লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ February 26, 2020, 12:00 AM, Hits: 1848
(প্রবাসী লেখক আলমগীর হুসেনের সঙ্গে এক সময় ধর্মের বিষয়ে ই-মেইলে আমার মতবিনিময় হয়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে সম্বোধনটুকু বাদ দিয়ে তার একটি এখানে পুরাটা তুলে দিলাম। হিন্দু ধর্ম নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও আরও কিছু বিষয় তাতে আসে। ─ শামসুজ্জোহা মানিক)
আপনি ঠিক বলেছেন যে হিন্দু ধর্ম ভারতের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এটা ভারতবর্ষের মাটি থেকে উঠে আসা ধর্ম। বিভিন্ন কারণেই হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পদ্ধতি খ্রীষ্টান বা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অনুরূপ হবে বলে আমি মনে করি না।
হিন্দু ধর্ম প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্যের উত্তর দিতে গিয়ে আমি আমার লেখা বই “বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান”-এর “হিন্দু বাঙ্গালীর কথা” নামক পরিচ্ছেদ থেকে (আমার) একটা টীকা উদ্ধৃত করছি। বইটা ওয়েবসাইট “বঙ্গরাষ্ট্র”-এর গ্রন্থাগার বিভাগেও আছে। সেখান থেকে টীকাটা তুলে দিচ্ছি।
“এই বিষয়টি বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, বর্ণজাতিমূলক সমাজ ব্যবস্থা উপর থেকে জোর করে চাপানো বা বলপ্রয়োগ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা নয়। বরং এটা সমাজের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ছিল। আর সেই কারণেই সাধারণভাবে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন ছাড়াই এই ধরনের একটি ব্যবস্থা হাজার হাজার বছর ধরে ভারতবর্ষে টিকে থেকেছে। এই কথা আমরা যেন মুহূর্তের জন্যও ভুলে না যাই যে হিন্দু ধর্ম ইসলামের মত অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় যে ধর্ম ত্যাগ করলেই তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া আছে। বরং হিন্দু ধর্মে ব্যক্তিগতভাবে ধর্মগ্রহণের কোন প্রথাগত বিধান নেই, অথচ যে কেউ ইচ্ছা করলে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এখানে আছে ব্যক্তি, পরিবার এমনকি গোষ্ঠীকেও জাতচ্যুত তথা বর্ণজাতিচ্যুত কিংবা সমাজচ্যুত করার বিধান। এক সময় হিন্দু সমাজে সে কাজ কথায় কথায় করা হত। তাই এখানে এক অর্থে প্রবেশের জন্য একটা দরজাও খোলা নেই, কিন্তু বেরিয়ে যাবার জন্য রয়েছে প্রায় সব দরজা খোলা। অথচ এই ধর্ম বা ব্যবস্থা এত দীর্ঘকাল প্রবল প্রতাপে টিকে আছে। হাজার হাজার বছর ধরে এই ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার জন্য সমাজের ভিতর থেকে কম আন্দোলন, কম চেষ্টা হয় নি। বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব থেকে শুরু করে অসংখ্য বৈরী আন্দোলনের ঝড় যুগে যুগে বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে। তাতে মাঝে মাঝে বর্ণজাতি রূপ মহীরূহের দুই-চারটা ডাল-পালা কখনও ভাঙ্গলেও তার শিকড়কে কেউই কখনই সমাজ-জমি থেকে উপড়াতে পারে নি। বরং প্রবল ঝড় স্তিমিত হলে সমাজের আরও গভীরে তা শিকড় ছড়িয়েছে এবং ঊর্ধ্বে আবারও নূতন ও প্রবল ভাবে ডালপালা বিস্তার করেছে।
বস্তুত ভারতবর্ষের আদিম উপজাতি ও গোত্র সমাজগুলি মূলত স্বেচ্ছামূলক ও শান্তিপূর্ণ ভাবেই কৃষি নির্ভর সভ্য সমাজে স্ব স্ব আদিম সমাজের প্রায় সকল বৈশিষ্ট্যসহ প্রবেশ করে ধীর গতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এভাবে ব্যাখ্যা করলে হিন্দু সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ বা বিবর্তন রহস্য বোঝা যায়। তখন বোঝা যাবে কেন এবং কীভাবে বর্ণজাতি কাঠামো আদিম গোত্র ও উপজাতি কাঠামোর অনুরূপ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে আদিম সমাজে ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক বর্ণজাতি ব্যবস্থা ছিল না; কারণ সেখানে একটি বৃহত্তর সমাজে বিভিন্ন উপজাতির ঐক্যবদ্ধ এবং পরস্পর সংলগ্ন ভাবে অবস্থানের প্রয়োজন যেমন ছিল না তেমন সভ্যতার প্রয়োজনে বিভিন্ন পেশা বা বৃত্তি গ্রহণেরও প্রয়োজন ছিল না। আদিম উপজাতিগুলি সভ্য সমাজে প্রবেশ ক’রে নিজেদের আদিম উপজাতীয় অনেক বিশ্বাস, প্রথা বা আচার-অনুষ্ঠান রক্ষার পাশাপাশি বৃহত্তর ঐক্যের প্রয়োজনে বেদ ও ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নেয় এবং সমষ্টিগতভাবে বংশপরম্পরায় পেশা বা বৃত্তিগত স্বাতন্ত্র্য গ্রহণ করে নিয়ে আদিম সমাজ-জীবনের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যকে রক্ষার পথ খুঁজে নেয়। সভ্য সমাজে আদিম সমাজের অনেক বৈশিষ্ট্যকেই রক্ষা করা সম্ভব হয় না। তবু আদিম সমাজের ঐতিহ্যের অনেক কিছুই এতে রক্ষা পায়। সবচেয়ে বড় কথা আদিম সমাজ চেতনায় যে গোত্রবদ্ধতা বা গোষ্ঠীবদ্ধতা ছিল নিয়ামক শক্তি হয়ে এবং সেই সঙ্গে ছিল বিশেষত এক উপজাতির সঙ্গে আর এক উপজাতির প্রায় সর্বাত্মক বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব এই ব্যবস্থায় সেগুলি রক্ষা পায়। এভাবে বর্ণজাতি কাঠামোতে সংরক্ষিত হয় গোষ্ঠীগুলির স্ব স্ব ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, পরস্পর বিচ্ছিন্নতা এবং আদিম সমাজের এক অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য গোষ্ঠীর ভিতর ব্যক্তিসত্তার বিলীনতা। হিন্দু সমাজের বিশ্বাস, প্রথা বা আচার-অনুষ্ঠানে আজ অবধি তাই এত আদিমতার প্রভাব, স্ববিরোধ এবং অসম মর্যাদাভিত্তিক বর্ণজাতি বা গোষ্ঠীগুলির পরস্পর বিচ্ছিন্নতা এবং আধুনিক যুগের এতসব পরিবর্তনের পরও কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তির ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিক পরিচয় বা ঠিকানার চেয়েও বর্ণজাতিগত পরিচয় বা ঠিকানার অনেক বেশী গুরুত্ব ।” - লেখক, ২৩ অক্টোবর, ২০০৮ পৃষ্ঠাঃ ৬৭-৬৮
এখন আমি মূল প্রসঙ্গে আসি। বর্ণজাতি বা caste নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি অনেক চিত্তাকর্ষক বিষয় জেনেছি। যেমন ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে ব্রাহ্মণের তুলনায় নিম্নতর বর্ণের কোনো কোনো জাত বা বর্ণজাতি অর্থ বা রাজনৈতিক প্রতিপত্তির জোরে ব্রাহ্মণদের উপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে। কিন্তু সেখানেও রয়ে যায় বর্ণজাতি বা caste হিসাবে স্বাতন্ত্র্যের ধারণা।
আমার ধারণা বর্ণজাতি ব্যবস্থা ভারতীয় কৃষিভিত্তিক সমাজ ও সভ্যতার মূল ভিত্তি নির্মাণ করেছে। বর্তমান যন্ত্র সভ্যতা ও প্রযুক্তি পুরাতন কৃষি সমাজকে যেমন ভেঙ্গেছে তেমন বর্ণজাতি ব্যবস্থাকেও তার আদিরূপে থাকতে দেয় নাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থা কীভাবে জন-মানসকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করে তার রূপ আমি দেখেছি। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা!
বর্তমান কালে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে বর্ণজাতি ব্যবস্থার সম্পর্ক না থাকতে পারে। কিন্তু এই ব্যবস্থার মর্মমূলে রয়ে যায় প্রত্যেক গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতা। এই স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করে পদবী এবং কতকগুলি প্রথা। তবে এ ক্ষেত্রে পদবীর গুরুত্ব অপরিসীম। এটা বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিদারুণ বাধা সৃষ্টি করে।
যাইহোক, ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপ বা পদ্ধতি এবং হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপ বা পদ্ধতি এক হতে পারে না। ইসলাম হচ্ছে সহিংস, আক্রমণাত্মক এবং নিরঙ্কুশ একত্ববাদী বা একনায়কী। কিন্তু হিন্দু ধর্ম হচ্ছে মূলত অহিংস, আত্মরক্ষামূলক এবং নিরঙ্কুশ বহুত্ববাদী। সুতরাং এই দুই ধর্মকে এক কাতারে ফেলাটা ভুল হবে। কিন্তু ধর্ম দুইটির ভূমিকা দুই ভিন্ন দিক থেকে সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার বিচারে প্রায় অভিন্ন। একটা ক্ষতি করে আক্রমণাত্মকতা ও হিংস্রতা দিয়ে, অপরটা ক্ষতি করে রক্ষণশীল নিষ্ক্রিয়তা ও নির্লিপ্ততা তথা নির্বীর্যতা দিয়ে। প্রথমটা জোর করে অন্যের ঘরে ঢুকে, দ্বিতীয়টা কারও ঘরে ঢুকে না, কিন্তু নিজের ঘরেও কাউকে ঢুকতে দেয় না। প্রথমটা কাউকে নিজের মত করে থাকতে দেয় না, নিজের ইচ্ছাধীন হতে বাধ্য করে বাকী সবাইকে। দ্বিতীয়টা স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতাকেই নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করে রাখতে চায়; কাউকে ভিন্ন কারও সাথে মিলিত হতে দিতে চায় না।
ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই বা আন্দোলনে সাংস্কৃতিক দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইসলামের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকটা খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত শুরুর পর্যায়ে। হিন্দু ধর্ম রাজনৈতিক না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে প্রধানত সাংস্কৃতিক।
যাইহোক, আমার কাছে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইটাই যেহেতু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিচার্য বিষয় সেহেতু এই লড়াইয়ের পথ ও পদ্ধতি নিয়েই আমি অনেক বেশী চিন্তা করি। সঙ্গত কারণে আমার অন্যসব লড়াইকেই এই লড়াইয়ের অধীন বা সহায়ক হিসাবে দেখতে বা রাখতে চাই।
রাশিয়ার মুসলিম এলাকাগুলি বেশী সমস্যা সৃষ্টি করছে। চীনেও তা-ই। খ্রীষ্ট বা বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান তেমনভাবে উল্লেখ্য বলে মনে হয় না। তবু বিপ্লব পরবর্তী কালের তুলনায় এখন ধর্ম বেশী শক্তিশালী দুই দেশেই। তথ্যের অভাবে আমি এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি নাই। তবে এইটুকু বুঝি যে সমস্যা কোথায়ও ছিল এবং আছে।
আসলে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ নয়। তবে সম্ভব। সেটা কীভাবে তা বোঝা অপরিহার্য। ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের সঙ্গে সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের গভীর সম্পর্ক আছে। সভ্যতা নির্মাণ তথা সভ্য সমাজ গঠন করতে গিয়ে মানুষ যে সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে সেগুলিকে মীমাংসা করতে গিয়ে মানুষ ধর্ম নির্মাণ করেছে। সুতরাং ধর্ম মুক্ত সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণ করতে হলে সমাজ ও সভ্যতার সমস্যাগুলিকে বুঝতে হবে। সভ্যতার প্রয়োজনে মানুষ যেমন ধর্ম নির্মাণ করেছে তেমন সভ্যতার আরও অগ্রগতির প্রয়োজনে ধর্মের বিলয়ও মানুষই ঘটাবে। মানুষের সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে যাবে। পিছনে পড়ে থাকবে একটা কালের স্মারক হিসাবে ধর্মগুলি, আগামীতে যেগুলিকে নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাবে না।
আগামী কালে অলৌকিক বিশ্বাসকে নির্ভর করে নীতি-নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এবং প্রথা থাকবে না। সুতরাং আজকের অর্থে ধর্ম থাকবে না। কিন্তু যুক্তিনির্ভর মানুষ বিভিন্ন ধরনের নীতি-নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এবং প্রথাকে অবলম্বন করে নিজেদেরকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে যেমন ঐক্যবদ্ধ করবে তেমন বিভক্তও করবে, যার রূপ আমাদের নিকট আজ অজানা। সব মানুষ সব বিষয়ে কখনই এক হবে না। সুতরাং রাষ্ট্রের বিভাজন যেমন থাকবে তেমন থাকবে সমাজেরও বিভাজন। এগুলিও চিরস্থির বা অপরিবর্তনীয় থাকবে না। আবার এইসব বিভাজনকে অতিক্রম করে বৃহত্তর বা অখণ্ড মানবসত্তায় বিলীনতার আকুতিও মানুষের ভিতর রইবে। এভাবে মানুষের ভিতর রইবে অনিঃশেষ অন্তর্দ্বন্দ্ব। গ্রহান্তরেও মানুষ তার নূতন সত্তার পাশে তার আদি সত্তাকে বহন করে নিয়ে যাবে। কিছু বিশ্বাস বা মূল্যবোধকে তখনও মানুষ ধারণ করবে জীবনের বিনিময়ে হলেও। সেটাকে ভবিষ্যতের মানুষ কী বলবে? নব রূপের সমাজ ও রাষ্ট্রের মত সেটাও কি হবে নব রূপের ধর্ম? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। আমি শুধু মনে করি আজকের প্রেক্ষিতে যে ধর্ম মানুষের অকল্যাণের কারণ হয়ে রয়েছে তাকে উচ্ছেদের লড়াই করা আজ আমাদের করণীয়। আর এটুকু বুঝি যে মানুষ প্রজাতির জন্য শেষ সমাধান কিংবা শেষ কথা বলে কিছু নাই।
২৫ মে, ২০১২