লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ June 16, 2019, 12:00 AM, Hits: 718
(পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার পরিণতি স্বরূপ একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের সরকারী বা অফিসিয়াল ভাষ্যের বাইরে গিয়ে অন্তরালে থেকে যাওয়া গভীরতর সত্য ঘটনাগুলি নিয়ে এ দেশে আলোচনার খুব অভাব। তবে ইদানীং কেউ কেউ বলবার চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়। এটা একটা আকর্ষণীয় বিতর্কও সৃষ্টি করতে পারে, আমি যেটার অভাব বহুকাল ধরে খুব বেশী অনুভব করি। সেই দিকে দৃষ্টি রেখে এবং এই বিতর্কে কিছু প্রশ্ন যুক্ত করতে চেয়ে ২০০৭ সালে আমার লিখা এবং বঙ্গরাষ্ট্রের গ্রন্থাগার বিভাগের প্রবন্ধ শাখায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সঙ্কট ও উত্তরণের পথ’ নামক গ্রন্থের একটি অধ্যায় ‘স্বাধীনতার সঙ্কট’ নিম্নে প্রকাশ করা হল। — লেখক)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন গুরুতর হুমকির সমমুখীন। ১৯৭১-এর পর থেকে বাঙ্গালী জাতির জীবনে অনেক সঙ্কট ও বিপদ এলেও এত বড় সঙ্কট আর বিপদ কখনও এসেছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের বিরাট ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব, গ্যাস-কয়লার মত খনিজ সম্পদ প্রাপ্তি এবং আরও প্রাপ্তির সম্ভাবনা এবং বঙ্গোপসাগরের গর্ভ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বর্গ মাইল তথা বাংলাদেশের কাছাকাছি আয়তনের এক বিশাল ভূখণ্ডের উত্থান প্রক্রিয়া বাংলাদেশের সামনে যেমন বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তেমন এগুলিই এখন তার জন্য বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা সতর্ক না থাকি এবং এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন ও রক্ষার জন্য যোগ্য হতে না পারি।
একটা দেশের স্বাধীনতার বিলুপ্তি বা পরাধীনতার জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা দুর্বলতা প্রয়োজনীয় হয় এমন ধারণা করা হবে ভুল। সমৃদ্ধ একটা দেশও তার রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বের জন্য যে পরাধীন হতে পারে তার দৃষ্টান্তের জন্য এই বাংলা ভূমিই যথেষ্ট।
মোগল ও নওয়াবী আমলে বাংলা ছিল খাদ্যশস্য, ফল, চিনি, গুড়, মধুর দেশ। এ ছাড়া ছিল উন্নত হস্তশিল্প। বিশেষ করে বাংলার মসলিন বস্ত্র ছিল জগৎ বিখ্যাত। বাংলা থেকে বিভিন্ন দেশে প্রচুর পরিমাণে চাল, চিনি, গুড়, মধু এবং বিভিন্ন কারিগরী পণ্য রফতানী হত। রফতানী পণ্যের মধ্যে মসলিন বস্ত্রের স্থান ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য নয়, এর বিপুল চাহিদা ছিল ইউরোপেও। বাংলার এই সমৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রের আয়ও ছিল বিপুল। এই রকম একটা সমৃদ্ধ অর্থনীতি থাকা সত্ত্বেও একটা অযোগ্য, দুর্নীতিগ্রস্ত, লুণ্ঠনপরায়ণ এবং দেশাত্মবোধহীন শাসক শ্রেণীর কারণে এ দেশ ইংরেজদের পদানত হল। এবং সেটা হল এই শাসক শ্রেণীর গরিষ্ঠ অংশের চক্রান্তের মাধ্যমেই এবং প্রায় বিনা যুদ্ধে।
বাংলাদেশে এমন একটা শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে যাদের কাছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর কোন প্রয়োজন নাই। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আমি বহুকাল ধরে এ কথা অনেককে বলতে শুনেছি যে, এ রাষ্ট্র টিকবে না কিংবা এর কোন প্রয়োজন নাই। এটা যে সবাই হতাশা বা ক্ষোভ থেকে বলেন তা কিন্তু নয়। কারও কারও ক্ষোভ বা হতাশা থেকে কথাটা বেরিয়ে এলেও কেউ কেউ সত্যিই মনে করেন বাংলাদেশ থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না কিংবা মনে করেন এটা না থাকলেই ভাল হবে।
এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশ সচিবালয়ের এক আমলা আমাকে বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ টিকবে না।’ তার মতে এটা ভারত নিয়ে নিবে। তারপর এক পর্যায়ে বললেন, ‘আমার অবশ্য কোন চিন্তা নাই। আমার সব কয়টা ছেলেকেই আমি আমেরিকায় সেট্ল করিয়েছি।’ আজ থেকে প্রায় বারো বৎসর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের কাছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষার প্রয়োজনের কথা বললে তার উত্তরে তিনি আমাকে যে কথা বললেন তা আমার হুবহু মনে আছে, ‘কী যে বলেন, মানিক ভাই! আজকের গ্লোবালাইজেশনের যুগে রাষ্ট্রের সীমান্তের কী প্রয়োজন?’ রাষ্ট্র, জাতি ইত্যাদি ধারণা যে পশ্চাৎপদ এমন বক্তব্য বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে জানার সুযোগ আমার আরও হয়েছে।
তা ঠিক, রাষ্ট্রের কী প্রয়োজন! এদের অনেকের অর্থ চলে গেছে ইউরোপ-আমেরিকায়। অনেকেরই পরবর্তী প্রজন্ম আর এ দেশে নাই। এদের অনেকে নিজেরা পাশ্চাত্যের নানান দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে রেখেছে। অনেকে নানান কাজে দিল্লী, লন্ডন, নিউইয়র্ক ঘুরে বেড়ান যখন তখন। নানান অর্থকারী কাজে তাঁরা ঘুরেন। কেউ বিদেশীদের সঙ্গে ব্যবসা করেন, কেউ কনসালটেন্সি করেন, কেউ এ দেশের বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করলেও ছুটি নিয়ে মাঝে মাঝে বিদেশে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তি ভিত্তিক চাকুরী করেন।
বাস্তবিক, এদের কাছে বাংলাদেশের অর্থ নাই। উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র গড়ার জন্য স্বপ্ন দেখা এবং তার জন্য প্রাণপাত করার তো প্রশ্নই ওঠে না। বৃহৎ কিছুই এরা গড়ে না। এরা সব সময় তৈরী জিনিস খোঁজে এবং দেখতে পেলে তাতে ভাগ বসায়। রাষ্ট্র রক্ষা ও পরিচালনার ঝুঁকি ও ঝামেলা এড়াতে চেয়ে এদের পূর্বসূরিরা ব্রিটিশদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আবার ব্রিটিশের ভাগ করো, শাসন করো নীতির প্রয়োজনে প্রায় বিনা শ্রমে ও বিনা ত্যাগে এদের পাকিস্তান পাওয়া। তারপর যা কিছু পেয়েছে প্রায় সবই বিনা শ্রমে বা স্বল্প শ্রমে পেয়েছে। হিন্দু বাঙ্গালীর তৈরী করা প্রায় সবকিছু এরা দখল এবং ভোগ করেছে। এর পর বাংলাদেশও এরা প্রায় বিনা শ্রম অথবা স্বল্প শ্রম ও স্বল্প ত্যাগে পরের সাহায্যে পেয়েছে। সেখানেও কাজ করেছে বিহারী ও উর্দূভাষীদের সম্পদ লুণ্ঠনের এবং তাদেরকে তাড়িয়ে রাতারাতি বড়লোক হবার প্রেরণা। স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি গড়ায় কোন ভূমিকা না রেখেই অবস্থার চাপে যুদ্ধে যোগ দিয়ে এরা তার সকল কৃতিত্বের দাবীদার হয়। অবশ্য ভারতের আশ্রয় ও সমর্থন সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর এদের প্রায় সবার যোগদান। এভাবে স্বাধীনতার রাজনীতি যারা গড়েছে তাদেরকে ধ্বংস করে তাদের সকল শ্রম ও আত্মদানের ফল এরাই আত্মসাৎ করেছে। যুদ্ধের ফলে যারা মূল্য দিয়েছে তারা এই লুণ্ঠনজীবীরা নয়। বেশীর ভাগই হিন্দু, বামপন্থী এবং সাধারণ মানুষ।
না, এরা তৈরী করে না। এদের চরিত্রেই সেই জিনিস নাই। এরা চরিত্রগতভাবে লুণ্ঠনজীবী। প্রকাশ্যে লুণ্ঠনের সুযোগ না পেলে এরা চুরি করে। এরা নিজেদের স্বার্থে অকাতরে মিথ্যাচার করে, প্রতারণা করে। এরা প্রতারণা ও আত্মসাতের প্রয়োজনে নির্দ্বিধায় বিশ্বাসঘাতকতা করে।
হাঁ, এরা জাত বিশ্বাসঘাতক। এই লুণ্ঠনজীবী বিশ্বাসঘাতকদের নিকট এ দেশের স্বাধীনতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন তাদের সামনে ইউরোপ-আমেরিকার দরজা খুলে গেছে। সেখানে তারা চলে যাচ্ছে এবং যাবে। তবে এত সহজে সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য এমন দেশ তারা পাবে কোথায়? সুতরাং তারা এখানেও থাকে এবং প্রয়োজনে থাকবে। কিন্তু বিদেশের অমরাবতীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তাদের হাতছানি দেয়। সেখানে বাংলাদেশের মত এত ক্ষুদ্র আর দুর্বল দেশের মানুষ হয়ে সুবিধা পেতে কিছু বেশী সমস্যা হয় না কি? তাহলে ভারতের মত এক বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্রের আশ্রয়টাই কি বেশী লাভজনক নয়? এতে করে যেমন ভারতের বৃহৎ ধনিক এবং শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে কিছু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে তেমন পাশ্চাত্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বার্গেইন করে সেখানেও নিজেদের সুবিধা বাড়ানো যেতে পারে। বিশেষত ১১ সেপ্টম্বরের পর থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় মুসলমান পরিচয়ের কারণে যে সমস্যা হচ্ছে তা লাঘবে অ-মুসলিম ভারতের আশ্রয় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ এবং উচ্চবর্গের অনেকের গুরু অথবা পরামর্শদাতা হিসাবে খ্যাত সিরাজুল আলম খান সম্প্রতি স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত থাকার দরকার নাই। খুব বেশী হলে যেটা দরকারী সেটা হচ্ছে স্বায়ত্তশাসন। তিনি আরও বলছেন, ‘যদি মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় তাহলে রাজনৈতিক সীমান্তের কী প্রয়োজন?’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরাজী পত্রিকা ‘প্রোব’-এর ১৬-২১মার্চ, ২০০৭, ভলিউম ৫, সংখ্যা ৩৪-এ ‘আড্ডা উইথ দাদা’ শিরোনামে সিরাজুল আলম খানের একটি নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এটির আংশিক অনুবাদ ২০ মার্চ ২০০৭ তারিখে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘আমাদের সময়’-এর শেষ পৃষ্ঠায় ‘স্বাধীনতা মানে শুধু বিদেশী তাড়ানো নয় ঃ সিরাজুল আলম খান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত ও স্বাধীনতা সম্পর্কিত সিরাজুল আলম খানের মতের সঙ্গে আমার গুরুতর মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর এই স্পষ্ট ও অকপট উচ্চারণের জন্য তাঁকে আমি অভিনন্দন জানাই। কারণ এটা এই ধরনের চিন্তার বিরুদ্ধে মতাদর্শিক লড়াই চালাতে সাহায্য করে। বস্তুত এই উচ্চারণ এ দেশের নেতৃত্বকারী শ্রেণীর একটি বড় অংশের চিন্তার প্রকাশ।
কিন্তু তাঁর বক্তব্য প্রসঙ্গে আমার মনে কিছু প্রশ্ন জাগে। তাঁর অনেক ভাবশিষ্যের মতে তিনিই ষাটের দশকে স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের মূল রূপকার, যিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে ১৯৬২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর কয়েক জন অনুসারী নিয়ে গোপন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন। বলা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে এই গোপন নিউক্লিয়াসে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ।* নিশ্চয় এটা তাঁরও বক্তব্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তিনি পাকিস্তান ভেঙ্গে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন তার দর্শনগত ভিত্তি কোনটা ছিল? লোকবাদ তথা সেকিউলারিজম নাকি ধর্ম? ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম হলে নিশ্চয় পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রয়োজন হয় না। পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যেই একটা সমাধান খোঁজা যেত। তার জন্য স্বায়ত্তশাসন যথেষ্ট। স্বাধীনতার প্রয়োজন কেন হবে?
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* দেখুন ঃ প্রকাশকের কথা, নির্বাচনী ইশতেহার, ড.মুহামমদ ইউনূস-এর ৭-দফা ভিত্তিক ‘শান্তি-চুক্তি’ এবং আমার ১৪-দফা প্রস্তাব, সিরজুল আলম খান, প্রকাশক - মোঃ সাখাওয়াত হোসেন, প্রকাশ স্থানঃ বাড়ী - ৩৪, রাস্তা - ২৭(পুরাতন), ধানমন্ডি, ঢাকা ১২০৯, প্রকাশকাল জানুয়ারী ২০০৭।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রাজনীতিতে ধর্মকে অস্বীকার করে লোকবাদী আদর্শ নিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আর কোনও যৌক্তিকতা থাকে কি? আর ধর্মীয় মতাদর্শ ও তার ধর্ম-সম্প্রদায়গত পরিচয়ের বিপরীতে লোকবাদ নিয়ে দাঁড়াতে গেলে স্বাভাবিকভাবে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নটি কি সামনে চলে আসে না? অর্থাৎ সামনে চলে আসে পাকিস্তানবাদ তথা ইসলামী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। এটা হচ্ছে ইসলামী বা মুসলমান সম্প্রদায়ের রাষ্ট্রের বিপরীতে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়। আর এভাবে যখনই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন সামনে আসে তখন সামনে আসে ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে বাংলা ও বাঙ্গালীকে বিভক্তির রাজনীতি ও ভাবাদর্শকে প্রত্যাখান করার প্রশ্নও। বস্তুত এ ছাড়া বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বলা আত্মপ্রতারণা অথবা পরপ্রতারণার নামান্তর। এই কাজটিই এ দেশে এ যাবৎ কাল করে আসা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি বাংলা ও বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের যৌক্তিক এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের ধারেকাছেও আছে? যদি না থাকে তবে কি ষাটের দশকের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও আজ অবধি অসমাপ্ত ও অপূর্ণাঙ্গ নয় ? মূল যে কাজ অসমাপ্ত রয়েছে তাকে সম্পূর্ণ করার কাজ বাদ দিয়ে রাষ্ট্রটিই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে সুতরাং এখন এটাকে ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এমন বক্তব্য দানকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?
তাহলে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের দাবী যদি সত্যিই হয় যে তিনি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গোপন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন তবে তার অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে তিনি উন্নত ও লোকবাদী কোন দর্শন চিন্তা থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার রাজনীতি করেন নাই? বরং তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যে কোনভাবে পাকিস্তান ভাঙ্গা। যদি পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বা যে নাম দিয়ে হোক স্বাধীন রাষ্ট্র করাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে দর্শনগত ভিত্তির অভাবের কারণে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে ভারত-রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া ছাড়া এই ধরনের রাষ্ট্রের আর কোন্ গতি থাকে?
না, আমি এ কথা বলি না যে রাষ্ট্র, জাতি বা জাতীয়তা কোনটিই চিরন্তন সত্তা। সবই সময় ও মানুষের প্রয়োজনে আসে আবার সময় ও মানুয়ের প্রয়োজনে যায়। সুতরাং বাংলাদেশও এক সময় রাষ্ট্র হিসাবে না থাকতে পারে। কিন্তু সেটা কি স্বাধীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূলে যে আদর্শ ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক চাহিদা ক্রিয়াশীল ছিল সেটার পরিপূর্ণতা সাধন না করেই এবং বৃহত্তর আয়তনে বাঙ্গালীর ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির অধিকতর বিকাশ সাধন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আয়োজন সমাপ্ত না করেই হতে হবে? ঠিক আছে, আমরা ইউরোপের মত এই উপমহাদেশেও একটা আঞ্চলিক সংঘ বা ইউনিয়ন গঠন করব। কিন্তু ইউরোপের জাতি-রাষ্ট্রগুলির বিকাশ ও পূর্ণতা সাধনের যে স্তরে পৌঁছাবার পর সেখানে এই কাজে হাত দেওয়া হয়েছে আমরা কি সেই স্তরে পৌঁছাবার অনেক পূর্বেই সেই কাজে হাত দিতে চেষ্টা করব? এবং এ প্রসঙ্গেও মনে রাখতে হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলির প্রত্যেকটিই তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছে। ভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন অর্জন তাদের কারোরই লক্ষ্য নয়।
হয়ত ভবিষ্যতে এক সময় বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ সম্পন্ন করার পর ভারতীয় বা দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রসংঘ কিংবা জাতিসংঘ গঠন করার প্রয়োজন দেখা দিবে। কিন্তু সেটা কি আজ আমাদের ভাবনার বিষয় হবে? আসলে বাঙ্গালীর উন্নত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের যে গুরু দায়িত্ব ইতিহাস আমাদের উপর অর্পণ করেছে সেই দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ও চরিত্র বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চবর্গ বা নেতৃত্বকারী শ্রেণী তথা শাসক শ্রেণীর নাই বলে তাদের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ সিরাজুল আলম খানের নিকট থেকে আমরা এ ধরনের বক্তব্য পাই।