Banner
গ্রামীণ ব্যাংক : রক্তচোষা না সেবামূলক? -- আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ May 16, 2011, 5:38 AM, Hits: 29342

আমার গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের সুদের হারটি নিয়ে ব্যাপক বির্তক চলছে; অথচ কেউই ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছেন না। ডঃ ইউনূসের সমালোচকরা বলছেন ৩০%, সর্মথকরা বলছেন ২০% বা তারও কম। সহজ হিসেবে প্রকৃত সুদের হার হচ্ছে ৪০-৪৪%। আসুন দেখি কিভাবে।

১৯৮০-র দশকের শুরুতে আমাদের এলাকায় আসে গ্রামীণ ব্যাংক। শুনতাম ২০% হারে ঋণ দিচ্ছে গ্রামের নিঃস্ব মানুষকে। মনে হতো বেশ “বদান্যতামূলক” একটা উদ্যোগ। অন্যান্য ব্যাংকও ঋণ দিচ্ছে প্রায় একই হারে, তবে কেবল উঁচু-স্তরের মানুষকে, নিঃস্ব মানুষকে নয়। গ্রামীণকে বদান্যতামূলকই বলতে হবে। এবং বিশ্ব-জোড়া ডঃ ইউনূস গ্রামীণকে সে পরিচিতিই দিয়েছেন, যার বদৌলতে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত পেয়েছেন।

তবে ১৯৯৫ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হব, তখন একদিন আমার মাথায় এল যে, গ্রামীণ ব্যাংকের স্বল্পহারে ঋণ দানের সুদটা আসলে স্বল্প নয়। আসল সুদের হার দাঁড়ায় ৪০%-এর উপরে। গোমরটা এখানে :

কেউ ১০০ টাকা ঋণ নিয়ে মোট ১২০ টাকা ফেরত দিচ্ছে এক বছর পর। কিন্তু সাপ্তাহিক কিস্তি ফেরত দেওয়া শুরু হয় “০” (শূন্য) দিন থেকে। তার মানে ঋণ-গ্রহীতা পুরো ১০০ টাকা খাটাচ্ছে ছয় মাসেরও  কয়েকদিন কম। সুতরা সুদের হার সরাসরি ৪০%-এর উপরে পড়ে যাচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়! তার সাথে যোগ করতে হবে সাপ্তাহিক কিস্তিতে সুদে-আসলে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারটি। সাপ্তাহিক কিস্তি সুদের ব্যাপারটি (অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধি হার) যোগ করলে প্রকৃত সুদের হার দাঁড়াবে ৪৪%-এর উপরে।

অর্থাৎ গ্রহীতাকে কাগজে-কলমে দেখানো হচ্ছে সুদের হার মাত্র ২০%, কিন্তু ব্যাংক আসলে আদায় করছে ৪৪%। ব্যাপারটি আমার মাথায় আসতে সময় নিয়েছে প্রায় ১৫ বছর। আর দেশ-বিদেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মাথায় এ সাধারণ হিসেবটা আজও ঢুকছে না। ২৯ মার্চ  (২০১১) আমেরিকার মিশিগানের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের “অর্থনীতির” প্রফেসর আব্দুল্লাহ আ, দেওয়ান ঢাকার Daily Sun পত্রিকায় ‘‘Demystifying Grameen Bank’s interest rates’’ শীর্ষক এক উপসম্পাদকীয়তে ব্যাখ্যা করে গেলেন কীভাবে সমালোচকরা গ্রামীণের সুদের হারকে ৩০% বলে অতিরঞ্জিত করছেন, যদিও প্রকৃত সুদের হার ২০%। সেন্টার “ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট”-এর ঊর্ধ্বতন গবেষক ডেভিড রুডম্যানের তথ্যের ভিত্তিতে (দেখুন এখানেঃ http://www.youtube.com/watch?v=2mdPS4rLb4M&NR=1) তিনি লিখেন, ডঃ ইউনূসের সমালোচকরা প্রকৃত সুদ ২০%-এর সাথে আরও ১০% যোগ করছেন গ্রহীতা প্রতি সপ্তাহে ঋণের কিস্তি পরিশোধে যে সময় ব্যয় করে তার বিনিময় মূল্য হিসেবে। আশ্চর্যের বিষয় যে, ঋণ-গ্রহীতার অপচয়কৃত সময়ের বিনিময়মূল্য বাদ দিলেও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকৃত সুদ আদায়ের হার দাঁড়ায় ৪৪%-এর বেশী, যা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের “অর্থনীতির” প্রফেসর বা “ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট”-এর ঊর্ধ্বতন গবেষকের মাথায়ও খেলছে না।

দেশ-বিদেশের অনেকেই ডঃ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার অর্জনে  উৎফুল্ল; সেটা তার মহান ও বদান্যতামূলক গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের ন্যায্য পুরস্কার। কিন্তু প্রশ্ন হলোঃ ৪০-৪৪% হারে ঋণ নিয়ে ক’জন লাভবান হতে পারবেন; আর ক’জন  পথে বসে যেতে পারবে?

দেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাও গ্রামীণের দেওয়া উচ্চহারে ঋণ নিয়ে লাভবান হবার আশা করতে পারবে না। অথচ গ্রামীণের ঋণ যাচ্ছে গ্রামের সবচেয়ে অশিক্ষিত মহিলাদের কাছে।

এরূপ হারে ঋণ নিয়ে খুব কম লোকই লাভবান হতে পারেন। বেশীর ভাগ গ্রহীতা কঠোর পরিশ্রম করে যা লাভ করবেন, তার পুরোটা বা সিংহভাগ গ্রামীণকে ফেরত দিতে বাধ্য হবেন। যারা লাভবান হতে পারবেন না, তারা এটা-সেটা বিক্রি করে ঋণটা পরিশোধ করবেন নতুন ঋণের আশায়। এভাবে অনেকটা জুয়া খেলার মত সহায়-সম্পত্তি হারাবেন কেউ কেউ। গ্রামীণের মত এন.জি.ও. গুলোর ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য মোচন করতে পারবেন খুব কম লোকই।

তাহলে গ্রামীণের ঋণ-প্রকল্পের ফলাফল কি? ফলাফল হল : হত-দরিদ্র জনগণের কঠোর পরিশ্রমের ফসল প্রায় পুরোটা বা সিংহভাগটা যাচ্ছে ঋণ-দাতার হাতে, গড়ে উঠছে গ্রামীণের মত বড় বড় সংস্থা । প্রকৃত লাভবান হচ্ছেন ঋণদাতা ও বেশ কিছু শিক্ষিত মানুষ, যাদের কর্ম-সংস্থা হচ্ছে। যাদের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমে এসব এন.জি.ও.-র পুঁজি বাড়ছে, সেসব নিঃস্ব গ্রহীতারা সামগ্রিকভাবে আদৌ লাভবান হচ্ছে না।

২৩শে মার্চ ঢাকার আমেরিকান-আন্তর্জাতিক স্কুলে এক আয়োজনে ডঃ ইউনূস দাবী করেন : ক্ষুদ্রঋণ ও অক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা পার্থক্য র্নিধারণ করতে হবে যে - এদের একটি সমাজসেবামূলক, অপরটি পয়সা কামানোর জন্য। গ্রামীণের মত প্রতিষ্ঠানগুলো যে কতটা “সেবামূলক” আর কতটা পয়সা কামানোর জন্য - সেটা এ আলোচনায় স্বচ্ছ হয়ে উঠবে সবার কাছে।

গ্রামীণ গরীবের রক্তচোষণকারী বলা ঠিক না হতে পারে, তবে এরূপ একটা প্রকল্পকে মহানুভব, বদান্য ও সমাজসেবামূলক হিসেবে তুলে ধরতে ডঃ ইউনূসের এ প্রচেষ্টা বা দাবী মূলত অনৈতিক। শুধু দেশের ভিতরেই নয়, বাইরেও তিনি  সেটা করেছেন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খায়েসে। ৪৪% হারে সুদ আদায় করে সেটাকে ২০% দেখিয়ে ডঃ ইউনূস গোল খাইয়েছেন দেশের নিঃস্ব মানুষকে; সে গোল তিনি খাইয়েছেন নোবেল কমিটিকেও।

(আলমগীর হুসেন (PH.D) একজন গবেষক ও লেখক।)

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ