লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ August 11, 2008, 5:19 AM, Hits: 12065
বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা
গ্রন্থস্বত্ব : লেখক
প্রকাশক : আজাহারুল ইসলাম, বদ্বীপ প্রকাশন, ৭০ বেসমেন্ট, অজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেট শাহবাগ, ঢাকা- ১০০০
প্রকাশকাল : নভেম্বর ২০০২
মুদ্রণ : অর্ক, ৫৫/বি, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদ : পল্লব / ৯০০৫৪৭৪, ISBN ৯৮৪ - ৮২৮৯ - ০২- ঢ
মূল্য : ৪০.০০ টাকা
বিষয়সুচী
১. নূতন দৃষ্টিতে দেখা
২. সমাজ গঠনে শ্রেণী
৩. ভারতীয় সমাজ ও বর্ণজাতি
৪. ইসলাম ও নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীবাদ
৫. ভারতবর্ষে বুর্জোয়া বিপ্লবের সূচনা
৬. রুশ ও চীনা বিপ্লবের তাৎপর্য
৭. ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল
৮. বাংলাদেশে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রায়নের সম্পর্ক
৯. সমাজ উন্নয়ন ও ধর্ম
১০. বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য
বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রশ্নে বিতর্ক কম নেই। কারণ বিপুল বৈদেশিকঋণ ও সাহায্যে একটা প্রাথমিক অবকাঠামো তৈরী হলেও দেশের পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য, শিক্ষাহীনতা, রাজনৈতিক-সামাজিক সংকট ও অস্থিরতা দেশের উন্নয়ন প্রশ্নেবিভিন্ন মত ও পথকে অবলম্বন ক’রে উন্নয়ন বিতর্ককে অব্যাহত রাখতে বাধ্য। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট এলাকায় তেরো কোটি মানুষ ঠাসাঠাসি ক’রে বাস করছে। দেশের সংকটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। সব মিলিয়ে অবস্থাটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যখন আমাদের দেশ ও উন্নয়ন সমস্যা সম্পর্কে নূতন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচার করার প্রয়োজন অত্যন্ত তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ দেশে উন্নয়ন সমস্যা মোকাবিলার জন্য এতকাল বিভিন্ন ধরনের প্রয়াস হয়েছে। সেগুলোর একটা ফল নিশ্চয়ই আছে। আন্তর্জাতিক পুঁজির বাজার প্রসারের তাড়নায় হোক আর দেশের ভিতর থেকে সমাজ প্রগতি ও উন্নয়নের তাগিদে হোক দেশ এগিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় সেই অগ্রগতি অতি সামান্য। অন্যদিকে পৃথিবীর অগ্রগতির তুলনায় দেশ বরং পিছিয়ে যাচ্ছে। উন্নত পৃথিবীর সঙ্গে দেশের ব্যবধান বাড়ছে।
এ দেশে উন্নয়ন প্রশ্নে দু’টো প্রধান দৃষ্টিভঙ্গী রয়েছে। একটা দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী এ দেশের উন্নয়ন সমস্যার মীমাংসার জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একমাত্র পথ মনে করা হয়। এ দেশে এই চিন্তার পিছনে আছে মার্কসবাদের প্রভাব। মার্কসবাদী তত্ত্ব অনুযায়ী শ্র্রেণী সংগ্রাম গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কম চেষ্টা এ দেশে হয় নি। এই চেষ্টায় নিয়োজিত হাজার হাজার কর্মীর শ্রম, সাধনা ও আত্মত্যাগ অভিজ্ঞতার বিরাট ভাণ্ডার নির্মাণ করেছে। সমাজের উন্নয়ন ও প্রগতির পথ নির্মাণে এর মূল্যও কম নয়। কিন্তু বাস্তব হল এই যে, মার্কসবাদী ধারায় এ দেশে সমাজ বিপ্লব এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। বারংবার ব্যর্থতার পর মার্কসবাদী ধারায় সমাজ বিপ্লবের আবেদন এ দেশে অনেক দিন ধরে কমে আসছিল। কমিউনিস্ট শিবিরের পতনের পর এই আবেদন প্রায় নিঃশেষ হয়েছে বলা ভাল। যদিও একটা দৃষ্টিভঙ্গী হিসাবে এটাচিন্তাশীল মানুষদের একাংশের মধ্যে আছে এবং থাকবে।
মার্কসবাদী ধারার বাইরে এ দেশে যে উন্নয়ন ভাবনা রয়েছে তার মধ্যে জাতি হিসাবে আত্মমর্যাদা বোধ ও সৃষ্টিশীলতা কতটা আছে বলা কঠিন। কারণ এইভাবনার উৎস মূলত পাশ্চাত্যের প্রভাব এবং সাহায্য নির্ভরতা। এই ভাবনায় সমাজ কাঠামোর বিষয়গুলোকে উন্নয়ন আলোচনায় গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশী ঋণ ও অনুদান কিভাবে পাওয়া যায় এবং সেটাকে কিভাবে কোথায় কতটা কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়গুলোকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আসলে উন্নয়ন ভাবনার এই ধারায় উন্নয়ন প্রশ্নকে মূলত টেকনিক্যাল বা কৃৎকৌশলগত ও প্রায়োগিক বিষয় হিসাবে দেখা হয়। এই ধারার ভাবনার কোন রকম স্বকীয়তা নেই। বলা যায় এই ধারা এ দেশকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সম্প্রসারণ হিসাবে বিবেচনা করে। পাশ্চাত্যের পুঁজির অধীনস্থ হয়ে বা তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে এখানে উন্নয়নের পথ খোঁজা হয় বলে এই ধারায় স্বকীয়তা যেমন নেই তেমন উন্নয়নের পথে যেসব কাঠামো এবং ভাবাদর্শগত বিষয় পর্বত প্রমাণ বাধা হয়ে আছে সেগুলোকে চিহ্নিত করার মানসিক শ্রম এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার বাস্তব শ্রম ও কষ্ট কোনটারই বিশেষ একটা প্রয়োজন হয় না। স্বাভাবিকভাবে উন্নয়নের এই সহজ পথের প্রতি আকর্ষণ এ দেশে বেশী হয়ে আছে। এবং ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে এ যাবৎ এ দেশে উন্নয়নের এই ধারাই অনুসৃত হয়ে আসছে। সুতরাং এ দেশে উন্নয়ন সমস্যা সমাধানে যতটুকু ব্যর্থতা তার সবচেয়ে বেশী দায়ভার এই ধারার উপরই বর্তায়।
বাংলাদেশে উন্নয়ন ভাবনার এই দুই ধারার সাফল্য ও ব্যর্থতা এবং এ দেশে তাদের উভয়ের ভূমিকার কথা মনে রেখে আমি এই আলোচনা করলেও এই আলোচনায় একান্ত প্রাসঙ্গিক না হলে সেই সম্পর্কে আলোচনা করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার এই আলোচনা হবে সংক্ষিপ্ত এবং সমগ্র আলোচনায় আমি প্রথাগত কাঠামোর বাইরে গিয়ে সমস্যার আরও গভীর তলদেশ সপর্শ করার চেষ্টা করব। সেই দিক থেকে দেখলে এটা প্রথাগত উন্নয়ন আলোচনা নয়, যদিও এর মূল উদ্দেশ্য এ দেশে উন্নয়ন প্রশ্নেরউত্তর খোঁজা।
একটা সমাজ সংগঠনে একাধিক শ্রেণী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সেই সব শ্রেণীর মধ্যে একটা শ্রেণীর ভূমিকাই সাধারণত প্রধান হয়। যেমন আধুনিক ইউরোপের সমাজগুলো সংগঠিত হয়েছে প্রধানত বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী শ্রেণীর নেতৃত্বে।ইউরোপে বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশের প্রধান চালিকা শক্তি ব্যক্তি মালিকানায় ও ব্যক্তির স্বাধীন সত্তায় নিহিত। তাই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের দাবীও সেখানে উঠে এসেছে বুর্জোয়া বিকাশের সূচনালগ্ন থেকে। সেখানে বুর্জোয়া শ্রেণী এবং সমাজ গড়ে উঠেছে ব্যক্তির স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অবস্থানকে রক্ষা করে।
সামন্ত যুগে ইউরোপে ব্যক্তিসত্তার এতটা বিকাশ লক্ষ্য করা না গেলেও তার একটা অস্তিত্ব তখনও ছিল সামন্ত ভূমি ব্যবস্থার ভিতর। সামন্ত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সামন্ত ভূ-স্বামীরা যেমন রাষ্ট্র বা রাজার ইচ্ছাধীন পুতুল মাত্র ছিল না তেমন তারা সমাজের ভিতর ব্যক্তির স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অস্তিত্বকে প্রতিনিধিত্ব করত। বুর্জোয়া সমাজের মতো সেখানে ব্যক্তিসত্তা প্রবল ও ব্যাপ্ত হয়ে উঠতে না পারলেও ব্যক্তিমালিকানার প্রবল অস্তিত্ব এবং সামন্ত প্রভুদের বহুবিধ অধিকারের মধ্যেও ব্যক্তিসত্তা টিকে ছিল। তবে সেটা ছিল সমাজের উপর তলায়। ভূমিদাস বা সাফ্র্দের মধ্যে ব্যক্তির অস্তিত্ব খুঁজে লাভ নেই।
ইউরোপের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে সেখানে বহু সংখ্যক স্বাধীন ব্যক্তিকে অবলম্বন করে সমাজ ও শাসক শ্রেণী গড়ে উঠেছে। সামন্ত সমাজ ও শ্রেণীর বিরুদ্ধে সেখানে যখন বুর্জোয়া সমাজ ও শ্রেণী দাঁড়াতে চেয়েছে তখন সঙ্গতভাবে তা এই বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করতে পেরেছে। পুরাতন সমাজের ভিতর থেকে নূতন শক্তির জাগরণের জন্য সেখানে ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবী ক্রমবর্ধমানভাবে জোরালো হয়েছে। সামন্ত রাষ্ট্র ও ধর্মের স্বৈরতার বিরুদ্ধে বুর্জোয়া ব্যক্তি মাথা তুলেছে। নূতন বুর্জোয়া সমাজ দাঁড়িয়েছে বুর্জোয়া ব্যক্তিসত্তার দ্বারা গঠিত বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে।
কাজটা সহজে হয় নি। কিন্তু হয়েছে। প্রাচ্যে স্থানীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে এইভাবে বুর্জোয়া সমাজ গঠন সম্ভব হয় নি। তার কারণ এখানে ইউরোপের মত সামন্ত সমাজ ছিল না। সুদীর্ঘ কাল ধরে এখানে যে কৃষি সভ্যতা টিকে ছিল সেখানে ইউরোপের মত ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব ছিল না। এখানে ব্যক্তিমালিকানা ছিল না তা নয়। কিন্তু তা সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার পর্যায়ে ছিল না। ব্যক্তিমালিকানা এবং সেই সঙ্গে ব্যক্তিসত্তা ছিল একান্তরূপে সমাজ ও রাষ্ট্রের অধীনস্থ ও অনুগত। অর্থাৎ এখানে ব্যক্তিশক্তির তুলনায় গোষ্ঠীশক্তি এবং গোষ্ঠীচেতনা অনেক বেশী প্রবল হয়ে থেকেছে। গোষ্ঠীবাদের চাপে এখানে ব্যক্তি দাঁড়াবার জায়গা পায় নি। প্রাচ্যের এই অবস্থা সাধারণভাবে পরিচিত এশীয় স্বৈরতন্ত্র হিসাবে যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ নির্দয় বাঁধনে ব্যক্তিকে আবদ্ধ করে রাখে।রাষ্ট্র ও সমাজের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও শাসনের ফলে প্রাচ্যে ব্যক্তি যেমন মুক্তি পায় নি তেমন বুর্জোয়া সমাজের আবির্ভাবও এখানে ভিতর থেকে ঘটে নি। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছে বুর্জোয়া ইউরোপের হস্তক্ষেপের। উন্নততর সামাজিক সংগঠন, প্রযুক্তি ও শিল্পের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণী প্রাচ্যকে অধিকার ক’রে তার সনাতন স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভাঙ্গে এবং বলা যায় প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে এখানে বুর্জোয়া বিপ্লবেরও সূচনা করে। ’ভারতে ব্রিটিশ শাসন’-এ মার্কস বহু কাল আগে ভারতে ব্রিটিশ সূচিত বুর্জোয়া বিপ্লবকে সামাজিক বিপ্লব হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন*। এটা ঠিক যে, এই ঘটনাকে সামাজিক বিপ্লব বলার মধ্যে ভুলেরও সম্ভাবনা থাকে। কারণ বিদেশী লুণ্ঠনমূলক শাসনের কারণে এই বিপ্লবে গড়ার তুলনায় ভাঙ্গার দিক অনেক বেশী প্রবল থাকে এবং সমাজের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণ বেশী ঘটে। তবু ঐতিহাসিক বাস্তবতায় এটাকে একটা সামাজিক বিপ্লবের অন্তত সূচনা বলা ছাড়া উপায় নেই।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* কার্ল মার্কস-ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশনালয়, মস্কো। পৃষ্ঠা-৪২
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
প্রাচ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও অনেক বিষয়ে ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। যে বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষের একান্ত নিজস্ব এবং যা ভারতবর্ষকে সমস্ত পৃথিবী থেকে খুব বেশী ভিন্ন করেছিল সেটা হ’ল তার caste বা বর্ণজাতি ব্যবস্থা। ইউরোপের ব্যক্তিসত্তা ভিত্তিক শ্রেণীর বিপরীতে ব্যক্তিসত্তা বর্জিত এবং গোষ্ঠীভিত্তিক বর্ণজাতি ছিল ভারতীয় সমাজের প্রধান চালিকা শক্তি।
বর্ণজাতি প্রথায় সমগ্র সমাজ ছিল অসংখ্য গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তত্ত্বগতভাবে সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত বলা হলেও বাস্তবে সমাজ ছিল অসংখ্য গোষ্ঠী বা বর্ণজাতির সমাহার যার শীর্ষে ছিল ব্রাহ্মণ বর্ণজাতির স্থান। ব্রাহ্মণের মর্যাদা এবং প্রভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল গোটা সামাজিক কাঠামো।
বর্ণজাতি প্রথার ভিত্তি নির্মাণ করেছিল যে বিষয়গুলি সেগুলি হল পবিত্র-অপবিত্রের ধারণা, জন্মসূত্রে অর্জিত পেশা ও সামাজিক মর্যাদার প্রায় অপরিবর্তনীয়তা, পেশার সঙ্গে মর্যাদার সম্পর্ক, এক বর্ণজাতির সঙ্গে অপর বর্ণজাতির বিবাহ ও আহার সংক্রান্ত কঠোর বিধি-নিষেধ, একান্নবর্তী পরিবারইত্যাদি। বর্ণজাতি সীমানার বাইরে যাবার ক্ষমতা বা সুযোগ ব্যক্তির ছিল না। বস্তুত এর বাইরে ব্যক্তির কোন পরিচয় ছিল না। সুতরাং বর্ণজাতি প্রথা এমন সমাজ সৃষ্টি করেছিল যেখানে সমাজ গঠিত হয়েছিল এমন অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী নিয়ে যেখানে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব ছিল না।
বর্ণজাতি প্রথায় আবদ্ধ হয়ে ভারতবর্ষ এমন এক সমাজ গঠন করেছিল যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের তুলনায় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশী প্রবল ছিল। মুষ্টিমেয় নগর ও শহর কেন্দ্রিক রাষ্ট্র ছিল ক্ষত্রিয়দের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তার বাইরে বিশাল গ্রাম এবং জনসমাজ ছিল ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে। এবং রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ব্রাহ্মণদের প্রভাব ও ভূমিকা অস্বীকার করার ক্ষমতা ক্ষত্রিয়দের ছিল না।
ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে বর্ণজাতি এবং বর্ণজাতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভারতবর্ষের সমগ্র সমাজকে হাজার হাজার বৎসর ধরে নিজস্ব ধারায় সভ্যতা নির্মাণ করার ও টিকে থাকার এক অবিশ্বাস্য শক্তি দান করেছিল। ব্রিটিশের পূর্বে কোন বহিরাগত শক্তি বর্ণজাতি এবং পঞ্চায়েতকে ধ্বংস করতে পারে নি। ফলে রাষ্ট্রের উপর তলায় যত পরিবর্তন হোক সমাজ বিশেষত গ্রাম সমাজ তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গেছে।
এমনকি বহিরাগত মুসলমান শাসকরা তাদের শত শত বৎসরের শাসন কালেও রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্রকে সমাজের ভিত্তিমূলে এবং বিশেষ করে গ্রাম পর্যন্ত সেভাবে নিতে পারে নি। বর্ণজাতি ও পঞ্চায়েতকে অবলম্বন ক’রে গ্রাম সমাজ মুসলিম শাসনের প্রভাবকে অনেকাংশে প্রতিহত করেছে।
এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, মুসলিম শাসন কেন্দ্র শত শত বৎসর উত্তর ভারতে অবস্থিত হলেও সেখানে ধর্মান্তরকরণ কম হওয়ায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা খুব কম থেকেছে। বরং ভারতবর্ষের যে দুই প্রান্তে বর্ণজাতি ব্যবস্থা দুর্বল ছিল ইসলাম প্রসার লাভ করেছে সেই দুই প্রান্তে সবচেয়ে বেশী। বর্তমান পাকিস্তান অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিল দুর্বল। এখানে সমাজ ছিল অনেক বেশী উপজাতীয় এবং ভূমির অনুর্বরতার কারণে যথেষ্ট পরিমাণে পশু পালন নির্ভর এবং অস্থিতিশীল। কৃষির দুর্বলতার কারণে এখানে স্থিতিশীল গ্রাম সমাজ এবং সভ্যতা দুর্বল থাকায় ইসলামের পক্ষে দুর্বল বর্ণজাতি ও পঞ্চায়েতের ব্যূহ ভেঙ্গে প্রবেশ করা সহজ সাধ্য হয়েছে।
অন্যদিকে, বহু সংখ্যক নদীর পলিতে গড়ে ওঠা অগণিত চরের সমষ্টি স্বরূপ এক বৃহৎ বদ্বীপ বঙ্গ বিশেষত পূর্ব বঙ্গ অতীতে ছিল আরও অনেক বেশী নদী ভাঙ্গার শিকার। তাই পূর্ব বঙ্গ মূলত কৃষিভিত্তিক সমাজ হলেও এখানকার ভূ-প্রকৃতির এই বৈশিষ্ট্য এখানে স্থিতিশীল ও দৃঢ়বদ্ধ সমাজ গড়ার পথে বাধা হয়েছিল। ফলে বর্ণজাতি এবং পঞ্চায়েত থাকলেও উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। সুতরাং সাধারণভাবে যেমনটা বলা হয় যে, উচ্চ বর্ণজাতির অত্যাচারের কারণে বঙ্গে ইসলাম প্রসার লাভ করে, ব্যাপারটা তেমন নয়। ব্রাহ্মণ এবং বর্ণজাতি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্পেষণ যেখানে সবচেয়ে প্রবল ছিল সেখানে ইসলাম প্রসার লাভ না ক’রে করেছে সেই দুই অঞ্চলে যেখানে ব্রাহ্মণ ও বর্ণজাতি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্পেষণ ক্ষমতা সবচেয়ে দুর্বল ছিল।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ভারতবর্ষের জনসমাজ ইসলাম ধর্মকে প্রতিহত করেছে তার বর্ণজাতি প্রথা দিয়ে এবং রাষ্ট্রকে প্রতিহত করেছে তার পঞ্চায়েত দিয়ে। এবং এই জনসমাজের ভিত্তিমূলে আবার থেকেছে প্রধানত কৃষক এবং গ্রাম।
ইসলাম নিজেও গোষ্ঠীবাদের ধর্ম। বরং বলা উচিত এটা নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীবাদের ধর্ম। আরবে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন সেখানে পুরাতন উপজাতীয় গোষ্ঠী সমাজ ভেঙ্গে পড়ছিল ব্যক্তিসত্তার উদ্ভব ও বিকাশের ফলে। ব্যবসা এবং উৎপাদনের বিকাশের ফলে সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণী বৈষম্য তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছিল। পুরাতন উপজাতীয় বন্ধন ভেঙ্গে পড়ছিল, গোত্র বা উপজাতির রক্ত বন্ধনের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছিল সম্পদের শক্তি, উপজাতীয় গরীবরা ঋণগ্রস্ত হচ্ছিল এবং দারিদ্র্য ও ঋণগ্রস্ততার প্রক্রিয়ায় দাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
ইসলাম ছিল সেই অবস্থার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। যে ব্যক্তি সমাজ বা গোষ্ঠীর ঊর্ধ্বে উঠছিল তাকে তা নিরঙ্কুশভাবে সমাজ বা গোষ্ঠীর অধীনস্থ করল। ব্যক্তির মালিকানা ও ধন বৈষম্যকে তা নাকচ করে নি কিন্তু সমাজ বা গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ অধীনতায় তাকে আবদ্ধ করা হল। অর্থাৎ সমাজ কর্তৃত্বের নিরঙ্কুশ অধীনতায়।
পূর্বতন সমাজ বিকাশের ধারায় যে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য ভেঙ্গে পড়ছিল সেটাকেও সম্পন্ন করা হল, তবে ভিন্নভাবে। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে শ্রেণী গড়ে উঠতে দেওয়া হল না। এই শ্রেণী গঠনের প্রক্রিয়ায় ইতিপূর্বে সূচিত বৃহত্তর সমাজ ও জাতি গঠনের কাজ সম্পন্ন হল। বৃহত্তর গোষ্ঠীর ভিতর সকল স্বাতন্ত্র্যকে বিলীন ক’রে এই কাজ করা হল। অর্থাৎ ইসলাম সমগ্র আরবকে এক অখণ্ড গোষ্ঠী বা সমাজে পরিণত করল। অন্তত তত্ত্বগতভাবে।একজন ব্যক্তির নিরঙ্কুশ পরিচালনায় প্রথমে মক্কায় গড়ে উঠল একটা ধর্মগোষ্ঠী। অতঃপর মদীনায় এই ধর্মগোষ্ঠী পরিণত হল একটা রাজনৈতিক ও সামরিক গোষ্ঠীতেও। এইভাবে আরবে প্রতিষ্ঠিত হল একটা ধর্মীয় সামরিক- রাজনৈতিক শ্রেণীর নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠীবাদী রাষ্ট্র এবং সমাজ। এই রাষ্ট্র এবং সমাজ ক্রমে আরবের বাইরে বিস্তীর্ণ ভূভাগে বিস্তৃত হল। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ,বিধি-বিধান, বিকাশধারা ও ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় তাতে গোষ্ঠীবাদ কতখানি প্রবল এবং নিরঙ্কুশ।
ইসলামের বাস্তব তাৎপর্য হল তার নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীবাদ। উমমা বা সম্প্রদায়ের ধারণার মাধ্যমে এবং ধর্মীয় তত্ত্ব ও চর্চার মাধ্যমে গোষ্ঠী চেতনা এতটাই প্রবল হয়েছে যে, তার বাইরে যাবার ক্ষমতা কারোরই হয় না। রাষ্ট্রীয়-ধর্মীয় শাসক শ্রেণী মূলত অবিভাজ্য একটা গোষ্ঠী। কিন্তু তা সামাজিকভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীরও অবিভাজ্য অংশ। তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে যেমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তেমন নিজেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতনা ও কর্ম দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। বস্তুত ধর্মের মাধ্যমে গোষ্ঠীবাদের এমন এক ছকে গোটা সমাজের সকলে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য যার বাইরে যাবার ক্ষমতা কারোরই হয় না। ইসলাম গোষ্ঠীবাদী সমাজ নিয়ন্ত্রণের একটা অত্যন্ত দৃঢ় ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা দান করেছে। বাইরের সমাজের চাপ বা আঘাত ছাড়া এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানো অসম্ভব প্রমাণিত হয়েছে।
অবশ্য আর সব সফল মতবাদের মত ইসলামও বাস্তবে প্রচুর আপস করেছে কিংবা বাস্তবের সঙ্গে যথেষ্ট খাপ খাইয়ে নিয়েছে। যেমন ইসলামে বংশীয় স্বাতন্ত্র্যকে বা শ্রেষ্ঠত্বকে তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া না হলেও আরবের সবচেয়ে অভিজাত বংশ কোরাইশের বাইরে আরবদের শাসন ক্ষমতা যেতে পারে নি। ইসলামের আধিপত্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত হয়েছে কোরাইশ আধিপত্য। একইভাবে অনারব ভূভাগে সুদীর্ঘ কাল অনারব মুসলমানদের উপর বিজয়ী আরব মুসলমানদের আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা হয়েছিল বিজয়ী শাসক হিসাবে।ইসলামের গোষ্ঠী বা community চেতনার সঙ্গে এই প্রয়োগ মেলে না। কারণ ইসলাম মুসলমান এবং অমুসলমানে বিরাট পার্থক্য রেখা টানলেও মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে এই ধরনের কোন পার্থক্য রেখা টানে না। যেটাকে ইসলামের সাম্যের প্রেরণা বলা হয় সেটা মূলত তার নিরঙ্কুশ গোষ্ঠী প্রেরণা, তার উমমার প্রেরণা।
ইসলামের এই খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষমতার পরিচয় আমরা পেয়েছি ভারতবর্ষেও যেখানে ইসলামের নিরঙ্কুশ ধর্মীয় সামাজিক গোষ্ঠীবাদ বর্ণজাতি প্রথার গোষ্ঠীসংঘবাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে এখানে তার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। বহিরাগত এবং রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত মুসলমানরা নিজেদের সংগঠিত করেছিল আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণীতে। বাকী মুসলমান জনগোষ্ঠী ছিল সাধারণভাবে আতরাফ বা অনভিজাত। কিন্তু এ দু’টো সাধারণ ভাগ মাত্র। হিন্দুদের চার বর্ণের মত। বাস্তবে অসংখ্য ভাগ ছিল উভয় শ্রেণীতেই। আভিজাত্য বা শ্রেষ্ঠত্বের রকমফের ছিল। পাঠান, মোগল, সৈয়দ ইত্যাদি নানান গোষ্ঠীতে বিভক্ত আশরাফরা আতরাফদের ঘৃণা করে চলত এবং তাদের সঙ্গে বিবাহ ও সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলত। এটা অনেকটা বর্ণজাতি প্রথার মত ছিল। তবে তাদের নিজেদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এই সম্পর্ক কঠিন হলেও রুদ্ধ ছিল না।
কিন্তু বিভাজন প্রবল ছিল ক্রমবর্ধমানভাবে নীচের দিকে। আতরাফদেরবিভিন্ন গোষ্ঠী বর্ণজাতির মত বিভিন্ন ’জাত’ বা ’জাতিতে’ বিভক্ত ছিল। এইসব গোষ্ঠীর মধ্যে মর্যাদার বিরাট তারতম্য ছিল যার উপর নির্ভর করত বিবাহ, একত্র আহার এবং সামাজিক সম্পর্কের মাত্রা। বর্ণজাতির পেশাগত নির্দিষ্টতার মত এখানেও পেশার নির্দিষ্টতা বা পরিবর্তনে দুরূহতা লক্ষণীয়।
তবে এটা ঠিক যে, মুসলমানদের মধ্যে এই ধরনের গোষ্ঠী বিভাজন হুবহু হিন্দু সমাজের মত ছিল না। কারণ হিন্দু বর্ণজাতির তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিল জন্মান্তরবাদ এবং পূর্বজন্মে বিশ্বাসমূলক কর্মফলবাদ যার কোনরূপ স্বীকৃতি ইসলামে নেই। এর ফলে মুসলিম সমাজে বর্ণজাতি প্রথার প্রভাব এবং এই আদলে সমাজ সংগঠন ছিল মূলত শ্রম-কর্ম বিভাজনের বা শ্রম বিভাগের নির্দিষ্ট ভারতীয় রূপ যা কয়েক হাজার বৎসর ধরে এখানে ক্রিয়াশীল ছিল। ভারতবর্ষে বর্ণজাতি প্রথার প্রভাব কত গভীর ও ব্যাপ্ত ছিল সেটা বোঝা যায় যখন আমরা এমনকি ব্রিটিশ শাসনকালেও মুসলিম সমাজে এই ধরনের সামাজিক স্তর বিন্যাসের অস্তিত্বের সাক্ষ্য পাই।
ব্রিটিশ শাসনে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যিক সমাজ কাঠামোর বিরাট রকম পরিবর্তন সংঘটিত হল। ব্রিটিশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসনে ভারতীয় সমাজের নিজস্ব কাঠামো ভেঙ্গে পড়ল। একদিকে উৎপাদনে বর্ণজাতি ব্যবস্থার ভূমিকা ফুরাল। ব্রিটিশ কেন্দ্রিক শিল্প-বাণিজ্যের গতিশীলতা বর্ণজাতি প্রথার কাঠামোকে ভাঙ্গল দুইভাবে। প্রথমত, তা এ দেশের সনাতন কুটির শিল্প ও বাণিজ্য কাঠামোকে চূর্ণ করল। এইভাবে সমাজের এবং বিশেষভাবে গ্রাম সমাজের নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তিকে বিপর্যস্ত করল। ভারতীয় সমাজের নিজস্ব শিল্প কাঠামো ভেঙ্গে পড়ায় সমাজ দারুণভাবে কৃষি নির্ভর হল। এটা সমাজের নিজস্ব শক্তি ও গতিশীলতার উপর মারাত্মক আঘাত ছিল। দ্বিতীয়ত, বড় বড় নগর ও শহরকে কেন্দ্র ক’রে যন্ত্র শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং এর পাশাপাশি ব্রিটিশের বাণিজ্য ও শাসনের প্রয়োজনে রেলপথ প্রতিষ্ঠা এবং রাস্তা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সামাজিক ভিত্তি হিসাবে বর্ণজাতি প্রথার অস্তিত্ব শেষ করল। পুঁজির বিকাশ ইউরোপ ও আমেরিকায় যেমন ভূমিদাস এবং দাস প্রথার অস্তিত্ব বিরোধী ছিল ভারতবর্ষে তেমন তা বর্ণজাতি প্রথার অস্তিত্ব বিরোধী ছিল। বুর্জোয়া অর্থনীতি ও নীতিবোধ কোনটাই বর্ণজাতি প্রথার সঙ্গে খাপ খায় না।
এটা একদিক। অপর দিকে ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় সমাজের নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েতকেও ধ্বংস করল। উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র শহর ও গ্রাম সহ সমগ্র সমাজকে তার নিরঙ্কুশ আয়ত্তে নিয়ে এল যেটা ইতিপূর্বে কোন রাষ্ট্রই পারে নি।
ব্রিটিশ শাসনে যখন একদিকে এই ঘটনা ঘটছে তখন অন্যদিকে মুসলমান সমাজে চলছে আর এক ঘটনা। ক্ষমতাচ্যুত মুসলমান শাসক শ্রেণী মুসলমান জনগণের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য সমাজের ইসলামীকরণের উপর জোর দিল। ফলে বর্ণজাতি প্রথা ও হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব নির্মূল করার আন্দোলন শুরু হল।
উৎপাদন ব্যবস্থায় এবং সমাজ নিয়ন্ত্রণে বর্ণজাতি প্রথার আর কোন গুরুত্ব না থাকায় মুসলমান সমাজে তার প্রভাব দূর করা সহজ সাধ্য হল। তবে হিন্দু সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থায় তার গুরুত্ব ফুরালেও সমাজ নিয়ন্ত্রণে তার ভূমিকা থেকে গেল ধর্মীয় তথা একটা মতাদর্শিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি হিসাবে। হিন্দু সমাজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত উচ্চ বর্ণজাতিসমূহ নিজেদের স্বার্থে যেমন একটা সামাজিক-আদর্শিক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণজাতি প্রথাকে কম বেশী রক্ষা করে চলল তেমন সুদীর্ঘ অভ্যাসে অভ্যস্ত নিম্নতর বর্ণজাতিসমূহও বর্ণজাতি প্রথাকে একটা সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে মেনে চলল। ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক বর্ণজাতি কাঠামোয় সংগঠিত হিন্দু সমাজ উপনিবেশিক বুর্জোয়া ব্যবস্থায় প্রবেশ করল তার বর্ণজাতিমূলক সামাজিক কাঠামোকে মূলত রক্ষা করে। এটা ঠিক যে, যুগের চাপে এই কাঠামোয় অনেক পরিবর্তন এল এবং আনা হলও। কিন্তু তথাপি ধর্মীয়-সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণজাতি ব্যবস্থাকে নির্মূল করা হল না বা করা গেল না।
ভারতীয় মুসলমান সমাজও অনিবার্যভাবে উপনিবেশিক বুর্জোয়া ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে বাধ্য ছিল এবং তা করলও। কিন্তু ধর্মীয় অথবা তার মানসিক পরিমণ্ডলে নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীবাদকে রক্ষা ক’রে, যেখানে ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্ব নেই। এইভাবে ব্যক্তিসত্তামূলক বুর্জোয়া ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিসত্তাহীন নিরঙ্কুশ গোষ্ঠীবাদ এই উভয়ের জটিল মিশ্রণ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এক অস্বাভাবিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করল।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ শাসকরা যে পরিবর্তন এনেছিল তা ছিল যুগান্তকারী। ইংরেজ এ দেশে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তি মালিকানাকে দৃঢ়বদ্ধ করে। কিন্তু বিদেশী উপনিবেশিক চরিত্রের দরুন তাদের এই শাসন ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশ ও প্রকৃত স্বাধীনতা বিরোধী ছিল। তাই তারা এখানে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তাতে পুরাতন স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বহু বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা হল। বলা যায় ইংরেজরা পুরাতন মোগল সাম্রাজ্যকে একটা নূতন অবয়ব দান করল। তবে মোগল রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ সামরিক আমলাতান্ত্রিক রূপটা অক্ষুণ্ন থাকল না। তার বদলে রাষ্ট্রের বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক রূপ প্রধান হয়ে দেখা দিল। এই উপনিবেশিক রাষ্ট্রের স্বৈরতন্ত্রকেও ইংরেজ শাসকরা কিছুটা সংযত করল। বিশেষত ইংরেজ শাসক শ্রেণী এই উপমহাদেশে নীচ থেকে ধীরে ধীরে নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং রাজনৈতিক দল গঠন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও আন্দোলনের অধিকার স্বীকার ক’রে খুব সীমিত পরিসরে হলেও একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোগড়ে তুলল।
অর্থাৎ এ দেশে ইংরেজ শাসনে খুব সীমাবদ্ধ আকারে শিল্প বিপ্লবের সূচনা যেমন হল ঠিক তেমন গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনাও হল। মনে রাখতে হবে বৈদেশিক উপনিবেশিক শাসনাধীনে সংগঠিত হওয়ায় এই উভয়েরই সীমাবদ্ধতা ও বিকৃতি নিদারুণ। ইউরোপের বুর্জোয়া বিপ্লবের সঙ্গে একে এক করে দেখলে ভুল হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর অসাধারণ তাৎপর্য রয়েছে। এই তাৎপর্য না বুঝে বিপ্লবের চেষ্টা করার অর্থ হচ্ছে অনিবার্য ব্যর্থতার পথে যাওয়া।
এই উপমহাদেশে মার্কসবাদী বিপ্লবীদের সামনে সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের যে দুই প্রধান মডেল ছিল তার একটা রুশ বিপ্লব অপরটা চীনা বিপ্লব। রাশিয়া ছিল সম্পূর্ণরূপে স্বৈরতান্ত্রিক এক রাষ্ট্র যেখানে পশ্চিম ইউরোপের প্রভাবে পুঁজির বিকাশ শুরু হলেও আমলাতান্ত্রিক-সামন্তবাদী রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো এবং সংস্কৃতির চাপে তার বিকাশ ছিল বাধাপ্রাপ্ত। অপরদিকে রাষ্ট্র প্রবলভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক হওয়ায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রায় অনুপস্থিত ছিল। এই অবস্থায় জারের সামন্তবাদী স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে কমিউনিস্ট পার্টি সমাজের শিল্পায়ন ও গণতন্ত্রায়নের অগ্রগামী শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবার সুযোগ পেয়েছিল। একটা পশ্চাৎপদ স্বৈরতান্ত্রিক সমাজকে পাল্টা ও উন্নত স্বৈরতন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়িত ও আধুনিক করার বিকল্পটা কমিউনিস্ট পার্টি উপস্থিত করেছিল। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির নিজের ভিতরে ছিল এক ধরনের গণতন্ত্র যার যত সীমাবদ্ধতা থাক রাশিয়ার মতো মধ্যযুগীয় স্বৈরতান্ত্রিক সমাজের শিল্পায়ন ও গণতন্ত্রায়নে তার কার্যকারিতা ছিল অপরিমেয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে রাশিয়ায় ব্যক্তি পুঁজির বদলে রাষ্ট্রীয় পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে সমাজের শিল্পায়ন ও আধুনিকায়ন অর্জন করা হয়। এখন সেখানে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের পতনের মতাদর্শিক তাৎপর্য যা-ই থাক এটা বাস্তবে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের পতন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বুর্জোয়া অর্থনীতি ও সমাজ গঠনের পথে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ সেখানে একটা অন্তর্বর্তী ভূমিকা পালন করেছে। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে এই ভূমিকা কিছু দীর্ঘায়িত হয়েছে মাত্র।
কমিউনিজম রাশিয়াকে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসাবে এক ধরনের গোষ্ঠীবাদ দান করেছিল যাতে ব্যক্তিসত্তাকে দমন করে তাকে গোষ্ঠীর নিরঙ্কুশ অধীনে এনে শিল্প অর্থনীতি গড়ার চেষ্টা হয়। কিন্তু স্বাধীন ব্যক্তির অস্তিত্ব ছাড়া শিল্প অর্থনীতি বেশী দূর এগোতে পারে না বলে গোষ্ঠীবাদের প্রেরণায় সমাজের দ্রুত শিল্পায়ন হলেও একটা সময়ে প্রযুক্তির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গোটা ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়েছে।
সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের ফলে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে যে সীমাবদ্ধ গণতন্ত্র ছিল তারও মুক্তি ঘটেছে। এতদিন যেটা ছিল পার্টির ভিতরে এক ধরনের গণতন্ত্র এবং বাইরে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র এখন সেটা একটা সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করেছে যাকে এখন যত বিশৃঙ্খল ও যন্ত্রণাদায়ক মনে হোক এখান থেকে তাকে পিছনের দিকে সেভাবে ঘোরানো আর সম্ভব নয়। অবশ্য এই ধরনের ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনের মুহূর্তগুলোতে অনেক সময় সাময়িক পশ্চাদপসরণ ঘটে। কিন্তু ঠিক পূর্বাবস্থায় ফেরা সম্ভব হয় না।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এমন এক দেশে বিপ্লব করে যেখানে সমাজ রাশিয়ার তুলনায়ও পশ্চাৎপদ ছিল। সেখানে শিল্প পুঁজির এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় অনুপস্থিতিতে সমাজের দ্রুত শিল্পায়ন ও গণতন্ত্রায়নের প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির আবির্ভাব ঘটেছিল।
এটা ঠিক যে, কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় যেটার উপর সবচেয়ে জোর দেওয়া হয়েছে সেটা হল সমাজের শিল্পায়ন ও আধুনিকায়ন। ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অস্তিত্বহীনতার ফলে গণতন্ত্রের বিকাশের পথে যত দুর্লংঘ্য বাধাই উপস্থিত হোক বহু পুরাতন ও সনাতন কৃষি ভিত্তিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক সমাজের আধুনিক শিল্প সমাজে রূপান্তরে রাশিয়া ও চীন এই উভয় দেশেই কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা যুগান্তকারী।
চীনে অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি এখনও ক্ষমতাসীন। কিন্তু তা একদলীয় শাসনেই ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের পথ এখন গ্রহণ করেছে যেটা তার মতাদর্শ বিরোধী। অবশ্য এই পথে যেটা স্বাভাবিক সেটা হল একটা পর্যায়ে সমাজের উদার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা করা। এটা কখন কিভাবে হবে সেটা এখন বলা না গেলেও এই পরিণতির কথা বলা যায়।
রাশিয়া বা চীনের বিপ্লবের এই মডেল ভারতীয় উপমহাদেশে কার্যকর যে হয় নি তার বহুবিধ কারণের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী উপমহাদেশের সমাজকে পুরোপুরি বদলায় নি। কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের প্রয়োজনে সমাজটাকে পূর্বের রূপেও রাখে নি। বিশেষত তার নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বেইএখানে আধুনিকায়ন ও শিল্পায়নের সূচনা হয় পুরাতন সমাজ কাঠামোকে অনেকাংশে ভেঙ্গে কিংবা পরিবর্তিত করে। ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী পূর্বের স্বৈরতান্ত্রিক সমাজকেএতটা বদলায় নি কিংবা ভাঙ্গে নি যাতে এখানে নূতন সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়া বাধামুক্ত হয়। বলা যায় তার ধ্বংসের শিকার ছিল এ দেশের ভালো দিকগুলোই অনেক বেশী রকম। তাই ধ্বংস হয়েছিল এ উপমহাদেশের নিজস্ব শিল্প, বাণিজ্য, জনগণের প্রথাগত নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা। বলা যায় ব্রিটিশ ধ্বংস করেছিল এ উপমহাদেশের নিজস্ব শক্তি ও সম্ভাবনাকে। এবং তার পরিবর্তে সে ভালো যেটুকু গড়ল তা হল একান্ত সীমাবদ্ধ ও অনেকাংশে বিকৃত ও পরনির্ভরও।
তবু যত দুঃখজনকই হোক যুগ-যুগান্ত ধরে ভারতীয় সমাজের যে জাড্যের শক্তি শিল্প-প্রযুক্তি, ব্যক্তিসত্তা ও আধুনিক গণতন্ত্রের উদ্ভব কিংবা বিকাশকে চাপা দিয়ে রাখছিল ব্রিটিশ শাসন সেই শক্তির ধ্বংসের অন্তত পথ করে দেয়। একদিকে আধুনিক শিল্প-প্রযুক্তির সূচনা অপর দিকে একটি আমলাতান্ত্র্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সীমাবদ্ধ আধুনিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশে সমাজ বিকাশের গতিপথটা মোটামুটি নির্দিষ্ট করে দেয়। যখন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের যাবার সময় হয় তখন তারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত ক’রে তাদের শাসনভার দিয়ে চলে যায়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয় মুসলমান সংখ্যাগুরু অঞ্চল নিয়ে এবং ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয় হিন্দু সংখ্যাগুরু অঞ্চল নিয়ে। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পূর্ব অংশ। পাকিস্তানের শাসন পর্বে এক বৃহৎ সময় সামরিক শাসনের মধ্যে কাটে। কিন্তু সামরিক শাসকরাও নির্বাচনমূলক রাজনীতিকে ব্যবহার করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা মোটামুটি কার্যকর থাকলেও ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কাটে মূলত সামরিক এবং আধা সামরিক শাসনে। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮-তে সামরিক শাসন কায়েম করলেও এক সময় নির্বাচনের মাধ্যমে তার শাসনকে একটা বেসামরিক রূপ দেন। ১৯৬৯-এ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন কায়েম করেন এবং সামরিক শাসনাধীনে ১৯৭০-এ নির্বাচন দেন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিপুল ভোটাধিক্যে স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করে। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার নির্বাচনের ফলকে অস্বীকার করে পূর্ব পাকিস্তানে সেনা অভিযান পরিচালনা করলে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র জাতীয় যুদ্ধে পরিণত হয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একত্রিশ বৎসরের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করলে আমরা দেখতে পাব ব্রিটিশ শাসনকালে সূচিত শিল্পায়ন ও গণতন্ত্রায়নের যে ধারাপাকিস্তানী শাসনকালে এ দেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল সেই ধারার ভিতর রয়েছে রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। নির্বাচনমূলক সংসদের প্রশ্নকে উপেক্ষা ক’রে এ দেশে জনগণের কোন রাজনৈতিক শক্তি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। বিদ্যমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ হিসাবে সেনাবাহিনী যখন সংসদকে আঘাত করেছে তখন তার নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে হলেও আর একটি সংসদ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সামরিক শাসক এরশাদ তার অধীনস্থ সংসদকে রাজনীতিক ও জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য করতে পারেন নি। ফলে তার সরকার এবং সংসদ উভয়ের পতন হয়েছে গণ-আন্দোলনের আঘাতে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এ ক্ষেত্রে জনমনে যে আকাঙ্ক্ষা কাজ করেছে তা হল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং এ দেশে বাস্তবে অথবা মানুষের আকাঙ্ক্ষায় গণতান্ত্রিক ও সার্বভৌম সংসদ হচ্ছে রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র। তাই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী সার্বভৌম সংসদের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে এ দেশে যাঁরা বিপ্লব কিংবা রাজনীতির স্বপ্ন দেখেন তাঁরা জনগণকে সংগঠিতকরায় ব্যর্থ হয়েছেন।
’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ প্রতিষ্ঠিত হলে দেখা গেল এই সংসদ গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচিত হলেও জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে তা যেমন কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করতে পারে নি তেমন তা এমন কি গণতন্ত্রকে দৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেও পারে নি। তাহলে সংকটটা কোথায় এবং সমাধানই বা কোন পথে ? এর উত্তর হল এর সংকট গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার ভিতর নিহিত। বস্তুত বিদেশী ব্রিটিশ শাসক শ্রেণী এ দেশে সীমাবদ্ধ গণতন্ত্রের যে ধারণা ও চর্চা দিয়েছিল এবং পাকিস্তান আমলেও যে সীমাবদ্ধ গণতন্ত্রের ধারণা অনুযায়ী গণতন্ত্র চর্চার চেষ্টা চালানো হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশেও আজ অবধি সেই সীমাবদ্ধ গণতন্ত্রকেই গণতন্ত্র হিসাবে চালানোর মধ্যে রয়েছে সংকটের প্রকৃত উৎস।
বাস্তবের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাব এ দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্র হিসাবে যে সংসদ ও সরকার থাকে বা আছে তা একটি ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ কেন্দ্রে থেকে সারাদেশের জনগণকে পরিচালনা করে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এবং আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র সংসদের ক্ষুদ্র কাঠামোতে আবদ্ধ, যার চারপাশে রয়েছে দেশ রক্ষা ও শাসনের এক বিশাল আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা। সরকার আমলাদের মাধ্যমে দেশ শাসন করতে গিয়ে গণতন্ত্রকে প্রকৃতপক্ষে আমলাতন্ত্রেই পরিণত করে। এইভাবে গণতন্ত্র গণবিরোধী স্বৈরতন্ত্ররূপে আচরণ করে। দেশ শাসনের ভিত্তিমূলে জবাবদিহিমূলক এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনের অস্তিত্ব নেই। সরকার অনেক দূরে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এক অদৃশ্য শক্তি রূপে জনগণের কাছে থাকে। জেলার জনগণ, থানা ও গ্রামের জনগণ যে প্রশাসকদের শাসনাধীনে থাকে তারা কেউ নির্বাচিত নয়। জেলার শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু নির্বাচিত জেলা পরিষদ নয়, বরং উপনিবেশিক আমলে তৈরী আমলাতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ স্বরূপ জেলা প্রশাসক বা ডিসি। তারই নীচে রয়েছে থানায় বা উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা ইউএনও। এই নিয়মেই প্রকৃতপক্ষে সারা দেশ চলছে। সরকারের সকল শাসন ও কর্মের বিভাগ জনগণের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত স্বাধীন ও স্বয়ংক্রিয় শক্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ এ দেশে সংসদের বাইরে রাষ্ট্র কাঠামোয় গণতন্ত্র নেই। ফলেআমলাতন্ত্র দ্বারা সীমাবদ্ধ সংসদকে ঘিরে এক অশুভ রাজনীতির চক্রও গড়ে উঠেছে। যাদের হাতে বিপুল অর্থ ও ক্ষমতা তাদের পক্ষে সংসদ দখল করা খুব সহজ হয়।
ফলে রাজনীতির রাজনৈতিক চরিত্র থাকে না। ক্ষুদ্র কেন্দ্রে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় সেনাবাহিনীর পক্ষে যেমন এ দেশে যখন তখন ক্ষমতা দখল করা সহজ হয়েছে ব্যাপারটা অনেকটা তেমন। এই অবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনমূলক রাজনীতি ক্লেদাক্ত ও দুর্বৃত্তায়িত হতে বাধ্য হয়।
দেশের সকল বৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতা একটি মাত্র কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ হওয়ায় কখনও রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্র এবং কখনও সামরিক স্বৈরতন্ত্র পরিচালিত হবার যে পরিস্থিতি রয়েছে তা থেকে মুক্তির পথ হল গণতন্ত্রকে মুষ্টিমেয় রাজনীতিক, আমলা ও ধনিকের গণতন্ত্রের পরিবর্তে জনগণের গণতন্ত্রে পরিণত করার পদ্ধতি হিসাবে দেশ শাসনের সকল স্তরে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা একটি মাত্র কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ না থেকে সারা দেশে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। তখন সামরিক শক্তির বলে উচ্চাভিলাষী সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে কিংবা অর্থ ও ক্ষমতার বলে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থ বিরোধী শক্তির পক্ষে ক্ষমতা বা শাসন কেন্দ্র দখল করা সম্ভব হবে না। আর সেটা যদি কখনও সম্ভব হয় তবে তাতেও তার লাভ হবে না এই কারণে যে, সমগ্র দেশে প্রসারিত গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা থাকায় কোন মুষ্টিমেয় শক্তির পক্ষে জনগণকে পদানত করা সম্ভব হবে না। তখন সারা দেশে বিস্তৃত গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকর রক্ষাব্যূহ হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। সুতরাং এ দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট চলছে তা থেকে উত্তরণের পথ গণতন্ত্রকেক্ষুদ্র সংসদের চৌহদ্দি থেকে মুক্ত করে সারা দেশেবিস্তৃত করা, রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে এবং ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
দেশ শাসনের এই ব্যবস্থা আমাদের নিকট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন হিসাবে পরিচিত। তবে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলতে আমাদের কল্পনায় বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চিত্র ভেসে ওঠে। কিন্তু এই ধরনের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী না হওয়ায় এগুলি প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনকে প্রতিনিধিত্ব করে না। এগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মনীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা পালন করে মাত্র। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের শেখানো অনেক ভ্রান্ত ধারণার মত স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের এই উদ্ভট ধারণার বাইরে বেরোতেনা পারা এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক হয়েছে।
অথচ ব্রিটিশ শাসনকালের পূর্ব পর্যন্ত এ দেশেই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের একটা অনেক বেশী কার্যকর কাঠামো ছিল যা ছিল এ দেশের সমাজ ও জনগণের সৃষ্টিশীলতা ও প্রাণশক্তির অন্যতম উৎস। এটা হল পঞ্চায়েত। যুগ যুগ ধরেবিভিন্ন সময় বাইরের বিভিন্ন আক্রমণ এবং রাষ্ট্রের উলট-পালট এই সবকিছুর ভিতর দিয়েও বঙ্গ ও ভারতের সমাজ যে শক্তি বলে তার ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পেরেছিল তার সবচেয়ে বড় উৎস হল পঞ্চায়েত। জনগণের এই পঞ্চায়েতমূলক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে ধ্বংস ক’রে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ এ দেশের জনগণের নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি পুরোপুুরি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। কার্যকর স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন একটা সমাজের জন্য কতখানি শুভ হতে পারে তা দেখার জন্য আমাদের ইউরোপ, আমেরিকায় যাবার দরকার হয় না। প্রতিবেশী পশ্চিম বঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা বুঝতে পারব সেখানে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য অর্জনের পিছনে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অবদান কতখানি। অথচ ভারত রাষ্ট্র ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের আমলাতান্ত্রিক উত্তরাধিকার এখনও বহন করে। কিন্তু সেখানে যেটুকু গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা বজায় আছে তাকে ব্যবহার ক’রে পশ্চিম বঙ্গে সিপি (এম) এবং বামফ্রন্ট সরকার প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের সমান্তরালে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের একটা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোকে সারা দেশে বিস্তৃত ক’রে ভূমি সংস্কারসহ জনগণের জন্য কল্যাণকর বেশ কিছু সংখ্যক কর্মনীতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিল পাকিস্তানেরঅন্তর্ভুক্ত বাঙ্গালী জনগণের নিজস্ব জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা। জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা একদিনে গড়ে ওঠে নি। শুধু আঞ্চলিক বৈষম্য এই চেতনা গড়ে উঠার কারণ নয়। পূর্ব বঙ্গের উপর পাকিস্তানের বৈষম্য ও আধিপত্য জাতিগত রূপ নিয়ে প্রথম থেকেই দেখা দিয়েছিল। যার একটা প্রকাশ ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বাংলা ভাষার উপর আঘাত। সুতরাং অভিন্ন ধর্মের পরিচয়ের ভিত্তিতে অখণ্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই রাষ্ট্রটা এখানে বেশী দিন টিকল না।
যদি এই অঞ্চলের বাঙ্গালী তার জাতিসত্তাগত পরিচয়কে তুচ্ছ বা বর্জন করতে পারত এবং পাকিস্তানের ধর্মীয় পরিচয়ের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে প্রধানত মুসলমান হিসাবে আত্ম-বিকাশের পথ খুঁজত তাহলে বাঙ্গালীর রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা দেখা দিত না। যে ধরনের আঞ্চলিক বৈষম্য তখন ছিল তেমন বা তার চেয়ে অনেক বেশী বৈষম্য নিয়েও অখণ্ড রাষ্ট্র বজায় থাকতে পারে যদি একটা অঞ্চলের জনগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী থেকে নিজেদের জাতিসত্তাগত কিংবা জনগোষ্ঠীগত পার্থক্য দেখতে না পায়। সেই ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামটা ভিন্ন রূপ নেয়। প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী জনগণ বাঙ্গালী পরিচয়কে বর্জন করে নিজেদের সত্তাকে ভাবতে রাজী হয় নি। সুতরাং বাঙ্গালী জাতিসত্তার আত্মবিকাশ ও প্রতিষ্ঠার তাগিদ ধর্মীয় কাঠামো ভেঙ্গে তাকে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে তার প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে বর্জন করার ফল হয়েছে ভয়ংকর ক্ষতিকর। এর ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হয়েছে লক্ষ্যচ্যুত। কারণ রাষ্ট্র শুধু একটা ভৌগোলিক সীমানার ব্যাপার নয়। বিশেষত আধুনিক যুগে যখন সকল অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে রাষ্ট্র তখন একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও আদর্শিক অভিব্যক্তি হিসাবে যদি রাষ্ট্র দেখা না দেয় তবে সমষ্টিগতভাবে জনগোষ্ঠী বা সমাজের প্রেরণা থাকে না। সেক্ষেত্রে গোষ্ঠী বা সমষ্টি চেতনা থেকে সমাজের ব্যক্তি চেতনা বিচ্যুত হয়। ফলে জাতি বা রাষ্ট্রের বৃহত্তর উন্নয়ন স্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তির উন্নয়ন স্বার্থবোধ সঙ্গতি রাখার পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যার ফলে সংখ্যাগুরুর স্বার্থ এবং উন্নয়ন বিপন্ন হয়।
সব সমাজেই ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা সমস্যা রয়েছে। সমস্যা তাই শুধু ব্যক্তিকে মুক্ত করার নয়, তাকে সমাজের সঙ্গে আবদ্ধ বা সংযুক্ত করারও। সামাজিক কোন আদর্শ বা নীতিবোধ না থাকলে মাৎস্যন্যায় দেখা দেয় যার সুফল তাৎক্ষণিকভাবে মুষ্টিমেয় ভোগ করলেও কুফলটা যেমন ব্যাপক সমাজ জীবনে নেমে আসে তেমন শেষ পর্যন্ত এই মাৎস্যন্যায়ে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীও আর নিরাপদ থাকে না। এবং সবচেয়ে বড় কথা সমাজের উৎপাদন, উন্নয়ন ও সংগঠিত উদ্যোগ সব বিনষ্ট হয়। তাই সমাজ অথবা রাষ্ট্র গঠনে একটা আদর্শের প্রয়োজন হয়।
সামাজিক সংহতি ও গতি অর্জনের তাগিদ অতীত কালে ধর্ম, উপজাতীয় চেতনা, ভাষাভিত্তিক জাতি চেতনা, রাজানুগত্য অথবা অন্য কোন ধরনের আদর্শকে অবলম্বন ক’রে আত্মপ্রকাশ করত। আধুনিক যুগের সূচনায় ইউরোপে ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আদর্শিক শক্তি হয়ে দেখা দেয়। সেখানে আধুনিক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন হয় জাতি-রাষ্ট্রকে অবলম্বন করে। জাতি-রাষ্ট্রের মাধ্যমে সমাজ বিকাশের সুউন্নত স্তরে প্রবেশ করার পর সেখানে এখন অনেক ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপীয় সম্প্রদায় বোধকে অধিকতর গুরুত্ব বা অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে গঠিত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু আমরা বুর্জোয়া বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক, সামাজিক ও ভৌগোলিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বর্তমানে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অপরিমেয়। একে বর্জন করলে আমাদেরকে আধুনিকতা বর্জন করতে হয়। সেই সঙ্গে বর্জন করতে হয় গণতন্ত্রকেও। জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসাবে আমাদের সামনে থাকে কেবলমাত্র ধর্ম। কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং উপাদান হিসাবে এটিকে বর্জন করেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে বর্জন করলে আমাদেরকে ’৭১ পূর্বাবস্থায় ফিরতে হয়। অথবা ’৪৭ পূর্বাবস্থায়।
এমতাবস্থায় বাঙ্গালীর জন্য বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আদর্শ পরিত্যাগ করার পর থেকে এ দেশে আদর্শিকভাবে বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নেই। যেটা আছে সেটা একটা ভূখণ্ড মাত্র যার একটা রাজনৈতিক সীমানা আছে। অবশ্য এই সীমানাকে রক্ষা করার জন্য এখানে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়কে মুখ্য করে তুলে একটা রাষ্ট্রীয় আদর্শ দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছে। সংকটটা সেখানে। কোন সমাজ বা জাতির উন্নয়ন বা আধুনিকায়ন এই রকম গোঁজামিল বা স্ববিরোধ দিয়ে অর্জন করা যায় না বলে বাংলাদেশের এই অবস্থা।
উন্নয়ন শুধু অর্থনীতির সমস্যা হলে পৃথিবীতে রাষ্ট্রের কোন সীমান্ত দেওয়ার দরকার হ’ত না। অর্থাৎ উন্নয়নের একটা সীমান্ত আছে। এমন কি গণতন্ত্রেরও তা আছে। তা যদি না হ’ত তবে আজকের এই বৈশ্বিক অর্থনীতির যুগেও ইউরোপ-আমেরিকা কেন তাদের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখে? বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি আমেরিকা কি সমস্ত পৃথিবীর মানুষের ভোটে তাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন মেনে নিবে? কিংবা এটা মনে করার কারণ নেই যে, ইউরোপ-আমেরিকা এমন কোন ধরনের আন্তর্জাতিক নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা মেনে নিবে যা সমস্ত পৃথিবীকে একটি অখণ্ড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন করবে। সে ক্ষেত্রে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ পৃথিবীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছে তারা হারবে। অর্থাৎ কোন কিছুই নিরঙ্কুশভাবে অবাধ নয়। তাই তাদের গণতন্ত্রেরও সীমানা আছে। সেখানে মানুষ মাত্রেরই সবার প্রবেশাধিকার নেই। আজ যে অবাধ বাজার ব্যবস্থার কথা তারা বলছে সেটিরও ভিতর রয়েছে তাদের নিজেদের বাজার রক্ষা ও সম্প্রসারণের সব রকম ব্যবস্থা এবং একই সঙ্গে দুর্বল ও অনুন্নত দেশগুলোর নিজস্ব বাজার অধিকার করার ব্যবস্থা।
সুতরাং জাতির সীমান্তকে রক্ষা করে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথ খুঁজতে হবে। এই সীমান্ত শুধু মাটিতে থাকলে চলে না। তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হ’ল চেতনায় তার অবস্থান।আর চেতনায় তাকে আনতে হলে তাকে খুঁজতে হবে জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্যের ভিতর। এইভাবে দেখা দেয় বাঙ্গালী জাতিসত্তা এবং জাতীয়তাবাদ।
অবশ্য যদি উন্নয়নের উদ্যোগ এবং নেতৃত্ব বিদেশীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় তবে জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রয়োজন হয় না। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রয়োজন হয় জাতির নিজস্ব নেতৃত্বে জাতীয় উন্নয়নের জন্য। যদি বিদেশীদের হাতে থাকে উন্নয়নের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব তাহলে তাদের প্রয়োজনে এবং চাপে এক ধরনের সীমাবদ্ধ উন্নয়ন হতে পারে। তবে তার মধ্যে জাতির গৌরব, সৃজনশীলতা এবং নিজস্বতার কিছু থাকে না। সেদিক থেকে বিচার করলে এ কথা বলতে হয় যে, বাংলাদেশের উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা এবং সংকট তার নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা এবং সংকট থেকে এসেছে। আলোচনার শুরুর দিকে আমি বলেছিলাম যে, সমাজ বা রাষ্ট্র গঠন একটা শ্রেণীর নেতৃত্বে হয়। কাজেই এটা বাংলাদেশের নেতৃত্বকারী শ্রেণীর দুর্বলতার ফল।
এই শ্রেণীর মধ্যে বুর্জোয়া উপাদান থাকলেও ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর অনুরূপ চরিত্রের অধিকারী নয়। ফলে তা এখানে একটা বুর্জোয়া সমাজ গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং এখানকার বাস্তবতা অনুযায়ী এখানে একটি উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য এমন একটি শ্রেণী গঠনের প্রয়োজন রয়েছে যা বর্তমান নেতৃত্বকারী শ্রেণীর বাস্তব ও আদর্শগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে দর্শন বা আদর্শের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বাস্তবে এই শ্রেণী গঠনের ক্ষেত্রে সমাজের যে দুর্বলতা এবং সীমাবদ্ধতা আছে তা থেকে তার মুক্তির জন্য তাকে হাত বাড়াতে হবে আদর্শের দিকে। বৈষয়িক ক্ষেত্রে নূতন ও উদীয়মান শ্রেণীর দুর্বলতাকে পূরণ করতে পারে এবং সমস্ত সমাজ ও জাতিকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারে কেবলমাত্র একটি আদর্শ। এ দেশের বাস্তবতায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে সেই আদর্শ নির্মাণ করা অসম্ভব।
অবশ্য বাংলাদেশ শুধু বাঙ্গালীর আবাসভূমি নয়। এখানে জুম্ম বা পাহাড়ী, সাঁওতাল, গারো প্রভৃতি কিছু সংখ্যক সংখ্যালঘু জাতিসত্তাও বাস করে। সুতরাং সংখ্যালঘু হলেও এ সকল জাতিসত্তার জাতিগত অধিকার তথা জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তার গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুকে রক্ষা করতে পারে না। তাই আমাদের এই আলোচনায় জাতীয়তাবাদ বিশেষ প্রেক্ষিতে বাঙ্গালীর প্রশ্নকে প্রধান করে দেখলেও অন্যান্য জাতিসত্তার জাতিগত অধিকার এবং তাদের জাতীয়তাবাদের সমস্যা ও প্রশ্নকে মোটেই উপেক্ষা করে না, বরং অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু উন্নয়ন সমস্যার একটি জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের জন্য বাঙ্গালী জাতিসত্তা ও তার জাতীয়তাবাদের সমস্যাই এখানে আলোচিত হ’ল। বস্তুত বাংলাদেশে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সমস্যার মীমাংসা ছাড়া উন্নয়ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অর্থহীন। তবে উন্নয়নের শর্ত পূরণকারী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক। ফলে এই জাতীয়তাবাদের মর্মে অবস্থান করে বাংলাদেশী জাতিসংঘবাদ, যা বাংলাদেশে সকল জাতির স্বাতন্ত্র্য, মর্যাদা ও উন্নয়ন অধিকারকে ভিত্তি ক’রে দাঁড়াতে গিয়ে স্বীকার করে নেয় বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার অপরিহার্যতা।