার্কেট প্রভৃতি।

এখন আসা যাক ভূমি রেজিস্ট্রেশনের প্রসঙ্গে। ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনের ৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, “যে সকল দলিলের রেজিস্ট্রেশন আবশ্যক তাহা যদি রেজিস্ট্রি না হয়, তাহা হইলে উক্ত দলিল দ্বারা সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে বর্তমান বা ভবিষ্যত কোন প্রকার অধিকার বর্তাইবে না এবং দত্তক গ্রহণের ক্ষমতা নিবে না।” সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে  রেজিস্ট্রেশন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য এই রেজিস্ট্রেশন করে থাকেন একজন সাব রেজিস্ট্রার। তিনি আবার আইন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন।

মুঘল আমলে কানুনগো রাজস্ব নির্ধারণ এবং রাজস্ব সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র যেমন সংরক্ষণ করতেন তেমন তিনি আবাদি জমি, পতিত জমির পরিমাণ, বিভিন্ন ফসলের বিবরণ, ফসলের বাজার দর, রাজস্বের হার, আদায়ের পরিমাণ, ঘাটতির পরিমাণ ইত্যাদি সরক্ষণ করতেন। এছাড়া তিনি জমি হস্তান্তরের দলিল, জমি সংক্রান্ত আদালতের ডিক্রী সংরক্ষণ, নিবন্ধন ও তার অনুলিপি প্রদান করতেন। অর্থাৎ মুঘল আমলে তহসিল অফিস ও রেজিস্ট্রশন অফিস একই ছিল।

কিন্তু ব্রিটিশরা উপনিবেশিক শাসন দৃঢ় করার প্রত্যয়ে অর্থাৎ এ দেশের মানুষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে, ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও ভূমি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের জন্য আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরী করে। তহসিল অফিসে ভূমির প্রকৃতি ও মালিকানা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য থাকে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন অফিসে ভূমি হস্তান্তর সংক্রান্ত তথ্য থাকে। ফলে কেউ যদি কোন জমি রেজিস্ট্রি করার জন্য রেজিস্ট্রেশন অফিসারের নিকট উপস্থিত হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তিই যে ঐ জমির মালিক তা নির্ণয়ের কোন উপায় থাকে না। ফলে একজন অনায়াসেই অন্যের জমি বিক্রি করে দিতে পারবে। সাব রেজিস্ট্রারের নিকট রেজিস্ট্রির জন্য উপস্থিত হলে তিনি জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হবেন যে তিনিই কি দলিল সম্পাদন করেছেন কিনা? (রেজিস্ট্রেশন আইন, ধারা - ৩৫)। রেজিস্ট্রিকারী অফিসার দলিলটির বৈধতা অথবা যথার্যতা প্রতিপাদন করতে পারবেন না (PLD 1975 Kar. 786)। এই আইনের পরিণতি - জোর যার মুলুক তার। হানাহানি, মারামারি। ব্রিটিশরা এই উদ্ভাবনী কৌশলের বলেই ১৯০ বৎসর শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল।

কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার পর কেউই এই ইচ্ছাকৃত প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা ও দুর্বলতার পরিসমাপ্তি ঘটাতে উদ্যোগী হয় নাই। এখন আসা যাক সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতির বিষয়ে।

কোন সম্পত্তির উপর দলিল রেজিস্ট্রি করতে হলে অনেকগুলো আনুষ্ঠানিকতা পার করতে হয়। যেমন: দলিল উপস্থাপন, কেনা-বেচার তল্লাশী, দলিলে ভুল-ভ্রান্তি সংশোধন, টিপসই গ্রহণ, দলিলের নকল গ্রহণ প্রভৃতি কাজ; এবং এ সকল কাজেই অর্থ প্রদান করতে হয়। মূল অর্থ যায় সাব রেজিস্ট্রারের পকেটে। প্রতিটি দলিল রেজিস্ট্রি করতে ৩০০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকা সাব রেজিস্ট্রার সাহেবকে (!) দিতে হয়, অন্যথায় তিনি সই করেন না। আবার কোন কোন দলিলে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এটাই বাস্তব, এটাই সত্যি!

এখন আসা যাক, ভূমি সংক্রান্ত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দপ্তরে। এটার নাম ভূমি রেকর্র্ড ও জরিপ অধিদপ্তর। এটা আবার Land Ministry-এর আওতাধীন।

১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের বিধান অনুযায়ী ভূমি স্বত্ব নির্ধারণ ও খতিয়ান প্রস্তুত করার জন্য ১৯৪০ সালে অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশে জমি সরেজমিনে জরিপ করা হয়েছিল। সকল প্রকার ভূমির স্বত্বাধিকারীর নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। যাকে বলা হয় ক্যাডাষ্ট্রাল সার্ভে বা সিএস খতিয়ান। মুঘল আমলেও রাজস্ব নির্ধারণের জন্য ভূমি জরিপের প্রচলন ছিল।

পাকিস্তান আমলে আর কোন ভূমি জরিপ হয় নাই। বাংলাদেশ আমলে এখন জরিপের কাজ চলছে। জরিপটা হয় দখলী স্বত্বকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ জরিপের লোকজন এসে জমিতে দখলকারের নাম, পরিচয়, জমির পরিমাণ, জমির প্রকৃতি ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করে। তা বিভিন্ন পর্যায়ে সংশোধন করে ভূমি মন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। মন্ত্রী তার Approval দিয়ে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে উক্ত রেকর্ড ফাইনালাইজ করে , সব শেষে তা DC-এর কাছে প্রেরণ করা হয়। DC সাহেব এক কপি তহসিলদারের কাছে এবং এক কপি  সেটেলমেন্ট অফিসে প্রেরণ করেন।

এই দখলী স্বত্বের রেকর্ড এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তা ব্যাখ্যা করার জন্য আইনের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি অন্যের সম্পত্তি প্রকাশ্যভাবে মালিকের গোচরে ১২ বৎসরের ঊর্ধ্বে দখল করে রাখে, তবে সে ক্ষেত্রে জবরদখলকারীর স্বত্ব পাকা হয় এবং আসল মালিকের স্বত্ব নষ্ট হয়। আর এই দখল আদালতে প্রমাণিত হয় খতিয়ান বা পর্চার ভিত্তিতে।

জমি জরিপ করে মূলত সার্ভেয়াররা। এখন কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাই।

ভূমি জরিপ কয়েকটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। প্রথম দফায় সার্ভেয়াররা জমিতে আসে এবং মাপ-জোক করে মালিক অথবা দখলকারের নাম লিখে নিয়ে যায়। এই পর্যায়ে যদি তাদেরকে উপর্যুপরি অর্থ দেওয়া না হয় তাহলে, যার জমি আছে ১০ শতাংশ তার জমি খসড়ায় আসবে ২ শতাংশ আর যার জমি আছে ২ শতাংশ তার আসবে ১২ শতাংশ। এরূপ গণ্ডগোলের ফলে ডিসপুট হয় এবং সার্ভেয়াররা আবার জমিতে আসে সঠিক পরিমাপের জন্য এবং মানুষ তখন মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদান করতে বাধ্য হয়।

যে সমস্ত জমিতে কোন মালিক নাই কিন্তু দখলকার আছে, সেখানে সার্ভেয়াররা মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে, উক্ত জমিতে দখলকারের নাম অন্তর্ভুক্ত করে। যা তামাদি আইন দ্বারা একটি শক্তিশালী দলিলে পরিণত হয়।

আর যে সমস্ত জমি একাধিক ব্যক্তি দাবী করে, সে সমস্ত জমিতো স্বর্ণের খনিতে রূপান্তরিত হয়। এই ডিসপুট সেটেলমেন্ট অফিসার পর্যন্ত গড়ায় এবং সেখানে মোটা অঙ্কের অর্থের আদান-প্রদান ঘটে।

দেখা যায় যমুনা বা পদ্মায় চর জেগেছে ১০০০ বিঘার। শুরু হয় দুই প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীর মধ্যে লড়াই। যারা অধিক ঘুষ দিয়ে সেটেলমেন্ট অফিসারকে পড়হারহপব করতে পারবে, তাদের এলাকায় সেটেলমেন্ট অফিসার ভূমিরেকর্ড করে দেবে। এভাবেই একজন মন্ত্রীও আমার এক সেটেলমেন্ট অফিসার বন্ধুকে ৫০,০০০ টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে।

ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে ঢাকার সাভারে জরিপ চলার সময়। সেখানে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকাউন্টিং-এর একজন প্রফেসরকে ভয়ঙ্করভাবে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। অর্ধশিক্ষিত সার্ভেয়ারদের দ্বারা তার কি লাঞ্ছনাই না হল! তা আমার পক্ষে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। প্রফেসর সাহেবের অপরাধ তিনি সার্ভেয়ারদের পয়সা দেবার ব্যাপারে আপত্তি করে ছিলেন।

আর নিদারুণ অভিজ্ঞতা ঘটে নোয়াখালী জেলায়। সেখানে এক গরীব কৃষক সার্ভেয়ারদের টাকা দিতে না পারার কারণে, এবং সেই কৃষকের প্রতিবেশী প্রতাপশালী ব্যক্তি বহুল পরিমাণে টাকা দেবার ফলে, সেই গরীব কৃষকের জমি প্রতিবেশী ব্যক্তির নামে রেকর্ড করে সার্ভেয়ার। যা ক্রমান্নয়ে খতিয়ানে রূপান্তরিত হয়। অবশ্য খতিয়ান সংশোধন বা জমি জরিপে কোন প্রকার ভুল কিছু রেকর্ড হলে তা সংশোধনের জন্য প্রতি জেলায় একটি ল্যাণ্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আছে। ঐ ট্রাইব্যুনালের দোরগোড়ায় কতটুকু পৌছাতে পারে সেই গরীব কৃষক?

বাংলাদেশের ভূমিকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট সমস্যা হচ্ছে জবর দখল। প্রকৃতিগতভাবেই বাংলাদেশে বিশাল জনসংখ্যার অনুপাতে ভূমির পরিমাণ কম হওয়ায় এই সমস্যার উদ্ভব। আরও গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় দুই হাজার বছর পূর্বেও এই সমস্যার অস্তিত্ব ছিল (আগ্রহী পাঠকেরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র দেখতে পারেন)। এই সমস্যাটি জনগণের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে হুমকির সমমুখীন করে তোলে।

যাই হোক, বর্তমান কালে এই সমস্যাটি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। কেউ যদি গায়ের জোরে, অর্থের জোরে অন্যের ভূমি দখল করে তাহলে সেই ভূমি মালিককে আইন কতটুকু রক্ষা করে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা বেআইনী দখলদার তারা কিছু অর্থ খরচ করে কিছু জাল কাগজপত্র বের করে থাকে, এবং এর ভিত্তিতে তারা অবৈধভাবে ভূমি দখল করে। অনেকে আবার জাল কাগজ তৈরি করারও প্রয়োজন মনে করে না। দখলচ্যুত ব্যক্তির দখল ফিরে পাবার উপায় কি? তাকে দখল উদ্ধারের জন্য দেওয়ানী আদালতে যেতে হবে। আদালতে যাওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে জমির মূল্যের উপর কোর্ট ফি প্রদান। সর্বোচ্চ কোর্ট ফি ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপরে রয়েছে উকিলের ফি এবং প্রতি স্তরে-স্তরে ঘুষ প্রদান। ৩-৪ বছরের মাথায় মামলার রায় হবে। সময় বেশি লাগে কারণ মামলার তুলনায় বিচারকের স্বল্পতা।

এরপর ঐ রায় কার্যকর করার জন্য পুনরায় ডিক্রী জারির জন্য মামলা করতে হয়। এটা আইনের বিধান। এছাড়াও ডিক্রীর বিরুদ্ধে পরাজিত পক্ষের আপিল, আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল, রিভিশন, রিভিউ প্রভৃতি করে শেষ পর্যন্ত আসতে আসতে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। আর অর্থ খরচ হয় তার চাইতেও বেশি।

এখন আসা যাক অবৈধ দখলদারের শাস্তি কি হয়? সে যে এই ২০ বছর জমির দখল ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করেছে তার কি হয়? কিছুই না, কিছুই না। কিন্তু প্রকৃত মালিকের জীবন শেষ।

এই সমস্যার সাথে জড়িত রয়েছে সমাজে শান্তি ও স্থায়িত্বের প্রশ্ন। ডেভেলপার কোম্পানীদের অবৈধ ভূমি দখল রোধ করার জন্য আইন প্রণয়নের চিন্তা একবার হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর করা হয় নাই। মন্ত্রী, এমপি, গ্রামের জোতদার, ধনী কৃষক তারা কি পরিমাণ ভূমি দখল করে আছে? আইন হলে তাদের বাঁচার উপায় কি?

এরকম বহু ধরনের সমস্যা রয়েছে বাংলাদেশের ভূমি ও ভূমি প্রশাসনকে কেন্দ্র করে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারা এই সমস্যার কথা জানেন। কিন্তু সমাধানের প্রচেষ্টায় অগ্রসর হন না। উপনেবিশিক কাল থেকে এদেশের মানুষ তার প্রাণপ্রিয় ভূমি নিয়ে কি পরিমাণ যন্ত্রণা, ক্লেশ ভোগ করেছে তা ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে। বৃটিশ আমলে যে কৃষককে অতিরিক্ত খাজনা ও আবওয়াব প্রদানে ব্যর্থ হবার জন্য জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো তা-ও আলোচিত হয়েছে। এবং সমগ্র প্রক্রিয়াতে যে উপনেবেশিক শক্তির ইন্ধন ও মদদ ছিল তা-ও আলোচিত হয়েছে। এ সকল কিছু আমাদের রাষ্ট্রনায়করা অবিহত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের যা দিয়েছেন তা হচ্ছে সুন্দর সুন্দর আইন। যার প্রয়োগ প্রশ্ন সাপেক্ষ! এছাড়াও ভূমি রেজিস্ট্রশন বিভাগ ও তহসিল অফিস একত্রীকরণ, আইন সংশোধন সবই এখনও এড়িয়ে যাবার বিষয় হয়ে আছে। বর্তমানে ভূমি প্রশাসনের কর্মচারীরা উপনিবেশিক শাসকের জায়গা দখল করে নিয়েছেন।

শেষ একটি ঘটনা বলেই কথা শেষ করতে  চাই। আমি ভেবেছিলাম আমি বোধ হয় ভূমি প্রশাসনের সকল দুর্নীতি জেনে ফেলেছি! নিচের ঘটনা জানার পরে মনে হল আমার জানার আরও অনেক বাকী আছে। কয়দিন আগে আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে তার বোনের বাড়ী যাই। বন্ধুর ঐ বোনের বাড়ী ঢাকার ধানমণ্ডিতে। বোন জামাই সাব রেজিস্ট্রার। সেই বাড়ী থেকে বের হবার পর আমার বন্ধু বললো বাসার সবাই টেনশনে আছে। কারণ সাব রেজিস্ট্রার দুলাভাই কোন এক জায়গায় এক বৎসরের পোস্টিং-এর জন্য ৮৬ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছে। অন্য কেউ যদি এর চাইতে বেশী ঘুষ দেয় তবে তার পোস্টিং কনফারম্‌ড হবে। আর তার যদি পোস্টিং না হয় তবে ঘুষের টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত। ঘুষের টাকার পরিমাণ এত হলে রিটার্ন কত আসবে? এভাবেই কি দেশ দুর্নীতি ও সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাবে?

অনলাইন : ৪ এপ্রিল, ২০০৯

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ