Banner
ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 25, 2022, 12:00 AM, Hits: 2030

 

পূর্বকথা

গ্রন্থটি রচনার শুরু ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে। অসুস্থতার কারণে রচনার শেষ পর্যায়ে ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারীতে একটা ছেদ ঘটে। আমার এই অসুস্থতার সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার আমার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামক বিভিন্ন ইংরাজী প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ হিসাবে একটি সংকলন-গ্রন্থ প্রকাশের কারণে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে আমাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযু্ক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭(২) ধারায় কারারুদ্ধ করে। একই অভিযোগে যে ছাপাখানায় বইটি ছাপা হয়েছিল সেই ছাপাখানার মালিককেও একই ধারায় গ্রেফতার করে জেলে নেওয়া হয়। অথচ বইয়ের বিষয়বস্তু তার জানবার কথা নয়। কী অদ্ভূত আইন এবং তার প্রয়োগ!

এটা আরও বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে, ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনও ব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও এবং ‘ইসলাম-বিতর্ক’ নামক গ্রন্থটির সঙ্গে কোনও প্রকার সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও ইংরাজী এবং বাংলায় সিন্ধু সভ্যতা ও ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণামূলক মৌল গ্রন্থ এবং প্রবন্ধের লেখক শামসুল আলম চঞ্চলকেও ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর বিপণন কর্মকর্তা দেখিয়ে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং আমার সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির একই ধারায় মামলা দিয়ে জেলে নেয়। জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাবার পর তাকেও মামলার আসামী হিসাবে আমার সঙ্গে আদালতে দীর্ঘদিন হাজিরা দিতে হয়েছে। জেলে যাবার কারণে কর্মস্থলে নিয়মিত হাজিরা দিতে না পারায় ঘোড়াশালে একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে তার কর্মচ্যুতি ঘটানো হল। এখানে বলে রাখা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, চঞ্চল সিন্ধু সভ্যতা এবং বৈদিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পণ্ডিত মহলে খ্যাতি এবং পরিচিতির অধিকারী ইতিহাস গবেষক ও লেখক  হলেও পেশায় প্রকৌশলী। হতে পারে যে, আমার সঙ্গে `The Aryans and the Indus Civilization', (http://www.bangarashtra.net/article/848.html) `Rediscovering Indus Civilization and Aryans : Journey to Our Renaissance' (http://www.bangarashtra.net/article/1202.html) এবং ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ (http://www.bangarashtra.net/article/853.html)-এর মতো ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন মৌলিক গবেষণামূলক কাজ করা ছাড়াও চঞ্চলের আর একটি অপরাধ ছিল সেটা হল আমার ভাই হওয়া।

যাইহোক, সরকারী হামলার ফলে আমার বই লিখায় কিছু দীর্ঘ ছেদ ঘটে। সাড়ে আট মাস কারাবাসের পর ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর জামিনে মুক্ত হয়ে আসবার পর ২০১৭ সালের জুন মাসে পুনরায় বইটি লিখায় হাত দিই এবং জুলাইয়ের মধ্যে এটিকে সম্পূর্ণ করি। এখানে এ প্রসঙ্গে বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, পুলিশ আমাকে আমার বাসগৃহ থেকে বন্দী করে নিয়ে যাবার সময় আমার বাসগৃহের প্রায় সকল গ্রন্থ এবং দুই সেট মোবাইলসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্র লুঠতরাজ করে এবং আমার মূল্যবান ব্যক্তিগত এবং প্রায় নূতন কম্পিউটারটাও নিয়ে যায়। এছাড়া তারা ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর কার্যালয় ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকেও বহুসংখ্যক বই জব্দ করে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়। পুলিশ তার এই গ্রেফতার ও দখল অভিযানে আমার ব্যক্তিগত বইপত্র ছাড়াও ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’-এর বহু লক্ষ টাকার মুদ্রিত বই লুঠ করে। বলা বাহুল্য যে, এসব লুঠের মালের কোনটাই ফেরত পাই নাই। অবশ্য ফেরত দিবার জন্য পুলিশ যে সেসব নেয় নাই সে কথাও বলার প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশের বর্তমান কালের পুলিশ সম্ভবত এসব ফেরত দিবার জন্য নেয় না। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে পুলিশ হয়ত সরকারের নির্দেশে অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে এমনভাবে আচরণ করেছিল যাতে আমি পারিবারিকভাবে এবং আর্থিকসহ সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হই এবং আমার প্রকাশন স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

যাইহোক, অসমাপ্ত ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’ ঐ কম্পিউটারে থাকায় আমার বইয়ের মূল অংশও হারিয়ে যেতে পারত। কিন্তু আমার সতর্কতার কারণে এটা রক্ষা পেয়েছিল। আমি সাধারণত আমার সব লেখা ইন্টারনেট প্রযু্ক্তির সাহায্য নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে কিংবা শুভানুধ্যায়ী ব্যক্তির নিকট রাখি। যে কোনও লেখাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করলে কিছুটা লিখবার পরও আমি সাধারণত এ কাজ করি। এর কারণ আমি যে কোনও সময় কম্পিউটারের কারিগরি বিপর্যয় এবং বিশেষত জিহাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কিংবা সরকারের দিক থেকে হামলাসহ যে কোনও দুর্ঘটনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করি। সুতরাং পুলিশ কম্পিউটার লুঠ করে নিয়ে গেলেও অসমাপ্ত লেখা উদ্ধার করতে আমাকে বেগ পেতে হয় নাই। জেল থেকে বের হবার পর সংরক্ষিত জায়গা থেকে নিয়ে ২০১৭ সালের জুন-জুলাইতে বইটির বাকী অংশটি লিখে শেষ করি।

যাইহোক, আমি বাংলাদেশে অবস্থান করি। এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের পরিণতি এ দেশে কী হতে পারে সে কথা সবার জানা। ধর্ম অথবা ইসলাম সম্পর্কে সত্য কথা লিখতে বা বলতে গিয়ে জিহাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে অনেকে আহত এবং এমনকি নিহত হয়েছেন, এবং বহু বেশী সংখ্যক মানুষ জিহাদী সরকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক জেল ও মামলাসহ নানাবিধ হয়রানির শিকার হয়েছেন। আমি এ দিক থেকে ভাগ্যবান যে, আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা আমার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ধ্বংস দ্বারা আমার বিপুল ক্ষতি করলেও এবং আমাকে জেলে নিলেও এবং অতঃপর আমার জামিন লাভের পর মামলার বিচারাধীন আসামী হিসাবে কয়েক বৎসর আমাকে হয়রানির শিকার করলেও আমি বেঁচে আছি। এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারীতে আদালত কর্তৃক আমার ভাই চঞ্চল, ছাপাখানার মালিক এবং আমিসহ আমরা তিনজন মামলা থেকে অব্যাহতি পাই।

যাইহোক, বইটি লিখা সম্পূর্ণ হলেও দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটিকে এতকাল অপ্রকাশিত রাখতে হয়েছে। অবশ্য ইসলাম এবং ধর্ম সম্পর্কে বহুকাল ধরে আমি লিখে আসছি। আমার বিভিন্ন রচনায় ধর্ম বিশেষত ইসলাম এবং তার ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়াদি চলে আসে। এছাড়া ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’ (http://www.bangarashtra.net/article/852.html) এবং ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’ (http://www.bangarashtra.net/article/1169.html) নামে আমার ইসলাম সংক্রান্ত দুইটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণা গ্রন্থ আছে, যে দুইটি ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ কর্তৃক পুস্তকাকারে প্রকাশিত ও বাজারজাত হয়েছিল। এছাড়া ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ’-এ গ্রন্থ দুইটি দেওয়া আছে। তবে ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’-এ আরও গভীরে গিয়ে বিশদতর পরিসরে শুধু ইসলামের বিচার-বিশ্লেষণ এবং স্বরূপ সন্ধান করা হয় নাই, উপরন্তু ইসলাম থেকে মানুষের মুক্তির পথ সন্ধানও করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির সমস্যাও এই আলোচনায় এসেছে। এতদিন আমি অপেক্ষা করছিলাম এমন একটা পরিস্থিতির জন্য যখন ইসলামের উপর এ ধরনের বিশ্লেষণাত্মক গ্রন্থ প্রকাশ করা যায়। এই রকম একটি গ্রন্থ প্রকাশের এটা উপযুক্ত সময় বিবেচনা করে এটি প্রকাশ করা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে এর সফ্টকপি দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জনকে পড়তে দিয়ে তাদের মতামত জানবার চেষ্টা করেছি। তাদের মধ্যে ইসলাম বিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত আবুল কাশেমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্নজন ইসলাম সংক্রান্ত তার লিখা বিভিন্ন ইংরাজী গ্রন্থ ও প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ করায় তিনি বাংলাভাষী পাঠকদের নিকটও পরিচিত। শুধু এইটুকু নয়। তথ্যনির্ভর ও গবেষণাধর্মী অথচ সহজ ভাষায় লেখার গুণে ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী পাঠকের নিকটও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক। বিদেশে প্রকাশিত তার বিভিন্ন রচনার কথা বাদ যাক, শুধু ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ তার প্রকাশিত ‘ইসলামে কাম ও কামকেলি’ নামক গ্রন্থের হিট সংখ্যার কথা উল্লেখ করা যায়। আমি যখন আমার এই লেখা প্রকাশ করতে যাচ্ছি তখন পর্যন্ত তার এই গ্রন্থের হিট সংখ্যা হচ্ছে ৮৪,৫৮২ (চুরাশি হাজার পাঁচশত বিরাশি)। ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ তার দুইটি গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে (‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ’-এ প্রকাশিত তার নিম্নবর্ণিত রচনাগুলি দ্রষ্টব্য : ‘ইসলামে কাম ও কামকেলি’ http://www.bangarashtra.net/article/389.html,
এবং ‘ইসলামে নারী এবং যৌনতা {প্রথম অংশ}’-
 http://www.bangarashtra.net/article/1411.html,
‘ইসলামে নারী এবং যৌনতা {দ্বিতীয় অংশ}’-
 http://www.bangarashtra.net/article/1412.html)।

এখানে এটাও উল্লেখ করা উচিত যে, বহুকাল পূর্বে পাশ্চাত্য নিবাসী হলেও তিনি মূলত বাংলাদেশ থেকে বাঙ্গালী অভিবাসী। তিনি বাংলা জানায় আমি তার নিকট ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’ পাঠাই। আমি যখন বইটির সফ্টকপি তার নিকট পাঠাই তখন তিনি ছিলেন খুব অসুস্থ, যেটা পরে জেনেছিলাম। যাইহোক, তিনি তার অসুস্থতার মধ্যেও গ্রন্থটি পাঠ করে তার প্রশংসায় আমাকে যে সংক্ষিপ্ত পত্র দেন সেটা আমার নিকট বিরাট মূল্য বহন করে। আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলাম বিষয়ে তার মাপের একজন পণ্ডিত ব্যক্তির নিকট থেকে এমন প্রশংসা লাভ আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কয়েক বৎসর পূর্বে লিখা হলেও পত্রের গুরুত্ব বিবেচনা ক’রে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আবুল কাশেমের পত্রের সম্পূর্ণ অনুলিপি ‘পূর্বকথা’র নীচে দেওয়া হল।

শেষ করার পূর্বে বলি যে, ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ লেখাটি প্রকাশের সময় ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হলেও এটির রচনা সম্পূর্ণ করা হয় মূলত ২০১৭ সালের জুলাইতে। তারপর এতে আর তেমনভাবে হাত দেওয়া হয় নাই। সুতরাং পাঠের সময় পাঠকের উচিত হবে রচনার কালপ্রেক্ষিত মনে রাখা।

লেখক, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
-------------------


শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর ২০১৭

প্রিয় মানিক ভাই,

অনেক কষ্ট করে হলেও আপনার এই অসাধারণ মৌলিক লেখাটা পড়লাম। আপনার লেখা প্রচণ্ড ক্ষুরধার, তীব্রগতিশীল এবং অত্যন্ত সুপাঠ্য। একবার শুরু করলে শেষ না করা যায় না। এই ধরনের লেখা যে সমাজ বিপ্লব ঘটাতে পারে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

আপনি ইসলামের অবসানের জন্য যে ধারালো অস্ত্র ধরেছেন তা নির্ভুল এবং সাহসিক। বাংলাদেশের কোন লেখকের এত সাহস নাই।

আপনার এই লেখা মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ হলে মোল্লারা আপনার কল্লা চাইবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। বাংলাদেশের ইসলামী সরকার যে আপনাকে অক্ষত রাখবে না তা নিশ্চিত।

আমার অসুস্থতার চিকিৎসা অনেকদিন চলবে।
 
ইতি
কাশেম
-----------------------

 

সূচীপত্র :

১। ভূমিকা

২। ইসলামে ধর্ম ও রাষ্ট্র

৩। যুদ্ধ ও সহিংসতা নির্ভর সমাজ

৪। শান্তি ও যুদ্ধের চক্র

৫। ধর্ম ও রাজনীতি

৬। যুদ্ধ ও সন্ত্রাস

৭। মুসলিমের মন ও মনন

৮। মডারেট ও জিহাদী মুসলিম

৯। প্রতারণার ধর্ম

১০। পাশ্চাত্য আধিপত্য ও ইসলাম

১১। ইসলাম থেকে মুক্তির সংগ্রাম

১২। ইসলাম এবং পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ

১৩। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশ

১৪। বাংলাদেশে রাষ্ট্র–বিপ্লবের তাৎপর্য
 

১। ভূমিকা

এ কথা আজ স্পষ্টভাবে বলতে হবে, বাংলাদেশে মানবিকতা, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। যত দিন যাচ্ছে ইসলাম চর্চার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তত বেড়ে চলেছে সম্ভাব্য সব রকম সামাজিক দুরাচার, ক্ষমতাসীনদের ঘুষ-দুর্নীতি, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার ও বঞ্চনার পাশাপাশি তাদেরকে দেশ থেকে ক্রমবর্ধমান হারে বিতাড়ন এবং সর্বোপরি নারীর উপর ধর্ষণসহ যাবতীয় নিগ্রহের সর্বব্যাপী চর্চা। অবশ্য বাংলাদেশের যাবতীয় অধঃপতনের জন্য শুধু ইসলাম ধর্মকে দায়ী করলে ভুল হবে। তবে এটা তো ঠিক, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে যে উপাদান সবচেয়ে বেশী ক্রিয়াশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যার জন্য তাকেই সবচেয়ে বেশী দায়ী করতে হবে।

এ কথাও তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে আজকের বাংলাদেশ-রাষ্ট্র যে ভূখণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত সেটা ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতি ও তার বাসভূমি বঙ্গের বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের উত্তরাধিকারী হিসাবেই জন্মের পর থেকে আজ অবধি বর্তমান রয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পাকিস্তানের ইসলামী উত্তরাধিকারকেই নানানভাবে ধারণ করে আসছে।

এটা ঠিক যে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গের জনগণের যে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাতে অংশ নিয়েছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালীই শুধু নয়, অধিকন্তু তাতে অংশ নিয়েছিল পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী, সাঁওতাল, ওরাওঁ, গারো এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের জুম্ম বা পাহাড়ীসহ সকল জাতিসত্তার মানুষ। সুতরাং ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী এবং অবাঙ্গালীসহ সকল জাতিসত্তার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধে ধর্মের যেমন কোনও স্থান ছিল না তেমন স্থান ছিল না সংকীর্ণ কোনও জাতির দাম্ভিক ও পরজাতি বিদ্বেষী চেতনারও। এটা ঠিক যে, বিহারী বিরোধী হত্যা ও উৎসাদনে এই যুদ্ধের চেতনা অনেক সময় কলঙ্কিত হয়েছে, কিন্তু সেটা এই যুদ্ধের মূল সুরকে কলঙ্কিত করতে পারে নাই। বরং এর জন্য দায়ী করতে হবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে, আওয়ামী লীগ কর্তৃক লালিত ও প্রচারিত উগ্র বাঙ্গালী জাতিবাদী এবং ইসলামের ধর্মীয় চেতনার নিকৃষ্ট সম্মিলনকে। তা সত্ত্বেও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল সামগ্রিক বিচারে এ দেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়। সেটা ছিল সঙ্কীর্ণ ধর্ম ও জাতি চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে এ দেশের গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে উঠবার একটা সময়। এটা ছিল পূর্ব বঙ্গের ইতিহাসের শুধু প্রথম জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ নয়, এটা ছিল প্রথম বিপ্লবও।

কিন্তু সেটা ছিল খুব সংক্ষিপ্ত একটা সময়। ’৭১ ছিল এ দেশের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ইতিহাসে একটি ক্ষণকালের যতিচিহ্নের মতো। বঙ্গ এবং বাঙ্গালীর ইতিহাসের এই প্রথম বিপ্লব সফল হয়েও ব্যর্থ। পাকিস্তান বিদায় নিলেও ইসলাম বিদায় নেয় নাই। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দেশ প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ইসলামী ধারায় প্রত্যাবর্তনের পথে যাত্রা শুরু করেছে। ১৯৭২-এর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সেকিউলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রকে মূলনীতি হিসাবে উল্লেখ করা হলেও এগুলি ছিল কথার কথা মাত্র। তখনও মুক্তিযুদ্ধের ভাবপ্রেরণাকে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না বলে কাগজেকলমে কিছু ভালো কথা বলা হলেও করা হল বিপরীতটা। এমন কি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হলেও সেটাকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের অবাঙ্গালী জাতিসত্তার উপর বাঙ্গালীত্ব চাপাবার স্থূল হাতিয়ার করা হল। যে সব জাতির মানুষরা সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের সেই ভূমিকাকে যেমন অস্বীকার করা হল তেমন তাদের জাতিগত স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার করে তাদের উপর জোর করে চাপানো হল বাঙ্গালীত্বের দাবী। সর্বোপরি এমন এক সংবিধানকে সমগ্র জাতির উপর চাপানো হল যা হল আপাদমস্তক একনায়কী এবং স্বেচ্ছাচারী শাসনকে বৈধতা দিবার হাতিয়ার।

সর্বোপরি রয়ে গেল নানান কৌশলে বাস্তবে ইসলামের লালন। সুতরাং শেখ মুজিব পাকিস্তানের দালালদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কালক্ষেপণ ও শৈথিল্য করলেন। তিনি একদিকে বললেন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, অপর দিকে পাকিস্তান কালে আইয়ুব সরকারের করা মূলত হিন্দু বিরোধী ‘শত্রু সম্পত্তি আইনকে’ ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নাম দিয়ে রক্ষা করলেন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে বাতিল করে দেশে আধুনিক ও একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তিনি তাকে রক্ষা করলেন। তিনি ইসলাম চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলেন। শুধু এইটুকুতে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি এ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণার পরেও তাকে আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠন ওআইসি-এর অন্তর্ভুক্ত করলেন।

অর্থাৎ ধর্ম থেকে মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে এ দেশে যে রাজনীতি গড়ে তুলা হয়েছিল তা সফল হয় নাই। বরং এ দেশে ইসলাম নূতন রূপে জাঁকিয়ে বসেছে। সুতরাং আজ আমাদেরকে নূতন করে ইসলাম ও তার সমস্যাকে বুঝতে পারতে হবে। যে সমাজ প্রধানত ধর্মবিশ্বাস নির্ভর এবং যে রাষ্ট্র প্রধানত ধর্ম দ্বারা নানানভাবে যে প্রভাবিত শুধু তাই নয়, অধিকন্তু যে রাষ্ট্রের ধর্ম আনুষ্ঠানিক এবং সাংবিধানিক ভাবে ইসলাম সেই সমাজ এবং রাষ্ট্রের সমস্যার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে যে প্রথমেই ইসলামের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে সেটাই কি একান্ত স্বাভাবিক না? বস্তুত ইসলামের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল সমস্যার মূলে যে ইসলাম এই সত্য বুঝলে বাকী সব সমস্যার সমাধানের পথ বের করাও অসম্ভব হবে না। তখন আমরা দেখতে পাব আমাদের সমাজে ধর্ম বিশেষত সংখ্যাগুরুর ধর্ম হিসাবে ইসলাম সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন এবং তাদের গতিধারা নির্ধারণে কীভাবে ভূমিকা পালন করে। আর তখন এটাও আমাদের নিকট স্পষ্ট হবে যে, এ দেশে ধর্মের কারণে পশ্চাৎপদতার যে সামাজিক ভিত্তি টিকে থাকে সেটাকে ব্যবহার করে কীভাবে এ দেশে সাম্রাজ্যবাদী কিংবা বাইরের আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের আধিপত্য, শোষণ ও লুণ্ঠনের ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল থাকে সেই সত্য।   

সুতরাং আমি আমাদের সমাজের বিদ্যমান প্রধান সকল সমস্যা এবং সেগুলির সমাধানের পথ খুঁজবার উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে ইসলামকে বুঝাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ইসলাম শুধু আমাদের দেশের জন্য নয় উপরন্তু সমগ্র পৃথিবীর মানবতার জন্যও প্রায় দেড় হাজার বৎসর ধরে সমস্যা সৃষ্টি করে রাখলেও এতকাল ইসলামী সমাজে বাস করে তার সম্পর্কে নির্মোহ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং আলোচনা করার অর্থ ছিল প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু। ইসলাম তথা মুসলিমদের মারমুখী আচরণের কারণে বাইরের সমাজগুলি থেকেও ইসলামের উপর নির্মোহ আলোচনা কিংবা সমালোচনা ছিল বিপজ্জনক একটা কাজ। সালমান রুশদীর কথা এখনও নিশ্চয় অনেকে ভুলেন নাই। তবে ইন্টারনেট উদ্ভাবনের পর পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে অত্যন্ত দ্রুত। ইসলাম আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে নিজেকে রাখতে পারছে না।

এখন ইসলামের বুকে প্রতিমুহূর্তে মরণ আঘাত হানছে ইন্টারনেট।

প্রকৃতপক্ষে ইসলাম চৌদ্দশত বৎসর যাবত বেঁচে আছে যে মিথ্যার বলে বলীয়ান হয়ে সেই মিথ্যা এখন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির আঘাতে ধ্বংস হতে শুরু করেছে। তার নৃশংসতা, তার বর্বরতা, তার শোষণ, তার লুণ্ঠন, তার নারী ধর্ষণলিপ্সা ও নারী লোলুপতা, স্বাধীন মানুষ এবং নারীর প্রতি তার অপরিমেয় ঘৃণা সবকিছুকেই তা চৌদ্দশত বৎসর ধরে আড়াল দিয়ে রেখেছে এমন এক ধর্মবিশ্বাসের আবরণ তৈরী করে যেটা নিকৃষ্ট পর্যায়ের মিথ্যা অথচ যে কোনও মুসলিম সমাজে যার সম্পর্কে সামান্য উচ্চারণই যে কোনও সত্যভাষীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ইসলাম যেমন বিস্তার লাভ করেছিল হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে তেমন তা টিকেও আছে ত্রাসের মাধ্যমে। কিন্তু অতি সম্প্রতি ইন্টারনেট প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও বিস্তার ইসলামের বেঁচে থাকার সব অবলম্বন কেড়ে নিচ্ছে।

যে মিথ্যার ভিত্তির উপর ইসলামের পুরা সৌধ নির্মিত সেই মিথ্যাকে ধ্বংস করার শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে তার অনুসারী এবং অন্যদেরকেও ইসলামের সত্য জানানো। ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তারের কালে এখন নির্ভয়ে সবাই যেভাবে ইসলামের তত্ত্বতালাশ এবং মুখোশ উন্মোচন শুরু করেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে ইসলামের অবসান হতে আর দেরী নাই। কোনও হিংস্রতার অবলম্বনই আর ইসলামকে বাঁচাতে পারবে না। সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস এবং ক্ষমতা কোনটাই ইসলামের নাই। এটা পুরাটাই অন্ধকারের ধর্ম, মিথ্যার ধর্ম, ধর্মের নামে করা যাবতীয় অন্যায় ও অপকর্মের ধর্ম। ইসলামের উপর তথ্য ও যুক্তি ভিত্তিক আলোকপাত মানেই তার মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করা।

প্রকৃতপক্ষে, আধুনিক সভ্যতার যুগে ইসলামের এভাবে এত কাল ধরে টিকে থাকাই এক বিস্ময়কর ঘটনা। বিগত প্রায় পাঁচ-ছয় শত বৎসর পাশ্চাত্যের হাতে নানানভাবে পরাজিত, হেনস্থা ও অধীনস্থ হবার পরেও তা যে এভাবে তার শক্তি নিয়ে এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তার পিছনে আছে বিশ্ব রাজনীতিরও ভূমিকা। কিন্তু তাতেও এখন পরিবর্তন ঘটছে।

এক সময় পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ নিজস্ব অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রয়োজনে ইসলামকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এলেও তাদের সেই প্রয়োজন এখন আর পূর্বের মতো করে থাকছে না। এক দিকে, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হবার পর কমিউনিজম ঠেকাবার জন্য ইসলামের প্রয়োজন না থাকা, অপর দিকে, পাশ্চাত্যের উপর সন্ত্রাসমূলক জিহাদী কর্মকাণ্ডের প্রসার পাশ্চাত্যকে পূর্বের মতো ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ভূমিকায় থাকবার অবস্থায় আর রাখছে না।

এটা ঠিক যে, আধুনিক সভ্যতার সম্পূর্ণরূপে পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও সৌদী আরবের মতো একটা বন্য এবং বর্বর ইসলামী রাষ্ট্রকে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাদের বৈশ্বিক আধিপত্যের স্বার্থে এখনও সর্বপ্রযত্নে টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সব মিলিয়ে অবস্থা যেমন সৌদী আরবের পক্ষে থাকছে না তেমন ইসলামের পক্ষেও থাকছে না। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য যদি তার ইসলাম সংক্রান্ত কর্মনীতিতে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন আনে তাতেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

আর সবচেয়ে বড় কথা হল হিসাবে নিতে হবে ইন্টারনেটের বিস্তারকে, যা ইসলামের সমস্ত মিথ্যাকে তছনছ করছে বিশ্বজুড়ে প্রতিটি মুহূর্তে। মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের এই অভিযানকে কীভাবে রোধ করা যাবে? মিথ্যা প্রচার করা যাবে। কিন্তু চাইলেও তো কেউ আর আজকের যুগে সত্যকে চাপা দিয়ে রাখতে পারবে না।

যাইহোক, যেভাবে যেখান দিয়ে যে ঘটনাই ঘটুক ইসলামের বিদায় যে আসন্ন সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এটাও বলা যায় যেভাবে তা ঝড়ের গতিতে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল সেভাবেই তা ঝড়ের গতিতে বিদায় নিবে। কিন্তু প্রশ্ন, যা এসেছে হিংস্রতা, যুদ্ধ এবং ত্রাস সৃষ্টি দ্বারা তা কি শুধু যুক্তি ও তথ্য ভিত্তিক প্রচারে যাবে? এটা ঠিক যে ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রচার ইসলামের ভিত্তিমূলকে নড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই প্রচারই কি যথেষ্ট এমন এক বর্বরতা, প্রতারণা এবং অমানবিক ধর্মকে বিদায় দিবার জন্য? শুধু প্রচারে কাজ হবে না। তাকে আঘাতও করতে হবে। আঘাত করে যা এসেছে আঘাত করেই তাকে বিদায় দিতে হবে।

কিন্তু এই আঘাত কারা করবে? বস্তুত ইসলাম কি অমুসলিম পৃথিবীর আঘাতে বিদায় নিবে, নাকি অমুসলিম পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান চাপ ও আঘাতের সুযোগ নিয়ে এবং সেই সঙ্গে সমব্যথী অমুসলিম জনগণের সাহায্য ও সহায়তা নিয়ে ইসলাম অধিকৃত সমাজ ও পৃথিবীর ভিতর থেকেই সংগঠিত এক নবজাগরণের মধ্য দিয়ে উৎখাত হবে সেই বিষয়টিই এখন নির্ধারণের অপেক্ষায় আছে বলে আমি মনে করি।

ইসলাম অধিকৃত সমাজের একজন মানুষ হিসাবে আমি মনে করি ইসলাম মানবতা ও সভ্যতার জন্য বিগত চৌদ্দশত বৎসর ধরে যে সমস্যা সৃষ্টি করে রেখেছে তা থেকে শুধু ইসলাম অধিকৃত সমাজ ও পৃথিবীর মানুষের মুক্তির পথ নয়, অধিকন্তু মানবতা ও সভ্যতার জন্য নবতর মুক্তি ও অধিকতর অগ্রগমনের পথ সন্ধানের দায়িত্বও আজ আমাদের উপর এসে পড়েছে। ইসলামের বিদায় ঘণ্টা বাজছে সেটা যেমন সত্য তেমন বর্তমান পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক আধুনিক সভ্যতাও তার ব্যক্তিসর্বস্বতা, অতিমুনাফাবাদ এবং পরমাণু প্রযুক্তির যুগে যুদ্ধ নির্ভর সংস্কৃতি দ্বারা পৃথিবী ও মানব জাতির জন্য যে ক্রমবর্ধমানভাবে অনুপযোগী ও ক্ষতিকর হয়ে পড়ছে সেটাও সত্য। সুতরাং ইসলাম থেকে মুক্তির অর্থ এই নয় যে আমরা পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক সভ্যতার অনুসারী হবার সাধনা করব।

অবশ্য এই বক্তব্যের অর্থ এই দাঁড়ায় না যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিবাচক অবদানকে আমরা অবজ্ঞা করব কিংবা আমাদের পথ নির্মাণের জন্য আমরা সেখানকার অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করব। কিন্তু আমাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, যাদের অভিজ্ঞতাই আমরা সামনে রাখি না কেন আমাদের পথ পরিক্রমা সবার থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য হবে। আমাদের সমাজ এবং কালের বাস্তবতা আমাদের সমস্যায় যেমন অনেক ভিন্নতা এনে দেয় তেমন আমাদের অভিজ্ঞতায়ও অনেক ভিন্নতা এনে দেয়। এই সকল ভিন্নতা আমাদের পথ পরিক্রমাকেও ভিন্ন করতে বাধ্য। এর ফলে যে লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাই সেটা যে পূর্ব ধারণাকৃত বা পূর্ব পরিকল্পিত লক্ষ্য হতে কম-বেশী ভিন্ন হবে সেটা স্বাভাবিক। এই রকম এক বাস্তবতায় পাশ্চাত্য এবং আধুনিক সভ্যতার ত্রুটি ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন থেকে এবং একই সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে সামনে রেখে কিন্তু কারও অন্ধ অনুসারী না হয়ে আমরা বরং সন্ধান করব নূতন সভ্যতা নির্মাণের পথ। বিশেষ করে সভ্যতার চেতনা তথা সংস্কৃতি নির্মাণের প্রশ্নটা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

সেই দিকে দৃষ্টি রেখে এখন আমি প্রথমে ইসলাম মানবতা এবং সভ্যতার জন্য যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সে বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করব এবং তারপর তা থেকে উত্তরণ এবং বিকল্প সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের পথ সম্পর্কে আলোচনা করব। তবে এই আলোচনায় যাবার আগে প্রথমেই বলে রাখি যে একটা লেখায় সবকিছু বা বহুকিছু আনা সম্ভব নয়। তাছাড়া বিশেষ করে বিকল্প সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণ সংক্রান্ত বহু প্রশ্নেরই উত্তর যে আমরা এখন পাব তা হতে পারে না। অনেক প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসবে কাজের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।

সুতরাং অনেক প্রশ্নই হয়ত উত্তরের অপেক্ষায় রইবে। তাছাড়া ইসলাম এবং বিকল্প সংক্রান্ত আমার আরও বই এবং লেখা আছে যেগুলিতে আমি অনেক বিষয় আলোচনা করায় স্বাভাবিকভাবে এখানে অনেক বিষয় কম আলোচনা করব অথবা প্রাসঙ্গিক মনে না করলে সে সব বিষয়ে আলোচনা করব না। তবে ইসলাম যেহেতু এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সেহেতু তার উপর একটা স্পষ্ট ধারণা পাবার প্রয়োজনে তুলনায় যথেষ্ট সংক্ষেপে হলেও যতটা সম্ভব তার গভীরে যাবার চেষ্টা করব।

আমার ধারণা রাষ্ট্র এবং রাজনীতির আলোকে ইসলামকে বুঝতে চাইলে তাকে সবচেয়ে ভালভাবে বুঝা যাবে। আমাদের এ কথা বুঝতে হবে যে, ইসলামের নবী মুহাম্মদ রাষ্ট্রহীন আরবে ইসলাম ধর্মের সাহায্যে একটি দিগ্বিজয়ী রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন। সুতরাং রাষ্ট্র গঠনের প্রসঙ্গ দিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু করা যাক।

 

২। ইসলামে ধর্ম ও রাষ্ট্র

এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে, মুহাম্মদ ধর্ম বিশ্বাসকে ব্যবহার করে মক্কায় প্রথমে ক্ষুদ্র হলেও এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন যা ছিল নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও প্রচারের মাধ্যমে কঠোরভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ। এর মধ্যে প্রথম থেকেই ছিল সামরিক শৃঙ্খলার বীজ। বিশেষত আরবের বিদ্যমান ধর্মবিশ্বাসগুলির বিরুদ্ধে মুহাম্মদের প্রচারে ছিল আক্রমণাত্মকতাও, যা বিশেষভাবে মূর্ত হত আরবদের প্রধান মন্দির কাবাগৃহে গিয়ে সেখানে বহুদেবতায় বিশ্বাস ও মূর্তি পূজার বিরুদ্ধে তার নিন্দাসূচক ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে। মদীনায় আশ্রয় লাভের পর মুহাম্মদ এই সমাজকে একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে তাকে আরও দৃঢ়বদ্ধ সামরিক শৃঙ্খলা এবং আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী রূপ দান করেন। বস্তুত প্রতিটি মুসলিম সমাজ আপাত দৃষ্টিতে যত নিরীহ ও বাস্তবে যত নিরস্ত্র হোক তাকে চিনতে হবে প্রথমে মক্কা ও অতঃপর মদীনার সেই সামরিক চরিত্র বিশিষ্ট মুসলিম সমাজেরই সম্প্রসারিত রূপ তথা ধারাবাহিকতা হিসাবে। তবে যতদিন তা প্রতিকূল অবস্থায় থাকে ততদিন তা থাকতে পারে মক্কার আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা নিরীহ রূপ নিয়ে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে পেলেই তা রূপ নেয় মদীনার সমাজের।

এভাবে মুসলিম সমাজের ভিতরে সর্বদা অধিষ্ঠান করে কখনও কম আর কখনও বেশী ইসলামের সামরিক শৃঙ্খলা, চরিত্র ও মনন এবং সেই সঙ্গে আপাত দৃষ্টিতে তার চরিত্রের দ্বৈততা, যা পরিস্থিতি বুঝে তাকে নম্র অথবা কঠোর করে। তবে চরিত্রের দ্বৈততা বলায় কেউ যদি মনে করেন যে, ইসলাম নম্রতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় তাহলে তিনি ভুল করবেন। এটা তার কৌশল মাত্র। কঠোরতাই ইসলামের মূল বৈশিষ্ট্য। এই কঠোরতার লালন হয় তার ধর্মের নির্দিষ্ট বিশ্বাস এবং বিভিন্ন চর্চার মাধ্যমে। ইসলাম প্রকৃতপক্ষে সামরিক শৃঙ্খলার ধর্ম। বিশেষ করে তার সামরিক শৃঙ্খলা, চরিত্র ও মননকে রক্ষা করবার অথবা গড়ে তুলবার জন্য আছে তার দৈনিক পাঁচবার নিয়মিত নামায, বিশেষত মসজিদে সম্মিলিত নামায, রোযা, ধর্মীয় ভাষণ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এগুলি তার সামরিক শৃঙ্খলা ও চরিত্রকে ধর্মীয় আবরণ দেয়। বিশেষ করে প্রতিটি মসজিদ ইসলামের সামরিক মনন ও চরিত্র তৈরী বা রক্ষার প্রশিক্ষণ শিবির হিসাবে ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ মসজিদকে চিনতে হবে ধর্মের আবরণে ইসলামের জিহাদী বা যুদ্ধ শিবির হিসাবে।

মুহাম্মদের ধর্ম প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ তথা জিহাদের গুরুত্ব সম্পর্কে এখানে এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে, মদীনায় যাবার পর থেকেই মুহাম্মদ একই সঙ্গে একজন ধর্মনেতা ও যুদ্ধনেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। ইসলামী ইতিহাসবিদদের দ্বারা লিখিত মুহাম্মদের জীবনীতে মদীনায় বসবাসকালীন অবস্থায় তার জীবনের শেষ দশ বৎসরে মুহাম্মদ কর্তৃক পরিচালিত বা নির্দেশিত ৭০ থেকে ১০০টি ব্যর্থ বা সফল আক্রমণ, লুণ্ঠন অভিযান এবং যুদ্ধের কথা জানা যায়। এর মধ্যে ১৭ থেকে ২৯টিতে মুহাম্মদ নিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।* এ থেকেই ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে যুদ্ধের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

---------------------------------------------
* M. A. Khan, Islamic Jihad : A Legacy of Forced Conversion, Imperialism, and Slavery, iUniverse, Inc., New York Bloomington, The United States of America, iUniverse rev. date: 5/19/2009, p. 74.

অথবা বাংলা অনুবাদ :
এমএ খান, জিহাদ : জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশ- ২০১০, পৃষ্ঠা- ৮৯।

---------------------------------------------

এটা মনে রাখতে হবে বর্বর ও যুদ্ধবাজ বেদুইন অধ্যুষিত এবং রাষ্ট্রহীন মরুময় আরবে ইসলাম দ্বারা একটি রাষ্ট্র এবং আরবের বাইরে বিস্তীর্ণ ভূভাগে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং ইসলামের মর্মমূলে আরবদের একটি রাষ্ট্র গঠন এবং সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা প্রোথিত রয়েছে। মুহাম্মদের হাত দিয়ে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ লাভ করে।

তবে আরবে দ্রুত একটি দিগ্বিজয়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বহু সংখ্যক উপজাতিতে বিভক্ত, স্বাতন্ত্র্যপরায়ণ এবং কখনও পরস্পর দ্বন্দ্ব ও কলহে লিপ্ত মূলত বেদুইন আরবদেরকে একটি কঠোর ও দৃঢ়বদ্ধ একনায়কী শাসনের অধীনে এনে একীভূত বৃহত্তর জাতিতে পরিণত করা। মুহাম্মদের অনেক পূর্ব থেকে কুরাইশরা ঐক্যবদ্ধ আরব জাতি গঠনের কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছিল। এ কাজে তাদের হাতিয়ার ছিল ধর্ম। তবে তাদের পদ্ধতি ছিল শান্তিপূর্ণ। মক্কার কাবা মন্দিরে বিভিন্ন উপজাতির স্বাতন্ত্র্য সূচক দেবতাদের প্রতীক হিসাবে বহু দেবতার প্রতিমা বা মূর্তি স্থাপন করে তারা কাবাগৃহকে বহুসংখ্যক উপজাতিতে বিভক্ত আরবদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত করে। বলা হয় কাবা মন্দিরে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতীক স্বরূপ ৩৬০টি মূর্তি ছিল। বিশেষত যুদ্ধপ্রবণ যাযাবর ও পশুপালক মরুচারী বেদুইনরা কুরাইশদের প্রভাবে বৎসরের চারমাস যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে চলতে অভ্যস্ত হয়। এই চার মাস যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল, যা আরবরা কঠোরভাবে মেনে চলত। এ ছাড়া বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আরবরা তাদের দেবতাদের পূজার উদ্দেশ্যে কাবায় সমবেত হত। সেই সময় দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজা ছাড়াও ছিল কবিতা পাঠ ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ নানান ধরনের উৎসবের আয়োজন, যা কয়েক দিন ধরে চলত। এভাবে কুরাইশদের পথ ছিল বলপ্রয়োগ ব্যতিরেকে এবং স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিকে দুর্বল ও খর্ব করে ঐক্যবদ্ধ ও বৃহত্তর আরব জাতি গঠন করা।  

কুরাইশদের দ্বারা সূচিত ও অনুসৃত আরব জাতি গঠনের কাজটিকেই কুরাইশ উপজাতির একজন সদস্য মুহাম্মদ সম্পন্ন করেন আরেক ভাবে। কিন্তু তার পদ্ধতি বা পথের ভিন্নতার ফলে ফলাফলও অনেক ভিন্ন হল। কুরাইশদের মতো তিনিও এ কাজে ধর্মের আশ্রয় নিলেন। তবে শান্তিপূর্ণ পন্থার পরিবর্তে তিনি আশ্রয় নেন যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের। তার ধর্ম সংস্কার দ্বারা শান্তির চার মাসও আর যুদ্ধমুক্ত রইল না। এভাবে সভ্য কুরাইশরা যেখানে যুদ্ধপ্রবণ এবং বর্বর বেদুইনদের সহিংসতা, হিংস্রতা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ প্রবণতাকে সংযত করে বৃহত্তর সভ্য সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেখানে মুহাম্মদ বেদুইনদের লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও যুদ্ধ প্রবণতাকে তার ধর্মের মাধ্যমে মুক্ত করে তার সাফল্যের ভিত্তি রচনা করলেন। ঐক্যবদ্ধ ও বৃহত্তর জাতি গঠনের শান্তিপূর্ণ ও ধীর প্রক্রিয়ার পরিবর্তে তিনি বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধ দ্বারা উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যের প্রাচীর ভেঙ্গে দ্রুত নিরঙ্কুশভাবে ঐক্যবদ্ধ আরব জাতি গঠনের পথ গ্রহণ করেন। এ কাজ করতে গিয়ে একটি ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে তিনি নূতন ধর্ম গঠন করেন।

মুহাম্মদ বিদ্যমান বহু দেবতার পরিবর্তে কুরাইশদের এবং মক্কার আশপাশের আরব উপজাতিসমূহের প্রধান দেবতা আল্লাহকে একমাত্র দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে ঘোষণা করেন এবং এই আল্লাহর একক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার নামে নিজের একক শ্রেষ্ঠত্ব এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধের পথ গ্রহণ করেন। এ পথ ধরেই তার একাধিপত্যবাদী, যুদ্ধ নির্ভর এবং আগ্রাসী চরিত্র বিশিষ্ট বৃহত্তর ও ক্রমপ্রসারমান আরব জাতি এবং রাষ্ট্র গঠন, যা তার মৃত্যুর পরও বহু শতাব্দী যাবৎ অব্যাহত থাকে।

সুতরাং ইসলামের মর্মে শুধু রাষ্ট্র গঠনকে দেখলে চলবে না একই সঙ্গে দেখতে হবে আরব জাতি গঠন তথা আরব জাতীয়তাবাদকেও, যা আজ অবধি ইসলামের অনেক বিপর্যয় ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও ধর্মের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল রয়েছে। তাই ইসলামের আল্লাহর ঘর হিসাবে বিবেচিত মক্কার কাবাঘরকে ঘিরে মুসলিমদের দৈনিক পাঁচবার নামায বা উপাসনা চলে এবং এই নামায বা উপাসনার ভাষাও বাধ্যতামূলকভাবে আরবী ভাষা। আরব ও মক্কার কাবাকে কেন্দ্র করে বাধ্যতামূলকভাবে যে দৈনিক পাঁচবার নামায হয় শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু হজের নামে বৎসরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে সারা পৃথিবীর সমর্থ মুসলিমদের কাবাগৃহে সমবেত হতে হয়। অর্থাৎ ইসলামের মর্মে আছে আরব উপাসনা। এভাবেও বলা যায় যে এক অর্থে ইসলাম হচ্ছে আরব ও আরবীর প্রতি আনুগত্যের ধর্ম।

ইসলাম যেখানে গেছে সেখানেই তার ধর্মচর্চার মাধ্যমে অন্যান্য জাতি ও সমাজের কম-বেশী আরব ও আরবীকরণ ঘটিয়েছে। পুণ্য অর্জন করতে মুসলিমদের জন্য শুধু যে উপাসনা ও ধর্মগ্রন্থ বা কুরআন আরবী ভাষায় পাঠ বাধ্যতামূলক তা-ই নয়, অধিকন্তু মুসলিম পরিচয়ের জন্যও আরবী ভাষায় নামকরণ বাধ্যতামূলক হয়ে দেখা দেয়। শুধু এইটুকুতে আরব বা আরবীকরণ যে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, উপরন্তু বিজিত অনারবদের উপর নানানভাবে আরবী ভাষা চাপিয়ে তাদেরকে আরব জাতিভুক্ত করার প্রচেষ্টা ইসলামের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই প্রচেষ্টার পরিণতিতে এশিয়ার সিরিয়া, ইরাক থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকার মিসর, লিবিয়া এবং মরক্কো, মৌরিতানিয়া পর্যন্ত বিশাল ভূভাগের মানুষ তাদের মাতৃভাষার পরিবর্তে আরবীকে তাদের মাতৃভাষায় পরিণত করে। এভাবে ঘটে বিশাল অঞ্চলের বাধ্যতামূলক আরবকরণ।

এই আরবকরণের সঙ্গে যে অনেক ক্ষেত্রেই হত্যা, নির্যাতন ও চাপ প্রয়োগ জড়িত ছিল সেই সত্য অনেক সময়ই অনালোচিত থাকে। যেমন ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, উমাইয়া গভর্নর হাজ্জাজের নির্দেশে ইরানে পারসী ভাষায় লেখার জন্য হাজার হাজার ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।* সে যুগে শিক্ষিত মানুষ কয়জন থাকতে পারত সেটুকু কল্পনা করতে পারলেই হত্যাযজ্ঞের এই ভয়াবহতা আমরা অনুমান করতে পারি। অবশ্য এতদ্সত্ত্বেও সুসভ্য ইরানীদেরকে তুলনায় অসভ্য ও বর্বর আরব মুসলিমরা জবরদস্তিমূলকভাবে ধর্মান্তরিত করতে পারলেও তাদের ভাষাকে পরিত্যাগ করাতে ব্যর্থ হয়। ইরানীরা ইসলাম ধর্ম এবং আরবী লিপি গ্রহণ করতে বাধ্য হলেও আরবী ভাষাকে গ্রহণ করে নাই। প্রাণ দিয়ে হলেও তাদের ভাষাকে তারা রক্ষা করেছে। তবে সামগ্রিকভাবে ইসলামের ইতিহাস এই সত্যকে তুলে ধরে যে, ইসলামের ইতিহাস বাধ্যতামূলক আরবকরণের ইতিহাস।

---------------------------------------------
* এ প্রসঙ্গে ইয়াহ্ ইয়া আরমাজানী ‘মধ্যপ্রাচ্য : অতীত ও বর্তমান’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে সবচাইতে অন্ধ দেশহিতৈষী ছিলেন বোধ হয় আবদ আল-মালিক, যিনি তাঁহার ভৃত্য ইরানের শাসনকর্তা হাজ্জাজের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আদেশ জারি করেন যে, অতঃপর শাসনকার্যের সমস্ত নথিপত্র পারস্য ও গ্রীক ভাষার পরিবর্তে আরবীতে লিখিতে হইবে। তিনি আরবী অক্ষরযুক্ত নতুন মুদ্রা চালু করেন এবং জনসাধারণকে চিঠিপত্র আরবী ভাষায় লিখিতে বাধ্য করেন। কথিত আছে যে, পারস্য ভাষায় লিখিবার অপরাধে হাজ্জাজ হাজার হাজার লোককে হত্যা করেন। আঘানীতে আমরা দেখি, কোন পারস্যবাসী তাহার নিজস্ব দেশের প্রশংসা করিলে খলিফা তাহার উপর অত্যাচার করেন।’ দ্রষ্টব্য : ইয়াহ্ ইয়া আরমাজানী, মধ্যপ্রাচ্য : অতীত ও বর্তমান, অনুবাদ : মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক, প্রকাশক- বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ- জুন ১৯৮৪, পৃষ্ঠা- ১০৬।  
---------------------------------------------

অর্থাৎ ইসলামের তরবারির সাহায্যে মুহাম্মদ মূল আরব ভূখণ্ডে যে অখণ্ড আরব জাতি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন সেই জাতি ও রাষ্ট্র আরবের বাইরে প্রসার অথবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের প্রসার ও চর্চার মাধ্যমে অধীনস্থ সমাজগুলির আরবকরণও ঘটিয়েছে। এভাবে ইসলাম ধর্মের লক্ষ্য শুধু ইসলাম ধর্মের একাধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, অধিকন্তু অনারবদের উপর আরব জাতির একাধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই সঙ্গে অনারবদেরকেও আরব সমাজ ও জাতিভুক্ত করা। এভাবে ধর্মের আবরণে ইসলাম একই সঙ্গে আরব জাতীয়তাবাদী এবং আরব সাম্রাজ্যবাদী। ইসলাম হচ্ছে প্রথমে আরবদের উপর মুহাম্মদের নিরঙ্কুশ একাধিপত্য এবং অতঃপর তার একনায়কী উত্তরাধিকারীদের নেতৃত্বাধীনে অনারবদের উপর আরবদের নিরঙ্কুশ একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। স্বাভাবিকভাবে ইসলাম আগ্রাসী আরব জাতীয়তাবাদকে দিয়েছে ধর্মের আবরণ। ধর্মের আবরণে প্রধানত যাদের সাহায্য নিয়ে মুহাম্মদ ইসলামের বিজয়ী বাহিনী গঠন করেন তারা হল অসভ্য, বর্বর ও যাযাবর বেদুইন।

সুতরাং ইসলামের মর্মে অধিষ্ঠান করে আছে অসভ্য, বর্বর ও যাযাবর আরব বেদুইন। এই বাস্তবতায় মুসলিম মনকে মূলত আরবায়িত মন কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে আরব বেদুইন মন হিসাবে চিনতে পারতে হবে। মুসলিমের মনের উপরে অন্যান্য সমাজ ও সংস্কৃতির যত আবরণ বা প্রলেপই পড়ুক ধর্মের মাধ্যমে বিশ্বাসী মুসলিমের মনের গভীরে বাস করে বর্বর আরব বেদুইন সত্তা।

ইসলামের মর্মকে অনুধাবন করতে পারলে ইসলামে রাজনীতি তথা রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যাবে। এটা বুঝতে হবে যে মুহাম্মদ যতটা না ধর্মনেতা ছিলেন তার চেয়ে বেশী তিনি ছিলেন একজন রাষ্ট্রনেতা। মুহাম্মদের নিকট ধর্ম ছিল আরবে তার একনায়কী কর্তৃত্বাধীনে একটা একনায়কী যুদ্ধবাদী সমাজ এবং একই সঙ্গে ঐ রকম এক সমাজের অভিব্যক্তি স্বরূপ একটা একনায়কী যুদ্ধবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। কুরআন-হাদীসসহ ইসলামের সূচনা পর্বের ইতিহাস এবং মুহাম্মদের জীবন ও কর্মকাণ্ড মনোযোগ দিয়ে পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয় যে আরবে একটা বিশ্বজয়ী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে মুহাম্মদ ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। এর জন্য যা যা করা তিনি দরকার এবং সম্ভব মনে করেছিলেন তার সবই তিনি করেছিলেন। এবং যে কথা একটু আগেই বলেছি যে, এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি যাদের সাহায্য নিয়েছিলেন তারা ছিল প্রধানত আরবের বর্বর বেদুইন।

মুহাম্মদের বিশ্বজয়ের পরিকল্পনার সাক্ষ্য আমরা পাই বিভিন্ন হাদীস থেকে। এ প্রসঙ্গে এখানে দুইটি হাদীস উল্লেখ করছি যা থেকে এই পরিকল্পনা এবং আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। একটি হাদীসে বলা হয়েছে,‘আবু হোরায়রা হইতে বর্ণিত আছে, হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন, অচিরেই পারস্য সম্রাট ধ্বংস হইবে; অতঃপর আর কেহ পারস্য সম্রাট হইবে না এবং রোম সম্রাটও অবশ্যই ধ্বংস হইবে; অতঃপর আর কেহ রোম সম্রাট হইবে না (উভয় সাম্রাজ্য মুসলিমদের করতলগত হইয়া) তাহাদের ধন-ভাণ্ডার আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় হইয়া যাইবে।’ বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা), তৃতীয় খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও আজিজুল হক সাহেব, প্রকাশক- হামিদিয়া লাইব্রেরী, ৬৫ চক সারকুলার রোড, ঢাকা-১২১১, একাদশ সংস্করণ, প্রকাশ কাল জুন ২০০৭, হাদীস নং ১৩৭৩, পৃষ্ঠা- ৮৯।

অপর একটি হাদীসে বলা হচ্ছে যে, একদিন তিনি ইহুদীদের (মদীনার) নিকট গিয়ে তাদেরকে বললেন, ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা মুসলিম হয়ে যাও, নিরাপদ থাকবে। ..... তোমরা জেনে রেখো যে, যমীন কেবল আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের।’ একই কথার পুনরুক্তি করে তিনি বললেন, ‘তোমরা জেনে রেখো যে, যমীন কেবল আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের। আমি তোমাদেরকে দেশান্তর করতে মনস্থ করেছি। তাই তোমাদের যার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, তা যেন সে বিক্রি করে দেয়। অন্যথায় জেনে রেখো, যমীন কেবল আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের।’ (বুখারী শরীফ, দশম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জানুয়ারী ২০০১, পৃষ্ঠা- ৩০৪।)

সুতরাং প্রকৃত বিচারে আরবে তিনি বর্বরদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তার মৃত্যুর পর এই বর্বরদের রাষ্ট্রই সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রগুলিকে আক্রমণ ও ধ্বংস করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ ভূভাগে সম্প্রসারিত হয়। আসলে সেটা ছিল সভ্যতার অবক্ষয় ও সঙ্কটের সময়। ফলে একদিকে যেমন ইসলামের মতো বর্বরতায় পরিপূর্ণ ও অমানবিক ধর্মের উত্থান সম্ভব হয়েছিল অপরদিকে তেমন তার এভাবে এমন বিস্তারও সম্ভব হয়েছিল।*

---------------------------------------------
* প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতার ক্ষয় ও সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামের উত্থানকে দেখলে ইসলামের মতো বর্বরতাপূর্ণ একটা ধর্মের উত্থানকে বুঝা সহজ হয়। এ বিষয়ে আমি আমার গ্রন্থ ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’য় কিছু আলোচনা করেছি। দ্রষ্টব্য : ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৭৫-৮০। এছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলেছি ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য়। এটিও ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত। প্রকাশনটি বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পুলিশ কর্তৃক বন্ধ করা হয়েছে। উভয় গ্রন্থই ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ (www.bangarashtra.net/org)-এর ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ’-এ দেওয়া আছে।
---------------------------------------------

সুতরাং সভ্যতার সঙ্কট, ক্ষয় ও পতনের পটভূমিতে দেখতে না পারলে ইসলামকে যেমন সঠিকভাবে বুঝা যাবে না তেমন ইসলাম সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের জন্য যে সমস্যা সৃষ্টি করেছে তার মীমাংসার পথও বের করা যাবে না। এটা বুঝতে হবে যে মানুষকে বর্বরতা ও হিংস্রতা, মানসিক প্রতিবন্ধ ও দাসত্বে ধরে রাখার ধর্ম এটা।

আসলে মুহাম্মদকে বুঝলে ইসলামের অনেক রহস্যই উন্মোচিত হয়। তিনি যে সচেতনভাবে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে যায় মৃত্যুর অল্পপূর্বে দেওয়া তার শেষ ভাষণ পড়লে যেটা বিদায় হজের ভাষণ হিসাবে সমধিক পরিচিত। সেখানে তিনি বলছেন, ‘সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’ (সূত্র : মহানবী (সা)-এর বিদায় হজ্জের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য, ইসলামিক ফউন্ডেশন বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০০৫)

এটা কি বিস্ময়কর স্ববিরোধে পূর্ণ একটা বক্তব্য নয়? যে ব্যক্তি ধর্ম নিয়ে এত রক্তারক্তি এবং বাড়াবাড়ি করে একটা ধর্ম এবং সেই সঙ্গে তাকে ব্যবহার করে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মুখ থেকে এ হেন বক্তব্য কি শোভা পায়? বাস্তব হচ্ছে এটাই যে, তার কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়েছিল। সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ধর্ম থাকবে বৈকি! কারণ ধর্মের সাহায্যে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাষ্ট্র রক্ষার জন্যও তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তার অবস্থান এখন গৌণ। মুখ্য বা প্রধান অবস্থান রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের অধিকারী শাসকদের।

এক অর্থে ইসলামের প্রথম এবং শেষ মোল্লা-শাসক একজনই, তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ। কারণ তিনি একই সঙ্গে ধর্ম প্রবর্তক, তার বিধিবিধান প্রণেতা এবং সেই ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। তারপর তার প্রবর্তিত ধর্মে আর কারও পক্ষে মৌলিক কোনও সংযোজন বা বিয়োজন ঘটানো যাবে না। কারণ তিনি নিজেকে আল্লাহর শেষ নবী বলেছেন। বিদায় হজের ভাষণে সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ‘নিশ্চয় জেনো, আমার পরে আর কোন নবী নেই।’

সুতরাং এরপর যারা ধর্মের দায়িত্ব নিবে তাদের পক্ষে মুহাম্মদের প্রবর্তিত ধর্ম ও তার শাস্ত্রের ব্যাখ্যা ও পালন সংক্রান্ত বিষয়েই মনোনিবেশ করতে হবে। রাষ্ট্র শাসন করতে গেলে সঙ্গত কারণে সেদিকে আর মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ধর্ম পরিচালনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে পার্থক্য ঘটতে শুরু করে। প্রথম চার খলীফা যারা ছিলেন মুহাম্মদের সাথী ও অনুসারী বা সাহাবী তাদের সময় এই পার্থক্য কিছুটা কম দৃশ্যমান হলেও তাদের পরবর্তী শাসকদের সময় থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল। শাসক আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মনেতা রয়ে গেলেও নিয়মিত ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং ইসলামী শাস্ত্র সংক্রান্ত বিষয়াদি অধ্যয়ন ও জ্ঞান লাভের জন্য তাদের অধস্তন ও প্রতিনিধি হিসাবে মোল্লা ও আলেমরা দেখা দিল।

ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ থাকে রাজনৈতিক নেতা তথা রাষ্ট্র-শাসকের হাতে। একই সঙ্গে সে ধর্ম তথা ধর্মীয় সমাজের এমন নেতা যার দায়িত্ব ইসলামের রক্ষা, প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য কাজ করা, আবার রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী নেতা হিসাবে আইনের শাসন রক্ষা ও প্রয়োগ এবং যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের দায়িত্ব পালন করা।

এই রকম বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবে ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন ও ধর্ম চর্চার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের জন্য আলেম এবং মোল্লা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটল। তবে মোল্লারা ধর্মের দায়িত্ব পালন করে প্রকৃতপক্ষে শাসক বা রাষ্ট্র নেতাদের অধস্তন হিসাবে। সুতরাং ইসলামে মোল্লারা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করলেও গোষ্ঠী বা শ্রেণী হিসাবে তারা কখনই এমন শক্তিশালী হতে পারে না যে তারা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনা করার জায়গায় যেতে পারে। আসলে যুদ্ধ ও প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত থাকলে নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করা এবং ধর্মের নির্দিষ্ট ও খুঁটিনাটি বিষয়গুলির উপর বিশদ জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয় বলে শাসকরা এগুলিকে মোল্লা এবং আলেমদের হাতে ছেড়ে দেয়। এমন অবস্থায় মোল্লা ও আলেমদেরকে রাষ্ট্রের শাসকদের অধস্তন অবস্থানে থেকে ধর্মের বিষয়াদি সম্পর্কে ব্যাখ্যা এবং নিয়মিত নামায ও কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা ইত্যাদি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

তবে ইসলামী সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি ইসলাম ধর্ম। এই ধর্মের সাহায্যে ইসলামে রাষ্ট্র ও সমাজের শাসক শ্রেণী আমজনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় শ্রেণী হিসাবে মোল্লা শ্রেণীর মাধ্যমে জনগণের উপর শাসক শ্রেণীর এই নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয়। ফলে এই শাসকদের উপরেও মোল্লাদের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ কাজ করে। অর্থাৎ শাসক যে আইন বা বিধান বলে রাষ্ট্র শাসন করবে তার ভিত্তি হচ্ছে ইসলাম। এটাকেই ইসলামী বিধিবিধান তথা শরীয়ৎ বা শরীয়া বলে।  

মুহাম্মদ তার বিদায় হজের ভাষণেও ইসলামের শাসকদের ক্ষমতার সীমা স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন, যেটা লঙ্ঘন করার ক্ষমতা কোনও শাসকেরই নাই। দেখা যাক তিনি কী বলছেন, ‘আমি যা রেখে যাচ্ছি তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো তাহলে তোমাদের পতন হবে না। আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ্।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যদি নাককাটা হাবশী ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমীর করা হয় এবং সে যদি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী তোমাদেরকে পরিচালনা করে তাহলে তার আদেশ মেনে চলবে।’

এমন এক বাস্তবতায় শাসক শরীয়া বা ইসলামের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে যা খুশী তা করার ক্ষমতা রাখে না। কিছু ক্ষেত্রে কিছু অন্যথা করা যেতে পারে। কিন্তু বেশী দূর যেতে চাইলে বিপদ ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে শাসককে কাফের আখ্যায়িত করে মোল্লা শ্রেণী জনমত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শাসক বা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটাবার ক্ষমতা রাখে। ধর্মের বিরুদ্ধে গেছে জেনে অনুসারীরাও শাসক কিংবা শাসক শ্রেণীকে অমান্য করবে। কাজেই যে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক শাসক শ্রেণী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই ধর্মকে অস্বীকার করার ক্ষমতা তার আর হয় না।

আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানুল্লাহ্ সমাজের সংস্কার বা আধুনিকায়ন ঘটাতে গিয়ে মোল্লাদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত এবং বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়ে ১৯২৯ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। অনেক পরবর্তী কালে মার্কসবাদীরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর এমন একটি বিপদে পড়েছিল। মোল্লাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বিশ্ব কর্তৃক সমর্থিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত মুসলিম জনগণের যুদ্ধে ১৯৯২ সালে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। তার পূর্বে মার্কসবাদীদের শাসন রক্ষায় ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠায়। কিন্তু মুজাহিদদের চাপের মুখে ১৯৮৯-এ একটা পর্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সেনা প্রত্যাহার করে নিলে ১৯৯২ সালে মার্কসবাদী সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।

পৃথিবীর ইসলামবাদীদের নিকট আফগান সরকারের বিরুদ্ধে এই লড়াই জিহাদ বা ইসলামী ধর্মযুদ্ধ হিসাবে দেখা দেয়। বাংলাদেশসহ বহু দেশের বিপুল সংখ্যক জিহাদী এই যুদ্ধে তথা জিহাদে অংশ নেয়। এই জিহাদ ছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত আফগান ‘কাফের’ কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন সমর্থিত জিহাদীদের যুদ্ধ। এভাবে এই যুদ্ধে আমরা দেখতে পাই সোভিয়েত সমর্থিত আফগান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ-গণতন্ত্র ও ইসলামের ঐক্য। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলামী সমাজে জনমত নিয়ন্ত্রণে মোল্লাদের ভূমিকা বিশেষভাবে দৃশ্যমান হয়।

অর্থাৎ ইসলামে জনমত নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে ইসলাম ধর্ম এবং এরই মূর্ত রূপ হচ্ছে মোল্লা শ্রেণী, যারা ইসলাম সংক্রান্ত বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্বপ্রাপ্ত। ইসলামী আইন বা বিধান তথা শরীয়ার ব্যাখ্যাও মূলত তাদের হাতে। রাষ্ট্র ক্ষমতা সরাসরি হাতে না থাকলেও এই কারণে মোল্লারা মুসলিম সমাজে যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হয়। তবে যুদ্ধ ভিত্তিক সমাজ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে যে জায়গায় যুদ্ধের শক্তি সবচেয়ে বেশী কেন্দ্রীভূত এবং সংগঠিত হয় সেই রাষ্ট্র হয় ইসলামের প্রধান ভরকেন্দ্র। এবং এই রাষ্ট্রটাও মূলত যুদ্ধ নির্ভর এবং এর ফলে সেনাবাহিনী নির্ভর। এই বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ইসলামী শাসকদের ভূমিকার মধ্যে। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রশাসককে যোদ্ধা এবং সেনাপতি হতে হয়। পাশ্চাত্যের হাতে পরাজয় ও অধীনস্থতার পূর্ব পর্যন্ত এটাই ছিল সমস্ত ইসলামী সমাজের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য।

 

৩। যুদ্ধ ও সহিংসতা নির্ভর সমাজ

যুদ্ধ নির্ভর সমাজ হওয়ায় সমর নায়ক তথা যুদ্ধনেতা যে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতা হবে সেটাই স্বাভাবিক। বস্তুত এই রকম সমাজ যুদ্ধ ও সহিংসতা নির্ভর হওয়ায় ভয় তথা ত্রাস সৃষ্টি সমাজ ও রাষ্ট্র রক্ষা ও পরিচালনার এক প্রধান হাতিয়ার হয়। এই বাস্তবতা মোল্লাদের উপর শাসকদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। কারণ যারা শাসক হয় যুদ্ধ এবং ক্ষমতা নিয়ে ষড়যন্ত্র, রক্তপাত এগুলিতে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠে। রণক্ষেত্রের একজন যোদ্ধার মত হয় তার মনস্তত্ত্ব। যে কোনও সময় মৃত্যুর জন্য তাকে প্রস্তত থাকতে হয়। যে কয়দিন ক্ষমতায় থাকে তাকে অধস্তনদেরকে শাসন করতে হয় কঠোর হস্তে। কারণ গোটা ব্যবস্থাই ভয় ও সন্ত্রাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। নমনীয় শাসক এখানে কাপুরুষ বা ভীরু হিসাবে চিহ্নিত হবে এবং প্রজারা যেমন তাকে মানবে না তেমন তার নিকট অনুসারীরাও তাকে মানবে না। এই ব্যবস্থায় দয়া থাকবে না তা নয়, তবে সেটাকে হতে হবে নৃশংস ও দয়াহীনের দয়া।

মোল্লারা এমন এক কঠোর ও নৃশংস ভাবাদর্শের প্রচারক এবং বার্তাবাহক মাত্র, এটার প্রয়োগকারী নয়। এই ভাবাদর্শের প্রয়োগের জন্য যে সময় ও মনোযোগ দরকার সেটা সম্ভব হয় না ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় বিষয়াদি সংক্রান্ত জ্ঞানচর্চায় নিজেদের শ্রম ও মনোযোগ নিবদ্ধ করার উপর জোর দিতে গিয়ে। সুতরাং এটার প্রয়োগ বা অনুশীলনের ক্ষমতা রাষ্ট্র-নেতাদের হাতে। রাষ্ট ক্ষমতা হাতে থাকায় অর্থবিত্ত সংগ্রহের ও ব্যবহারের সুযোগও তাদের হাতে। সুতরাং মোল্লারা ধর্মীয় ব্যাখ্যার যত ক্ষমতাই রাখুক এবং সমাজে যতই প্রভাব রাখুক তারা জীবন ও জীবিকার জন্য শাসকদের উপর বিভিন্নভাবে নির্ভর করে। বিশেষত থাকে প্রাণের ভয়। কারণ স্বেচ্চাচারী একনায়ক শাসক সর্বদা মৃত্যুর ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত এবং একই সঙ্গে অন্যদেরকে যে কোনও অজুহাতে হত্যায় অভ্যস্ত।

এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। সেটা হচ্ছে মুহাম্মদ তার শাসন ক্ষমতার উত্তরাধিকারী বাছাইয়ের কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা নিয়ম দিয়ে যান নাই। ফলে তার যুদ্ধবাদী রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচনের প্রশ্নে শুধু সামরিক দক্ষতা যথেষ্ট ছিল না, উপরন্তু ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তের দক্ষতা ও সক্ষমতাও অন্যতম নিয়ামক উপাদান হিসাবে দেখা দেয়। মুহাম্মদের মৃত্যুর সাথে সাথে তার ক্ষমতার উত্তরাধিকার নিয়ে এই চক্রান্তের রূপ আমরা দেখেছি। মুহাম্মদের আপন চাচাত ভাই ও জামাতা আলীকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে বাদ দিবার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে বিবাদ ও চক্রান্ত শুরু হয় তা পরবর্তী কালে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের রূপ নিয়ে আজ অবধি ইসলামী পৃথিবীকে অধিকার করে আছে। উত্তরাধিকার নির্বাচনের পদ্ধতির অনিশ্চয়তার পরিণতিতে এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে চতুর্থ খলীফা আলীর পর মুয়াবিয়া খলীফার পদ দখল করে তাকে বংশগত রাজতন্ত্রের রূপ দেন।

কিন্তু সেখানে বংশ বা পরিবারের ভিতর ক্ষমতা রাখার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হলেও পিতার মৃত্যুর পর যে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করবে এমন কোনও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেল না। এ ক্ষেত্রে সাধারণত পুত্রদের মধ্যে যে সবচেয়ে দক্ষ চক্রান্তকারী এবং যোদ্ধা হত সে-ই সিংহাসনের দখল নিত। সেই সঙ্গে অনেক সময়ই থাকত অন্য ভাই বা নিকটাত্মীয়দেরকে হত্যা করে ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার রীতি। বিশেষত নিরঙ্কুশভাবে স্বেচ্ছাচারী এবং একনায়কী ক্ষমতা চর্চার কেন্দ্র স্বরূপ সিংহাসনের অধিকার নিয়ে যে চক্রান্ত এবং সহিংসতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এভাবে ইসলাম একটা ভয়ঙ্কর ও নৃশংস চক্রান্ত, নিষ্ঠুরতা এবং যুদ্ধ ও সহিংসতার রীতি-নীতি, অভ্যাস ও মনন সমগ্র সমাজের ভিতরে সতত ব্যাপ্ত করেছে। এই বক্তব্যের সত্যতা কতখানি তা মুসলিম পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যায়। তা প্রায় সর্বত্র ও প্রায় সর্বক্ষণ চক্রান্ত, হিংস্র নিষ্ঠুরতা ও খুনাখুনিতে পরিপূর্ণ। এমন একটি নিষ্ঠুরতা, সহিংসতা, স্বেচ্ছাচার ও যুদ্ধনির্ভর একনায়কী সমাজ ব্যবস্থার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সামরিক শাসকদের ভয়ে মোল্লারাও ভীত থাকে। তারা জানে যে শাসক চাইলে যে কোনও সময় যে কোনও ছুতায় তাদের প্রাণ সংহার করতে পারে।

এই অবস্থায় ইসলামী শাসককে নিয়ন্ত্রণ করার মতো কোনও শক্তি সমাজের ভিতরে কোথায়ও থাকে না। ফলে ধর্মের অনেক বিধি লঙ্ঘন করেও তারা নিজেদের ব্যক্তি জীবনকে পরিচালিত করতে পারে। যেমন ধর্মীয় বিধানকে লঙ্ঘন করে ইচ্ছামত মদ্যপান, অপরিমিত ভোগ-বিলাস এবং ইচ্ছামত অগণন নারী সম্ভোগ, ইচ্ছা হলে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী কারও স্ত্রী-কন্যাকে জোর করে ধরে নিয়ে এসেও। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই বিধি লঙ্ঘনের সীমাকে একজন শাসকের ব্যক্তিগত ভোগ-সম্ভোগের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। এবং সে ক্ষেত্রেও মোল্লাদেরকে বেশী চটালে বিপদ হতে পারে।

সবচেয়ে বড় কথা শাসক যে স্বেচ্ছাচারিতাই করুক সমাজের মূল বিন্যাসকে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে না। শাসক যদি সৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েও ধর্মীয় বিধিবিধান লঙ্ঘনকে সামাজিক রূপ দিবার চেষ্টা করে অর্থাৎ সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করে তবে মোল্লারা তার বিরুদ্ধে জনমত জাগাবে এবং স্বাভাবিকভাবে উপর তলা থেকেও ক্ষমতার নূতন আকাঙ্ক্ষী পাবে, যারা মোল্লাদের এবং সেই সঙ্গে নীচ তলার জনগণেরও সমর্থন নিয়ে এই ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়াসকে বিনষ্ট করবে। অর্থাৎ ইসলাম এমন এক ব্যবস্থা যেটা একবার চেপে বসলে বা প্রতিষ্ঠিত হলে সেটাকে ভিতর থেকে পরিবর্তন ঘটাবার আর কোনও উপায় থাকে না।  

এই কারণে ইসলামী পৃথিবীতে পরিবর্তনের সূচনা ঘটাবার জন্য পাশ্চাত্যের বিজয় এবং আধিপত্যের প্রয়োজন হয়েছে। পাশ্চাত্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে সনাতন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর প্রায় কোথায়ও সনাতন রূপে নাই। ইসলামের নূতন শাসকরাও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু করে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। তবে মূল ইসলাম যেমন ঠিক থাকছে তেমন তার বার্তাবাহক হিসাবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও মোল্লারা তাদের ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাস্তবে আর অনেক কিছু মানা যাচ্ছে না। কিন্তু সেটা যে ঠিক হচ্ছে না সেই বোধটুকু সর্বদা তারা সমাজের ভিতর জাগিয়ে রাখে। সময় এলে যে ইসলামের আদি অধ্যায়ে প্রত্যাবর্তন করে প্রকৃত ইসলাম কায়েম করতে হবে সেই আকঙ্ক্ষার বীজও তারা সর্বদা সমাজ মনে বপন করে চলে। সেটার জন্য আলাদা কোনও প্রচারণার দরকার হয় না। ইসলামের প্রচারই তার জন্য যথেষ্ট। কেন যথেষ্ট বলছি তা বুঝবার জন্য কুরআন-হাদীসের একটু মনোযোগী পাঠই যথেষ্ট। এই দুইটির কোনটিরই পরিবর্তন কিংবা সংস্কার করা সম্ভব নয়। সুতরাং এগুলির চর্চা ও প্রচার সমাজের চেতনায় সর্বদা পরিবর্তন বিরোধী আকাঙ্ক্ষাকে জাগরূক রাখে।

যাইহোক, একদিকে শাসক এবং অপর দিকে মোল্লা এই উভয় শ্রেণীকে আমরা ইসলামী সমাজের সংগঠন, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষার প্রধান শক্তি হিসাবে দেখতে পাই। একদিকে শাসক এবং অপর দিকে মোল্লা এই উভয়ের ঐক্যের মধ্যে ইসলামী তথা মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য রক্ষার চাবিকাঠি নিহিত।

আমার মনে হয় এই দিক থেকে বিচার করলে স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক মাদ্রাসা শিক্ষাকে রক্ষার তাৎপর্য স্পষ্ট হয়। কারণ মাদ্রাসা হচ্ছে মোল্লা সৃষ্টির কারখানা। বিএনপি-জাতীয় পার্টির শাসনামলের মতো আজও একই কর্মনীতি আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হতে দেখছি। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা বা লোকবাদ হচ্ছে কথার কথা, যার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক থাকতে পারে না অথবা থাকলেও সেটা হয় ক্ষীণ বা ভঙ্গুর, যা যে কোনও সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে।

কারণ ইসলামী সমাজ এমন রাজনৈতিক সমাজ যেখানে রাষ্ট্রের করণীয় বা দায়িত্ব হচ্ছে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা অথবা সংরক্ষণ ও প্রসার করা। ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক ভাবে ইসলাম প্রসারের জন্য ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রকে অব্যাহতভাবে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। যখন অবস্থা প্রতিকূল থাকে তখন ইসলামী সমাজ বা তার নেতৃত্ব কৌশলগতভাবে নমনীয় হতে পারে, কিন্তু অবস্থা পক্ষে আসবার সাথে সাথে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেওয়া তার জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দেখা দেয়। যে নেতৃত্ব এই আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে পারে না ইসলামী সমাজ অথবা রাষ্ট্র তাকে অপসারণ করে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে সক্ষম শক্তিকে তথা জিহাদী শক্তিকে নেতৃত্বে নিয়ে আসে।


৪। শান্তি ও যুদ্ধের চক্র

শান্তি ও যুদ্ধের একটি চক্রের মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান ইসলামের গতিধারাকে বুঝতে না পারলে ইসলামের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা সম্ভব নয়। এর ফলে কারও দৃষ্টিতে ইসলাম শুধুই শান্তির ধর্ম আবার কারও নিকট ইসলাম শুধুই যুদ্ধ তথা শুধুই জিহাদের ধর্ম। এটা ঠিক যে ইসলামের প্রাণশক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে জিহাদ; যুদ্ধজয়ী না হলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিতই হত না। যুদ্ধ তাকে করতে হবে। কারণ যুদ্ধ ছাড়া ইসলাম নাই। ধর্মীয় বিধানেই সেটা সিদ্ধ। এ বিষয়ে কুরআনের বিধান স্পষ্ট।

কুরআনের ৯ নং সূরা তাওবার ২৯ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘ .... যাহারা আল্লাহে ঈমান আনে না ও শেষ দিনেও নহে এবং আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন তাহা হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দীন অনুসরণ করে না; তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিবে, ....।’*

---------------------------------------------
* এই গ্রন্থে কুরআনের সকল অনুবাদের উৎস : আল কুরআনুল করীম, প্রকাশক : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, আগারগাঁও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা- ১২০৭, ছত্রিশতম মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০০৭।
---------------------------------------------

কুরআনের বহু আয়াতেই যুদ্ধ ও সহিংসতার পক্ষে বক্তব্য পাই। যেমন, ‘ তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়। কিন্তু তোমরা যাহা অপসন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা ভালবাস সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্ জানেন আর তোমরা জান না।’ (২:২১৬)। বুঝাই যায় যে প্রথম পর্যায়ে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মের প্রসারের জন্য সহিংসতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে জনমত বা আপত্তি ছিল তা দূর করার জন্য মুহাম্মদ আল্লাহর নামে এই ওহী হাজির করেন। কিংবা দেখা যাক এই আয়াত, ‘যাহারা কুফরী করে আমি তাহাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করিব; সুতরাং তোমরা আঘাত কর তাহাদের স্কন্ধে ও আঘাত কর তাহাদের প্রত্যেক আঙ্গুলের অগ্রভাগে।’ (৮:১২)। আমরা যুদ্ধের সপক্ষে কুরআনে বহু আয়াত দেখি, যথা, ২:১৯৩, ৮:৩৯, ৮:৬০, ৯:৫, ৬৬:৯, ইত্যাদি। বস্তুত কুরআন মুহাম্মদের কর্তৃত্ব ও একনায়কত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদানে অস্বীকারকারী তথা ইসলামে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ, সহিংসতা ও যুদ্ধের নির্দেশ পূর্ণ এমন একটি গ্রন্থ যে এটিকে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাপ্রদর্শন, যুদ্ধ ও সহিংসতার নির্দেশিকা বললে বেশী বাড়িয়ে বলা হয় না। এক কথায় ইসলামে অবিশ্বাস ও অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের মূল সুর।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ইসলামে সর্বক্ষণ ও সর্বত্রই যুদ্ধ করে যেতে বলা হয়েছে কিংবা ইসলামে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নাই। একটা উপমা দিলে বোধ হয় বুঝতে সুবিধা হবে। আমাদের প্রাণশক্তির প্রধান উৎস খাদ্য। খাদ্য ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। সুতরাং আমরা খাবার খাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা সারাক্ষণ খাবার খাই বা খাবার খেতেই থাকি। খাবার পর সেটাকে হজম বা শরীরে তার প্রাণরস আত্মস্থ করার জন্য সেটাকে পরিপাক করতে হয়। সেই সময়টা খাদ্য গ্রহণের নয়। এটা প্রকৃতপক্ষে আত্মস্থকরণের সময়। তখনও খেয়ে গেলে হজম বা আত্মস্থকরণ দূরের কথা বাঁচাই সম্ভব হবে না, আর খুব বেশী খেয়ে খাওয়া বন্ধ করলে পেট খারাপ হবে।

ইসলামের ব্যাপারটাও তেমন। যুদ্ধ তার সম্প্রসারণ ও নূতন শক্তি আহরণের জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু তার পর আসে তার অর্জন সংহত বা দৃঢ়বদ্ধ করার পর্যায়। এটাকে ইংরাজীতে বলা হয় ‘কনসলিডেশন’। এই পর্যায়ে নবলব্ধ বিজয়কে আত্মস্থ করার জন্য তাকে অনেক সময় বিজিতদেরকে ছাড় দিতে দেখা যায়। এটারই একটা প্রকারভেদ হচ্ছে ‘জিজিয়া’ করের বিনিময়ে বিধর্মীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের কিছু অধিকার প্রদান। তবে এটা সাময়িক একটা ছাড় এবং কৌশলও বটে। অনেকে এটাকে ইসলামের উদারচিত্ততা বা সহনশীলতা ভেবে কিংবা বলে খুশীতে উচ্ছ্বসিত হন। কিন্তু এই পর্যায়ের ভিতরে কীভাবে ধীর কিংবা সুস্থির গতিতে বিজিতদের উপর চাপ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, প্রলোভন এবং বিতাড়নের মাধ্যমে ইসলামের অর্জনকে সংহত করা কিংবা তার অধিকারভুক্ত এলাকায় তার প্রসার ঘটানো কিংবা ইসলামীকরণকে সম্পূর্ণ করা হয় সেটা প্রায় সময়ই অনুল্লেখিত অথবা উপেক্ষিত থেকে যায়।

জিজিয়া কর প্রবর্তনের মতো স্থূল রূপে ইসলামের অনেক বিধির প্রয়োগই আজকের যুগে সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন রূপে ইসলামীকরণ এ যুগেও সম্ভব। ইসলামীকরণের এই প্রক্রিয়া আমরা বাংলার এই অংশটিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেখে আসছি। ১৯৭১ ছাড়াও কিছু কিছু সময় হামলা করে হত্যা, ধর্ষণ ও লুঠতরাজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামে ধর্মান্তরকরণ হলেও সম্পদ ও সম্পত্তি দখল এবং বিতাড়নটাই বাংলার এই ভূখণ্ডের ইসলামীকরণের প্রধান পদ্ধতি হিসাবে আমরা ’৪৭ থেকে আজ অবধি দেখে আসছি। হিন্দু বা অমুসলিমদের পালাবার জায়গা হিসাবে পার্শ্ববর্তী ভারত-রাষ্ট্র আছে। সুতরাং সেভাবে ধর্মান্তরকরণ করা সম্ভব নয়। অমুসলিমরাও বাধ্যতামূলকভাবে ইসলাম গ্রহণের মতো অবমাননাকর বা অসম্মানজনক পরিণতিকে এড়াতে চেয়ে বিকল্প হিসাবে মাতৃভূমি পরিত্যাগ ক’রে পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। তবে আমরা আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা থেকেই ইসলামের আত্মস্থকরণ বা তুলনামূলক অর্থে সঙ্কোচন এবং প্রসারণের এই পর্যায়ক্রম সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। বস্তুত ইসলাম তার প্রতিষ্ঠার পর চৌদ্দশত বৎসর এই গতিধারা নিয়েই অব্যাহত আছে।

তবে এও সত্য যে সব সময় এবং সর্বত্র ইসলামের মারমুখী রূপ চোখে পড়ে না। ইসলাম বা মুসলিমরা অসাধারণ কৌশলীও বটে। সুতরাং শান্তির ললিত বাণী অনবরত উচ্চারিত হবে। যখন নির্দোষ ও নিরীহদের উপর হামলা হবে তখনও তার সব দায়ভার চাপানো হবে হিন্দু বা অমুসলিমদের উপর। বিশেষ করে হামলা শেষ হয়ে গেলে আপাতদৃষ্টিতে জিহাদের ভূমিকা শেষ হয় কিছু সময়ের জন্য। তখন মডারেট মুসুলিমরা ইসলামের শান্তির বার্তা প্রচারে মাঠে নেমে পড়ে।

আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যারা হামলা করে, লুটপাটে যারা অংশ নেয় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র এবং লুঠের পরেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্রই রয়ে যায়। আমার অভিজ্ঞতা থেকেও দেখেছি’ ৭১-এ ব্যাপকায়তনে লুঠের পর হিন্দুদের যে সব সম্পদ গরীব মুসলিমরা লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল টিন, আসবাবপত্রসহ সেগুলির বেশীর ভাগ শেষ পর্যন্ত ধনী মুসলিমরা পানির দরে কিনে নিয়েছে।*

---------------------------------------------
* প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ ধরনের একটি ঘটনার জীবন্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে আজাহারুল ইসলামের লিখা গ্রন্থ ‘বাঙ্গালী জন-চরিত্র : কিছু নমুনা বিশ্লেষণ’-এর ‘নমুনা-৭১’ নামক প্রবন্ধে। গ্রন্থটি ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত। এ ছাড়া এটি ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ (www.bangarashtra.net/org)-এর ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘প্রবন্ধ’-এ ‘বাঙ্গালী জন-চরিত্রের কিছু নমুনা বিশ্লেষণ’ (http://www.bangarashtra.net/article/829.html) নামক গ্রন্থে দেওয়া আছে।
---------------------------------------------

আমাদের দেশে হিন্দুদের উপর যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তাতে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে মডারেট মুসলিমরা, যারা নিজেরা সবাই হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও হিন্দুদের জমি, বাড়ী ও অন্যান্য সহায়-সম্পদ নানানভাবে পানির দরে অথবা বিনামূল্যে হস্তগত করেছে। কিংবা প্রত্যক্ষ জিহাদীদের অনেকে হিন্দুদের সম্পদ-সম্পত্তি নানানভাবে আত্মসাৎ করে পরবর্তী সময়ে মডারেট সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক নেতায় পরিণত হয়েছে। এই মডারেট মুসলিমদেরই আর একটু শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত এবং বুদ্ধিমানরা হিন্দুদের শূন্য স্থান পূরণ করে সমাজের বুদ্ধিজীবীদের নানান স্তর গঠন করেছে। এই মডারেট মুসলিমরা প্রত্যক্ষভাবে জিহাদী বা জঙ্গী না হতে পারে এমনকি উচ্চকণ্ঠ অসাম্প্রদায়িকও হতে পারে, কিন্তু এ দেশ ও সমাজের ইসলামীকরণের যাবতীয় সুবিধা ভোগকারী। সুতরাং ইসলামের অন্ধকার দিকগুলির উন্মোচনের বিরুদ্ধে জিহাদী এবং মোল্লাদের থেকে তাদের অবস্থান বেশী দূরে থাকে না। শান্তির ধর্ম ইসলামের সমালোচনা শুনলে নানান যুক্তির জাল বিছিয়ে তারা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে পড়ে। যেন জিহাদ বা সন্ত্রাস ইসলামের অংশ নয়। যেন ইসলামের সমালোচনা করার ফলে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত লাগায় কিছু মানুষ ক্ষিপ্ত হতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ ধর্মে কোনও দোষ নাই, সব দোষ সমালোচনায়!

আসলে এ কথা বুঝতে হবে যে, মডারেট মুসলিম আর জিহাদী মুসলিম একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। আজকের মডারেট কাল জিহাদী এবং আজকের জিহাদী কাল মডারেটে পরিণত হতে পারে। এই অর্থে বলা যায় যে, ইসলাম একটা বহুরূপী ধর্ম বা মতাদর্শ। ইসলামে সবই মজুত আছে। শান্তি এবং জিহাদ সবই। সুতরাং শান্তি থেকে জিহাদ এবং জিহাদ থেকে শান্তিতে চক্রাকারে আবর্তিত এই ধর্মে যখন যেটার প্রয়োজন তখন সেটারই আশ্রয় নিতে সমস্যা নাই। মূল বিষয় হচ্ছে ভোগ-সম্ভোগ এবং স্বার্থ। ভোগ-সম্ভোগ এবং স্বার্থ হাসিল বা রক্ষার জন্য পরিস্থিতি কখন কী করতে বলবে তার উপর নির্ভর করে জিহাদ নাকি শান্তি কোনটার আশ্রয় নেওয়া হবে।


৫। ধর্ম ও রাজনীতি

ইসলাম একই সঙ্গে একটি রাজনীতি এবং ধর্ম। সাধারণভাবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের নিকট এই ধর্মের রাজনৈতিক দিকটা প্রধান আর ধর্মীয় নেতৃত্বের নিকট এই রাজনীতির ধর্মীয় দিকটা প্রধান। তবে এই সঙ্গে এ কথা পুনরায় বলা দরকার যে ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতি জড়াজড়ি করে থাকলেও রাজনীতিই এখানে নেতা আর ধর্ম তার অনুসারী। কিন্তু রাজনীতি এখানে নেতা হলেও তার পক্ষে ধর্মের কাঠামো ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয় না। ধর্মের হাতিয়ার ছাড়া ইসলামের রাজনীতি অচল। অর্থাৎ ইসলামের রাজনীতি ধর্মের এমন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে ধর্মকে বাদ দিলে বা ধর্ম না থাকলে তার রাজনীতিও থাকে না। বরং বাস্তবে দেখা যায় যে রাষ্ট্র যেখানে নাই সেখানেও মুসলিমরা ইসলামী সমাজ গঠন করে টিকে থাকতে পারে। যেমন পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে কিংবা ভারত-রাষ্ট্রে মুসলিমরা শক্তিশালী সমাজ গঠন করে আছে। সে ক্ষেত্রে মসজিদ তাদের সংহতি বা ঐক্যের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা রাখে। তবে সব সময় মনে রাখতে হবে ইসলাম তথা ইসলামী সমাজের লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র গঠন। কারণ ইসলাম শুধু বিশ্বাস ও কিছু সামাজিক অনুশাসনে সীমাবদ্ধ থাকবার ধর্ম নয়, এটা একই সঙ্গে একজন একনায়কের অধীনে জবরদস্তিমূলক শাসনদণ্ড হাতে রেখে চলতে চায়। সেটা শুধু একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে নয়, উপরন্তু সমগ্র বিশ্বব্যাপী।

সুতরাং মুসলিমরা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে যেখানেই থাকুক সেখানেই তারা রাজনৈতিক সত্তা হিসাবেও অবস্থান করে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি মুসলিম সমাজ সেটা যত ক্ষুদ্র হোক এবং পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকুক তার গর্ভে ধারণ করে ইসলামী রাষ্ট্রের ভ্রূণ। ইসলামী রাষ্ট্র যতক্ষণ জন্মলাভ না করে ততক্ষণ এই ভ্রূণাকার রাষ্ট্রের কেন্দ্র বা রাজধানী হিসাবে ভূমিকা পালন করে তার মসজিদ। রাষ্ট্র না থাকলে মসজিদকে কেন্দ্র করে ইসলামের রাজনীতি আবর্তিত হয়।

ইসলাম কখনই তার বিশ্বজয়ের লক্ষ্য গোপন করে না। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘এবং তোমরা তাহাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে থাকিবে যতক্ষণ না ফিৎনা* দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর দীন** সামগ্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়’ (কুরআন- ৮:৩৯)। ‘তিনিই তাঁহার রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করিয়াছেন, অপর সমস্ত দীনের উপর ইহাকে জয়যুক্ত করিবার জন্য। আর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্ই যথেষ্ট’ (৪৮:২৮)।  ‘তিনিই তাঁহার রাসূলকে প্রেরণ করিয়াছেন হিদায়াত*** ও সত্য দীনসহ সকল দীনের উপর উহাকে বিজয়ী করার জন্য, যদিও মুশরিকগণ× উহা অপসন্দ করে।’ (কুরআন- ৬১:৯)

---------------------------------------------
* ফিৎনা অর্থ কুফর বা অস্বীকার, অমান্যতা, অকৃতজ্ঞতা, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য দেবতায় বিশ্বাস ইত্যাদি।

* দীন অর্থ জীবন যাপনের নিয়ম বা ধর্ম।
* এখানে হিদায়াত অর্থ দিকনির্দেশনা, সত্য-মিথ্যাকে স্পষ্ট করা ও সঠিক পথের সন্ধান দান।

× মুশরিক অর্থ পৌত্তলিক. বহুদেবতায় বিশ্বাসী।
---------------------------------------------

সব ধর্মের উপর ইসলামের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে কুরআনে যেমন বলা হয়েছে তেমন মুহাম্মদ তার বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা হাদীসে স্পষ্টভাবে বলেছেন। আসলে বিশ্বব্যাপী একটি একক ইসলামী সমাজ বা উম্মা এবং একটি একক ইসলামী রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ইসলামের মর্মে গাঁথা। এবং এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছে জিহাদ বা যুদ্ধ অর্থাৎ বলপ্রয়োগ। এ ব্যাপারে ইসলাম অকপট। এটি না বুঝলে ইসলামের কিছুই বুঝা যাবে না। অবশ্য তার আগে তা অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে। এ ব্যাপারে ইসলাম বা ঈমানদার মুসলিম অসাধারণ ধৈর্যশীল ও ধূর্ত। সব অন্যায়কারী ও আগ্রাসী যুদ্ধবাজের মত ইসলামের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে প্রতারণা ও মিথ্যাচার। ইসলামের সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারের জন্য ইসলামে এটা ‘তাকিয়া’ হিসাবে অভিহিত একটি বৈধ পন্থা।

যুদ্ধের বিকল্প হিসাবে ইসলাম শান্তিকেও রাখে। এবং তা সর্বক্ষণ এবং সর্বত্রই নিজেকে শান্তির ধর্ম হিসাবে দাবী করে। তবে এই শান্তির শর্ত হচ্ছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। এটা বাস্তবে তার ধর্মের নিকট, তার রাজনৈতিক শাসন বা আধিপত্যের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, যেটার মর্ম হচ্ছে একনায়কী আরব আধিপত্যের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। প্রথমে এটা ছিল মুহাম্মদের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। তার মৃত্যুর পরবর্তীকালে এটা হয়ে দাঁড়ায় ঐতিহ্য সূত্রে তার উত্তরাধিকারী শাসকদের নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। তাতে সাড়া না দিলে আসবে যুদ্ধ অথবা বলপ্রয়োগ। তবে হ্যাঁ, তখন এই যুদ্ধের এবং ইসলামীকরণের অংশ হিসাবে থাকবে কপটতা, মিথ্যা, প্রতারণা, ভণ্ডামি, হত্যা, ধর্ষণ*, ‘মালে গণীমত’ সৃষ্টির জন্য লুণ্ঠন এবং যাবতীয় নৃশংসতা। আমার এই বক্তব্যের সপক্ষে সাক্ষ্যদানে যে কুরআন, হাদীস এবং ইসলামের আদি ইতিহাস অকৃপণ তা কুরআন-হাদীস ও ইসলামের ইতিহাসের যে কোনও মনোযোগী পাঠক জানেন।

---------------------------------------------
* যুদ্ধে বন্দী অথবা ক্রয়সূত্রে প্রাপ্ত নারী ধর্ষণ কুরআন তথা ইসলামে বৈধ। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না’ (২৩:৫-৬)। ‘ইহার পর, তোমার জন্য কোন নারী বৈধ নহে এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নহে যদিও উহাদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করে। তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে’ (৩৩:৫২)। ‘এবং যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, তাহাদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না’ (৭০:২৯-৩০)। যুদ্ধবন্দিনীরাও অধিকারভুক্ত দাসী। কাজেই বুঝাই যায় ইসলাম নারীর জন্য কী বিধান দিয়েছে!
---------------------------------------------


৬। যুদ্ধ ও সন্ত্রাস

সভ্যতার সঙ্কটের যে পটভূমিতে ইসলামের বর্বরতার উত্থান সম্ভব হয়েছিল সেটা বহুশতাব্দী যাবত প্রযোজ্য না হলেও এবং ইউরোপে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী কাল থেকে রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে মানুষ সভ্যতার নবদিগন্তের পথে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামী পৃথিবীতে ইসলামের কৃষ্ণ অধ্যায় আজও দোর্দণ্ড প্রতাপে বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে মুসলিমরা এখন দেউলিয়া। বহুকাল ধরে তারা সাধারণভাবে পাশ্চাত্যের তাবেদার বা অধীনস্থ হিসাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য কলঙ্কের দৃষ্টান্ত হিসাবে যেন মুসলিমরা টিকে আছে। আধুনিক সভ্যতার এই যুগেও ইসলাম ও মুসলিমরা নিজ সমাজে বর্বরতার চর্চা যে অব্যাহত রেখেছে তাই নয়, উপরন্তু সুযোগমত সমগ্র পৃথিবীর দেশে দেশে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও জিহাদের উপদ্রব ঘটিয়ে চলেছে।

সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্যের অধীনস্থতা সত্ত্বেও ইসলামের উপদ্রবের শক্তি এখন পর্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে নাই। অবশ্য বিশ্ব রাজনীতির জটিলতা, মুসলিম রাষ্ট্র বা সমাজগুলিকে নিজেদের স্বার্থে বৃহৎ অমুসলিম শক্তিগুলির ব্যবহারের প্রয়োজন এবং অমুসলিম বৃহৎ শক্তিবর্গের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপড়েন ইসলামকে কার্যকরভাবে আঘাত করা থেকে আজ অবধি বিরত রেখেছে। এর ফলে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে অসঙ্গতিপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক হলেও ইসলাম আজ অবধি ধর্ম হিসাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

আসলে ইসলাম ধর্মের শক্তির একটি বড় জায়গা হচ্ছে এটাকে একটা যুদ্ধবাজ রাজনীতি হিসাবে চিনতে না পারা। চিরকালই খাঁটি মুসলিমরা ধর্মের আড়ালে নিজেদের সহিংস, খুনী, নারী নিগ্রহী, নারী ধর্ষণবাদী ও নারী সম্ভোগবাদী, লুঠেরা এবং একাধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষকে ঢেকে রেখে পৃথিবীর সকল অমুসলিমকে ধাপ্পা দিতে পেরেছে। সম্পূর্ণরূপে বৈষয়িক ভোগলিপ্সা ও লালসাকে ধর্মের আবরণে রাখার কারণে ইসলাম হয়েছে আশ্চর্য রকম স্ববিরোধ ও ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘তোমাদিগকে যাহা কিছু দেওয়া হইয়াছে তাহা তো পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা এবং যাহা আল্লাহর নিকট দেওয়া আছে তাহা উত্তম এবং স্থায়ী। তোমরা কি অনুধাবন করিবে না?’ (২৮:৬০) ‘এই জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নহে। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি উহারা জানিত।’(২৯:৬৪) সুতরাং বস্তুজগৎ বা জীবন নয়, বরং মৃত্যুই প্রকৃত জীবন।

কুরআনে এভাবে এ জীবনের প্রতি তুচ্ছতাচ্ছিল্য অনেক বার প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ মুসলিমদেরকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে শুধু যে মৃত্যুপরবর্তী জীবনে তথা ইসলামী স্বর্গে স্থূল ভোগ-সম্ভোগের চিত্র দ্বারা তা-ই নয়, অধিকন্তু বস্তুজীবনেও ভোগের উপকরণ সরবরাহ দ্বারা। যুদ্ধের মাধ্যমে লুণ্ঠিত ‘মালে গণীমত’-এর বন্দোবস্ত, দাস-দাসী সরবরাহ এবং অগণন লুণ্ঠিত নারী কিংবা দাসী ধর্ষণ ও সম্ভোগের এমন বন্দোবস্ত আর কোন্ ধর্ম দিতে পেরেছে?

কুরআনে মালে গণীমতের লুটের লোভের চিত্র দেখিয়ে মুসলিমদেরকে কীভাবে প্রলোভিত করা হয়েছিল তা তুলে ধরার জন্য এখানে আমি দুইটি সূরা থেকে মাত্র কয়েকটি আয়াত ও আয়াতের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি, ‘যুদ্ধে যাহা তোমরা লাভ করিয়াছ তাহা বৈধ ও উত্তম বলিয়া ভোগ কর এবং আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’ (৮:৬৯)। এবং ‘আল্লাহ্ তো মুমিনগণের উপর সন্তুষ্ট হইলেন .... তাহাদিগকে তিনি দান করিলেন প্রশান্তি এবং তাহাদিগকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয় ও বিপুল পরিমাণ যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ, যাহা উহারা হস্তগত করিবে; আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ্ তোমাদিগকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের যাহার অধিকারী হইবে তোমরা। .... এবং আরও রহিয়াছে যাহা এখনও তোমাদের অধিকারে আসে নাই, উহা তো আল্লাহ্ আয়ত্তে রাখিয়াছেন’ (৪৮:১৮-২১), ইত্যাদি।

মুহাম্মদ নিজেও কি ভোগ-সম্ভোগে কম? মোল্লারা মুহাম্মদের শুদ্ধাচারী, সংযত এবং দরিদ্র জীবনের যে সব গল্প হরহামেশা করে বেড়ায় তার সঙ্গে মুহাম্মদের বাস্তব জীবনের কোনও সম্পর্কই যে নাই কুরআন-হাদীসসহ তার জীবনীর বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান সেই সিদ্ধান্ত নিবার জন্য যথেষ্ট। ইসলামী ধর্মবেত্তাদের এই সকল প্রচারও মুহাম্মদ ও ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী ‘তাকিয়া’ তথা ইসলামী মিথ্যা প্রচার ও ধাপ্পার অংশ মাত্র।

যে ব্যক্তি পঞ্চাশ বৎসর বয়সে ছয় বৎসর বয়সের এক অবোধ বালিকাকে বিয়ে করতে পারে, যে ব্যক্তি একজন ধর্মপ্রবর্তক বা ধর্মনেতা হওয়া সত্ত্বেও বহু নারীকে শুধু বিয়ে নয়, উপরন্তু যুদ্ধে লব্ধ নারীকে ধর্ষণ করতে পারে (রাইহানা ও সাফিয়ার দৃষ্টান্ত উল্লেখ্য।) এবং তার অনুচরদেরকেও যুদ্ধে বন্দী অসহায় নারীদেরকে ধর্মের নামে ধর্ষণের বৈধতা দিতে পারে, যে ব্যক্তি শুধু মতের ভিন্নতার জন্য অপরের সম্পদ ও সম্পত্তি আল্লাহ্ ও ধর্মের নামে আত্মসাৎ করে বিপুল অর্থ-বিত্ত ও সম্পদের মালিক হতে পারে (যুদ্ধলব্ধ লুণ্ঠিত ‘মালে গণীমতের’ ২০%) এবং যে ব্যক্তি অন্ধভাবে তার এবং তার ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও অধীনতা স্বীকার না করার কারণে হাজার হাজার মানুষের জীবন ও সংসার-পরিবার ধ্বংস করতে পারে তার সংযত ও শুদ্ধ জীবনের কাহিনী প্রচারের মত হাস্যকর মিথ্যা প্রচার আর কী হতে পারে?  

বস্তুত মুহাম্মদকে বুঝলে শুধু ইসলামকে নয়, উপরন্তু খাঁটি মুসলিমকেও বুঝা যায়। আমি সব মুসলিমকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলছি না। অনেক মুসলিম আছে যাদের মধ্যে অনেক মানবিক গুণাবলী আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকে যেমন প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে অচেতন তেমন ইসলামের অনেক বৈশিষ্ট্য ও নিয়ম বাস্তব জীবনে মেনেও চলে না। এরা খঁটি মুসলিম নয়। খাঁটি মুসলিম শুধু নামায-রোযা অনুশীলন করে না, সে ইসলামের জীবনাচরণ অনুসরণ করতে গিয়ে ইসলামের তাকিয়ারও আশ্রয় সতত নিয়ে থাকে। কারণ মুহাম্মদ মুসলিমদের আদর্শ, যাকে অনুসরণ করাও মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘তোমাদিগের মধ্যে যাহারা আল্লাহ্ ও আখিরাতকে (পরকালকে) ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাহাদিগের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ।’ (৩৩:২১)। সেই রাসূলুল্লাহ্ বা মুহাম্মদের চরিত্র কেমন তা তো ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এমন যে কোনও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষেরই জানা আছে।

মুহাম্মদ আসলে কী রূপ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তা বুঝার জন্য হাদীস এবং তার জীবনীকারদের বহু বিবরণ উল্লেখ করা যায়। তবে এখানে আমি একটা মাত্র বিবরণ উল্লেখ করব যেটা মুহাম্মদের স্বরূপ বুঝার জন্য কিছুটা সহায়ক হতে পারে। এটি আবু দাউদ শরীফের একটি হাদীস যা আমি উদ্ধৃত করছি :

‘আবু তাওবা ... সহল ইবন হানযালিয়্যা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরা হুনায়নের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে সফরে ছিলেন। তখন দ্রুতগতিতে উট চালিয়ে সন্ধ্যাকালে মাগরিবের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এমন সময় একজন অশ্বারোহী সৈনিক এসে তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাদের নিকট হতে আলাদা হয়ে ঐ সকল পাহাড়ের উপর আরোহণ করে দেখতে পেলাম যে, হাওয়াযিন গোত্রের স্ত্রী-পুরুষ সকলেই তাদের উট, বকরী সবকিছু নিয়ে হুনায়নে একত্রিত হয়েছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ঐ সকল বস্তু আল্লাহ্ চাহেত আগামীকাল মুসলিমদের গণীমতের সামগ্রীতে পরিণত হবে।’ (আবু দাউদ শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং- ২৪৯৩)

এ যেন একজন ডাকাত সর্দার এবং তার সঙ্গীদের মধ্যকার সংলাপ। এই রকম লোকের যারা গুণগান গেয়ে বেড়ানোটাকে তাদের পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে তারা যে তার তাকিয়ারও চর্চাকারী তা কি বলে দিতে হবে?

ইসলাম ও মুহাম্মদের প্রশস্তি করার সময় ইসলামের সার্বক্ষণিক প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনকারী মোল্লারা সর্বদা সেই তাকিয়া অনুসরণ করে থাকে। আমি মোল্লাদের এমন বহু বক্তৃতা বা ওয়াজ শুনেছি যেখানে মুহাম্মদের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন সব বয়ান দেওয়া হয় যেগুলির সঙ্গে কুরআন বা হাদীসের বিন্দু মাত্র সম্পর্ক নাই। অর্থাৎ এগুলি সম্পূর্ণ বানোয়াট। যে সব জ্ঞাত ব্যক্তি বুঝেন যে এগুলি মিথ্যা তারাও তাকিয়ার সমর্থক হিসাবে চুপ করে থাকেন অথবা মুসলিম জনগণ বা পাবলিকের ভয়ে বা ঝামেলা এড়াতে চেয়ে চুপ করে থাকেন।

আসলে ইসলামের মূল একটি ভিত্তি হচ্ছে জেনে বুঝে মিথ্যাচার এবং প্রতারণা, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য মোটেই অলৌকিক বা অবস্তুগত নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে লৌকিক এবং বস্তুগত। এই লৌকিক এবং বস্তুগত উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মুহাম্মদ খুব সচেতনভাবে মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে তার হাতিয়ার করেছিলেন। এবং সেটা করেছিলেন খুব সফলভাবে। এটা বুঝলে ইসলাম যে একটা যুদ্ধবাজ, বহুনারীলিপ্সু-ধর্ষক-সম্ভোগী ও একনায়কী সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিকে আড়াল দিবার জন্য ধর্মের আবরণ নিয়েছে সেই সত্যও দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায়। মুহাম্মদের ক্ষমতালিপ্সা, নারীলিপ্সা (শুধু নারী সম্ভোগলিপ্সা নয়, অধিকন্তু নারী ধর্ষণলিপ্সাও), সম্পদলিপ্সা ও আনুগত্যলিপ্সাকে সর্বোচ্চ পরিমাণে বৈধতা দিবার হাতিয়ার হয়েছে মানুষের যুক্তি-প্রমাণহীন অন্ধ ধর্মবিশ্বাস। তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তিনি ধর্মকে তার ইচ্ছামত ব্যবহার করেছেন। আল্লাহর নামে ইচ্ছামত আয়াত বা বাণী হাজির করেছেন যেগুলি অনেক ক্ষেত্রে একটি অপরটির সঙ্গে বিস্ময়করভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ শুধু নয় বরং বিরোধাত্মক। খুব বেশী সমস্যা হলে তিনি কুরআনের পুরাতন বাণী বাতিল করে নূতন বাণী উপস্থিত করতেন। এ সম্পর্কে কুরআনেও বলা আছে। তাতে তার কোনও সমস্যা হত না। সবই তিনি করতেন আল্লাহ্ বা ইসলামী ঈশ্বরের নামে। কুরআনের ২ নং সূরা বাকারার ১০৬ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘আমি কোন আয়াত রহিত করিলে কিংবা বিস্মৃত হইতে দিলে তাহা হইতে উত্তম কিংবা তাহার সমতুল্য কোন আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ্ই সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ কিংবা কুরআনের ১৬ নং সূরা নাহলের ১০১ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘আমি যখন এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি  ̶  আল্লাহ্ যাহা অবতীর্ণ করেন তাহা তিনিই ভাল জানেন, তখন তাহারা বলে, “তুমি তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবনকারী” কিন্তু উহাদের অধিকাংশই জানে না।’

এই রকম একটি স্ববিরোধী, গোঁজামিলে পরিপূর্ণ, লুণ্ঠনবাদী, ধর্ষবাদী এবং নৃশংস ও যুদ্ধবাজ ধর্মের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল চরম পশ্চাৎপদ, যুদ্ধবাজ এবং লুণ্ঠনপরায়ণ একটি সমাজের ভিতরে তার সমর্থক গোষ্ঠী এবং যোদ্ধা বাহিনী তৈরী করতে পারায়। সেটা হচ্ছে যাযাবর পশুচারী ও মরুচারী আরব বেদুইন সমাজ বা জনগোষ্ঠী। এ নিয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। তবে এখানে খুব সংক্ষেপে আমি যে কথা বলব সেটা হচ্ছে ইসলামের প্রধান সামাজিক ভিত্তি হিসাবে বেদুইন উপজাতিসমূহকে চিনতে পারলে ইসলামের মূল সমস্যা এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ বুঝা অনেকখানি সহজ হতে পারে। ফলে সমাধানের পথ পাওয়াও সহজতর হতে পারে।*

---------------------------------------------
* ইসলামের আবির্ভাব কালে সভ্যতার অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে বিশ্ব পরিস্থিতি এবং এই ধর্মের উত্থান বা প্রসারে বেদুইনদের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমি আমার লিখা ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’ এবং ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’ নামক গ্রন্থ দুইটিতে আলোচনা করেছি। গ্রন্থ দুইটির প্রকাশক : ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা। এগুলি ‘বঙ্গরাষ্ট্রের’ ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ’-এ দেওয়া আছে।
---------------------------------------------

আমাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে তৎকালীন আরবের পরিপ্রেক্ষিতে মক্কার কুরাইশরা ছিল একটি উন্নত উপজাতি। তৎকালীন আরবের সবচেয়ে সম্মানজনক এবং প্রধান ধর্মমন্দির কাবা গৃহের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসাবে যে তারা আরবের সবচেয়ে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত উপজাতি ছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্য পরিচালনাকারী বণিক সম্প্রদায় হিসাবেও তারা ছিল সম্পদ এবং সেই সঙ্গে সামাজিক মর্যাদার অধিকারী। ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা যে উদার ও সহিষ্ণু ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে প্রথমত, কাবাগৃহকে আরবের সকল ধর্মবিশ্বাসী উপজাতিসমূহের মিলনকেন্দ্রে পরিণত করা।  

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধপ্রবণ বেদুইন উপজাতিগুলিকে বৎসরের চার মাস যুদ্ধ থেকে বিরত রাখা। এই চার মাস ছিল প্রাক-ইসলামী যুগে যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মাস, যা পৌত্তলিক এবং উপজাতীয় আরবরা মেনে চলত। বস্তুত এই প্রথা বা নিয়ম মুহাম্মদ প্রথম লঙ্ঘন করেন এবং ইসলামকে নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধের ধর্মে পরিণত করেন। অর্থাৎ মুহাম্মদের কল্যাণে যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মাস হিসাবে শান্তির চার মাস আর থাকল না। কী চমৎকার শান্তির ধর্ম!

তৃতীয়ত, পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে শুধু মক্কায় নয়, অধিকন্তু খোদ কাবাগৃহে দাঁড়িয়ে প্রচার করার পরও মক্কায় মুহাম্মদকে ১৩ বৎসর সহ্য করা। এই তেরো বৎসর মুহাম্মদের প্রতি সকল বিরোধিতা সত্ত্বেও তাকে হত্যা করা হয় নাই। আজ কেউ কাবাগৃহে গিয়ে মুহাম্মদ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে দেখুক তো! তা হলেই বুঝা যাবে তার কী অবস্থা করে ‘শান্তির ধর্মের’ অনুসারীরা!

যাইহোক, মক্কায় ইসলাম প্রচারে তেরো বৎসর মুহাম্মদের অনুসারী সংখ্যা এক থেকে দেড় শতের অধিক হয় নাই। তৎকালীন আরবের প্রেক্ষিতে উন্নত ও সমৃদ্ধ নগর মক্কা থেকে একটি ক্ষুদ্র ও পশ্চাৎপদ বসতি মদীনায় আশ্রয় পাবার পর মুহাম্মদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়। সেখানে তিনি পশ্চাৎপদ ও তুলনায় দরিদ্র আরব এবং বিশেষ করে বেদুইনদের সাহায্য ও সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হন। কুরাইশদের বাণিজ্য বহরসমূহের উপর নিয়মিত আক্রমণ ও লুন্ঠন অভিযানসমূহ দিয়ে যুদ্ধ ও লুণ্ঠনের ধর্ম প্রতিষ্ঠার পথে তার যাত্রা শুরু হয়।

তার হাতিয়ার ছিল পশ্চাৎপদ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ প্রিয় মানুষরা। মক্কার স্থিতিশীল জীবনের অধিকারী, সভ্য ও শিক্ষিত কুরাইশদের মধ্যে এবং কুরাইশদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত মক্কার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের উপজাতি ও জনগোষ্ঠী সমূহের মধ্যে যে সমর্থন লাভে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন মদীনা ও তার আশপাশের বর্বর, পশ্চাৎপদ ও দরিদ্র উপজাতিসমূহ বিশেষত পশুচারী ও যাযাবর বেদুইন উপজাতিসমূহের মধ্যে তিনি সহজেই সেই সমর্থন লাভে সমর্থ হন। তার ধর্মের অনুসারী হলেই পরলোকে লাভ ও ভোগের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে থাকল এ জীবনেই নগদ লাভ ও ভোগের চাহিদা পূরণের অভূতপূর্ব সুযোগ। পরলোকের বাকীর লাভের তুলনায় এর আকর্ষণ হল অপ্রতিরোধ্য। লুঠ বা ডাকাতির মাধ্যমে নগদ লাভ এবং নারী ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়ার মত এমন ধর্ম আর কয়টা আছে?

সুতরাং ধর্মের নামে লুণ্ঠন ও নারী-ধর্ষণের এমন সুযোগের সদ্ব্যবহারে দলে দলে আরবের মরুচারী ও পশুচারী যাযাবর বেদুইনরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুহাম্মদের অনুসারী হল। সবাই স্বেচ্ছায় অনুসারী হল এমন নয়। যারা প্রথমে স্বেচ্ছায় অনুসারী হয় নাই তাদের উপর হামলা হয়েছে। তাদেরকে হত্যা অথবা বন্দী করা হয়েছে। বন্দী করে বাধ্যতামূলকভাবে মুসলিম করা হয়েছে। যারা ধর্মান্তরিত হয় নাই তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। মুসলিম করার পরেও দাস করা হয়েছে। আবার ইচ্ছামত মুক্তও করা হয়েছে। এ হল একদিক। এটা পুরুষদের দিক। অন্যদিক হল নারীদের দিক। সেটা হচ্ছে ধর্ষণের পাইকারী চর্চার দিক। সাধারণ নিয়মে যে কোনও বয়সের প্রতিটি সঙ্গমযোগ্য তথা ধর্ষণযোগ্য নারীকে গণীমতের মাল বা সামগ্রী হিসাবে ধর্ষণ করা হয়েছে। এর পর তাদের সবাইকে ইচ্ছামত দাসী হিসাবে ব্যবহার এবং বাজারে বিক্রী করা হয়েছে। সেই সঙ্গে শিশুদেরকেও দাস-দাসী হিসাবে বিক্রী করা হয়েছে।

এভাবে প্রতিটি বিজয়ী অভিযান ভিন্ন ধর্মের উপজাতি বা জনগোষ্ঠীর সম্পদ, সম্পত্তি এবং দাস-দাসীদের মালিকানা লাভের সুযোগ এনে দিয়েছে। এখানেই কিন্তু শেষ নয়। প্রতিটি বিজয় অভিযান শুধু সম্পদ-সম্পত্তি এবং দাস-দাসীর মালিকানা এনে যে দিত তা-ই নয়, অধিকন্তু প্রতিটি অভিযানের সাফল্য মুসলিম যোদ্ধা বাহিনীর সংখ্যাও বৃদ্ধি করত। কারণ বাধ্যতামূলকভাবে ইসলাম গ্রহণের পর সক্ষম পুরুষদেরকে পরবর্তী আক্রমণ অভিযানগুলিতে যোগ দিতে হত। জিহাদে যোগ দেওয়াও ছিল সক্ষম মুসলিম পুরুষদের জন্য অবশ্য পালনীয় ঈমানী দায়িত্ব। তাছাড়া এই ঈমানী দায়িত্ব পালনের পর যে লুণ্ঠন ও ধর্ষণের সুযোগ লাভ করা যায় তা দিয়ে নিজেদের পূর্বের ক্ষতিকে অনেকাংশে পুষিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ লাভ পশ্চাৎপদ ও পশুপ্রায় চেতনা সম্পন্ন পুরুষ মানুষদের জন্য কম পাওয়া নয়। এভাবে হত্যা, লুণ্ঠন, নারী-ধর্ষণ ও দাসকরণের যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটা উপজাতি আসত সেই একই অভিজ্ঞতা তারা অন্যদের উপরও প্রয়োগ করত। ইসলামের প্রসারের সঙ্গে এই চক্রাকার প্রক্রিয়া প্রথমে আরব উপদ্বীপে এবং এরপর সারা পৃথিবীতে ইসলাম যেখানে সফলভাবে গেছে সেখানেই সম্প্রসারিত হয়েছে।
 

৭। মুসলিমের মন ও মনন

ইসলাম ও মুসলিম সমাজের সমস্যা বুঝবার জন্য মুসলিম সমাজের গড় চেতনার মান বুঝাটা অত্যাবশ্যক। আর সেটা বুঝতে হলে মুহাম্মদের অনুসারী যারা হয়েছিল তাদেরকে আগে বুঝতে হবে। আগেই বলেছি যে আরবের স্থিতিশীল এবং তুলনামূলকভাবে সভ্য সমাজ কুরাইশদের ভিতর থেকে প্রথম পর্যায়ে মুহাম্মদের অনুসারী খুব সামান্য কয়জন হয়েছিল। এমনকি মক্কার কিংবা মক্কার আশপাশের অকুরাইশ অধিবাসীদের মধ্যেও মুসলিমদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কুরাইশরা মুসলিম হয় প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ কর্তৃক ৬৩০ খ্রীষ্টাব্দে মক্কা জয়ের পর। ইসলামে এই দীক্ষিতকরণও যে মোটেই শান্তিপূর্ণ এবং স্বেচ্ছামূলক ছিল না সেটা ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি পাঠকের জানবার কথা। এমনকি মক্কাজয়ের পর কুরাইশদের প্রধান নেতা এবং মুহাম্মদের আপন এক শ্বশুর আবু সুফিয়ানেরও (মুহাম্মদের অন্যতম স্ত্রী রামলা বিনতে আবি সুফিয়ান, যিনি উম্মে হাবিবা নামে সমধিক পরিচিত, তার পিতা) বেঁচে থাকার শর্ত ছিল বাধ্যতামূলকভাবে ইসলাম গ্রহণ। মুহাম্মদের মক্কা জয়ের প্রধান শক্তি ছিল বেদুইন উপজাতিগুলি নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনী। বস্তুত সভ্য সমাজ বহির্ভূত বিচরণশীল ‍এবং মূলত পশুপালন-নির্ভর এই অশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ, অসভ্য, বর্বর, লুণ্ঠনপ্রিয় ও ধর্ষণকামী বেদুইনরাই যে ছিল ইসলামের মেরুদণ্ড ও মূল ভিত্তি এবং ইসলামের মূল শক্তি সেটা বুঝলে ইসলাম এবং সেই সঙ্গে মুসলিম মানসের অনেক রহস্যই উন্মোচিত হবে।

সুতরাং এখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজা যাক যারা ইসলামের মেরুদণ্ড গঠন করেছিল তাদের মন ও মনন কেমন ছিল সেটা। এ সম্পর্কে অনেক আলোচনা করা যায়। তবে বেশী আলোচনা না করে বুখারী শরীফের দুইটি হাদীস থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করাই যথেষ্ট হতে পারে। একটি হাদীসে আমরা পাই, ‘তিনি পানি ভরে একটি পাত্র আনতে বললেন। (পানি আনা হল।) তিনি এর মধ্যে নিজের উভয় হাত ও মুখমণ্ডল ধুয়ে কুল্লি করলেন। তারপর (আবু মূসা ও বিলাল {রা}-কে) বললেন, তোমরা উভয়ে এ থেকে পান করো এবং নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকে ছিটিয়ে দাও। আর সুসংবাদ গ্রহণ করো। তাঁরা উভয়ে পাত্র তুলে নিয়ে যথা নির্দেশ কাজ করলেন।’*

এই যথা নির্দেশ মানে হল উভয়ে মুহাম্মদের হাত ও মুখ ধোয়া এবং কুল্লি করা পানি নিজেরা পান করল এবং নিজেদের মুখে ও বুকে ছিটিয়ে নিল। এটা প্রকান্তরে মুহাম্মদের থুতু খাওয়া এবং মুখে-বুকে মাখা। আর একটা হাদীস থেকে মুহাম্মদের শিষ্যদের আচরণ সম্পর্কে আমরা কিছু ধারণা করতে পারি, ‘রসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামের থুথু বা শ্লেষ্মা মাটিতে পতিত হইতে পারিত না, বরং উহা ছাহাবীগণ নিজ হস্তে লইয়া লইতেন এবং তৎক্ষণাৎ স্বীয় চেহারা ও শরীরে মাখিয়া ফেলিতেন।’**

---------------------------------------------
* বুখারী শরীফ (সপ্তম খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ মে ২০০১, পৃষ্ঠা- ১৬৮।

** বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), তৃতীয় খণ্ড, অনুবাদ : মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, একাদশ সংস্করণ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ২১০।
---------------------------------------------

অর্থাৎ বুখারী শরীফের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস থেকে মুহাম্মদের সহচর ও  অনুসারীদের যে ধরনে মন-মানসিকতা ও রুচির পরিচয় পাই তা থেকে ইসলামের মূল ভিত্তি যারা নির্মাণ করেছিল তাদেরকে সভ্য মানুষ হিসাবে গণ্য করার কোনও কারণই খুঁজে পাওয়া যায় না। মুহাম্মদের থুথু খাওয়া এবং মুখে ও শরীরে মুহাম্মদের থুথু, কফ-কাশি ও সর্দি মাখা মানুষরাই কিন্তু ইসলামের বীর সিপাহী এবং পতাকাবাহী। এদের এই নিকৃষ্ট চেতনার উত্তরাধিকারীই হল চৌদ্দশত বৎসর ধরে সারা পৃথিবীর মুসলিম উম্মা। মুহাম্মদ নিজেও হয়ত তার থুথু-কফ-শ্লেষ্মা খাওয়া এবং মাখা এই লোকগুলিকে মনুষ্য পদবাচ্য মনে করতেন না এবং মনের ভিতরে নিকৃষ্ট পর্যায়ের জীব হিসাবে ঘৃণা করতেন। কিংবা হয়ত নিজে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত মানুষ হিসাবে তার উম্মত বা অনুসারীদের এই নিকৃষ্টতাকে উপভোগও করতেন। যেটাই করুন এটা কিন্তু মানুষ হিসাবে মুহাম্মদের মান বা স্ট্যান্ডার্ডটাকেও সভ্য এবং বিবেকবান মানুষের নিকট তুলে ধরে।

তবু এটাই বুঝতে হবে যে মুহাম্মদ নিজের স্বার্থে এদেরকে এই স্তরে যেমন নামিয়েছিলেন তেমন এদেরকে এই নিকৃষ্টতার পর্যায়ে ধরেও রেখেছিলেন তার আধিপত্যের স্বার্থে। তাদের ধর্মীয় অন্ধত্ব ছিল তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। এদের অন্ধত্বকে ব্যবহার করেই তিনি শুধু ধর্ম তথা ধর্মভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন নাই উপরন্তু ধর্মভিত্তিক একটা রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করলেন, যে সমাজ ও রাষ্ট্র হল যুদ্ধবাজ, লুণ্ঠনকারী, নারী নিগ্রহী, নারী ধর্ষণকারী, দাসকরণকারী ও দাসব্যবসায়ী এবং সাম্রাজ্যবাদী।

শুধু তাই নয়, এই সমাজ ও রাষ্ট্রটি হল সর্বাত্মক দাসত্বের চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে যে স্বাধীন মানুষকে দাস করা হয়েছে তা-ই নয়, উপরন্তু গোটা ধর্মটাই প্রতিষ্ঠিত আল্লাহর দাস বা বান্দা হিসাবে মানুষের সর্বাত্মক দাসত্বের ধারণার উপর। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যে দয়াময়ের নিকট বান্দারূপে উপস্থিত হইবে না (১৯:৯৩)। তাছাড়া কুরআন ৫১:৫৬-তে এ কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তার দাসত্ব করার জন্যই মানুষ এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন।

যাইহোক, যুদ্ধজয়ের পর সর্বদা সবাইকে দাস করা হয়েছে তা যেমন সত্য নয় তেমন সবাইকে সর্বদা দাস করে রাখা হয়েছে ব্যাপারটা তেমনও নয়। আর এত দাস দিয়ে কী করা হবে? ব্যক্তিমালিকানায় দাস-দাসী করে রাখলে তাদেরকে খাওয়াতে পরাতেও তো হবে! সেটা কি সম্ভব? আর আরবদের পশ্চাৎপদ অর্থনীতিতে কোন্ কাজে এত বেশী সংখ্যক মানুষকে নিয়োজিত করা সম্ভব? বাজারে দাসের চাহিদাও তো থাকতে হবে। সুতরাং দাস-দাসীদের অনেককে পণবন্দীর বিনিময়ে হোক আর বিজয়ীদের ইচ্ছায় হোক মুক্ত করা হয়েছে। বাস্তবতার চাপে তাই ইসলামে দাসদের মুক্তিতে উৎসাহও দেওয়া হয়েছে।  

তবে ইসলাম তথা মুহাম্মদের দাসত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতির জন্য দাস-দাসী করে এবং নারীদেরকে ধর্ষণ করে তাদের মানসিক মেরুদণ্ড যে আগেই ভেঙ্গে ফেলা হয় সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। কাজেই একদিকে দাসকরণ এবং অপর দিকে ইচ্ছা মতো কিছু করে দাস-দাসী মুক্তিদানের মধ্যে ইসলামের মহত্ত্ব খুঁজে লাভ নাই। ইসলাম দাসত্বের চর্চা যেমন করেছে তেমন আল্লাহর দাসত্বের নামে মুসলিমদের মধ্যে দাসত্বের চেতনা ও সংস্কৃতির সর্বাত্মক প্রসার ঘটিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম সামাজিক দাসত্বের এমন এক ধর্ম যেখানে কেউই আর স্বাধীন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকে না। বিশেষত চেতনার জগতে প্রতিটি মানুষই দাস - কেউ ছোট দাস, দাসের দাস, কেউ বড় দাস, দাসদের সর্দার দাস। এভাবে ইসলামে স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন কোনও মানুষেরই অস্তিত্ব সম্ভব নয়। আল্লাহর দাসত্বের নামে প্রত্যেক পুরুষ ও নারী সমাজের বিশেষ ব্যবস্থার দাস ও দাসী অর্থাৎ বান্দা ও বান্দী। সুতরাং মানুষের চিরন্তন দাসত্বের ধর্ম ইসলামে মানুষের গড় চেতনার মান কী হতে পারে তা সহজেই বোধগম্য।

এই রকম এক সমাজে যত নীচে যাওয়া যায় সাধারণ মানুষের চেতনার মান তত নীচু হয়। এর মানে এই নয় নীচের দিকের সব মানুষের চেতনার মান নীচু বা নিকৃষ্ট হয়। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী অমুসলিম সমাজের সংস্কৃতির প্রভাব কাজ করতে পারে। কিংবা ধর্মান্তরকরণ ঘটলেও পূর্ববর্তী সমাজ-সংস্কৃতির প্রভাবও কিছুকাল রয়ে যেতে পারে। ফলে মুসলিম জনচেতনার নিকৃষ্টতা বা নিম্নমান অর্জনে কিছু সময় লাগতে পারে। আর আজকের যুগে সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন, কিছু করে আধুনিক শিক্ষার প্রসার, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদির মাধ্যমে নানানভাবে আধুনিক ও উন্নত চেতনা সবচেয়ে নীচের স্তরের মানুষদের মধ্যেও কম-বেশী প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণভাবে মুসলিম সমাজে সাধারণ মানুষের চেতনার মান যে খুব নীচু হয় সে কথা শুধু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদেরকে দিয়ে যে বুঝা যায় তা নয়, অধিকন্তু সমস্ত পৃথিবীর সকল মুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতা থেকেও এই সত্য বুঝা যায়।

এ কথা ভাবা ভুল হবে যে সাধারণ মুসলিম ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খুব জ্ঞাত। বরং ধর্ম সম্পর্কে খুব কম লোকই তেমন কোন জ্ঞান রাখে। ধর্ম পালনেও সবাই যে সমান উৎসাহী তা নয়। কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে যে কোনও সমালোচনা মুসলিম সমাজে যে কোনও ব্যক্তির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। ধর্মের পাহারাদার হিসাবে মোল্লারা এ ক্ষেত্রে অপরিমেয় কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা ভোগ করে। মোল্লারা মূল ইসলামী বিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইসলাম সম্পর্কে যা খুশী তা-ই বয়ান করে বেড়ালেও সাধারণ মুসলিমরা সেগুলিকেই সত্য জ্ঞান করে চলে। একটু আগেই যে কথা বলেছি ধর্মের সব বিধিবিধান সাধারণ মুসলিমরা যে মেনে চলে তাও নয়। কিন্তু না মানার জন্য তাদের ভিতরে পীড়ন বা অপরাধ বোধ কাজ করে। এই অপরাধ বোধ নিয়েই তারা সারা জীবন পার করে। তবে আশা করে বিশ্বাসী মুসলিম হবার কারণে মৃত্যুর পর আল্লাহ তাদের অপরাধ বা পাপ মাফ করে দিবে এবং তাদের জন্য বেহেশ্ত নসীব করবে। আর তারা যে বিশ্বাসী মুসলিম সেটা আল্লাহর কাছে প্রমাণের জন্য শক্তির ভারসাম্য পক্ষে দেখলে তারা ইসলামের যে কোনও বিরোধিতাকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগকে সচরাচর হাত ছাড়া করতে চায় না। কারণ এটাও তাদের জিহাদের অংশ।

জিহাদ হচ্ছে ইসলামের প্রাণশক্তির সবচেয়ে বড় উৎস। সেই জিহাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে যুদ্ধে বিজয়, সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা দ্বারা ইসলাম-বিরোধিতাকারী তথা শত্রুর মনে ত্রাস বা ভয় সৃষ্টি করা। ত্রাস বা ভয় হচ্ছে ইসলামের প্রাণশক্তির এক বড় উৎস। এই ত্রাস বা ভয়কে আতঙ্ক বললে বোধ হয় ইসলামের ত্রাস সঞ্চারী ভাবটা আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। হ্যাঁ, ইসলাম হচ্ছে ত্রাস বা আতঙ্ক সৃষ্টির ধর্ম। ধর্মের নামে এই ত্রাস বা আতঙ্ক সৃষ্টি করে ইসলামী সমাজে সর্বক্ষণ অধীনস্থ জনগণ এবং নারীকে কীভাবে বশীভূত রাখা হয় তা বুঝতে বেশী জ্ঞান লাগে না। ইসলামী সমাজে বাসকারী প্রতিটি মানুষই এই ঘটনার সাক্ষী। যুক্তি নয়, মানবিকতার আবেদন নয়, বরং ভয় বা ত্রাস তথা আতঙ্ক হচ্ছে ইসলামের সংরক্ষণ ও পালনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তবে শুধু ভয় বা ত্রাস নয়। ভয় বা ত্রাসের সঙ্গেই আছে স্থূল বস্তুগত ভোগ-সম্ভোগের প্রলোভন। সেটা শুধু জান্নাতের উচ্ছৃঙ্খল ভোগ-সম্ভোগের কল্পনার মধ্যে সীমিত নয়। বিধর্মী হলে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণের পাইকারি চর্চার মধ্য দিয়ে এই ধর্মের যাত্রাপথ নির্মিত হয়েছে। আসলে ধর্ম হল ছুতা। আসল লক্ষ্য হল অপরের সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণ ও সম্ভোগ। সুতরাং মুসলিম মানসকে বুঝতে হলে ইসলামের আদি যাত্রাপথ নির্মাণে এই পশুপ্রায় চেতনার ভূমিকাকেও বুঝতে হবে।

শুধু পরকালে জান্নাতের ভোগ ও উচ্ছৃযখল লাম্পট্যের কল্পনার মাধ্যমে এদেরকে অনুপ্রাণিত করা হয় না, বরং এ জীবনেই ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে অপরের সম্পদ লুণ্ঠন এবং নারী ধর্ষণের চর্চা প্রতিষ্ঠা দ্বারা এদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে মানবিক গুণাবলীর কিছুই অবশিষ্ট রাখা হয় না। যেটা রাখা হয় সেটা হচ্ছে ধর্মের নামে ভণ্ডামি. প্রতারণা, মিথ্যাচার এবং হিংস্র বর্বরতার অপ্রতিহত চর্চা।

এই সন্ত্রাসী ধর্ম ও সংস্কৃতি দিয়ে কী করে উন্নত মানুষ গড়া যায়? এরা হবে তাদের নবীর সেই থুথু খাওয়া ও থুথু-কফ-সর্দি মুখে-শরীরে মাখা মানুষদের মতোই নিকৃষ্ট চেতনা সম্পন্ন। এদের উপর নির্ভর করে উন্নত কিংবা মানবিক কোনও সমাজ কিংবা রাষ্ট্র গড়া সম্ভব? তাহলেই হয়েছে!

অপরের সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠন করে খাওয়া এবং নারী ধর্ষণকারীদের ধর্ম দিয়ে উন্নত মানুষ গড়ার প্রশ্নই উঠে না। ঘোড়ার পিঠে চেপে ক্ষয়িষ্ণু ‍কিংবা দুর্বল সমাজ ও সভ্যতাগুলিকে আক্রমণ ও ধ্বংস করে বেড়াবার যুগ বহুকাল আগেই শেষ হয়েছে। এখন তারা প্রধানত পাশ্চাত্যের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির কিংবা অন্যান্য অমুসলিম শক্তিশালী রাষ্ট্রের নিকৃষ্ট অনুগ্রহজীবী ও হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এবং তারা পরিণত হয়েছে নিকৃষ্ট শ্রেণীর অপরাধজীবীতে।

অবশ্য অপরাধজীবী তারা চিরকালই। জন্মই তাদের অপরাধের মধ্য দিয়ে। লুণ্ঠন আর ধর্ষণের মধ্য দিয়ে যাদের উত্থান তারা অপরাধজীবী হবে না তো কী হবে? ব্যক্তিগতভাবে সব মুসলিমের কথা আমি বলছি না। ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। তারা হতে পারে একটা ভয়ঙ্কর বর্বরতার ব্যবস্থার অনিচ্ছুক শিকার। কিন্তু সমষ্টি বা সমাজ নয়। কারণ মুসলিম সমাজের উত্থানই হয়েছে নীতি-নৈতিকতা ও মানবিকতার মানদণ্ডে যা কিছু পড়ে সবগুলিকেই পদদলিত করে। চেতনার এই জায়গা থেকে আগে মুসলিমদেরকে সামষ্টিকভাবে বের হতে হবে।

ইসলামের চেতনাধারী জনগণের উপর নির্ভর করে ইসলামী সমাজগুলিতে যারা সমাজ বিপ্লব করতে গেছে প্রায় সর্বত্র তারা বলি হয়ে গেছে। সেটা ইন্দোনেশিয়া হোক, ইরান হোক আর আফগানিস্তান হোক। কমিউনিস্টদের যতই সীমাবদ্ধতা থাক অনুন্নত অথবা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ পৃথিবীর সমাজগুলিকে স্বাধীনভাবে উন্নয়ন ও প্রগতির পথে, শিক্ষার পথে, মানবিকতার পথে, লোকবাদ ও যুক্তিবাদের পথে অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নিবার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অতুলনীয়। কিন্তু মুসলিম পৃথিবীর সর্বত্র তারা ব্যর্থ। যেখানে তারা সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রসর হয়েছে সেখানে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা কিংবা বিদ্যমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণীগুলির অধীনস্থ আমজনতা লেলানো ডালকুত্তার মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং তাদেরকে ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করেছে।

বস্তুত ইসলাম শুধু বিশ্বাসের বিষয় নয়। এটা এক আল্লাহর নামে নিরঙ্কুশভাবে স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ব ও দাসত্বের অধীনে মানুষের চেতনা এবং ফলত জীবনকে অধঃপতিত করার এক ভয়ঙ্কর যন্ত্র। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রটির মূল চাবি ধরা একদিকে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতা বা শাসক এবং অপর দিকে ইসলামের ব্যাখ্যাদাতা এবং সার্বক্ষণিক পরিচালনার দায়িত্ব পালনকারী মোল্লা শ্রেণীর হাতে।

এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে কুরআন ও হাদীসের অনুশাসন পুরাপুরি মেনে চলা আজকের দিনে সম্ভব। এটা মৌলিকভাবে একটা সময় পর্যন্ত অনেকটা মানা হলেও কোনও কালেই পুরাপুরি মানা সম্ভব হয় নাই। ইসলামের ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়। আর আজকের বাস্তবতায় তো বহু কিছইু আর মানা সম্ভব নয়। যেমন প্রাণীর ছবি আঁকা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও আজকের যুগে সেটা পুরাপুরি মেনে চলার পাগলামি কোন রাষ্ট্র বা সমাজের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাহলে পাসপোর্টও নিষিদ্ধ করতে হবে। ফলে মক্কায় বিদেশ থেকে হজ করতে যাওয়াও নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ ছবি ছাড়া পাসপোর্ট অর্থহীন। ছবির কারণে কিংবা ধর্মের বিধিনিষেধের কারণে সিনেমা, টেলিভিশন বন্ধ করে দিতে হবে। এ রকম আরও অনেক ঘটনার বিচার করলে আমরা দেখতে পাব অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে ধর্মের বিধান অমান্য করে চলে। কিন্তু তাতে এটা মনে করলে ভুল করা হবে যে তাতে তারা ধর্মকে অগ্রাহ্য বা অবিশ্বাস করে।

বরং ইসলাম ধর্ম সর্বক্ষণ হয়ে থাকে মানুষের যাবতীয় অপকর্মের এক চমৎকার হাতিয়ার। বিশেষত দুর্বল, নারী এবং অমুসলিমদের উপর যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও নিগ্রহ পরিচালনা করার ক্ষেত্রে ইসলামের মতো সহায়ক ধর্ম পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নাই। নারীদের নির্যাতন, গৃহবন্দী করে রাখা, রাস্তায় বা বাহিরে নানান ছুতায় নারীদের অসম্মান, দরিদ্রদের উপর ধনী ও ক্ষমতাশালীদের স্বেচ্ছাচার এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর যখন তখন হামলা, তাদের সম্পদ-সম্পত্তি লুণ্ঠন ও দখল এবং তাদের নারীদেরকে অপহরণ ও ধর্ষণের মানসিকতা সৃষ্টির জন্য ইসলামের চেয়ে সুবিধাজনক ধর্ম পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নাই।

আসলে এ কথা বুঝলেই ইসলামের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হবে যে, দুর্বলের উপর আক্রমণ, লুণ্ঠন, শাসন, শোষণ এবং নারীকে ইচ্ছামত ভোগ ও সম্ভোগকে ধর্মের নামে বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই মুহাম্মদ ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এবং এ কাজে তার প্রধান হাতিয়ার ছিল আরবের মরুচারী ও যাযাবর পশুপালক এবং বর্বর, ধর্ষক, লুণ্ঠক ও যুদ্ধবাজ বেদুইন। মুসলিমদের মানস অবতলে চৌদ্দশত বৎসর ধরে ধর্মচর্চার মাধ্যমে এই বর্বর বেদুইন মানসকেই লালন করা হচ্ছে। এই বর্বর বেদুইন মানসকে মুহাম্মদের প্রতিনিধি হিসাবে ইসলামের শাসক এবং মোল্লারা লালন ও নিয়ন্ত্রণ যেমন করেছে তেমন একে প্রয়োজন মত ডালকুত্তার মতো বিরুদ্ধ পক্ষের বিরুদ্ধে লেলিয়েও দিয়েছে। সেটা নিজেদের মধ্যেও হতে পারে।

এটা বুঝলে ইসলামের গোপন রহস্য উদ্ঘাটিত হবে বলেই ইসলাম ও তার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ সম্পর্কে কোনও সত্যনিষ্ঠ আলোচনা কিংবা সমালোচনাকে ঈমানদার মুসলিমদের এত ভয়। সেই ভয় থেকেই আসে এই ধরনের আলোচক ও সমালোচকদের প্রতি ঈমানদার মুসলিমদের এত হিংস্র আক্রমণাত্মকতা। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে ইসলাম পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে। ইসলাম এসেছে ত্রাসের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে ইসলামের নবী মুহাম্মদ অকপট। তিনি বলছেন, ‘এক মাসের পথের সুদূর প্রান্তে আমার প্রভাবে ভীতির সঞ্চার দ্বারা আল্লাহ্ তায়ালা আমায় সাহায্য করিয়াছেন।’ (বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, একাদশ সংস্করণ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা-৮৫)। হাদীস পাঠে জানা যায় তার সমালোচকদেরকে কীভাবে গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে তিনি হত্যা করাতেন। তার অপকর্মের সমালোচনা করায় সন্তানকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন এমন নারীকেও তার প্রেরিত ঘাতক ছুরিকাঘাতে হত্যা করে এসে জানালে মুহাম্মদ সন্তোষ প্রকাশ করেন।

আজকের পৃথিবীর দেশে দেশে জিহাদীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি দিলে যে কোনও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষই বুঝবেন কোথা থেকে ঈমানদার বা প্রকৃত বিশ্বাসী মুসলিমরা এই ধরনের কাজে উৎসাহ বা প্রেরণা পায়। সেই জায়গা হচ্ছে কুরআন, হাদীস এবং মুহাম্মদের দৃষ্টান্ত তথা ইসলাম। প্রকৃতপক্ষে আজ এ কথা স্পষ্টভাবে এবং জোরালোভাবে বলতে হবে যে, ইসলাম হচ্ছে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের ধর্ম এবং সংস্কৃতি। মানুষকে ভয়াতুর এবং বিচার-বুদ্ধিহীনভাবে আনুগত্যপরায়ণ করে রাখাই হচ্ছে ইসলামের এক প্রধান কাজ। এর জন্য তার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে কল্পিত আল্লাহর কথা বলে বলপ্রয়োগ, নারী ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যা দ্বারা ত্রাস সৃষ্টি। বস্তুতপক্ষে বিশ্বাসী হৃদয়ের কাছে কোনও অহিংস আবেদন কিংবা যুক্তিনিষ্ঠ কোনও আলোচনা বা বিতর্ক দিয়ে মুহাম্মদ যেমন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন নাই তেমন তার সৃষ্ট ইসলামও চৌদ্দশত বৎসর ধরে সেভাবে টিকে থাকে নাই।

ইসলামের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় উৎসই হত্যা ও সহিংসতা দ্বারা তার ত্রাস সৃষ্টির সক্ষমতা। একবার ইসলামকে যুক্তি ও তথ্য নিষ্ঠ বিচারের সম্মুখীন করলে এর অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। তখন মুহাম্মদ ও ইসলামের যাবতীয় কদর্যতা এবং যে অমানবিকতা ও অপরাধ সেখানে লুকিয়ে আছে তার স্বরূপ মানুষের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হবে। আর এই কারণে বিশ্বাসী মুসলিমরা ধর্মের প্রশ্নে এত হিংস্র। কারণ যে মিথ্যার উপর তারা দাঁড়িয়ে আছে সেটা ধ্বসে পড়বে। এই মিথ্যা বিশ্বাসটুকুকে অবলম্বন করে যাদের জীবন চালিত কিংবা আয়-উন্নতি ও সুখভোগ তারা তো তাদের নবীর পথ অনুসরণ করে এমন সম্ভাবনার উপর সদাই হিংস্র ডালকুত্তার মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইবেই।  


৮। মডারেট ও জিহাদী মুসলিম

আমি আগেই এ কথা বলেছি যে ইসলামে বিশ্বাসী সব মুসলিমই মূলত এক। তাদের মধ্যে মধ্যপন্থী বা মডারেট যারা তারাও অন্তরে জিহাদী। কারণ ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারেই তাদের সন্তোষ। সেটার জন্য প্রয়োজন ও সম্ভব হলে তারা জিহাদে অংশ নিতে পারে সশরীরে অথবা তাতে তাদের সমর্থন জানিয়ে তার জন্য নৈতিক শক্তি যোগাতে পারে। আর জিহাদ শেষে নানানভাবে বিধর্মীদের উপর লুণ্ঠনের সুবিধাভোগী হতে পারে। মনে রাখতে হবে জিহাদ মানে তলোয়ার-বন্দুক নিয়ে শুধু সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযান নয়, বরং বিধর্মী কিংবা বিধর্মী হিসাবে আখ্যায়িত যে কারও উপর হামলাও জিহাদ হতে পারে। মুসলিমের অব্যাহত শুদ্ধি অভিযানের অপর নাম হচ্ছে জিহাদ। এরই এক ‘মারফতী’ ব্যাখ্যা এক দল দেয় এই বলে যে, জিহাদ হচ্ছে অন্তরের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অন্তরের এই অশুভ শক্তিটা কী? এটা হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে যে শক্তি নিজের ভিতরে থাকে সেটা। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যেমন জিহাদ তেমন ইসলাম কায়েম করার জন্য বিধর্মীদের উপর হামলা ও তাদের উৎসাদনও জিহাদ। এ হচ্ছে ইসলাম তথা মুসলিমের এক দিক।

আবার যারা জিহাদী তারাও যুদ্ধ এবং লুণ্ঠন ও ধর্ষণ শেষে মডারেট মুসলিমে পরিণত হতে পারে। কারণ তখন তাদের লুণ্ঠনলব্ধ সম্পদ, সম্পত্তি ও নারী ভোগ ও সম্ভোগের জন্য নির্বিঘ্ন অবকাশ প্রয়োজন। তখন প্রয়োজন হলে তারা কিছু সময়ের জন্য উদার মুসলিমেও পরিণত হবে, নিজেদের প্রয়োজনেই অমুসলিমদেরকে (যদি তখনও কিছু বেঁচে বা টিকে থাকে) কিছু বিষয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও কিছু রক্ষা বা ছাড় দিবে। আবার প্রয়োজন হলে তারা জিহাদী হবে। অথবা পরবর্তী জিহাদীদের জিহাদী কর্মকাণ্ডের সুবিধাভোগী হবে। তবে নিজেরা হবে এখন মডারেট। প্রয়োজন হলে তখন তারা বিদায় হজে মুহাম্মদের সেই শেষ ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে শুনাবে, ‘সাবধান! ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করো না। এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

এটা কি ধর্ম? ধর্ম বললে ধর্ম, প্রতারণা বললে প্রতারণা। ধর্মের আবরণে যুদ্ধবাজ রাজনীতি বললে তা-ই। কিন্তু এটুকু বললেও যথেষ্ট বলা হয় না। এটা প্রকৃতপক্ষে ধর্মের আবরণ দেওয়া যুদ্ধ, লুণ্ঠন, হত্যা, নারী-ধর্ষণ, নির্যাতন ও সন্ত্রাস সৃষ্টির এক রাজনীতি, যাকে এক কথায় বলা খুব কঠিন। তবু এক কথায় বলতে হলে একে বলতে হয় যুদ্ধবাজ রাজনীতি, ধর্মের রূপ বা আবরণ দেওয়ায় যাকে চিনাটা কঠিন হয়।

আসলে ইসলামের মূল কথা হচ্ছে দুর্বলের দুর্বলতা, অসহায়ের অসহায়তা, বোকার বোকামি এবং অন্ধ বিশ্বাস প্রবণের অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে মুহাম্মদ ও তার অনুসারীদের হাতের পুতুলে পরিণত করা। এর জন্য দেওয়া হয়েছে ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আবরণ।

ধর্মের নাম নিয়ে প্রতারণার এমন ধর্ম পৃথিবীতে কি আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে? যে এই মুহূর্তে একজন ধার্মিক মুসলিম পরের মুহূর্তেই সে নারী ধর্ষক হতে পারে। যেমন ধরা যাক যুদ্ধ শেষে শত্রু পুরুষদের হত্যা, লুণ্ঠন ও মালে গণীমতের বণ্টন পর্ব সমাধা করে রাতের বেলায় জিহাদীরা হাতমুখ ধুয়ে ওজু করে মুসল্লি হয়ে নামাযে দাঁড়িয়ে গেল এবং তাদের আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করল। এরপর তারা শরীয়তী সূত্রে প্রাপ্ত লুণ্ঠিত নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সারা রাত্রি ধরে তাদেরকে শরীয়ত সম্মতভাবে ধর্ষণ করে ভোরের দিকে পুনরায় হাতমুখ ধুয়ে, পাকসাফ হয়ে এবং ওযু করে পুনরায় নামাযে দাঁড়িয়ে গেল এবং উপাসনায় মশগুল হয়ে গেল। এই নামাযীদের দেখে তখন কি ধারণা করা যাবে যে সারা রাত্রি ধরে তারা কী উন্মত্ততার সাথে ‘শরীয়তী’ পৈশাচিকতা করেছে অসহায় নারীদের উপর, যাদের স্বজনদের তারা তাদের চোখের সামনে অল্পকিছু সময় পূর্বেই হত্যা করেছে? রোযার মাস হলে এরা এক মাস রোযাও রাখবে। এই ধরনের নামাযী আর রোযাদারদের দেখে কে বলবে যে এদের মূল প্রেরণা হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ? আর এর জন্য তাদের আল্লাহর কাছে এত হাজার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কিংবা শুকরানার নামায আদায় করা?

ইসলাম প্রকৃতপক্ষে ডাকাত দলের ডাকাতি এবং সেই সঙ্গে নারী ধর্ষণকে ধর্মীয় বৈধতা দিবার এক তুলনাবিহীন ধর্ম বিশেষ। যেহেতু ধর্মের নামে এবং ধর্মের বৈধতা নিয়ে যাবতীয় অপকর্ম করা হয় সেহেতু অপরাধীদের মনে কোনও ধরনের অপরাধ বোধ জাগে না। ডাকাতের ডাকাতিতে ও ধর্ষকের নারী ধর্ষণেও অপরাধ বোধ বা অন্যায় বোধ থাকতে পারে। তাছাড়া এগুলির জন্য আইন ও সামাজিক চাপ থাকতে পারে। ইসলামী ডাকাতি এবং ধর্ষণ বুক ফুলিয়ে করা যেতে পারে। এবং এটা করে সমাজে বুক ফুলিয়ে চলা যায়। সমাজই এটা মেনে নেয়। যে সব মুসলিম এতটা পছন্দ করে না তারাও চুপ করে থাকতে চায়। কারণ তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার এবং আক্রান্ত হবার ভয় করে। তাছাড়া এগুলিকে পছন্দ না করলেও বিরোধিতা করার মত নৈতিক জায়গাও পায় না। কারণ ধর্মীয় বিধানেই এগুলি বৈধ, অবশ্য যদি এগুলি অমুসলিমদের উপর জিহাদের অংশ হিসাবে করা যায়।

এই জিহাদ যে শুধু যুদ্ধ হবে তার কি মানে আছে? দুর্বল ও অসহায় সংখ্যালঘুদের উপর ধর্মের অজুহাত তুলে যখন তখন দলবদ্ধ তথা সাম্প্রদায়িক হামলাও হতে পারে। জিহাদের এই খুচরা সাম্প্রদায়িক রূপ দেখবার জন্য আমাদের এ দেশের দূর অতীতে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে অথবা পাকিস্তানের মতো দূর দেশে যেতে হবে কেন? বাংলাদেশেই ১৯৪৬-৪৭ থেকে আজ অবধি কম জিহাদ কি আমরা দেখেছি? হ্যাঁ, এটাই ইসলাম। এই ইসলামের কারণেই এ দেশে হিন্দুর সংখ্যা ১৯৪১ সালে বাংলা ভাগের পূর্বে যেখানে ৩০%-এর কাছাকাছি (২৮%) এবং বাংলা ভাগের পর ১৯৫১ সালে ২২.০৫% ছিল সেখানে ২০১১-তে এই সংখ্যা নেমে ৮.৫%-এ পৌঁছেছে। এখন ২০১৭-তে জনসংখ্যা অনুপাতে হিন্দুদের এই হার আরও কমবার কথা।

বস্তুত ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার দ্বারা অমুসলিমদের সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায় সব মুসলিম সংখ্যাগুরু কিংবা মুসলিম অধিকৃত সমাজেই মুসলিমদের একটি সুবিধাভোগী বা ‘বেনিফিশিয়ারী’ শ্রেণী গড়ে উঠে, যারা জিহাদীই হোক আর মডারেটই হোক নিজেদের সুবিধাজনক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান রক্ষার জন্য ইসলাম রক্ষা ও চর্চার জন্য সব সময় সতর্ক থাকে। বাংলাদেশে আজকের যে শ্রেণী সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রেখেছে তাদের একটি বড় অংশই প্রধানত হিন্দুর সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠনের মাধ্যমে তাদের প্রাথমিক আর্থ-সামাজিক ভিত্তি নির্মাণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে একই প্রক্রিয়ায় অবাঙ্গালী অমুসলিম জাতিগুলিকে শোষণ, লুণ্ঠন ও উৎসাদন করে বাঙ্গালী মুসলিমদের অনেকে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী গঠন করেছে।

মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এই সমগ্র প্রক্রিয়ার একটি প্রায় অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে হিন্দু অথবা অবাঙ্গালী ও অমুসলিম নারী অপহরণ ও ধর্ষণ। এই কাজে মুসলিমদের পারঙ্গমতা অন্য যে কোনও ধর্মসম্প্রদায়ের চেয়ে যে বেশী সে কথা বোধ করি এখানে নূতন করে বলতে হবে না।

বস্তুত ইসলাম ধর্মটাই অপরাধ ও অপরাধী সৃষ্টির একটা কারখানা। এই কারণে মুসলিম সমাজ যে সাধারণত অন্য যে কোনও সমাজের চেয়ে অনেক বেশী অপরাধপ্রবণ হয় তা-ই নয়, অধিকন্তু মুসলিমরা যেখানে থাকে সেখানকার অমুসলিম সমাজকেও অপরাধপ্রবণ করে ফেলে। তাদের সংস্পর্শে ও প্রভাবে সংক্রামক ব্যাধির মতো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী নিগ্রহ, ধর্ষণ, সহিংসতা, খুনাখুনি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি অন্যান্য সমাজের ভিতরেও ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম যেখানেই গেছে সেখানেই এগুলিকে বহন করে নিয়ে গেছে।

আমি এ কথা বলি না যে অন্য কোনও সমাজে অপরাধ কিংবা অপরাধ প্রবণতা থাকে না। কিন্তু ধর্মের আড়ালে এগুলি আর কোথায়ও এতটা কিংবা এভাবে বৈধতা পায় না যতটা কিংবা যেভাবে ইসলামী সমাজে পায়। এই ধর্ম চর্চার প্রভাবে যে চিন্তাধারা ও সংস্কৃতি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মানুষের চেতনা বা মনোজগৎকে অধিকার করে তার ফলে মুসলিম সমাজ লোভ-লালসা সঞ্জাত সব ধরনের অপরাধ প্রবণতার লালনভূমিতে পরিণত হয়। পরিণতিতে মুসলিম সমাজে সব রকম অপরাধ, অন্যায় ও অবিচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে মুসলিম সমাজ ও তার নেতৃত্বকারী তথা শাসক শ্রেণী গঠনের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত যুদ্ধ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ মূলক যাবতীয় অপরাধ ও অন্যায়ের ঐতিহ্যকে, যা অজস্র উপায়ে সমাজে তার প্রভাব এবং ধারাবাহিকতা রেখে চলে।

এই ধর্মের অস্তিত্ব শুধু ইসলামী সমাজকে নয়, উপরন্তু গোটা মানব সমাজ বা মানব জাতিকেও দূষিত করে চলেছে। মানুষের ভিতর এমনিতেই কম-বেশী যে দোষ-ত্রুটি, লোভ-লালসা কিংবা অপরাধ প্রবণতা থাকে বা থাকতে পারে ইসলাম এবং মুসলিম সমাজের অস্তিত্ব সেগুলিকে উস্কে দেওয়ার জন্য নানানভাবে কাজ করে। বিশেষ করে অন্যান্য সমাজের অপরাধপ্রবণ মানুষরা এর ফলে তাদের অপরাধ বাণিজ্য বিস্তারের জন্য চমৎকারভাবে অনুকূল বাজার খুঁজে পায়। এটা মানব জাতির সামগ্রিক অধঃপাতে সহায়ক হয়।


৯। প্রতারণার ধর্ম

ইসলামকে ধর্ম হিসাবে দেখে পৃথিবীর অন্য সকল ধর্মের মানুষ চিরকাল প্রতারিত হয়েছে। তবে কি এটা ধর্ম নয়? অবশ্যই ধর্ম। তবে সেটা তার কিছু বিশ্বাস এবং আনুষ্ঠানিক দিক মাত্র। কিন্তু এগুলির সবটাই মুসলমানের ব্যক্তি ও সমষ্টি স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্ম চর্চার কৌশল মাত্র। আসলে ধর্ম চর্চার আবরণের ভিতরে লুকানো থাকে লুঠের, হামলা বা যুদ্ধের, নারী ধর্ষণের এবং অসংযত নারী সম্ভোগের সংগুপ্ত ইচ্ছা। এই সংগুপ্ত ইচ্ছা কিছু ভালো কথা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে লুকানো থাকে বলে এগুলিকে বাহির থেকে দেখা যায় না কিংবা বুঝতে ভুল হতে পারে। কিন্তু এটা যে কোনও ছুতায় কিংবা ঘটনার জের ধরে প্রকাশ্যে কদর্য ও ভয়ঙ্কর রূপ ধরে বেরিয়ে আসতে পারে।

কোনও একটি ঘটনার জের ধরে মসজিদে বিশেষ করে জুম্মার নামাজ শেষে মুসলিমরা যখন ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে ‘নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর’ হুঙ্কার দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে অমুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের হত্যা কিংবা জখম করে, তাদের বাড়ীঘর-সম্পদ লুঠ করে, তাদের সম্পত্তি থেকে তাদের উৎখাত ক’রে সেসব দখল করে, তাদের নারীদেরকে ধর্ষণ এবং অপহরণ করে তখন ইসলামের ভিতরের রূপ বেরিয়ে আসে। অবশ্য এসব এক সময় থেমে আসতে পারে। আজকের পৃথিবীতে এসব বেশী সময়ের জন্য চালানোও যায় না।

সুতরাং তখন রাষ্ট্র বা সরকার মডারেট মুসলিমের রূপ ধরে মাঠে নামে। অমুসলিমদের সান্ত্বনা দেয়। কিছু দুষ্কৃতিকারীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণের সঙ্গে ইসলামের যে কোনও সম্পর্ক নাই সে কথা তারস্বরে নানানভাবে নানান প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে শুনায়। বিদেশ থেকে যদি কখনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয় তখনও বলা হবে ‘শান্তির ধর্ম’ ইসলামের সঙ্গে এ সব সহিংসতা ও দুষ্কৃতির কোনও সম্পর্ক নাই। আর ইসলাম সম্পর্কে ডান কিংবা বুর্জোয়া মতাদর্শের রাজনীতিক ও মডারেট বুদ্ধিজীবীরা তো বটেই এমনকি অনেক বামপন্থী বা কমিউনিস্ট রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীও সর্বদা গলা ফাটিয়ে প্রচার করে যাবে যে ইসলাম শান্তির ধর্ম, ফলে কোনও ধরনের সহিংসতার সঙ্গে ইসলামের সামান্য সম্পর্কও নাই; যারা সহিংসতা করে তারা ইসলামের প্রকৃত অনুসারী নয়।

সব সময় যে মুসলিমরা হামলা বা দাঙ্গা করে বেড়ায় তা নয়। তখন আপাত দৃষ্টিতে সমাজ থাকে উপরে শান্ত। কিন্তু সেটা উপরের রূপ। কিন্তু সমাজের ভিতরে অমুসলিমদের উপর চলে নানান ধরনের খুচরা উপদ্রব। সেটা বিদ্রূপ, অভদ্র আচরণ, নানান ধরনের সামাজিক হেনস্থা, এখানে সেখানে জমি দখল কিংবা বাড়ী থেকে উচ্ছেদ, সস্তায় জমি বিক্রয়ে বাধ্য করা; এ ছাড়া আছে অমুসলিম কিংবা হিন্দু নারীদের উপর নানান ধরনের অসম্মানজনক আচরণ এমনকি মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে অপহরণ এবং ধর্ষণ।

এখানে আরও বলা উচিত যে মুসলিম সমাজে নারী দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়, এবং তারা প্রকৃতপক্ষে পুরুষের ভোগের বস্তু ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব নারীই যে কোনও মুসলিম সংখ্যাগুরু সমাজে দুর্ভোগের শিকার হয় পদে পদে। তবে নারীর প্রতি অসম্মান যে ইসলামের মর্মে আছে সে কথা মানতে রাজী না ইসলামে বিশ্বাসী কোনও মুসলিমই। এ ক্ষেত্রে জিহাদী বা মৌলবাদী এবং মডারেট সব মুসলিমই এক জোট।

আসলে এই ধরনের মডারেট মুসলিমদেরকেও চিনতে হবে মানবতার শত্রু হিসাবে। বস্তুত, আজকের যুগে ইসলামের প্রকৃত রূপকে আড়াল করার পথে এরা সবচেয়ে বড় বাধা। জ্ঞানে বা অজ্ঞানে এরা প্রতারক। অবশ্য প্রতারণা ইসলামের এক অপরিহার্য অঙ্গ। ইসলাম তথা নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মুহাম্মদ যেটার অহর্নিশ চর্চা করতেন। এটাকে ইসলামী শাস্ত্রে বলা হয় ‘তাকিয়া’। এই মডারেট মুসলিমদেরকে চিনতে হবে ইসলামের তাকিয়া বা প্রতারণার মূর্ত সামাজিক রূপ হিসাবে, যারা জেনে হোক না জেনে হোক ইসলামের অসহিষ্ণু, মারমুখী বা সহিংস, আগ্রাসী এবং নারী বিদ্বেষী ও নারী ধর্ষণকারী রূপকে আড়াল দিবার জন্য মরীয়া চেষ্টা চালায়।

যারা ইসলামকে জেনে এ কাজ করে তারা হল জ্ঞানপাপী বা সুবিধাবাদী। আর কিছু থাকে যারা ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ কিছু না জেনে বিশ্বাস বা মনে করে যে ধর্ম হওয়ায় আর দশটা ধর্মের মত ইসলামও নিরীহ প্রকৃতির। কিংবা এরা বোকা বা সরল, যারা মনে করে একটা কথাকে বারবার বললে সেটা সত্য হয়ে যাবে এবং তাতে হয়ত মুসলিমরা সব নিরীহ ভালোমানুষ হয়ে যাবে।

তারা ভুলে যায় যে ইসলামের আসল সত্য নিহিত আছে কুরআন, হাদীস এবং মুহাম্মদের জীবনের মধ্যে, যার চর্চা আলেম বা মোল্লারা সর্বদা করে এবং সেগুলি থেকে সাধারণ মুসলিমদের নিকট ইসলামের প্রকৃত সত্যও তুলে ধরে। প্রয়োজনে তাকিয়া তারাও করে। কারণ সেটাই ইসলামের শিক্ষা। ইসলামের সহিংসতাসহ যাবতীয় অন্ধকার দিকের শিক্ষা তাদের কাছ থেকে সমাজে অব্যাহতভাবে প্রসারিত হয়। এই অন্ধকার দিকগুলির শিক্ষালয় হচ্ছে বিশেষ করে মাদ্রাসা আর এগুলির অব্যাহত সামাজিক চর্চাকেন্দ্র হচ্ছে মসজিদ। বিশেষত সাধারণ মুসলিমদের জন্য ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষণ শিবির হচ্ছে মসজিদ। বাড়ীতে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়াও দৈনিক পাঁচ বার নামায এবং মসজিদে বিশেষত সপ্তাহে একদিন তথা শুক্রবারের জুম্মার নামায মুসলিমদের খাঁটি তথা জিহাদী মুসলিম হিসাবে গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

ইসলামকে বুঝতে হলে মুহাম্মদকে বুঝতে হবে। মক্কায় যতদিন তিনি রাষ্ট্র বা ক্ষমতা হাতে পান নাই ততদিন তিনি খুব নিরীহ একজন ‘পরহেজগার’ বা ধার্মিক মুসলিম, যিনি আল্লাহর বাণী হাজির করছেন, ‘দীন (ধর্ম) সম্পর্কে জোর-জবরদস্তি নাই’ (কুরআন- ২:২৫৬)। কিংবা ‘তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার’ (কুরআন- ১০৯:৬)। বিশেষত, মক্কার সূরাগুলি পড়লে কখনও কখনও একজন নিরীহ ও সহিষ্ণু ধর্মপ্রচারক হিসাবে তাকে মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে এ সবই ছিল দুর্বল ধূর্ত মুহাম্মদের কৌশল। এটাই হচ্ছে তার তাকিয়া। যখন হাতে সুযোগ এসেছে অর্থাৎ মদীনায় গিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়েছেন তখন তার চেহারা বদলে গেছে। আসলে বদলে গেছে বললে ভুল হবে, বরং বলা উচিত হবে তিনি তার আসল চেহারা ধারণ করেছেন। আবার প্রয়োজন হলে নম্র রূপ হাজির করেছেন। যেমন বিদায় হজে আমরা অনেক ভালো কথারও বয়ান শুনি। এটা শুধু মুহাম্মদের আসল রূপ নয় এটাই ইসলাম তথা সব বিশ্বাসী ও ইসলাম চর্চাকারী প্রকৃত মুসলিমেরই আসল রূপ। এটাই ইসলাম। আসলে প্রতারণারই আর এক নাম ইসলাম।

মুহাম্মদ তার নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র প্রভু ও শাসক হিসাবে কাল্পনিক ও অদৃশ্য আল্লাহর ধারণা তৈরী করেন এবং এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী স্বেচ্ছাচারী আল্লাহর দাস বা বান্দা হিসাবে মানুষকে উপস্থিত করেন। এই স্বেচ্ছাচারী ও দাস-মালিক আল্লাহর প্রতিনিধি বা নবী হিসাবে তিনি নিজেকে উপস্থিত করেন। উদ্দেশ্য, মানুষকে কাল্পনিক আল্লাহর দাস বা বান্দায় পরিণত করে বৈষয়িক সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে নিয়ে বাস্তবে তাদেরকে নিজের ইচ্ছার দাস বা বান্দায় পরিণত করবেন। সুতরাং কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘কেহ রাসূলের আনুগত্য করিলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করিল’ (৪:৮০)। ‘মুমিনদের উক্তি তো এই - যখন তাহাদের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিবার জন্য আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তাহারা বলে, “আমরা শ্রবণ করিলাম ও আনুগত্য করিলাম।” আর উহারাই তো সফলকাম’ (২৪:৫১)। ‘যাহারা আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁহার অবাধ্যতা হইতে সাবধান থাকে তাহারাই সফলকাম’ (২৪:৫২)। ‘বল, “আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর” (২৪:৫৪)। ‘যাহারা আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, তাহারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করিবে’ (৩৩:৭১)। অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য আর মুহাম্মদের আনুগত্য সমার্থক। আল্লাহর দাসত্ব আর মুহাম্মদের দাসত্ব একই কথা। এভাবে ইসলাম প্রবর্তনের মাধ্যমে মুহাম্মদ সমস্ত ক্ষমতার নিরঙ্কুশ কেন্দ্রীভবন নিজের হাতে ঘটাতে চাইলেন। কিন্তু মক্কায় তিনি সুবিধা করতে পারেন নাই।

মক্কাবাসীরা তার নবীত্বে বিশ্বাস না করায় সেখানে তিনি দাঁড়াতে পারেন নাই। সুতরাং স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন নাই। কিন্তু মদীনায় নিজের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পাবার সাথে সাথে সেটা করেছেন। অর্থাৎ নিজ স্বেচ্ছাচার চরিতার্থ করার জন্য আল্লাহর ধারণা তথা ধর্মকে নিজ ইচ্ছামত ব্যবহার। যখন তার যে ইচ্ছা হত তখন সেই ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনি তার হাতের পুতুল আল্লাহর কাছ থেকে ওহী নাজিল করতেন। তিনি তো অদৃশ্য আল্লাহর একমাত্র প্রতিনিধি! একবার তাকে বিশ্বাস করলে এইসব ওহীর সঠিকতা বা যৌক্তিকতায় প্রশ্ন করার সব পথই তো বন্ধ। এভাবে তিনি আল্লাহর কথা বলে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতেন।

সাধারণ নিয়মে প্রত্যেক প্রকৃত মুসলিমকে চিনতে হবে মুহাম্মদের ছায়া রূপে। অর্থাৎ প্রত্যেক খাঁটি ও ঈমানদার মুসলিমের অন্তরে একজন করে মুহাম্মদ থাকে। কুরআনেও আদর্শ হিসাবে তাকে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। ‘তোমাদের মধ্যে যাহারা আল্লাহ্ ও আখিরাতকে (পরকাল) ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাহাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ’ (৩৩:২১)। ইত্যাদি।

অন্ধ না হলে মুহাম্মদের মধ্যে আদর্শের রূপ চিনতে কারও কষ্ট হবার কথা নয়। সুতরাং এই আদর্শের অনুসারীগণ মুহাম্মদের মক্কা বা মদীনার যখন যে রূপ তাদের জন্য দরকার হবে তখন সেটাই তারা কুরআন আর হাদীস থেকে বের করবে। কোনটা মিথ্যা? সবই তো সত্য! ইসলামে সব আছে। আছে ক্ষমা, দয়া. সহিষ্ণুতা, সংযম। আবার আছে লুণ্ঠন, হত্যা, নারী ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও নিগ্রহ, সন্ত্রাসও। দরকার মতো সবই চালানো যাবে ইসলামের নামে। ক্ষমতার ভারসাম্য যার হাতে থাকবে সবই সে করতে পারবে ইসলামের নামে।

অবশ্য যা-ই করা যাক একটা ছুতা দিতে হবে। ছুতা দিতে সমস্যা কী? বিধর্মী হলে তো সবই জায়েজ। না হলেও বা ক্ষতি কী? ইসলাম থেকে সরে গেছে বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেই তো হল? কেন শিয়া, সুন্নী, হানাফী ইত্যাদি নানান মাযহাব আছে না! না হলেও সমস্যা নাই। নেকড়ে ও মেষ শাবকের সেই গল্প অনেক পাঠকের জানবার কথা যেখানে নেকড়ে বাঘ একটা মেষ শাবককে খাবার জন্য একটা মিথ্যা ছুতায় তাকে অভিযুক্ত করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দরকার হলে এ ক্ষেত্রেও তা করা যেতে পারে। যে কোনও একটা ছুতা তৈরী করে কতল আর ধর্ষণ অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জন্য এমন ধর্ম পৃথিবীতে আর কোনটা আছে?

আবার পরিস্থিতি যখন উগ্রতার বিপক্ষে থাকবে অথবা উগ্রতার প্রয়োজন মনে হবে না তখন কুরআনের ঝোলা থেকে শান্তি ও সহিষ্ণুতার ললিত বাণী বের করে শুনানো যাবে। দরকার হলে কাতর স্বরে মিউ মিউ করা যাবে ‘শান্তির ধর্মের’ অনুসারী হিসাবে। এবং শান্তিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো যাবে নামাযের কাতারে। তখন কে বলবে এই লোকগুলাই সুযোগ বুঝে মুহূর্ত পরেই চোখ উল্টে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে অপ্রস্তুত ও অসন্দিগ্ধ মানুষদের উপর এবং হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের উৎসবে মাতোয়ারা হতে পারে? আসলেই ধর্মের নামে প্রতারণার এত বড় হাতিয়ার পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নাই। যে সব অমুসলিম এটাকে ধর্ম হিসাবে বিশ্বাস করেছে তারা সকলেই প্রতারিত হয়েছে।

হ্যাঁ, এটা ধর্ম। কারণ এর সকল দুষ্কৃতিতেই ধর্মের আবরণ দেওয়া আছে। ধর্মীয় কিছু তত্ত্ব আছে, নামায-রোযার মত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আছে। আল্লাহ্ তথা ঈশ্বর প্রদত্ত গ্রন্থ হিসাবে কথিত কুরআনও আছে। সুতরাং ধর্ম না বলে উপায় কী? কিন্তু যে কথা বললাম এটা যাবতীয় অন্যায়, দুষ্কৃতি ও অপকর্মের আবরণ। ইসলাম হচ্ছে মানুষের সকল অপরাধ ও অন্যায়কে জায়েজ করা বা ন্যায্যতা দিবার ধর্ম। এটা হচ্ছে দুর্বলের উপর সবলের সকল ধরনের অন্যায় আর অত্যাচারকে ন্যায্যতা দিবার ধর্ম। অর্থাৎ ইসলাম হচ্ছে অপধর্ম। এই অপধর্মের কারণে সবল যে দুর্বলের উপর অপ্রতিহতভাবে অত্যাচার ও অন্যায় করে যাবার সুযোগ পায় শুধু তাই নয়, উপরন্তু অত্যাচারিতও অবিশ্বাস্য পীড়ন ও অমর্যাদাকে অলঙ্ঘনীয় বিধিলিপি বা আল্লাহর ইচ্ছা হিসাবে মেনে নিবার প্রেরণা পায়। ইসলামের নারীদের দিকে তাকালেই এই সত্য স্পষ্ট হয়।

ইসলামে নারী যেন পুরুষের লোভনীয় খাদ্যবস্তু, যেন সে মানুষ নয়। আর তাই তাকে বের হতে হলে সমস্ত শরীর এবং মাথা-মুখ পর্যন্ত ঢেকে বের হতে হয়। গায়ে চাদর দিয়ে এবং মুখ ঢেকেও শান্তি নাই। কী জানি কোথা দিয়ে শরীরের কোন জায়গা দেখা যায়! সুতরাং অনেকে বোরখাও পরে, যা সমস্ত শরীরকে আপাদমস্তক ঢেকে রাখে। শীত নাই, গরম নাই এটাই হয়েছে মুসলিম মেয়েদের বাইরে চলার পোশাক। ইদানীং ইসলাম ধর্মের প্রভাব যত বাড়ছে তত এই ইসলামী লেবাসের কদর বাড়ছে।

নারীরা কি গরমের সময় কিংবা গরমের দেশে কষ্ট পায় না? পুরুষ কি রাজী হবে মুখ-শরীর ঢাকা এমন পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতে? মেয়েরা এত কষ্ট করে কী করে? উত্তর, ধর্মবিশ্বাস করায়। এতে মানুষ হিসাবে তাদের স্বাভাবিক বোধ বা অনুভূতি নষ্ট হলেও তারা ধর্মের প্রভাবে সেটাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। এ গেল একদিক। অপর দিকে, যে প্রশ্ন সঙ্গতভাবে মাথায় জাগে তা হল এ ধরনের অমানুষের মতো পোশাক পরে সমাজে ঘুরে বেড়ানো নারীর জন্য কতখানি অসম্মানের তা কি সমাজ বা নারী কারও মাথায়ই আসে না? না, আসে না। কারণ ধর্ম সেই বোধটুকুও মুসলিমদের মধ্যে রাখে না। না পুরুষ, না নারী কারও মধ্যেই এই বোধ থাকে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারীদেরই নিজেদের অসম্মানজনক সামাজিক ও মানবিক অবস্থান নিয়ে গর্ব বেশী।

কুরআন-হাদীস পড়লে বুঝা যায় পুরুষের ভোগ্যবস্তু আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে বিবেচনা ছাড়া ইসলামে নারীকে আর কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয় নাই। ইসলামে ধরা হয়েছে পুরুষ মাত্রই খাদক আর নারী মাত্র খাদ্য। খাদ্যবস্তুকে তো অন্যান্য খাদক তথা পরপুরুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখতেই হবে। নারীরাও যদি নিজেদেরকে মানুষ হিসাবে না দেখে পুরুষের খাদ্যবস্তু হিসাবে দেখে তবে তাদের এভাবে থাকতে এবং চলতে অসুবিধা কী?

আসলে ইসলাম পুরুষকেও মানুষ রাখে নাই। ধরে নিয়েছে সব পুরুষ ইসলামের নবী মুহাম্মদ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মতোই নারী খাদক, যে কারণে নারী হলেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা হবে। কাজেই পুরুষের যাতে মুহাম্মদ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মত নারী দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছা না হয় সেই জন্য নারীকে নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে।

ধর্ম প্রবর্তক হওয়া সত্ত্বেও যে পুরুষ অসহায় যুদ্ধবন্দী নারীদেরকে ধর্ষণ করতে ছাড়ে না, শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু ধর্মীয় বিধান হাজির করে নিজ অনুসারীদেরকেও এমন অমানবিক কাজে উৎসাহ দেয়, নিজের এক কন্যার স্বামী ওসমান এবং এমনকি সবচেয়ে প্রিয় অপর এক কন্যা ফাতেমার স্বামী আলীকেও যে লোক সম্ভোগের জন্য যুদ্ধবন্দী দাসী উপহার দিতে পারে, ইচ্ছামত স্ত্রী আর দাসীদের দিয়ে নিজের হেরেম সাজাতে এবং তাদের সম্ভোগ করতে পারে, নিজের ধর্মপুত্র যায়িদের রূপসী স্ত্রী যয়নব যে ছিল তার থেকে ২৩ বছরের ছোট তার প্রতি লোভ হওয়ায় আল্লাহর ওহী বা বাণী নাযিল করে তার কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিয়ে করতে এবং এভাবে যায়িদের জীবনকে ধ্বংস করতে পারে এবং পঞ্চাশ বৎসর বয়সে যে পুরুষ ছয় বৎসর বয়সের অবোধ নারী-শিশু আয়েশাকে বিয়ের লোভ সামলাতে পারে না তার কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো আর কোন্ দৃষ্টিভঙ্গী আশা করা যায়?   

এই রকম লোক যে মানুষদের নিকট আদর্শ মানুষ হিসাবে পরিগণিত হয় সেই মানুষরাও যে কুরআনের নির্দেশ মেনে ও তাদের নবীর আদর্শ অনুসরণ করে কোন পর্যায়ের মানুষ হতে পারে সে কথা ভাবাটা কি জরুরী নয়? প্রতিটা মুসলিম সমাজ এমন সব ‘আদর্শ’ মানুষ দিয়ে গঠিত যেখানে মানবতা ও নারীত্ব প্রতিটি মুহূর্তে লুণ্ঠিত হয়, নিগৃহীত হয়, পদপিষ্ট হয়, নিহত হয়।


১০। পাশ্চাত্য আধিপত্য ও ইসলাম

এমন এক বর্বরতার পূজারী হয়ে ইসলাম সুদীর্ঘ কাল পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপী দাপিয়ে বেড়িয়েছিল। সমগ্র উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম ইউরোপের স্পেন, পূর্ব ইউরোপের এক উল্লেখযোগ্য অঞ্চল, পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া থেকে ভারত এবং সাগর পার হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত সুবিশাল ভূভাগ ইসলামের অধীনে চলে যায়। তবে ভারতবর্ষ ইসলামের শাসনাধীন হলেও এখানকার জনসাধারণের সুবৃহৎ অংশই শত হত্যা-পীড়ন সত্ত্বেও কোনক্রমে নিজেদের পিতৃপুরুষদের ধর্ম রক্ষায় সমর্থ হয়। ইউরোপের খ্রীষ্টান অধ্যুষিত স্পেন থেকে ইসলাম চূড়ান্তভাবে উৎখাত হয় ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে সেখানে খ্রীষ্টান শক্তির হাতে মুসলিমদের শেষ ঘাঁটি গ্রানাডা রাজ্যের পতন হলে। পশ্চিম ইউরোপ প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত হিংস্র ইসলামী আগ্রাসনকে প্রতিরোধে সমর্থ হয়। খ্রীষ্টান অধ্যুষিত রাশিয়া মোঙ্গলদের ইসলামে ধর্মান্তরিত অংশ গোল্ডেন হোর্ড শাসকদেরকে ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে মুসলিম শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। ১৪৫৩ সালে বাইজেন্টাইন রাষ্ট্রের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপল মুসলিম তুর্কীদের অধিকারে গেলেও ইউরোপে ইসলাম ও মুসলিম আগ্রাসনের শক্তি ক্রমে স্তিমিত হয়ে আসে।  

একটা পর্যায়ে ইউরোপ পাল্টা আঘাত হানে। ১০৯৬ থেকে শুরু হয়ে ১২৯১ পর্যন্ত প্রায় দুইশত বৎসর স্থায়ী ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের কথা আমি বলছি না। তখনও ইউরোপ খ্রীষ্টান ধর্ম শাসিত। সেই যুদ্ধ ছিল খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় তীর্থভূমি জেরুজালেম ও প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডকে মুসলিমদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য প্রায় দুইশত বৎসর স্থায়ী খ্রীষ্টানদের ব্যর্থ ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড। আমি বলছি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে সূচিত এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রবল রূপ নিয়ে আবির্ভূত এবং সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে প্রবলতর শক্তি নিয়ে আবির্ভূত ইউরোপের ইসলামী জগতের উপর পাল্টা আঘাতের কথা। স্পেনে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ ছিল ইসলামী আধিপত্যের শেষ বছর। এই সময় বা পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীর চতুর্দিকে ইউরোপের দেশগুলির আবিষ্কার ও বিজয় অভিযান শুরু হয়। দুই আমেরিকা মহাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও এশিয়াসহ পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগ ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধীনে চলে যেতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে ইসলামী দেশগুলিরও প্রায় সবাইকে আগে বা পিছে একই পরিণতি ভোগ করতে হয়। ইসলাম ও মুসলিমদের আধিপত্যের যুগ শেষ হল।  

ইউরোপের আধিপত্য ইসলাম অধিকৃত দেশগুলির জন্য পরাধীনতা, উপনিবেশিকতা এবং পরাধীনতা ও উপনিবেশিকতার অনুষঙ্গ হিসাবে অনেক নেতিবাচক দিক নিয়ে এল ঠিক, কিন্তু এক অর্থে ইসলামের ভয়ঙ্কর অন্ধকারের বুক চিরে নূতন আলোর রেখার সূত্রপাত অন্তত ঘটালো। ইসলামী পৃথিবীর মানুষ এবার অন্তত বর্বরতা থেকে সভ্যতার পথে যাত্রা করার একটা দিশা পেল। ইসলামের ভিতর থেকে কোনও ধরনের মানবিকতা কিংবা সভ্যতার শক্তির উত্থান সম্ভব ছিল না। সুতরাং তার পথ করে দিবার জন্য একটা বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের অপরিহার্যতা ছিল। ইউরোপ ইতিহাসের এই প্রয়োজন পূরণের হাতিয়ার হল।

একটা পর্যায়ে ইউরোপের প্রত্যক্ষ আধিপত্যের অবসান হল। গত শতাব্দী অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেই মোটামুটি এই পর্ব সম্পূর্ণ হল। কোথায়ও একটু আগে, কোথায়ও একটু পরে। এরপরেও ইউরোপের আধিপত্য রইল না আমি তা বলি না, তবে সেটা প্রত্যক্ষ নয়। সেটাকে ইউরোপীয় আধিপত্যের অধীনে যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটার একটা ধারাবাহিকতা বলা যেতে পারে। এই ধারাবাহিকতাকে নয়া উপনিবেশবাদ নামে অভিহিত করা যায়।

ইউরোপীয় আধিপত্য যেসব দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সেসব দেশে পাশ্চাত্যের অধীনস্থ একটা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেমন গড়ে উঠে তেমন সামাজিক বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন না হলেও অর্থনীতিতে ইউরোপীয় প্রভু রাষ্ট্রগুলির প্রয়োজনে তাদের উপর নির্ভরশীল একটা অর্থনীতি গড়ে উঠে। এই সঙ্গে ইউরোপীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবও পড়ে এইসব দেশে। গড়ে উঠে বিভিন্ন আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও যুগমনস্ক শিক্ষা দেওয়া হয়। ইউরোপীয় আধিপত্য ইসলামের ধর্মীয় বিধানের অংশ দাস ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে। ইউরোপীয়দের অধীনতায় নারীরাও মানুষের মতো চলাফেরার কিছু সুযোগ লাভ করে। বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্গের নারীদের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো হল।

তুরস্কে সংঘটিত পরিবর্তন ছিল সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ার মতো। প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তা ছিল ইসলামী খেলাফতের অধীন। ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে একটা জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে কামাল পাশার নেতৃত্বে যুগান্তকারী অনেক পরিবর্তন হল। তুরস্ককে লোকবাদী বা সেকিউলার রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হল এবং ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে খেলাফত উচ্ছেদ করা হল। তিনি বুঝেছিলেন এ ছাড়া তুরস্ককে বাঁচানো যাবে না। বলা যায় কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন তুরস্ক বহুকাল পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম পৃথিবীতে পরিবর্তনের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল।

তবে এ কথা বলা বিশেষভাবে প্রয়োজন যে, ইউরোপের আধিপত্যাধীনে হোক আর প্রভাবে হোক মুসলিম পৃথিবীতে যতটুকু পরিবর্তন হল বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তা হল সমাজের উপর তলায়। সমাজের নীচ তলা তথা সাধারণ জনগণ রয়ে গেল ধর্মাচ্ছন্ন ও ফলে পশ্চাৎপদ। এদের ভাবাদর্শিক এবং সামাজিক নেতা হয়ে থাকল মোল্লা শ্রেণী। ইউরোপীয় শাসকদের প্রয়োজনে ও প্রভাবে মুসলিম সমাজের উপর তলায় আধুনিক তথা ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ও ইউরোপীয় রুচি ও সংস্কৃতি দ্বারা কম-বেশী প্রভাবিত একটা উচ্চবর্গ বা এলিট শ্রেণী গড়ে উঠল। এরা পুরাতন যুগের রাজা, বাদশাহ্, সুলতান কিংবা শাসক শ্রেণী থেকে অনেকাংশে ভিন্ন হল। শুধু পোশাকে নয়, রুচি ও আচার-আচরণেও। এরা থাকল উপর তলার বিদেশী শাসক এবং নীচ তলার মুসলিম জনগণের মাঝখানে একটি মধ্যবর্তী শ্রেণী হিসাবে। এরা হল উপনিবেশিক শাসকদের অধস্তন শ্রেণী। অবস্থান বিচারে সাধারণভাবে এদেরকে একালের মুসলিম সমাজের উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলা যায়। ইউরোপীয় শাসকরা যখন বিদায় নিল তখন এই নব্য এলিটদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিয়ে গেল।

এই নব্য এলিটরা যত আধুনিক হোক যে সমাজের উপর এরা প্রতিষ্ঠিত তা হল ইসলামের প্রভাবে গভীরভাবে প্রভাবিত। নীচ তলার আমজনতা রইল ধর্মান্ধ। যে সমাজদেহের উপর এদের শাসন প্রতিষ্ঠিত রইল তার হিংস্র গুহামানবীয় চেতনা, নিদারুণ প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পশ্চাৎপদতা তাদের চরিত্রেও কম-বেশী প্রতিফলিত হল। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা কোনও সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রভাবকে উচ্ছেদ করে একটা নূতন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয় নাই। ইউরোপ যতটুকু পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন ও সম্ভব মনে করেছিল ততটুকুই ঘটিয়ে তাদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা দিয়ে চলে গিয়েছিল।

সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অতীতের সঙ্গে কোনও গুরুতর ছেদ না ঘটার ফলে এই নব্য এলিটদের মধ্যে রয়ে যায় ইসলামের ঐতিহ্যের নানাবিধ প্রভাব ও ধারাবাহিকতা। বিশেষত ইসলামের দীর্ঘ বিজয় এবং অমুসলিম জনগোষ্ঠীসমূহের উপর প্রভুত্বের স্মৃতি তাদের মধ্যে এক ধরনের ইসলামী গৌরব বোধকে জাগিয়ে রাখে। ফলে পিছনে ফিরবার এক ধরনের আকুতি কম আর বেশী রয়ে যায়। এটা এক ধরনের নস্টালজিয়া। কিন্তু আধুনিক সভ্য ও মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য এটা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। এটা পৈশাচিক একটা ব্যবস্থার উত্তরাধিকারকে ধারণ করতে অনুপ্রাণিত করে। ফলে উপর তলার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এলিটদের মধ্যেও থাকে সর্বদা একটা দোদুল্যমানতা। একদিকে জনসমাজের পশ্চাৎপদতা ও ধর্মাচ্ছন্নতা এবং তার ফলে এলিট বা শাসকদের দিক থেকে জনতুষ্টির প্রয়োজন, অপরদিকে ইসলামী ঐতিহ্য নিয়ে নব্য এলিটদেরও প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য বা গোপন গৌরব বোধ একটা অব্যাহত দোলাচলে সমাজকে ধরে রাখে।

এই নব্য এলিট শ্রেণী গঠনে আর একটি গুরুতর সমস্যাকে হিসাবে নিতে হবে। সেটা হচ্ছে এই যে, এই শ্রেণী শুধু যে পাশ্চাত্য উপনিবেশিক আধিপত্যের উত্তরাধিকারকে ধারণ করে তা-ই নয়, অধিকন্তু ইসলামী সমাজের সনাতন এলিট বা পুরাতন শাসক শ্রেণী গঠনের মধ্যে যে আগ্রাসন, লুণ্ঠন ও বর্বরতা ছিল সেটারও অবশেষকে এরা নানান রূপে ধারণ বা বহন করে। বলা চলে ইসলামী বর্বরতার এরাও সাধারণভাবে ভাগী ও সুবিধাভোগী। প্রকৃতপক্ষে এটা ইসলামের উত্তরাধিকার বা ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের সঙ্গে ছেদ একটি আধুনিক সভ্য ও মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য অপরিহার্য। এই ছেদের জন্য প্রয়োজন হয় আমূল পরিবর্তনকারী বিপ্লবের।

ইউরোপকেও আধুনিক যুগে প্রবেশের জন্য বিরাট বিরাট সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। মূলত অহিংস ও অরাজনৈতিক খ্রীষ্টীয় সামাজিক পটভূমি থেকে আসবার পরেও ইউরোপকে অতীতের সঙ্গে ছেদ ঘটাবার জন্য অনেক সময় রক্তাক্ত বিপ্লব ঘটাতে হয়েছে। কিন্তু ইসলামী সমাজে যে ধরনের সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন সেটা হয়ে উঠে নাই বিভিন্ন কারণে। এই কারণগুলির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে আধুনিক কালে সমাজ বিপ্লবগুলির ধারণা পাশ্চাত্য থেকে আসায় ইসলামী সমাজের উপযোগী সমাজ বিপ্লবের ধারণার অনুপস্থিতি।

বস্তুত ইউরোপীয় শাসনের উত্তরাধিকার উত্তর-উপনিবেশিক মুসলিম পৃথিবীর জন্য যে সমস্যা সৃষ্টি করল সেটা হচ্ছে ধর্মনিয়ন্ত্রিত চরম পশ্চাৎপদ, একনায়কতান্ত্রিক, সহিংস, নারী নিগ্রহী ও সন্ত্রাসী একটা সমাজের উপর ইউরোপের তৈরী একটা মোটামুটি আধুনিক ও সেকিউলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব। পরিস্থিতিটাকে আমরা এভাবেও বর্ণনা করতে পারি যে, উত্তর-উপনিবেশিক মুসলিম সমাজের শরীর হল ইসলাম শাসিত আর মাথা হল পাশ্চাত্য ধ্যন-ধারণা শাসিত। আসলে এ কথা বলেও পরিস্থিতির জটিলতাকে বুঝানো কঠিন হয়। কারণ ইসলামের সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার কোনও ধরনের সঙ্গতি বা সম্মিলন সম্ভব নয়। অথচ ইসলামী পৃথিবীর উপর পাশ্চাত্যের আধিপত্য এবং পাশ্চাত্যের উপর ইসলামী পৃথিবীর নির্ভরতার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র, শাসক ও শাসিত, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ সেটাকেই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় প্রতিটি মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র এক অস্বাভাবিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সমাজ তথা জনগণের ভয়ঙ্কর পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল ও বর্বর মানসের সঙ্গে শাসকরা যতই তাল মিলাক তারা তাদের রুচি ও নিরাপত্তার জন্য পাশ্চাত্যের অনুগত হয়ে কিংবা তার উপর নির্ভর করে চলতে চায়।

আসলে এই রকম অবস্থায় কোনও নৈতিক ও মানবিক শাসক শ্রেণীর উত্থানও সম্ভব হয় না। যে কথা একটু আগেই বলেছি, জনগণের হিংস্র গুহামানবীয় চেতনার প্রভাব শাসক শ্রেণীর উপরও পড়ে। স্বৈরতা ও দুর্নীতি যা ইসলামের মর্মে আছে তা নূতন রূপে পরিব্যাপ্ত হয়। সভ্য ইউরোপীয় উপনিবেশিক শাসনামলে রাষ্ট্রশাসনে যেটুকু ন্যায়-নীতি থাকে সেটুকুও দেশীয় শাসনামলে লোপ পেতে থাকে। শাসকদের অনেকেই যে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের দুর্নীতিলব্ধ টাকা পাচার করে তাই নয়, অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বসবাসের জন্য পাঠিয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম দেশগুলির শাসক বা এলিট শ্রেণীর অনেকেরই ‘সেকেন্ড হোম’ বা দ্বিতীয় আবাস হয় ইউরোপ বা আমেরিকার রাষ্ট্রগুলি। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একটা ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত হতে পারে।

শুধু এলিট শ্রেণী নয়, নীচের দিকের শিক্ষিত কিংবা অর্ধ-শিক্ষিত-অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটা অংশও উন্নত জীবনের সুবিধাভোগের জন্য পাড়ি জমায় ইউরোপ-আমেরিকায়। এখন বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা বিপুল হয়েছে। এই সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় উন্নত জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগের আশায় গেলেও যে তারা ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত সংস্কৃতি ও চেতনাকে ধারণ করার প্রয়োজন বোধ করে তা নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সেখানে গিয়ে নিজেদের পশ্চাৎপদ ও বর্বর ধর্ম ও তার মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিকে আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরে।

তারা যেখানে যায় একটু সংখ্যা হলেই সেখানে মসজিদ তৈরী করে এবং এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে নিজ দৃঢ়বদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতি। পাশ্চাত্যে বাস করে এরা পাশ্চাত্যকে ঘৃণা করে। এবং তাদের চরিত্র অনুযায়ী সেখানে ধর্ষণ, ছিনতাই, সহিংসতাসহ যাবতীয় অপরাধ করে চলে। এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা সেখানকার জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম হলেও জনসংখ্যানুপাতে সেখানকার অপরাধের বিপুল অধিকাংশই মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হয়।

যে অমুসলিম পাশ্চাত্যে তারা যায় তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, রীতি-নীতিকে তারা ঘৃণা করে। তা থেকে নিজেদের দূরত্ব রক্ষা করার জন্য তারা সেখানে গিয়ে আরও বেশী ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। প্রশ্ন করা যেতে পারে যদি অমুসলিম পাশ্চাত্য এতই ঘৃণ্য তাহলে তারা সেখানে যায় কেন? ইসলামী স্বর্গ সৌদী আরবে না গিয়ে পাশ্চাত্যে যাবার জন্য এত হুড়াহুড়ি কেন? যতই সমৃদ্ধ হোক সৌদী আরব তাদেরকে ঢুকতেও দিবে না। আর দিলেও তারা সৌদী আরবে যেতে আগ্রহী হবে না; কারণ পাশ্চাত্যের স্বাধীনতা এবং সুবিধা তারা সেখানে পাবে না। সুতরাং তারা ঈমানের দেশ সৌদী আরবের চেয়ে কাফের পাশ্চাত্যকেই কর্মক্ষেত্র ও বাসস্থান হিসাবে পছন্দের শীর্ষে রাখে। অর্থাৎ কাফেরদেরকে ঘৃণা করেই তারা তাদের দেশে যাবে। পুনরায় যদি প্রশ্ন করা যায়, কাফেররা যখন এতই ঘৃণ্য তখন সেখানে যাওয়া এবং থাকা কেন? পুনরায় উত্তর হবে, উন্নত বা প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন লাভের জন্য।

এই উন্নত জীবন তারা তাদের সমাজে পায় না বলে তাদের কোনও আত্মজিজ্ঞাসা নাই। কোনও সাধারণ মুসলিমকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, তার নিজের সমাজের কেন এই দুর্দশা যে কারণে তাকে নিজের সমাজ বা দেশ ছেড়ে কাফেরদের দেশে যেতে হচ্ছে? খুব চিন্তা করে যদি কেউ উত্তর দেয় তা হবে এই রকম যে, ইসলামের পথ থেকে সরে যাওয়ায় অথবা পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ ও ষড়যন্ত্রের ফলে তার সমাজের এই দুর্দশা। কিন্তু তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় কাফেররা ইসলামের পথে নাই কিংবা আল্লাহকে মানেও না তাহলে তারা এত উন্নত হল কী করে অথবা মুসলিমরা আল্লাহর পথের অনুসারী হয়েও কেন কাফেরদের ষড়যন্ত্রের নিকট পরাস্ত? তখন সে হয় উত্তরকে এড়াবে অথবা আল্লাহ্ দুঃখ-কষ্ট দিয়ে মুসলিমদের ঈমান বা বিশ্বাসের পরীক্ষা নিচ্ছেন, ইত্যাদি এমন সব হাস্যকর উত্তর দিবে যেগুলি উল্লেখের উপযুক্ত নয়।

আসলে সাধারণ মুসলিম শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক অত চিন্তা করে না। অত যুক্তি দিয়ে তার বুঝবার মতো বুদ্ধি হয় না বা থাকে না। তার ধর্ম তথা সমাজ-সংস্কৃতিই সেই বুদ্ধি হতে দেয় না। সে জানে যে যেখানে লাভ আছে, ভোগ আছে সেখানে তাকে যেতে হবে। সে তৈরী করতে শিখে নাই। তবে তৈরী কিছু পেলে সে তাতে ভাগ বসায়। আসলে ঘৃণার সঙ্গে ভোগ ইসলামের চেতনার মর্মে গাঁথা। মুসলিম লোভী। লোভ দিয়েই মুহাম্মদ বর্বর বেদুইনদের দিয়ে তার যুদ্ধজয়ী বাহিনী গড়েছিলেন। সুতরাং সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মুসলিমকে হতে হবে লোভী। তবে সে মনে ঘৃণা পুষে রেখে লোভ করবে। কারণ বর্বরতার জন্য সে নিজে সৃষ্টি করতে অক্ষম। তার বর্বর ধর্মই সেটা শিখায় নাই। তার প্রয়োজনও নাই। কারণ সে যাকে কাফের বলে ঘৃণা করে বাহুবলে তার শ্রমের ফল আত্মসাৎ করবে। সুতরাং অন্যের সৃষ্টি সে ভোগ করবে ঘৃণার সঙ্গে। ভোগ করবে বিচার-বিবেচনাহীন পশুর মতো এবং সেটাকে ভোগ করে নিঃশেষ করে ছুঁড়ে ফেলবে। এবং পুনরায় নূতন কোনও অথবা কারও তৈরী সামগ্রীর সন্ধানে থাকবে।

ইসলামের মনস্তত্ত্বকে বুঝবার জন্য আমি একটা তুলনা খুঁজে পাই। সেটা হচ্ছে ‘সিরিয়াল কিলার রেপিস্টের’ মনস্তত্ত্ব। ‘সিরিয়াল কিলার রেপিস্ট’ যেমন নারীকে ধর্ষণ ক’রে আরও আনন্দ লাভের জন্য তাকে হত্যা করে এবং এভাবে সে একটার পর একটা নারীকে ঘৃণার সঙ্গে ধর্ষণ করে এবং নারীর প্রতি তার ঘৃণাকে পূর্ণতা দিতে চেয়ে এবং আরও আনন্দ পেতে চেয়ে হত্যা করে চলে ইসলামের মনস্তত্ত্ব অনুরূপভাবে কাজ করে সভ্যতার প্রতি। সভ্যতা নির্মাণের প্রতি তার ঘৃণা, সভ্যতার উপকরণের প্রতি তার ঘৃণা। অথচ এগুলির প্রতি তার লোভ। সুতরাং পরকালে ভোগের লোভনীয় চিত্র আাঁকা হয়েছে তার ধর্মগ্রন্থে। ইসলামের স্বর্গে রাখা হয়েছে মদ, বহুসংখ্যক নারী ও বালক লাভের সুযোগ। সেই সঙ্গে আছে এমন বহুকিছু ব্যবহারের সুযোগ যেগুলির ব্যবহার এই পৃথিবীতে ঘৃণ্য অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত।

কুরআনের ৫২-সূরা তূর-এ বলা হচ্ছে, ‘(আয়াত ১৭) মুত্তাকীরা (ধর্মভীরু) তো থাকিবে জান্নাতে ও আরাম-আয়েশে, .... (১৯) ‘‘তোমরা যাহা করিতে তাহার প্রতিফল স্বরূপ তোমরা তৃপ্তির সহিত পানাহার করিতে থাক।’’ (২০) তাহারা বসিবে শ্রেণীবদ্ধভাবে সজ্জিত আসনে হেলান দিয়া; আমি তাহাদের মিলন ঘটাইব আয়তলোচনা হূরের সঙ্গে; .... (২২) আমি তাহাদিগকে দিব ফলমূল এবং গোশ্ত যাহা তাহারা পছন্দ করে। (২৩) সেথায় তাহারা পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান করিতে থাকিবে পানপাত্র, যাহা হইতে পান করিলে কেহ অসার কথা বলিবে না এবং পাপ কর্মেও লিপ্ত হইবে না। (২৪) তাহাদিগের সেবায় নিয়োজিত থাকিবে কিশোরেরা, সুরক্ষিত মুক্তাসদৃশ।’

নিম্নবর্ণিত হাদীস থেকে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন সামগ্রীর প্রতি মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গী বেরিয়ে আসে, ‘তিনিই (আয়েশা রাঃ) বলিয়াছেন, (একদা) নবী সঃ চতুষ্কোণ কাল একটি চাদর পরিয়া নামায পড়িলেন। তাহাতে ছিল নকশা। তিনি উহার নকশার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিলেন। নামায শেষ করিয়া তিনি বলিলেন, ‘এই চাদরখানা আবু জহমের নিকট লইয়া যাও (উহা তাহাকে দাও) এবং আবু জহমের নকশাবিহীন মোটা চাদরখানা লইয়া আইস; কেননা ইহা আমাকে এইমাত্র নামাযে অমনোযোগী করিয়াছিল।’ (নকশী চাদরখানা আবু জহমই সঃ কে উপহার দিয়াছিলেন।} - তজরীদুল বুখারী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৫৮, পৃষ্ঠা- ১১৪।

অপর একটি হাদীসে বলা হচ্ছে, ‘ওকবা ইবনে আমের (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামের খেদমতে একটি রেশমী জুব্বা হাদিয়া দেওয়া দেওয়া হইয়াছিল (তখন রেশমী বস্ত্র ব্যবহার পুরুষের জন্য হারাম ছিল না)। তিনি উহা পরিধান করিয়া নামায পড়িলেন কিন্তু নামায শেষে উহা ঘৃণিত বস্তুর ন্যায় তাড়াতাড়ি খুলিয়া ফেলিলেন এবং বলিলেন, ইহা মোত্তাকীদের জন্য সমীচীন নহে।’ (হাদীস : ২৫০- বোখারী শরীফ, প্রথম খণ্ড, অনুবাদ : মাওলানা শাসছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) এবং মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, প্রকাশক : হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, ৬৫, চক সারকুলার রোড, ঢাকাণ্ড ১২১১, পঞ্চদশ সংস্করণ, মে ২০০৭, পৃষ্ঠা- ১৮৪।)

আমরা ঐ একই গ্রন্থ থেকে জানতে পারি, ‘রেশমী বস্ত্র পুরুষের জন্য হারাম হওয়ার ইহা প্রথম পদক্ষেপ। ইহার পর রসূলুল্লাহ্ (সঃ) পরিষ্কার বলিয়াছেন - দুনিয়াতে রেশমী বস্ত্র ঐ পুরুষই ব্যবহার করিতে পারে, আখেরাতে যাহার সুখ লাভের আদৌ কোন আশা নাই। খলীফা ওমর (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, ‘‘রসূলুল্লাহ্ (সঃ) রেশমী বস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করিয়াছেন।” গ্রন্থ ঐ, পৃষ্ঠা- ১৮৪।

অথচ বেহেশতে রেশমী কাপড়ের সরবরাহও হবে অবাধ। কুরআনে সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে, ‘তাহারা (মুত্তাকীরা) পরিধান করিবে মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র।’ (৪৪:৫৩)

অপর একটি হাদীস উল্লেখ করা যায় সভ্যতার প্রতি মুহাম্মদের মনোভাব বুঝবার জন্য, ‘ছাহাবী আবু উমামা (রাঃ) কোথাও লাঙ্গল-জোঁয়াল দেখিতে পাইয়া বলিলেন, আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছি, এই জিনিস যেই লোকদের ঘরে প্রবেশ করিবে, আল্লাহ্ তায়ালার সাধারণ নিয়ম অনুসারে তাহাদের উপর সম্মানের লাঘব ও নীচতা নামিয়া আসিবে।’ - বোখারী শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, অনুবাদঃ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) এবং মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, হামিদিয়া লাইব্রেরী, একাদশ সংস্করণ : সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃষ্ঠা- ২৫২।

বস্তুত এ ধরনের হাদীস থেকে সভ্যতা ও সভ্যতার উপকরণের প্রতি মুহাম্মদের ঘৃণা বেরিয়ে আসে। অথচ এগুলির অনেক কিছুই স্বর্গে সহজপ্রাপ্য। এভাবে যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে ঘৃণার সঙ্গে ভোগের মনস্তত্ত্ব সৃষ্টি। আসলে ঘৃণার সঙ্গে ভোগ ইসলামের মর্মমূলে গাঁথা। সাধারণ মুসলিম এটাই আত্মস্থ করেছে ইসলামের কাছ থেকে।

এক সময় তারা ভিন্ন দেশ বা রাষ্ট্রের মানুষদের সম্পদ লুঠ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এখন একমাত্র নিজ দেশের কাফেরদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লুঠ করতে পারলেও সেখানে আছেই বা কতটুকু যে তা থেকে বিরাট লাভ হবে? তবু কিছু ক’রে লুঠ ক’রে যেটুকু পায় তা দিয়ে নিজেদের সম্পদ বাড়ায়। পাকিস্তানের হিসাব বাদ থাক, বাংলাদেশের হিসাবটাই কী চিত্র দেয়? কিছু আগেই বলেছিলাম যে, ১৯৪১ সালে আজকের বাংলাদেশভুক্ত অঞ্চলে হিন্দুর সংখ্যা যেখানে ছিল সমগ্র জনসংখ্যার ২৮% এবং ১৯৫১ সালে ২২.০৫ সেটা ২০১১ সালে হয়েছে ৮.৫%। এটা শুধু সংখ্যা হ্রাসের একটা চিত্র। হিন্দু নির্যাতনের বাকী চিত্রটা আর বলছি না। সেটাকে কল্পনার উপর আপাতত ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এখন হিন্দুর আছেই বা আর কী? সুতরাং মুসলিমদের পেট ভরবে কী করে? মুসলিমদের যে কাজ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি তো করে চলেছে পঙ্গপালের মতো। বাধ্য হয়ে শ্রম দিবার জন্য মুসলিমরা ছুটছে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর দেশে দেশে। কিন্তু যারা আর একটু বেশী সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখে তারা কোন দুঃখে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলিতে?

এখন রইল ইউরোপ-আমেরিকা। কিন্তু সেখানে তো আর আগের কালের মতো তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় না। সুতরাং দীন-হীন ও মিসকিনের মতো হাজির হওয়া। কিন্তু বিনা শ্রমে তো আর সেখানকার প্রাচুর্যে ভাগ বসানো যাবে না। সুতরাং বাধ্য হয়ে শ্রম করে। কিন্তু সারাক্ষণ ঘৃণা করে সেখানকার সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে। সুতরাং মসজিদ তৈরী করে, নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। লক্ষ্য থাকে, যে কাফের সমাজে তারা যায় সেখানে সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করা এবং যে মুহূর্তে শক্তির ভারসাম্য পক্ষে আসবে সেই মুহূর্তে সেখানকার কাফের স্থানীয় অধিবাসীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া এবং নিজেদের লুণ্ঠন, ভোগ ও স্বেচ্ছাচারের শিকার করা এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ধর্মান্তরিত করে নিজেদের সকল অপকর্মের অংশীদার করা, এমন অংশীদার করা যাতে নও মুসলিমরা নিজেদের উপর কৃত সকল অন্যায় ও অপরাধকে আল্লাহর নির্দেশের বাইরে থাকার শাস্তি হিসাবে যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত মনে করে অথবা এ ধরনের ঘটনা সংঘটনের ইতিহাসকেই অস্বীকার করে। এভাবে এক সময় সকল ধরনের দুষ্কৃতিকারীরা ধর্মের গুণে নির্যাতিতদের নিকট ‘সত্য পথের দিশারী’ এবং ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসাবে দেখা দেয়। ধর্মের মাধ্যমে মগজ ধোলাইয়ের এমনই গুণ! ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের দিকে তাকিয়ে দেখলেই বুঝা যাবে কথাটা কতখানি সত্য।

বস্তুত মুসলিমরা যেখানে গেছে এবং শক্তির ভারসাম্য নিজ পক্ষে আনতে পেরেছে সেখানেই উপরে বর্ণিত ঘটনা ব্যতিক্রমহীনভাবে ঘটেছে। এবং সেই সঙ্গে ঘটেছে সেই সব সমাজের সার্বিক অধঃপতন। এর জন্য বেশী দূর যেতে হয় না। আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের অতীত ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তবে একই ঘটনা ঘটতে দেখব। প্রাক-ইসলামী ভারতবর্ষে সমাজ ও সভ্যতার অবক্ষয় কিংবা সঙ্কট সত্ত্বেও প্রাচুর্য এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির যে চিত্র আমরা দেখতে পাই ইসলামী আগ্রাসন শুরুর পর থেকে অনেক ক্ষেত্রে তার প্রায় কিছুই আর থাকে নাই। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র ইসলামী শাসনের কাল ভারতবর্ষের ইতিহাসের গভীর অন্ধকারের কাল; অনেক বৃহত্তর আয়তন ও মাত্রায় যুদ্ধ ও সহিংসতার কাল, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, হত্যা ও ধ্বংসের কাল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন কালের প্রায় সকল কীর্তিকে এটা ধ্বংস করার কাল।

ইসলামের প্রভাবে প্রকৃত মুসলিমের পক্ষে উদ্ভাবনশীল ও উৎপাদনশীল বা সৃষ্টিশীল হওয়া সম্ভব নয়। মুসলিমের শ্রেষ্ঠ উৎপাদন প্রকৃতপক্ষে একটাই, সেটা হচ্ছে সন্তান উৎপাদন। এর জন্য ধর্মীয় বিধানে তাকে দেওয়া হয়েছে বহু বিবাহ (এক সঙ্গে চার স্ত্রী) এবং ইচ্ছামতো অগণিত সংখ্যক দাসী (যুদ্ধবন্দী নারী এবং ক্রীতদাসী) সম্ভোগের স্বাধীনতা। মুহাম্মদ কুরআনের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছেন। যুদ্ধবন্দিনী ধর্ষণ ও সম্ভোগের এই শরীয়তী বিধান কীভাবে এই বাংলায় ’৭১-এ পাকিস্তানের ইসলামী সেনাবাহিনী মেনে চলেছিল তা বাঙ্গালীর ভুলবার কথা নয়।

এমন একটি বাস্তবতায় আধুনিক সভ্যতার জন্য সম্পূর্ণরূপে অনুপযোগী ধর্ম ইসলামের প্রভাবের কারণে মুসলিম সমাজগুলি দীর্ঘকাল যাবৎ পাশ্চাত্য আধিপত্যের অধীনে চলে গেছে। পাশ্চাত্যের প্রত্যক্ষ আধিপত্য শেষ হলেও মুসলিম সমাজগুলির অক্ষমতার কারণে এবং এখানকার শাসকদেরও নিজেদের টিকে থাকবার এবং ভোগের স্বার্থে পাশ্চাত্যের উপর নির্ভর করতে হয়। বিশেষ করে আধুনিক যুগ তথা উন্নত বিশ্বের চাপে সমাজের কিছু করে উন্নয়ন না ঘটিয়ে উপায় থাকে না। এই উন্নয়নের শক্তি স্বাধীনভাবে সমাজের ভিতর থেকে ইসলামের কারণে জন্ম নিবার সুযোগ পায় না। সুতরাং পাশ্চাত্যের উপর নির্ভর না করে উপায় থাকে না। শুধু পাশ্চাত্য বলে কথা নয়, এটা রাশিয়া বা চীনের মতো পৃথিবীর যে কোনও শক্তিশালী অমুসলিম রাষ্ট্র হতে পারে। তবে বিভিন্নভাবে পাশ্চাত্য আধিপত্যের ধারাবাহিকতা থাকায় মুসলিম পৃথিবীর প্রায় সব দেশ যে মূলত পাশ্চাত্যের উপর নির্ভর করে চলবে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণাধীনে চলবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই ধারাতেই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মতো দেশগুলি চলছে।


১১। ইসলাম থেকে মুক্তির সংগ্রাম

এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবে করণীয় কী? এই অবস্থাকে আমরা কি মেনে নিব নাকি বদলাবার জন্য চেষ্টা করব? এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে ইসলামের জগদ্দল পাথরকে অপসারণের চেষ্টা অতীতে মুসলিম সমাজের কোথায়ও কখনও হয় নাই। যুগে যুগে দেশে দেশে তেমন চেষ্টা হলেও সেটা সফল হয় নাই। তার একটা বড় কারণ সভ্যতার সেই সব অঞ্চলে ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল মূলত যে অঞ্চলগুলিতে সভ্যতায় দীর্ঘকাল যাবত ক্ষয় নেমে এসেছিল।

ইসলাম সভ্যতার ধর্ম নয়, বর্বরতার ধর্ম। ইসলাম সভ্যতার গতিকে থামিয়ে পিছন দিকে নিবার ধর্ম। সভ্যতার ভিতরে মানুষ থাকবে না তা নয়। তবে সভ্যতার একেবারে এমন নিম্ন পর্যায় সেটা হবে যেখানে মানুষের বোধ-বুদ্ধি প্রায় লোপ পাবে এবং চেতনা অসাড় হবে। সুতরাং এই রকম এক পশুপ্রায় জীবনে মানুষের বেঁচে থাকার উপযোগী মানসিক রসদ যোগাবার ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। এর মধ্যে উন্নত মন ও মানবিকতার কিছুরই সন্ধান করে লাভ নাই। ছিটাফোটা যদি উন্নত কিছু পাওয়া যায় তবে বুঝতে হবে পার্শ্ববর্তী বা পূর্ববর্তী সভ্য সমাজ ও সংস্কৃতির কিছু প্রভাব। আর এটাও মনে রাখতে হবে জীবনের নিজস্ব কিছু চাহিদা থাকে। সুতরাং সবচেয়ে হিংস্র জানোয়ারও সারাক্ষণ হিংস্রতা করে বেড়াতে পারে না। তারও আহার-নিদ্রা-বিশ্রাম থাকে এবং থাকে কিছু স্নেহ-মমতার জায়গাও। কিন্তু এইসব কিছু দিয়ে তার মূল বৈশিষ্ট্যের বিচার হয় না। ইসলামকেও দেখতে হবে সেভাবে।

একটু আগে যে কথা বলেছিলাম ইসলাম সভ্যতার অবক্ষয় বা সঙ্কটের ধর্ম। সুতরাং মানব জাতি যে পর্যন্ত নূতন পর্যায়ে সভ্যতা গঠনে পদক্ষেপ দিতে পারে নাই সে পর্যন্ত ইসলাম দাপিয়ে বেড়াতে পেরেছিল। এটা লক্ষ্যণীয় যে ইসলামের জগৎ থেকে সভ্যতার পুনর্জাগরণ ঘটে নাই, তা ঘটেছে তার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ইউরোপ থেকে। এই ইউরোপও খ্রীষ্টধর্মের দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসনের জোঁয়াল তার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারার পরই মাত্র আধুনিক সভ্যতার পথে পদক্ষেপ দিতে পেরেছে। এটা সম্ভব হয়েছিল বিশেষত প্রাচীন গ্রীসের বিস্মৃত জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের ফলে। এরপর ইউরোপ তার দিগ্বিজয়ী অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের মুখে ইসলামী বিশ্ব তার পদানত হয়। এবং ইসলামের সনাতন ব্যবস্থার বহুকিছুই ভেঙ্গে পড়ে।

ইউরোপের যা প্রয়োজন ছিল তা করেছে। এই ইউরোপ তো খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কিংবা মানুষের মুক্তির মিশন নিয়ে বিশ্বজয়ে নামে নাই। এই ইউরোপ মূলত ধর্মের শাসন মুক্ত এবং নগদ লাভ সন্ধানী। তার প্রয়োজন ছিল বাজার ও উপনিবেশ। সুতরাং ইসলাম থেকে মুসলিম পৃথিবীর মুক্তির পথ তার কাছ থেকে অন্বেষণ করা কীভাবে সমীচীন হবে? তার যেটা করার প্রয়োজন ছিল সেটা তা নিজ স্বার্থেই করেছে। সনাতন ইসলামের কাঠামোকে অনেকটাই ভেঙ্গে দিয়ে গেছে।

কিন্তু এটা ঠিক যে ইসলামের সনাতন সমাজ কাঠামো অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়লেও তার ভাবাদর্শ এবং চিন্তার জায়গা এখনও প্রায় অটুট আছে। এটা তার সমাজকে পশ্চাৎপদ করে রাখে। সেটা প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে পাশ্চাত্যকে যদি বাড়তি সুবিধা দেয় তবে সেটা পাশ্চাত্য নিবে না কেন? ইসলাম তার নিজ সমাজকে দুর্বল করে রেখেছে। এই দুর্বলতার সুযোগ কেউই নিতে চাইবে না মানুষ সম্পর্কে এমন ধারণা আমরা কেন করব? সুতরাং পাশ্চাত্য অথবা পাশ্চাত্য শক্তিগুলির কেউ না কেউ সেই সুযোগ নিয়েছে এবং সম্ভব ও প্রয়োজন মনে করলে একটা পর্যায়ে ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রগুলিকে আটকে রাখতে চেষ্টাও করেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে উন্নত দেশগুলি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে ইসলামী সমাজগুলিতে ইসলামী শক্তিগুলির পৃষ্ঠপোষকতাও করেছে নানানভাবে। যেমন এক সময় এটা আমরা দেখেছি পাশ্চাত্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার দ্বন্দ্বে পাশ্চাত্য কর্তৃক ইসলাম তথা ধর্মকে নানানভাবে ব্যবহার করতে ও উস্কে দিতে।

এভাবে দেখা যায় বিভিন্ন কারণে ইউরোপের হাতে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ইসলামের বিপর্যয় শুরু হলেও বিগত প্রায় ছয় শত বৎসর ইউরোপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং প্রয়োজনের কারণেও তা টিকে থাকতে পেরেছে। অপর একটি কারণ হচ্ছে ইসলামের প্রচণ্ড অনমনীয়তা ও সহিংস আক্রমণাত্মকতা।

কিন্তু যে সকল কারণে ইসলাম টিকে থেকেছে বিশেষ করে ভিতর থেকে তেমন ভাবে তাকে আঘাত করা যায় নাই সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ইসলাম সংক্রান্ত কোনও ধরনের সমালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে না পারা। এটা করলেই তাকে হত্যা করাটা ইসলামী সমাজে মামুলী ব্যাপার। সুতরাং ইসলামী সমাজে ভিতর থেকে তার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় কোনও পদক্ষেপ দেওয়াই সম্ভব ছিল না। আধুনিক কালে এই কাজ যতটুকু সম্ভব মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টরা করেছিল তাদের বস্তুবাদী দর্শন বা বিশ্বদৃষ্টির কারণে। কারণ মার্কসীয় দর্শন সমাজ ও ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী, ফলে ভাববাদ তথা ধর্মবিশ্বাস-বিরোধী।

তবে ইসলামী সমাজে সাধারণভাবে মার্কসবাদ ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য যে শুধু পাশ্চাত্যের ভূমিকা দায়ী তা নয়, অধিকন্তু ইসলামী সমাজের সমস্যা ও বৈশিষ্ট্য বুঝবার ক্ষেত্রে কমিউনিস্টদের ব্যর্থতাও দায়ী। মার্কসবাদ বা কমিউনিজম ব্যক্তি-পুঁজিবাদী বা বুর্জোয়া বিভিন্ন তত্ত্ব বা ধারণার মত পশ্চিম ইউরোপ বা পাশ্চাত্য থেকে উদ্ভূত তত্ত্ব বা ধারণা। ইসলামের সমস্যা বুঝে প্রতিকারের উপায় বের না করায় যেমন পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী বা বুর্জোয়া নানান ব্যবস্থা বা সিস্টেমের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইসলামী দেশগুলিতে সাধারণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে তেমন বলা চলে যে একই কারণে কমিউনিস্টদের বিপ্লবের সকল প্রচেষ্টাও এখানে ব্যর্থ হয়েছে।

কমিউনিস্টদের ব্যর্থতার একটা খুব বড় উৎস হল, যে শ্রমজীবী জনগণকে তারা পরিবর্তনের অগ্রবাহিনী হিসাবে বিবেচনা করেছে ইসলামী সমাজে তারা হচ্ছে চেতনাগত বিচারে চরম প্রতিক্রিয়াশীল, সুতরাং পরিবর্তন বিরোধী শক্তি। মোল্লা ও প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী ও গোষ্ঠীগুলির মূল বাহিনী হিসাবে যারা প্রতিবিপ্লবের ভিত্তি নির্মাণ করে তাদেরকে বিপ্লবের মূল শক্তি হিসাবে ধরে নিয়ে কমিউনিস্টরা বিপ্লব ঘটাতে চেয়েছে। এটা হচ্ছে ইউরোপীয় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে গড়ে উঠা তত্ত্ব ও তার রণনীতির অন্ধ অনুশীলন। তারা ইউরোপের সমাজ নির্মাণে খ্রীষ্টধর্মের ভূমিকাকে হিসাবে নেয় নাই কখনও। ফলে তার অভিজ্ঞতা যান্ত্রিকভাবে ইসলামী সমাজেও প্রয়োগ করতে গিয়েছিল। সুতরাং এমন বিপ্লব চেষ্টার পরিণতি যা হবার তা-ই হয়েছে।

অবশ্য তাদের চেষ্টার একটা ভাল দিক হচ্ছে সমাজের নীচ তলা থেকে পরিবর্তন ও বিপ্লবের চেষ্টার ফলে সমাজের তলদেশে একটা উদার ও প্রগতিশীল চেতনার কিছুটা বিস্তার। সবচেয়ে বড় কথা ইসলামী সমাজে কমিউনিস্টদের ভূমিকার মূল্যায়নের সময় কাল প্রেক্ষিতটাকেও বিবেচনায় নিবার প্রয়োজন আছে। এই রকম পশ্চাৎপদ এবং ভয়ঙ্কর বর্বরতাপূর্ণ একটা সমাজে, যেটাকে হিংস্র গুহামানবীয় বলাই উচিত, সেই রকম এক সমাজে ভিতর থেকে নিজেদের উদ্যোগে ও স্বাধীনভাবে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মমুক্ত দর্শন-ভিত্তিক বিপ্লবের চিন্তা নিয়ে সংগ্রাম করারই মূল্য অপরিমেয়। যে কোনও কাজের সূচনার জন্য একটা ধারণা বা তত্ত্বের প্রয়োজন হয়। প্রাচ্যে আধুনিক কালের যাত্রা শুরু হয়েছে ইউরোপ থেকে পাওয়া ধারণা কিংবা জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে। এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ প্রাচ্য আধুনিক সভ্যতার পথে যাত্রা করেছে অনেক দেরীতে, ইউরোপের চাপে কিংবা ইউরোপের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে।

এই অবস্থায় উপনিবেশিক অধীনতার পরিবর্তে যারা স্বাধীনভাবে সমাজ পরিবর্তন, উন্নয়ন ও যন্ত্রশিল্প নির্ভর আধুনিক সভ্যতা নির্মাণ করতে চাইবে তারা যে মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিস্ট আদর্শকে অবলম্বন করবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কথাটাকে একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ইউরোপের আধিপত্যের অধীনে তার অধীনস্থ এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যেই রয়ে যায় ইউরোপের আধিপত্য তথা উপনিবেশিক ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। এটা ইসলামী সমাজে ইউরোপের রেখে যাওয়া পুলিশী বা আমলাতান্ত্রিক ও দমনমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রেও একটা উপনিবেশিক উত্তরাধিকার রেখে যায় যা স্বাধীন চরিত্র বিশিষ্ট এবং উন্নত ও মানবিক অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়ক হয় না।

আসলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে উপনিবেশিক ব্যবস্থার সঙ্গে ছেদ ঘটানো প্রকৃত স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য উত্তর-উপনিবেশিক দেশগুলির জন্য অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। মার্কসবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাহায্যে এটা চীন, ভিয়েৎনামের মতো অনেক দেশ ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু ইসলামী বিশ্বে কমিউনিস্টরা এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে।

কিন্তু ঐ কালে এর বেশী করা যে সম্ভব ছিল না সেটাও আমাদেরকে বুঝতে হবে। কিছুকাল আগেও পৃথিবীর বাস্তবতা এবং ইসলামী সমাজের পরিস্থিতি কোনটাই ভিতর থেকে তথা নিজস্ব ও স্বাধীন উদ্যেগে ইসলামী সমাজে বিরাট পরিবর্তন ঘটাবার অনুকূল ছিল না। ইসলামের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত পৃথিবীতে সভ্যতাকে আরও অগ্রসর হতে দিতে হয়েছে এবং সেই সঙ্গে ইসলামী সমাজেরও ভিতর থেকে পরিবর্তনের প্রয়াসগুলির নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারের সমৃদ্ধির প্রয়োজন ছিল।

ইসলামী পৃথিবীতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে কমিউনিস্ট আন্দোলন সাধারণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমাদেরকে এটাও বুঝতে হবে যে, এই আন্দোলন যে বিপুল অভিজ্ঞতা দিয়েছে তা ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে আগামী সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের পথরেখা নির্মাণে অনেকখানি সহায়ক হবে। তবে তার জন্য মতান্ধ না হয়ে এবং সেখানকার অনেক কিছুকে বর্জন করে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিবার মানসিকতা থাকতে হবে।

আসলে ইসলামের মতো একটা চরম অসহিষ্ণু এবং বর্বরতাপূর্ণ মানসিকতার সমাজে ইসলামের সমস্যা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতায় তার প্রভাব বা ভূমিকা এবং বিকল্প নির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনাই অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। আর এ সংক্রান্ত আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়া এবং সেই সঙ্গে সামাজিকভাবে কর্মপ্রয়াস ছাড়া পরিবর্তন তথা ইসলাম থেকে মুক্তির উপায় এবং ইসলামের বিকল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনও সঠিক ধারণাও বেরিয়ে আসতে পারে না।

ইসলামের ইতিহাস আগাগোড়া নিরবচ্ছিন্ন বিজয়ের নয়। বিশেষত পরবর্তী কালে তাকে অনেক পরাজয় ও ধ্বংস দেখতে হয়েছে। যেমন ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল আক্রমণে তার ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। মোঙ্গল হানাদারদের হাতে ১২৫৮ খ্রীষ্টাব্দে আব্বাসীয় খলীফাদের রাজধানী বাগদাদ লুণ্ঠিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে সেটা ছিল প্রধানত রাজনৈতিক বিপর্যয়। ধর্মীয় বিপর্যয় বা সঙ্কট তার যেটুকু ঘটেছে সেটুকু প্রধানত আধুনিক ইউরোপের উত্থানের পর থেকে ঘটেছে।

ক্রুসেডের কথা বাদ দিলেও বিগত প্রায় পাঁচ-ছয় শত বৎসর ধরে তাকে পাশ্চাত্যের পাল্টা আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এবং এই সময়-সীমার শেষ দিকের দীর্ঘ সময়ে তাকে বিভিন্ন দেশে ইউরোপীয়দের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে থাকতে হয়েছে। পাশ্চাত্য অধীনতায় শুধু যে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্র কাঠামোয় পরিবর্তন হয়েছে তা-ই নয়, পাশ্চাত্যের ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে সামাজিক ক্ষেত্রেও কিছু করে পরিবর্তন ঘটেছে। সর্বোপরি আছে বস্তুগত উন্নয়ন ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার। ফলে পরিবর্তন তো সর্বত্রই হচ্ছে কম আর বেশী।

কিন্তু একটা ভাবাদর্শ এবং সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামের জগতে ইসলাম এতকাল প্রকৃত অর্থে নিজের আধিপত্য রক্ষায় সফল হয়েছে। ইসলাম ও তার নবীর যে কোনও সমালোচনার জবাব মুসলিমরা যুক্তি বা কথায় না দিয়ে অস্ত্র দিয়ে দিতে অভ্যস্ত। এই অবস্থায় কে ইসলামের ভিতরে থেকে ইসলামের সমস্যা ও ভূমিকা সম্পর্কে নির্মোহ এবং যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা-সমালোচনা করতে যাবে! সুতরাং এতকাল মুসলিম সমাজ-নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব তার সমাজ সংরক্ষণে অনেকটাই নিশ্চিন্ত ছিল।

কিন্তু চৌদ্দশত বৎসর পর এই প্রথম ইসলাম তার ইতিহাসে এমন ভয়ঙ্কর অস্ত্রের সম্মুখীন হয়েছে যাকে মোকাবিলা করা তার পক্ষে কোনও ভাবেই সম্ভব নয়। সেই অস্ত্রের নাম হচ্ছে ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল। ইসলাম টিকে আছে মিথ্যা প্রচার এবং ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে। তার মিথ্যাকে ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে কেউ মিথ্যা হিসাবে চিহ্নিত করতে এবং ইসলামের প্রকৃত সত্য বলতে গেলেই তাকে আক্রমণ, নির্যাতন এবং হত্যা করা হয়। ফলে যে ত্রাস সৃষ্টি হয় তাতে করে সমাজের ভিতর থেকে ইসলাম সম্পর্কে কোনও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করা সম্ভব হয় না। সমাজের ভিতর থেকে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনার অর্থ হচ্ছে তার গুণগান করে যাওয়া। যেহেতু সমাজের ভিতর থেকে কোনও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্ক সম্ভব হয় না সেহেতু ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে মৌলিক পরিবর্তনের কোনও শক্তি মাথা তুলতে পারে না।

এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে, বিশেষত ইউরোপে অতীতে ইসলাম সম্পর্কে কোনও বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানচর্চা একেবারে হয় নাই। কিন্তু এটা তাদের সমাজের ভিতরের সমস্যা নয় যে এ নিয়ে তাদের বিশেষ তাড়না বা উৎসাহের কারণ থাকবে। বিশেষ করে ইসলামের মত এক বিপজ্জনক জিনিস নিয়ে কেউই খুব বেশী মাথা ঘামাবার প্রয়োজন বোধ করে না। যে কথাটা বলেছি সমস্যাটা যদি তাদের জীবনের না হয় তবে সত্য জানার ও বলার জন্য তাদের তাড়না থাকার কিংবা জীবনপাতের কী কারণ থাকবে? সর্বোপরি, ইসলাম যদি তার নিজ সমাজকে পশ্চাৎপদ করে রেখে ইসলামের জগতে পাশ্চাত্যের আধিপত্য রক্ষার সহজ হাতিয়ার হয় তবে তার স্বরূপ আড়াল করার ব্যাপারে বিশেষত পাশ্চাত্যের বৃহৎ শক্তিবর্গের আগ্রহের অভাব হবে কেন? স্বাভাবিকভাবেই পাশ্চাত্যের মূলধারার প্রচারমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনেতারা ইসলাম যে শান্তির ধর্ম এ কথা বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলবে। এবং সেটাই তারা এত কাল ধরে করে আসছে।

কিন্তু ইন্টারনেট উদ্ভাবন ইসলামের সমালোচনার নূতন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এখন আর ইসলামের বীভৎস ও কদর্য রূপকে কোনও ভাবেই ঢেকে রাখা সম্ভব নয়। ইসলামের ভিতর থেকে যারা এতকাল ইসলামের প্রকৃত সত্য জানা সত্ত্বেও চুপ করে থাকত সেই সব জ্ঞানী মানুষরাও এখন ইন্টারনেটের সুযোগকে কাজে লাগাতে শুরু করেছে। এতে যুক্ত হয়েছে পাশ্চাত্যেরও বিভিন্ন পণ্ডিত। আগেও ইউরোপে বা পাশ্চাত্যে ইসলাম সংক্রান্ত সামান্য কিছু বইপত্র ছিল। কিন্তু ইসলামের সমালোচনায় ইন্টারনেট তথা ওয়েবসাইট ব্যবহার শুরুর পর মুদ্রণ প্রকাশনেও নূতন জোয়ার দেখা দিয়েছে। এই জোয়ার এখন ছড়িয়ে পড়তে শুরুও করেছে।

ইন্টারনেটের সুবিধা হচ্ছে লেখক বা প্রকাশক না চাইলে তাদের কাউকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। বিশেষত পাশ্চাত্য দেশগুলির বাক স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে খুব সহজেই সেখান থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক লেখা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা সম্ভব। শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য ওয়েবসাইট কিংবা অনলাইন পত্রিকা, ব্লগ ইত্যাদি চালানো কোনও সমস্যাই সেখানে নয়। এ ধরনের অসংখ্য ওয়েবসাইট সেখান থেকে চালানো হচ্ছে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য ভাষায় ইউটিউব-এর মাধ্যমে অনেক ইসলাম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি যুক্তি-তথ্য সহকারে ইসলামের স্বরূপ উদ্ঘাটন ক’রে ইদানীং বক্তব্য দিতেও শুরু করেছেন। এর মধ্যে আছে তর্ক-বিতর্কও। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব লেখা, বক্তব্য এবং  তর্ক-বিতর্ক সারা পৃথিবীতে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলিকে আটকানো কীভাবে সম্ভব?

সুতরাং ইসলামবাদী বা জিহাদীরা অসহায় হয়ে পড়েছে। ইসলামী সমাজগুলিতে অবস্থিত সমালোচকদের মুখ না হয় রাষ্ট্রের দণ্ড, সমাজের হুমকি ও হামলা এবং ছুরি-বন্দুক-বোমার ভয় দেখিয়ে বন্ধ রাখা গেল। কিন্তু মুসলিম সমাজগুলি থেকে পাশ্চাত্যে অভিবাসী যে বহু সংখ্যক ইসলাম বিষয়ক পণ্ডিত ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলামের সত্য সারা পৃথিবীর মানুষকে জানাচ্ছেন তাদেরকে থামানো যাবে কোন ভয় দেখিয়ে?

এ হল এক দিক। অপর দিক হল পাশ্চাত্যেরও নিজস্ব প্রয়োজন। এতকাল রাজনৈতিক স্বার্থে পাশ্চাত্যের নিকট ইসলাম তোষণ ও পোষণের যে প্রয়োজন থাক সেটা এখন আর আগের মতো নাই প্রধানত দুইটি কারণে। প্রথমটি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সেই সঙ্গে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের প্রভাবকে প্রতিরোধের জন্য ইসলামের যে গুরুত্ব ছিল সেই গুরুত্ব ফুরিয়ে যাওয়া, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে জিহাদীদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড। বিশেষ করে ২০০১-এ জিহাদীদের দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারে পাশ্চাত্যে এক ধরনের অনুমোদন সৃষ্টি হয়েছে।

পাশ্চাত্যের মূলধারার রাজনীতি বা প্রচার মাধ্যম ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যে কোনও সমালোচনাকে এখন পর্যন্ত সাধারণভাবে এড়িয়ে গেলেও সম্প্রতি ওয়েবসাইট এবং বইপত্রের প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হচ্ছে। এর প্রতিফলন সম্প্রতি মূলধারার রাজনীতিতেও ঘটতে শুরু করেছে।

বিশেষ করে সন্ত্রাসে বিস্ফোরকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার আজকের যুগে জিহাদী সন্ত্রাসকে নূতন মাত্রা দিয়েছে। এটা ঠিক যে মুসলিম অভিবাসন পাশ্চাত্যে প্রয়োজনীয় শ্রম ও মেধার যে যোগান দেয় সেটাও একটা বড় কারণ মুসলিমদের প্রতি সহনশীল ও নমনীয় মনোভাবের। ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার উত্থানের পর থেকে পদানত ইসলাম বহুকাল বহুভাবে আধিপত্যকারী পাশ্চাত্যকে সেবা দিয়েছে। ইসলামী পৃথিবী থেকে বিশেষত শ্রমের চালান সেই ধরনেরই একটা সেবা মাত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে ইসলামী পৃথিবী থেকে পাশ্চাত্যে শ্রমের চালানের সঙ্গে সন্ত্রাসেরও চালান যেভাবে যাচ্ছে তাতে অবস্থাটা বেশী দিন আর মুসলিমদের পক্ষে থাকছে না। বরং এখন এটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

জিহাদীদের দ্বারা সন্ত্রাসের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার পাশ্চাত্যে শুধু জিহাদীদের প্রতি নয় সেই সঙ্গে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিও সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্ম দিচ্ছে। কিছুকাল আগেও সাধারণভাবে ইউরোপের মানুষ ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ কিছু বুঝত না, জানত না। আধুনিক সভ্যতার উত্থানের পর থেকে ইসলাম বা মুসলিমরা তাদের জন্য আর হুমকি না থাকায় তারা বহুকাল ধরে অতীতের বহু তিক্ত স্মৃতি ভুলেও গিয়েছিল। তাদের অনেকে মনে করতে শুরু করেছিল যে ইসলাম আর দশটা সাধারণ ধর্মের মতো মূলগতভাবে শান্তির ধর্ম। ফলে জিহাদকে তারা ভিন্নভাবে দেখত। যেমন বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, মুষ্টিমেয় দুই-চারজনের বিচ্যুতি, ইত্যাদি। কিন্তু এখন ইসলামের প্রকৃত চরিত্র সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান প্রচারের ফলে তাদের মনে এতকাল ইসলামের প্রতি যে নিরাসক্ত কিংবা সহানুভূতিশীল ধারণা ছিল সেটা যেমন দূর হচ্ছে তেমন ইসলামবাদী কিংবা জিহাদীদের আফগানিস্তান-ইরাক-সিরিয়া-নাইজেরিয়াসহ দুনিয়া জোড়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ঘৃণা ও বিরুদ্ধতাও সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে পাশ্চাত্যে ইদানীং কালে ইসলামের বিরুদ্ধে যেভাবে জনমত সৃষ্টি হচ্ছে সেটা সেখানকার রাষ্ট্রগুলির উপরেও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এটা একটা পর্যায়ে পাশ্চাত্যকে ইসলাম তথা মুসলিমদের সঙ্গে একটা বড় ধরনের সংঘাতের দিকে নিতে পারে।

এই সংঘাতের প্রশ্নে আর একটি বিষয়কে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সেটা হচ্ছে পরমাণু প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিস্তার এবং সেটা মুসলিমদের অধিকারেও যাওয়া। এখন পরমাণু বোমাও আর অমুসলিমদের একচেটিয়া অধিকারে নাই। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানও এখন পরমাণু বোমার অধিকারী। অর্থাৎ এই ঘটনার তাৎপর্য বুঝলেই চলবে যে, জিহাদী আদর্শে বিশ্বাসীদের হাতে পরমাণু প্রযুক্তি চলে গেছে। এখন এটার প্রয়োগ যে কোনও সময় যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে। আজকের যুগে পরমাণু বোমার ব্যবহার যেই করুক সেটার পরিণাম ভয়াবহ হবে। বিশেষ করে মুসলিমদের দিক থেকে তেমন ঘটনা ঘটাবার সম্ভাবনাকে আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে। আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রের হাতেই পরমাণু প্রযুক্তি সীমাবদ্ধ থাকবে এটা মনে করার কী কারণ আছে? এটা রাষ্ট্র বহির্ভূত কোনও জিহাদী গোষ্ঠীর হাতে কখনও যাবে না এমন নিশ্চয়তা কি দেওয়া যায়?

যাইহোক, বর্তমানে ইসলামী পৃথিবীতে যেভাবে সংঘাতের বিস্তার ঘটছে তাতে করে বিভিন্ন দেশ তাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। এই সংঘাতে রাশিয়া-চীনের মতো শক্তিগুলিও জড়িয়ে যেতে পারে। ইসলাম ও মুসলিমদের সম্পর্কে এদেরও কারও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ইসলামী সন্ত্রাস দ্বারা রাশিয়া ও চীন উভয় দেশই আক্রান্ত। ফলে সেই জড়িয়ে যাওয়াটা মুসলিমদের জন্যও সুখকর না হতে পারে। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটা পর্যায়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের মতৈক্যের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া মুসলিম রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যেও যে ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তাতেও তারা ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদী আরব ও ইরান কেন্দ্রিক ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব সেখানে একটা বিরাটাকারের যুদ্ধে পরিণত হতে পারে, যেটা মুসলিম বিশ্ব এবং ইসলামের জন্যও ধ্বংসাত্মক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। বিভিন্ন অমুসলিম রাষ্ট্র এর সুযোগকে কাজে লাগাবে না এমন ভাবাটা ভুল হতে পারে। সুতরাং সব মিলিয়ে এমনটাই মনে হচ্ছে যে ইসলামের অবসান আসন্ন। হয়ত কিছু সময় লাগবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে যোগাযোগ ও প্রচার মাধ্যম এবং প্রযুক্তির ভূমিকা ও শক্তি দেখে সেটা খুব বেশী হবে বলে মনে হয় না।

চৌদ্দশত বৎসর পর ইসলাম এই প্রথম তার অস্তিত্বের চূড়ান্ত সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। যেভাবে তা ঝড়ের গতিতে উঠেছিল এবং পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল সেভাবেই এখন তাকে পরিবর্তনের প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে তছনছ হয়ে নিশ্চিহ্ন হতে হবে। ইসলামকে এখন যেতে হবে। সভ্যতার দীর্ঘকালীন সঙ্কট ও অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে উত্থান লাভের পর থেকে সভ্যতার গতিরোধী যে ভূমিকা তা পালন করতে পেরেছিল বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং মানুষের জ্ঞানের বিপুল বিকাশ তার সেই সভ্যতারোধী ভূমিকা পালনের আর কোনও সুযোগ রাখছে না। ইসলাম তার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যাধীন পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ রোধ করে রাখতে পারে, কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বাইরে অবস্থিত পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে রোধ করবে কী করে?

এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় ইসলামের যাবার সময় হয়েছে। এখন তাকে অর্থাৎ মুসলিমদেরকে ঠিক করতে হবে তা কীভাবে যাবে। মুসলিমরা নিজেরাই বর্বরতার এই ধর্ম থেকে মুসলিম সমাজ ও পৃথিবীকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিবে, নাকি অমুসলিম পৃথিবীর আক্রমণ কিংবা চাপের মধ্য দিয়ে ইসলাম যাবে, এটা এখন তাদেরকে ঠিক করতে হবে। অবশ্য শুধু ভিতর থেকে ইসলাম অধিকৃত সমাজ থেকে ইসলাম থেকে মুক্তির লড়াই করা কতটা সম্ভব হবে তা বলা কঠিন। কারণ ইসলাম বিশ্বাসী মুসলিমদের বোধ-বুদ্ধিকে এমনইভাবে ধ্বংস করে যে সমাজের ভিতর থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচার এবং শক্তির উত্থান ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে ইসলাম থেকে মুক্তির লড়ইয়ের উদ্যোগ যারা নিবে তাদেরকে অমুসলিম সমাজ কিংবা রাষ্ট্রগুলির সহায়তা নিতে হবে। আর যদি মুসলিম সমাজ থেকে এমন কোনও উদ্যোগী শক্তির উদ্ভব না ঘ’টে বাইরের শক্তির চাপে ইসলাম ধর্ম পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ হয় তবে সে ক্ষেত্রে মুসলিমদেরকে যে কোনও না কোনও ধরনের পরাধীনতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে সেই রকমই মনে হয়। তবে নিজেদের যোগ্যতা না থাকলে হয়ত সেটাই হবে এবং কোনও ধরনের ধর্মান্তরিত হবার অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন তাদেরকে হয়ত হতে হবে।

আমি মনে করি মুসলিমদের জন্য এবং মানব জাতির জন্যও প্রথম বিকল্পটিই বাঞ্ছনীয় হবে। অর্থাৎ ইসলামকে বিদায় দিবার মূল দায়িত্ব মুসলিমদেরকেই নিতে হবে, যাতে সহায়তা এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে অমুসলিম জনগোষ্ঠীরও। তবে মনে রাখতে হবে ভূপৃষ্ঠ থেকে ইসলামকে উৎখাত করার দায়িত্বটা শুধু মুসলিম সমাজ থেকে আগত ইসলামমুক্ত মানুষদের একার নয়, এই দায়িত্ব ইসলাম দ্বারা নিগৃহীত সকল অমুসলিম মানুষের এবং একই সঙ্গে ইসলামের অভিশাপ থেকে যারা মানব জাতির মুক্তিকে নিজেদের দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করবেন তাদের সবারই। বস্তুত ইসলামের উৎখাত সাধন মুসলিমদের জন্য প্রকৃত অর্থে হবে একটি হিংস্র গুহামানবীয় ধর্ম ও রাজনীতি ইসলামের কবল থেকে মুক্তি এবং এটা হবে একই সঙ্গে মানব জাতির জন্যও ইসলামের মতো একটা অভিশাপ থেকে মুক্তি। এর জন্য আজ প্রয়োজন ইসলাম থেকে মুক্তির এক আন্দোলন গড়ে তোলা বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর দেশে দেশে ।

এটা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম থেকে মানবতার মুক্তির প্রশ্নে সকল শক্তিকে বৃহত্তর ঐক্যে জমায়েত করার বিষয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, অন্ধবিশ্বাস নির্ভর অলোকবাদী এবং অযুক্তিবাদী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেমে থাকবে। মানুষকে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার লড়াইকে আমরা খাটো করে দেখতে পারি না। কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে, অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ এমনকি হিন্দু ধর্মের মতো মূলত অহিংস এবং অরাজনৈতিক-সামাজিক ধর্মগুলিকে আমরা ইসলামের মতো সামরিক বা সহিংস এবং দানবিক রাজনৈতিক ধর্মের সঙ্গে এক পাল্লায় মাপতে পারি না। অবশ্য হিন্দুধর্মের জাতপাতের বিভাজন এবং জন্মের নিরিখে মানুষকে পবিত্র-অপবিত্র হিসাবে চিহ্নিত করবার মতো ঘৃণ্য, অগণতান্ত্রিক, অমানবিক এবং ক্ষতিকর ধারণাগুলির বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামের গুরুত্ব অপরিমেয়। সুতরাং ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় সকল অন্ধ বিশ্বাস ও প্রথার বিরুদ্ধে সমালোচনা বা সংগ্রামের এই দিককে ভুললে চলবে না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যে সব ধর্ম শান্তিপূর্ণভাবে এসেছে বা আছে এবং যাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম করা সম্ভব তাদের সমস্যার বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামও হবে শান্তিপূর্ণ। যুক্তির আবেদনের বিরুদ্ধে যারা সামরিক এবং হিংস্র নয় তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা সামরিকতা এবং হিংস্রতার প্রয়োজন কোথায়?

বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে যে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত সেটা হচ্ছে এই যে আমরা নিজেরা ইসলাম অধিকৃত সমাজের মানুষ হিসাবে এক ভয়ঙ্কর দাসত্বের সবচেয়ে বড় শিকার। সুতরাং ইসলামই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শত্রু। এই শত্রুকে নিপাত করেই মাত্র বৃহত্তর মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির পথে আমরা এগিয়ে যেতে পারি। সুতরাং এই শত্রুর বিরুদ্ধেই যে আমরা সর্বোচ্চ পরিমাণ শক্তির সমাবেশ ঘটাতে চাইব সেটাই হচ্ছে যুক্তির কথা। বিশেষ করে মনে রাখতে হবে আমরা শুধু যে ইসলাম কর্তৃক অধিকৃত একটি সমাজের অধিবাসী তা-ই নয়, উপরন্তু বাংলাদেশ নামে একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডেরও অধিবাসী। ইসলামের মতো সহিংস ধর্মের বিরুদ্ধে শুধু যুক্তির বিশুদ্ধ লড়াই চালাবার যে কোনও বাস্তবতা নাই সেটা এই আলোচনায় ইতিমধ্যেই আমি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি। এটা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক বা যুক্তির লড়াই নয়, এটা একই সঙ্গে একটি রাজনৈতিক লড়াই। অন্যদিকে, আমাদের জন্য এই লড়াই যেহেতু বিমূর্ত এবং দেশকালহীন লড়াই নয়, বরং একটি দেশ এবং কালের বাস্তবতা নির্ভর লড়াই সেহেতু সেই লড়াই করতে গিয়ে আমাদের সামনে আসে বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই আমরা আমাদের লড়াইয়ের শত্রু-মিত্র এবং কৌশল নির্ধারণ করব। সুতরাং এই সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আজকের বাংলাদেশ-রাষ্ট্রকে ইসলামের অধিকার থেকে মুক্ত করেই যেমন আমরা এখানে একটি স্বাধীন, উন্নত, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি তেমন ইসলামের অভিশাপ থেকে মুক্ত এবং উন্নততর ও অধিকতর মানবিক পৃথিবী নির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের ভূমিকাও রাখতে পারি।


১২। ইসলাম এবং পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ

ইসলাম থেকে মুক্ত এক মানবিক ও উন্নত সমাজের স্বপ্ন আমরা দেখি। স্বাভাবিকভাবে এই সমাজের একটা কল্পচিত্র আমাদের চোখের সামনে থাকে। তবে সেটা যে এখনই খুব স্পষ্ট হবে সে কথা বলা যায় না। ইসলাম থেকে মুক্তির আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তার রূপ পরিস্ফুট হবে। এখন শুধু এইটুকু বলা যায় অন্যের বা সমাজের ক্ষতি না করে মানুষের জীবনাচরণের স্বাধীনতা যেমন সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে তেমন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নিজ ধারণা প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা সেখানে থাকবে। সুতরাং ইসলাম যে জবরদস্তি চাপিয়ে দেয় তার বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সেটাকে নিষিদ্ধ করা হবে। শুধু তাই নয় তার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের নির্ভয়ে বলার অধিকার থাকবে। বিশেষ করে তার নারী স্বাধীনতা হরণকারী এবং নারী বিদ্বেষী ও নারী ধর্ষক চেতনার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে হবে।

বস্তুত ইসলামের সবচেয়ে বড় জিহাদ নারীর বিরুদ্ধে। সুতরাং ইসলামকে চিনতে হবে নারীর অধিকার ও মর্যাদার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসাবে। ইসলামের প্রধান প্রতিপক্ষ নারী। আর তাই মুহাম্মদ বিভিন্ন হাদীসে নারীকে শয়তানের সঙ্গে তুলনা করেছেন অথবা তাদের জন্য হেয় অবস্থান নির্দেশ করেছেন। যেমন তিনি বলছেন, ‘নারী শয়তানের আকৃতিতে সম্মুখে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে চলিয়া যায়।’ (বোখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, অনুবাদ : মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, সপ্তম সংস্করণ, জুলাই ২০০৬, পৃষ্ঠা- ২৯১)। কুরআনেও বিভিন্ন ভাবে নারীর অধীনস্থ অবস্থান নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। যেমন একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাহাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন .... স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাহাদিগকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর’ (৪:৩৪)। এই অবস্থায় ইসলামের জগতে সমাজ বিপ্লবের প্রধান করণীয় নারীর মুক্তির প্রশ্নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

নারীর মুক্তির প্রসঙ্গে আমি ইউরোপের নারী মুক্তির ধারণা থেকে অনেকাংশে ভিন্ন ধারণা পোষণ করি। আমি মনে করি নারী মানুষ হলেও সে পুরুষ থেকে এমনই ভিন্ন একটা সত্তা এবং তার সমস্যা পুরুষ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে এমনই ভিন্ন যে সমাজ ও সভ্যতায় নারীর স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি সূচক এমন একটি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য যা তাকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের বিষয়গুলিতে সিদ্ধান্ত নিবার সুযোগ দিবে। এভাবে সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার যে পুরুষতান্ত্রিক রূপ এতকাল যাবৎ চলে এসেছে তার অবসান হবে এবং মানবিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হবে।

এ ব্যাপারে আমি আমার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। তবে এখানে এইটুকু বলি যে, আমি ভবিষ্যৎ সভ্যতার এমন এক সম্ভাব্য রূপ দেখি যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের জায়গাগুলিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীর স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র পুরুষের পাশাপাশি নারীর নিজস্ব স্বার্থেরও প্রতিনিধিত্ব করতে বাধ্য হবে। এভাবে আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা গণতন্ত্রের নামে কৌশলে যে পুরুষতন্ত্র সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত রেখেছে তার পরিবর্তে ভিন্ন এমন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে নারী শুধু ব্যক্তি হিসাবে নয় বরং সমষ্টিগতভাবে পুরুষের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের হাল ধরবে। এটা জন্ম দিবে এক নূতন সভ্যতাকে। বস্তুত দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুরুষের সহিংস প্রবণতার পরিবর্তে নারীর ভিতর যে প্রবণতার প্রাধান্য থাকে সেটা হচ্ছে তার অহিংসা বা শান্তিপ্রিয়তা। নারীর দেহই নারীকে প্রধানত সংযম ও শান্তির পক্ষপাতী করে। সুতরাং নারীর ভূমিকা সভ্যতায় যে নূতন উপাদান সংযোজন করবে তা তাকে আজকের সভ্যতা থেকে অনেক ভিন্ন, অনেক সংযত ও অহিংস বৈশিষ্ট্য দান করবে বলে আমি মনে করি।*

---------------------------------------------
* আমার বিভিন্ন লেখায় নারীর মুক্তির সমস্যা নিয়ে আমি আলোচনা করেছি। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখযোগ্য ‘নারী ও ধর্ম’ (http://www.bangarashtra.net/article/1519.html) এবং ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ (http://www.bangarashtra.net/article/922.html) নামক গ্রন্থের ‘দ্বাদশ অধ্যায় : নারীর মুক্তি কোন পথে’। এ দু’টিই ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রে (www.bangarashtra.net) দেওয়া আছে। প্রথমটি একটি প্রবন্ধ; এটি দেওয়া আছে ‘নির্বাচিত’ বিভাগে এবং দ্বিতীয়টি ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ’-এ আছে।
---------------------------------------------

আধুনিক সভ্যতায় ইউরোপ-আমেরিকার ভূমিকার ইতিবাচক দিকগুলির মূল্যায়নের পাশাপাশি তার নেতিবাচক দিকগুলিকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বিশেষত তার ভোগসর্বস্ব এবং অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ মানুষ এবং পৃথিবীর জন্য যে সব সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা থেকে আমাদের সতর্ক হবার প্রয়োজন আছে। অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ আমাদের দেশের ক্ষেত্রে যেমন তেমন আন্তর্জাতিক পরিসরেও ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যকে অগ্রহণীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সম্পদের এই ধরনের বৈষম্য বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের জীবন ধারণকে যে শুধু দুর্বিষহ করছে তাই নয়, অধিকন্তু মানুষের মানবিক মূল্যবোধকেও নানান বিকার ও বিকৃতি দ্বারা পর্যুদস্ত করে চলেছে। এই পুঁজিবাদের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার যুদ্ধ ও মারণাস্ত্র নির্ভরতা। এভাবে এই পুঁজিবাদ যুদ্ধ নির্ভর অর্থনীতির পাশাপাশি যুদ্ধ নির্ভর রাজনীতি ও সংস্কৃতিকেও উৎসাহিত করছে। বিশেষত ইউরোপে পুঁজিবাদের উত্থান পর্বে যে নৃশংসতা আমরা দেখতে পাই তা থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ পথ নির্মাণের সময় সতর্ক শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

এদিক থেকে বলা চলে ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ এক অর্থে ইসলামের সন্তান। ৮/৯ শত কিংবা প্রায় হাজার বৎসর খ্রীষ্টীয় ইউরোপ ইসলামের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য মরণপণ হিংস্র যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক সময় আত্মরক্ষার অবস্থান থেকে ক্রুসেডের (১০৯৬ খ্রীঃ থেকে ১২৯১ খ্রীঃ পর্যন্ত) মধ্য দিয়ে তার আক্রমণমূলক অবস্থান গ্রহণ। অতঃপর রেনেসাঁর (চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে) মধ্য দিয়ে নূতন রূপে ইউরোপের উত্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে (১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ) স্পেন থেকে ইসলামকে বিতাড়নের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপের জয়যাত্রা শুরু। এই সময় থেকে উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পথে পশ্চিম ইউরোপ যাত্রা শুরু করে। স্পেনের রাণী ইসাবেলার সাহায্য নিয়ে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেন ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে।

এটা ঠিক যে খ্রীষ্টীয় ধর্মের শাসনে যে ইউরোপ ঘুমিয়েছিল রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে তার সেই ঘুম ভাঙ্গল এবং নূতন, জাগতিক ও বিজ্ঞান মনস্ক চেতনা নিয়ে ইউরোপ জাগল। কিন্তু এর অনেক ভালো দিকের পাশে মন্দ অনেক দিকও ছিল। খ্রীষ্টান ধর্মের প্রভাব ঝেড়ে যে ইউরোপ জাগল সে বৈষয়িক ও ব্যবহারিক হতে গিয়ে অমানবিকও হল। নিজ দেশে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশী বাইরের উপনিবেশের দেশগুলিতে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আগ্রাসন ও আধিপত্য আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশগুলির কোটি কোটি মানুষের ধ্বংস ও মৃত্যুর কারণ হল। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বিভিন্ন কর্মনীতির মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসকরা বাংলার কুটীরশিল্প নির্ভর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিল এবং ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে এক মহাদুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে তাদের হিসাব অনুযায়ীই (বঙ্গের গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের হিসাব অনুযায়ী) শুধু তৎকালীন বাংলার তিন কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটি মানুষের প্রাণ সংহার করল। এমনকি সাম্প্রতিক কাল ১৯৪৩ সালেও বৃহৎ বঙ্গে সম্পূর্ণরূপে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এক কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে উইনস্টন চার্চিল নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ গণতান্ত্রিক শাসকরা ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করল। এভাবে ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য শুধু বাংলার সমাজ জীবনকে তছনছ করে নাই। ইউরোপীয়দের আগ্রাসনে বহু রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংস হল। এ যেন প্রায় হাজার বৎসর ধরে ইসলামকে মোকাবিলা করে ইউরোপ ইসলামের যে বিষ নিজ শরীরে সঞ্চয় করেছিল তার ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটানো অন্যদের উপর।

প্রায় আটশত বৎসর ইসলামের অধীনতা থেকে মুক্তিলাভের পর স্পেনের অভিযাত্রা দিয়ে পৃথিবী জয়ের পথে ইউরোপের যাত্রা শুরু। স্পেনের অভিযান আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের উপর যে ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায় পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির কম। আমেরিকায় স্পেনের এবং পিছু পিছু পর্তুগাল, ইংল্যান্ড ইত্যাদি রাষ্ট্রের বিজয় শুধু যে অগণিত মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল তা-ই নয়, উপরন্তু আমেরিকার নিজস্ব নগর সভ্যতার যেখানে যা কিছু ছিল সবগুলিকেই ধ্বংস করে দিল। আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতিটি নগর বিধ্বস্ত অথবা পরিত্যক্ত হল এবং জনপদগুলি বন্দুক ও তরবারির আঘাতে অথবা ব্যাধিতে বিধ্বস্ত এবং জনশূন্য হল। কত কোটি মানুষ যে সেখানে ইউরোপীয়দের অভিযানের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ফলাফলের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তা শুধু এখন অনুমান নির্ভর হিসাবের বিষয়। অনুমান করা হয় যে, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সময় দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তরসহ সমগ্র বৃহত্তর আমেরিকা মহাদেশের রেড ইন্ডিয়ান জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি। ইউরোপীয়দের অভিযানের পরিণতিতে এর ৮০% থেকে ৯০% মৃত্যুবরণ করে। কল্পনা করা যায় কী ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এসেছিল আমেরিকার অধিবাসীদের উপর!

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা সভ্যতায় আরও পিছিয়ে ছিল। ইউরোপ বিশেষত ব্রিটিশদের হাতে তাদেরও একই পরিণতি হল। ১৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে সেখানে ব্রিটিশদের আগমন এবং উপনিবেশীকরণ সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের ধ্বংস ঘটাল। সেখানে লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে হত্যা করা কিংবা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হল নানানভাবে। গুলি করে, অনাহার এবং রোগের মুখে ঠেলে দিয়ে। যে কায়দায় আমেরিকার অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এখানেও প্রায় একই কায়দায় তাদেরকে ধ্বংস করা হয়।

এভাবে আদিবাসীদের উৎসাদন করে ইউরোপীয়রা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশকে তাদের বাসভূমিতে পরিণত করল। আফ্রিকার আদিবাসীরা অতটা দুর্ভাগা হয় নাই তার জলবায়ু ইউরোপীয়দের নিকট পছন্দনীয় বা বাসের অনুকূল না হওয়ায়। তবু সেখানেও ধ্বংস ও মৃত্যু কম হয় নাই। বিশেষ করে আরব এবং আফ্রিকার মুসলিম দাস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আফ্রিকার লক্ষ লক্ষ নিগ্রোকে আমেরিকায় দাস শ্রমিক হিসাবে ধরে নেওয়া হল।

আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আফ্রিকা থেকে যে পরিমাণ মানুষকে বন্দী করে দাস হিসাবে জাহাজে করে দুই আমেরিকা মহাদেশে চালান দেওয়া হয় তার এক হিসাব থেকে জানা যায় যে, ১৫২৫ থেকে ১৮৬৬ পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লক্ষ আফ্রিকানকে আমেরিকা তথা নূতন পৃথিবীতে দাস হিসাবে পাঠানো হয়। কিন্তু যাত্রাপথের অবর্ণনীয় কষ্টে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। ফলে যারা আমেরিকার মহাদেশ দুইটি এবং ক্যারিবীয় দ্বীপগুলিতে পৌঁছাতে পেরেছিল তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৭ লক্ষে।

এ হল শুধু দাস ব্যবসার চিত্র। কিন্তু আফ্রিকার অভ্যন্তরেও বিভিন্ন কারণে ইউরোপীয়দের থাবায় কোটি কোটি মানুষ নির্মূল হল। বলা হয় শুধু কঙ্গোতেই বেলজিয়ান উপনিবেশবাদীরা ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত ২৩ বৎসর সময়ে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এক কোটি মানুষকে হত্যা করে। বেলজিয়ান উপনিবেশবাদীরা ১৮৮৫ থেকে ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই প্রায় ২৩ বৎসর সময়ের মধ্যে যদি কঙ্গোতে প্রায় এক কোটি মানুষকে হত্যা করতে পারে তবে সমগ্র আফ্রিকায় ব্রিটিশসহ অন্য ইউরোপীয়রা কী পরিমাণ মানুষকে হত্যা করেছে অথবা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে তা কিছুটা হলেও অনুমান করা চলে। এছাড়া আফ্রিকায় যেখানে পছন্দ হয়েছে সেখানে স্থানীয়দের উৎখাত করে শ্বেতাঙ্গদের বাসভূমি স্থাপন করা হয়। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকায় করা হয়েছিল। তবু আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের তুলনায় আফ্রিকার আদিবাসীরা অনেক ভাগ্যবান যে তারা নির্মূল বা প্রায় নির্মূল হয় নাই।

এশিয়ার অধিবাসীদেরকেও এক অর্থে ভাগ্যবান বলতে হবে। এখানে স্থানীয় সভ্যতাগুলির ইউরোপীয় আগ্রাসনের ধ্বংসলীলাকে প্রতিহত করে টিকে থাকবার উপযোগী শক্তি থাকার ফলে আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরা যে ধরনের গণহত্যা ও স্থানীয় অধিবাসীদের নির্মূল করতে পেরেছিল সেভাবে এখানে তা করতে পারে নাই। তবু যেটুকু ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল তার একটা খণ্ডচিত্র হিসাবে বাংলার কথা কিছু আগে বলেছি।

অথচ খ্রীষ্টধর্ম কিংবা খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সঙ্গে এমন আচরণ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আসলে এভাবে সূচনা হল আধুনিক পুঁজিবাদের পথে পাশ্চাত্যের যাত্রার। আর তার সূচনা এমনই বীভৎস। স্পেন প্রদর্শিত হত্যা ও ধ্বংসের পথ ধরেই কম আর বেশী এগিয়ে গেল পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ইত্যাদি ইউরোপের দেশগুলি। তবে এই সঙ্গে এটাও আমাদের চিন্তায় রাখা দরকার যে, অখ্রীষ্টান সমাজগুলির উপর এই ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অখ্রীষ্টান ও অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি ঘৃণা অথবা নির্লিপ্ততা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে ভূমিকা রেখেছিল। সুতরাং এর ভিতরে শুধু যে পুঁজির লোভ ও মুনাফাবৃত্তি ছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু ছিল খ্রীষ্টান সাম্প্রদায়িকতাবাদ এবং শ্বেতবর্ণবাদও। যাইহোক, পুনরুক্তি করে বলতে হয় পৃথিবীর বহু সংখ্যক জাতি ও জনগোষ্ঠীর জন্য ইউরোপের এই অগ্রযাত্রা মৃত্যু ও ধ্বংস নিয়ে এসেছিল, কখনও সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সম্পূর্ণ জাতিগত বিনাশ ও বিলুপ্তি।

বিশেষত এটা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এই ইউরোপ খ্রীষ্টধর্মকে গৌণ কিংবা বর্জন করতে গিয়ে তার অনেক পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা ও অন্ধত্বের সঙ্গে তার অনেক মানবিক গুণাবলীকেও বর্জন করল। বৌদ্ধধর্মের মতো ত্যাগ, সেবা ও সংযমের প্রতি অনুরাগ খ্রীষ্টান ধর্মের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিশেষত মানুষের প্রতি ভালবাসা বা প্রেম খ্রীষ্টীয় চেতনার গভীরে প্রোথিত। ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস মানুষের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষত ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে বিরাট বাধার পাহাড় হয়ে থাকে। সুতরাং ধর্মের নিয়ন্ত্রণ থেকে মানুষের মুক্তির প্রয়োজন আছে। কিন্তু বৌদ্ধ বা খ্রীষ্ট ধর্মের মতো ধর্মগুলি মানবিক কল্যাণের জন্য যেসব নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দিয়েছে ধর্মকে গৌণ অথবা বর্জন করতে গিয়ে সেগুলির সবকিছুকে অন্ধভাবে ও নির্বিচারে পরিত্যাগ করা মানুষের জন্য অকল্যাণের কারণ যে হতে পারে তার দৃষ্টান্ত ইউরোপ স্থাপন করেছে। এমন সেকিউলারিজম কিংবা ধর্মমুক্তি নিশ্চয় আমাদের কাম্য হতে পারে না যা মানুষকে তার মানবিক গুণাবলীর বন্ধন থেকে মুক্ত করে তাকে দানবীয় সত্তায় পরিণত করবে।

ধর্ম থেকে বস্তু জীবন ও রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে যে ইউরোপ জাগল সেই ইউরোপ যেন খ্রীষ্টীয় চেতনার ভিতরের মানবিক সারবস্তুকেও নাকচ ক’রে বিশেষ করে ভিন্ন সমাজগুলির প্রতি দানবিক প্রকৃতি ও রূপ নিয়ে আবির্ভূত হল। খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধের বন্ধনমুক্ত পাশ্চাত্যের অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ মানুষকে ভোগবাদ শিখাতে গিয়ে মানুষকে নির্বিবেকও করল। পণ্যের দাস করল মানুষকে। এ যেন ইসলামের আরেক রূপে পুনরুত্থান। এই পুঁজিবাদ যেন ইসলামের সন্তান। ইসলামের লোভ, ভোগবাদ, নারী সম্ভোগবাদ যেন পরিবর্তিত ও ভিন্ন রূপে প্রত্যাবর্তন করেছে। ইসলাম এবং পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।

ইসলামের মূল প্রেরণা ভোগ - মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালী ও ধনীর জন্য ইহকালে যথেচ্ছ ভোগের আয়োজন এবং পরকালেও যথেচ্ছ ভোগের প্রতিশ্রুতি, আর দুর্বল ও দরিদ্র বহুসংখ্যকের জন্য শুধু পরকালে ভোগের প্রতিশ্রুতি এবং ইহকালে শুধুই বঞ্চনা। পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের প্রেরণাও ভোগ, যথেচ্ছ ভোগ - পাশ্চাত্যের সমাজগুলির বহু সংখ্যক মানুষদের জন্য রয়েছে সেই ভোগের বন্দোবস্ত; আর সাবেক উপনিবেশ ও পশ্চাৎপদ দেশ ও সমাজগুলির বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য পাশ্চাত্যের পথ অনুসরণ করে উন্নয়নের মাধ্যমে যথেচ্ছ ভোগের স্বপ্ন অথবা পাশ্চাত্যে অভিবাসনের মাধ্যমে এই ভোগের স্বপ্ন। এই ভোগের জন্য যেখানে ইসলাম দিয়েছে ঈশ্বর বা সর্বশক্তিমান সত্তার কল্পনা হিসাবে আল্লাহর দাসত্বের প্রেরণা. পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ সেখানে দিয়েছে অবাধ বাজারের তথা মুনাফার দাসত্বের প্রেরণা। অর্থাৎ ইসলামের ঈশ্বর যেখানে আল্লাহ্, পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের ঈশ্বর সেখানে মুনাফা। উভয়ই সর্বশক্তিমান এবং একমাত্র উপাস্য, কারণ উভয়ই অকৃপণ হস্তে, নির্বিচারে ভোগের যোগান কিংবা সেই যোগান দিবার প্রতিশ্রুতি দেয় তার দাসদেরকে তার ইচ্ছামতো।

ভোগ ও সম্ভোগের চেতনায় ইসলাম ও পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের মধ্যে বিস্ময়কর মিল। উভয়ই নির্বিচার ও অসংযত ভোগবাদী। নারীকেও উভয়েই ভোগ্যবস্তু করেছে। তবে সভ্যতার সঙ্কটের পরিস্থিতিতে ইসলাম এসেছিল বলে নীচতলার আমজনতার অবর্ণনীয় বঞ্চনার বিনিময়ে তা যথেচ্ছ ভোগের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল উপর তলার মুষ্টিমেয় ক্ষমতাসীন পুরুষদের জন্য। সেই ভোগ ছিল উন্মত্ত ও ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি এবং বিশেষ করে নারীর প্রতি। পাশ্চাত্য পুঁজিবাদও উন্মত্ত ও ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি। তবে একটা পর্যায় পর্যন্ত সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হওয়ায় এই পুঁজিবাদ পাশ্চাত্যে ভোগ-সম্ভোগকে বহুর আয়ত্তে এনে দিয়েছে। তবে তত্ত্বে সেখানে নারী পুরুষের সমান এবং স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবে নারী সেখানে পণ্য। এই পণ্যকে পুরুষ ভোগ করে। তবে নারী সেখানে ইসলামের মতো এক পুরুষের ভোগ্য না থেকে বহু পুরুষের ভোগ্য হবার স্বাধীনতা ভোগ করে।

এটা ঠিক যে পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ এক সময় যে রূপ নিয়ে ছিল তা এখন আর ঠিক সেভাবে নাই। সেখানে এখন তার বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মৌল চরিত্রে তেমন পরিবর্তন ঘটেছে এ কথা মনে করার কারণ নাই। এটা ঠিক যে উপনিবেশ লুণ্ঠন ও শোষণের মধ্য দিয়ে এবং পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে উন্নয়নের যে ভিত্তি সেখানকার সমাজগুলি নির্মাণ করতে পেরেছে তার ফলে এখন সেখানে সেখানকার জনগণকে পূর্বের মত শোষণ ও বঞ্চনার প্রয়োজন যেমন হয় না তেমন তাদেরকে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয়।

তবে পুঁজিবাদের যে বিকাশ প্রক্রিয়ার কথা এর আগে বলেছি তার ধারাবাহিকতাকে আমাদেরকে হিসাবে নিতে হবে। বিশেষত বাইরের সমাজ ও পৃথিবীর জন্য তার চরিত্রে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। সবচেয়ে বড় কথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে যে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে সেটার আধিপত্য আমাদের মতো সমাজগুলির বিকাশের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই সহায়ক হয় না। তার আধিপত্য অথবা প্রাধান্যের মধ্যে অতীতের সাম্রাজ্যবাদী কিংবা উপনিবেশবাদী কালের অনেক বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের মতো পাশ্চাত্য নির্ভর এবং দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ সমাজগুলির বিপুল সংখ্যক মানুষ পুঁজিবাদের এই ব্যবস্থায় অবর্ণনীয় বঞ্চনা, দারিদ্র্য, নির্যাতন এবং অমানবিকতার শিকার হয়ে থাকে।

পাশ্চাত্যের এই পুঁজিবাদ তার দৃকপাতহীন মুনাফাবৃত্তির দ্বারা পৃথিবী নামক এই গ্রহকে দূষিত করে মানুষের বাসের অযোগ্য করছে, যুদ্ধ নির্ভরতা দিয়ে পরমাণু প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। সুতরাং ইসলামের বিপরীতে পাশ্চাত্যের এই পুঁজিবাদ যেমন আমাদের নিকট সমাজ ও সভ্যতার আদর্শ রূপ হতে পারে না তেমন তার মূল্যবোধসহ বহু কিছুকেই আমাদের নূতন দৃষ্টিতে বিচার করতে হবে। আধুনিকতার নামে কোনও বিষয়েই আমাদের পাশ্চাত্যের কিংবা কারোরই অন্ধ অনুসারী কিংবা পূজারী হবার প্রয়োজন নাই।

এ প্রসঙ্গে এটা বলার প্রয়োজন বোধ করছি যে, অনিয়ন্ত্রিত বা নিরঙ্কুশ ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজিবাদ যেমন গ্রহণযোগ্য নয় তেমন অনিয়ন্ত্রিত অথবা নিরঙ্কুশ সমাজতন্ত্রও গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদেরকে এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে যখন যেদিকে বেশী জোর দেওয়া দরকার হবে তখন সেদিকে আমরা জোর দিতে পারি।

বিশেষত পরমাণু প্রযুক্তির এই যুগে যুদ্ধ নির্ভর ইসলামের সংস্কৃতির মতো যুদ্ধ নির্ভর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের সংস্কৃতি থেকেও মুক্তি মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। এই পুঁজিবাদের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্য এমনইভাবে জড়িয়ে আছে যে চাইলেও তাদের পক্ষে এখান থেকে সরে এসে নূতন পথ নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন। অন্যরা পথ দেখালে হয়ত তারা বাধ্য হয়ে সে পথে যাবে। কিন্তু তাদের পক্ষে অন্তত এখন নূতন পথের পথিকৃৎ হওয়া সম্ভব নয়। অথচ পথের পরিবর্তন মানুষের অস্তিত্বের জন্যই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

অবশ্য এখানে এ কথা বলা উচিত হবে না যে, পাশ্চাত্যেও বিকল্প সন্ধান নাই। সেখানেও সর্বদা কিছু সংখ্যক মানুষ বিদ্যমান সভ্যতা ও ব্যবস্থার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সোচ্চার থাকেন এবং সেই সব ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে তাদের লড়াইও অব্যাহত রাখেন। বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প নিয়েও সেখানে অনেক ভাবনা আছে যেগুলি থেকে আমরা অনেক কিছু শিক্ষণীয় পেতে পারি। এটা ভুললে চলবে না যে, আধুনিক সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ধারণারও উদ্ভব ইউরোপ বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ থেকে। নারীর অধিকার ও সমতা সংক্রান্ত আধুনিক কালের ভাবনাগুলিও প্রধানত সেখানকার সমাজ থেকে উদ্ভূত। এগুলি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও সেখানে হয়েছে কিংবা হচ্ছে। সেখানে আধুনিক কালে সবুজ আন্দোলন বা ‘গ্রীন মুভমেন্ট’ নামে একটি জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে উঠেছে যেখানে আধুনিক মুনাফা সর্বস্ব পুঁজিবাদেরও বিকল্প সন্ধান করা হচ্ছে। কিন্তু পাশ্চাত্য থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ধারণার প্রায়োগিক সীমাবদ্ধতার দিকটিকেও আমাদের বুঝতে হবে। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে ব্যবস্থা সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে এবং একই সঙ্গে যা দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবী ব্যাপী তার ভাবাদর্শিক ও বাস্তব আধিপত্য অথবা প্রাধান্যের উপর ভিত্তি করে সেই ভিত্তি তাকে ধরে রাখতে চায় পিছন দিকে এবং তার আরও সামনের দিকে অগ্রগমনের পথে বাধা হয়ে থাকে।

বস্তুত একটা ব্যবস্থা একবার প্রতিষ্ঠিত হলে তার স্থিতির সঙ্গে জড়িত হয় কোন না কোনও ভাবে বহু সংখ্যক মানুষের স্বার্থ অথবা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ধারণা বা আকাঙ্ক্ষা। ফলে নূতন কোনও ধারণা যেখান থেকেই উদ্ভূত হোক তার বাস্তবায়নটা ঘটে সাধারণত অধিকতর পিছিয়ে থাকা কোনও সমাজে। এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় ধারণা বা চিন্তাও তার আদিরূপে থাকে না। সমাজ বাস্তবতাজাত অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োগ প্রক্রিয়ার ভিন্নতা সেখানে অনেক ভিন্নতা আনে। এই বাস্তবতার মূর্ত একটি উদাহরণ হতে পারে পশ্চিম ইউরোপ থেকে উদ্ভূত মার্কসবাদ। একটা বিপ্লবী তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদের ব্যবহার পশ্চিম ইউরোপে না হলেও পূর্ব ইউরোপ বিশেষত রাশিয়ায় হয়েছিল। কিন্তু সেটার সঙ্গে মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা মার্কস-এঙ্গেলসের কল্পিত সমাজতান্ত্রিক সমাজের কতটুকু মিল ছিল সেই প্রশ্ন করা যায়। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিম ইউরোপেও মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট এবং বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রভাবে জনকল্যাণবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠে তার সঙ্গে যে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের বিশেষ কোনও সম্পর্ক ছিল না কিংবা নাই সেটা সর্বজন বিদিত। অর্থাৎ সমাজ বাস্তবতার ভিন্নতা পশ্চিম ইউরোপকে সমাজতন্ত্রের ভিন্ন ধরনের অনুশীলনে নিয়ে গেছে। আমরা রাশিয়া, চীন, ভিয়েৎনাম, কিউবা ইত্যাদি দেশের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই যার যার সমাজের বাস্তবতা অনুযায়ী সমাজতন্ত্রের অনুশীলনে ভিন্নতা।

সুতরাং পশ্চিম ইউরোপ বা উন্নত দেশগুলির অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিজাত বিভিন্ন ধারণা বা চিন্তা আমাদের সামনে পাথেয় হিসাবে থাকতে পারে। উন্নত ও আধুনিক শিল্প-সভ্যতা নির্মাণে সবার অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিক্ষা নিব। কিন্তু পথটা আমাদের। এভাবে দেখা যাবে যে, স্বাধীনভাবে আমাদের সমাজের উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে আমরা আমাদের উন্নয়নের নিজস্ব পথ নির্মাণ করছি যা আবার অনেকের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে।

আজ সভ্যতাকে নূতন পথের দিকে নিতে হবে। এবং সে পথ এখন আমাদেরকে বের করার উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যমান পুঁজিবাদী ধারায় যে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব অথবা বিকাশ ঘটেছে আমাদের পশ্চাৎপদতার কারণে সেখানে আমাদের অবস্থান গৌণ। ফলে নূতন পথে সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রচলিত সভ্যতার অনেক নেতিবাচক দিকের সঙ্গে আমাদের পক্ষে ছেদ ঘটানো সহজতর হবে। এভাবে আমরা গড়ে তুলব নূতন সভ্যতা। তবে তার প্রথম শর্ত ইসলাম থেকে মুক্তি। আর সে কাজটা আমরা তখনই করতে পারব যখন আমরা ইসলামের স্বরূপকে চিনতে বা বুঝতে পারব।

ইতিপূর্বে যে কথা বলেছি সে কথার জের টেনে বলি ইসলামকে আর সব সামাজিক ধর্মের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে ভুল হবে। এটাকে চিনতে হবে ধর্মের আবরণে মূলত একটি স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কী যুদ্ধবাজ রাজনীতি হিসাবে, যা আপাদমস্তক নারী লোলুপ অথচ চরমভাবে নারী বিদ্বেষী। তাই নারীর স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে নারী সম্ভোগেও তার আনন্দ বা তৃপ্তি নাই, তার আনন্দ বা তৃপ্তি নারীর উপর জবরদস্তিমূলক ধর্ষণে। সে পথও দেখিয়ে গেছে মুসলিমদের নবী। যে দিন তিনি রায়হানার চোখের সামনে তার স্বামী, ভাই এবং পিতাকে হত্যা করেন সে দিন রাতেই তিনি এই নারীকে ধর্ষণ করেন। সাফিয়ার ক্ষেত্রেও তিনি একই রকম নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটান। এই রকম এক অমানুষ এবং বিকৃতকাম ধর্ষক যাদের নবী এবং আদর্শ পুরুষ সেই মুসলিমদের চেতনার মান কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই রকম এক বাস্তবতায় ইসলামকে চিনতে হবে একটি মানবিক সমাজ এবং একটি লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসাবে। যদি তা-ই হয় তবে তার বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই চালাবার দায়িত্ব ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধারায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র হিসাবে বিশেষভাবে বাংলাদেশের উপর এসে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে এই বিষয়ও স্পষ্ট করা দরকার যে, ইসলাম থেকে মুক্তির লড়াইকে কোনও কার্যকর রূপ দান করা রাষ্ট্র্রের সমর্থন ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমান যুগ ও বিশ্বপরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ইসলামের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে সমাজ অভ্যন্তরে কিছু ধারণার প্রসার ঘটানো যেতে পারে। এরও মূল্য বা প্রয়োজন আছে। তবে তার গতি হবে খুব ধীর। একটা পর্যায় পর্যন্ত তার কার্যকরতা থাকলেও একটা পর্যায়ের পর তা আর সময়ের দাবী পূরণ করতে পারবে না।

ইসলাম থেকে মুক্তির জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশ্নে দুইটি বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে ইসলাম কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করেছিল মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের যাত্রা রাষ্ট্র ক্ষমতা তথা বলপ্রয়োগের ক্ষমতা হাতে নিয়ে। এই বাস্তবতার তাৎপর্য অপরিমেয়। এটা না বুঝলে ইসলামকে বুঝা যাবে না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুসলিমদের গড় চেতনার মান অবিশ্বাস্যভাবে নীচু। এটাকে হিংস্র গুহামানবীয় চেতনা ছাড়া আর কোনও তুলনা দিয়েই সঠিকভাবে বুঝা বা বুঝানো যায় না। এই রকম অবস্থায় সাধারণ মুসলিমদের চেতনার কাছে ধর্মের প্রশ্নে শুধু যুক্তিবুদ্ধি কোনও আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে এটা মনে করলে নিদারুণ ভুল করা হবে। যুক্তির ভাষাই তারা বুঝতে পারবে না কিংবা তাকে তারা কোনও গুরুত্বই দিবে না বা শুনবে না যদি তারা যুক্তির পিছনে বা সাথে বলপ্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন শক্তিকে দেখতে না পায়। যুক্তির পাশে তাদের চোখের সামনে থাকতে হবে সামরিক শক্তির উপস্থিতি, যার ভাষা তারা ঐতিহাসিকভাবেই বুঝতে অভ্যস্ত।

এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে সাধারণ মুসলমানের কাছে জ্ঞানের কোনও মূল্য নাই যদি সেই জ্ঞানের পিছনে দেশী হোক বিদেশী হোক শক্তি বা ক্ষমতার সমর্থন বা পোষকতা না থাকে। এই কারণে কোনও ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞান তথা ধর্মশাসিত বা ধর্মাশ্রিত জ্ঞানের বাইরে আর কোনও জ্ঞানের প্রসার তেমন একটা ঘটে না। সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনও সামাজিক উদ্যোগই রক্ষা কিংবা প্রসার লাভ করে না। সেই পৃষ্ঠপোষকতা সমাজ করে না বলে জ্ঞানের জগতে সাধারণভাবে মুসলিমরা এত দেউলিয়া। জ্ঞান চর্চা একেবারে হয় না তা নয়। তবে সেটা হয় দেশী হোক বিদেশী হোক শাসক অথবা ক্ষমতাশালীদের স্বার্থের প্রয়োজনে।  

এই কারণে মুসলিম পৃথিবীতে ভিতরের পরিবর্তনগুলি সাধারণভাবে হয়েছে উপর থেকে। রাষ্ট্রের অধিকর্তা শক্তি বা শ্রেণীগুলির প্রয়োজনে। মুসলিম পৃথিবীতে ভিতর থেকে প্রথম যে রাষ্ট্রকে ধর্ম তথা ইসলাম থেকে মুক্ত করা হয়েছিল সেটা হচ্ছে ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত তুরস্ক। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর সেনানায়ক কামাল পাশা তুরস্ককে ধ্বংস ও পাশ্চাত্যের অধীনতা থেকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতার সাহায্য নিয়ে ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে খেলাফত উচ্ছেদের মাধ্যমে ইসলামী শাসনের শেষ চিহ্নটুকুরও অবসান ঘটান। এর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল আরও কিছু সংস্কার যেগুলি তিনি আধুনিক তুরস্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পন্ন করেন।

এটা ঠিক যে প্রায় শতাব্দী কাল পর শেষ পর্যন্ত পুনরায় সেখানে ইসলামবাদী শক্তি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে। ২০০২ খ্রীষ্টাব্দে এরদোগানের নেতৃত্বে ইসলামবাদীরা তুরস্কের সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে আজ অবধি নির্বাচনে (২০০২, ২০০৭, ২০১১ এবং ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দের ১ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসহ সব কয়টি নির্বাচনে) জয়লাভের মাধ্যমে ক্ষমতায় আছে।

এই ঘটনা থেকে অনেক কিছু শিখবার আছে। এটা সম্ভব হয়েছিল ইসলামকে বিশেষত খ্রীষ্টধর্মের মতো দেখবার কারণে যথাযথ পদক্ষেপ না দেওয়ায়। কামাল পাশা যেটা করেছিলেন সেটা হচ্ছে ইউরোপে ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে পৃথক ও স্বাধীন করে নিবার অভিজ্ঞতার অনুকরণ। সমাজকেও ইসলাম ধর্ম থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে যে পদক্ষেপ দেওয়া উচিত ছিল সেটা তিনি দিতে পারেন নাই। তবে এটা তো আসলে একজন ব্যক্তির চাওয়ার ব্যাপার নয়। এর জন্য ইসলামী সমাজের অভ্যন্তর থেকে বহু সংখ্যক মানুষ কর্তৃক দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যে মতাদর্শিক সংগ্রাম গড়ে তুলবার প্রয়োজন থাকে সেটা সে কালে কীভাবে সম্ভব ছিল? আর সংগ্রামটা যেখানে ইসলামের বিরুদ্ধে যায় সেখানে সে কালে এটা আশা করা অযৌক্তিক। সুতরাং কামাল যা করেছিলেন কাল প্রেক্ষিতে সেটারই মূল্য অনেক। যাইহোক, এটা এমন একটা অভিজ্ঞতা যা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে ।

আধুনিক সেকিউলার রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তথা সেকিউলারিজমের প্রয়োগ সম্পর্কে যে ধারণা বিস্তৃত হয়েছে তার উদ্ভব পশ্চিম ইউরোপে, যার পটভূমিতে আছে খ্রীষ্ট্রীয় সমাজ তথা খ্রীষ্টধর্ম। খ্রীষ্টধর্ম এবং ইসলাম যে প্রায় বিপরীত ধর্মী দুইটি ধর্ম এটা না বুঝবার ফলে ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার বহু প্রয়োগই মুসলিম সমাজে নানান সমস্যা সৃষ্টি করেছে অথবা ব্যর্থ হয়েছে। এই কারণে ইউরোপের অভিজ্ঞতার অনুসরণ বা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক বিবেচনার গুরুত্ব খুব বেশী।

এ কথা আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, খ্রীষ্টধর্ম সামরিক-রাজনৈতিক ধর্ম নয়। তার উদ্ভব অহিংস বা নিরস্ত্র সামাজিক আন্দোলন হিসাবে, বিকাশও সেভাবে। অনেক পরবর্তী কালে বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে যখন তা পোপের নেতৃত্বে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তখনও তা রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত হয় নাই। ফলে রাষ্ট্র প্রধান আর ধর্ম প্রধান যেমন একজনই হয় নাই তেমন রাষ্ট্র ও গীর্জাও একীভূত হয় নাই। রেনেসাঁ পরবর্তী কালে বিভিন্ন বিপ্লব ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকে যখন ধর্মের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করা হল তখন শুধু যে রাষ্ট্র লোকবাদী কিংবা ধর্মমুক্ত হল তা-ই নয়, অধিকন্তু সমাজেরও ধর্মমুক্তি তথা লোকবাদের পথে যাত্রা হল অনেকাংশে অবারিত। ধর্মের পক্ষে ও বিপক্ষে যে কোনও মত বা চিন্তা প্রচারের স্বাধীনতা তাই সেখানে প্রতিষ্ঠিত। যত দিন যাচ্ছে সেখানে মানুষের উপর থেকে ধর্মের প্রভাব ততই লোপ পাচ্ছে। এই সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে যে, খ্রীষ্টধর্ম রাজনৈতিক ধর্ম না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়িত্ব সব ক্ষেত্রে যে রাষ্ট্রকে নিতে হয় তা নয়। সেই সংগ্রাম তখন সমাজ বা সমাজের পক্ষ থেকে ব্যক্তি নিতে পারে।

অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় সমাজে ধর্ম ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবস্থান নিরপেক্ষ থাকলে সেটা ধর্মের জবরদস্তি থেকে ব্যক্তিকে নিরাপত্তা ও রক্ষা দিতে পারে। তখন ধর্ম পালন অথবা বিরোধিতা করার ব্যাপারটা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন হয়ে পড়ে। কিন্তু দাসত্বের চেতনা সৃষ্টিকারী ও সামরিক চরিত্র বিশিষ্ট রাজনৈতিক ধর্ম ইসলামের বিষয়টা এত সহজ নয়। দাস-চেতনার বিরুদ্ধতাকারীর প্রতি ভয়ঙ্করভাবে আক্রমণাত্মক ও সহিংস ইসলামে ব্যক্তি তথা ব্যক্তির স্বাধীনতা কোনও বিষয়ই নয়। রাষ্ট্র যদি ধর্মের প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান রাখতে গিয়ে ধর্মের সমালোচনাকারী ব্যক্তিকে রক্ষায় নিষ্ক্রিয় অবস্থান নেয় তাহলে সেই ব্যক্তি যে নির্মূল হবে এতে সামান্য সন্দেহের কারণও নাই।

এ কথা মনে রাখতে হবে যে, হিংস্র গুহামানবীয় এবং যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক ধর্ম ইসলামের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় পদ্ধতি আদৌ প্রযোজ্য নয়। এখানে ধর্ম বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিমেয়। অর্থাৎ সমাজকে ইসলামের দাসত্ব থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব এখানে শেষ বিচারে রাষ্ট্রের উপর এসে পড়ে। এই দায়িত্ব ব্যক্তির যতটা তার চেয়ে বেশী রাষ্ট্রের। কারণ একটা দীর্ঘ সময় ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যক্তিকে রক্ষার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে। সমাজ হবে ইসলামী আর রাষ্ট্র হবে লোকবাদী কিংবা ধর্ম মুক্ত এটা কল্পনা করা আর আকাশকুসুম কল্পনা করা এক কথা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে?

বহুকালের এত বিপুল অভিজ্ঞতার পরেও ইসলামী পৃথিবীতে মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন নীচ থেকে আমজনতার উপর নির্ভর করে আনবার কল্পনা নেহাতই বাস্তবতা বর্জিত। একটা ভয়ঙ্কর দাসত্বের ব্যবস্থায় আবদ্ধ চেতনার কাছ থেকে নিজ থেকে কী করে আমরা উন্নত জীবনের দিশা আশা করি? বরং যে শক্তির চাপে তা পঙ্গুত্ব বরণ করেছে সেই শক্তিকে পাল্টা শক্তির চাপে অপসারণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে একটা ধর্মের ভ্রূণ রূপে মক্কায় জন্ম নিলেও ইসলামের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছে মদীনায় আশ্রয় লাভের পর। মদীনা ছিল ইসলামের রাষ্ট্র। অর্থাৎ বিজয়ের পথ ধরে ইসলামের যাত্রা রাষ্ট্রের শক্তি হাতে নিয়ে। তাই ইসলাম থেকে মুসলিম সমাজেরও মুক্তির পথে প্রকৃত যাত্রা শুরু হতে পারে রাষ্ট্রের শক্তি নিয়ে। তখন এই ভয়কাতর মানুষরা উঠে দাঁড়াবার, মুক্তভাবে চিন্তা করবার এবং আধুনিক যুগের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবার সাহস ফিরে পাবে। সেই পাল্টা শক্তির চাপটা রাষ্ট্র ছাড়া আর কে দিবে?


১৩। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশ

এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে, ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে শুদ্ধ ও বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তির লড়াই চালিয়ে এই ধর্মের অভিশাপ থেকে ইসলাম অধিকৃত জনসমাজকে মুক্ত করা অসম্ভব। মনে রাখতে হবে ইসলাম শুধু একটা বিমূর্ত ধর্ম বিশ্বাস নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং বিধিবিধান ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা, যার মর্মে আছে আগ্রাসী আরবীয় ঐক্য, শ্রেষ্ঠত্বের বোধ এবং এই বোধের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রদান। ইসলাম হচ্ছে বাস্তবে হিংস্রতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আরব জাতীয়তাবাদের বাহন। ইসলাম হচ্ছে বর্বরদের আগ্রাসী একটা জাতি, একটা রাষ্ট্র এবং একটা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য কৃত সকল বর্বরতা, নৃশংসতা, অন্যায় ও স্বৈরতাকে গ্রহণযোগ্যতা দিবার উপযোগী একটা ধর্ম।

যে কথা এই আলোচনার শুরুর দিকে বলেছিলাম, ইসলামের মর্মে আছে আগ্রাসী এবং নিরঙ্কুশভাবে আধিপত্যবাদী আরব জাতীয়তাবাদ এবং পরিণতিতে আরব সাম্রাজ্যবাদ। সুতরাং ইসলাম অধিকৃত সব অনারব সমাজেরই মুক্তির জন্য যার যার নিজস্ব ভাষা অথবা সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাবার দায়িত্ব এসে পড়ে ইসলাম থেকে মুক্তির সংগ্রাম যারা করছেন এবং করবেন তাদের সবার উপর। আজকের বাংলাদেশে আমাদের জন্য এই দিক থেকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ দেখা দেয় অপরিমেয় গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে।
   
বস্তুত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীতে যে আন্দোলন শুরু হয় তার ভিতর ছিল শুধু যে পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ তা-ই নয়, উপরন্তু ইসলাম ধর্মেরও ধ্বংসের বীজ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ছিল ইসলাম ধর্ম এবং তার পরিচয়। সেই পরিচয়কে অস্বীকার অথবা গৌণ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই প্রধানত বাঙ্গালী মুসলিমরা যখন ভাষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠা জাতি পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল তখনই শুধু পাকিস্তানের নয়, উপরন্তু ইসলাম ধর্মেরও মৃত্যুর বীজ বপন হয়েছিল। হয়ত তখনও ঘটনাটা সাধারণ বাঙ্গালী মুসলিমদের চেতনা বা বোধে ধরা দেয় নাই। কিন্তু ইতিহাস তো সর্বদা ব্যক্তি এমনকি জনগোষ্ঠীরও ইচ্ছাধীন বা আকাঙ্ক্ষাধীন থাকে না। পাকিস্তানের অবাঙ্গালী মুসলিম শাসকদের চাওয়ার বিরোধিতায় দাঁড়াতে গিয়ে বাঙ্গালী মুসলিম যে পথে পা বাড়ালো তা তাকে তার মুসলিম সত্তা থেকে তার বাঙ্গালী সত্তাকে বিযুক্ত বা বিচ্ছিন্ন করার দিকেই শুধু নিল না, উপরন্তু বিরোধাত্মক পরিণতির দিকেও নিল। পরিণতিতে বিভিন্ন জটিলতার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ এল, বাঙ্গালীর ধর্ম-পরিচয় মুক্ত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটা স্বাধীনতা যুদ্ধ হল এবং নয় মাস যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হল।

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা জাতি চেতনা তথা জাতীয়তাবাদের বিকাশ পাকিস্তান এবং ইসলামের আদর্শের পাল্টা হিসাবে কীভাবে লোকবাদী এবং ধর্মমুক্ত জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে তার উদাহরণ হিসাবে এখানে একুশে ফেব্রুয়ারী এবং পহেলা বৈশাখের কথা উল্লেখ করা যায়। সুতরাং এই দিবস দুইটি উদ্যাপনের প্রতি যে শুধু পাকিস্তান কালে ইসলামী শক্তিগুলির বিরুদ্ধতা ছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু সেই বিরুদ্ধতা আজ অবধি আমরা দেখতে পাই।

আসলে দিবস দুইটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে অলোকবাদী ইসলাম ধর্মের আবরণে রাখা আরব কেন্দ্রিক চেতনা ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর লোকবাদী জাতীয় চেতনার প্রতিরোধের শক্তি দাঁড়াতে চায়। তাই শহীদ মিনার যেন হয়ে উঠে আরবের কাবার বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর পাল্টা বিজয় অভিযানের দুর্গ। মক্কার কাবা কেন্দ্রিক আরাধনাকে চ্যালেঞ্জ ক’রে বঙ্গ ও বাঙ্গালী জাতির স্বকীয়তার প্রতীক হয়ে উঠে যেন একুশে ফেব্রুয়ারীর শহীদ মিনার এবং সেই সঙ্গে পহেলা বৈশাখ। এভাবে পাকিস্তান কালে পূর্ব বঙ্গে ভাষা, ভাষা ভিত্তিক জাতি চেতনা এবং তার সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ শুধু যে পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে তা-ই নয়, উপরন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের আদর্শিক উৎস ইসলামের বিরুদ্ধেও এক দুর্ভেদ্য রক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেছে। এই রক্ষা প্রাচীরের আড়াল থাকায় বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই ইসলাম এবং ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনা কম-বেশী সব সময় উচ্চারিত হয়েছে। বাধা থেকেছে, আঘাত এসেছে, বিপর্যয় ঘটেছে ধর্মদ্রোহীর, প্রাণও গেছে; কিন্তু ইসলাম ও ধর্মের অধীনতা থেকে মুক্তির লড়াই থেমে থাকে নাই। এদিক থেকে সমগ্র মুসলিম পৃথিবীতে বাংলাদেশ এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

এভাবে আমরা দেখতে পাই আমাদের সমাজে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভাষা-সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা পর্যায় শেষ হয়েছে মাত্র। একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানের ভাবাদর্শিক উৎস ইসলামের ভিত্তিকেও বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষত এর প্রভাবে শিক্ষিত শ্রেণীর ভিতরে ধর্মমুক্ত চেতনা বিস্তার লাভ করার জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছে। এটা ঠিক যে এর পাশাপাশি সমাজে ইসলামের প্রভাবও আপাত দৃষ্টিতে পাকিস্তান কালের তুলনায় অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেটা যেন আমাদের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন না করে। এটা এ দেশে ধর্ম এবং ইসলামের মৃত্যুর পূর্বেকার শেষ আক্ষেপ মাত্র।

আসলে পাকিস্তান কালে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশের নির্দিষ্ট গতিধারার মধ্যে ইসলামের মৃত্যুর বীজ যে পোঁতা হয়েছিল এই ঘটনার তাৎপর্যকে আমাদের বুঝতে হবে। যে কথা ইতিপূর্বে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছি সেটার পুনরুক্তি করে বলি ইসলামকে ধর্মের আবরণে মোড়া আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতি হিসাবে চিনতে পারতে হবে। সুতরাং অপ-রাজনীতি বলা যাক আর যা-ই বলা যাক ইসলামের মর্মে আছে রাজনীতি। এই কারণে শুদ্ধ বুদ্ধিচর্চা কিংবা যুক্তি দ্বারা ইসলামকে মোকাবিলা করা অসম্ভব। ইসলামকে মোকাবিলা করতে চাই পাল্টা রাজনীতি। এভাবেও বলা যায় ইসলামকে মোকাবিলার জন্য চাই পাল্টা রাষ্ট্র-চিন্তা। অর্থাৎ ইসলাম দ্বারা শাসিত জন-চেতনাকে ইসলাম উৎখাতের লড়াইয়ে উদ্দীপিত বা অনুপ্রাণিত করার জন্য চাই পাল্টা এবং উন্নততর ও মানবিক রাষ্ট্র চিন্তা। এই রাষ্ট্র চিন্তা বাংলাদেশের উদ্ভব প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল বলে বাঙ্গালী জাতির একটা লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ঘটা সম্ভব হয়েছিল। সেই লক্ষ্য কেন অর্জন হয় নাই, তার সমস্যাগুলি কোথায় বা কীভাবে ছিল সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। তবে সেই আলোচনার জায়গা এটা নয়।* কিন্তু এ কথা বলা যায় যে, ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার এই বহিঃপ্রকাশের তাৎপর্য অপরিমেয়। মুক্তিযুদ্ধ ইসলাম ও ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এমন একটি ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছে যার উপর দাঁড়িয়ে আগামী দিনে এ দেশে ইসলাম থেকে মানুষের মুক্তির লড়াই নবতর শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাবার শক্তি খুঁজে পাবে।

---------------------------------------------

* পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতির বিকাশের সমস্যাগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। তা না হলে বাংলাদেশের ইসলামীকরণ ও দুর্বৃত্তায়নের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আমি মনে করি। এ বিষয়ে আমি আমার বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধে আলোচনার চেষ্টা করেছি। এ প্রসঙ্গে কয়েকটির নাম এখানে উল্লেখ করা যায়, যেমন, রাজনীতির পুনর্বিন্যাস,

বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ভূমিকা (http://www.bangarashtra.net/article/1404.html),

মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক : ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিকের পত্রালাপ (http://www.bangarashtra.net/article/413.html),

বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়ন (http://www.bangarashtra.net/article/646.html),

বাংলাদেশের সঙ্কট (http://www.bangarashtra.net/article/466.html),

বাংলাদেশের সঙ্কট ও উত্তরণের পথ(http://www.bangarashtra.net/article/406.html),

বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্রঃ সমস্যা ও করণীয় (http://www.bangarashtra.net/article/1318.html),

মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বনাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি (http://www.bangarashtra.net/article/1480.html),

ইত্যাদি। সবগুলিই বঙ্গরাষ্ট্র (www.bangarashtra.net)-এ দেওয়া আছে। সংক্ষিপ্ত পাঠের জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বনাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি’ পাঠকদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে।
---------------------------------------------

কিন্তু আমাদেরকে একই সঙ্গে এ কথাও বুঝতে হবে যে, ইসলাম শুধু যে রাষ্ট্র-চিন্তা দিয়েছে তা নয় উপরন্তু সেই সাথে তা দিয়েছে আর দশটা ধর্মের মত সমাজ-চিন্তাও, যদিও তার সমাজ-চিন্তা অন্য ধর্মগুলি থেকে অনেক বিষয়েই ভিন্ন। বস্তুত ধর্মের অন্তর্গত প্রেরণা আসে বৃহত্তর পরিসরে মানুষকে মানুষের সাথে মিলাবার কিংবা আবদ্ধ করবার প্রয়োজন বোধ থেকে। কোনও বিশেষ ধর্মের জীবন ও জগৎ সংক্রান্ত কতকগুলি বিশ্বাস বা ধারণাকে অবলম্বন করে মানুষ যেমন ঐক্যবদ্ধ হয় তেমন সেই ঐক্যকে রক্ষার প্রয়োজনে কতকগুলি অভিন্ন আচার বা অনুষ্ঠান গড়ে তুলে। এভাবে ধর্মের মাধ্যমে মানুষ শুধু তার কল্পিত পরলৌকিক বা অলৌকিক জীবনের মুক্তির পথ পেতে চায় না, উপরন্তু কতকগুলি নীতি বা মূল্যবোধকে অবলম্বন করে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনও গড়ে তুলে।

তবে যে কথা বার বার বলেছি ইসলামের মর্মে আছে রাজনীতি তথা রাষ্ট্র-চিন্তা। এই জায়াগায় তা খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ ধর্মের মতো ধর্মগুলি থেকে ভিন্ন। তার আছে এমন সমাজ-চিন্তা যা তাকে এই দুই প্রধান ধর্ম থেকে অনেক ভিন্ন করেছে। অন্য দুই প্রধান ধর্মে সমাজ রাষ্ট্র থেকে দূরবর্তী অবস্থান নিয়ে গড়ে উঠায় রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে তা কখনও প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেও রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে তার একটা দূরত্ব কম-বেশী থেকে যায়। যেহেতু রাষ্ট্র এক অর্থে সমাজেরই সৃষ্টি কিংবা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে সমাজের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি, যেখানে সমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত প্রকাশ ঘটে, সেহেতু একটা সহিংস, যুদ্ধ নির্ভর, একনায়কী, স্বৈরাচারী এবং আক্রমণাত্মকভাবে পুরুষবাদী রাষ্ট্র গড়তে ইসলামকে এমন একটা সমাজ গড়তে হয়েছে যা এই ধরনের রাষ্ট্রের উপযোগী হবে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামে সমাজ ও রাষ্ট্র একই সঙ্গে স্বতন্ত্র এবং অভিন্ন সত্তা। সমাজ কখন রাষ্ট্র হয়ে উঠে এবং রাষ্ট্র কখন সমাজ হয়ে উঠে তা অনেক সময় বুঝা যায় না। ইসলামে সমাজ ও রাষ্ট্রের পার্থক্যের মধ্যে ঐক্য বা অভিন্নতার এই দিককে বুঝতে পারতে হবে। এই কারণে ঐতিহ্যিকভাবে নিয়ম অনুযায়ী একজন সক্ষম মুসলিম যে পেশায় নিয়োজিত থাকুক ধর্ম রক্ষা, প্রচার এবং প্রসারের জন্য তাকে অস্ত্র ধরার কিংবা যুদ্ধ করার জন্য সতত প্রস্তুত থাকতে হয়।

এর জন্য ধর্মচর্চার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কঠোরতা, নিষ্ঠুরতা বা নৃশংসতা, দৃঢ়বদ্ধ সামরিক শৃঙ্খলা এবং আক্রমণাত্মকতার উপযোগী মনন গড়ে তুলবার ও রক্ষা করবার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন মসজিদকে কেন্দ্র করে নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে সর্বদা এই মননের চর্চা করা হয়। আজকের যুগের এত সব পরিবর্তনের পরেও মসজিদ এবং নামায-রোযা-ঈদ-কোরবানী এবং ওয়াজসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই মননকে লালন করা হয়। দৈনিক পাঁচবার নিয়মিত নামায, বিশেষত মসজিদে সারিবদ্ধভাবে নামায অনুষ্ঠান এবং একমাস ব্যাপী সারাদিন উপবাস তথা রোযা পালন একটি দৃঢ় ও সুকুমারবৃত্তি অবদমনকারী এবং এক ধরনের সামরিক শৃঙ্খলায় সমাজকে আবদ্ধ করে রাখে। এছাড়া আছে গলায় পোচ দিয়ে পশুহত্যার নিষ্ঠুর নিয়ম যা মানুষের সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংস করে। বিশেষত ঈদুল আজহা বা কোরবানীর ঈদের সময় মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক আয়তনে যেভাবে গবাদি পশু হত্যা করা হয় তা ধর্মের নামে নৃশংসতার উন্মত্ত চর্চা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে নৃত্য, সঙ্গীত, কাব্য এবং শিল্পকলা বিশেষত প্রাণীর চিত্র ও ভাস্কর্য নির্মাণসহ যাবতীয় সুকুমার বৃত্তির প্রতি ধর্মের ঘৃণা ও বিধিনিষেধকে। এভাবে ধর্মের নামে ইসলাম সুকঠোর ও অনমনীয় শৃঙ্খলা এবং নির্মম-নিষ্ঠুর ও স্থূল মানসিকতা চর্চার মাধ্যমে মানুষের সমস্ত রকম মানবিক অনুভূতি ও যুক্তি-বুদ্ধি ধ্বংসের এক ভয়ঙ্কর যন্ত্র হিসাবে কাজ করে।

ইতিপূর্বে যে কথা বলেছি তার পুনরুক্তি করে বলতে হয় পাল্টা বলপ্রয়োগের শক্তি প্রদর্শন ছাড়া বিশ্বাসী মুসলিম মনকে আর কোনও কিছু দিয়ে বুঝানো যাবে না। যুক্তির প্রয়োজন আছে। কিন্তু শুধু যুক্তি দিয়ে কোনও কাজ হবে না। পাল্টা বলপ্রয়োগের ক্ষমতা প্রদর্শন অথবা প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করা ছাড়া মুসলিম মনকে যুক্তি-বুদ্ধি ও মানবিকতার পথে আনা অসম্ভব। কারণ কেবলমাত্র বলপ্রয়োগের ক্ষমতা বা অস্ত্রের ভাষাই তা বুঝতে অভ্যস্ত। এখন এই বলপ্রয়োগের ক্ষমতা গঠন ও প্রয়োগ ইসলামের রাজনীতির পাল্টা রাজনীতি গঠন করা ছাড়া আর কীভাবে সম্ভব? সুতরাং আমাদের দেশের বাস্তবতায় অন্তত প্রাথমিক পর্যায় হিসাবে এটা দেখা দেয় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাজনীতি হিসাবে, যার মর্মে আছে বাংলাদেশকে একটি লোকবাদী তথা ইসলাম বা ধর্ম থেকে মুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করার ভাবনা। একই সঙ্গে এই রাষ্ট্রটি এ দেশে বসবাসকারী অন্য সকল জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রতি স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অর্থাৎ এ দেশের বাস্তবতায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ হবে গণতান্ত্রিক এবং সকল জাতির সমাধিকার ভিত্তিক। সুতরাং লোকবাদী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের মর্মে আছে জাতিসমন্বয়বাদ বা জাতিসংঘবাদ। জাতি সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্রমে বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে।

এই রাষ্ট্রটি শুধু যে বাংলাদেশকে ইসলামের অভিশাপ থেকে মুক্ত করবে তা-ই নয়, উপরন্তু সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ এবং সমগ্র পৃথিবীকেও এবং বিশেষত মুসলিম পৃথিবীকে ইসলামের মত বর্বর, অমানবিক ও নিকৃষ্ট ধর্ম থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকবে। মানবতা এবং নারীত্বের প্রতি নিকৃষ্টতম অভিশাপ ও পাপ ইসলামকে উৎখাত সাধনের মাধ্যমেই মাত্র নবউত্থিত বাংলাদেশ-রাষ্ট্র ইতিহাসের প্রতি তার একান্ত প্রাথমিক অঙ্গীকারকে পূরণ করতে পারবে।

তবে এর জন্য শুরুতে দুইটি করণীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির যে ধর্মভিত্তিক বিভাজন ঘটেছিল সেটিকে নাকচ করার জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করা। এটা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কিনা কিংবা হলে কখন এবং কীভাবে হবে সেটা বড় কথা নয়। এটা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশকে ইসলাম থেকে মুক্ত এবং লোকবাদী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে একটি নীতিগত কিংবা নৈতিক বা আদর্শিক প্রশ্ন। এ ছাড়া পাকিস্তানের ইসলামী রাজনীতির উত্তরাধিকার থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা যাবে না। সুতরাং বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে রাখতে হবে। এরই অংশ এবং প্রধান শর্ত হিসাবে ১৯৪৭-এ ধর্মের ভিত্তিতে বাংলার বিভাজনের পর থেকে এই ভূমির যে সকল ভূমি সন্তানকে মুসলিম না হবার কারণে বাস্তুচ্যুত এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে তাদেরকে এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের সবাইকে এ দেশের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করে তাদের ইচ্ছা সাপেক্ষে এ দেশে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে।

অপরটি হচ্ছে নারীর মুক্তির লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর নিজস্ব ও স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এটা নারীর নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করবে যার প্রভাব পড়বে সমাজের নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রেও। প্রকৃতপক্ষে এটা পুরুষের ক্ষমতা ও মর্যাদার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতা ও মর্যাদাকে কেন্দ্র করে একটা নূতন সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের পথ সন্ধান মানব জাতিকে দিবে। এর পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেওয়া এখনও সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় যে, নারীর স্বতন্ত্র ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা পৃথিবীতে একটি নূতন ধরনের সমাজ বিপ্লব ঘটাবে।

বিশেষত ইসলাম থেকে মুক্তির সংগ্রাম শুরুর জন্য নারীর এই নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটা হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং ইসলামের বর্বরতার সবচেয়ে বড় শিকার নারীকে মুক্ত করা এবং এভাবে তাকে ইসলামের বিপক্ষে মুক্ত শক্তি হিসাবে দাঁড় করানো।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সমাজকে ইসলাম থেকে মুক্তির কাজে হাত দেওয়া যায় নাই বলেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভাবপ্রেরণা থেকে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই বিচ্যুতি। এটা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রেরও পুনর্গঠনের কাজ। ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ ছিল ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে পূর্ব বঙ্গের মানুষের মুক্তির বিপ্লব। পাকিস্তান থেকে মুক্তি হলেও ইসলামের অভিশাপ ও দুঃশাসন থেকে আমাদের মুক্তি আসে নাই।

এখন আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে বিপ্লবের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায় ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব। এটা শুরু করলে বাকী সব কাজেও হাত দেওয়া যাবে। এটা এক বিরাট সংগ্রামের বিষয়। আর আদর্শ বলা যাক, রাজনীতি বলা যাক, সব কিছু নির্মিত হয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সেই সংগ্রাম গড়ে তুলবার দায়িত্বটাই বাঙ্গালী জাতিকে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী সকল জাতিসত্তার মানুষকে এবং বাংলাদেশের পুনর্গঠিত রাষ্ট্রকে নিতে হবে। আমার বিবেচনায় আজকের যুগের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক করণীয় সম্পাদনের যোগ্যতা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের গতিধারায় আছে।

কিন্তু শুধু বাংলাদেশ বা বঙ্গের মানুষকে ইসলামের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার মধ্যে আমাদের প্রয়াস সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কারণ ইসলাম শুধু জাতীয় সমস্যা নয়, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যাও। বিশেষত ইসলাম অধিকৃত সমাজের মানুষ হিসাবে সেটা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সত্য। সমগ্র ইসলাম অধিকৃত পৃথিবীর মানবতা আমাদেরই মতো ইসলামের যাঁতাকলে অবিরাম নিষ্পেষিত হচ্ছে। আর মূলত এই ইসলামের কারণেই ইসলাম অধিকৃত পৃথিবীর মানুষরা অমানবিকতা ও পশ্চাৎপদতার ভিতর পড়ে থেকে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার আধিপত্যেরও সহজ শিকার হয়ে আছে। এভাবে তারা আজ অবধি সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের আধিপত্য, লুণ্ঠন, শোষণ ও অসম্মানের ব্যবস্থার সকল প্রকার ধারাবাহিকতাকে বহন করে নিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের ধারাবাহিকতাকে উচ্ছেদ করার জন্যও আজ প্রয়োজন ইসলামকে উচ্ছেদ করার। আজ সময় এসেছে দাসত্বের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার। ইসলাম তার অধিকৃত পৃথিবীতে আমাদের ভ্রাতা-ভগ্নীদেরকে দাসত্বের যে শৃঙ্খলে বন্দী করে রেখেছে সেই শৃঙ্খলকে সবলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তাদেরকে মুক্তির পথ দেখানো আমাদের সামনে অবশ্য পালনীয় ঐতিহাসিক কর্তব্য হয়ে রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আমাদের অঙ্গীকার হোক সমগ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে ইসলামকে উৎখাত ক’রে ইসলামের পাপ থেকে মানবতাকে মুক্ত করা। এই আশা আমরা করতে পারি যে, চৌদ্দশত বৎসরের অভিশাপ থেকে মানব জাতির মুক্তি এবং নারী ও পুরুষের সমাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মানুষের নূতন সভ্যতার যাত্রাপথ নির্মাণে ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বাংলাদেশের আবির্ভাব হবে পথিকৃতের ভূমিকায়। তবে এর জন্য অপরিহার্য হচ্ছে রাষ্ট্র বিপ্লবের মাধ্যমে বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবসান ঘটিয়ে এখানে ইসলাম থেকে মুক্ত এবং সর্বস্তরে জনগণের স্বশাসন ভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এটি হবে এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের পরিচালনায় বাঙ্গালীসহ এ দেশের সকল জাতিসত্তার মানুষ যেমন অংশ নিবে তেমন নারী তার নিজস্ব অধিকারের স্বীকৃতি স্বরূপ রাষ্ট্রের প্রতিটি নীতিনির্ধারক স্তরে পুরুষের পাশাপাশি স্বতন্ত্রভাবেও তার ভূমিকা রাখবে। এভাবে আমাদের সামনে রাষ্ট্র বিপ্লবের প্রশ্ন বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়। রাষ্ট্রের পরিবর্তন ছাড়া যে সেকিউলার কিংবা ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় তার প্রমাণ হচ্ছে বাংলাদেশ। কেন এ কথা বলছি তা বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকেই স্পষ্ট হয়।


১৪। বাংলাদেশে রাষ্ট্র–বিপ্লবের তাৎপর্য

এই গ্রন্থের আলোচনায় আমি এ কথা স্পষ্ট করতে চেয়েছি যে, ইসলাম শুধু যে একটা অমানবিক, বর্বর এবং নারী নিগ্রহী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে তা-ই নয়, উপরন্তু এই ধরনের সমাজের উপযোগী একটা রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করে। সুতরাং ইসলামে সমাজ চিন্তার পাশাপাশি রাষ্ট্র চিন্তাও আছে। ইসলামে বরং এই রাষ্ট্র চিন্তার গুরুত্ব অনেক বেশী। কারণ ইসলাম তার জিহাদী ও নারী নিগ্রহী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। একবার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তা জিহাদ বা যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী তার বর্বরতাপূর্ণ এবং নারী নিগ্রহী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হয়। এইভাবে যুদ্ধজয়ী অভিযানের মাধ্যমে অমুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে পরাজিত ও ধ্বংস এবং অমুসলিম সমাজগুলিকে অধীনস্থ এবং অতঃপর বাধ্যতামূলকভাবে ইসলামে দীক্ষিত করাই ইসলামের লক্ষ্য। এই প্রশ্নে কুরআন এবং হাদীস যেমন অকপট তেমন ইসলামের ১৪ শত বৎসরের ইতিহাসও এই বক্তব্যের সত্যতার সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। এই কারণে ইসলামকে মোকাবিলা করতে হলে ইসলামের পাল্টা বা বিকল্প রাষ্ট্র চিন্তার গুরুত্ব এত বেশী।

সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আমরা যখন ইসলাম থেকে মুক্তির পথ অনুসন্ধান করি তখন বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রটি আছে তার স্বরূপ সন্ধান যেমন গুরুত্বপূর্ণ হয় তেমন তার বিকল্প রাষ্ট্রের রূপরেখাকেও আমাদের সামনে উপস্থিত করতে হয়। রাষ্ট্র প্রসঙ্গে প্রথমেই যে কথা বলা অত্যাবশ্যক তা হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্রকে যেন আমরা দেশের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি। রাষ্ট্র একটি দেশ বা ভূণ্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তা মূলত একটি শাসনযন্ত্র, যা ঐ দেশ বা ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জন্য যে ধরনের হোক একটি শাসন বা নিয়ন্ত্রণ মূলক ব্যবস্থাকে রক্ষা এবং পরিচালনা করে। সহজভাবে বললে এই দাঁড়ায় যে, আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, সেনা তথা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং সরকার একটি রাষ্ট্রের মূল উপাদান হিসাবে কাজ করে। অর্থাৎ সহজ ভাষায় রাষ্ট্র হচ্ছে শাসন যন্ত্র। এটি সমাজের স্বশাসন এবং ক্ষমতা প্রয়োগের কেন্দ্রীভূত অভিব্যক্তি হতে পারে আবার বাহির থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে চাপানো বা সম্পূর্ণরূপে বহিরারোপিতও হতে পারে।  

এখন এই প্রশ্নে আসা যাক যে, গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গভুক্ত অঞ্চলের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি কীভাবে গঠিত হয়েছে। এ কথা বলা হয় যে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কি এই রাষ্ট্র স্বাধীন সত্তার কোনও ইঙ্গিত দেয়? যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হলেও এই রাষ্ট্র পশ্চিমাদের বাদ দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর সবকিছুকে হুবহু রেখে দিয়েছে। আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন শুধু নয়, এমনকি পাকিস্তানী সেনা কাঠামোকেও রক্ষা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে বলা হলেও পাকিস্তানী সেনা কাঠামো বহির্ভূত মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। বরং যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তাদেরকে নিরস্ত্র এবং ছত্রভঙ্গ করলেন। শুধু তাই নয, তিনি পাকিস্তানী সেনা কাঠামোর ধারাবাহিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যেসব বাঙ্গালী সদস্য দেশে ফিরে এল মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করা সত্ত্বেও তাদেরকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে পুনর্বহাল করলেন। এভাবে শেখ মুজিব পুরাতন পাকিস্তানী আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে পুনঃপ্রতিষ্টিত করলেন। সুতরাং যে সংবিধান দেওয়া হল তাতে চার মূল নীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকিউলারিজমের কথা বলা হলেও তা ছিল প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন। ইতিহাস প্রমাণ করেছে এগুলি ছিল তখনও ক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে প্রতারণার হাতিয়ার।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিব দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রায় ভেঙ্গে পড়া পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে মেরামত এবং পুনর্গঠন করলেন। এভাবে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের ধর্মীয় ভিত্তিকেও রক্ষা করলেন। গ্রন্থের শুরুতে যে কথা বলেছি তার কিছু পুনরুক্তি করে বলতে হয় যে, তার অন্যান্য কর্মকাণ্ডও পাকিস্তানের ব্যবহারিক এবং ধর্মীয় আদর্শ রক্ষার সপক্ষে তার ইসলামী আদর্শিক এবং সাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রকাশ করে। সুতরাং তিনি যুদ্ধপরাধীদের বিচারে কালক্ষেপণ করে তাদের বিরুদ্ধে জনরোষ প্রশমিত করার কৌশল নিলেন। অন্যদিকে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা দ্বারা পাকিস্তানের দালালদের ক্ষমা করে দিলেন। তিনি পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের করা হিন্দু বিরোধী শত্রু সম্পত্তি আইনকে অর্পিত সম্পত্তি আইন নাম দিয়ে বহাল রাখলেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে মাদ্রাসা শিক্ষাকে রক্ষা করলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করলেন। শুধু এইটুকুতে তিনি সীমাবদ্ধ থাকলেন না। বাংলাদেশকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করা সত্ত্বেও তাকে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রগুলির আন্তজার্তিক সংস্থা ওআইসি-তে যোগ দেওয়ালেন।  

অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানী রাষ্ট্রের খণ্ডিত রূপ মাত্র। মর্মবস্তুতে বা চরিত্রগতভাবে এটাকে পূর্ব পাকিস্তানী রাষ্ট্রও বলা চলে। এখন তো এই রাষ্ট্রের সংবিধানে যেমন বিসমিল্লাহ জায়গা পেয়েছে তেমন রাষ্ট্রের ধর্ম হিসাবে ইসলামও প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ বা আর যে নামই দেওয়া যাক এই রাষ্ট্রটি হল ছদ্মাবরণে আর একটি পাকিস্তান, যা পাকিস্তানের ভাবাদর্শিক তথা ইসলামী আদর্শের ধারাবাহিকতাকে যেমন রক্ষা করছে তেমন তার রাষ্ট্র কাঠামোকেও রক্ষা করছে, যা হল পরিপূর্ণ রূপে আমলাতান্ত্রিক। এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা শাসন যন্ত্রের উপর সরকার হিসাবে যেই অধিষ্ঠিত হোক সমাজ বা জনগণের তাতে কী যায় আসে?

এখন এই রাষ্ট্রের মর্মমূলে প্রবেশের জন্য আমরা আর একটু গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করি পাকিস্তানের রাষ্ট্রটি কোথা থেকে এসেছিল যা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। তখন আমরা দেখতে পাই যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের রেখে যাওয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্রেরই এটি একটি অপরিবর্তিত ধারাবাহিকতা মাত্র। রাষ্ট্র বা শাসন যন্ত্র রইল অপরিবর্তিত। পরিবর্তন হল শুধু সরকারে। তবে ইংরেজ শাসকরা বিদায় নিল শাসন যন্ত্রের সর্বস্তর থেকে। এই শাসন-যন্ত্রে জায়গা থাকল মুসলিমদের, যাদের মধ্যে আবার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হল পশ্চিম পাকিস্তানী তথা অবাঙ্গালী মুসলিমদের। অর্থাৎ পাকিস্তান-রাষ্ট্র হচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও জনগণকে দমন ও লুণ্ঠন মূলক শাসন, শোষণ এবং নিপীড়নের জন্য গড়ে তুলা উপনিবেশিক রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা মাত্র। সুতরাং অব্যাহত রইল একই কায়দার আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। শাসকদের ধর্ম পরিচয় এবং গায়ের রং বদলাল মাত্র। কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র অপরিবর্তিত রইল। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসকরা যে শাসন যন্ত্র এ দেশ এবং তার অধিবাসীদের পদানত, দমন এবং লুণ্ঠন করবার জন্য গড়ে তুলেছিল সেই শাসন যন্ত্রকে নূতন নামে বা পরিচয়ে এ দেশ এবং তার অধিবাসীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল। রাষ্ট্রটির উপর থেকে বিদেশী সরকারকে সরিয়ে দিয়ে তার উপর স্বাধীন বা স্বদেশী সরকার নাম দিয়ে একটি সরকার বসিয়ে দিয়ে স্বাধীনতার নামে সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শোষণ ও লুণ্ঠনকে নূতন ও পরোক্ষ রূপে রক্ষার এক আশ্চর্য প্রতারক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হল। অর্থাৎ রাষ্ট্রটি হল প্রকৃতপক্ষে জাতি, সমাজ এবং দেশ দ্রোহী।

রাষ্ট্রটিকে শুধু আমলাতান্ত্রিক বললে তার জাতি, সমাজ এবং দেশ দ্রোহী চরিত্র পরিস্ফুট হয় না যদি একই সাথে তার বহিরাগত রূপটিকে তুলে ধরা না যায়। অর্থাৎ জনগণের নিকট এই রাষ্ট্র তথা শাসন যন্ত্র ছিল বহিরাগত। তাই এক এলাকার মানুষকে শাসন কিংবা নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঠানো হত আর এক এলাকার মানুষকে। এভাবে পুলিশ, প্রশাসক, বিচারক সবই এলাকায় বহিরাগত। এলাকার জনগণের নিকট অচেনা এবং তাদের প্রতি আনুগত্যহীন এবং দায়-দায়িত্বহীন আমলাদের পাঠানো হত শাসন এবং বিচারের জন্য। বহিরাগত এবং বিদেশী ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশের মানুষদেরকে পদদলিত করে রেখে তাদের উপনিবেশবাদী শোষণ ও লুণ্ঠন অব্যাহত রাখার জন্য বহিরাগত চরিত্র বিশিষ্ট এবং আমলাতান্ত্রিক যে শাসন যন্ত্র তথা রাষ্ট্র গড়েছিল তা কোনও মৌলিক পরিবর্তন ছাড়াই সমগ্র পাকিস্তান কাল জুড়ে বিদ্যমান থাকল এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরেও আজ অবধি বিদ্যমান রয়েছে। এভাবে এই রাষ্ট্রটি হল দেশী শাসকদেরও জনগণের উপর দমনমূলক শোষণ ও লুণ্ঠনের হাতিয়ার।*
-----------------------------------------------------
* রাষ্ট্রের এই বহিরাগত এবং আমলাতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে আমি বিভিন্ন গ্রন্থ এবং প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। কিছু সংক্ষিপ্ত পাঠের জন্য এখানে উল্লেখ্য : ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা’(http://www.bangarashtra.net/article/403.html), ‘বাঙ্গালীর সমাজ ও জাতি গঠনের গতিধারা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’ (http://www.bangarashtra.net/article/1365.html) এবং ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকা’ (http://www.bangarashtra.net/article/645.html)। এগুলি ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রে দেওয়া আছে।
-----------------------------------------------------

সুতরাং বাংলাদেশ-রাষ্ট্র পাকিস্তান-রাষ্ট্রের সেই দেশদ্রোহী এবং প্রতারক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকেই রক্ষা করছে। আর এভাবে তা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে আজ অবধি। তবে এক সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিল পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রধান শক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার কোমর ভেঙ্গে যাওয়ায় এই জায়গা নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার জনক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিকট তার কৃতজ্ঞতার ঋণ এখনও ভুলতে পারে নাই। সুতরাং এখনও তা নিজেকে ইংল্যান্ডের নেতৃত্বাধীন কমনওয়েলথ অব নেশন্সের সদস্য করে রেখেছে। এই নির্লজ্জ রাষ্ট্র শাসকদের কখনও এ কথা মনে হয় না যে কত অত্যাচার, অনাচার, অবিচার এবং ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা তাদের এ দেশ দখল এবং জবরদস্তিমূলক শাসনের সময়ে। এই নির্লজ্জ রাষ্ট্র শাসকরা বাংলা ’৭৬-এর মন্বন্তরে বঙ্গের এক তৃতীয়াশ মানুষকে হত্যার ইতিহাসকে তুচ্ছ বিবেচনা ক’রে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের দুই শত বৎসরের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের রক্ত, ঘাম এবং অশ্রু ভেজা ইতিহাসকে অগ্রাহ্য ক’রে ইংল্যান্ডের রাণীকে নিজেদেরও রাণী হিসাবে মেনে নিয়ে আজও কমনওয়েলথের সভায় উপস্থিত হয়। অথচ এই রাণী এ দেশের অগণিত মানুষ হত্যাকারী এবং নির্যাতন ও লুণ্ঠনকারীদের উত্তরাধিকারীদের রাণী ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই সবই হতে পারছে; কারণ আমরা প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র পাই নাই। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে অস্বীকার না করেও এ কথা বলা যায় যে, পূর্ব বঙ্গের বুকে বাংলাদেশ নামে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা মোটেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তুলে ধরে না। এটি স্বাধীনতা যুদ্ধের ফসল হয়ে উঠতে পারে নাই, বরং এটি হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তার আকাঙ্ক্ষা বা চেতনার প্রতি একটি বিরাট প্রতারণা। প্রকৃত বিচারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি পরাধীন। শুধু যে ইসলাম সমাজকে দুর্বল করে রেখে এই পরাধীনতাকে অব্যাহত রেখেছে তা-ই নয়, অধিকন্তু এই রাষ্ট্রটির উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক চরিত্রও এই পরাধীনতাকে অব্যাহত রাখতে বাধ্য করছে। এই রাষ্ট্রের উপনিবেশিক ধারাবাহিকতা থেকে মুক্তি ছাড়া আমাদের পক্ষে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন অসম্ভব। এ দেশে এই রাষ্ট্রের মাধ্যমে বিশেষত পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ তাদের আধিপত্য, শোষণ ও লুণ্ঠন অব্যাহত রেখেছে। এই রাষ্ট্রের কারণেও এ দেশে দেশপ্রেম, সততা, মানবিকতা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীন চেতনার উন্মেষ ঘটছে না। এই রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক এবং সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসক এবং দুর্নীতি নির্ভর ধনীরা বিভিন্ন কায়দায় দেশের সম্পদ লুণ্ঠন ক’রে বিদেশে পাচার করছে এবং সেই সঙ্গে তাদের অনেকের সন্তানদেরকেও বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এভাবে তাদের অনেকেরই এখন সেকেন্ড হোম বা পরবর্তী আবাস ভূমি হচ্ছে বিশেষত পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ।

এই রকম এক বাস্তবতায় শুধু রাষ্ট্রকে লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত ঘোষণা করা অর্থহীন। বরং গোটা রাষ্ট্রকে বদলে ফেলতে হবে। দেশদ্রোহী, সমাজদ্রোহী, জাতিদ্রোহী এবং প্রতারক রাষ্ট্রের পরিবর্তে দেশ, সমাজ, জাতি এবং মানবতার প্রতি নিবেদিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই রাষ্ট্রের মূর্ত রূপ হবে দেশ শাসনের প্রতিটি স্তরে স্থানীয় জনগণের স্বশাসন। এভাবে বহিরাগত আমলা শাসনের অবসান হবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রকে রক্ষা করে তার পরিচালনায় গণতন্ত্রের নামে কিংবা নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যে ধরনের সরকারকে বসানো যাক না কেন বহিরাগত চরিত্র বিশিষ্ট আমলাতন্ত্রের কাঠামোবদ্ধ হয়ে থেকে তা হবে মূলত জনগণের উপর বহিরাগতদের শাসনমূলক, আমলাতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক এবং পরিণামে লুণ্ঠন ও দমন মূলক। সমাজকে ইসলামের কাঠামোবদ্ধ রেখে যেমন কোনও মানবিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না তেমন একইভাবে উপনিবেশবাদের উত্তরাধিকার স্বরূপ উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ এই উত্তর-উপনিবেশিক রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করেও আমরা কোনও প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও দেশ প্রেমিক কিংবা জনগণের প্রতি অনুগত রাষ্ট্র কল্পনা করতে পারি না। সুতরাং আমাদের চাই ইসলাম থেকে মুক্ত সমাজ এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক চেতনায় সমুন্নত আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং সরকার সমন্বিত একটি নূতন গণতান্ত্রিক এবং মানবিক রাষ্ট্র। তারা হবে জনগণের প্রতি অনুগত ও দায়বদ্ধ, নারীর সম্মান ও অধিকার রক্ষায় নিবেদিত। সাম্রাজ্যবাদী এবং উপনিবেশবাদীদের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রটা যখন থাকবে না তখন তাদের এ দেশ এবং তার জনগণকে নিয়ন্ত্রণের এবং নিজেদের সঙ্গে অধীনতামূলক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখবার সবচেয়ে বড় হাতিয়ারও তারা হারাবে। সুতরাং বিদ্যমান রাষ্ট্রের অবসান এবং নূতন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণ যেমন মুক্ত হবে ইসলামের অভিশাপ থেকে, পুরাতন প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনা থেকে তেমন একই সঙ্গে তারা মুক্ত হবে লুণ্ঠন ও দমন মূলক সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা থেকেও। এভাবে বাংলাদেশে ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবের মাধ্যমে এমন এক রাষ্ট্র বিপ্লব ঘটবে যে বিপ্লব সমগ্র ইসলামী পৃথিবীর সামনে নূতন এক বিপ্লবের পথরেখা অঙ্কিত করবে। এই বিপ্লব হবে প্রকৃতপক্ষে এমন এক যাত্রার সূচনা যা আজকের বাংলাদেশ ভূ-খণ্ড কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না। বরং তা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গৌরবময় এবং মানবিক উত্তরাধিকারকে ধারণ ক’রে এবং একই সঙ্গে তার অপরিমেয় শক্তিকে আত্মস্থ ক’রে মানব জাতির অধিকতর অগ্রগতির লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।

 

মূল রচনা : ১৪ নভেম্বর, ২০১৫ -  ২২ জানুয়ারী, ২০১৬

চূড়ান্ত রূপ দান : জুন-জুলাই, ২০১৭

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ