Banner
আসাঞ্জ প্রসংগঃ বাক-স্বাধীনতা, আমেরিকা ও সমাজতন্ত্র -- আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন , আপডেটঃ October 10, 2012, 8:31 AM, Hits: 1441

 
ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় শামসুল আলম চঞ্চল ভাইকে আমার “আসাঞ্জকে নিয়ে মাতামাতি ও এক সাম্রাজ্যবাদী দালালের ভাবনা” শীর্ষক রচনাটির একটা জ্ঞানগর্ব পর্যালোচনা লিখার জন্য (জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে আলমগীর হুসেনের নিবন্ধের জবাবে -- শামসুল আলম চঞ্চল)। আমার লেখাটার উদ্দেশ্য মূল রচনা থেকে উদ্ধৃত করছিঃ
 

1. আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতার  লড়াই। আসাঞ্জকে সমর্থকগণ নিয়ে এতটা মাতামাতি করছে মূলত তাকে বাক-স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে জ্ঞান করে। আসাঞ্জও তার তৎপরতাকে সেভাবেই প্রতিফলিত করছে। আসলে কি তাই?
 
2. আসাঞ্জের উপর অবিচার। আইন-কানুনের ধার না ধরে আসাঞ্জের উপর চরম অবিচার-অত্যাচার করছে বা করতে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য। এ দাবী কতটা সত্য?

3. আসাঞ্জ হচ্ছে বিশ্ব-মানবতার এক নম্বর বন্ধু, নতুন যুগ সৃষ্টিকারী মহানায়ক, অথচ পূঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী চক্র তার উপর অমানবিক নির্যাতনে তৎপর। ঘটনা কি তাই?

অন্য কথায়, আসাঞ্জের কর্মকাণ্ডকে আসাঞ্জ ও তার ভক্তরা কিভাবে দেখে এবং আসাঞ্জের সুইডেনে ধর্ষণের অভিযোগের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ও জল্পনা-কল্পনার বিশ্লেষণ ছিল আমার রচনার বিষয়বস্তু। চঞ্চল ভাই উনার উত্তরে আমার লেখার মূল বিষয়বস্তুকে অনেকটা অগ্রাহ্য করেছেন। এবং উনার বেশীর ভাগ আলোচনাই আমেরিকার কথিত কুৎসিত কর্মকাণ্ডের উপর, যা বাংগালী, বিশেষত মার্ক্সিস্ট ও ইসলামপন্থী বাংগালীদের আলাপ-চারিতায় বহুল প্রচারিত। বাংগালী পাঠক তা উঠতে-বসতে শুনে থাকবে।

উত্থাপিত সে বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, তবে অপ্রাসংগিক। তা আমার রচনার উত্তর না হয়ে তা আমেরিকার আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাষ্ট্রীয় নীতির সমালোচনামূলক একটা আলাদা রচনা হতে পারতো। কাজেই এ রচনায় আমি কেবল প্রাসংগিক বিষয়গুলোর উপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব।

প্রথমত, চঞ্চল ভাই বলেছেন, “লেখক আলমগীর হুসেন মনে করেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ উদার গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিভূ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য ফাঁস করে মহা অন্যায় করেছেন।” এ প্রসংগে আমি যা বলেছি, তা নীচে উদ্ধৃত করছিঃ

...(রাষ্ট্রের গোপন তথ্য) প্রকাশ্য জনসমক্ষে উন্মোচন দণ্ডনীয় অপরাধ বিবেচিত হয়ে এসেছে এ পর্যন্ত। সম্প্রতি অতিতের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো সে গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে দোষীদেরকে কোন গ্রহণযোগ্য বিচার-আচার ছাড়াই যেভাবে নিষ্ঠুর, বর্বর শাস্তি দিয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। তাদের কপালে কি ঘটেছে তা জানারও সুযোগ হয় নি অন্যদের, আপনজনদের। এ প্রসংগে স্মরণ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র কর্মী আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে পুতিন সরকার-কর্তৃক সংঘটিত অপকর্মের কথা “Blowing up Russia: Terror from within” ও “Lubyanka Criminal Group” ইত্যাদি পুস্তকে প্রকাশ করে দিলে নভেম্বর ২০০৬ তাকে তেজষ্ক্রিয় বিষ (radioactive poison) খাইয়ে হত্যা করা হয়।

কাজেই আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড বাক-স্বাধীনতা কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা নিশ্চিত যে, আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশই এমন কাজকে বাক-স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি। রাষ্ট্রীয় গুপ্ত-তথ্য চুরি করে প্রকাশ করা বাক-স্বাধীনতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় নি আমেরিকা-ব্রিটেনের কাছে; রাশিয়া-একুইডরের কাছে এরূপ কর্মকাণ্ডের বাক-স্বাধীনতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা আরও কম।

আমি এখনো মনে করি, আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার উপরোক্ত কথাগুলো হাড়ে-হাড়ে সঠিক। চঞ্চল ভাই যদি তা অস্বীকার করেন, তাহলে উনি জগতে বাসিন্দা, সে জগতের সাথে আমার পরিচিতি নেই। আর যদি তা স্বীকার করেন, তাহলে এ প্রসংগে অতিরিক্ত বিতর্ক অর্থহীন।

এরপর চঞ্চল ভাই লিখেছেনঃ

প্রথমত: আলমগীর হুসেন বর্তমান বাক স্বাধীনতার তথাকথিত পুণ্যভূমি পশ্চিমা বিশ্বের গুরু আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাক স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করি। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমেরিকায় অভ্যন্তরীণ বাক স্বাধীনতা আছে। আমেরিকা শুধুমাত্র সেই সব ক্ষেত্রেই সহনশীল যেখানে আমেরিকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হচ্ছে। এটি বোঝার জন্য মার্কসবাদ ও ইসলাম এই দু’টি রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আমেরিকার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গী জানা প্রয়োজন। ইসলাম কঠোরভাবে একটি এককেন্দ্রিক ও স্বৈরাচারী ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা ইসলামের প্রতি সহনশীল ও উদার। সেখানে মসজিদ নির্মাণ ও ধর্ম পালনে ইসলামের জন্য কোন বাধা নেই। কিন্তু মার্কসবাদী তত্ত্ব নিয়ে সীমিত পরিসরে কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা ছাড়া সেখানে কি মার্কসবাদী দল গঠনের কোন স্বাধীনতা আছে? সেখানে সংবিধানে প্রত্যেকের নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও মার্কসবাদী মতবাদ প্রচারের ও দল গঠনের কোন স্বাধীনতা নাই। নিজ দেশে আমেরিকাকে তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্মমভাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রচারকে একেবারে শুরুতেই ধ্বংস বা খুবই সীমিত করে রাখার জন্য। অনেক সময় কমিউনিস্ট অথবা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের গুম অথবা খুন করা হত। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক চার্লি চ্যাপলিনকে পর্যন্ত কমিউনিস্ট সন্দেহে মার্কিন রাষ্ট্র দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল।

আলোচনায় যাওয়ার আগে এ প্রসংগে বলে রাখা আবশ্যক যে, বাক-স্বাধীনতা ব্যক্তির মতামত প্রকাশের অধিকার মাত্র। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা আন্দোলন বাক-স্বাধীনতা হিসেবে গণ্য নাও হতে পারে।

তথাপি চঞ্চল ভাই’র উদ্ধৃত বক্তব্য সঠিক নয়। আমেরিকাতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৯ সালে। তার অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান। এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পার্টিটি সোভিয়েট রাশিয়া থাকে অনুদান পেয়েছে। অন্যদিকে আজ আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মার্ক্সিস্টদের ক্রীড়াক্ষেত্র। নামজাদা বিশ্ব-নন্দিত সব মার্ক্সিস্ট লেখকদেরকে আমেরিকা ও অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক পশ্চিমা দেশেই বিচরণ করতে দেখা যায়।

তবে হ্যা, মার্ক্সিবাদীদের উপর কড়া খবরদারী হয়েছে আমেরিকায়, বিশেষত ১৯৩৯ সালে কমিউনিস্ট রাশিয়া বিশ্ব দখল করে ভাগাভাগি করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে হিটলারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করার পর। আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির প্রভূ রাশিয়া যখন এ চুক্তির পর হিটলারের পাশাপাশি আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর উপর একে একে আগ্রাসী আক্রমণ ও দখল শুরু করল, তখন পার্টিটির উপর কড়া নজর পড়া অস্বাভাবিক কিছু না। বিশেষত রাশিয়া-হিটলার চক্রের সংগী জাপান যখন পার্ল হার্বারে আক্রমণ করল। উল্লেখ্য আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়া-হিটলার চুক্তি ও ইউরোপে তাদের দখলদারী ও বর্বরতামূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে নিরবতা পালন করেছে। তবে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি খবরদারী আরও বেড়ে যায় যখন আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে পার্টিটির সদস্যদেরকে রাশিয়ার গোয়েন্দা হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার ঘটনা বের হয়ে আসে, যাদের পরিকল্পনা ছিল আমেরিকাকে ভিতর থেকে কৌশলে ধ্বংস করে রাশিয়ার অধীনে নিয়ে আসা এবং এমনকি তারা আমেরিকার পারমানবিক অস্ত্র উদ্ভাবনের গোপন খবরও রাশিয়ার কাছে ফাস করে দিয়েছিল। কাজেই কমিউনিস্ট পার্টির যারা রাশিয়ার পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিল, তাদের অনেকে সে দোষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়, অন্যদেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার প্রভু-দেশ রাশিয়া কমিউনিস্ট বিরোধীদের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছে, তা উদ্ধৃত করলে চঞ্চল ভাই’র আলোচনাটা সুন্দর হতো। উল্লেখ্য তাদের হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মৃতদেহ কমিউনিস্ট দেশগুলোতে লাশের গঙ্গা বহিয়েছে।

ওদিকে কমিউনিজমের মত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাক-স্বাধীনতা কিনা, সে প্রসংগে বলতে হয়ঃ জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশের সংবিধানে রাজনৈতিক অধিকার মানবাধিকার হিসেবে সংরক্ষিত, তবে তা বাক-স্বাধীনতা থেকে ভিন্ন। এবং আমি যতটুকু বুঝি – রাজনৈতিক অধিকার চর্চা হবে একটি দেশের সংবিধানের নিরিখে। যেমন জাতি-বিদ্বেষ বা নাৎসীবাদ ভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আমেরিকায় স্বীকৃতি পাবে না, কেননা তা দেশটির সংবিধানের পরিপন্থী।

আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলন ছিল আন্তর্জাতিকতাপন্থী তথা সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে বিশ্বরাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে, যা আমেরিকান সংবিধানের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। কাজেই আইনত আমেরিকার মাটিতে সে তৎপরতা অবৈধ কর্ম বলে গণ্য হবে। এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের এককেন্দ্রিক স্বৈরাচারী ম্যানিফেস্টোও আমেরিকার গণতান্ত্রিক সংবিধানের পরিপন্থী। ওদিকে আমেরিকান সংবিধানের সবচেয়ে গূঢ় বক্তব্য হচ্ছে – জীবনের পবিত্রতা (sanctity of life) ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা ইত্যাদি। ফলে জীবনের নিরাপত্তা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ইত্যাদির নিশ্চিত করার প্রয়াস রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অথচ কমিউনিস্ট আন্দোলন সমাজের বিরাট সংখ্যক জনতাকে গণহারে হত্যার বা নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে পরিচালিত, ব্যক্তি-স্বাধীনতার কথা-তো উঠেই না। কাজেই কমিউনিস্ট আন্দোলন তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও কর্মে আমেরিকার সংবিধানের চরম শত্রু। তথাপি আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টি ১৯১৯ সালে তার জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কেবল রাষ্ট্র-বিরোধী কর্মে যারা নিযুক্ত হয়েছে, তারা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ওদিকে কমিউনিস্ট দেশগুলোতে যারা শুধুমাত্র স্বাধীনতা চেয়েছিল তাদের উপর বর্বরতার রেলগাড়ি চালানো হয়, তাদেরকে হত্যা করা হয় লাখে লাখে।

চঞ্চল ভাই আরও লিখেছেনঃ

এটি মোটেও সত্য নয় যে মার্কসবাদী তত্ত্ব গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিরোধী বলে আমেরিকা এই তত্ত্বের প্রবলভাবে বিরোধী। মার্কসবাদী তত্ত্ব এক সময় বিশ্ব জুড়ে উপনিবেশিক ও নয়া-উপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের জনগণের জন্য তাদের দেশকে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার হাতিয়ার হিসাবে দেখা দিয়েছিল।

কমিউনিজম নিঃসন্দেহে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিরোধী। এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই, অন্তত জাতিসংঘ সংবিধানের মানবাধিকার আইনের নিরিখে। মার্ক্সবাদ ও পুজিবাদী উদার গণতন্ত্র দুই-ই পাশ্চাত্যের সৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বকে ধ্বংস করার প্রত্যয়েই কমিউনিজমের জন্ম হয়েছিল। তবে এটা অনেকটা আত্ম-বিরোধী ধারণা যে, উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল মার্ক্সবাদ। কেননা বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলন ছিল জাতীয়তাপন্থী, অথচ মার্ক্সবাদ হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাপন্থী। কাজেই মার্ক্সবাদ ও জাতি-রাষ্ট্র বাদী আন্দোলন পারষ্পারিক বিরুদ্ধ ধারণা। তবে কূট মার্ক্সবাদীরা জাতীয়তাবাদের ভাণ ধরে কোন কোন উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে, সেটাও সত্য। তবে পরষ্পর-বিরোধী মার্ক্সবাদ ও জাতীয়তাবাদের মাঝে সে সখ্যতা ছিল মূলত ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ সে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, যেমন করে হিটলার ও কমিউনিস্ট রাশিয়ার মাঝে একতা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে।

এবং এমন সখ্যতার ফলাফল হয় খুবই বিপজ্জনক, যা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিল সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া। এবং রাশিয়ার সাথে সখ্যতা স্থাপন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারী দেশগুলোর (যেমন রোমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব-জার্মানী, উত্তর কোরিয়া ও অন্যান্য) অভিজ্ঞতাও একই। ফলে আমরা দেখেছি, রাশিয়ায় হস্তক্ষেপে বা মদদে যেখানেই মার্ক্সবাদ সফল বিপ্লব চালিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা আরোপ করেছে, সেখানেই জনতা আবার বীভৎস কমিউনিস্ট নৃশংসতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে পাশ্চাত্যীয় গণতন্ত্র ও মানবাধীকারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। কাজেই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের জন্য মার্ক্সবাদ’ই ছিল পরম বন্ধু, সে ধারণা সঠিক নয়। বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলে আমরা ঠিকই আবার গণতন্ত্রের হাতিয়ার হাতে যুদ্ধে নামতাম, যেমনটি ঘটেছে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া-সহ পূর্ব-ইউরোপীয় ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে।

এক কথায়, গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র দুই-ই ইউরোপের উদ্ভাবিত সমাজতত্ত্ব। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য কখনো সাথী হয়েছে সমাজতন্ত্র, আবার কখনো গণতন্ত্র। এবং চূড়ান্ত বিচারে সমাজতন্ত্র দীর্ঘমেয়াদী ও কল্যানকর সাথী হয় নি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, তা নিঃসন্দেহে মানবতার জন্য নিষ্ঠুরতম শত্রুদের একটি হিসেবে গণ্য হবে।

চঞ্চল ভাই আমেরিকার ইসলাম-প্রীতিমূলক নীতির প্রতিও অঙ্গুলী তুলেছেন। বিশেষত আফগানিস্তানে জিহাদি মৌলবাদের উৎপত্তিতে আমেরিকার ইন্ধন-দানের প্রতি সবাই অঙ্গুলী উত্থাপন করে থাকে। তবে সোভিয়েট রাশিয়ার উগ্রবাদী ইসলাম-প্রীতির কথা কখনোই কেউ উল্লেখ করবে না, বিশেষত মার্ক্সিস্টরা।

প্রথমেই বলে রাখা আবশ্যক যে, বিশ্বের অরাজক অবস্থা এমন যে, সেখানে সবসময় নৈতিক অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয় বা ছিল না – হোক সে গণতান্ত্রিক পাশ্চাত্য কিংবা সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার জন্য। তবে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার উগ্র ইসলামপন্থীদের সাথে সখ্যতা আমেরিকার তুলনায় আরও পুরানো ও গভীর। এ প্রসঙ্গে আধুনিক উগ্র মৌলবাদী ইসলামী আন্দোলনে প্রথম অনুপ্রেরণাদানকারী ইরানী মুল্লাতন্ত্রের সাথে সোভিয়েট রাশিয়ার অচ্ছেদ্য সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওদিকে আফগানিস্তানে উগ্রপন্থী জিহাদি ইসলামের উস্কানি দানের মূল হোতা সোভিয়েত রাশিয়া, সেখানে আমেরিকার ভূমিকা আসে রাশিয়ার পর। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত ধারণা পেতে দেখুন আমার সাম্প্রতিক রচনা, আমেরিকা চলমান ইসলামি জিহাদের জন্মদাতা? নাকি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া?।

মুসলিম দেশের স্বৈরাচারী সরকারগুলোর সাথে আমেরিকার সুসম্পর্কের নিন্দায় অনেক কিছুই বলা হয়, চঞ্চল ভাইও তা উল্লেখ করেছেন। উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতির অংশ হচ্ছে বিশ্ব-স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রাষ্ট্রগুলোর মাঝে সুসম্পর্ক, পরষ্পর-নির্ভরশীলতা ও পারষ্পারিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি বিশ্বকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস। মুসলিম দেশগুলোর সাথে আমেরিকার সম্পর্কও সে ভিত্তিতেই পরিচালিত। এবং আরব বিশ্বের দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখি, যেসব দেশের রাষ্ট্রনায়কগণের সাথে আমেরিকার সুসম্পর্ক ছিল, তারাই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সভ্যতম অংশ। কাজেই আমেরিকার মিত্র মিশরের মুবারক, তিউনিসিয়ার বেন আলী ও ইয়েমের আব্দুল্লাহ সালেহ স্বল্প রক্তপাতেই ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকা-বিরোধি স্বৈরশাসকগণ, যেমন গাদ্দাফি এবং আসাদ চরম বর্বরতা ও গণহত্যা চালাচ্ছেন বা চালিয়েছেন ক্ষমতা ধরে রাখতে। এবং মধ্যপ্রাচ্যে গণবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অবস্থান এটাও প্রতীয়মান করে যে, আমেরিকা সবসময় স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষে থাকবে। কাজেই জনতা বড় সংখ্যায় রাস্তায় নামতে-না-নামতেই আমেরিকা তাদের একনায়ক দোসর মুবারক, বেন আলী ও আব্দুল্লাহ সালেহকে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বললেন। অথচ রাশিয়া ও চীন সিরিয়ায় ব্যাপক গণহত্যা চলা সত্ত্বেও আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে।

চঞ্চল ভাই আরও লিখেছেনঃ

অপর দিকে মার্কসবাদী তত্ত্ব যেমন তেমনি এই তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক পৃথিবী আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে ও মর্যাদার সাথে দাঁড়াবার প্রেরণা যোগায়। তাই আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের জন্য মার্কসবাদী বা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বিপদজনক। এখানেই ভন্ডামীর খোলস ভেঙ্গে তাদের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে।

উপরে বলা হয়েছে যে, মার্ক্সবাদ আন্তর্জাতিকতাপন্থী এবং তা এক-কেন্দ্রিক স্বৈরাচারী; ফলে না সে জাতীয়তাপন্থী, না স্বাধীনতাপন্থী। কাজেই চঞ্চল ভাই’র এ উক্তি সঠিক নয়। বরং জাতীয়তার ধারণা পাশ্চাত্যের উদার গণতান্ত্রিক ধারণা মাঝেই নিহিত এবং সেখানে তার উৎপত্তি। মার্ক্সবাদের উৎপত্তি হয়েছিল উদার-গণতান্ত্রিক বিশ্ব উদ্ভাবিত জাতীয়তা তথা জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা ও ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করতে।

উপনিবেশগুলোতে, যেমন ভারতে, দেশাত্ববোধ ও তার ফলশ্রুতিতে জাতীয়তাবাদ এবং উপনিবেশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন -- এগুলোর সবকিছুর মূলেই ছিল পশ্চিমা ইউরোপের উদার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধারণা, মার্ক্সবাদ তত্ত্বগতভাবে তার পরিপন্থী। উল্লেখ্য, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারত-সহ উপনিবেশগুলোতে দেশাত্ববোধ ও জাতীয়তাবাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। যেমন বাংলায় এগুলোর বীজ রোপিত হতে শুরু করে উনবিংশ শতকের শুরুতে। আর মার্ক্সিস্ট প্রভাব ভারতবর্ষে প্রবেশ শুরু করে এক শতাব্দী পরে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লবের পর। ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল গৌণ।

এরপর চঞ্চল ভাই আমেরিকান সাংবাদিক টিম ওয়েইনারের “লিগেসি অব অ্যাশেজ: দি হিস্ট্রি অব সিআইএ” বইটির উপর বিষদ আলোকপাত করত আমেরিকার যাবতীয় কুকীর্তির কথা উল্লেখ করত লিখেছেনঃ

বইটিতে সি,আই,এ,-এর মূলত ব্যর্থতার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে রাশিয়া, চীন, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার সফল ও ব্যর্থ সামরিক অভিযান পরিচালনার অসংখ্য বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এক কথায় সিআইএ-এর জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে দেশে নাশকতামূলক তৎপরতা, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, বিপুল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে দেশে দেশে দুর্নীতিবাজ ও দেশদ্রোহী শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো, জাতীয় নেতাদের হত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টা, ইত্যাদির মাধ্যমে গণতন্ত্রের মহান পুজারী আমেরিকা গত প্রায় ষাট বৎসর যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এসেছে তারই চমকপ্রদ বিবরণ পাতায় পাতায় দিয়েছেন সে দেশেরই সাংবাদিক টিম ওয়েইনার। বইটি পড়লে এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের বিশ্বব্যপী যে সন্ত্রাস পরিচালনার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তাতে আমেরিকাকে সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদার চেয়েও ভয়ংকর ও নির্মম মনে হয়।

এ আলোচনা যেহেতু মূল রচনার বিষয়বস্তুর সাথে পুরোপুরি অপ্রাসংগিক, কাজেই বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। তবে আজ চঞ্চল ভাইকে যদি বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হয় এবং সুযোগ দেওয়া হয় আমেরিকা অথবা কোন আল-কায়েদা শাসিত দেশে আশ্রয়ের – উনি মনে হচ্ছে আল-কায়েদা শাসিত দেশে আশ্রয় নেবেন। তবে বৃহত্তর বাংলাদেশী জনতা এবং সিংহভাগ বাংলাদেশী মার্ক্সিস্টরাও আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে। আমেরিকা’ই সর্বাধিক শ্রেয় গন্তব্য বাংলাদেশ-সহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের মানুষের। এবং একইভাবে বলতে হয়ঃ এশিয়ায় আমেরিকার শ্রেষ্ঠ মিত্র দেশ হচ্ছে জাপান, সিংগাপুর, তাইওয়ান, দঃ কোরিয়া ইত্যাদি। এবং সে দেশগুলো এশিয়ার মুক্ততম দেশ এবং আল-কায়েদা শাসিত দেশে থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। বরং বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত রাশিয়ার ইন্ধনে প্রতিষ্ঠিত মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রগুলোই ছিল আল-কায়েদা বা সম-মনা উগ্র ইসলামপন্থী শাসিত ত্রাসপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর কাছাকাছি (যেমন তালেবানী আফগানিস্তান ও আল-কায়েদাপন্থী আল-শাবাব শাসিত সোমালিয়ার অংশবিশেষ)।

যাহোক, মূল রচনা যেহেতু আসাঞ্জের তথাকথিত বাক-স্বাধীনতার লড়াই নিয়ে, আলোচনা সেদিকে ঘুরিয়ে শেষ করি। আমার মূল রচনার বক্তব্য ছিলঃ বর্তমান বিশ্বে বাক-স্বাধীনতার সর্বাধিক মুক্ত চর্চা হচ্ছে ব্রিটেন, আমেরিকা ও সুইডেনের মত উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে, যে প্রসঙ্গে আমি লিখেছিঃ

মানবতার জন্য বাক-স্বাধীনতার উৎকর্ষ সাধনই যদি হতো আসাঞ্জের আন্দোলনের সত্যিকার উদ্দেশ্য, রাশিয়া, একুইডর, চীন বা বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলো হতো তার ক্রুসেডের প্রাথমিক লক্ষ্য, পাশ্চাত্য হতে পারত শেষ লক্ষ্য। কিন্তু আফসোচঃ আসাঞ্জের জগতে রাশিয়া, একুইডরের মত দেশগুলো হচ্ছে বাক-স্বাধীনতার পুণ্যভূমি, আর বদ্ধভূমি হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলো!

চঞ্চল ভাই নিঃসন্দেহে আসাঞ্জের সাথে সহমত প্রকাশ করছেন। তবে আমি আমার উক্ত বক্তব্যে আস্থা রাখি। আমি চঞ্চল ভাই’র উদ্ধৃত টিম ওয়েইনারের “লিগেসি অব অ্যাশেজ: দি হিস্ট্রি অব সিআইএ” বইটির ভিত্তিতেই তা প্রমাণ করছি।

আমেরিকার সংবিধানের ‘ফার্স্ট এ্যামেন্ডমেন্ট’ বাক-স্বাধীনতায় সর্বোচ্চ স্বাধীনতা প্রদান-কারী বক্তব্য নিহিত, যা কেবল সহিংসতা-উদ্রেককারী মতামত ব্যতীত সব মতামতকে বৈধতা দিয়েছে, তা যতই অনভিপ্রেত মনে হোক না কেন। এতটা স্বাধীনতা বিশ্বের অন্য কোন দেশের সংবিধানেই দেওয়া হয় নি। এবং সাংবাদিক টিম ওয়েইনারের উদ্ধৃত বইটিই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। বাক-স্বাধীনতার কারণেই আমেরিকার সরকার বইটির প্রকাশ ও প্রচারণায় বাধা দেয় নি, তার বক্তব্য যতই অনাকাংখিত হোক না কেন। বইটি প্রকাশের জন্য কাউকেই হত্যা করা হয় নি, না কাউকে জেলে যেতে হয়েছে, না কোন হুমকি খেতে হয়েছে। বরং টিম ওয়েইনার বইটি লিখে আমেরিকায় অবাধ বিচরণকারী এক নির্ভিক হিরো হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অনুরূপভাবে রাশিয়ার পুতিন সরকারের গুপ্ত তথ্য ফাস করে দু’টো বই লিখেছিলেন পুতিনেরই প্রাক্তন কেজিবি সহকর্মী আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো (“Blowing up Russia: Terror from within” ও “Lubyanka Criminal Group”), যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং লন্ডনে পালিয়ে ও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক নিরাপত্তা দান সত্ত্বেও তাকে তেজষ্ক্রিয় বিষ (radioactive poison) খাইয়ে হত্যা করার আলোচিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এ ঘটনা-ই পাশ্চাত্যে বাক-স্বাধীনতার চর্চা সম্পর্কে আমার উপরোক্ত বক্তব্যকে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রতিপন্ন করতে যথেষ্ট।

চঞ্চল ভাই লিখেছেনঃ

আলমগীর হুসেন লিখেছেন রাশিয়া, চীন, বা সিরিয়ার মত দেশগুলো যেখানে কোন গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নাই সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য অ্যাসাঞ্জ প্রকাশ করছেন না। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অ্যাসাঞ্জ যদি তাই করতেন তাহলে তাকে মানবতার পরম মিত্র হিসাবে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য ব্যাপকভাব সম্মানিত করত। হয়ত তাকে তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য তাদের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করত!

উদ্ধৃত বক্তব্যটা একেবারেই বাস্তবতা বহির্ভূত। আমরা ব্রিটেনে প্রাক্তন কেজিবি সদস্য আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো কর্তৃক রাশিয়া সরকারের গুপ্ত খবর প্রকাশের ঘটনা আলোচনা করেছি। তবে সে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের কাছে না হয়েছে বড় কোন হিরো, না পেয়েছে নোবেল পুরস্কার। এমনকি তাকে এমনভাবে হত্যা না করা হলে পাশ্চাত্যের মানুষ তার নামও জানতো না।

সবশেষে চঞ্চল ভাই’র যে বক্তব্যটুকুর উপর একটু আলোচনা করতে চাই, তা হচ্ছে,

...এভাবে আমেরিকানরা নিজস্ব পথে আমেরিকান হিসাবেই পৃথিবীতে নিজেদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এক্ষেত্রে আমাদের আমেরিকানদের কাছ থেকে শিখবার আছে। ... দালালী করে অন্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে নিজ জতির স্বার্থ রক্ষা করা যায় না। আমরা যদি সমৃদ্ধি, কল্যাণ আর মর্যাদার সাথে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই তবে আমাদেরকেও আমেরিকানদের মতই লড়াইয়ের মাধ্যমে, স্বাধীন ও নিজস্ব পথে এবং আত্মগৌরববোধ নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সে পথ কারও অনুকরণ বা দালালীর পথ হবে না – সে আমেরিকা-ইউরোপ হোক আর চীন বা রাশিয়া হোক।

ব্যক্তিগতভাবে আমি জাতি-বিদ্বেষী নই, তবে মার্ক্সবাদের বিপরীতে বিশ্বের সুষ্ঠ পরিচালনার জন্য জাতীয়তাবাদ এখনও অপরিহার্য মনে করি এবং সে মর্মে আমি জাতি-রাষ্ট্রের ধারণায় বিশ্বাসী। এবং এটাও উল্লেখ্য যে, যে ইউরোপ আধুনিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভাবনকারী, তারা আজ জাতীয়তাবাদের উর্ধ্বে উঠার প্রয়াস চাল্লাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

তবে চঞ্চল ভাই’র উদ্ধৃত বক্তব্য আমি সমর্থন করি – আমাদেরকে সবকিছুই নতুন করে বানাতেই হবে সে বিশ্বাসে নয়, মানবজাতির অগ্রসরে গৌরবজনক ভূমিকা রাখার প্রত্যয়ে। আমরা বাংলাদেশীরা কথা বলতে গেলেই দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কিংবা ইসলামতন্ত্রের কথা বলি। শিক্ষায় ও বিজ্ঞানে আমরা মূলত পাশ্চাত্যীয় ধারা বা সৃষ্টি ব্যবহার করে যাচ্ছি। কেবল ইসলামতন্ত্র ব্যতীত এগুলোর সবই পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। ইসলামতন্ত্রও আরব ভূখণ্ড থেকে আগত। এগুলো বাদ দিয়ে বিশ্ব-পরিচালনায় আমরা নতুন তত্ত্ব বা ধারা হাজির করে সেগুলো দিয়ে মানবতাকে পরিপুষ্ট করতে পারলে সেটা খুবই গৌরবের হবে আমাদের জন্য। প্রয়োজন হচ্ছে সে বিপ্লবী নতুন তত্ত্ব বা ব্যবস্থার উদ্ভাবন করা। শুধু স্বপ্ন দেখায় কোন লাভ নেই।

তবে বহির্দেশীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও বৈজ্ঞানিক ধারা যদি গ্রহণ করতেই হয়, তাহলে আমাদের উচিত সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যা অধিক সুফল এনেছে মানবজাতির কল্যানে। শিক্ষায় ও বিজ্ঞানে পাশ্চাত্য ধারার বাইরে আমরা বাংগালীরা কিছু দাঁড় করাতে পারব কিনা, সে ব্যাপারের আমি সন্দিহান। রাজনীতিতে ইসলামতন্ত্র নিঃসন্দেহে আমার জাতীয় কল্যানে সহায়ক হবে না। কাজেই পুজিবাদী উদার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র – এ দু’টো সমাজতত্ত্বের মাঝ থেকে একটাকে চয়ন করতে হবে আমাদেরকে।

রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও পরবর্তীতে রাশিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপ বা ইন্ধনে আরোপিত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে (উত্তর কোরিয়া, রোমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব-জার্মানী, কম্বোডিয়া ও অন্যান্য) চরম মার্ক্সবাদী বর্বরতা-নৃশংসতা ও ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি। পাশাপাশি এশিয়াতে পাশ্চাত্যীয় উদার গণতন্ত্র ও আমেরিকার সামরিক শক্তির তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠা জাপান, দঃ কোরিয়া ও তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনেই। কাজেই আমরা যেহেতু পাশ্চাত্যে উদ্ভাবিত সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়েই সর্বদা টানাটানিতে ব্যস্ত, আমাদের অতি-আকাংখিত শ্রেয়তর নতুন সমাজতত্ত্ব উপস্থাপন না-করা পর্যন্ত এগুলোর কোনটি আমাদের জাতীয় কল্যানে সহায়ক হবে সেটা স্থির করার ভার চঞ্চল ভাই-সহ পাঠকের কাছেই ছেড়ে দিচ্ছি।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ