Banner
সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনায় জেগে উঠুক উপমহাদেশ — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ March 1, 2020, 12:00 AM, Hits: 1549

 

পৃথিবীর এক তুলনা বিহীন সভ্যতার নাম সিন্ধু সভ্যতা। বহু দিক বিচারেই আধুনিক কালের পূর্বকাল পর্যন্ত এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে আধুনিকতম সভ্যতা। শতাব্দীকালের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে এমন এক সভ্যতার চিত্র আমাদের চোখের সামনে পরিস্ফুট হয় যা ছিল বিস্ময়করভাবে ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত, গণতান্ত্রিক এবং কালপ্রেক্ষিতে বিশাল ভূভাগব্যাপী বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও যথেষ্ট রকম শান্তিনির্ভর তথা অহিংস। *

--------------------------------------------
* সিন্ধু সভ্যতার সমৃদ্ধি, নগর বিন্যাস, গণতান্ত্রিকতা ইত্যাদি বিষয়ে আমার যৌথভাবে এবং এককভাবে লিখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ আছে। সুতরাং এখানে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে খুব প্রয়োজন বোধ না করলে আলাদাভাবে বিশদ আলোচনা করব না। এ সম্পর্কে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র (http://www.bangarashtra.net/article/853.html)  নাম উল্লেখ করব, যা বঙ্গরাষ্ট্র-এর ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ’-এ দেওয়া আছে। এছাড়া বর্তমান আলোচ্য নিবন্ধ পাঠের জন্য আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র দর্শন’ (http://www.bangarashtra.net/article/1333.html) এবং ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’ (http://www.bangarashtra.net/article/1456.html) সহায়ক হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এই আলোচনাকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে একান্ত প্রয়োজন না হলে সিন্ধু সভ্যতার অনেকগুলি বিষয়ের উপরে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করব না।
--------------------------------------------

প্রাচীন কালের অন্য সকল সভ্যতা ছিল ব্যতিক্রমহীনভাবে যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগ নির্ভর। সেটা মিসর, ব্যাবিলন কিংবা চীন যেখানকারই সভ্যতা হোক না কেন! এমন কি অনেক পরবর্তী কালে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে কলম্বাস কর্তৃক আমেরিকায় পদার্পণের সময় সেখানে আজটেক এবং ইন্কা এই যে দুইটি সভ্যতা বিদ্যমান ছিল সেগুলিও ছিল যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ এবং নৃশংস সব প্রথানির্ভর – যেমন নিয়মিতভাবে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পরাজিত ও বন্দী উপজাতির মানুষদেরকে পাইকারিভাবে বলিদান।

ইউরোপীয়দের আমেরিকা প্রবেশের পূর্বে মধ্য আমেরিকার বৃহৎ অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত মায়া নামে পরিচিত আর একটি উন্নত নগর সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারা যায় যা ইউরোপীয়দের প্রবেশের পূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। এখন শুধু পড়ে আছে বিরাট অঞ্চলব্যাপী ছড়ানো ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়া বিভিন্ন নগরের ধ্বংসাবশেষ আর সুউচ্চ পিরামিড। মায়া সভ্যতার মত বৃহৎ অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সমৃদ্ধ ও উন্নত একটা সভ্যতার প্রায় আকস্মিক বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান গবেষকদের নিকট গভীর আগ্রহের বিষয় হয়ে আছে। ইউরোপীয়দের আক্রমণ ও আগ্রাসনে ইনকা এবং আজটেক রাষ্ট্র এবং সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু মায়া সভ্যতার ধ্বংসের পিছনে ইউরোপীয়দের ভূমিকা সেভাবে ছিল না। তার আগেই মায়া সভ্যতা মূলত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মায়াদের বিভিন্ন বিবরণ বিশেষত মায়া লিপির পাঠোদ্ধার দ্বারা এখন অনেকে মনে করছেন, যে যুদ্ধ নির্ভরতা দিয়ে মায়া সভ্যতার উত্থান সেই যুদ্ধ নির্ভরতাই তার ধ্বংসের মূল কারণ। মায়া হিসাবে পরিচিত জনগোষ্ঠীর নগর রাষ্ট্রগুলি নিজেদের মধ্যে এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যা অন্তহীন ও অমীমাংসেয় যুদ্ধের চক্রে সভ্যতাকে নিক্ষেপ ক’রে তার চূড়ান্ত ধ্বংস সাধন করে।

আসলে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহ নির্ভর আদিম সমাজ থেকে কৃষি এবং অতঃপর নগর সভ্যতা নির্ভর সমাজে মানুষের উত্তরণ সহজ কোনও কাজ ছিল না। পশুশিকার ও বনের ফলমূল সংগ্রহ-নির্ভর চলমান ও মুক্ত আদিম জীবন থেকে কৃষি বিশেষত লাঙ্গল-নির্ভর কৃষি এবং স্থিতিশীল বসতি তথা গ্রাম এবং গ্রাম থেকে তার উচ্চতর পর্যায় নগর জীবনে প্রবেশ মানুষের জন্য খুবই কষ্টদায়ক একটা যাত্রা ছিল। এটা ছিল প্রকৃতির অবারিত প্রান্তরে বিচরণশীল মুক্ত ও স্বাধীন মানুষের বন্দী জীবনে আবদ্ধ হবার শামিল। তার উপর যদি তার উপর দেওয়া যায় সভ্যতা নির্মাণের জন্য বাধ্যতামূলক ও শ্রমসাধ্য কাজের বোঝা তাহলে সেটা হতে পারত আরও দুঃসহ অভিজ্ঞতার ব্যাপার।

সভ্যতার উন্নত অথচ কৃত্রিম জীবন কিংবা খাদ্যের সহজপ্রাপ্তি যদি আদিম শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী মানুষদের নিকট এতই আকর্ষণীয় হত তাহলে হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে সভ্যতার পাশাপাশি আদিম উপজাতীয়দের এমন বিচিত্র সহাবস্থান দেখা যেত না। এমনকি আজও আদিম শিকারী জীবনে অভ্যস্ত এমন অনেক উপজাতিকে উপমহাদেশের বিভিন্ন দুর্গম বনাঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায় যারা সভ্য সমাজের উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে নিজেদের পুরাপুরি দূরে রাখতে না পারলেও তাদের আদিম শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী জীবনের অনেক অভ্যাস ও আচরণ পরিত্যাগ করতে পারে নাই। আমি আমার ছেলেবেলায় তৎকালীন দিনাজপুর জিলার গ্রামাঞ্চলে সাঁওতালদেরকে দলবেঁধে পাখী, ইঁদুর ইত্যাদি শিকারে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তে দেখতাম। তখনও দিনাজপুরে বিভিন্ন স্থানে মাইলের পর মাইল জুড়ে বন বা জঙ্গলাকীর্ণ অনেক পতিত জমি ছিল। সাঁওতালরা জীবিকার তাগিদে নানানভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। তাদের অনেকে ভূমিহীন হওয়ায় দিনমজুরি করত। এছাড়া বাকী সময়ে তারা বনে-জঙ্গলে শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ করত। বস্তুত কৃষিজীবী মানুষরা তাদের খাদ্য ও বাসের উৎস বনভূমি ধ্বংস না করলে তারা কোনক্রমেই সভ্য জীবনে প্রবেশ করতে চাইত না। আমরা এ প্রসঙ্গে ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি যেখানে আজও এমন কিছুসংখ্যক উপজাতি বাস করে যারা সভ্য জীবন থেকে নিজেদের আদিম জীবনকে রক্ষা করতে চেয়ে সভ্য মানুষদের থেকে নিজেদের দূরত্ব বজায় রাখায় মরীয়া হয়ে থাকে। আমাদের নিকট সভ্যতা যতই আকর্ষণীয় মনে হোক তাদের নিকট এটা অতীব ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য একটা বিষয়।

পাতা : ১

আসলে মানুষ বলে কথা নয়, কোনও প্রাণই তার চিরচেনা বা চিরঅভ্যস্ত পথ ছেড়ে অন্য জীবনে যেতে চায় না। তার উপরে সেই অন্য বা নূতন জীবনে যদি কষ্ট থাকে তাহলে তো কথাই নাই। সভ্যতা মানুষকে যে আরাম বা স্বাচ্ছন্দ্য দিক সেটার জন্য প্রথমে তো কষ্টই করতে হয়। এই সঙ্গে এ কথাও তো সত্য যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সভ্যতা সংখ্যাগুরুর কষ্টসাধ্য শ্রম এবং দুঃখের বিনিময়ে সংখ্যালঘুকে আরাম-আয়েশ এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। বিশেষত সভ্যতার পথে নূতন যাত্রার সময় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর চাপাতে হয়েছে অপরিচিত ও বন্দী জীবনের অসহনীয় শ্রম ও দুঃখ-কষ্টের বোঝা। সভ্যতার আদিপর্বে এক উপজাতি বা একাধিক উপজাতির কনফেডারেসি বা সংঘ ভিন্ন উপজাতির মানুষদেরকে ধরে এনে সভ্য জীবনের অন্তর্ভুক্ত করত। আসলে বন্দী মানুষরা হত দাস অথবা এমন অধীনস্থ মানুষ যারা সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম দানে বাধ্য হত। সুতরাং মিসর, ব্যাবিলন বা সুমের এবং চীনে সভ্যতা নির্মাণের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসাবে দেখা দিয়েছ সেনাবাহিনী এবং যুদ্ধের প্রাধান্য।

অথচ এমন কোনও ঘটনা সিন্ধু সভ্যতায় ঘটে নাই। তবে কি এ কথা বলব জীবজগৎ এবং মানুষের সর্বজনীন চরিত্র-বৈশিষ্ট্য থেকে সিন্ধু সভ্যতার নায়কদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ভিন্ন? অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার মানুষ কি মানব জাতি থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী?

আমার ধারণা, সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতাদের আদিপর্বকে বুঝতে পারলে মূলত শান্তিপূর্ণ ধারায় সিন্ধু সভ্যতার বিকাশের রহস্য উন্মোচন করা যাবে। তার জন্য আমাদেরকে যেতে হবে সেই আদিপর্বে যখন একটা উপজাতি কিংবা সমমনা একাধিক উপজাতির একটা সংঘ বা কনফেডারেসি অব ট্রাইব্স মূলত শান্তিপূর্ণ পথে লাঙ্গল দ্বারা জমি চাষের মাধ্যমে স্থিতিশীল কৃষিসমাজ গঠন এবং তার পরিণতিতে নগর সভ্যতা গঠনের পথে যাত্রা করেছিল। বস্তুত একটা বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বাস্তবতায় এক পথপরিক্রমায় তারা বাধ্য হয়েছিল লাঙ্গল নির্ভর কৃষি জীবনে প্রবেশে। এ ক্ষেত্রে ভিন্ন উপজাতির মানুষদের উপর বলপ্রয়োগের ভূমিকা ছিল না বা থাকলেও সেটা ছিল তুলনায় গৌণ। মনে রাখতে হবে আগের কালে প্রতিটি উপজাতি নিজেদেরকে অন্য মানুষ থেকে অনেক ভিন্ন ভাবত। এমনকি এক উপজাতি অন্য উপজাতির মানুষদেরকে অনেক সময় মানুষ বলেই গণ্য করত না।

এক সময় নারীবাদ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পেতে চেয়ে বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও শেরপুর জিলাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিবাসী গারো জাতিসত্তার উপর অনুসন্ধান বা গবেষণা চালাতে গিয়ে আমি জানতে পারি যে, গারোরা নিজেদের পরিচয়ের জন্য গারো শব্দ ব্যবহার করে না। এটা সম্পূর্ণরূপে বাইরের মানুষদের দেওয়া শব্দ। প্রকৃতপক্ষে গারোরা নিজেদের জন্য গারো শব্দের প্রয়োগ পছন্দও করে না; বরং বাধ্য হয়ে মেনে নেয়। গারোরা নিজেদেরকে মান্দে বা মান্দি বলে। গারো ভাষায় যার অর্থ হচ্ছে মানুষ। অর্থাৎ একমাত্র তারা নিজেরা মানুষ। বাকী সব মানুষ তাহলে কী? অবশ্য গারোরা অনেক সময় আর একটি শব্দ নিজেদের পরিচয়ের জন্য ব্যবহার করে। সেটা হচ্ছে আচিক। গারো ভাষায় যার অর্থ হল পাহাড় বা পাহাড়ী। গারো বুঝাতে শব্দটার ব্যবহার সম্ভবত অনেক সাম্প্রতিক।

যাইহোক, সব ক্ষেত্রে যদি নাও হয়ে থাকে তবু অন্তত অনেক ক্ষেত্রে আদিম সমাজে নিজ উপজাতির বাইরের মানুষদেরকে প্রকৃত অর্থে মানুষ হিসাবে বিবেচনা না করার ফলে নিজ উপজাতির মানুষদের জন্য যে আবেগ বা অনুভূতি কাজ করত সেটা অন্য উপজাতির মানুষদের জন্য থাকত না। সুতরাং অন্য সকল সভ্যতায় আমরা সভ্যতা নির্মাণে নৃশংসতার ব্যাপ্তি দেখতে পাই। এই সকল সভ্যতায় একদল মানুষ রক্তবন্ধনহীন কিংবা অপরিচিত আর একদল তথা ভিন্ন উপজাতির মানুষদের প্রতি যে কোনও ধরনের নিষ্ঠুর আচরণে সমস্যা বোধ করত না। অধীনস্থ বা বন্দী মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধন না থাকায় শাসক শ্রেণী বা শাসক জনগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যেও অসন্তোষ বা বিদ্রোহের সম্ভাবনা থাকত না।

প্রকৃতপক্ষে মানুষ মানুষের প্রতি নির্দয় হতে পারলেই সাধারণত সভ্যতা নির্মাণ করতে পারত। সুতরাং যারা সভ্যতা নির্মাণ করত তাদের মানসিক গঠনটাই এমন ধরনের সহিংসতা ও ত্রাস সৃষ্টিমূলক আচরণের উপযোগী হয়ে উঠত। এই বাস্তবতায় সম্ভব শাসকদের বিলাস-বৈভব প্রদর্শনের জমকালো আয়োজন। ফলে অধীনস্থ জনগণের শ্রম, ঘাম ও অশ্রুর সাগর প্রবাহিত করে নির্মিত হয়েছে বিপুলায়তন পিরামিড কিংবা সমাধি সৌধ, মন্দির আর রাজপ্রাসাদ। এই পথেই হেঁটেছে মিসর, ব্যাবিলন এবং চীন। এমনকি গোলার্ধের অপর পার্শ্বে থাকা আমেরিকার মায়া, ইনকা এবং আজটেকরাও আলাদাভাবে এই একই পথ ধরে হেঁটেছে। শুধু ব্যতিক্রম হয়ে থেকেছে সিন্ধু সভ্যতা। আয়তনের বিচারে প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম সভ্যতা, যা সমকালীন মিসরের তুলনায় কিংবা ব্যাবিলনেরও তুলনায় দ্বিগুণ আয়তন-বিশিষ্ট, দশ থেকে সাড়ে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত, সেই মহা সভ্যতার নায়কেরা সভ্যতা নির্মাণে এমন এক পথ ধরে হেঁটেছেন যার তুলনা পৃথিবীতে আর নাই।

আর তাই সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে যুদ্ধনির্ভর সভ্যতার চিত্র নির্মাণ করা যায় না। শুধু প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের নিম্নমান লক্ষ্যণীয় নয়, সেই সঙ্গে কোথায়ও যুদ্ধের বা সেনাবাহিনীর বীরত্ব প্রদর্শনমূলক কোনও চিত্র কিংবা শিল্পকর্ম পাওয়া যায় নাই। অথচ অন্য সকল সভ্যতায় যুদ্ধাস্ত্রের উন্নত মান এবং প্রাচুর্য যেমন লক্ষ্যণীয় তেমন দেওয়াল চিত্র এবং বিভিন্ন শিল্পকর্ম সভ্যতায় যুদ্ধ ও যোদ্ধার গুরুত্বকে তুলে ধরে। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে বুঝা যায় অন্যান্য সভ্যতার মত এখানে যোদ্ধা, যুদ্ধ এবং সেনাবাহিনীকে আদর্শায়িত করা হয় নাই। এটা স্পষ্ট যে, রাষ্ট্র এবং সভ্যতা রক্ষার প্রয়োজনে সেনাবাহিনী তথা যোদ্ধা থাকলেও ক্ষমতা ও মর্যাদার বিচারে সমাজে তাদের অবস্থান ছিল যথেষ্ট গৌণ। অর্থাৎ সভ্যতা রক্ষায় যে ভূমিকাই থাকুক সভ্যতার মূল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল না।

পাতা : ২

প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণে বলপ্রয়োগ তথা জবরদস্তির ভূমিকা ছিল গৌণ, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নগণ্য। বিশাল অঞ্চল ব্যাপী শত শত বৎসর ধরে একটি সুউন্নত নগর সভ্যতা বলপ্রয়োগ ছাড়া কীভাবে গড়ে উঠেছিল এবং টিকেছিল এ কথা ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। আলোচনাকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখতে চেয়ে সভ্যতার নম্রতা, সম্পদের বণ্টনে বেশ কিছুটা সুষমতা, নগর পরিকল্পনা এবং পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে পরিস্ফুট জনগণের স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাস্থ্যের প্রতি শাসকদের মনোযোগ ইত্যাদি নিয়ে এখানে আর বিশেষ কিছু আলোচনা করব না। সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা এগুলি সম্পর্কে জানেন। আমার বিভিন্ন লেখায়ও বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি। *

--------------------------------------------
* ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ ছাড়াও আমার অল্পকাল পূর্বে লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র দর্শন’ (http://www.bangarashtra.net/article/1333.html) এবং ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’-এ (http://www.bangarashtra.net/article/1419.html) বিষযগুলি নিয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
--------------------------------------------

এটা স্পষ্ট যে, প্রধানত শান্তিপূর্ণ ধারায় বিকশিত বলেই সিন্ধু সভ্যতায় অন্যান্য সভ্যতার মত ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আকাশ-পাতালের পার্থক্য তথা অস্বাভাবিক বৈষম্য বা অসমতার প্রকাশ যেমন আমরা দেখতে পাই না তেমন দেখতে পাই না ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবনের প্রকাশও। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত চারটি বৃহৎ নগর হল হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, রাখিগাড়ী এবং গানেরিওয়ালা। এই নগরগুলির মধ্যে আয়তনেও খুব বেশী পার্থক্য লক্ষ্যণীয় নয়। এটা ঠিক যে, সকল নগরের ভিতরে উচ্চনগর কিংবা নগর-দুর্গ হিসাবে কথিত প্রাচীর ঘেরা একটা আলাদা স্থান আছে। নগরের ভিতর এটাকে একটা আলাদা নগর বলা যায়। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকরা এটাকে নগরের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছাড়া আর কিছু বলে মনে করেন না। সবচেয়ে বড় কথা সভ্যতার কোথায়ও রাজপ্রাসাদ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কোনও ভবনের সন্ধান পাওয়া যায় না। এটা স্পষ্টতই ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবনের অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রে যে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র ছিল না, বরং প্রজাতন্ত্র এবং সেই সঙ্গে কোন না কোন ধরনের জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা ছিল নিশ্চিতভাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। একদিকে সমাজে বিদ্যমান এক ধরনের সমতা অথবা বিরাট ধরনের বৈষম্যের অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবনের অনুপস্থিতি সিন্ধু সভ্যতাকে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য মহিমা দিয়েছে। *

--------------------------------------------
* নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার বিচারে মিসর, ব্যাবিলন বা সুমের, চীন ইত্যাদি সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার পার্থক্যের দিক সম্পর্কে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমি কিছু বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ গ্রন্থের ‘চতুর্থ অধ্যায় — সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক অধ্যায়ের ‘সিন্ধু সভ্যতার কিছু বৈশিষ্ট্য’-এ। আগ্রহী পাঠকের জন্য ‘সিন্ধু সভ্যতার কিছু বৈশিষ্ট্য’ শীর্ষক আলোচনা এই প্রবন্ধের শেষে ‘পরিশিষ্ট’-এ সম্পূর্ণটাই দেওয়া হয়েছে।
--------------------------------------------

আর একটি বৈশিষ্ট্য সিন্ধু সভ্যতাকে অনন্য মহিমা দিয়েছে। সেটা হচ্ছে ধর্মের প্রকাশ হিসাবে দেবতা-মূর্তি এবং মন্দিরের অনুপস্থিতি। অন্য সকল সভ্যতা যে ধরনের বলপ্রয়োগ এবং নিষ্ঠুর শাসন ও শোষণের উপর প্রতিষ্ঠিত হত তাতে অধীনস্থ জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্ম ছিল এক অপরিহার্য হাতিয়ার। কারণ শুধু বলপ্রয়োগ দ্বারা কোনও ব্যবস্থাকে চিরকাল মানুষের উপর চাপিয়ে রাখা যায় না। এর জন্য মানুষের মনোজগৎকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সুতরাং গড়ে তুলতে হয় এমন ভাবাদর্শিক ব্যবস্থা যাতে অধিকার বঞ্চিত ও অধীনস্থ মানুষ তাদের উপর পরিচালিত অবিশ্বাস্য রকম দমন, পীড়ন এবং দুর্গত ও বঞ্চিত জীবনকেও মেনে নিবার প্রেরণা ও সান্ত্বনা কিংবা যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। সুতরাং গড়ে তোলা হয় ধর্ম।

যে সভ্যতা সাধারণ মানুষের উপর যত বেশী নির্দয় সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সেখানে অলৌকিক বিশ্বাসমূলক ধর্মের দাপট তত বেশী। প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে তার প্রকাশ হিসাবে দেখা দেয় দেব-দেবীর প্রতিমা এবং মন্দির। অর্থাৎ এই সকল সভ্যতায় শাসক বা রাজার ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে যেমন থাকবে বৃহৎ প্রাসাদ এবং সেই সঙ্গে থাকতে পারে তাদের বৃহৎ মূর্তি তেমন থাকবে দেবতাদের মূর্তি এবং সেই সব মূর্তি পূজার স্থান হিসাবে মন্দির। অর্থাৎ ব্যাপারটা যেন এমন যে, দৃশ্যলোকের শাসক রাজার বাসের জন্য যেমন চাই তার ক্ষমতা ও সামর্থ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জমকালো বা বিরাট গৃহ বা প্রাসাদ তেমন অদৃশ্য লোকের শাসক দেবতার জন্যও চাই তার প্রতীক স্বরূপ প্রতিমা পূজার গৃহ বা মন্দির।

এই সকল প্রাচীন সভ্যতায় রাজারা প্রকৃতপক্ষে অনেক সময়ই দৈব ক্ষমতাসম্পন্ন। অর্থাৎ রাজাদেরকে মনে করা হয় পৃথিবীতে স্বর্গের দেবতাদের প্রতিভু স্বরূপ কিংবা তাদের মানবীয় রূপ। পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাচীন সভ্যতায় মানুষ মনে করত যে, স্বর্গের দেবতাদের নিকট থেকে এই সকল রাজা ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে পৃথিবীতে শাসন করে। অর্থাৎ রাজারা প্রকৃতপক্ষে দেব-রাজা বা god-king. এই দেব-রাজা বা god-kingরা মিসরে কিংবা চীনেও শাসন করত। ব্যাবিলনের নগর-রাষ্ট্রগুলিতে দেবতাদের পক্ষ থেকেই রাজা বা পুরোহিতরা শাসন করত। প্রাচীন জাপানে শুধু নয়, আধুনিক জাপানেও অনেক সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে রাজা বা সম্রাটরা স্বর্গপুত্রের মর্যাদা সম্পন্ন।

পাতা : ৩

ইউরোপীয়দের পদার্পণের পূর্বকার লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতাও একই কথা বলে। অবশ্য সেখানে ধর্মের অংশ হিসাবে রক্তপাত, যুদ্ধ এবং নৃশংসতার ভূমিকা খুব বেশী। আমার অনুমান সেখানে লাঙ্গল এবং লাঙ্গল টানার জন্য গরু বা ঘোড়ার অনুপস্থিতে কৃষি তথা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা দুর্বল ছিল। ফলে নগর সভ্যতা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত খাদ্য বা ফসল উৎপাদনের জন্য নিজ উপজাতির বাইরের বিভিন্ন উপজাতির মানুষদেরকে অসহনীয় শ্রমে নিয়োজিত করতে হত। এর সঙ্গে ছিল নগর সভ্যতা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিপুল শ্রমশক্তির প্রয়োজন।

এই রকম বাস্তবতায় বিশাল বিশাল পিরামিড, রাজপ্রাসাদ এবং দেবতাদের মূর্তি ও মন্দির সমাকীর্ণ নগর-সভ্যতা নির্মাণে যে অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতা এবং বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয়েছিল সেটার অনুকূলে শাসক শ্রেণী ও শাসিত জনগণ এই উভয়েরই মানসিকতা সৃষ্টির জন্য এমন সব রক্তপিপাসু দেবতার পূজা প্রবর্তন করা হয়েছিল, যাদের পূজায় প্রতি বৎসর শত শত এমনকি কখনও কয়েক সহস্র মানুষকে বলি দেওয়া হত। এইসব বলির মানুষ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন উপজাতির বিরুদ্ধে নিয়মিত যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা করা হ্ত। আজটেক দেবতাদের নিকট বলিদানের যে নৃশংস বিবরণ আমার মনে আছে তা এক কথায় শুধু ভয়াবহ নয়, উপরন্তু তার বিবরণ যে কোনও অনুভূতিসম্পন্ন মানুষকে শিহরিত করবার জন্য যথেষ্ট। বলির উদ্দেশ্যে নেওয়া মানুষদের বুক চিরে হাত ঢুকিয়ে জীবন্ত হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে তুলে এনে তাকে দেবতার মূর্তির পদতলে উৎসর্গ করা হত। তখনও সেই ছিন্ন হৃদপিণ্ড জীবন্ত থাকায় কিছু সময় ধুক ধুক করে সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হত। বহুসংখ্যক মানুষের এই ছিন্ন হৃদপিণ্ড ছিল দেবতাদের প্রিয় নৈবেদ্য বা অর্ঘ্য।

মিসর কিংবা ব্যাবিলন হয়ত এতটা ভয়ঙ্কর নয়। কিন্তু মিসরের অতিকায় পিরামিড অথবা ব্যাবিলনের বিরাট বিরাট জিগ্গুরাট নির্মাণে যে বিপুল মানবিক শ্রম ও সম্পদের প্রয়োজন হত তার পিছনের নির্দয়তা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। বিশেষত বহু দূরবর্তী স্থান থেকে পাহাড় কেটে বিশাল বিশাল প্রস্তরখণ্ড এনে মিসরের অতিকায় পিরামিডগুলি নির্মাণে কত মানুষের যে প্রাণ যেত এবং সেই সঙ্গে কত বিপুল সংখ্যক মানুষের অঙ্গহানি ঘটতে পারত সে প্রশ্নও মনে জাগা স্বাভাবিক। অথচ এই পিরামিড মানুষের কী কাজে লাগত? এই সকল পিরামিড মৃত রাজা বা ফারাওদের সমাধি বা কবর ছাড়া তো আর কিছুই নয়। অর্থাৎ একটা সভ্যতা তার বিপুল মানবিক ও বস্তুগত সম্পদকে অপচয় করেছে শুধু মৃত্যুর পর শাসকদের সুখভোগের কল্পনা বা আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করবার জন্য। এ থেকে সহজেই বুঝা যায় জীবিত অবস্থায় এই শাসকদের শাসন কতটা জাঁকজমকপূর্ণ এবং উদ্ধত ছিল।

বস্তুত এটা যে শুধু ব্যক্তি শাসক বা ফারাওয়ের সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতার বাস্তবতাকে প্রকাশ করে তাই নয়, অধিকন্তু এটা শাসকদের একটা সম্পূর্ণ শ্রেণীরও বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরে। অর্থাৎ একটা ভয়ঙ্কর নির্দয় শাসক শ্রেণী এই সকল সভ্যতার নায়ক, যাদের শীর্ষে থাকত নানান ধরনের অথবা নামে দেব-রাজা বা god-king, যারা বাস্তবে মানুষ হলেও অধীনস্থদের কল্পনায় তাদেরকে প্রতিভাত করানো হত স্বর্গীয় কর্তৃত্ব বা দেবতাদের মানবীয় প্রতিনিধি কিংবা এমনকি তাদের অংশ হিসাবে। এই দেব-রাজারা স্বর্গের দেবতাদের নামে অথবা এমনকি দেবতা হিসাবেও শাসন করত মর্ত্যের মানুষদের উপর। আসলে একটা শ্রেণী শাসন করত এইসব তথাকথিত দেব-রাজাকে সামনে রেখে। এবং দেব-রাজাদের স্বেচ্ছাচারী শাসনের সুবিধাভোগী তারা নিজেরাও হত নানানভাবে এবং নানান পরিমাণে। বস্তুত এই নির্দয়তার প্রক্রিয়ায় শুধু একটা শ্রেণী নয়, বরং একটা সমাজও যেন রক্তপিপাসু হয়ে উঠত। যে প্রক্রিয়ায় তারা অধঃপতিত হত বাইরের আঘাত ও ধ্বংস ছাড়া এই রকম সমাজ-জীবনে অভ্যস্ত জনগণ নিজেরাও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না।  

প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতায়ও বিরাট বিরাট নগর এবং বহুসংখ্যক বৃহৎ ভবন নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু সেসবের কোনটাই বিশেষ ব্যক্তির ক্ষমতার উদ্ধত প্রকাশ ঘটায় না। অর্থাৎ তেমন ক্ষমতার অধিকারী শ্রেণীও সেখানে ছিল না। বরং সমগ্র সভ্যতা ক্ষমতা এবং সম্পদের তুলনামূলকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টনের বাস্তবতাকে তুলে ধরে।

সুতরাং যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি সে কথারই পুনরুক্তি করে বলতে হয় যে, দুর্গত মানুষকে তার দুর্গত জীবনকে মানিয়ে নিবার প্রয়োজনে ধর্মেরও প্রয়োজন হয় নাই। বিপুল ক্ষমতার অধিকারী রাজা নাই। সুতরাং তার প্রতিরূপ হিসাবে কল্পনার জগতে দেবতা বা ঈশ্বরকে অধিষ্ঠিত করারও প্রয়োজন হয় নাই। বরং সমস্ত সভ্যতা তার সর্বাধিক পরিমাণ শ্রম ও মনোযোগ দিয়েছে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বোচ্চ পরিমাণ ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের উপর। এ হল এমন এক সভ্যতা যার রাজা নাই, তাই তার প্রাসাদ এবং মূর্তি নাই; দেবতা নাই, তাই তার মন্দির এবং প্রতিমা নাই।

হয়ত বলা হবে সিন্ধু সভ্যতায় ছোট মূর্তি পাওয়া গেছে। যেমন যোগাসনে আসীন যোগীর মত একটি মূর্তির কথা বলা হয়। কিন্তু অত বিশালায়তন সভ্যতায় অত ছোট একটি মূর্তি যে কোনও রাজকীয় ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের মূর্তি হতে পারে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ যে কোনও নির্মাণের মত মূর্তির সঙ্গেও সম্পর্কিত থাকে সভ্যতার শক্তি এবং সামর্থ্য এবং সেই সঙ্গে তার প্রেরণা। তাছাড়া অত বৃহৎ সভ্যতায় একটা মাত্র মূর্তি দিয়ে কি এমন ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়? এই একই বিচার থেকে অযত্নে নির্মিত পোড়া মাটির যেসব ক্ষুদ্র নারীমূর্তিকে মাতৃদেবী হিসাবে কখনও বা কল্পনা করা হয় সেগুলি যে অন্তত সভ্যতার ধর্মীয় ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় সে কথাও দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। এগুলি যদি ধর্মবিশ্বাস বা অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েও থাকে তবে বলতে হবে এগুলি পশ্চাৎপদ ও সংখ্যাল্প জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসের স্মারক কিংবা এগুলি বাচ্চাদের খেলার পুতুল ছাড়া আর কিছু না।

এ প্রসঙ্গে সিলের কথা আসবে। কারণ বহু সংখ্যক সিলে মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণী কিংবা কল্পিত প্রাণীরও (ইউনিকর্ন্) চিত্র পাওয়া গেছে। এ সম্পর্কে আমি আমার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করলেও এখানে এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

পাতা : ৪

সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার আজ অবধি হয় নাই। সুতরাং ভাষার সাহায্য ছাড়া আমাদেরকে লিপির চিত্রগুলির তাৎপর্য বুঝার চেষ্টা করতে হয়। সিলের ব্যবহার নানান কাজে হত। অনুমান করা হয় ব্যবসায়িক লেনদেনে এগুলির ব্যবহার ছিল। এছাড়া হয়ত রাষ্ট্রের দাপ্তরিক কিছু কাজে এগুলির ব্যবহার ছিল। তা যা-ই হোক, সিলে বিভিন্ন প্রাণীর চিত্রের নিশ্চয় কিছু তাৎপর্য ছিল। এগুলি সকল ক্ষেত্রে না হোক, কিছু ক্ষেত্রে কি ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না?

আমার এখন ধারণা বিকাশমান পর্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ধর্মবিশ্বাস-মুক্ত ছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রে ধর্মের স্থান ছিল না। কারণ হিসাবে সভ্যতার উপযোগবাদের বৈশিষ্ট্যের প্রতি দিকনির্দেশ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি মানুষের সামাজিক বাস্তবতা। অর্থাৎ সমাজের বাস্তব রূপ মানুষের কল্পনায় বিমূর্ত রূপ পরিগ্রহ করে। বলা যায় ধর্ম সমাজের বাস্তবতার এক ধরনের প্রতিচ্ছবি। ঈশ্বর, দেবতা, দেবদূত, স্বর্গ, নরক, আত্মা, পরজন্ম, পরলোক এসবের কল্পনা যে শুধু মানুষের বাস্তব জীবন থেকে উঠে আসে তা-ই নয়, উপরন্তু এগুলি মানুষের বাস্তব জীবনের চাহিদার প্রতিফলনও ঘটায়।

সুতরাং যে সমাজে শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক তথা শাসক শ্রেণী ও শাসিত শ্রেণীর সম্পর্ক স্বর্গ ও মর্ত্যের পার্থক্যকে প্রতিফলিত করে না সেখানে ধর্মের প্রয়োজন কেন হবে? ধর্মের স্বর্গ-নরক, দেবতা, ঈশ্বর, সুতরাং আত্মা-পরমাত্মা এসবই সেখানে অপ্রয়োজনীয় এবং বাস্তবতা বর্জিত ধারণা মাত্র। সুতরাং শাসক শ্রেণীর নিকট যেমন এগুলি নিরর্থক এবং অপ্রয়োজনীয় শাসিত বা জনগণের নিকটও তেমন তা-ই। তাদের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি হবে না বলে এগুলি যেমন তাদের বোধগম্য হবে না তেমন এ ধরনের পরজীবনের কল্পনাভিত্তিক বিশ্বাসমূলক ধর্মের প্রতি তারা আকৃষ্টও হবে না।  সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার মূল ধারায় ধর্মের স্থান থাকবার কারণ নাই। আর তাই সেখানে সমগ্র সভ্যতায় উপযোগবাদের যেমন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তেমন ধর্মানুষ্ঠানের প্রকাশও সেভাবে দেখা যায় না।

কিন্তু সমগ্র সভ্যতায় বিভিন্ন উপজাতি বা জনগোষ্ঠীর সমাবেশ ঘটেছিল। ফলে কোনও কোনও উপজাতির ভিতর ধর্মবিশ্বাস থাকা অসম্ভব নয়। সিন্ধু সভ্যতা সেভাবে বলপ্রয়োগ-নির্ভর না হওয়ায় অনেক প্রথা ও বিশ্বাসের মত ধর্মবিশ্বাসকেও সমাজে জায়গা দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সম্ভবত কঠোর কিছু বিধিনিষেধের মধ্যে ধর্মকে রেখেছে। হয়ত কিছু ক্ষেত্রে সিলগুলির ক্ষুদ্র ও সীমাবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের কিছু প্রকাশকে মেনে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এটা হল ধর্মকে সীমাবদ্ধ পরিসরে কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখবার মত বিষয়।

অবশ্য একই কারণে সভ্যতায় ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন রূপ থাকতে পারে। যেমন নিরাকার দেবতাদের ধারণা, যার প্রকাশ আমরা বৈদিক ধর্মে দেখতে পাই। বৈদিক ধর্মের বিকাশের বিষয়ে আমি আমার পূর্বেকার যৌথভাবে ও এককভাবে লিখা বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধে বিশদ আলোচনা করায় এখানে আর নূতন করে তেমন একটা আলোচনা করব না। বিশেষত শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমি ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বৈদিক ধর্মের উত্থান নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি।

তবে এখানে এইটুকু বলতে পারি যে, সভ্যতার উত্থান ও বিকাশের পর্যায়ে ধর্মের ভূমিকা সেভাবে না থাকলেও সভ্যতার ক্ষয় বা পতনের পর্যায়ে ধর্মের গুরুত্ব ও ভূমিকা দেখা দিয়েছিল। অন্তত শাসক শ্রেণী সভ্যতার সঙ্কটের পর্যায়ে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সহজ হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে দেখতে শুরু করেছিল। সুতরাং পূর্ব থেকে সমাজের প্রান্তে অবস্থিত একটি ধর্মবিশ্বাসের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা দিতে শুরু করে। এ সম্পর্কে সিন্ধু সভ্যতায় জলকপাটযুক্ত বাঁধের সাহায্যে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রশ্নটি চলে আসে।

সিন্ধু সভ্যতা যে জলকপাট বা স্লুইসগেট যুক্ত বাঁধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নদীনিয়ন্ত্রণমূলক সেচ ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এই বিষয় সম্পর্কে আমি ১৯৯০ সালে লিখা গ্রন্থ ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’-এ প্রথম উল্লেখ করি। আমার এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি ছিল মূলত হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ পাঠ এবং সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার প্রাপ্ত তথ্যাদির পর্যালোচনা। তবে গ্রন্থটি অপ্রকাশিত রয়ে যায়। অতঃপর আমার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক গবেষক শামসুল আলম চঞ্চল যোগ দেন। তিনি আমার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি থিসিস লিখে ১৯৯৪ সালে সিন্ধু সভ্যতার উপর বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলকে পাঠালে তিনি আমাদের থিসিসকে সমর্থন করে সেটিকে যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশের জন্য তাগিদ দিয়ে একটি চিঠি দিলে আমরা দুইজনে ১৯৯৫ সালে The Aryans and the Indus Civilization (http://www.bangarashtra.net/article/848.html) নামে ইংরাজী ভাষায় একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি। এটি ছিল মোগলের নিকট প্রেরিত মূল থিসিসের পরিবর্ধিত রূপ। এরপর সিন্ধু সভ্যতার উপর বাংলায় আমরা উভয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামে একটি গ্রন্থ লিখি, যা ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণমূলক সেচ ব্যবস্থার উপর চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে এবং এককভাবে ব্যাখ্যামূলক বক্তব্য এসেছে।

ঋগ্বেদ থেকে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় বিদ্যমান নদীনিয়ন্ত্রণমূলক সেচ ব্যবস্থার স্পষ্ট চিত্র পাই। বস্তত জলকপাটযুক্ত বাঁধের সাহায্যে নদীগুলির জলধারাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার বিশাল এলাকায় ব্যাপকায়তন কৃষি উৎপাদনের আর কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। বিশেষত এই সমগ্র অঞ্চল আজকের মত সেদিনও ছিল কম-বেশী ঊষর। নদীনিয়ন্ত্রণের এই ব্যবস্থার ফলেই সেখানে বিশাল অঞ্চলব্যাপী সভ্যতার এমন বিস্তার, সমৃদ্ধি এবং এতটা শান্তিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতার পতনের অনেক পরবর্তী কালে মৌর্য যুগে গুজরাট অঞ্চলে যে বাঁধ, জলাধার ও খাল সমন্বিত সেচ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল সে সম্পর্কে জানতে পারা যায়। প্রায় সমকালীন মধ্যভারতেও আমরা এ ধরনের সেচব্যবস্থার বিদ্যমানতা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাই। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, একটা ব্যবস্থার অবশেষ হিসাবে আরও কিছুকাল কোথায়ও কোথায়ও নদীনিয়ন্ত্রণ নির্ভর সেচ ব্যবস্থা সীমিতভাবে হলেও চালু ছিল। শুধু তাই নয়, খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় এবং চতুর্থ শতক জুড়ে সুদূর দক্ষিণের দ্বীপ শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরকে কেন্দ্র করে এক বৃহৎ ও শুষ্ক অঞ্চলে বহুসংখ্যক বৃহৎ জলাধার, বাঁধ ও খালের সাহায্যে জলধারাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেচ-নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে ব্যাপক সাফল্যলাভ সত্ত্বেও পরবর্তী কালে এই কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং এটি পরিত্যক্ত হয়। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায়ও এক সময় নদীনিয়ন্ত্রণ-নির্ভর সেচ ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বলে আমরা জানতে পারি। *

--------------------------------------------
* দেখুন : K. M. de Silva, A History of Sri Lanka, Vijitha Yapa Publications, Unity Plaza, 2 Galle Road, Colombo 4, Sri Lanka. Second Sri Lankan Reprint, August 2008, pp. 34-35.
--------------------------------------------

পাতা : ৫

সিন্ধু সভ্যতায়ও একটা পর্যায় পর্যন্ত নদীনিয়ন্ত্রণের যে ইতিবাচক ভূমিকা থাকুক এক সময় তার ভূমিকা শেষ হয়ে আসে। জলকপাটযুক্ত বাঁধ দ্বারা নদীর জলধারা নিয়ন্ত্রণের ফলে নদীখাতে পলি সঞ্চয় ঘটে। এর ফলে এক সময় নদীর স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ হয়ে আসে এবং পরিণতিতে নদীগুলির খাত পরিবর্তিত হতে শুরু করে। তাছাড়া সুদীর্ঘ কালব্যাপী একই জমিতে সেচের ফলে দেখা দিয়েছিল লবণাক্ততা এবং ফলশ্রুতিতে ফলন হ্রাস। ফলন হ্রাস, একদিকে জলাভাব, অন্যদিকে বন্যা ও জলাবদ্ধতা এবং সেই সঙ্গে নদীখাতের ঘনঘন পরিবর্তন এই সবকিছু একত্রিত হয়ে সভ্যতায় বিপর্যয় ঘটাতে শুরু করে। ফলে নদীনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে জনমত জেগে উঠতে থাকে।

ততদিনে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি। এ বিষয়ে ইতিপূর্বেকার লিখা বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধে আমাদের মত ব্যক্ত করায় এখানে আর নূতন করে বেশী কিছু বলব না। শুধু এইটুকু বলি যে, নদীনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাকে বিদ্যমান ধর্মের অংশ করে নেওয়ায় সেটাকে ধ্বংস করার জন্য তার বিরুদ্ধে বিদ্যমান ধর্মে সংস্কারের প্রয়োজন হয়। এই প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্য নিয়ে বৈদিক ধর্মের উত্থান। এভাবে সকল সফল ধর্মীয় আন্দোলনের নিয়ম অনুযায়ী পুরাতন ধর্মের সংস্কার ঘটাতে গিয়ে নূতন ধর্মের উত্থান ঘটানো হল।

সিন্ধু সভ্যতার প্রচলিত ধর্ম ছিল অহিংসা বা শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির পক্ষপাতী। কিন্তু যারা নদীনিয়ন্ত্রণের অবসান চেয়েছিল তাদের জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হয়েছিল। সুতরাং বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে যুদ্ধকে অগ্রাধিকার দানের প্রয়োজনে যুদ্ধ দেবতা হিসাবে ইন্দ্রকে প্রাধান্য দেওয়া হল।

অপর দিকে, সভ্যতার যে অংশ নদীনিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিল তাদের জন্যও বৈদিক সংস্কারকে মোকাবিলা করার জন্য পাল্টা আর একটা ধর্মসংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। পুরাতন যে ধর্মের পৃষ্ঠপোষক তারা ছিল বা হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার শান্তিনির্ভরতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেটাও ছিল মূলত শান্তিবাদী বা অহিংস চেতনার অনুসারী। এমন অবস্থায় সহিংস বৈদিক আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে সনাতন ধর্মে আর একটি সংস্কার ঘটে। এটিরই ফসল হচ্ছে ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা। আমরা আরও অনুমান করি যে, গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার অবসান হলে আবেস্তার অনুসারীরা প্রধানত ইরানে গমন করে।

আমরা অনুমান করি নদীনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বিভক্তি শুধু জনসমাজের মধ্যে ঘটে নাই, উপরন্তু সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণীর মধ্যেও ঘটে। তবে আমরা অনুমান করি যে, শাসক শ্রেণীর সংখ্যালঘু অংশ ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ বিরোধী। কিন্তু শাসক শ্রেণীর সংখ্যাগুরু অংশের পক্ষে পতনোন্মুখ এই ব্যবস্থাকে রক্ষা করা সম্ভব হয় নাই।

এটি ছিল এমন একটি গৃহযুদ্ধ যেখানে উভয় পক্ষই ছিল একই সমাজ ও জাতিভুক্ত। ফলে ঋগ্বেদে যুদ্ধের যেমন চিত্রই পাওয়া যাক সেটা যে তেমন তীব্র এবং ধ্বংসাত্মক ছিল না তা বলা যায়। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে ব্যাপক ধ্বংস এবং হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তথা জলকপাটযু্ক্ত বাঁধ ধ্বংস করলে নদীনিয়ন্ত্রণ এবং সেই সঙ্গে সেচ ব্যবস্থা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়ে। কাজেই প্রতিপক্ষের নগরকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করার প্রয়োজন হয় না। বৈদিক পক্ষ নগর নয়, বরং জলকপাটযুক্ত বাঁধগুলিকেই তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করেছিল এভাবে ব্যাখ্যা করলে ব্যাপক অঞ্চলব্যাপী তেমন বিধ্বংসী কোনও যুদ্ধ ছাড়াই সিন্ধু সভ্যতার এমন আকস্মিক বা দ্রুত অবসানকে ব্যাখ্যা করা সহজ হয়।

আসলে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সঙ্কট দেখা দিবার পর থেকে খাদ্যোৎপাদনে ঘাটতি ও নদীখাত পরিবর্তন ও জলহীনতার কারণে কোথায়ও কোথায়ও জনজীবনে অচলাবস্থা ঘটতে থাকলেও সভ্যতা একেবারে ধ্বংস হয় নাই। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ধ্বংসের ফলে সভ্যতার অবশেষ যেটুকু ছিল সেটুকুরও টিকে থাকবার কোনও পরিস্থিতি থাকে নাই। ফসল উৎপাদনের অবশিষ্ট ব্যবস্থার অবসান সভ্যতার অধিবাসীদেরকে তাদের নগর ও গ্রামগুলিকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য করল। কৃত্রিম জলসেচ ব্যবস্থার ক্রমিক সঙ্কট এবং সবশেষে ধ্বংসের ফলে এই ধরনের কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে তোলা সভ্যতার বিপুল জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ ক্ষুধায়, ব্যাধিতে এবং বিভিন্ন অপঘাতে মৃত্যু বরণ করল এবং বাকীদের অধিকাংশ যে যেদিকে পারল সেদিকে যাত্রা করল। তারা কয়েক লক্ষ বর্গকিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতার বিশাল বস্তুগত নির্মাণ তথা অসংখ্য নগর, গ্রাম এবং শুষ্ক ও পরিত্যক্ত শস্যক্ষেত্র পিছনে ফেলে চলে গেল। একদিকে ঘটল বিশাল মানবিক বিপর্যয় এবং অপর দিকে শুরু হল পৃথিবীর এক বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে দেশে অভিযাত্রা ও অভিগমন। তারা যে পথ দিয়ে গেল এবং যেখানে গেল সেখানে ছড়িয়ে দিল তাদের উন্নত ও সভ্য সংস্কৃতি ও ভাষার চিহ্ন। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে এভাবে ঘটল ইন্দো-ইউরোপীয় হিসাবে কথিত ভাষাগোষ্ঠীর বিস্তার। বস্তুত এরা সবাই কম অথবা বেশী সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারকে বহন করছে। *

--------------------------------------------
* ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’ (http://www.bangarashtra.net/article/1456.html)-এ আমি সিন্ধু সভ্যতায় একটি অভিন্ন ভাষার প্রতিষ্ঠা এবং তার ধারাবাহিকতা হিসাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ভাষাগুলির বিস্তারের বিষয়টি নিয়ে নূতনভাবে কিছু আলোচনা করেছি। দেখুন : ‘তৃতীয় পর্ব : ইতিহাসের বস্তু-নির্ভর পাঠ’-এর অধীনে ‘(ঘ) সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতা এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের রূপ’।
--------------------------------------------

পাতা : ৬

প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে ইদানীং কালে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস মূলত খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতকে ঘটে। অবশ্য সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায়ের অবসান হলেও কিছু কিছু এলাকায় বা অঞ্চলে সিন্ধুর নগর সভ্যতার ধারাবাহিকতা হিসাবে গ্রামীণ জীবনধারা টিকে থাকল। তবে সেটা সিন্ধুর নগর সভ্যতার প্রত্যাবর্তন অভিমুখী নয়। যেটাকে সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায় তথা প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় যেটাকে পরিণত হরপ্পান পর্যায় বলা হয় সেটা আর ফিরে আসে নাই। অঞ্চল ভেদে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় হিসাবে পরিচিত হরপ্পান সভ্যতার কিছু ধারাবাহিকতা বহনকারী গ্রামীণ পর্যায় টিকে থাকল কোথায়ও বা খ্রীষ্টপূর্ব ১৮ থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত কোথায়ও খ্রীষ্টপূর্ব ১,০০০ পর্যন্ত। তারপর প্রায় সবটাই অতীতের বিষয়।

তবু অত মহান সভ্যতার সবটা অতীতের বিষয় হতে পারে না। পারে না বলে সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চল থেকে পূর্বদিকে অনেক দূরে অবস্থিত বঙ্গভূমিতে আমরা বাংলা ভাষা হিসাবে পরিচিত যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাটি সিন্ধু সভ্যতার ভাষা দ্বারা এত গভীরভাবে প্রভাবিত এবং এত গভীরভাবে সেই ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। হ্যাঁ, ঋগ্বেদ যে ভাষায় লিখা বৈদিক ভাষা হিসাবে পরিচিত সেই ভাষার কথা আমি বলছি। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে উপমহাদেশের সকল ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দসম্ভার সর্বাধিক পরিমাণে বিদ্যমান। আর একভাবে বললে বলা যায়, বাংলা ভাষা সংস্কৃত ভাষা দ্বারা সর্বোচ্চ পরিমাণে প্রভাবিত। আর এই সংস্কৃত হচ্ছে বৈদিক ভাষার কিছু পরিমার্জিত বা সংস্কৃত রূপ। এটি প্রকৃতপক্ষে বৈদিক ভাষার পরবর্তী রূপ। সুতরাং জীবিত ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষা হচ্ছে বৈদিক ভাষার নিকটতম ভাষা। তবে আমরা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, বৈদিক ভাষা যেখানে ছিল জনগণের নিত্য ব্যবহার্য ভাষা এবং সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রেরও ভাষা সেখানে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অনেক পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের উদ্যোগে বৈদিক ভাষার পরিমার্জিত রূপ হিসাবে সংস্কৃত ভাষা গড়ে তোলা হয়। তবে এটি আমজনতার ভাষা ছিল না। এটি মূলত উচ্চবর্গের জ্ঞান ও ধর্ম চর্চার ভাষায় পরিণত হয়েছিল।

সভ্যতার ধ্বংস এবং বিপুল জনসংখ্যার স্থানান্তরগমনের ফলে সিন্ধু সভ্যতার ভাষার টিকে থাকবার কারণ ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলে অভিগমনের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা তাদের নিজেদের ভাষার সঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নূতন নূতন ভাষার বিকাশ ঘটায়। এমনিতেই কালপরিক্রমায় ভাষায় পরিবর্তন ঘটে। তার উপর যদি ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য জাতি বা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংমিশ্রণ বা সম্মিলন ঘটে তবে নূতন ভাষার উদ্ভব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দেখা দেয়। এভাবে আমরা ভারতবর্ষে বৈদিক ভাষার ধারায় কালক্রমে প্রাকৃত, পালি ইত্যাদি জনগণ-চর্চিত ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটতে দেখি।

এখন হয়ত প্রশ্ন করা হবে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র এবং জনগণের ভাষা যে বৈদিক ভাষা কিংবা ঋগ্বেদ যে ভাষায় লিখা হয়েছে সেই ভাষা ছিল তার প্রমাণ কী? সিন্ধু লিপি পাঠের পূর্বে কি আমরা এ ধরনের কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি? এ বিষয়ে আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি। বিশেষ করে ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’ নামক প্রবন্ধে বিষয়টিকে স্পষ্টতর করবার চেষ্টা করেছি। তারপরেও এক কথায় বলি যে, ঋগ্বেদ পাঠ থেকে নিশ্চিতরূপে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, এই গ্রন্থের সঙ্গে বৈদেশিক তথা বহিরাগত আর্যদের আক্রমণ কিংবা অভিগমন ও অভিবাসনের কোনও সম্পর্কে নাই। বরং এটা সম্পূর্ণরূপে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের রচনা।

অন্যদিকে, যে কোনও ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা জানবেন যে, কোন নূতন ধর্মীয় আন্দোলনই জনগণের ভাষা ছাড়া দাঁড়াতে পারে না। কারণ নূতন ধর্মপ্রবক্তাদেরকে সর্বদাই তাদের নূতন ধর্মীয় মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য সাধারণ মানুষদের দ্বারস্থ হতে হয়। এর ফলে জনগণের ভাষায় তাদেরকে ধর্ম তথা ধর্মের বাণী এবং মন্ত্র ইত্যাদি রচনা করতে হয়। এই কারণে রচনাকালীন সময়ের বিদ্যমান সমাজের আমজনতার মাঝে প্রচলিত কিংবা বোধগম্য ভাষায় পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ রচিত। বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীষ্টান, ইসলাম, শিখ ইত্যাদি সকল ধর্মই ব্যতিক্রমহীনভাবে এই সত্যকে তুলে ধরে। ঋগ্বেদও যে আর দশটি ধর্মীয় আন্দোলনের মত একটি ধর্মীয় আন্দোলনের ফসল এই সত্য বুঝবার জন্য বেশী জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না; যেটার প্রয়োজন হয় সেটা হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মের বিকাশ সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক জ্ঞান এবং সেই সঙ্গে সংস্কারমুক্ত ও বিচারক্ষম মন।  

আমার মনে হয় ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’-এ ঋগ্বেদের ভাষার বিষয়টি আমি যেভাবে আলোচনা করেছি তাতে সেটি পাঠ করলে এ বিষয়ে আর বিশদ ব্যাখ্যা বা আলোচনার প্রয়োজন হবে না। সেখানে আমি এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করতে চেয়েছি যে, বিশাল ভূভাগব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতায় ঐক্য রক্ষায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যেমন ভূমিকা রেখেছিল তেমন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল একটি অভিন্ন ভাষা, যেটি ছিল রাষ্ট্রেরও ভাষা। বস্তুত এই অভিন্ন ভাষার প্রবর্তন বা বিস্তার বিশালায়তন সভ্যতার বিপুল সংখ্যক জনগণের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি জাগাবার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার ছিল। ধর্ম যে সেটা ছিল না সেটা স্পষ্ট। অন্যান্য সভ্যতায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মের সমান্তরালে যেটা থাকে জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের হাতিয়ার স্বরূপ সেই সেনাবাহিনীও যে সেটা সেখানে সেভাবে ছিল না সেটাও স্পষ্ট। তাহলে সেই শক্তি কোনটা ছিল যেটা এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে এমন ঐক্যের অনুভূতি দিয়েছিল যে শত শত বৎসর অথবা হয়ত সহস্র বৎসর তারা প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে একটি অভিন্ন শাসন বা কর্তৃত্বের অধীনে থেকেছিল? অর্থাৎ আজ আমরা অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা নিজেদের একটি অখণ্ড জনগোষ্ঠী তথা জাতি হিসাবে ধারণা করত। একটি অভিন্ন ভাষার অধিকারী হওয়ায় সভ্যতার যে প্রান্তে যে থাকুক সকলে সহজেই পারস্পরিক যোগাযোগ ও মতবিনিময় বা ভাববিনিময় করতে পারত।

পাতা : ৭

ঘোড়ার ব্যবহার তখনও ঘটে নাই। সুতরাং সেটা ছিল অত্যন্ত ধীর গতিতে যোগাযোগের যুগ। এই রকম বাস্তবতায় ঐক্যের অনুভূতি রক্ষার নিমিত্তে শুধু অভিন্ন ভাষার প্রবর্তনই কি যথেষ্ট ছিল? অনুমান করি সমগ্র সভ্যতার বিশাল ভূভাগে জনগণেরও নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ এবং মতবিনিময়ের চলমান ব্যবস্থা গড়ে তোলায় রাষ্ট্র উদ্যোগী ভূমিকা রাখত। তার ধরন আজ আমাদের জানা নাই। তবু হয়ত সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার বহুসংখ্যক মিলনমেলায় নিয়মিতভাবে দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্র হয়ে পরস্পরের অভিজ্ঞতা, মতামত এবং আবেগ-অনুভূতিকে ভাগ করে নিত। আর এভাবে তাদের মধ্যকার ভাষা এবং জীবনাচরণের ঐক্য নবতর প্রাণশক্তি পেত। হয়ত আজ আমরা ভারতবর্ষে সেই ব্যবস্থারই পরবর্তী ও পরিবর্তিত রূপ হিসাবে তীর্থযাত্রাকে দেখতে পাই।

এটা বুঝতে হবে যে, অখণ্ড রাষ্ট্র থাকুক বা না থাকুক সুদীর্ঘ কাল ধরে ভারতীয় উপমহাদেশব্যাপী হিন্দু সমাজে সীমাহীন বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও সামাজিক ঐক্যের অনুভূতি রক্ষায় তীর্থযাত্রা অপরিমেয় ভূমিকা রেখেছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও তীর্থযাত্রা ও দেশপরিভ্রমণের ব্যাপক প্রবণতা ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সমসাময়িক নিরীশ্বরবাদী কিন্তু নিয়তিবাদী আজীবিক সম্প্রদায়ের শ্রমণরাও বৌদ্ধ ও জৈন শ্রমণদের মত ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে দেশে দেশ পরিভ্রমণ ক’রে তাদের মতবাদ প্রচার করত। সিন্ধু সভ্যতায় যা ছিল লৌকিক বা জাগতিক পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা-ই হয়ত ধর্মের আবরণে নবরূপ ধারণ ক’রে সিন্ধু সভ্যতার ঐক্যের ভাবপ্রেরণাকে ভিন্ন রূপে রক্ষা করেছে।

অবশ্য সিন্ধু সভ্যতায়ও বৈচিত্র্য বা ভিন্নতা ছিল। তবু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি একটা মহাকায় সভ্যতার ভিতরকার ঐক্য বা অভিন্নতার দিকটিকেই সভ্যতার প্রধান দিক হিসাবে আমাদের সম্মুখে তুলে ধরে।

আসলে পৃথিবীর আর কোনও সভ্যতার মানদণ্ডে ফেলে সিন্ধু সভ্যতাকে বুঝা যায় না। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি তার পুনরুক্তি করে বলি এই সভ্যতার কোথায়ও নজর কাড়ার মত কোনও মহানির্মাণ নাই। না, রাজা বা ব্যক্তির সুবিশাল প্রাসাদ, না পিরামিডতুল্য সমাধি সৌধ, না মহাকায় মন্দির, না আছে রাজার বিরাট মূর্তি, না আছে দেবতার বিরাট প্রতিমা। মহানির্মাণ হিসাবে যদি উল্লেখ করতে হয় তবে উল্লেখ করতে হবে বহুসংখ্যক পাকা বাসগৃহ নিয়ে গঠিত প্রাচীরঘেরা নগরগুলির কথা। প্রাচীন আর কোনও সভ্যতার নগরগুলি এত বেশী সংখ্যক নাগরিককে এভাবে এমন স্বাচ্ছন্দ্য, মর্যাদা এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের সুযোগ দেয় নাই। ধনী-দরিদ্র যেমন হোক প্রতিটি নগরবাসী ইটে তৈরী বা পাকা গৃহের অধিবাসী। কোনও নগরেই দরিদ্রদের বস্তির চিহ্ন পাওয়া যায় না।

বিশেষ করে নগরগুলির বাসগৃহ থেকে জলীয় বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য যে ধরনের নালা ব্যবস্থা বা drainage system গড়ে তোলা হয়েছিল তা বিস্ময় জাগানীয়া। এ ছাড়া ছিল নগর বা শহরের বর্জ্য বা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে জমা করে সেখান থেকে নিয়ে নগর বা শহরের বাইরে ফেলার ব্যবস্থা। নাগরিকদের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য রক্ষার প্রতি রাষ্ট্র বা নগর কর্তৃপক্ষের এমন মনোযোগের কারণ কি জনসংখ্যা রক্ষা ও বৃদ্ধির তাগিদ? হতে পারে যে, ভিন্ন সমাজ থেকে ধরে এনে বাধ্যতামূলকভাবে সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত করায় তেমন একটা সক্ষম না হওয়ায় সভ্যতা তার সম্প্রসারণের প্রয়োজনে নিজ সমাজের জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিল। একদিকে ধনী-দরিদ্র সবার পুষ্টির প্রয়োজন পূরণের উপযোগী খাদ্যলাভের নিশ্চয়তা, অপর দিকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ রক্ষার এমন ব্যবস্থা মানুষের মৃত্যুহার হ্রাস এবং আয়ু বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সহায়ক ছিল।

সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে যারা খোঁজ রাখেন তারা এটা জানেন যে, সেখানে যেসব নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে সেগুলির উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে ধনী-দরিদ্রদের পুষ্টিমানে তেমন কোনও পার্থক্য ছিল না। অন্য যে কোনও সভ্যতার ক্ষেত্রে এটা অকল্পনীয় ঘটনা। যাইহোক, অনুমান করা চলে যে এমন একটা সভ্যতায় প্রধানত একই জাতি বা সমাজের জনসংখ্যার বৃদ্ধি সভ্যতার বিস্তার, বিকাশ ও সংরক্ষণে অনেক জটিলতা থেকে সিন্ধু সভ্যতাকে মুক্ত রেখেছিল। রাষ্ট্র কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মাধ্যমে সভ্যতার কেন্দ্রস্থ নগর ও গ্রামগুলি থেকে বর্ধিত জনসংখ্যাকে প্রান্তস্ত অঞ্চলগুলিতে বসতি স্থাপন করে সেখানে পুনর্বাসিত করত বলে অনুমান করা চলে।     

এমন একটা সমৃদ্ধ তথা প্রাচুর্যপূর্ণ সভ্যতা যে কোনও বহিঃশক্তিকে আক্রমণে প্রলুব্ধ করতে পারত। সুতরাং এই সভ্যতার শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চয় ছিল। অর্থাৎ আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তার সেনাবাহিনী ছিল। একান্ত প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা সহিংসতা দমনে সেটা যেমন কাজে লাগত তেমন বহিঃশক্তির আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষায়ও সেটা কাজে লাগত। সেটার রূপ আজ আমাদের জানা নাই। তবে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় যুদ্ধ এবং সেনাবাহিনীর গৌণ দশা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করতে পারি। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি, এই সভ্যতা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের অস্তিত্বের সম্ভাবনাকেও নাকচ করে। এবং এই সভ্যতার মূলধারায় ধর্ম যে ছিল না সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায়।

ধর্ম অবশ্যই ছিল। তবে বিশেষ করে ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’ এবং ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’-এ যে কথা জোর দিয়ে বলেছি সে কথার পুনরুক্তি করে বলি ধর্মের অবস্থান ছিল সমাজ ও সভ্যতার প্রান্তবর্তী।

পাতা : ৮

আজ আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সজীবতার কারণে যতদিন সভ্যতা বিকাশমান ছিল ততদিন সমাজ ও সভ্যতার প্রান্তসীমায়ই ধর্ম সীমাবদ্ধ ছিল। অনুমান করি এক্ষেত্রে সভ্যতার নায়ক তথা রাষ্ট্রশাসকদের উদ্যোগী ভূমিকা ছিল। অনুমেয় যে, ব্যাপক সংখ্যক জনগণ ছিল প্রচলিত অর্থে ধর্মবিশ্বাস-মুক্ত বা লোকবাদী। সম্ভবত এই বাস্তবতায় ঈশ্বর-দেবতা-আত্মা ইত্যাদি অলৌকিক সত্তায় অবিশ্বাসমূলক চিন্তাধারা বা দর্শন লোকায়ত হিসাবে পরবর্তী কালে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রে লোকায়ত শব্দটি বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ লোকায়ত শব্দের অর্থ বলা হচ্ছে : ‘প্রাকৃতজনের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা ও আচার।’ অভিধানে একই সাথে এর অর্থ বলা হচ্ছে : ‘প্রাচীন হিন্দু * দার্শনিক চার্বাকের মতানুসারী; নাস্তিক, পরলোক ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী।’ অর্থাৎ লোকসমাজে এক সময় যে লোকবাদী চেতনা অত্যন্ত প্রবল ছিল নিরীশ্বরবাদী দর্শনের লোকায়ত নামকরণ থেকেই সেটা প্রমাণিত হয়। বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বলা হচ্ছে যে, সংস্কৃত লোক+আয়ত থেকে লোকায়ত শব্দের উৎপত্তি। সুতরাং এটি সম্পূর্ণরূপে লোকসমাজে বিদ্যমান বা জনপ্রিয় বিশ্বাস বা ধারণাকে নির্দেশ করে।

--------------------------------------------
* অভিধানে, প্রকৃতপক্ষে, ‘প্রাচীন হিন্দু’ না বলে বলা উচিত ছিল প্রাচীন ভারতীয়। প্রাচীন হিন্দু যে শাস্ত্রগুলি থেকে আমরা বস্তুবাদী দার্শনিক চার্বাক সম্পর্কে জানতে পারি তার আবির্ভাব হিন্দুদের সর্বশেষ তথা চতুর্থ বেদ হিসাবে কথিত অথর্ব বেদ রচিত হবারও পূর্বকালে। অর্থাৎ তখনও বৈদিক ধর্মগ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত চার বেদের সর্বশেষ বেদ রচিত হয় নাই। যে কারণে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের ভাষ্য অনুযায়ী চার্বাক বলছেন, ‘ত্রয়োবেদস্য কর্তারো ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচরঃ।’ অর্থ, তিন বেদের রচয়িতারা ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচর। ভণ্ড, ধূ্র্ত বলতে কী বুঝায় তা আমরা জানি। নিশাচর অর্থ রাতে বিচরণশীল, পেঁচক, অশুভ প্রেতাত্মা বা পিশাচ, রাক্ষস, চোর ইত্যাদি। তিন বেদের রচয়িতাদেরকে যিনি এমন সব মধুর বিশেষণে ভূষিত করছেন যে কোনও অলোকবাদী ধর্ম বিরোধী সেই দার্শনিককে কি হিন্দু বলা যৌক্তিক? চার্বাকের সময়ে সর্বশেষ বেদ অথর্ব বেদ যে ছিল না সেটা স্পষ্ট। বেদ-পরবর্তী হিন্দু ধর্ম হিসাবে পরিচিত চতুর্বর্ণ ভিত্তিক ধর্ম তখনও সুসম্বদ্ধ রূপ নিয়েছে বলেও মনে হয় না।

--------------------------------------------     

অর্থাৎ ধর্মের প্রভাব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্কট ও পতনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞানচর্চার প্রাধান্য এবং বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নাই। বরং এটা জ্ঞান ও বুদ্ধির অধঃপতনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেটা আবার সভ্যতার সঙ্কট ও বিপর্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, এবং সেই সঙ্গে সম্পর্কিত সমাজের মানুষদের মধ্যকার তথা শ্রেণীগুলির মধ্যকার ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ও শ্রেণী বৈষম্যের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে। বৈদিক ধর্মের উত্থান এমনই এক বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তাকে মোকাবিলায় আবেস্তান তথা পারসী হিসাবে পরিচিত যে ধর্মের উত্থান ঘটে সেটিও সিন্ধু সভ্যতার এমন একটি বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ইত্যাদি সকল ধর্ম যেগুলিকে আমরা ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক কালে বিকাশ লাভ করতে দেখি সেগুলি ছিল সিন্ধু সভ্যতার পতনেরও অনেক পরবর্তী কালের ঘটনা। যে কালে সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকার পরিবর্তে গাঙ্গেয় অববাহিকাকে কেন্দ্র করে নগর সভ্যতা নূতন করে বিকাশ লাভ করছে সেই কালের ঘটনা।

তবে বুঝা যায় ভারতবর্ষে উদ্ভূত ও বিকশিত এই প্রত্যেকটি ধর্মে সিন্ধু সভ্যতা কম-বেশী ছায়াপাত করেছে। এ সম্পর্কে আমার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি। বৈদিক ধর্ম ও অনেক পরবর্তী কালে তার ধারাবাহিকতায় হিন্দু ধর্মের উত্থান প্রক্রিয়া সম্পর্কে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার আলোচনা আছে। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’-এও আমি হিন্দু ধর্মের উদ্ভবের পটভূমি ও বিকাশধারা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করেছি। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম সম্পর্কেও সেখানে আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে। বৈদিক ধর্ম এবং তার উত্তরাধিকারকে ধারণ করে পরবর্তী কালে গড়ে উঠা হিন্দু ধর্মের বিপরীতে এই দুই ধর্মে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত দর্শন-চিন্তার প্রভাব গভীর। এই কারণে আত্মার ধারণা নিয়ে ধর্ম হিসাবে গড়ে উঠলেও এই দুই ধর্মে বিশ্বস্রষ্টা ও বিশ্বশাসক হিসাবে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ধারণার স্থান নাই। অনুমেয় যে, সিন্ধু সভ্যতার মূল দার্শনিক ধারা হিসাবে গড়ে উঠা লোকায়ত ধারার প্রভাবকে অনেকাংশে ধারণ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরবর্তী কালে এই দুই ধর্ম বিকাশ লাভ করেছে।

সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সভ্যতা নির্মাণে তুলনামূলকভাবে নম্র পথ অনুসরণের কাল শেষ হয়েছে। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদীনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সভ্যতা নির্মাণের যে অভিজ্ঞতা মানুষ লাভ করেছিল তার ব্যর্থতা মানুষের দেখা হয়েছে। সুতরাং এমনিতেই মানুষের পক্ষে আর সেই ব্যবস্থায় ফিরতে চাওয়ার কারণ ছিল না। তার উপর নদীনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকে ধ্বংসসাধনের উদ্দেশ্যে যে ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার সাফল্য উপমহাদেশে আর নূতন করে কোথায়ও নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের সুযোগ সেভাবে রাখে নাই। কারণ নদীনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা করা এখন একটা বিজয়ী ধর্মের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সব দিক বিচারেই নদীনিয়ন্ত্রণমূলক সেচ ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন সম্ভব ছিল না। সুতরাং পরবর্তী কালে সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চল থেকে পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় অববাহিকাকে কেন্দ্র করে যে নূতন সভ্যতা গড়ে উঠল তা হল সিন্ধু সভ্যতা থেকে বহু বিষয়েই ভিন্ন। এখানে যুদ্ধ এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে রাজা এবং ধর্ম সভ্যতার প্রধান নির্ণায়ক উপাদান হয়ে দেখা দিতে থাকল। সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রায় হাজার বছর পর বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান পর্বে নগর সভ্যতার যে পুনরুত্থান ঘটছিল সেখানে আমরা সেই চিত্রই দেখতে পাই।

পাতা : ৯

একটা দীর্ঘ সময় বংশগত রাজতন্ত্র এবং নির্বাচনমূলক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলল। কিন্তু ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে প্রায় সর্বত্র যুদ্ধের শক্তি তথা সেনাবাহিনী প্রাধান্য অর্জন করল। স্বাভাবিক নিয়মে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠা সেনাপতিদের হাতে ক্ষমতা চলে যেতে থাকল। এভাবে প্রজাতন্ত্রগুলির অবসান ঘটল এবং রাজতন্ত্র প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত হল। মগধ এবং পাটলীপুত্র নগরকে কেন্দ্র করে যে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট গড়ে উঠল তা এক সময় দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল ও বালুচিস্তানসহ বৃহৎ বঙ্গ এবং আসামের কিছু অংশকে নিয়ে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে বিস্তৃত হল। বিশেষ করে মৌর্য সম্রাট অশোকের সময় (রাজত্বকাল খ্রীষ্টপূর্ব ২৬৯ – ২৩২) কলিঙ্গ জয়ের মাধ্যমে তা প্রায় আসমুদ্রহিমাচল মহাভারতীয় রাষ্ট্রের রূপ নিল। খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০ অব্দে তার আয়তন দাঁড়ালো ৫০,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (বা ঊনিশ লক্ষ বর্গমাইল)। বলা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ২৬১ অব্দে এই সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি।  

কলিঙ্গ জয়ের মাধ্যমে মহাভারতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেন। বস্তুত তার উদ্যোগী ভূমিকার ফলে বৌদ্ধ ধর্ম উপমহাদেশের সীমানা পেরিয়ে বৈশ্বিক ধর্মে পরিণত হল। এ থেকে প্রমাণিত হল কোনও ধর্মের বৃহৎ সাফল্য এবং ব্যাপ্তির পিছনে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

বলা হয় কলিঙ্গ যুদ্ধে রক্তপাতে ব্যথিত অশোক শান্তির ধর্ম হিসাবে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। আমার ধারণা শুধু যুদ্ধ ও রক্তপাতে বিমুখতা তার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের কারণ নয়। বরং উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিশাল রাষ্ট্র লাভ করে তিনি সেটাকে আরও প্রসারিত করেছিলেন সেটাকে রক্ষার এবং দীর্ঘস্থায়িত্ব দিবার প্রেরণা থেকেও তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। আমি অনুমান করি এটাই ছিল প্রধান কারণ। যাকে বলা হয় চণ্ডাশোক এবং কলিঙ্গযুদ্ধে তার যে নরমেধযজ্ঞের বিবরণ আমরা ইতিহাসে পাঠ করি তাতে করে হিসাব বহির্ভূতভাবে শুধু আবেগের উপর ভর করে তার মত শাসকের পক্ষে কি এভাবে একটা ধর্মকে গ্রহণ করা এবং তাকে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা দান করা সম্ভব? আমি অনুমান করি যে, তার মত একজন বুদ্ধিমান শাসক তার রাষ্ট্রের জন্য ঐক্যবদ্ধ সামাজিক ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হিসাবেই বৌদ্ধধর্মকে দেখতে পেয়েছিলেন।

অশোকের সমকালে বৌদ্ধধর্ম ছাড়া আর কোনও ধর্ম এভাবে বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক ছিল বলে মনে হয় না। এই সামাজিক ঐক্য বৃহদায়তনে রাষ্ট্রকে টিকে থাকার অনুকূল পরিবেশ দেয়। বিশেষত বৈদিক ধর্ম সমাজকে বিভক্ত চেতনায় নিতে সাহায্য করে। তখনও হিন্দু ধর্ম কতটা বিকাশ লাভ করেছিল সেই প্রশ্ন করা যায়। তবে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দুধর্ম অসংখ্য বিভাজনকে মেনে নিয়েই এক ধরনের সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করলেও বৃহত্তর সমাজকে দৃঢ়বদ্ধ ঐক্য দিতে ব্যর্থ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, অপরিবর্তনীয় পেশা বা কর্ম এবং মর্যাদার স্তরবিন্যাসে বিভক্ত বৃহত্তর হিন্দু সমাজ যুদ্ধ বিমুখ হবার কারণে মর্মগতভাবে রাষ্ট্রচিন্তা বিমুখ হয়। কারণ যুদ্ধ করা এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা রক্ষার দায়িত্ব ঐতিহ্যগত বা ধর্মীয় ভাবে সমাজের পরিবর্তে সমাজের একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তথা ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির।

আসলে অসংখ্য বিভাজন এমনিতেই সমগ্র সমাজকে শিথিল এবং গতিহীন করায় সমাজ বাহিরের কোনও সমাজের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারে না। অন্যদিকে, এই ধরনের সামাজিক বিভক্তি সমাজে অহিংসার চর্চা তথা মন-মানসিকতা ও সংস্কৃতিকে এমন পর্যায়ে নিতে বাধ্য যাতে সেটা বৃহত্তর পর্যায়ে সামাজিক নির্বীর্যতায় পরিণত হয়। আসলে এই ধরনের সমাজ প্রয়োজনেও সহিংসতা তথা যুদ্ধচর্চাকে গুরুত্ব দিতে পারে না। কারণ তাতে করে অজস্র বিভাজনে বিভক্ত সমাজ সহিংস আত্মদ্বন্দ্ব বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর পারস্পরিক সংঘাতে ধ্বংস হতে পারে। ফলে হিংসা বা যুদ্ধের চর্চা সীমাবদ্ধ থাকে বংশধারা তথা কুলধারায় গঠিত ক্ষত্রিয় হিসাবে পরিচিত খুব ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীর ভিতর। এই অবস্থায় বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দূরের কথা, বিদ্যমান রাষ্ট্রকে রক্ষা করাই হিন্দু সমাজের পক্ষে দুরূহ হয়। বর্ণাশ্রমের তত্ত্ব অনুযায়ী কাজটা সমাজেরও নয়, বরং ক্ষত্রিয়দের। কাজেই সমাজের বৃহত্তর অংশের রাষ্ট্রচিন্তার প্রয়োজনটা কী? সুতরাং হিন্দুধর্ম বাস্তবে শুধু যুদ্ধ-বিমুখ নয়, অধিকন্তু রাষ্ট্র-বিমুখ একটা সমাজেরও জন্ম দেয়। রাষ্ট্র উপর থেকে চাপালেও তার সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের তেমন কোনও আত্মিক সম্পর্ক থাকে না।

যাইহোক, অশোকের সময়ও হিন্দু ধর্ম পরবর্তী কালের মত দৃঢ়বদ্ধ রূপ নিয়েছিল বলে মনে হয় না। তবে বৈদিক ধর্মের একটা শক্তিশালী অবস্থান ছিল বলে মনে হয়। কিন্তু তখন বৈদিক ধর্মের পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণরা স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথার সঙ্গে আপোসের পথ অনুসরণ করে বৈদিক ধর্মের শুদ্ধতা থেকে সরে যাচ্ছিল বলে মনে হয়। এভাবে তারা বর্তমানে হিন্দুধর্ম হিসাবে পরিচিত ধর্ম গড়ে তুলছিল। বৈদিক ধর্মের তুলনায় এটি প্রকৃতপক্ষে অর্বাচীন বা নূতন।

হয়ত বলা হবে বৈদিক ধর্ম প্রাচীন, সুতরাং তার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ধর্মও প্রাচীন। কিন্তু বৈদিক ধর্মের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেও প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মকে বৈদিক ধর্মের ধারাবাহিকতা বললে ভুল বুঝবার সম্ভাবনা থেকে যায়। বেদের মন্ত্র পড়ে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি পূজা করলেই কি সেটা বৈদিক ধর্ম হয়? প্রতিটি ধর্ম তার সমাজে বিদ্যমান ধর্ম অথবা বিশ্বাস ও প্রথার ঐতিহ্যের দিকে হাত বাড়ায়। এটা তাকে করতে হয় জনপ্রিয়তা কিংবা জনসমাজে বৈধতা অর্জনের জন্য।

পাতা : ১০

ইসলাম ধর্মের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই তওরাত (ওল্ড টেস্টামেন্ট) ও ইঞ্জিল (নিউ টেস্টামেন্ট) তথা ইহুদী ও খ্রীষ্টান ঐতিহ্যকে তা নিজের বলে দাবী করেছে। এমনকি মক্কার পৌত্তলিক ধর্মের ঐতিহ্যকেও তা ছাড়ে নাই। সুতরাং মক্কা এবং মক্কার আশপাশের অঞ্চলের প্রধান দেবতা আল্লাহকে একমাত্র দেবতা তথা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসাবে ঘোষণা করেছে। তা পৌত্তলিক আরবদের প্রধান ধর্মমন্দির কাবার ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ কিংবা চূর্ণ করে সেটিকে নিরাকার আল্লাহর উপাসনার প্রধান কেন্দ্র করেছে। একইভাবে তা পৌত্তলিক আরবদের বাৎসরিক ধর্মীয় মিলনমেলাকে হজে পরিণত করেছে। শুধু তাই নয়, ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্বে আল্লাহ্ ও শয়তানের মধ্যকার যে দ্বন্দ্বকে তুলে ধরা হয় সেটা যে মূলত আবেস্তান ধর্মের অহুর মযদা (Ahura Mazda) ও অঙ্গরা মইন্যু (Angra Mainyu)-এর মধ্যকার দ্বন্দ্বতত্ত্বের প্রতিফলন তাতে আমি সন্দেহ করার কারণ দেখি না। আবেস্তান ধর্মমতে অহুর ময্দা হচ্ছে শুভশক্তির সর্বোচ্চ রূপ ঈশ্বর, আর অঙ্গরা মইন্যু হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ স্বরূপ সর্বোচ্চ অশুভ শক্তি। তবে আবেস্তান ধর্মমতে এই উভয় শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব অন্তহীন চক্রে আবর্তিত হয়ে চলবে। যাতে কখনও জয় হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর শুভ শক্তি তথা অহুর মযদার, আবার কখনও জয় হবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর অশুভ শক্তি অঙ্গরা মইন্যুর।

যাইহোক, এইসব ঐতিহ্যকে ব্যবহার করায় ইসলাম যেমন সেইসব ধর্মের অংশ হয় নাই, হিন্দুধর্মের ব্যাপারটাও তেমন। বেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও অভ্রান্ততার প্রতি সাড়ম্বর ঘোষণা সত্ত্বেও হিন্দুধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে ভিন্ন। বেদের ধারায় তা এলেও বেদের বহু কিছু থেকেই হিন্দু ধর্ম আলাদা এবং অনেক ক্ষেত্রে বিরোধাত্মক। যেমন বেদে প্রতিমা পূজা না থাকলেও হিন্দুধর্মে মূর্তি বা প্রতিমা পূজা প্রচলিত, হিন্দুধর্মের পূজিত দেবতারা সাধারণভাবে বেদের দেবতা থেকে ভিন্ন যেমন ইন্দ্র, বরুণ, মিত্র, অশ্বিনীদ্বয়, অগ্নি, ঊষা ইত্যাদি বৈদিক দেবতার সঙ্গে হিন্দুধর্মের শিব, দুর্গা, গণেশ, কালী ইত্যাদি দেবতার কোনও দূরবর্তী সম্পর্কও নাই, বেদের বিধানে গরুর মাংস ভক্ষণ সিদ্ধ এবং এমনকি দেবতা ইন্দ্রের প্রিয় খাদ্য হলেও হিন্দুধর্মে গোবধ ও গোমাংস ভক্ষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, বৈদিক সমাজে বর্ণজাতিভেদ না থাকলেও হিন্দুমতে তত্ত্বগতভাবে বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে চার বর্ণে সমাজ বিভক্ত এবং বাস্তবে অগণিত বর্ণজাতিতে সমাজ বিভক্ত, ইত্যাদি। বস্তুত বেদকে আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মানলেও বা বললেও কিংবা বেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করলেও বেদের মন্ত্র পাঠ করে পূজা-অর্চণা করা ছাড়া বৈদিক ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের আর বিশেষ কোনও সম্পর্ক নাই। তবে বেদের দেবতাদের পূজা আর না হলেও তাদের নামও রইল যেমন মন্ত্রপাঠে তেমন রইল বিভিন্ন ধর্মীয় আখ্যান ও ব্যাখ্যায়।

বৈদিক ধর্ম প্রকৃতপক্ষে একটি মৃত ধর্ম। এই ধর্মের পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে গড়ে উঠা ব্রাহ্মণরা পরবর্তী কালে বর্ণজাতিভেদকে ভিত্তি ক’রে এবং বৈদিক ধর্মের রীতি-নীতি ও প্রথায় বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে তার সঙ্গে বিভিন্ন স্থানিক ধর্মবিশ্বাস ও প্রথার সংমিশ্রণে হিন্দুধর্ম গড়ে তোলে। অর্থাৎ উপমহাদেশের আরও অনেক স্থানের ও কালের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস ও প্রথা কিংবা আচার-অনুষ্ঠানকে অঙ্গীভূত বা আত্মস্থ করে হিন্দুধর্ম গড়ে উঠেছে। তবে বৈদিক ধর্মের ধারা থেকে আসা পুরোহিত শ্রেণী তথা ব্রাহ্মণরা বেদের দখল ছাড়ে নাই। প্রকৃত অর্থে আদি বৈদিক ধর্ম পরিত্যাগ করে পরবর্তী কালে হিন্দুধর্ম গড়ে তুললেও তারা বেদ চর্চার উপর একচেটিয়া দখল নিয়ে রাখল। বেদের সাহিত্য তথা মন্ত্রগুলি হল ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা কিংবা রক্ষার হাতিয়ার। এভাবে একটা বিজয়ী ধর্মের উত্তরাধিকার স্বরূপ তার উপর দখল বজায় রেখে ব্রাহ্মণরা প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ধর্ম গড়ে তুলল। মুখে রইল বেদের গুণকীর্তণ, শ্রেষ্ঠত্ব ও অভ্রান্ততার ঘোষণা, অথচ বাস্তব জীবনে সেটাকে করা হল বর্জন। যারা এই ধর্মচর্চার দায়িত্বে ছিল সেই ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সবাই মিলে যখন কাজটা করল তখন বেদের প্রকৃত উত্তরাধিকারের দাবীদার আর থাকবে কে? সুতরাং বেদের নামে, সনাতন ঐতিহ্যের নামে যা খুশী তা-ই চালানো গেল!

বস্তত সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসকে ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করে বৈদিক ধর্ম-চর্চার দায়িত্বপ্রাপ্তরা কালক্রমে সেই ধর্মের আদি রূপকেও বর্জন করল। তবে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার স্বার্থে বেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে তার চর্চার উপর অধিকারকে একচেটিয়া করে রাখার একটা ফল হল হিন্দুধর্মের আশ্রয়ে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারের অনেক কিছুর মত তার ভাষারও সংরক্ষণ। ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় বেদ যেমন অপরিবর্তিত রূপে রক্ষিত হল তেমন তার ভাষাও রক্ষিত হল। এভাবে একটা মহান সভ্যতার ভাষা ধর্মের আশ্রয় নিয়ে প্রায় চার হাজার বছরের পথ পার হয়ে আজ আমাদের নিকট পৌঁছাচ্ছে। সুতরাং অব্যাহত বেদ চর্চার মাধ্যমে এক মহাসভ্যতার ভাষাকে জীবন্ত রাখবার কৃতিত্বও ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কাকে দেওয়া যাবে?

যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জীবনের মত সব সভ্যতারই এক সময় না এক সময় মৃত্যু বা ধ্বংস ঘটে। সুতরাং সভ্যতা চিরস্থায়ী না হলেই তার ভূমিকার গুরুত্ব ফুরায় এভাবে বিচার করা ঠিক নয়। কিংবা সভ্যতা চিরস্থায়ী হয় না বলে মানুষ নূতন সভ্যতা নির্মাণের সাধনা করবে না এ ধরনের চিন্তা করাও ভ্রান্ত। মানুষ মরণশীল বলে কি জীবন অর্থহীন কিংবা মরণশীল মানুষের জীবনধারায় মৃত্যুর অনিবার্যতা থাকায় মানুষের জন্মদান কি বন্ধ করে দিতে হবে?

পাতা : ১১

সুতরাং নূতনতর সভ্যতা নির্মাণের পথ থেকে মানুষ কখনই বিরত হবে না। সেক্ষেত্রে মানুষের পাথেয় হয় পুরাতন সভ্যতার অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং উত্তরাধিকার। কারণ মানুষ শূন্য থেকে যাত্রা করতে পারে না। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ভারতীয় উপমহাদেশ এক দীর্ঘ বিরতির পর গাঙ্গেয় অববাহিকাকে ভিত্তি করে পুনরায় নূতন করে সভ্যতা নির্মাণ করলেও মানবিক কল্যাণের সামগ্রিক বিচারে সেটা সিন্ধু সভ্যতার সমতুল্য হয় নাই। বরং প্রাচীন যুগের অবসানের পর মধ্যযুগ থেকে বৈদেশিক হানাদারদের যে প্রায় অব্যাহত আক্রমণ, বিজয় ও শাসন চলেছে ১৯৪৭ সালে উপনিবেশবাদী বহিরাগত ব্রিটিশ শাসকরা উপমহাদেশ থেকে বিদায় নিবার পরও আজ অবধি নানান রূপে সেই সব আক্রমণ, বিজয় ও শাসনের গভীর ধারাবাহিকতা উপমহাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও জনজীবন ধারণ ও বহন করে চলেছে। এক কথায় সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করলে উপমহাদেশের বিগত চার হাজার বছরের জন্য অনেক সময় দুঃখ হয়। আমি অতীতের এই দীর্ঘ সময়ের সকল কিছুকে নাকচ করি না, কিন্তু তা সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে যখন তুলনা করা যায় তখন সিন্ধু সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত হয়ে দেখা দেয়। এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য সকল সভ্যতার পাশে রেখে যখন বিচার করা যায় তখন সিন্ধু সভ্যতার মহিমা উজ্জ্বলতর হয়ে দেখা দেয়।

নিশ্চয় সিন্ধু সভ্যতায়ও অনেক সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটি বা সমস্যা ছিল। সেগুলির অনুসন্ধানেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সব ত্রুটি সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতার সুমহান উত্তরাধিকারকে আমরা ক্ষণিকের জন্যও তুচ্ছজ্ঞান করতে পারি না। সেখান থেকে শ্রেষ্ঠ এবং আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রেরণা এবং বৈশিষ্ট্যগুলিকে গ্রহণ করে নিয়ে আমরা আজকের যুগের উপযোগী করে আমাদের নূতন সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণ করব।

আর সে প্রসঙ্গে আসে পশ্চাৎপদতা, অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারের লালনভূমি হিসাবে বিদ্যমান ধর্ম থেকে মুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের প্রশ্নটি। উপমহাদেশে বিদ্যমান দুইটি ধর্ম ইসলাম ও হিন্দু আপাত দৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রশ্নে যতই পরস্পর বিরোধী হোক তারা শেষ বিচারে একই উদ্দেশ্য সাধন করছে, আর সেটা হল সমাজের পশ্চাৎপদতা এবং নানান ধরনের বিকার ও বিকৃতি রক্ষা। মূলত এই দুই ধর্মকে ভিত্তি করে যে সমাজ গঠিত হয়েছে তার উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে উপমহাদেশের প্রধান তিনটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান। ধর্মের অনুভূতি বা প্রাধান্যের কারণে ব্রিটিশরা বিদায় নিবার কালে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ অধিকৃত উপমহাদেশ পাকিস্তান ও ভারত এই দুইটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল দুইটিকে নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাকী অঞ্চলকে নিয়ে ভারত-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে রাষ্ট্র গঠনে ধর্ম একটি নিয়ামক উপাদান রূপে দেখা দিল। পরবর্তী কালে ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হল।

কিন্তু ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলেও তার সামাজিক ভিত্তিতে ইসলাম ধর্ম অক্ষুণ্ণ থাকায় রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্ম পাকিস্তান কালের মতই নিয়ামক উপাদান হয়ে দেখা দিল। এমনকি সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযোজন করে এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে ষাটের দশকে সংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার ধারায় ১৯৭১-এ সংঘটিত স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল অঙ্গীকারকে ভূলুণ্ঠিত করা হল। এভাবে একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তে ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান ভাঙ্গলেও সেখানে বাস্তবে বাংলাদেশ নামে আর একটা ধর্মরাষ্ট্র তথা ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে আর এক পাকিস্তানের উত্থান হল।

এ হল বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের ভাবাদর্শিক দিক। এবার তার কাঠামোগত দিকের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। জনগণের অংশগ্রহণ-সমৃদ্ধ একটা জাতীয় যুদ্ধ ঘটলেও তার কোনও ছাপ এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামোতে পড়ল না। বরং পাকিস্তান কালের সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন এবং বিচার বিভাগসহ পাকিস্তানী রাষ্ট্রের সকল যন্ত্র সর্বস্তরে রক্ষিত হল। অর্থাৎ শুধু পশ্চিমাদের বাদ দিয়ে একই ধরনের দমন ও পীড়ন মূলক রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থাকে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল। এটা চরিত্রে হল আমলাতান্ত্রিক এবং পরদেশী বা বহিরাগত। সুতরাং এক এলাকার শাসন, প্রশাসন এবং বিচারের ভার রইল ভিন্ন এলাকা থেকে আগত এবং জনগণের নিকট অচেনা ও অপরিচিত আমলাদের হাতে। বস্তুত এই যে রাষ্ট্র কাঠামো পাকিস্তানের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করা হয়েছিল সেটি আবার পাকিস্তান লাভ করেছিল পরদেশী, নিপীড়ক এবং লুণ্ঠনজীবী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শাসকদের নিকট থেকে। ব্রিটিশরা যেমন ছিল বহিরাগত লুণ্ঠনজীবী তেমন তাদের বহিরাগত বা বিদেশী লুণ্ঠনজীবী ও নিপীড়ক শাসনকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল আমলাতান্ত্রিক শাসনের এমন ব্যবস্থা যা চরিত্রে হবে বহিরাগত বা বিদেশী। এলাকার মানুষ হলে তো লুণ্ঠন ও নিপীড়ন মূলক শাসনকে নির্বিকারভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। সুতরাং এমন একটা পরদেশী এবং আমলাতান্ত্রিক শাসনযন্ত্রকে ভারতবর্ষে চাপিয়ে দেওয়া। এটাকে আমরা বলতে পারি উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র।

ভারতবাসীদের দুর্ভাগ্য, একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তারা ব্রিটিশদেরকে পরাস্ত এবং বিতাড়ন করে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে পারে নাই। পারলে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের আবর্জনা আজ অবধি উপমহাদেশের জনগণকে বহন করতে হত না। সুভাষচন্দ্র বসু এই ধরনের কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি প্রকৃত স্বাধীন এবং জনবাদী রাষ্ট্র গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে আজাদ হিন্দ্ ফৌজ গঠন করে স্বাধীনতার যুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন। কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। বরং গান্ধী, নেহরু ও জিন্নাহর মত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অনুগত ও অনুরাগী নেতারা জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও আবেগকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ শাসকদের পরিবর্তে নিজেরাই ব্রিটিশ উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হল। এভাবে প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান হলেও ব্রিটিশ শাসকদের বাজার ব্যবস্থা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত হল এই দেশীয় শাসকরা, যারা প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশিক প্রভুদের পক্ষ হয়ে তাদের বাজার ব্যবস্থা রক্ষা ও পরিচালনার ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

পাতা : ১২

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে একদিকে জার্মান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় এবং অপর দিকে যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ফলে ব্রিটিশ, ফরাসী ও ডাচ ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদীদের পৃথিবীব্যাপী আধিপত্য রক্ষার কাল শেষ হল। এবার ব্রিটিশ, ফরাসী ইত্যাদি পুরাতন উপনেশবাদীদের বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত বাজার ব্যবস্থাকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এল নূতন পরাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম ইউরোপ কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের সৃষ্ট এই বাজার ব্যবস্থার অনুকূল যন্ত্র হিসাবে দেশে দেশে ক্রিয়াশীল রইল উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র। সুতরাং নূতন পদ্ধতিতে অব্যাহত রইল উপনিবেশিক কালের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিধিবিধানসহ জীবন ধারার প্রায় সবকিছুই।

বাংলাদেশ একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও তা ব্রিটিশ উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের বৃত্ত ভাঙ্গতে পারে নাই কেন সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে বিভিন্ন লেখায় আমি আলোচনা করলেও এর প্রয়োজন ফুরায় নাই। আজকের আলোচনাকে আর দীর্ঘায়িত করতে না চেয়ে আমি এইটুকু বলি যে, ষাটের দশকে যে প্রজন্মের শক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেই প্রজন্মের ব্যর্থতার পরিণতিতে পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব বঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধ রাজনৈতিক পরিণতি পায় নাই।

প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকে তরুণ সমাজতন্ত্রী বা বামপন্থী প্রজন্ম একটা ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র গড়তে চেয়ে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তবে তারা ছিল নেতৃত্বহীন এবং অনভিজ্ঞ। বিপুল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তাদের পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। তবু তাদের আন্দোলনের অভিঘাতে ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিবার্য হল। এখানে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে এই বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের তৎকালীন প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার এগারো দফা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচীতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। যেটার একটা বড় কারণ এই কর্মসূচী নির্মাণে মতান্ধ পুরাতন কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের হস্তক্ষেপ এবং তরুণ প্রজন্মের অপরিপক্বতা। তবু সে কালে প্রকাশ্যে আর কারও এভাবে স্বাধীনতার কর্মসূচী ছিল না। এর প্রায় এক বছর পরই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল। এ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকার গুরুত্ব বুঝা যায়। *

--------------------------------------------
* ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ (
http://bangarashtra.net/article/926.html)  গ্রন্থের পরিশিষ্ট-এ স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচী দেওয়া আছে। গ্রন্থটির পরিশিষ্টে দেওয়া কয়েকটি কর্মসূচীর শেষে এই কর্মসূচীটি দেওয়া আছে।
--------------------------------------------

কিন্তু যে কথা বলেছি সে কথার জের টেনে সংক্ষেপে বলি যে, ঐ প্রজন্মের সফলতার ভিত্তি তখনও তৈরী হয় নাই। দেশের ভিতরে স্বতঃস্ফূ্র্তভাবে যুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী সেনার নিকট ধরা দিলেন আর আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন। এর পর প্রায় নয় মাস পুরাটাই ভারতের আশ্রয়ে, সাহায্যে এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারা পরিচালিত হল। ভারতের কংগ্রেস সরকার যেমন ছিল উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনা ও রক্ষার সরকার তেমন পূর্ব বঙ্গে আর একটা উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র সংগঠন ও রক্ষার কাজটা নিশ্চিত করাই ছিল তার পক্ষে স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে সে কাজটাই তা করেছিল। সুতরাং যে প্রজন্ম এই যুদ্ধের রাজনীতি গড়েছিল তাদের স্বপ্নের বিপরীতে বরং এমন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল যেটা হল ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনের ধারাবাহিকতায় আপাদমস্তক উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ।

অন্যদিকে বিপ্লবী প্রজন্মের চেতনায় যে ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী তথা লোকায়ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল সেটাও প্রতারণার শিকার হল। সুতরাং ১৯৭২ সালে যে সংবিধান তৈরী করা হল সেটা যেমন হল চূড়ান্ত রকম দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্ত, স্বেচ্ছাচারী এবং একনায়কী শাসনকে বৈধতা দিবার হাতিয়ার তেমন সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও তা ছিল প্রতারণার হাতিয়ার। আসলে সংবিধানের মূল নীতি হিসাবে ঘোষিত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এসবই যে ছিল কথার কথা এবং প্রতারণার হাতিয়ার সময় সেটা প্রমাণ করেছে।

এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন এখানে দেখি না। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছি। অবশ্য এ নিয়ে আরও অনেক আলোচনার প্রয়োজন আছে। সাধারণত অনেক তিক্ত সত্যকেই আমাদের দেশে আলোচনায় আনা হয় না। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানান প্রতিকূলতার কারণে অনেক সত্যই চাপা পড়ে থাকে। তবু জাতির ভবিষ্যতের প্রযোজনে কাউকে না কাউকে কথাগুলি বলতে হবে।

ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা ও পরিণতির কথা বলতে গিয়ে আমার অনেক সময় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বীর সুভাষচন্দ্র বসুর কথা মনে পড়ে। সুভাষ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করলে গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ্ কি এত সহজে ব্রিটিশ শাসনের দায়িত্বভার হাতে পেতেন, এত সহজে ব্রিটিশ প্রভুরা তাদের অনুগত ও অনুরক্ত ভৃত্য শ্রেণীর হাতে তাদের রাষ্ট্রের পরিচালনার ভার দিয়ে যেত? মোটেই না। আসলে সুভাষের অকাল মৃত্যু এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধ অকালে সমাপ্ত হলেও ভারতীয় সৈনিকদের বিদ্রোহ থেমে থাকল না। মুম্বইয়ের নৌবিদ্রোহের মত ঘটনার পর আর দেরী না করে ব্রিটিশ শাসকরা তাদের শাসনের সুবিধাভোগী শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসাবে গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহর হাতে তাদের গড়া উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনার ভার হস্তান্তর করে চলে গেছে। এটা আসলেই ক্ষমতার হস্তান্তর মাত্র, মোটেই নূতন ক্ষমতা কর্তৃক পুরাতন ক্ষমতাকে অপসারণ নয়। উপমহাদেশের তিনটি তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্রই এই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়ে চলেছে।

পাতা : ১৩

তবু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ উপমহাদেশের রাজনীতির গতিধারায় এক নূতন দিগন্তের উন্মোচন করে দিয়ে গেছে। যার সাহায্য নিয়েই হোক তৎকালীন পূর্ব বঙ্গবাসীরা একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ পাকিস্তানকে এই অঞ্চল থেকে পরাস্ত ও উৎখাত করেছে। এর তাৎপর্য অপরিমেয়। তৎকালীন ভারতের কংগ্রেস সরকারের ভূমিকা, আওয়ামী লীগের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নিয়ে প্রভূত পরিমাণে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা হতে পারে, তার প্রয়োজনও আছে। কিন্তু সেসব কোনওভাবেই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের মহিমা ও তাৎপর্যকে ম্লান করতে পারে না।

বস্তুত বিচ্ছিন্নভাবে একজন ব্যক্তি যেমন কিছু করতে পারে না তেমন একটা প্রজন্মও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে সময় এবং পরিস্থিতি ফ্যাক্টর। সুতরাং সুভাষচন্দ্র বসুর ব্যর্থতাকেও সেভাবে বিচার করতে হবে। কিন্তু ভারতবর্ষে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে অন্যায় ও অপরাধমূলক শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল তার অবসানের শ্রেষ্ঠ পথ যে যুদ্ধ সেই যুদ্ধের পথরেখা চিহ্নিত করে দিয়ে তিনি চলে গেছেন। এই শিক্ষা নিয়ে বাংলার পূর্ব অংশে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম ন্যায়যুদ্ধের পথে একটা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গিয়েছিল। এটা বস্তুত কালের একটা পরিহাস যে, সুভাষ যেমন ভারতবর্ষব্যাপী একটা প্রবল বিপ্লবী প্রজন্ম কিংবা সামাজিক শক্তির উত্থান এবং সমর্থন পান নাই তেমন ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মও সুভাষের মত একজন বিপ্লবী নেতাকে পায় নাই। দুই কালের দুই বিপ্লবী শক্তির মিলন হয় নাই। তবু সুভাষের পথ ধরে ষাটের দশকের যে প্রজন্ম এ দেশে একটা পর্যায় পর্যন্ত সমাজকে এগিয়ে নিয়ে একটা ন্যায়যুদ্ধকে অনিবার্য করেছিল তার যে সুদূরপ্রসারী ফল ফলতে বাধ্য সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অর্ধশতাব্দী কাল অতিবাহিত হয়েছে। ইতিহাসের বিচারে এই সময় সামান্য হতে পারে। কিন্তু প্রজন্ম বা ব্যক্তির বিচারে অনেক। এই দীর্ঘ সময়ে পৃথিবী এবং উপমহাদেশ যেমন অনেক পথ পার হয়েছে তেমন বাংলাদেশও অনেকটা পথ  পার হয়েছে। বিগত শতাব্দীতে যেমন অনেক কয়টি দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লব মানব জাতি দেখেছে তেমন বর্তমান শতকও দুনিয়া কাঁপানো নূতন বিপ্লবের অপেক্ষায় আছে বলে ধারণা করবার সঙ্গত কারণ আছে।

অন্তত ইসলামী পৃথিবী যে এক বা একাধিক বিশাল বিপ্লবের দিকে এগিয়ে চলেছে সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে হয়ত সেটা হবে বিপুল আত্মধ্বংসের পর। সব ধর্মই আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক হলেও ইসলাম আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে চরমভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক। তবু এতকাল পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ নিজেদের স্বার্থে বিশেষ করে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে প্রতিহত ও কোণঠাসা করার প্রয়োজনে ইসলামকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর থেকে পাশ্চাত্যের নিকট ইসলামের সেই প্রয়োজন প্রায় ফুরিয়েছে। অন্যদিকে সোভিয়েত বিপ্লবের পর থেকে ইসলামের প্রধান আদর্শিক শত্রু হিসাবে দেখা দেওয়া কম্যুনিজমও আর না থাকায় এখন ইসলাম তথা বিশ্বাসী মুসলমানদের প্রধান শত্রু হিসাবে পাশ্চাত্য দেখা দিয়েছে।

পৃথিবীতে ইসলাম এসেছে যুদ্ধ করে। তা এতকাল টিকেও ছিল যুদ্ধ করে। ইসলামকে টিকেও থাকতে হবে যুদ্ধ করে। এই ধর্ম যুদ্ধের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস নির্ভর। কাফের বা বিধর্মীদের বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেমন তাকে পথ চলতে হবে তেমন কাফের বা বিধর্মী না পেলে নানান অজুহাতে স্বধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হলেও তাকে পথ চলতে হবে। রক্তপাত ও খুনখারাবি ছাড়া ইসলাম ও সামাজিকভাবে মুসলমান বাঁচতে পারে না। জন্মের পর থেকে তার ইতিহাস এ কথা বলে। আজ আফগানিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির দিকে তাকালেও এই বাস্তবতা দেখতে পাওয়া যায়। আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য বা অমুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনও মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে জিহাদ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অথচ জিহাদ তথা ধর্মের নামে যুদ্ধ তাকে করতেই হবে। বাস্তবে সহিংসতা বা খুনাখুনির এই ইসলামী সংস্কৃতি মুসলমান সমাজকে শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী যুদ্ধ কিংবা সংঘাতে নিতে বাধ্য। বিশেষত আজকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন বিস্ময়কর বিকাশ ও বিস্তারের যুগে ইসলামের চরম সহিংসতা তথা খুনাখুনির সংস্কৃতি তার নিজেরই চূড়ান্ত ধ্বংসকে অনিবার্য ও আসন্ন করছে। তলোয়ারের যুগ-নির্ভর সহিংসতার এমন ধর্মীয় সংস্কৃতি মুসলিম সমাজগুলির কী পরিণতি ঘটাতে যাচ্ছে তা দেখবার জন্য বেশী কাল আর অপেক্ষা করতে হবে না। আগে থেকে সতর্ক হয়ে পথ পরিবর্তন করতে না পারলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মত উপমহাদেশের দেশ দুইটির জন্যও যে ভিন্ন পরিণতি অপেক্ষা করবে না সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ইসলাম ধর্ম যে বিপর্যয় ইসলামী সমাজে ঘটাচ্ছে এবং আরও ব্যাপকায়তনে ঘটাতে যাচ্ছে ভিন্ন দিক থেকে হিন্দুধর্মও যে প্রায় একই পরিণতি ভারতের হিন্দু সমাজে ঘটাতে যাচ্ছে সে কথাও বলা যায়। এর জন্য হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও তার সমস্যাগুলিকে বুঝতে হবে। *

--------------------------------------------
* হিন্দু ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও সমসম্যাগুলি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখায় আলোচনার চেষ্টা করেছি। এগুলির মধ্যে এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে কয়েকটি রচনার নাম উল্লেখ করছি। যথা, ‘ধর্ম আর জাতপাতের সীমানা পেরিয়ে’ (http://www.bangarashtra.net/article/1356.html), ‘ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের উত্থান ও রাষ্ট্রশক্তির অবসান’ (http://www.bangarashtra.net/article/1437.html), ‘হিন্দু ধর্ম ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়’ (http://www.bangarashtra.net/article/1458.html), ‘রামমূর্তি : যোগী আদিত্যনাথরা কোন্ ভারতের কারিগর হতে চান — ‘‘শাইনিং ইন্ডিয়া’’, নাকি ‘‘ডার্কলিং ইন্ডিয়া?’’ (http://www.bangarashtra.net/article/1459.html), ‘হিন্দু সমাজ এবং একটি কেস-স্টাডি’ (http://www.bangarashtra.net/article/1398.html),  ‘সিন্ধু সভ্যতা থেকে হিন্দু সমাজ’ (http://www.bangarashtra.net/article/1461.html) ইত্যাদি। এছাড়া ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ’ (http://www.bangarashtra.net/article/1456.html)-এ এ সংক্রান্ত কিছু আলোচনা আছে।
--------------------------------------------

পাতা : ১৪

এ বিষয় নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনা না করে এটুকু বলি যে, হিন্দুধর্ম ইসলামের মত আক্রমণাত্মক ও সহিংস বা মারমুখী নয়। আপাতদৃষ্টিতে তা সহিষ্ণু ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। হিন্দুধর্ম ও সমাজ সম্পর্কে কিছুপূর্বে যে কথা বলেছি কিছু পুনরুক্তি হলেও তার জের টেনে বলি এই সহিষ্ণুতার মূল কারণ বর্ণজাতিভেদমূলক বিভাজনের মাধ্যমে সমাজকে অজস্র বিভক্তির মধ্যে রাখা। এর ফলে সমাজকে তার বিভিন্ন বর্ণজাতি তথা গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শান্তি ও স্থিতি রক্ষার জন্য নিষ্ক্রিয়তা ও অনাক্রমণাত্মকতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হয়। এটা হিন্দু মানসকে যেমন প্রবলতর শক্তির বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধী করে তেমন তার উপর একবার কোনও কিছু চাপিয়ে দিতে পারলে সেটাকে মেনে নিতে শিখায়। আসলে স্থিতাবস্থা রক্ষার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে গিয়ে তা এক নির্বীর্য, অপ্রতিরোধী ও নিষ্ক্রিয় সমাজ সমষ্টি গঠন করে। বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে সমাজকে রক্ষার দায়িত্ব থাকে ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির হাতে। কিন্তু সমাজের বিভাজন তথা অনৈক্য এবং অক্ষত্রিয় বর্ণজাতিসমূহের নিরস্ত্রীকরণের সামাজিক প্রভাব ক্ষত্রিয়দের সক্ষমতাকেও হ্রাস বা খর্ব করে। এই অবস্থা বাইরের প্রবলতর শক্তিগুলিকে আক্রমণে উৎসাহিত করে। এই রকম সামাজিক পরিমণ্ডলে বহিঃশক্তি বিজয়ী হলে হিন্দু সমাজ সেটাকে মেনে নিয়ে স্থিতি বজায় রাখতে চেষ্টা করে।

এটা ঠিক যে, বহিরাগত মুসলিম শক্তি শুধু বিজয়ে সন্তুষ্ট না থেকে হিন্দুদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করার উপর গুরুত্ব দিলেও ভারতবর্ষে এ ক্ষেত্রে তেমন একটা সফল হয় নাই। সবচেয়ে বড় কথা হিন্দুদের ধর্মীয় এবং বর্ণজাতিগত পরিচয় রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা এবং মনোভাবের কারণে বিজয়ী মুসলমান শাসকরা অনেক ক্ষেত্রেই হাল ছেড়ে দিয়েছে। সভ্যতার বিচারে উন্নত হওয়ায় সামাজিক শ্রম ও সেবা দানে হিন্দুদের দক্ষতা ও সক্ষমতাও নিশ্চয় বহিরাগত মুসলমানদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দুদেরকে ছাড় দিতে কিংবা তাদের প্রতি নমনীয় হতে বাধ্য করেছিল।

অবশ্য হিন্দুদের যে কোনও মূল্যে এবং অনেক সময় এমনকি প্রাণের বিনিময়েও নিজ ধর্মবিশ্বাস রক্ষার মনোভাব থেকে অনেক কিছু বুঝবার আছে। আমি বিভিন্ন মুসলিম আগ্রাসনের সময়ে ঘটা এমন কিছু ঘটনার বিবরণ পড়েছি যেগুলি থেকে বুঝা যায় একটা জনগোষ্ঠী তার আত্মপরিচয় ও মর্যাদা বোধকে রক্ষার জন্য কী পরিমাণ মূল্য দিতে পারে! কোন কোন সময় পরাজিত হলে ধর্ম ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য নারীরা দলে দলে অগ্নিতে কিংবা বিষপানে আত্মহত্যা করত এবং পুরুষরাও একে অন্যকে দিয়ে হত্যা বা শিরোচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যু বরণ করত। ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের জন্য এটা যেন অনেক ক্ষেত্রে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এ যেন সচেতনভাবে একটা পরাজিত জনগোষ্ঠীর পাইকারি আত্মহত্যার উৎসব। অনেক সময় বিদেশী হানাদাররা এসব দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হত। এমনকি ব্রাহ্মণদের জন্য অস্ত্র ধরা সিদ্ধ না হলেও এবং ফলে নিরীহ ও অপ্রতিরোধী হলেও ধর্ম রক্ষার জন্য তারাও শত্রুর তরবারির নীচে দলে দলে আত্মবলিদান করত।   

বুঝা যায় নানান পথ ধরে হাজার হাজার বছর ধরে বহমান এক মহান সভ্যতা এবং তার উত্তরাধিকারের স্মৃতি একটা বিশাল ভূভাগের জনগোষ্ঠীকে ধর্মের মাধ্যমে তার আত্মপরিচয়কে রক্ষার জন্য এমন বেপরোয়া করত। এই জায়গায় সবাই হার মেনেছে। মুসলিম হানাদারদের আগে আসা শক, হুন ইত্যাদি হানাদাররা যে শুধু হার মেনেছে তা-ই নয়, অধিকন্তু নিজেদের আদি পরিচয়ের অনেক কিছু হারিয়ে ফেলে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বাধীন হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত হয়েছে। আক্রমণকারী বিজয়ী যোদ্ধারা সাধারণত ক্ষত্রিয় বর্ণজাতিভুক্ত হয়েছে।

কিন্তু ভারতের বাইরে বিশেষত আরবে মুসলমানদের ধর্মকেন্দ্র থাকায় এবং মধ্য-এশিয়া থেকে ঘন ঘন আক্রমণ অভিযান পরিচালনা এবং অব্যাহত ধারায় অভিবাসন করায় মুসলমানরা ভারতীয় জনসমাজ কিংবা হিন্দু সমাজে মিশে যায় নাই। বরং কালক্রমে তারা এখানে কিছু পরিমাণে দেশজ জনসংখ্যাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে। তবু উপমহাদেশে বিশেষত আজকের ভারত-রাষ্ট্রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

যে কথা বলেছি এটা একটা সভ্যতার শক্তিরও প্রকাশ। আসলে এর এক প্রধান উৎস হিসাবে আমি দেখতে পাই সিন্ধু সভ্যতাকে। পরবর্তী কালের আরও অনেক সভ্যতা ও সংস্কৃতির রসদও হিন্দু ধর্মকে সমৃদ্ধ করেছে। বর্ণজাতিভেদের কাঠামোতে ফেলে ব্রাহ্মণরা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য বোধকে মেনে নিয়ে ধীর গতিতে তাদেরকে এক বৃহত্তর সমাজের অংশ করে নিয়েছে। তবে সবার পিছনে চালিকা শক্তি হিসাবে থেকেছে সমাজ-নেতা ব্রাহ্মণদেরই প্রচণ্ড ও অদম্য আত্মগৌরববোধ। নানান উপকথা এবং সাহিত্যের মধ্য দিয়ে টিকে থাকা এক বিস্মৃত কিন্তু পরাক্রান্ত সভ্যতা সদাসর্বদা নানান চর্চার মধ্য দিয়ে কোন না কোন রূপে তাদের স্মৃতিতে জেগে থেকেছে। বিস্মৃত এই স্মৃতির আলোকে রক্ষার জন্য তারা যে কোনও কৌশল নিতে, অনেক সময় যে কোনও পরিণতিকে — সেটা চরমতম আত্মপীড়ন এমনকি আত্মহত্যা হলেও — মেনে নিতে দ্বিধা করে নাই। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ বর্ণজাতির শক্তির মধ্যেই যে রয়েছে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের অন্তর্গত শক্তির মূল উৎস এ কথা বুঝতে পারতে হবে। নেতা এমন দৃঢ় বলেই তো তার অনুসারীরাও এমন অচল, অটল, অনড় হয়ে তাদের ধর্মকে রক্ষা করেছে এতটা কাল এত বিপর্যয় আর বিপত্তির মধ্য দিয়েও।

পাতা : ১৫

আজকের ভারতের সঙ্কটটাও কিন্তু এই জায়গায়। অতীত ঐতিহ্যের মূল্য আছে। ব্যক্তির যেমন গোষ্ঠীরও তেমন স্বাতন্ত্র্য বা আত্মপরিচিতি বোধের মূল্য আছে। কিন্তু সেসবই স্থান, কাল এবং পাত্র নির্ভর। বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের অন্ধ চর্চা একটা সমাজের জন্য পতনও ডেকে আনতে পারে। ভারতবর্ষের জনসমাজের ভাগ্যে সেটাই ঘটেছে সুদীর্ঘ কাল ধরে। এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে ভারতবর্ষে কিংবা বঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষয় বা অবসানের পর বহিরাগত মুসলিম আক্রমণগুলি সাফল্য লাভ করে। বৃহৎ বঙ্গে বৌদ্ধ পাল শাসন ছিল প্রায় একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। দ্বাদশ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশ বঙ্গের শাসন ক্ষমতা অধিকার করে। তাদের শাসন শত বৎসর পূর্ণ হবার পূর্বেই আনুমানিক ১২০০ থেকে ১২০৪-এর মধ্যে  কোনও এক সময় বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে বহিরাগত মুসলমানরা বঙ্গ জয় করে। তার আগে তারা সেই কালে বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

হিন্দুধর্ম নিশ্চয় ভারতবর্ষকে পরাজয় ও পীড়নের মধ্যেও আত্মরক্ষার এক ধরনের শক্তি যুগিয়েছিল। কিন্তু ভারতবর্ষকে তার উপর আক্রমণকারীদেরকে উৎখাত ও উচ্ছেদের শক্তি দেয় নাই। বস্তুত তা ভারতবর্ষকে কিছু অভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা বা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক ধরনের সামাজিক ঐক্য দিলেও বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক বিভক্তি ও বিভাজন দ্বারা রাষ্ট্র নির্মাণ এবং রক্ষার কাজে দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে থেকেছে। শুধু যে বর্ণজাতিভেদ সমাজকে বিভক্তির চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছে তা-ই নয়, অধিকন্তু এই বিভক্তির চেতনাকে অব্যাহতভাবে শক্তি যুগিয়েছে বিভিন্ন স্থানিক ও গোষ্ঠীগত বিশ্বাস, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান এবং অসংখ্য দেব-দেবীর পূজার রীতি। এগুলি ভারতকে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য দিয়েছে বলে বাগাড়ম্বর করা হলেও বস্তুত এগুলি ভারতের প্রাণশক্তিকে প্রতিনিয়ত হরণ করছে। এগুলির সংরক্ষণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে সমাজ প্রকৃতপক্ষে প্রবল ও গতিশীল না হয়ে হয় দুর্বল ও স্থবির। আজকের এই তীব্র গতির যুগে এই রকম সমাজের টিকে থাকাই সম্ভব নয়, উন্নতির পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা।

অবশ্য আজ যেভাবেই হোক ভারতে একটা রাষ্ট্র আছে। কিন্তু ভারতে এখন যেভাবে ধর্মের আবেদন এবং শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশান্বিত হবার কারণ নাই। এটা ঠিক যে, ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু যে সমাজ-দেহের উপর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা যখন ধর্মাচ্ছন্ন হয় তখন রাষ্ট্র কী করে নিজেকে ধর্ম থেকে দূরে রাখতে পারে? একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা কী কথা বলে?

এমনিতেই আজকের যুগে ধর্ম নিয়ে কোনও সমাজের পক্ষেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার উপর ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের মত এত রক্ষণশীল এবং কিছু বিচারে অতীব প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মের চর্চা মানুষের অগ্রযাত্রাকে আরও অসম্ভব করে। ধর্ম মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দেয় না। ফলে এই মানুষও স্বাধীন হয় না। যে মানুষ চেতনায় পরাধীন সে কী করে স্বাধীন থাকে? উপমহাদেশ না হয় তার ধর্মগুলিকে নিয়ে থাকল। কিন্তু পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলি তো ধর্ম নিয়ে পড়ে নাই। প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে হেরে গেলে কী হতে পারে তা কি বলে দিতে হবে?

ধর্ম মানুষকে কীভাবে বন্ধ্যা ও মস্তিষ্কশূন্য বা নির্বোধ করে তার উদাহরণ হিসাবে পলাশীর যুদ্ধের কথা বলা যায়। নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহনীর সৈন্যসংখ্যা বলা হয় ৬৭ বা ৬৮ হাজার ছিল। ইংরেজ পক্ষে তার সংখ্যা ৩ হাজারের সামান্য কিছু বেশী। নওয়াবের সেনাপতি মীরজাফর তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীর ৫০ হাজার সেনা নিয়ে যুদ্ধ না করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কিন্তু নওয়াবের পক্ষে বাকী ১৭/১৮ হাজার সেনা তো লড়াই করল। ইংরেজদের তুলনায় সংখ্যাটা বিরাট। সুতরাং নওয়াবের পরাজয়ের কথা নয়। কিন্তু দিনটা ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। অর্থাৎ সময়টা তখন বর্ষা ঋতুর। এ বছরের পঞ্জিকার হিসাবে বাংলা তারিখটা হয় ৯ আষাঢ়। এ রকম এক ভরা বর্ষার দিনে বৃষ্টি আসায় নওয়াবের সমস্ত বারুদ ভিজে গেল। কারণ বারুদ ঢেকে রাখবার কোনও প্রস্তুতি নওয়াব এবং তার সেনাপতিরা রাখেন নাই। তার পক্ষে তো মীরমদন এবং মোহনলালের মত সেনাপতিরা যুদ্ধ করেছিলেন। প্রথম জন মুসলমান এবং দ্বিতীয় জন হিন্দু। কিন্তু এদেশের মানুষ হবার পরেও বর্ষা কালে বৃষ্টি আসা যে স্বাভাবিক এবং বৃষ্টিতে বারুদ ভিজে গেলে যে কী পরিণতি হতে পারে সেটাই কারও মাথায় ঢুকে নাই।

অথচ ইংরেজরা বিদেশী হলেও তারা তাদের বারুদ রক্ষার সব আয়োজন করে রেখেছিল। ফলে বারুদ না ভেজায় তাদের কামান এবং বন্দুক সচল ছিল। তারা সমানে নওয়াব সৈন্যদের বিরুদ্ধে কামান-বন্দুক দেগে চলল। বিপরীতে বারুদ ভিজবার কারণে নওয়াবের কামান-বন্দুক অচল রইল। সংখ্যায় নওয়াবের সৈন্য অনেক বেশী হলেও ইংরেজদের কামান-বন্দুকের সামনে ঢাল-তলোয়ার দিয়ে কী করবে? তাদের অনেকে মৃত্যু বরণ করল। একদিকে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, অপর দিকে কামান-বন্দুকের এই হাল! সন্ধ্যা নামতে নওয়াব সিরাজ পরের দিনের অপেক্ষা না করে রণক্ষেত্র পরিত্যাগ করলেন। এটা সহজ বুদ্ধির কথা যে, ভেজা বারুদ দিয়ে পরের দিনও কামান-বন্দুক চালানো যেত না।

পাতা : ১৬

এই ঘটনা থেকে বুঝতে হবে ধর্ম কীভাবে মানুষের বোধ-বুদ্ধি নষ্ট করে, মানুষকে বিচার-বুদ্ধিশূন্য করে কিংবা তার চিন্তা করার শক্তিকে ধ্বংস করে। ইংরেজদের জন্য এটা সৌভাগ্যের যে তারা ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ব্রত নিয়ে এ দেশে আসে নাই। বরং তারা ধর্মমুক্ত চেতনা নিয়ে এ দেশে এসেছিল বাণিজ্য করতে এবং সুযোগমত যুদ্ধ করে দেশ জয় করতে।

এটা ঠিক যে, এক কালে বিচার-বুদ্ধিশূন্য কিংবা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাহীন মুসলমানরা পৃথিবীর বিশাল অঞ্চল জয় করেছিল। কিন্তু ঢাল-তলোয়ার আর গায়ের জোরের সেই কাল অনেক আগেই গত হয়েছে। এখন বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তির এই বিস্ময়কর অগ্রগতির কালে অন্ধত্ব নিয়ে, অন্ধত্বের সংস্কৃতি ও চর্চা নিয়ে মুসলমানরা দাঁড়াবে কী করে? এখন পাশ্চাত্য কিংবা অমুসলিম শক্তিবর্গের দাসত্ব করে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কী করণীয় আছে? সে কাজটাই তারা করে চলেছে বহুকাল ধরে। কিন্তু সভ্যতার জন্য কেউ বোঝা হলে সভ্য পৃথিবী তাকে বেশী কাল টানবে বা সহ্য করবে কেন?

প্রকৃতপক্ষে, ধর্ম মুসলমান বা হিন্দু কাউকে রক্ষা দিবে না। ইসলামী পৃথিবীর পতন এবং ধ্বংসের কাল শুরু হয়েছে। সেটা একভাবে। ভারতের হিন্দু সমাজ আর একভাবে নিজেদের বিপর্যয়ের পথ প্রশস্ত করছে ধর্মচর্চাকে রাজনীতিতে প্রাধান্য দিয়ে। এছাড়া অবশ্য বর্তমান ভারতের জন্য উপায়ও নাই। কারণ বহু ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতি ভিত্তিক ভারতকে এক অখণ্ড রাষ্ট্রের বন্ধনে ধরে রাখবার জন্য এখন পর্যন্ত ধর্মের বাইরে তার আর কোনও আদর্শিক শক্তি নাই। সংখ্যাগুরুর ধর্ম হিসাবে সেটা হয়ে আছে হিন্দু ধর্ম। এই কারণে ভারতে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও প্রায় সর্ব পর্যায়ে সেখানে ধর্মের প্রভাব এত প্রবল। বরং রাষ্ট্রের সঙ্কট বৃদ্ধির সঙ্গে ধর্মের প্রভাবও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি আবার রাষ্ট্রের সঙ্কট বৃদ্ধি করবে। সমস্যাটা বুঝতে না পারলে এটা একটা অশুভ চক্র সৃষ্টি করে সমাজ ও রাষ্ট্র উভয়েরই ধ্বংস ঘটাবে।

বস্তুত উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র এবং ধর্ম এই দুইটি শক্তি উপমহাদেশের অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে। রাষ্ট্র যেমন অবিচার, অন্যায়, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের হাতিয়ার হয়ে আছে তেমন ধর্ম সেগুলির লালনের জন্য অনুকূল ভূমি তৈরী করে রেখেছে। এখান থেকে বের হতে হবে।

আর সেক্ষেত্রে আমি দিকনির্দেশক হিসাবে দেখতে পাই সিন্ধু সভ্যতাকে। অবশ্যই সেটা সেখানে ফিরবার জন্য নয়। তবু শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার জন্য সেখানে ফিরতেও হবে। সেখান থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হবে। এবং সেখানে আমি দেখতে পাই উপমহাদেশব্যাপী একটি বৃহত্তর ঐক্যের পথনির্দেশও। একটি ভাষাকে কেন্দ্র করে কিছু অভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের আদিপুরুষরা যেভাবে ধীর গতির সেই কালে বিশাল ভূভাগে একটি মহাসভ্যতা নির্মাণ করেছিলেন সেখান থেকে শিক্ষণীয় বহুকিছুই আমাদের জন্য আছে। তবে তার জন্য মতান্ধ না হয়ে এবং সজীব মন দিয়ে সবকিছুকে বিচারের মাধ্যমে গ্রহণ ও বর্জনের সক্ষমতা রাখতে হবে।

সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ভাষার প্রশ্নটা আমার কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হিসাবে উপস্থিত হয়। আজ বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রে উপমহাদেশের বিভাজন একটা বাস্তবতা। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। তবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে গেলে উপমহাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্যের ভিত্তিতে একটা অভিন্নতা অর্জনের বিষয়টিও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনা ও ভাষার পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে আমরা সমগ্র উপমহাদেশের ঐ্ক্যবদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারি। বিশেষ করে ভারত-রাষ্ট্রের জন্য সিন্ধু সভ্যতার ভাষা হিসাবে বৈদিক ভাষার পুনরুজ্জীবন সহজতর হতে পারে। কারণ এর সঙ্গে জড়িত আছে হিন্দু সমাজের আবেগের বিষয়। একবার যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তবে সেটা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব ব্যাপার হবে না। এটা মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যবহারের বিচারে মৃত ভাষা হলেও ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থের ভাষা হিব্রু এখন ইসরাইলের শুধু রাষ্ট্রভাষা নয়, বরং সেটা সেখানকার সাধারণ মানুষদেরও ব্যবহারের ভাষায় পরিণত হয়েছে। এমনকি একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দ্বারা কীভাবে প্রায় নূতন একটা ভাষাকে সর্বসাধারণের ভাষা হিসাবে জন্ম দেওয়া যায় তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রভাষা।  ডাচ শাসনাধীন থাকাকালে ইন্দোনেশিয়ায় কোনও অভিন্ন দেশীয় ভাষা ছিল না। কয়েক হাজার দ্বীপ এবং সাতশ’র অধিক ভাষার দেশ ছিল ইন্দোনেশিয়া। বিদেশী ডাচরা নিজেদের ডাচ ভাষায় সেখানকার উপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাজকর্ম পরিচালনা করত। ইন্দোনেশীয়রা ১৯৪৫ সালে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ই তারা উপনিবেশিক শাসকদের ভাষা ডাচকে প্রত্যাখ্যান ক’রে নিজস্ব জাতীয় ভাষা প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেয়, যে ভাষা হবে তাদের রাষ্ট্রভাষা এবং সকল ইন্দোনেশিয়াবাসীর অভিন্ন ভাষা। সুতরাং মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ লোকের ভাষা মালয়কে কেন্দ্র করে অনেকাংশে নূতন একটা ভাষা গঠন করা হল, যার নাম দেওয়া হল বাহাসা ইন্দোনেশিয়া (Bahasa Indonesia)। বুঝা যায় সংস্কৃত শব্দ ভাষা থেকে বাহাসা। অর্থাৎ ভাষা ইন্দোনেশিয়া। ১৯৪৯ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করার পর বাহাসা ইন্দোনেশিয়া শুধু ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রভাষা নয়, উপরন্তু হাজার হাজার দ্বীপে বিভক্ত রাষ্ট্রের সর্বত্র জনগণের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্যও প্রধান ভাষা হয়েছে।

পাতা : ১৭

সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার ভাষা হিসাবে বৈদিক ভাষার পুনরুজ্জীবন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। বিশেষত হিন্দু ধর্মের ভিতর সর্বভারতীয় ঐক্যের যে আকাঙ্ক্ষা সুপ্ত আছে সেটাও এভাবে বাঙ্ময় হবে। অথচ এটা ধর্মের আধিপত্য থেকে মানুষ ও সমাজকে মুক্তির পথে নেওয়া তথা লোকায়ত চেতনা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।

এ কথা আমাদের বুঝতে হবে যে, ধর্মচর্চার ভাষা হলেও বৈদিক ভাষার উৎস সিন্ধু সভ্যতার জনসমাজ। এটা ঠিক যে, একটা ধর্মগ্রন্থের ভাষা হওয়ার কারণে আজ অবধি এই ভাষার চর্চা একটা ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে ব্রাহ্মণদের কারণে হলেও রক্ষা পেয়েছে। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার সুমহান উত্তরাধিকারকে ভাষাচর্চার মাধ্যমে আজ অবধি জীবন্ত রাখবার কৃতিত্ব হিন্দুধর্ম এবং সেই সঙ্গে তার নেতৃত্বকারী শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদেরকে দিতে হবে। কিন্তু এখন এই শ্রেণীর হাত থেকে এই ভাষা চর্চার দায়িত্ব তুলে নিতে হবে। সভ্যতার উত্তরাধিকারকে রক্ষায় এক কালে এই ধর্ম ও তার নেতৃত্বকারী শ্রেণীর কিছু ভূমিকা থাকলেও এখন সেটা ফুরিয়েছে। বস্তুত এক সময়ে মানুষের অগ্রগতিতে কিছু ক্ষেত্রে ধর্মের কিছু ইতিবাচক ভূমিকা থাকলেও এখন পশ্চাৎমুখী জীবনে কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতায় ধরে রেখে ধর্মগুলি মানুষের অগ্রগতিতে নিদারুণ বাধার কারণ হয়েছে। সুতরাং ধর্মের আধিপত্য থেকে মুক্তি আজ কালের দাবী।

এই দাবীকে সামনে রেখে অর্ধশতাব্দীরও অধিক কাল পূর্বে পূর্ব বঙ্গের বুকে যে জাগরণ ঘটেছিল তার ফলে ঘটেছিল ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। সেটা ছিল আধুনিক কালের মত করে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনার পুনর্জাগরণ। যুদ্ধে জয় হলেও শেষ অবধি স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতির শক্তির পরাজয় ঘটেছে। যুদ্ধজয়ের ফসল অন্যরা আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু একটা লোকায়ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে রাজনীতি ও যুদ্ধ গড়ে তোলা হয়েছিল তার ফসল অন্যরা আত্মসাৎ করলেও তার উত্তরাধিকার ও প্রেরণা বিনষ্ট হতে পারে না।

এটা ঠিক যে, তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের জনগণের মুক্তির যে যুদ্ধ অসমাপ্ত রয়েছে তাকে সম্পূর্ণ না করে আমরা উপমহাদেশীয় ঐক্যের প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিতে পারি না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আমাদের দৃষ্টিকে আমরা কোনও ক্ষুদ্র গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ করে উপমহাদেশকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবার যে সুযোগ আমাদের সামনে আছে তাকে অবহেলা করতে পারি না। বিশেষ করে আমাদের আত্মপরিচয়ের গৌরবময় উত্তরাধিকারের দিকে যখন আমরা হাত বাড়াই তখন আমাদেরকে সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। সেখানে বিশেষভাবে দেখা দেয় ভাষার নৈকট্যের বিষয়টি, যে বিষয়ে ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি।

বিগত একশত বৎসরের আবিষ্কার ও অনুসন্ধানের ফলে এখন সিন্ধু সভ্যতার বহুকিছুই আর অজ্ঞাত কিংবা ধারণাতীত কোনও বিষয় নয়। এখনও আবিষ্কারের অনেক বাকী আছে। তবু যেটুকু আবিষ্কার হয়েছে তা থেকে একটা মহাসভ্যতার অনেকটা ছবিই আজ আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তা থেকে আমরা জানি আমরা কত বিশাল ও মহান এক সভ্যতার উত্তরাধিকারী। আজ যখন মানুষ মহাশূন্যের পথ পাড়ি দিয়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাবার উপায় সন্ধান করছে তখন কি আমরা এত বড় সম্পদকে, এমন এক মহাসভ্যতার উত্তরাধিকারকে ফেলে দিয়ে ক্ষুদ্রত্বে আশ্রয় নিব? আজকের ভাষিক কিংবা রাষ্ট্রিক পরিচয় সেটাও মিথ্যা নয়। কিন্তু সম্মুখে অপেক্ষা করছে আরও প্রসারিত দিগন্ত। সেটার হাতছানিকে কেন অস্বীকার করব? আজকের ভিত্তিকে স্বীকার ও পুনর্নির্মাণ ক’রে এবং তার উপরে পা রেখে আমরা অধিকতর প্রসারিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করব।

হ্যাঁ, খুব গর্বের সঙ্গে বলছি ভিত্তি আমরা একাত্তরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ বঙ্গে নির্মাণ করেছি। এটাও সত্য যে, আধুনিক কালে সমগ্র উপমহাদেশে আর কেউই ঠিক এই রকম করে এই ভিত্তি নির্মাণ করতে পারে নাই। আধুনিক কালের যাত্রাপথ নির্মাণে বঙ্গসন্তান সুভাষ একটা সূচনা ঘটিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটাকে তিনি আর এগিয়ে নিতে পারেন নাই। এ বঙ্গে আমরা সেটাকে আরও কিছু দূর এগিয়ে নিয়ে একটা প্রকৃত লোকায়ত ও জনক্যাণবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধ সংগঠিত করতে পেরেছিলাম। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারলেও নানান কারণে তার ফল হস্তচ্যুত হয়েছে। সেই যুদ্ধ আজও তার পরিণতির অপেক্ষায় আছে। সেটাকে পরিণতি দানের মাধ্যমে আমরা উপমহাদেশের বুকে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত ও জনকল্যাণবাদী চেতনার পুনরুজ্জীবন যে ঘটাতে পারি সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারগুলিকে নিয়ে এখন নূতন করে আলোচনা ও পর্যালোচনা হওয়া অত্যাবশ্যক। বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি থেকে এই সভ্যতার জনকল্যাণবাদী, গণতান্ত্রিক ও লোকায়ত চেতনা যেভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে এখন সময়ের একান্ত দাবী তাকে সামনে নিয়ে আসবার। তাহলে একদিকে যেমন ঘটবে সিন্ধু সভ্যতার ভাবপ্রেরণার পুনরুত্থান, অপর দিকে তেমন চেতনার জগতে যে নবজাগরণ ঘটবে সেটা উপমহাদেশকে নিয়ে যাবে আর এক মহাসভ্যতা নির্মাণের পথে। এভাবে চার হাজার বছর পর নূতন কালের পথরেখা ধরে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনার উত্তরসূরি হিসাবে মানব জাতির সম্মুখে আবির্ভূত হবে আর এক মহাসভ্যতা।  

রচনা : ১২ – ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০

পাতা : ১৮




 

পরিশিষ্ট :

আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা —  শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল

চতুর্থ অধ্যায় — সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যালোচনা

সিন্ধু সভ্যতার কিছু বৈশিষ্ট্য

খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন সহ কোন সভ্যতাকে দেখা যায় না। পণ্ডিতরা এখন নিশ্চিত হয়েছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণে বাইরের সভ্যতাগুলোর সাথে বিনিময় এবং যোগাযোগের ভূমিকা থাকলেও সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ও স্বাধীনভাবে তা গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু উপত্যকায় নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়ে সেখানকার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আরো যে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জানা যাচ্ছে যে, সুপ্রাচীনকালে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীতে দু’টি ছেদ দেখা যায়- প্রথমটি হল মেহরগড়ে নবপ্রস্তর যুগ থেকে তাম্রযুগে উত্তরণের পর্যায়ে (অর্থাৎ প্রায় ৫০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে) এবং দ্বিতীয়টি হল ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পরে। মাঝখানে এই দীর্ঘ সময়ে এই অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যে স্পষ্ট ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অর্থাৎ একাধারে সাংস্কৃতিক ও নৃগোষ্ঠীগত ধারাবাহিকতা থাকায় এখানে প্রাগৈতিহাসিককালে বহিরাগত জনগোষ্ঠী হিসাবে আর্যদের আগমনের কোন পথ থাকে না। সিন্ধু সভ্যতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের উপর লেখকরা আলোকপাত করেছেন, সেটা হল সভ্যতা নির্মাণে যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ এখানে অপ্রধান ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন বড় তরবারি, বর্ম, ঢাল, শিরস্ত্রাণ, ইত্যাদি সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে এমন কি যাকে নগরদুর্গ বলা হয় সেখানেও পাওয়া যায়নি। কিছু ছোট অস্ত্র পাওয়া গেছে যেগুলিকে কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক যুদ্ধাস্ত্র বলেছেন সেগুলি সংখ্যায় কম ও নিম্ন মানের। বেশ কিছু সংখ্যক হরপ্পান নগর ও শহর উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এসব প্রাচীরে বড় প্রবেশ-দ্বার থাকত। তাছাড়া লোকজনের ভিতরে প্রবেশের জন্য সিঁড়িও থাকত আলাদাভাবে। নগর প্রাচীরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে পণ্ডিতরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এসব নগর প্রাচীর মূলত যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী করা হয় নি। এগুলি তৈরীর একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বন্যা প্রতিরোধ করা।

--------------------------------------------
দেখুন : Jim G. Shaffer & Diane A. Lichtenstein ‘Migration, Philology and South Asian Archaeology.’ in, Aryan and Non-Aryan in South Asia, (1999), pp. 247-257.

দেহগত নৃবিজ্ঞানী কেনেথ কেনেডি এই বিষয়ে বলছেন : ‘Our multivariate approach does not define the biological identity of an ancient Aryan population, but it does indicate that the Indus Valley and Gandhara peoples shared a number of craniometric, odontometric and discrete traits that point to a high degree of biological affinity. Evidence of demographic discontinuities is present in our study, but the first occurs between 6000 and 4500 B.C (a separation between the Neolithic and Chalcolithic populations of Mehrgarh) and the second is after 800 B.C., the discontinuity being between the peoples of Harappa, Chalcolithic Mehrgarh and post-Harappan Timargarha on the one hand and the late Bronze Age and early Iron Age inhabitants of Sarai Khola on the other. In short, there is no evidence of demographic disruptions in the northwestern sector of the subcontinent during and immediately after the decline of the Harappan culture.’

Kenneth A.R. Kennedy, ‘Have Aryans been identified in the prehistoric skeletal record from South Asia? Biological anthropology and concepts of ancient races,’ in, The Indo-Aryans of Ancient South Asia; Language, Material Culture and Ethnicity, ed. George Erdosy (Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1997), pp. 49-60.

এছাড়াও অন্য একটি লেখায় কেনেডি বলেন : ‘The important message for archaeologists from this example is that whatever the racial origins of the Harappans may have been they were a relatively stable population inhabiting the northern and northwestern sectors of the Subcontinent for several millenia prior to their climatic moment of urbanization and commercial influence ....’

Kenneth A.R. Kennedy. ‘Skulls, Aryans and Flowing Drains:The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization’, in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, (1982), p. 290.

দেখুন : B.B. Lal, ‘Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan’, in, Frontiers of the Indus Civilization (1984), p. 55.
--------------------------------------------

পাতা: ১৯

অন্য দিকে মেসোপটেমিয়া ও মিসরে সভ্যতা নির্মাণে যুদ্ধ একটি প্রধান দিক ছিল। এখানকার পাওয়া অস্ত্র পরিমাণে বেশী ও উন্নতমানের। তাছাড়া এখন পর্যন্ত পাওয়া সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত সিল ও চিত্রাঙ্কিত বিভিন্ন ফলকের মধ্যে কেবলমাত্র একটিতে যুদ্ধের ছবি দেখা যায়। মেসোপটেমিয়া ও মিসরের নগরগুলিতে যে প্রাচীর ছিল তা যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। এই দুই সভ্যতার বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ফলকে যে সব ছবি পাওয়া গেছে তার মধ্যে বেশ কিছু ছবিই যুদ্ধ বা যুদ্ধ জয়ের সাথে সম্পর্কিত। যুদ্ধে সুমেরীয়রা ছিল খুবই নিষ্ঠুর। বেশীর ভাগ যুদ্ধবন্দীদের তারা সাথে সাথে হত্যা করত এবং বাকীদের আজীবনের জন্য দাস করে রাখত। শত্রুদের অধিকৃত শহরগুলো শুধু লুঠ করা হত না, বাড়ীঘর পোড়ানো হত বা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হত এবং যারা বেঁচে থাকত তারা বিভিন্ন জায়গায় পালাত। মিসরে রাষ্ট্র নির্মাণের সূচনা থেকেই যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ঊর্ধ ও নিম্ন মিসর একত্রীকরণ এবং মিসরে আদি রাষ্ট্র গঠনের সময়ে হায়ারাকোনপোলিসে (Hierakonpolis) রাজা নরমারের ফলকে কিছু ছবি আঁকা আছে। সেখানে মৃত শত্রুদের এবং লোকজন অথবা বসতিসমূহের পরাভূত অবস্থা দেখানো হয়েছে। এই রাজার রাজদণ্ডের মাথায় কিছু ছবি ও চিহ্নে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্য দেখানো হয়েছে। রাজা স্করপিয়ানের রাজদণ্ডের মাথায়ও বিজিত মানুষদের ছবি ছিল। যদিও যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন স্তর সেসময় পাওয়া যায় নি তবু এ বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত যে, যুদ্ধের মাধ্যমে মিসরে আদি রাজবংশের সুদৃঢ়করণ এবং প্রথম রাজবংশের আদিতে নিম্ন নুবিয়া ও দক্ষিণ প্যালেস্টাইনে মিসরীয় রাষ্ট্রশক্তির সম্পসারণ হয়। এরপর সমগ্র মিসরীয় সভ্যতার নানা সময়ে যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর ছবি এবং হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।

--------------------------------------------
দেখুন : Kathryn A. Bard, 'The Emergence of the Egyptian State (C.3200-2686 BC)' in, The Oxford Histry of Ancient Egypt. ed., Ian Shaw (Oxford University Press, Oxford, 2000), pp-61-88.
--------------------------------------------

কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার কোন পর্যায়েই যুদ্ধের কারণে এই ধরনের ধ্বংসকাণ্ড বা ব্যাপক গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে কেবলমাত্র কোট দিজি, আমরি ও গুমলাতে আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান স্তরের মাঝখানে আগুনে পোড়ানো চিহ্ন পাওয়া গেছে। এগুলো যুদ্ধের কারণে বলে মনে হয়। তাছাড়া কালিবঙ্গানে এই দুই স্তরের মাঝে ঘরের দেয়ালে ফাটলের চিহ্ন দেখা গেছে। এগুলো ভূমিকম্পের কারণে হয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন। বনওয়ালীতে বিভিন্ন ভবনে ফাটলের চিহ্ন এবং গুমলাতে ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব উদাহরণ থেকে সেখানে আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ের মাঝখানে যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হবার বিষয়টি নাকচ করা যায় না। এছাড়া মহেঞ্জোদাড়োতে কিছু হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক মর্টিমার হুইলার একে ‘গণহত্যা’ বললেও সম্প্রতি আরও গবেষণার ফলে এই মত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তি ও বসতির সংখ্যার তুলনায় এইসব দৃষ্টান্ত খুবই কম এবং এগুলো এই সভ্যতার সামগ্রিক প্রবণতাকে প্রকাশ করে না। কারণ কোন ফলক ও সিলে অথবা অন্য কোন কিছুতে এমন কোন ছবি পাওয়া যায় না যা সিন্ধু সভ্যতায় বল প্রয়োগ বা যুদ্ধের উপস্থিতিকে প্রকাশ করে (একটি ব্যতিক্রম ছাড়া)।

যদিও সুমেরীয়রা শিল্পকলায় সিন্ধু সভ্যতার তুলনায় দক্ষ ছিল, তবু বিভিন্ন তথ্য থেকে তাদের এক নিষ্ঠুর ও নির্মম সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের, সম্ভবত রাজা বা রাজপুত্রদের কবর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের কংকাল পেয়েছিলেন। এই কবরগুলোতে এ সমস্ত নারী-পুরুষকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত তারা রাজার দাস-দাসী ছিল। এধরনের একটি কবরের প্রবেশপথে তামার শিরস্ত্রাণ ও বল্লম সজ্জিত পাহারারত ভঙ্গিতে মৃতদেহ রাখা হয়েছিল। একজন রাণীর সমাধিতে তার সামনে সম্ভবত রাজপ্রাসাদের পরিচারিকা বা দাসীদের কবর দেওয়া হয়েছিল। এখানে আরও ছিল হার্পসহ একজন হার্পবাদক এবং আনত অবস্থানে দু’জন পরিচারকের দেহ। এসব বিবরণ থেকে যে কেউ রাজা বা রাণীর মৃত্যুর পর তাদের সেবক-সেবিকা বা দাস-দাসীদের ভয়ংকর পরিণতি কল্পনা করতে পারবেন। মৃত্যু পরবর্তী জগতে শাসকদের সেবা করবার জন্য যে তাদের হত্যা করার ধর্মীয় প্রথা ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাচীন চীনেও বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের প্রথা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে রাজার সমাধিতে শতাধিক দাসদাসী হত্যা করে কবর দেবার ঘটনাও জানা গেছে। এই ধরনের কোন নিষ্ঠুর প্রথার প্রচলন বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় দেখা যায় না। যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের প্রাধান্য ছাড়া সমাজে এরকম প্রথার প্রচলন সম্ভব নয়।

ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুমেরীয়দের মধ্যে সাকার দেবতার পূজা (অর্থাৎ প্রতিমা পূজা) এবং বহুদেবতাবাদ প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রীয় দেবতার মূর্তি হত বৃহদাকার। এছাড়া প্রায় বাড়ীগুলোতেই ছোট মূর্তি পাওয়া গেছে, যেগুলো গৃহদেবতা বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব দেবতার প্রতিমা বলে মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতায়ও মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো কোনটাই খুব বড় আকৃতির নয়। এমনকি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় নগর মহেঞ্জোদাড়োতেও বড় ভবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলোর কোনটাকেই দেবতার মূর্তি বলে চিহ্নিত করা যায় নি। এছাড়া মাথায় অলংকারযুক্ত খুবই ছোট পোড়া মাটির নারী মূর্তি সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেলেও সেগুলোর সাথে রাষ্ট্রীয় দেবতা বা শাসক শ্রেণীর ধর্মের কোন সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় না।

সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোন রাজার সমাধি, মন্দির বা রাজপ্রাসাদ খুঁজে পান নি। যেসব বড় ভবনের কাঠামো পাওয়া গেছে সেগুলো ধনীদের বাসস্থান বা গণমিলনায়তন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। কিন্তু এককভাবে কোন ভবনই তত বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না যাতে করে তাকে রাজপ্রাসাদ বা মন্দির বলে চিহ্নিত করা যায়। যে সব কবর পাওয়া গেছে সেগুলির মধ্যে কিছু সংখ্যককে অন্যগুলির তুলনায় বেশী বা উন্নতমানের জিনিসপত্র, যেমন মৃৎপাত্র, অলংকার, পাথর বা ব্রোঞ্জের অস্ত্র ইত্যাদি থেকে ধনীর সমাধি বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু রাজার সমাধি হিসাবে কোনটিকে নির্দিষ্ট করা যায় না। বড় বাড়ীগুলো নগরের এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে সমস্ত নগর বা শহরব্যাপী সমভাবে ছড়ানো ছিল। একইভাবে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র, যা সে যুগে ধনীদেরই কেবল ব্যবহার করার কথা, নগরের কোন বিশেষ স্থানে না থেকে সমস্ত শহরব্যাপী পাওয়া গেছে।

--------------------------------------------
দেখুন : John Elder., Archaeology and the Bible (Robert Hale Limited, London, 1961), p. 39.
এ বিষয়ে জিম শেফার তাঁর লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দেখুন : Jim G. Shaffer, ‘Harappan Culture: A Reconsideration,’ in, Harappan Civilization : A Recent Perspective, ed. Gregory L. Possehl, (Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1993) pp. 41-50.

--------------------------------------------

পাতা : ২০

এ থেকে বোঝা যায় যে, নগরে শাসক থাকলেও তাকে কেন্দ্র করে ধনীরা অবস্থান করে না বরং সমস্ত নগরে ছড়িয়ে থাকে, এমনকি নগরের নীচু স্তরের মানুষদের বাড়ীর কাছেও। এগুলো হরপ্পান সভ্যতায় তুলনামূলক সাম্য ও গণতন্ত্র থাকার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে। ধনী ও দরিদ্রের তুলনামূলক পার্থক্যহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে হরপ্পান যুগের নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়ে। অন্যান্য সভ্যতায় এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে একই সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা নীচু শ্রেণীর মানুষের তুলনায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় কম ভোগে ও দৈর্ঘ্যে অধিকতর লম্বা হয়। খুবই আশ্চর্য হবার মত বিষয় যে, হরপ্পান সভ্যতায় এই ধরনের পার্থক্য দেখা যায় নি। বিপুল জন-অধ্যুষিত এই সভ্যতায় এই ঘটনা সমাজের সর্বস্তরে সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে।

--------------------------------------------
এ প্রসঙ্গে কেনেথ কেনেডি বলেছেন : ‘... ... .. High ranking individuals enjoy a greater potential to attain their full ontogenetic development, hence are taller in stature, and tend to suffer less from abnormalities of nutritional stress than do individuals of subordinate social status within the same society. However, observations of Harappan skeletal series from five major sites, which comprise about 350 individuals, have not revealed significant differences in patterns of growth and development as would be recognized by lines of arrested growth in long bones and hyper-palsia or dental enamel. Osseons malformations suggestive of nutritional stress are absent as well. Nor are there any striking differences in incidences of dental attrition and common dental pathologies such as caries, abscess, malocclusion and ante-mortem tooth loss in Harappan skeletons. In short, the Harappan skeletal series is aberrant when compared with series from other archaeological sites for which archaeological data suggest a significant development of social stratification. This negative evidence from the Harappan sample should not be interpreted to mean that a social hierarchy was absent in Harappan culture. Rather, biological observations suggest that social control may have been exercised by the Harappan elite in a way that did not evoke the usual dietary stresses so often imposed elswhere upon an urban proletariat. The absence of royal tombs in Harappan centers may be significant in this connection.’ Kenneth A.R. Kennedy, ‘Skulls, Aryans and Flowing Drains : The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization,’ in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, (1982), P. 290.

--------------------------------------------

অন্যদিকে, মিসরে ও মেসোপটেমিয়ায় সব যুগেই রাজার সমাধি চিহ্নিত করা গেছে অন্যান্য সমাধি থেকে এর বৃহদাকার নির্মাণ ও মূল্যবান সামগ্রী থেকে। মিসরের রাজারা, যাদেরকে ফারাও বলা হত, সমগ্র সভ্যতার শক্তিকে নিয়োজিত করেছিল তাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সুখের জন্য বিশাল বিশাল পিরামিড তৈরী করায়। মেসোপটেমিয়ায় রাজপ্রাসাদ হত বড়। মন্দিরগুলো প্রথম দিকের তুলনায় পরের যুগগুলোতে সমাজের শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির সাথে বড় হতে থাকে। সে সময়ে মন্দির বা জিগগুরাটগুলো তৈরী করা হত বিশালায়তনে। সিন্ধু সভ্যতায় ধনী-দরিদ্র সবাই নগর বা শহরে দালান-বাড়ীতে বসবাস করত এবং এখানে কোন বস্তি ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু মেসোপটেমিয়ার নগরগুলোতে দরিদ্ররা থাকতে পারত না বলে ধারণা করা হয়। খুব সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খননগুলো থেকে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে, নগরের বাইরে তারা ঝুপড়ি বা কাঁচা বাড়ীঘর তৈরী করে থাকত। মিসর বা মেসোপটেমিয়া উভয় সভ্যতায় রাজা ও ধনীদের বাড়ীঘরগুলো নগরের নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত হত। তুলনামূলক কম ধনীদেরগুলো দূরে নগরের প্রান্তীয় এলাকায় অবস্থান করত। তাছাড়া ধাতুর তৈরী জিনিসপত্রও ধনীদের বাড়ীঘরগুলোতেই কেন্দ্রীভূত থাকত। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এইসব সভ্যতায় ক্ষমতা ও সম্পদ একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকত এবং সমাজে ব্যাপক অসাম্য ছিল।

মেসোপটেমীয় সভ্যতায় যে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপুল বৈষম্য ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার উর নগরে রাজকীয় কবরখানা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে :

--------------

বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : Susan Pollock, Ancient Mesopotamia, (Cambridge University Press, Cambridge, 1999), pp. 46-52.

দেখুন : C.C. Lamberg- Karlovsky and R. Wrigth, ‘The Tigris and Euphrates Valley (3000-1500 BC),’ in, History of Humanity: Scientifc and Cultural Development, (1996), vol. II, p. 174.

--------------------------------------------

পাতা: ২১

   রাজকীয় কবর

   ৫টি

     অত্যন্ত বড়, সম্পদে পূর্ণ, উৎসর্গীকৃত (নিহত) দাস-দাসীসহ

   ধনী, রাজকীয় নয়

   ২০টি

     পর্যাপ্ত ধাতুর জিনিসপত্র, মূল্যবান পাথর, অন্যান্য সম্পদ

   ধনী সাধারণ 

   ৪৩৫টি

     কিছু ধাতব জিনিসপত্র

   সাধারণ

   ৮২৫টি

     মৃৎপাত্র

পাঠক কল্পনা করুন রাজকীয় কবরখানায় ‘সাধারণ’ স্তরের মানুষের কবরে যদি শুধুমাত্র মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, তাহলে যারা একেবারে দরিদ্র এবং যাদের কবর দেবার সুযোগ রাজকীয় কবরখানায় হত না তাদের কী অবস্থা হতে পারে!

সিন্ধু সভ্যতায় দেখা যায় বড় নগরগুলো কাছাকাছি আয়তনের। যেমন মহেঞ্জোদাড়ো (৮৩ হে:), গানেরিওয়ালা (৮১.৫ হে:), হরপ্পা (৭৬ হে:) ও রাখিগাড়ি (৮০ হে:)। হরপ্পান যুগে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিল থাকাতে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ মেলে। তার মানে প্রচলিত ধারণায় এখানে একটি রাজধানী থাকতে হবে যেখান থেকে সমগ্র অঞ্চল শাসন করা যায়। সম্প্রতি আবিষ্কৃত ক্যাম্বে উপসাগরে নিমজ্জিত নগর ছাড়া মহেঞ্জোদাড়ো সবচেয়ে বড় হলেও অন্য বড় নগরগুলো এর কাছাকাছি আয়তনের। সাধারণত দেখা যায় রাজধানী অন্যান্য নগরের চেয়ে অনেক বড় হয়। এক্ষেত্রেও সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিক্রম। মহেঞ্জোদাড়ো অথবা ক্যাম্বে নগর যেটাই রাজধানী হয়ে থাকুক কোনটাই সাধারণভাবে সাম্রাজ্যে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবনের প্রতি ইঙ্গিত করে না।

অথচ মিসরে ফারাও-এর অধীনে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র উদ্ভূত হতে দেখা যায়। একেবারে প্রথম থেকেই রাজা ও তার সভাসদদের কেন্দ্র করে রাজধানী থেকে এই শাসন ব্যবস্থা প্রদেশ ও গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। বিপুল সম্পদ রাজপ্রাসাদে কেন্দ্রীভূত হত। রাজধানী, ঘর-বাড়ী, জন-বসতি সবকিছুর বিন্যাসে ক্ষমতা ও সম্পদের চূড়ান্ত রকম অসম বন্টন প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

পাতা: ২২

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ