লিখেছেনঃ নায়ার খান, আপডেটঃ November 29, 2011, 6:17 AM, Hits: 1572
জামাত-এ-ইসলামী ও পাকিস্তানের ছায়া সরকার এমন এক কারিশ্মাপূর্ণ ব্যক্তি খুঁজছিলেন, যার মাঝে রয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ছাপ কিন্তু ইসলামপন্থীর মন-মানসিকতা। এবং ক্রিকেট মহানায়ক এবং আন্তর্জাতিক মানের যৌনতার প্রতীক ও ক্যাসানোভা ইমরান খান সে চাহিদা পূরণ করেছেন।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জামাত-এ-ইসলামী প্রথম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের সংক্ষিপ্ত কিন্তু ঘটনাপূর্ণ শাসনামলে, যখন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়নের ভার দেওয়া হয়েছিল বার্তা ও জাতীয় কর্মকাণ্ড বিষয়ক মন্ত্রী মেজর জেনারেল শের আলী খানকে। ইয়াহিয়া খান জিন্নাহ থেকে আইয়ুব খান প্রমুখ পূর্বসূরীদের থেকে খুব একটা ভিন্ন ছিলেন না – যারা তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামী আচার-প্রথার সামান্যই চর্চা করতেন কিন্তু রাজনৈতিক ইসলামকে জাতীয় পরিচয় ও রাষ্ট্র গঠনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতেন। তারা রাজনৈতিক ইসলামকে বশে রাখতে চাইতেন, যাতে তা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে, কিন্তু সেটাকে ব্যবহার করতেন ভারতের বিরুদ্ধে এবং অভ্যন্তরীণভাবে বামবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধেও কেননা সেসব আন্দোলন রাষ্ট্রের ইসলামী পরিচয়ের বিরুদ্ধে কাজ করছিল। শের আলী খানের কর্মপ্রকল্পে “পাকিস্তানী আদর্শ ও ইসলামের গৌরব” সামরিক নেতৃত্বের মুখের বুলি হয়ে উঠে, যা আর্মিকে “পাকিস্তানী আদর্শের” রক্ষাকর্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করে তোলে।
পূর্ববর্তী আইয়ুব খান বিরোধী গণ-আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে শের আলী খান ইয়াহিয়াকে বুঝান যে, জাতীয় স্বার্থে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত রক্ষাকর্তারূপে আর্মিকে এক কল্পলোকীয় আমেজ বজায় রাখতে হবে, যার মাধ্যমে সে পিছন থেকে জাতীয় রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে, যাতে আর্মিকে জনগণের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হতে না হয়। এবং সে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলশ্রুতিতে এক দুর্বল রাজনৈতিক সরকার গঠনের দরকার পড়ে, যা কেবলই সামরিক নেতৃত্বের পুতুল হিসাবে কাজ করবে।
শের আলী খানের পরিকল্পনা ছিলঃ নির্বাচনের ফলাফলে কারচুপি করা হবে ভোটের সময়ে নয়, বরং ভোটের আগে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষত জামাত-এ-ইসলামীকে, রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক ও প্রচারণা সহায়তা দিয়ে। ফলে মুসলিম লীগের আইয়ুব খান অংশকে প্রদত্ত আর্থিক অনুদানের বড় অংশ হস্তগত করে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার তা জামাতকে প্রদান করে। তার উপর গোয়েন্দা সংস্থা ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনকে সহায়তা দানের নিমিত্তে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে (দেখুন Hasan Zaheer, ‘The Separation of East Pakistan’, Oxford University Press, p. 124-25). জামাত-এ-ইসলামীর ভাণ্ডে সৌদি সরকার এবং সৌদি সাহায্য-পুষ্ট রাবিতা আল-আলম আল-ইসলামী সংস্থা থেকেও অর্থ ঢালা হয়।
১৯৭০ সালের এপিল-মে মাসে সাংবাদিকদের বিক্ষোভের পর শের আলী খান রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি মালিকানার বার্তা-সংস্থা থেকে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী সাংবাদিকদেরকে অপসারণ করে জামাতের কর্মীদের নিয়োগ করেন – যার ফলে প্রচার মাধ্যমে ইসলামী সুর জোরদার হয়। রাষ্ট্রীয় প্রচারণাযন্ত্রের সহায়তায় জামাত এ প্রচারণা জোরদার করে তোলে যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমানের মত নাস্তিক্যপন্থী সমাজবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা পাকিস্তানী আদর্শের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
এ প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের ছায়া সরকার এক ঢিলে দুই পাখী মারার চেষ্টা করছিলঃ ১) গণভোটকে বিভাজণের মাধ্যমে এক শক্তিশালী জনপ্রিয় সরকারের আবির্ভাব ব্যাহত করা, যার ফলে আর্মি সব সময় সংঘর্ষপূর্ণ রাজনীতিতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারবে, ২) ধর্মনিরপেক্ষতা-বিমুখী জাতীয় আদর্শ বজায় রাখতে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ইসলামী দলগুলোর প্রভাব বলবৎ রাখা (বিস্তারিত জানতে দেখুন Ayesha Jalal, State of Martial Rule, Cambridge University Press, 1990)।
কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থার সব ধারণা বা ভবিষ্যৎ বাণীর বিপরীতে নির্বাচনের ফলাফল সকলকে বিস্মিত করে দেয়। কড়া ধর্মনিরপেক্ষবাদী আওয়ামী লীগ ও মধ্যপন্থী পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক বিজয় লাভ করে। জামাত-এ-ইসলামী সব মিলিয়ে মোট ৪৪০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৭টি আসন লাভ করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কম পছন্দের ইসলামী দল ‘জামিয়াত উলেমা ইসলাম’ কিছুটা ভাল করেছিল বামপন্থীদের সাথে জোট করার কারণে।
নির্বাচনের প্রধান উদ্যোক্তা জেনারেল শের আলী খান ভোটের ফলাফলে খুবই আশাহত হন এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারকরা দেখতে ব্যর্থ হয় যে, পাকিস্তানের জনগণকে আকৃষ্ট করতে জামাতের দাড়িওয়ালা, চশ্মাধারী ও আবেদনহীন পুরানা নেতৃত্ব উচ্ছ্বাস-সৃষ্টিকারী ভুট্টো ও অগ্নিকণ্ঠ মুজিবের মত সম্মোহনকারী ব্যক্তিত্বের জন্য কোন প্রতিপক্ষই নয়।
ভুট্টোর শাসনকালে জামাত রাষ্ট্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করে কিন্তু প্রতিরক্ষাযন্ত্রের সাথে সহযোগ বজায় রাখে। ভুট্টোও পূর্ববর্তী পাকিস্তানী শাসকদের মতই একজন ইসলামবাদী ছিলেন। রাজনৈতিক ইসলামকে ইসলামবাদ (Islamism) নাম দেওয়া হয়েছে, যার সমর্থকদেরকে অবশ্যই ইসলাম-চর্চাকারী মুসলিম হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভুট্টোর সংযুক্ত ইসলামী বিশ্ব ও ‘ইসলামী বম্ব’ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা এবং ১৯৭৩ সালের সংবিধানে ধর্মকে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে সংযুক্তকরণ নিঃসন্দেহে প্রতিপন্ন করে যে, ভুট্টো পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামবাদীদের একজন ছিলেন। তবে তিনি মুল্লাহ ও সামরিকযন্ত্রকে আন্তর্জাতিক কৌশল ও গুপ্ত পরিকল্পনায় ব্যবহার করলেও দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে তাদের কাউকেই কোন ভূমিকা দিতে চান নি। এর ফলে প্রতিরক্ষাযন্ত্র ও পিপিপি-র মাঝে দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হয়, এবং জামাত প্রতিরক্ষাযন্ত্রের সান্নিধ্যে এসে পড়ে।
জামাত এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল পাকিস্তানের ছায়া সরকারের মধ্য এশিয়া পরিকল্পনায় – যা আফগানিস্তান থেকে শুরু করে সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্য এশীয় মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ও এমনকি পূর্ব তুর্কিস্তান (চীনের শিনজিয়াং) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্ধনশীল পাক-চীন সুসম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে শিনজিয়াং কম গুরুত্বপূর্ণ হয়। আফগানিস্তান ছিল তালিকার শীর্ষে। ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট দাউদ খানের বামপন্থী সরকার কর্তৃক ‘জামাতে-এ-ইসলামী আফগানিস্তান’ বিরোধী অভিযানের পর দলটির নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়, যেখানে তারা প্রথমত পাকিস্তানী জামাত কর্তৃক গৃহীত হয়। অল্প সময় পরেই প্রতিরক্ষাযন্ত্র ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক সরকার উভয়ই তাদেরকে স্বাগত জানায় এবং আফগানিস্তানে তাদের ইসলামী বিদ্রোহমূলক কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
জামাতকে গণমুখী দল করে তুলতে কাজীর প্রচেষ্টা
জেনারেল জিয়াউল হকের বিদ্রোহের (কু) পর (জুলাই ১৯৭৭) জামাত পিছন দরজা দিয়ে ক্ষমতার দ্বার-গোড়ায় চলে আসে জিয়ার চয়নকৃত মন্ত্রী পরিষদে জোরদার প্রতিনিধিত্ব অর্জনের ফলে। জিয়ার কুখ্যাত ডিসেম্বর ১৯৮৪-র রেফারেন্ডামে জামাত “হ্যাঁ” ভোটের পক্ষে জোর প্রচারণা চালায়। কিন্তু ফেব্রুয়ারী ১৯৮৫-র অরাজনৈতিক নির্বাচনে ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিয়ে জামাত কর্মীরা আবারও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সাথে প্রতিযোগিতায় ধুলো হজম করতে বাধ্য হয়।
তবে জিয়ার শাসনকাল জামাতকে এক দুর্বল ও বিনীত মৌলবাদের দল থেকে একটা সহিংস, আগ্রাসী ও বিরুদ্ধবাদী দলে পরিণত করে, যারা সদা প্রস্তুত ছিল সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য। এবং পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে যুগ্ম প্রকল্পে তারা সত্যি সত্যি কমিউনিস্ট-বিরোধী আফগান জিহাদে অংশ নেয় (১৯৭৮-৮৮)। তবে জামাতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ‘জামিয়াত-এ-তালাবা’র মাঝে সর্বদাই এরূপ ঝোঁক ছিল। এবং সে ঝোঁকের পূর্ণ প্রতিফলন আমরা দেখি অন্যান্য ঘটনার পাশাপাশি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আর্মির পূর্ব-পাকিস্তানে তথা বাংলাদেশে অভিযানে। এরপর থেকে জামাত পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাযন্ত্রের আরও সান্নিধ্যে চলে আসে।
মওদুদি ও মিয়া তুফায়েল মুহাম্মদের অধীনে জামাত সদস্য সংগ্রহে কঠোর নিয়মাবলী প্রয়োগ করে। তখন মৌলিকত্ব ও অনমনীয় নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তার পিছনে ছোটেনি জামাত। তবে কাজী হুসেইন আহমদ ১৯৮৭ সালের জামাতের আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর দলের রীতিনীতি বদলাতে শুরু করে। কাজী চান জনগণের মাঝে জামাতের সীমিত আবেদন দূর করতে এবং জনগণের জামাতে ঢুকার কঠোর নিয়মাবলী শিথিল করতে। তিনি চান জনগণের নেতা হতে। কাজী নিজেকে ও জামাতকে জনপ্রিয় করে তুলতে কুশ্রী প্রচারণা ও সস্তা উপায় অবলম্বন করতে দ্বিধা করেন নি, যা তার পূর্বসূরী নেতৃত্ব কখনোই করে নি। এ সময়ে জামাতের বৃদ্ধ নেতৃত্ব দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে মূল দলের ক্ষমতা হস্তান্তর করছিল। কাজী ও তার প্রচারণা দল দৃষ্টি-আকর্ষক স্লোগান ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা সমেত প্রচারণা কর্মকাণ্ড চালায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে দেশের প্রতিটি দেয়াল লেখা হয়েছিলঃ “হে অত্যাচারীরা! কাজি আসছেন।” ১৯৯০ সালের নির্বাচনের জামাত ঐক্যজোটের প্রতীক ছিল “সাইকেল”। নির্বাচনের প্রচারণাকালে বিভিন্ন শহরে কাজী নিজে অগ্রভাগে সাইকেল চালিয়ে সভা-সম্মেলনে নেতৃত্ব দেন। তবে সাইকেলে চড়া সালোয়ার ও জিন্নাহ টুপি পরিহিত এক মৌলবী, যার এক বোঝা দাড়ি বাতাসে ভাসছিল – সে প্রতিচ্ছবি জনগণের কাছে আদৌ আকর্ষক ছিল না। ১৯৯৭ সালে কাজী দেশব্যাপী অভিযান চালান পার্টির সদস্যসংখ্যা বাড়াতে, যা এখন প্রায় সবার জন্যই উন্মুক্ত ছিল।
কিন্তু কাজীর সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জামাত তার অংশগ্রহণকৃত কোন নির্বাচনেই উল্লেখযোগ্য সফলতা পায়নি, কেবলমাত্র ২০০২ সালের নির্বাচন ছাড়া – যে নির্বাচনে জেনারেল মুশাররফ দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলকে (পিপিপি ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ) নির্বাচনের বাইরে থাকতে বাধ্য করেন।
তবে প্রচার মাধ্যমে শক্তিশালী উপস্থিতি, রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা এবং প্রতিরক্ষাযন্ত্র ও সন্ত্রাসবাদী দলগুলোর সাথে সুসম্পর্ক থাকায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জামাতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, যদিও ভোট-ব্যাংকের বিচারে জামাত একটা নগণ্য রাজনৈতিক শক্তি। সম্ভবত তার প্রধান কারণ হচ্ছে জামাত “দিওবান্দি” ইসলামের অনুসারী, অথচ পাকিস্তানী জনগণের সিংহভাগ “দিওবান্দি” ইসলামের অনুসারী নয়। আরেক কারণ হতে পারে যে, পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ যদিও মন-মানসিকতায় সংকীর্ণমনা ও রক্ষণশীল, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তারা অপেক্ষাকৃত উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ। তারা একদিকে কাফেরদের ধ্বংস চায়, অন্যদিকে ভারতীয় ছবি দেখা থেকে বিরত থাকতে পারে না। তারা মনে-প্রাণে আমেরিকাকে ঘৃণা করে, পাশাপাশি আমেরিকার মত জীবনযাত্রাও কামনা করে।
জামাতের রদবদল
পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র ও জামাত গণ-আবেদন সৃষ্টি করতে সক্ষম এক নমনীয় মুখোশের রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল অনেক দিন ধরে। ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে জামাতের “পাশবন” যুবদলটির সৃষ্টি এরূপ প্রত্যাশা ধ্বনিত করে। সহিংস কর্মকাণ্ডের অভিযোগে নওয়াজ শরীফ সরকার দলটি নিষিদ্ধ করলে তার নাম পরিবর্তন করে “শবাব-এ-মিল্লি” (যুবক সংঘ) রাখা হয়। যদিও এ দলগুলোকে স্বাধীন সংগঠন বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়, তবে দলগুলো যে কেবলই জামাতের অংগ-সংগঠন ছিল সেটা সুস্পষ্ট ছিল। জনসমক্ষে এ দলগুলোকে ইসলামবাদী না দেখিয়ে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। গণ-আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পাশবন সম্মেলনে বাদ্যযন্ত্র সমেত গান বাজানো হতো, যা জামাতের চিরাচরিত সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্ব ক্রিকেট কাপ বিজয়ের পর পাশবন জুনায়েদ জামশেদের পেপসি-পাকিস্তান গান প্রদর্শনীর সাথে দেশব্যাপী সে বিজয় উদযাপন করে। সকল সম্ভাব্য উপায়ে পাশবনের প্রচারণা চালানো হয়। কিন্তু সাধারণ জনগণকে আকর্ষণ করার মতো কোন নেতা ছিল না পাশবনের।
এমতাবস্থায় জামাত ও পাকিস্তানের ছায়া সরকার জিন্নাহ বা ভুট্টোর মত কারিশ্মা সমেত এক নেতা খুঁজছিল – যার মাঝে রয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আভা ও ইসলামপন্থী মনোবৃত্তি। হাফিজুল্লাহ নিয়াজি নামের জামাত-এ-ইসলামীর এক উচ্চ-স্থানীয় সদস্য সে ব্যক্তিটির খোঁজে সহায়ক হন, ঘটনাক্রমে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের ক্রিকেট মহানায়ক এবং আন্তর্জাতিক মানের যৌনতার প্রতীক ও ক্যাসানোভা ইমরান খানের দুলাভাই।
জামাত কর্তৃক ইমরান খানের প্রাথমিক তত্ত্বাবধান
দুলা ভাই হাফিজুল্লাহর জন্য ইমরান খানের কাছে মওদুদির ইসলামী আদর্শ প্রচার করা সহজ ছিল, যখন ইমরান ইহজগতের সবকিছু অবারিত উপভোগের পর পরজগতে অনুরূপ উপভোগ নিশ্চিত করার রাস্তা খুঁজছিলেন। ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে তার অধিনায়কত্বাধীন পাকিস্তান ক্রিকেট দল লাহোরে সেমি-ফাইনালে হেরে গেলে ইমরান প্রথম বারের মত ক্রিকেট থেকে অবসর নেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের ডাকে মত পাল্টান। তার অধিনায়কত্বে পাকিস্তান ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ জয় করলে ইমরান জাতীয় নায়কের মর্যাদায় উন্নীত হন, যার পর তিনি চূড়ান্তভাবে ক্রিকেট ত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইমরান খান ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো লেখা প্রকাশ করেন, যাতে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতি ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করেন এবং পাকিস্তানীদেরকে নিজস্ব ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী পরিচয়কে শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন – যা তার উপর জামাতী মস্তক-ধোলাইয়ের গভীর প্রভাব প্রতিফলিত করে। দেশী সংস্কৃতিতে ফিরে আসার ঠিক প্রাথমিক পর্যায়ে ইমরান খান জামাতী মগজ-ধোলাইয়ের কবলে পড়েছিলেন।
ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরও জনসমক্ষে নিজ উপস্থিতি অব্যাহত রাখতে ইমরান একটি মুনাফাহীন ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হন। সেজন্যে নওয়াজ শরীফের পাঞ্জাব সরকার ভূমি বরাদ্দ করার পর অর্থ সংগ্রহের অভিযানে পাশবন তাকে সবরকম সহায়তা দেয়। এখানে জামাতের স্বভাব-চরিত্রের আরেক ভণ্ডামি ফুটে উঠে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানী শিল্পীরা ভারতে তাদের শিল্প-কর্ম উপস্থাপন করতে থাকে। বিনিময়ে পাকিস্তানের কিছু শিল্প-প্রদর্শনী সংগঠকরা ভারতীয় শিল্পীদেরকেও পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু পাশবনের চরম প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে সংগঠকরা সেসব প্রদর্শনী বাতিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইমরান খান তার হাসপাতালের জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য ১৯৯৫ সালে ভারতীয় অভিনেতা রেখা, বিনোদ খান্না, সনু উয়ালিয়া ও কবির বেদী প্রমুখকে লাহোরে তাদের অভিনয় প্রদর্শনীর জন্য আমন্ত্রণ জানালে পাশবল একদম বিরোধিতা করেনি। একইভাবে জামাত তার প্রতিপক্ষ ব্যক্তিত্বের মাঝে নৈতিক ক্রটি খুঁজে খুঁজে তাদের চরিত্র-হননে সদা ব্যস্ত থেকেছে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৭০-র দশকে জামাত ভুট্টোর “অনৈসলামিক জীবনযাত্রাকে” লক্ষ্য করে চরিত্র-হনন কর্মকাণ্ড চালায়। জামাতের গণ-সম্মেলন ও স্লোগানে ভুট্টোকে “মদ্যপ” ও “ব্যভিচারী” বলে প্রচারণা চালায়। কিন্তু ইমরান খানের আরও বেশি রঙ্গীন ও অনৈসলামিক জীবনাচার এবং সবার জানা তার বিবাহ-বহির্ভূত সন্তান (love-child) কখনোই জামাতের মাথা-ব্যাথার কারণ হয় নি। ভুট্টোর ক্ষেত্রে অপপ্রচারে জামাত এতই নীচে নামে যে, তারা দাবী করে ভুট্টোর মা ছিলেন একজন হিন্দু। অথচ ১৯৯৪ সালে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও ব্রিটিশ আভিজাত্যের নিন্দাকারী ইমরান খান নিজেই যখন উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ ইহুদী পরিবারের এক মেয়েকে বিয়ে করলো, তা জামাতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো না।
জামাতের তত্ত্বাবধানে ইমরানের “পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ” দল গঠন
ইমরান খানের তেহরিক-এ-ইনসাফ দলটি নিঃসন্দেহে জামাত, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাযন্ত্র ও বিশেষত তাদের জিহাদী অংশের সংমিশ্রণ মাত্র। জামাতের সাথে ইমরানের সংযোগ খুবই স্পষ্ট। ইমরান খানের পার্টিকে ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে সহায়তা করতে কাজী নিযুক্ত করেন জামাতের পারদর্শী প্রচারণা অভিযান পরিচালক মনসুর সিদ্দিকি (কাজীর জন্য “হে অত্যাচারী” স্লোগানের নির্মাতা), শামস রাজা খান ও মোহাম্মদ আলী দুরানী এবং সেই সাথে পাশবনের প্রতিষ্ঠাতা শাবির সিয়াল ও মাহমুদ-উল-রশীদকে (যারা জামাতের টিকেটে ১৯৮৮ সালে পাঞ্জাব অ্যাসেমব্লির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল)। জামাত নিজে নির্বাচন সে পরিহার করে। শাবির সিয়াল পরবর্তী কালে তেহরিক-এ-ইনসাফের লাহোর পর্বের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন এবং মাহমুদ-উল-রশীদ এখন সে পদটিতে নিযুক্ত আছেন।
তেহরিক-এ-ইনসাফের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দলের যুব সংগঠনের পরিচালক ইজাজ চৌধুরী হলেন ইমরান খানের সর্বাধিক প্রিয় পরামর্শদাতা – যিনি পূর্বে ছিলেন একজন জামাত নেতা এবং মওদুদির উত্তরসূরী জামাত-নেতা মিয়া তুফায়েল মুহাম্মদের জামাই। তেহরিক-এ-ইনসাফের আরেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল হাফিজ খানও ছিলেন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাত ছাত্র-সংগঠন ইসলাম-এ-জামাত তালাবার প্রধান।
গোড়াপত্তন থেকে আজ পর্যন্ত তেহরিক-এ-ইনসাফের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে পূর্ববর্তী জামাত সদস্য বা জামাত-সহমর্মীরা ব্যাপক প্রাধান্য পেয়েছে। যখন এক পার্টি আরেক পার্টির সদস্য ছিনিয়ে নেয় বা আকর্ষণ করে, তখন সাধারণত পার্টি দু’টোর মাঝে তিক্ত বিরোধিতা ও শত্রুতা শুরু হয়। কিন্তু জামাতের নেতারা একের পর এক তেহরিক-এ-ইনসাফে যোগ দেওয়ার পরও জামাত ও তেহরিক-এ-ইনসাফ হাতে হাত রেখে এগুচ্ছে – যা জামাতের তত্ত্বাবধানে তেহরিক-এ-ইনসাফের পরিপুষ্টির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। ২০০৭ সালে জামাতের ছাত্ররা পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে ইমরান খানকে লাঞ্ছিত করলে তিনি কেবল তাদের ত্বরিত ক্ষমা করেই দেননি, জামাতের ছাত্র-সংগঠনের নেতা এহসান নিয়াজিকে তিনি তেহরিক-এ-ইনসাফের ছাত্র-সংগঠনের প্রধান নিযুক্তও করেন। এর ফলে গুণ্ডাগিরির কারণে ইসলাম-এ-জামাত তালাবার যেসব সদস্য সেখান থেকে সরে এসে তেহরিক-এ-ইনসাফের ছাত্র-সংগঠনে এসে যোগ দিচ্ছে, তারা আবারও তাদের পূর্বতন নেতার সান্নিধ্য পাচ্ছে। আজ যখন নির্বাচন এগিয়ে আসছে, তখন তেহরিক-এ-ইনসাফের বর্ধনশীল জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে সকল রাজনৈতিক দল থেকে সুবিধাবাদীদেরকে আকর্ষণ করবে। তবে তেহরিক-এ-ইনসাফের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে খুব সম্ভব মনে-প্রাণে জামাতী আদর্শের নেতাদের আধিপত্য বজায় থাকবে।
তেহরিক-এ-ইনসাফের জিহাদী সংযোগ
১৯৯৫-৯৬ সালে তেহরিক-এ-ইনসাফের গোড়াপত্তনের ঠিক পূর্বে ইমরান খান জেনারেল হামিদ গুলের সাথে অনেকবার মিটিং করেন। সে সময়ের খবরের পত্রিকা গবেষণা করলে বুঝা যায় যে, ইমরান খান ও হামিদ গুল যুগ্মভাবে এক রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন করতে যাচ্ছেন – যা পাকিস্তানের ভঙ্গুর ও বিভাজিত রাজনীতিতে এক বিকল্প অধ্যায়ের সূচনা করবে। কিন্তু সে যুগ্ম প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি, সম্ভবত পাছে সেটা জিহাদী দলগুলোর সাথে সম্পৃক্ত পাকিস্তানী প্রতিরক্ষাযন্ত্রের পূর্বতন সদস্যদের সাথে ইমরানের সংযোগকে উন্মোচিত করে ফেলে।
তথাপি প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের বার্তা-সচিব লেফটেনেন্ট জেনারেল মুজিবুল রহমান – যার রয়েছে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষাযন্ত্র ও হামিদ গুলের সাথে সুসম্পর্ক – তিনি ছিলেন তেহরিক-এ-ইনসাফের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং পরে তিনি দলটির সাধারণ সচিব নিযুক্ত হন। বর্তমানে তেহরিক-এ-ইনসাফের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একজন হচ্ছেন আহমদ আউয়াইস, যিনি হামিদ গুলের ভাতিজা।
১৯৯৭ সালে ইমরান খান এক সপ্তাহের জন্য চেচনিয়া ভ্রমণ করেন, যেখানে তিনি মুজাহিদী বিদ্রোহী নেতা আস্লান মাস্কাদবের অতিথি ছিলেন এবং পরবর্তী কালে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মাস্কাদব সেখানে পরিপূর্ণ শরীয়তী আইন প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তালেবান প্রশ্নে ইমরান খানের তেহরিক-এ-ইনসাফের নমনীয় কিংবা সহমর্মী অবস্থান সর্বজনবিদিত। ইমরান খান তালেবানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক অভিযানের বিরোধী এবং তালেবানকে “দখলদার শক্তি-বিরোধী পাশতুন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন” হিসাবে রঙ দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ইমরান খান তালেবানের প্রয়োগকৃত বর্বর আইনী প্রথাকেও সমর্থন দিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধ (war on terror), আফিয়া সিদ্দিকি ও রেইমন্ড ডেভিস প্রশ্নে ইমরান খান পাকিস্তানের ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে একই সুরে সুর মিলিয়েছেন।
ইমরান খানের ডান হাত ইজাজ চৌধুরী ‘সিপাহ-এ-সাহাবা পাকিস্তান’-এর মত সন্ত্রাসী ও সাম্প্রদায়িক ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে সংযুক্ত। সম্প্রতি ১৫ই নভেম্বরে সিপাহ-এ-সাহাবা কর্তৃক লাহোর প্রেস ক্লাবে আয়োজিত উসমান-এ-গনি শহীদ দিবস আলোচনা-সভায় তিনি এক বক্তা হিসাবে যোগ দেন। তিনি সক্রিয়ভাবে আরেক উগ্রপন্থী সংস্থা ‘আলমি মজলিশ-এ-তাহাফুজ-এ-খতমে নবুয়ত’-এর সম্মেলনে যোগ দিয়ে যাচ্ছেন। খতমে নবুয়ত সংখ্যালঘু আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে ও সহিংসতার উস্কানি দিতে খ্যাত। পাঞ্জাব গভর্নর সালমান তাশিরের হত্যাকারী মুমতাজ কাদরীর সমর্থনে খতমে নবুয়ত আয়োজিত এক সম্মেলনে যোগ দিয়ে ইজাজ চৌধুরী বলেনঃ “তিনি ইমরাম খানের পক্ষ হয়ে বলছেন যে, পাকিস্তান সংবিধানের ধর্মনাশ বিরোধী (blasphemy) আইন ২৯৫-C একটা চূড়ান্ত আইন এবং সেটা একটা স্বর্গীয় বিধান, যার প্রতি কেউ অঙ্গুলী তুলতে পারবে না।” মেহরান সামরিক ঘাটিতে আক্রমণে আমেরিকার CIA ও ভারতের RAW-এর সম্পৃক্ততার দাবীর ক্ষেত্রে তেহরিক-এ-ইনসাফের মতামত জামাত ও অন্য উগ্র ইসলামপন্থী দলগুলোর মতামতের সাথে একমত।
২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট মুশাররফের ঘোষণাকৃত জরুরী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করায় ইমরান খানকে গ্রেফতার করে দেরা ইসমাইল খান জেলে আটক রাখা হলে তেহরিক-এ-তালেবান পাকিস্তান সন্ত্রাসী দলের নেতা বাইতুল্লাহ মাসুদ পাকিস্তান সরকারকে হুমকি দেন যে, ইমরান খানকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া না হলে জেলটিকে উড়িয়ে দেওয়া হবে। সে হুমকি পাকিস্তানের সকল সংবাদপত্রে প্রচারণা পায় এবং ইমরান খানকে ঠিকই ২৪ ঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২ অক্টোবর ২০০৮-এ বাইতুল্লাহ মাসুদ দক্ষিণ উয়াজিরিস্তানে এক জনসভায় উপস্থিত হলে তেহরিক-এ-ইনসাফের স্থানীয় প্রেসিডেন্ট তুফান বার্কি তাকে ফুলের মালা ও পাগড়ী পরিয়ে অভিবাদন জানান।
ইমরানের তেহরিক-এ-ইনসাফের মুখপাত্র ও পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব শিরীন মাযারী (‘মহিলা তালেবান’ হিসাবে খ্যাত) একজন উচ্ছ্বসিত আমেরিকা ও ভারত বিরোধী শিক্ষাবিদ। প্রচার-মাধ্যমে ষঢ়যন্ত্রমূলক অনুসিদ্ধান্ত ছড়াতে তিনি হামিদ গুল ও জায়েদ হামিদের সমকক্ষ। জায়েদ হামিদের আত্মার আত্মীয় আহমেদ কোরেশীর অয়েবসাইটে নিয়মিত ষঢ়যন্ত্রমূলক কলাম লিখে শিরীন মাযারী তালেবানের সকল বর্বর ও নৃশংস কর্মকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি আফগানিস্তানে রাব্বানীর হত্যার দায়ভার তারা CIA ও RAW-এর উপর চাপিয়ে যাচ্ছেন। কোরেশী মিথ্যা উইকিলিকস বার্তা প্রকাশ করে ধরা পড়েও কুখ্যাত হয়েছেন। কোরেশীর অয়েবসাইটে শিরীন মাযারী প্রচার করছেন যে মেহরান সামরিক ছাউনির উপর আক্রমণটি ঘটিয়েছে CIA কিংবা RAW। অথচ এ ষঢ়যন্ত্রমূলক অনুসিদ্ধান্তের বিপরীতে সাংবাদিক সেলিম শাহজাদ দেখান যে ছাউনিটিতে আক্রমণে আল-কায়েদা ও পাকিস্তান নৌবাহিনীতে আল-কায়েদার এক গুপ্ত-আখড়া সংযুক্ত ছিল এবং এ সত্যতা ফাঁস করে দেওয়ার জন্য তাকে প্রাণ হারাতে হলো।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাযন্ত্রের সাথে শিরীন মাযারীর ঘনিষ্ট যোগাযোগ আচ্ছে বলে জানা যায়। তিনি জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজে নিয়মিত পড়ান, যেখানে তার পড়ানোর বিষয়বস্তু ইসলামী আদর্শ। শিক্ষা-বিভাগে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে ইমরান যে বিপ্লবী পরিবর্তন আনার কথা বলছেন, তা নিঃসন্দেহে মাযারীর মত শিক্ষাবিদদের হাতে রচিত হবে। এবং তা ঘটলে পাকিস্তানের স্কুলগুলো মাদ্রাসার চেয়েও বেশী তালেবান সৃষ্ট করবে।
তেহরিক-এ-ইনসাফ গণ-কল্যাণ বয়ে আনবে কি?
অতিশয় আলোচিত সাম্প্রতিক লাহোর সম্মেলনে ইমরান খান নতুন কিছুই বলেননি; তার একমাত্র বক্তব্য ছিল দেশের সমস্ত সমস্যার মূলে রয়েছে রাজনীতিকদের দুর্নীতি, যা তার পুরানো বক্তব্য। এটা হচ্ছে সেই উস্কানিমূলক কৌশল, যা পাকিস্তানের ছায়া সরকার প্রচার করে যাচ্ছে ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে, এবং সে অজুহাতে বেশ কয়েকটি গণ-ভোটে নির্বাচিত সরকারকে মাঝপথে উৎখাত করা হয়েছে। ইমরান খান কেবলই একজন সাধারণ পাকিস্তানীর ধারণার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছেন যে, দুর্নীতিই তার সকল সমস্যার একমাত্র কারণ। যদিও দুর্নীতি একটা সমস্যা, তবে তা পাকিস্তানের সামগ্রিক সমস্যার আংশিক কারণ মাত্র। অথচ উদ্দেশ্যবাদী মহল দুর্নীতিকে সর্বদা অতিরঞ্জিত করেছে দেশের প্রকৃত সমস্যাকে ঢাকা দেওয়ার বা ছোট করে দেখানোর নিমিত্তে এবং পাকিস্তানের মৌলিক সমস্যা হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সামরিক পরিকল্পনা, যা দেশের সীমিত সম্পদের সিংহভাগ খেয়ে ফেলছে। উগ্র মুল্লাতন্ত্রও দেশের অগ্রগতিতে আরেক বড় বাধা। পাকিস্তানের এসব মৌলিক সমস্যাগুলোরই প্রতিনিধিত্ব করছেন ইমরান খান। বিপর্যয়গ্রস্থ এ দেশটি আবারও তার সমস্যার সমাধান চাচ্ছে তার মৌলিক সমস্যার উৎসের মাঝেই। ইমরান খানের হাতে যদি দেশের সমস্যার মহৌষধ থেকে থাকে, তাহলে জামাতের হাতে তা সর্বদাই ছিল। এবং তা যদি সত্য হয়, তাহলে পাকিস্তানবাসী জামাতকে দুদীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় নির্বাচিত না করে আহাম্মকের পরিচয় দিয়েছে।
পাকিস্তানী লেখক নায়ার খান ইতহাস, ধর্ম ও পারস্পারিক সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের উপর গবেষণায় উৎসাহী। লেখাটি ইংরেজীতে www.viewpointonline.net-এ প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে ইমেইলঃ nayyer.khan@gmail.com