লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান, আপডেটঃ September 18, 2018, 12:00 AM, Hits: 1841
এক. বাংলাদেশে বর্তমানে যে ধরনের স্থানীয় শাসন প্রচলিত তার শুরু ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক আমলে। ব্রিটিশরা তাদের ঔপেনিবেশিক শাসন ও অর্থনৈতিক লুটপাট পরিচালনার উপযোগী করে এই গণ বিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিক স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এজন্য তারা ধ্বংস করে হাজার বছরের স্থানীয় স্বশাসিত সরকার তথা গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলার গণমানুষের নিজস্ব ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল ভিত্তিতে বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক-সামাজিক এককসমূহের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত। এসব স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক-সামাজিক এককগুলো পরিচালিত হত স্থানীয় স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থার গণসংস্থাসমূহকে অবলম্বন করে। রাজ্যের-সাম্রাজ্যের ভাঙ্গা-গড়া, উত্থানপতন বা রাজার পরিবর্তন এসব সংস্থায় মৌলিক কোন প্রভাব ফেলে নি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়, মৌর্য ও মৌর্যপূর্ব যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ – ১৮৩ অব্দে) গ্রামের বিশিষ্ট পরিবারের প্রবীণদের দ্বারা একটি পরিষদ গঠিত হত যারা স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের প্রশাসনের কাজ চালাত। পরবর্তী হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম রাজবংশীয় শাসন আমলেও এ ধরনের স্বশাসিত গণসংস্থা দ্বারা গ্রামের প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে।
তারও পূর্বে, যখন কোন রাষ্ট্র ছিল না, যখন কৌম সমাজই ছিল সর্বেসর্বা, তখন থেকে এ অঞ্চলে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছে বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। কৌম সমাজ পরিচালিত হতো নির্বাচিত নেতৃত্ব তথা পঞ্চায়েতমণ্ডলী দ্বারা। আদিবাসী, বিশেষকরে মুণ্ডাদের মধ্যে কয়েকটি গ্রাম জুড়ে গ্রাম সংঘের মতো সমাজ বন্ধন এখনো দেখা যায়। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, এ অঞ্চলে পঞ্চায়েত প্রথার প্রচলন সম্ভবত মুণ্ডাদের দ্বারাই শুরু হয়েছে। কৌম সমাজে দলপতি নির্বাচনের চর্চা ছিল এবং কৌম সমাজ একত্র হয়ে কৌম পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিত। অর্থাৎ এ অঞ্চলের নির্বাচন ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে কৌম সমাজ থেকে।
ব্রিটিশপূর্ব বাংলার শাসনযন্ত্রে তিনটি প্রধান স্তর বরাবরই বিদ্যমান ছিল। প্রথমটি কেন্দ্রীয় সরকার, দ্বিতীয়টি প্রশাসনিক অভিজাত শ্রেণী ও শেষটি ছিল স্বশাসিত গণসংস্থা বা গ্রাম পঞ্চায়েত। প্রথম স্তরটি ছিল মূলত বিদেশী এবং বাংলার মাটির সাথে সংযোগহীন। যোগাযোগে অসুবিধা, ভিন্ন ভাষা, স্বজাতীয় লোকের স্বল্পতা - প্রভৃতি কারণে বিদেশী শাসকেরা নির্ভর করতো দেশী লোকের ওপর, যারা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের মূল ভিত্তি। রাজ্যের ক্ষমতা, পদ ও পদবী দিয়ে ওদেরকে করা হতো সমাজের প্রভু। নতুন কেন্দ্রীয় শক্তি এসে তাদেরকেই অভিজাত শ্রেণির তালিকাভুক্ত করতো, যারা তার বিজয়ে সাহায্য করেছে এবং যাদের আনুগত্য ও প্রভুভক্তি ছিল সন্দেহাতীত। তা ছাড়া বিবেচনা করা হতো স্বধর্ম, স্ববর্ণ ও স্বজাতি। তাই আমরা দেখতে পাই যে প্রত্যেকবারই কেন্দ্রীয় শক্তির পরিবর্তনে দেশের প্রশাসনিক অভিজাত শ্রেণির গঠন ও বিন্যাসে এসেছে আমূল পরিবর্তন।
গুপ্ত সম্রাটগণ কর্তৃক শাসিত বঙ্গরাজ্য অনেকগুলি ধারাবাহিক প্রশাসনিক ভাগে বিভক্ত ছিল, যেমন ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মন্ডল’, ‘বীথি’ ও সর্বনিম্নে ‘গ্রাম’। এ সকল প্রশাসনিক ভাগের প্রত্যেকটির একটি করে প্রধান কেন্দ্র বা ‘অধিকরণ’ (অধিষ্ঠান) ছিল। ‘ভুক্তি’ (আধুনিক বিভাগ-এর অনুরূপ) ছিল সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক বিভাগ এবং সম্রাটের একজন প্রতিনিধি তা শাসন করতেন। ‘ভুক্তি’পতি বা শাসনকর্তা তার কার্যাবলির জন্য সরাসরি সম্রাটের কাছে দায়ী থাকতেন, কারণ তার নিয়োগ সম্রাটের ইচ্ছা বা মঞ্জুরীর উপর নির্ভর করত। ‘ভুক্তি’র পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগের নাম ‘বিষয়’। ‘বিষয়’ দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রশাসনিক ইউনিট এবং শাসনক্ষেত্রে এর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা ছিল আধুনিক জেলার অনুরূপ। ‘বিষয়’ এর শাসনকর্তাকে প্রথম গুপ্তযুগে বলা হতো ‘কুমারমাত্য’ এবং পরবর্তী গুপ্তযুগে ‘’আযুক্তক’। আবার কোথায়ও ‘বিষয়’ এর শাসনকর্তাকে ‘বিষয়পতি’ বলা হতো। সাধারণত ‘ভুক্তি’র শাসনকর্তাই তার অধীন ‘বিষয়’ বা জেলার প্রশাসক নিয়োগ করতেন। ‘বিষয়পতি’ কর্মচারী দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এসকল কর্মচারীর মধ্যে দলিল-রক্ষক (পুস্তপাল) ভূমি দান-বিক্রয় সংক্রান্ত কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। সম্ভবত বিষয়াধিকরণের কার্যক্রম কেবল ভূমি হস্তান্তর সংক্রান্ত কাজে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভূমি দান-বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যাবলি ছাড়াও বিষয়াধিকরণ আরও অনেক প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করত। আবার কোথায়ও কোথায়ও ‘বিষয়পতির’ সহায়করূপে এক উপদেষ্টামন্ডলীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী চারজন সদস্য ও স্বয়ং বিষয়পতি সমন্বয়ে এ উপদেষ্টামন্ডলী গঠিত হতো। এ উপদেষ্টা-সভার সদস্যরা ছিলেন ‘নগরশ্রেষ্ঠী’, ‘প্রথম-সার্থবাহ’, ‘প্রথম-কুলিক’, এবং ‘প্রথম-কায়স্থ’। ‘বিষয়’ বা জেলার পরবর্তী প্রশাসনিক বিভাগ ‘বীথি’র শাসনব্যবস্থা প্রাচীন বাংলার প্রশাসনের অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ‘বীথি’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ অস্পষ্ট। কখনও কখনও বীথি ‘ভুক্তি’ বা ‘মন্ডল’-এর উপ-বিভাগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ‘বীথি’র অধিকরণকে সহায়তা দানের জন্য বিশিষ্ট লোকদের সমন্বয়ে একটি পরিষদ থাকত। ‘বীথি’র অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ যেমন ‘মহত্তর’, ‘অগ্রহঋণ,’ ‘খড়গী’ (অসি যোদ্ধা) এবং অন্ততপক্ষে একজন ‘বহনায়ক’ (যানবাহন তত্ত্বাবধায়ক) মিলে এ পরিষদ গঠিত হতো।
পূর্ববর্তী যুগের ন্যায় পাল যুগেও বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট যেমন ‘ভুক্তি’, ‘বিষয়’, ‘মন্ডল’সহ অন্যান্য ছোট ছোট বিভাগের প্রচলন ছিল। পাল লিপিমালা থেকে ‘বিষয়’ ও ‘মন্ডল’ ছাড়াও ‘খন্ডল’, ‘আবৃত্তি’ ও ‘ভাগ’ নামে বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশাসনিক বিভাগের উল্লেখ রয়েছে। ‘আবৃত্তি’সমূহ বিভিন্ন ‘চতুরকে’ এবং ‘চতুরক’গুলি সম্ভবত বিভিন্ন ‘পাটকে’ বিভক্ত ছিল। এ বিভাগগুলির যথার্থ প্রকৃতি নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, পাল লিপিমালায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার উপর বেশ আলোকপাত করা হলেও সেগুলিতে সমসাময়িক প্রাদেশিক ও স্থানীয় শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ নেই।
দুই. তেমনি মুসলিম শাসন তথা মুঘল ও নবাবী আমলেও এ রকম বিভিন্ন প্রশাসনিক ইউনিট বিদ্যমান ছিল। এ সময়ে মধ্যবর্তী স্তরে সামন্ত বা জমিদার ব্যবস্থার পত্তন হতে দেখা যায়। বাবর সামন্ত অধিপতিদের ওপর স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। সামন্ত অধিপতিগণ নিজ নিজ অঞ্চলে প্রায় অর্ধ স্বাধীন রাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং নিজস্ব আইন অনুযায়ী শাসন করতেন। তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, সামন্ত অধিপতি বা জমিদারগণ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন।
কিন্তু কেন্দ্রীয় বা মধ্যবর্তী, কেউই গ্রাম-প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করেনি, গ্রাম-প্রশাসনে কোন পরিবর্তন সংঘটিত হয় নি।
১৮১২ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ কমন্স সভা কমিটির একটি রিপোর্টে প্রাক ব্রিটিশ সামাজিক অবস্থার একটি বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে মুঘল আমলের গ্রাম প্রশাসনের চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে বলা হয়েছে, “ ভৌগলিকভাবে একটি গ্রাম হল কয়েক শত বা কয়েক হাজার একর আবাদী বা পতিত জমির এক একটি অঞ্চল; রাজনৈতিকভাবে দেখলে তার ধরনটা কর্পোরেশন বা পৌর গোষ্ঠীর মতো। তার পরিচালক বা সেবকদের ব্যবস্থাপনা নিম্নোক্ত ধরনেরঃ পটেল অথবা প্রধান মণ্ডল, তার ওপর সাধারণত গ্রামের অবস্থা-ব্যবস্থা তদারক করবার ভার, অধিবাসীদের মধ্যকার ঝগড়ার সে মীমাংসা করে, পুলিশের কাজ দেখে, এবং স্ব-গ্রামের অভ্যন্তর থেকে কর সংগ্রহের কাজ চালায় – ব্যক্তিগত প্রভাব এবং গ্রামবাসীদের অবস্থা ও স্বার্থের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ পরিচয়ের ফলে এ দায়িত্বের পক্ষে সে হয় সবচেয়ে উপযোগী। কর্ণম চাষের হিসাব রাখে এবং চাষ সংক্রান্ত সবকিছু নথিবদ্ধ করে। তৈলার আর তোত্তী – প্রথম জনের কাজ অপরাধীদের সংবাদ এবং গ্রাম থেকে গ্রামান্তর গমনাগমনে লোকজনকে পৌঁছে দেয়া ও রক্ষা করা; অপর জনের এখতিয়ার গ্রামেই সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়, অন্যান্য কাজ ছাড়াও তার কাজ হল শস্য পাহারা দেওয়া এবং তার পরিমাপে সাহায্য করা। সীমানাদার – তার কাজ গ্রামের সীমানা রক্ষা এবং কলহ উপস্থিত হলে সীমানা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেওয়া। জলাশয় ও জলপ্রণালীর তত্ত্বাবধায়ক কৃষির জন্যে জলের বিলিব্যবস্থা করে। ব্রাহ্মণ করে গ্রামের পূজা অর্চনা। গুরু মহাশয়কে দেখা যায় ছেলেপিলেদের বালির ওপর লিখতে পড়তে শেখাচ্ছেন। এইসব পরিচালক ও সেবকদের নিয়েই সাধারণত গ্রামের ব্যবস্থাপনা; কিন্তু দেশের কোন কোন অঞ্চলে সে ব্যবস্থা এত প্রসারিত নয়, উপরে কথিত দায়-দায়িত্বের কতকগুলি একই ব্যক্তি পালন করে। আবার কোন কোন অঞ্চলে উপরে কথিত লোক ছাড়াও অনেককে দায়িত্ব নিতে দেখা যায়। এই সরল ধরনের পৌর-শাসনের আওতায় অবিস্মরণীয় কাল থেকে এ-দেশবাসী বাস করে আসছে। গ্রামের সীমানা বদল হয়েছে ক্বচিৎ; এবং যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা মারীমড়কে গ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি বিধ্বস্ত হলেও সেই একই নাম, একই সীমানা, একই স্বার্থ, এমনকি একই পরিবারসমূহ চলে এসেছে যুগের পর যুগ। রাজ্যের ভাঙ্গাভাঙ্গি, ভাগ-বিভাগ নিয়ে অধিবাসীরা মাথা ঘামায় না।, গ্রামটি অখণ্ড হয়ে থাকলেই হল, কোন শক্তির কাছে তা গেল, কোন সম্রাটের তা করায়ত্ত হল এ নিয়ে তারা ভাবে না। গ্রামের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি অপরিবর্তিতই থাকে। সেই একই পটেল থাকে প্রধান মণ্ডল তথা ক্ষুদে বিচারপতি বা শাসনকর্তা; এবং গ্রামের কর আদায়ের কাজ তারা চালিয়ে যায়”। সুলতান বা নবাবী আমলে বাংলার পূর্বাঞ্চলে গ্রাম প্রধানকে চৌধুরীও বলা হতো।
বস্তুত সর্বযুগেই (প্রাক ব্রিটিশ) কেন্দ্রীয় রাজশক্তির ক্ষমতার শেষ সীমা ছিল প্রশাসনিক অভিজাত শ্রেণি পর্যন্ত। এর বাইরের বাঙালী সমাজ ছিল বরাবরই স্বাধীন-স্বচালিত। তাই দেখা যায় যুগে যুগে রাজ্যপতির পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু গ্রামপতির পরিবর্তন হয় নি। গ্রামপতিদের নিয়ে গঠিত গ্রাম পঞ্চায়েত তার অধীনস্থ এলাকাকেই চিরকালই শাসন করে এসেছে তার নিজস্ব আচার ও শাস্ত্র মতে। কেন্দ্রীয় সরকার রাজস্ব পেয়েই খুশী থাকতো এবং সে রাজস্ব আদায় ও সংশ্লিষ্ট শাসনকার্যের ভার ছিল দেশীয় অভিজাত শাসকশ্রেণীর ওপর।
মুঘল ও নবাবী আমলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থার যে চিত্র দেখতে পাই তা ছিল নিম্নরূপঃ
১. প্রথমত জমিদাররা তাদের নিজ নিজ এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সশস্র বাহিনী রাখতেন। এই বাহিনী জমিদারদের হুকুম তামিলের পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ হিসেবেও ভূমিকা পালন করত। এদের প্রতিপালনের জন্য জমিদাররা নিষ্কর ভূমি দান করতেন। আবার জমিদাররাও এদের প্রতিপালনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে রাজস্ব অব্যাহতি পেতেন।
২. দ্বিতীয়ত জমিদারের থানাদারী ব্যবস্থা থেকে পৃথকভাবে গ্রাম সমাজে চৌকিদারদের দিয়ে একটি সম্পূরক পুলিশি ব্যবস্থা ছিল। এটা গ্রামের জনগণের শান্তি রক্ষার নিজস্ব ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করত। গ্রাম সমাজই এদের প্রতিপালনের ব্যবস্থা করত।
বস্তুত প্রাক ব্রিটিশ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ব্যবস্থা ছিল সর্বযুগেই প্রায় একই রকম। তবে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগের শাসন ব্যবস্থায় কিছুটা ফারাক ছিল। প্রাচীন যুগে দ্বিতীয় স্তরের প্রশাসন ছিল প্রধানত আমলাতন্ত্র নির্ভর। কিন্তু মধ্যযুগে বিশেষ করে মোগল আমলে মধ্যস্তরের জমিদারগণ কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতেন। তাদেরকে পুরোপুরি আমলা বলা চলে না। অবশ্য পাল আমলেও মধ্যস্তরের সামন্তগণ এরকম কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতেন। তবে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, সামন্ত বা জমিদারগণ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন।
তিন. এই স্বশাসিত গণসংস্থা বা স্বশাসিত স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার ওপর কার্যকর আঘাত আসে ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক শাসকদের দ্বারা। ঔপেনিবেশিক কর্তৃত্বকে সর্বব্যাপী প্রসারিত করার রাজনৈতিক প্রয়োজনে তারা গ্রামের স্বশাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ তথা ধ্বংস করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১৮১৬-এর বিধি ২২ দ্বারা সমাজ কর্তৃক তার নিজস্ব পঞ্চায়েত নির্বাচন করার ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয়। এই আইন দ্বারা নির্দেশ করা হয় যে, এখন থেকে ৫জন করে সদস্য নিয়ে গঠিত পঞ্চায়েতের সদস্যদের মনোনয়ন ও নিয়োগদান আসবে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট থেকে। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল কাউন্সিলে লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইনে এদেশের গ্রামাঞ্চলে তিন স্তর বিশিষ্ট স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগুলো হল (১) জেলা কমিটি (২) থানা কমিটি ও (৩) ইউনিয়ন কমিটি। ১৯১৯ সালে গৃহীত নতুন আইনে ১০টি গ্রাম নিয়ে তিন বছর কার্যকালের ইউনিয়ন বোর্ড চালু করা হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে এ আইন সংশোধন করে গোপন ব্যালটে ভোট চালু হয় এবং নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করা হয়। তিনটি ওয়ার্ড সৃষ্টি করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে এর নামকরণ করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ। ১৯৯৬ সালে করা হয় ৯টি ওয়ার্ড। এভাবে অবয়বে পরিবর্তন করা হলেও ক্ষমতা কাঠামোয় কোন পরিবর্তন করা হয় নি। এটি ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক আমলের ন্যায় গণবিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে থেকে গেছে।
শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাক ব্রিটিশ ব্যবস্থাও নিজস্ব উপনিবেশিক স্বার্থে ধ্বংস করা হয়। ৭ ডিসেম্বর, ১৭৯২ এর পুলিশ বিধি দ্বারা প্রথমে এই নীতি ঘোষণা করা হয় যে, দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার সমস্ত দায়িত্ব একমাত্র কেন্দ্রীয় শাসন কর্তৃত্বের হাতেই ন্যস্ত থাকবে, আর কারও হাতে নয়। ১৭৯৩ এর বিধি ১(ধারা ৮) দ্বারা জমিদারদের পুলিশ বাহিনী প্রতিপালনের অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দেয়া হয়। তবে চৌকিদারদের ক্ষেত্রে ভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া হয়। ১৮১৭ এর বিধি ২০ দ্বারা চৌকিদারদের ওপর দারোগার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু তাদেরকে বেতনভুক্ত কর্মচারী করা হয় নি। জমিদারদের ভুমিদান এবং গ্রাম সমাজের স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৮৫৬ এর ২০ ধারা জারীর পরিপ্রেক্ষিতে পঞ্চায়েত বা গ্রাম সমাজ চৌকিদার নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারটুকুও হারায়। চৌকিদাররা পুলিশ কর্মচারী রূপে গণ্য হয় এবং তারা সরাসরি দারোগার নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে। কিন্তু তাদের বেতনভোগী সদস্য করা হয় নি। তবে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত যে জমি ভোগ করত, তাতে জমিদারের রাজস্ব প্রদান করতে হত না। ১৮৭০ এর পর গ্রাম চৌকিদার আইন দ্বারা তাদের এ অধিকারও হরণ করা হয়। এভাবে প্রতিপালনের বিষয় অমীমাংসিত রেখে চৌকিদারদের পদটিকে কার্যক্ষেত্রে গুরুত্বহীন করা হল।
এভাবে স্বশাসিত গণসংস্থা বা গ্রাম পঞ্চায়েত আমলাতন্ত্রের অধীনস্থ করে ফেলা হয়। তাই ঐতিহ্যগত ও ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক শাসনামলের ইউনিয়ন পরিষদ যেভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে, তার সাথে কোনভাবেই গণতান্ত্রিক চেতনার কোন সম্পর্ক নেই। প্রকৃত অর্থে স্থানীয় সরকার সংস্থা কেন্দ্রীয় প্রশাসনের শাখা বা সম্প্রসারণ বই অন্য কিছু নয়। ব্রিটিশদের গঠিত এ সংস্থাগুলো সে আমলেও গণসংস্থা ছিল না, এখনো নেই। বস্তুত জনগণের রায়ে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদগুলো আদতে জনগণের প্রতিষ্ঠান নয়, এগুলো জনগণের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি। বরং এগুলো দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি এবং অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচির পণ্য বা টাকা আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের লুটপাটের অংশ হয়েছে।
চার. রূপের দিক দিয়ে, চর্চার দিক দিয়ে গণতন্ত্র হল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়। তা সম্ভব হলে মাত্রই শাসন ব্যবস্থায় জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তথা নিজেরাই নিজেকে শাসন করতে পারে যা গণতন্ত্রের মর্ম কথা। প্রশাসনের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তাই বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক স্থানীয় প্রশাসনের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় এই দুই স্তরে বিভক্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য, সীমারেখা ইত্যাদির স্পষ্ট রূপরেখা গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে স্থানীয় সরকারের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য করার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে| এবং স্থানীয় সরকারকে জনগণের নিকট সরাসরি জবাবদিহিতে বাধ্য করার জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ‘রিকল’সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় সরকারের কাছে স্থানীয় জনশৃঙ্খলা রক্ষা, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্থানীয় করারোপ ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। স্থানীয় বিরোধ মীমাংসার আইনী ও বিচারিক দায়িত্বও স্থানীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের ন্যুনতম মূল্য (পণ্যের উৎপাদন খরচ +মুনাফা ) নির্ধারণ ও স্হানীয় বাজারে ন্যুনতম মুল্যের উপরে স্হানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্য বিক্রির নিশ্চয়তা সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় তদারকির ব্যবস্হাসহ স্থানীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভারসাম্য রক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালনের আইনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্থানীয় তদারকি ও অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাচীন বাংলার স্থানীয় স্বশাসিত সরকার তথা গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আমাদের দিক নির্দেশক হতে পারে।
বস্তুত বাংলাদেশে বর্তমানে একটি মাত্র সরকার ব্যবস্থা রয়েছে, তা হল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকার। স্থানীয় সরকার সংস্থা হিসেবে যেগুলোকে দেখানো হচ্ছে সেগুলো প্রকৃতঅর্থে বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগের শাখা হিসেবে কাজ করছে। সংবিধানে স্থানীয় শাসনের ধারণা দেয়া আছে। এই ধারণার বিপরীতে স্থানীয় সরকারের ধারণা গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সংবিধানের ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের বাংলা অনুবাদ সংশোধনসহ সংবিধানের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হবে সবার আগে।