লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ December 25, 2012, 6:52 AM, Hits: 2094
(নারীর জন্য ভারত এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র।)
ভারতের রাজধানী দিল্লীর রাজপথ পাশ্চাত্যের পুরুষতান্ত্রিক গণতন্ত্র ও ভোগবাদী পুঁজিবাদী আদর্শের বামন অনুকরণকারীদের দখলে কী পরিণতি নিয়েছে তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দেখা গেল গত ১৬ ডিসেম্বর রবিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাসযাত্রী ২৩ বৎসর বয়সী মেডিক্যাল ছাত্রীর উপর ছয়-সাত পুরুষ যাত্রীর দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ রাতে সেই মেডিক্যালের ছাত্রী তার ছেলে বন্ধুকে নিয়ে বাসে করে যখন বাসায় ফিরছিল তখন বাসে থাকা পুরুষ যাত্রীরা অসহায় মেয়েটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে এবং বাধা দিতে চাইলে তার ছেলে বন্ধুকে লোহার রড দিয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার করে। শুধু তা-ই নয়, ধর্ষণের পাশাপাশি মেয়েটিকেও লোহার রড দিয়ে পৈশাচিকভাবে আঘাত এবং গুরুতর জখম করে। যে অত্যাচার তারা মেয়েটির উপর করে তা এক কথায় হৃদয় বিদারক ও ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মেয়েটিকে ধর্ষণ শেষে তাকে এবং তার ছেলে বন্ধুকে দুর্বৃত্তরা চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরে উভয়কে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। মেয়েটি এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে দিল্লীর রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। আমরা মেয়েটি এবং ছেলেটির প্রতি আমাদের সমবেদনা জানাবার পাশাপাশি আমাদের অভিনন্দন জানাই এই প্রতিবাদী জনতাকে এবং সেই সঙ্গে ঘৃণা জানাই ঐ ধর্ষকদের প্রতি যাদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে চরম অসম্মানের মৃত্যু।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রকাশিত এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিভিন্ন বিবরণ থেকেও নারীর জন্য এক অনিরাপদ নগর হিসাবে দিল্লীর যে চিত্র আমরা জেনেছি সেটারই এক পরিণত চিত্র উপস্থিত করেছে উপরের ঘটনাটি। ভারতের রাজধানী দিল্লী যখন নারীর জন্য বিপজ্জনক এক নগর হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে তখন সমগ্র ভারতের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে। বস্তুত, নারীর জন্য ভারত এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র।
নিঃসন্দেহে পাকিস্তানও নারীর জন্য এক বিপজ্জনক রাষ্ট্র। এই অল্প কিছুদিন আগে ১৪ বছর বয়সী সাহসী কিশোরী ইউসুফজাই মালালা নারী শিক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইসলামবাদী তালেবানের বন্দুক হামলায় গুরুতর জখম হয়ে খুব অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মত নারীর উপর হামলা, আগ্রাসন ও নিগ্রহের ঘটনা হরহামেশা ঘটে। তার সহজ ব্যাখ্যাও আছে। ইসলাম নিজে যেমন অমুসলিম বিদ্বেষী তেমন ভয়ঙ্করভাবে নারী বিদ্বেষী। ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রে নারীর মানবেতর অবস্থান ধর্মীয় বিধানেই নির্দিষ্ট। পাকিস্তান বলে কথা নয়, যে কোন মুসলিম সমাজে নারী নিগ্রহ ও অসম্মানের মূল উৎস যে তার ধর্মীয় মনস্তত্ত্বে নিহিত রয়েছে সেটা সহজে বোধগম্য হতে পারে। কিন্তু হিন্দু প্রধান ভারতে নারীর এই ধরনের বিপজ্জনক অবস্থার কী কারণ হতে পারে? হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থান যত নিম্নে থাক তা দিয়ে ভারত-রাষ্ট্রে বর্তমানে যে ধরনের নিগ্রহ চলছে তাকে পুরা ব্যাখ্যা করা যায় না।
ভারতের তামাশার গণতন্ত্র যা পুরুষতন্ত্র ও ভোগবাদী পুঁজিবাদের আজ্ঞাবহ তা শ্রমজীবী জনগণ, মানবিক মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও জাতিসত্তা, দলিত সম্প্রদায় বা হরিজন এবং বিশেষত নারীর উপর নিপীড়ন ও দলনের এক নির্মম যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এই তামাশার গণতন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়ে ভারতের বোম্বাইয়া চলচ্চিত্র শিল্প এবং নিকৃষ্ট মানের টিভি চ্যানেলগুলি পাশ্চাত্যের উদ্ধত ও উচ্ছৃঙ্খল পুরুষবাদী ও ভোগবাদী পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অন্যতম বাহন হয়ে মানবতা ও নারীত্বের বিরুদ্ধে যে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে তা থেকে আজ ভারতবাসীকে মুক্তির পথ অন্বেষণ করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্যও ভারতের এই নারী নিগ্রহের দৃষ্টান্ত থেকে শিখবার আছে। মনে রাখতে হবে সারা ভারতের অসংখ্য নারী নিগ্রহের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত মাত্র ভারতের রাজধানীর এই কলঙ্কিত ঘটনা। সংবাদপত্রে প্রকাশিত ভারতের National Crime Records Bureau-এর এক সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও অবাধ পুঁজিবাদ ও পুরুষবাদী গণতন্ত্রের মহানায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগ্য শিষ্য বটে "গণতান্ত্রিক' ভারত-রাষ্ট্র!
বাংলাদেশেও অসংখ্য নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটে যার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইকে অব্যাহত রাখতে হবে। এর জন্য আমাদেরকে নারী বিদ্বেষী ইসলাম এবং একই সঙ্গে পাশ্চাত্যের সামাজিক দায়-দায়িত্ব বোধহীন ভোগবাদী পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রী গণতন্ত্রের পরিবর্তে বিকল্প পথ সন্ধান করতে হবে, যা আমাদেরকে দিবে নারীর নিজস্ব মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ। এর জন্য চাই রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে নারীর নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা। নারীর এই নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো শুধু আমাদের দেশের নারীকে নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের নারী সমাজকেও দিবে সর্বোচ্চ অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পথ সন্ধান। তখন যাবতীয় বিনোদন ও প্রচার মাধ্যমে নারীর দেহকে বিপণনের সামগ্রী করার সুযোগ যেমন শেষ হবে তেমন নারী পুরুষকে শিখতে বাধ্য করবে নারীকে সম অধিকার সম্পন্ন মানুষ হিসাবে গণ্য করতে।
২৫ ডিসেম্বর, ২০১২