Banner
জীবন দর্শন -- আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ December 30, 2011, 4:22 AM, Hits: 2381

 

(ডঃ আলমগীর হুসেন নিবন্ধটি ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে ঢাকায় ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় মূল নিবন্ধ হিসাবে পাঠ করেন। নিবন্ধটির উপর বিভিন্ন বক্তা আলোচনা-সমালোচনা করেন। সেগুলির সারাংশ ভবিষ্যতে প্রকাশের ইচ্ছা রেখে নিবন্ধটি ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশ করা হল। -- বঙ্গরাষ্ট্র, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১)

 

জীবন দর্শন কি?

 

জীবন দর্শন, যাকে ইংরেজীতে ‘Philosophy of Life’ কিংবা ‘Worldview’ বলা হয়ে থাকে, তা মূলত জীবন সম্পর্কে আমাদের সামগ্রিক ধারণা বা বোঝাপড়া (understanding)। অন্য কথায়, পৃথিবীতে মানব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা বা বোঝাপড়া এবং সে ভিত্তিতে জীবন-চালনায় আমাদের কর্মকাণ্ড কি হবে – তার সমষ্টিই জীবন দর্শন।

মানব জীবনের চারটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছেঃ (১) ব্যক্তিগত, (২) সামাজিক, (৩) রাজনৈতিক, ও (৪) অর্থনৈতিক। জীবনের এসব ক্ষেত্রগুলোকে আমরা কিভাবে দেখি এবং সে ভিত্তিতে আমরা কি নীতি ও কর্মকাণ্ড গ্রহণ করি – সেটাই হবে আমাদের জীবন দর্শন।

পৃথিবীতে মূলত ২ ধরনের জীবন দর্শন রয়েছেঃ (ক) ধর্মীয় (ইসলামি, খৃষ্টীয় ইত্যাদি) ও (খ) নির্ধর্মীয় (মার্ক্সবাদ/সমাজতন্ত্র, উদারবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি)

 

 

 

কেন জীবন দর্শন?

 

প্রথমত, জীবন দর্শন আমাদেরকে সহায়তা করে জীবন আসলে কি, জীবনের অর্থ কি, ইত্যাদি বুঝতে। দ্বিতীয়ত ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণঃ জীবন দর্শন পৃথিবীতে আমাদের জীবন চালনার রূপরেখা বা গতিবিধি তথা আমাদের “জীবন বিধান” কি হবে – সেটা নির্দেশিত করে। এবং পৃথিবীতে আমাদের একটা সুনির্দিষ্ট জীবন বিধানের প্রয়োজন হচ্ছে আমাদের সুখ-শান্তি (happiness) সর্বাধিক বৃদ্ধিকরণের লক্ষ্যে। সুখ-শান্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন জান-মালের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যক্তির আত্ম-মর্যাদা ও স্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিতকরণ।

 

 

জীবনের উদ্দেশ্য কি?

 

একটা সুসংহত জীবন দর্শন নির্ণয় করার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন হলো “জীবন কী” বা “জীবনের উদ্দেশ্য কী” – সেটা অনুধাবন করা বা অনুধাবনের চেষ্টা করা। জীবনের উদ্দেশ্য দুই ধরনের হতে পারেঃ ধর্মীয় ও নিঃধর্মীয়।

 

(ক) ধর্মীয় – একজন ধার্মিকের জন্য জীবনের উদ্দেশ্য কি সেটা বুঝা খুবই সহজ। ইহুদি, খৃষ্ট, ইসলাম ইত্যাদি একত্ববাদী ধর্মগুলোর মতে বিশ্ব ও তার মাঝেকার যাবতীয় সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর আজ থেকে প্রায় ৬,০০০ হাজার বছর আগে এবং তা সৃষ্টি করতে ঈশ্বরের ৭ দিন সময় লেগেছিল। আদম ও হাওয়া ছিল প্রথম মানুষ এবং বিশ্বের অন্যান্য যাবতীয় জীবিত প্রজাতিকে আলাদাভাবে সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছেন ঈশ্বর। মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র বুদ্ধিমান জীব এবং সেই সূত্রে ঈশ্বর একমাত্র মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন “আসমানী কিতাব” (তাওরাত, বাইবেল, কোরান ইত্যাদি), যাতে তারা একটা সুনির্দিষ্ট বিধান অনুসারে জীবন চালনা করতে পারে।

 

অন্য কথায়, ঈশ্বর তাঁর আসমানী কিতাবে যা বলেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন, তা অনুসরণ করাই ধার্মিকদের জীবনের উদ্দেশ্য। একজন মুসলমান নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, হজ্জ্বে যাবে ও কোরানের অন্যান্য নির্দেশাবলী পালন করবে আল্লাহর অনুগ্রহ বা সোয়াব কামানোর জন্য, যা পরজগতের অন্তহীন জীবনে তার সার্বিক কল্যান নিশ্চিত করবে। সেটা ভালমত করতে পারলেই তার জীবন অর্থবহ তথা অর্থপূর্ণ বা সার্থক হবে; সে নিজেকে ধন্য মনে করবে। একজন ধার্মিকের এর বাইরে আর কোন কিছু জানার বা বোঝার আবশ্যকতা নেই।

 

খ) নিঃধর্মীয় – যে ধার্মিক নয়, তার জীবনের উদ্দেশ্য কি হবে?


 

একজন নিঃধার্মিকের জীবনের উদ্দেশ্য কী – সেটা অনুধাবণ করা খুবই কঠিন। আদৌ সেটা নির্ণয় করা সম্ভব কিনা – সে সম্পর্কে আমি সন্দিহান। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা যাক এখানে।

 

আজ নিঃধর্মীয় জীবন বিধানে বিশ্বাসী তারাই, যারা প্রধানত বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। এবং বিজ্ঞান ইংগিত দেয় যে, পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি এক আকস্মিক ঘটনার ফসল মাত্র (result of an accident)। এবং সে accident-টি হলো আজ থেকে ১৪-১৬ বিলিয়ন বছর আগে ঘটিত বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের ঘটনা, যার ফলে খুবই ক্ষুদ্র একটি শক্তিপিণ্ড বিস্ফারিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করে। সে মুহুর্ত থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে আরও অসংখ্য বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। আমাদের সৌরজগতের সৃষ্টি হয় আজ থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। এবং শুরুতে পৃথিবী সহ সব নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ ছিল জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ড। পরবর্তিতে ক্রমান্বয়ে তাপ নিঃসরণ করে অনেক গ্রহ, উপগ্রহ (যেমন পৃথিবী, চন্দ্র ইত্যাদি) প্রথমে উত্তপ্ত তরল পিণ্ডে এবং আরো ঠাণ্ডা হয়ে পরিশেষে কঠিন উপরিভাগ সম্পন্ন পিণ্ডে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ আজও উত্তপ্ত ও তরল রয়ে গেছে, যা আজও মাঝে মাঝে লাভা হিসেবে বেরিয়ে আসে পৃথিবীর উপরিভাগে। বেশিরভাগ নক্ষত্র আজও জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ড রয়ে গেছে।

 

এক কথায়, বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ না ঘটলে জীবের বাসযোগ্য আমাদের এ পৃথিবীর আবির্ভাব হতো না। এবং পৃথিবীর উপরিভাগে এ বিশাল পরিবর্তন ঘটণকালে ব্যাপক রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে। সেসব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার অংশরূপে আরেক accident বা আকস্মিক ঘটনা ঘটে, যা জড় পদার্থ থেকে জীবনের সৃষ্টি করে। এবং পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয় প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। সে প্রাথমিক জীবনটি কোটি কোটি বছর ধরে বিন্দু বিন্দু পরিবর্তিত ও জটিলতর হওয়ার ফলশ্রুতিতে মানুষ সহ আজকের এ জীবজগতের আবির্ভাব। আধুনিক মানুষের মতো দেখতে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে প্রায় ২০০,০০০ বছর আগে। পৃথিবীতে আমাদের মত মানুষের বসবাস কম করে হলেও ১০০,০০০ বছর।

 

আর এটাই যদি পৃথিবীতে আমাদের আগমণের গতিধারা হয়, অর্থাৎ আমরা কেবলই একটা বা কিছু সংখ্যক আকস্মিক ঘটনার বা accident-এর ফসল হই, তাহলে আমাদের জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকতে পারে না। আকস্মিক ঘটনার আবার কোন অর্থ থাকে কি?

 

কিন্তু জীবনের যদি কোন উদ্দেশ্য বা অর্থই না থাকে, তাহলে সে জীবনযাপনের কোন মূল্য থাকে না; বাঁচার কোন অর্থ থাকে না। সামান্য কিছু মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পায় না বিধায় আত্মহত্যা করে। কিন্তু ব্যাপক সিংহভাগ মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে না – হোক সে ধার্মিক কিংবা নিঃধার্মিক।

 

তার মানে দাঁড়ায়ঃ জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও এক নিঃধার্মিক জীবনকে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে, অর্থহীন মনে করে না। ধার্মিক কিংবা নিঃধার্মিক – উভয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে প্রায় সমান অর্থপূর্ণ মনে করে। বিষয়টাকে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট ও যুক্তিবাদী পর্যালোচনার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা যাক।

 

পৃথিবীতে আমাদের মত মানুষের বসবাস প্রায় ১০০,০০০ বছর। অথচ ঈশ্বর মানুষের জীবনবিধান রূপে ব্যবহারের জন্য “আসমানী কিতাব” পাঠিয়েছেন মাত্র ৩,২০০ বছর আগে মুসা নবীর মাধ্যমে। তার মানে দাঁড়ায়ঃ কম করে হলেও ৯০,০০০ বছর ধরে আধুনিক মানুষের হাতে স্রষ্টা-প্রদত্ত কোন আসমানী কিতাব বা জীবনবিধান ছিল না। অন্য কথায়, জীবন চলার বা পৃথিবীতে বাঁচার যে একটা উদ্দেশ্য আছে বা থাকতে পারে – সেটা জানার বা বোঝার কোনই উপায় ছিল না মানুষের সে বিশাল সময় ধরে। তথাপি মানুষ জীবনের কঠিন যুদ্ধে, তথা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, সামিল হয়েছে – সৃষ্টি করেছে সমাজ, আইন-কানুন, রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য। সে আত্মহত্যা করে নি, নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে নি।

 

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সে সুধীর্ঘ সময়কালে মানুষের জীবনের কোন অর্থ ছিল না বা তা জানার কোন উপায় ছিল না মানুষের। তাহলে সুধীর্ঘ সময়ে জীবনের লড়াইয়ে মানুষ কেন সামিল হয়েছিল? কেন সৃষ্টি করেছিল এত্ত সব কিছু, যার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে আজকের এ আধুনিক মানব সভ্যতা?

 

একইভাবে ধর্ম বলে যে, মানুষ ব্যতিত অন্য প্রাণীর জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই; কাজেই তাদের জীবন চালনার জন্য কোন বিধানের প্রয়োজনও নেই। সে জন্যেই ঈশ্বর অন্য প্রাণীর জন্য জীবনবিধান বা আসমানী কিতাব পাঠান নি। অথচ সে সব প্রাণীও কিন্তু জীবন যুদ্ধে ঠিক মানুষের মতোই সামিল হয়, লড়াই করে পুরো জীবনটা ভালমত বা সুখে কাঁটিয়ে দেওয়ার জন্য।


 

তাহলে আমরা দেখছিঃ হোক সে (১) আজকের নিঃধার্মিক মানুষ, যে মনে করে জীবন একটা accident-এর ফসল, যার পূর্ব-পরিকল্পিত কোন উদ্দেশ্য নেই, বা (২) আসমানী কিতাব পূর্ববর্তি মানুষ, যাদের জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল না, বা (৩) আজকের আসমানী কিতাবধারী ধার্মিক মানুষ, কিংবা (৪) জীবজগতের অন্যান্য প্রাণী – তারা সবাই চায় বাঁচতে, সুখে শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে বাঁচতে; প্রত্যেকেই চায় পৃথিবীতে তাদের জীবন ধীর্ঘায়ু হোক। অন্য কথায়ঃ হোক সে ধার্মিক-নিঃধার্মিক মানুষ কিংবা নিম্নশ্রেণীর জীব – সবার মাঝেই পৃথিবীতে সর্বাধিক সময় বাঁচার স্পৃহা বিদ্যমান। মানুষ সহ সব প্রাণীর মাঝেই অভ্যন্তরীণভাবে রয়েছে জীবনের প্রতি ভালবাসা, পৃথিবীতে বাঁচার প্রতি ভালবাসা, পৃথিবীর বুকে সর্বাধিক সময় কাঁটানোর উদগ্র বাসনা। এবং তারই মাঝে আমাদেরকে, বিশেষত নিঃধার্মিকদেরকে, খুঁজতে হবে জীবনের উদ্দেশ্য, বাঁচার অর্থ। জীবনকে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে, ভাল লাগে – সেটাই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য (এর বাইরে কিছু জানার বা বুঝার উপায় নেই আমাদের)।

 

এবং এ সত্যতাটিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথঃ

মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাচিবারে চাই।

 

এ বৈচিত্রময় ধরনীতে, এ মানুষের মাঝে, সুধীর্ঘকাল বেঁচে থাকার স্পৃহা মানুষের অন্তর্নিহিত, প্রবৃত্তিজাত, বাসনা। এবং পৃথিবীতে আমরা বাঁচতে চাই নির্বিঘ্নে, সুখে-শান্তিতে, স্বচ্ছলতা-সমৃদ্ধিতে। এসব মৌলিক চাওয়াকে লক্ষ্য করেই আমাদেরকে চয়ন করতে হবে আমাদের জীবন দর্শন তথা জীবন বিধান।

 

 

জীবন দর্শনের ভিত্তি কী হবে?

 

সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শনের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স লিখেছেনঃ

 

“...communism, as fully developed naturalism, equals humanism, and as fully developed humanism equals naturalism।”

“কমিউনিজম সম্পূর্ণরূপে ‘প্রকৃতিবাদ’ হিসেবে উন্নীত হলে মানবতাবাদের সমতূল্য হবে, এবং সম্পূর্ণরূপে মানবতাবাদ হিসেবে উন্নীত হলে প্রকৃতিবাদের সমতূল্য হবে।”

 

২য় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস বলেছেনঃ

 

“The United States of America have exhibited, perhaps, the first example of governments erected on the simple principles of nature; and… [man] will consider this event as an era in their history.”

“যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বিশ্বের বুকে প্রথম ‘প্রাকৃতিক’ নীতির ভিতিতে সরকার গঠন করেছে এবং [মানুষ] সেটাকে যুগান্তরকারী হিসেবে দেখবে।”

 

মার্ক্স তার নিঃধর্মীয় সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শনের ভিত্তি সম্পর্কে এবং অ্যাডামস আমেরিকার নিঃধর্মীয় উদার-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে দু’জনেই “প্রকৃতিবাদ” তথা “প্রাকৃতিক নিয়মের” উপর জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ উনারা দু’জনেই বলতে চাচ্ছেনঃ একটা সুষ্ঠ জীবন বিধান বা ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করতে হলে তাকে প্রাকৃতিক নিয়ম নীতির সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ হতে, অর্থাৎ বাস্তবতা ভিত্তিক হতে হবে।

 

কাজেই একটা সুষ্ঠ ও সফল মানব জীবন দর্শন গঠন করতে হলে, সেটাকে মানুষের মৌলিক প্রকৃতি বা প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যতাপূর্ণ হতে হবে। নইলে সেটা মানুষের কল্যান বর্ধিতকরণে সহায়ক হবে না।

 

 

ইসলামি জীবন দর্শন

 

ইসলাম হলো স্বয়ং ঈশ্বর নির্দেশিত একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা (perfect way of life); কোরান হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর রচিত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান (complete code of life)। এ প্রসংগে আল্লাহ নিজেই কোরানে বলেছেনঃ “This day have I perfected your religion for you, completed My favour upon you, and have chosen for you Islam as your religion.” (আজ আমি তোমাদের জন্য ধর্মকে নিখুঁত করেছি; তোমাদের উপর আমার কৃপা পরিপূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে চয়ন করেছি।) (কোরান ৫:৩)

 

এবং মুসলিমদেরকে পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান কোরানের প্রত্যেকটি আয়াতকে মেনে চলতে হবে; একটিকেও বাদ দেওয়া যাবে না। আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন (৪:১৫০-৫১): “Those who deny Allah and His messengers, and (those who) wish to separate Allah from His messengers, saying: "We believe in some but reject others": And (those who) wish to take a course midway. They are in truth (equally) unbelievers; and we have prepared for unbelievers a humiliating punishment.” (যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে অস্বীকার করে; এবং যারা আল্লাহকে তাঁর রসুল থেকে পৃথক করে বলে, “আমরা কিছু অংশ গ্রহণ করি এবং কিছু প্রত্যাখ্যান করি”; এবং যারা একটা মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করে – তারা সবাই সম পরিমাণ অবিশ্বাসী এবং আমরা অবিশ্বাসীদের জন্য লজ্জাজনক শাস্তি প্রস্তুত করেছি।)

 

কোরান (২:৮৫) “Do you then believe in a part of the Book and disbelieve in the other? What then is the reward of such among you as do this but disgrace in the life of this world, and on the day of resurrection they shall be sent back to the most grievous chastisement...” (তোমরা কি আসমানী কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং বাকী অংশ প্রত্যাখ্যান কর? তাদের কী প্রতিফল হবে যারা এ জীবনের জন্য এরূপ ঘৃণাত্মক কাজ করে? শেষ বিচারের দিন তাদেরকে সর্বাধিক কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।)


সুতরাং কোরানের প্রত্যেকটি আয়াত বা বাণীকে পূংখানুপুংখ পালন করার মাঝেই একজন মুসলিমের জীবনবিধান নিহিত। এবার আসুন দেখি ইসলাম মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে কি বলছে?

 

১) ইসলামে ব্যক্তি

 

ইসলামে ব্যক্তি কি? ব্যক্তির অবস্থান কি, মূল্য কি?

 

ইসলামে ব্যক্তি হলো আল্লাহর সৃষ্টি, যে কেবলই আল্লাহর প্রত্যাশিত কর্মকাণ্ড সম্পাদনে নিযুক্ত থাকবে। মানুষ যেমন কম্পিউটার, ঘড়ি, ফোন, টেলিভিশন, রোবট ইত্যাদি উদ্ভাবন করে মানুষেরই প্রত্যাশিত কোন কর্ম সম্পাদনের জন্য, আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন ঠিক অনুরূপ উদ্দেশ্যে। মানুষের কোন স্বাধীনতা নেই, স্বাধীন ইচ্ছা নেই (free will)। সে যেন আল্লাহর হাতের পুতুল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বলেন তিনি ব্যক্তির জান-মাল সব কিছুই কিনে নিয়েছেনঃ “Lo! Allah hath bought from the believers their lives and their wealth because the Garden will be theirs: they shall fight in the way of Allah and shall slay and be slain.” (দেখ! আল্লাহ বিশ্বাসীদের জীবন ও মালামাল কিনে নিয়েছেন, কেননা বেহেস্তের বাগান হবে তাদের।) (কোরান ৯:১১১)

 

ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে এ জগতে ব্যক্তি যেন আল্লাহর ক্রীতদাস, আল্লাহর কেনা গোলাম এবং তার একমাত্র কাজ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক কোরানে নির্দেশিত যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্নকরণে নিয়োজিত থাকা। এবং তা ঠিকমত করতে পারলে সে আল্লাহ অপার অনুগ্রহ বা পুরস্কার পাবে পরজগতে। অন্য কথায়, একজন মুসলিমের জীবন সম্পূর্ণরূপে এক কল্পিত পরকালের জন্য উৎসর্গকৃত; ইহকালের জন্য নয়।

 

আমরা দেখছি যে, ইসলামে ব্যক্তির নিজস্ব সত্তা মানুষের সৃষ্ট যন্ত্রপাতির সত্তার চেয়ে নড়বড়ে। কেননা আল্লাহ মানুষকে কেবল নিজ হাতে সৃষ্টি করেই তাকে হাতে পুতুল করেন নি, তাদের জান-মাল আবার কিনেও নিয়েছেন এবং সে প্রক্রিয়ায় মানুষকে দ্বিতীয় দফা তাঁর হাতের পুতুল বানিয়েছেন।

 

এবং পৃথিবীতে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আল্লাহর নির্দেশনায় হচ্ছে কি না হচ্ছে সেটা হিসেব রাখার জন্য আল্লাহ ব্যক্তির দুই কাঁধে দু’জন ফেরেস্তা রেখেছেন ডায়রী হাতে। ডান কাঁধের ফেরেস্তা লিপিবদ্ধ করবেন তার সমস্ত পূণ্যবাণ, তথা আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে কৃত কর্মকাণ্ড; আর বাম কাঁধের ফেরেস্তা লিপিবদ্ধ করবেন তার পাপ কর্ম, অর্থাৎ সেসব কর্ম যা আল্লাহর নির্দেশনা বিরোধী। এবং আল্লাহ কিয়ামতের দিন বিশ্বকে ধ্বংস করার পর শেষ বিচারের দিন সব মানুষকে হাসরের ময়দানে দাঁড় করাবেন। সেদিন তার পাপ-পূণ্যের বিচার করা হবে ফেরেস্তা দু’জনের লিখিত পাপের লিপি না পূণ্যের লিপি ভারী সে ভিত্তিতে। যার পাপের লিপি ভারী সে যাবে দোজখে এবং যার পূণ্যের লিপি ভারী সে যাবে বেহেস্তে। ইসলামি দৃষ্টিতে এটাই ব্যক্তির জীবনের মোটামুটি রূপরেখা।

 

(খ) ইসলামী সমাজ ও রাজনীতি

 

১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে সফল বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর থেকে পাশ্চাত্যে ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। ধর্ম কেবলই ব্যক্তির নিজস্ব আধ্যাত্মিক পরিপুষ্টি সাধনের নিমিত্তে। সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। কিন্তু ইসলাম হচ্ছে বিশ্ব-স্রষ্টার নির্দেশিত মানবজীবনের জন্য একটি সামগ্রিক জীবনবিধান – যার মাঝে অন্তর্ভূক্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রঃ ব্যক্তিগত, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। কোরান জীবনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র সম্পর্কে কি বলে সেটা খতিয়ে দেখা যাক এখানে।

 

কোরানের ২৪:৪২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ “Yea, to Allah belongs the dominion of the heavens and the earth; and to Allah is the final goal (of all).” (হ্যাঁ, আসমান ও জমিনের মালিক একমাত্র আল্লাহ; এবং আল্লাহই হচ্ছেন চূড়ান্ত গন্তব্য)।

 

আল্লাহ একই দাবী পুনরাবৃত্ত করেছেন ৩৪:১ নং আয়াতে।

 

কোরানের ৫৭:৫ ও ৬৭:১ নং আয়াতে আল্লাহ নিজেকে আসমান ও জমীনের উপর একচ্ছত্র আধিপত্যকারী দাবী করেছেন।

 

কোরান ৬:১৬৫-এ আল্লাহ বলেনঃ “It is He Who hath made you (His) agents, inheritors of the earth...” (আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি ও পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করেছেন)।

 

এবং কোরান ২৪:৫৫-এ আল্লাহ বলেছেনঃ “Allah has promised to those of you who believe and do good that He will most certainly make them rulers in the earth as He made rulers those before them, and that He will most certainly establish for them their religion which He has chosen for them...” (যারা বিশ্বাস করে ও ভাল কাজ করে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি তাদেরকে পৃথিবীর শাসনকর্তা বানাবেন... এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য পছন্দকৃত ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন...)

 

তার মানে দাঁড়ায়, আল্লাহ ও কোরান মতেঃ সমগ্র পৃথিবীর প্রকৃত মালিক বা উত্তরাধিকারী হচ্ছে মুসলিমরা। কাজেই অমুসলিমদের মালিকানাধীন বা শাসনাধীন পৃথিবীর সকল ভূখণ্ডের প্রকৃত মালিকও মুসলিমরা। অন্য কথায় ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদির প্রকৃত মালিক হলো মুসলিমরা; সেসব ভূখণ্ডকে সেখানকার অমুসলিমরা অন্যায়ভাবে দখল করে আছে। এবং আল্লাহ সে অন্যায় দখল থেকে বিশ্বের প্রত্যেক টুকরো ভূখণ্ড মুসলিমদের মালিকানায় ও শাসনে এনে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

 


 

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্পন্ন হবে?

 

আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের মালিকানা ও রাজত্ব মুসলিমদের হাতে আপনাআপনি এনে দেবেন না। মুসলিমদেরকেও কাঠ-খড় পোড়াতে হবে (No free lunch)। আল্লাহর মতে, সেটা অর্জিত হবে মুসলিমদের বাহুবলে, সমরবলে ঘটিত “জিহাদ” বা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে এবং তাতে আল্লাহর ভূমিকা হবে সহায়তা দান মাত্র। জিহাদ সম্পর্কে বহু বিতর্ক রয়েছে – অনেকে দাবী করে জিহাদ হলো নিজ কুপ্রবৃত্তির সাথে লড়াই করা। যারা এমন দাবী করে তাদেরকে নজর দেওয়া উচিত কোরানের সুরা নং ৯, আয়াত নং ১১১-এর দিকে, যা বলছেঃ

 

দেখ! আল্লাহ বিশ্বাসীদের জীবন ও মালামাল কিনে নিয়েছেন, কেননা বেহেস্তের বাগান হবে তাদের। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করবে এবং মারবে ও মারা যাবে – যে প্রতিশ্রুতি আইন, গসপেল ও কোরান দ্বারা আল্লাহর সাথে বাঁধিত।

 

“জিহাদ” হচ্ছে “আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ” করা। আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা যদি নিজ কুপ্রবৃত্তির সাথে লড়াই করা হবে, তাহলে সেটা করতে গিয়ে মুসলিমরা অন্যকে মারবে ও নিজে মারা যাবে কিভাবে?

 

এবং জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কি সে সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই ৮:৩৯ আয়াতটিতে, যা বলেঃ

 

“...যুদ্ধ করে যাও তাদের বিরুদ্ধে যতদিন-না গণ্ডগোল-নির্যাতন দূর হয় এবং কেবলমাত্র আল্লাহর প্রতি ন্যায় ও বিশ্বাস পুরোপুরি ও সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।” (কোরান ৮:৩৯)

 

আয়াতটি বলছে জিহাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে একমাত্র আল্লাহতে বিশ্বাস তথা ইসলামধর্মকে পুরোপুরি ও বিশ্বের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করা। এবং বিশ্বের সর্বত্র ও সব মানুষের উপর ইসলামের কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেই পৃথিবী থেকে গণ্ডগোল-নির্যাতন সব দূর হয়ে যাবে।

 

সুতরাং আল্লাহর স্বপ্ন হচ্ছে মুসলিমদেরকে পৃথিবীর মালিক ও শাসনকর্তা বানানো ও পৃথিবীর সর্বত্র ও সব মানুষের উপর ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা। এবং আল্লাহর সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে মুসলিমদের দ্বারা ঘটিত সহিংস ও রক্তক্ষয়ী জিহাদের মাধ্যমে। এবং মুসলিমরা যখন অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদি যুদ্ধে লিপ্ত হবে, আল্লাহ তাদেরকে সহায়তা করবেন। এ প্রসংগে আল্লাহ কোরানের ৮:৬৫-৬৬ নং আয়াতে বলেছেনঃ আল্লাহর সহায়তায় মুসলিমরা তাদের চেয়ে ১০ গুণ বেশী শক্তিশালী শত্রুপক্ষকে পরাজিত করতে পারবে। আল্লাহ তাঁর সহায়তা পাঠাবেন জিহাদে লিপ্ত মুসলিমদের পাশাপাশি ফেরেস্তাদেরকে নিযুক্ত করে। এ প্রসংগে কোরান ৩:১২৪-২৫ আয়াতে বলছেঃ “মনে আছে তুমি বিশ্বাসীদেরকে বলেছিলেঃ এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য ৩,০০০ হাজার ফেরেস্তা পাঠিয়ে সহায়তা করবেন? তোমরা দৃঢ় ও সত্য পথে থাকলে আল্লাহ ৫,০০০ ফেরেস্তা পাঠিয়েছে তোমাদের শত্রুদের উপর সাঙ্ঘাতিক হত্যাযজ্ঞ ঘটাবেন।”

 

এবং আল্লাহ এটাও দাবী করেন যে, মুসলিমরা যখন জিহাদ লড়ে ধীরে ধীরে কাফেরদের ভূখণ্ড দখল করে মদীনা-কেন্দ্রিক ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিল, তাতে আল্লাহ সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছিলেন। যেমন কোরান ১৩:৪১ (২১:৪৪) বলেঃ “তারা কি দেখছেনা যে আমরা তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড সীমান্তবর্তি অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস করছি? তারা কি মনে করে তারা জিততে পারবে?”

 

অর্থাৎ আল্লাহর কেরামতিতে নবী ও তাঁর শিষ্যরা অবিশ্বাসীদের ভূখণ্ড জয় করতে সমর্থ হচ্ছিল মদীনার প্রাথমিক ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায়। কিন্তু আল্লাহর স্বপ্ন হলো সমগ্র বিশ্ব জয় করে মুসলিমদের হাতে তুলে দেওয়া। আল্লাহর সে চূড়ান্ত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কিভাবে? মুসলিমদের জন্য আল্লাহ সে রাস্তাও বাতলিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বকে কব্জাকরণের লক্ষ্যে আল্লাহ মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, পৌত্তলিকদেরকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানে হত্যা করতে (কোরান ৯:৫) এবং এভাবে পৌত্তলিকদের অধিকৃত ভূখণ্ডে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। একেশ্বরবাদী ইহুদি ও খৃষ্টানদের অধিকৃত ভূখণ্ড কব্জা করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেনঃ মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাবে যতক্ষণ-না তারা পরাজিত হয়ে অবমানিত ও বশীভূত অনুভব করে এবং স্বেচ্ছায় মুসলিমদেরকে বৈষম্যমূলক কর (জিজিয়া) দেয় (কোরান ৯:২৯)। এভাবে বিশ্ব পর্যায়ে আল্লাহর প্রত্যাশিত ইসলামি বিজয় ও শাসন অর্জিত হবে।

 

এবং নবী মুহাম্মদের সময় থেকে মুসলিমরা আল্লাহর নির্দেশত ঠিক সেই কর্ম-প্রণালীই প্রয়োগ করেছে বিশ্বব্যাপী ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সে অভিযানে তারা ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে, যদিও সমগ্র বিশ্ব বিজয়ের স্বপ্ন এখনো সফল হয় নি। তবে প্রচেষ্টা কোন না কোন পন্থায় আজও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

 

ইসলামের রাজনৈতিক ব্লুপ্রিন্ট সম্পর্কে আরও বলতে হয় যে, মুহাম্মদ নবীত্বের পাশাপাশি মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নব্য ইসলামী রাষ্ট্রের একনায়ক শাসক হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত একনায়ক শাসক রূপে কর্তৃত্ব করে যান। নবীর মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরীরাও একই পদ্ধতি গ্রহণ করেন। একবার যে খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হন, তার স্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত বা তাকে মেরে ফেলা পর্যন্ত সে একনায়ক শাসক থাকেন। অর্থাৎ ইসলামের শাসনব্যবস্থা হবে একনায়কতান্ত্রিক, যদিও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র নয়। তবে নবীর মৃত্যুর মাত্র তিন দশক পর তা একনায়কতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে উন্নীত হয়ে যায়, কেননা একনায়কতন্ত্র যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে রাজতন্ত্র আসতে বাধ্য।


 

ইসলামি অর্থনীতি

 

কার্ল মার্ক্স ও এ্যাঙ্গেলস নবী মুহাম্মদের ইসলাম প্রতিষ্ঠার অভিযানকে একটা অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার বিপ্লব হিসেবে দেখতেন। সেটাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা না হলেও তাদের দৃষ্টিতে সেটা ছিল মূলত একটা অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রসূত দ্বন্দ্ব। কিন্তু আজ পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত বলতে চান যে, নবী মুহাম্মদ ছিলেন মূলত একজন পূঁজিবাদী। এবং তাদের যুক্তি হচ্ছে নবী ছোটকাল থেকে ব্যবসা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ধনাঢ্য খাদিজার বিরাট ব্যবসাকে সফল ও লাভজনক ভাবে পরিচালনা করেছিলেন।

 

প্রশ্ন হচ্ছেঃ এ দু’টো দাবীর মধ্যে কোনটি সঠিক? নবী মুহাম্মদ সমাজবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, না পূঁজিবাদী?

 

১৯৯৯ সালে বিবিসি’র সমীক্ষায় মার্ক্স দ্বিতীয় শহস্রাব্দের সেরা চিন্তাবিদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই মুহাম্মদ সম্পর্কে বিচার-বিবেচনায় তিনি আজকের চুনোপুটি পণ্ডিতদের কাছে হেরে যাবেন, সেটা কী করে সম্ভব! যারা মুহাম্মদকে পূঁজিবাদী হিসেবে দেখেন, তারা ভুলে যান যে, নবীর জীবনের দু’টো অধ্যায় রয়েছেঃ প্রথমটা পৌত্তলিক, দ্বিতীয়টা ইসলামী। এবং তিনি পূজিবাদী ছিলেন পৌত্তলিক অধ্যায়ে। ইসলামের নবীত্ব শুরুর পর তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেন এবং স্ত্রী খাদিজার পূঞ্জীকৃত ধন-সম্পদের উপর ভর করে তার ইসলামী বিপ্লব সংগঠিত করতে থাকেন। সে পর্বে আমরা দেখি খাদিজা ও আবু বকর প্রমুখ ধনাঢ্য মুসলিমরা তাদের ধন সম্পদ দিয়ে দারিদ্র-পীড়িত মুহাম্মদের শিষ্যদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। অর্থাৎ মুহাম্মদের ইসলামী নবীত্ব পর্বে আমরা তার সম্প্রদায়ের মাঝে মার্ক্সবাদী অর্থনীতির ছাপ দেখি।

 

এবং মদীনায় স্থানান্তরের পর আমরা নবীকে দেখি বাণিজ্য-কাফেলা আক্রমণ করে লুণ্ঠিত মালামালে তার মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিত করতে। এটা পূঁজিবাদের পরিপন্থী, কেননা একজন পূঁজিবাদী চাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাধা-বিঘ্নহীন পরিচালনা।

 

এবং এরপর নবী মদীনা থেকে শুরু করে আরবের ধনী সম্প্রদায়গুলোকে হামলা করে তাদের ধন-সম্পদ করায়ত্ব করতে থাকেন, যার উপর ভিত্তি করে তাঁর মুসলিম সম্প্রদায় জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। কোরানের অষ্টম সুরাটির শিরোনাম হচ্ছে “আন-ফাল”, যার অর্থ হচ্ছে “গণিমতের মাল” বা “যুদ্ধে লুণ্ঠিত মালামাল”। এ সুরাটি মুসলিমদেরকে নির্দেশনা দিয়েছে কিভাবে তারা অবিশ্বাসীদের মালামাল লুণ্ঠণ করে তা মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করবে। বণ্টনের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন লুণ্ঠণের এক-পঞ্চমাংশ নবী ও আল্লাহর ভাগে যাবে; বাকী অংশ সব মুসলিমদের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হবে।

 

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্ম-প্রণালীও কিন্তু অনেকটা সেরকমই। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বে ধনীদের ধন-সম্পদ কেড়ে নিয়ে সবার মাঝে পুনর্বণ্টন করা মার্ক্সবাদী অর্থনীতির একটা বড় লক্ষ্য। সে প্রসঙ্গে নবীর গ্রহণকৃত অর্থনৈতিক পন্থা মার্ক্সবাদী অর্থনৈতিক নীতির কাছাকাছি ছিল।

 

মোটকথা পৌত্তলিক জীবনে নবী ছিলেন পূঁজিবাদী এবং ইসলামী মিশন গ্রহণের পর তিনি পূঁজিবাদ বিরোধী হয়ে উঠেন এবং অনেকটা মার্ক্সবাদী পন্থার কাছাকাছি ছিল নবীর ইসলামী অর্থনৈতিক পন্থা।

 

এবং নবীর জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন পুরো আরব ইসলামের পদতলে এসে গেছে এবং বেশীর ভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে, যার ফলে লুটপাট করার মতো আর সম্প্রদায় অবশিষ্ট নেই – তখন আগের সেই অর্থনৈতিক পন্থা মেনে চলা সম্ভব হল না। এখন লুটপাটের পেশা ছেড়ে মুসলিমদেরকে হয় চাষাবাদ বা ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা পূঁজিবাদী পথে যেতে হবে, নইলে অন্য উপায় বের করতে হবে। এবং আল্লাহ কি করলেন? আল্লাহ সেটা নির্ণয় করেছেন কোরানের ৯:২৮-২৯ আয়াতে।

 

৯.২৮: “হে বিশ্বাসীরা! পৌত্তলিকরা সত্যি সত্যি নোংরা; সুতরাং এ বছরের পর আর তাদেরকে কাবায় ঢুকতে দিবে না। এবং তোমরা যদি দারিদ্রের আশংকা কর, আল্লাহ শীঘ্রই তোমাদেরকে ধনবাদ করে তুলবেন...”

 

আল্লাহ কীভাবে মুসলিমদেরকে ধনবাদ করে তুলবেন? তা তিনি উল্লেখ করেছেন পরের আয়াতে (৯:২৯), যাতে আল্লাহ বলেছেনঃ “যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহর নবী যা নিষেধ করেছেন তা নিষিদ্ধ বিবেচনা করে না – তারা আসমানী কিতাবের মানুষ হলেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাও যতদিন-না তারা অবমানিত ও বশীভূত হয়ে স্বেচ্চায় কর প্রদান করবে।”

 

মুসলিমরা রাষ্ট্রকে দিবে নগণ্য যাকাত মাত্র, তাও স্বেচ্ছামূলকভাবে – যার দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের পরিচালনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, ইসলাম পৌত্তলিকদেরকে বাঁচতে দেবে না। একমাত্র বাকী থাকে ইহুদি ও খৃষ্টানরা – যারা অন্তত আল্লাহরই পাঠানো তবে অনিখুঁত ও ভ্রান্ত ধর্মের অনুসারী। তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের ডাক দিয়েছেন আল্লাহ ও তাঁর নবী, এবং তারা সে ডাকে সাড়া না দিলে তাদেরকে ইসলামী রাজ্যে বাঁচতে দেওয়া হোক, তবে বৈষম্যমূলক ও উচ্চ কর প্রদানের বিনিময়ে। এবং তাদের উপর প্রধানত দুই ধরনের কর আরোপ করা হয়ঃ ১) জিজিয়া বা বশ্যতা কর এবং ২) খারাজ বা ভূমি কর।

 

কোরানে নির্দেশিত ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখা মোটামুটি এটাই। এবং যতদিন ইসলামী খিলাফতের কর্তৃত্ব আরবদের হাতে ছিল, ততদিন বিশেষত আরব-মুসলিমরা এভাবেই জীবিকা বির্বাহ করেছে।

 

মানবতাবাদ কি?


মানবতাবাদের কয়েকটি সংজ্ঞাঃ

 

1.মানবতাবাদ হচ্ছে একটা পার্থিব জীবন দর্শন যা যুক্তিতর্ক, নৈতিকতা ও সুবিচারকে ধারণ করে এবং বিশেষত নৈতিকতা ও সিদ্ধান্ত প্রনয়নের ভিত্তি হিসেবে অলৌকিকতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। (উইকিপিডিয়া)


2.মানবতাবাদ একটা অলৌকিকত্ববিহীন জীবন দর্শন, যা দাবী করে যে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিপূর্ণ নৈতিক জীবনযাপনের সামর্থ্য ও দায়িত্ব রয়েছে মানুষের এবং তা মানবজাতির জন্য অধিকতর কল্যান সাধনের প্রয়াস করে। (আমেরিকান মানবতাবাদী সঙ্ঘ)


3.মানবতাবাদ একটি গণতান্ত্রিক ও নৈতিক জীবন দর্শন, যা দাবী করে যে মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে নিজ জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার ও তার গতিবিধি নির্ণয় করার। মানবতাবাদ বিশ্বাস করে যে, মানুষ যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তা প্রয়োগ করে একটা অধিকতর মানবীয় সমাজ প্রতিষ্টা করার সামর্থ্য রাখে, যার ভিত্তি হবে মানবীয় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গুণাবলী। তা ধর্মীয় নয় এবং বাস্তবতার অলৌকিক ধারণা গ্রহণ করে না। (International Humanist and Ethical Union, Minimum Statement)

 

আমার মতে মানবতাবাদঃ মানবতাবাদ হবে মানুষের নিজস্ব চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে গঠিত একটি জীবনতত্ত্ব, যা হবে মানবীয় প্রবৃত্তির সাথে যতটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যার লক্ষ্য হবে মানুষের সুখ-শান্তিকে সর্বাধিক বর্ধিতকরণ।

 

আমি এখানে মানবতাবাদের ভিত্তি গঠনে মানবীয় প্রবৃত্তির উপর বিশেষ জোর দিচ্ছি, কেননা মানুষ ভাল ও মহৎ কাজ করে আবার ভুল করে, সে নিজ স্বার্থবাদী ও স্বার্থপর হয় এবং সে মন্দ কাজ, যেমন চুরি, ডাকাতি, হত্যা করতেও সক্ষম। কাজেই মানবতাবাদী জীবনবিধান নির্ধারিতকরণে মানুষের এ ভুল করার, মন্দ ও অন্যায় কাজ করার প্রবৃত্তিকে যতটা সম্ভব মানবীয়/সহনশীল দৃষ্টিতে দেখা উচিত বলে আমার বিশ্বাস। সেটা না করলে আমাদের সমাজ সহনশীল, সুবিচারী ও সভ্য হবে না। আমার মতে মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক সমাজতত্ত্বের এখানে ছিল একটা বড় ব্যর্থতা। মার্ক্সবাদ চেয়েছে মানুষের দুর্বল ও মন্দ দিককে অসহনশীল দৃষ্টিতে দেখতে, ব্যক্তি ও সমাজ জীবন তা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে।

 

 

উদারবাদ

 

যাহোক, মানবতাদের একটি বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এখনো দাঁড় করানো হয় নি। পাশ্চাত্যে চর্চিত উদারবাদ মার্ক্সবাদের মত একটা মানব-সৃষ্ট সামগ্রিক জীবনবিধান। এবং মার্ক্সবাদের মত উদারবাদে মানবজীবনের একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা রয়েছে। ইউরোপে ‘ইনলাইটনমেন্ট’ যুগে উদারবাদ একটি সুষ্ঠ জীবনবিধান রূপে আবির্ভূত হয় – যার মাঝে ব্যক্তিগত, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও বিশ্ব পর্যায়ের নীতিগত ধারণা অন্তর্নিহিত। এবং উদারবাদের পাখায় ভর করেই মার্ক্সবাদ আরেকটি নিঃধর্মীয় জীবনব্যবস্থা রূপে আবির্ভূত হয়। মার্ক্সের মতে সমাজতন্ত্র হচ্ছে একটি নিখুঁত ও চূড়ান্ত জীবনব্যবস্থা, যে প্রসংগে তিনি বলেছেনঃ

 

“সমাজতন্ত্র হচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতি মাঝেকার এবং মানুষে মানুষে সংঘাতের প্রকৃত সমাধান; অস্তিত্ব ও জীবনের মাঝেকার, পণ্যায়ন ও আত্ম-অভিব্যক্তির মাঝেকার, স্বাধীনতা ও চাহিদার মাঝেকার, এবং ব্যক্তি ও প্রজাতির মাঝেকার দ্বন্দ্বের সত্যিকার সমাধান। এটাই ইতিহাসের সমস্যার সমাধান এবং সে জানে নিজেই সে সমাধান।” ([communism] is the genuine resolution of the conflict between man and nature, and between man and man, the true resolution of the conflict between existence and being, between objectification and self-affirmation, between freedom and necessity, between individual and species. It is the solution of the riddle of history and knows itself to be the solution.)

 

এবং একজন মার্ক্সবাদী দাবী করতে পারে যে, মার্ক্সবাদই একটা নিখুঁত ও পরিপূর্ণ মানবতাবাদী জীবনব্যবস্থা, যে দাবী মার্ক্স নিজেই করে গেছেন, যখন তিনি বলেছেনঃ “কমিউনিজম সম্পূর্ণরূপে ‘প্রকৃতিবাদ’ হিসেবে উন্নীত হলে মানবতাবাদের সমতূল্য হবে, এবং সম্পূর্ণরূপে মানবতাবাদ হিসেবে উন্নীত হলে প্রকৃতিবাদের সমতূল্য হবে।”

 

মার্ক্সবাদের মতো উদারবাদ নিখুঁত নয়। উদারবাদী তত্ত্বের মূলে রয়েছে অব্যাহত পরিবর্তনশীলতার স্পন্দন। এবং আমার ব্যক্তিগত বিচারে উদারবাদ হতে পারে অনেকাংশে মানবতাবাদের ভিত্তি। অথবা উদারবাদ ও মার্ক্সবাদের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হতে পারে একটি সুসংহত মানবতাবাদী জীবন দর্শন।

 

আমরা সবাই ইসলামের পাশাপাশি মার্ক্সবাদ বা সমাজতান্ত্রিক জীবন-ব্যবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি পরিচিত। একটা সামগ্রিক জীবন দর্শন হিসেবে উদারবাদের সাথে আমাদের পরিচিতি কম। কাজেই এখানে আমি উদারবাদ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

 


১। ব্যক্তির বা মানুষের প্রকৃতি

 

ক) মানুষ আত্মস্বার্থবাদী (Self-interested) -- মানুষ স্বেচ্ছায় যা কিছু করতে চায়, তার প্রত্যেকটি এক-একটি self-interest বা আত্মস্বার্থ। আত্মস্বার্থ হতে পারে স্বল্পমেয়াদি – যেমন এখন আমার গান শোনার ইচ্ছা, কিংবা আজ বিকালে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার ইচ্ছা বা কাল বিকেলটা বউ বা বান্ধবীকে নিয়ে পার্কে ঘুড়তে যাওয়ার বা সিনেমা দেখার ইচ্ছা। আবার কর্মজীবন বা ক্যারিয়ার দাঁড় করানোর জন্য বছরের পর বছর কাজ করে যাওয়া, যেমন পড়াশুনা করা, সেটা একটা ধীর্ঘমেয়াদি self-interest। এসব আত্মস্বার্থ বা self-interest গুলোই মূলত আমাদের জীবনকে চালিত করে।

 

খ) মানুষ প্রজ্ঞাশীল (rational) -- উদারবাদের ভিত্তিমূলক ধারণা হচ্ছে ‘মানুষ প্রজ্ঞাশীল জীব’। প্রজ্ঞাশীল মানে মানুষ জীবনের সব বিষয়ে যুক্তিতর্ক খাঁটিয়ে বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নিজ নিজ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে। অবশ্য সব মানুষ একই বিষয়ে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। অনেক সময় কোন ব্যক্তি ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে। তার মানে নয় এটা নয় যে, ঐ ব্যক্তি প্রজ্ঞাশীল নয়। সেও প্রজ্ঞাশীল, কেননা তার বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা আছে – যদিও সে বিচার-বিবেচনা ভ্রান্ত হতে পারে।

 

গ) মানুষ স্বনির্ভর (autonomous) -- উদারবাদীদের মতে প্রজ্ঞাশীলতা থেকে আসে মানুষের স্বনির্ভরতার ধারণা। প্রজ্ঞাশীল মানুষ স্বাধীনভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র বা বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। আর মানুষের যদি সে সক্ষমতা থাকে, তাহলে সে স্বাধীনভাবে নিজ জীবন পরিচালনায় সক্ষম তথা সে স্বনির্ভর। কাজেই উদারবাদে মানবজীবন চালনার জন্য অলৌকিক বা ঈশ্বর-রচিত কোন জীবন-নির্দেশনার তথা ধর্মগ্রন্থের প্রয়োজন নেই, যা মানুষকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে হবে।

 

২) সমাজ/রাষ্ট্র কেন?

 

বলা হয়ে থাকে মানুষ সামাজিক জীব; সে অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চাই; এবং সে কারণেই সামষ্ঠিক সংগঠন, যেমন সমাজ, সমিতি বা রাষ্ট্রের উৎপত্তি।

 

তবে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, একজন মানুষ ১০০-২০০ জন মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে পারলেই সে সুখী জীবনযাপন করতে পারে। এবং কারো পক্ষে ১০০০-এর বেশি মানুষের সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়া সম্ভব নয়।

 

অর্থাৎ একজন মানুষ সুখী হওয়ার জন্য ১০০০ হাজার মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়লেই যথেষ্ট, বাংলাদেশের মত ১৮ কোটি মানুষের কোনই প্রয়োজন নেই।

 

এবং মানুষ যদিও সামাজিক জীব, পাশাপাশি সে ব্যক্তিগত জীবও – কেননা অনেক সময় সে আপন সময় চায়, যখন সে অন্যের উপস্থিতি কামনা করে না; তা তাকে বিরক্ত করে। কাজেই সুষ্ঠ জীবন যাপনের জন্য ব্যক্তির সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে।

 

উদারবাদে সমাজ বা রাষ্ট্রকে গণ্য করা হয় একটা “necessary evil” তথা “অবাঞ্ছিত প্রয়োজনীয়তা” হিসেবে। কেননা মানুষ যেহেতু স্বনির্ভর অর্থাৎ নিজেই নিজ জীবন পরিচালনায় সক্ষম -- সুযোগ দিলে মানুষ রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেওয়া, আইনের কাছে জবাবদিহি করা ইত্যাদি ঝামেলা থেকে অব্যাহতি পেতে চাইবে; এসবে সে জড়াতে চাবে না। এবং পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে, যারা ব্যক্তিগতভাবে ন্যায় পথে চলে। তাদের মত সবাই চললে পুলিশ, কোর্ট-কাছারী ইত্যাদির কোনই প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু সব মানুষ এক নয় এবং কিছু মানুষ ন্যায়ের সীমানা অতিক্রম করে অন্যায় কর্মে লিপ্ত হয় – এবং সে কারণেই পুলিশ, কোর্ট-কাছারীর প্রয়োজন। কিছু লোক খারাপ কর্ম লিপ্ত হয় বিধায় রাষ্ট্রের সবাইকে পুলিশ, কোর্ট-কাছারী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার দায়ভার গ্রহণ করতে হয়। ভাল-মন্দ মিলিয়েই মানুষ -- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ যে ভাল মানুষ কাল সে মন্দ কাজে লিপ্ত হতে পারে। কাজেই আমাদের সুখ-শান্তিকে বর্ধিত করতে চাইলে, আমাদের জীবন চালনায় বাধা-বিঘ্ন হ্রাস করতে চাইলে, আইনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরী। একই কারণে মানুষ সৃষ্টি করেছে সকল সামষ্ঠিক প্রতিষ্ঠান – হোক সে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা আইনি ব্যবস্থা। আমরা এসবে জড়াতে চাই না কিন্তু সেগুলো আমাদের জীবন যাত্রাকে সহজ, সুগম ও নিরাপদ করে তোলে – যা আমাদের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বর্ধিতকরণে সহায়ক হয়।

 

এক কথায় ব্যক্তিগতভাবে মানুষ সামষ্ঠিক প্রতিষ্ঠানে জড়াতে চাইনা, তথাপি জড়াই ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার আশায় – অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্র ইত্যাদি ব্যক্তির সুখ ও সমৃদ্ধি বর্ধিত করবে সে আশায় ব্যক্তি এসব প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়। এখানেও আমরা দেখছি ব্যক্তির আত্মস্বার্থ বড় হয়ে উঠছে। ব্যক্তির আত্মস্বার্থ বর্ধিত হবে সে প্রত্যাশায়ই মানুষ সমাজ, সমিতি, রাষ্ট্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে।

 

উদারবাদে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে সে দৃষ্টিতেই দেখা হয়। উদারবাদী রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সর্বপ্রথম প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয় দার্শনিক স্পিনোজাকে (১৬৩২-৭৭)। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে স্পিনোজা বলেনঃ “সরকারের সত্যিকার লক্ষ্য হবে (ব্যক্তির) স্বাধীনতা নিশ্চিত করা”। অর্থাৎ সরকারের দায়িত্ব হবে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা, যেখানে ব্যক্তি শান্তিতে তার নিজ কর্মপ্রকল্প পরিচালনা করতে পারে এবং বাধা-বিঘ্ন বিনা নিজ মতামত ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারে। অনুরূপভাবে রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে আইনস্টাইনের মতঃ “কোন রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্বের একমাত্র সংগত উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির বাধা-বিঘ্নহীন অভিব্যক্তি নিশ্চিত করা”।

 

স্বাধীনতা ছাড়াও ব্যক্তির অধিকার (মানবাধিকার), সবার জন্য সমান সুযোগ, চিন্তা-চেতনার ও তা প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং বাধাহীনভাবে চিন্তা-ভাবনার বিনিময় নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাছে উদারবাদের কিছু মৌলিক দাবী।

 

উদারবাদে ব্যক্তির স্বাধীন বা স্বশাসিত প্রকৃতি দাবি করে যে, সমাজ ও রাষ্ট্র তার ব্যক্তিগত জীবনের উপর সর্বনিম্ন প্রভাব খাঁটাবে; অন্য কথায় রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যক্তিকে তার জীবন চলায় সর্বাধিক স্বাধীনতা দিবে যতক্ষণ-না তার স্বাধীনতা চর্চা অন্যের ক্ষতি করে বা অন্যের স্বাধীনতা চর্চাকে ব্যাহত করে।

 

৩) ব্যক্তি বড় না রাষ্ট্র বড়? – আইনস্টাইন বলেছেনঃ “রাষ্ট্র মানুষের জন্য, মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়।” তার মানে রাষ্ট্র মানুষের ভৃত্য বা দাস সমতূল্য; মানুষ বড়, ব্যক্তি বড়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষের জন্য কাজ করা; ব্যক্তির চাওয়া-পাওয়া পুর্তির পথকে সুগম করা।

 

অন্য একটা উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক। মানুষ কম্পিউটার, রোবট ইত্যাদি সৃষ্টি করে। কেন করে? সেগুলো মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করতে, সুখতর করতে, সমৃদ্ধতর করতে চাকরের মত কাজ করে যাবে সে উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রও ঠিক তেমনি মানুষের সৃষ্টি। মানুষ না থাকলে যেমন কম্পিউটার, রোবট সৃষ্টি হত না, একইভাবে মানুষ না থাকলে সমাজ, রাষ্ট্র বা অন্য কোন সংগঠনের অস্তিত্ব অসম্ভব। কাজেই কম্পিউটার-রোবটের মত রাষ্ট্রের দায়িত্বও হবে মানুষের আশা-আকাংখা পুর্তির পথকে, সুখ-শান্তি বৃদ্ধির পথকে সুগম করা মাত্র। রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। সে ব্যক্তির চেয়ে বড় নয়।

 


 

অর্থাৎ ব্যক্তির উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র। এবং ব্যক্তি জীবনে কি চায়? ব্যক্তি চায় তার নিজ ইচ্ছা ও চাওয়া-পাওয়া অনুসারে জীবনকে চালনা করতে। তা করতে পারলেই সে সুখী হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে সে পথকে সুগম করা। অন্য কথায়, রাষ্ট্র ব্যক্তির ইচ্ছে মত জীবন চলায়, ব্যক্তির নিজ নিজ কর্মকাণ্ড পরিচালনায়, সর্বাধিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে – যতক্ষণ-না তা অন্যের জীবন চলাকে ব্যাহত করে।

 

৪) রাষ্ট্রের দায়িত্বঃ

 

ব্যক্তির ১) নিরাপত্তা, ২) স্বাধীনতা, ৩) মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার, ৪) সবার জন্য সমান সুযোগ, ৫) চিন্তা-ভাবনার স্বাধীনতা ও নির্বিঘ্নে মতামত প্রকাশের অধিকার, ৬) বিঘ্নহীনভাবে চিন্তা-ভাবনা বিনিময়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা ইত্যাদি (marketplace of ideas)।

 

৫) সামাজিক প্রগতিশীলতা (Social Progressivism)

 

উদারবাদ ‘সামাজিক প্রগতির’ উপর বিশেষ জোর দেয়, যার মূলে রয়েছে এ ধারণা যে, সামাজিক সংস্কার, রীতি-প্রথা, আইন-কানুন, নৈতিকতা ইত্যাদির কোন অভ্যন্তরীণ বা ধ্রুব মূল্য নেই এবং অব্যাহতভাবে সেগুলোর পুনর্সংগঠন ও পুনঃসমন্বয় ঘটাতে হবে মানবসমাজের অধিকতর লাভ ও প্রগতির স্বার্থে। এখানে উদারবাদী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা মার্ক্স/সমাজতান্ত্রিক ও ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ভিন্ন – কেননা সেগুলো হলো চূড়ান্ত ব্যবস্থা। কিন্তু উদারবাদী রাষ্ট্র হবে সর্বদা পরিবর্তনশীল।

 

৬) রাজনৈতিক ব্যবস্থাঃ

 

আগেই বলা হয়েছে উদারবাদে ব্যক্তি স্বনির্ভর বা স্বশাসিত হিসেবে গণ্য, অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিকে যথেষ্ট বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাশীল ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন জীব হিসেবে গণ্য যে নিজ উদ্যোগে সুষ্ঠ জীবন চালনার সামর্থ্য রাখে। তার জীবন চালনায় অন্য ব্যক্তির বা সংগঠনের সহায়তা আবশ্যক নয়। কাজেই উদারবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থাও এমন হবে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির এ মৌলিক সামর্থ্য প্রতিফলিত হয়। এবং সেটা কেবলই সম্ভব গণ-অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। যে প্রতিনিধি বেশীরভাগ ব্যক্তির চিন্তাধারা ও আশা-প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার প্রতিজ্ঞা করবে, সে গণভোটে নির্বাচিত হবে। এবং উদারবাদী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণের চয়নকৃত একগুচ্ছ আইন বা একটি সংবিধান দ্বারা। উদারবাদে পূর্ব-নির্ধারিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাষ্ট্র একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনাও প্রতিষ্ঠিত করবে, এবং সীমিত ক্ষমতা চর্চা করবে। উদারবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত পূর্ববর্তি শাসন-ব্যবস্থা, যেমন রাজার স্বর্গীয় অধিকার, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, রাষ্ট্র চালনায় ধর্মের ভূমিকা ইত্যাদি দূরীভূত করেছে।

 

৭) অর্থনীতি

একটা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী হবে তা নির্ণয় করার জন্য আমাদেরকে বিবেচনা করতে হবেঃ (ক) অর্থনৈতিক নীতির মৌলিক উদ্দেশ্য কি? এবং (খ) সে উদ্দেশ্য অর্জনের উৎকৃষ্ট উপায় কি?

 

সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদেরকে বিবেচনা করে দেখা দরকার মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থের গুরুত্ব কতটুকু। আগেই বলা হয়েছেঃ মানুষের জীবনের দৈনন্দিন ও ধীর্ঘমেয়াদি কর্মকাণ্ড চালিত হয় কিছু আত্মস্বার্থ দ্বারা – যেগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে ব্যক্তি সন্তুষ্টি, সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে চায়। একজন নিঃধার্মিকের জীবনের উদ্দেশ্য ও চাওয়া-পাওয়া সেগুলোর মাঝেই নিহিত। এবং আমার মতে, ব্যক্তির আত্মস্বার্থগুলোর মাঝে অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ হচ্ছে সবচেয়ে বড় আত্মস্বার্থ।

 

ক) অর্থনৈতিক নীতির উদ্দেশ্য কি?

 

ইসলামী অর্থনীতিঃ মূল ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিমরা অমুসলিমদেরকে চুষে খাবে। সেটা কেবল অন্যায়ই নয়, সে অর্থনীতির চর্চা করে আজকের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠির ভরণপোষণ অসম্ভব।

 

মার্ক্সবাদী অর্থনীতিঃ মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বড় লক্ষ্যগুলো হলোঃ

 

সম্পদের পুনর্বণ্টন, অর্থাৎ ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদের মাঝে ভাগাভাগি করে দেওয়া।


ব্যক্তি-মালিকানা উৎখাত করা।

 

ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্র থেকে নেবে।

 

মার্ক্স ব্যক্তির অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থকে খুবই গৌণ কোরে দেখেছেন। মার্ক্স বলেন অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ কেবল কোনমতে পেট বাঁচানোর জন্য এবং সে জন্যে মানুষকে যতটা সম্ভব কম সময় ও প্রয়াস ব্যয় করতে হবে। মার্ক্সের মতে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হবে মননশীলতা চর্চা, কেননা মানুষ মননশীল জীব। অন্যকথায়, মানুষ কোন মতে তার পেটের চাহিদা মিটিয়ে বাকী সময় ও প্রয়াস নিয়োগ করবে কেবলই নিজ আত্ম-তুষ্টির জন্য মননশীলতার চর্চায়।

 

কথা হচ্ছেঃ মার্ক্সের এ অনুসিদ্ধান্ত মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তির সাথে কতটা সামঞ্জস্যতাপূর্ণ?

 

আমার পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও বিবেচনায় মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে খুবই কম মানুষ। হাজারে একজন কিংবা বড়জোর শতকরা একজন মানুষ চাবে তার পেটের চাহিদা কোনমতে মিটে গেলে সে নিজেকে মননশীল কর্মে আত্ম-নিয়োগ করতে। মননশীল কর্ম, গবেষণা ইত্যাদিতে আগ্রহ খুবই কম মানুষের। বেশীর ভাগ মানুষ কেবল পেটের চাহিদা মিটিয়েই সন্তুষ্ট নয়, তারা চায় যতটা-সম্ভব স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধ জীবন উপভোগ করতে। মানুষের এ স্বভাবজাত প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রের লক্ষ্য, কেননা স্বভাবসিদ্ধভাবে মানুষ যা করতে চায়, তা করতেই পারলেই সে অধিক সুখী হবে।

 

পূঁজিবাদঃ পূঁজিবাদী অর্থনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের সৃষ্টি, সম্পদের পরিমাণ বাড়ানো।

 

পূঁজিবাদের আবির্ভাবের পূর্বে ধারণা ছিল যে, বিশ্বে সম্পদের পরিমাণ মোটামুটি স্থির এবং কারও ধনী হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে অন্যকে লুটপাট বা শোষণ করা। সে কারণেই আমরা দেখেছিঃ পূঁজিবাদী আধুনিক যুগের আবির্ভাবের আগে কোন রাজা বা শাসক শক্তিশালী হলেই সে অন্য রাজা বা ভূখণ্ডকে আক্রমণ করে তা দখলের চেষ্টা করতো। অথবা নিজ মাল অন্যের কাছে বিক্রির চেষ্টা করতো কিন্তু অন্যের মাল কিনতে চাইতো না। সেটাই সম্পদ পূঞ্জীভূত করার বা ধনবাদ হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বলে ধারণা ছিল। সে অর্থনৈতিক নীতিকে বলা হতো mercantilist। এবং মার্ক্সবাদ সে ধারণাকে অনেকাংশে ধারন করে।

 

কিন্তু পূঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা (David Hume, Adam Smith and David Richardo) বললেনঃ না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌলিক লক্ষ্য হবে সম্পদের সৃষ্টি, অন্যের সম্পদ লুটপাট বা শোষণ নয়। অন্য কোথায়, কারো ধনী হওয়ার জন্য লুটপাট বা শোষণের প্রয়োজন নেই। এবং তাঁরা নিঃসন্দেহে সঠিক ছিলেন। সিংগাপুরের কথা ধরা যাক। দেশটি বাংলাদেশের মতোই ব্রিটিশদের দ্বারা শোষিত হয়েছে। এবং বাংলাদেশের বেশ পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, কিন্তু সিংগাপুরের তাও নেই – না খনিজ তেল, সোনা-রূপা, এমনকি সিংগাপুরের মাটিও উর্বর ও চাষবাস যোগ্য নয়; না আছে দেশটির অন্যকে লুটপাট করে খাওয়ার শক্তি। অথচ আজ সিংগাপুরের মাথাপীছু আয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর গড় মাথাপীছু আয়েরও বেশী।

 

এবং সিংগাপুরের অর্থনৈতিক নীতির মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করা। সিংগাপুরের সরকার নানা কৌশল ও প্রলোভন সৃষ্টি করছে, যাতে করে বিদেশী ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে সিংগাপুরে তাদের ব্যবসা খোলায় রাজী করানো যায়। সিংগাপুরের অর্থনৈতিক সফলতার চাবিকাঠি আর কিছু নয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচল ও প্রাণবন্ত রাখতে পারলেই সম্পদের সৃষ্টি হবে এবং সম্পদ সৃষ্টি হলেই দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে ও জনগণের সমৃদ্ধি বর্ধিত হবে।

 

এবং উদারবাদ গ্রহণ করেছে পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কেননা সেটা সম্পদ সৃষ্টি করে, তথা জনগণের কল্যান ও সমৃদ্ধি বর্ধিতকরণে সর্বাধিক প্রযোজ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। দ্বিতীয়তঃ উদারবাদ চায় ব্যক্তির স্বাধীনতা ও আত্মস্বার্থের পথকে সুগম করতে। অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ যেহেতু মানুষের সবচেয়ে বড় আত্মস্বার্থ, তা পূর্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের একটি বড় প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। এবং সেটা কেবল পূঁজিবাদী অর্থনীতির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব।


 

 উদারবাদী চিন্তাধারার একটা সুন্দর দিক হলোঃ মানুষ যেহেতু স্বভাবসিদ্ধভাবে আত্মস্বার্থবাদী – সে আত্মস্বার্থবাদিতাকে লাভজনক ফলাফল অর্জনে কাজে লাগানোর দিকে দৃষ্টি দিয়েছে উদারবাদ। আমার মতে মানুষ আত্মস্বার্থবাদী বলেই মানব সমাজ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে ধাবিত হতে পেরেছে। মানুষ যদি আত্মস্বার্থবাদী না হতো তাহলে সে কোন কিছু করতে, যেমন সম্পদ সৃষ্টির জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে স্পৃহা পেতনা। সম্পদের সৃষ্টি না হলে পৃথিবী এতটা সমৃদ্ধ, সহজ ও সুন্দর হতো না।

 

কাজেই উদারবাদ চৌকস বুদ্ধিমানের মত ব্যক্তির আত্মস্বার্থ পূরণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তবে ব্যক্তিকে তা পূরণ করতে হবে সৎ উপায়ে, অন্যের আত্মস্বার্থকে ভংগ বা ব্যাহত করে নয়। মানুষ যেহেতু আত্মস্বার্থের জন্য পরিশ্রম করতে রাজী, করুক সে পরিশ্রম এবং ভোগ করুক ফলাফল তথা পূরণ করুক তার আত্মস্বার্থ, তবে সৎ উপায়ে। এটাই উদারবাদী অর্থনীতির চাবিকাঠি।

 

উদার পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিযোগীতার সৃষ্টি করে এবং প্রতিযোগীতা হচ্ছে উৎকর্ষ অর্জনের শ্রেষ্ঠ উপায়। রাষ্ট্রের ভূমিকা হচ্ছে সুষ্ঠ প্রতিযোগীতার পরিবেশ সৃষ্টি ও বলবত রাখা মাত্র। কেবল সুষ্ঠ প্রতিযোগীতার শর্ত বা নিয়ম ভঙ্গ হলে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে।

 

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারবাদীরা চায় রাজারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা যেখানে ব্যক্তিরা, যারা আত্মস্বার্থবাদী (Self-interested), তারা কঠোর পরিশ্রম করবে নিজের ভালোর জন্যে – যা বাজারে প্রতিযোগিতা করবে এবং যার মাধ্যমে ব্যক্তি রাষ্ট্র ও সমাজে সর্বাধিক অবদান রাখতে পারে, তথা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। আত্মস্বার্থবাদী ব্যক্তিরা এভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য লাভজনক ফলাফল আনতে পারবে। কাজেই উদারবাদীরা পূঁজিবাদ, এবং মুক্তবাজার বা মিশ্র অর্থনীতি পক্ষপাতি বা সেগুলোর প্রসার চায়।

 

মার্ক্সবাদী অর্থনীতির সমস্যাঃ

৮) উদারবাদের প্রকারভেদঃ উদারবাদে দু’টো প্রধান ধারা রয়েছেঃ ১) আদি বা চিরায়ত (classical) উদারবাদ, ও ২) সমাজমুখী উদারবাদ। ধারা দু’টো কেবল সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং সেসব ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়ে ভিন্নমতাবলম্বী। চিরায়ত উদারবাদীরা চায় স্বাধীন ব্যক্তি মালিকানা ও মুক্ত অর্থনৈতিক নীতি, এবং তারা সেবামূলক রাষ্ট্রের বিরোধী। তারা আইনের সামনে সকলের সমতা এবং বাজারে মুক্ত ও সুষ্ঠ প্রতিযোগিতার সমর্থক। এবং এরূপ প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক অসমতাকে তারা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য প্রতিফল বিবেচনা করে। কিন্তু সমাজমুখী উদারবাদীরা নাগরিকদের মাঝে সম্পদ ও সেবার অধিক সমতামূলক পুনর্বণ্টনের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী। তারা দাবী করে রাষ্ট্র-কর্তৃক সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা, এবং তাদের অনেকের দাবী সরকার ধনীদের থেকে অধিক কর আদায়ের মাধ্যমে বেকার ভাতা, ঘরহীনদের জন্য বাসস্থান ও সবার জন্য চিকিৎসা ইত্যাদি নিশ্চিত করবে।

 

১৩) উদারবাদী আন্তর্জাতিকতা

 

উদারবাদ নিজেকে একটা বিশ্বজনীন জীবনবিধান হিসেবে দেখে এবং স্বভাবতই চেষ্টা করছে ব্যক্তি, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারবাদের ধারণাগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে।

 

সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেঃ মানবজাতির জন্য উদারবাদের সর্বাদিক মূল্যবান অবদান হচ্ছে মানবাধিকারের ঘোষণা। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে সফল বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে প্রথম উদারবাদী সাংবিধানিক শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে সংবিধানের অংশ ছিল মানবাধিকার ঘোষণা। এবং পরবর্তিতে পাশ্চাত্যের দেশগুলো একে একে ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী গণতন্ত্র গ্রহণ করলে, সে দেশগুলোও ফ্রান্সের সংবিধান প্রায় অপরিবর্তিতরূপে গ্রহণ করে। এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সংবিধানের মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ সালে প্রায় অপরিবর্তিতরূপে জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র হিসেবে গৃহীত হয়। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন জাতিসঙ্ঘ হচ্ছে একটা নও-উদারবাদী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান।

 

উদারবাদ মনে করে তার মানবাধিকার ঘোষণা সামাজিক, সাংস্কৃতির বা রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে সব মানুষের মৌলিক অধিকার এবং বিশ্বের সব মানুষের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই উদারবাদের মূলে রয়েছে বিশ্বজনীনতার সুর। ‘ইনলাইটনমেন্ট’ যুগের শুরুতেই উদারবাদী দার্শনিকদের মাঝে আলোচনা ও তর্কে উদারবাদের সে বিশ্বজনীনতার সুর ধ্বণিত হয়।[1] ১৭৯৫ সালে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ত রচিত “চিরন্তন শান্তি” (Perpetual Peace) শীর্ষক প্রভাবশালী নিবন্ধটিতে বিশ্ব পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সমস্যা ধ্বণিত হয় এবং তা একটা ন্যায়পরায়ণ, সুবিন্যস্ত ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা সৃষ্টির প্রাথমিক রূপরেখা উপস্থাপন করে।[2]

 

শান্তিপূর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা সৃষ্টিতে উদারবাদের প্রথম দাবী ছিল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা – যে রাষ্ট্র হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম। শক্তিশালী শাসক কর্তৃক দুর্বল শাসককে আক্রমণ করা ছিল ইতিহাসের এক চিরাচরিত ঘটনা। রাষ্ট্র হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম – এ ধারনা সৃষ্টি করা হয় ১৬৪৮ সালে ইউরোপের ওয়েস্টফালিয়া শান্তিচুক্তির মাধ্যমে, যা ইউরোপে ৩০ বছর চলমান ক্যাথলিক-প্রটেস্টান্ট যুদ্ধ এবং ৮০ বছর চলমান স্পেইন-হল্যান্ড যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। চুক্তিটির মূল বক্তব্য ছিল ইউরোপের রাজারা নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানার মাঝে তাদের শাসন সীমিত রাখবে এবং একে অপরকে আক্রমণ করবে না। রাষ্ট্রের স্বাধীন ও সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের আধুনিক ধারণার সূচনাও সেখান থেকেই।

 

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটা খুবই উপকারী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, কেননা তা রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ কমিয়েছে। কিন্তু উদারবাদীদের মতে কেবল রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধই বিশ্বে অশান্তির একমাত্র উৎস নয়। বিশ্বে চূড়ান্ত শান্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজন রয়েছে রাষ্ট্রের ভিতরেও নাগরিকদের মানবাধিকার ও সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা।

 

শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য উদারবাদীরা অবংশানুক্রমিক ও অস্বৈরাচারী প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রীয় রাষ্ট্র গঠনের উপর জোর দেয়, যা একটা সংবিধাব বা আইনশাস্ত্র দ্বারা পরিচালিত হবে। এ প্রসঙ্গে তাদের যুক্তি ছিল যে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সম্পন্ন ও কর্মকাণ্ডের কৈফিয়তদানহীনতা সম্পন্ন স্বৈরাচারী শাসকরা সহজেই নিজ নাগরিকদের মানবাধিকার লংঘন করতে ও অন্য রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে – যা বিশ্বে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির বড় অন্তরায়। কাজেই উদারবাদ প্রথমত দাবী করে গণ-অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার, যেখানে সরকারকে জনগণের কাছে তার কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত, উদারবাদ চায় যে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা এক হাতে ন্যস্ত করা যাবে না, কেননা এমন সরকার সহজেই অন্য রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বাধাতে পারে। উদারবাদ রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা কয়েকটি পরস্পর নির্ভরশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাঝে ভাগ করার ব্যবস্থা করেছে – যেমন রাষ্ট্রপ্রধান, বিচার-বিভাগ, সংগ্রেস ও সেনিট ইত্যাদির মাঝে। এরূপ সাংবিধানিক বা প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সরকারের ক্ষমতা দুর্বলকরণ ও ভোটারদের কাছে সরকারের কর্মকাণ্ডের কৈফিয়তদান স্বভাবতই সরকারের জন্য জনগণের অধিকার লংঘন বা আগ্রাসী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া কঠিনতর করে তোলে। উদারবাদী গণতান্ত্রিক সরকার সংকীর্ণ নিজ-স্বার্থের জন্যে একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে না – মাইকল ডোয়েল-এর এ মতবাদটির আজ অবধি সত্যতা উদারবাদী শান্তি তত্ত্বকে সমর্থন দেয়।[3]

 

বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইউরোপে সূচিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যা ভয়ঙ্কর ধরনের মানব জীবন ও ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনে, তা রাষ্ট্রের মাঝে সংঘাত এড়ানোর জন্য নতুন উপায় খুঁজতে উদারবাদী চিন্তাবিদদেরকে জরুরী অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে উদারবাদীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনের শাসন, রাষ্ট্রগুলোর মাঝে পারস্পারিক সম্মানবোধ সৃষ্টিতে পারস্পারিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে আন্তর্জাতিক সংস্থা সৃষ্টিতে মনোযোগ দেয়। সে লক্ষ্যে উদারবাদীরা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের সুপারিশ অনুসারে ১৯২০ সালে ‘লীগ অব নেইশন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন তাকে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার এবং দুর্বল রাষ্ট্রকে আগ্রাসকদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরক্ষা প্রদানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। উদারবাদীরা ভেবেছিল এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ বিশ্ব-পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাব আন্তর্জাতিক উদারবাদে এক বড় আঘাত হানে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে উদারবাদী তত্ত্ব “বাস্তবতাবাদ” (Realism)-এর কাছে হেরে যায়। বাস্তবতাবাদ বলে যে, বিশ্বের অরাজক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো স্বভাবতই আত্মস্বার্থবাদী ও ক্ষমতার বলে পরিচালিত এবং সেগুলো আন্তর্জাতিক আইন বা নৈতিকতার বাঁধা উপেক্ষা করে নিজ নিজ আত্মস্বার্থের পীছে ছুটবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাঘাত সত্ত্বেও উদারবাদী জীবনদর্শনকে বিশ্বায়িত করার প্রয়াস অব্যাহত থাকে। আন্তর্জাতিক সহযোগীতা ও বিশ্বশান্তি নিশ্চিতকরণের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে লীগ অব নেইশন্স পুনর্জন্ম লাভ করে জাতিসংঘের মাঝে। ইউরোপে জন্ম হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি যুগে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমাতে উদারবাদীরা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা লঘুকরণে তাদের সার্বভৌমত্বের কিছু অংশ বা উপাদানকে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইত্যাদির হাতে হস্তান্তরের দাবী জানায়।

 

উদারবাদী অর্থনৈতিক আন্তর্জাতিকতাঃ বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কিভাবে উন্নীত করা যায়, সে চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে স্কটিশ দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথের “The Wealth of Nations” রচনাটিতে – যেখানে তিনি দাবি করেন: পারস্পারিক বাণিজ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো পারস্পারিকভাবে লাভবান হতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রগুলো যদি পরস্পরের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করে তথা মুক্ত-বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে, তা রাষ্ট্রগুলোকে পারস্পারিকভাবে লাভবান করবে। এবং উদারবাদ চায় মুক্ত-বাজার অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এবং সে লক্ষ্যে উদারবাদীরা ১৯৪৪ সালে আমেরিকার ব্রেটন উডস-এ বহুজাতিক আলোচনার ভিত্তিতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্ব ব্যাংক (World Bank), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (International Monetary Fund), ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল দুর্যোগের সময়ে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে। বিশ্ব ব্যাংক দ্বিতীয় বিশ্বের পর ইউরোপের ধ্বংসকৃত অর্থনীতিগুলোকে পুনর্সংগঠনের নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; এবং পরবর্তিতে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ, আর্থিক অনুদান ও ঋণ দেওয়ার কাজে নামে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শুল্ক কমাতে এবং বাণিজ্যভাবে সংরক্ষণশীল দেশগুলোর অর্থনীতি উন্মুক্তকরণে আলোচনার মঞ্চ হিসেবে কাজ করে।


এসব আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে উদারবাদের অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে বিশ্বায়িত করার কাজে নিয়োজিত, অন্যদিকে জাতিসংঘ নীতিগতভাবে উদারবাদের সামাজিক-রাজনৈতিক রীতিনীতিগুলোকে – যার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুবিচার, মানবাধিকার, সমনাগরিকত্ব, স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতার অধিকার, সায়ত্বশাসন ইত্যাদি – বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ “মানবাধিকারের নীতি ও জনগণের সায়ত্তশাসন” (অনুচ্ছেদ ১) এবং “মানবাধিকার ও বিভেদহীনভাবে সকলের জন্য মৌলিক স্বাধীনতা” (অনুচ্ছেদ ৫৫) উন্নীত করার প্রয়াসে কাজ করে। সনদটি বাক-স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ১৯) ও ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ১৮) ইত্যাদির প্রসার ঘটাতে কাজ করে। জাতিসংঘ তার সদস্য-দেশগুলোকে তার সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সনদটি সাক্ষর করানোর মাধ্যমে সেসব দেশকে নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানার মাঝে মানবাধিকারগুলো নিশ্চিত করতে আইনগতভাবে দায়গ্রস্ত করে। ১৯৬০-এর দশকে উদারবাদীরা বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ইত্যাদির ঘোষণা জাতিসংঘ সনদে অন্তর্ভূক্ত করে। জাতিসংঘ সনদ চায় বিশ্বের সকল মানুষের জন্য মানবাধিকারের একটা সর্বজনীন ও একক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে।

 

উদারবাদী বেসরকারী সংস্থাগুলো (NGOs), যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও আম্নেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইত্যাদিও উদারবাদী নীতি, যেমন মানবাধিকার, সুবিচার ও স্বাধীনতা, ইত্যাদির প্রসারে পাহারাদার হিসেবে কাজ করে।

---

 

মানবতাবাদের প্রত্যাশা

 

1.নিরীক্ষা, পরীক্ষা ও যুক্তিবাদী পর্যালোচনার মাধ্যমে পার্থিব জ্ঞান অর্জন করা। মানবতাবাদীরা বিশ্বাস করে জ্ঞান অর্জনের জন্য ও সেই সাথে উপকারী প্রকৌশল উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞান হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। আমরা যুক্তিবাদী বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে চিন্তাশীলতা, শিল্পকর্ম ও অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতাকে মূল্য দেই।


2.মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ও অনিয়ন্ত্রিত বিবর্তনের ফসল। মানবতাবাদীরা প্রকৃতিকে আত্মজাত গণ্য করে। আমরা আমাদের জীবনকেই সব ও যথেষ্ট মনে করি, এবং বাস্তবতাকে আমাদের প্রত্যাশা ও কল্পনা থেকে পৃথক করি। আমরা ভবিষ্যতের প্রতিযোগীতাকে গ্রহণ করি এবং ভীতিহীনভাবে আগামী ও অজানার দিকে ধাবিত হই।


3.নৈতিক মূল্যবোধের উৎপত্তি ঘটবে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষের চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থ থেকে। মানবতাবাদীরা মানুষের কল্যানে বিশ্বাসী, যা মানুষের অবস্থা, স্বার্থ ও চাহিদার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে এবং তার পরিধি হবে বিশ্ব-প্রকৃতি বা তারও বাহির পর্যন্ত। আমরা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আভ্যন্তরীণ মূল্য ও মর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে দেখি, যে দায়িত্ববোধের সাথে স্বাধীনতার সাথে জীবন চালনা করবে।


4.জীবনের অর্থপূর্ণতা নিহিত আছে মানবীয় আদর্শ চর্চায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আমরা আমাদের সর্বাধিক উন্নয়ন কামনা করি এবং জীবনকে গভীর উদ্দেশ্যবোধে প্রাণবন্ত করে তুলি, জীবনের অস্তিত্ব, তার সমস্যা ও নির্মমতা এবং এমনকি মৃত্যুর অপরিহার্যতা ও চূড়ান্ততার আনন্দ ও সৌন্দর্যের মাঝেই আমরা চমৎকারিত্ব ও বিস্ময় খুঁজে পাই। মানবতাবাদীরা মানবীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারন করে এবং মানবতাবাদী জীবন দর্শন অসময়ে সুখানুভব ও প্রাচুর্য্যের সময়ে উদ্দীপনা যোগায়।


5.মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সামাজিক জীব এবং মানুষের সাথে সম্পর্কের মাঝে অর্থ খুঁজে পায়। মানবতাবাদীরা প্রত্যাশা করে পারস্পারিক চাওয়া-পাওয়া; এবং প্রচেষ্টা চালায় তা নির্মমতা ও তার প্রতিফল বিহীনভাবে অর্জন করার – যেখানে বিরোধের নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হবে সহযোগীতার মাধ্যমে ও সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে। ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে পারস্পারিক নির্ভরশীলতার সাথে সংযুক্তি আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধতর করে, আমাদের একে অপরের জীবনকে সমৃদ্ধকরণে প্রেরণা যোগায়, এবং শান্তি, ন্যায় ও সকলের জন্য সমান সুযোগের আশাবাদ উৎসাহিত করে।


6.সমাজের স্বার্থে কাজ করা ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি বর্ধিত করে। প্রগতিশীল সংস্কৃতি কেবলই টিকে থাকার লড়াইয়ের নির্মমতা থেকে মুক্ত হতে এবং দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে, সমাজের উন্নতি ও বিশ্ব মানবতার উন্নয়নে সচেষ্ট হয়েছে। আমরা মানুষের অবস্থা ও সামর্থ্যের বৈষম্য কমাতে চায়; প্রাকৃতিক সম্পদের ও মানবীয় প্রচেষ্টার ফসলের ন্যায্য বণ্টন চাই, যাতে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মানুষ সুখী জীবন যাপন করতে পারে।

 

মানবতাবাদীরা সকলের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে, বৈচিত্রে বিশ্বাসী এবং ভিন্ন কিন্তু মানবীয় মতামতকে শ্রদ্ধা করে। আমরা উন্মুক্ত ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে সকলের সমান মানবাধিকার ও গণ-স্বাধীনতা চর্চা বলবত করতে কাজ করি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণকে নাগরিক দায়িত্ব মনে করি, এবং প্রকৃতির সত্তা, বৈচিত্র ও সৌন্দর্য্যকে নিরাপদ ও দীর্ঘমেয়াদীভাবে প্রতিরক্ষা করাকে পার্থিব দায়িত্ব মনে করি।

 

১৬ ডিসেম্বর ২০১১

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ