Banner
বাংলাদেশের অর্থনীতি : ঔপেনিবেশিক অর্থনীতির ধারাবাহিকতা (প্রথম পর্ব) — হাবিবুর রহমান

লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান , আপডেটঃ April 19, 2018, 12:00 AM, Hits: 3886


ভূমিকার বদলে

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে  বিশ্ব অর্থনীতি থেকে  বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন একটি দেশের অর্থনীতির বিকাশ দুরুহ বা সম্ভব নয়। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে যে বিশ্বায়ন ব্যবস্থা জারী আছে তা কিছু বৃহৎ সংস্থা, কিছু বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটাচ্ছে। অর্থাৎ দেশে দেশে অসম উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। দেখা যাচ্ছে বিশ্বায়ন বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির সমৃদ্ধির স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে যার কারণে আমাদের মত দেশে উৎপাদনশীল পুঁজির পুঞ্জিভবন ব্যাহত হচ্ছে। দেশের পুঁজি বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে যার ফলে আমাদের মত দেশের অর্থনীতিতে প্রয়োজনীয় পুঁজির ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। এভাবে পৃথিবীর তাবৎ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়িক সংস্থা বা পরিবারের হাতে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বের ধনাঢ্য ১ শতাংশ জনগণের কাছে বাকি ৯৯ শতাংশ জনগণের আয় ও সম্পদের চেয়ে বেশি আয় ও সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে আছে। বস্তুত বিশ্বায়ন যদি বিশ্ব অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি দেশের অর্থনীতির বিকাশে সমহারে গতিশীল ভুমিকা রাখতে সক্ষম হতো তবে একটি দেশের অর্থনীতির বিকাশের বিষয়টি পৃথকভাবে উত্থাপনের প্রয়োজন হতো না। তাই কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বা সংস্থায় আয় ও সম্পদ পুঞ্জিভূত করার বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্বায়ন ব্যবস্থা মোকাবেলা করেই একটি দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নের সুফল যাতে সর্বস্তরের জনগণের হাতে পৌঁছায় (সম্পদ যেন গুটিকয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়) সে ব্যবস্থাও অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় থাকতে হবে। উপরোক্ত কঠিন বাস্তবতা আমলে নিয়ে একজন রাজনৈতিক কর্মীর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি বোঝার চেষ্টা করেছি, আলোচনার চেষ্টা করেছি। লেখাটা দুই পর্বে সম্পন্ন করা হবে।

 

প্রথম পর্ব

শুরুতে আমি বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতির কয়েকটি দিক সকলের দৃষ্টিতে নিতে চাই যা বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতির স্বরূপ উন্মোচন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এক. বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ক্রমশঃ বড় হচ্ছে। প্রায় এক যুগ ধরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি কমবেশি ৬% এর মধ্যে অবস্থান করছিল। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৭.২৪%। ১৯৯০ সালে পৃথিবীতে দেশগুলোর শীর্ষ অর্থনীতির আকারের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৫০তম। ২০১৫ সালে এই তালিকায় বাংলাদেশ ৩১তম স্থানে চলে এসেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ২৮তম এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ২৩তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। অর্থনীতির প্রধান তিন চালিকা শক্তি – প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, শিল্প পণ্য থেকে রফতানি আয় (প্রধানত গার্মেন্টস খাত) এবং কৃষি উৎপাদন কমবেশি বেড়ে চলেছে। যদিও খাদ্যশস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে (২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে)। এখান উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে অনুৎপাদনশীল সেবা খাত। মাথাপিছু আয় ক্রমশ বাড়ছে, বর্তমানে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬০২ মার্কিন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সন্তোষজনক। ২০১৭ সালের জুনে এসে এই মজুদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩  বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমেছে। জিডিপি’র আনুপাতিক হার হিসেবে তা ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

দারিদ্র্যের হার ক্রমশ কমছে। ২০০০ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯%, সেখানে ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৪.৩%। আবার ২০১০-১১ অর্থবছরে যেখানে অতিদরিদ্রের হার ছিল ১৭.৬%, সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অতিদরিদ্রের হার দাঁড়িয়েছে ১২.৯%। অবশ্য বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ৫৭.৯% (বিশ্বব্যাংক দারিদ্র্য পরিমাপ করে মাথাপিছু দৈনিক আয় ১.৯০ ডলার ধরে, আর বাংলাদেশ দারিদ্র্য পরিমাপ করে মাথা পিছু দৈনিক আয় ১.২০ ডলার ধরে)। যাহোক, সরকারের হিসাব মতেই বর্তমানে দারিদ্র্য কমার হারের গতি অনেকটা কমে যাওয়াতে দরিদ্রের মোট সংখ্যা কমছে না। যেমন ২০১১ সালে অতিদরিদ্রের হার ছিল ১৭.৬% এবং অতিদরিদ্র লোকসংখ্যা ছিল মোট ২ কোটি ৬০ লক্ষ।  অন্যদিকে, ২০১৬ সালে অতিদরিদ্রের হার কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৯%। এই সময় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি হিসাবে  ধরলে  অতিদরিদ্র লোকসংখ্যা দাঁড়ায় মোট ২ কোটি ৮০ লক্ষের মতো। এ হিসাবে বরং অতিদরিদ্র লোকসংখ্যা বেড়ে গেছে। এখানে উল্লেখ্য, ২০১১ সালের আদমশুমারির গণনার যথার্থতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাদের ধারণা, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গণনাকারীদের ফাঁকিবাজির শিকার হয়ে প্রকাশিত হিসেবের বাইরে রয়ে গেছেন। বস্তুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম করে দেখানো, সাক্ষরতার হার বেশি করে দেখানো, শিশু মৃত্যুর হার কম করে দেখানো, দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার কম করে দেখানো, চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার হার কম করে দেখানো, মূল্যস্ফীতির হার কম করে দেখানো, গড় প্রত্যাশিত আয়ু বেশি করে দেখানো -এগুলো এখন বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সরকারের সাধারণ বদখাসলতে পরিণত হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যাহোক, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া বা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের পথে পা রেখেছে বাংলাদেশ।

দুই. বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনৈতিক ভাবে সরকার ও সরকার দলীয় সদস্যদের নগ্ন হস্তক্ষেপ সুস্পষ্ট। বিশেষ করে বড় বড় কেনাকাটা, অবকাঠামো নির্মাণ এবং ব্যাংকের টাকা লুটপাটে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। যেমন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়। এসব চেয়ারম্যান কর্তৃক অনৈতিকভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের প্রদানের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৭ লক্ষ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে শীর্ষ ১০০ ঋণগ্রহীতার কাছেই রয়েছে এই ঋণের অর্ধেক, প্রায় ৩.৫ লক্ষ কোটি টাকা। আর শীর্ষ ২০ ঋণগ্রহীতার কাছেই রয়েছে প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এসব ঋণগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে যেমন নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়া হয়েছে, তেমনি ঋণের সুদ মাফ করা হয়েছে। আর খেলাফি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখাতে ঋণের পুন তফশিল ও অবলোপন করা হয়েছে। অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ প্রদানেও একই ধরনের অভিযোগ উঠে এসেছে। তেমনি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অসংখ্য মানুষকে সর্বস্বান্ত করে শেয়ার মার্কেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কিছু দুর্বৃত্ত তা ও স্পষ্ট। আবার অবকাঠামো নির্মাণে নিম্ন ও যোগ্য দরদাতাকে কাজ না দিয়ে অযোগ্য ও বেশি দরদাতাকে কাজ দেওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারছে না, প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছে। তাই বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতিকে হস্তক্ষেপের অর্থনীতি হিসেবে অভিহিত করা অত্যুক্তি হবে না।

তিন. ধনী-গরিবের বৈষম্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৪ অনুযায়ী দেশের এক তৃতীয়াংশ (৩৬ শতাংশ) সম্পদের মালিকানা মাত্র ১০% মানুষের হাতে কুক্ষিগত রয়েছে। বিপরীতে সবচেয়ে গরীব ১০% ভাগের হাতে সম্পদ রয়েছে মাত্র ২%। দেশের প্রায় ৭৮ শতাংশ মানুষের দৈনিক আয় ৩.১ ডলার বা ২৫০ টাকার নিচে। আর দৈনিক ১.০৯ ডলার ১৫০ টাকার নিচে আয় করেন প্রায় ৪৪ শতাংশ মানুষ ( ২০১৬ এর জুনে প্রকাশিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সমীক্ষা)। অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কাছে ৪০ শতাংশের বেশী সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। অবশ্য বৈশ্বিক চিত্র এরকমই।

দেশের আয় বা প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। আর আয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৈষম্য – ধনী-গরীবে, শহরে-গ্রামে। ১৯৮০-৯০ সময়কালে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৭ শতাংশ। ওই সময় জিনি বা গিনি সহগের মান ছিল ০.৩০। ১৯৯১-২০০০ সময়কালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৪.৮ শতাংশ, আর গিনি সহগের মান ছিল ০.৪১। আর ২০০১-১০ সময়কালে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৮ শতাংশ এবং গিনি সহগের মান দাঁড়ায় ০.৪৫। অথচ  বাংলাদেশের জন্মকালে তা ছিল মাত্র ০.২৮। জিনি বা গিনি সহগ ( Ginny coefficient ) অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক যা কোন দেশের আয় বা সম্পদ বণ্টনের অসমতা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। গিনি সহগের মান শূন্য হলে বুঝতে হবে দেশে কোন বৈষম্য নেই, আর গিনি সহগের মান এক হলে বুঝতে হবে বৈষম্য চরমে পৌঁছেছে। গিনি সহগ ০.৫০ অতিক্রম করলে তা অর্থনীতির জন্য হয় মারাত্মক। তীব্র অর্থনৈতিক বৈষম্যে বিভাজিত একটি সমাজ ও রাষ্ট্র ভঙ্গুর হয়ে থাকে।

চার. ব্যাপক হারে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি, ইউএনডিপিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ তথ্যমতে ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ দশকে বাংলাদেশ থেকে ৫৬.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে মোট ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা যা আগের বছরের তুলনায় ৩৩.৭৯ শতাংশ বেশি। আর ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি ও পানি সম্পদ খাতের উন্নয়ন বাজেটের সমান। সুত্র গ্লোবাল ফিনানসিয়াল ইনটিগ্রিটি, তথ্য প্রকাশ ২ মে, ২০১৭। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা করে পাচার করা হচ্ছে। গবেষণাগুলো থেকে জানা যায়  মোট টাকা পাচারের ৩০-৪০ শতাংশ এভাবেই পাচার হয়ে থাকে। এ ছাড়া হুন্ডি, ট্রান্সফার প্রাইসিং, ভুয়া এলসি খোলা  ও অন্যান্য উপায়ে টাকা পাচার হয়। সুইস ব্যাংকে  বাংলাদেশিদের টাকা জমার পরিমাণ দিন দিন বেড়ে চলেছে। ২০১৩ সালে বৃদ্ধির হার ছিল আগের বছরের তুলনায় ৬২% বেশী। তেমনি ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে  বাংলাদেশিদের টাকা জমার পরিমাণ ১৯% বেড়েছে। এদেশের সম্পদশালীদের সেকেন্ড হোম এখন আর গ্রাম বাংলা নয়; সেকেন্ড হোম হল মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ।

পাঁচ. ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা, চোরাকারবার, কালোবাজারি, লুটপাট ইত্যাদি উপায়ে একটি কালো অর্থনীতির বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। এভাবে বছরে যে পরিমাণ কালো টাকা সৃষ্টি হচ্ছে তা জিডিপি’র  ৪০–৭০ শতাংশের মধ্যে থাকছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারি-আধা সরকারি ক্রয়ে উচ্চ মুল্য দেখিয়ে লুটপাট করা হচ্ছে। অবৈধ ব্যবসা-দুর্নীতি-লুটপাটের কিছু ধারণা এখানে উল্লেখ করা হল।

১. বাংলাদেশে সড়ক, সেতু, ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ। যেমন বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সড়ক নির্মাণ হচ্ছে যার কিলোমিটার প্রতি খরচ হচ্ছে ১০৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে এরকম ৪ লেনের নতুন সড়ক নির্মাণে ইউরোপে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয় ২৮ কোটি টাকা এবং ভারতে ও চীনে ব্যয় হয় ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। অথচ এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নির্মাণ শ্রমিকের মজুরি কম, এমন কি নির্মাণ সামগ্রী মুল্য তুলনামূলক কম থাকে। ইন্টারন্যাশনাল কন্সট্রাকশন কষ্ট সার্ভে, ২০১৩ তথ্য মতে মালয়েশিয়ায় নির্মাণ শ্রমিকের গড় মজুরি প্রতি ঘণ্টায় ৩ ডলার, চীনে ২ ডলার, ভারতে ৪০ সেন্ট। আর বাংলাদেশে ৪০ সেন্টের কম। বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় সবচেয়ে বেশি, মানের দিক থেকে সবচেয়ে নিচে! Global Competitive Index বলছে, সড়ক অবকাঠামোর মানের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৮১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১০৯। মর্মন্তুদ ভূমিকম্প বিধ্বস্ত নেপালের পরে বাংলদেশের রাস্তা এশিয়ার সবচাইতে নিকৃষ্ট।

২. নানা ভাবে ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট করা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০১৭-এর সেপ্টেম্বরে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় এগার শতাংশ। অবলোপনকৃত ৪৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। তারল্য সংকট মোকাবেলায় ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সরকারি ব্যাংগুলোকে প্রায় ১৫ হাজার কোটির টাকা বেইল আউট মানি দেয়া হয়েছে।

৩. দেশে স্বর্ণের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ লাখ টন। বাংলাদেশে বৈধ পথে সোনা আমদানি হয় না বললেই চলে। চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ পূরণ হয় চোরাচালানকৃত সোনা দারা।

৪. গত ৪০ বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকার ওপরে বৈদেশিক ঋণ-অনুদান সহায়তা  এসেছে। গবেষণাগুলো বলছে, বৈদেশিক ঋণ-অনুদান সহায়তার মাত্র ২৫-৩০ ভাগ সাধারণ মানুষের কাজে লাগে। বাকী ৭০-৭৫ ভাগ ক্ষুদ্র একদল সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর পকেট ভারী করে থাকে।

৫. ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এর ধারণাসূচকে ২০১৭ সালে বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭তম। টিআইবি’র বলছে, ২০১১-১২ অর্থ বছরে শুধুমাত্র সেবা খাতে ২১ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে যা ঐ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটের ১৩.৬ শতাংশ।  টিআইবি’র সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে যে দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর জিডিপি’র প্রায় ২-২.৫% ক্ষতি হচ্ছে তার প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সরকারী ব্যয়।

৬. গত কয়েক বছরে শুধুমাত্র ৬টি বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি চুরি বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এগুলো হল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, শেয়ার বাজার ২০১০ কেলেংকারি, হলমার্ক কেলেংকারি, বেসিক ব্যাংক কেলেংকারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেংকারি ও ডেসটিনি কেলেংকারি।

৭. এক তথ্যে জানা যায়, সরকারের প্রায় ৪৭ হাজার ২২৩ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।

ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধ ব্যবসা, চোরাকারবার, কালোবাজারি, লুটপাট ইত্যাদি উপায়ে অর্জিত টাকার একটি অংশ পাচার হয়, একটি অংশ অবৈধ বা কালো ব্যবসায় বিনিয়োগ হয়। কিছু পরিমাণ রিয়াল এস্টেট বা আবাসন খাতে বিনিয়োগ হতে দেখা যায়। তবে শিল্প ও কৃষি খাত তথা প্রকৃত উৎপাদনশীল খাতে এ টাকার বিনিয়োগ লক্ষণীয় নয়।

ছয়. জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না কর্মসংস্থান, বরং কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি  কমছে। এর সরাসরি ফলাফল, বাড়ছে বেকার মানুষের সংখ্যা ও বেকারত্বের হার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সহযোগিতায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রণীত ‘এমপ্লয়মেন্ট ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক পর্যালোচনায় এ বিষয়ের ওপর বিশদ আলোচনা করা হয়ে থাকে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত পর্যবেক্ষণে এ সংস্থাটি বলেছে, ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছর পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.০১। এ সময়কালে  কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৩ শতাংশ। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গড় অর্থনৈতিক  প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৬.১১ শতাংশ। এ সময়কালে  কর্মসংস্থানের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৩২ শতাংশ। ২০১০ সাল  থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক  প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ৬.২ শতাংশ। আর এ সময়কালে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ২.৩৯ শতাংশ। বাংলাদেশে আশংকাজনক হারে বাড়ছে বেকারত্বের হার ও সংখ্যা। বিবিএসসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় প্রতিবছর বাংলাদেশের শ্রম বাজারে প্রবেশ করে থাকে ২২ থেকে ২৪ লক্ষ নতুন মুখ। অথচ দেশ-বিদেশ মিলে প্রতিবছর কর্মসংস্থান হয়ে থাকে ১০-১২ লক্ষ বাংলাদেশীর। অর্থাৎ প্রতিবছর বেকার থেকে যায় কমপক্ষে ১০ লক্ষ কর্মক্ষম মানুষ। বিবিএসস-এর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাংলাদেশে মোট কর্মোপযোগী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এরমধ্যে কর্মে নিয়োজিত আছে ৮ কোটি ৮২ লাখ মানুষ। বাকি ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তির বাইরে বা বেকার। বেকারদের ভেতর ৩ কোটি ৬৩ লাখ ২৩ হাজার এবং পুরুষ ১ কোটি ১৯ লাখ ৪৭ হাজার জন। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) এর ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৩’ শিরোনামের সমীক্ষা থেকে দেখা যায় বাংলাদেশে ওই সময় ৪ কোটি ৩৪ লক্ষ লোকের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে যারা কর্মক্ষম মানুষ। তাদের মধ্যে ১ কোটি ২০ লক্ষ তরুণ-যুবক এমুহূর্তে পড়াশুনা করছে না; কোন ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে না। এরা নিস্ক্রিয়, অন্যের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ অপচয় হচ্ছে বিশাল শ্রমশক্তির যা দেশের অর্থনৈতিক বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত। উক্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী যারা দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭.৫ শতাংশ। আর যারা অনার্স-মাস্টার্স করেছেন তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৬.৪ শতাংশ। এতে দেখা গেছে কম শিক্ষিত বেকারত্ব হার কমছে, শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে। ২০১০ সালে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রীধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৯.৯ শতাংশ, ২০১৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৬.৪ শতাংশ। ধারনা করা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লক্ষ শিক্ষিত যুবক আনুষ্ঠানিক ভাবে কর্মহীন। আরও লক্ষ্যনীয়, আমাদের কর্মসংস্থান যা হচ্ছে  তার প্রায় ৮০%ই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যা শিল্পের বিকাশহীনতার বার্তা দিচ্ছে।

সাত. শ্রম চাহিদার সাথে সঙ্গতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ২ লক্ষের অধিক বিদেশি শ্রমিক কাজ করছিল। এরা মুলত উচ্চশিক্ষিত এবং দক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীরা প্রধানত ভারত, পাকিস্তান, চীন, শ্রীলংকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও তাইওয়ান এর নাগরিক। এরা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বেতন ভাতা গ্রহণ করছেন। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে প্রোডাকশন মানেজার, মার্চেনডাইজার, সিনিয়র অপারেটর, কাটিং মাস্টার, ডিজাইনার ও ওয়াশিং এক্সপার্ট এর মত শীর্ষ পদে কাজ করছে প্রধানত বিদেশী শ্রমিক। পৃথিবীর শীর্ষ রেমিটেন্স আহরণকারী দেশ ভারতের রেমিটেন্স আহরণে বাংলাদেশের স্থান পঞ্চম, অন্যসুত্র বলছে তৃতীয়। শুধুমাত্র ভারতের শ্রমিকেরা এদেশ থেকে প্রতি বছর নিয়ে যাচ্ছে ৩১ হাজার কোটি টাকা (সর্বশেষ হিসেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা)। এরা বৈধ ভাবে কাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা অনুমান করছেন বৈধ কাগজপত্র ছাড়াও এদেশে অসংখ্য বিদেশী শ্রমিক (বৈধ শ্রমিকের সমান সংখ্যক)কাজ করছে। হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়দের সংখ্যা ৫ লক্ষ হবে।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা শ্রম চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বিধায় এমনটি হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। একদিকে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে বিদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিকের আমদানিও বাড়ছে। আবার বিদেশে আমরা পাঠাচ্ছি মূলত অদক্ষ শ্রমিক। আমাদের প্রায় ৯০ লক্ষ প্রবাসী শ্রমিক বর্তমানে প্রতিবছর ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৪/১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠাতে পারছেন (বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিটেন্স পাঠিয়ে থাকেন)। এই অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে দ্বিগুণ হত যদি তাদের কর্মদক্ষতা থাকতো। আরও অধিক সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে যেতে পারতো। অবশ্য বিশেষ দক্ষতা থাকলে দেশেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

আট. দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রধান অবদান রাখছে জমি ও সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসন খাতসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা তথা সেবা খাত। অর্থাৎ কৃষি ও শিল্প তথা মূল উৎপাদনশীল খাতের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে অনুৎপাদনশীল সেবা খাত। আবার আমাদের প্রধান শিল্প তৈরি পোশাক শিল্প যার মূল্য সংযোজন ও সামাজিক উপযোগ অত্যন্ত কম। এভাবে সৃষ্ট ও বিকশিত পুঁজি উৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প বিকাশে তেমন ভূমিকা রাখছে না। অথচ কোন দেশের যখন প্রকৃত উন্নয়ন হয়, তখন প্রথমে কৃষির মাধ্যমে হয়, পরে তা হয় ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের মাধ্যমে। আবার টেকসই শিল্প উৎপাদন হল, উৎপাদনের উপায়  উৎপাদনকারী শিল্পের সঙ্গে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী শিল্পের ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশ। শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্যকে কেন্দ্র করে পুজিবাদী উৎপাদন এগিয়ে যায় না। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০১৭ থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৫.৩৫%, শিল্পের অবদান ৩১.৫৪% এবং সেবা খাতের অবদান ৫৩.১২%। অতীতের উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কৃষি খাতের সংকোচনের পর শিল্পখাতের অংশ বাড়ার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক। তারপর সম্প্রসারিত হয় সেবা খাত। তা না হয়ে কৃষির পর সেবা খাত সম্প্রসারিত হলে এটা টেকসই উন্নয়ন হয় না।

নয়. আমাদের দেশে উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে কৃষি পণ্যের মূল্যের বিশাল ফারাক রয়েছে। শিল্প মালিকেরা তার পণ্যের মূল্য যেভাবে নিজেরা নির্ধারণ করতে পারে সেভাবে কৃষকেরা পারে না। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক অর্থ সংকটের কারণে ফসল তোলার সাথে সাথে বিক্রি করতে বাধ্য হয় যখন উৎপাদিত পণ্যের দাম সবচেয়ে কম থাকে। আবার দ্রুত পচনশীল কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় ভরা মওসুমে দাম কমে গিয়ে উৎপাদন খরচ উসুল না হলেও সব শ্রেণির কৃষকই এসব পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য থাকে। আর কৃষকের ঘাম ও শ্রমের ফসল থেকে ফায়দা লোটে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া, মজুদদার এবং চাঁদাবাজরা। এদের দ্বারাই কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। এদের বিভিন্ন কূটকৌশলের কারণে কৃষক পর্যায়ে পণ্যের নিম্নমুল্য এবং ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের উচ্চমূল্য বজায় থাকে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কোন কৃষি পণ্যের দাম কম থাকলে এদেশেও ঐ পণ্যের দাম পরে যায়। এরকম বিভিন্ন ভাবে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। কৃষির প্রবৃদ্ধি, বিশেষ করে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমে আসার পিছনে ন্যায্য মূল্য আদায় না করতে পারা একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

দশ. বাংলাদেশ ১৭ কোটি লোকের একটি অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলেও মধ্যশ্রেণির ভোক্তার সংখ্যা নগন্য। অধিকাংশ লোকের আয় ও মজুরি খুব কম। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এবং ইউএনডিপি বলছে ২০১৬ সালে বাংলাদেশের ৩১.৫% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছিল যাদের আয় দৈনিক ১.২৫ ডলারের নিচে। অন্যদিকে অক্সফাম বলছে, বাংলাদেশে বসবাসের জন্য শোভন মজুরির প্রয়োজন ২৫২ মার্কিন ডলার। বিপরীতে একজন শ্রমিক পায় মাত্র ৫০ ডলার। ২০১২ সালের পর থেকে প্রকৃত মজুরিতো বাড়েইনি, বরং কিছুদিন স্থিতিশীল থেকে কমে গেছে। একটি দেশের ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা তথা অভ্যন্তরীণ ক্রয়ক্ষমতার সামর্থ্যের সাথে ঐ দেশের শিল্পায়ন সরাসরি সম্পর্কিত। তাই শিল্পায়নের স্বার্থে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি আবশ্যক। কৃষকের আয় নিশ্চিত করা ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিসহ আপামর জনগণের আয় বাড়িয়ে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

এগার. দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক, অনেকদিন ধরে বিরাজ করছে স্থবিরতা। এই অবস্থা দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের উভয়ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে। বিশ্বব্যাংকের ‘আন্তর্জাতিক ঋণ পরিসংখ্যান ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে যেখানে বিনিয়োগ ছিল ২৪৩ কোটি ৭২ লক্ষ ডলার, সেখানে ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে ১৭০ কোটি ৬৪ লক্ষ ডলার। বেসরকারি বিনিয়োগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগ জিডিপি’র ২১ থেকে ২৩ শতাংশের ভিতর আঁটকে আছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়াতে জটিলতা তথা শক্তি সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, পুঁজি পাচার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর অদক্ষতা  প্রভৃতি কারণ বিনিয়োগে বাঁধা হয়ে আছে।  বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস ২০১৮’ শীর্ষক বৈশ্বিক সূচক অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ আগের তুলনায় খারাপ হয়েহে। সহজে ব্যবসা করা যায় এমন ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭ যা গত বছর ছিল ১৭৬। বিনিয়োগ বাড়ছে না, অথচ ব্যাংকে টাকা নেই? ইদানীং যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ বা শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলার পরিমাণ বেঁড়ে গেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞগণের অভিমত, যন্ত্রাংশ বা শিল্পের কাঁচামাল আমদানির উদ্দেশ্যে এলসি খোলার পরিমাণ বাড়লেও তাতে শিল্পের প্রসার হবে এ ধারনা অতি সরলীকরণ হবে। কেননা সম্প্রতি অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে ভয়াবহ এক নতুন ফর্মুলার সন্ধান মিলেছে। এক্ষেত্রে মিথ্যা ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই ওভার বা আন্ডার ইনভয়েসিং এর। এ ফর্মুলায় এলসিকৃত কোন পণ্যসামগ্রী দেশেও আসছে না। এ পদ্ধতিতে প্রভাবশালী মহল পণ্য জাহাজীকরণের কাগজ জাল করে পুরো টাকাটাই তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করছে। সুতরাং এলসি খোলার পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে পুঁজি পাচার বেঁড়ে যাবার আশঙ্কা করা অমূলক নয়।

উপরে বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতির যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তাতে মোটাদাগে বলা যায় –

১. বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ক্রমশঃ বড় হচ্ছে। জিডিপি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে, বর্তমানে ৭% এর ঘরে চলে এসেছে।

২. পুঁজি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেঃ  প্রথমত, লভ্যাংশ আকারে বিদেশি কোম্পানিগুলো নিয়ে যাচ্ছে; দ্বিতীয়ত, দেশীয় কোম্পানিগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় টাকা বিদেশে পাচার করছে।; তৃতীয়ত, পাচার হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ।

২. দাপটের সাথে বিরাজ করছে কালো অর্থনীতি এবং লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর জিডিপি’র প্রায় ২ থেকে ২.৫% ক্ষতি হচ্ছে। অর্থনীতির আকার যত বড় হচ্ছে, লুটপাট ও দুর্নীতির পরিমাণ তত বেশি হচ্ছে।

৩. এটি কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি।

৪. দেশে যথাযথভাবে পুঁজির সঞ্চয়ন ও তা পুনঃ বিনিয়োগ হচ্ছে না। যে পুঁজি সৃষ্ট হচ্ছে তা  উৎপাদনশীল খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে তেমন অবদান রাখছে না।

৫. ধনী-গরিবের বৈষম্য সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থা সামগ্রিক অভ্যন্তরীণ টেকসই ক্রয়ক্ষমতার বিকাশ বাধাগ্রস্থ করছে।

৬. বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য আদায় করতে পারে না যা কৃষির পুজিতান্ত্রিক রূপান্তরে অন্যতম প্রধান বাঁধা।

৭. জাতীয় ও বৈশ্বিক শ্রম চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না।

৮. উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা বলে একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হয় প্রথমে কৃষির মাধ্যমে, পরে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশে কৃষির স্থান দখল করেছে অনুৎপাদনশীল সেবা খাত, দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা পালন করছে অনুৎপাদনশীল সেবা খাত।

এ ধরনের অর্থনীতির সাথে ঔপেনিবেশিক অর্থনীতির মিল লক্ষ্যনীয় যেখানে চিরায়ত ও উৎপাদনশীল পুঁজির বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত করা হয়, যেখানে পুঁজি পাচার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। নিচে নিকট অতীতে আমরা যে দুই দেশের উপনিবেশ ছিলাম তাদের আমলে অর্থাৎ ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপেনিবেশিক আমলের অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতির তুলনামূলক পর্যালোচনা করে সাধারণ বৈশিষ্ট্য খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।

ক. ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক আমল

মোটাদাগে ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক আমলের অর্থনীতির লক্ষ্য ছিল -

১. স্থানীয় শিল্প ধ্বংস করে ব্রিটেনের তৈরি পণ্যের বাজার তৈরি করা

২. ভারতবর্ষের সম্পদ লুঠ করে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া

৩. সস্তায় ভারতবর্ষ থেকে কাঁচামালের যোগানের ব্যবস্থা করা।

ব্রিটিশ আমলের অর্থনীতিকে দুই পর্বে ভাগ করা যায়,

ক. ১৭৫৭-১৮১৩ সময়কাল – এ সময়কালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকারী ছিল। তারা মুলত ভারতবর্ষ উৎপাদিত পণ্য ব্রিটেন ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে বিক্রি করত। তখন ব্রিটেন বা ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে বিক্রয় করার মত পণ্য উৎপাদিত হত না। তাই  এ সময় বাণিজ্য ছিল ভারতবর্ষের অনুকূলে। ইউরোপ থেকে থেকে জাহাজ খালি আসত, তাই তারা ভারতবর্ষে ইউরোপের লবণ বিক্রয় করা শুরু করে। যেহেতু এদেশেও লবণ উৎপাদন হত, কোম্পানি দাম কমিয়ে দিয়ে এবং চতুরতা ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এদেশের লবণ উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে লবণ বিক্রয় করার ব্যবস্থা করে। এসব হীন প্রচেষ্টা থাকা সত্তেও ১৮১৩ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল প্রধানত রফতানিকারক দেশ।

তবে স্বাভাবিক বাণিজ্য নয়, দুর্নীতি ও লুটপাট ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান বৈশিষ্ট্য।  ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটেনে ধনসম্পদ পাচারে বাণিজ্যের স্থান ছিল নগন্য, তার সবটাই ছিল সরাসরি লুট, দস্যুতা ও কেড়ে নেওয়া। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা ১৭৫৭-১৭৬৬ সালের মধ্যে ভারতীয়দের কাছ থেকে উপঢৌকন পেয়েছিল ৬০০০০০০ পাউন্ড। ১৭৬৯-৭০ সালে সমস্ত চাল কিনে এবং প্রচুর দাম না পাওয়া পর্যন্ত তা তা বিক্রয় বন্ধ রাখে কোম্পানি। বস্তুত, আইনের পরিভাষায় ‘দুর্নীতি’ বলতে যা বোঝায় ভারতবর্ষে তার অনুপ্রবেশ এবং লালনপালন হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। সহায় সম্পদহীন বেকার ক্লাইভ, যে ভারতে এসেছিল শুন্য হাতে, ভারত থেকে প্রথমবার ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যায় ততকালীন ২ লাখ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড সমমূল্যের সম্পদ। এই সম্পদ আত্মসাতের অভিযোগে শুনানি চলছিল তখন সে যে ভাষায় লুটপাটের স্বপক্ষে বক্তব্য রেখেছিল তা অভাবনীয়। ঐ সময় ভারতীয় ভাষার ‘লুট’ শব্দটি ইংল্যান্ডে পরিচিত হয়ে ওঠে, ইংরেজি ভাষায় স্থান নিয়ে নেয়।

খ. ১৮১৪ -১৯৪৭ সময়কালঃ এ সময়কালে এসে শিল্প পণ্য রফতানিকারক ভারতবর্ষ পরিণত হয় শিল্প পণ্য আমদানিকারক দেশে। প্রথমে বিদ্যমান বস্ত্রশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর এদেশে যাতে শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যবস্থা করা হয়। ১৮১৪ সাল থেকে ব্রিটেন থেকে সুতা ও সুতি বস্ত্র রফতানি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং ২০ বছরের ভিতরেই এদেশ পুরোপুরি আমদানিকারক দেশে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এবং ধিরে ধীরে এ দেশের কৃষি ইংল্যান্ডের শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারীতে পরিণত হয়।

ব্রিটিশরা কিভাবে একটি শিল্পসমৃদ্ধ দেশকে ঔপেনিবেশিক অর্থনীতির অধীনস্থ করে ফেলে তা বুঝতে তাদের ভুমি রাজস্ব নীতি এবং আমদানি-রফতানি নীতি পর্যালোচনা করতে হবে। তাহল -

১. ইংরেজপূর্ব সময়কালে ভুমি রাজস্ব আদায় করা হত উৎপাদিত ফসলের ছয়ভাগের একভাগ এবং চার ভাগের একভাগ হিসাবে। এই ব্যবস্থা বদলে দিয়ে ব্রিটিশরা নির্দিষ্ট হারে ভুমি বন্দোবস্ত দিয়ে নগদে খাজনা আদায় শুরু করে যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। এই ব্যবস্থায়ঃ

জমিদার বংশ পরম্পরায় জমির মালিকানা স্বত্ব পায়, জমি ইজারা ও বিক্রয় করার অধিকার পায়।

-  অনেক জমিদার তার জমিদারীর জমি একজনকে বা একাধিকজনকে ভাগ করে ইজারা দিত। এই ভাবে পত্তনি ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।

-  নিলামের মাধ্যমে জমিদারী বণ্টন করা হত। আবার নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে জমিদারীর খাজনা কোষাগারে জমা দিতে না পারলে জমিদারি নিলামে তোলা হত।

-  এই ব্যবস্থায় ফসল হোক বা না হোক চাষিদেরও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাজনা পরিশোধ করতে হত। কৃষকেরা প্রায়শই মহাজন থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে খাজনা দিতে বাধ্য হত। অনেক কৃষক ঋণ শোধ করতে না পেরে জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যেত।

-  চড়া হারে রাজস্ব আদায়ের নীতির কারণে পুরনো (ব্রিটিশ পূর্ব) জমিদার শ্রেণির প্রায় অবলুপ্তি ঘটল। ১৮১৫ সালের মধ্যেই বাংলার প্রায় অর্ধেক জমি পুরনো জমিদারদের হাত থেকে ফটকাবাজ ব্যবসায়ী, মহাজন ও সরকারি কর্ম করে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন এমন ব্যক্তিবর্গের হাতে চলে যায় যারা ছিল শহুরে, কৃষির সাথে যাদের কোন সম্পর্ক ছিল না।

এভাবে বাংলার কৃষিতে গড়ে ওঠে মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি নিখুঁত বহুধাপ ব্যবস্থা যা তার সমস্ত ভার চাপিয়ে দেয় হতভাগ্য কৃষকদের ওপর যাদের থেকে জমির ওপর বংশ পরম্পরায় ভোগ করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হয়।

এখানে উল্লেখ্য ব্রিটিশ পূর্ব সময়কালেও  (মুলত মুঘল আমলে এদের উদ্ভব ঘটে) জমিদারী ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তবে সকল জমি জমিদারী ব্যবস্থার আওতাধীন ছিল না। অনেক গ্রামের রায়ত বা চাষি সরাসরি রাজস্ব প্রদান করত। অন্যদিকে, জমিদারী ব্যবস্থার আওতাধীন গ্রামগুলোর রায়ত বা চাষি জমিদারকে রাজস্ব প্রদান করত এবং জমিদার পুরো জমিদারীর রাজস্ব রাজ কোষাগারে জমা দিতেন। জমিদার কৃষকের উৎপাদিত ফসলের একটি নিজের জন্য রেখে দিতে পারত। তবে রাজস্ব নির্ধারণ করতেন দিউয়ান ও তার কর্মচারীরা। রায়ত বা জমিদার কেউ ই জমির মালিক ছিল না। যদিও তারা বংশ পরম্পরায় জমি ভোগ করতে পারত বা হস্তান্তর করতে পারত। তবে জমি চাষ না করলে বা খাজনা না দিলে এ জমির ভোগ অধিকার থাকতো না। প্রাক ব্রিটিশ আমলে তালুকে অনুপস্থিত জমিদারের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তারা যেমন তালুকে বসবাস করত, তেমনি বেশিরভাগ জমিদার সরাসরি চাষাবাদের সাথে যুক্ত ছিল। জমিদারগণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় রাজ কর্মচারীদের সাহায্য করতেন। তবে তাদেরকে প্রশাসনের অংশ মনে করা হত না।

ব্রিটিশ পূর্ব জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্ট জমিদারদের প্রধান প্রধান পার্থক্য হল,(১) ব্রিটিশ পূর্ব জমিদারগণ জমির মালিক ছিলেন না, কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারদের শর্তাধীনে জমির মালিকানা দেয়া হয়। (২) পূর্বের জমিদারদের জমির সাথে সম্পর্ক ছিল কিন্তু নতুন জমিদারগণ ছিলেন জমির সাথে সম্পর্কহীন শহুরে নাগরিক। (৩) ব্রিটিশ সৃষ্ট জমিদারগণ নিজেরা  খাজনা নির্ধারণ করতে পারতেন। কিন্তু ব্রিটিশ পূর্ব জমিদারদের খাজনা নির্ধারণের ক্ষমতা ছিল না। (৪)ব্রিটিশ পূর্ব জমিদারদের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় কিছুটা দায়িত্ব নিতে হয়েছে, কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্ট জমিদারদের এ ধরনের কোন দায়িত্ব ছিল না।

২. বাংলা তথা ভারতবর্ষকে আমদানি ও রপ্তানি উভয়েরই বাজারে পরিণত করা, এবং নানা রকমের কাঁচামাল সস্তায় ইংলণ্ডে পাঠানো এবং এই কাঁচামাল থেকে উৎপন্ন পণ্য দ্রব্য চড়ামুল্যে বিক্রি করা ছিল ব্রিটিশ শাসকদের উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে ব্রিটিশরা ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষি পণ্যকে বাণিজ্যিকিকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাশ, ১৮১৩ সালে বাংলার মুখ্য শিল্পখাত টেক্সটাইল রপ্তানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা তথা ভারতবর্ষে উৎপন্ন পণ্য ইংলণ্ডে প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ করা হল, এবং যাতে ইউরোপের অনান্য দেশে বিক্রি না হতে পারে তার ব্যবস্থাও করা হল। এ লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার ভারতে উৎপাদিত বস্ত্র আমদানির ওপর ৬৭.৫% থেকে ৭৫% পর্যন্ত শুল্ক ধার্য করে। অন্যদিকে ভারতে আমদানিকৃত ব্রিটেনে উৎপাদিত পণ্যের ওপর মাত্র ২% আমদানি শুল্ক দিতে হত। আর ভারতের তুলা রপ্তানিতে কোনরূপ শুল্ক আরোপ করা হয় নি। এতদিন যে বাংলা ও ভারতবর্ষ ছিল প্রধানত রপ্তানিকারক দেশ, এখন সে হয়ে গেল আমদানিকারক দেশে। অবিস্মরণীয় কাল থেকে দুনিয়ার সুতিবস্ত্রের বৃহৎ কারখানা বাংলা এবার ভেসে গেল ইংরেজ টুইস্ট ও সুতিবস্ত্রে। কাজ হারিয়ে কারিগরগণ কৃষি কাজে চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৮২৪ সালে ভারতে ব্রিটিশ সুতিবস্ত্র আমদানি হয় ১০ লক্ষ গজের কম, সেখানে ১৮৩৭ সালে দাড়ায় ৬ কোটি ৪০ লক্ষ গজ। ঐ একই সময়ে মসলিনের কেন্দ্র ঢাকা শহরের জনসংখ্যা নেমে আসে ১৫০,০০০ জন থেকে ২০,০০০ জনে। ব্রিটিশ শাসনের পুরো সময়কাল জুড়ে এ অঞ্চলে শিল্প বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় নি। তাই দেখা যায়, ১৯০১ – ১৯৪১ সালের মধ্যে কৃষিতে নির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ ৬৭.৫-৭০% বৃদ্ধি পেয়েছিল। অন্যদিকে কৃষিকে ব্রিটেনের শিল্পের কাঁচামালের উৎসে পরিণত করার অংশ হিসেবে বলপূর্বক নীল চাষ প্রবর্তন করা হয়।

এ দেশের উঠতি ধনিক শ্রেণি তাদের পুঁজি জমি তথা জমিদারীতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয় প্রধান দুটি কারণে। প্রথমত, অসম প্রতিযোগিতা (ভারতীয় পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক ধার্য করণ), রপ্তানি সুযোগ সীমিত থাকা এবং রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা না থাকা। দ্বিতীয়ত, নিলামে সর্বোচ্চ দামে জমিদারী কেনার পর চড়া দামে জমি ইজারা দিতে পারা। ইজারাদারগণ আবার ইচ্ছেমত খাজনা আদায় করার অধিকারী ছিল।

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আয়ের প্রধান উৎস ছিল রাজস্ব। মোট নীট রাজস্বের প্রায় তিন পঞ্চমাংশ আসত ভুমি থেকে, এক সপ্তমাংশ আসত আফিম থেকে, এক নবমাংশের বেশি আসত লবন কর থেকে। অন্যদিকে ভারতের জন্য ব্যয়যোগ্য অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ খরচ হত সামরিক খাতে। আর পাবলিক ওয়ার্কস এ খরচ হত মাত্র পৌনে তিন শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে তারা ছিল নির্মম। তাই দেখা যায়, আকালের বছরেও রাজস্ব আদায় একটুও কমেনি।

সারমর্মে, ব্রিটিশদের রাজস্ব ও বাণিজ্য নীতির লক্ষ্য ছিল এ দেশে শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ধ্বংস করা। কৃষিকে ব্রিটিশ শিল্পের কাঁচামাল উৎপাদনে রূপান্তরিত করা। এজন্যে তারা শিল্পে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত ও জমিতে তথা খাজনা আদায়ে বিনিয়োগ সহজ ও নিরাপদ করেছিল।

সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়(ঔপেনিবেশিক ধ্যান ধারণার বুদ্ধিজীবীগণের প্রচারণার ফলে প্রতিষ্ঠিত), ব্রিটেনের উন্নত পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিকট বা অবাধ বাণিজ্যের কাছে বাংলা ও ভারতবর্ষের পশ্চাৎপদ অর্থনীতি পরাজিত হয়েছিল। এটা সত্য নয়, ইতিহাসের প্রকৃত সত্য হল, এদেশের অর্থনীতি পরাজিত হয়েছিল পুঁজিবাদী ব্রিটেনের রাজনৈতিক ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের দমন নীতির কাছে। বলপূর্বক ধ্বংস করা হয়েছিল ভারতবর্ষের অর্থনীতি। যেমন বলপূর্বক কৃষককে নীল চাষে বাধ্য করে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। যেমন নির্মমভাবে বাংলার বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংস করে লাখ লাখ তাঁতিকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। যেমন লবণ শিল্পকে ধ্বংস করে লক্ষ লক্ষ লবণ চাষিকে  বেকার করে  দিয়েছিল।

এটা অস্বীকারের উপায় নাই যে, ব্রিটিশ শাসকরা একধরনের পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তবে সে পুঁজিবাদ ছিল ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক অর্থনীতির পরিপুরক পুঁজিবাদ। তারা পুরনো অর্থনীতি ধ্বংস করেছিল ঠিকই, তবে চিরায়ত বা উন্নত পুঁজিবাদ দ্বারা তা প্রতিস্থাপন করেনি। শিল্প উৎপাদন নয়, ভারতবর্ষকে আমদানি ও রপ্তানি – উভয়ের বাজারে পরিণত করার কাজটিই তারা সফলভাবে করেছে। রপ্তানি পণ্য হল ইংল্যান্ডের শিল্পের কাঁচামাল এবং আমদানি পণ্য ছিল ইংল্যান্ডে তৈরি শিল্প পণ্য।

ব্রিটিশদের লুটপাট ও শোষণ, কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া, দেশীয় শিল্প ধ্বংস সাধন, চড়া হারে খাজনা আদায় বাংলা ও ভারতবর্ষের সুদৃঢ় অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে দেয়। ফলস্বরূপ সারা ভারতবর্ষে বড় বড় দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। বাংলা অঞ্চলে ২টি বড় দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। প্রথমটি সংঘটিত হয় ১৭৬৯-৭০ সালে যা ছিয়াত্তরের মনন্ত্বর নামে খ্যাত। লর্ড ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লুটপাট ও দুর্নীতি এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে বাংলার একতৃতীয়াংশ (১ কোটি) মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। বাংলার এক বিশাল অঞ্চল জনমানবহীন ঘন বনজঙ্গলে পরিণত হয়। দ্বিতীয় দুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয় ১৯৪৩ সালে যখন বাংলার প্রায় ৪০ লাখ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এটি পঞ্চাশের মনন্ত্বর নামে খ্যাত। তাছাড়া সমগ্র ব্রিটিশ শাসনকালে বেশিরভাগ মানুষের দু’ বেলা খাবার জুটত না। তখনকার করা এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯১১ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে প্রতিদিন মাত্র ২৯% মানুষের দু’ বেলা খাবার জুটত। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হল, এমন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বছরেও রাজস্ব আদায় একটুও কমেনি।

খ. পাকিস্তানি ঔপেনিবেশিক আমল

পাকিস্তান আমলে অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা ব্রিটিশ আমল থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল। ব্রিটিশ আমলের মত নগ্নভাবে নয়, নিয়ম পদ্ধতির ভেতর দিয়ে বৈষম্য বজায় রাখা হয়েছে, লুটপাট ও সম্পদ পাচার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশে দুই ধরনের অর্থনীতি চালু রেখে সম্পদ পাচার করা হয়, বৈষম্য বজায় রাখা হয়। যেমন,

(১) বিনিয়োগ ও উন্নয়নে সরকারি অর্থ খরচ ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক। ১৯৫৯-৬০ অর্থবছর থেকে ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরের ১০ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের জিডিপি বেড়েছে ১৭ শতাংশ, বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়েছে ৪২ শতাংশ।  পাকিস্তানের ২৩ বছরে ৩টি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ১১৩ কোটি ও ৫০০ কোটি রুপি। দ্বিতীয়টিতে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৯৫০ কোটি ও ১৩৫০ কোটি রুপি। এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৩৬% ও ৬৩%। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে পাকিস্তানের জাতীয় বাজেটে মোট বরাদ্দ ছিল ১৫৯২৭ কোটি রুপি। এরমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১৩৩৪ কোটি রুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪৫৯৩ কোটি রুপি। রাজস্ব খাতের ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ১৫০০ কোটি রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৫০০০ কোটি রুপি। উন্নয়ন খাতে ব্যয় পূর্ব পাকিস্তানে ৩০০০ কোটি রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০০০ কোটি রুপি। বৈদেশিক সাহায্য পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২০ ভাগ, পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৮০ ভাগ। বৈদেশিক দ্রব্য আমদানি পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২৫ ভাগ, পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৭৫ ভাগ।

(২) ১৯৭০ সালের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে পাকিস্তান সৃষ্টির পর (১৯৪৭) থেকে ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ৮ হাজার টাকা অর্জন করে। অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অর্জন করে ২৮৫৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর থেকে দেখা যায়, এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান ৪১২ কোটি ৯৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বেশি অর্জন করেছে। অথচ ওই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান আমদানি করে ৪৮৬১ কোটি ৬৩ লাখ ৫ হাজার টাকার পণ্য। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি করা হয় মাত্র ২৩৩৫ কোটি ৩৯ লাখ ৫১ হাজার টাকার পণ্য। অর্থাৎ এই ২৩ বছরে পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল ৫৪.৭%। রপ্তানি আয় বেশি করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমদানি ব্যয় ছিল ৩১.১%।

(৩) পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য দেশবিভাগের সময় থেকেই বিদ্যমান ছিল। তবে পাকিস্তান আমলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৯-৫০ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য ২১.৯ শতাংশ। ১৯৬৯-৭০ সালে এসে আয়ের বৈষম্য দাঁড়ায় ৬১.৫ শতাংশে। তবে মাথাপিছু আয় কম হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জীবন যাত্রার ব্যয় ছিল অনেক বেশি, কেননা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বেশি ছিল। যেমন  পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে চালের দাম ছিল (মণপ্রতি) পূর্ব পাকিস্তানে ৫০ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫ রুপি। আটা (মণপ্রতি) পূর্ব পাকিস্তানে ৩০ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ১৫ রুপি। সরিষার তেল (সের প্রতি) পূর্ব পাকিস্তানে ৫ রুপি, পশ্চিম পাকিস্তানে ২.৫ রুপি।

(৪) পাকিস্তানের ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে ৬৮টি পাটকল, ৩৭টি বস্ত্র কল, ১০টি চিনি কল স্থাপিত হয়। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কলকারখানাগুলো হল, জুট মিল স্পেয়ার পার্টস তৈরির কারখানা, কাগজ-নিউজপ্রিন্ট-হার্ডবোর্ড মিল, অক্সিজেন তৈরি কারখানা, ক্যাবল ফ্যাক্টরি ইত্যাদি। এছাড়া স্থাপিত হয় গাড়ী সংযোজন কারখানা, বাইসাইকেল নির্মাণ ও সংযোজন কারখানা, রসায়ন শিল্প ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগের মালিক ছিল মূলত অবাঙালি বা পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী যাদের প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। তাদের আয়কর, শিল্পকর পশ্চিম পাকিস্তানের রাজস্বে জমা হত। এসব শিল্প কারখানার বেশিরভাগই পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা তথা রাষ্ট্রের সহযোগিতায় স্থাপিত হয়েছিল। তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক শিল্পায়ন হয়। তার প্রতিফলন পড়েছে রপ্তানি বানিজ্যে। রপ্তানি খাতে পাকিস্তান আমলের শেষদিন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পাট ও পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। পক্ষান্তরে, শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তান তুলা ও তুলাজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও শেষ দিকে এসে রপ্তানির ক্ষেত্রে তুলা ও তুলাজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতার অবসান ঘটে। পশ্চিম পাকিস্তানে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিকাশ ঘটে যা পূর্ব পাকিস্তানের বেলায় ঘটেনি।

১৯৫১-৫২ সালে গড় পড়তা আয়ের ক্ষেত্রে দুই প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য ছিল ১৮ শতাংশ, ১৯৬৭-৬৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ শতাংশে দাঁড়ায়। আয়ের এ পার্থক্য সূচিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে অধিক হারে বিনিয়োগ এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচারের কারণে। প্রধানত কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনার ব্যয়, রাজধানী উন্নয়ন ব্যয়, প্রতিরক্ষা সেক্টরের ব্যয়, আন্ত প্রদেশ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং ব্যাঙ্কিং ও বীমার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হত। পাকিস্তানের চতুর্থ পরিকল্পনার অর্থনৈতিক প্যানেলের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৯৪৮-৪৯ থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ওপর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য হিস্যা ছিল ৩৫১৪ কোটি রুপি, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত ব্যয় হয়েছে ১৯৩৩ কোটি রুপি। এ হিসাবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্য স্থানান্তর হয়েছে ১৫৮১ কোটি রুপি। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট বাদ দিলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ স্থানান্তর হয়েছে ১১৭৯ কোটি রুপি।

উপরের আলোচনা থেকে ঔপেনিবেশিক অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনীতির যে মিল দেখা যায়, তাহল -

(১) বৈধ ও অবৈধ পথে পুঁজি ও সম্পদ পাচার ঔপেনিবেশিক অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য যা স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রকটভাবে বহাল রয়েছে।

(২) বাংলাদেশে ঔপেনিবেশিক আমলের মতই তীব্র আয় বৈষম্য বিরাজ করছে।

(৩) ঔপেনিবেশিক আমলের মতই মৌলিক শিল্প বা ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের বিকাশ হচ্ছে না, ঔপেনিবেশিক আমলের মতই শিল্পের প্রধান দিক ভোগ্যপণ্য উৎপাদন।

(৪) দুর্নীতি, লুটপাট এবং পুঁজি ও সম্পদ পাচার করতে গিয়ে ঔপেনিবেশিক আমলের মতই অর্থনীতির স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে, উৎপাদনশীল অর্থনীতির বিকাশকে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে।

 

সহায়ক গ্রন্থ, গবেষণা প্রতিবেদন ও অর্থনৈতিক নিবন্ধঃ

১.The Agrarian System of Mughal India – Irfan Habib

২. Making of a nation, Bangladesh – Nurul Islam

৩. বাংলাদেশের অভ্যুদয়  - রেহমান সোবহান

৪. বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন

৫. বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিবন্ধ

   (চলবে........)

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ