Banner
‘সর্বরোগহর’ ক্ষুদ্র ঋণী ইউনূস সমাচার -- আজাহারুল ইসলাম

লিখেছেনঃ আজাহারুল ইসলাম, আপডেটঃ May 10, 2011, 6:33 AM, Hits: 18604

বেশ কিছু দিন যাবত ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে মিডিয়া জগতে বেশ হৈ-চৈ চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের পদ থেকে ইউনূসকে অপসারণের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়েই নানা প্রশ্ন ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। মিডিয়ার প্রচারের তাপে কিছু দিন তো মনে হলো এটাই বোধ হয় বাংলাদেশের মানুষের প্রধান সমস্যা। সুশীল সমাজের একটা অংশ, স্বনামধন্য আইনজীবীদের একটা অংশতো ছিলই, এর সঙ্গে ছিল পাশ্চাত্যের সর্ববৃহৎ কর্পোরেট পুঁজিপতিদের সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ শক্তিধর রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ভূমিকা। টেলিফোনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনের হম্বিতম্বি, সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সফর এবং সাংবাদিক সম্মেলনে কূটনীতি বহির্ভূত হুমকিমূলক বিবৃতি উপর তলার গোটা রাজনীতিটাকেই যেন মাতিয়ে দিল।

ডঃ ইউনূসের সমর্থকদের মূল সুর, ক্ষুদ্র ঋণ ব্যব
স্থাউদ্ভাবক ডঃ ইউনূস এই পদ্ধতি উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশসহ তাবৎ বিশ্বের দরিদ্রদের মহা কল্যাণ সাধন করেছেন। এভাবে দরিদ্রদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় অবদান রেখেছেন। তাইতো তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। অতএব এ নোবেল লরিয়েটকে অসম্মান করা যাবে না, তা সহ্য করা হবে না -- এই ছিল পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্র-প্রতিনিধিদের স্পষ্ট হুমকি। এখন প্রশ্ন উঠে, তাহলে নোবেল লরিয়েটরা কি সব রকম আইনের ঊর্ধ্বে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক লরিয়েটকে সে দেশে আইনের আওতায় বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তা হলে আমাদের দেশে তার ব্যত্যয় হবে কেন? আর জনকল্যাণের জন্যই যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার তিনি পেয়ে থাকেন, তবে কেন কল্যাণ-ভোগী জনগণ তাঁর জন্য সারা দেশে রাস্তায় নামলো না? কোন আন্দোলনে নামলো না? মুখ চেনা এক বিশেষ আইনজীবী যাকে এদেশবাসী পাশ্চাত্যের কর্পোরেট পুঁজির এ দেশীয় এক বড় খুঁটি বলে মনে করে, তিনিসহ বিরোধীদলের সমর্থক রাজনৈতিক ফায়দালোভী কিছু আইনজীবী ও সুশীল সমাজের মুখচেনা কিছু বিশেষ ব্যক্তি, যারা পাশ্চাত্যের সমর্থক বলে মূলত চিহ্নিত, তারাসহ কিছু মিডিয়ার ভূমিকা ছাড়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু ইউনূসের প্রতি কোন সমর্থন জানায় নাই। দেশের মুখচেনা সুবিধাবাদী শ্রেণীর লোক ছাড়া সাধারণ মানুষ তাকে কর্মের মধ্য দিয়ে চেনে। সাধারণ মানুষ জানে যে, ইউনূস গরীব মানুষ, গরীব নারীদের নিয়ে ব্যবসা করলেও কোন গরীব মানুষের প্রতি তার সম্মান বা সাধারণ শ্রদ্ধাবোধও নাই। কোন বিপদের দিনে তিনি কখনও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন নাই। দুর্যোগ কবলিত এই দেশে বার বার প্রলয়ঙ্করী ঝড়, বন্যা, আইলা, সিডর, জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি আঘাত হেনেছে। আঘাতের তাণ্ডবে মৃত বা মুমূর্ষ মানুষের পাশে ডঃ ইউনূস কখনও এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ান নাই। তবে কেন সাধারণ মানুষ তার পাশে দাঁড়াবে? বরং সিডরের পরে বিধ্বস- জনপদে তাঁর ব্যবসার সুদ আদায়কারী বরকন্দাজেরা সুদ আদায়ের তাগাদায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল - সে খবরও পত্রিকার মাধ্যমে এ দেশবাসী জানে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, জনগণের প্রতি কোন দরদ, ভালবাসা বা কর্তব্যবোধের মহান ব্রতের জন্য নয় - নিছক ব্যবসার জন্য অত্যন্ত কর্মঠ এই ব্যক্তি তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিষ্ঠুরও বটে। এতো গেল দেশবাসীর প্রতি দরদ ও কর্তব্যের দৃষ্টান্ত, এবার আমরা দেখব যে দেশে তিনি জন্মেছেন সে দেশের প্রতি তার ভালবাসা বা শ্রদ্ধাবোধের পরিচয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রচারিত হয়েছে, তিনি কখনও কোন জাতীয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি সৌধে যান নাই বা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নাই। প্রায় সারা দুনিয়া তিনি ঘুরে বেড়ান। পাশ্চাত্যের উন্নত বিশ্বের প্রতিটা নগর বন্দরে তাকে প্রতি নিয়ত ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বোধ হয় শতশত সভা-সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান, কিন্তু জীবনে কখনও জাতীয় স্মৃতিসৌধে ভুলেও এক বারের জন্য যান না। ২১ ফেব্রুয়ারীতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যান কি? আসলে বাঙ্গালীর স্বাধীনতার প্রতি তার কতটা শ্রদ্ধাবোধ আছে সেটা জানার মত অনুকূল দৃষ্টান্ত আমরা পাই না। ব্যবসা ছাড়া দেশের মানুষের প্রতি তার দরদ, কর্তব্যবোধ বা সহানুভূতির প্রকাশ যেমন ঘটে না তেমন তার প্রতি বিদেশীদের অতিশয় দরদ দেখে দেশের মানুষ বিস্মিত হয়। কারণটা কী? একটু খতিয়ে দেখলেই তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ডঃ ইউনূস তার কর্মদক্ষতা, চাতুর্যমিশ্রিত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গ্রামীণ ব্যাংককে একটা সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলেছেন বিশেষ একটা কাঠামো দিয়ে। যে কাঠামোর মধ্য দিয়ে তার একক কর্তৃত্ব অত্যন্ত নির্বিঘ্ন। এই নির্বিঘ্ন কাঠামোয় নির্মিত সিংহাসনে বসে তিনি গরীব মানুষকে ব্যাংকের আওতায় এনে শোষণমূলক ব্যাংক পুঁজির ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই শোষণমূলক কাঠামোটা তিনি বিশাল প্রচারণার মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই শোষণমূলক কাঠামো পদ্ধতিটা তার আবিষ্কার হলেও গরীবদের মধ্যে ব্যাংক ঋণ দেবার ব্যবস্থা বা কার্যক্রম নূতন নয়। এখন থেকে একশত বছর আগে আমাদের দেশেই সমগ্র বাঙ্গালী ও উপ-মহাদেশের গর্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শাহজাদপুরে শুধুমাত্র গরীব কৃষকদের জন্য ‘কৃষিব্যাংক’ নাম দিয়ে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেই ব্যাংক থেকে গরীব কৃষকদের মধ্যে ক্ষুদ্র আকারের ঋণ দিতেন এবং ফসল উঠার পর ঋণ আদায় করতেন সুদমুক্তভাবে। অর্থাৎ কোন সুদ নিতেন না। এছাড়া তিনি সমবায় চাষ ব্যবস্থা এবং সেচ ব্যবস্থা চালু করার জন্য চেষ্টা করেন। সবই বিনা লাভে, বিনাসুদে। তার নোবেল পুরস্কারের টাকার একটা বড় অংশ গরীব কৃষকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই ‘কৃষি ব্যাংক’-এ পুঁজি হিসাবে দেন। গ্রামের গরীব কৃষকদের মধ্যে ক্ষুদ্র আকারে ঋণ দিতে গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে জার্মানীর এক সমাজকর্মী ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সেটাও ছিল স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণ। অথচ তার পরও ইউনূসকে গ্রামের দরিদ্রদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তক বলা হয়। তাদের দাবী এক অর্থে সঠিক হতে পারে; তা হলো, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কঠোর নিয়মে সুদ ব্যবস্থার গ্রামীণীকরণ। অবশ্য গ্রামেও যুগ যুগ ধরে ব্যক্তিগতভাবে সুদে মহাজনী কারবার প্রচলিত ছিল। বৃটিশ আমলে এবং পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকেও কাবুলী অলারা প্রবাদ বাক্য সম সুদে কারবার করত। সেই সুদে কারবারকেই আধুনিকীকরণ করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেশে ও আন-র্জাতিক বাজারে উপস্থাপন করেছেন ইউনূস। এভাবে তিনি গ্রামের গরীব নারীকে বিশেষত ঋণ ব্যবসায়ী ব্যাংকের আওতায় এনে বিশ্বব্যাপী এ ধরনের শোষণমূলক ব্যাংক পুঁজির সামনে এক নূতন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে সুদ ভিত্তিক এ ব্যবসাটি আন্তর্জাতিক মহাজনদের কাছে খুবই সফল ব্যবসা বলে মনে হয়েছে। আমেরিকাতে যেখানে আইনের চাপে ও জনসাধারণের সচেনতার কারণে মাত্র ২% লাভ ও সুদে টাকা খাটানো কঠিন সেখানে ক্ষুদ্র ঋণের ইউনূসীয় কঠোর পদ্ধতির মাধ্যমে ৫% থেকে ১০% পর্যন্ত এমনকি ১২% পর্যন্ত সুদেও তারা ঋণ ব্যবসা চালাতে সক্ষম হচ্ছে বলে প্রকাশ। পাশ্চাত্যের অন্যান্য অনেক দেশে নাকি তার চেয়েও বেশী সুদে ক্ষুদ্র ঋণ কাঠামোতে ব্যবসা চলছে ইউনুসীয় পদ্ধতিতে। কাজেই আন্তর্জাতিক বৃহৎ পুঁজি মালিকেরা বা কর্পোরেট পুঁজি মালিকদের রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা ইউনূসের পাশে এত দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়। তাদের পছন্দের এ কঠোর সুদ পদ্ধতির উদ্ভাবককে নানা নামে ডজন ডজন পুরস্কার প্রদান করে। শান্তির জন্য প্রদত্ত নোবেল পুরস্কার পেতে তার মোটেও কষ্ট হয় নাই।

শুধু গরীব নারীদের নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবসাই নয়, গ্রামীণ ব্র্যাণ্ডের নামে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন খুব ব্যবসা সফল। গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইউনূস সাহেব যা গড়ে তুলেছেন। গ্রামীণ ফোন এসব সফল ব্যবসার অন্যতম প্রধান দৃষ্টা
ন্ত। তিনি শুধু নিজেই নয়, গ্রামীণ ফোনের মাধ্যমে বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির মালিক বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার লাভ বিদেশে নিয়ে গেছে। এবং এখনও সফল ভাবেই ব্যবসা চলছে। লাভ নামের এ শোষণের সবই হয়েছে গ্রামের গরীব নারীদের স্বাবলম্বী করার নামে শ্রুতিমধুর এ চমক সৃষ্টিকারী স্লোগানের মাধ্যমে। চুক্তির ধারার কারণে গ্রামীণ ফোনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ এখন অবশ্য ইউনূসের হাতে নাই। বিদেশী মালিকের হাতেই সরাসরি চলে গেছে। তাতে কী, ইউনূসের উদ্যোগ তো সফল হয়েছে! গরীব নারীদের নাম করে অনেক সুযোগই রাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা নিয়েছে। ইউনূসের সহযোগিতায় এত বড় একটা লাভের প্রতিষ্ঠান গড়তে পারায় তারা অব্যশই বিপদে ইউনূসের পাশে থাকবে।

উপরোক্ত পদ্ধতিতে শুধু ইউনূসই নন, অন্যান্য এনজিওরাও একই পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো এই এনজিও পদ্ধতিতে কি ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ এবং নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব, যা সুশীল সমাজের এক শ্রেণীর লোক বিশ্বাস করেন? এই বিশ্বাসের প্রমাণ হিসাবে তারা যে তথ্যের উদাহরণ দেন তা হল, ইউনূস অনেক আ
ন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন, শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু তারা বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র নারীর কত ভাগ দারিদ্র্য মুক্ত হল তার কোন তথ্যচিত্র বা পরিসংখ্যান দেন না। তাদের মতে বাংলাদেশকে পুরস্কারের মাধ্যমে অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছেন ইউনূস। কিন্তু আবেগে আপ্লুত হলেই কি বাস্তব পাল্টে যায়? তাদের যদি তথ্য-প্রমাণ খুঁজে দেখার ধৈর্য না থাকে তবে তারা সাদা চোখেও কি দারিদ্র্য পরিস্তিতি দেখেন না?

যারা ক্ষুদ্র ঋণ ও এনজিও মডেলকেই দারিদ্র্য বিমোচনের পথ বলে সব সময় স'তি করে থাকেন, আমাদের দেশের সেই সরকারী আমলা এবং জাতিসংঘের হিসাব হচ্ছে গত প্রায় তিন দশক ধরে এনজিও-র মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির মহা কর্মকাণ্ডের পরও এখন পর্য
ন্ত শতকরা ৫০ জন বা প্রায় ৮ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করেন। সেই অবস্থাটা আমাদের দেশের সেই সব শিক্ষিত ও বিশিষ্ট ব্যক্তি বা সুশীল সমাজের দৃষ্টি এড়ায় কীভাবে? যদি খাদ্য ও কাজের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় তা হলে এই হতভাগ্যদের সংখ্যা ১২ কোটিতে দাঁড়াবে।

এখন আমরা স্মরণ করতে পারি ডঃ ইউনূসের এক সময়ের গর্বিত দাবী যা বহুবার তিনি উচ্চারণ করেছেন ‘দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠাবো’।
কিন্তু বাস্তব সত্যতো সরকারী ও জাতিসংঘের পরিসংখ্যানেই দেখলাম। এই সদম্ভ প্রচার কৌশল তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি অত্যন্ত উচ্চস্বরে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কথা বলেন। যেখানে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ নাই সেখানে কিন্তু চরম জাতীয় স্বার্থের পক্ষে কখনো কথা বলেন না। ইউনূস দীর্ঘদিন ধরে বলছেন, ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু মানুষের আর কোন মৌলিক অধিকার সম্পর্কে তার কোন আগ্রহ দেখা যায় না। গত ৩০ বছরে জনগণের আর কোন মৌলিক অধিকার নিয়ে তার কোন কথা আমরা শুনি নাই। অন্য কোন জন-অধিকার বা জন-দুর্ভোগ নিয়ে তিনি কখনও টু শব্দটি করেন না। ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরুর পর যেমন হৈ চৈ ফেলে দিলেন ক্ষুদ্র ঋণ হলো মানবাধিকার, মৌলিক অধিকার, তেমনি মোবাইল ব্যবসা শুরুর পর মোবাইল দিয়ে দরিদ্রদের, নারীদের ক্ষমতায়নের মাহাত্ম্য প্রচার, আইটি ব্যবসা শুরুর পর ইন্টারনেটের মাহাত্ম্য শুনেছি তার মুখে। এক সময় ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠাবার কথা বলে সারা দুনিয়াতে ভীষণ চমক সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে নানা জনের নানা গবেষণায় উল্টো চেহারা সামনে আসার পর এখন আর ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে বেশী কথা বলেন না। এখন তার নূতন কৌশল সামাজিক ব্যবসা খাত। এদিকেই এখন তার নানা কৌশলী তৎপরতা। এই ব্যবসাগুলোকেও তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের নানা সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবেই সংগঠিত করেন নানাভাবে। সহযোগী নানা সংগঠন গড়ে গ্রামীণ ব্যাংকের পুঁজির সাহায্যে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কোন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের লাভ কোথায় যায়, কে সেটা পরিচালনা করেন এবং কতটা সততার সঙ্গে করেন তার হিসাব বড় কঠিন। গোলোক ধাঁ-ধাঁ-র মত কোথাকার লাভ কোথায় যায় সে হিসাব আরো কঠিন; তার হিসাব কে রাখে?

তিনি বলে বেড়ান যে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হলেন তার সকল, বিশেষত নারী ঋণ গ্রহীতা। দারিদ্র্যকে যাদুঘরে পাঠাবার কথার মত এই কথার উপর বিশ্বাস অনেকের।
কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায় নাই যে, এই কথিত দরিদ্র নারী মালিকেরা কীভাবে তাদের মালিকানা প্রয়োগ করেন? দরিদ্র নারীদের কাছ থেকে জন্মানো আগাম টাকার হিসাব কোথায়? সে টাকার হিসাব তো পাওয়া যায় না! গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সহযোগী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভের অংশ তাদের হাতে যায় না কেন? সহযোগী এই সকল প্রতিষ্ঠানের সব তৎপরতার বা কার্যাবলীর সকল তথ্য সেই দরিদ্র নারী সদস্যদের কাছে যায় না কেন? দরিদ্র সেই নারী সদস্যদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তাদের মালিক বলা হয়। অন্ধের হাতি দেখবার মত! এত বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সেই নারীদের অবস্থা নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী দেশ নরওয়েরই জনৈক যুবকের ডকুমেন্টারী ফিল্মেই বেরিয়ে এসেছে। হায়রে মালিকদের জীবন!

বলা হয়ে থাকে পরিচালনা পরিষদের ১২ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জনই গরীব নারী ঋণ গ্রহীতাদের প্রতিনিধি। খুবই চমকপ্রদ কথা। কীভাবে তারা এই প্রতিনিধি ঠিক করেন? কোথায় এই নির্বাচন হয়? বাংলাদেশের যে কোন ব্যাংক বা যে কোন বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের
C.B.A. নির্বাচন, কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহের সমিতির নির্বাচন বা শিল্প বণিক সমিতির নির্বাচনের খবর বিস্তারিত পাওয়া যায়। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের খবরও সংশ্লিষ্ট এলাকায় সবাই জানতে পারে। আর গ্রামীণ ব্যাংকের মত অতি বৃহৎ একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও বিশদ বিরবণ তো কেউ কোন দিন জানতে পারে না! অথচ যার লক্ষ লক্ষ দরিদ্র নারী সদস্য! আসলে কারা এই প্রতিনিধি ঠিক করেন? সত্যি সত্যি কে ঠিক করেন এই ৯ প্রতিনিধিকে? আসলে এটাও কথার পুষ্পাবরণে একটা নির্লজ্জ মিথ্যা উপাখ্যান নয় কি? সত্যি সত্যি এটা এক ব্যক্তির নির্বাচিত প্রতিনিধি নয় কি? সঠিক উত্তরটি জনগণেরও না বোঝার কারণ নাই। আর এই প্রতিনিধিরা গ্রামীণ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা পালন করেন? গ্রামীণ ব্যাকের সঞ্চিত পুঁজি কোথায় কীভাবে যাবে বা কোথায় কোন কাজে ব্যবহার করা হবে তা কীভাবে কে নির্ধারণ করেন? এই সঞ্চিত মূলধনের খাটানো লভ্যাংশ কীভাবে বন্টিত হয়? এর সঠিক উত্তর কখনই পাওয়া যায় না।

প্রকৃতপক্ষে সব ক্ষমতা পরিচালনা করেন এক ব্যক্তি। অন্য কারো টু শব্দটি করার কোন ক্ষমতা নাই। গ্রামীণ ব্যাংকের সেই ব্যক্তিটিকে বাংলাদেশের তো বটেই দুনিয়ার অনেক দেশের, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা ভালই চেনে, তাদের আপন জন বলেই জানে।

গ্রামীণ ব্যাংকের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য অন্যান্য বৃহৎ বাণিজিক এনজিও গুলোর জন্যও সমান ভাবেই প্রযোজ্য। তার মধ্যে এক ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা অন্যতম। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়, যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মতৎপরতার যথাযথ জবাবদিহিতা না থাকে, যদি স্বচ্ছতার অভাব থাকে, তাহলে সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়ম, দুর্নীতি তৈরী হবে। সুতরাং এগুলো নিয়ে প্রশ্ন ও অভিযোগও তৈরী হবে। খ্যাতি ও প্রচারণা দিয়ে সব কিছুকে আড়াল করে রাখা কর্পোরেট জগতের একটা বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু তারও তো সীমা থাকে। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন আসলে ক্ষুদ্র ঋণ মডেল নিয়েই প্রশ্ন। ভুল বা মিথ্যা গৌরব দিয়ে কোন দেশ তার নিজের মৌলিক সমস্যা দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখতে পারে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের দারিদ্র্যের জাল, ঋণের বোঝা, আর নিপীড়নের নানা ঘটনা কি কেবল পুরস্কারের স'তি দিয়ে ঢেকে রাখা যায়? দারিদ্র্য বিমোচনের গল্প সত্য হলে তো ৭০/৮০ লাখ গরীব মানুষই এখন ইউনূসের সপক্ষে ঢাকা শহর ঘেরাও করত, কিন্তু কোন সাড়াশব্দ তাদের দিক থেকে নাই। সাড়াশব্দ যত সব দূতাবাস আর বহুজাতিক পুঁজির নানা ঘাঁটিতে, কিংবা ‘সুশীল সমাজে’।

গত ৪-মে-২০১১-এর সংবাদপত্রের খবরে জানা গেল আপিল বিভাগের রায়ের পর ইউনুস কার্যক্রমের পরিকল্পনা। রায় পক্ষে গেলে কীভাবে সারা ঢাকা শহরে আনন্দ মিছিল করবে, আর রায় বিপক্ষে গেলে কীভাবে ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে আন্দোলন সংগঠিত করে ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকবে তার পরিকল্পনা। ১১-মের পত্রিকায় বিশেষভাবে সেটা দেশবাসী জানতে পেরেছিল। ঠিক সেই অনুসারেই তার কার্যক্রম চলছে। রায়কে অকার্যকর করতে ভবিষ্যতে তার আন্দোলনের ধারাবাহিক পরিকল্পনা যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে, কোন নৈতিকতার অব
স্থান থেকে নয়। তার নৈতিকতা কোন দিন ছিল না। তার দরকার অর্থ এবং সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠার। মাত্র নাকি ৬২ ডলার দিয়ে শুরু করা এ প্রতিষ্ঠান আজ কত কোটি ডলারের তহবিল গড়েছে? সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোসহ এ ব্যবসার নীট মূলধন কত? তা রক্ষার জন্য তিনি পাহাড়-নদী-সাগর সব একাকার করে ফেলতেও প্রস'ত। দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি সময় ক্ষেপণ করতে চান। অবশ্য মূল নির্ভর তার বিদেশের উপর। তিনি যে বিদেশী লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে ও সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে চান সেটা তার কর্মকাণ্ড থেকে ধারণা করা যায়। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কেও যে তিনি তোয়াক্কা করেন না সেটাও স্পষ্ট।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ