লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 4, 2023, 12:00 AM, Hits: 1308
(‘আলাপচারিতা’ নামের অধীনে ধারাবাহিকভাবে মূলত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমার বিভিন্ন ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে চেয়ে এই ধারাবাহিক রচনার প্রয়াস। বিশেষত আমার রাজনৈতিক জীবনের বৈচিত্র্যমণ্ডিত অভিজ্ঞতা ও সেগুলির ভিত্তিতে আমার ধারণাগত বা তত্ত্বগত মূল্যায়নকেও এই ধারাবাহিক রচনায় আনবার চেষ্টা করব। ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে টেনে আমার এই মূল্যায়ন সাধারণ পাঠকদের নিকট অধিকতর জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে বলে আমি ধারণা করি। তবে অভিন্ন নামের অধীনে লিখলেও প্রতিটি পর্বের রচনা হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ।)
(এক)
বিশ্বাসের বিচারে বিপ্লবী রাজনীতির পথে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল তখন যখন আমি ১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পাঠরত অবস্থায় যুক্তি-বুদ্ধি চর্চার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস হারাই। ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত হবার সাথে সাথে আমার চেতনায় দুইটি বিপ্লব ঘটে। প্রথমত, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কোনও নৈতিকতা আর থাকল না। সুতরাং ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন এবং বিশেষত বাঙ্গালী ও বাংলার বিভাজনকে আমার নিকট বিরাট ভুল এবং এমনকি ঐতিহাসিক পাপ বলে মনে হল। ফলে প্রথমে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে ধর্মমুক্ত তথা লোকবাদী বা লোকায়ত রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা দ্বারা বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার সামনে বাংলা ও বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণকে প্রধান ও প্রথম করণীয় হিসাবে দেখলাম। বৃহত্তর ভারতের স্থান হল এর পর।
দ্বিতীয়টি, ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত এবং মানুষের সমতার দর্শন বা রাজনীতি হিসাবে সে কালে ব্যাপকভাবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক বা কম্যুনিস্ট রাজনীতির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন। এখানে এ কথা বলা উচিত হবে যে, যতদিন পর্যন্ত আমি ধর্ম তথা ইসলাম-বিশ্বাসী ছিলাম ততদিন পর্যন্ত আমি একদিকে যেমন পাকিস্তান-সমর্থক ছিলাম অপর দিকে তেমন নিরীশ্বরবাদী দর্শন হিসাবে কম্যুনিজম বা সমাজতন্ত্র-বিরোধী ছিলাম। এভাবে ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি আমার চেতনায় প্রায় একই সাথে দুইটি বিরাট বিপ্লব ঘটালো। বস্তুত কিশোর বয়সেই ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি তথা লোকবাদী বা লোকায়ত চেতনায় উত্তরণ আমার জীবনের ভবিষ্যৎ গতিপথকে সম্পূর্ণ বদলে দিল। আমি বিপ্লবের পথানুসারী হলাম।
ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্তি আমার ভিতর যুক্তিবুদ্ধির যে উন্মেষ ঘটায় সেটা শুধু যুক্তিবুদ্ধির যান্ত্রিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আমাকে মানুষ ও মানবতার বিষয়সমূহ নিয়েও ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। বিশেষত মানবতার সমস্যাসমূহ নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি আমাদের সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনে বিশ্বাসী হয়ে উঠি। এই বিপ্লবী পরিবর্তনের প্রয়োজনবোধ থেকে আমি ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে আরও উৎসাহী হয়ে উঠি। কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসকে আমি বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থার স্থিতি বা অনড়তার মূলে ক্রিয়াশীল একটি প্রধান শক্তি হিসাবে দেখতে পাই। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক অধ্যয়ন এবং সেই সঙ্গে আমার নিজ সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে আমি ইসলামকেই সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম হিসাবে চিনতে পারি। অন্যান্য প্রধান ধর্মের বিপরীতে এটাকে এমন এক রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম হিসাবে দেখতে পাই যা মানবিকতার পথে মানুষের চেতনার উন্মেষকে সবচেয়ে প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত করে রাখে। বস্তুত কুরআন-হাদীসসহ ইসলামের মৌলিক গ্রন্থসমূহ ও ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন এবং সর্বোপরি বাস্তব সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে ইসলামকে আমি নারীত্ব ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং সর্বোপরি যুদ্ধাপরাধের ধর্ম হিসাবে চিনতে পারি।
সামাজিক পরিবর্তন তো পরের কথা। আগে মানুষের চেতনাকে মুক্ত করতে হয়। সেই চেতনার মুক্তির পথে যে ধর্ম সবচেয়ে বেশী বাধা অর্পণ করে রাখে তার বিরুদ্ধে লড়াইটাই যে সবচেয়ে বড় করণীয় সেই বোধ আমার ভিতরে ক্রমবর্ধিত হয়। এ দেশে সমাজ-বিপ্লবের সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনা করতে গিয়ে ক্রমশ আমি ধর্ম বিশেষত ইসলাম সংক্রান্ত আলোচনার গুরুত্বকে অনুধাবন করি। এটা আমার জন্য আরও স্বাভাবিক এই কারণে যে, আমি নিজে এসেছি মুসলিম সমাজ থেকে এবং আমি বাস করি তার আবেষ্টনে। ফলে এটাই আমার জন্য স্বাভাবিক যে, আমি ধর্ম হিসাবে ইসলামের উপর অনুসন্ধানকেই অগ্রাধিকার দিই। এটা মুসলিম সমাজ থেকে আসা মানুষ হিসাবে আমার নৈতিক দায়িত্বও বটে।*
------------------------------
* বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্ম প্রসঙ্গে আলোচনা করলেও ইসলাম সম্পর্কিত আমার কিছু বিশদ ও বিশ্লেষণমূলক আলোচনার জন্য উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল : ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’ (http://bangarashtra.net/article/852.html), ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’ (http://bangarashtra.net/article/1169.html), এবং ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’ (http://bangarashtra.net/article/1542.html)।
------------------------------
জীবনের যাত্রাপথে স্বাভাবিকভাবে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার চিন্তা-চেতনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন সমাজ-বিপ্লবের সঠিক পথ সন্ধানের প্রয়োজন থেকে ঘটেছে। ফলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিপ্লবের পথ হিসাবে মার্কসবাদকে প্রত্যাখ্যান করলেও বিপ্লবী রাজনীতিতে উত্তরাধিকার হিসাবে তার ভূমিকাকে অস্বীকার করি নাই। একইভাবে আজও আমি যেমন বিপ্লবের প্রয়োজনে ধর্মমুক্ত তথা লোকায়ত দর্শন-ভিত্তিক বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন বোধ করি তেমন আমি বৃহত্তর পরিসরে ভারতবর্ষব্যাপী লোকায়ত চেতনা-ভিত্তিক জন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনও অনুভব করি। এ দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে লোকায়ত দর্শন প্রতিষ্ঠাকে যেমন আমি অপরিহার্য মনে করি তেমন একটা পর্যায়ের জন্য হলেও সমাজতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রয়োগকে অপরিহার্য মনে করি।
একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে এইসব করণীয়ের কিছুই অর্জন হয় নাই। বর্তমান বাংলাদেশ-রাষ্ট্র কিংবা যুক্তবাংলা অথবা বৃহত্তর ভারতের এই সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবর্তন একটি বিপ্লবী রূপান্তরের বিষয় বলে আমি মনে করি। তবে আমি কোনও চিরন্তন সমাধান বা বিপ্লব বা সমাজের চিরস্থায়ী রূপ আছে বলে মনে করি না। জীবনের মতো সবই গতিশীল এবং ফলত পরিবর্তনশীল। তবে আজকের অগ্রহণযোগ্য সামগ্রিক ব্যবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে আমাদের একটা বিরাট সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিপ্লবের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। এই বিপ্লব যেমন ধর্মের অন্ধত্ব ও আধিপত্য থেকে সমাজকে মুক্ত করবে, অপরদিকে তেমন দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থেকেও সমাজকে মুক্ত করবে। এভাবে আমরা বিজ্ঞান মনস্ক, স্বাধীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র লাভ করব।
পশ্চিম ইউরাপ, রাশিয়া, চীন ইত্যাদি যেসব অঞ্চল বা দেশে সেখানকার বাস্তবতা অনুযায়ী যার যার মতো করে শিল্প বিপ্লব এবং গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে তাদের সবার অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য মূল্যবান হলেও, আমি মনে করি, আমাদের সমাজ ও ইতিহাসের ভিন্নতার কারণে আমাদের বিপ্লব হবে অন্য সবার থেকে অনেক ভিন্ন। সুতরাং কারও থেকে নকল করা বিদ্যায় আমি বিশ্বাসী নই।
মোটা দাগে ধরলে আমার রাজনৈতিক জীবনের দুইটি পর্ব আছে। একটি পাকিস্তান কালের পর্ব, অপরটি বাংলাদেশ কালের পর্ব। পাকিস্তান কালে আমার রাজনৈতিক যাত্রাপথ ছিল কিছু সমালোচনা ও সংশয়মূলক হলেও মূলত মার্কসবাদী দর্শন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবে আমি যখন অন্তত দশম শ্রেণীর ছাত্র (১৯৫৯ সাল) সেই সময় থেকে সর্বদা আমার ভিতরে ছিল আমাদের সমাজের বাস্তবতায় মার্কসবাদ সম্পর্কে কিছু সংশয় এবং সেই সঙ্গে মার্কসবাদের কিছু দার্শনিক সীমাবদ্ধতা ও ভুল সম্পর্কে আমার নিজস্ব উপলব্ধি। তবে সে কালে পাকিস্তানকে উচ্ছেদ করে পূর্ব বাংলার বুকে একটি লোকবাদী বা লোকায়ত তথা ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তীব্র তাড়না থেকে আমি যেমন একটি বিপ্লবী আদর্শভিত্তিক আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভব করতাম তেমন এই আদর্শের প্রায়োগিক দর্শন হিসাবে মার্কসবাদ এবং বিপ্লবী আন্দোলন হিসাবে কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে দেখতে পেতাম। আমি নিষ্কর্মা কিংবা বাস্তবতাবর্জিত ও পুঁথিসর্বস্ব বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকতে চাই নাই। ফলে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলাম। ভাবতাম বাস্তব সংগ্রামের ভিতর থেকে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর ও এ দেশের বিপ্লবের সঠিক পথও খুঁজে পাব।
বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আমার জীবনের যে নবতর পর্ব শুরু হয় তার সূচনাতেই ঘটে কম্যুনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ। সেই সময় আমি পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির সঙ্গে যু্ক্ত ছিলাম। এর সমাপ্তি ঘটে ১৯৭২-এর মার্চ-এপ্রিলের দিকে। আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আমার নিকট বিপ্লবী রাজনীতি হিসাবে কম্যুনিস্ট রাজনীতির প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হল এ দেশের প্রেক্ষিতে তার যে ইতিবাচক বিপ্লবী ভূমিকা ছিল একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ধ্বংস ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেটা শেষ হয়েছে। আমার নিকট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে একটা অসমাপ্ত বিপ্লবের প্রথম পর্যায় বলে মনে হল। সুতরাং এই অসমাপ্ত বিপ্লবকে কীভাবে সমাপ্ত করা যাবে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজাটাই আমার সামনে সবচেয়ে বড় করণীয় মনে হল।*
-----------------------------
* আমাদের সমাজের বাস্তবতায় বিপ্লবের পথ অনুসন্ধান এবং মার্কসবাদ ও কম্যুনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে আমার সমালোচনামূলক আলোচনার জন্য বিভিন্ন রচনার মধ্যে ডঃ লেনিন আজাদের সঙ্গে পত্রালাপে মার্কসবাদের উপর আমার সমালোচনামূলক মূল্যায়নের জন্য দেখা যেতে পারে : মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক : ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিকের পত্রালাপ — http://bangarashtra.net/article/413.html. এছাড়া বিশেষভাবে উল্লেখ্য ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ (http://bangarashtra.net/article/922.html) এবং ‘মার্কসবাদের সংকট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’ (http://bangarashtra.net/article/395.html)
-----------------------------
কম্যুনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগের পর প্রকাশ্য সংগঠন হিসাবে ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপে সক্রিয় হবার চেষ্টা করি। কিন্তু এ দেশে আওয়ামী লীগের নিকট কম্যুনিস্ট আন্দোলনের বিরাট বিপর্যয় ঘটে যাবার পর এবং আমার নিজেরও কম্যুনিস্ট রাজনীতির প্রতি অনাস্থা জাগবার পর আমার আর রাজনীতিতে সেভাবে সক্রিয় হবার মতো মন ছিল না। আমি চেয়েছিলাম আমাদের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে এবং এ সমাজ সম্পর্কে আরও ধারণা সংগ্রহের মাধ্যমে বিপ্লবের সঠিক পথ সন্ধান করতে। এতদসত্ত্বেও হয়ত আমি গণ-সংগঠন হিসাবে ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারতাম। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ভাসানী ধর্মসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করলে ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবার আগ্রহও হারাই। ভাসানীর মৃত্যুর পর এক সময় কয়েক মাসের জন্য ন্যাপে পুনরায় সক্রিয় হলেও ন্যাপের তৎকালীন নেতৃত্ব জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিলে তার বিরোধিতা ক’রে ন্যাপ থেকেও সরে যাই এবং এরপর থেকে রাজনীতিতে যে ভূমিকাই রাখবার চেষ্টা করি সেটা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত ভূমিকা হয়ে থেকেছে। সংগঠন নিয়ে আর দাঁড়াতে পারি নাই। শেষাবধি সেই চেষ্টা বাদ দিয়ে প্রধানত লেখার দিকে মনোযোগ দিই। বিশেষত আশির দশকের শেষ দিক থেকে আমি এ দিকে মনোনিবেশ করি। এ ছাড়া পাশে থাকে জীবন ও জীবিকার জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, সেই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
আমার জীবন অনেকটা নূতন মোড় নেয় ২০০২ সালে প্রকাশনী সংস্থা হিসাবে ব-দ্বীপ প্রকাশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ২০০৬ সালে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ প্রকাশ আমার আর এক উল্লেখ্য অগ্রযাত্রা।
জীবনের এই দীর্ঘ যাত্রা সংক্রান্ত জটিল আলোচনা এখন নাই বা করলাম। তবে এটা ঠিক যে, মাঝে মাঝে বাংলাদেশ সম্পর্কে হতাশ হয়েছি। তখন এ বঙ্গে আমাদের মনোভূমি নির্মাণে এক সময় এক অর্থে যাদের ভূমিকা সর্বাধিক ছিল সেই লেখক, গবেষক, রাজনীতিকদের কেন্দ্রভূমি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গে গিয়েছি নূতন দিশা অথবা প্রেরণা পেতে। ১৯৭১ সালের পর ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত চারবার সেখানে যাই।
(দুই)
পশ্চিম বঙ্গে আমার শেষবার যাওয়া ২০০৪ সালে। তারপর আর যাওয়া হয় নাই। আসলে যাওয়ার আগ্রহই আর হয় নাই। আমার প্রতিটি ভ্রমণে পশ্চিম বঙ্গকে এমন মানুষদের সমাজ মনে হয়েছিল যাদের প্রবল জিজ্ঞাসা নাই, বৃহৎ স্বপ্ন নাই, আবেগ-উচ্ছ্বাসও নাই। যখন পশ্চিম বঙ্গে যেতাম তখন প্রথমে মনে হত যেন আমি নরক থেকে ভদ্র, সৌম্য, নম্র ও সভ্য মানুষদের স্বর্গে প্রবেশ করেছি। কিন্তু আমার ঐ অনুভূতি হত খৃব স্বল্পকাল স্থায়ী। ২/৪ দিন থাকবার পর আমার মনে হত মানুষ এত স্তিমিত ও নির্জীব হয় কী করে? কিছুদিন থাকবার পর যখন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতাম তখন মনে হত আমি জীবন্মৃত মানুষদের জনপদ থেকে যত বর্বর হোক প্রাণবন্ত ও আবেগ-উচ্ছ্বাসপূর্ণ মানুষদের জনপদে প্রবেশ করেছি।
আমি যেতাম মত বিনিময় করতে। প্রয়োজনে প্রবল উদ্যমে বিতর্কও করতে, যেটা এ বঙ্গে আমাকে অনেক সময়ই করতে হয়েছে। অথচ স্তিমিত মানুষে পরিপূর্ণ জনপদ হিসাবে দেখতে পেতাম পশ্চিম বঙ্গকে। আসলে পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশে আমাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে প্রচণ্ড লড়াই করে। সরকার, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, ইতিহাস, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আমার মতামত আমার প্রচুর বৈরী শক্তিকে যেমন তৈরী করেছে তেমন আমাকে তাদের আক্রমণ ও আঘাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রবল লড়াই করতে হয়েছে এবং নানান কৌশল ও পদ্ধতিও উদ্ভাবন করতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এ বঙ্গ বা বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রশ্নে আমি যেটুকু উৎসাহপূর্ণ সমর্থন কিংবা সাড়া পেয়েছিলাম তার প্রায় কিছুই পশ্চিম বঙ্গে পাই নাই। আমি বুঝি যে, এ দেশে বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা চেনা-অচেনা বহু মানুষের কোনও না কোনও ধরনের সমর্থন বা আনুকূল্য ছাড়া আমি এই রকম এক পশ্চাৎপদ ও বর্বরতাপূর্ণ সমাজে এতকাল এভাবে টিকে থাকতে ও এতকিছু করতে পারতাম না।
যে কথা একটু আগেই বলেছি এই অবস্থায় আমি ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ চালু করি ২০০২ সালে এবং ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ চালু করি ২০০৬ সালে। আমার ইসলামের সমালোচনার জন্য চিহ্নিত ইসলামী জঙ্গীরা কিন্তু আমাকে আঘাত করে নাই। বাংলাদেশে যখন ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সময়ে মুক্তচিন্তক লেখক, ব্লগার, প্রকাশকদের উপরে জিহাদীদের হত্যা ও আক্রমণের ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল (মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের গোপন পৃষ্ঠপোষকতায়?) তখন আমি যেমন ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ চালু রেখেছিলাম তেমন নিজেও সেখানে বসতাম। হ্যাঁ, আমার ও প্রকাশনের উপর ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীতে আঘাত এসেছিল; তবে সেটা আওয়ামী লীগের নিকট থেকে এবং আমার প্রকাশনী সংস্থা কর্তৃক ‘ইসলাম বিতর্ক’ প্রকাশ দ্বারা ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ তুলে। সুতরাং আমার নিকট প্রমাণিত জিহাদী ও ইসলামী জঙ্গী শক্তি আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কে? শুধু ‘ইসলাম বিতর্ক’ নিষিদ্ধ করারও একটা যুক্তি থাকতে পারত। কিন্তু ইসলামের উপর দেশ-বিদেশের পণ্ডিতবর্গের লিখা বিভিন্ন ইংরাজী প্রবন্ধের একটা অনুবাদ সংকলন প্রকাশের জন্য ছাপাখানার মালিকসহ আমাদের দুই ভাইকে জেল খাটানো (গবেষক ও লেখক আমার ছোটভাই শামসুল আলম চঞ্চল ছিল বইটির প্রকাশ কিংবা প্রকাশনী সংস্থা ব-দ্বীপ প্রকাশনের সাথে সম্পর্কহীন), আমার বাসগৃহ ও প্রকাশনের কার্যালয়ে ব্যাপক লুটতরাজ চালানো, এবং সর্বোপরি ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ কার্যালয় সিলগালা করে প্রকাশন বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে লীগ সরকার আমাকেসহ বাংলাদেশের সকল মুক্তচিন্তককে কী বার্তা দিয়েছে? আমার সন্দেহ, আমাদের উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ ও গ্রেফতারের আগে রাস্তায় ও প্রচারমাধ্যমে ‘ইসলাম বিতর্ক’-এর বিরুদ্ধে যে কিছু আন্দোলন ও প্রচার হয়েছিল সেসবেরই পিছনে সরকারী উস্কানি ও ইন্ধন মূল ভূমিকা রেখেছিল। অর্থাৎ অনুমান করি সবটাই ছিল লীগ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠিত। শুধু তাই নয়, এ দেশে যত জিহাদী হামলা ও হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার বেশীর ভাগের পিছনেই লীগ সরকারের হাত ছিল কিনা সেই প্রশ্ন আমার মনে রয়েছে। আসলে রাষ্ট্র কীভাবে এসব হামলা ও সহিংসতার পিছনে কাজ করে সে সম্পর্কে জানবার সুযোগ আমার অনেকভাবে হয়েছে। আমাদের দেশে ধর্মীয় রাজনীতি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা হামলার পিছনে সরকার, রাষ্ট্র ও প্রশাসন কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে আমার মোটামুটি ভালোই ধারণা আছে।
(তিন)
১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসে যখন আইয়ুব সরকারের ইন্ধনে কাশ্মীরে ‘হযরত বালের’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ভয়ঙ্কর হামলা হচ্ছিল সেই সময় আমি দেখেছি রাষ্ট্র তথা প্রশাসন যন্ত্র এবং সংগঠিত জনশক্তি এ ধরনের হামলা সংগঠন অথবা দমনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ (অনার্স)-এর ছাত্র। বিশেষ করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রবল সাহসী ভূমিকার কারণে ঢাকায় হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা কীভাবে বন্ধ হয়েছিল সেটা আমি দেখেছি। আমি নিজেও সাম্প্রদায়িক হামলা-বিরোধী মিছিলে থাকতাম। আমি দেখেছিলাম কীভাবে অস্ত্রধারী সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা আমাদের নিরস্ত্র মিছিলের স্লোগান শুনে হিন্দুদের বাড়ীঘর ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে যেত। মিছিল চলাকালীন অবস্থায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা সশস্ত্র মুসলিম গুণ্ডাদের হাত থেকে আহত ও রক্তাক্ত মানুষদের উদ্ধার করে নিকটবর্তী হাসপাতালে সেবার জন্য নিয়ে যেত। অস্ত্রধারী গুণ্ডাদের সাহস হত না আমাদের মোকাবিলায় দাঁড়ায়। নিরস্ত্র কিন্তু সংগঠিত জনশক্তিকেও তাদের এত ভয়! বিশেষত, এ ধরনের সংগঠিত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ তাদের কল্পনার বাইরে ছিল। তাছাড়া ছাত্র ও যুব শক্তিকে ভয় করার এমনিতেই কারণ ছিল।
ঢাকা মোটামুটি শান্ত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অল্প কিছুদিনের জন্য বন্ধ হলে আমি বরিশালে যাই। আমার পিতা তখন বরিশাল জেলার ডিএসপি বা ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিস। কোথায়ও যাতে হিন্দুদের উপর কোনও ধরনের হামলা না হয় সেইজন্য আমার পিতাকে দেখতাম কীভাবে দিনরাত জিপে করে টহল দিয়ে বেড়াতেন। বরিশালের পুলিশ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তারা জেলায় কোনও ধরনের হামলা হতে দিবে না। সেকালে অপরাধপ্রবণ হিসাবে কুখ্যাতি অর্জনকারী বরিশাল জেলার মতো একটা জেলা সম্পূর্ণরূপে হিন্দুদের উপর হামলামুক্ত ছিল। আমি তখন দেখেছি এবং বুঝেছি এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামার পিছনে রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে ভূমিকা পালন করে।
আর একটু বললে বুঝা যাবে রাষ্ট্রযন্ত্র বা পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে। তখনকার বৃহত্তর বরিশাল জেলার পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর জেলা খুলনায় মুসলিম লীগের কুখ্যাত মন্ত্রী খান এ, সবুরের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুদের উপর ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চলে। অথচ বরিশালের মতো ‘কুখ্যাত’ জেলা এত শান্ত! আইয়ুবের মুসলিম লীগ সরকারের এটা সহ্য হবে কেন? বরিশালে হিন্দুদের উপর হামলা করার জন্য খুলনা থেকে লঞ্চে প্রায় দেড়শ’ সশস্ত্র বিহারী গুণ্ডাকে পাঠানো হল। বরিশালের পুলিশ বাহিনী প্রস্তুত ছিল। লঞ্চঘাটে লঞ্চ ভিড়ার সাথে সাথে সবাইকে অস্ত্রসহ ধরে জেলে ঢুকানো হল। এর জন্য বরিশাল পুলিশ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয় নাই। বুঝা যায় আজকের তুলনায় তখনকার কালেও সরকার কিছু নিয়ম-নীত মেনে চলত। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, খুলনা জেলা সংলগ্ন তৎকালীন বৃহত্তর যশোর জেলাও ছিল সেখানকার জেলা প্রশাসনের সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে হিন্দুদের জন্য নিরুপদ্রব ও নিরাপদ। সেখানকার জেলা প্রশাসনের এই প্রশংসনীয় ও দৃঢ়চিত্ত ভূমিকা সম্পর্কে আমি সেই সময় কিছু কথা শুনেছিলাম। বিশেষত যশোরের তৎকালীন ডিসি বা জেলা প্রশাসকের বলিষ্ঠ ভূমিকা সম্পর্কে জেনেছিলাম।
পরবর্তী কালে যখন আমার অনেক বয়স ও অভিজ্ঞতা হয়েছিল তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরের বন্ধুদের কারও কারও কাছ থেকে শুনে বা জেনে বিভিন্ন হামলা ও ঘটনার পিছনে সরকার ও রাষ্ট্র কীভাবে কাজ করে সেসব সম্পর্কে এখন আমি অনেকটা সহজে ধারণা করতে পারি। আমার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা থেকে এখন আমি বলতে পারি বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন হয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই তিন দলই হিন্দুদের শত্রু হিসাবে ভূমিকা রাখলেও হিন্দুদের এবং সেই সঙ্গে মুক্তচিন্তকদের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বিপজ্জনক অথচ একই সাথে সবচেয়ে ধূর্ত শত্রু হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
যাইহোক, আমি যে কথা বলতে চাই সেটা হচ্ছে বাংলাদেশে আমি লড়াই করে আজ অবধি টিকে আছি। অনেকে নিহত হয়েছেন, কেউ কেউ বিদেশে পলাতক। তবু দেশে থেকে আজ অবধি কেউ কেউ লড়াই করছেন। তাদের সংখ্যা এখন খুব কম। তা হোক, তবু এত বৈরী পরিবেশেও কিছু সংখ্যক মানুষ দেশের ভিতরে থেকেও লড়াই জারী রেখেছেন। আর বিদেশে থেকে যারা যার যার মতো করে বুদ্ধিবৃত্তিক এই লড়াই চালাচ্ছেন তাদের সংখ্যাও যে বেশী তা নয়। তারাও সংখ্যাল্প। তবে পৃথিবীকে বদলায় এই অল্প সংখ্যক মানুষই। সংখ্যা আসে পরে, আগে নয়, আগে গুণ। একটা সমাজের ভিতরে আগে গুণগত মান গড়ে তুলতে হয়। তারপর আসে সেই সমাজের গুণগত রূপান্তরের প্রশ্ন।
(চার)
একটা সমাজের বর্তমানকে বুঝবার জন্য আমি বারবার তার অতীতের দিকে তাকাই। সেই অর্থে আমি অনেকাংশে ইতিহাসাশ্রয়ী। সেই অতীত বা ইতিহাসের দিকে যখন আমি তাকাই তখন মুসলিম অতীত নিয়ে যেমন গর্বের কারণ দেখি না তেমন বিশেষত বাংলার হিন্দুদের অতীত নিয়েও গর্বের তেমন কিছু দেখি না। ১২০৪ বা ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দের দিকে ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেন বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বাধীন ১৮ মুসলিম হানাদার অশ্বারোহীর রাজপ্রাসাদ আক্রমণের সংবাদ শুনেই বিনা যুদ্ধে খিড়কির দরজা দিয়ে প্রাসাদ ও রাজধানী নবদ্বীপ ছেড়ে নৌকাযোগে পালালেন। আমি সন্দেহ করি, সে সময়েও পলাশীর ষড়যন্ত্রের মতো প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল ছিল। তা না হলে ঘোড়ার ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে(!) আঠারো সশস্ত্র মুসলিম ঘোড়সওয়ার বিনাবাধায় রাজধানীতে ঢুকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত যেতে পারে? অনুমান করা চলে তাদের পিছনে ছিল হানাদার বৃহৎ মুসলিম বাহিনী। রাজা হয়ত বুঝেছিলেন রাজকীয় সেনা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সুতরাং অর্থহীন যুদ্ধ না করে পালিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, রাজা লক্ষ্মণ সেন ভীরু কোনও রাজা ছিলেন না। তখন বয়োবৃদ্ধ হলেও তিনি তার যৌবন কালে ছিলেন বহু যুদ্ধজয়ী বীর, যিনি তার পিতার সাম্রাজ্যকে আসাম থেকে উত্তর ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিলেন।
অবশ্য, চার শতাধিক বছর কালস্থায়ী বৌদ্ধ পালযুগের (৭৫০-১১৬১ খ্রীষ্টাব্দ) পর বাংলার শৌর্যবীর্যের যুগ প্রকৃতপক্ষে শেষ হয়েছিল। পূর্ব বঙ্গের বিক্রমপুরে লক্ষ্মণসেনের পলায়ন ও সেখানে রাজধানী স্থানান্তরের পর ক্রমে প্রায় সমগ্র বঙ্গ বা বাংলা মুসলিম অধিকারে যায়। বিশেষ করে বাংলায় হিন্দুরা ছিল নির্বিবাদী। সুতরাং মুসলিমরা অতীব সংখ্যাল্প হওয়া সত্ত্বেও বহিরাগত মুসলিম শাসন উচ্ছেদে হিন্দুরা কোনও ভূমিকা রাখে নাই। অথচ মোগল শাসনের শেষ দিকে মহারাষ্ট্রে হিন্দুরা ও পাঞ্জাবে শিখরা বহিরাগত মুসলিম শাসন উচ্ছেদে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখল।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে যখন ইংরেজরা জয়ী হয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করল তখন সেই বিজয় ছিল বাংলার নওয়াবী রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু মুসলিম নেতৃত্ব ও বাংলার হিন্দুদের সংখ্যাগুরু নেতৃত্বের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের পরিণতি। আমি অনুমান করি যে, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে দেশজ জনগোষ্ঠী দ্বারা বহিরাগত মুসলিম শাসনের পতনদশা দেখে বাংলার বহিরাগত মুসলিম শাসক-চক্র বুঝতে পারছিল যে, দেশজ তথা হিন্দু জনগোষ্ঠীর হাতে তাদেরও পতন হতে দেরী হবে না। সুতরাং আর একদল বহিরাগতের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যে তারা শেষ রক্ষার কিছু সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। মীর জাফরের সঙ্গে তো নওয়াবী রাষ্ট্রের খুব বেশীর ভাগই চলে গিয়েছিল। সুতরাং চাইলে মীর জাফর নিজেই সিংহাসন দখল করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে ইংরেজদের সঙ্গে মিলে পলাশীর যুদ্ধের নাটক করলেন।
আমার কাছে বিষয়টা স্পষ্ট। রাষ্ট্র ক্ষমতার বিষয় সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা সহজেই বুঝবেন যে, পলাশীর নাটক করার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা বিদেশী ইংরেজদের নিকট হস্তান্তর করা। সুতরাং নওয়াবের পক্ষে থাকা ১৭ বা ১৮ হাজার সৈন্যের বিপরীতে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মীর জাফর যুদ্ধের তামাশা দেখলেন।
কত অযোগ্য এক রাষ্ট্র ও তার সেনাবাহিনী! নওয়াবের গোলাবারুদ বৃষ্টিতে ভিজে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। সময়টা ছিল ভরা বর্ষার। খ্রীষ্টীয় ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন; বাংলা সনের হিসাবে দিনটা ছিল সম্ভবত ৯ আষাঢ় কিংবা তার আশপাশে (বাংলা সাল সম্ভবত ১১৬৪)। অর্থাৎ ভরা বর্ষার দিন সেটা। নওয়াবের বাহিনীর বারুদ ছিল অরক্ষিত। কিন্তু ইংরেজ সৈন্যরা বিদেশী হলেও তারা তাদের গোলাবারুদ ত্রিপল জাতীয় ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। সুতরাং যুদ্ধ শুরুর আগেই যুদ্ধের ভাগ্য ঠিক হয়ে গিয়েছিল। একদিকে, নওয়াবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা, অপর দিকে, অকেজো কামান-বন্দুক ফেলে রেখে নওয়াব সেনার পক্ষে ঢাল-তলোয়ার দিয়ে তিন হাজারের সামান্য কিছু বেশী সৈন্য নিয়ে গঠিত হলেও কামান-বন্দুক সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে মোকাবিলার প্রশ্ন উঠে না। সুতরাং কামান-বন্দৃক সজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে অসম যুদ্ধে কিছু লোকক্ষয়ের পর সন্ধ্যা হতেই নওয়াব তার অনুগত সেনাবাহিনী নিয়ে পলাশীর রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালেন।
নওয়াবের যা খুশী তা হোক। ওটা আমাকে ভাবায় না সেভাবে। ওদের যাবার সময় হয়েছিল; তাই গেছে। কিন্তু দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী হিন্দুদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেল না কেন — সেটাই আমার প্রশ্ন। ব্রিটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের এক বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, নওয়াবী আমলের শেষ দিকে বাংলার জনসংখ্যা কম-বেশী তিন কোটি ছিল। তার হিসাব অনুযায়ী ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর বাংলায় ১৭৬৯-’৭০ খ্রীষ্টাব্দে যে মহাদুর্ভিক্ষ হয় (বাংলা সনের হিসাবে ১১৭৬-এর মন্বন্তর) সেই সময় বাংলার জনসংখ্যার ৩ কোটির মধ্যে ১ কোটি মৃত্যু বরণ করে। অর্থাৎ নওয়াবী আমলের শেষ পর্যায়ে বাংলার জনসংখ্যা ৩ কোটির মতোই ছিল।
আমার অনুমান, সে সময় দেশী-বহিরাগত মিলে বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ লক্ষের মতো ছিল। কল্পনাকে অতিরিক্ত বাড়িয়ে এই সংখ্যাকে খুব বেশী হলে ৩০ লক্ষ পর্যন্ত নেওয়া যেতে পারে। সেই সময়কার মুসলিম জনসংখ্যা সম্পর্কে কোনও জরীপের ফল আমাদের কাছে নাই। তবে আমরা এ প্রসঙ্গে ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়েরের সাহায্য নিতে পারি। তিনি সম্রাট আওরঙ্গযেবের সময় ভারতে ছিলেন। তিনি সে সময় বাংলাতেও এসেছিলেন। তিনি বলছেন, ‘হিন্দুস্থানের একশজন ভারতীয়ের মধ্যে একজন ‘‘মোগল’’ আছে কিনা সন্দেহ। শতকরা একজন মুসলমান আছে কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’ (দেখুন : বিনয় ঘোষ, বাদশাহী আমল, হিন্দুস্থান প্রসঙ্গে, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ, কলিকাতা – ৭, প্রথম সংস্করণ, ৭ চৈত্র ১৮৭৯ শকাব্দ, পৃষ্ঠা – ৮৭)।
মোগল পরিচয় প্রসঙ্গে বার্নিয়ের বলছেন, ‘এখানে ‘‘মোগল’ কথাটা অবশ্য একটা বিশষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে কোন বিদেশী মুসলমানধর্মী ব্যক্তি শ্বেতাঙ্গ হলেই ‘‘মোগল’’ বলে পরিচিত হন। আসল “মোগল’’ কিন্তু ‘‘মোগল’’ বলে যাঁরা পরিচিত তাঁদের মধ্যে খুব অল্পই আছে।’ (ঐ, পৃ - ৮৭)
তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী বার্নিয়েরের এই হিসাবকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তিনি বাংলাসহ ভারতের বহু অঞ্চল ঘুরেছেন। সেই সঙ্গে খ্যাতিমান চিকিৎসক হবার সুবাদে তার ছিল রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে প্রবেশাধিকার। ফলে ভারতের সামগ্রিক ধর্মীয় জনসংখ্যার বিন্যাস সম্পর্কে তার ধারণা বা মূল্যায়নকে আমরা গুরুত্ব দিতে পারি। এখন তিনি ভারতের জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা সর্বোচ্চ এক শতাংশ দেখতে পাচ্ছেন। বাংলায় এই সংখ্যা সর্বোচ্চ কত হতে পারে? চার বা পাঁচ শতাংশ? বাংলার সভ্যতা বহির্ভূত চরাঞ্চলের মানুষরাই প্রধানত বিজয়ী শাসকদের ধর্ম হিসাবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েছিল বলে আমি ধারণা করি। এদের সংখ্যাও তেমন বেশী ছিল না। অনুমান করি তৎকালে বাংলায় তিন কোটি মানুষের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা খুব বেশী হলে কুড়ি লক্ষ থেকে ত্রিশ লক্ষের মধ্যে হবে। ত্রিশ লক্ষও অতিরিক্ত হিসাব হয়। তবু সেটাই না হয় আপাতত ধরা গেল। তাহলে বাকী দুই কোটি সত্তর লক্ষ প্রধানত হিন্দু এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষ। অর্থাৎ বাংলার জনসংখ্যার দশ শতাংশ মুসলিম ধরলে এই সংখ্যা দাঁড়াবে।
বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাগুলির বিপরীতে আমি আমার বিভিন্ন লেখায় বিশদ না হলেও কিছু আলোচনা করেছি। যেমন, ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’ (http://bangarashtra.net/article/414.html)। অবশ্য ভবিষ্যতে এ সম্পর্কে আরও আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করি। তবে এখানে এটুকু বলি যে, ব্রিটিশ শাসন-পূর্বকালে মুসলিম সংখ্যা ছিল খুব সামান্য। সাধারণত সভ্য সমাজের বাইরে থাকা চরে চরে ভাসমান বা চলমান ও নদীভাঙ্গা মানুষদের প্রধান অংশ বিজয়ী ও শক্তিমানের ধর্ম হিসাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। এবং এরাও প্রকৃতপক্ষে ছিল আধামুসলিম ও আধাহিন্দু, যারা এক আল্লাহ্য় বিশ্বাসের পাশে মনসা, চণ্ডী, শীতলা, শিব, কালী ইত্যাদি বিভিন্ন লোকজ দেব-দেবীতেও বিশ্বাস রাখত ও তাদের পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিত। প্রাচীন দলিলাদি থেকে জানা যায় যে, মুসলিম শাসনামলে এই অর্ধমুসলিমদেরকে বহিরাগত শাসক শ্রেণীর মুসলিম তথা আশরাফ শ্রেণীর মুসলিমরা মুসলিম বলে মনে করত না। বস্তুত ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই অর্ধমুসলিমদের খাঁটি মুসলিম করার দিকে বহিরাগত মুসলিমরা দৃষ্টি দেয়। এই লক্ষ্যে তারা বাংলায় ওয়াহাবী, ফরায়েজী ইত্যাদি ধর্মীয় আন্দোলন সংগঠিত করে। এটা ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সামাজিক সমর্থন-ভিত্তিকে সংহত ও দৃঢ় করার প্রয়োজন সম্ভূত। এই সব সংস্কারমূলক সামাজিক আন্দোলনের পরিণতিতে বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলায় মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলন মাথা তুলল। অবশেষে তার পরিণতি হল ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। এভাবে বাঙ্গালী মুসলিমরা অবিভক্ত ভারতকে বিভক্ত করার প্রধান শক্তিতে পরিণত হল। নেতৃত্ব যেখান থেকে আসুক জনগোষ্ঠী হিসাবে এরাই ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের নির্ধারক শক্তি।
ব্রিটিশ আমলে ১৮৭২ সালে প্রথম যে লোকগণনা হয় তা থেকে আমরা জানি যে, তখনও বাংলায় মুসলিম সংখ্যালঘু। তবে ১৮৮১ ও তার পরবর্তী লোকগণনা থেকে এই চিত্র বদলে যেতে থাকে। এ নিয়ে এখানে আমি বেশী আলোচনা না করে নওয়াবী আমলে বাংলার মুসলিম জনসংখ্যা যে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ লক্ষের মধ্যে ছিল সেটা ধরে নিয়েই আপাতত আলোচনা করি। এদের বেশীর ভাগই ছিল আবার চর বা নদীর তীরবর্তী ভাঙ্গনপ্রবণ অঞ্চলগুলির বাসিন্দা। আর এ কথা সবার জানা যে, সে কালে নদীবিধৌত বাংলার বৃহত্তর ভূভাগই ছিল নদীর অবিরাম গতিপরিবর্তনের ফলে ও পলিসঞ্চয়ের মাধ্যমে নূতন নূতন ভূমি গঠনের কারণে অতিমাত্রায় অস্থিতিশীল। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, এই অস্থির-অনিশ্চিত চরভূমির অস্থিতিশীল বাসিন্দারাই প্রধানত ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েছিল।
মুসলিম শাসনকালে সভ্যতা বহির্ভূত এই ‘চইরা’ মানুষদের রাষ্ট্র দূরের কথা সভ্য সমাজেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবার কারণ ছিল না। যে মুসলিমরা ভূমিকা রাখত তারা ছিল অতীব সংখ্যাল্প বহিরাগত কিংবা তাদের বংশধর। এই বংশধরদের বেশীর ভাগই আবার ইসলামে ধর্মান্তরিত হিন্দু নারীদের গর্ভজাত। সব মিলিয়ে বহিরাগত ও তাদের বংশধর মুসলিমরা হয়ত সমগ্র জনসংখ্যার এক শতাংশও ছিল না। বাংলার আর্দ্র জলবায়ু ও জলাজঙ্গলময় ভূমির কারণে পশ্চিমের শুষ্ক অঞ্চল থেকে আসা মুসলিমদের মধ্যে মৃত্যুহারও ছিল খুব বেশী। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? বাংলার শিল্প-বাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রায় পুরাটাই হিন্দুদের হাতে। মনে রাখতে হবে নওয়াবের টাকশাল ছিল জগৎ শেঠের অধীনে। তখন রাজস্ব বিভাগ ছিল প্রায় সম্পূর্ণরূপে হিন্দুদের হাতে। রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব যে জমিদারদের হাতে ছিল তারাও প্রায় সকলে ছিল হিন্দু। তাহলে রাষ্ট্রের বাকী রইল কী? বিচার বিভাগটা ছিল মুসলিম প্রাধান্য বিশিষ্ট। সেই বিচার বিভাগও ছিল প্রধানত নগরে, বিশেষত উপর তলায় সীমাবদ্ধ। সমগ্র সমাজ পরিচালিত হত পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার অধীনে। ফলে গুরুতর ঘটনা ছাড়া বিচার লাভের জন্য সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রের আশ্রয় চাওয়ার কোনও কারণ ছিল না।
পঞ্চায়েতের পাশাপাশি অবশ্য বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে স্থানীয় জমিদাররাও রাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা রাখত। বিশেষত নিরাপত্তা ও পথঘাটের উন্নয়ন ইত্যাদির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পাশে জমিদারদেরও ভূমিকা থাকত। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে ব্রিটিশপূর্ব কালে জমিদাররা জমির মালিক হত না। তাদের মূল কাজ ছিল খাজনা আদায় করা এবং প্রয়োজনে অবকাঠামো ও শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিভিন্ন কাজে রাষ্ট্রের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা রাখা। মোগল বা নওয়াবী শাসনকালে জমিদাররা রাষ্ট্র ও প্রজাসাধারণের মধ্যে হত এক ধরনের সেতুবন্ধনকারী কিংবা মধ্যবর্তী ভূমিকা পালনকারী। একই জমিদারিতে বংশপরম্পরায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় জমিদাররা জমির মালিক না হলেও স্থানীয় জনগণের স্বার্থ ও আকাঙ্ক্ষাকে রাষ্ট্রের নিকট তুলে ধরতে পারত। তবে মনে রাখতে হবে সমগ্র সমাজ ক্রিয়াশীল ছিল মূলত পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থার ভিত্তিতে, যাকে অগ্রাহ্য করে চলবার ক্ষমতা স্থানীয় জমিদার কিংবা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র কারোরই শেষ পর্যন্ত হত না। কারণ শুধু স্থানীয় শান্তি-শৃঙ্খলা ও যোগাযোগ নয়, উপরন্তু সমগ্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও পঞ্চায়েতের ভূমিকা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাকী রইল সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসাবে এই সেনা ছিল বহিরাগত মুসলিম প্রাধান্যবিশিষ্ট। প্রধানত পশ্চিম থেকে আসা মুসলিমরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিত। এ দেশ দখল ও শাসনের প্রধান শক্তি হিসাবে সেনাবাহিনী ছিল বহিরাগত মুসলিমদের মনোযোগের প্রধান ক্ষেত্র। তবে বাংলাতেও কিছু হিন্দু যে সেনাবাহিনীতে যোগ দিত তার প্রমাণ হচ্ছে পলাশীর যুদ্ধে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে থাকা সেনাপতি মোহনলাল।
যাইহোক, সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে, নওয়াবী রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে শুধু হিন্দু ও অমুসলিম ছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতেও তাদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কী করছিল? পাঞ্জাবে শিখ উত্থানের ফলে বহিরাগত মুসলিম আগমনের পথ এমনিতেই কাটা পড়ছিল। আমার অনুমান মহারাষ্ট্রে মারাঠা উত্থানকেও শক্তি যুগিয়েছে এই ঘটনা। বহিরাগত মুসলিম হানাদারদের বিরুদ্ধে পাঞ্জাব-হরিয়ানা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে শিখ উত্থান ভারতের জন্য অপরিমেয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ভারতে মুসলিম আগ্রাসন ও শাসনের কাল শেষ হয়ে আসছে। নবযুগের অভ্যুদয়ের সমস্ত লক্ষণ স্পষ্ট।
এই রকম যুগ সংক্রান্তির কালে বাঙ্গালী হিন্দুরা কী করেছে? এরা কতখানি দাসত্বপরায়ণ যে, তারা নিজেরা ইতিহাসের নায়ক না হয়ে মীর জাফরের সঙ্গে হাত মিলালো আর একদল বিদেশীর কাছে রাষ্ট্রশাসনভার তুলে দিতে! প্রতিটি কর্মের ফল থাকে। ভুল বা অপকর্ম যা-ই বলা যাক, তার মাশুল বাঙ্গালী হিন্দুকে দিতে হয়েছে প্রধানত জন্মহার দ্বারা বাংলায় সংখ্যাগুরুতে পরিণত মুসলিমদের ভূমিকার ফলে ১৯৪৭-এ বাংলা ও ভারত ভাগ দ্বারা। দেশভাগের পরিণতিতে গণহত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রায় হিন্দুশূন্য ও সেই সাথে শিখশূন্য করা হল। পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার হিন্দুদের ভাগ্যও ভালো হল না। আজকের বাংলাদেশ-রাষ্ট্রে হিন্দুদের দুর্গতি তো আমাদেরকে আজ অবধি দেখতে হচ্ছে।
এই দুর্ভাগ্যের জন্য নওয়াবী শাসনকালের বাঙ্গালী হিন্দু নেতৃত্বকে সর্বাধিক পরিমাণে দায়ী না করে আর কাকে দায়ী করব? বাস্তবতার বিচারেও লগ্ন বলে একটা কথা আছে, যেটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইতিহাসে এমন লগ্ন বারবার আসে না। সেই লগ্ন তারা হেলায় হাতছাড়া করেছিল ১৭৫৭ পূর্ববর্তী কালে। তারা মীর জাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর একদল বহিরাগতের চাকর-বাকর হয়ে থাকতে চাইল। আসলে চেতনার বিচারে খুব বেশী সংখ্যক হিন্দু বাঙ্গালীই আপাদ-মস্তক চাকর-বাকর। সুতরাং হঠাৎ আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু সম্ভাবনার আলো জ্বাললেও রহস্যজনক ও অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই আলো নিভে যেতে সময় লাগল না। তবু ব্রিটিশ কালে হিন্দু বাঙ্গালী কিছু গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল। এপার বাংলায় তার আলোয় পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমাদের প্রজন্ম আলোকিত হয়েছিল। অন্তত আমার কথাটা বলতে পারি। আর আমি তো শুধু ব্যক্তি নই। আমি এক অর্থে একটা প্রজন্মেরও প্রতিনিধি। অন্যদিকে, সেই প্রজন্ম নির্মাণে যারা কম-বেশী ভূমিকা রেখেছিল আমি তাদেরই একজন।
বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কালে কত প্রত্যাশা নিয়ে কয়েকবার ছুটে গেছি পশ্চিম বঙ্গে। এবং নিদারুণভাবে হতাশ হয়েছি। বারবার গিয়েছি প্রজ্বলিত অগ্নির আশায়। গিয়ে দেখেছি পড়ে আছে শুধু ছাইয়ের স্তূপ। যাদের জিজ্ঞাসা নাই, নূতন চিন্তা নাই, বরং নূতন যে কোনও চিন্তার প্রতি যাদের ভয় ও বিদ্বেষ তাদের দিয়ে পূর্ণ এক জনপদ থেকে তিক্ত মন নিয়ে ফিরে এসেছি। আসলে সেই অর্থে পশ্চিম বঙ্গ থেকে আমার প্রত্যাশা অন্তত এখন পর্যন্ত অল্পই। হিন্দু বাঙ্গালীর যেটুকু শক্তি-সামর্থ্য অবশিষ্ট ছিল সেটুকু শেষ হয়েছে ১৯৪৭-এর দেশভাগের ধাক্কায়। ব্রিটিশ আমলের হিন্দু বাঙ্গালীর নবজাগৃতি যে কতটা ঠুনকো ও ফাঁপা ছিল তা এ থেকে বুঝা যায়। তথাকথিত নবজাগৃতির এই অন্তঃসারশূন্যতা বিনয় ঘোষ সঠিকভাবেই ধরেছিলেন। ‘‘বাংলার নবজাগৃতি” একটি অতিকথা’য় তিনি এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। (‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর ‘আহরণ’ বিভাগে উপরোক্ত শিরোনামে লেখাটির একটি পুনঃপ্রকাশ আছে। http://bangarashtra.net/article/419.html)
(পাঁচ)
সাধারণ হিন্দু বাঙ্গালীর বুদ্ধিবৃত্তি কিংবা মেধার মান যে কতটা নীচু সেটা আমি বুঝতে পারি যখন তারা পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্পর্কে আওয়ামী লীগীয় হাস্যকর ব্যাখ্যাকে মেনে নিয়ে শেখ মুজিবকে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা হিসাবে প্রায় পূজা করে। অবশ্যই মুজিবের ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেটা ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত। এবং সে ক্ষেত্র্রেও প্রশ্ন করা উচিত নয় কি ১৯৫৬-’৫৭ সালে প্রধান মন্ত্রী হিসাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগ কেন একুশ দফার স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির প্রতি তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল? এটা কি নীতি ও কর্মসূচীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? এই বিশ্বাসঘাতকতায় সোহরাওয়ার্দীকে দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে শেখ মুজিবও কি এই বিশ্বাসভঙ্গের অংশীদার হন না? আর একবারের বিশ্বাস বা অঙ্গীকার ভঙ্গকারী কি একই কাজ সুযোগ পেলে বারবার করতে পারে না? নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে ও এই বিশ্বাসভঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলেন।
ঠিক আছে, ছয় দফা কর্মসূচীর জন্য মুজিবকে না হয় কৃতিত্ব দেওয়া গেল! ঐ সময় অমন একটা কর্মসূচীর খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ছয় দফার স্বায়ত্তশাসন, আর একটা জাতির স্বাধীনতা কি এক কথা? তার উপর স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ! মুজিব স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন!! এ নিয়ে এখন আমি কথা বলব না। ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’(http://bangarashtra.net/article/922.html) সহ আমার অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। আসলে ষাটের দশকে স্বাধীনতা ও তার যুদ্ধের রাজনীতি মূলত সেই দশকের বামপন্থী তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলেছিল। ভারত, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-এর ঢক্কানিনাদে সেই সত্য চাপা পড়ে গেছে। ঐ প্রজন্মের ফসল ভারত, লীগ, বিএনপি ইত্যাদি শক্তি যার যার মতো করে দখল করেছে। নেতৃত্বহীন প্রজন্মের জন্য এই পরিণতি বরণ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আমি মনে করি পাকিস্তান কালে বিশেষ করে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার যে রাজনীতি গড়ে তুলেছিল সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে মূলত ভারত ও পাকিস্তান যার যার মতো করে রাজনৈতিক খেলা খেলেছিল। ভারত সঙ্গত কারণে পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে চেয়েছিল। ১৯৭০-এ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পর পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীও আর চায় নাই পাকিস্তান থাকুক। ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ সেই নির্বাচন বর্জন করায় নির্বাচনে লীগের এমন বিজয় ছিল অনিবার্য। যাইহোক, একদিকে স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের প্রবল উত্থান, এবং অপর দিকে, লীগের এমন বিজয়ের পর অখণ্ড পাকিস্তান রাখবার কোনও বাস্তবতাই আর ছিল না। তখন পশ্চিম পাকিস্তানীদের এবং বিশেষত পাঞ্জাবীদের প্রাধান্যবিশিষ্ট শাসক শ্রেণীর প্রয়োজন হল পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে ফেলা। কিন্তু আলাদা করতে চাইলেই তো করা যায় না। সুতরাং তাদের প্রয়োজন হয়েছিল একটা গণহত্যা পরিচালনার, যাতে করে পাকিস্তানপন্থী মুসলিম বাঙ্গালীরাও বাধ্য হয় অস্ত্র ধরতে এবং বিচ্ছিন্নতা তথা স্বাধীনতা চাইতে। তাহলে যেভাবেই হোক তাদের জন্য দায় হয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে দেওয়া যেত। কিন্তু সব তো আর হিসাব অনুযায়ী সর্বদা ঘটে না। পাকিস্তান রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসাবে মুজিব ঘরে বসে থেকে পাক-বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল। পাকিস্তানী সেনা আক্রমণের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূ্র্তভাবে যুদ্ধ শুরু হল, যাতে বামপন্থীরা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মুজিব বাদে লীগ নেতৃত্ব পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিল। এভাবে যুদ্ধে ভারত ঢুকে পড়ল। শেষ পর্যন্ত বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধে পরিণত হল এবং তাতে পাকিস্তানের পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল।
এটা বাঙ্গালী জাতির দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এ ভারতের কংগ্রেস সরকারের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন হল। ঘটনার এমন পরিণতির জন্য কি বামপন্থী বিশেষত কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের দায় ছিল না? এ দেশে কম্যুনিস্টরা যখন থেকে মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থীদের মধ্যে বিভক্ত হয়েছিল তখন থেকে মস্কোপন্থী হওয়া কম্যুনিস্টদেরকে আমি আর বিপ্লবী হিসাবে গণ্য করি না। তারা তখন থেকে বিপ্লব চিন্তা বাদ দিয়ে সংস্কারের মধ্য দিয়ে যতটুকু অর্জন করা যায় সেই মতবাদে বিশ্বাসী এবং আমাদের দেশের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের অনুসারী হল। ষাটের দশকে যারা চীনপন্থী হল তারা সবাই বিপ্লবপন্থী হলেও তাদের মধ্যেও বহু ভাগ। এখন সেসবে গিয়ে কাজ নাই। তবে মোটা দাগে বলা যায় একদিকে রইল বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম, অপর দিকে রইল পুরাতন কম্যুনিস্ট ধারা থেকে আসা বিপ্লবে বিশ্বাসী নেতৃত্ব। এই নেতৃত্ব বিপ্লব করতে চাইলেও তার পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে কোনও ধারণা রাখত না। আসলে বিপ্লবের কথা বললেও কর্মপন্থার বিচারে সংস্কারবাদী ও শান্তিবাদী মস্কোপন্থীদের সঙ্গে তাদের বিশেষ কোনও পার্থক্য ছিল না। পার্থক্যের প্রধান জায়গাটা ছিল প্রকৃতপক্ষে মস্কো নাকি পিকিং কার অনুগত ও সমর্থক হওয়া যাবে সেই বিষয়।
এই নেতৃত্বের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের পার্থক্য ছিল পর্বতপ্রমাণ। অন্তত আমার কথা বলতে পারি। যাইহোক, এ নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনা বা চুলচেরা বিশ্লেষণের সুযোগ নাই। আজ যখন সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে নির্মোহভাবে ঐ কালকে দেখি তখন বুঝি যে, পূর্ব বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুললেও এবং একটা যুদ্ধের দিকে দেশটাকে নিতে সফল হলেও আমাদের সাফল্যের কারণ তখনও ছিল না। আমাদের সমাজের বাস্তবতায় মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ সঠিক তত্ত্ব বা ধারণার অভাব, মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব সংগঠিত করার সমস্যা এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থনের অভাব এ দেশে বিপ্লবের বিরুদ্ধে ছিল। তবু মূলত আমাদের প্রজন্মের ভূমিকার ফলে যে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ ঘটল এটাই আমাদের জাতির এক শ্রেষ্ঠ অর্জন। আমি মনে করি এটা শুধু পূর্ব বাংলার অর্জন নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেরও অর্জন। কারণ এই যুদ্ধের মর্মে আছে একই সাথে ধর্মমুক্ত তথা লোকায়ত ও সমাজতান্ত্রিক কিংবা জন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এ কথা ভেবে আমি গৌরবান্বিত বোধ করি যে, আমাদের প্রজন্ম ছিল এই যুদ্ধ সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি। এ দেশে আমরাই প্রথমে পূর্ব বাংলায় জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি শুরু করেছিলাম। পরে অনেকে এসেছে এবং যু্দ্ধের শক্তিকে বেগবান করেছে।
ঐ বিপ্লবী প্রজন্মের একজন কর্মী বা সংগঠক হিসাবে আজ আমি অনুভব করি আমরা কতটা অসাধ্য সাধন করেছিলাম ঐ কালে। উল্লেখ করার মতো কোন্ মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে নিজ উদ্যোগে সফল লোকায়ত বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আছে? অন্তত আমার ঐ কালের অভিজ্ঞতার কথা যখন মনে হয় তখন বুঝি ধর্মের প্রশ্নকে মাথায় রেখে কত একাগ্রতার সঙ্গে এ সমাজে বিপ্লবের লক্ষ্যে আমি নিবেদিত ছিলাম। এটা ঠিক যে, আজ যেমন আমি প্রকাশ্যে ধর্ম বিশেষত ইসলাম বিরোধী অবস্থান জারী রেখেছি সে কালে সেটা সেভাবে করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং পাকিস্তানকে আঘাত করে ইসলাম তথা ধর্মের ভিত্তিকে ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম। আমার পদ্ধতি ছিল অনেকটা এ রকম যে, বাইরে পাকিস্তানকে আঘাত করে ভিতরে ধর্ম বিশেষত ইসলামকে আঘাত করা। আমি বিশুদ্ধ বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকতে চাই নাই। মুসলিম সমাজে বাস করে শুধু ইসলাম বিরোধী বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করে কতটা অগ্রসর হওয়া যায় সেটা অবশ্য একটা প্রশ্ন। আমি যে আজ পর্যন্ত আসতে পেরেছি সেটা আমার রাজনৈতিক ভূমিকা বা কর্মকাণ্ডের জন্য সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তান কালে প্রকাশ্যে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও গোপনে বা অপ্রকাশ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতির আড়াল নিয়ে আমি আমার ধর্মমুক্ত চিন্তাকে প্রচার করতে ও ভিত্তি দিতে চেয়েছিলাম। ১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণী থেকে আমার ধর্ম থেকে মুক্তির যে লড়াইয়ের শুরু সেটাকে আমি এভাবে একাত্তর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়েছিলাম।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই লড়াইকে এগিয়ে নিতে যুক্তবাংলার চিন্তার আশ্রয় নিই। এ হল খণ্ডে খণ্ডে সমাধানের পদ্ধতি। পশ্চিম বঙ্গে বা ভারতে সেখানকার বিপ্লবীরা কী করবেন সেটা সেখানকার পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা ঠিক করবেন। তবে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বঙ্গের বুকে দাঁড়িয়ে আমার পদ্ধতিটাই এখানে আমাদের জন্য সঠিক মনে হয়। যুক্তবাংলা তথা বঙ্গরাষ্ট্রের ধারণা ব্যতিরেকে এখানে ইসলাম থেকে মুক্তির লড়াইকে এগিয়ে নিবার আর কোনও উপায় আমি দেখি না। কারণ এ ছাড়া বাংলা ও ভারত ভাগ ক’রে ১৯৪৭-এর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করা যাবে না। আবার এখনই যদি অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ডাক দেওয়া যায় তবে কি সেটা তেমন কোনও আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে? আসলে ধর্মমুক্ত তথা লোকায়ত চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে আগে বাংলাদেশকে ভারতীয় উপমহাদেশের বিপ্লব ও পরিবর্তনের অগ্রণী শক্তিতে পরিণত করতে হবে। যদি সেটা করা যায় তবে বাংলাদেশের বিপ্লব প্রথমে পশ্চিম বঙ্গের ও অতঃপর সমগ্র উপমহাদেশের বিপ্লবী রূপান্তর ও একত্রীকরণের বাস্তবতা সৃষ্টি করবে। আমার অভিজ্ঞতা বলে, সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত ও গণতান্ত্রিক চেতনার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে আমরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতসহ সমগ্র উপমহাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করে নবভারত নির্মাণের শক্তির জাগরণ ঘটাতে পারি।
আমাদের সমাজের বাস্তবতায় আমার কাছে ইসলামকেই সমাজ বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে হয়েছে। আসলে উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে ধর্মকেই সবথেকে বড় সমস্যা মনে হয়। তবে মুসলিম সমাজে সমস্যাটা ভিন্ন ধরনের এবং এটা অনেক বেশী ভয়ঙ্কর, বিশেষত আমাদের জন্য। স্বাভাবিকভাবে, বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমি ইসলামের বিরুদ্ধে সকল শক্তির সমাবেশ ঘটাতে চাইব আগে এই সমস্যার ফয়সালা করার জন্য। তারপর হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্ন আসবে। আমার কোনও ধর্মের প্রতি দুর্বলতা নাই। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইটা আমার কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আগে এটা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা মুসলিম সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষ হিসাবে ইসলাম থেকে মুক্তির সংগ্রাম করাই নৈতিকতার বিচারে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বলে আমি মনে করি। এভাবেই আমরা আমাদের সমাজ ও সেই সাথে বৃহত্তর মানবতার কল্যাণে আমাদের ভূমিকা রাখতে পারি।
এটা ঠিক যে, কৈশোরেই ধর্ম এবং বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার চেতনার জাগরণ আমাকে রাজনৈতিক বিপ্লবের পথে নিয়েছিল। আর তা থেকে সেই সময় থেকে আমি কিছু শর্তসাপেক্ষে হলেও ধর্মবিশ্বাস-বিরোধী ও সেই সাথে মানুষের সমতায় বিশ্বাসী দর্শন ও রাজনীতি হিসাবে কম্যুনিজম বা মার্কসবাদকে বিপ্লবের মতাদর্শিক হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করে আমার যাত্রা শুরু করেছিলাম। কিন্তু মার্কসবাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এক সময় ওটাকে পরিত্যাগ করি। তবে বিশেষত আমার প্রজন্মের অন্য অনেকের মতো আমি বিপ্লবের পথ পরিত্যাগ করে ব্যক্তিজীবনে ফিরে যাই নাই কিংবা সুবিধাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করি নাই। বরং আমার সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিপ্লবের নূতন পথ সন্ধান করেছি। মজার ব্যাপার আমি মার্কসবাদ বা কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে পরিত্যাগ করলেও তার উত্তরাধিকারকে পরিত্যাগ করি নাই। অধিকন্তু এই আন্দোলন এমন নিকৃষ্ট ও পশ্চাৎপদ এক সমাজের সামনে ত্যাগ ও আপোসহীন সংগ্রামের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে তার জন্য তার প্রতি আমার ভক্তি নিবেদনে আমি আজও কুণ্ঠাহীন। আসলে একটা জাতি বা জনগোষ্ঠী একদিনে বড় হয় না। অনেক চড়াই-উৎরাই তাকে পার হয়ে আসতে হয়। এই যাত্রার মধ্য দিয়ে সঞ্চিত হয় অভিজ্ঞতা এবং গঠিত হয় যোগ্য নেতৃত্ব। এগুলি তার ভবিষ্যৎ সাফল্যের ভিত্তি রচনা করে দেয়। সুতরাং আজ পথ ভিন্ন হয়ে গেলেও আমরা কী করে আমাদের কম্যুনিস্ট অগ্রজদের মহিমান্বিত ভূমিকাকে খাটো করে দেখব? আসলে তাদেরকে খাটো করলে আমরা আমাদের আগামী যাত্রার ভিত্তিটাকে অস্বীকার করে শূন্যে পতিত হব এবং বাস্তবে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকব। তাদের ভুল ও সীমাবদ্ধতার সমালোচনা থাকবে। সামগ্রিকভাবে তাদের পথও পরিত্যাজ্য। কিন্তু তাদের সবকিছু পরিত্যাজ্য নয়। এটাকে বলা যায় উত্তরণ। পুরাতন পথ ও পদ্ধতি থেকে, পুরাতন তত্ত্ব থেকে নূতন পথ, পদ্ধতি ও তত্ত্বে উত্তরণ।
সে কালে এর বেশী আর কী করা যেত? বিশেষ করে ইসলামের মতো এক ভয়ঙ্কর ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে সে কালে এর বেশী আর কি কিছু করার ছিল? ইন্দোনেশিয়া-আফগানিস্তানের স্মৃতি তো এখনও জীবন্ত। এই রকম ভয়ঙ্কর নৃশংস এক সমাজে ভিতর থেকে বিপ্লব চেষ্টা, বিশেষ করে যদি দর্শনের কারণে সেটা ধর্ম বিরোধী হয়, তবে সেই চেষ্টা যে কতটা কঠিন হতে পারে সেটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। এর পথ ও পদ্ধতিও পশ্চিম ইউরোপ ও রাশিয়া কিংবা চীন-ভিয়েৎনাম থেকে অনেক ভিন্ন। পথ কিংবা পদ্ধতি শুধু বই পড়ে নির্ণয় করা যায় না। সেটা লাগে; তবে সেই সঙ্গে লাগে বাস্তব সংগ্রামের অভিজ্ঞতা। অমুসলিম বিশেষত হিন্দু সমাজে যারা বাস করেন তাদের পক্ষেও এই সংগ্রামের কঠোরতা ধারণা করা সম্ভব নয়। সেই সংগ্রাম করে চলেছি আজ অবধি। জিহাদীরা অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের পক্ষ হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আঘাত করেছে আওয়ামী লীগ। আমাদেরকে কারারুদ্ধ যেমন করেছে তেমন দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তোলা আমার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করেছে এবং লুটতরাজ দ্বারা আমার বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে।
এই হচ্ছে আওয়ামী লীগ! যে যেটা শুনতে চায় প্রয়োজন হলে সেটাই তাকে শুনায়। কিন্তু করে ভিন্নটা। আসল কাজ তো একটাই — বাঙ্গালী পরিচয়ের পাশে নিজেদের মুসলিম পরিচয়কে রক্ষা করে চুরি ও লুটপাট করা। বিশেষত লুণ্ঠনের (মালে গণীমত) ধর্ম হিসাবে ইসলামকে তাদের চাই। এ দেশে ১৯৪৭ সাল থেকে কোটি কোটি হিন্দু বিতাড়নের মাধ্যমে সম্পদ ও ক্ষমতার যে ভিত্তি তারা তৈরী করেছে সেই লুঠেরা ঐতিহ্য তাদের ধমনী ও শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
আমার খুব অবাক লাগে এ কথা ভেবে যে, ভারতীয়রা কেন আওয়ামী লীগের মূল্যায়নে এত অক্ষম। বুঝি যে, এর পিছনে রাজনীতির নগদ লাভালাভের হিসাব আছে। ঠিক আছে ভারতীয়রা না হয় ভুল করল কিংবা তাদের নগদ স্বার্থ বিবেচনা থেকে কর্মনীতি অনুসরণ করল। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদেরও বেশীর ভাগ মানুষ কেন বায়ান্ন বছর ধরে এত তিক্ত অভিজ্ঞতার পরেও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে এতটা মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকে? হিন্দু চেতনার যে স্থবিরতা ও রক্ষণশীলতা তা-ই তাকে ধরে রাখে সেই একাত্তর পর্বে। মনে করে, মুজিব পাকিস্তান ভেঙ্গেছে(!), সুতরাং মুজিব ও তার কন্যার দলকে পূজা করতে হবে। তাদের বেশীর ভাগই দেখেছি কীভাবে লীগের প্রতি অন্ধ হয়ে থাকে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে হিন্দুদের এ দেশে সাধারণভাবে এই অবস্থা। অথচ এ দেশে হিন্দুদের সম্পদ-সম্পত্তি লুণ্ঠনে লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাই সবচেয়ে অগ্রণী থেকেছে।
এই ঐতিহ্য কিন্তু একাত্তর থেকেও অব্যাহত রয়েছে। বিশেষত হিন্দু মেয়েদের নিগ্রহের কিছু ঘটনার কথা মনে হলে এখনও কষ্ট হয়। একাত্তরে সব হিন্দু তো ভারতে যেতে পারে নাই। তারা গ্রামে লুকিয়ে থাকত। আমি এক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকেই শুনেছিলাম সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ হিন্দুদের বাড়ী থেকে সম্ভোগের জন্য হিন্দু যুবতী মেয়েদেরকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যেত। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও আওয়ামী লীগের লোকদের এমন আরও ঘটনা ঘটাবার কথা আমি সেই কালে শুনেছিলাম। এ হল হিন্দু নারী অপহরণ বা ধর্ষণ। এছাড়া আছে বাড়ী, জমি দখল। সেটা যুদ্ধের ভিতরই শুরু হয়েছিল। বঙ্গরাষ্ট্রেও কিছু ঘটনার জীবন্ত বর্ণনা আছে। এ দেশে আওয়ামী লীগের মূল শ্রেণীভিত্তি এরাই গঠন করেছে। বাঙ্গালী মুসলিম চরিত্রের এই দিক জানার জন্য দেখুন : আজাহারুল ইসলাম লিখিত ‘বাঙ্গালী জন-চরিত্রের কিছু নমুনা বিশ্লেষণ’-এর (১)নমুনা – ’৬৯] এবং (২)নমুনা– ’৭১ (http://bangarashtra.net/article/829.html)।
আমার খুব কষ্ট হয় অবাঙ্গালী বা বিহারীদের উপর এবং বিশেষত তাদের নারীদের উপর নৃশংসতার কথা মনে হলে। কখনও কখনও খোলা জায়গায় বাবা-মাকে অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের সামনে তাদের মেয়েদেরকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হত। এই ধরনের দুর্বৃত্তরাই হল আওয়ামী লীগের শ্রেণীগত ভিত্তি!
বিহারীরা সাধারণভাবে পাকিস্তানের পক্ষে গেলেও একটা বৃহৎ অংশ আমাদের ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র রাজনীতির পক্ষে ছিল। আমরা যে তৎকালে লীগের ঐ জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদের রক্ষার জন্য তেমন কিছু করতে পারি নাই এ কথা মনে হলে এখনও খুব দুঃখ পাই। বিশেষত নারী নিগ্রহের এইসব ঘটনার স্মৃতি আমাকে খুব পীড়া দেয়। সব বিহারী আমাদের রাজনীতির সঙ্গে ছিল না। তারা না হয় আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। তাতে কী হয়েছে? সেই অপরাধে কি তাদের মেয়েদেরকে অসম্মানিত, ধর্ষণ ও নিগ্রহ করতে হবে? এমন শিক্ষা আওয়ামী লীগ দিতে পারে। কিন্তু কোনও কম্যুনিস্টই কি কখনও এই শিক্ষা দিয়েছে? আমি দেখেছি কম্যুনিস্ট রাজনীতির কতটা গভীরে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রোথিত ছিল।
আমাদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি করা সহকর্মী বিহারীদের কথা যখন মনে হয় তখন আজও ভয়ানক কষ্ট পাই। তারাও আমাদের পাশে থেকে ’৬৮-’৬৯ থেকে ’৭১-এ যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য স্লোগান দিত। সেই সাথীরা আজ কে কোথায় তা জানি না। অন্তত যাদেরকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতাম তারা নাই। রংপুর জেলার রেলওয়ে শ্রমিক আন্দোলনের একজন তরুণ নেতা ও আমাদের পার্টির কর্মী জয়নুলকে আমি খুব পছন্দ করতাম। সে যে যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল সেটা আমি শুনেছি। যুদ্ধের ভিতর তৎকালীন সৈয়দপুরে বিহারী ও পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাঙ্গালীদের রক্ষায় তার বলিষ্ঠ ভূমিকার কথাও আমি শুনেছিলাম। আরেক বিহারী শ্রমিক নেতা ইব্রাহীম কোথায় গিয়েছেন সেটা আমি ভুলে গেছি।
একাত্তর ও বিশেষত একাত্তর পরবর্তী কালে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতকালে আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাদের ঘরের অনেক নারীকে যেভাবে ধর্ষণ ও লাঞ্ছিত করত সেসব বেদনাদায়ক ঘটনার স্মৃতি এখনও আমাকে পীড়া দেয়। আমি এমন ঘটনার কথাও জানি যে, এক জেলার এক তরুণ বামপন্থী নেতার মা ও বোনকে আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা পাশাপাশি শুইয়ে গণ-ধর্ষণ করেছিল।
হতে পারে যে, বামপন্থীদের একটা অংশ হঠকারিতা করেছিল। কিন্তু তার জন্য তাদের ঘরের মা-বোনরা দায়ী হবে কেন? সবচেয়ে বড় কথা নারীকে এভাবে লাঞ্ছিত করা হবে কেন? এসব কথা মনে হলে আমার মন আজও বেদনায় ভরে উঠে। আসলে এসব স্মৃতির বাইরে যাবার ক্ষমতা আমার নাই। সেভাবে আমি আমার জীবনকে গড়িও নাই।
একাত্তরের যুদ্ধের প্রধান অনুঘটক আমরা। বিভিন্ন সংগঠন থাকলেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সংগঠনের নাম নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হবে বেআইনী ও গোপনে থাকা পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টির নাম। ১৯৬৮ সালে সেই পার্টিতে আমার উদ্যোগে তরুণ প্রজন্মের খুব বড় একটা অংশ যোগ দেয়। কিন্তু পার্টির নেতৃত্ব ছিল আমার প্রতি বৈরী। তা হোক। তারা যত অপদার্থ ও পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নেও বিভ্রান্ত ও অনেকটাই প্রতারণাপূর্ণ হোন, তাদের রাজনীতির আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকারকে ব্যবহার ক’রে আমি তাদেরকে ঠেলে দিতে চেয়েছিলাম স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধকে অনিবার্য করার দিকে। পূর্ব বাংলার কম্যুনিস্ট পার্টি ছিল ১৯৭০ সালের শেষ পর্যন্ত ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপের মূল চালিকা শক্তি। সুতরাং কম্যুনিস্ট পার্টি গোপন হলেও ন্যাপ ও অন্যান্য প্রকাশ্য গণ-সংগঠনের তখনকার প্রবল প্রভাবকে ব্যবহার করে আমি সারাদেশে যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব তৈরী করতে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করতে চেয়েছিলাম। এ দিক থেকে আমি সফল। শেষ মুহূর্তে ভারতের সাহায্য নিয়ে আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্ব দখল করলেও যুদ্ধটা হয়েছে। যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি হয় কষ্ট হলেও সেটাকে মেনে নিতে হয়। বিশেষ করে আমরা যারা সে কালে বামপন্থী রাজনীতি করেছিলাম তাদের জন্য পরাজয় ও বিপর্যয় ছিল অনিবার্য। প্রধান শত্রু পাকিস্তান। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমাদের বিরুদ্ধ শক্তি, ভারত আমাদের বিরুদ্ধে, চীন আমাদের বিরুদ্ধে, রাশিয়া আমাদের বিরুদ্ধে, আমেরিকা তো বিরুদ্ধে বটেই। আমরা কী করে সফল হব? আমাদের নেতৃত্ব সঠিক হলেও ঐ কালে তারা সাফল্যের জন্য কতটা কী করতে পারত? সর্বোপরি, একটা মুসলিম সমাজে ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ আমাদের জন্য এমন ব্যর্থতা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এমন বিপ্লবী আন্দোলন ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কি উপমহাদেশে আর কারও আছে? নেপালের বিপ্লবী যুদ্ধ সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নাই। অবশ্য তার প্রভাব আমাদের দেশে নাই। ভারতেও কতটা আছে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
ষাটের দশকের বিপ্লবী ও স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার পরিণতিতে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের নিকট অপরিমেয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমার ধারণা এটা উপমহাদেশের জন্যও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা, যার সুফল আগামীতে সমগ্র উপমহাদেশ ভোগ করবে। বিশেষত তরুণ প্রজন্মের আমরা যারা পঞ্চাশ ও ষাটের দশক থেকে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার রাজনীতি গড়ে তুলেছিলাম তারা কিন্তু উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ছিলাম না। সুতরাং বাঙ্গালী, বিহারী ও চাকমা-মারমা-ত্রিপুরাসহ অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষদেরকে আমরা আমাদের স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাদের এই রাজনীতির পরিণতিতে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত হলেও কংগ্রেসী ভারত ও আওয়ামী লীগের চাপে তা হারিয়ে গেছে। শুধু আমাদের প্রজন্ম নয়, উপরন্তু স্বাধীনতা ও বিপ্লবী যুদ্ধের সকল শক্তিই বৈরী পরিস্থিতির চাপে ও বৈরী শক্তির আঘাতে ছত্রভঙ্গ হয়েছে এবং বাস্তবে হারিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তাদের অবদানও অস্বীকৃত হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস সাধারণত বিজয়ীরা লেখে, পরাজিতরা লেখে না। লিখলেও সেটাকে চেপে দেওয়া হয়। সেটাই হয়েছে এবং হচ্ছে আজ অবধি। তবু বলি, ভিত্তিটা রয়ে গেছে। ওটা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নাই।
(ছয়)
অর্ধশতা্ব্দীর অধিক কাল পর আজ যখন ষাটের দশক ও একাত্তরের কথা ভাবি তখন বুঝি শত ভ্রান্তি ও ব্যর্থতার পরেও পূর্ব বাংলার বুকে কতটা বিরাট ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আমরা ঘটিয়েছিলাম সে কালে। আমরা যে বিপ্লবী আন্দোলন গড়েছিলাম সেটা সফল হলে শুধু পূর্ব বাংলায় একটা জন-গণতান্ত্রিক ও লোকায়ত বিপ্লব সংগঠিত হত না, অধিকন্তু সেটা ভারত ও পাকিস্তানসহ সমগ্র উপমহাদেশে বিস্তৃত হতে পারত। হ্যাঁ, সেই স্বপ্ন আমাদের কারো কারো মনে ছিল। আমার মনে তো ছিলই।
পূর্ব বাংলায় বিপ্লবের স্বাভাবিক পরিণতি কি সেটা না? ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ আমার বিবেচনায় এক অসমাপ্ত বিপ্লব, যা সমাপ্ত হবার অপেক্ষায় আছে। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা সে দিকে যাচ্ছে বলে আমি ধারণা করি। কারণ একটা বিপ্লবী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসায় যত ব্যর্থই আমরা হই, এখন আমাদের আছে একটা বিপ্লবী যুদ্ধের সূচনা ও পরিচালনার অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর প্রতিটি প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেই বিপ্লব প্রয়াস ব্যর্থ হলেও সেটা একটা সমাজে পরবর্তী সফল বিপ্লবের ভিত্তি তৈরী করে দিতে পারে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভিয়েৎনাম, কিউবা কোথায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটে নাই।
বিশেষ করে ষাটের দশকে তরুণ প্রজন্মের আমরা যখন ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার ধ্বনি দিয়েছিলাম তখন আমরা শুধু জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করি নাই, সেই সাথে ধর্মমুক্ত তথা লোকায়ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকেও ধারণ করেছিলাম। আমরা যারা সে কালে মার্কসবাদী তথা কম্যুনিস্ট রাজনীতি করতাম তারা সাধারণত মার্কসবাদী দর্শনের অন্তর্বস্তু হিসাবে লোকায়ত দর্শনকে ধারণ করতাম। ফলে দর্শনগতভাবে আমরা যেমন ছিলাম ধর্মসম্প্রদায় ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান বিরোধী তেমন আমাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ছিল বাংলা ও বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণের প্রয়োজনে পূর্ব বাংলার বুকে ধর্ম থেকে মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। এটা ছিল ছিল সে কালে আমাদের বিপ্লবের প্রথম ধাপ। এর পরের ধাপেই ছিল স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে দুই বাংলার পুনরেকত্রীকরণ এবং সেই সঙ্গে বিপ্লবের মাধ্যমে সমগ্র উপমহাদেশের পুনর্গঠন। সে কালে আফগানিস্তানের কথা আমরা না ভাবলেও আজ অন্তত আমি সেই কল্পনা করি। সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা আমাকে সেই জায়গায় নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে এটা বলে রাখা ভালো যে, উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী যেমন আমি নই তেমন উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষেও আমি নই। কিন্তু যে লোকায়ত ও জন-গণতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আমি দেখি তার জন্য একটা ভূমি বা রাষ্ট্র চাই। কিন্তু জাতির ভিত্তি না পেলে সেটা দৃঢ়মূল কিংবা টিকসই হতে পারে না। মনে রাখতে হবে আজকের পৃথিবীতে আমাদের বিপ্লব হবে এমনই নূতন এক বিপ্লব যাকে ভিতর ও বাইরের বহু বাধাকে মোকাবিলা করে সফল হতে কিংবা টিকে থাকতে হবে। সুতরাং উপমহাদেশ পরিসরে নূতন রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনে আমাদের আজ নবতর ও দৃঢ়বদ্ধ জাতি গঠনের কথা ভাবতে হবে। অর্থাৎ যতই আন্তর্জাতিক আবেদন থাকুক আমাদের বিপ্লব দাঁড়াতে পারে মূলত একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের ভিত্তির উপর, যার মুলে আবার থাকতে হবে একটা অভিন্ন জাতিবোধ। এই জাতিবোধ জন্মাবার পিছনে ভাষা যেমন একটা ফ্যাক্টর হতে পারে তেমন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অভিন্ন সূত্র তাকে প্রাণশক্তি যোগাতে পারে। শুধু ধর্ম থেকে মুক্ত লোকায়ত চেতনা-ভিত্তিক সমাজের কথা ভাবলে হবে না। বহু ভাষার বিভাজন থেকে মুক্ত এক অভিন্ন ভাষা ভিত্তিক জাতি গঠনের কথাও আমাদেরকে ভাবতে হবে। আর তখন আসে সিন্ধু সভ্যতার মূল ভাষা হিসাবে বৈদিক ভাষার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা। (এ প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য আমার লিখা প্রবন্ধ : ‘সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনায় জেগে উঠুক উপমহাদেশ’ http://bangarashtra.net/article/1504.html)
তবে আজ আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। সেই বিচারে আজ আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে একটি লোকায়ত ও জন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।