Banner
বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান -- শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক , আপডেটঃ July 2, 2010, 12:00 AM, Hits: 32402

 

ঐতিহাসিক পটভূমিঃ ধর্ম-সম্প্রদায়গত বিভাজন

আলোচনার শুরুতেই মধ্যবিত্ত শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা উচিত হবে। ইংরাজী Middle Class-এর বাংলা প্রতিশব্দ মধ্য শ্রেণী হলেও বাংলা ভাষায় মধ্যবিত্ত শব্দটাই বেশী ব্যবহৃত হয়। শব্দের ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী একজন নিম্নবিত্ত এমনকি নির্বিত্ত হয়েও মধ্য শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কারণ ইংরাজী Middle Class অর্থে মধ্যবিত্ত বা মধ্য শ্রেণী আধুনিক পুঁজিবাদী ও শিল্প সভ্যতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মধ্যবিত্ত এমন একটি শ্রেণী যা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থায় মধ্যবর্তী একটি অবস্থান অধিকার করে। সুতরাং বিত্তের বিচারে মধ্যবিত্তকে মধ্য যুগসহ সভ্যতার সব পর্বে পাওয়া গেলেও মধ্যবিত্ত বা মধ্য শ্রেণী বলতে এখন আমরা যে শ্রেণীকে বুঝি তার সঙ্গে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ও সভ্যতার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু দোকানদার, ব্যবসায়ী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার লোক এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলেও এর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ড স্বরূপ যে গোষ্ঠীটি অবস্থান করে সেটি হচ্ছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত সম্প্রদায়। বস্তুত আধুনিক তথা সেকিউলার এবং যুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর শিক্ষা বাদ দিলে মধ্যবিত্ত ধারণার কোন তাৎপর্য ও গুরুত্ব থাকে না। সুতরাং অর্থনীতির মাঝারী পর্যায়ে অবস্থান দ্বারাই আধুনিক মধ্যবিত্ত বা মধ্য শ্রেণী গঠন হয় না যদি তার সঙ্গে কোন না কোন রূপে আধুনিক শিক্ষা ও আলোকপ্রাপ্তির যোগ না থাকে। এই বিচারে আক্ষরিক অর্থে যিনি নির্বিত্ত অথচ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তিনিও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন যদি তিনি এই শিক্ষা নির্ভর কোন পেশায় নিয়োজিত থাকেন।

আলোচনার শুরুতে এ বিষয়ও স্পষ্ট করা উচিত হবে যে আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ আলোচনায় মুখ্য স্থান অধিকার করলেও বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলতে শুধু বাংলাদেশের বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত বোঝাটা সঠিক বা যথেষ্ট নয়। কারণ ভারতেও বাঙ্গালী জাতির এক বৃহৎ অংশ বাস করে। বস্তুত ১৯৪৭-এ বাঙ্গালী জাতিসত্তা ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত এই দুই রাষ্ট্রে যে আত্মবিভাজন ঘটিয়েছিল আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেই ঘটনার উত্তরাধিকারকে ধারণ ও বহন করছে। সুতরাং বাংলাদেশের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কিত এই আলোচনায় ধর্ম-সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু ও মুসলমান এই উভয় বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের বিকাশের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। এভাবে এ আলোচনার পটভূমি হিসাবে দেখা দিবে অতীতের বৃহত্তর ও অবিভক্ত বাংলা, এবং সম্প্রদায় নির্বিশেষে বৃহত্তর বাঙ্গালী জাতিসত্তা।

বিভিন্ন সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে বাঙ্গালী হিন্দু ও মুসলমানের বিকাশ অভিন্ন ধারায় হয় নি। এটা বিস্ময়কর যে, ব্রিটিশ শাসনকালের একশত বৎসরের অধিক কাল পর্যন্ত বাংলায় মুসলমান জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হলেও জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি তাদেরকে বাংলায় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে। ব্রিটিশ শাসন কালে ১৮৭২ সালে প্রথম যে আদমশুমারী বা লোকগণনা হয় তাতে বাংলায় ধর্ম-সম্প্রদায়গতভাবে জনসংখ্যার বিন্যাস ছিল নিম্নরূপঃ

লোক গণনা

বাংলা ভাষাভাষী বাংলায় মোট জনসংখ্যা

 বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা

  বাংলায় হিন্দু জনসংখ্যা

১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দ

৩,৬৭,৬৯,৭৩৫

  ১,৬৩,৭০,৯৬৬

১,৮১,০২,৩৪৮ (সঠিক সংখ্যা হবে ১ কোটি ৬৮ লক্ষ। কারণ এই সংখ্যার মধ্যে সর্বপ্রাণবাদীদেরও ধরা হয়েছে।

 কিন্তু পরবর্তী ১৮৮১ এবং ১৮৯১-এর লোকগণনায় ধর্ম-সম্প্রদায়গতভাবে উপরোক্ত বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে। যথা,

   লোক গণনা

বাংলা ভাষাভাষী বাংলায়     মোট জনসংখ্যা

   বাংলায় মুসলমান          জনসংখ্যা

  বাংলায় হিন্দু জনসংখ্যা

   ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দ

৩,৫৬,০৭,৬২৮ (সিলেটকে পৃথক করে আসামের সঙ্গে সংযুক্তির ফলে বাংলার মোট জনসংখ্যা হ্রাস পায়। ১৮৮১ সালে সিলেটের জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ)

   ১,৭৮,৬৩,৪১১

  ১,৭২,৫৪,১২০

১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দ

৩,৮২,৭৭,৩৩৮

১,৯৫,৮২,৪৮১

১,৮০,৬৮,৬৫৫

উপরের হিসাব থেকে আমরা দেখি যে, ১৮৭২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম লোকগণনা অনুযায়ী বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুদের থেকে ৪,২৯,০৩৪ জন কম ছিল। তবে সমগ্র অমুসলমান জনসংখ্যার তুলনায় মুসলমান জনসংখ্যা তখন আরও অনেক কম ছিল। ৪০,২৭,৮০৩ জন কম। তখন মুসলমানদের সংখ্যা যেখানে ছিল ১,৬৩,৭০,৯৬৬ জন সেখানে অমুসলমান (হিন্দু ও অন্যান্য) জনসংখ্যা ছিল ২,০৩,৯৮,৭৬৯।

১৮৮১ সালের লোকগণনায় এই চিত্র বদলে যায়। ১৮৮১ সালে মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যাকে ৬,০৯,২৯১ জন দ্বারা অতিক্রম করে যায়। তবে সমগ্র অ-মুসলমান জনসংখ্যার তুলনায় তখন বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১,২৩,১৯৪ জন বেশী। ঐ লোকগণনায় মুসলমান জনসংখ্যা যেখানে ছিল ১,৭৮,৬৩,৪১১ সেখানে অ-মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ১,৭৭,৪৪,২১৭।

১৮৯১ সালের লোকগণনায় মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যাকে ১৫,১৪,২২৬ জন দ্বারা অতিক্রম করে যায়। তবে সমগ্র অ-মুসলমান জনসংখ্যার তুলনায় তখন বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা সামান্য কিছু বেশী ছিল। তখন বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ১,৯৫,৮২,৪৮১ এবং অ-মুসলমান জনসংখ্যা ছিল ১,৮৬,৯৩,৮৫৭। সুতরাং ঐ লোকগণনা অনুযায়ী বাংলায় মুসলমানদের সংখ্যা অ-মুসলমানদের তুলনায় ৮,৮৮,৬২৪ জন বেশী ছিল। বাংলায় ব্রিটিশ শাসনামলে এসে সংখ্যালঘু মুসলমানদের এভাবে সংখ্যাগুরু জনসংখ্যায় পরিণত হবার তাৎপর্য ও ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দূর প্রসারী। পূর্ব বাংলায় মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই জনসংখ্যার বিন্যাসের এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ইংরাজীসহ আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ বৃদ্ধি। এই সময় পর্যন্ত মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় শুধু যে শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল তা-ই নয়, উপরন্তু তারা ছিল ইংরাজী ও আধুনিক শিক্ষার প্রতি বিমুখও।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে আধুনিক শিক্ষা যুক্ত হলে বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় ক্রমে সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করতে থাকে। সম্পদ-সম্পত্তি ও শিক্ষায় হিন্দুদের প্রাধান্য সত্ত্বেও এই অবস্থা মুসলমানদের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে নীচতলা থেকে সীমাবদ্ধ পরিসরে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং নির্বাচনমূলক ব্যবস্থার ক্রম প্রসার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য নূতন সুযোগ এনে দেয়। বিশেষ করে ১৯৩৫-এ ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত ভারত শাসন আইনের অধীন নির্বাচন ব্যবস্থা বাংলায় অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে পশ্চাৎপদ মুসলমানদের অধিকতর শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়। এটা সম্পদ ও শিক্ষায় অনেক বেশী অগ্রসর কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সম্পদ ও শিক্ষায় অনেক বেশী দুর্বল ও পশ্চাৎপদ কিন্তু সংখ্যাগুরু মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

বাঙ্গালীর ইতিহাস চর্চায় কিছু বিস্ময়কর ভ্রান্ত ধারণার প্রাধান্য বিদ্যমান। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, ব্রিটিশ কর্তৃক রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় মুসলমানরা অর্থ-সম্পদ হারায় এবং সেই সঙ্গে বিদেশী বিজেতা ব্রিটিশদের ভাষা ইংরাজীর প্রতি বিরূপ হওয়ায় তারা আধুনিক শিক্ষায় হিন্দুদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। এই ধারণা অনুযায়ী ধরে নেওয়া হয় ব্রিটিশ বিজয়ের পূর্বে মুসলমানরা হিন্দুদের তুলনায় সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। কিন্তু বাংলার মুসলমানদের সম্পর্কে এমন ধারণা সত্য নয়।

প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় যাদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিল তারা ছিল বহিরাগত মুসলমান, যারা এ দেশের অধীনস্থ অথবা নিম্ন শ্রেণীর ধর্মান্তরিত মুসলমানদের থেকে সাধারণত নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও দূরত্ব বজায় রাখত। বহিরাগতদের সংখ্যা ছিল যথেষ্ট কম। দেশজ বা ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যা বহিরাগতদের তুলনায় অনেক বেশী হলেও তাদের সংখ্যাও হিন্দুদের তুলনায় তৎকালে অনেক কম ছিল। দেশজ ধর্মান্তরিত মুসলমানদের ব্যাপক অংশের না ছিল অর্থ-বিত্ত, না ছিল শিক্ষা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্ন শ্রেণী ও নিম্নবর্ণ থেকে ধর্মান্তরিত এই মুসলমানদের বেশীর ভাগ ছিল তৎকালীন উন্নত সমাজ, সভ্যতা এবং শিক্ষা থেকে অনেক দূরের অবস্থানে। এরা ছিল সত্যিকার অর্থে সমাজের প্রান্তবর্তী। এরা ছিল বিচ্ছিন্ন ও পশ্চাৎপদ গ্রাম ও চরের অধিবাসী। বাকীরা অনেকে ছিল তখনকার শহরগুলোর বহিরাগত আশরাফ ও শাসক মুসলমানদের চাকর-দাস-দাসী এবং কিছু সংখ্যক ছিল কারিগর, দর্জী, রাজমিস্ত্রী, মুটে-মজুর ইত্যাদি।

প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত দুই একটি ক্ষেত্র ছাড়া তখনও হিন্দুরা ছিল এমন কি বহিরাগত ও অভিজাত মুসলমানদের তুলনায়ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে উন্নততর অবস্থানে। উচ্চ বর্ণ ও উপর তলার হিন্দুরা ছিল পূর্ব থেকেই শিক্ষানুরাগী। রাষ্ট্রভাষা ফার্সী তারা শিখে নিয়েছিল। মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের যেসব ভাগ্যান্বেষী ও ভবঘুরে বাংলায় আসত তাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে যে শিক্ষা থাকার কারণ ছিল না তা সহজবোধ্য। সুতরাং মুসলিম শাসনকালেও উপর ও নীচতলার প্রায় সর্বত্র লেখাপড়ার ও দাপ্তরিক জায়গাগুলোতে হিন্দুরা নিয়োজিত ছিল। এমন কি মোগল ও নওয়াবী আমলেও আমরা দেখি যে রাজস্ব বিভাগের উচ্চতম পদটি ছাড়া আর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুদের নিয়োগ দেওয়া হত। শিক্ষা ছাড়াও এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল মুসলমান শাসকরা মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদেরকে অধিকতর বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মনে করতেন। বস্তুত বহিরাগত মুসলমানরা জোর দিত যুদ্ধ চর্চার উপর। তাদের এ দেশ জয়ের মূল উৎস ছিল যুদ্ধ তথা সমর বিদ্যায় তাদের শ্রেষ্ঠত্ব। সুতরাং যুদ্ধ বিদ্যা চর্চা তথা সেনাবাহিনী ছিল তাদের মনোযোগের মূল জায়গা; শিক্ষা নয়। তখনকার যুগে প্রশাসনও ছিল সেনাবাহিনী বা সামরিক কর্মকর্তাদের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণাধীন। সুতরাং সেনা কর্মকর্তা হওয়া ছিল সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর তলায় অধিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এই অবস্থায় অন্যান্য পেশায় অপ্রাধান্য বা হীনতা এমন কি কিছু ক্ষেত্রে অনুপস্থিতি ঘটলেও ক্ষতি ছিল না।

তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভবত বিচার বিভাগ ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ বিচারের জন্য কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ছিল অত্যাবশ্যক, যেহেতু বিচারের মূল ভিত্তি ছিল ধর্মীয় অনুশাসন। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভাষা আরবী জানা অত্যাবশ্যক হলেও রাষ্ট্রভাষা ফার্সী জানাও ছিল অপরিহার্য। কারণ বিচারের রায় এবং নথিপত্র ইত্যাদি লেখা হত ফার্সীতে। কিন্তু এখানেও সাধারণ কর্মচারী ও কেরানী হিসাবে হিন্দুদের গুরুত্ব ছিল। এক কথায় মুসলমান শাসন কালেও মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুরা শিক্ষায় অগ্রণী ছিল এবং বেসামরিক ও প্রশাসনিক দপ্তরগুলিতে বিশেষত নীচতলার পদগুলিতে সাধারণভাবে তাদের সংখ্যাধিক্য ও প্রাধান্য বিদ্যমান ছিল।

তবে অর্থ-সম্পদ আপাত দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী বহিরাগত মুসলমানদের বেশী হলেও এক্ষেত্রে উচ্চ বর্ণের হিন্দুরাও খারাপ অবস্থায় ছিল না। প্রথমত ব্যবসা ছিল প্রায় একচেটিয়াভাবে হিন্দুদের হাতে। এ ছাড়া বাংলার অধিকাংশ জমিদার ছিল হিন্দু। বিশেষত খুব বৃহৎ প্রায় সব জমিদার ছিল হিন্দু। অবশ্য ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে জমিদাররা জমির মালিক ছিল না। তারা ছিল নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের খাজনা আদায়কারী।

আসলে এই বিষয় আমাদের জানা দরকার যে, আধুনিক অর্থে জমিতে ব্যক্তি মালিকানা ব্রিটিশ শাসনকালের পূর্বে বাংলা বা ভারতে ছিল না।* জমির উপর মালিকানা বা অধিকার ছিল নির্দিষ্ট দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, যেমন কৃষকের জন্য কৃষিকাজ এবং জমিদারদের জন্য খাজনা আদায়। অবশ্য জমিদারদের কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকত, যেমন নির্দিষ্ট জমিদারীর শান্তি-শৃঙ্খলা-নিরাপত্তা বিধান ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল পঞ্চায়েত, যাকে হিসাবে না নেবার উপায় রাষ্ট্র বা রাজ-সরকার এবং জমিদার কারও ছিল না।

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* শুধু জমি নয় বরং যে কোন সম্পদ ও সম্পত্তিতে মোগল যুগে ব্যক্তিগত মালিকানার দুর্বল অবস্থা সম্পর্কে আমরা জীবন্ত চিত্র পাই ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়েরের ভারত ভ্রমণের বৃত্তান্ত থেকে। আগ্রহী পাঠক বিনয় ঘোষকৃত অনুবাদ ‘বাদশাহী আমল’ পাঠ করতে পারেন।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------

যাইহোক, এমন এক বাস্তবতায় মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতা মুসলমান নওয়াবদের হাত থেকে ইংরেজদের হাতে যাবার পর বহিরাগত মুসলমানরা এক অর্থে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছাড়া যে খুব বেশী কিছু হারিয়েছিল তা নয়। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা বহির্ভূত পেশাসমূহের ক্ষেত্রে অবস্থান না থাকায় কিংবা তা দুর্বল থাকায় রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তচ্যুত হবার সঙ্গে তাদের প্রায় সব হস্তচ্যুত হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতাহীন বহিরাগত আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণী এর ফলে তাদের দ্বারা এত কাল ঘৃণিত এবং উপেক্ষিত দেশজ ও ধর্মান্তরিত তথাকথিত আতরাফ বা নিম্নশ্রেণীর মুসলমানদের কাতারে অধঃপতিত হতে বাধ্য হল।

সুতরাং অনেক অতিকথা বা মীথের মত এটাও একটা অতিকথা মাত্র যে ইংরেজদের মুসলমান বিদ্বেষী কর্মনীতির ফলে রাজ্যহারা মুসলমানরা সর্বস্বান্ত হয় এবং হিন্দুদের তুলনায় সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। বরং এ কথাই সত্য যে হিন্দুরা তাদের এ দেশীয় ধর্মান্তরিত বা স্বজাতীয় প্রতিপক্ষ মুসলমানদের তুলনায় পূর্ব থেকেই সব দিক থেকে উন্নত ও অগ্রগামী ছিল এবং এমন কি বহিরাগত শাসক মুসলমান অভিজাত বা আশরাফ শ্রেণীর তুলনায়ও শিক্ষা, বাণিজ্য ইত্যাদি কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর অগ্রগামী ছিল।

ইতিহাসের নামে কখনও কখনও আর একটি অতিকথা চালাবার চেষ্টা হয় এ কথা বলে যে, প্রধানত হিন্দুদের বিশ্বাসঘাতকতা ও চক্রান্তের কারণে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পতন এবং ইংরেজদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যেমন রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ ইত্যাদি হিন্দুরা ছিলেন তেমন নওয়াবের প্রধান সেনাপতি ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মীর জাফরও ছিলেন। অন্যদিকে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে নওয়াবের পক্ষে যেমন মুসলমান সেনানী মীর মদন যুদ্ধ করেছিলেন তেমন হিন্দু সেনানী মোহন লালও যুদ্ধ করেছিলেন। পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভের তিন হাজারের কিছু বেশী সৈন্যের বিরুদ্ধে মীর মদন, মোহন লাল প্রভৃতি সেনাধ্যক্ষ যেখানে সতেরো হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করেন সেখানে মীর জাফরের নেতৃত্বাধীন পঞ্চাশ হাজার সৈন্য যুদ্ধ না করে দাঁড়িয়ে থাকে। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ বাহিনীর পক্ষাবলম্বন।

এর অর্থ কিন্তু সহজ। নওয়াবী রাষ্ট্রের প্রধান অংশ চেয়েছিল বিদেশী ইংরেজদের হাতে রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটিয়ে ভাগাভাগি বা অংশীদারির ভিত্তিতে এ দেশ শাসন করতে। মীর জাফর যদি শুধু নওয়াব হতে চাইতেন তবে পলাশীর নাটকের প্রয়োজন হত না। কারণ সমগ্র রাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনীর বিপুল সংখ্যাধিক অংশ ছিল তার সঙ্গে। সুতরাং পলাশীর তাৎপর্য আরও গভীরে নিহিত।

পলাশী যুদ্ধের পূর্বে মীর জাফর ক্লাইভের সঙ্গে গোপন চুক্তির ভিত্তিতে যে বিপুল পরিমাণ ছাড় দেন তা থেকেও নওয়াবী রাষ্ট্রের প্রধান অংশের মনোভাব বোঝা যায়। বস্তুত যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের পক্ষে এ ধরনের চুক্তি এবং পলাশী যুদ্ধের ফলাফল এবং তাৎপর্য কী হতে পারে তা পুরোটা না হোক একেবারে না বোঝার কারণ নেই। সুতরাং মীর জাফর এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অজ্ঞতা বা মূর্খতা প্রসূত এ কথা মনে করাও যুক্তিযুক্ত নয়।

এটা স্পষ্ট যে নওয়াবী রাষ্ট্রের প্রধান বা বৃহত্তর অংশ স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এবং কমবেশী ফলাফল বুঝে পলাশীর নাটক মঞ্চস্থ করেছিল যাতে করে ইংরেজদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে। হয়ত তাদের একটা আশা ছিল যে, মূল ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে গেলেও তারা তাদেরকে একেবারে বঞ্চিত করবে না, বরং তাদেরকে ক্ষমতার গৌণ অংশীদার হিসাবে হলেও রেখে দিবে। সেটা ইংরেজরা কিছু কাল রাখলেও শেষ পর্যন্ত রাখে নি। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর বক্সারে মীর জাফরের জামাতা এবং নওয়াব মীর কাসিমকে পরাজিত করে সমস্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা ইংরেজরা করায়ত্ত করে। এরপর ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ দিল্লীর নামে মাত্র সম্রাটের নিকট থেকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দিউয়ানী সনদ লাভ করে উপনিবেশিক ব্রিটিশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে চূড়ান্ত এবং বৈধ রূপ দান করেন।

যাইহোক, এ দেশের পরবর্তী ইতিহাসের কিছু জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের জন্য পলাশীর তাৎপর্য বোঝা জরুরী। মুসলিম রাষ্ট্রশক্তির প্রধান বা বৃহত্তর অংশের এ ধরনের আচরণের পিছনে নিশ্চয় কোন গুরুতর কারণ আছে যে জন্য তারা বিদেশী-বিধর্মী ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর উদ্দেশ্যে পলাশীর মঞ্চে একটি নাটক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের নওয়াবকে বলি দেয়।

এই ঘটনার তাৎপর্য বোঝার জন্য আমাদের মধ্যযুগে বাংলায় মুসলিম শাসনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা দেখতে পাই যে ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম তুর্কী আক্রমণকারী বখতিয়ার খলজীর বাংলা জয়ের পর থেকে যে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তার বহিরাগত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য প্রবল রূপে বিদ্যমান থেকেছে। অধিকাংশ সময় চেপে থেকেছে দিল্লীর সুলতান বা সম্রাটদের শাসন। আর যখন কোন শাসক স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তখন তার স্থায়িত্ব এবং স্থিতিশীলতা যথেষ্ট সীমাবদ্ধ এবং ভঙ্গুর থেকেছে। মোগল শাসনের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত নামে সুবেদার বা প্রদেশপাল কিন্তু কার্যত স্বাধীন নওয়াবদের শাসনও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৭২৭ খ্রীষ্টাব্দে নওয়াব মুর্শিদ কুলী খানের মৃত্যুর পর তাঁর জামাতা নওয়াব সুজাউদ্দীন খান বাংলা-উড়িষ্যার নওয়াব হন। ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র সরফরাজ খান নওয়াব হন। কিন্তু ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর অধীনস্থ বিহারের নাযিম আলীবর্দী খান তাঁকে আক্রমণ ও নিহত করে সিংহাসন দখল করেন। ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দে আলীবর্দীর মৃত্যু হলে তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা নওয়াব হন এবং ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পলায়নকালে ধৃত ও নিহত হন।

অবশ্য শাসক বা রাজবংশের স্থায়িত্বের চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গোটা মুসলিম শাসন ব্যবস্থার বহিরাগত ও বহিরারোপিত বৈশিষ্ট্য। বস্তুত রাষ্ট্রের এই বহিরাগত এবং বহিরারোপিত চরিত্রের মধ্যে যে এখানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ঘন ঘন শাসক বা রাজবংশ পরিবর্তনের অন্যতম উৎস নিহিত ছিল সে কথা মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। কখনও কোন রাজবংশ (যেমন ইলিয়াস শাহী বংশ) কিছু দীর্ঘস্থায়ী হলেও রাষ্ট্রযন্ত্রটি সর্বদা সচল থাকত প্রধানত অব্যাহত ধারায় আসা বিদেশী মুসলমানদের অংশগ্রহণ দ্বারা। বিশেষত সেনা ও প্রশাসনের উচ্চ পদগুলি বহিরাগতরা পূরণ করত। ফলে রাষ্ট্র থাকত মূলত অব্যাহত ধারায় আগত বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণে। নওয়াবী রাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম ছিল না। এই অবস্থায় শাসন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার দেশীকরণ ছিল শ্রেণীগতভাবে এই শাসকদের স্বার্থ বিরোধী।

দীর্ঘ দিন এক রাজবংশ শাসন করলে রাষ্ট্রযন্ত্রে দেশজ কিংবা একাধিক প্রজন্ম ধরে দীর্ঘকাল বসবাসের মধ্য দিয়ে দেশী হয়ে পড়া মুসলমানদের অংশগ্রহণ এবং প্রাধান্য লাভের সুযোগ যেমন বৃদ্ধি পায় তেমন দীর্ঘকাল যাবৎ প্রতিবেশী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদেরও রাষ্ট্রযন্ত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। এই বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাই দিল্লীতে কখনও কোন ধর্মান্তরিত অথবা স্থানীয় ভারতীয় মুসলমানকে সিংহাসনে বসতে দেওয়ায় হয় নি এবং যদি কখনও এমন কেউ দিল্লীর সিংহাসন দখলে সমর্থ হয়েছে তবে তাকে বহিরাগত মুসলমান সেনাধ্যক্ষরা সত্বর একজোট হয়ে হত্যা করেছে এবং পুনরায় বহিরাগত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। অবশ্য দিল্লীতে মোগল বংশসহ কয়েকটি কম অথবা বেশী দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, যা রাষ্ট্র ব্যবস্থার তুলনামূলক স্থিতিশীলতার পরিচায়ক। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বহিরাগত রূপটি সর্বাবস্থায় অব্যাহত থেকেছে।

দিল্লী তথা উত্তর ভারতের বহিরাগত মুসলিম শাসনের অংশ হিসাবে বাংলায় শেষ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত বংশগত নওয়াবী শাসনে অস্থিতিশীলতা এবং ঘন ঘন পরিবর্তন লক্ষণীয়। বোঝা যায় যে এর একটি প্রধান কারণ নওয়াবী শাসন ব্যবস্থা যে বহিরাগত চক্রের অংশগ্রহণ ও সমর্থনের উপর দাঁড়িয়েছিল মূলত তারা ছিল এই ধরনের শাসন তথা রাজবংশের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও স্থিতির বিরোধী।

একটু পূর্বে দেওয়া ব্যাখ্যা থেকে কারণটা বোধগম্য হয়। এক বা দুই প্রজন্ম পর এ দেশে যাদের জন্ম ও লালন হত স্বাভাবিকভাবে তারা এ দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির কম-বেশী কাছাকাছি হত। নওয়াব সরফরাজের জন্ম এ দেশে। রাষ্ট্রের উপর তলায় চক্রান্তের মাধ্যমে তাঁর কর্মচারী বহিরাগত আলীবর্দী খান সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু বহিরাগত এবং নিষ্ঠাবান মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও নওয়াব আলীবর্দী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদের সমর্থন ও আনুগত্য লাভের জন্য তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানে, যেমন হোলি খেলায়, যোগ দিতেন। নওয়াব আলীবর্দীর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ও লালন এ দেশে। সুতরাং বাংলার মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর নৈকট্য অর্জন ছিল সহজতর এবং অধিকতর স্বাভাবিক। এই বাস্তবতা নিশ্চয় শাসন ক্ষমতার বিভিন্ন স্তর ও ক্ষেত্রে অধিষ্ঠিত বহিরাগত মুসলিম চক্রের অনুকূল ছিল না।

আসলে কালটা ছিল একদিকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু জনগণের জাগরণের, অপর দিকে হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে সংমিশ্রণ ও সমন্বয় সাধনের। মোগল শাসনের শেষ দিকটাতে মহারাষ্ট্রে মারাঠা এবং পাঞ্জাবে শিখ উত্থান মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকেই শুধু ধ্বংস করে নি, উপরন্তু ভারতবর্ষে বহিরাগত মুসলিম শাসনের জীবনী শক্তিকেও নিঃশেষ করে। এ ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের শিখ উত্থান ছিল এই অর্থে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ যে, সাধারণত পাঞ্জাবের উপর দিয়ে মধ্য এশিয়া ও মধ্য-প্রাচ্য থেকে মুসলমানরা অব্যাহত ধারায় এসে ভারতবর্ষে বহিরাগত মুসলিম শাসনের ধমনী ও শিরায় যে নূতন রক্ত সঞ্চালন করত পাঞ্জাবে শিখ উত্থান বহিরাগত মুসলিম আগমনের পথটিকে কেটে ফেলে সেই রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দেয়। বহিরাগত মুসলমানদের আগমন প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতির তখন ধ্বংস ও পরিবর্তন অথবা রূপান্তর ছিল অনিবার্য। সেই ঘটনা দূরবর্তী বাংলায় ঘটা ছিল আরও স্বাভাবিক।

সম্ভবত এই রকম পরিস্থিতিতে বাংলায় বহিরাগত মুসলিম শাসক চক্র ছিল আতঙ্কিত। একদিকে ছিল মারাঠা আক্রমণের চাপ। অপর দিকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভিতর থেকে নূতন শক্তির উত্থান সম্ভাবনা কিংবা মুসলিম শাসক শ্রেণীরই একাংশ কর্তৃক ধর্মীয়-সামাজিক সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে নূতন ধারায় রাষ্ট্র কাঠামোর রূপান্তর সাধন এই বহিরাগত চক্রের স্বার্থ-বিরোধী ছিল।

সুতরাং এটাই যুক্তিসঙ্গত যে বহিরাগত মুসলিম চক্র আর এক দল বহিরাগত বণিক ইংরেজদের সঙ্গে নিজ স্বার্থের ঐক্য খুঁজে পেয়েছিল। সুতরাং দুই বহিরাগত শক্তির ঐক্যের মাধ্যমে দেশজ ধারায় নওয়াবী রাষ্ট্রের বিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতীক সিরাজউদ্দৌলাকে বলি দেওয়া হল। ইতিপূর্বে বলেছি যে, মীর জাফর নওয়াব হতে চাইলে সেটা তিনি এককভাবেই সহজে হতে পারতেন। কারণ রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী তার পক্ষে চলে গিয়েছিল। বস্তুত বহিরাগত মুসলিম শাসক-প্রশাসক চক্র তাদের বহিরাগত গোষ্ঠী বা শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার জন্য উদীয়মান ও বিদেশী ইংরেজ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল এভাবে দেখা ছাড়া পলাশীর নাটক অনুষ্ঠানের আর কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।

বহিরাগত মুসলিম চক্রের আচরণের না হয় একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়; কিন্তু এখানকার হিন্দু রাজপুরুষ কিংবা পদস্থ ব্যক্তিদের একই রকম আচরণের ব্যাখ্যা কী হবে? মুসলমান সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়ায় এরাই তো তখন বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা। এরাও প্রায় সকলে মীর জাফর এবং ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলালো কেন?

বস্তুত এই ঘটনার সঠিক উপলব্ধি ব্রিটিশ শাসনকালে হিন্দু সমাজ ও মধ্যবিত্তের দুর্বলতা ও সমস্যা বুঝতে আমাদেরকে বিরাটভাবে সাহায্য করবে। ফলে এটা আজকের ভারত রাষ্ট্রে অবস্থিত পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী সমাজ ও মধ্যবিত্তের দুর্বলতার জায়গাগুলোকেও চিনতে ও বুঝতে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্য করতে পারে। শুধু তাই নয়, এটা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র বাঙ্গালী জাতিসত্তার কিছু অভিন্ন দুর্বলতামূলক বৈশিষ্ট্য এবং সেগুলোর কারণ বুঝতেও অনেকখানি সাহায্য করতে পারে। সুতরাং এই বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করা উচিত হবে।

 

ভূ-প্রকৃতির প্রভাব

হিন্দু ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নদী বিধৌত বাংলার কিছু ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মিলিত হয়ে এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করেছিল যে, হিন্দুদের পক্ষে এ দেশে বৃহদায়তনে রাষ্ট্র সংগঠন প্রায় অসম্ভব ছিল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশ ছিল দীর্ঘস্থায়ী রাজবংশ (আনুমানিক ৭৫৬ খ্রীঃ থেকে ১১৬১ খ্রীঃ)। তবে উত্তর বঙ্গের গৌড় তার রাজধানী হলেও এবং বাংলা-বিহারের বৃহত্তর অঞ্চলব্যাপী তার রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হলেও বিহারের একাংশ, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং উত্তরবঙ্গ ছিল পাল রাষ্ট্রের মূল ভূমি।

বৌদ্ধ পাল শাসনের শেষ পর্যায়ে হিন্দু সেন রাজবংশের উত্থান শুরু হয়। বাংলায় ১২০৪-এ বখতিয়ার খলজী কর্তৃক সেন রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী নবদ্বীপ জয় পর্যন্ত সময়কে ধরলে ১০৯৮ থেকে ১২০৪ এই প্রায় একশত বৎসর ছিল সেন শাসন কাল। সাধারণভাবে মনে করা হয় সেন আমলে হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা তথা বর্ণজাতিভেদ প্রথা বাংলার হিন্দু সমাজে দৃঢ়মূল হয়। অনুমান করা চলে আদি বাঙ্গালী সমাজের হিন্দুয়ায়ন আরও পূর্বে অন্তত পাল রাজবংশের শেষ দিক থেকেই শক্তি ও বিস্তার লাভ করে। যদি তা হয়ে থাকে তবে বৌদ্ধ পাল শাসন উচ্ছেদ এবং হিন্দু সেন শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল একটা সামাজিক গতিধারার অনিবার্য রাজনৈতিক পরিণতি লাভ। এরপর যে কোন বৈদেশিক আক্রমণে বাংলার রাষ্ট্র কাঠামোর ভাঙ্গন ও পতন ছিল সময়ের ব্যাপার। বহিরাগত প্রবল মুসলিম আক্রমণকারীরা এই অনিবার্য ঘটনাটি সম্পন্ন করেছে মাত্র।

বস্তুত ‘জাত-পাতের’ অজস্র ভাগে ভাগ হয়ে থাকা হিন্দু সমাজের পক্ষে এমনিতেই বৃহৎ কোন সামাজিক কর্মসাধনা করা সুকঠিন। কারণ প্রায় অপরিবর্তনীয় জন্মগত মর্যাদা ও কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অজস্র কুঠরি বা গোষ্ঠীতে আবদ্ধ গোষ্ঠী সংঘ স্বরূপ হিন্দু সমাজের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত হয়ে দাঁড়ানো ছিল অসম্ভব। এই অবস্থায় পূর্ববর্তী শক-হূন ইত্যাদি বহিরাগত হানাদারদের পথ অনুসরণ করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে মধ্য এশিয়ার মুসলিম হানাদাররা। তাদেরই একটা ঢেউ প্রবেশ করে বাংলায়।

জাত-পাতের অজস্র বিভাজনের কারণে এমনিতেই দুর্বল হিন্দু সমাজকে আরও অনেক বেশী দুর্বল করেছিল বাংলার অজস্র নদী-খাল-বিল-জলা এবং বর্ষা-বন্যার প্রভাবে সমাজ বিন্যাসের শিথিলতা এবং অব্যাহত নদী ভাঙ্গনের প্রভাবে সমাজের অবিরাম ছত্রভঙ্গ এবং অস্থিতিশীল হবার প্রবণতা। বিশেষত নদী ভাঙ্গন চিরকাল বাংলার জন্য এক বৃহৎ সমস্যা হয়ে থেকেছে। সাম্প্রতিক কালে বাঁধ, সেতু, সড়ক ইত্যাদি নির্মাণের কারণে এবং বৃষ্টিপাত হ্রাসের কারণেও অতীতের মত নদী ভাঙ্গন প্রকট না হলেও ব্রিটিশ শাসন কালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এটা ছিল বাংলার এক বৃহদাংশের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

বস্তুত বাংলা হচ্ছে অসংখ্য ব-দ্বীপের সমষ্টি স্বরূপ এক বৃহৎ ব-দ্বীপ। দেশী ভাষায় এটাকে এক বৃহৎ চরও বলা যায়, যা হাজার হাজার বৎসর ধরে অসংখ্য চরের সমাহারে গঠিত হয়েছে। শত শত বা হাজার হাজার বৎসর ধরে চর গঠন ও ভাঙ্গন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ক্রমে সমুদ্রের ভিতর অগ্রসর হয়ে ভূমি গঠন করছে। নদী স্রোতের প্রবাহে পুরাতন তীর এবং চরের ভাঙ্গন ও নিমজ্জন এবং নূতন তীর এবং চরের জাগরণ ও গঠনের মাধ্যমে বাংলার ভূমি বিন্যাস অবিরাম বদলেছে।

আজও বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী জেলাগুলোতে আমরা এই পরিবর্তন ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখি। কিন্তু দেড় বা দুই শত বৎসর পূর্ব পর্যন্ত পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের কিছু জেলা বা অঞ্চল বাদে উভয় বাংলার বেশীর ভাগ অঞ্চল ছিল নদী ভাঙ্গন ও চর গঠন প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত। এক কালে পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর অঞ্চলে অবস্থিত তাম্রলিপ্তি ছিল বিখ্যাত বাণিজ্য বন্দর, যা নদীখাত পরিবর্তনের ফলে পরিত্যক্ত ও বিলুপ্ত হয়।

মোট কথা নদী-জলার বাহুল্য, বাৎসরিক বন্যা ও নদী ভাঙ্গন ইত্যাদি কারণে বাংলার সমাজ ছিল অস্থিতিশীল। পশ্চিম বঙ্গের মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম ইত্যাদি কয়েকটি জেলা বাদে বৃহৎ বঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলে গ্রাম এবং শহরগুলো সুষ্ঠু পরিকল্পনা মাফিক এবং ঘনবদ্ধ বা নিবিড়ভাবে গড়ে উঠতে পারত না। বসতিসমূহ হত ছাড়া ছাড়া বা এলোমেলো এবং নদী ভাঙ্গনের দরুণ অস্থিতিশীল। নদীর খাত পরিবর্তন ও ভাঙ্গনের দরুণ বাংলার ব্যাপক অঞ্চলে কোন গ্রাম বা শহরের হাজার বছর দূরের কথা কয়েক শত বৎসর স্থায়ী হওয়াও ছিল দুর্ঘট ব্যাপার।

এমন অবস্থায় বাঙ্গালীর সমাজ সংগঠনে দুর্বলতা ছিল স্বাভাবিক।* বিশেষত বৃহৎ সমাজ সংগঠন স্বরূপ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এই অবস্থা ছিল প্রতিকূল। এর ফলে বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠনে বহিরাগতদের কিংবা বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ প্রায়শ নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে আমরা এই অবস্থা দেখি। প্রাচীন যুগের সেন বংশ ছিল কর্ণাটক থেকে আগত। তারও পূর্ববর্তী পালদের রাজধানী বাংলায় হলেও তাদের উদ্ভবে আদি বাঙ্গালীদের ভূমিকা কতটুকু ছিল তা বলা কঠিন। কারণ তাদের রাষ্ট্রের মূল বা কেন্দ্রীয় ভূমি ছিল উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বঙ্গ এবং তৎসংলগ্ন বিহারের দক্ষিণাংশ বা মগধ অঞ্চল। হতে পারে যে তাদের রাষ্ট্র গঠনের মূল শক্তি সরবরাহ হয়েছিল বিহার থেকে।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* বাংলাদেশের সমাজ সংস্থার ঐতিহাসিক দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতার পিছনে নদী ও ভূ-প্রকৃতির প্রভাব সম্পর্কে আকবর আলী খান তাঁর Discovery of Bangladesh: Explorations into dynamics of a Hidden Nation নামক গ্রন্থে মূল্যবান আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ (ইউপিএল) কর্তৃক ১৯৯৬-তে প্রকাশিত।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------

বস্তুত এমন একটি ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে বর্ণজাতিভেদের জটিলতা ও খণ্ড-বিখণ্ডীকরণ মিলিত হয়ে হিন্দু বাঙ্গালীর জন্য রাষ্ট্র সাধনাকে প্রায় অসম্ভব করে রেখেছিল। প্রকৃতপক্ষে শুধু বর্ণজাতিভেদের প্রাবল্য তথা বহু ভাগে সমাজের বিভক্তি রাষ্ট্র সাধনা তথা রাষ্ট্র সংগঠন কার্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট। এই কারণে যেখানে হিন্দু সমাজ বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘জাত’ (caste) বা বর্ণজাতিতে বিভক্ত থেকেছে সেখানে অতীতেও হিন্দুদের মধ্যে কোন কার্যকর রাজনৈতিক আন্দোলন হয় নি।

পাঞ্জাবে শিখ ধর্ম-সম্প্রদায় এবং মহারাষ্ট্রে মারাঠা জাতির উত্থানের দিকে দৃষ্টি দিলেও আমরা বুঝতে পারব একটি কার্যকর রাষ্ট্র গঠনে অভ্যন্তরীণভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত একটি অভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির গুরুত্ব কতখানি। শিবাজীর সময়ে মহারাষ্ট্রে মূলত দুইটি বর্ণজাতি বা জাত ছিল। একটি ব্রাহ্মণ এবং অপরটি মারাঠা। ব্রাহ্মণরা ছিল অত্যন্ত সংখ্যালঘু। বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মারাঠারা ছিল শূদ্র। সুতরাং মারাঠারা ছিল একটি সুবৃহৎ বর্ণজাতি। এরা ছিল তখন অনেকটা উপজাতীয় পর্যায়ে। তারা ছিল কৃষক এবং পশুপালক। অনেকে ছিল অর্ধ-যাযাবর। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর শিবাজীকে ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির মর্যাদা দান করলেও শিবাজী ছিলেন মারাঠা, সুতরাং শূদ্র। যাইহোক একটা বৃহৎ ও অভিন্ন বর্ণজাতি বা গোষ্ঠীতে মারাঠাদের অবস্থানের ফলে শিবাজীর পক্ষে তাদের নিয়ে একটি বৃহৎ ও কার্যকর রাজনৈতিক আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংগঠন করা সম্ভব হয়েছিল। 

পাঞ্জাবেও ঘটনাটা অনুরূপ ছিল। সেখানে জাঠ জনগোষ্ঠী ছিল মূলত এক বৃহৎ বর্ণজাতি। বলা হয় এরা এক কালের দুর্ধর্ষ হূন অভিযানকারীদের বংশধর। জাঠ কৃষকরা শিখ ধর্মীয় আন্দোলনের মেরুদণ্ড গঠন করে। ইতিপূর্বে এ কথা আমাদের আলোচনায় এসেছে যে, একটা বৃহৎ সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠনের জন্য এই ধরনের বৃহৎ ও মোটামুটি সমধর্মী ও অখণ্ড বা অবিভাজ্য জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। এদের মধ্যে একত্র আহার, বিবাহ, সহজ ও জীবন্ত সামাজিক যোগাযোগ ও লেনদেন থাকায় যে কোন ধরনের বৃহৎ সামাজিক কর্ম সংগঠন করা সম্ভব বা সহজতর হয়।

এ কথাও ইতিপূর্বে বলেছি যে, বাংলার ভূমির চইরা এবং ভাঙ্গন প্রবণ বৈশিষ্ট্যের জন্য এমনিতে এখানে অতীতে ভিতর থেকে সুদীর্ঘ কাল যাবৎ সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠন করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে ছিল। তার উপর হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতিভেদমূলক বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ায় এটা সহজবোধ্য যে, বাংলার হিন্দুরা বহিরাগত মুসলিম চক্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরা স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখে নি। বরং তারা প্রভু পরিবর্তনে লাভ দেখেছিল।

এ ক্ষেত্রে কলকাতায় ইংরেজদের বাণিজ্য কুঠীকে কেন্দ্র করে যে বসতি বা শহর গড়ে উঠেছিল তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ঐ সময় কলকাতা ছিল দ্রুত বর্ধিষ্ণু। বিশেষত মারাঠা আক্রমণ ও লুণ্ঠন থেকে আত্মরক্ষার জন্য পশ্চিম বঙ্গের অনেক বিত্তবান কলকাতায় আশ্রয় নিতে শুরু করেছিল। একদিকে মারাঠা আক্রমণ মোকাবিলায় ইংরেজদের উন্নততর সামরিক প্রস্তুতি এবং অপরদিকে ইংরেজদের উন্নততর প্রশাসন, বিচার এবং শান্তি-শৃঙ্খলার কারণে বাংলার বিত্তবানদের অনেকে কলকাতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। মোট কথা কলকাতায় ইংরেজদের অবস্থান দুর্নীতিগ্রস্ত, অত্যাচারী এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ নওয়াবী রাষ্ট্রের একটা উন্নততর বিকল্প এ দেশের মানুষের সামনে উপস্থিত করে। স্বাভাবিকভাবে, প্রভু পরিবর্তনের দিক থেকে বিচার করলে হিন্দুদের জন্য ইংরেজদের হাতে নওয়াবী রাষ্ট্রের পতনে হারাবার কিছু ছিল না।

এটা ঠিক যে পুরাতন রাষ্ট্রের পরিবর্তনে উপরতলার মুসলমানদের মত উপর তলার হিন্দুদেরও অনেকে অনেক কিছু হারালো। কিন্তু হিন্দু সমাজের এক বৃহৎ অংশের জন্য ঘটনাটা লাভজনক হল। ফার্সীর পরিবর্তে ইংরাজী শিখে হিন্দুরা এবার ইংরেজ শাসকদের ভাল কেরানী ও কর্মচারী হল। ইংরেজদের বাণিজ্যিক দালালী বা মুৎসুদ্দিগিরি করে যারা প্রচুর অর্থ-বিত্ত করল তাদের অনেকে নূতন জমিদারী ব্যবস্থায় অর্থ বিনিয়োগ করে জমির মালিক অর্থে জমিদার হল। এভাবে হিন্দু বাঙ্গালীর উদ্যোগ কেরানীর চাকুরী ও জমিতে স্থানান্তরিত হল। দু’টোই হল প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন সম্পর্ক বিযুক্ত। জমিদার যারা হল তারাও জমির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগের পরিবর্তে অলস খাজনা ভোগীতে পরিণত হল। জমিদারদের এক বৃহদাংশ কলকাতায় বাড়ী করে সেখানেই বসবাস করতে থাকল। খাজনা আদায় করা ছাড়া জমি ও কৃষক প্রজাদের প্রতি তাদের অনেকেরই আর কোন দায়-দায়িত্ব বোধ রইল না।

এই সময়টাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা হারানো বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর রূপান্তর শুরু হয়। তারা দেশী ধর্মান্তরিত মুসলমানদের নিকটবর্তী হল এবং উভয়ের মধ্যে মিশ্রণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হল। দেশী মুসলমানরা আগে ছিল আধা হিন্দু, আধা মুসলমান। বহিরাগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা হারিয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে এদের ইসলামীকরণের উপর গুরুত্ব দিল। সুতরাং শুরু হল ওয়াহাবী-ফরায়েজী ইত্যাদি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন।

রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে একটা পর্যায় পর্যন্ত ইংরেজ বিরোধিতা ও বিদ্বেষ ছিল স্বাভাবিক। ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনগুলিতে আমরা এর রাজনৈতিক প্রকাশ দেখতে পাই। অবশ্য ইসলাম মূলত রাজনৈতিক ধর্ম হিসাবে উত্থান ও প্রসার লাভ করায় ইসলামীকরণ আন্দোলনের ইংরেজ শাসন উচ্ছেদকামী প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না।

তবে এটা লক্ষণীয় যে বাংলায় ইংরেজ শাসন বিরোধী আন্দোলন উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মত তীব্র ছিল না। তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা কিংবা হিন্দু সন্ন্যাসী ও মুসলমান ফকিরদের বিদ্রোহ ইত্যাদি ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে বাংলা তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। ১৮৫৭ সালে ভারত ব্যাপী যে সিপাহী বিদ্রোহ হয় তাতে বাংলার অধিবাসীদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিল না বলাই ভাল। ঢাকায় যে সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছিল তারা ছিল পশ্চিম অথবা উত্তর ভারতীয়।

প্রকৃতপক্ষে বাংলার ভূ-প্রকৃতি বাঙ্গালী চরিত্রে যে কতিপয় নিকৃষ্টতা সঞ্চার করেছিল তার একটা হল ভীরুতা এবং অপর একটা হল শক্তিমানের বশ্যতা ও দালালী। বাঙ্গালীর ইতিহাসে বৃহত্তর রাষ্ট্র সংগঠন তাই যেমন খুব কম দেখা যায় তেমন তার বীরত্বের ইতিহাসও খুব কম। যাদের নিয়ে গর্ব করা হয় তাদের অধিকাংশ ছিল বহিরাগত। যেমন ঈসা খাঁ। কিন্তু এ দেশে বসবাসের কয়েক প্রজন্ম পর তাদের বংশধরদের বীরত্বও হীনতা প্রাপ্ত হত।

বাঙ্গালীর ইতিহাসে বৃহৎ রাষ্ট্র সংগঠনের পরিবর্তে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ এলাকা ভিত্তিক অস্থিতিশীল জমিদারী বা রাজ্যের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। যেমন ছিল মোগল যুগে বারো ভূঁইয়া। এই ভূঁইয়ারাও একজোট হয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে বরং নিজেদের ভিতর দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধেই বেশী আগ্রহ বোধ করত। আসলে বাঙ্গালীর চেতনা ছিল খুবই সংকীর্ণ, স্থানিক এবং অস্থিতিশীল। সুতরাং বৃহৎ আয়তনে রাষ্ট্র গঠন ও যুদ্ধের পরিবর্তে স্থানীয় দলাদলি ও চর দখলের কাজিয়ার মধ্যে সাংগঠনিক মেধা ও সমর স্পৃহার পরিণতি ঘটত।

চর দখলের কাজিয়া ছিল নদী বিধৌত বাংলার ব্যাপক অস্থিতিশীল অঞ্চলের প্রতি বৎসরের নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু এইসব কাজিয়াও হত স্বল্পকাল স্থায়ী এবং স্বল্প লোক ক্ষয়কারী। সামান্য কিছু জখম ও প্রাণহানির পর এক পক্ষের জয়-পরাজয়ের মাধ্যমে কাজিয়ার সমাপ্তি ঘটত এবং জয়ী পক্ষ চরের দখল নিত। কিন্তু পরাজিত পক্ষ চর দখলের জন্য সচরাচর আর চেষ্টা করত না। এটা আজও চরের কাজিয়ার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

এর কারণ সমাজ সংস্থা বা কর্তৃত্বের অস্থিতিশীলতা বা দুর্বলতার পাশাপাশি চরের অস্থায়িত্ব বা অস্থিতিশীলতা। এক সময় ঐ চরও না থাকতে পারে অথবা দূরবর্তী নদী তীরে বা মাঝে নূতন চর জাগবে। সুতরাং অস্থিতিশীলতার মাঝে বেড়ে ওঠা বাঙ্গালী কোন কালে সাধারণত খুব বেশী ঝুঁকি নিতে কিংবা প্রাণপাত করতে রাজী নয়। আর তাই তাৎক্ষণিকতা ও মুহূর্তের আবেগ-উত্তেজনা সরে গেলে সাধারণ বাঙ্গালী চিরকালই নূতন স্থিতি ও নির্বিরোধ জীবনের মধ্যে আশ্রয় খোঁজ করে। তবে সেটাও তার অস্থায়ী। আর তাই অস্থিতিশীল বাঙ্গালী চরিত্রে এত স্ব-বিরোধ ও অস্থিরতা এবং তার আচরণে এত অনিশ্চয়তা বা unpredictability.

 

হিন্দু মধ্যবিত্তের উত্থান

ইংরেজ শাসন কালে বাংলার সনাতন সমাজ ও ভূ-প্রকৃতি উভয় ক্ষেত্রেই যুগান্তকারী পরিবর্তন সূচিত হল। রেল লাইন, সেতু, বাঁধ, রাজপথ নির্মাণ নদীগুলির পূর্বের প্রমত্ততা এবং অবাধ গতির উপর মানুষের প্রবল হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ ঘটালো। ফলে বৃহৎ অঞ্চল ব্যাপী গ্রাম ও শহরগুলো তথা জন-বসতি পূর্বের তুলনায় স্থিতিশীল হতে থাকল। অপর দিকে নগরায়ন ও আধুনিক শিক্ষার বিস্তার একটি আধুনিক মধ্য শ্রেণীর উত্থান ঘটালো। কলকাতাকে কেন্দ্র করে এবং প্রধানত হিন্দু জমিদারদের নেতৃত্বে বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের এই উত্থান শুরু হয়। রামমোহন (১৭৭২ খ্রীঃ-১৮৩৩ খ্রীঃ), বিদ্যাসাগর (১৮২০ খ্রীঃ-১৮৯১ খ্রীঃ) থেকে রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১ খ্রীঃ-১৯৪১ খ্রীঃ) পর্যন্ত একটা কালপর্ব হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের জন্য স্বর্ণযুগ স্বরূপ ছিল।

এটা লক্ষণীয় যে এই কালপর্বে ধর্ম সংস্কার ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন যতটা গুরুত্ব পেয়েছিল রাজনৈতিক আন্দোলন ততটা গুরুত্ব ও জন-ভিত্তি পায় নি। মধ্যবিত্তের মধ্যে অধিকার আদায়ের রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠলেও তার আপসমুখিতা ও সংস্কারবাদ ছিল প্রধান দিক। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলে হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে বিপ্লবী চিন্তা বিস্তার লাভ করতে থাকলেও তা ছিল সীমিত। নির্বাচনমুখী ও সংস্কারমূলক রাজনৈতিক আন্দোলনের বাইরে হিন্দু সমাজ ও মধ্যবিত্তের আন্দোলন সাধারণভাবে যেতে পারে নি। এর প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতার জন্য অধিকতর অগ্রগামী বিপ্লবী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদের দিকে চালিত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। একটি বিপ্লবী যুব গণ-অভ্যুত্থানের চরিত্র নিয়ে ১৯৩০-এ চট্টগ্রামে সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও গেরিলা যুদ্ধ। কিন্তু তা ছিল হঠাৎ জ্বলে উঠে নিভে যাওয়া আগুনের মত ক্ষণস্থায়ী ঘটনা। এতে কার্যকরভাবে জনগণের অংশগ্রহণ ঘটে নি।

ব্রিটিশ শাসন কালে হিন্দু বাঙ্গালী সমাজ যে দুইজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতার জন্ম দিয়েছিল তাদের একজন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং অপর জন সুভাষ চন্দ্র বসু। চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনীতি বিপ্লবী না হলেও তিনি ছিলেন মূলত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী। বাঙ্গালী জাতির ঐক্যের প্রয়োজনে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির উপর তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন এবং তৎকালীন পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণে তাঁর উদ্যোগ তাঁকে মুসলমান বাঙ্গালীদের নিকট জনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু ১৯২৫ সালে তাঁর অকাল মৃত্যু হিন্দু-মুসলমান বাঙ্গালীর ঐক্যের প্রচেষ্টাকে আর বেশী দূর এগোতে দেয় নি।

এর পর যে বাঙ্গালী নেতা বিশাল সম্ভাবনা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে আবির্ভূত হন তিনি হলেন সুভাষ চন্দ্র বসু (১৮৯৭ খ্রীঃ-১৯৪৫ খ্রীঃ)। তিনি এক সময় কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলেও গান্ধীর বিরোধিতায় টিকতে পারেন নি। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস বিমুখ এবং গান্ধী তথা কংগ্রেস নেতৃত্বের নরমপন্থা-বিরোধী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে বন্দী অবস্থা থেকে গোপনে দেশ ত্যাগ করে তিনি জার্মানী হয়ে জাপান যান এবং ভারতকে স্বাধীন করার জন্য জাপানের সাহায্য নিয়ে আজাদ হিন্দ্‌ ফৌজ গঠন করে যুদ্ধ শুরু করেন।

কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে বাংলায় এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে সুভাষ বসু কার্যকর সমর্থন লাভ করেন নি। আজাদ হিন্দ্‌ ফৌজে তাঁর উল্লেখ্য সহকর্মীদের সকলেই ছিলেন উত্তর ও পশ্চিম ভারতের মানুষ। সুভাষ বসু ছিলেন সেকালে বাঙ্গালীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিনিধি। তাঁর ব্যর্থতা ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সেটুকুও শেষ হল। না, তাঁকে ধারণ করার মত সমাজ জমি বাংলায় ছিল না। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষেই এ কথা প্রযোজ্য। বিশেষত হিন্দুদের দুর্বলতা এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। মুসলমানদের তুলনায় শিক্ষায়, সম্পদে অনেক এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও এবং একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাংলা ও বাঙ্গালী জাতিসত্তার নেতৃত্ব তাদের হাতে থাকা সত্ত্বেও কালের চাহিদা পূরণে হিন্দু সমাজ ও তার নেতৃত্বকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণী বলিষ্ঠতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হল। হিন্দু মধ্যবিত্তের পরনির্ভরতা, দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে দাঁড়াবার অক্ষমতা তাকে বাঙ্গালীর জাতি গঠনের রাজনীতির পরিবর্তে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ভিত্তিক রাজনীতির পথে নিয়ে গেল। এ ক্ষেত্রে তারা তাদের তুলনায় পশ্চাৎপদ কিন্তু উদীয়মান বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্তের সহযাত্রী হল। ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে সারা ভারত ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়তে চেয়ে উভয় পক্ষই বাংলা ও বাঙ্গালীকে বিভক্ত করল।

যেটাকে বাংলার রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলা হয় সেটা যে কত ঠুনকো তা ইংরেজ শাসন অবসানে হিন্দু বাঙ্গালীর দ্রুত বিপর্যয়ে প্রমাণিত হল। এই রেনেসাঁর মর্মে রাষ্ট্র চিন্তার পরিবর্তে ছিল সমাজ সংস্কার চিন্তার নিরংকুশ প্রাধান্য। এবং সেখানেও ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী চেতনা ছিল দুর্বল। বঙ্কিমের (১৮৩৮ খ্রীঃ-১৮৯৪ খ্রীঃ) মত যাঁরা রাষ্ট্র চিন্তা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আমরা হিন্দু ধর্মের গভীর প্রভাব দেখতে পাই। ইউরোপের রেনেসাঁর সঙ্গে বাংলার এই রেনেসাঁর পার্থক্য ও বৈপরীত্য লক্ষণীয়। বস্তুত ইউরোপের রেনেসাঁ ছিল স্বাধীন মানুষের বিদ্রোহ, জীবন জিজ্ঞাসা ও জাগরণ সম্ভূত। কিন্তু বাংলায় ব্রিটিশের অনুগত, মোহমুগ্ধ এবং তার উপর নির্ভরশীল হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের রেনেসাঁ ছিল প্রকৃতপক্ষে পরনির্ভর, অন্তঃশক্তিহীন, ফাঁপা এবং অনেকাংশে মেকী বা নকল। এক দুর্বল মধ্যবিত্তের কাছ থেকে সবলতা ও প্রবলতা আশা করা যায় না। তাই ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট ইংরেজের বিদায় এবং বাংলা বিভক্তি হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং সেই সঙ্গে সমগ্র হিন্দু বাঙ্গালী সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়েছিল। বাংলা ভাগের সঙ্গে হিন্দু মধ্যবিত্তের শক্তি ধ্বংস হল।

বাংলা ভাগকেই যদি হিন্দু বাঙ্গালীর সর্বনাশের জন্য দায়ী করা হয় তাহলে ভুল করা হবে। তাহলে পাঞ্জাব ভাগের সঙ্গে পাঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায়ও ধ্বংস হতে পারত। কিন্তু দেশ ভাগের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়াতে শিখদের বেশী সময় লাগে নি। অথচ ইংরেজ শাসনের আশ্রয়চ্যুত হলে রাষ্ট্র সাধনা বিহীন বাঙ্গালী হিন্দু মধ্যবিত্তের পক্ষে ধাক্কা সামলানো সম্ভব হয় নি। তাদের প্রভু পরিবর্তনের দরকার ছিল। এবার তারা ইংরেজের পরিবর্তে হিন্দীভাষীদের আশ্রয় নিল। কিন্তু এতে করে ইংরেজের উপনিবেশ পত্তন কালের সুদিন ফিরে পাওয়া আর সম্ভব ছিল না। প্রকৃতপক্ষে এ শুধু নেতৃত্বের শ্রেণী হিসাবে হিন্দু মধ্যবিত্তের দুর্বলতা নয়, উপরন্তু এটা যে সমাজের সে নেতা সেই হিন্দু সমাজেরও দুর্বলতা।

 

মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান

১৭৫৭-তে যখন ইংরেজরা বাংলা অধিকার করে তখনও বহিরাগত ও দেশী ধর্মান্তরিত মিলিয়ে সকল মুসলমান সংখ্যালঘু। সম্ভবত তখন পর্যন্ত হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানরা অনেক বেশী সংখ্যালঘু ছিল। ইংরেজ শাসন কালে অনুষ্ঠিত প্রথম যে লোক গণনা ১৮৭২ সালে হয় তাতেও আমরা মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু হিসাবে দেখতে পাই। তবে তখন মুসলমানরা হিন্দুদের সমান সংখ্যক হয়ে উঠছে এবং ১৮৮১ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় লোক গণনায় তারা বাংলায় সংখ্যাগুরু ধর্ম সম্প্রদায় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।

মুসলমান জনসংখ্যার এই দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ রাষ্ট্র ক্ষমতাচ্যুত মুসলমানের এই সময় সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ ধর্মান্তরিতকরণ হওয়া সম্ভব ছিল না। একদিকে মুসলমানরা তখন শক্তিহীন ও দিশাহারা, অপর দিকে হিন্দুদের মধ্যে তখন চলছে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন।

সুতরাং মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আমরা ভিন্ন কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে পারি। প্রথমত, ধর্মীয় কারণে হিন্দুদের মত মুসলমানদের মধ্যে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ এবং সন্ন্যাস ব্রত জনপ্রিয় বা গ্রহণযোগ্য ছিল না। উপরন্তু হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান পুরুষদের মধ্যে বহু বিবাহ বেশী প্রচলিত ছিল। এসবের ফলে স্বাভাবিকভাবে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের জনসংখ্যা অধিকতর বৃদ্ধিশীল ছিল।

কিন্তু বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য দ্বিতীয় আর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। সেটি হচ্ছে ’৭৬ (১৭৬৯-’৭০ খ্রীঃ)-এর মন্বন্তর বা মহাদুর্ভিক্ষের আঘাতে বাংলার হিন্দু প্রধান উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলের জনসংখ্যার নিদারুণ হ্রাস প্রাপ্তি। বাংলার মুসলিম প্রধান পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহ যেমন বৃহত্তর বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম এই দুর্ভিক্ষ থেকে অনেকটা রেহাই পায়। ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের মত অনুযায়ী বাংলার তৎকালীন আনুমানিক ৩ কোটি জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ তথা ১ কোটি মৃত্যু মুখে পতিত হয়। প্রকৃত অবস্থা আরও ভয়াবহ হওয়া অসম্ভব নয়। এই দুর্ভিক্ষে উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জনশূন্য ও জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। কোন কোন জেলায় জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে।*

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ’৭৬-এর মন্বন্তর সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুনঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম ও অন্যান্য, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, নওরোজ কিতাবিস্তান, পঞ্চম সংস্করণ, মে ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ৩৭৮-৩৮৬
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------

তৃতীয়ত, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার পশ্চিম ও উত্তর অংশে ভূ-প্রকৃতির দিকে দৃকপাতহীনভাবে রেললাইন নির্মাণের ফলে ব্যাপক অঞ্চলে জলাবদ্ধতার কারণে একটি পরিবেশগত বিপর্যয় সাধিত হয়। ফলে বিশেষত বাংলার উত্তর, মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলে মহামারী আকারে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। দীর্ঘ কাল স্থায়ী এই ব্যাধিতে লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটে। অর্থাৎ ’৭৬-এর মন্বন্তর এবং পরবর্তী সময়ে ম্যালেরিয়ার ব্যাপক প্রকোপ বাংলার পশ্চিম ও উত্তরের প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির ব্যাপক লোক ক্ষয়ের মাধ্যমে হিন্দু জনসংখ্যার নিদারুণ সংখ্যা হ্রাস ঘটায়। মুসলিম সংখ্যাগুরু পূর্ব বঙ্গ এই উভয় বিপর্যয় থেকে অনেকটা মুক্ত থাকে।

চতুর্থ একটি ঘটনা ছিল শুধু মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির নয় সেই সঙ্গে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধিরও খুব বড় একটি কারণ। সেটি হচ্ছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষ করে ব্রিটেনের পাট শিল্পে কাঁচা পাটের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ফলে পাট চাষ বৃদ্ধি। পাট চাষের উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠ জমিগুলো ছিল প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বঙ্গের নদী বিধৌত ও উর্বর জেলাগুলোতে। নূতন নূতন গুলি ও অস্ত্রের আবিষ্কারের ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে যুদ্ধের চিত্র বদলে যেতে থাকে। ইতিপূর্বে বস্ত্র, চট, দড়ি ইত্যাদি তৈরীর জন্য পাটের চাহিদা থাকলেও তা ছিল সীমিত। কিন্তু এখন শত্রুর বুলেটের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য পাটের চট দিয়ে তৈরী বালির বস্তা খুব কার্যকর অথচ অত্যন্ত সস্তা বস্তু হিসাবে প্রমাণিত হওয়ায় এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের চাহিদা ব্যাপকভাবে সৃষ্টি হতে থাকে। ১৯০৫ সালে রাশিয়া ও জাপানের যুদ্ধে পাটের বস্তার ব্যাপক ব্যবহার হলে পাটের চাহিদা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ১৯১৪-’১৮-এর প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পাটের চাহিদা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় বহু গুণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে প্রধানত পূর্ব বাংলার পাটচাষীরা প্রচুর অর্থ উপার্জনের সুযোগ পায়।

এভাবে অর্থ ও উন্নততর জীবনের মান তাদের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধির সহায়ক হল। সর্বোপরি পাট চাষের অর্থ মুসলমান জোতদার, ধনী ও মধ্য কৃষকদের যেমন সামাজিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রত্যয়ী করতে থাকে তেমন তারা তাদের ছেলেদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য স্কুল-কলেজে পাঠাতে শুরু করে।* 

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থানের পটভূমি রচনায় পাট চাষের ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুনঃ আতিউর রহমান ও লেনিন আজাদ, ভাষা আন্দোলনঃ অর্থনৈতিক পটভূমি, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিঃ (ইউপিএল), ১৯৯১।

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------

অবশ্য শুধু পাট চাষ নয় উপরন্তু সামগ্রিকভাবে বাজার অর্থনীতির বিকাশ অধিকতর উর্বর ও কৃষি-প্রধান এবং মুসলিম-প্রধান পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীদের সম্পদ ও সেই সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছিল। ধান, ডাল, সরিষা ইত্যাদি খাদ্যশস্য উৎপাদনেরও প্রধান কেন্দ্র ছিল নদী বিধৌত পূর্ব বঙ্গ। ফলে কলকাতার খাদ্যশস্য সরবরাহের প্রধান উৎসও ছিল পূর্ব বঙ্গ।

সুতরাং নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে কৃষিপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে সর্বাধিক লাভবান ছিল পূর্ব বঙ্গের জোতদার এবং ধনী ও মধ্য কৃষক। এভাবে কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু জমিদার ও মধ্য শ্রেণীর সমান্তরালে প্রধানত পূর্ব বঙ্গ কেন্দ্রিক মুসলমান মধ্য শ্রেণীর উত্থান প্রক্রিয়া বিশেষ শক্তি ও গতি লাভ করতে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রায় প্রথম দিক থেকে। স্বাভাবিকভাবে ব্রিটিশ সরকার এই বাস্তবতাকে ব্যবহার করে তার ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ কর্মনীতিকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল। ফলে ঘটেছিল ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ। মূলত হিন্দু বাঙ্গালীর তীব্র আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হলেও ইতিহাসের গতি ছিল বঙ্গভঙ্গ অভিমুখী। মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যে ঐক্যের বদলে দ্বন্দ্বের দিকটাই প্রধান হয়ে উঠতে থাকে। 

আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তনের প্রথম পর্যায় থেকেই মুসলমানদের সকলে তার প্রতি বিমুখ ছিল এই ধারণা করা ভুল হবে। ইংরাজী এবং আধুনিক শিক্ষা লাভের জন্য স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে অভিজাত কিংবা পূর্ব থেকে শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্য থেকে কেউ কেউ তাদের ছেলেদেরকে সেখানে পাঠাতে শুরু করে। তবে তাদের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে অনেক কম ছিল। এর কারণও পূর্বে বলেছি যে মুসলমানরা শিক্ষায় পূর্ব থেকেই হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল একটা সময় পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে ইংরাজী শিক্ষার প্রতি অনীহা।

কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে পাট ও খাদ্য শস্যের মূল্য লাভের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্য থেকে একটি স্বচ্ছল ভূম্যধিকারী ও কৃষক শ্রেণীর উত্থান ঘটলে শিক্ষার প্রতি আগ্রহে মুসলিম সমাজে নূতন ও প্রবল গতির সঞ্চার হয়। এভাবে মুসলিম অভিজাত বা আশরাফ শ্রেণীর পাশাপাশি সংখ্যাবলে বিপুলভাবে বলীয়ান আতরাফ বা অনভিজাত মুসলমান কৃষকদের মধ্য থেকে একটি নূতন মধ্য শ্রেণীর উদ্ভব ঘটতে শুরু করে।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানদের ভিতর থেকে একটি শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর বিকাশ সহজতর হয়। ফলে মুসলিম মধ্যবিত্তের বিকাশ নূতন শক্তি ও গতি লাভ করে।

হিন্দু মধ্যবিত্তের প্রধান অংশ বা মূল ধারার সঙ্গে এই মধ্যবিত্তের পার্থক্যের দিকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দু মধ্যবিত্তের মূল অংশ যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং ইংরেজদের বেনিয়া-মুৎসুদ্দি, কর্মচারী এবং জমিদারদের মধ্য থেকে এসেছিল সেখানে মুসলিম মধ্যবিত্তের মূল অংশ এসেছিল সরাসরি গ্রাম ও জমির সঙ্গে সংযুক্ত কৃষকদের ভিতর থেকে। এক সময় এই শ্রেণী ছোটলোক বা আতরাফ হিসাবে আশরাফ মুসলমানদের নিকটও ঘৃণিত ছিল। কিন্তু একদিকে বহিরাগত মুসলিম রাষ্ট্রশক্তির পতন এবং অপর দিকে নূতন অর্থনৈতিক অবস্থান এবং আধুনিক শিক্ষার প্রসার এই শ্রেণীর উত্থান ও আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ তৈরী করে দেয়।

এটা ঠিক যে প্রথম দিকে এই শ্রেণী মুসলিম আশরাফদেরকে সামনে রেখেই অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু সেটা সর্বদা অন্ধ অনুসরণ ছিল না। সুতরাং একটা পর্যায় পর্যন্ত মুসলিম লীগ মুসলিম মধ্যবিত্তের ভিতর তেমন জনপ্রিয় ছিল না। বরং ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টি এক সময় মধ্যবিত্তসহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভিতর অধিকতর জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ছিল।

অবশ্য চল্লিশের দশকের শেষ দিকে সাধারণ মধ্যবিত্তসহ সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায় অভিজাত শ্রেণীর দল মুসলিম লীগের পতাকাতলে জমায়েত হয়েছিল। ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টিও জনমতের প্রবল চাপে মুসলিম লীগে যোগ দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এটা ছিল মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে সাধারণ মুসলিম বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের একটা সাময়িক আপস। এটা ছিল হিন্দু জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধিপত্য মুক্ত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপস। সুতরাং ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় অবাঙ্গালী শাসক শ্রেণী এবং বাংলায় বসবাসকারী মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ তাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হল তখন তারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল।

এর প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দূর পাশে বাংলার দাবীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য অপরিমেয়। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙ্গালী উর্দূর পরিবর্তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ইংরাজীর দাবী করতে পারত। কারণ এতদিন সেটাই ছিল রাষ্ট্রভাষা।

উর্দূকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণে আপত্তির কারণ বোধগম্য। কারণ এ ভাষা তদের অপরিচিত এবং এ ভাষায় তারা পশ্চিমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে। কিন্তু ইংরাজীর ক্ষেত্রেও তাদের জন্য ব্যাপারটা খুব ভিন্ন নয়।

তারা বাধ্য হয়ে ইংরাজী শিখতে শুরু করলেও তাদের মধ্যে খুব সামান্য সংখ্যক শিক্ষিত মানুষেরই এ ভাষায় দক্ষতা অর্জিত রয়েছে। মনে রাখতে হবে ইংরাজী তারা কেবল শিখছে। এমন কি নিজেদের মাতৃভাষা হিসাবে গৃহীত কলকাতা কেন্দ্রিক চলিত এবং সাধু বাংলাও তাদের অধিকাংশই ঠিকমত লেখতে এবং বলতে পারে না। অনেক কাল পর্যন্ত শিক্ষিত মুসলমান বাঙ্গালীদের অধিকাংশই বাংলা বলার সময় যার যার আঞ্চলিক উচ্চারণ ও ভঙ্গিতে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিল। একটা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা হিসাবে কলকাতার হিন্দুরা যে আধুনিক বাংলা গড়ে তুলেছিল সেটাকে তারাও তাদের স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু এতে ব্যুৎপত্তি বা দখল অর্জন ছিল তাদের জন্য কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। মনে রাখতে হবে একটা ভাষার উপর ভালোভাবে দখল অর্জন করতে একটা জনগোষ্ঠীর একাধিক বা কয়েকটি প্রজন্ম লাগে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলমান মধ্যবিত্ত হিন্দু মধ্যবিত্তের তৈরী অভিন্ন ও মানসম্মত আধুনিক বাংলা ভাষাকে প্রবল আবেগ ও শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে আত্মরক্ষা ও বিকাশের পথ খুঁজতে চাইল। এবং এ ক্ষেত্রে তারা হিন্দুকেও ছাড়িয়ে গেল। জমি থেকে, উৎপাদন থেকে দূরে থাকা শত শত বৎসরের কেরানী বৃত্তির ঐতিহ্যধারী হিন্দু শিক্ষিত শ্রেণী বা মধ্যবিত্তের সঙ্গে এই মধ্যবিত্তের পার্থক্য বিপুল। সুতরাং পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী কখনই পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীর মত মাতৃভাষার জন্য ব্যাকুল আবেগ অনুভব করে নি। রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে হিন্দীর প্রতি তারা কখনও কিছু আপত্তি প্রকাশ করেছে। কারণ তাতে করে তারা চাকুরীর বাজারে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দী ভাষীদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় যেতে বাধ্য হবে। কিন্তু ইংরাজীর প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব প্রবল। কারণ দীর্ঘকাল ধরে রপ্ত এই ভাষায় পশ্চিম বাংলার হিন্দু মধ্যবিত্ত চাকুরীর বাজারে টিকে থাকার ভরসা করতে পারে।

যাইহোক, পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষক সমাজের ভিতর থেকে যে মধ্যবিত্তের উত্থান ঘটেছিল ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বহুবধি কারণে তাদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্র চিন্তা অনেক বেশী প্রবল রূপ নিয়েছে। এটা একটা গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা যে, যে উচ্চ শ্রেণী এদের সামনে আদর্শ বা নেতৃত্বকারী ছিল সেই আশরাফ শ্রেণী এক সময়ে এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী বা রাষ্ট্র শাসক ছিল। সেটাও খুব বেশী কাল আগের ঘটনা নয়। সুতরাং আশরাফদের ভিতরকার রাষ্ট্র ক্ষমতা ফিরে পাবার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা এদের মধ্যে দ্রুত সঞ্চারিত হয়েছিল।

এ ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের আদর্শ বা মডেল ছিল শত শত বৎসর ধরে বিদেশী শাসকদের অধীনস্থ কর্মচারীর উত্তরাধিকার ধারণকারী উচ্চবর্ণের হিন্দু মধ্য শ্রেণী। এই শ্রেণীর মধ্যে রাষ্ট্র শাসক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশের কল্পনা বা আকাঙ্ক্ষা কখনই প্রবল হতে পারে নি। সুতরাং সুভাষ চন্দ্র বসুর মত প্রবল বাঙ্গালী স্বদেশে তাঁর দাঁড়াবার মত সমাজ জমি পান নি।

 

বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চেতনার উন্মেষ

ব্রিটিশ আমলে যে মধ্যবিত্ত কেবল দাঁড়াচ্ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই মধ্যবিত্ত আত্মবিকাশের জন্য একটা অধিকতর অনুকূল ক্ষেত্র পেল। এখন ব্রিটিশ শাসক ঘাড়ের উপর চেপে নেই। হিন্দুদের চাপও আর নেই। তবে বাধা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিক থেকে। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, সেনা শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত এক সময়, বিশেষত ষাটের দশকের শেষ দিকে, স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে মোড় নিতে শুরু করে। বিশেষত ছাত্র ও শিক্ষিত যুব সমাজের ভিতর তৎকালে সমাজতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ধর্ম থেকে মুক্ত রাজনীতি ও রাষ্ট্র চিন্তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আদর্শ-ভিত্তিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেকিউলার বাঙ্গালী জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা প্রবল হতে শুরু করে। এভাবে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং অতঃপর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন বামপন্থী রাজনীতির প্রভাবে জাতীয়তাবাদ ও জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপান্তরিত হল।

এ ক্ষেত্রে ১৯৬৬-তে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবের ৬ দফা কর্মসূচীর সহায়ক ভূমিকা থাকলেও পাকিস্তানের কাঠামোভুক্ত ৬ দফা কর্মসূচীর সঙ্গে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন ও সেকিউলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাকে মেলাবার চেষ্টাটা ভ্রান্ত। দুইটি দুই ভিন্ন রাষ্ট্র চিন্তার প্রকাশ। একটি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক তথা ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভিতর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা, অপরটি পূর্ব পাকিস্তানের বুকে ধর্মমুক্ত তথা সেকিউলার বাঙ্গালী জাতি পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

১৯৬৬-তে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী দেবার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১৪ দফা কর্মসূচী দেয়। ১৪ দফা কর্মসূচীতে রাজনৈতিক বিভিন্ন দাবী থাকলেও স্বায়ত্তশাসন দাবীর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তবে ১৪ দফায় কেন্দ্রের হাতে দেশ রক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং অর্থ রাখা হলেও ৬ দফায় কেন্দ্রের হাতে শুধু দেশ রক্ষা এবং বৈদেশিক সম্পর্ক রেখে বাকী বিষয়গুলোকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান এই উভয় প্রদেশের হাতে দেওয়া হয়। সুতরাং ১৪ দফার তুলনায় ৬ দফা দুর্বলতর কেন্দ্রের পক্ষপাতী ছিল।

এটা ঠিক যে, ১৪ দফা ৬ দফার মত সুসম্বদ্ধ ছিল না। কিন্তু এটাও ঠিক যে স্বায়ত্তশাসনসহ জনগণের সার্বিক কল্যাণ সাধন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার বিচারে ন্যাপের ১৪ দফা আওয়ামী লীগের ৬ দফার তুলনায় উন্নততর কর্মসূচী ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ৬ দফা যেখানে ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রচার লাভ এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল সেখানে ১৪ দফা জনপ্রিয় হওয়া দূরের কথা জনগণের কাছে যেতেই পারে নি। এ দেশের ইতিহাসের কিছু জটিল সমস্যা সীমাংসার ক্ষেত্রে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপর্ণ বিষয় হওয়ায় খুব সংক্ষেপে হলেও প্রায় সম্পূর্ণরূপে অনালোচিত এই বিষয়ের উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার।

এ বিষয় সর্বজনবিদিত যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রবাহিনী ছিল ছাত্ররা। ছাত্র সমাজের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা এবং ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে ভাষা আন্দোলন সাফল্য অর্জন করে।

এই বাস্তবতায় ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতি চেতনার প্রথম উন্মেষ সবচেয়ে কার্যকরভাবে ও ব্যাপক মাত্রায় ঘটে ছাত্রদের মধ্যে, যার কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে পঞ্চাশের দশকে জাতি চেতনা স্বায়ত্তশাসন দাবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু ষাটের দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে ক্রমে জাতি রাষ্ট্র চেতনার বিস্তার ঘটতে শুরু করে। এটা অনেক দিন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল তৎকালীন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে। এক দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য, অপর দিকে সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসবাদী রাজনীতির বস্তুবাদী ও লোকবাদী (secular) দর্শনের প্রভাব পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার রাজনীতির দিকে বামপন্থী ছাত্রদের অগ্রণী অংশকে নিতে থাকে। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র এবং স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাও তখন ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রণী অংশের মধ্যে দানা বাঁধছিল। এই অবস্থায় গোপন কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপের পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে এদের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠলে ১৯৬৫-তে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হয়। রাশেদ খান মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নে এই অগ্রণী অংশ সমবেত হয়।

১৯৬৬-তে শেখ মুজিব ৬ দফা দিলে আওয়ামী লীগের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগ তা বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে। এভাবে গণ-আন্দোলনের অগ্রবাহিনী ছাত্রদের মাধ্যমে ৬ দফা ব্যাপক জনগণের মাঝে প্রচার লাভ করে। কিন্তু ন্যাপের ১৪ দফার ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে নি। মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়ন ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপের সঙ্গে থাকলেও একটি দুর্বল এবং সারা পাকিস্তান ভিত্তিক কর্মসূচী হিসাবে প্রতীয়মান হওয়ায় ১৪ দফা তার বেশীরভাগ কর্মীর নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারল না। তারা তখন শুধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রিক একটি উন্নত ও সুসংহত জাতীয় কর্মসূচীর প্রত্যাশী ছিল যা তাদেরকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এ ক্ষেত্রে তাদের সামনে একটি মডেল ছিল ১৯৫৩-তে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা।

অন্যদিকে মস্কোপন্থী রাজনীতির অনুসারী মতিয়া নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়ন তাদের রাজনীতির কারণে ১৪ দফার পরিবর্তে ৬ দফার প্রতি দুর্বল ছিল। পরবর্তী সময়ে তারা প্রকাশ্যে ৬ দফাকে সমর্থন দিতে শুরু করল।

যাইহোক, মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাপক সংখ্যক কর্মীরা ১৪ দফাকে গ্রহণ না করায় এবং এর আন্দোলন বিমুখ প্রণেতারাও এটি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে ইচ্ছুক না হওয়ায় ১৪ দফা একটি কাগুজে কর্মসূচীতে পরিণত হয়েছিল এবং অচিরে বিস্মৃত হয়েছিল। এর সুযোগ পেল ৬ দফা ও আওয়ামী লীগ। স্বায়ত্তশাসনের দাবী ভিত্তিক গণ-আন্দোলনের শূন্যতা পূরণ করল ৬ দফা। আর ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে একদিকে কৃষক-শ্রমিকের দাবী ভিত্তিক আন্দোলন এবং অপর দিকে এই দাবীসহ স্বাধীনতার লক্ষ্যাভিমুখী গোপন কর্মকাণ্ড ও প্রকাশ্য আন্দোলন প্রসার লাভ করতে থাকল।

অবশ্য ৬ দফার প্রচার ও জনপ্রিয়তা লাভের পিছনে ছাত্র লীগ কর্মী ও সমর্থকদের ভূমিকা প্রধান হলেও একক ছিল না। মধ্যবিত্তের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের প্রধান বা সাধারণ অংশ ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক। ন্যাপ ছিল প্রগতিশীল, উদারনৈতিক এবং সমাজতন্ত্রের অনুসারী মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। এরা ছিল মধ্যবিত্তের একান্ত সংখ্যালঘু অংশ। তৎকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের বেশ কিছু কাজ শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে থাকলেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শ্রমিক-কৃষকদের ব্যাপক সংখ্যাগুরু অংশ ছিল আওয়ামী লীগের পিছনে। কারণ তাদের নেতৃত্বের শ্রেণী হিসাবে মধ্যবিত্ত সাধারণভাবে ছিল আওয়ামী লীগ সমর্থক।

একমাত্র ছাত্রদের ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। কিন্তু ছাত্রদের সমর্থন হারোনোয় বিশেষত স্বায়ত্তশাসনের দাবী নিয়ে কার্যকরভাবে অগ্রসর হতে না পারায় ন্যাপের সমর্থন ও শক্তি প্রকৃত বিচারে সংকুচিত হতে শুরু করে। অপর দিকে বামপন্থী ছাত্রদের স্বাধীনতার রাজনীতি তাদেরকেও অংশত গণবিচ্ছিন্ন করে। কারণ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাক-বাহিনীর আক্রমণ অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত সাধারণ বাঙ্গালী তথা জনগণের ব্যাপক অংশ স্বায়ত্তশাসন চাইলেও পাকিস্তানের উচ্ছেদ বা ভাঙ্গন তথা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চায় নি।

তবে এটা ঠিক যে বামপন্থী ছাত্রদের স্বাধীনতার রাজনীতিই স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করে। এই রাজনীতির প্রভাব তৎকালে ছাত্র লীগের ভিতরেও প্রবশে করে। আর এভাবে আন্দোলনের অভিমুখ স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার দিকে যেতে থাকে।

তবে তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতিকে স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত করার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে যে শক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল তা হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যগণ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সেনার পাশাপাশি ইপিআর ও পুলিশের বাঙ্গালী সদস্যদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। তবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকাই সর্বাগ্রগণ্য। এর সৈনিক ও অফিসাররাই গঠন করে বাঙ্গালীর প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম কার্যকর নিউক্লিয়াস।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিশেষত শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে আপসের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু সমগ্র ছাত্র সমাজ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোন ধরনের আপসকে কার্যকর হতে দেয় নি। মনে রাখতে হবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চের পূর্বেই। গাজীপুরের জয়দেবপুরে এই বিদ্রোহ শুরু হয়।

আসলে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ ভোটাররা পাকিস্তান রক্ষা করে স্বায়ত্তশাসন চাইলেও একদিকে ছাত্র এবং অপরদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভিতর বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানের অস্তিত্বের বাস্তবতা রাখে নি। তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও যুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর দুই সামাজিক শক্তির -- যথা বামপন্থী-ডানপন্থী নির্বিশেষে সমগ্র ছাত্র সমাজ এবং বাঙ্গালী সেনা সদস্য বিশেষত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সম্মিলন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরোধ যুদ্ধ অনিবার্য করে।

প্রতিরোধ যুদ্ধের সূচনা ছিল নেতৃত্বহীন। কারণ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও তার নেতা ভাসানী ততদিনে গণ-আন্দোলনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেতা মুজিব ছিলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তান রক্ষার পক্ষে। সুতরাং ব্যাপক জনসমর্থন সত্ত্বেও জাতিকে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত না করে এবং বিনা প্রতিরোধে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে তিনি পাক-সেনার নিকট ধরা দিলেন। এ ছাড়া ধরা দিলেন কামাল হোসেন। বাকী আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন।

এটা ছিল এক চমৎকার কৌশল। ভারত বা পাকিস্তান যে-ই জিতুক মুজিব এবং আওয়ামী লীগের লাভ হবে। কারণ পাক বাহিনীর আক্রমণ ও দমন অভিযান সাফল্য লাভ করলেও ইয়াহিয়া সরকার ’৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলকে অক্ষুণ্ন রাখতে বাধ্য হত। স্বাভাবিকভাবে যে বন্দোবস্ত হত তাতে করে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রীর পদে মুজিবকেই অধিষ্ঠিত করতে হত। কিন্তু প্রতিরোধ যুদ্ধের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণতি এবং আওয়ামী লীগের মাধ্যমে এই যুদ্ধের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ লাভ এবং সবশেষে পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের বিজয় মুজিবের জন্য ভিন্ন পরিণতি এনে দিল। তিনি পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী না হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী হলেন।

 

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা

১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্তের প্রধান অংশ তাকে সমর্থন দেয়। এদের পিছনে ছিল আম জনতা। সুতরাং আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙ্গালী জনগণের প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হল। ভাষা আন্দোলনের ধাক্কায় ধর্মীয় রাজনীতির যে ক্ষয় ঘটে তার প্রকাশ ঘটে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বর্জনের মধ্যে। এবার আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও আম জনতার প্রধান লোকবাদী বা সেকিউলার রাজনৈতিক দল হিসাবে আবির্ভূত হল।

১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের কবর রচনা পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে পুরাতন আশরাফ শ্রেণীর নেতৃত্বের অবসান ঘটায়। এটা ছিল দেশজ উদীয়মান মুসলিম বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের প্রধান্য প্রতিষ্ঠার ঘটনা। কিন্তু ব্যাপক গণভিত্তি লাভের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাঙ্গালী সমাজের কিছু ত্রুটি এবং দুর্বলতা ধারণ করে।

সুবিধা ও নগদ প্রাপ্তির কাছে ন্যায়-নীতি বা আদর্শ বিসর্জন বাঙ্গালী চরিত্রের অন্যতম সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নদী বহুল বাংলার ভূ-প্রকৃতির যে চইরা এবং ভাঙ্গন প্রবণ বা অস্থিতিশীল বৈশিষ্ট্যের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি তার প্রভাবে ঐতিহাসিক কাল ধরে আমরা বাঙ্গালীর ভিতর এই দুর্বলতা দেখতে পাই। এর ফলে বাঙ্গালী যে শুধু দীর্ঘ কাল পরাধীন থেকেছে তা-ই নয়, অধিকন্তু বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠনও করতে পারে নি। অধিকাংশ সময় রাষ্ট্র গঠনই করতে পারে নি। ক্ষুদ্র এলাকাভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়ে তারা সেটাকেও রক্ষা করতে পারে নি বাইরের প্রবলতর সংগঠন শক্তির আক্রমণের কারণে।

বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস এক অর্থে বারো ভুঁইয়ার মত অগণিত ভূঁইয়ার ইতিহাস, যারা কখনও ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। ভিতর থেকে কেউ উঠে সবাইকে এক নেতৃত্বাধীন বা শাসনাধীনে এনে কার্যকর রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নি। আর তাই কার্যকর রাষ্ট্র গঠনের পিছনে সাধারণত থেকেছে কোন না কোন রূপে বহিঃশক্তির আগ্রাসন অথবা হস্তক্ষেপমূলক ভূমিকা।

তবে এটাও খুব লক্ষ্যণীয় যে সমাজ বিবর্তনে প্রধান বা মূল ধারা হয়ে উঠতে না পারলেও গৌণভাবে একটা বিপরীত বা ভিন্ন ধারা বাঙ্গালীর ভিতর প্রচীনকাল থেকেই বিদ্যমান থেকেছে। এই গৌণ ধারা কখনও কখনও এতই প্রবল হয়েছে যে, তার আঘাতে বা চাপে সমাজের মূল ধারাও অনেকাংশে প্রভাবিত হয়েছে। আমরা অতীতের যেসব রাজনৈতিক বিদ্রোহ এবং ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের বিবরণ পাই তা থেকে এটা বোঝা যায়। মধ্যযুগে বৈষ্ণব আন্দোলন সমাজের মূল ধারা হয়ে উঠতে না পারলেও তার প্রভাব সমাজের উপর পড়েছিল। পরবর্তী কালের বাউল ও অন্যান্য মানবতাবাদী আন্দোলনও সমাজকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করেছিল।

সুতরাং বাঙ্গালী সমাজের অনেক ত্রুটির পরেও গৌণভাবে হলেও একটি আদর্শনিষ্ঠ, বস্তু ও জীবন ঘনিষ্ঠ ধারা সতত বহমান রয়েছে বলে মনে করার কারণ আছে। কখনও কখনও তা অত্যন্ত শক্তিমত্তা নিয়ে উপস্থিত হয়। শুধু চিন্তা কিংবা জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে প্রাচীন বাঙ্গলীর শক্তিমত্তার দিকটির প্রকাশ ঘটে নি, কখনও কখনও রাষ্ট্র সাধনায়ও তার প্রকাশ ঘটেছে। পাল যুগের পর সমগ্র মধ্যযুগ জুড়ে বাংলায় যে অসংখ্য রাজনৈতিক বিদ্রোহ ও সংঘাত ঘটেছে সেগুলির মধ্য দিয়েও আদি বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চিন্তার এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

তবে যে কথা বলেছি ক্ষুদ্র স্থানিকতা, সংকীর্ণতা, তাৎক্ষণিক লাভালাভ বিবেচনা বা হ্রস্ব দৃষ্টি, ভীরুতা, ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা এবং অতি লোভ আদি বাঙ্গালীর প্রধান দিক হয়ে থেকেছে। বৃহৎ সমাজ শৃঙ্খলায় অনভ্যস্ততা এবং কিছুটা আর্দ্র ও উষ্ণ জলবায়ুর কারণে কখনও অলসতা বা শ্রম বিমুখতাও ছিল যথেষ্ট প্রবল। ভূ-প্রকৃতির অস্থিরতা ও ধ্বংসাত্মকতা, যেমন ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এবং ভূমি ভাঙ্গনের কারণে ভাগ্যবাদ ও অলৌকিক শক্তিতে নির্ভরতার যে প্রাবল্য প্রাচীন বা অতীত বাঙ্গালী চরিত্রে বিদ্যমান ছিল এত সব সামাজিক পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের পরেও তা আজ অবধি সমাজকে যথেষ্ট পরিমাণে অধিকার করে আছে।

সম্ভবত এইসব কারণে অতীতে ভিতর থেকে বৃহৎ বাঙ্গালী দাঁড়াতে পারে নি। কারণ বৃহৎ আকার বা আয়তন নিয়ে দাঁড়াবার জন্য বৃহৎ আয়তনে বা পরিমাণে সমাজ প্রক্রিয়াও দরকার। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ব্যক্তির বিকাশ সামাজিক বাস্তবতার উপর নির্ভর করে। তাই ব্যক্তি এক অর্থে সমাজের সৃষ্টি। ব্যক্তির সৃষ্টি এক অর্থে সমাজের সৃষ্টি। সমাজ বা তার শক্তি কিংবা গতিধারা নিজেকে উপস্থাপন করে ব্যক্তির মাধ্যমে।

অতীত বাঙ্গালী সমাজের এই সীমাবদ্ধতার কারণে বিশাল ও প্রবল ব্যক্তিত্ব হিসাবে আত্মপ্রকাশ বা বিকাশের জন্য প্রত্যেক বাঙ্গালীকে বিদেশীদের বা ভিন্ন সমাজ ও জাতির আশ্রয়, সমর্থন কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা পেতে হয়েছে, কিংবা তাকে পেতে হয়েছে ভিন দেশী শাসন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তর সামাজিক গতিধারা।

প্রাচীন কালের বাংলার সন্তান বৌদ্ধ পণ্ডিত শীলভদ্র (৭ম শতক) এবং বৌদ্ধ পণ্ডিত ও ধর্ম প্রচারক অতীশ দীপঙ্করের (৯৮০ খ্রীঃ-১০৫৩ খ্রীঃ) বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠা এখানে নয়। এর জন্য শীলভদ্রকে যেতে হয়েছে বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অতীশ দীপঙ্করকে দুর্গম তিব্বতে। বিশাল রাজনৈতিক নেতা হিসাবে সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠা হয়েছে জাপানের আশ্রয় ও সমর্থন নিয়ে আজাদ হিন্দ্‌ ফৌজ গঠন করে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে পারার পর। শুধু যে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে মহাকবি হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিকাশ হয়েছিল তা-ই নয়, উপরন্তু তাঁর প্রকৃত স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ইউরোপ থেকে নোবেল পুরস্কার লাভ পর্যন্ত।

যাইহোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী চরিত্রের হ্রস্বদৃষ্টি ও সুবিধাবাদ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙ্গালী চরিত্রের আদর্শ ও নিয়ম-নীতি নিষ্ঠার মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রকাশ আমরা এ কালে দেখতে পেয়েছি পঞ্চাশের দশকে আওয়ামী লীগের মধ্যে। সোহ্‌রাওয়ার্দী ও মুজিব ছিলেন প্রথমটির প্রতিভূ এবং ভাসানী ছিলেন দ্বিতীয়টির প্রতিভূ। সুতরাং যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং আওয়ামী লীগের স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যাবার পর যখন সোহ্‌রাওয়ার্দী ও মুজিব তাকে প্রত্যাখ্যান করেন তখন ভাসানী তাঁর নিজের গড়া দলেই সংখালঘু হন এবং পরিণতিতে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করতে বাধ্য হন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ভাল কথা বলা এবং মন্দ কাজ করা এ দুইয়েই সাধারণ বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের সমান দক্ষতা। আবার তার সুবিধাবাদের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাবার জন্য সে নিজের অবস্থানকে অতি দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে। আর এভাবে সে অন্যের কাজের ফল আত্মসাতেও সমান পারঙ্গম।

ভারতের প্রয়োজন ছিল তার শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলা। এ ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের বিশেষত বামপন্থী তরুণ প্রজন্ম দ্বারা সৃষ্ট স্বাধীনতার রাজনীতি তার পক্ষে যায়। এই রাজনীতির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী এবং বিশেষ করে পাঞ্জাবীদের দ্বারা উপেক্ষিত ও নিগৃহীত বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিকদের যে আত্মিক যোগ ঘটে তা ছিল ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনার তাৎক্ষণিক ও প্রধান কারণ। মনে রাখতে হবে স্বাধীনতার প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণা আসে ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারীতে। মেনন নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ঐ দিন পল্টনের জনসভায় স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু ভারত সরকারের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠিত হলে সেখানে বামপন্থীদের কোন জায়গা হল না। বরং বামপন্থীরা যাতে স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারে সে দিকে ভারত সরকারের সজাগ দৃষ্টি ছিল। বস্তুত ভারত সরকারের প্রয়োজন ছিল একটা দুর্বল ও অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। একটা উন্নত, সেকিউলার ও সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ছিল ভারত রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী। পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো যে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ভারতও ঠিক তা-ই। সুতরাং উপনিবেশিক কাঠামো ভাঙ্গা বাংলাদেশ ভারতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারত।

এই বাস্তবতায় যে ভারতের নিয়ন্ত্রণে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। শুধু বামপন্থীদের ভ্রান্তিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তখন পর্যন্ত বাঙ্গালীর সামাজিক বিকাশের মান এবং বিশাল ভারত কর্তৃক পরিবেষ্টিত দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এমন পরিণতি ছিল অনিবার্য।

তবু একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটা খুব ভাল দিক এবং সুদূর প্রসারী সুফল আছে। এ ঘটনার গৌরবের সঙ্গে গান্ধী, নেহ্‌রু, জিন্নাহ্‌র নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে দেন-দরবার করে ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আদৌ তুলনীয় নয়। এমন কোন গৌরব ভারত ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেই।

বাঙ্গালীর ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্র ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে। এটি কিন্তু সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ দেশের বামপন্থী রাজনীতির সাফল্য, যার যুগান্তকারী ফলাফল এ দেশ এবং উপমহাদেশের সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারাকে বর্তমানে না হলেও ভবিষ্যতে বদলে দিতে বাধ্য।

যাইহোক, আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি গড়ে না তুললেও এবং ফলে এর প্রকৃত শক্তি না হলেও ভারত সরকারের সাহায্যে এককভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ লাভে সমর্থ হয়। এভাবে তা বামপন্থীদের রাজনীতিও আত্মসাতে সমর্থ হয়। এর ফলে বামপন্থী রাজনীতির আদর্শ ও নীতিগুলো লীগ নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতিতে প্রবেশ করে। কিন্তু সঙ্গত কারণে সেগুলির প্রতি প্রকৃতপক্ষে তার কোন অঙ্গীকার ছিল না। সুতরাং ১৯৭২-এর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ও সেকিউলারিজম মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হলেও এগুলির কোনটারই যথাযথ প্রয়োগ হয় নি।

আওয়ামী লীগের ইতিবাচক ভূমিকা এক অর্থে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত। বাঙ্গালী জাতির একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক-সামাজিক বিভিন্ন বাস্তবতায় ’৭১-এর পূর্বকালে বাঙ্গালী জাতির পক্ষে যেমন একটি কার্যকর ও বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব গঠন করা সম্ভব হয় নি তেমন তিন দিক দিয়ে পরিবেষ্টনকারী বিশাল ও শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারতের চরিত্র ও ভূমিকার কারণেও এ দেশে তেমন কোন নেতৃত্বের অধীনে কার্যকরভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও রাষ্ট্র গঠন ছিল অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং এই বাস্তবতায় সমাজের গতিধারাকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ হয়েছিল ইতিহাসের অনিচ্ছুক ও অচেতন হাতিয়ার।

ভারত রাষ্ট্রের সাহায্যে বিদেশ-বিজাতি নির্ভর, আদর্শহীন ও সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একটি আত্মমর্যাদা ও দেশপ্রেম বিহীন, লুটেরা, লুম্পেন, দুর্নীতিপরায়ণ ও বিদেশ নির্ভর শাসক শ্রেণীর বিকাশ অনিবার্য করে। আজ অবধি শাসক ব্যক্তি ও দলের সকল পরিবর্তন সত্ত্বেও এই শ্রেণীর বিকাশ অব্যাহত থেকেছে। তবু এ কথা সত্য যে এই শ্রেণীর নেতৃত্বে যেমন এ দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও রাষ্ট্র গঠন হয়েছে তেমন এ দেশের উন্নয়নও যতটুকু অর্জিত হয়েছে তা হয়েছে মূলত এই শ্রেণীর নেতৃত্বে। এবং সমগ্র গতিধারায় রয়ে গেছে কোন না কোন রূপে বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা যেমন ভারতের হস্তক্ষেপে অর্জিত হয়েছে তেমন বিগত ৩৫ বছরের বস্তুগত উন্নয়নও অর্জিত হয়েছে পাশ্চাত্য তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ ও সাহায্যে।

নিশ্চয়ই এই সমগ্র গতিধারায় এ দেশের সমাজ ও জনগণের একটা শক্তিশালী ভূমিকা সর্বদা থেকেছে। তা না হলে শুধু বাহিরের হস্তক্ষেপ দ্বারা স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা রাষ্ট্র গঠন এবং এই উন্নয়ন -- এসব কিছুই হত না। তা সত্ত্বেও বহিঃশক্তির ভূমিকা যে আজ অবধি অন্যতম প্রধান নির্ধারক বা নিয়ন্তা উপাদান হিসাবে কার্যকর রয়েছে এই সত্য অস্বীকার করে আর যা-ই হোক এই অবস্থাকে বদলানো যাবে না। তবে এর সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ এ দেশে সরাসরি নেই। সেটা আছে বিদ্যমান রাষ্ট্র এবং তার এ দেশীয় শাসক শ্রেণীর মাধ্যমে।

যত বিকৃতি ও সীমাবদ্ধতা থাকুক বাংলাদেশে বিগত প্রায় ৩৫ বৎসরে যে বস্তুগত উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে তা উপেক্ষণীয় নয়। বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ এবং এ দেশের শাসক শ্রেণীর বিদেশ নির্ভরতা এই জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশও বটে। কিন্তু একই সঙ্গে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, তার জন্য রাজনীতি গড়ে তোলা এবং একটা জাতীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং পরবর্তী সময়ে সকল সমস্যা, সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে বস্তুগত উন্নয়নের একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো -- এ সবই একটা জনগোষ্ঠী হিসাবে প্রধানত মুসলমান বাঙ্গালী এবং তার নেতৃত্বের শ্রেণী হিসাবে মধ্যবিত্তের প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং শক্তিরও বহিঃপ্রকাশ। এভাবে দেখলে এ দেশের জনগণ এবং তার নেতৃত্বকারী শক্তি হিসাবে প্রধানত মধ্যবিত্তের শক্তি ও সম্ভাবনার দিকটাও স্পষ্ট হয়ে উঠে।

বাঙ্গালী সমাজের ভিতর যে উন্নত, যুক্তিবাদী, আত্মমর্যাদাশীল, স্বাধীন, আদর্শনিষ্ঠ এবং সংগ্রামী ও কর্মবাদী ধারা বহমান রয়েছে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কারণে তা প্রাধান্যে আসতে না পারলেও তার শক্তিমত্তা একেবারে কম নয়। এই ধারার শক্তি থেকে এসেছে বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে আবুল হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ চিন্তাবিদের নেতৃত্বে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ধর্মমুক্ত জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির উত্থান। ষাটের দশকে বামপন্থী ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের উত্থানে এই ধারা একটা বিশেষ পরিণতি বা রূপ নিয়েছিল। এর ফলে ঘটেছিল ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই ধারার শক্তিমত্তা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও বিভিন্ন কালপর্বে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৯০-তে সামরিক শাসক এরশাদ-বিরোধী গণ-অভুøত্থান ছিল তেমন একটি ঘটনা।

এ কথা বোঝা অত্যাবশ্যক যে, সমাজের নেতৃত্বকারী শ্রেণীর প্রধান বা অপ্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ শুধু শ্রেণীগত বিষয় নয়, এগুলি সমাজগত বিষয়ও বটে। অর্থাৎ জনগণ বা সমাজের তলদেশের বিভিন্ন প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্য নেতৃত্বকারী শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের ত্রুটি-বিচুøতিগুলি যেমন এই শ্রেণীর তেমন সেগুলি বাঙ্গালী সমাজ ও জাতিসত্তার ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকেও প্রকাশ করে। একই সঙ্গে এই সমাজ ও জাতিসত্তার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলিও তার অগ্রণী শ্রেণী হিসাবে মধ্যবিত্তের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।

এ ক্ষেত্রে শত শত বৎসরের বিভিন্ন ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের ভূমিকা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জাতপাত-বিরোধী বৈষ্ণব ও বাউল আন্দোলনের ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এসব উদারনৈতিক আন্দোলন বাঙ্গালীর চেতনাকে শত শত বৎসর ধরে একটি উদার, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অনেকাংশে তৈরী করেছে। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ্যে যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন হয় তার গুরুত্বও কম নয়। এর প্রভাব শুধু হিন্দু সমাজে সীমাবদ্ধ থাকে নি। অপর দিকে হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে আধুনিক যুগ চেতনায় সমৃদ্ধ বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলন মুসলিম বাঙ্গালী সমাজের অনেক আগে শুরু হয়। এগুলি মুসলিম বাঙ্গালী সমাজকেও নানানভাবে প্রভাবিত করেছিল।

এটা ঠিক যে প্রচলিত ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারায় হিন্দু ও মুসলমানে বিভাজন থেকে গিয়েছে। ফলে অনেক মিল এবং লেনদেন বা বিনিময় সত্ত্বেও উভয় ধর্মীয় সমাজ স্বতন্ত্র ধারায় আগে ও পিছে বিকাশ লাভ করেছে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে মুসলমান বাঙ্গালীর মধ্যে ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ তীব্রতর হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উদরনৈতিক ও যুক্তিবাদী চেতনা ও আন্দোলন যত ক্ষীণ ধারায় হোক বহমান থেকেছে। ১৯২০-এর দশকে ঢাকাকে কেন্দ্র করে মুসলিম শিক্ষিত যুব সমাজে যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তার প্রভাব ছিল দূরপ্রসারী এবং গভীর। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের আবুল হুসেন, আবদুল ওদুদ প্রমুখ ব্যক্তি ছাড়াও আরও অনেকে ঐ কালে মুসলিম সমাজের উগ্র ও আক্রমণাত্মক রক্ষণশীলতার নিগড় ভেঙ্গে প্রগতিশীলতা ও যুক্তিবাদ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঙ্গালীর অগ্রগমনে যাদের ভূমিকা প্রভূত এমন অনেকেরই নাম আমরা করতে পারি। সমাজ সংস্কারে বেগম রোকেয়া, সাহিত্যে নজরুল ইসলাম, জসিম উদ্দীন, বিপ্লবী রাজনীতিতে কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমদ, এমনই কয়েকটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।

বস্তুত এই ধরনের দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিতর থেকে মুসলিম বাঙ্গালী সমাজ ও মধ্যবিত্তের আজকের অগ্রমনের শক্তি আহরিত হয়েছে। এটা ঠিক যে, আজ অবধি মুসলিম বাঙ্গালী সমাজ এবং মধ্যবিত্তসহ তার নেতৃত্বকারী শ্রেণীসমূহের মধ্যে বেশ কিছু নেতিবাচক দিকের প্রাধান্য বিদ্যমান। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতিবাচক দিকগুলি যত গৌণ বা অবদমিত হোক সেগুলিরও শক্তিমত্তাকে হিসাবে না নিলে বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রগমনকে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

মুসলিম বাঙ্গালী মধ্য শ্রেণীর শক্তির বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখা দিয়েছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার দ্রুত বস্তুগত বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন। মনে রাখতে হবে ১৯৪৭-এ যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলা তার অন্তর্ভুক্ত হয় তখন বাংলার এই অংশ সম্পূর্ণরূপে একটি কৃষি অঞ্চল। তার শিল্প প্রায় কিছু ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত। রাজধানী ঢাকা একটি ছোট শহর মাত্র। অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা এবং প্রায় সমগ্র শিল্প-কারখানা তখন পশ্চিম বাংলা ও ভারতের ভাগে পড়ে। ১৯৭১-এ যখন পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রে পরিণত হয় তখনও তার অবকাঠামো, শিল্প এবং নগরায়ন যৎসামান্য।

নিশ্চয় এই ঘটনা একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত হিন্দু বাঙ্গালী ও তার মধ্যবিত্তের তুলনায় মুসলিম বাঙ্গালী ও তার মধ্যবিত্তের প্রাণশক্তির পরিচায়ক। বস্তুত হিন্দু মধ্যবিত্তের দুর্বলতার সর্বাধিক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার রাষ্ট্র চিন্তার অস্বচ্ছতা ও দুর্বলতার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ আমল থেকেই হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের রাষ্ট্র চিন্তা ধর্ম চিন্তার গণ্ডী অতিক্রম করতে পারে নি। বাঙ্গালীদের মধ্যে যাঁরা প্রথম রাষ্ট্র চিন্তা করেছিলেন এবং সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য হলেন বিখ্যাত উপন্যাসিক ও সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অতুলনীয় সাহিত্য শক্তির অধিকারী বঙ্কিমও তা পারেন নি।

বস্তুত হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত যখন ভারতভিত্তিক রাষ্ট্র চিন্তা করেছে তখন তার মধ্যে কাজ করেছে সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়গত ঐক্যের অনুভূতি। তার মধ্যে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি কেন্দ্রিক যে বোধ কাজ করেছে তাকে আমরা বড় জোর সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ বলতে পারি। তা কখনও কার্যকরভাবে রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদে রূপান্তরিত হতে পারে নি।

প্রকৃতপক্ষে হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী পরিচয়ে রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা শক্তিতে পরিণত হতে চায় নি এবং বাঙ্গালী জাতিসত্তাকেও তা করতে চায় নি। অর্থাৎ সে কখনও রাজনৈতিক নেতৃত্বের শক্তি হতে চায় নি। সুতরাং তার আন্দোলনে অর্থনৈতিক এবং সমাজ সংস্কারমূলক দিক প্রায় সর্বদা প্রধান হয়ে থেকেছে। কিন্তু মুসলমান বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের জন্য এ কথা প্রযোজ্য নয়।

প্রায় সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে আমরা হিন্দু সমাজকে বিধবা বিবাহ প্রবর্তন, জাতপাতের কড়াকড়ির অবসান ইত্যাদি আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখি। বস্তুত অসংখ্য ভাগে বিভক্ত হবার ফলে অশক্ত এবং প্রায় অচল-অনড় হয়ে পড়া হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ, গতিশীল এবং কার্যকর শক্তিতে পরিণত করার জন্য ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পিছনেই হিন্দু মধ্যবিত্ত তার প্রায় সমস্ত শক্তি ব্যয় করেছে। সামাজিক শক্তি হিসাবেই যার দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তা দাঁড়াবে কী করে?

এটা ঠিক যে মুসলমান সমাজে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্রতা এক অর্থে হিন্দু সমাজের তুলনায় অনেক বেশী ছিল এবং আজও আছে। এ ক্ষেত্রে তার যে কোন ভিন্নতা এবং নূতনত্বের প্রতি এবং বিশেষত যুক্তি-বুদ্ধির প্রতি অসহিষ্ণু আক্রমণাত্মকতা উল্লেখযোগ্য। কিন্তু জাতপাতের ভাগ না থাকায় মুসলমান সমাজ হিন্দু সমাজের চেয়ে অনেক বেশী ঐক্যবদ্ধ ও সংহত। ফলে তার পক্ষে কার্যকর রাজনৈতিক শক্তি বা সত্তা হিসাবে দাঁড়ানো সহজতর। তবে ধর্মীয় কারণে যুক্তি ও বিজ্ঞান মনস্কতার প্রতি বিরোধিতা মুসলমান সমাজকে অনেক পিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে তার তীব্র লড়াইও অব্যাহত রয়েছে। বরং এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকে অবলম্বন করে ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে তার আধুনিকতা, যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞান মনস্কতার লড়াই দাঁড়িয়েছে।

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে ১৯২০-এর দশকে ঢাকা কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সমাজ মানসে অভিঘাত আনলেও তার প্রভাব ছিল তুলনায় নগণ্য। বরং পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় চেতনার জোয়ারে যুক্তি ও বুদ্ধিবাদী কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি বর্জিত এই আন্দোলন প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলন এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে অবলম্বন করে একটি শক্তিশালী ধর্মমুক্ত এবং যুক্তিবাদী জ্ঞানতাত্ত্বিক ধারা মাথা তুলে দাঁড়ায়। এই ধারা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও সমগ্র সামাজিক গতিধারাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে, যার ফল হচ্ছে একটি জন-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

বস্তুত কৃষকের মধ্য থেকে উঠে আসা মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ হয়েছে রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বিটিশ শাসন কালে তার বিরুদ্ধেও তার একটা সংগ্রাম ছিল। তবে কৃষক সন্তান হিসাবে তখন তার সংগ্রামের প্রধান অভিমুখ ছিল হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে। এইসব আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ কাল জুড়ে আত্মবিকাশের ক্ষেত্র পেতে চেষ্টা করেছে। তবে স্বাধীন শক্তি হিসাবে তার প্রকৃত আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে।

প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বকারী শ্রেণী হিসাবে মুসলমান মধ্যবিত্ত ব্রিটিশ শাসনকালে দাঁড়ায় নি। তখন পর্যন্ত সে প্রধানত উচ্চ শ্রেণী তথা আশরাফ বা অভিজাতদের অনুসারী ছিল। নেতৃত্বকারী শ্রেণী হিসাবে সে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। এবং তখন থেকে তার যাত্রা প্রধানতই একটা রাজনৈতিক শ্রেণী হিসাবে।

এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ প্রক্রিয়া আলোচনা করতে গেলে রামমোহন থেকে যে যাত্রা শুরু হয় তাতে প্রায় পুরোটা জায়গা দখল করে থাকে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার এবং সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়। এখানে রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের স্থান তুলনায় অনেক গৌণ। হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশে তার নিজস্ব রাজনীতি না থাকায় তার বিকাশের ইতিহাস আলোচনা প্রধানত সমাজ সংস্কার এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি কেন্দ্রিক হতে বাধ্য হয়।

অথচ মুসলমান বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত তথা বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের উত্থান ও বিকাশের সমগ্র প্রক্রিয়া খুব বেশী রাজনীতিকেন্দ্রিক। এই কারণে আমাদের এই আলোচনাতে এ বাংলার মধ্যবিত্তের বিকাশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজনীতির বিষয় এবং বিতর্কগুলিকে বেশী আনতে হয়েছে। কারণ রাজনীতি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের বিকাশ এবং সমস্যা কোনটাই কিছুমাত্র বোঝা যায় না। তার ভাষা, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যও তাই রাজনীতিকেন্দ্রিক। রাজনীতির মাধ্যমে, রাজনৈতিক আন্দোলন ও গতিধারার মাধ্যমে এই মধ্যবিত্তের উত্থান হওয়ায় এমনটা হয়েছে। আর এখানেই আজকের পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের পার্থক্য। একজন যেখানে মোটামুটি ভালভাবে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারলে তুষ্ট হয়, অপর জন সেখানে নিজস্ব রাষ্ট্র চায়।

হিন্দু মধ্যবিত্তের তুলনায় অনেক পরে যাত্রা শুরু করেও মুসলমান মধ্যবিত্ত অনেক বেশী এগিয়েছে তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে। ১৯৪৭ সালের পূর্বে ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র চাইলেও তার পরবর্তী কালে সে তার নিজস্ব জাতি পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র চেয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই আকাঙ্ক্ষার ভিত্তি রচনা হয়। অবশ্য পঞ্চাশের দশকে বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চিন্তা কোন মূর্ত রূপ নেয় নি। তবে তার বহিঃপ্রকাশ কিছু করে ঘটছিল। ১৯৫৭-তে মওলানা ভাসানী কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ‘আস্‌সালামু আলায়কুম’ তথা বিদায় বার্তার হুমকি প্রদান তার একটি দৃষ্টান্ত।

তবে, প্রকৃতপক্ষে, ষাটের দশক ছিল বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা এবং আকাঙ্ক্ষার জাগরণের যুগ। বিশেষ করে বাঙ্গালী পরিচয় ভিত্তিক এবং সেকিউলার বা লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা এই দশকে বিকাশ লাভ করে। ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী বাঙ্গালীর যে ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী জাতি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এই দশকে এসে দাঁড়াবার মত জমি পায়।

ষাটের দশক ছিল পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও বিপ্লবের নবতর উত্তাল জোয়ারের কাল। তার ঢেউ এ দেশেও আছড়ে পড়ে। বিশেষ করে ছাত্রদের এক বিরাট অংশ এর দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের সঙ্গে সংযুক্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সে কালে এ দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগারে পরিণত হয়। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাব লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত রাজনীতির ভাবনাকেও প্রবল করে তোলে।

ভাষা আন্দোলন যে বাঙ্গালী চেতনার জন্ম দিয়েছিল তার সঙ্গে লোকবাদ বা সেকিউলারিজম তথা ধর্মমুক্ত রাজনীতি ও রাষ্ট্র চেতনার সম্মিলনের অনিবার্য পরিণতি ছিল ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পরিবর্তে বাঙ্গালী জাতিসত্তার পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ। অবশ্যই বাঙ্গালীদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য এই চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশকে পুষ্টি যুগিয়েছিল। এর ফলে জন্ম নেয় স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। কিন্তু স্বাধীন পূর্ব বাংলা কিংবা বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দার্শনিক উৎস জাতিগত নিপীড়ন ছিল না। সেটা ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিতর নিহিত লোকবাদী কিংবা বস্তুবাদী দর্শন, যা সকল প্রকার অলৌকিকতায় বিশ্বাস থেকে মুক্ত। তবে একথা ঠিক যে জাতিগত নিপীড়ন স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতির দর্শনগত উৎস না হলেও এটা ছিল বস্তুগত উৎস বা ভিত্তি। এই বস্তুগত জমি পেয়েছিল বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এত দ্রুত একটি দর্শনগত চিন্তা বা আদর্শ এভাবে বিকাশ লাভ করতে পেরেছিল।

তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন ও লোকবাদী বা সেকিউলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার পিছনে যে, বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছিল তার প্রমাণ হল সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসবাদী আন্দোলনের ধারায় এই আকাঙ্ক্ষা বা রাজনীতির উদ্ভব ও বিকাশ। এই ধারার মূল সংগঠকরা ছিল সাধারণভাবে সব ধরনের ধর্ম বিশ্বাস থেকে মুক্ত। বাকীরা সকলে ততটা অগ্রসর না হলেও ধর্ম থেকে রাজনীতি ও রাষ্ট্রের বিযুক্তিতে বিশ্বাসী ছিল। সুতরাং এই ধারায় বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা সবার আগে জন্ম ও প্রসার লাভ করতে পেরেছিল।

অবশ্য এই প্রশ্নে মার্কসবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ধারায় দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতাও ছিল। বিশেষত অন্ধ আন্তর্জাতিকতাবাদী ও প্রাচীনপন্থী নেতৃত্ব ছিল এ ধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনা বিরোধী। ফলে তারা সাধারণভাবে ছিল জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা বিরোধী। কিন্তু সে কালের বামপন্থী ছাত্র ও যুব প্রজন্মের ভিতর জাতীয়তাবাদী তথা বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই ছিল প্রবল। স্বাভাবিকভাবে তাদের জাতি রাষ্ট্রের ভাবনার ভিতর অবাঙ্গালী সংখ্যালঘু জাতিসত্তা সমূহের অধিকার যেমন স্বীকৃত ছিল তেমন ছিল সমাজতান্ত্রিক কিংবা তার ধাঁচের রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রতি অঙ্গীকার।

কিন্তু একটা চিন্তা বা ধারণা জন্ম দেওয়া যত সহজ সেটাকে বাস্তবায়ন করা তত সহজ নয়, বরং বহু বেশী কঠিন। এমনিতেই বাঙ্গালীর রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না। তার উপর মুসলমান বাঙ্গালী মধ্য শ্রেণীর বিকাশ হয়েছে অতি সম্প্রতি এবং বিদ্যমান প্রথা বা কাঠামো-বিরোধী তথা র‌্যাডিক্যাল রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতাও তার খুব সাম্প্রতিক কালের। র‌্যাডিক্যাল বা আমুল পরিবর্তনবাদী আন্দোলনের পথে তার যাত্রা শুরু হয়েছে মূলত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই রকম একটা পশ্চাৎপদ, অনভিজ্ঞ ও অপরিপক্ব সামাজিক পটভূমির উপর দাঁড়িয়ে ঐ কালে তরুণ প্রজন্ম যেটুকু করেছিল সেটুকুই বিস্ময়কর। এই কৃতিত্ব শুধু তরুণ প্রজন্মের নয় অধিকন্তু যে মুসলিম বাঙ্গালী সমাজ ও তার মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে তার উদ্ভব সেই সমাজ ও শ্রেণীরও এটা একটা কৃতিত্ব।

এটা ঠিক যে পূর্ব বাংলায় শুধু মুসলমান বাস করে না, হিন্দুও বাস করে। এ দেশের রাজনীতি ও আন্দোলনে তাদেরও অংশ ছিল এবং আছে। শুধু তা-ই নয়, এ দেশের মুসলিম বাঙ্গালীর সেকিউলার মানস নির্মাণে বিশেষ করে হিন্দু সমাজ থেকে আগত কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীদের ভূমিকা অতুলনীয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় বামপন্থী রাজনীতির যে ধারা গড়ে উঠেছিল সেটা মূলত তাদের অবদান।

তবে হিন্দু সমাজ থেকে আগত বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের এই ভূমিকার একটা নেতিবাচক দিকও এ দেশের বামপন্থী রাজনীতির জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। সেটা হচ্ছে তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা বিমুখ অতি আদর্শবাদী সমাজ চিন্তা। তাদের আদর্শকে বলা যায় ক্ষমতা বিমুখ সুতরাং রাজনীতি বিমুখ সমাজ সংস্কারের আদর্শ, যেখানে ত্যাগ ও নীতি-নৈতিকতার চর্চায় প্রায় সমস্ত উদ্যম ও কর্মশক্তি নিঃশেষ হয়। তবু এ সমাজকে এগিয়ে নেবার ক্ষেত্রে তাদের মহৎ ভূমিকাকে অস্বীকার করা হবে নিদারুণ ভুল।

যাইহোক, এ দেশের রাজনীতিতে হিন্দু মধ্যবিত্ত ও জনগণের ভূমিকাকে অস্বীকার না করেও বলা যায় যে, ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে নির্যাতন, বৈষম্য ও বিতাড়নের ফলে এ দেশে তাদের কার্যকর ভূমিকা পালনের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে। এই অবস্থায় এ দেশের বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভূমিকাই খুব বেশী রকমভাবে নির্ধারক হয়েছে, যার অঙ্গীভূত হয়েছে হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায় বা সমাজের ভূমিকা। যাইহোক, ইতিপূর্বে এ আলোচনায় বলা হয়েছে যে, বিশেষ সামাজিক (সমাজের অনভিজ্ঞতা, পশ্চাৎপদতা ইত্যাদি) এবং ভূ-রাজনৈতিক (দেশের তিন দিক ঘিরে ভারতের অবস্থান) বাস্তবতায় বামপন্থীদের পক্ষে স্বাধীনতার জন্য একদিকে যেমন কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি অপর দিকে তেমন তাদের দ্বারা গড়ে তোলা স্বাধীনতার রাজনীতি স্বাধীনতার যুদ্ধে পরিণত হলেও তাতে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হয় নি। এর ফলে তাদের রাজনীতির যৌক্তিক পরিণতিও আজ অবধি ঘটে নি।

১৯৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও সেকিউলারিজমের প্রতি অঙ্গীকার ঘোষণা করা হলেও সেটা ছিল একটা কাগুজে ঘোষণা মাত্র। এগুলির কোনটিই পালিত হয় নি। বরং ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও লুটতরাজের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের যে দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া শুরু করে তা পরবর্তী প্রতিটি সরকারের শাসনের মধ্য দিয়ে ক্রমবিকশিত ও বেগবান হয়েছে।

তবে ১৯৭৫ পর্যন্ত সংবিধানের মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়ন করা না হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান থেকে বর্জন করা হয় নি। কিন্তু ১৯৭৫-এ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনকালে বিভিন্ন সংশোধন ও সংযোজনের মাধ্যমে সংবিধানের মূলনীতিসমূহে মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো হয়। এভাবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ইসলামী ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয় এবং তার সমাজতান্ত্রিক মূলনীতিকেও বর্জন করা হয়। আর গণতন্ত্রের নামে যে কাঠামো চালু আছে তাকে বলা যায় একটি অন্তঃসারশূন্য নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা, যার আবরণে পরিচালিত হয়েছে একটি আমলাতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

বস্তুত পাশ্চাত্য পুঁজির অধীনস্থ এবং তার স্বার্থের পাহারাদার হিসাবে একটি গণ-নিপীড়নকারী আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কিছু সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দেওয়া আছে একদল নির্বাচিত রাজনীতিকের হাতে। এই রাজনীতিকরা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত সংগ্রহ ক’রে যেমন তাদের প্রাথমিক রাজনৈতিক ক্ষমতা গঠন করে তেমন এই অর্থ-বিত্ত দ্বারা জনমতকে প্রভাবিত ক’রে এবং রাষ্ট্রের সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যায়। এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ক্ষমতার সাহায্যে আমলা-রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের এক অংশ বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে। আর এভাবে স্বাধীনতার পর মধ্যবিত্তের এক উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চবিত্ত তথা ধনীতে পরিণত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও নিয়ম-নীতির পরিবর্তে দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হয়েছে প্রধান উপায়।

কিন্তু এত সবের পরেও সমাজ ও মধ্যবিত্তের প্রগতিশীল ও আদর্শনিষ্ঠ ধারাটির শক্তি ও সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করার কারণ নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন হলেও তার বিরুদ্ধে লড়াইও অব্যাহত রয়েছে। এই দুর্বৃত্তায়নের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসাবে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শক্তিসমূহ দ্বারা বাংলাদেশ আজ অবধি পরিচালিত হলেও একটি শক্তিশালী সেকিউলার ধারা বাংলাদেশে সতত বিদ্যমান।

 

বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও বাঙ্গালীর ভবিষ্য

পশ্চিম বাংলার সঙ্গে একটা বিষয়ে তুলনা দিলে বাংলাদেশে বাঙ্গালীর জাতিগত ও লোকবাদী অগ্রগমনের তাৎপর্য বোঝা যায়। পশ্চিম বাংলায় শুধু লোকবাদী নয় বরং একটি নিরীশ্বরবাদী দর্শনের অধিকারী বামফ্রন্ট প্রায় ত্রিশ বৎসর ক্ষমতাসীন আছে। এবং এটাও ঠিক যে পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় আজ অবধি কি বাংলাদেশের মত ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ কোন ধর্মমুক্ত কিংবা লোকবাদী জাতীয় অনুষ্ঠান বা উৎসব গড়ে উঠেছে? বাংলাদেশে ২১-এ ফেব্রুয়ারী এবং ১লা বৈশাখ যেভাবে পালিত বা উদযাপিত হয় তার কোন তুলনা পশ্চিম বাংলায় নেই। পশ্চিম বাংলার প্রধান জাতীয় উৎসব দুর্গা পূজা।

বস্তুত পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালী বাংলাদেশের বাঙ্গালীর মত কোন কার্যকর সেকিউলার বা ধর্মমুক্ত সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে নি। অর্থাৎ পশ্চিম বাংলার হিন্দু বাঙ্গালী ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে নি। এটা ঠিক যে পশ্চিম বাংলায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অনেক বেশী। কিন্তু সেটাকে লোকবাদী কিংবা ধর্মমুক্ত চেতনার প্রভাব বলাটা ভুল হবে। এটা হচ্ছে ভিন্ন ধর্ম বা ধর্ম-সম্প্রদায় সহিষ্ণুতা, যেটা মূলত হিন্দু ধর্মের ভিতরই আছে। এ বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ না থাকলেও সংক্ষেপে এ কথা বলা দরকার যে, হিন্দু ধর্মের ভিতর নিম্নবর্ণ ও ভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রতি অন্তর্গত ঘৃণা কাজ করলেও সেটা সাধারণত আক্রমণাত্মক নয়। বৈচিত্র্য, বহুত্ব এবং বহু বর্ণজাতির সমন্বয় বা সহাবস্থানের ফলে হিন্দু সমাজ ঐতিহাসিকভাবেই সহিষ্ণু। তা অন্যকে ঘৃণা করতে পারে, কিন্তু তার জন্য সচরাচর আক্রমণ করতে যায় না। তার আক্রমণাত্মকতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বহিরারোপিত এবং বহিরাক্রমণের প্রতিক্রিয়া সম্ভূত।

সুতরাং মুসলিম সমাজের মত করে হিন্দু সমাজ ও ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত হবে না। হিন্দু সমাজের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতাকে তাই ধর্মাতীত বা লোকবাদী কোন ব্যাপার ধরে নেওয়াটা ভুলও হতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বামফ্রন্ট এবং মার্কসবাদী দর্শনের প্রভাবে পশ্চিম বঙ্গে যে চেতনা গড়ে উঠেছে সেটাকে সেকিউলার বা লোকবাদী না বলে উদারনৈতিক হিন্দুত্ব বলাই সঙ্গত। আর তাই দুর্গা পূজার সমান্তরালে হলেও পশ্চিম বাংলার বাঙ্গালীর পক্ষে কোন লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত উৎসব গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি।

অর্থাৎ সকল সংকট সত্ত্বেও যে লড়াই বাংলাদেশে আছে সেটা পশ্চিম বাংলায় থাকলেও অত্যন্ত দুর্বল। সুতরাং জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ পশ্চিম বাংলার তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশী সম্ভাবনাময়। একটি উন্নত, লোকবাদী, সবল, সচেতন এবং জাতি গঠনকামী যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজন তা এখন পর্যন্ত যত ক্ষুদ্র আকারে হোক বাংলাদেশে আছে।

এটা ঠিক যে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের সুস্থ ও স্বাভাবিক বিকাশের পথ অনেকাংশে রুদ্ধ করেছে। ফলে মধ্যবিত্তের একাংশ লুটেরা-লুম্পেন শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং দুনীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ-বিত্তের অধিকারী হয়েছে। শত শত কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকার মূল্যের সম্পদ ও অর্থের অধিকারী ধনিকের সংখ্যা এখন কম নয়। হয়ত তাদের সংখ্যা এখন বহু শত হবে। সেটা অনেক হাজারও হতে পারে।

মধ্য শ্রেণীর বিস্তারও হয়েছে বিপুলভাবে। অত্যন্ত দ্রুত এবং প্রধানত অসৎ ও অবৈধ পথে উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর বিকাশ সমাজে অনেক সমস্যা ও সংকট জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এই বিকাশে বিদেশ নির্ভরতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করায় এদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। একটা স্বাধীন ও উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের পথে এটি অন্তরায়। এমনকি এটা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বও বিপন্ন করতে পারে।

কিন্তু বাংলাদেশের সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত তার মধ্যবিত্তের মধ্যে নিহিত। এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে যে প্রবণতাই প্রধান থাক তাদের বিকাশ এবং অস্তিত্বের প্রধান শর্ত হচ্ছে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব।

আমার ধারণা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বস্তুগত উন্নয়নের প্রাথমিক ভিত্তি অর্জনের পর এখন তার পথ পরিবর্তনের সময় এসেছে। দেশ যে পথে এগিয়েছে সে পথে আরও এগোলে যেটুকু অর্জন হয়েছে সেটুকু ধ্বংস হবে। প্রধানত বিদেশ নির্ভরতা এবং দুর্নীতি ও লুণ্ঠনমূলক শাসক শ্রেণীর মাধ্যমে একটি প্রাথমিক বস্তুগত অবকাঠামো অর্জিত হলেও এটিকে রক্ষা করা সম্ভব নয় যদি সমাজে আদর্শ তথা জাতীয় মর্যাদা বোধ এবং ন্যায়-নীতি-নিয়ম প্রতিষ্ঠিত না হয়। উচ্চবিত্তের সংখ্যাগুরু এবং মধ্যবিত্তের সংখ্যালঘু অংশ না হয় বিপদ দেখলে তাদের সম্পদ নিয়ে বিদেশে চলে যেতে পারবে। কিন্তু অধিকাংশের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।

সুতরাং আমরা আশা করতে পারি উন্মত্ত লুণ্ঠন ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাথমিক পুঁজি ও সম্পদ সংগ্রহের কালের সমাপ্তি সমাগত। দেশের বস্তগত উন্নয়নকে রক্ষা করতে হলে আদর্শিক উন্নয়ন ঘটানো এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। 

বিশেষ করে বস্তুগত উন্নয়ন সামাজিক পরিবর্তনকে অতীতের তুলনায় সহজসাধ্য করছে। নগরায়ন, রাস্তা-সেতু-বাঁধসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও নদী নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদির ফলে ভূ-প্রকৃতি ও মানুষের উপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে প্রবল হস্তক্ষেপ ঘটছে তা মানুষের মনোজগতেও পরিবর্তন আনছে। এর ফলে ভূ-প্রকৃতির প্রভাবে বাঙ্গালী চরিত্রে বিদ্যমান কিছু দুর্বলতা ও নিকৃষ্টতা যেগুলি এত কাল অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল সেগুলির পরিবর্তনের বাস্তবতাও ক্রম প্রসারিত হচ্ছে। সব মিলিয়েই পরিস্থিতিতে একটা পরিবর্তন আসন্ন ও অনিবার্য হয়ে উঠছে। ফলে আদর্শের জায়গাও নূতন করে তৈরী হচ্ছে।

এ কথা ঠিক যে এর তাগিদ সামাজিক নিয়মে জনগণের ভিতর দেখা দিচ্ছে। ফলে তৈরী হচ্ছে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের বিভিন্ন ঘটনা। কিন্তু মূল এবং নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিতে যে শ্রেণীকে এগিয়ে আসতে হবে সেটি হল একটি আদর্শনিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণী। প্রকৃতপক্ষে এটি এ দেশের বৃহত্তর মধ্যবিত্তের অংশ হলেও তা থেকে পৃথকও বটে।

দীর্ঘকাল অবদমিত এই মধ্যবিত্ত এ দেশের সমাজ প্রগতির প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে এই সমাজকে কতকগুলি ঘটনার অভিঘাত দ্বারা এগিয়ে নিতে সক্ষম হলেও বিভিন্ন কারণে সামনে আসতে পারে নি। বরং তারা থেকেছে এতকাল অবদমিত, এবং তাদের কাজের সুফল মধ্যবিত্তের সংখ্যায় ভারী বিদেশ ও পর নির্ভর এবং সুবিধাবাদী অংশ বৈদেশিক শক্তিসমূহের সাহায্য নিয়ে বার বার আত্মসাৎ করেছে। কিন্তু সমাজকে উৎপাদনশীলতা, আত্মনির্ভরতা ও মর্যাদা, স্বাধীনতা এবং নিয়ম-নীতির মাধ্যমে এগিয়ে নেবার প্রশ্ন যখন উঠবে তখন স্বাভাবিকভাবে সেই কাজের জন্য যারা যোগ্য ইতিহাস তাদের উপরই এই দায়িত্ব অর্জন করবে। তখন তারা জনগণকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে অসমাপ্ত কাজটিকে সম্পন্ন করবে।

অবশ্য অতীতে আদর্শনিষ্ঠ, প্রগতিশীল ও সংগ্রামী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অগ্রণী অংশ হিসাবে ছাত্র ও তরুণরা সর্বদা আন্দোলনের অগ্রবাহিনী হিসাবে ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৯০-এর পর থেকে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা অনেকাংশে চাপা পড়ে গেছে। সমাজের দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া এর ফলে অনেকাংশে অপ্রতিহত হতে পেরেছে। সুতরাং পুনরায় আদর্শনিষ্ঠ মধ্যবিত্তের সংগ্রামী বাহিনী হিসাবে ছাত্রদের পুনরভ্যুদয়ের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

আদর্শনিষ্ঠ মধ্য শ্রেণী বা মধ্যবিত্তের উত্থান প্রসঙ্গে একটি কথা বলা বিশেষভাবে দরকারী মনে করছি। তা হল কোন নেতৃত্বকারী শ্রেণী শুধু অর্থনীতি দ্বারা গড়ে ওঠে না। তার জন্য একটা সামাজিক বা রাজনৈতিক আদর্শও লাগে। আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ আমলা-বুর্জোয়ার অধীনস্থ যে ধনিক ও মধ্য শ্রেণী গড়ে উঠেছিল তার সামনে আদর্শ ছিল ইউরোপীয় বিশেষত ব্রিটিশ পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের আদর্শ বা ধ্যান-ধারণা। এই আদর্শ কোন ক্রমে এ দেশে একটি স্বাধীন, দেশপ্রেমিক, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এবং প্রবলভাবে গতিশীল ও উৎপাদনশীল শ্রেণী জন্ম দিতে পারে না। এই আদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপনিবেশিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা। বাস্তব ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্যই তাই অপরিহার্য হয়ে পড়ে ঐ ধরনের আদর্শের সঙ্গে একটি ছেদ।

সুতরাং অতীতে এ দেশে স্বাধীন ও সংগ্রামী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটি ভিন্ন ধরনের আদর্শের, যা মধ্যযুগীয় না হয়ে আধুনিক হলেও উপনিবেশিক কাঠামো বিরোধী হবে। এমন একটি আদর্শ হিসাবে সে কালে দেখা দিয়েছিল মার্কসবাদ। এক কালে মার্কসবাদ তার অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ দেশে একটি সময়ের কিছু চাহিদা পূরণ করেছিল। তবে এই আদর্শ নিয়ে যাঁরা এ দেশে এগিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ থেকেই এই ধারায় ক্ষয় ও বিপর্যয় শুরু হয়। বিশেষ করে ১৯৯১-তে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন এবং কমিউনিস্ট শিবিরের পতনের পর শুধু যে পৃথিবীব্যাপী আদর্শিক সংকট ও শূন্যতা দেখা দিয়েছে তা-ই নয় সেই সঙ্গে আমাদের দেশেও তার গভীর ও প্রবল প্রভাব পড়েছে।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সমাজ আদর্শের অভাবে বসে থাকবে। বরং সমাজের প্রয়োজনে নূতন আদর্শ গড়ে উঠবে তার ভিতর থেকে। এ ক্ষেত্রে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানসহ বহু আন্দোলন আমাদের জন্য অভিজ্ঞতার অমূল্য ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে, যার ফলে আদর্শ বা তত্ত্বের জন্য আমাদের আর বাইরের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না।

আর একটি কথা পুনরায় বলা প্রয়োজনীয় যে বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের গঠন হয়েছে প্রধানত রাজনীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। যেমন ধরনের হোক রাজনৈতিক আদর্শ, সংগঠন ও আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মধ্যবিত্তের বিভিন্ন অংশ সংগঠিত ও বিকশিত হয়েছে। যার ফলে ঘটেছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের মত যুগান্তকারী ঘটনাসমূহ। সুতরাং বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন এবং একটি নূতন মধ্য শ্রেণীর উদ্ভব ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যও প্রয়োজন হবে শুধু একটি নূতন আদর্শের নয়, অধিকন্তু একটি নূতন রাজনৈতিক সংগঠনেরও, যা একই সঙ্গে সংগঠিত এবং পুনর্বিন্যস্ত করবে মধ্য শ্রেণীকে এবং সেই সঙ্গে সমগ্র জনগণ ও জাতিকে।

বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সংক্রান্ত এই আলোচনা শেষ করার পূর্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করা উচিত হবে। সেটা হচ্ছে যে জনগোষ্ঠী নিয়ে বাঙ্গালী জাতিসত্তা গঠিত হয়েছে তার ঐতিহ্য যত প্রাচীন হোক বাঙ্গালী হিসাবে তার গঠন তুলনায় অতি সাম্প্রতিক কালের ঘটনা এবং এ গঠনও এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয় নি।

মোটামুটি কাছাকাছি বাংলা ভাষায় কথা বলা এবং একটা অভিন্ন লেখ্য রীতির বাংলা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীকে এখন বাঙ্গালী বলা হয়। বাংলাদেশে এবং ভারতের পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা রাজ্যে এই জনগোষ্ঠীর কেন্দ্রীভবন ঘটলেও আসাম ও বিহারসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তা ছড়িয়ে আছে। বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং নিজেদেরকে বাঙ্গালী হিসাবে পরিচয় দেয় এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ কোটি।

ভাষাগত বিচারে চর্যাপদের কালে গেলে বাংলা ভাষার সূচনা কাল প্রায় হাজার বছর আগে। কিন্ত সে বাংলাকে বাংলা না বলাই ভাল। সে বাংলার সঙ্গে আধুনিক বাংলার মিলের চেয়ে গরমিল এত বেশী যে তাকে বাংলা হিসাবে চেনা বেশ কঠিন। বরং হিন্দী, উড়িয়া ইত্যাদি ভাষাও চর্যাপদের ভাষাকে নিজেদের আদি ভাষা হিসাবে দাবী করতে পারে এবং অনেক সময় সেটা করা হয়ও।

সব ভাষা এবং জাতির দীর্ঘ বিবর্তন এবং বিকাশ ধারা থাকে। কিন্তু আধুনিক বাংলা ভাষাকে যদি বাঙ্গালী জাতি গঠনের প্রধান শর্ত ধরা হয় তবে তার শুরু খুব সাম্প্রতিক কালের হয়ে দাঁড়ায়। মধ্যযুগে তা বাঙ্গালী পরিচয় নিয়ে কেবল দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। তবে তখনও সেটা একটা নাম। বঙ্গ শব্দ থেকে উদ্ভূত বাঙ্গালা নামক রাজনৈতিক ভূখণ্ড বা প্রদেশে বাস করার সুবাদে তার অধিবাসীরা বাঙ্গাল বা বাঙ্গালী নামে আর তাদের ভাষা বাঙ্গালা বা বাংলা নামে কিংবা কখনও বঙ্গ ভাষা নামে কথিত হচ্ছে। এবং এই পরিচয় বা বলাটাও প্রধানত বিদেশী শাসক বা বহিরাগতদের প্রয়োজনে।

এই সময় মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার লিপিমালা একটা রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেই লিপিতে কাব্য-সাহিত্য লেখা হচ্ছে। তবে বাঙ্গালী জাতির পরিচয় নিয়ে বাঙ্গালীর দাঁড়াবার দিন তখনও আসে নি। তখনও ‘জাত’ ও ধর্মের বিভাজন ছিল খুব প্রবল এবং সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র স্থানিকতার প্রভাব। স্থানিকতা এবং ‘জাত’ ও ধর্মের পরিচয়ের নীচে চাপা পড়ে ছিল বাঙ্গালীত্বের বোধ। কখনও এই বোধের হঠাৎ স্ফুরণ ঘটলেও সেটার প্রভাব ছিল নগণ্য।

এই বোধ প্রথম জাগে ইংরেজ শাসনামলে। কলকাতাকে কেন্দ্র করে আধুনিক বাংলা ভাষার সৃষ্টিও সেই সময়। সেটা ছিল হিন্দু বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের জাগরণের এবং নিজেকে বাঙ্গালী হিসাবে চিনতে শুরু করার কাল। কিন্তু এ জাগরণ বেশী দূর এগোয় নি। প্রথমত জাত-পাতের ব্যবধানের কারণে হিন্দুর পক্ষে কোন ঐক্যবদ্ধ ও সংহত সমাজ গঠনই ছিল সুকঠিন। কাজেই সংহত জাতি গঠন করা ছিল তার জন্য আরও কঠিন। তবু বাঙ্গালী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। কিন্তু হিন্দু এবং মুসলমানে বিভেদ ও বিরোধে শেষ পর্যন্ত সবই চাপা পড়ে গেছে। এবং নূতন করে বাঙ্গালী সত্তার জাগরণের সূচনা হয়েছে ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বাংলায় প্রধানত মুসলমান বাঙ্গালীদের ভিতর থেকে। অথচ মাত্র ১৯৪৭ সালে তারা নিজেদেরকে ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দু বাঙ্গালীদের থেকে পৃথক করে নিয়েছিল। কিন্তু আত্মবিকাশের প্রয়োজনে ধর্মের পরিবর্তে তারা তাদের ভাষা বাংলাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরল। এভাবে বিভক্ত জাতিসত্তা বাঙ্গালীর নূতন কালের পথে যাত্রা শুরু হল।

প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালী শুধু বিভক্ত নয়, তা এখনও জাতি হয়ে ওঠে নি। এখনও তার জাতি গঠন প্রক্রিয়া চলছে। একটা সচেতন, সংহত এবং রাজনৈতিক জাতি হবার পথে ১৯৭১-এ তা পদক্ষেপ দিলেও সেটা থমকে আছে। পুনরায় ধর্ম এসেছে তার জাতি হবার পথটিকে রুদ্ধ করে দিতে। ধর্ম বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে বিভক্ত করায় আজ অবধি তার ধর্ম বোধ ও জাতি বোধে সমন্বয় বা মিল হয় নি। বরং সর্বদা ধর্ম দাঁড়িয়ে থেকেছে জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর বিকাশের বিরুদ্ধে।

বস্তুত বাঙ্গালীর জাতি হবার লড়াই যতটা না বাইরের শক্তির বিরুদ্ধে তার চেয়ে অনেক বেশী তার নিজের ভিতরের শক্তির বিরুদ্ধে। ভিতরের এই শক্তি তার প্রচলিত ধর্ম। আর তাই ধর্মের বিরুদ্ধেই তার লড়াই সবচেয়ে প্রবল রূপে চলছে। এই লড়াই সর্বদা সরল রেখায় এবং স্পষ্ট রূপ নিয়ে যে চলে তা নয়। এখানে অনেক বাঁক বা মোড়, আড়াল এবং উত্থান-পতন আছে। তবু এ লড়াই আছে। সেটা ’৫২-তে হোক, ’৬৯-এ হোক, ’৭১-এ হোক, ’৯০-তে হোক এবং যে রূপ নিয়ে হোক আছে। এ লড়াইয়ের মর্মে আছে উন্নত বাঙ্গালী জাতি ও তার পরাক্রান্ত রাষ্ট্র গঠনের দুর্নিবার কল্পনা ও আকাশ ছোঁওয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

এ লড়াই আছে বলে বাঙ্গালী অন্তত এ বাংলায় এতটুকু এগোতে পেরেছে। এ লড়াইয়ের প্রধান চালিকা শক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ এবং ছাত্র-যুব শক্তি। সুতরাং মূলত তাদের ভূমিকার উপর নির্ভর করছে বাঙ্গালী জাতি গঠনের আরব্ধ কাজের সম্পূর্ণতা।

রচনাঃ জুন-আগস্ট, ২০০৫

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ