Banner
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হবেন কারা এবং কীভাবে?’ প্রসঙ্গে আলোচনা -- আজাহারুল ইসলাম

লিখেছেনঃ আজাহারুল ইসলাম, আপডেটঃ January 4, 2013, 4:35 AM, Hits: 1986

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশেও এক কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ...... এই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার যেমন অভাব ছিল তেমনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কর্মীদের প্রায় ঢালাওভাবে দুর্নীতি ও লুটপাটের দৃশ্য মানুষের মনে ক্ষমতাসীন দল ও নেতার প্রতি এক চরম অনাস্থা সৃষ্টি করে। এই রকম সময়েই সর্বপ্রধান নেতার বড় ছেলের বিবাহ হয় স্বর্ণ মুকুট পরে, পত্র-পত্রিকার খবরে যা প্রকাশ পায়। নেতাদের পক্ষ থেকে জনগণের সঙ্গে দুর্ভোগ ভাগাভাগি করে নেওয়ার দৃশ্য কি এটা?
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

 

প্রখ্যাত কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর উপরোক্ত শিরোনামের তিন দফায় লেখা দীর্ঘ কলামটি পড়ার পর গুরুত্ব বিবেচনা করে এ বিষয়ে কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। সুতরাং কিছু দেরীতে হলেও এ বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া জানাতে কলম ধরলাম। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির উপর তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় বিরামহীনভাবে লেখেন। তার লেখার কলাকুশলতা ও শক্তি সম্পর্কে বাংলাভাষী পাঠক মহল সম্যক জ্ঞাত। তার মত নামীদামী লেখকের কোন লেখার সমালোচনা করে কিছু লেখা হয়ত ধৃষ্টতার পর্যায়ে মনে হতে পারে, কিন্তু তবুও কিছু না লিখে পারলাম না।

 

দৈনিক ‘যুগান্তর’পত্রিকায় ‘তৃতীয় মত’ কলামে ২৩ ও ৩০ জুলাই এবং ৭ আগস্ট ২০১২ ইং তারিখে জনাব গাফফার চৌধুরীর উপরোক্ত শিরোনামের লেখাগুলো তিন দফায় প্রকাশিত হয়। গাফফার সাহেব লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন দু’টি প্রধান স্রোত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। স্রোত দু’টি বিপরীতমুখী হওয়া সত্ত্বেও চরিত্রে এক। আওয়ামী লীগ সেক্যুলারিজমের কথা বলে, মুক্তি যুদ্ধের কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলে। বিএনপি কথায় কাজে এই দু’টি আদর্শেরই বিরোধী, কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের যে ভোগবাদী, পুঁজিবাদী এবং দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্ভর অত্যন্ত শক্তিশালী নব্য ধনী শ্রণী গড়ে উঠেছে এবং  সমাজের সর্বস্তরে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তারা দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলকেই তাদের কব্জায় নিয়ে গিয়েছে।’

 

তার তিন দফায় লেখার প্রথম দফা থেকে উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে। এখানে গাফফার সাহেব বলছেন, ‘রাজনীতিতে এখন দু’টি প্রধান স্রোত, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।’তার মানে আরও স্রোত আছে। তাহলে প্রধান দু’টি স্রোত যদি শক্তি হয়, তবে অন্যগুলো কি কোনই শক্তি নয়? যদিও তারা খুব ক্ষীণ বা দুর্বল শক্তি। কেউ সবল শক্তি হওয়ার চেষ্টা করলে সেখানেই গাফফার সাহেবের আপত্তি! কারণ তিন নম্বর শক্তিটি যদি এক নম্বরে চলে যায়, তাই তার যত ভয় বা আপত্তি। প্রথমে তিনি দেখিয়েছেন এ দেশে তিন নম্বর শক্তি হওয়ার মত কোন বাস্তব অবস্থা নাই।  কারণ অনাবাদী জমিতে যেমন কোন ফসল ফলতে পারে না ‘যদি সেই জমি আবাদ করা না হয়।’ ‘সমাজবদলের নতুন নিয়ামক শক্তি যেখানে তৈরী হয়নি, সেখানে নতুন এবং তৃতীয় শক্তি গড়ে উঠবে কী  করে, কাদের দ্বারা?’

 

অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই তিনি এই উদ্ধৃত কথাসহ আরও স্পষ্ট কথা বলেছেন। আমার মনে প্রশ্ন জাগছে তৃতীয় শক্তি কেউ হতেই পারবে না, এত আত্মবিশ্বাস যখন তার মনে, তখন কেন এত গুরুত্ব দিয়ে সে সম্পর্কে এত কষ্ট করে লেখা? তিনি বলছেন, ‘সেখানে (অর্থাৎ বাংলাদেশে - আঃ ইসলাম) কোন নতুন ধারা সৃষ্টির পরিসর সৃষ্টি হয়নি।’তার বর্ণনার ছত্রে ছত্রে সবাইকে ব্যর্থ, অযোগ্য, স্বার্থলোভী, ষড়যন্ত্রকারী ইত্যাদি বলে তাদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন - তারপরও মনে হয়েছে একটা অব্যক্ত আতঙ্ক যেন গাফফার সাহেবের লেখার পিছনে কাজ করছে। তিনি বলছেন, ‘আদর্শ নয়, অর্থ (বেশীরভাগ ক্ষেত্রে কালো অর্থ) এখন সমাজ ও রাজনীতির চালিকা শক্তি এবং যতদিন পর্যন্ত এই দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল এই নব্যবিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ ও আধিপত্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলবে ততদিন দেশটির রাজনীতিতে কোন রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির মাথা তোলার অবকাশ নেই।’ অর্থাৎ এই নব্যধনিক শ্রেণী যতই দুর্নীতি ও সন্ত্রাস নির্ভর হোক না কেন, ‘যতদিন পর্যন্ত এই দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল এই নব্য বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ ও আধিপত্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলবে, ততদিন দেশটির রাজনীতিতে কোন রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির মাথা তোলার অবকাশ নেই।’

 

তার এই কাংঙ্ক্ষিত সিদ্ধান্ত সঠিক বা বেঠিক যা-ই হোক বাংলাদেশের দুর্নীতিপরায়ণ, সন্ত্রাস নির্ভর অত্যন্ত শক্তিশালী এই নব্যধনী শ্রেণীর স্বার্থেই এ দেশেও গ্রেট ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের মত দ্বিদলীয় ব্যবস্থা বজায় রাখার পক্ষে তার বলিষ্ট বক্তব্য দৃষ্টি কাড়ে। গাফফার সাহেবের দীর্ঘদিনের আবাস স্থল বৃটেনের উদাহরণ প্রথম ও শেষ দফার লেখায় দুই দুই বার বিস্তৃতভাবে তুলে ধরে দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রতি গভীর দরদ প্রকাশ করেছেন। তার মতে এই গড়ে উঠা ‘অত্যন্ত শক্তিশালী নব্যধনী শ্রেণী’যারা ‘সমাজের সর্বস্তরে আধিপত্য বিস্তার করেছে, তারা দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলকেই তাদের কব্জায় নিয়ে গিয়েছে।’এখানে আমার প্রশ্ন, সত্যটা কি তাই? গাফফার সাহেবের বর্ণিত এই ভোগবাদী, পুঁজিবাদী এবং সন্ত্রাস নির্ভর অত্যন্ত শক্তিশালী নব্যধনী শ্রেণী কীভাবে সমাজে গজিয়ে উঠলো? কাদের গর্ভে তারা জন্ম নিল? কারা তাদের আতুর ঘরের সেবা বা আশ্রয়-প্রশয় দিয়েছে? কাদের আশ্রয়ে এত বড় হলো, বেড়ে উঠল এবং এত বড় ‘অত্যন্ত শক্তিশালী নব্যধনী’ হয়ে উঠলো? এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে গাফফার সাহেব কখনও কিছু বলেছেন বলে আমার জানা নাই। আমার চোখে কখনও পড়ে নাই। মনে হয় তিনি সেগুলো সযত্নে এগিয়ে চলেন।  তিনি তো এই ‘নব্যধনী’দের ‘কব্জাকরা’ বাংলা দেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থার স্থিতি চান। যেন বহাল তবিয়তে তা টিকে থাকে!

 

কিন্তু বাংলাদেশের আপামর জনগণের প্রশ্ন, কেন স্বাধীনতার পর থেকে এই লুটেরা ধনিক শ্রেণীর সর্বরকম নিয়ম বহির্ভূত লুণ্ঠনকে প্রতিহত করা হলো না? সর্বগ্রাসী লুণ্ঠনের এই প্রক্রিয়াকে কেন নিয়ন্ত্রণ করা গেল না? জন্মাবার পূর্বেই তো তাদের নিশ্চয় শক্তি ছিল না। বিভিন্নভাবে লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাদের জন্ম ও বিকাশ, তাদের শক্তি বৃদ্ধি। গাফফার সাহেবের কাছে এ প্রশ্নগুলো করতে ইচ্ছা করে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর গাফফার সাহেবের কেমন লাগবে আমি জানি না। কিন্তু বাস্তব সত্যটা কি দেশের সাধারণ মানুষ সবাই ভুলে গেছে? মনে হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্র শক্তির ছত্রছায়ায়ই  গাফফার সাহেবের বিশেষায়িত ঐ নব্যধনী শ্রেণী জন্ম নিয়েছে, বড় হয়েছে এবং আজকের মহাশক্তিশালী প্রধান দুই দলকেই ‘কব্জায়’ নিয়ে নিয়েছে। তিনি যে কেন এই নব্যধনী শ্রেণীর জন্ম ও বিকাশ বাদ দিয়ে শুধু দুই দলকে ‘কব্জা করার’কথাটাই শুধু বলেছেন পাঠকবৃন্দ আশা করি তা উপলব্ধি করতে পারবেন। কারণ তাতে করে যে এই শ্রেণীর জন্ম ও উত্থানের দায় আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের উপরে গিয়ে পড়বে! সেটা কি তিনি করতে পারেন? সব নষ্টের গোড়াকে তাহলে তিনি আড়াল করবেন কী করে?

 

তিনি আরো বলেছেন, ‘যত দিন পর্যন্ত এই দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল এই নব্য বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ ও আধিপত্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলবে, ততদিন দেশটির রাজনীতিতে কোন রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির মাথা তোলার অবকাশ নেই।’

 

কী নিশ্চিত সিদ্ধান্ত, কী দরদ ভরা দৃঢ় আস্থা! তার এই আস্থা বা সিদ্ধান্ত বা মন্তব্য সঠিক বেঠিক যা-ই হোক একটা বিষয় অতি পরিষ্কার, এই লুটেরা নব্যধনীদের স্বার্থ রক্ষাকারী দলই ক্ষমতায় টিকে  থাক এটাই তার একান্ত কামনা। তারই সমর্থনে ইংল্যান্ডসহ পাশ্চাত্যের দ্বিদলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান সম্ভব নয়।

 

তিনি তার লেখার দ্বিতীয় কিস্তির এক জায়গায় নব্য বুদ্ধিজীবীদের অর্থবিত্ত প্রতিপত্তি বাড়ার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, রাতারাতি এই অর্থ-বিত্ত বাড়ার পদ্ধতিটা নিয়ে। ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে লুটেরা শ্রেণীর জন্ম হয়, স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সামরিক বাহিনীকে সামনে রেখে ক্ষমতা দখল করে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির কর্তৃত্ব তাদের অবাধ লুটপাটের পথে অন্তরায়, এ জন্য ঢালাওভাবে শুরু হয় রাজনীতি, রাজনীতিকদের চরিত্র হনন।’ কিন্তু তিনি কি সত্যি সত্যি ‘রাতারাতি অর্থ-বিত্ত বাড়ার পদ্ধতিটা’ জানেন না? তিনি নিজেই বলছেন ‘লুটেরা শ্রেণী’। তাহলে এই শ্রেণী স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছর ধরে লুট করেছে নিশ্চয়! নয় কি ? তাহলে এই সাড়ে তিন বছর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল তারা কী করছিলো? নিশ্চয়ই তাদের সেই লুটপাটে সাহায্য সমর্থন দিয়েছে রাষ্ট্রশক্তি। অথবা দেখেও একেবারে না দেখার ভান করেছে। অবৈধ লুটপাটে কোন বাধাই দেয় নাই। না হলে মাত্র সাড়ে তিন বছরে এমন ক্ষমতা অর্জন করল কী করে? তাদের লুটপাটের কথা গাফফার সাহেবকে স্বীকার করতে হয়েছে। থলের বিড়াল তাই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মুক্ত, যেমন খুশী তেমন লুটপাট ও দুর্নীতির পথে পুঁজি বিকাশের যে পদ্ধতি বা দর্শন, লাগামহীন পুঁজিবাদী যে দর্শন সেখানে গাফফার সাহেবরা কি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে নিয়মনীতিতে আবদ্ধ, সুশীল, সুসভ্য, ভদ্র ও বিবেকবান একটি পুঁজিবাদী বা ধনিক সমাজ চান? পাথরের স্বর্ণমূর্তি ? তাতো কখনও হয় না। রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্র পরিচালনাকারী নেতৃত্ব ও আমলাদের সহযোগিতায় মূলত উৎপাদনশীলতা বিরোধী এবং লুটেরা যে ধনিক শ্রেণীটির জন্ম ও বিকাশ তা কি ধর্মের ছালা গায়ে দিয়ে দরবেশ হয়ে যাবে? কী আশা করেন গাফফার সাহেবরা? আইয়ূব খানের নীতি বা কৌশলের বর্ণনা দিয়েছেন গফফার সাহেব। কিন্তু গোটা লুণ্ঠনমূলক এবং সাম্রাজ্যবাদের অধীনন্থ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কর্মনীতিই তো তাই। কখনও গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে, আবার প্রয়োজনে কখনও স্বরূপে অস্ত্রের জোরে লুণ্ঠন ও শোষণ কায়েম রেখে লুণ্ঠন নির্ভর ব্যবস্থা রক্ষা করাই তো তাদের কাজ।

 

তারা প্রয়োজনে জনপ্রিয়তা হারানো রাজনীতিকদের নিন্দা করবে। আবার প্রয়োজনে তাদেরকেই সামনে নিয়ে আসবে গণতন্ত্রের আবরণ দেবার জন্য। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিয়ে সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে, সামরিক রূপের শাসন পদ্ধতিই হোক আর গণতান্ত্রিক রূপের শাসন পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন। এটা অনেক পুরোনো খেলা।

 

বর্তমান বিশ্ব যখন খুব ছোট হয়ে গেছে তখন সারা বিশ্ব জুড়ে লুণ্ঠন তাণ্ডবের সর্দার সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে যোগসাজশ করেই আবার প্রতিটা দেশের লুণ্ঠনকারী এই ধরনের ধনিক শ্রেণীকে চলতে হয়। কারণ আন্তর্জাতিক লুণ্ঠনকারীদেরকে অর্থাৎ ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম’কে সুযোগ না দিয়ে বর্তমান বিশ্বে দেশীয় লুণ্ঠনকারী বা ‘নব্যধনীরা’ চলতে পারে না। তাই গাফফার সাহেব বর্ণিত ‘নব্যধনী’রা শুধু লুণ্ঠনকারীই নয়, তারা আন্তর্জাতিক লুণ্ঠনকারী বা ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের’এজেন্ট বা দালালও বটে। কিন্তু এদের মধ্যে আবার স্বার্থের দ্বন্দ্বও থাকে। ভাগবাটোয়ারার দরকষাকষি, একে অন্যকে টেক্কা দেবার নানা কৌশল বা চাপাচাপি চলতে থাকে। তাই স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে আন্তর্জাতিক এই এজেন্ট শ্রেণীর  মধ্যে গ্রুপিং বা দলাদলি থাকাটাই স্বাভাবিক। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ক্যাপিটালিজম’ নিজেদের প্রয়োজনে নানা চক্রান্ত করে। সিংহাসনে উলটপালট ঘটায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারা তা-ই ঘটিয়েছিল গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম’-এর বড় সর্দার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচণায় এবং স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী চক্রের সহযোগিতায় সামরিক বাহনীর ভিতরকার দলালদের দ্বারা এবং যার নেতৃত্বে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও দলীয় নেতা। কাজেই গাফফার সাহেব যখন বলেন যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে লুটেরা শ্রেণীর জন্ম হয়, তারা স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সামরিক বাহিনীকে সামনে রেখে ক্ষমতা দখল করে তখন কী বুঝবো! গাফফার সাহেবের কথা অনুসারে সামরিক বাহিনীকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরের লুটেরা শ্রেণীর একটি অংশ ক্ষমতা দখল করেছিল! এটা কি পুরা সত্য কথা? না। তাহলে সেই লুটেরা ধনী শ্রেণীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক লুটেরা সর্দার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য সামাজ্যবাদী শক্তিকে আড়াল করা হয়।

 

অবশ্য তার লেখার তৃতীয় দফায় তিনি ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের’ ছত্রছায়ায় পরিচালিত বৃহৎ এনজিও দানবের থাবার বর্ণনা দিয়েছেন -- কীভাবে মিডিয়া অর্থাৎ পত্র-পত্রিকা, টিভি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, বুরোক্র্যাট ইত্যাদি শ্রেণীপেশার মানুষের মধ্যে তাদের নিজস্ব লোক বা এজেন্ট সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে সবাই একই সঙ্গে রা রা করে উঠে। গাফফার সাহেবের এসব বিষয়ে বর্ণনা অত্যন্ত সঠিক এবং এটা শুধু এখন নয় অনেক পূর্ব থেকেই চলছে এবং ক্রমবর্ধমানভাবেই চলছে। কিন্তু ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হচ্ছে কেন? গাফফার সাহেবের বর্ণনা অনুসারে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের দেশীয় এজেন্টদের এতই শক্তিশালী করা হয়েছে যে, এরা যে কোন উন্নয়নশীল দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের পুরোপুরি আজ্ঞাবহ নয় এমন দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণের ক্ষমতা রাখে। হ্যাঁ! তার এ কথাটির সঙ্গেও আমি সহমত পোষণ করি। তার বর্ণনাতেই আছে যে, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইদানীং তারা এই কৌশল নিয়েছে। সামরিক উর্দী দেখলে জনগণ এখন সহজেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে বলেই এই নয়া কৌশল। প্রয়োজনে তারা যে কোন কৌশল নিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক কালের আরব বসন্তের মত কৌশল থেকে ইরাক বা আফগানিস্তনের মত যে কোন কৌশল। অর্থাৎ সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগের কৌশলও তারা নিতে পারে। এসব বিষয়ের বর্ণনার মধ্য দিয়ে জনাব গাফফার বলেছেন যে, এরা যে কোন উন্নয়নশীল দেশে ‘সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের পুরোপুরি আজ্ঞাবহ নয় এমন দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণের ক্ষমতা রাখে।’ অবশ্য গাফফার সাহেব এখানে বলছেন ‘সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদের পুরোপুরি আজ্ঞাবহ নয়’ অর্থাৎ আজ্ঞাবহ তবে কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব চলছে এমন দুর্বল গণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণের ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রেও তার মতামতের সঙ্গে সহমত পোষণ করি।

 

অবশ্য একেবারে আজ্ঞাবহ না হলে সে সরকারকে অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হতে হবে এবং জনগণ অন্ত:প্রাণ হতে হবে। অর্থাৎ দেশের সর্বসাধারণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে।  দেশের সম্পদ যাতে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের দেশীয় দালাল শ্রেণী অবাধে লুটপাট করতে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিতে হবে, জনস্বার্থের সেবক হতে হবে। তবেই জনগণও সেই নেতৃত্বকে সাম্রাজ্যবাদের সকল চক্রান্ত থেকে রক্ষা করবে। তাহলে দুর্বল ও অনুন্নত হলেও সে দেশের সরকারকে যখন তখন যেমন খুশী পরিবর্তন যে করা যায় না তারও দৃষ্টান্ত আছে। আমি সেরকম একটা দৃষ্টান্ত সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।

 

সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনকারীদের  সর্দার, ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের’ শীর্ষ নেতা মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শোষণ জর্জরিত ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শোষণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উচ্চকণ্ঠ। তিনি সাম্রাজ্যবাদী শোষণের পথ ক্রমান্বয়ে বন্ধের কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, জনগণ অন্ত:প্রাণ, সাহসী নেতা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই তাকে সহ্য করতে পারছিল না। সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে চক্রান্ত করে এক ক্যু-এর মাধ্যমে শ্যাভেজকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দী করা হয়।  সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের খবর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের  সাধারণ মানুষ রাজধানী শহর কারাকাস থেকে শুরু করে সকল শহর ও গ্রামাঞ্চলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। দুই দিন পর্যন্ত তারা ঘরে ফেরে না। শহর-বন্দর গ্রাম সর্বত্র রাস্তাঘাট জনগণের দখলে। অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবার আশঙ্কায় সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। শ্যাভেজকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় বসাতে বাধ্য হয়। ক্ষমতায় বসেই শ্যাভেজ বিদ্রোহী সেনা প্রধান ও তার সহযোগীদের অপসারণ ও বিচার করে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। জনগণ হঠাৎ করে এমনভাবে সংগঠিত হলো কী করে? মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে, শুনেছি মাত্র এক কি দুই ঘন্টার মধ্যেই জনগণ দেশের সমস্ত রাস্তাঘাট দখলে নিয়ে নেয় - যে কারণে বিদ্রোহী সেনা নেতৃত্ব শ্যাভেজকে বন্দী করেও হত্যা করার সাহস করে নাই! কিন্তু প্রশ্ন একটাই, এত দ্রুত জনগণ এই প্রতিক্রিয়া ও কর্মযজ্ঞ দেখালো কী করে? শ্যাভেজের নির্লোভ, নিঃস্বার্থ ত্যাগ, সততা, বিচক্ষণতা ও সবকিছু জনগণের স্বার্থে করার কারণেই তিনি জনগণের প্রকৃত নেতায় পরিণত হয়েছেন। তার নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ আস্থা বা বিশ্বাস থাকার কারণেই এমনটা হতে পেরেছে। তার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বলিষ্ঠ নীতি, সকল কাজের স্বচ্ছতা, সততার আদর্শের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

 

ল্যাটিন আমেরিকার আরেক দেশ বলিভিয়া । সে দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষক, আর প্রধান কৃষি সম্পদ কোকো। এই কেকো চাষীদের নির্মমভাবে ঠকিয়ে  সমস্ত কৃষি পণ্যের ব্যবসাসহ সব ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্লোবাল’ পুঁজির নিয়ন্ত্রকেরা। তারা এটা করত সে দেশের দালাল পুঁজিপতি, দালাল রাজনীতিবিদ ও দালাল আমলাতন্ত্র ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যেকার এজেন্টদের মাধ্যমে। একজন নবীন কোকোচাষী মোরালেসা এই শোষক চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কেকো চাষীসহ সমগ্র দেশবাসীকে আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে সংগঠিত করেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে বিদেশীদের লগ্নীখামার জাতীয়করণ করে শোষণের লাগাম টেনে ধরেছেন। ক্রমান্বয়ে দেশীয় পুঁজি ও শিল্প বিকাশে সহায়তা করেছেন এবং বিদেশী শোষণকে উচ্ছেদ করেছেন। সমাজ থেকে অসৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তি এবং সৎ ও দেশ প্রেমিক পুঁজির বিকাশের পথ বাধামুক্ত করেছেন। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষার ব্যবস্থাসহ  জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। যার কারণে হাজার রকম প্রচেষ্টা করেও মার্কিন সরকার মোরালেসাকে বলিভিয়ার ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে পারে নাই।

 

জনগণকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ণ সচেতন করেই এগিয়ে চলেছেন মোরালেসা। এর ফলে জনগণ ক্রমবর্ধমান হারে সচেতন ও সংগঠিত হয়ে তার নেতৃত্বে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করছে। এখন ল্যাটিন আমেরিকার বেশীর ভাগ দেশ থেকেই সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ক্রমান্বয়ে প্রতিহত হচ্ছে। ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশ এক জোট হয়ে একটা আঞ্চলিক ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। যার মাধ্যমে তারা সেই অঞ্চলের তুলনামূলক দুর্বল দেশ ও সরকারগুলোকে নিম্ন সুদে উন্নয়ন সহায়তা দিতে পারে। এভাবে তারা ল্যাটিন আমেরিকা থেকে বিশ্ব ব্যাঙ্কের কার্যক্রম বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রকাশ্য ও গোপন, লিখিত ও অলিখিত নানা শর্তের মাধ্যমে দেশের জনগণকে শোষণ করে এবং নানাভাবে সরকারকেও নিয়ন্ত্রণ করে। আসলে ‘গ্লেবাল ক্যাপিটালিজমের’ অন্যতম কৌশলী বাহন বিশ্ব ব্যাঙ্ক।

 

ল্যাটিন আমেরিকায় আজকের এ অবস্থার প্রায় ৫০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পেটের মধ্যে অর্থাৎ তার সীমানা থেকে মাত্র ৯০ মাইল সাগর পেরিয়ে একটা ছোট্ট দ্বীপ দেশ কিউবা। সেখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল অত্যাচারী গণ-নিপীড়ক স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। টগবগে এক কিউবান জোয়ান। অর্থনীতিসহ ৪টি বিষয়ে মার্কিন মুল্লুকের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  সবেমাত্র মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়েছেন। দেশের দুরবস্থার কারণ অত্যাচারী স্বৈরাচারী বাতিস্তাকে উচ্ছেদের  সিদ্ধান্ত নেন। অত্যাচারের ফলে কোন নিয়মতান্ত্রিক পথ খোলা না থাকায় পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রী করে অস্ত্র কিনে ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোসহ কিছু সংখ্যক দেশ প্রেমিক, নিবেদিতপ্রাণ যুবককে সংগঠিত করে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে প্রথমে যুদ্ধে পরাজিত হন। একবার একেবারে মৃত্যুর হাত থেকে কোন রকমে বেঁচে যান। যুদ্ধস্থানের কাছের আখখেতের ভিতর দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। তারপর সংগঠিত হয়ে পুনঃপুনঃ আক্রমণের মাধ্যমে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। বিপ্লবী যুদ্ধে চে গুয়েভারা ফিদেলের সঙ্গে যোগ দেন এবং বিপ্লবের সফলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রা ৫০ বছর ক্ষমতায় থেকে আধুনিক ও উন্নত কিউবা নির্মাণের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। এটা ছিল কঠিন সংগ্রাম, যাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীদের যাবতীয় চক্রান্ত ও বিরোধিতা বা বাধাকে মোকাবিলা করে এগিয়ে নিতে হয়েছে। তারপর ক্যাস্ট্রো স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নিজ শরীরের ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে নিজেকে সুস্থ করে তোলেন। তারপর থেকে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা দানে মসিযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। অর্থাৎ লেখার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী সকল শোষণের বিরুদ্ধে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার জনগণকে সচেতন করার কাজে নিজেকে লিপ্ত করেছেন। ইতিমধ্যে শুধু কিউবায়ই নয়, উপরন্তু সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকাতেই জনগণের স্বার্থের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনার উপযোগী শক্তি গঠনে, জনচেতনা সৃষ্টিতে, সততা এবং দেশ প্রেম জাগ্রত করতে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এক প্রতীকী মহানায়কে পরিণত হয়েছেন।

 

তাই আজ ক্যস্ট্রো শুধু কিউবার নয়, বরং সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের কাছে এক প্রতীকী মহানায়ক। শ্যাভেজ, মোরালেসাসহ ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় সব রাষ্ট্রনায়কই তাকে যার যার মত করে অনুসরণের চেষ্টা করছে। অর্থাৎ গোটা ল্যাটিন আমেরিকার জন্য ক্যাস্ট্রো একজন নৈতিক ও আদর্শিক নেতায় পরিণত হয়েছেন। অথচ তাঁর ক্ষমতায় থাকাকালীন সমগ্র সময়টায় অর্থাৎ ৫০ বছর ধরেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা করেছে। তাকে শতাধিকবার (১২৪ বা ১২৭ বার) গুপ্তহত্যার চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। নিঃস্বার্থভাবে পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা এবং জনগণকেও সেভাবে তৈরী করতে পারার  কারণেই ক্যাস্ট্রোর পক্ষে সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্তকে নস্যাৎ করে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তার বিরুদ্ধে অপ্রপ্রচারের জন্য সকল প্রকারের মিডিয়া ব্যবহার করে নাই? বরং অত্যন্ত বেশী বেশী করেই তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে সব ধরনের মিডিয়ার মাধ্যমে। মনে হতে পারে কিউবাতে কি কোন সমাজ বিরোধী, গণবিরোধী স্বার্থপর বদ বা দুষ্ট শ্রেণীর লোক মোটেই ছিল না বা নাই যারা সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তা করে বা দালালী করে? পৃথিবীর সব দেশেই এই শ্রেণীর কিছু মানুষ থাকেই এবং কিউবাতেও ছিল বা এখনও আছে। কিন্তু দেশের জনগণ যদি বোঝে যে, একজন নেতা সত্যি সত্যি নিবেদিত প্রাণ, প্রচার নয় বরং তার কাজের মাধ্যমে তা উপলব্ধি করতে পারে, তবে তারা সত্যি সত্যি নেতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অসাধ্য সাধন করতে পারে। তারই উদাহরণ ফিদেল ক্যাস্ট্রোর দীর্ঘ জীবন ও কর্ম, দ্বীপরাষ্ট্র কিউবা।

 

কিন্তু আমাদের দেশের উদাহরণ দুর্ভাগ্যবশত উল্টা। আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যে নেতার নেতৃত্বের নামে সংঘটিত হলো, তিনি যুদ্ধের সময় থাকলেন না রণাঙ্গনে। তার প্রতীকী নেতৃত্বে যুদ্ধ চলছে, তিনি পাকিস্তানী কারাগারে। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে  পাকিস্তানী বাহিনী গোলাগুলী ছোঁড়ার মাধ্যমে এক প্রচণ্ড নরমেধ যজ্ঞ শুরু করে। তার কোন শব্দ পৌঁছালো না নেতার কানে। তিনি তখন বিমানে চেপে বাতাসে ভেসে ভেসে করাচীর মৌরীপুর বিমান বন্দরের অভিযাত্রী। কীভাবে আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ হলো তিনি কিছুই জানতে পারলেন না। জানতে পারলেন না কীভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হলো এবং ৯ মাস যুদ্ধের পর কীভাবে বিজয় সম্পন্ন হলো। কিছুই তিনি জানতে পারেন নাই। তাকে কোন খবরের কাগজ কিংবা কোন রেডিও খবরও শুনতে দেয়া হয় নাই। এসব খবরাখবরের ব্যাপারে পুরো অন্ধকারেই ছিলেন তিনি। সেখান থেকে  মুক্তি পেয়ে এসেই সদ্য স্বাধীন দেশটির দায়িত্ব নিলেন। জগণের এক বিপুল অংশ মনে করে, পাকিস্তানীদের সঙ্গে আলোচনা যখন ভেঙ্গে গেল, যার সকল আলামত পূর্বেই জানা গিয়েছিলো, তখন যদি নেতা আত্মগোপনে চলে গিয়ে নিজে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, ভিয়েৎনামের হোচিমিন-এর মত, তাহলে যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় প্রত্যক্ষভাবে সমৃদ্ধ হয়ে দেশ পরিচালনায়ও অনেক বেশী সফলতা আনতে পারতেন, এবং প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান রোধ করাও হয়তো সম্ভব হতো।

 

জনগণের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করলে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়তো। দুঃখ-দুর্দশা ভোগ করলেও জনগণ মনে করত নেতা তো কষ্ট করে আমাদের মাঝে থেকেই আমাদের জন্য, দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করছেন; অতএব কোন কষ্টই আর কষ্ট নয়। সব কষ্টই জয় করতে হবে। জনগণ হাসিমুখেই তা করত। জনগণের সঙ্গে নেতার একাত্মতা আরো দৃঢ় হতো। সামাজিক বহু কাজেই এ ধরনের উদাহরণ আছে। এক বড় মাপের, বিশ্বমাপের অন্যতম বড় নেতৃত্বের এক জনের একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করবো।

 

রুশ বিপ্লবের পর ইউরোপ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো যখন রুশ বিপ্লবকে কোনভাবেই ঠেকাতে পারলো না, যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাশিয়ার বিপুল খাদ্য বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়ে প্রতিবিপ্লবের সহায়ক শক্তি হিসাবে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টির প্রত্যাশা করছিল। তাই তারা কড়াকড়ি আরোপ করে যাতে রাশিয়ায় বহির্বিশ্ব থেকে এক দানা খাদ্যও না যায়। এই নিদারুণ খাদ্য অভাবের মধ্যে সমগ্র দেশে খাদ্য রেশনিং চালু করে সরকার। প্রত্যেক পরিবারকেই লাইনে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। খাদ্যের পরিমাণও হয়ত অপ্রতুল। একদিন কিছু লোকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং উত্তেজনাকর মন্তব্য করতে থাকে। তখন পাশ্ববর্তী লোকেরা তাদের সান্ত্বনা দেয় এই বলে যে, দেখো কিছু দূরেই মাদাম লেনিনও তাদের মত কষ্ট করে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন রেশন তোলার জন্য।  সঙ্গে সঙ্গে সবাই একদম স্তব্ধ। কারণ বিপ্লবের মহানায়কের স্ত্রীও তাদেরই মত লাইনে দাঁড়িয়ে কষ্ট করে রেশন তুলছেন। জনগণর সুখ-দুঃখে একাত্ম হওয়ার কী অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত! ভি,আই,পি, ব্যক্তিরও আইন মেনে চলার কী অনুকরণীয় উদাহরণ! জনগণ কষ্টকর আইনও এজন্যই হাসি মুখে মেনে  নেয়। কিন্তু আমাদের নেতারা কি জনগণের সম্মুখে এ ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে? দুর্ভাগ্যবশত উত্তর হচ্ছে, না।

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশেও এক কঠিন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সারা দেশেই তীব্রতা ছিল। কিন্তু উত্তর বঙ্গে এই দুর্ভিক্ষের তীব্রতা ছিল সব চেয়ে বেশী। ভয়াবহ আকারে। তৎকালীন পত্র-পত্রিকার হিসাব মতে শুধু রংপুরেই নাকি ৭ লাখ লোক মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার ক্ষেত্রে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার যেমন অভাব ছিল তেমনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও কর্মীদের প্রায় ঢালাওভাবে দুর্নীতি ও লুটপাটের দৃশ্য মানুষের মনে ক্ষমতাসীন দল ও নেতার প্রতি এক চরম অনাস্থা সৃষ্টি করে। এই রকম সময়েই সর্বপ্রধান নেতার বড় ছেলের বিবাহ হয় স্বর্ণ মুকুট পরে, পত্র-পত্রিকার খবরে যা প্রকাশ পায়।

 

নেতাদের পক্ষ থেকে জনগণের সঙ্গে দুর্ভোগ ভাগাভাগি করে নেওয়ার দৃশ্য কি এটা? জনগণের বৃহত্তর অংশের সাথে ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারী দলের নেতা ও কর্মীদের সম্পর্ক যখন এই রকম মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, জনগণের বেশীর ভাগই ক্ষমতাসীনদের আপনজন ভাবতে পারে নাই,  সরকারের এই রকম একটা জন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সামরিক বাহিনীর ভিতরকার একটা অংশকে দিয়ে মৌলবাদ সমর্থক পাকিস্তানপন্থীরা প্রতিবিপ্লব সম্পন্ন করে। যার মূল নায়ক ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই কেন্দ্রীয়  কমিটির অন্যতম নেতা ও প্রভাবশালী মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। প্রবাসী সরকারেও পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন তিনি। সেই প্রবাসী সরকারে থাকাকালীন সময়েই তার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগের কথা জানা যায় -  তা হলো, খন্দকার মোশতাক নাকি গোপনে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের এক চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছিলেন। প্রবাসী সরকার শেষ পর্যন্ত তাকে অঘোষিতভাবে বা প্রকারান্তরে নজরবন্দী হিসাবে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। সেই খন্দকার মোশতাকই শেষ পর্যন্ত প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে তার নিজের চিন্তার এক ধরনের সফলতা এনেছিলেন। আরও কতিপয় মন্ত্রী ষড়যন্ত্রে তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অথচ দুঃখের  ব্যাপার, যে ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে নেতার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন প্রবাসী সরকারের সেই প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণের পর বেশী দিন মন্ত্রী সভায় থাকতে পারেন নাই। দলীয়ভাবে তার প্রভাব বিশেষ কিছু ছিল না। কিন্তু কেন এমন হলো, কী দোষে মন্ত্রী পরিষদ থেকে তার মত সৎ নেতা পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সে কথা আজও দেশবাসী জানতে পারে নাই। মন্ত্রী পরিষদে না থাকলেও খন্দকার  মোশতাকের ইঙ্গিতে আরো তিন জাতীয় নেতার সাথে বন্দী অবস্থায়  কারাগারে তাকেও জীবন দিতে হয়েছে।

 

যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হলো, লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে অসীম সাহসে যুদ্ধ করলো, জনগণ বিপুলভাবে ত্যাগ স্বীকার করল এবং সাহায্য-সমর্থন করলো, প্রায় এক কোটি লোক দেশ ত্যাগ করে ভারতের ক্যাম্পে উদ্বাস্তু হলো, লাখ লাখ লোক জীবন দিল, লাখ লাখ মা-বোন ইজ্জত হারালো,  যে নেতার অমর ভাষণ শুনে ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হলো, সেই নেতার সপরিবারে হত্যায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার পাশে এসে দাঁড়ালো না। কিন্তু, কেন? কেন দলীয় কর্মী, নেতারা এমন কি যুদ্ধ করা সেই মুক্তি যোদ্ধারাও এগিয়ে আসার প্রেরণা বা সাহস পেল না, কোন প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টাও তারা করলো না বা করতে পারলো না কেন? কী বিস্ময়কর! কী হতভাগ্য  ব্যাপার!

 

আসলে নেতা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের চেয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজে ব্যস্ত ছিলো ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। সেখানে কোন স্বচ্ছতা ছিল না। প্রকৃত পক্ষে তাদের কোন আদর্শ ছিল না বা সে চেতনাও ছিল না। যে অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে চলতে হয়, নয়তো বা তাদের চক্রান্তের দ্বারা উচ্ছেদ হতে হয় -- এমনটাই হয়েছিল আমাদের দেশে। আবারও কি এমন অবস্থা হতে পারে? অসম্ভব কিছু না। জনগণের স্বার্থে স্বচ্ছতার সাথে কাজের মধ্য দিয়ে যদি নিজের পক্ষে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা না যায় তবে এ জাতীয় ঘটনা ঘটা অসম্ভব না। তাই ফাঁক ও ফাঁকির বিষয়গুলো জেনে শুধরে না নিলে হয়তো  ভিন্ন ধরনের অবস্থার মধ্য দিয়ে নানা ঘটনা ঘটতে পারে। অতএব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ।

 

কিন্তু বাস্তবে কি কোন শিক্ষা নেবার প্রমাণ পাওয়া যায়? ছাত্র, যুব সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংগ সংগঠনসহ মূল সংগঠনর নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগনামা জন-সম্মুখে সঞ্চিত হয়েছে, তাকে কি গাফফার সাহেবের তিলকে তাল বানাবার অভিযোগের গল্প দিয়ে ঢেকে ফেলা যায়? এ রকম সাফাই তো বিএনপি জোট আমলের দুর্নীতি ঢাকার সাফাইয়ের মত মনে হচ্ছে। সে আমলের অঘোষিত ‘ক্রাউন প্রিন্স’ তারেক রহমানের দুর্নীতিকে কেউ কেউ ঢেকে ফেলার চেষ্টা করেছে, অনেকে এখনও করছে। ঢাকতে কি পেরেছে? আর ধরে নিলাম জনগণ যদি সে কথা ভুলেও যায় -- তবু কি তা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে? তা হলে আমি বুঝি না কেন গাফফার সাহেব নীতি-নৈতিকতা একেবারে ভুলে দুর্নীতিবাজ অপরাধীদের তিরস্কার না করে যারা সেই দুর্নীতির সমালোচনা করছে, শুধু তাদের নৈতিক ভিত্তি খুঁজে বেড়াচ্ছেন? এটা কি পক্ষপাতিত্বের উলঙ্গ নিদর্শন নয়?

 

তিনি সুদীর্ঘকাল ব্যাপী, বোধ হয় ১৯৭৫ সালের পর থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পরিচিত, উন্নত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ (এক সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ)  দেশের রাজধানী শহর লন্ডনে  সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মাঝে মধ্যেই ইউরোপ-আমেরিকার নানা শহরে নানা উপলক্ষ্যে ভ্রমণ করেন। মাঝে মধ্যে কখনও  বাংলাদেশেও দু’চার দিনের জন্য আসেন। তার জীবিকা সম্পর্কে  আমার সঠিক কোন ধারণা নাই। হয়তো সেখানেও সাংবাদিকতা করেন। তবে এটুকু জানি যে তিনি স্বাধীনতার ৩/৪ বছর পরেই বাংলাদেশ ছেড়ে ব্রিটেনের রাজধানী শহর লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের কোন না কোন পত্রিকায় কলাম লিখে দেশাসীকে অনেক মূল্যবান উপদেশ দেন, সচেতন করেন। তার বর্ণনার নিজস্ব শক্তিতে, উপস্থাপনা কৌশলের জোরে তিনি বলেন, আমরা আমজনতা পাঠক গোগ্রাসে গিলি। তিনি  যাকে বা যে দলকে সমর্থন করেন, সেই পক্ষে যে কোন উপায়েই হোক জনসমর্থন আদায়ের প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন।

 

কিন্তু লেখার শক্তিতেই কি সব ঠিক হয়ে যায়? সব সত্য হয়ে যায়? অর্থাৎ প্রচারের বলিষ্ঠতার জন্যই কি মিথ্যাও সত্য হয়ে যায়? তাই যদি হতো তবে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের মর্মন্তুদ ট্রাজেডির পরও জনগণ কেন সাড়া দিল না? তৎকালে সরকারের পক্ষে তো বিভিন্ন উপলক্ষ্যে, নানা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশাল বিশাল জনসভা, রেডিও, পত্র-পত্রিকার প্রচার-প্রোপাগান্ডা, বিরাট বিরাট বিলবোর্ডের প্রচার ছিল, নানা উপলক্ষ্যে শত শত দলীয় গেট তৈরী করা হতো, দেওয়াল পোস্টার দিয়ে মুড়ে দেয়া হতো। কিন্তু তারপরও এত বড় মর্মান্তিক ঘটনার পর জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন প্রতিরোধ করতে কোন চেষ্টা করে নাই। অথচ তখনও গাফফার সাহেবের লিখনী  প্রচারও ছিল। আসলে জন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে জনগণকে পাওয়া যায় না। শুধু কিছু ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী কারো সপক্ষে বা বিপক্ষে লিখলেই সত্য পরিবর্তিত হয় না। জনগণের সত্য উপলব্ধি করার নিজস্ব একটা ব্যারোমিটার আছে, আছে সত্য উপলব্ধির এক নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। সেই পদ্ধতি অনুযায়ীই অর্থাৎ  মানসিক উপলব্ধির নিরখেই জনগণ কখনও নিশ্চুপ থাকে, আবার কখনও সক্রিয় বা কখনও অত্যধিক সক্রিয় হয়। তখন জীবন পর্যন্ত  বাজি রাখতে দ্বিধা করে না। স্বাধীনতা যুদ্ধটাও কিন্তু জন-উপলব্ধির জলন্ত উদাহরণ।

 

অবশ্য গাফফার সাহেব কী মনে করেন তা জানি না। উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশের দ্বিদলীয় বাস্তবতার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের তুলনা করে যদি কেউ আত্মপ্রসাদ লাভ করে তাকে বোকা বলব, না প্রতারক ভাববো তা ভেবে পাচ্ছি না। যে দল দু’টির একটির মধ্যেও  গণতন্ত্রের নাম নিশানা নাই, মুলত যার মর্মবস্তুতে রয়েছে বংশতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র তাকেই তুলনা করা হচ্ছে ইংল্যান্ড বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক দু’টি দলের সঙ্গে । যদিও সবাই জানি যে এ দু’টি দেশের গণতান্ত্রিক এ দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার সব ক’টি দলের আদর্শিক মানদণ্ড হচ্ছে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী মানদণ্ড। এক কথায় বলা যায় গাফফার সাহেবের উল্লেখিত ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম’-এর শীর্ষ প্রতিনিধি এরা। তাদের সঙ্গে এ দেশে গাফফার সাহেবের কথিত দল দু’টির চরিত্রগত দূরত্বটা কি তিনি বোঝেন না? ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দল দু’টির নিজ দলের মধ্যে ও নিজ দেশের মধ্যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের এক ধরনের চর্চা আছে। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে একটা অহং বোধও আছে। অবশ্য তারা অন্য দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে মূলত নিজ স্বার্থে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে দ্বিধা করে না। তার অনেক মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত দগদগে ঘায়ের মত বিশ্বের বহু দেশে বিদ্যমান রয়েছে।  কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজেদের দল এবং দেশের মধ্যে তারা কম-বেশী গণতন্ত্রের চর্চা ঠিকই করে।

 

কিন্তু আমাদের দেশে গাফফার সাহেবের কথিত দল দু’টির মধ্যে তা একেবারেই নাই। তাই পাশ্চাত্যের কতিপয় দেশের দ্বিদলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ দিয়ে এদেশে ঐ নির্দিষ্ট দল দু’টির পক্ষে তার ওকালতি নৈতিকতা বহির্ভূত বলেই মনে হয়। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চল্লিশোর্ধ্ব বছরের মধ্যে কি কখনও স্বাধীন ও যথাযথ শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে? সরকারে থাকা কোন দলই নিজেদের স্বার্থে তা কখনও করে নাই। কারণ প্রত্যেকটা দলই জানে তাদের শাসনকালে জনগণের মনের আয়নায় যে ছাপ পড়ে, তাতে সত্যিকারের নিরপেক্ষ নির্বাচনে কেউ পুনঃনির্বাচিত হতে পারবে না। দলগুলোর নিম্নতম স্তর থেকে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির যে কালিমা জমে তার দাগ বড় কদর্য হয়ে যায়। ফলে নির্বাচনকে প্রয়োজন মাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে কখনই শক্তিশালী ও স্বাধীন করা হয় নাই। সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ যোগ্য অবস্থায় এ প্রতিষ্ঠানটিকে রাখা হয়। এ কারণেই নিরপেক্ষ তত্ত্ববাধায়ক সরকারের প্রশ্নে এত দ্বন্দ্ব চলছে।

 

দুর্নীতির সপক্ষে সাফাই গাইতে গাফফার সাহেব একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।  নিম্নে উদ্ধৃত করছি। তিনি তার লেখার দ্বিতীয় কিস্তির শেষ প্যারায় বলছেন, "অবশ্যই দেশের রাজনীতি এখন অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই বলে সমাজের কোন অংশ নয়? রাজনীতিকদের চেয়েও বড় দুর্নীতিবাজরা কি আজ সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেনি? তাহলে কেবল প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ব্যর্থতার অভিযোগ কেন?'

 

বা! চমৎকার!! একজন মহামানব প্রেমিক শ্রীচৈতন্যদেব যেমন তাকে আক্রমণ করে রক্তাক্তকারী জগাই-মাধাইকে বলেছিলেন, ‘মেরেছিস কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দিব না?’ বলেই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে আলিঙ্গন করেছিলেন। আমাদেরও কি সেই রকম দুরন্ত দুর্নীতিবাজদেরকে কোলে তুলে আলিঙ্গন করতে হবে? প্রেসক্রিপশনটা মন্দ নয়। তাতে সেই জগাই-মাধাইয়ের মত সব দুর্নীতিবাজ যদি অনুতপ্ত হয়ে ভাল হয়ে যায়! তাহলে কী মজা, তাই না? অবশ্য তা তিনি বলছেন না। সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হোক এ কথা তিনি এখানে বলছেন না। তিনি বলছেন ‘অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিগ্রস্ত’ ‘সমাজের কোন অংশ নয়?’ তার মতে রাজনীতিকদের চেয়েও বড় দুর্নীতিবাজরা সমাজে আধিপত্য করছে। কাজেই দল দু’টির রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে কেন দুর্নীতির অভিযোগ আনা হবে? আর ব্যর্থতার অভিযোগই বা কেন আনা হবে? এভাবেই গাফফার সাহেবের ইচ্ছা অনুসারে দুর্নীতিপরায়ণ দ্বিদলীয় ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখা যায় কি না তা আমরা ভেবে দেখবো? সমাজের সর্বত্র যখন দুর্নীতিবাজদের আধিপত্য তখন সে সমাজের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি গাফফার সাহেবর দৃষ্টিতে তেমন দোষণীয় নয়।

 

কী দুর্ভাগ্য আমাদের! কী নৈতিক অবক্ষয় আমাদের! আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের নৈতিকতার মান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!  আমার প্রশ্ন আজ সমাজে সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকারী সেই দুর্নীতিকারীরা কাদের ছত্রছায়ায় এত বড় দুর্নীতিবাজ হয়েছে ? কীভাবে তারা আজ সমাজে সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে? কাদের দায়িত্ব ছিল দুর্নীতির  পথগামীদের প্রতিরোধ করার, দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার? এটা কি সরকারের দায়িত্ব ছিল না ? তা না করে নিজেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে দলীয় কর্মীদের দুর্নীতির অবাধ সুযোগ দিয়ে গোটা সমাজকেই ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করেছে।

 

এ  প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সরকার ও সরকারী দল যখন জন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে তখন তার সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির ইন্ধনে চক্রান্তকারীরা শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে মোস্তাকের নেতৃত্বে অধিকতর প্রতিক্রিয়াশীল এক সরকার গঠন করে। ক্রমে এক সময় ক্ষমতায় আসে সততার দাবী নিয়ে জিয়া সরকার। এক দিকে নিজের ব্যক্তিগত সততার কথা বলে ম্যাজিক দেখিয়েছে, অন্য দিকে ‘মানি ইজ নো প্রবলেম‘ স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে তার সহযোগিতার জন্য যুব কমপ্লেক্স বানিয়ে হাটঘাটের খাজনা তোলা আদায়ের দায়িত্ব দিয়ে দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়ে নৈতিকভাবে যুব সমাজকে অধঃপতিত করেছে। দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে নিম্ন স্তর পর্যন্ত। তারপর এরশাদের প্রায় এক দশক সরকারের সামরিক ও বেসামরিক রূপ ও গণতন্ত্রের খেলা এবং নির্বাচনের  মহড়ার সাথে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দল গঠনের খেলা জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের রূপ জনগণ আবার প্রত্যক্ষ করল। কিন্তু স্বাধীতার পর লুটপাট ও দুর্নীতির যে ‘রেস’ শুরু হয়েছিল তা হ্রাস না পেয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়তেই  থাকলো। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো পরিবারের ‘মিঃ পার্সেন্টটেজ’আমলের মত আমাদের জনগণের ঘাড়েও তা চেপে বসলো। গাফফার সাহেবের বর্ণিত দু’টি দলকেই এ দেশের জনগণ বারবার দেখছে।  এখন তার একান্ত সমর্থিত স্বাধীনতার সপক্ষের দলটির, যদিও নাম তার জোট সরকার, কর্মকাণ্ডও জনগণ দেখছে। দেখছে শেয়ার মার্কেট-হল মার্ক-ডেসটিনি কেলেংকারিসহ পদ্মা সেতু, রেলমন্ত্রীর অভযোগের নাট্যরূপসহ নানা প্রকার ঘটনা, ক্ষমতাসীন মূল দলের অংগ সংগঠনসমূহের নানা রঙ্গীন ঘটনা। ভাগাভাগি, প্রভাব বিস্তার ও প্রভাব বজায় রাখার জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি ও খুনের মত ঘটনাও ঘটতে দেখছে জনগণ। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে সরাসরি চাঁদা তোলা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাণিজ্য থেকে চাকরির তদবির! মায় পাড়া-মহল্লার, গ্রাম-গঞ্জের  বিভিন্ন  শালিস, সরকারী অনুদানসহ নানা বিষয়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ফায়দা তোলা। এ সবেই তো আমজনতা ভুক্তভোগী হচ্ছে, দেখছে। আর সরকারী সংস্থা ও বিভাগগুলোর সরকারী তহবিল ও জনগণের নিকট থেকে নানা কায়দায় ঠেকিয়ে অর্থ হাতানো এখন অলিখিত শাসনতান্ত্রিক আইনের  মতো প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে গেছে বলে জনগণের কাছে মনে হয়। এ অবস্থায় জনগণও ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হচ্ছে, নিজেরাও বিভিন্ন সময় জড়িয়ে  পড়ছে, এ ব্যবস্থার অংশীদার হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্রমান্বয়ে জালিয়াতি ও  প্রতারণার ভয়াবহ বিস্তারে দেশ সয়লাব হচ্ছে সরকার এবং আমলাদের প্রশ্রয়েই।

 

এই অবস্থার সব দায়-দায়িত্ব সরকারের ঘাড়েই বর্তায়। এই সুযোগটা যদি ‘গ্লোবাল ক্যাপটালিজম’ গ্রহণ করে তবে তাদের দোষারোপ করে লাভ কী ? সাম্রাজ্যবাদীরা তো প্রয়োজনে সে সুযোগকে কাজে লাগাবেই। রাষ্ট্রের শাসক দল  যদি জনগণের দৃষ্টিতে পরিচ্ছন্ন থাকে, জনগণের মনের আয়নায় যদি তাদের প্রতিবিম্ব স্বচ্ছ থাকে তবে সাম্রাজ্যবাদী  শক্তি সহজে কিছুই করতে পারে না। সে সম্পর্কে এ লেখায় উদাহরণ দিয়েছি।  আবারো একটু স্মরণ করবো। মাত্র কয়েকদিন আগেই ৭ অক্টোবর ২০১২ তারিখে ভেনিজুয়েলার নেতা হুগো শ্যাভেজ তৃতীয় বারের মত নির্বাচিত হয়েছেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে। ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারের মত রোগে ভোগা একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি নির্বাচিত হয়েছেন গণতন্ত্রের ত্রাতা সাজা মার্কিন মুল্লুকের সবকটা পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বছরের পর বছর ধরে সার্বক্ষণিক ও সর্বব্যাপী শ্যাভেজ বিরোধী মিথ্যা প্রচার এবং ভেনিজুয়েলায় অবস্থিত মার্কিনের ছোট-বড় সব দালালের সম্মিলিত সর্বাত্মক বিরোধিতা সত্ত্বেও।  শ্যাভেজকে ঠেকাবার জন্য বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করেও  মার্কিনীদের  কোন লাভ হয় নাই।

 

তার এ বিজয়ের মূল শক্তি তার সততা, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক  আদর্শ ও সে আদর্শ বাস্তবায়নে একনিষ্ঠ  কর্মতৎপরতা। তার সহায়ক শক্তি আদর্শনিষ্ঠ একটি পার্টি,  যা মূলত তার  প্রচেষ্টায়ই গড়ে উঠেছে; আর তার আদর্শের প্রতি বিপুল সমর্থন নিয়ে সদা প্রস্তুত ও সচেতন এক জনগোষ্ঠী। তার আদর্শ নির্ভর কর্মের দ্বারাই জনগণের এক বিপুল অংশ আদর্শ সচেতন হয়ে উঠেছে, তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সৎ, দেশ প্রেমিক জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়ারা তাদের বিকাশের সুযোগ পেয়েছে, আবার অসৎ, সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুর্জোয়াদের কঠোর আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলে সামগ্রিক জীবনমান ক্রমান্বয়ে উন্নতির পথে বিকাশমান। দরিদ্র  জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নে কর্মকৌশল পরিচালিত হচ্ছে। ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের’ সামগ্রিক বাজার অর্থনীতির ঘোর বিরোধী শ্যাভেজকে মার্কিন প্রশাসন যে কোন মূল্যে ঠেকাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে নানা ছলচাতুরী, অপকৌশল, চাপ এমনকি যুদ্ধের মাধ্যমে দখল ও তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাদের মাধ্যমে শোষণের আধুনিক রূপ মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু করেছে ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের’ সর্দার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ তার নাকের ডগার উপর শ্যাভেজের এই বিরোধিতা, যাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আবার কোনভাবেই তাকে উচ্ছেদও করতে পারছে না।

 

কিন্তু আমাদের দেশে? গাফফার সাহেবের মত অনুসারে বলা যায়, ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমেরও ইচ্ছা যে সব দেশে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো তাদের একেবারে বাধ্য নয়, তাদের অপসারণ দ্বারা এনজিও সরকার প্রতিষ্ঠা করা।’তাদের ইচ্ছা কার্যকর  করার কৌশল বদলালেও সরকার বদলের পুরোনো খেলা সাম্রাজ্যবাদীরা চিরকালই খেলে। দেশে যদি সত্যিকার দেশ প্রেমিক শক্তি সৃষ্টি হয়, তখন কি এ খেলা বন্ধ করা যায় না?  আর সে শক্তি সৃষ্টিতে পথ দেখানো বা উৎসাহ দেবার কি কোন লোকও দেশে নাই? গাফফার সাহেবদের মত প্রতিভাবান খুরধার লেখকরা কতটুকু সে কাজ করেন?  আর তা না করে শুধু বিপদের কথা বলে, সাম্রাজ্যবাদী জুজুর ভয় দেখিয়ে অসৎ, আদর্শহীন, নীতিহীন লুটেরা একনায়কী চরিত্রের তথাকথিত গণতান্ত্রিক শক্তিকে সমর্থন করে কি সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত ঠেকানো যাবে? কতবার ঠেকাবেন ? জনগণ কোন চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে চক্রান্ত ঠেকাবার লড়াইতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হবে?


কোনও আদর্শ বোধ ছাড়া মানুষ সৎ ও চরিত্রবান হয় না। লোভকেও জয় করতে পারে না। ল্যাটিন আমেরিকার একটা দেশের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্র প্রধানের উদাহরণ দেওয়া যায় এ লেখায়। গত ১৬ নভেম্বর ২০১২ তারিখে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায়  কর্পোরেট পুঁজি বা ‘গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের’ অন্যতম প্রধান প্রচার মাধ্যম ‘ডেইলি মেইল’পত্রিকার বারাত দিয়ে খবরটা পরিবেশিত হয়েছে। দৈনিক ‘যুগান্তর’পত্রিকার ৮-এর পাতায় নীচের দিকে ‘বিচিত্রিতা’কলামে বক্সের মধ্যে ‘বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র প্রধান’শিরোনামে ছাপা হয়েছে। খবর অনুযায়ী ‘প্রথাগত ঠাট বাটের বালাই নেই,’ ‘জীর্ণ খামার নিয়ে খুব সাধারণ এক মানুষের মত দিন গুজরান করছেন তিনি।’সব সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে অতি সাধারণ মানুষের জীবন বেছে নিয়েছেন তিনি । থাকেন রাজধানী থেকে বেশ দূরে। তাও নিজের নয়, স্ত্রীর  মালিকানাধীন জীর্ণ এক খামার বাড়ীতে। কাপড় কাচার ঘরটি বাড়ীর বাইরে। পানি আনতে হয় লতাপাতায় ঢাকা এক পুকুর বা খাদ থেকে। বড় রাস্তা থেকে কাদা-পানি মাখা পথে হেঁটে বাড়ী ঢুকতে হয়। প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাড়ীর নিরাপত্তা রক্ষায় রয়েছে মাত্র ২ জন পুলিশ সদস্য ও নিজের একটি তিন পাওয়ালা কুকুর। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত বেতন মাসিক ১২ হাজার ডলারের শতকরা ৯০ ভাগ জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে দেওয়া লোকটি গণভোটের মাধ্যমে  উরুগুয়ের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা। আদর্শগতভাবে বামপন্থী রাজনীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিউবা বিপ্লবে অনুপ্রাণিত হয়ে বামপন্থীদের গড়ে তোলা  ‘তোপা মারোস’ নামক গেরিলা সংগঠনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ষাট ও সত্তরের দশকে। সে সময় গেরিলা  জীবনে ছয়বার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ধরা পড়ে ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন। কঠোর শর্ত ও একাকীত্বের মধ্যেই বন্দী জীবন কেটেছে। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তনের পর ১৯৮৫ সালে হোসে মুজিকা মুক্তি পান। তারপর গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচনে জিতে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার সংগ্রামী ব্যক্তি জীবন কী নির্লোভ, অপূর্ব  এক আদর্শ বোধের নমুনা!

 

এবার আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে পরিচিত ভারতের পূর্ব প্রান্তের ত্রিপুরা রাজ্য সরকারের মুখ্য মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরব, যা গত ২৯ নভেম্বর ২০১২ তারিখের দৈনিক ‘যুগান্তর’পত্রিকা ৮ পাতার নীচের  দিকে ‘একজন ঘরহীন মন্ত্রী ও তার ভাই পোর গল্প’শিরোনামে  প্রকাশিত হয়েছে। মুখ্য মন্ত্রী হওয়ার আগে ভাড়া বাড়ীতে থাকতেন। এ ছাড়া উপার্জনের টাকা দিয়ে মাস না যেতে নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। নিজের বাড়ী-গাড়ী বা সম্পত্তি কিছুই নাই। তাহলে সংসার চলে কীভাবে ? সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে  তিনি জানান  স্ত্রীর পেনশনের অর্থ দিয়েই তার সংসার চলে। আর মুখ্য মন্ত্রীর স্বজনরাও একেক জন ন্যায়-নীতিবোধ ও নিঃস্বার্থপরতার জ্বলন্ত উদাহরণ। তারা মুখ্য মন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে  ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোন রকম সুবিধা নিয়েছেন, এমন খবর কারও জানা নাই। অর্থাৎ এ ধরনের বেআইনী সুযোগ কেউ নেয় নাই। ত্রিপুরার কল্যাণী শহরের বাজারে গেলে তার প্রমাণ মিলবে। মাছ বাজার গাছ তলায় বসে অন্যদের সঙ্গে মাছ বিক্রি করে এক মাছ ব্যবসায়ী। নাম সুনীল। অনেক উৎসাহী ক্রেতা অন্য দোকান ফেলে তার কাছে যায় ফরমালিন মুক্ত মাছ পাওয়ার আশায়। কারণ তার নীতিবান চাচা রাজ্যের মুখ্য মন্ত্রী। সরকারী চাকরীর পিছনে না ঘুরে বা মুখ্য মন্ত্রী চাচার কাছ থেকে কোন সুযোগের প্রত্যাশা না করে কাঁচা বাজারের খোলা  জায়গায় বসে যে লোক  মাছ বিক্রি করে, সে আর যাই হোক অসৎ হবে না। সুনীল সরকারও তার চাচার মত সততাকে নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।  

 

উদাহরণ আর বাড়াতে চাই না। আমাদের দেশের আজকের পরিস্থিতি যার কিছু বর্ণনা জনাব গাফফার চৌধুরী দিয়েছেন, তার সাথে সহমত পোষণ করে আমার কিছু কথা বলবো। সাম্রাজ্যবাদীদের অনেক কৌশলের মধ্যে এনজিও কৌশলও একটি। যা সুদে কারবারের পুরোনো কৌশলের নবায়নকৃত আধুনিক রূপ। তাকে সামাজিক মর্যাদা দিয়ে  সুসংগঠিত করে গ্রামের নিম্নতম স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করে সর্বোচ্চ মাত্রার সুদে কারবারের শোষণ নিশ্চিত করা হয়েছে, যার আদিরূপ এক সময় আমাদের দেশের মহাজন ও কাবুলিওয়ালাদের দ্বারা প্রচলিত ও পরিচালিত ছিল। এখন সাম্রাজ্যবাদ সর্বোচ্চ হারের এই সুদে কারবারীদের শক্তিকে ব্যবহার করে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণেরও চেষ্টা করছে। বলা যায় একে ‘এনজিও পলিটিক্সে’রূপান্তরিত করছে। যার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের গ্রামান্তর পর্যন্ত শিকড় বিস্তার করে সমগ্র দেশে প্রভাব বলয় গড়ে তুলে। এ প্রক্রিয়ায় বৃহৎ এনজিওগুলোর মাধ্যমে তারা শক্তভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির নিম্নতম স্তর পর্যন্ত শিকড় বিস্তার করে শোষণ প্রক্রিয়ার বিস্তার ঘটায়। তেমনি সমাজ ও দেশের রাজনীতিতে সার্বিকভাবে তাদের দর্শন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এ প্রক্রিয়ায়ই রাজনীতিতেও প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। আবার এ প্রক্রিয়ার বাইরে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত বেসরমারিক ও সামরিক আমলা শ্রেণী, পেশাজীবী ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, কলামিস্ট, সুশীল সমাজ ইত্যাদিসহ সমাজের সর্বক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ‘বন্ধুশ্রেণী’বা এজেন্ট আছে। বিশ্বের প্রতিটা দেশের প্রতিটা প্রান্তেই তাদের ‘বন্ধুশ্রেণী’বা এজেন্ট বাহিনী রয়েছে। হাজারো পন্থায় তারা এই এজেন্ট  তৈরী করে, পোষে, শুধুমাত্র তাদের সুদূর প্রসারী লাভের স্রোত প্রবহমান রাখার জন্যই। সেখানে মানব প্রেম, গণতন্ত্র বা মানবতার মুখ রোচক বুলি স্রেফ ভণ্ডামি। তাদের সুদূর প্রসারী লাভের জন্য হাজার হাজার  বা লাখ লাখ নয়, প্রয়োজনে কোটি কোটি মানুষ হত্যা করতে তাদের বিবেকে একটুও নাড়া লাগে না। কাজেই প্রয়োজনে সব রকম চক্রান্ত তারা করবেই। ‘স্ট্র্যাটেজিক্যাল’কারণে কোন দেশের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন দেখা দিলে তারা যে কোন মূল্যে সে দেশকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে  মরীয়া চেষ্টা করবে। আজকে বাংলাদেশকে নিয়েও তাদের এমন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে বলেই মনে হয়।

 

গাফফার সাহেবের দেখানো পথে গিয়ে না হবে দেশের মুক্তি, না হবে সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলার উপায় লাভ। তিনি নানান কৌশলে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে ও রক্ষা করতে চান। কাজেই দেশে যে দ্বিদলীয় ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে সেটার সপক্ষে নানান যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন। উদ্দেশ্য, যাতে প্রগতিশীল এবং লোকবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিসমূহ স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার চেষ্টা না করে মেকী প্রগতিশীল এবং মেকী ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের হাত শক্তিশালী করে এবং এভাবে প্রকারান্তরে দেশে বিদ্যমান লুণ্ঠনতন্ত্রকে অব্যাহত রাখায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সেই চেষ্টা যে তিনি করে  যাবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে দেশের জনগণের কী লাভ?

 

বিদ্যমান রাজনীতির বাইরেই আজ আমাদের পথ সন্ধান করতে হবে। কাজেই একদিকে দুর্নীতিতে বিধ্বস্ত, দুর্দশাগ্রস্ত এই দেশ ‘গ্লোবাল কর্পোরেট’পুঁজির তথা সাম্রাজ্যবাদের ছোবলে বিষ জর্জরিত নীলকণ্ঠ আমাদের এই স্বদেশকে, আমাদের এই শ্যামল বাংলা মা’কে সকল লোভের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে বাঙ্গালী জাতির পুনর্জাগরণ প্রয়োজন। প্রয়োজন ১৯৫২, ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও সেখান থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে উত্তরণের মতই জেগে উঠা।

 

সর্বস্তরের চরম দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, লাগামহীন লোভের দর্শন ত্যাগ করে সত্যনিষ্ঠ ও ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সমস্ত অন্যায়কে, সকল দানবীয় শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য, সাম্রাজ্যবাদের সকল চক্রান্তকে সাহসের সঙ্গে সচেতনভাবে প্রতিহত করার জন্য এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যা কেবল পারে যুব সমাজ। বাংলার দামাল যুব সমাজ। যাদেরকে আজ সীমাহীন লোভের দর্শন দিয়ে, সর্ব প্রকার ভোগের নেশায় বুঁদ করে রেখে ধ্বংসের এক চোরাবালিতে আটকে দেওয়া হচ্ছে, সেখান থেকে বের হবার কোন পথ রাখা হচ্ছে না। জীবন ধ্বংসের এই শেষ কিনারা থেকে তাদেরকে আজ জেগে উঠতে হবে; এবং জেগে উঠবে বাংলার এ তরুণ সমাজ। না হলে আমাদের অস্তিত্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে ব্যর্থ রাষ্ট্রের অপবাদ নিয়ে। জনগণের মধ্যে অবশিষ্ট চিন্তাশীল সকল স্তরের মানুষ প্রয়োজন মুহূর্তে অবশ্যই এ আন্দোলনে যোগ দিবে।


৯/১২/১২

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ