Banner
কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে স্বীকার না করা -- মোহাম্মদ মোস্তফা

লিখেছেনঃ মোহাম্মদ মোস্তফা, আপডেটঃ June 30, 2009, 12:00 AM, Hits: 9922

 

বুদ্ধের মূল চার সিদ্ধান্তের তৃতীয় সিদ্ধান্তটি হল : কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে স্বীকার না করা। অন্যথায় বুদ্ধিবৃত্তি এবং অভিজ্ঞতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত ধর্মগ্রন্থ সৃষ্টি হয়েছে সেইসব ধর্ম গ্রন্থের প্রতিটির লোকরা সেটাকে স্বতঃ প্রমাণ হিসাবে মানে এবং অপরকেও মানাবার চেষ্টা করে।

স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে ব্রাহ্মণরা মানে বেদকে এবং মুসলমানরা মানে কোরানশরীফকে, বাইবেলকে মানে খ্রীষ্টানরা। সেখানে কোন যুক্তি নির্ভর তথ্য না থাকলেও তারা তা মেনে যায়। স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে নিলে সেখানে কোন যুক্তির বালাই থাকে না। একই টেবিলের আসরে ব্রাহ্মণ বলছে আমার বেদই সত্য এবং খ্রীষ্টান বলছে বাইবেলই সত্য, মুসলমান বলছে কোরানশরীফ সত্য। আসলে কে সত্য? যদি বলা হয় কোরানশরীফ সত্য তাহলে বলতে হয় কিভাবে তা বোঝা গেল? বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি আছে কি? কোন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় কি? তাহলে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধির আশ্রয় নিতে হয়। এ দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে সবকিছুই নির্ভর করে বুদ্ধির উপর। এখানে কোরানশরীফ সম্পর্কে যেভাবে বলা হয়েছে বেদ, বাইবেল সম্পর্কেও সেভাবে বলা যায়।

আমার গ্রন্থই শ্রেষ্ট এই কথা বলতে গিয়ে, এই কথা প্রমাণ করতে গিয়ে যুগে যুগে পৃথিবীতে কত যুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছে, কত অনাচার সৃষ্টি হয়েছে তার হিসাব নাই। গ্যালিলিও বলেছিলেন পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। কিন্তু বাইবেলের বিপরীত ধর্মী কথা বলে গ্যালিলিও-এর জীবনে চরম দুরবস্থা নেমে এসেছিল। বাইবেলকে স্বতঃ প্রমাণ হিসাবে মানার কারণেই এ অবস্থা হল।

যবন তত্ত্বজ্ঞানীদের প্রায় সহস্রাব্দীর চিন্তার ফল গ্রন্থরূপে আলেকজান্দ্রিয়ার পুস্তকাগারে সুরক্ষিত ছিল। সেই গ্রন্থাগারকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হত না যদি না মুসলিম বিজেতারা কোরানকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানত।

কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানা মানে তার সম্বন্ধে সকল যুক্তি-তর্ককে অস্বীকার করা । তার মানে কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানার অর্থই হল পরমত অসিহষ্ণুতা। এই গ্রন্থমান্যতা সারা পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার বছর ধরে মনুষ্য জাতিকে ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস আর মানসিক দাসত্বের গাঢ় অন্ধকারে শুধু ফেলেই রাখে নাই, বরং মানুষের সমাজ জ্ঞানের উন্মেষের বিরুদ্ধেও বাধার প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে। ফল স্বরূপ পৃথিবী বারবার মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে এবং পিছিয়েছে।

খ্রীষ্টান এবং মুসলমানদের ভিতর যে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড হয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মমতার সাক্ষী দেয়।

কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ মানার অর্থ গ্রন্থের বর্ণিত বিষয় সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন তোলার অধিকার না থাকা এবং জিজ্ঞাসার অগ্রগতি রোধ করা। কে আমি, কোথা থেকে এলাম নিজের ভিতর এ রকম প্রশ্নই যুগে যুগে মানুষকে বড় বড় আবিষকার করতে শিখিয়েছে। কলম্বাস ভারতবর্ষে আসার পথ খুঁজতে  গিয়ে আমেরিকা আবিষকার করেন।

যদি গ্যালিলিও বাইবেলের মতকে মেনে নিতেন তাহলে মানুষকে হয়ত আরো অনেক দিন ভুল ধারণা নিয়ে আগাতে হত।

যদি কোপার্নিকাস বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী সূর্য সন্ধন্ধীয় তত্ত্ব মেনে নিতেন তাহলে বিজ্ঞান কিভাবে এগিয়ে যেত? বস্তুত গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানলে নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তির খোঁজও পাওয়া যেত না এবং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষকারও হতে পারত না।

প্রকৃতপক্ষে বিশ্বে জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্পকলা ইত্যাদির যে প্রগতি ঘটেছে, যার ফলে মানব সভ্যতার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে, তার সবটাই ঘটেছে কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে না মেনে।

পুরোনো ধর্মগ্রন্থগুলো মানসিক প্রতিবন্ধকতা  ও বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা সৃষ্টিকারী অন্ধবিশ্বাসসহ যাবতীয় আজগুবি তত্ত্বে ভরপুর। তবুও এই পচগলা তত্ত্ব অনেকেই গলাধঃকরণ করতে আগ্রহী।

কোন গ্রন্থকে স্বতঃপ্রমাণ হিসাবে মানা মানে নিজেকে কাঠের পুতুলে পরিণত করা। কারণ ধর্মীয় গ্রন্থে বলা আছে ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই সব হয়। যদি তা-ই হত তাহলে নিজেকে কাঠের পুতুল ভাবা ছাড়া কোন উপায় থাকত না। কর্মের স্বাধীনতার জন্য কোন গ্রন্থের অধীনতাপাশে আবদ্ধ থাকাটা অপ্রয়োজনীয়।

“বস্তুত যেখানে ঈশ্বরই নেই সেখানে ঈশ্বরের গ্রন্থ কোথা থেকে আসবে?” (বৌদ্ধ দর্শন - রাহুল সাংকৃত্যায়ন)

অনলাইন : ৩০ জুন, ২০০৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ