Banner
ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা — শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ February 12, 2021, 12:00 AM, Hits: 2496

 

(১)

গত প্রায় পঁচিশ বছর ধরে সমগ্র ভারতে বিপুল পরিমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এতদিনকার প্রচলিত অনেক ধারণাগত কাঠামো বদলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ থেকে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের এত দিনকার প্রচলিত প্রাচীনত্বের ধারণাটি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বিপুল প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হবার আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার উপাদান ছিল প্রধানত বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য, শিলালিপি, মুদ্রা, বিদেশীদের লেখা বিভিন্ন বর্ণনা, সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য, ইত্যাদি। প্রাচীন সাহিত্য বিশেষভাবে হিন্দু সাহিত্যের উপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনার সমস্যা হল, একটি সাহিত্য অপর একটি সাহিত্যের বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক ও পরস্পর বিরোধী। এছাড়া হিন্দু সাহিত্য হিন্দু ধর্মকে এত দূর অতীতে নিয়ে যায় যে, এর কাল নিরূপণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ এই সমস্যা দূর করে আমাদের সামনে ইতিহসের নতুন ‍দিগন্ত উন্মোচিত করছে।

ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা প্রধানত বৈদিক ও হিন্দু ধর্মের তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য, অন্যান্য ধর্মের উদ্ভব প্রক্রিয়ার তুলনামূলক আলোচনা, সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক ধর্মের উত্থান সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা, সাম্প্রতিক প্রাপ্ত বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দু ধর্মের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য এবং প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

সাধারণভাবে প্রচলিত যে, হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্মের উত্তরসূরি, এবং উভয় ধর্ম মোটামুটি একই। এটি একটি ভুল ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে উদ্ভূত হলেও হিন্দু ধর্ম সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন ধর্ম। এটা ঠিক যে, বৈদিক ধর্মের বেদ সমূহ, যেমন, ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ হিন্দুদেরও পবিত্র গ্রন্থ। কিন্তু বৈদিক দেব-দেবীরা যেমন, ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, উষা, অশ্বিদ্বয়, অগ্নি, মরুৎগণ, ইত্যাদি হিন্দুদের পূজনীয় দেব-দেবী নয়। হিন্দুদের দেব-দেবী হল, শিব, বিষ্ণু, কালী, গনেশ, লক্ষী, সরস্বতী, ইত্যাদি। এই দেব-দেবীদের বেশীর ভাগেরই নাম আবার বৈদিক যুগে পাওয়া যায় না। ঋগ্বেদে মৃতদেহ দাহ ও কবর দিবার কথা বলা আছে। কিন্তু হিন্দুরা মৃতদেহ শুধুমাত্র দাহ করে। ঋগ্বেদে নীচের মন্ত্রে মৃতদেহ দাহ ও মাটিতে কবর দিবার উভয় রীতির কথা উল্লেখ পাওয়া যায় :

”হে স্বপ্রকাশ অগ্নি! যে সকল পিতৃলোক অগ্নি দ্বারা দগ্ধ হয়েছেন, কিংবা যাঁরা অগ্নি দ্বারা দগ্ধ হন নি, যাঁরা স্বর্গ মধ্যে স্বধার দ্রব্য প্রাপ্ত হয়ে আমোদ করে থাকেন, তাঁদের হয়ে তুমি আমাদের এ সজীব দেহকে তোমার ও তাদের অভিলাষ পূর্ণ করতে প্রবৃত্ত কর।” (১০/১৫/১৪)

কিংবা, মৃতদেহ মাটির নীচে স্থাপন করা বা কবর দিবার ইংগিত পাওয়া যায় এমন একটি মন্ত্রে বলা হচ্ছে, “১১। হে পৃথিবী! তুমি এ মৃতকে উন্নত করে রাখ, এঁকে পীড়া দিও না। এঁকে উত্তম উত্তম সামগ্রী, উত্তম উত্তম প্রলোভন দাও। যেরূপ মাতা আপন অঞ্চলের দ্বারা পুত্রকে আচ্ছাদন করেন তদ্রূপ তুমি একে আচ্ছাদন কর। ১২। পৃথিবী উপরে স্তূপাকার হয়ে উত্তমরূপে অবস্থিতি করুন। সহস্রধূলি এ মৃতের উপর অবস্থিতি করুক। তারা এর পক্ষে ঘৃতপূর্ণ গৃহস্বরূপ হোক, প্রতিদিন এ স্থানে তারা এর আশ্রয় স্থানস্বরূপ হোক।” (১০/১৮/১১-১২)

এছাড়া মৃতদেহ দাহ করার প্রথার উল্লেখও ঋগ্বেদে পাওয়া যাচ্ছে, যেমন : “১। হে অগ্নি! এ মৃতব্যক্তিকে একেবারে ভস্ম করো না, একে ক্লেশ দিও না, এর চর্ম বা এর শরীর ছিন্ন ভিন্ন করো না। হে জাতবেদা! যখন এর শরীর তোমার তাপে উত্তমরূপে পক্ব হয় তখনই এঁকে পিতৃলোকদের নিকট পাঠিয়ে দাও। ২। হে অগ্নি! যখন এর শরীর উত্তমরূপে পক্ব করবে, তখনই পিতৃলোকদের নিকট এঁকে দেবে। যখন ইনি পুনর্বার সজীবত্ব প্রাপ্ত হবেন, তখন দেবতাদের বশতাপ্রাপ্ত হবেন।” (১০/১৬/১-২)

এছাড়া শ্মশানের উল্লেখ পাওয়া যায় ইন্দ্র দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত ১/১৩৩/১ ও ১/১৩৩/৩ মন্ত্রে।

বৈদিক যুগে কোনও মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল না। ঋগ্বেদে পুত্তলিকা বা মূর্তির কথা উল্লেখ থাকলেও সেটা যে পূজার উদ্দেশ্যে ছিল না তা স্পষ্ট। যেমন ইন্দ্র দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত নীচের মন্ত্রে বলা হচ্ছে :

” দৃঢ়, নব ও ক্ষুদ্র দ্রুপদে স্থিত পুত্তলিকাদ্বয়ের ন্যায় তোমার পিঙ্গলবর্ণ অশ্বদ্বয় যজ্ঞে শোভা পায়।” (৪/৩২/২৩)

অথবা, সোম প্রভৃতি দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রে দেখি, “হে সূর্যা! তোমার পতিগৃহে যাবার পথে সুন্দর পলাশ তরু, সুন্দর শাল্মলীবৃক্ষ আছে অর্থাৎ ঐ কাষ্ঠে নির্মিত এর মূর্তি উৎকৃষ্ট সুবর্ণের ন্যায় শোভা।” (১০/৫/২০)

অন্যদিকে হিন্দুদের পূজাই হয় দেব-দেবীর প্রতিমা নির্মাণ করে, সেটা স্থায়ী হোক আর অস্থায়ী হোক। কিন্তু চমকপ্রদ বিষয় হল যে, হিন্দুদের পুরোহিত ব্রাহ্মণরা এই প্রতিমাকে সামনে রেখেই বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে। এটাই পূজার নিয়ম।

বৈদিক ধর্মে সামাজিক পবিত্রতা-অপবিত্রতার ভিত্তিতে গড়ে উঠা চতুর্বর্ণ প্রথা ছিল না, যা হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ঋগ্বেদ এ বিষয়ে পরিষ্কার সাক্ষ্য দেয়। ঋগ্বেদের একজন ঋষি বলছেন, “দেখ, আমি স্ত্রোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জন-কারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।” (৯/১১২/৩)

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৯০ সূক্ত, যা পুরুষসূক্ত নামে পরিচিত, সেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা রাজন্য, বৈশ্য ও শূদ্র এই চতুর্বর্ণের যে উল্লেখ পাওয়া যায়, তা অনেক পরের ও প্রক্ষিপ্ত বলে পণ্ডিতরা একমত পোষণ করেন। পণ্ডিতরা একমত যে, ঋগ্বেদের সময়ে চতুর্বর্ণভিত্তিক জাতি বিভাগ ছিল না।

হিন্দু ধর্মে গরুর উপর পবিত্রতার ধারণা অর্পণ করা হয়েছে এবং গো-মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বৈদিক ধর্মে গো-মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে রচিত একটি মন্ত্রে দেখা যায় : “হে ইন্দ্র! যখন অন্ন কামনাতে তোমার উদ্দেশ্যে হোম করা হয়, তখন তারা শীঘ্র শীঘ্র প্রস্তরফলক সহযোগে মাদকতাশক্তিযুক্ত সোমরস প্রস্তুত করে, তুমি তা পান কর। তারা বৃষভসমূহ পাক করে, তুমি তা ভোজন কর।” (১০/২৮/৩)

এখানে বৃষভসমূহ অর্থাৎ ষাঁড় রান্না করার কথা বলা হয়েছে, যা ইন্দ্র ভক্ষণ করবে। প্রকৃতপক্ষে দেবতার নামে মানুষই যে তা খাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত আরেকটি মন্ত্রে বলা হচ্ছে : “আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষ পাক করে দাও, আমি খেয়ে শরীরের স্থূলতা সম্পাদন করি, আমার উদরের দু’পার্শ্ব পূর্ণ হয়। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।” (১০/৮৬/১৪)

গরু বা ষাঁড়ের মাংস খাওয়ার এই রকম আরো মন্ত্র ঋগ্বেদে পাওয়া যায়, যেমন, ১০/৮৯/১৪, ইত্যাদি।  

এই রকম আরো বৈশিষ্ট্য থেকে এমন ধারণাই দৃঢ়মূল হয় যে, হিন্দু ধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে উদ্ভূত হলেও এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্ম। নীচের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাব যে, প্রত্যেকটি ধর্মই সেই সমাজেরই পটভূমি ও পুরাতন ধর্মের ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম হিসাবে আবির্ভূত হয়। ধর্মের উদ্ভব প্রক্রিয়া বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, শামসুজ্জোহা মানিক ও আমার যৌথভাবে লেখা আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা গ্রন্থে। এছাড়া শামসুজ্জোহা মানিক বিভিন্ন লেখায় এবিষয়ে আলোচনা করেছেন, যা ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্র (www.bangarashtra.net)-এ পাওয়া যায়।

কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হল যে, পৃথিবীর যে কোন ধর্মই ব্যতিক্রমহীনভাবে একইভাবে জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছে। সেটা আজকের ‍যুগের প্রধান ধর্মগুলো, যেমন, শিখ, ইসলাম, খ্রীষ্টান এবং ইহুদী ধর্মের জন্যও প্রযোজ্য। অর্থাৎ সকল ধর্মই যে সমাজে এবং যে কালে উদ্ভূত হয়েছে সেই ধর্ম সেই সমাজের এবং সেই কালের বৈশিষ্ট্য বহন করেছে। এটাই সত্য যে, নতুন ধর্ম প্রচারক বা প্রচারকরা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সাধারণ মানুষের ভাষায় তার বা তাদের নতুন ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। এর ফলে কোনও ধর্মেরই তার সমাজ ও কাল প্রেক্ষিত থেকে ভিন্ন হবার উপায় নাই। হিন্দু ধর্মও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।

ইসলামের বিকাশ প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব যে, সপ্তম শতাব্দীতে আরবের মক্কা ও তার আশেপাশের এলাকার প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস, সামাজিক প্রথা, লোক কাহিনী, ইত্যাদি ইসলামকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ইসলামের প্রচারক মুহম্মদ আরবের মক্কা নগরের একটি প্রভাবশালী গোত্র কুরাইশ থেকে এসেছিলেন। সেই সময়ে সেখানকার অন্যান্য গোত্রের মত কুরাইশরাও মূর্তি পূজারী ছিল। ইসলামকে একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে মুহম্মদ মক্কার কা’বা মন্দিরে অবস্থিত জনপ্রিয় দেবতা আল্লাহকে তার নতুন ধর্মের একমাত্র তথা নিরঙ্কুশ দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। মক্কার কা’বা মন্দির ছিল এমন একটি মন্দির, যেখানে প্রধান দেবতা হিসাবে আল্লাহ থাকলেও আশেপাশে বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্র তাদের নিজস্ব দেবতার মূর্তি সেখানে স্থাপন করত এবং তাদের পূজা করত। এছাড়া বছরে একদিন মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে সাত বার প্রদক্ষিণ করা হত ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসাবে, যাকে হজ্জ বলা হত।  সেই সময় সেখানে বাৎসরিক মেলা বসত ও দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন গোত্রের লোকজন আসত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এবং অনুষ্ঠিত হত বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা ও কবিতা পাঠের আসর। মক্কা ও এর আশেপাশে মূর্তি পূজারী বিভিন্ন গোত্র ছাড়াও একেশ্বরবাদী বিভিন্ন গোত্র, যেমন ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা বসবাস করত। একেশ্বরবাদী নতুন ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে মুহম্মদকে যেমন আরব সমাজের একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর ঐতিহ্য গ্রহণ করতে হয়েছে তেমনি সেসময়ে আরব সমাজে প্রচলিত মূর্তি পূজারী ধর্মগুলো থেকেও তার ধর্মে বিভিন্ন উপাদান নিতে হয়েছে। যেমন ইহুদী ধর্ম থেকে ইসলামের ধর্ম মন্দির মসজিদে উপাসনার জন্য আহবান করার জন্য সূর করে যে আবৃতি করা হত সেটা এসেছে। এছাড়াও ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মের উপবাস বা রোজা, প্রার্থনার পদ্ধতি, ইত্যাদি গ্রহণ করা হয়েছে। খ্রীষ্টান ও ইহুদী ধর্ম থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরুষ ও নারী সৃষ্টির কাহিনী, মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের কাহিনী, ফেরেশতার ধারণা, বিভিন্ন লোক কাহিনী, পয়গম্বর বা ধর্ম প্রচারকদেরও ইসলামে গ্রহণ করা হয়েছে। এই সব কিছুই মুহম্মদ গ্রহণ করেছিলেন, তার ধর্মীয় কাঠামোতে। ফলে তিনি ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মের গ্রন্থ তোরাহ (বা তাওরাত) এবং বাইবেলকে যেমন আল্লাহ প্রেরিত গ্রন্থ বলে দাবী করলেন তেমনি তাদের ধর্ম প্রচারক যীশু ও মোশি বা মুসার ঈশ্বরকে মুহম্মদ আল্লাহ বলে দাবী করলেন। কুরআনে বলা হচ্ছে :

”তাওরাত (ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ) অবতীর্ণ করিয়াছিলাম; উহাতে ছিল পথ-নির্দেশ ও আলো; নবীগণ, যাহারা আল্লাহর অনুগত ছিল তাহারা য়াহূদীদিগকে তদনুসারে বিধান দিত, আরও বিধান দিত রাব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ, কারণ তাহাদিগকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হইয়াছিল এবং তাহারা ছিল উহার সাক্ষী। … ... “(সূরা মায়িদা: ৫/৪৪)

অর্থাৎ কুরআন অনুসারে আল্লাহ ইহুদীদের ধর্মীয় গ্রন্থ তাওরাত বা তোরাহ রচনা করেছিলেন। ইহুদীরা তাদের ঈশ্বরকে ইয়াওয়েহ্ বলে। কিন্তু মুহম্মদ ইহুদীদের একেশ্বরবাদী ধর্মীয় ঐতিহ্য গ্রহণ করতে গিয়ে দাবী করলেন যে তাদের ঈশ্বরও আল্লাহ। একইভাবে খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলকেও তিনি দাবী করলেন আল্লাহর প্রেরিত বলে। এবিষয়ে কুরআনে বলা হচ্ছে :

”৪৬। মারয়াম-তনয় ‘ঈসাকে তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে উহাদের পশ্চাতে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীদের জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাহাকে ইনজীল (খ্রীষ্টানদের বাইবেল) দিয়াছিলাম; উহাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো।

৪৭। ইনজীল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ উহাতে যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে বিধান দেয়। আল্লাহ্ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে যাহারা বিধান দেয় না, তাহারা সত্যত্যাগী।” (সূরা মায়িদা: ৫/৪৬-৪৭)

কুরআন থেকে জানা যায় যে, এই ধরণের আয়াত অবতীর্ণ হবার ফলে মুহম্মদের বিরুদ্ধে সেময় ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা সমালোচনা মুখর ছিল। এসব ছাড়াও স্থানীয় কিছু লোক কাহিনী ও প্রথা তিনি তার ধর্মের অঙ্গীভূত করলেন। এই প্রথাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বছরে একদিন কা’বা মন্দিরের চারপাশে আনুষ্ঠানিক প্রদক্ষিণ বা হজ্জ। এভাবে মক্কাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আরবের ধর্মীয় ও সামাজিক পটভূমি থেকে ঐতিহ্যিক ধারাবাহিকতা বহন করে মুহম্মদ যে ধর্ম সৃষ্টি করলেন তা হল সম্পূর্ণ নতুন এক ধর্ম।

বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত প্যালেস্টাইন অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে যীশু খ্রীষ্টের দ্বারা খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে দেখা যায়। সেই সময়ে ইহুদী সমাজ থেকে উঠে আসা যীশু ইহুদীদের ঐতিহ্য ধারণ করেই তার নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ইহুদী ধর্মের নবী মোশি বা মুসার ব্যবস্থা বা আইন পালন করার জন্য ইহুদী ধর্ম থেকে পথভ্রষ্টদের আহবান করলেন। বাইবেলের নতুন নিয়মে ধর্ম প্রচারের এই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় :

”পর্ব্বের মধ্য সময়ে যীশু ধর্ম্মধামে গেলেন, এবং উপদেশ দিতে লাগিলেন। তাহাতে যিহূদীরা আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া কহিল, এ ব্যক্তি শিক্ষা না করিয়া কি প্রকারে শাস্ত্রজ্ঞ হইয়া উঠিল? যীশু তাহাদিগকে উত্তর করিয়া কহিলেন, আমার উপদেশ আমার নহে, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার। যদি কেহ তাঁহার ইচ্ছা পালন করিতে ইচ্ছা করে, সে এই উপদেশের বিষয়ে জানিতে পারিবে, ইহা ঈশ্বর হইতে হইয়াছে, না আমি আপনা হইতে বলি। যে আপনা হইতে বলে, সে আপনারই গৌরব চেষ্টা করে; কিন্তু যিনি আপনার প্রেরণকর্ত্তার গৌরব চেষ্টা করেন, তিনি সত্যবাদী, আর তাঁহাতে কোন অধর্ম্ম নাই। মোশি তোমাদিগকে কি ব্যবস্থা দেন নাই? তথাপি তোমাদের মধ্যে কেহই সেই ব্যবস্থা পালন করে না। … “(বাইবেল, নতুন নিয়ম, যোহন লিখিত সুসমাচার, ৭, ১৪-১৯)

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, যীশুকেও সমসাময়িক ইহুদী সমাজের উপর দাঁড়িয়ে এবং ইহুদীদের নবী মোশির উত্তরাধিকার ধারণ করেই তার নতুন ধর্মমত প্রচার করতে হয়েছে। তিনি যে নতুন ধর্মমত প্রচার করেন, তাকে পুরাতন ইহূদীদের ধর্মের সংস্কার হিসাবে বিবেচনা করে নতুন নিয়ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন যীশুর মৃত্যুর পরে তার অনুসারীরা। এভাবে খ্রীষ্ট ধর্ম সম্পূর্ণ একটি নতুন ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এভাবে দেখা যায় যে, প্রতিটি ধর্মই তার উত্থানের সময়কার সমাজ ও কাল প্রেক্ষিতে ঐ সমাজেরই পুরাতন ধর্ম, প্রথা, বিশ্বাস, ইত্যাদির ধারাবাহিকতা থেকেই নতুন ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তা একই প্রক্রিয়ায় বৈদিক ধর্ম থেকে বিকাশ লাভ করেছে। তবে হিন্দু ধর্মে ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কোনও বিশেষ একজনকে চিহ্ণিত করা যায় না। বরং এখানে অনেক ব্যক্তির ভূমিকা আছে বলে বুঝা যায়। এবিষয়টি অনুমান করা যায় যে, ঋগ্বেদ রচনার পরবর্তীকালে বেদ সমূহের রচনাকারী ঋষিরা বা তাদের উত্তরাধিকারীরা নিজেদের ব্রাহ্মণ হিসাবে সমাজে পরিচিত করে। পরে অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত চতুর্বর্ণ ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা সহ আরো অনেক পরিবর্তন ও স্থানীয় নতুন উপাদান অন্তভুর্ক্তির মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্ম প্রবর্তন হয়। বৈদিক ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্মের উত্তরণকালটা অনেক দীর্ঘ ও প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল বলে অনুমান করা যায়। হিন্দু ধর্মের উদ্ভব প্রক্রিয়াটি বুঝার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে বিকশিত সিন্ধু সভ্যতা এবং এর শেষ পর্বে সংঘটিত বৈদিক ধর্মের উত্থান প্রক্রিয়া সম্পর্কে নীচে বর্ণনা করা  হয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতা, যা হরপ্পান সভ্যতা নামেও পরিচিত, ভারতীয় উপ-মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বিকাশ লাভ করে। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে পাকিস্তানের বালুচিস্তানে অবস্থিত মেহরগড়ে খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি স্থিতিশীল মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পরে কাছাকাছি সময়ে ভারতের হরিয়ানার ভিররানা ও কুনালে এবং আরো কিছু পরে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের কিছু স্থানে বিভিন্ন বসতিতে পুরাতন প্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা পরবর্তী তাম্রযুগের সংস্কৃতিতে বহন করতে দেখা যায়। কাছাকাছি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই অঞ্চলে আরো অনেক নতুন বসতি গড়ে উঠতে থাকে এবং সবার ধারাবাহিক বিকাশ প্রক্রিয়ার একটি পর্যায়ে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই অঞ্চলে নগর সভ্যতার সূচনা হয়, যা সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায় বা হরপ্পান সভ্যতা নামে পরিচিত। এই নগর সভ্যতা ১৯০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় সাত শত বছর ব্যাপী টিকে ছিল। প্রাচীন পৃথিবীর এই অনন্য সভ্যতা প্রধানত যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের অভাব, রাজপ্রাসাদ বা রাজকীয় সমাধির অনুপস্থিতি, কোনও নির্দিষ্ট শাসক বা রাজার মূর্তি এবং শাসকদের দেবতা হিসাবে কোনও মূর্তির অনুপস্থিতি এবং মন্দিরের অনুপস্থিতির জন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

হরপ্পান নগর সভ্যতা উত্তর আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ নিয়ে বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত ছিল, যা সমসাময়িক মিসর ও মেসোপটেমিয়া সভ্যতার দ্বারা অধিকৃত মোট আয়তনের চেয়েও বড়। এই সভ্যতার প্রধান নগরগুলো হল মহেঞ্জো-দাড়ো ও লাখানঞ্জো-দাড়ো (উভয়ই সিন্ধু প্রদেশে অবস্থিত), হরপ্পা (পাকিস্তানী পাঞ্জোব), রাখিগাড়ী (হরিয়ানা) এবং ধোলাভিরা (গুজরাট)। এছাড়া অন্যান্য নগর ও শহর হল গানেরিওয়ালা (পাকিস্তানী পাঞ্জাব), কালিবঙ্গান (রাজস্থান), লোথাল (গুজরাট), নৌশারো (বালুচিস্তান), ইত্যাদি। বিশাল এই এলাকাজুড়ে বিস্তৃত নগর ও শহরগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সুপরিকল্পিত নগর, সোজা রাস্তা ও গলি এবং একই ধরনের ইটের মাপ। এই সভ্যতায় একই ধরণের লিপি ছিল, যা পোড়া মাটি ও স্টীয়েটাইট পাথরের সীল, ফলক, ইত্যাদির উপর খোদাই করা হত। এই লিপির এখনও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই।

দেখা গেছে যে, এখানকার নগরগুলোতে ধনীদের বাড়ীঘর কোনও একটি জায়গায় কেন্দ্রীভূত না থেকে সমস্ত নগরব্যাপী ছড়ানো ছিল। এই সভ্যতায় ছড়ানো সকল বসতিতে একই ধরণের মান সম্পন্ন ওজন ও দৈর্ঘ্যের মাপ থাকায় এটাই যুক্তি সংগত বলে মনে হয় যে, এখানে একটি শক্তিশালী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল। মহেঞ্জো-দাড়ো, লোথাল ও কালিবঙ্গান থেকে দাগ কাটা পরিমাপের স্কেল পাওয়া গেছে। বেশীরভাগ বসতি কাদা-মাটির তৈরী পুরু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে বসতিগুলোতে বড় ধরণের সংঘাত বা যুদ্ধের প্রমাণ পাওয়া যায় নাই।

অনেক হরপ্পান বসতিতে ড্রেন বা নর্দমা-ব্যবস্থা একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মহেঞ্জো-দাড়ো, হরপ্পা, কালিবঙ্গান, নৌশারো, চানহুদাড়ো (সিন্ধু), আল্লাহদিনো (সিন্ধু), ধোলাভিরা, লোথাল, ইত্যাদিতে ড্রেন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এই সভ্যতায় খুব অল্প সংখ্যক ও দুর্বল মানের যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া গেছে এবং যুদ্ধ ও যুদ্ধ জয়ের কোনও ছবি বা ভাষ্কর্য পাওয়া যায় নাই। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এই সভ্যতা যুদ্ধশক্তির উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে নাই। অথচ মিসর, মেসোপটেমিয়া বা চীনা সভ্যতায় যুদ্ধ ও যুদ্ধ জয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রচুর ছবি ও ভাষ্কর্য এবং যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া গেছে।

হরপ্পা যুগের বহু সংখ্যক নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় এখানে সমাজের উঁচু স্তরের মানুষদের সাথে নীচু স্তরের মানুষদের পুষ্টির ঘাটতির পার্থক্য কম। এ থেকে এটাই মনে করা যুক্তি সংগত যে, হরপ্পান সমাজের উপর ও নীচ তলার মানুষদের খাদ্যমানের পার্থক্য যথেষ্ট কম ছিল এবং একই সাথে উভয় স্তরের ধন বৈষম্যও তুলনামূলকভাবে কম ছিল। কিছু সংখ্যক হরপ্পান বসতির কাছাকাছি মৃতদেহের করবস্থান পাওয়া গেছে, যেখানে নগরে দীর্ঘকাল বসবাসকারী বাসিন্দাদের সংখ্যার তুলনায় প্রাপ্ত নরকংকালের সংখ্যা অনেক কম। প্রত্নতাত্ত্বিক কেনোয়ার মনে করেন যে, বেশীরভাগ মানুষ কবরস্থ না করে মৃতদেহ হয় দাহ করত নতুবা অন্যভাবে সৎকার করত। যেহেতু সেখানে রাজকীয় সমাধি ছিল না, তাই সেসব কবরখানায় কোনও মূর্তি, সীল অথবা উৎকীর্ণ বস্তু পাওয়া যায় নাই, এবং কোনও মূল্যবান জিনিসও মৃতদেহের সাথে সমাধিস্থ করা হয় নাই। বেশীরভাগ প্রাচীন সভ্যতার বসতিগুলোতে সামগ্রিক নগর পরিকল্পনার সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। সেখানে বাড়ীঘর ও বিভিন্ন কাঠামো প্রধান সড়কের দু’পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠে ও এইসব সড়ক কোনও মন্দির বা গুরুত্বপূর্ণ ভবনে গিয়ে সংযুক্ত হয়। হরপ্পান বা সিন্ধু সভ্যতায় বসতিসমূহের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার পরিষ্কার সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

নগর পরিকল্পনার সমরূপতা, রৈখিক মাপ, ওজন, এবং বিশাল দূরত্ব ব্যাপী একই ধরণের লিপি নিঃসন্দেহে এই সভ্যতার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সাক্ষ্য দেয়। এ থেকে মনে করা যেতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব থেকে শাসিত হত। রাজার বাসস্থান হিসাবে রাজপ্রাসাদ এবং রাজকীয় সমাধির অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে এই সভ্যতায় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বা সম্রাটের অভাবকে প্রমাণ করে। মহেঞ্জো-দাড়ো এই সভ্যতায় সবচেয়ে বড় নগর। এছাড়াও অন্যান্য বড় নগর হল হরপ্পা, রাখিগাড়ি, লোখাঞ্জো-দাড়ো ও গানেরিওয়ালা। এই সভ্যতায় রৈখিক মাপ, ওজন বা লিপির মত বিষয়গুলোতে কঠোরভাবে সমরূপতা রক্ষা করা হলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কিছু পার্থক্যও দেখতে পাওয়া যায়, যেমন শিল্পকলা, চিত্র ও মৃৎপাত্রের শিল্পের ধরণে ও নগর পরিকল্পনায়।

এই সকল বৈশিষ্ট্য থেকে এটাই মনে করা যুক্তি সংগত যে, বিস্তৃত এই সভ্যতাটি একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হত। যদিও এই নিয়ন্ত্রণ অতিকেন্দ্রীভূত ছিল না। অনুমান করা সংগত যে, একই সাথে অন্যান্য নগর ও শহরেও কিছু কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। মহেঞ্জো-দাড়োতে প্রাপ্ত বহু স্তম্ভ-বিশিষ্ট কথিত হলঘরটি অ্যাসেম্বলি হল হিসাবে সমগ্র সাম্রাজ্য শাসন করার কেন্দ্র হতে পারে বলে অনুমান করা যায়। আলোচিত এই সকল বৈশিষ্ট্য আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে, এই সভ্যতাটি সেযুগের মত করেই গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার বা লোকবাদী ছিল। এছাড়াও অনুমান করা যায় যে, এখানকার শাসকরা প্রতিটা বসতিতে বসবাসকারী মানুষদের সেই যুগেও সম্ভাব্য সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও এই সাক্ষ্য দেয় যে, এই সভ্যতা যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল এবং বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত বহু সংখ্যক বসতিতে অনেক মানুষ বসবাস করত। আমরা অনুমান করি যে, কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা ছাড়া এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে ধারণ করা সম্ভব ছিল না, যা সভ্যতার সূচনা থেকেই সেখানকার শাসক শ্রেণীর নেতৃত্বে নদী নিয়ন্ত্রণের ফলে কার্যকর করা হয়েছিল। এই কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থায় নদীতে স্লুইস গেট যুক্ত আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরী করে সঞ্চিত জলকে বিভিন্ন খালের মাধ্যমে দূরের কৃষি জমিতে সরবরাহ করা হত। আমাদের দৃষ্টিতে সিন্ধু বা হরপ্পান সভ্যতার সমৃদ্ধির মূল উৎসই হল বাঁধ-ভিত্তিক নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রচলন। তবে একটা সময়ে নদীগুলোতে পলি পড়ে এই নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায় এবং ভাটিতে জল সংকট আর উজানে বন্যা, জলাবদ্ধতা ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সেখানকার বিপুল সংখ্যক মানুষের দুর্দশার কারণে পরিণত হয়। সিন্ধু সভ্যতা শুরুর কয়েক শত বছর পর থেকে কিছু সংকট শুরু হলেও সভ্যতার শেষ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও সংক্ষুব্ধ মানুষেরা সেখানকার নদী সমূহে নির্মিত এইসব বাঁধ ধ্বংস করতে চাইল। কিন্তু বাঁধ ধ্বংস সহজ ছিল না, কারণ সেখানকার মানুষেরা আগে থেকেই বাঁধের উপর দেবত্ব আরোপ করেছিল। প্রাচীন যুগের পশ্চাৎপদ মানুষ স্বাভাবিকভাবে নদীর উপর দেবত্ব আরোপ করত। কাজেই নদীর উপর রোধক বা বাঁধ নির্মাণের মত প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ করতে গিয়েও বাঁধের উপর দেবত্ব আরোপ স্বাভাবিক ছিল। শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষজন এই বাঁধ সমূহ ধ্বংসের জন্য তাই সেখানকার প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করার প্রয়োজন বোধ করে। আমরা মনে করি, ঋগ্বেদ হল সেই ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফসল যা সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বাঁধ ধ্বংস করার জন্য ধর্মীয় সংস্কারের প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।

আমরা মনে করি ঋগ্বেদের ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সমাজের সমর্থনে সেখান থেকে উঠে এসেছিলেন। তারা যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রের নামে বাঁধ বা বৃত্র ধ্বংস উদ্দেশ্যে মন্ত্র রচনা করলেন। স্বাভাবিকভাবেই ঋগ্বেদে অন্যান্য ধর্মীয় আন্দোলনের মত অনেক পুরাতন মন্ত্রের স্মৃতি কিংবা এমনকি হয়ত অনেক পুরাতন মন্ত্রও অন্তর্ভুক্ত হল। সিন্ধু সভ্যতার শাসকদের বিরুদ্ধে বাঁধ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে সংগঠিত এই ধর্মীয় আন্দোলনে সভ্যতার সংকটে পড়া শাসক শ্রেণীর কিছু অংশের সমর্থন যে ছিল তেমন অনুমান করা একান্তই যৌক্তিক। বাঁধসমূহ ধ্বংসের পর সিন্ধু সভ্যতার পতন হলে, সেখানকার সেচ ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থারও সামগ্রিক বিপর্যয় ঘটে। ফলে সেখানকার বিপুল সংখ্যক লোকজন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, কিছু মানুষ পূর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকায়, আর বাকীরা পশ্চিমে ইরানে ও আরো পশ্চিমে মধ্য এশিয়ায় ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সিন্ধু সভ্যতায় বাঁধ ভিত্তিক নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা,  বৈদিক ধর্মীয় আন্দোলন, বাঁধ ধ্বংস, ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে শামসুজ্জোহা মানিক ও আমার লেখা বই আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা এবং আমাদের যৌথ লেখা নিবন্ধ Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval ১০ এ।

প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে মনে করার যুক্তি সংগত কারণ আছে যে, সিন্ধু সভ্যতা মূলত সেক্যুলার বা লোকবাদী এবং এর প্রতিষ্ঠাতা ও শাসকরা নিরীশ্বরবাদী ছিল। এটি ছিল অন্তত এই সভ্যতার সূচনার পর্যায়ে। প্রাচীন কালে সভ্যতা নির্মিত হত কোনও নেতৃত্ব দানকারী গোত্র বা গোত্র সমূহের কনফেডারেসি দ্বারা। সভ্যতার জন্য খাদ্যোৎপাদন, বিভিন্ন ভবন বা কাঠামো নির্মাণ ও তার রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনে ক্রমবর্ধমান শ্রমশক্তির চাহিদার কারণে তাদের বৃহত্তর সমাজ গঠন করতে হত। দেখা যায় যে, বল প্রয়োগ ছাড়া বাইরের বিভিন্ন গোত্রকে তাদের নতুন সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা ও একই সমাজভুক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। বল প্রয়োগের এই প্রক্রিয়ায় যে সমস্ত গোত্র বা গোষ্ঠী সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয় তারা তাদের গোত্রীয় অনেক স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করতে বাধ্য হত, যেমন ধর্মীয় প্রথা, আচরণ এবং তাদের দেবতা। এক্ষেত্রে তাদের ধর্মীয় প্রথা বা দেবতাসমূহ অবদমিত অবস্থায় স্থানীয়ভাবে টিকে থাকতে পারে। সিন্ধু সভ্যতা ছাড়া পৃথিবীর সব সভ্যতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমহীনভাবে এটি ঘটতে দেখা যায়। অথচ এখানে নতুন নতুন জনগোষ্ঠীকে সভ্যতার আওতায় আনা হয়েছে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণভাবে। অনুমান করা যায় যে, সভ্যতায় সংকট দেখা দিলে সেই সব জনগোষ্ঠীর অবদমিত প্রথা ও এর সাথে তাদের দেবতাসমূহ প্রাধান্যে আসতে শুরু করে। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে জানা যায় যে, এর হরপ্পান নগর সভ্যতার পর্বে ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত কমপক্ষে তিনটি উপ-পর্বে নগরের বিকাশ, ক্ষয় ও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।১১ আমরা অনুমান করি যে, হরপ্পান সভ্যতা সূচনায় নিরীশ্বরবাদী হলেও নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দীর্ঘস্থায়ী সংকট দেখা দিলে পশ্চাৎপদ জনসাধারণ ধর্মের দিকে ঝুঁকে যায়, যা এক সময় শাসক শ্রেণীকে প্রভাবিত করে। ফলে সমাজের উপর তলা ও শাসক শ্রেণীও ধর্মকে কিছুটা জায়গা দেয়। আমরা অনুমান করি যে, এই সংকটের কারণেই ধর্মকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ২৩০০ খ্রীঃ পূঃ-এর দিকে মহেঞ্জো-দাড়োতে ধর্মীয় স্নানাগার বা গ্রেট বাথ নির্মাণ করা হয়েছিল।১২ হরপ্পায় সাম্প্রতিক উৎখননের ফলে জানা যাচ্ছে যে, সেখানে সভ্যতার শেষের দিকে ২২০০-১৯০০ খ্রীঃ পূঃ সময়ে বর্ণনামূলক চিত্র অনেক বেশী পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে মনে করা হচ্ছে যে, নগর সভ্যতার শেষ পর্যায়ে এসে কোনও বিশেষ ধর্মের এবং উপকথা সংশ্লিষ্ট কিছু চিত্রকলার বৈধতা দিবার প্রয়োজন পড়েছিল। এ বিষয়ে কেনোয়ার বলছেন, “… … recent excavations at Harappā indicate that examples of narrative art are found more commonly in the latest levels of the site, dating to around 2200-1900 BCE. This pattern suggests that after several hundred years of urbanism, there was an urgent need to depict and thereby legitimize specific religious figures, narrative myths and scenes of worship.” ১৩

প্রায় ছয় বা সাত শত বছর পর যখন সভ্যতার চূড়ান্ত ক্ষয় শুরু হল, সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় সমাজের নানা স্থানের ও নানা গোষ্ঠীর মানুষের অবদমিত ধর্মীয় প্রথা এবং সেই সাথে তাদের দেবতাসমূহ মুক্ত হতে থাকে। এই সময় বৃত্র বা নদীর বাঁধ ধ্বংস করার জন্য সংক্ষুব্ধ জনসাধারণ বিভিন্ন স্থান থেকে যুদ্ধ সংগঠিত করে। বৃত্র বা বাঁধ যেহেতু দেবত্ব প্রাপ্ত ছিল, এবং সমাজ শান্তিপূর্ণ বিকাশের কারণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, সুতরাং যুদ্ধ সংগঠিত করা ও বাঁধ ধ্বংসের জন্যও জনসমাজের প্রচলিত ধর্মকেও সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দিল। এটি সভ্যতার শেষ পর্বে ঘটেছিল বলে ধারণা করা যায়। প্রাচীন কিন্তু অবদমিত ধর্ম যা দীর্ঘ  সংকটের কারণে ক্রমশ জনমনে প্রাধান্যে চলে আসছিল, সেটি সংস্কার করতে চেয়ে ঋগ্বেদের ঋষিরা মন্ত্র রচনা করলেন। এটি করতে গিয়ে যুদ্ধের দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে নিয়ে আসতে হল, এবং আরো অনেক দেবতার ও পূজার প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করা হল। এভাবে বৈদিক ধর্ম সৃষ্টি হল। এই বৈদিক পক্ষ সভ্যতার ধ্বংসের পর পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি গড়ে তুলে। যেমন পূর্বে বলা হয়েছে, সভ্যতার শেষ পর্বে রাষ্ট্র শাসকরাও ধর্মের দিকে ঝুঁকছিল এবং ফলে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তাদের একটি অংশ একই ধরণের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করে, যার ফলে আবেস্তান ধর্ম সৃষ্টি হয়। পরাজিত হয়ে আবেস্তানরা পশ্চিমে ইরানে বসতি স্থাপন করে। শামসুজ্জোহা মানিক ও আমার লেখা বই আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা-য় এই বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।

আমরা আগে যেমন বলেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসকরা শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ও লোকবাদী ছিল। আমরা আরো মনে করি যে, সমগ্র সভ্যতাব্যাপী নিরীশ্বরবাদের চর্চা ছিল ও রাষ্ট্র এখানে উদ্যোগী ভূমিকায় ছিল। সেখানে যে সমস্ত ছোট ছোট পোড়া মাটির মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলো এত বড়, সমৃদ্ধ ও ক্ষমতাশালী সভ্যতার শাসক শ্রেণীর সাথে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। একই কারণে সেখানে পাওয়া শিং বিশিষ্ট দেবতার ছবি বা সীলে উৎকীর্ণ বিভিন্ন ছবিও সভ্যতার আদর্শিক অবস্থানকে প্রকাশ করে না। এগুলো বিভিন্ন গোত্রের আঞ্চলিক দেবতা হতে পারে যেগুলো সভ্যতার নির্মাণ ও সূচনা লগ্নে অবদমিত হয়েছিল। সভ্যতার শাসকরা একেশ্বরবাদও চর্চা করত বলে মনে হয় না, কারণ এই ধরণের ধর্মীয় চর্চা এই রকম একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে চরমভাবে এককেন্দ্রিক, স্বেচ্ছাচারী ও আগ্রাসী হতে সাহায্য করে। অথচ এই সভ্যতার কোথায়ও এই ধরণের বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। সুতরাং এটাই মনে হয় যে, সেখানকার শাসক শ্রেণী যেমন তেমনি সেখানকার বহু সংখ্যক নাগরিকই নিরীশ্বরবাদের অনুসারী ছিল ও তার চর্চা করত। তবে আমাদের মনে রাখতে যে, এই সভ্যতা বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তা ও ধারণাকে ধারণ করত। ফলে এখানে বহুদেবতাবাদ যেমন তেমনি একেশ্বরবাদের কিছু স্থান ছিল বলে ধারণা করা যায়, যা কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত থাকত এবং যেগুলোকে সভ্যতার অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে শাসক শ্রেণী অবদমন করে রেখেছিল।

আগে যেমন বলা হয়েছে, সিন্ধু সভ্যতা শুরুর দিকে (প্রায় ২৭০০-২৬০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে) প্রধানত সেক্যুলার বা লোকবাদী হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল। আমরা মনে করি যে, সেখানকার দার্শনিক, শিক্ষক ও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে জড়িত অন্যান্য জনগোষ্ঠী সভ্যতার নির্মাণে এবং শাসন-ব্যবস্থা ও কর্ম-পন্থা তৈরী ও এর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। যখন নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে তিন বা চারশ বছর পর প্রথম সংকট শুরু হল, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবদমিত হয়ে থাকা ধর্ম প্রাধান্যে আসতে শুরু করল।

 

(২)

ভারতীয় উপমহাদেশের গাঙ্গেয় উপত্যকায় ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে দুইটি প্রাধান্য বিস্তারকারী ধর্ম — বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উৎপত্তি হতে দেখা যায়। এটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে, এই উভয় ধর্ম নিরীশ্বরবাদী, অর্থাৎ এই দুই ধর্মীয় দর্শনে বিশ্ব জগতের সৃষ্টি কর্তা ও নিয়ন্তা হিসাবে কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল না। একই সময়ে ভারতবর্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী আরো কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরীশ্বরবাদী দর্শন চিন্তার অস্তিত্ত্বের কথা জানা যায়, যার মধ্যে আজীবিকরা অন্যতম। এছাড়াও সেই সময় ভারতবর্ষে নিরীশ্বরবাদী যে সমস্ত ধর্ম চিন্তার অস্তিত্ব ছিল সেগুলো হল চার্বাক, সাংখ্য ও লোকায়ত। আমরা আগে বলেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় জনমনে নিরীশ্বরবাদের অত্যন্ত গভীর প্রভাব ছিল। ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকায় সেখানকার অধিবাসীরা অভিগমন করলে এই ধারণা সেখানে নিয়ে যায় যা পরবর্তীকালে বহু সংখ্যক মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল ও সিন্ধু সভ্যতা পতনের দেড় হাজার বছর পরেও টিকেছিল। এই কারণে বুদ্ধ ও মহাবীর তাদের ধর্ম প্রতিষ্ঠা কালে নিরীশ্বরবাদের পক্ষে সমাজে একটি অনুকূল ক্ষেত্র পেয়েছিলেন।

সিন্ধু ও সরস্বতী নদী উপত্যকায় বিকশিত সিন্ধু সভ্যতার পতনের কয়েক শত বছর পর গঙ্গা নদীর উপত্যকায় লৌহ যুগ শুরু হয়। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে সেখানে লোহার সীমিত ব্যবহার দেখা যায় যাকে আদি লৌহ যুগ বলা হয়। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে লোহার মোটামুটি ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়, যা পরবর্তীকালে ক্রমশই বাড়তে থাকে।  

এর পরে খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ৮ম শতাব্দীতে গঙ্গা উপত্যকায় নগর ও শহরের বিকাশের মধ্য দিয়ে নগর জীবন শুরু হয়, যা আরও কিছুটা পরে পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলব্যাপী দেখা গিয়েছিল।১৪ খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশ তিনটি পৃথক, পরস্পর সম্পর্কিত এবং দীর্ঘ মেয়াদী ঘটনা দ্বারা চিহ্নিত : নগরের উদ্ভব, নতুন দুই ধর্ম বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদ্ভব, এবং লিপির বিকাশ।  

এতে কোনও সন্দেহ নাই যে, লোহার বহুল ব্যবহার খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গাঙ্গেয় সমভূমিতে দ্বিতীয় নগর সভ্যতা গড়ায় প্রধান ভূমিকা রেখেছিল। প্রথম দিককার মুদ্রার ব্যবহার ব্যবসা-বাণিজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, শেষ পর্যন্ত যা নগরায়নের বিকাশ ঘটায়। তবে পোড়া মাটির ইট ও মুদ্রা ব্যবহারের অনেক আগেই গঙ্গা ও যমুনা নদীর দোয়াবে ছোট ছোট শহর গড়ে উঠছিল বলে ধারণা করা যায়।১৫ উত্তর প্রদেশের ভিটা, কোশাম্বি, শ্রিংভেরাপুর এবং ঝুসিতে বিপুল পরিমাণ প্রথম দিককার মুদ্রা পাওয়া গেছে। এই শহরগুলো বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে বিকাশ লাভ করে।১৬

এই সময়ে বহু সংখ্যক স্বাধীন রাজ্য গড়ে উঠে যাদের কোনও বংশানুক্রমিক কেন্দ্রীয় শাসক ছিল না। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে শক্তিশালী ষোলটি মহাজনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো গণরাজ্য বা Republic ছিল। এছাড়াও সেই সময়ে ভারতবর্ষে আরো অনেক গণরাজ্যের কথা জানা যায়। এই প্রাচীন গণরাজ্যগুলো খ্রীষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল। এই সমস্ত গণরাজ্যগুলো বুদ্ধ, মহাবীর, আজীবিক ও আরো অন্যান্য সম্প্রদায়ের চিন্তা প্রচারের জন্য উর্বর ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করেছিল।

সাধারণভাবে এটা মনে করা হয় যে, হিন্দু ধর্ম অনেক প্রাচীন, পাঁচ হাজার বছর বা তার চেয়েও পুরনো। কিন্তু সমগ্র ভারত জুড়ে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ভিন্ন সম্ভাবনার বিষয়কে প্রকাশ করছে। সেখান থেকে জানা যায় যে, ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম থেকে অনেক প্রাচীন। 

ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে প্রাপ্ত প্রাচীন বিভিন্ন পুরানিদর্শনের উপস্থিতি নির্দেশ করে যে খ্রীষ্টপূর্ব যুগে জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। ভারতের একটি রাজ্য উড়িষ্যায় সাম্প্রতিক খননে মৌর্য যুগ (৩২২-১৮৫ খ্রীঃপূঃ) থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পর্যাপ্ত অবশেষ পাওয়া গেছে, এছাড়াও বৌদ্ধ ধর্মের ধারাবাহিক বিকাশ দেখতে পাওয়া যায় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে খননকৃত বিভিন্ন বসতিতে। মৌর্য সম্রাট অশোক আশি হাজার বৌদ্ধ স্মারক নির্মাণ করেছিলেন যেগুলোর মধ্যে ছিল স্তম্ভ, পাথর-খোদিত ভাষ্কর্য, স্তূপ, চৈত্য ও মঠ। এই ধরণের চর্চা কুশান, শতবাহন, বাকাটক, পাল, ভৌমকার, ইত্যাদি পরবর্তী বিভিন্ন রাজবংশ অনুসরণ করেছিল।১৭

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ প্রতিফলিত হয় ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে যেমন স্তূপ, চৈত্য, পাথর-খোদিত স্তূপ এবং গুহা-ভাস্কর্য ও শিলালিপি থেকে।১৮ জুয়াফারদিহতে (বিহার) সাম্প্রতিক খননে জানা যাচ্ছে যে, এখানে ১৬০০-১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে বসতি স্থাপন করা হয় এবং এখানকার আবাসস্থলের মাটির স্তরে সবচেয়ে প্রাচীন স্তূপ পাওয়া গেছে যার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ষষ্ঠ-পঞ্চম খ্রীষ্টপূর্বাব্দ।১৯ উড়িষ্যার বিভিন্ন অংশে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে ২০টি প্রধান আদি ঐতিহাসিক বৌদ্ধ বসতি পাওয়া গেছে।২০ সাম্প্রতিক জরিপ ও দলিলে উড়িষ্যার দয়া উপত্যকায় সিসুপালগড়, ধৌলি, কুরকিমুন্ডিয়া, লবণগিরি ও আরাগড়ে বৌদ্ধ নিদর্শন পাওয়া গেছে, যেখান থেকে বৌদ্ধ নিদর্শনাবলীর, বিশেষভাবে স্তূপ কাঠামোর বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়।২১ বাণিজ্য পথের সাম্প্রতিক জরিপ থেকে জানা যায় যে, আফগানিস্তানের বলখ্ ও বামিয়ান থেকে উত্তর ভারতের গঙ্গা উপত্যকা হয়ে সিল্ক রুট তাম্রলিপ্তিতে (তমলুক, পশ্চিম বঙ্গ) সংযুক্ত হয়েছিল এবং এর পর উড়িষ্যার (কলিঙ্গ) বিভিন্ন বৌদ্ধ বসতির সাথে যেমন লনগুড়ি, রাধানগর, ললিতগিরি, ধৌলি, আরাগড়, জুয়াগড়  এবং দক্ষিণ ভারতের বৌদ্ধ বসতিগুলোতে যেমন অন্ধ্র প্রদেশের কলিঙ্গপটনম, সালিহুনডাম, সংকরাম, তথালকোন্ডা, বাভিকোন্ডা ও নাগার্জুনকোন্ডা এবং তামিলনাড়ুর কাবেরিপটনমের সাথে সংযুক্ত হয়েছিল।২২

বৌদ্ধদের প্রাচীনতম পাথর-খোদিত গুহা পাওয়া গেছে বিহারের বরাবর পর্বতে যা অশোকের সময়ে ৩য় খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পরের ভাগে নির্মিত। এই গুহাগুলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ও আজীবিকদের থাকার জন্য সংরক্ষিত ছিল।২৩ প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে দেখা গেছে যে, গুজরাটের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে আধুনিক জুনাগড়ের উপকণ্ঠে গিরনার ও তার আশেপাশের অঞ্চল জৈন ও হিন্দুদের ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে খ্যাতি হওয়ার অনেক আগেই মৌর্য যুগ থেকেই বৌদ্ধদের ধর্মীয় কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছিল।২৪ মহারাষ্ট্র অঞ্চলে বৌদ্ধদের প্রায় ১০০০ পাথর-খোদাই করা গুহা আছে, যেগুলোকে দুটি সময় পর্বে ভাগ করা হয়েছে, প্রথমটি ৩০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ এবং ২৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে এবং পরের পর্বটি প্রায় ৪র্থ এবং ৭ম খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে।২৫ মঙ্গুলামে (তামিলনাড়ু) আবিষ্কৃত বেশীরভাগ তামিল-ব্রাহ্মী শিলালিপির সময় ধরা হয়েছে ৫ম খ্রীষ্টপূর্বাব্দ এবং ১ম খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে, যেগুলো জৈন সন্ন্যাসীদের প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিল।২৬ অশোক ও তার পৌত্র দশরথ আজীবিক সম্প্রদায়ের জন্য বরাবর ও নাগার্জুনী পাহাড়ে সাতটি গুহাচৈত্য খনন করান। ডমরুতে (ছত্তিসগড়) ১৬ টি বৃত্তাকার পাথরের কাঠামো পাওয়া গেছে যেগুলো নৈবেদ্যর জন্য নির্মিত স্তূপের মত, এবং এগুলোকে খ্রীষ্টীয় ১ম থেকে ৫ম শতাব্দীর মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে।২৭ অঙ্কিত বুদ্ধপদ প্রথম দিককার বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন কেন্দ্রে পাওয়া গেছে। ডমরুতে প্রাপ্ত পদচিহ্নগুলো খ্রীষ্টীয় ২য় থেকে ৩য় শতাব্দীর বলে ধারণা করা যেতে পারে।২৮ সাঁচীতে (মধ্য প্রদেশ) প্রাপ্ত ’মহা স্তূপে’ বিশদভাবে অলংকৃত দরজাগুলো এবং ভরহুত (মধ্য প্রদেশ), বোধগয়া (বিহার), এবং অমরাবতীর (অন্ধ্র প্রদেশ) এখনকার ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরসমূহ প্রাচীন ভারতে দক্ষতার সাথে নির্মিত প্রাচীন শিল্প বৈশিষ্ট্য এবং প্রচলিত শিল্প শৈলীর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভারতে বিভিন্ন পর্যায়ের বৌদ্ধ ধর্মের অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া যায়, যা থেকে নানা যুগে এর গঠন ও পৃষ্টপোষকতার বিষয়টি জানা যায়। এই সব নিদর্শন নির্মাণে সম্রাট, রাজা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ পৃষ্টপোষকতা প্রদান করেছিল।২৯

জৈনরাও স্তূপ তৈরী করত, যার সাক্ষ্য প্রাচীন মথুরা (উত্তর প্রদেশ) থেকে পাওয়া যায়।৩০ নন্দনগড়ের (বিহার) কিছু গোলকাকার সমাধি স্তূপকে বুদ্ধ-পূর্ব যুগের বলে বিবেচনা করা হয়।৩১ সন্ন্যাসী, তীর্থযাত্রী, বণিক এবং কারুশিল্পীদের এক স্থান থেকে অপর স্থানে ভ্রমণের ফলে বৌদ্ধ স্থানগুলোর মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট সময়ের রীতি-বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সমরূপতা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এই ধরণের ভ্রমণের প্রমাণ বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মের স্থানগুলোতে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। এই ধরণের ভ্রমণ এবং তার ফলস্বরূপ সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিনিময় শিল্প রীতি ও শিল্প উপাদান সহ জীবনের অনেক ক্ষেত্রে সমরূপতা এনে দিয়েছিল।৩২

খ্রীষ্টীয় প্রথম দিককার শতাব্দীগুলোতে উড়িষ্যায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বিকাশ লাভ করতে থাকে।৩৩ মনে করা হয় যে, হিন্দুদের আদি মন্দির হল বেসনগরে (বিদিশা, মধ্য প্রদেশ) এবং নাগরিতে (চিত্তৌরগড় জেলা) পাওয়া যথাক্রমে খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী ও খ্রীষ্টপূর্ব ১ম শতাব্দীর দু’টি ডিম্বাকৃতি মন্দির। গঙ্গা উপত্যকার বাইরে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু মন্দির পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে চিত্তুর জেলার গুড়িমল্লমে খ্রীষ্টপূর্ব ২য়-১ম শতাব্দীর শিব-লিঙ্গ এবং বীরপুরমে (কৃষ্ণ উপত্যকায়) খ্রীষ্টীয় ১ম শতাব্দীর মন্দির সমূহ উল্লেখযোগ্য।৩৪ এই আদি হিন্দু মন্দিরগুলোর ধর্ম স্থানে গার্হস্থ্য, স্থানীয় ও আঞ্চলিক ধর্ম বিশ্বাস বিচিত্র ধারায় স্থান করে নিয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের ধারার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবার প্রক্রিয়ায় না গিয়ে, যা লেখকরা দাবী করে থাকেন, এই স্থানীয় ও আঞ্চলিক ধর্ম বিশ্বাসের অনেক কিছুই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্বাধীন ধর্মীয় ধারা হিসাবে টিকেছিল।৩৫ প্রত্নতাত্ত্বিক দলিল থেকে দেখা গেছে যে, ভারতীয় প্রথম দিককার শিল্প কর্মে খুব কম হিন্দু দেবতার প্রতিরূপ দেখতে পাওয়া যায়।৩৬ মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর প্রতিমা প্রথম পাওয়া গেছে বাকাটক যুগে (৩৮৫-৪৮০ খ্রীষ্টাব্দ)।৩৭

৬ষ্ঠ থেকে ১৩শ শতাব্দী সময়ে হিন্দু মন্দিরসমূহের কাঠামো চারিপাশে ও উচ্চতা উভয় দিকে সম্প্রসারিত হয়েছিল।৩৮ এই সময়কে হিন্দু ধর্মের উত্থান যুগ হিসাবে বিবেচনা করা যায়।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের লিখিত দলিলসমূহের সাথে হিন্দু ধর্মের লিখিত দলিলসমূহের তুলনা করলে দেখা যায় যে, জৈন এবং বিশেষভাবে বৌদ্ধ ধর্ম লিখিত দলিলের প্রতি উচ্চতম সম্মান প্রদর্শন করেছে। এই কারণে বৌদ্ধ ও জৈনরা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের চেয়ে অনেক উন্নত হস্তলেখ শিল্প সমৃদ্ধ পাণ্ডু লিপির ঐতিহ্য গড়ে তুলেছিল।৩৯ ভারতে আনুশাসনিক পালি লিপি তুলনামূলক দুর্লভ।৪০ এটি কৌতূহলোদ্দীপক যে, প্রাচীন সংস্কৃত লিপির উদ্ভবের সাধারণভাবে স্বীকৃত সময় বিবেচনা করলে উৎকীর্ণ লিপি হিসাবে সংস্কৃতের প্রথম ব্যবহার হয়েছিল কেবলমাত্র খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, যেমন অযোধ্যা (উত্তর প্রদেশ) এবং রাজস্থানের ঘোসুণ্ডি ও হাথিবাদা শিলালিপি।৪১ কেবলমাত্র প্রথম দিককার গুপ্ত সম্রাটদের শাসনামলে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সংস্কৃত মর্যাদাপূর্ণ লিপির ভাষা হিসাবে উপমহাদেশে চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।৪২

ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ থেকে দেখা যায় যে, প্রাচীন ও আদি মধ্য যুগে খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে গরুর মাংস ভূমিকা রেখেছিল। উত্তর প্রদেশের মাদার দিহতে গুপ্ত ও শেষ গুপ্ত যুগে মহিষের মাংসকে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।৪৩ সাম্প্রতিক খনন করা কিছু বসতিতে আদি লৌহ যুগ ও লৌহ যুগে গরুর মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।৪৪ যদিও চূড়ান্ত মন্তব্য করার জন্য পর্যাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য নাই, তবুও এই সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এ কথা বলা যায় যে, এই সময়ে উপমহাদেশে গরুর মাংস খাবার ব্যপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এটি থেকে সমাজে প্রাচীন ও আদি ঐতিহাসিক যুগের সমাজে ব্রাহ্মণের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। অথবা এমনও হতে পারে তখনও ব্রাহ্মণরা গরুর উপর পবিত্রতা আরোপ করে নাই।

উপরে উল্লেখিত প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য সমূহের সাক্ষ্য থেকে এ কথা বলা যায় যে, খ্রীষ্টপূর্ব যুগে ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ধ্বংসাবশেষ, মন্দির ও মূর্তির চেয়েও বৌদ্ধদের মন্দির, স্তূপ, চৈত্য সংখ্যায় অনেক বেশী ছিল। তবে, জাতক ও অন্যান্য প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণদের উচ্চ মর্যাদা ছিল। বুদ্ধের বাণী মৌর্য-পূর্ব যুগে বুদ্ধের পরে দুই শত বছরের মধ্যে সংকলিত হলেও অশোকের সময় আনুমানিক ২৪৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে যে তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতি (সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হয়, সেখানকার সংকলনই ত্রিপিটক সাহিত্য হিসাবে মোটামুটি টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়। বৌদ্ধ ত্রিপিটক প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্য বলে এ‍গুলো সতর্কতার সাথে বিচার করলেও বুদ্ধের সময়ের মোটামুটি একটা সামাজিক চিত্র পাওয়া যায়। দেখা যায় যে, বৌদ্ধ সাহিত্যে ব্রাহ্মণের উল্লেখ থাকলেও প্রায় সকল ক্ষেত্রে আগে শ্রমণ ও ক্ষত্রিয়ের নাম ও তার পরে ব্রাহ্মণের নাম উল্লেখ দেখা যায়। যেমন, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ, ইত্যাদি। এতে মনে হয় সমাজে ব্রাহ্মণ শ্রেণী একক সম্মানিত শ্রেণী ছিল না। এছাড়া ধারণা করা যায় যে, ক্ষত্রিয়রা সেই সময় ব্রাহ্মণ কেন্দ্রিক ধর্মের বাইরে আলাদা গোষ্ঠী ছিল। আর ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে, তারা বেদপন্থী বা বেদের ধর্ম পালন করত।

বৌদ্ধ ত্রিপিটক সাহিত্য সমসাময়িক সমাজের বিভিন্ন পেশার সম্পর্কে উল্লেখ করেছে, যেমন কৃষি, বাণিজ্য, গোরক্ষা, শস্ত্রজীবিকা, রাজপুরুষপদ (সৈনিকপদ, রাজসেবা), ইত্যাদি। কিন্তু সমাজে হিন্দু ধর্মে আজকে প্রচলিত বংশানুক্রমিক পেশাভিত্তিক বর্ণজাতি প্রথা, যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের উল্লেখ খুবই কম দেখা যায়। সমাজে হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্ণ ভিত্তিক স্তর বিন্যাস তখনও সুস্পষ্ট রূপ নেয় নাই বলে ত্রিপিটক সাহিত্য থেকে মনে হয়। এছাড়া শূদ্র ও বৈশ্যের উল্লেখ পরবর্তী প্রক্ষেপও হতে পারে। ইন্দো-গ্রীক সম্রাট মিনান্ডারের সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেনের কথোপকথনের ভিত্তিতে খ্রীষ্ট পূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রচিত (অনেকে মনে করেন, এটি আরো পরে রচিত) মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থে চতুর্বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়।৪৫

ত্রিপিটক সাহিত্যে ইন্দ্র, প্রভৃতি বৈদিক দেবতার কথা উল্লেখ থাকলেও আজকের বেশীরভাগ হিন্দু দেবতার নামের উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিনয় পিটকের অন্তর্গত মহাবর্গ গ্রন্থে ব্রাহ্মণদের পূর্ববর্তী মন্ত্ররচয়িতা ও মন্ত্রপ্রবর্তক ঋষি হিসাবে বৈদিক ঋষিদের নাম পাওয়া যায়, যারা হলেন ঋগ্বেদের ঋষি। যেমন, বিশ্বামিত্র, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু, ইত্যাদি।৪৬ সূত্রপিটকের অন্তর্গত ধম্মপদ গ্রন্থে ব্রাহ্মণের মন্দিরে পূজার্চনার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোনও মূর্তি বা প্রতিমাকে পূজা করার কথা নাই। এই বিষয়ে ধম্মপদ  থেকে একটি বর্ণনা নীচে দেওয়া হল : ৪৭ 

”একদা বুদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘসহ বারানসীতে যাইবার সময়ে পথিমধ্যে তোদেয়্য গ্রামে এক পুরাতন মন্দির দেখিয়া তথায় অপেক্ষা করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে একজন ব্রাহ্মণ আসিয়া সেই মন্দিরকে ভক্তিভরে পূজার্চনা করিয়া ভক্তিভরে প্রণাম করিলেন। তখন বুদ্ধ তাঁহাকে মন্দিরের ঐতিহাসিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ করিয়া বলিলেন যে, এই মন্দির কাশ্যপবুদ্ধের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত হইয়াছিল। জনসাধারণ এখানে পূজার্চনা করিয়া প্রভূত পুণ্য সঞ্চয় করে। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ মহাপুরুষগণকে পূজার্চনার সার্থকতা বুঝাইয়া দিলেন।” (বুদ্ধবগগো–(১৪), আখ্যানভাগঃ একশ’ পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বই)

বুদ্ধের সময় যে গরুর মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য বিক্রী হত তারও বিবরণ সূত্র পিটকের অন্তর্গত মধ্যম-নিকায় গ্রন্থ থেকে জানা যায়। সেখানে বলা হচ্ছে :৪৮

”দক্ষ গোঘাতক বা গোঘাতক-অন্তেবাসী গাভী বধ করিয়া, উহার দেহ অংশাশীভাবে বিভক্ত করিয়া, তাহা বিক্রয়ার্থ চৌরাস্তায় অবস্থিত থাকে, … “(মধ্যম নিকায়, স্মৃতিপ্রস্থান-সূত্র, ১০/৭)

ত্রিপিটক সাহিত্য থেকে বুদ্ধের সময়ে আজীবিক, নির্গ্রন্থ (জৈন ধর্মাবলম্বী), কেশ কম্বলী, প্রভৃতি সহ অনেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাবর্গে জটিল নামে এক সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে যারা অগ্নিহোত্র করত বলে জানা যায়। এছাড়া সমাজে নানা মতের সন্ন্যাসী, ভিক্ষু, শ্রমণ, তীর্থিক, ইত্যাদি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়, যাদের মধ্যে শ্রমণদের মর্যাদা বেশী ছিল ধারণ করা যায়। এজন্যই ব্রাহ্মণের উল্লেখ শ্রমণের পরে করা হয়েছে বলে মনে হয়। ক্ষত্রিয়ের উল্লেখও আছে এবং বলা হয়েছে যে, বুদ্ধ নিজে ক্ষত্রিয় কুল বা বংশে জন্মেছিলেন। এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে ধারণা করা যায় যে, ভারতবর্ষে দ্বিতীয় নগরায়নের সূচনা পর্বেই নতুন চিন্তার বিকাশের জন্য অনুকুল ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছিল, ফলে বুদ্ধের আগে থেকেই সমাজে নানা ধরণের দার্শনিক চিন্তা ও মত ছড়িয়ে পড়ছিল।

বৌদ্ধ ধর্মের সংকট শুরু হয় পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দে হুনদের ভারতে প্রবেশ ও আক্রমণের পরে। এই সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে বিপুল সংখ্যক বৌদ্ধ মঠ ও সেই সাথে অনেক পাণ্ডুলিপি সমৃদ্ধ পাঠাগার তারা ধ্বংস করেছিল। চীনা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, পণ্ডিত ও ভ্রমণকারী হিউয়েন-সাং বলছেন যে, হুন আক্রমণকারী মিহিরকুল গান্ধারে (বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম ও আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব অংশ) ১৬০০ বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছিল। হুনরা বৌদ্ধদের সুপরিচিত শিক্ষা-কেন্দ্র তক্ষশিলাও (পাকিস্তানী পাঞ্জাব) ধ্বংস করেছিল। তক্ষশিলা প্রাক-বৌদ্ধ যুগ থেকে প্রধান শিক্ষা-কেন্দ্র ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন যুগে বৌদ্ধদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা-কেন্দ্রের কথা জানা যায়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল তক্ষশিলা, নালন্দা (বিহার), বলভি (সৌরাষ্ট্র, গুজরাট), বিক্রমশিলা (বিহার), ওদন্তপুরি (বিহার), সোমপুর মহাবিহার (পাহাড়পুর, বাংলাদেশ), জগদ্দল মহাবিহার (বাংলাদেশ), পুষ্পগিরি (উড়িষ্যা), শালবন বিহার (ময়নামতি, বাংলাদেশ)।

৮ম শতাব্দীতে প্রধানত পশ্চিম অংশে এবং ১২শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে সমগ্র ভারতে মুসলমান আক্রমণে সকল ধর্মের মঠ, মন্দির ও তীর্থস্থান আগুন ও তরবারির দ্বারা পাইকারীভাবে ধ্বংস হল। প্রথম দিককার এইসব বহিরাক্রমণ ভারতের পশ্চিম অংশ থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে ধ্বংস করল। বৌদ্ধ ধর্ম শেষবারের মত সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছিল ৯ম থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতের পূর্ব অংশ থেকে শাসিত পাল বংশের যুগে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে বখতিয়ার খলজির আক্রমণ ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বৌদ্ধ মঠ সমূহের ব্যাপক ধ্বংস পূর্ব ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এভাবে মাঝে কিছু শতাব্দী বাদ দিয়ে পঞ্চম থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ধারাবাহিক বহিরাক্রমণে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, প্রাচীন যুগ থেকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের শিক্ষা চর্চার কেন্দ্র হিসাবে মন্দিরের প্রধান ভূমিকা ছিল না, বরং তা ছিল ব্রাহ্মণদের পরিবার যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করেছিল। ব্রাহ্মণদের এই সমস্ত শিক্ষা কেন্দ্র গ্রাম ও ছোট ছোট শহরে ছড়ানো থাকত। ফলে বহিরাক্রমণকারীরা মন্দির ধ্বংস করলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে নাই। যেহেতু বৌদ্ধদের ধর্মীয় ও শিক্ষা কেন্দ্র মঠ ও তীর্থ মন্দিরগুলো ছিল, বিদেশী হানাদারদের দ্বারা এই সব প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের বিপুল ক্ষতির কারণ হয়।

সাধারণভাবে এটি দাবী করা হয় যে, হিন্দু ধর্ম প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনেক প্রথা বহন করছে, এমন কি তার কিছু কিছু হরপ্পান সভ্যতা বা তার পূর্বেও প্রচলিত ছিল। মেহরগড়ে (বালুচিস্তান) আদি হরপ্পান স্তরে প্রায় ৪০০০-৩৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে স্তর ৩-এ এবং নৌশারোতে (বালুচিস্তান) প্রায় ২৮০০-২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে কিছু নারী মূর্তিতে সিঁদুর হিসাবে চুলের সিঁথিতে লাল রঙের রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।৪৯ সিঁদুর ভারতীয় বিবাহিতা হিন্দু নারীদের সাধারণভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়, যা বৌদ্ধ, জৈন, ও শিখ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রচলিত। মহেঞ্জো-দাড়োতে বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজে প্রচলিত অভিবাদনের ভঙ্গিতে  পোড়ামাটির মানুষের মূর্তি পাওয়া গেছে, যা নমস্কারের ভঙ্গি হিসাবে পরিচিত।৫০ অন্যকে সম্মান জানানোর একই ভঙ্গি জৈন ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রচলিত। এবিষয়ে আমরা একথাই বলতে পারি যে, অন্য ধর্মের মত হিন্দু ধর্মও পূর্বের সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতি, প্রথা ও নিয়ম ধারণ করেছিল, যেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু স্মরণাতীত কাল ধরে বাহিত হয়েছিল।

আমরা দেখতে পাই যে, হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ব্রাহ্মণশ্রেণী বেদকে প্রাধান্যে রেখে বৃহত্তর সমাজ গঠন করতে গিয়ে ভারতবর্ষের স্থানীয় ও অস্থানীয় নানা দেবতা, ধর্মমত, পূজাপদ্ধতি, লোককাহিনী ও বিশ্বাস তার ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর ফলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার প্রথা দেখতে পাওয়া যায়। এত বৈচিত্র্য ধারণ করেও এই জনগোষ্ঠী হিন্দু ধর্মভুক্ত হতে পারে, বেদের অভ্রান্ততা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার, ব্রাহ্মণের পবিত্রতা  ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও ব্রাহ্মণ তাকে যে বর্ণজাতি কাঠামোতে অন্তভুক্ত করেছে সেটিকে স্বীকার করার মধ্য দিয়ে। তবে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে এ কথা বলা যায় যে, এটি কোনও স্থির ধর্ম নয়। ফলে যুগে যুগে তার মধ্যেও কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। গুপ্ত যুগে এসে হিন্দু ধর্ম হিসাবে পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেলেও ধীর প্রক্রিয়ায় পরবর্তীকালেও তার ভিতর পরিবর্তন ঘটেছে। এবং এখনও ঘটে চলেছে। সেটা কাল প্রেক্ষিতে যেমন তেমন স্থান প্রেক্ষিতেও। তাই শুধু যে কালভেদে হিন্দু ধর্মের ভিতর পরিবর্তন ঘটেছে তাই নয়, অধিকন্তু বিভিন্ন স্থানিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথাও তার বৃহত্তর কাঠামোর মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তার বৈচিত্র্য সাধন করেছে।

উপরের সমগ্র আলোচনায় এখানে সংক্ষেপে সমাপ্তি টানা যেতে পারে। ঋগ্বেদের অধ্যয়ন এবং প্রত্নতত্ত্ব ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদি থেকে একথা বলা যায় যে, ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর্যায়ে বৈদিক ধর্ম বৈদিক ঋষিদের দ্বারা একটি ধর্মীয় আন্দোলনের ফসল হিসাবে উদ্ভূত হয়েছিল। আমরা মনে করি যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র নিরীশ্বরবাদী একটি গোষ্ঠী দ্বারা শাসিত হত  এবং জনসংখ্যার বিপুল অংশ এই দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, যা সম্ভবত সাধারণভাবে লোকায়ত নামে পরিচিত ছিল। এর অর্থ হল একটি নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন লোক সমাজে প্রচলিত ও চর্চিত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে যে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদ্ভব ঘটে তা বিপুলভাবে জনপ্রিয় এই নিরীশ্বরবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। প্রথম যুগে ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মের চেয়ে এই দুই ধর্মের অনেক বেশী প্রত্নতাত্ত্বিক বা পুরা নিদর্শন পাওয়া গেছে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর বৈদিক ঋষিদের উত্তরসূরিরা পরবর্তীকালে গঙ্গা নদীর উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈদিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ধারণ করে পরবর্তী কালে তারা নিজেদের ব্রাহ্মণ পরিচয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর প্রায় দুই হাজার বছর ধরে তাদের ধর্মে অনেক পরিবর্তন হয়েছিল, যা প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আমরা বিস্তারিত এখনও জানি না। তবে, বর্তমান প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য উৎস থেকে ধারণা করা যায় যে, ধর্মতত্ত্ব, প্রতিমা পূজা, অলঙ্ঘনীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বর্ণজাতি প্রথা, পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ধারণা — এসব নিয়ে যে হিন্দু ধর্মকে আজকে আমরা জানি তা দীর্ঘকাল ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়ায় ছিল, এবং সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে এটি প্রাথমিক রূপ নেয় ও বর্তমান কাঠামোগত রূপ গ্রহণ করে গুপ্ত যুগে এসে।

 

সূত্র ও টীকাঃ


এই নিবন্ধে ঋগ্বেদের সকল উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছেঃ ঋগ্বেদ-সংহিতা (প্রথম খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, প্রকাশকঃ হরফ প্রকাশনী, কলিকাতা, দ্বিতীয় প্রকাশ, ১৯৮৭; এবং ঋগ্বেদ-সংহিতা (দ্বিতীয় খণ্ড), প্রথম প্রকাশ, ১৯৭৬।

শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩। বইটি বর্তমানে বাজারে পাওয়া যায় না। তবে ওয়েব সাইট বঙ্গরাষ্ট্র-এ এটি পাওয়া যায়। লিংকঃ http://www.bangarashtra.net/article/853.html

শামসুজ্জোহা মানিক, সিন্ধু সভ্যতা থেকে হিন্দু সমাজ। লেখাটির লিংকঃ http://www.bangarashtra.net/article/1461.html

শামসুজ্জোহা মানিক, হিন্দু ধর্ম ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়। লেখাটির লিংকঃ http://www.bangarashtra.net/article/1458.html

এই নিবন্ধে কুরআন-এর সকল উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছেঃ আল-কুরআনুল করীম, প্রকাশকঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, একাদশ মুদ্রণ ১৯৮৭।

এই নিবন্ধে বাইবেলের উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে, বাইবেল, পুরাতন ও নতুন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।

K.N. Dikshit and B.R. Mani, Indian Civilization evolved in the 8th Millennium BCE in the Plains of ‘Lost’ River Saraswati, (Notes and News), in, Purātattava, Number 42, 2012, p. 268.

কেনেথ কেনেডি উল্লেখ করেছেন যেঃ “... High ranking individuals enjoy a greater potential to attain their full ontogenetic development, hence are taller in stature, and tend to suffer less from abnormalities of nutritional stress than do individuals of subordinate social status within the same society. However, observations of Harappan skeletal series from five major sites, which comprise about 350 individuals, have not revealed significant differences in patterns of growth and development as would be recognized by lines of arrested growth in long bones and hyper-palsia or dental enamel.” Kenneth A.R. Kennedy, Skulls, Aryans and Flowing Drains: The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization, in, (ed.), Gregory L. Possehl, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, Oxford & IBH Publishing Co., In collaboration with American Institute of Indian Studies, New Delhi, 1982, p. 290.

Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, (ed.), Nalini Rao, Sindhu-Sarasvatī Civilization – New Perspectives, Nalanda International, Los Angeles and D.K. Printworld, New Delhi, 2014, pp. 521-522.

প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৫২৩।

১০ Shamsuzzoha Manik and Shamsul Alam Chanchal, Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval. এই নিবন্ধটি ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। লিংকঃ http://www.bangarashtra.net/article/1422.html

১১ Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, Harappa: New Discoveries on its Origin and Growth, in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, 1999, p. 4.

১২ Michael Jansen, Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Age Cities of the Third Millennium BC, in, (eds.), Terje Tvedt and Terje Oestigaard, A History of Water, A, Series III, Vol 1: Water and Urbanism, Published by I.B. Tauris, 2014, p. 63.

১৩ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, (ed.), Nalini Rao, Sindhu-Sarasvatī Civilization – New Perspectives, p. 521.

১৪ Monica L. Smith, The Role of Professionals in Daily Life and Ritual Life: An Archaeological View from the Early Historic Era of Urbanism, in, Purātattava, Number 42, 2012, p. 3.

১৫ Sanju Shukla, J.N. Pandey, Ramabhilash Shukla, Anshu Goel and C.L. Dubey, Early Coins and their Chronology in the Ganga-Yamuna Lower Doab, in, Purātattava, Number 41, 2011, p.140.

১৬ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ১৪০।

১৭ Sunil Kumar Patnaik, Buddhist Monuments in South-Eastern India: A Study of Forms and Patronage, in, International Review of Social Research, 2019, 9(1): 38–48, p.38.

১৮ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 224.

১৯ S.C. Saran, N.G. Nikoshey, S. Nayan, J.K. Tiwari, A. Arif and N. Saxena, Excavations at Juafardih and its identification with Kulika, in, Purātattava, Number 38, 2008, p.71.

২০ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 223.

২১ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২২৩।

২২ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২২৩।

২৩ B.R. Mani, Dazu Grottoes and Indian Rock-Cut Sculptures: A Comparative Survey, in, Purātattava, Number 42, 2012, p. 44.

২৪ Nayanjot Lahiri, Revisiting the Cultural Landscape of Junagadh in the Time of the Mauryas, in Purātattava, Number 41, 2011, p. 129.

২৫ Ajit Kumar, Buddhist Caves of Western Maharashtra with Specific Reference to Early Sculptural Art, in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 54.

২৬ K. Rajan, Early Writing System: Some issues and interpretations, in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 148.

২৭ Shivakant Bajpai, Rahul Kumar Singh, Vrassottam Sahoo and Jeetendra Sahoo, Further Excavation at Damroo, District Balodabazar-Bhatapara, Chhattisgarh (2014-15), in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 220.

২৮ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ২২০।

২৯ Sunil Kumar Patnaik, Buddhist Monuments in South-Eastern India: A Study of Forms and Patronage, in, International Review of Social Research, 2019, 9(1): 38–48, p.38.

৩০ Kiran Kumar Thaplyal and Phool Chand Jain ‘Premi’, An Inscribed Image of Tīrthaṅkara Ŗishabha from Mandi Dweep, (Notes and News), in, Purātattava, Number 45, 2015, p. 314.

৩১ R.S. Bisht, How Harappans Honoured Death at Dholāvīrā, in, (ed.), Nalini Rao, Sindhu-Sarasvatī Civiliation – New Perspectives, 2014, p. 306.

৩২ Ajit Kumar, Buddhist Caves of Western Maharashtra with Specific Reference to Early Sculptural Art, in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 56.

৩৩ D.K. Nayak, A Study of Group-Information of the Temples of Orissa, in, Purātattava, Number 32, 2001-02, p. 117.

৩৪ Himanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattava, Number 44, 2014, p. 7.

৩৫ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৬।

৩৬ Ajit Kumar and M. Mahadevaiah, Early Historic Artifacts from Paal, District Aurangabad, Maharashtra, (Notes and News), in, Purātattava, Number 45, 2015, p. 298.

৩৭ Kanchana B. Bhaisare, V.S. Shinde and P.S. Joshi, Saurajyaramya: Vidarbha of the Vakataka Times, (Notes & News), in, Purātattava, Number 44, 2014, pp. 255-256.

৩৮ Himanshu Prabha Ray, The Archaeology of Sacred Spaces in India: From Multi-Religious Sites to Monuments, in, Purātattava, Number 44, 2014, p. 8.

৩৯ Richard Salomon, Indian Epigraphy: A Guide to the Study of Inscriptions in Sanskrit, Prakrit, and the other Indo-Aryan Languages, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1998, p. 8.

৪০ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৮০।

৪১ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৮৬।

৪২ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃঃ ৯২।

৪৩ P.P. Joglekar, Anil Kumar Dubey, Chandrashekhar and Sachin Kumar Tiwary, Animal Remains from Madar Dih, District Jaunpur, Uttar Pradesh, (Notes and News), Purātattava, Number 43, 2013, pp. 265, 266.

৪৪ Jason D. Hawkes, Riza Abbas, Gurudas Shete and Michael Willis, A Newly Discovered Early Iron Age Settlement at Chachondi, District Amravati, Maharashtra, in, Purātattava, Number 46, 2016, p. 124.

৪৫ পণ্ডিত শ্রীমৎ ধর্মাধার মহাস্থবির অনুদিত, মিলিন্দ প্রশ্ন, মহাবোধি বুক এজেন্সি, কোলকাতা, পুনর্মূদ্রণ ২০১৩। পৃঃ ১, ১৫৭, ২৭৪।

৪৬ প্রজ্ঞানন্দ স্থবির অনুদিত, মহাবর্গ , প্রকাশক শ্রী অধরলাল বড়ুয়া, কলিকাতা, ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দ। পৃঃ ৩২৪।

৪৭ গিরিশচন্দ্র বরুয়া অনুদিত, ধম্মপদ , বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম পুনর্মুদ্রণ ১৯৯৬। পৃঃ ৩২৮।

৪৮ শ্রীবেণীমাধব বড়ুয়া অনুদিত, মধ্যম-নিকায়, যোগেন্দ্র-রূপসীবালা ত্রিপিটক বোর্ড থেকে শ্রীঅধরলাল বড়ুয়া প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দ। পৃঃ ৬১।

৪৯ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization, in, (ed.), Roger D. Long, A History of Pakistan, Oxford University Press, 2015, p. 30.

B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On: The Continuity of Indian Culture, Aryan Books International, New Delhi, 2002, pp. 82-83.

৫০ B.B. Lal, The Sarasvatī Flows On, p. 127.

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ