লিখেছেনঃ শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ June 13, 2009, 12:00 AM, Hits: 8133
ইসলামী সমাজে অনেকেই বলে থাকে যে, ইসলাম নারীকে মর্যাদা দিয়েছে, নিরাপত্তা দিয়েছে। ইসলামী শাস্ত্রে তথাকথিত পণ্ডিতরাও একথা বলে থাকেন। কিন্তু একটু মুক্ত মন দিয়ে ইসলামী সমাজের নারীদের অবস্থা দেখলে এ কথার কী কোনও প্রমাণ দেখা যায়? প্রচার মাধ্যম্যের মধ্য দিয়ে যে সমস্ত খবর আমাদের কাছে এসে পৌঁছে তার বাইরে নারী নিগ্রহের যে অসংখ্য ঘটনা ঘটে সেসব কিছুই আমরা জানতে পারি না। জন-মানসের দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে নারীর উপর সে সব নির্যাতন, নিগ্রহ বা অবমাননাকে সমাজ অন্যায় বা বর্বরতা হিসাবে দেখে না। ইসলাম যে নারীকে শুধু অমর্যাদা আর অবমাননাকর জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে তাই নয়, ইসলামী আদর্শের অব্যাহতভাবে চর্চার মাধ্যমে সমগ্র সমাজ মানসকে নারীর বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছে। বিশেষভাবে যে সব সমাজে ইসলামীকরণ বেশী হয়েছে, সেখানে নারীর দুরবস্থা অবর্ণনীয়। ইসলামপন্থীরা যতই গলা ফাটিয়ে নারীর মর্যাদার কথা প্রচার মাধ্যমে বলুক, আসলে তো নারীর প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায় সেইসব সমাজে নারীর সামগ্রিক অবস্থা থেকে, সামাজিক প্রক্রিয়ায় তার অংশগ্রহণ ও তার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। এ বিষয়টি বোঝার জন্য মোটেই পণ্ডিত হবার দরকার হয় না, দরকার সামান্য পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর মুক্ত মন দিয়ে দেখার মানসিকতা।
তথাকথিত নারীর মর্যাদা দানকারী ইসলাম নারীর মর্যাদার কথা দু’একবার বললেও বাস্তবে তাকে পুরুষের অধীনস্থ করে দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছে। ইসলামের মূল গ্রন্থ কোরআন থেকে যেমন এর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় তেমনি মোহামমদের কথা, কাজ ও সমমতির উপর ভিত্তি করে যে হাদীস গ্রন্থসমূহ১ রচিত হয়েছে সেগুলোও এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। কোরআন-এর২ কিছু আয়াতে আমরা দেখিঃ
২২৮। তালকপ্রাপ্তা স্ত্রী তিন রজঃস্রাব কাল প্রতীক্ষায় থাকিবে। তাহারা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী হইলে তাহাদের গর্ভাশয়ে আল্লাহ্ যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন তাহা গোপন রাখা তাহাদের পক্ষে বৈধ নহে। যদি তাহারা আপোষ-নিষ্পত্তি করিতে চায় তবে উহাতে তাহাদের পুনঃগ্রহণে তাহাদের স্বামিগণ অধিক হকদার। নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে যেমন আছে তাহাদের উপর পুরুষদের; কিন্তু নারীদের উপর পুরুষদের মর্যাদা আছে। আল্লাহ্ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরাঃ ২ বাকারা)
৩৪। পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাহাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীরা অনুগতা, এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হিফাজতে উহারা হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাহাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর। যদি তাহারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাহাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অন্বেষণ করিও না। আল্লাহ্ মহান, শ্রেষ্ঠ। (সূরাঃ ৪ নিসা)
অর্থাৎ নারী গৃহের অন্তরালে থাকবে অর্থনৈতিকভাবে স্বামীর উপর নির্ভরশীল হয়ে এবং স্বামীর করুণা প্রার্থী হয়ে শর্তহীন আনুগত্য দিবে। এছাড়াও প্রযোজনে স্বামী তাকে প্রহার করতে অর্থাৎ মারতেও পারবে। দুটি পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষকে এই ধরণের একতরফা ক্ষমতা দান সেই পক্ষকে বিপদজনকভাবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে ও স্বেচ্ছাচারী হতে প্ররোচিত করে। এক পক্ষ অপর পক্ষের দয়ার উপর নির্ভর করে।
আমরা জানি যখন দুইটি পক্ষের মধ্যে কোনও চুক্তি সম্পাদিত হয়, তখন উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য চুক্তিতে অনেক রকম ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উভয় পক্ষকে যেমন চুক্তি বাতিল করার ক্ষমতা দেওয়া হয় তেমনি প্রয়োজনে আইনানুগ উপায়ে সালিশির আশ্রয় নেবার ব্যবস্থাও রাখা হয়। এছাড়া মতদ্বৈধ হলে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথও খোলা রাখা হয়। অর্থাৎ চুক্তিতে সকল পক্ষ যেমন সম মর্যাদা ভোগ করে তেমনি উভয় পক্ষের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়। কোরআনে নারী-পুরুষের সম্পর্ককে কেবলমাত্র পুরুষের দয়ার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে নারী-পুরুষের সম্পর্ক সম মর্যাদার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। পুরুষ তার কর্তা। সুতরাং সে যা খুশী তাই করতে পারে। এতে নারীর বলার বা অভিযোগ করার কিছু নাই। স্ত্রী বাধ্য কি না, অনুগত কি না তা নির্ধারণ করার একমাত্র পক্ষ তার স্বামী। স্বামীর যদি অনেক দোষও থাকে এখানে নারীর পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোনও উপায় নাই। ইসলাম নারীকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ছাড়া বাস্তবে আর কোনও অধিকার অথবা মর্যাদা কোনওটাই দেয় নাই।
তারপরও কোরআন বা হাদীস থেকে মোহামমদ নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন মনে করলেও আসলে তা ছিল তৎকালীন আরবে প্রচলিত ঐতিহ্যের কোনও কোনওটিকে স্বীকৃতি দেওয়া। এটুকু না দিয়ে তাঁর উপায় ছিল না। তবে এটা ঠিক যে, সম্পত্তির অর্ধেক অংশ দিয়ে মোহমমদ নারীর কিছু অধিকার মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে নারীর প্রতি অর্ন্তগত ঘৃণা কাজ করেছে, যার অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায় হাদীস গ্রন্থ সমূহে। তিনি পর্দার নামে অবরোধ দিয়ে নারীকে সমাজ জীবন থেকে একেবারে বিতাড়িত করেছেন। স্বামীর অনুমতি ছাড়া নারীর বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন, স্বামীর প্রতি শর্তহীন আনুগত্য দাবী করেছেন এবং স্বামীকে সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছেন স্ত্রীর প্রতি যেমন ইচ্ছা তেমন আচরণ করার। নারীকে যৌন-যন্ত্র ছাড়া তিনি অন্য কোনও স্বীকৃতি দেন নাই। এরকম কিছু হাদীস৩ পর্যালোচনা করা যাকঃ
৫। হজরত রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ফরমাইয়াছেন - স্ত্রীলোক গোপনীয় বস্তু যখন সে পরদার বাহির হয়, শয়তান তাহাকে পুরুষদের চক্ষে মনোমুগ্ধকর করিয়া দেখায়। (তিরমিজি), পৃষ্ঠাঃ ১৮৭।
৬। যে রমণী বিনা কারণে স্বামীর নিকট তালাকের জন্য প্রার্থনা করে, বেহেস্তের সৌরভ তাহার জন্য হারাম। (আবু দাউদ, তিরমিজি) পৃষ্ঠাঃ ৩৮২।
১১। পুরুষ যে কারণে তাহার স্ত্রীকে প্রহার করে সে তৎসম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইবে না। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা), পৃষ্ঠাঃ ১৩৪।
২২। যদি কোন ব্যক্তি সংগমের ইচ্ছায় নিজের স্ত্রীকে আহ্বান করে, তবে সে যেন তাহার নিকট উপস্থিত হয়, যদিও সে উনানের উপর (রন্ধন কার্যে ব্যাপৃত) থাকে। (তিরমিজি), পৃষ্ঠাঃ ১৩৫।
আরেকটি হাদীস৪ থেকে জানা যায়ঃ
১৪২৩। আবু হোরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, হযরত রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেন, স্বামী যদি স্ত্রীকে স্বীয় বিছানার প্রতি ডাকে এবং স্ত্রী তাহাতে অসমমতি প্রকাশ করে যদ্দরুন স্বামী অসন্তুষ্টির সহিত রাত্রি যাপন করিয়াছে, তবে সেই স্ত্রীর রাত্রি এই অবস্থায় অতিবাহিত হয় যে, ফেরেশতাগণ ভোর পর্যন্ত সারা রাত্র তাহার প্রতি লানৎ ও অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকেন।
(বোখারী শরীফ)
নারীকে বোধহীন, অনুভূতিহীন, মনুষ্যত্বহীন এক সত্তা হিসাবে মোহামমদ বিবেচনা করেছেন, যাকে তৈরীই করা হয়েছে পুরুষের প্রয়োজনে। তবে সবচেয়ে নির্মম হল মোহামমদ যুদ্ধ ও আক্রমণাভিযানের ফলে লাভ করা নারীদের ধর্ষণকে কোরআনে বৈধতা দিয়েছেন। কোরআন এ সম্পর্কে বলছেঃ
২৯। এবং যাহারা নিজদিগের যৌন অংগকে সংযত রাখে,
৩০। তাহাদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ক্ষেত্র ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না -
(৭০ সূরা মা’আরিজ)
উপরের আয়াতে ”অধিকারভুক্ত দাসীদিগের” অর্থ যুদ্ধ জয়ের ফলে অথবা অর্থমূল্যে ক্রয়ের ফলে যে সকল নারী অধিকারে আসে। যুদ্ধ ও ক্রয় লব্ধ নারী ধর্ষণকে সমর্থন করে এমন প্রচুর হাদীস আছে এবং সেখানে যুদ্ধবন্দী নারীদের নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারার বর্ণনা আছে। আসলে ইসলামের তত্ত্বগত ও প্রায়োগিক আক্রমণাভিযানের একটি বড় অংশ হয়েছে নারীর বিরুদ্ধে। ইসলাম প্রচার হয়েছে অমুসলিম অন্যান্য জাতি সমূহের উপর যুদ্ধ পরিচালনা করে। সেখানে শত্রু পক্ষকে হত্যা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দাস করা, শত্রুর সম্পদ লুণ্ঠন - এগুলোই হত ইসলামের নামে। এই সব যুদ্ধে নারীদের উপর মুসলিম বাহিনীর ধর্ষণ ও নির্যাতন, দাসীরূপে অধিকার এবং প্রয়োজনে দাসী হিসাবে বাইরের বাজারে বিক্রী করা ছিল এই সব ইসলামী বাহিনীর জন্য সাধারণ বিষয়। কোরআনের আয়াত দ্বারা সেগুলোকে সমর্থন করা হয়েছিল। এর সমর্থনে বহু হাদীসও পাওয়া যায়।
মোহাম্মদ নারীকে দেখতে পেতেন সকল দোষের আধার হিসাবে। তারা আল্লাহতে অবিশ্বাসী হয়, অকৃতজ্ঞ হয়, অপরের বদনাম করে, ইত্যাদি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী জানা যায় নীচের হাদীস৫ থেকেঃ
২৭। ইবন ’আব্বাস রাঃ হইতে বর্ণিত আছে, নবী সঃ বলিয়াছেনঃ আমাকে দেখান হইল দোযখ; তখন দেখি কি! উহার অধিকাংশই স্ত্রীলোক। তাহারা কুফর করে। জিজ্ঞাসা করা হইল, ’কুফর করে খোদার?’ তিনি বলিলেন, কুফর (কুফরের দুই অর্থ - (১) খোদাতে অবিশ্বাস; (২) অকৃতজ্ঞতা।) করে স্বামীর ও কুফর করে উপকারের। যদি তুমি তাহাদের কাহারো উপকার কর যুগ ধরিয়া, তারপর তোমা হইতে পায় সে কিছু (ত্রুটি), সে বলে, ’আমি তোমা হইতে ভাল কিছু পাই নাই কখনও।’
(বোখারী শরীফ)
নীচের হাদীসে৬ আমরা দেখিঃ
১০৩৩। সূত্র - ইবনে আবি শায়বা - ইবনে ’ওলাইয়া - (সূত্র পরিবর্তন) জুহাইর ইবনে হারব - ইবনে ইব্রাহিম - ইফনুস- হুমাইদ - ইবনে সামেত - আবু জর।
আবু জর (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, যখন তোমাদের কেহ নামাজের উদ্দেশ্যে দাঁড়াইবে, সে তাহার সমমুখে হাওদার পেছনের কাঠটি পরিমাণ একটি কাঠ রাখিয়া দিবে, যদি ঐ রূপ কোন কাঠ বা অন্য কিছু রাখা না হয় এমতাবস্থায় তাহার সমমুখ দিয়া গাধা, স্ত্রীলোক অথবা কাল কুকুর গমন করিলে তাহার নামাজ ভংগ হইয়া যাইবে। বর্ণনাকারী ইবনে সামেত বলেন, আমি বলিলাম, হে আবু জর, লাল কুকুর এবং হলুদ রংয়ের কুকুর হইতে কাল কুকুরকে পৃথক করিবার কারণটা কি? তিনি বলিলেন, হে আমার ভাতিজা, আমি তোমার মত এই বিষয়ে রসুলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, রসুলুল্লাহ (সঃ) বলিলেন, কাল কুকুর একটি শয়তান।
(মুসলিম শরীফ)
গাধা ও কাল কুকুরের সাথে মেয়েদের তুলনা করা হয়েছে, যেখানে কাল কুকুর আবার সাক্ষাৎ শয়তান। অর্থাৎ মেয়েরা শয়তানের সমতূল্য। এই হল নারীর প্রতি ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ের দৃষ্টিভঙ্গী। এ বিষয়ে আর একটি হাদীসে৭ দেখিঃ
১৫। নিশ্চয় স্ত্রীলোক শয়তানের আকৃতিতে আগমন করে ও শয়তানের আকৃতিতে প্রত্যাবর্তন করে। যখন কোন স্ত্রীলোক তোমাদের নজরে প্রীতিজনক হয়, তৎপরে তাহার হৃদয়ে উহার প্রেম বদ্ধমূল হইয়া পড়ে, তখন সে যেন নিজের স্ত্রীর নিকট গমন করিয়া তাহার সহিত সংগম করে, কেননা ইহা অন্তর্নিহিত প্রেম কামনাকে দূর করিয়া দিবে।
(মোসলেম, পৃষ্ঠাঃ ১৮৮।)
ইসলামপূর্ব আরবে কিংবা মোহাম্মদ যখন সবে তাঁর ধর্ম প্রচার শুরু করছেন তখনও আমরা আমরা বরং স্বাধীন ও স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বীকৃত নারী দেখতে পাই। একটি হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি আরবে একজন স্বাধীন নারী ছিল, যে ছিল দাসদের মলিক। তার সাথে মোহাম্মদ কে কথা বলতে হয়েছিল তাঁর কাঠের তৈরী মিম্বর (মঞ্চ বা পাটাতন) বানাবার প্রয়োজনে। হাদীসটি৮ নিম্নরূপঃ
১০৯১। সাহ্ল রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করিয়াছেন, একজন মোহাজের নারীর একটি ছুতার মিস্ত্রী ক্রীতদাস ছিল। হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম তাহার নিকট খবর পাঠাইলেন যে, তোমার ক্রীতদাসকে বল, আমার জন্য একটি মিম্বর তৈরী করিতে। সেই স্ত্রীলোকটি তাহার ক্রীতদাসকে উহা বানাইবার আদেশ করিল। সে ঝাউগাছ কাটিয়া আনিল এবং উহার কাষ্ঠ দ্বারা মিম্বর তৈরী করিল। মিম্বর প্রস্তুত হইলে পর স্ত্রীলোকটি হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামের নিকট সংবাদ পাঠাইল যে মিম্বর প্রস্তুত হইয়াছে। তিনি উহা পাঠাইয়া দিবার জন্য আদেশ করিলেন, কতেক জন লোক উহা আনিল। অতঃপর হযরত নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম নিজ হস্তে উহাকে বর্তমান স্থানে বসাইয়াছিলেন।
(বোখারী শরীফ)
এছাড়া প্রাক্-ইসলাম ও ইসলামের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু নারীকে আরবী সাহিত্যে বিশেষ করে কাব্যে অবদান রাখতে দেখা যায়। এইসকল মহিলা কবিদের মধ্যে খনসা ছিলেন অসাধারণ (মৃত্যু ২৪ হিঃ)। তাঁর প্রকৃত নাম তুমাযের বিনতে আমর।৯ সম্পত্তির অধিকারী ও একজন স্বাধীন ব্যবসায়ী হিসাবে খাদিজার নাম আমরা জানি। প্রথম বয়সে মোহাম্মদ তাঁর কর্মচারী ছিলেন। সম্পত্তির অধিকারী ও ব্যবসায়ী আসমা বিনতে মুখাররিবাহ্ নামে মক্কায় আরো একজন স্বাধীন নারীর নাম জানা যায়। মক্কাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আরবে স্বকীয় ক্ষেত্রে অবদান রাখা স্বাধীন নারীদের যে উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ইসলামের প্রচারের সাথে সাথে পরবর্তীকালে নতুন কোনও উত্থানের সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হল। পরবর্তী ইসলামের ইতিহাস এক অন্ধকার যুগে নেমে গেল। এরপর নারীরা আগ্রাসী পুরুষের দয়ায় সামাজিক প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ থেকে নির্বাসিত হয়ে ঘরের মধ্যে অবরোধে চলে গেল।
প্রকৃতপক্ষে প্রাক্-ইসলাম যে যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ বলা হয়, বাস্তব চিত্র ছিল ঠিক তার বিপরীত। কিছু গোত্রে সেসময় নারী শিশু জীবন্ত কবর দেবার প্রথা থাকলেও আরবের সব গোত্রে নারীর অবস্থান খুব নীচে ছিল না। সেই সময় আরবের কিছু অঞ্চলে বিশেষভাবে মদীনায় মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব দেখা যায়। এবিষয়ে মোহাম্মদের জীবনী রচয়িতা মন্টগোমারি ওয়াট তাঁর Muhammad at Medina10 গ্রন্থে লিখেছেনঃ
“Despite the dominance of the dominance of patrilineal ideas at the time when our sources were written down, many points of matrilinean our sources were written down, many points of matrilineal organization have been recorded. Descent in the female line was relatively more important at Medina than in Mecca. Some clans, such as Banū Hudaylah and Banū Maghālah, took the name of a woman; and the Aws and the Khazraj together, before they became the Answār on conversion to Islam, could be called Banū Qaylah after a common ancestress. Individuals also were known by their mothers. Among the best-known examples are Mu’ādh, Mu’awwidh, and ‘Awf, the sons of ‘Afrā’, while ‘Abdallāh b. Ubayy is sometimes called Ibn Salūl after Ubayy’s mother. An interesting case is that of Ka’b b. al-Ashraf, who was reckoned as belonging to his Jewish mother’s clan of an-Nadīr, although his father was of a nomadic Arab tribe.” Page-378.
অর্থাৎ “যখন আমাদের তথ্যের উৎস সমূহ লিখিত হয়েছিল, সেই সময়ে পিতৃতান্ত্রিক ধারণা প্রবল হলেও মাতৃতান্ত্রিক সংগঠনের অনেক কিছুই লিখিত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে মক্কার চেয়ে মদীনায় মেয়েদের বংশধারা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বনু হুদেইলাহ এবং বনু মঘালাহ্ এর মত কিছু গোষ্ঠী, মেয়েদের নাম গ্রহণ করত; এবং আনসার হয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত হবার পূর্বে, আওস ও খাযরাজ উভয়কেই, বনু কায়লাহ্ নামে পূর্ববর্তী বংশের সাধারণ একজন নারীর নামে ডাকা হত। ব্যক্তিও তাদের মায়ের নামে পরিচিত হত। সবচেয়ে ভাল জানা উদাহরণগুলোর মধ্যে, আফরা’র পুত্র মু’আধ, মু’আওইধ এবং ’আওফ, যখন ’আবদাল্লাহ বিন উবেইকে উবেই’র মায়ের অনুকরণে মাঝে মাঝে ইবন সালুল নামে ডাকা হত। একটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় হল যে, কা’ব বিন আল-আশরাফ, তার ইহুদী মায়ের গোষ্ঠী আন-নাদির এর অন্তর্ভুক্ত হিসাবে পরিচিত ছিল, যদিও তার পিতা ছিল বেদুইন আরব গোত্রের।”
কিছু কিছু গোত্রে তখনও সেই সময়ে ক্ষয়িষ্ণু মাতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব থাকায় গোত্রের সদস্যরা নারীর নামে পরিচিত হত। তার মানে ইসলাম-পূর্ব আরবে সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রে নারীরা ততটা পিছিয়ে ছিল না।
সমগ্র আলোচনা আমাদের কাছে এবিষয়টি সপষ্ট করেছে যে, প্রাক-ইসলামী যুগে নারীদের যেটুকু সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা ছিল ইসলাম সেটুকু কেড়ে নিয়ে পুরুষের কেবলমাত্র যৌনযন্ত্র হিসাবে বিবেচনা করে তাকে এক অন্ধকার জগতে নিয়ে গেছে। আজকের যুগে ইসলামী সমাজের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মেয়েরাও তাদের এই হীন অবস্থা বুঝতে পারে না ইসলামপন্থীদের অব্যাহত প্রচার ও মানুষের স্বাধীন চিন্তার সুযোগ নষ্ট করা হয় বলে। এই ধর্ম প্রায় দেড় হাজার বছর মানুষের চিন্তা পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে আশ্চর্য রকম সাফল্য দেখিয়েছে। একবার যাদের তারা বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করতে পেরেছে, সেই সব ধর্মান্তরিত মানুষদের আর এই ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেখা যায় না। কিন্তু কোনও ধর্মের বা তত্ত্বের সাফল্যই সমাজে তার শুভ বা কল্যাণকর ভূমিকা নির্ধারণের মাপকাঠি নয়। আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগে, মানব সভ্যতার অগ্রগতির এই পর্যায়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষ যখন মানবিকতার চেতনায় আরও উন্নত হতে চাচ্ছে, তখন মধ্যযুগের এই বর্বর ধর্ম পৃথিবীর দেশে দেশে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানব জাতির অর্ধেক অংশকে অন্ধকারে রেখে পৃথিবী কখনই মানব সভ্যতার আলোকোজ্জ্বল পথে যেতে পারবে না। তাই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে গেলে এই ধর্মকে যেমন জানতে হবে তেমনি একে মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে নারীর যেমন মুক্তি নাই তেমন মানব জাতিরও মুক্তি নাই।
সূত্র ও টীকাঃ
১ যে সকল হাদীসের সত্যতা বা বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সন্দেহ নাই বলা হয়েছে সেগুলোকে সহীহ্ হাদীস হিসাবে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সহীহ হাদীস ছয়টি - (১) সহীহ বুখারী, (২) সহীহ মুসলিম, (৩) সুনানে নাসাঈ, (৪) সুনানে আবু দাউদ, (৫) জামি’ তিরমিযী, ও (৬) সুনানে ইবন্ মাজাহ। এই নিবন্ধে সকল হাদীসের উদ্ধৃতি কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সমূহ থেকে নেওয়া হয়েছে।
২ এই নিবন্ধে কোরআনের সকল আয়াতের উদ্ধৃতি আল-কুরআনুল করীম - প্রকাশকঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ; প্রকাশকালঃ ১৯৮৬ থেকে নেওয়া হয়েছে।
৩ হাদীসের উদ্ধৃতি সমূহের উৎস পবিত্র কোরান ও হাদীছে রাসুল - সংকলকঃ খোন্দকার মাওলানা মোহাম্মদ বসিরউদ্দিন; প্রকাশকঃ কোরান মঞ্জিল লাইব্রেরী, বরিশাল; প্রকাশকালঃ ২য় সংস্করণ; ১৩৯৩ (বাংলা)।
৪ বোখারী শরীফ (তৃতীয় খণ্ড) - অনুবাদকঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক; প্রকাশকঃ হামিদিয়া লাইব্রেরী; ঢাকা; প্রকাশকালঃ ১৯৬৭।
৫ তজ্রীদুল বুখারী (প্রথম খণ্ড) - প্রকাশক বাংলা একাডেমী, ঢাকা; প্রকাশকালঃ ১৯৫৮।
৬ বংগানুবাদ মুসলিম শরীফ (২য় খণ্ড) - অনুবাদকঃ আল্লামা মৌলানা নেছারুল হক; প্রকাশকঃ ইসলামিয়া লাইব্রেরী, চট্টগ্রাম; প্রকাশকালঃ ১৯৭৫।
৭ পবিত্র কোরান ও হাদীছে রাসুল (সাঃ) - প্রকাশকঃ কোরান মঞ্জিল লাইব্রেরী; বরিশাল।
৮ বোখারী শরীফ (দ্বিতীয় খণ্ড) - মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক; প্রকাশকঃ হামিদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা; প্রকাশকালঃ - তৃতীয় সংস্করণ; ১৯৬৮।
৯ আরবী সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - গোলাম সামদানী কোরায়শী; প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমী, ঢাকা; প্রথম প্রকাশ; জুন, ১৯৭৭।
১০ Muhammad at Medina – by W. Montgomery Watt; Oxford University Press; Karachi; 1994.
অনলাইন ঃ ১৩ জুন, ২০০৯