Banner
চতুর্দশ অধ্যায় : বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাস

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:51 AM, Hits: 1428

মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পিছনে শ্রমের ভূমিকা আছে বৈকি। এঙ্গেল্স এই ভূমিকার উপর জোর দিয়েছেন। সেটা যাঁরা শ্রমকে বাদ দিয়ে শুধু বুদ্ধি চর্চার মধ্যেই মানুষের বিকাশ সূত্র দেখতে পেতেন তাঁদের ভ্রান্ত যুক্তি ও ধারণাকে খণ্ডন করার প্রয়োজনে। কিন্তু বুদ্ধি বা মনন চর্চা বাদ দিয়ে যদি শুধু শ্রমের মধ্যেই মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাসের সূত্র সন্ধান করা যায় তবে সেটা হবে আর এক ভ্রান্তি।

শুধু শ্রম দিয়ে কি হবে? তাহলে গরুর শ্রমের মধ্যেও আমাদের সেটা খুঁজতে হয়। পৃথিবীর এক প্রাচীনতম সভ্যতার উদ্ভব এই ভারতবর্ষে। সেটা সিন্ধু-পাঞ্জাবের বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায়। শেষ হিম যুগ আজ থেকে দশ হাজার বৎসর পূর্বে শেষ হলে সেখানে মানুষের প্রথম স্থিতিশীল জীবনের সূত্রপাত হয় এবং সেই সঙ্গে কৃষি জীবনও গড়ে ওঠে ঐ এলাকায়। সেখানে নগর সভ্যতা গড়ে ওঠে আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্ব থেকে ছয় হাজার বৎসরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। কৃষিতে গরুর ব্যবহার যদি সেই সময় থেকেও হয়ে থাকে তবে প্রায় ছয় হাজার বৎসর ধরে গরু লাঙ্গল টানছে। এই ছয় হাজার বছর শ্রমের কারণে গরুর চেতনার কতটুকু বিকাশ হয়েছে সেটা নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখতে পারেন। তবে আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে যেটা বুঝি সেটা হল ছয় হাজার বছর লাঙ্গল টানার পরও গরু গরুই রয়ে গেছে। কারণ তার স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি নেই। যেটা আছে সেটা তার স্নায়ুতন্ত্রের নির্দিষ্ট কতকগুলো তাড়নার সমাহার মাত্র। সেটার বাইরে তার যাবার উপায় নেই। তার দেহতন্ত্র ও মস্তিষ্ক গঠনই সে উপায় রাখে নি। কিন্তু মানুষের স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি আছে এবং তার মস্তিষ্কের ক্ষমতা প্রায় অসীম। আর তাই ছয় হাজার বছরে মানুষ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে সেটা এতকালের রচিত সকল রূপকথার সবচেয়ে অবিশ্বাস্য কল্পনাকেও হার মানায়।

হাঁ, মানুষ মানুষ হয়েছে প্রধানত তার বুদ্ধিবৃত্তির জোরে। যখন অমানুষ হয় তখনও প্রধানত তার কারণে। যখন তার পতন ঘটে তখনও সেই বুদ্ধিবৃত্তির পতনের কারণে। হয়তো আর এক উন্নততর বুদ্ধিবৃত্তির কাছে পরাজয় তার পতনটাকে চূড়ান্ত করে। মানুষ যখন একটা নির্দিষ্ট চিন্তা কাঠামোতে আটকে গিয়ে পরিস্থিতি ও সময়ের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না তখন তার বুদ্ধিবৃত্তি স্থবির হয়ে তালগোল পাকায় একই জায়গায়। আর তালগোল পাকানোর ফলেও তার পতন অনিবার্য হতে পারে।

আজ জাতি হিসাবে আমাদের মুক্তির জন্য তাই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে সবার আগে মুক্ত করতে হবে। মনে রাখতে হবে আমাদের যুগ-যুগান্তের দু:খ, বেদনা ও গ্লানির মূলে রয়েছে এই বুদ্ধিবৃত্তির বিকৃতি অথবা দৈন্য। এই বিকৃতি অথবা দৈন্যের সুযোগ নিয়ে আমাদের শত্রুরা, জাতি ও জনগণের শত্রুরা আমাদের জীবনের অন্ধকারটাকে স্থায়ী করে রাখছে মাত্র।

যারা এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য নিজেদের নিবেদিত করেছে তারাও বুদ্ধিবৃত্তির দৈন্যের শিকার হয়েছে এ দেশে। আমার রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাও সে কথা বলে। রাজনীতি করতে গিয়েও দেখেছি চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আমরা কতটা পশ্চাৎপদ। এটা যে শুধু কয়েকটি মানুষের পশ্চাৎপদতার ব্যাপার তা নয় বরং তা সমগ্র সমাজেরও পশ্চাৎপদতার প্রকাশযখন রাজনৈতিক দল করেছি তখন দেখেছি সেখানে সমাজের পশ্চাৎপদ চেতনার প্রতিফলন কিভাবে হয়। কোনো ধারণা ছাড়া কোনো কাজে হাত দেওয়া যায় না। কাজেই একটা ধারণা নিয়ে হয়তো কাজটা শুরু করলাম। শুরু করার পর হয়তো ধারণার ভুলটা দেখলাম। তখন উপলব্ধি এল যে, এটা পথ নয়, এখন আমাদের ভিন্ন পথে যেতে হবে। এবং সেই পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটা প্রাথমিক ধারণাও হয়তো ইতিমধ্যে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু তখন সেটা আর কাউকে মানানো যায় না। তারা চায় ঐ পথেই গোঁয়ারের মতো শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যেতে। এর সুযোগ নিয়েছে পশ্চাৎপদ চেতনা এবং বুদ্ধিবৃত্তির নেতারা।

বুদ্ধিবৃত্তির বিকারের ফলে হাজার হাজার বছর ধরে এটা উদ্ভট সাধনার দেশ। গাছের ডালে ঠ্যাং বেঁধে মাথা নীচে ঝুলিয়ে কয়েক দিন থাকতে পারলে মেলা ভক্ত, শিষ্য জুটে যেত। বুদ্ধ তো সংসার ত্যাগ করে ছয় বছর কঠোর সন্ন্যাস সাধনা করে বুঝলেন যে, ওভাবে কিছু হয় না, সত্যকে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর সন্ন্যাস সাধনার মহিমায় মুগ্ধ হয়ে কিছু শিষ্যও জুটেছিল। বুদ্ধ যখন কঠোর আত্মনিগ্রহের সাধনার পর ঐ পথের ভ্রান্তি বুঝলেন তখন সে পথ থেকে ফিরতে চাইলেন। কিন্তু গুরুর এমন মত পরিবর্তন দেখে তাঁর শিষ্যরা তাঁকে ছেড়ে চলে গেল। ভাগ্যিস! বুদ্ধ ঐসব গবেট শিষ্যের গুরু হয়ে থাকতে চান নি। তবে আড়াই হাজার বছর আগের সেই কালেই নিশ্চয় ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তির মানটা এ কালের চেয়েও অনেক উন্নত ছিল। তা না হলে বুদ্ধকে বুদ্ধ হতে হত না। হয় শেষ পর্যন্ত কপিলাবস্তুতে ফিরে সংসার সাধনা করতে হত, নয় জঙ্গল সাধনা করে যেতে হত। পৃথিবী বুদ্ধকে পেত না। এ কালটা হল রামকৃষäদের বুদ্ধিবৃত্তির যুগ। কালী প্রতিমা থেকে কালী বেরিয়ে এসে রামকৃষেäর দুধ-কলা খেয়ে নেয়! আর সেটা বিশ্বাস করার লোকের অভাবও হয় না। ঐ ব্যক্তি এ দেশের বাঘা বাঘা লোকেরও গুরু হয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দের মতো মানুষেরও তিনি গুরু। আর কয়েক দিন আগেই গণেশ মূর্তির দুধ খাওয়া নিয়ে ভারতে যে উন্মাদনা চলল সে কথা মনে এলে বলতে হয় যে, এ ভূমি আজও পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকারের আবাস হয়ে রয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তির স্থবিরতা আর বিকারের এই উপমহাদেশে নেতার নড়ার উপায় নেই। এমন কি যুদ্ধেও নয়। রাজা বা সেনাপতিকে লড়াইয়ের ময়দানে বসে থাকতে হত হাতির পিঠে হাওদায়। আর সৈনিকরা তাকে দেখে লড়াই করত। নিশ্চয় অর্ধেক মন থাকত শত্রুর দিকে আর বাকী অর্ধেকটা ঐ হাতির হাওদার দিকে। হাতির হাওদা খালি দেখতে পেলেই সৈনিকরা রণক্ষেত্র ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাত। ধরে নিত রাজা বা সেনাপতি নিহত বা বন্দী হয়েছে। অন্যদিকে রাজা বা সেনাপতি ওখানে থেকে শত্রুর সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হত।

কিন্তু খাইবার গিরিপথ পার হয়ে যে শত্রুরা আসত তারা তো আর হাতির পিঠে চেপে আসত না। তারা এই এক দঙ্গল বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর মাঝে হাতির পিঠে থাকা রাজা বা সেনাপতিদের সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসাবে দেখতে পেত। এবং অনেক কম সৈন্যবল নিয়েও ঐ রাজা বা সেনাপতিকে বন্দী বা হত্যা করে সহজেই যুদ্ধ জয় করত। আলেকজান্ডার তাঁর স্বল্প সংখ্যক সেনা নিয়েই রাজা পুরুকে হাতির পিঠ থেকে বন্দী করলেন। রাজা দাহির আরব আক্রমণকারীদের হাতে নিহত ও পরাজিত হলেন হাতির পিঠে চেপেই। রাজা জয়পালও যথারীতি হাতির পিঠে চেপে সুলতান মাহমুদের প্রথম ভারত আক্রমণ ও লুণ্ঠন অভিযান প্রতিহত করতে গিয়ে পেশোয়ারের প্রান্তরে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হলেন। হিমুর পরাজয় হল পানিপথের যুদ্ধে হাতির পিঠে চেপে যুদ্ধ পরিচালনার সময় আকবরের অভিভাবক ও সেনাপতি বৈরাম খাঁ-এর এক সৈনিকের নিক্ষিপ্ত তীর তাঁর এক চোখের ভিতর ঢুকে যাওয়ায়। নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার জ্ঞাতি শওকত জং লড়তে গেলেন সিরাজের বিরুদ্ধে। তা ঐ হাতির পিঠে বসে শওকত জং নওয়াব সৈনিকের বন্ধুকের গোলায় ওখানেই অক্কা পেলেন। তিনি যতক্ষণ বসে থাকলেন তাঁর সৈন্যরা লড়ল। কিন্তু যখনই দূর থেকে দেখল যে, শওকত জং আর বসে নেই, শত্রুর গোলার আঘাত তাঁর সিংহাসনের সাধ মিটিয়েছে তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাল।

হাঁ, এ দেশে ঐ হাতির পিঠে চেপে থাকতে হয়। ওখান থেকে নড়ার উপায় থাকে না। ওখানে ঐ অত উপরে বসে থেকে, ঐ রকম এক স্থবির জন্তুর উপর থেকে রণনৈপুণ্য প্রদর্শনের সুযোগ কতটুকু থাকে? সবচেয়ে বড় কথা লড়াইয়ে যে শত্রুকে ফাঁকি দিতে হয়, লড়াইয়ের প্রয়োজনে রণকৌশল বদলাতে হয় ও সবের উপায় কোথায়? আর শুধু যে নিজ সৈন্যদের দৃষ্টিগোচর হয়ে থাকা হয় তা তো নয়, বরং শত্রুরও দৃষ্টিগোচর হয়ে সহজ লক্ষ্যবস্তু হতে হয়।

তা, আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময় থেকে ধরলেও সোয়া দুই হাজার বছরেও ভারতবর্ষ এটা শিখল না। গ্রীক এসেছে, জয় করেছে। শক এসেছে, জয় করেছে। হুন এসেছে, জয় করেছে। তুর্কী এসেছে, মোগল এসেছে, জয় করেছে। পায়ে হেঁটে হোক আর ঘোড়ায় চেপে হোক এসেছে, জয় করেছে। কিন্তু এই ভূভাগে কিছু কাল থাকার পর সবাইকে ঐ হাতির পিঠে চাপতে হয়েছে। উপায় নেই! তা না হলে ভারতীয় সৈনিকরা লড়াই করতেই পারবে না। সংগঠন শক্তি উন্নত করার চেতনা নেই! রণকৌশলের অবিরাম পরিবর্তনের শিক্ষা নেই! প্রয়োজন অনুয়ায়ী রণনীতির পরিবর্তন ঘটাবারও উপায় নেই! তা, লড়াই জেতার উপায় কি? উপায় হল একপাল হাতি আর এক দঙ্গল সৈনিক নিয়ে শত্রুকে ভয় পাওয়ানো। কিন্তু হাতির শরীর আর সৈন্য সংখ্যা দেখে যেসব বিদেশী ভয় পায় নি তাদের হারাবে কিভাবে? সুতরাং অন্তত সোয়া দুই হাজার বৎসর ধরে বার বার নিজেরা হেরেছে। তবু শিক্ষা নেয় নি। বরং উচ্চ নিনাদে গান গেয়েছে, ‘শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।’ শিক্ষা নেবার উপায় যখন নেই তখন ঐ সান্তবনার গান গাওয়া ছাড়া উপায় কি?

নিবে কিভাবে? শিক্ষা নেওয়ার শিক্ষাটাই তো এদের ছিল না। এটা যে আজো নেই তা এ দেশের অবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বিশেষ করে যারা আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি করে তাদের মধ্যে চিন্তার অনড়তা খুব স্পষ্ট। কারণ তাদের কাছে আদর্শ মানে তো ‘নট নড়ন চড়ন’! আর যদি একান্ত চলতে হয় তবে চলতে হবে নাক বরাবর। অবশ্য সামনে তাল গাছ পড়লেই মহা বিপদ! কারণ লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য পথ পরিবর্তন করলেই তো পথ বিচ্যুতি, সুতরাং আদর্শচ্যুতি হল! হাঁ, আদর্শের একটা ফর্মুলাও এরা গ্রহণ করে। নিজেদের তৈরী করার মুরোদ নেই। অন্যদেরটা নেয়। তা নিক। শুরুর জন্য একটা কিছু লাগে। কিন্তু আদর্শ মানে কি জীবনের চেয়েও বড়? মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনার চেয়েও কি সেটা বড় হতে পারে?

বর্ণজাতিভেদের এই দেশে আদর্শ মানে ধর্ম। গতিশীল জীবনের মহৎ আদর্শ অর্থে ধর্ম নয়। ধর্মের যে বিশেষ মানেটা এই ভূভাগে তৈরী হয়েছে সেই ধর্ম। কর্মকারের ধর্ম লোহার কাজ করা। কৃষকের যে সব বর্ণজাতি আছে তাদের ধর্ম কৃষি কাজ করা। নাপিতের ধর্ম চুল কাটাক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ করা। মেথরের ধর্ম ময়লা ফেলা। ব্রাহ্মণের ধর্ম অন্ধ বিশ্বাস চর্চা করা। চোরের ধর্ম চুরি করা। ডাকাতের ধর্ম ডাকাতি করা। না, চোরের ধর্ম, ডাকাতের ধর্ম রসিকতা করে বলছি না। এটাও এই উপমহাদেশে ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ হয়ে যেতে পারত। ঠগীদের ইতিহাস পড়লে জানা যায় তারা কিভাবে নরহত্যা ও দস্যুতাকে তাদের ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল।

বর্ণজাতিভেদের যে বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো তার বাইরে এ দেশ, উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমান অধিকাংশই যেতে পারে নি। তাই অধিকাংশই স্থবির। এক পেশার লোক আর এক পেশা সম্পর্কে খোঁজ রাখারও প্রয়োজন বোধ করে না। প্রায় সবাই যার যার খণ্ডিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং কর্মকেই একমাত্র সত্য, সম্পূর্ণ সত্য মনে করে এগোতে চায়। এবং তারা কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে নড়তে চায় না। কারণ তাহলে যে ধর্মচ্যুত হবে! যাদের ধর্মবোধটা ভিন্ন, তাদের ভয় আদর্শচ্যুতির। আর যাদের কোনো আদর্শই নেই, লুণ্ঠন, চুরি, আত্মসাৎ যাদের আয়-উন্নতির পথ, ওটাই তাদের কাছে ধর্ম বা আদর্শ। ঐ পথে চলার জন্যও তাদের ভিতর গ্লানি নেই।

এই সমগ্র উপমহাদেশের, ভারতবর্ষের মন-মানসিকতা বড় জটিল। একটার সঙ্গে আর একটার সংযোগ নেই। এক কুঠরির সঙ্গে আর এক কুঠরির যোগাযোগের পথটা বন্ধ। তবু যোগাযোগ একটা আছে বৈকি! তা না হলে সমাজ চলবে কি করে? সেই যোগাযোগটা জীবন্তু নয়। এটা হল চুইয়ে পড়া যোগাযোগ। এক জায়গার অভিজ্ঞতা বা ধারণা আর এক জায়গায় যেটুকু চুইয়ে যায় সেটুকুই অন্যদের কাছে পূর্ণাঙ্গ মনে হয়। ফলে মানুষ সম্পর্কে, জীবন সম্পর্কে ধারণা খুবই খণ্ডিত। ফলে ভ্রান্তও।

এই ভূভাগের পণ্ডিত, মহাপণ্ডিতদের অধিকাংশই এর বাইরে নয়। কিছুটা নীচের দিকে যারা জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে জ্ঞান সাধনা করে তাদের অনেকের ধারণা হয়তো অনেক বেশী পূর্ণাঙ্গ হতে পারত। কিন্তু সমাজের প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর কিংবা সমগ্র সমাজেরও সমর্থনের অভাবে কিংবা বিরোধিতায় সেসব বিকশিত হয় না। তার পরিচয় সমগ্র সমাজ পায় না। তারা তাদের বিকাশ সম্ভাবনা নিয়ে নীরবে, নিভৃতে ঝরে যায়। আর জ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তির জগতে যারা আধিপত্য করে তারা হল বর্ণজাতিভেদমূলক চেতনার প্রতিনিধি, যেখানে উৎকৃষ্টতা ও নিকৃষ্টতার এমন সমাহার ঘটে যাকে বোঝাতে হলে আলবেরুনীর ভাষা প্রয়োগ করতে হয়।

ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তির অবস্থাটা বোঝাবার জন্য এখন আমি একটা উদাহরণ দিব। সেটা হল ঋগ্বেদের উদাহরণ। প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের পণ্ডিতরা বলেছে যে, আর্যদের আদিগ্রন্থ ঋগ্বেদ ভারতবর্ষে বহিরাগত যাযাবর, পশুপালক আক্রমণকারীদের রচনা। আর এইভাবে ভারতবর্ষের একটা মিথ্যা ইতিহাস তৈরী হয়ে গেল। এবং সেই মিথ্যা আজ ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিত্তিও হয়ে গেছে। যাঁরা ঋগ্বেদ পড়েন নি আমি তাঁদেরকে অভিযুক্ত করি না। তাঁদের দোষ কি? সবাইকে সব কিছু পড়তে হবে ওটা কোনো কথা নয়। কিন্তু যাঁরা নিজেরা বেদ-পণ্ডিত এবং ঋগ্বেদ পড়ে তারা ব্যাখ্যা করেছেন সেই শত শত বা হাজার হাজার পণ্ডিত কি মানুষের সঙ্গে ভাষার সম্পর্কটাও বোঝেন না? না, ঋগ্বেদের ভাষা তো ওদের কাছে দেবভাষা! স্বর্গের নগর সভ্যতার অধিকারী দেবতারা কতকগুলো মূর্খ, যাযাবর, পশুপালক, ভাষাজ্ঞানহীন বর্বর ঋষিকে কতকগুলো শব্দ বা বাক্য মুখস্থ করিয়েছে আর অমনিই ঋগ্বেদ তৈরী হয়ে গেল!

ঋগ্বেদের উপর শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে আমার যৌথভাবে লেখা বই আছে। ইংরাজীতে লেখা বইটার নাম The Aryans and The Indus Civilization. এই বইয়ে আমরা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদ এবং তার রচয়িতা আর্যদের সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছি।* তা, সেটা এখানে আমার আলোচনার বিষয় নয়। সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে কিংবা তার কোন্ পর্যায় বা কোন্ অঞ্চলের সঙ্গে ঋগ্বেদের কিংবা আর্যদের কি ধরনের সম্পর্ক তা নিয়ে নিশ্চয় বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু ঋগ্বেদ পশুপালক যাযাবর এবং বহিরাগত আক্রমণকারীদের ধর্মগ্রন্থ যখন এ কথা বেদজ্ঞ পণ্ডিতরা বলেন তখন ক্ষোভ জাগে।

_________________________________________________________________________________

* উভয় গ্রন্থকার কর্তৃক উল্লিখিত বিষয়ের উপর বাংলায় আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতানামে একটি গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

_________________________________________________________________________________

 

ইউরোপের না হয় সত্যটা বলার বা বোঝার প্রয়োজন নেই। বরং সত্যটা বলাই তাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল। কারণ ঋগ্বেদের এমন উদ্ভট ব্যাখ্যা যখন তারা দিয়েছিল তখন ভারতবর্ষ ছিল তাদের উপনিবেশ। সত্যটা স্বীকার করলে তাদের ‘রেসিয়াল’ দম্ভটা ভয়ঙ্করভাবে মার খায়। কারণ সমগ্র ইউরোপের ভাষা, সংস্কৃতি, সভ্যতা প্রধানত আর্যদের অবদান। গ্রীক-রোমান সভ্যতার সৌধটা নির্মাণ করেছিল আর্যরা, অর্থাৎ আর্য ভাষা-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারীরা। আর এই আর্য-গৌরবের একমাত্র বিশুদ্ধ দাবীদার হয়ে হিটলার তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই বাধিয়ে ফেললেন। সুতরাং একবার যদি স্বীকার করা যায় যে, আর্যদের প্রাচীনতম গ্রন্থটা ভারতবর্ষের বিস্মৃত অতীতের গর্ভে হারানো এক সুউন্নত নগর সভ্যতার সংগঠক কিংবা উত্তরাধিকারী আর্যদের সৃষ্টি তাহলে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দম্ভটা মারাত্মক ঘা খায়। তারা নেমেছে ‘অসভ্য, বর্বর’ পৃথিবীকে সভ্য করতে আর সেখানে কি না যদি দেখা যায় প্রায় তিন, সাড়ে তিন হাজার কিংবা চার হাজার বৎসর পূর্বে কথিত আর্য ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহক ভারতীয়রা ভারতবর্ষ থেকে ইউরোপে গিয়ে তাদেরকেই প্রথম সভ্য করেছে, উন্নত ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা দান করেছে এবং শুধু তাই নয় আজকের ইউরোপীয়রা ঐ দেশান্তরী ভারতীয়দের সভ্যতার উত্তরাধিকারী তা হলে তাদের দম্ভটা থাকে কোথায়? জবরদস্তি করে ভারতবর্ষ কিংবা প্রাচ্যকে অধীনস্থ করে রাখার পিছনে তো একটা যুক্তি দরকার। তাদের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য যেটা আজো চলছে তার জন্যও তাদের ঐ মিথ্যার প্রয়োজন আছে। ওটা শুধু জ্ঞানের ব্যাপার নয়, রাজনীতিরও ব্যাপারএবং রাজনীতিটাই প্রধান। এটাও ঠিক করে দেয় জ্ঞান কেমন হবে, ইতিহাস কিভাবে লেখতে হবে সেটা।

তা, না হয় ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের ব্যাপারটা বুঝলাম। কিন্তু ভারতবর্ষের ব্যাপারটার ব্যাখ্যা কিভাবে করব? একটা বিষয়ে আমি নি:সংশয় হয়েছি যে, ঐ পণ্ডিতরা হয় মতলববাজ, ইউরোপের আত্মমর্যাদাবোধহীন দাস মাত্র অথবা ওদের পাণ্ডিত্য মূর্খামিপূর্ণ। হাঁ, এদের প্রতি এখন আমার করুণাই জাগে। যারা এইটুকু বোঝে না যে, ভাষা মানুষের সমাজ কিংবা সভ্যতার প্রতিফলন তারা করবে ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থ, সমাজের ব্যাখ্যা! ঋগ্বেদের সবটুকু বোঝার প্রয়োজন হয় না মূল একটি বিষয় বোঝার জন্য। সেটা হল ঋগ্বেদ এমন একদল মানুষের রচনা যারা একটি সুউন্নত সভ্যতার অধিকারী কিংবা তার প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী। কয়েক হাজার বৎসরের এক অত্যন্ত উন্নত নগর সভ্যতার অভিজ্ঞতা ছাড়া মানুষের পক্ষে ঐ কল্পনা, উপমা, ছন্দজ্ঞান, বাক্য বিন্যাস, শব্দ সম্ভার আয়ত্ত করাই সম্ভব ছিল না। এবং এটা এক স্থিতিশীল সভ্য জীবনেই সম্ভব।

হাঁ, ঐ মূর্খ-পণ্ডিতরাই সমগ্র উপমহাদেশের জ্ঞানের এবং বুদ্ধিবৃত্তির জগতের বেশীর ভাগটাকেই নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা সত্যের কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করেছে তারা এই সমাজে সাধারণত দাঁড়াতে পারে নি। কে শুনবে তাদের কথা! ঐ মূর্খ-পণ্ডিতরা না ইউরোপের সার্টিফিকেট পাওয়া!

নিশ্চয় ঐ পণ্ডিতদের কাছ থেকেও অনেক কিছু জানার এবং শেখার আছে। কিন্তু তাদের মূর্খামিটা বাদ দিয়ে। ঐ ওদের পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে বাংলার এক যথার্থ সত্যসাধক পণ্ডিত বিনয় ঘোষ শেষাবধি মোহমুক্ত হয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন তা এখানে উদ্ধৃত করার লোভ আমি সংবরণ করতে পারছি না। বাংলার নবজাগরণের অতিকথা বা ‘মীথ’ সম্পর্কে যখন তাঁর মোহমুক্তি ঘটেছিল তখন তিনি ১৯৭০-এ ‘বাংলার নবজাগরণ : সমীক্ষা ও সমালোচনা’ নামে প্রবন্ধটি তাঁর ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে সংযোজন করেন। তাঁর কথাই আমি তুলে দিই, ‘গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলার নবজাগরণের যে ভাবপ্রতিমা, ঊনিশ শতকের পশ্চাদ্পটে, নানা রঙের প্রলেপ দিয়ে আমরা নির্মাণ করেছি, তার অনেক রঙ আজ সামাজিক গতির তরঙ্গে ধুয়েমুছে মাটি হয়ে গিয়েছে, অনেক রঙের বাহ্য ঔজ্জ্বল্য ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। তার কারণ, প্রলেপগুলি বেশীর ভাগই কাঁচা রঙের। তা থেকে বোঝা যায়, আমাদের ইতিহাসের ধারা বিশ্লেষণে, বিশেষ করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারা, মূলে কোথাও গলদ আছে, ভয়ঙ্কর একটা ফাঁক ও ফাঁকি আছে, যে ফাঁক ও ফাঁকি কেবল তারিখ ও তথ্যের সমারোহে পূরণ করা যায় না। কারণ প্রাণহীন নীরেট তথ্য, মহাফেজখানা বা গ্রন্থাগার যেখান থেকেই আবিষ্কৃত হোক, ঐতিহাসিক ও অনুসন্ধানীর হাতে তা খেলার পুতুল মাত্র। তিনি তাঁর দৃষ্টি, বুদ্ধি ও বিচারভঙ্গি অনুযায়ী সেগুলি নির্বাচন করেন, সাজিয়ে-গুছিয়ে সামনে উপস্থিত করেন এবং তার ভিতর দিয়ে ইতিহাসের পালাগান শোনান। সেটা কেবল তথ্যের পুতুলনাচের ইতিকথা, সমাজের ও মানুষের ইতিকথা নয়।’ (বিনয় ঘোষ, বাংলার নবজাগৃতি, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলকাতা, পৃ: ১৪২)।

বিনয় ঘোষ তাঁর ঐ গ্রন্থে শেষ পর্যায়ে আর একটি সংযোজন ঘটান ১৯৭৮-এ। নাম : “বাংলার নজাগৃতি’ একটি অতিকথা”জীবনের শেষ সময়ে তাঁর মোহমুক্তির এবং তার চেয়েও বড় কথা নূতন চেতনার জগতে তাঁর উত্তরণের এক অত্যন্ত মূল্যবান স্বাক্ষর এই শেষ সংযোজন। বিনয় ঘোষের মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবীর পক্ষে এমন উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল যিনি প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের উপর না দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে জীবন ও মানুষকে কাছে থেকে দেখার এবং বোঝার ঐকান্তিক চেষ্টা করেছিলেন। হাঁ, শূদ্র-ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিবৃত্তির বাইরেও আমাদের উত্তরাধিকার আছে বৈকি।

কিন্তু যারা তথ্যের পুতুলনাচের খেলা দেখিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির জগতে আত্মপ্রতারণা কিংবা পরপ্রতারণার কাজটা সবচেয়ে দক্ষভাবে চালাতে পেরেছে তারাই এই উপমহাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির মূল নিয়ন্তা। শূদ্র-ব্রাহ্মণ বুদ্ধিবৃত্তির এই ভূভাগে এই পণ্ডিতদের বুঝতে হলে কৌটিল্যের লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’ পড়া দরকার। এটা পড়লে বোঝা যাবে বিগত কয়েক হাজার বৎসর যাবৎ কি জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তি ভারতবর্ষে আধিপত্য করছে।

উৎকৃষ্ট ও নিকৃষ্টের এক বিস্ময়কর সমাহার এই গ্রন্থ। চরম নীতিহীনতা, অমানবিকতা এবং উচ্চ নিয়ম নিষ্ঠার এক বিস্ময়কর সমাহার ঘটেছে ওখানে। এক রাজাকে পরামর্শ দিয়েছে কিভাবে অন্য রাজাকে ধ্বংস করা যায়। রাজাকে শিখিয়েছে রাজপুত্রদের পঙ্গু করে রাখার কৌশল। রাজপুত্রদেরকে দিয়েছে পিতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার শিক্ষা। প্রজা সাধারণের দায়-দায়িত্ব, তাদের প্রতি রাজা ও রাষ্ট্রের কর্তব্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিধানও দেওয়া আছে। এমন কি বারবণিতার, দাস-দাসীরও অধিকার রক্ষার যে বিধান দেওয়া হয়েছে তা মনকে অভিভূত করে যা আসলে প্রাচীন সেই সমাজের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলনকিন্তু সব মিলিয়ে ব্যাপারটা কি? চোরকে বলেছে চুরি করতে আর গৃহস্থকে বলেছে পাহারা দিতে।

এমন এক মস্তিষ্কের উপমা আমাদের দেশেও আছে বৈকি! একজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক আছেন। তাঁর সম্পর্কে পাকিস্তান আমলে শুনেছিলাম যে, তিনি একই সঙ্গে দুইটা পৃথক সংবাদপত্রে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এবং বিপক্ষে সমানে লেখছেন। তখন ঐ বিতর্ক খুব জমে উঠেছিল। তীব্র আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে লেখা ঐ বিতর্কের কিছু আমিও পড়েছিলাম। তবে আরো অনেকের মতো আমিও শুনেছিলাম যে ওটা একজনেরই লেখা। অবশ্য আমি নিজে থেকে গিয়ে সেই বুদ্ধিজীবীকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিই নি যে ওটা ঘটনা নাকি রটনা। অবশ্য বুদ্ধিবৃত্তির ধার বাড়ানো জন্য এমন পদ্ধতিটা মন্দ কি? এটা তো বিতর্ক সভারই রকম ফের মাত্র। তবু এমন এক কৌটিলীয় বুদ্ধির অধিকারী তিনিই কিনা সেটা হয়তো তাঁর কাছ থেকে জানার চেষ্টা করতে পারতাম।

অবশ্য তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই যে, তিনি আমার কাছে সত্যটা বলতেন এমন তো নাও হতে পারত। আর তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ও ছিল না। তাঁর নাম এবং লেখার বাইরে আজও আমি তাঁকে চিনি না। তা, দেখেছি চেনা লোকেরাও অনেক সময় সত্য স্বীকার করেন না। আমার মনে আছে সাপ্তাহিক ‘জনতা’র ১৯৬৫ সালের ২৬ মে-এর সংখ্যায় সাদেকুর রহমান নাম দিয়ে কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক সুকৌশলে আইয়ুবের সমর্থনে ‘বৈদেশিক নীতি ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। তিনি ঐ ছদ্মনামেই লেখতেন। হুলিয়া থাকায় তিনি তখন পর্যন্ত আত্মগোপন করে ছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, এই বক্তব্য তিনি কেন দিয়েছেন? তিনি অবলীলাক্রমে বললেন, ‘এই লেখাটা আমার না। এটা তোহা ভাই লেখেছেন।’ অর্থাৎ তাঁর ছদ্মনাম মোহাম্মদ তোয়াহা ব্যবহার করেছেন। আমি নিশ্চিত হবার জন্য তখন জনতার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আনোয়ার জাহিদকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমাকে জানান যে, ওটা মোহাম্মদ তোয়াহার নয়, আবদুল হকেরই লেখা।*

_________________________________________________________________________________

* আবদুল হকের মত লোকেরা সেকালে কিভাবে আইয়ুব সরকারের প্রতি সমর্থনের তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরী করেছিলেন সেটা বোঝার সুবিধার জন্য আমি ঐ প্রবন্ধ থেকে সামান্য কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ জায়গা উদ্ধৃত করছি।

কথা আজ সন্দেহাতীত যে, বর্তমান পর্যায়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হইতেছে আমাদের দেশের শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রধান শত্রু তাই এই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে জনতার সকল অংশকে একটি মৈত্রী জোটে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে ...

পক্ষান্তরে দ্বিধা-বিভক্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর শেষোক্ত প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রভাব যদি সরকারের উপর অধিক বর্তায় সেই অবস্খায় সরকার সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকিবে এবং জনতার অধিকার পদদলিত করিবে

প্রথমোক্ত পরিস্খিতিতে সরকার মূলত বুর্জোয়া শ্রেণীর সরকার হইলেও তাহার ভূমিকা হইবে সুকর্ণ অথবা নাসেরের ন্যায়; আর শেষোক্ত অবস্খায় তার ভূমিকা হবে চিয়াং কাইসেক এবং সীং ম্যান রী সরকারের অনুরূপ

আইয়ুব সরকারের ক্ষেত্রেও সংগ্রামের এই মূলনীতি প্রয়োগ করাই হইবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিকদের কর্তব্য

সাদেকুর রহমান, বৈদেশিক নীতি গণতন্ত্রের সংগ্রাম, সাপ্তাহিক 'জনতা', মে ২৬, ১৯৬৫

লক্ষণীয় যে, সাদেকুর রহমান ছদ্মনামে লেখা এই প্রবন্ধে আবদুল হক আইয়ুব সরকারকে প্রধান শত্রু বলছেন না, বলছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে কাজেই স্বাভাবিকভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আইয়ুবের কিছু দ্বন্দ্ব থাকলে সেটাকে ব্যবহার করা এবং বাড়ানো তাদের এক প্রধান কাজ হয়ে দেখা দেয় এবং মার্কিনের প্রতি অনমনীয় হবার নামে তারা আইয়ুবের প্রতি নমনীয় হয়ে পড়ে এইভাবে তারা আইয়ুব পাকিস্তানের প্রতি সুকৌশল সমর্থনের রাজনীতি গড়ে তোলে

এখানে আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৬৫-এর এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হবার পর আইয়ুব সমর্থনের রাজনীতি নিয়ে নামতে আবদুল হক আর বেশী দেরী করেন নি অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকেই তারা তখন আনোয়ার জাহিদ সম্পাদিত পরিচালিত জনতাপত্রিকাকে অবলম্বন 'রে আইয়ুবের সমর্থনে কিংবা সমর্থনের সাহস না করলে কৌশলে ডোন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব রাজনীতি ফেরী করতে মাঠে নামে

_________________________________________________________________________________

এই ধরনের বুদ্ধিবৃত্তির শুধু গুরু নয় মহাগুরুও বলা যায় কৌটিল্যকে। তাই তিনি চোরকে চুরি করার এবং গৃহস্থকে পাহারা দেবার বুদ্ধিটা খুব নিপুণভাবে দিয়েছেন। কারণ তিনি নিরপেক্ষ। হাঁ, এ এক আশ্চর্য নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক বুদ্ধি! তবে পক্ষটা শুধু নিজের।

কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রের’ উদাহরণটা আমি দিলাম ভারতবর্ষে কোন্ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তি আধিপত্য করছে সেটা স্পষ্ট করার জন্য। ওটা কি আদৌ কোনো ব্যক্তিরও লেখা? ওটা পড়ে কি মনে হয় যে, ওটা বিশেষ কোনো দেশ, সমাজ বা সময়ের লেখা? এক বিশেষ ব্যক্তির নাম এসেছে লেখক হিসাবে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে ঐ বিশেষ ব্যক্তি কৌটিল্য প্রকৃতপক্ষে দেশ, মানুষ, সমাজ ও সময়ের প্রতি নির্বিকার, নির্বিবেক একটা শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ মাত্র। ঐ শ্রেণীর কাজ হল নিজ বুদ্ধিবৃত্তি খাটিয়ে শুধু নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করা। সুতরাং ঐ শ্রেণী সব জায়গায় আছে। সব রাজার সঙ্গে আছে। তাই ‘অর্থশাস্ত্র’ প্রকৃতপক্ষে দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে যে কোনও রাজা বা রাজ্যের জন্য রচিত। ওটা বিশেষ কোনও রাজা বা রাজ্যের জন্য রচিত এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। আসলে ঐ বুদ্ধিবৃত্তি নিজে কোনও ক্ষমতা সৃষ্টি করে না, সম্পদও নয়। ওটা শুধু আত্মসাৎ করে বেড়ায়। সব ক্ষমতা ও সম্পদের সঙ্গে তাই থাকে। থেকে সব জায়গায় বিভেদ ঘটায়। সব জায়গায় গোলমাল বাধিয়ে বেড়ায়। নীতিহীন ও বিবেকহীন চক্রান্ত শিখিয়ে বেড়ায়। কিন্তু সবখানেই নিজের মর্যাদা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে রাখে। হাঁ, ওটা এক শ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তির ফসল। ব্রাহ্মণ শ্রেণীর। আসলে কৌটিল্য এই উপমহাদেশের শূদ্র-ব্রাহ্মণ মস্তিকের এক শ্রেষ্ঠ প্রকাশ।

শূদ্রের শ্রম আছে। কিন্তু সাহস নেই, শৌর্য নেই, মুক্ত দৃষ্টি নেই, বুদ্ধি নেই, ঔদার্য নেই। ব্রাহ্মণের দৈহিক শ্রম নেই। কিন্তু মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তি আছে। কিন্তু তারও নেই সাহস, শৌর্য, মুক্ত দৃষ্টি এবং ঔদার্য, এবং ফলে প্রকৃত বুদ্ধিও। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ এবং শূদ্র এক জিনিস। একটা না থাকলে আর একটা থাকে না। এবং এ দু’টোই বহু কাল ধরে ভারতবর্ষের অনেক দুর্গতির মূল। যে শ্রমজীবী ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিজেকে শূদ্র করে রাখে সেই শ্রমজীবীও ভারতবর্ষকে নীচে টেনে নামিয়েছে। এবং সুবিধাবাদী, মতলববাজ ধূর্ত ব্রাহ্মণরা পশ্চাৎপদ উপজাতি-মানুষের সকল নির্বুদ্ধিতা, পশ্চাৎপদতা, সঙ্কীর্ণতা, ভিন্ন উপজাতির মানুষ বা গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা এগুলোকে বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থার মধ্যে রূপ দিয়েছে। বর্ণজাতিভেদ আকাশ থেকে পড়ে নি। ওটা জবরদস্তি করে চাপানোও নয়। ওটা জনগণেরও সৃষ্টি। নীচ তলার মানুষেরও সৃষ্টি। উপর তলার ধূর্ততার অনুসারী নীচতলার মানুষের মূঢ়তার সৃষ্টি। উপর তলার সৎ ও উন্নত বুদ্ধিবৃত্তির মানুষেরা শঠ ব্রাহ্মণদের কাছে হেরে গেছে ঐ নীচ তলার মানুষদের কারণেও। আর উপর তলার সব ব্রাহ্মণ যে শঠ ছিল তা তো নয়। কিন্তু মূর্খ-মূঢ়দের দেশে শঠতাই জয়ী হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নত বুদ্ধিবৃত্তি জিতবে কেন?

অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান বুদ্ধিজীবীরাও এ ভূমিতে শূদ্র-ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের রকম ফের মাত্র। এরা হল বান্দা-ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবী। আসলে এ ভূভাগে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বুদ্ধিবৃত্তির জগৎটা বর্ণজাতিভেদ এবং শূদ্র-ব্রাহ্মণ কাঠামো দ্বারা প্রায় ক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রিত কিংবা গভীরভাবে প্রভাবিত। পাশ্চাত্য আধিপত্য ও সংযোগ শূদ্র-ব্রাহ্মণ বুদ্ধিবৃত্তির চাকচিক্য এবং শক্তিটাকে বাড়িয়েছে মাত্র।

দক্ষিণ-বাম অধিকাংশেরই এক অবস্থাএ এক বিশাল চক্র। বিশাল জাল পাতা সর্বত্র। তবে বুঝলে এটা তেমন কিছু না। এটাকে তছনছ করা, ছিন্নভিন্ন করা এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ করে উৎখাত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর এর জন্যই প্রয়োজন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাস করার।

এ কথা আজ সন্দেহাতীত যে, বর্তমান পর্যায়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হইতেছে আমাদের দেশের শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রধান শত্রু। তাই এই সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে জনতার সকল অংশকে একটি মৈত্রী জোটে ঐক্যবদ্ধ করিতে হইবে।’ ...

পক্ষান্তরে দ্বিধা-বিভক্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর শেষোক্ত প্রতিক্রিয়াশীল অংশের প্রভাব যদি সরকারের উপর অধিক বর্তায় সেই অবস্থায় সরকার সাম্রাজ্যবাদের দিকে ঝুঁকিবে এবং জনতার অধিকার পদদলিত করিবে।

প্রথমোক্ত পরিস্থিতিতে সরকার মূলত বুর্জোয়া শ্রেণীর সরকার হইলেও তাহার ভূমিকা হইবে সুকর্ণ অথবা নাসেরের ন্যায়; আর শেষোক্ত অবস্থায় তার ভূমিকা হবে চিয়াং কাইসেক এবং সীং ম্যান রী সরকাররের অনুরূপ।

আইয়ুব সরকারের ক্ষেত্রেও সংগ্রামের এই মূলনীতি প্রয়োগ করাই হইবে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিকদের কর্তব্য।’

সাদেকুর রহমান, বৈদেশিক নীতি ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম, সাপ্তাহিক ‘জনতা’, মে ২৬, ১৯৬৫

লক্ষণীয় যে, সাদেকুর রহমান ছদ্মনামে লেখা এই প্রবন্ধে আবদুল হক আইয়ুব সরকারকে প্রধান শত্রু বলছেন না, বলছেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। কাজেই স্বাভাবিকভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আইয়ুবের কিছু দ্বন্দ্ব থাকলে সেটাকে ব্যবহার করা এবং বাড়ানো তাদের এক প্রধান কাজ হয়ে দেখা দেয় এবং মার্কিনের প্রতি অনমনীয় হবার নামে তারা আইয়ুবের প্রতি নমনীয় হয়ে পড়ে। এইভাবে তারা আইয়ুব ও পাকিস্তানের প্রতি সুকৌশল সমর্থনের রাজনীতি গড়ে তোলে।

এখানে আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ১৯৬৫-এর ২ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধা বিভক্ত হবার পর আইয়ুব সমর্থনের রাজনীতি নিয়ে নামতে আবদুল হক আর বেশী দেরী করেন নি। অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে থেকেই তারা তখন আনোয়ার জাহিদ সম্পাদিত ও পরিচালিত ‘জনতা’ পত্রিকাকে অবলম্বন ক’রে আইয়ুবের সমর্থনে কিংবা সমর্থনের সাহস না করলে কৌশলে ‘ডোন্ট ডিসটার্ব আইয়ুব’ রাজনীতি ফেরী করতে মাঠে নামে।

পুরাতন এবং প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে আমি বলি না। এ প্রসঙ্গে আমার এক প্রবীণ ও প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতার উক্তি মনে হল। তিনি কিছু কাল পূর্বে একদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলছিলেন, ‘আমি বিবিসি শুনি না।’ সাম্রাজ্যবাদের প্রচারযন্ত্রের প্রতি তাঁর ঘৃণা জানাতে গিয়ে সে কথা বলছিলেন এবং বলছিলেন যে, ওটা তিনি কোনোদিন শোনেন নিও।

অত্যন্ত আদর্শনিষ্ঠ এই মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এ কেমন বুদ্ধি! এই বুদ্ধি দিয়ে এঁরা সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলা করবেন? সাম্রাজ্যবাদ কি জিনিস, তার সূক্ষ্মতা, ধূর্ততা কতখানি তাই যাঁরা জানবেন না তাঁদের নেতৃত্বে বিপ্লবী রাজনীতির সর্বনাশই হয়। এই রকম কমিউনিস্টদের জন্য একটা আশ্রম বানাবার ব্যবস্থা করতে পারলে এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষতিটা কমানো যেতে পারত।

আমি বরং মনে করি বৃদ্ধিবৃত্তির জগৎটাকে আমাদের খুব ভালভাবে জানতে হবে। পাশ্চাত্যের এবং সেই সঙ্গে শূদ্র-ব্রাহ্মণদেরও। বিশেষত শূদ্র-ব্রাহ্মণদের বুদ্ধিবৃত্তির সন্ধানের সময় আলবেরুনীর কথাটা খুব মনে রাখতে হবে। বিপুল বিষ্ঠারাশির মধ্য থেকে মুক্তাগুলোকে বের করে নেবার কাজ ওটা। বড় কষ্টসাধ্য কাজ! তবু করতে হবে। শূন্য থেকে কিছুই হয় না। সুতরাং বেশীরভাগ সময়েই ঐ পণ্ডিতদেরই শরণাপন্ন হতে হবে প্রথমটায়। ওদের মূর্খতাগুলোকে বাদ দিতে হবে। তার মানে কি এই যে, আমাদের মধ্যেও মূর্খতা থাকবে না ? থাকবে। ওটা কার না থাকে? অমন যে মহা বিজ্ঞানী নিউটন তাঁর মধ্যেও কি কম মূখর্তা ছিল ? তাঁর ছিল দু’টো বিড়াল। একটা বড়, আর একটা ছোট। তিনি বিড়াল দু’টোর জন্য একটা ঘর বানালেন। তার দু’টো দরজা রাখলেন। বড় বিড়ালের জন্য বড় দরজা, ছোট বিড়ালের জন্য ছোট দরজা। তাঁর ধারণা ছিল যে, ছোট বিড়াল বড় দরজা দিয়ে ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না। তা, তিনি যখন একদিন দেখলেন যে, ছোট বিড়াল বড় দরজা দিয়েই আরামসে বেরোচ্ছে তাঁর তখন অবাক হওয়ার ব্যাপরটা আমরা সহজেই ভেবে নিতে পারি।

আসলে কোনো মানুষই সবকিছু বোঝে না। আর অনেক কিছু বুঝলেও বুঝতে সময় নেয়। তবে সব কিছু বোঝা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। সুতরাং মূর্খতা বলা যাক, বোকামি বলা যাক ওটা সব মানুষেরই কিছু না কিছু থাকে। কিন্তু মূর্খ হওয়াটা আর এক জিনিস। মূর্খ-পণ্ডিতরা রাশি রাশি জ্ঞানের বিষ্ঠা নির্গত করে যার ভিতর সামান্যই রত্ন থাকে।

আর আজকের এই পাশ্চাত্য আধিপত্যের যুগে পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তি বা জ্ঞানের মাধ্যমেও আমাদের চেতনার নগরে অবিরাম ট্রয়ের ঘোড়া প্রবেশ করে। কারণ জ্ঞানেরও মূলে থাকে রাজনীতি। কোনো না কোনো রূপে। সুতরাং বুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের রাজনীতি এবং সেই সঙ্গে তাদের অনুসারী এ দেশের বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত ও ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির স্বরূপটাও আমাদের বুঝতে হবে। সুতরাং সমস্ত কিছুকে বাস্তবের সঙ্গে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে, যাচাই করে, প্রয়োজনে ভেঙ্গে, খুলে দেখতে হবে, বুঝতে হবে। আর এইভাবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির নিজস্ব কাঠামোটা তৈরী করতে হবে।

পাশ্চাত্য বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে, বিশেষত ইতিহাস, সমাজ দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা পাঠের সময় আমাদের অতি সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে সামাজিক বিজ্ঞান পদার্থ বিজ্ঞানের মতো নয়। সামাজিক বিজ্ঞান কিংবা মানবিক বিদ্যা পুরোটাই মানুষের ব্যাপার, প্রত্যক্ষভাবে মানুষ নিয়ে কারবার করে। সুতরাং তার পিছনের মানুষটাকে বুঝতে হয়। আর তখন আমরা দেখতে পাব পাশ্চাত্যের মানুষকে, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যার প্রধান সমস্যাটা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং আমাদের উপর তার আধিপত্য রক্ষা করা। এর বাইরেও সেখানে বুদ্ধিবৃত্তির জগৎ আছে বৈকি। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেটাও সেখানে সমাজ সমর্থন, কায়েমী স্বার্থের সমর্থনের অভাবে নীচ তলায় পড়ে থাকে। ওটা সেখানেও হয়ে থাকে অবদমিত মানুষের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার অবদমিত প্রকাশ। সেটার সন্ধান আমরা কোথা থেকে পাব ? ওটা কি প্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে? হাঁ, যাবতীয় কায়েমী প্রতিষ্ঠানকেই এখন আমাদের সন্দেহ করতে হবে। কারণ এই কায়েমী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হল পাশ্চাত্য আধিপত্যকে রক্ষা করা।

এদের অনুসারী এই ভূভাগের কৌটিলীয় শূদ্র-ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। এই শূদ্র-ব্রাহ্মণ পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আমাদের আরো সতর্ক থাকতে হবে এই কারণে যে, এদের প্রতারণা, মিথ্যাচার, ভণ্ডামি এবং কূটকৌশলের তুলনা সমস্ত পৃথিবীর কোনো সমাজে পাওয়া যায় না। মুসলমান যুগের পূর্বে ভারতবর্ষে ইতিহাস লেখার চল প্রায় ছিল না। বৌদ্ধদের মধ্যে ইতিহাস বা দলিল রাখার একটা অভ্যাস তবু ছিল। কিন্তু হিন্দু সমাজে বুদ্ধিবৃত্তির নিয়ন্ত্রণটা যাদের হাতে চলে গিয়েছিল সেই ব্রাহ্মণরা ইতিহাস লেখত না। কিন্তু কেন ? কারণ ইতিহাস লেখলে মানুষকে ওভাবে ঠকানো সম্ভব হত না।

ব্রাহ্মণরা মানুষকে জাতিচ্যুত, সমাজচ্যুত করায় ওস্তাদ ছিল। কিন্তু নীচ বর্ণজাতি থেকে উচ্চ বর্ণজাতিতে ওঠার পথটা বন্ধ করে রেখেছিল। কারণ নির্দিষ্ট বর্ণজাতিতে জন্ম নেওয়া তো পূর্ব জন্মের কৃতকর্মের ফল! কিন্তু তবু শক্তিশালী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা বর্ণজাতির উত্তণের পথ খোলাও রাখতে হত। কারণ দুর্বলকে বা কাউকে কোণঠাসা করতে পারলে না হয় নীচে ফেলে দেওয়া যায়, বর্ণজাতি মর্যাদা আরো নীচে নামিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু সবলদের যদি পাওয়া না যায় তবে সে ব্যবস্থা কি টেকে ? বিশেষত সবলেরা যদি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সবাই জোট বাঁধে তবে সেটা ভেঙ্গে পড়তে কতক্ষণ ? আর শুধু দুর্বল দিয়ে কোনো ব্যবস্থাই টেকে না। শুধু শ্রমশক্তি দিয়ে কি হবে যদি সেটাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার শক্তি না থাকে ?

সুতরাং যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাইরে থেকে প্রবল শক্তি নিয়ে এসেছে কিংবা ভিতর থেকেও প্রবল হয়েছে তখন সমাজপতি ব্রাহ্মণরা তাকে বর্ণজাতি কাঠামোর উপর তলায় জায়গা করে দিয়েছে। শূদ্র রাজা শিবাজীকে যেমন ক্ষত্রিয় করে নিয়েছে। প্রয়োজন শুধু একটা মনগড়া অতীত বংশ তালিকা তৈরী করার। ক্ষত্রিয় বানাবার জন্য চন্দ্র বংশ, সূর্য বংশ একটা কিছু বানিয়ে দিলেই হল! ব্রাহ্মণও নিশ্চয় এভাবে হত। হয়তো কৌশলটা আরও অনেক বেশী সূক্ষ্ম হত এবং মূল্যটা হয়তো খুব বেশী চড়া হত। সেক্ষেত্রে ভৃগু, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র একটা কুলগত ঐতিহ্য বানিয়ে দিতে পারলে হল। এ এক আশ্চর্য আত্মপ্রতারণা ও পরপ্রতারণার ব্যবস্থা ! কয়েক হাজার বছর ধরে সচেতনভাবে মিথ্যাচার, বুঝে শুনে এই রকম প্রতারণা চালাতে পারে যে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী সেই গোষ্ঠী যদি বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সমগ্র সমাজ, রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ জগতের সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে তবে সেই বুদ্ধিবৃত্তিটা যে কত ক্ষতিকর হতে পারে, কতটা শঠতাপূর্ণ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু শঠতা করতে করতে এই বুদ্ধিবৃত্তি এতটাই অভ্যস্ত হয় যে, ওটা যে শঠতা সুতরাং অন্যায় সেই বোধও তার লোপ পায়।

এই ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিবৃত্তিই আজ ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তির মূল কাঠামোটা নির্মাণ করেছে ইংরেজদের উপনিবেশবাদী বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে। এটা প্রকৃতপক্ষে আধুনিক এবং মুৎসুদ্দি শূদ্র-ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিবৃত্তি। এই উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান সকল আধিপত্যকারী বুদ্ধিবৃত্তি মূলত এক জিনিস, যার মাথাটা স্বার্থান্ধ, প্রতারক ব্রাহ্মণ বুদ্ধি দিয়ে তৈরী আর শরীরটা সমান নির্বোধ কিন্তু কাপুরুষ বন্য অথবা হিংস্র বর্বরের বুদ্ধি দিয়ে তৈরী। এই বুদ্ধিবৃত্তি সবাইকে ঠকাতে গিয়ে নিজেও ঠকে। তবু ঐ পথে তার আনন্দ। কারণ এ পথ ছাড়া আর কোনো পথের শিক্ষা নেবার উপায় তার ঐ মাথার এবং শরীরের কারণে নেই। সুতরাং পরের মাথা ভাঙ্গা আর প্রয়োজনে মুহূর্তেই পায়ে পড়া সবেতে তার সমান দক্ষতা এবং আনন্দ। শুধু আপন স্বার্থসিদ্ধি, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা তার জীবনের মূল মন্ত্র। প্রবল পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কি সাধে শেষ জীবনে সভ্য সমাজের সংসর্গ ত্যাগ করে আদিবাসী সমাজের ভিতর আশ্রয় খুঁজেছিলেন!

এই মুৎসুদ্দি শূদ্র-ব্রাহ্মণের প্রতারক বুদ্ধিবৃত্তি আজ পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদী বুদ্ধিবৃত্তির আশ্রয় এবং সাহায্য নিয়ে এই উপমহাদেশে এক পরাক্রান্ত দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই। ওটার দু’টো পা-ই মাটির তৈরী। কারণ ঐ বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিটা কিন্তু মূর্খতা, মূঢ়তা, বন্যতা, বর্বরতা, ভীরুতা, কুসংস্কার আর নির্বুদ্ধিতা দিয়ে তৈরী। সুতরাং যেদিন নূতন বুদ্ধিবৃত্তি ওটাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিবে সেদিন ঐ দৈত্যটা মাটিতে আছড়ে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হবে। তখন আগামী কালের মানুষ যাদুঘরে যাবে আজকের এই মূর্খ পণ্ডিত-বুদ্ধিজীবীদের হাস্যকর বুদ্ধিবৃত্তির নমুনার সংরক্ষিত টুকরোটাকরা অবশেষগুলো দেখতে।

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির পূর্ণবিন্যাসের সময় মনে রাখতে হবে বর্তমানের মতই আমাদের অতীতেরও সবটা কিন্তু এই শূদ্র-বান্দা-ব্রাহ্মণ্য বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। তার বাইরেও আমাদের এক বিশাল উত্তরাধিকার আছে। শুধু যে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার এক বিস্ময়কর মহাসভ্যতার আমরা উত্তরাধিকারী তা-ই নয়, সেই সঙ্গে হাজার হাজার বৎসর ব্যাপী ভারতবর্ষ এবং বাংলার বৃদ্ধিবৃত্তির জগতে এবং সামাজিক কর্মের ক্ষেত্রে এমন বহু ঐতিহ্যের উপাদান আছে যেগুলো আমাদের নূতন পথে যাত্রার ক্ষেত্রে বিপুল শক্তি যোগাতে পারে।

বিশেষত সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে আমাদের গৌরবের কারণ আছে। প্রত্নতাত্ত্ব্কিরা ক্রমেই একটি সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন যে, প্রাচীন যে কোনো সভ্যতার তুলনায় বহু ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতা অনেক বেশী উন্নত। তার ব্যাপ্তিও যে কোনো মানুষকে অভিভূত করার জন্য যথেষ্ট। সুপ্রাচীন কালে আজ থেকে পাঁচ হাজার বৎসর এমন কি তারও অনেক পূর্ব থেকে ঐ সভ্যতার কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল আধুনিক কালের মতো বাঁধ নির্মাণ বা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে, যেখানে নদীর জলরাশি আটকে বা নিয়ন্ত্রণ করে লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি একর জমিতে জলসেচ করে শস্য উৎপাদন করা হত। ঋগ্বেদ সেই সাক্ষ্যই দেয়। এবং আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলোও এই সভ্যতায় জলসেচ ব্যবস্থার গুরুত্বকে স্বীকার করে নিচ্ছে।

এই সভ্যতার প্রধান ভাষা বৈদিক ভাষা। সংস্কৃত বৈদিক ভাষারই আধুনিকতর বা পরবর্তী রূপ। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে পৃথিবীর আর সব ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দসম্ভার সবচেয়ে বেশী। এর অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট। সেটা হল বৈদিক শব্দসম্ভার বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশী। ভাষার সঙ্গে মানুষের মনোজগতের সম্পর্কটা বুঝলে আমরা এর তাৎপর্য বুঝতে পারব। তবে আমাদের সবকিছু পুনর্বিন্যস্ত করতে হবে। অতীতের মহত্তম উপাদানগুলো ও ঐতিহ্য ধারণ করে আমরা এগিয়ে যাব। অর্থাৎ আমরা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে নূতনভাবে বিন্যস্ত করব নূতন কালের দাবীকে পূরণ করার জন্য।

আর বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে আমাদের আর একটি বিষয় খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে বলে আমি মনে করি। সেটি হল নারীদের বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাস। এতকাল নারীরা পুরুষদের দৃষ্টি দিয়ে সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবন সবকিছুকে দেখেছে। এই দেখাটা তাদের নিজেদের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে। ফলে তাদের বৃদ্ধিবৃত্তিরও পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হবে। বুঝতে হবে নারীর একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে। সভ্যতার সূচনাটা প্রধানত তাকে দিয়ে। পরবর্তী কালে ওটা পুরুষের হাতে চলে গেলেও চিরকাল তার একটা নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে, যার ভিতর রয়েছে তার আগামী অগ্রগমনের পথরেখাটিও। সেই ইতিহাস জীবন খুঁড়ে, মানুষের, নারীর মনোজগৎ খুঁড়ে তাকে বের করে আনতে হবে। সন্তান ধারণ ও লালন এবং গৃহ কর্মের ভিতর এবং সেগুলোর বাইরেও তার যে নিজস্ব ইতিহাস আছে সেই ইতিহাসের সবটা অধীনতা ও আত্মসমপর্ণের নয়। তার ভিতর সংগ্রাম আছে, বিদ্রোহ আছে, সংগঠন আছে, নির্মাণ আছে, মহত্ত্ব আছে। সেই ইতিহাস আবিষ্কার ও পুননির্মাণের কাজটা মূলত নারীর। পুরুষের উপর, পুরুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও কর্মের উপর নির্ভর করেই নারী যদি নিজের ইতিহাস পাবার আশা করে তবে সেটা হবে এক মস্ত ভুল। বুঝতে হবে এটাও এক রাজনীতি। পুরুষের রাজনীতির বাইরে নারীর রাজনীতি। পুরুষের রাজনীতির সঙ্গে তার যেমন দ্বন্দ্ব থাকবে তেমন সমন্বয়ও থাকবে। কিন্তু নারী যদি সেই রাজনীতি নিজে না করে তবে তার নিজ অর্জনটা কী হবে ? মুক্তির একটা নিজস্ব মূল্য আছে। নারী যদি সেটা দিতে না চায় তবে তার চেয়ে অনেক বড় মূল্য তাকে দিয়ে যেতে হবে যেমন সে এতকাল দিয়ে এসেছে। সুতরাং এইটুকু শ্রম তাকে করতে হবে।

নারীর পুনর্বিন্যস্ত বৃদ্ধিবৃত্তির রূপ কি হবে সেটা আজও বলা সম্ভব নয়। কারণ নারীর নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো যতদিন তৈরী না হবে ততদিন নারীর নিজস্ব কোনো রাজনীতিও সুসম্বদ্ধ রূপ নিয়ে দাঁড়াবে না। আর এই রাজনীতি না দাঁড়ালে নারীর নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তির কাঠামোও সুসম্বদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে না। তবে এটা দাঁড়াবে বৈকি ! সেই প্রয়াস সারা পৃথিবীতে আজ চলছে। এ দেশে সুদূর অতীতেও বহু নারী সেই প্রয়াস চালিয়েছিলেন। শুধু গার্গী বা সুলতানা রাজিয়া কেন, খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যাবে। আর আধুনিক কালে বেগম রোকেয়া বাঙ্গালী নারীর মুক্তি সংগ্রামের পথিকৃৎ। এ কালেও অনেকে নারীর একটা নিজস্ব সংগ্রামের ধারা যার যার মতো করে গড়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রোকেয়া অনেক বিশাল কল্পনাশক্তির অধিকারী এবং কর্মযজ্ঞের পুরোহিত নারী। একই সঙ্গে একজন সংগঠক এবং চিন্তাবিদ। বিশেষত তাঁর নারীস্থানের কল্পনা তাঁকে এমন একটা মহিমা দিয়েছে যার তুলনা অন্তত বাংলার ইতিহাসে আর নেই। নারীর রাষ্ট্র তথা ক্ষমতা কাঠামো যেদিন গড়ে উঠবে সেদিন নারীর বুদ্ধিবৃত্তির নিজস্ব কাঠামোটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে। তার পূর্বে সেটা হবে শুধু এক সংগ্রাম যে সংগ্রাম ছাড়া কোনো কিছু হয় না। তারপরেও থাকবে সংগ্রাম কাঠামোটা রক্ষা করার, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাকে বিকশিত কিংবা পরিবর্তিত করার।

হাঁ, বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাস পুরোপুরিই এক সংগ্রামের ব্যাপার। এটা শুধু বই পড়ার ব্যাপার নয়, শুধু অন্যের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও ধারণা থেকে শিক্ষা লাভের ব্যাপার নয়, সেই সঙ্গে সেটাকে নিজ অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাবারও ব্যাপার ! এবং এই সব কিছুর উদ্দেশ্য বাস্তব জীবনকে বদলানো, আজকের দুর্গত ও বিকৃত অবস্থাকে বদলানো। মার্কসের এই কথা আজো সমান সত্য, ‘এতকাল দার্শনিকরা শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কাজ হল তাকে বদলানো।’

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ