লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:57 AM, Hits: 1452
বাংলাদেশে বিদ্যমান অথর্ব ও অক্ষম রাজনীতির বৃত্ত ভেঙ্গে নূতন এক সৃজনশীল, গণমুখী এবং জাতি গঠনমূলক রাজনীতির সন্ধানে আমার এই গ্রন্থ রচনা। আর সেই কাজে হাত দিতে গিয়ে আমাকে বিশেষভাবে ফিরতে হয়েছে ষাটের দশকে, যে দশক ছিল আমার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ তারুণ্যের দশক।
ষাটের দশক ছিল এক অগ্নিগর্ভ দশক। আমি মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করেছি কি ছিল সেই দশকে যার ফলে এমন এক বিপ্লবী প্রজন্মের বিশাল উত্থান ঘটেছিল যা সম্ভব এবং অনিবার্য করেছিল ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। শুধু এ দেশের জন্য নয় সারা পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য সেটা ছিল তরুণ প্রজন্মের নব উত্থান, বিদ্রোহ, বিপ্লবের দশক। হয়ত বহু কাল পর কোনও কোনও দেশে কখনও বা এমন একটা কাল আসে। আমাদের সৌভাগ্য তেমন একটা কাল এ দেশেও এসেছিল। এবং আমি গৌরব অনুভব করি ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের একজন হিসাবে।
কিন্তু সেই দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস অস্বীকৃতির, অবহেলার, ইতিহাসের পাতায় তার প্রকৃত ভূমিকা অনুক্ত কিংবা বিকৃত হয়ে থাকার। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করলেও, এই যুদ্ধের রাজনীতি মূলত তারাই গড়ে তুললেও তাদের এই ভূমিকার স্বীকৃতি মেলে নি। বরং প্রথাগত বাম নেতৃত্বের ভূমিকার সঙ্গে তাদের ভূমিকাকে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। অথচ এই নেতারা ছিল প্রকৃতপক্ষে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বিরোধী কিংবা এই রাজনীতি খর্বকারী। সুতরাং ষাটের দশক ছিল এই নেতৃত্বের সঙ্গে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের তীব্র, জটিল ও অন্তহীন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে পরিপূর্ণ। পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের পার্থক্যকে না দেখে ঐ নেতৃত্বের দৃষ্ট ভূমিকা দিয়ে সেই কালকে বিচারের এক সাধারণ প্রবণতা ষাটের দশকের বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের মূল ধারার প্রতি এক নিদারুণ অবিচারের কারণ হয়েছে। অথচ ষাটের দশকের বামপন্থী আন্দোলন এবং জাতীয় মুক্তির রাজনীতির মূল নির্মাতা কিন্তু ঐ দশকের তরুণ প্রজন্ম, যে প্রজন্ম পদে পদে পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করে এই নির্মাণ সম্ভব করেছিল। কিভাবে, তার অনেকটাই আমার জানা আছে এবং সেটা এই গ্রন্থে বলতে চেষ্টা করেছি। হয়ত আমি নিজে সেই দশকে নেতার আসনে অধিষ্ঠিত না থাকায় সেই দশকের তরুণ প্রজন্মের সমস্যা, সংকট ও দুর্ভাগ্যকে গভীরভাবে অনুভব করার অবকাশ পেয়েছি। সামনের সারির নেতা হই নি বলে হয়ত অনেক নির্মোহ হতে পেরেছি এবং নিজেকেও সমালোচনার সম্মুখীন করতে পেরেছি। এই গ্রন্থে এমন অনেক কথা বলতে পেরেছি যা বিশেষত সেকালের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের পক্ষে এভাবে বলা হয়ত সুকঠিন কিংবা অসম্ভব। কারণ সেই প্রজন্মের প্রকৃত ভূমিকা পালনের পথে বাধা অর্পণের অনেক দায় কম-বেশী তাদের প্রায় সকলকে বহন করতে হয়।
নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে সেই দশকের তরুণদেরও অনেকে পুরাতন নেতৃত্বের অংশ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত প্রধান নেতাদের ক্ষেত্রে এই কথা সাধারণভাবে প্রযোজ্য। হয়ত সেটা নেতৃত্ব রক্ষার প্রয়োজন বোধে। কিংবা হয়ত যখন পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছিল তখন তারা নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে নেতৃত্বে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল। কিংবা হয়ত তাদের অনভিজ্ঞতা অথবা ধারণার দৈন্য বা অস্বচ্ছতার কারণে তারা ছিল দ্বিধান্বিত এবং ফলে শেষ পর্যন্ত পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ত। সুতরাং ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম মূলত এমন এক প্রজন্ম যার আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার প্রতিনিধিত্ব বা প্রতিফলন ঘটাবার মত কিংবা সেটাকে সংহত ও মূর্ত করার মত কোনও নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারে নি। ফলে প্রকৃত অর্থে ওটা এক নেতৃত্বহীন প্রজন্মও। এক এক সময় এক একজনকে সামনে রেখে হয়ত তা এগিয়েছে। ফলে তার নেতা বদল হয়েছে বারবার। নেতৃত্বের সঙ্গে প্রজন্মের এই যে এক আশ্চর্য ব্যবধান তার ফলে নেতাদের কে কিংবা ঐ কালের নেতৃত্বের সঙ্গে একাত্ম কে ঐ প্রজন্মের প্রকৃত ভূমিকা উন্মোচন করবে?
এই গ্রন্থে সেই কালের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার নিজের কথা বা প্রসঙ্গও এসেছে। স্মৃতি থেকে আমার বিভিন্ন সময়ের কিছু ভূমিকা উল্লেখ করেছি। আসলে এই গ্রন্থের মূল ভিত্তি আমার নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ষাটের দশকের অভিজ্ঞতা। আমি যেভাবে এ দেশের রাজনীতি ও তার সমস্যা মোকাবিলা করেছি, দেখেছি, বিশেষত ষাটের দশকে, তার অনেকটা আমার এই গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে অন্তরালবর্তী অনেক ঘটনা এবং প্রসঙ্গ এসেছে যেগুলোর অনেক কিছু আমার নিজের দেখা অথবা আমার নিজ ভূমিকা সম্পর্কিত।
কিন্তু আমার সমগ্র আলোচনার মূল ভিত্তি ষাটের দশক হলেও আমার লেখার বিষয়বস্তু আরও অনেক কিছু নিয়ে। ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাম ধারা এবং আওয়ামী লীগ ধারার মধ্যে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয় সংবাদপত্রগুলোর পাতায়, সেই বিতর্কের একটা সূত্র ধরে আমি এই লেখায় এ দেশের সমগ্র রাজনীতির গতি-প্রকৃতি মূল্যায়নের একটা চেষ্টা করেছি। সেটা পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগের ক্ষমতারোহণ পর্যন্ত সমগ্র কাল জুড়ে। তবে ষাটের দশকে বাম রাজনীতির সমস্যা ও সংকটের উৎস সন্ধান এবং অনেক অনুদ্ঘাটিত এবং অজানা ঘটনা উন্মোচন আমার আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ সেটা এ দেশের সমগ্র রাজনীতির সমস্যা বোঝায় ও জটিলতার জট খোলায় সবচেয়ে বেশী সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি।
এর প্রয়োজন আমার বিবেচনায় সর্বাধিক। কারণ আমার বিচারে বাংলাদেশে আর একটি গণ-বিপ্লব আসন্ন হয়ে উঠছে। ’৭১-এর গণ-বিপ্লব অসমাপ্ত। আসলে পৃথিবীর প্রতিটি প্রথম বিপ্লব প্রথম প্রয়াসের মত ব্যর্থ অথবা অসমাপ্ত থাকে অনভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য বিভিন্ন কারণে। সুতরাং ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যা বাঙ্গালী জাতি এবং বাংলার সকল জাতিসত্তার জনগণের ইতিহাসের প্রথম গণ-বিপ্লব তা অনেকাংশে ব্যর্থ এবং অসমাপ্ত। ’৭১-এর জাতীয় যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি, ভারত-রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী নেতৃত্বসহ জাতীয় নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে যে সকল সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অমীমাংসিত রয়ে গেছে সেগুলি ক্রমেই বেড়ে উঠে আর এক বিস্ফোরণের দিকে দেশকে নিয়ে যাচ্ছে। এটি দ্বিতীয় আর একটি বিপ্লবের বিজয় না ঘটিয়ে পুনরায় আর একটি প্রতিবিপ্লবের বিজয়ও ঘটাতে পারে। আর তাই আসন্ন আর এক গণ-বিপ্লবের দিকে মুখ রেখে আমার এই সমগ্র গ্রন্থ রচনা যার উদ্দেশ্য হল দ্বিতীয় গণ-বিপ্লবের বিজয়কে অনিবার্য করা। ফলে বহুবিধ তাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি।
গ্রন্থটি রচনার মূল সময় ১৯৯৬-এর ২২ আগস্ট থেকে ২৮ অক্টোবর। তারপর প্রায় সাড়ে পাঁচ বৎসর কাল চলে গেছে। এই সময়ে বিভিন্ন তথ্য যাচাই অথবা সংশোধন করতে চেষ্টা করেছি। পরবর্তী সময়ে খুব প্রয়োজন মনে করলে বাদ পড়ে যাওয়া কিংবা দেরীতে উপলব্ধি বা চিন্তায় আসা কিছু তথ্য বা বিশ্লেষণ সংযোজন করেছি। কিন্তু গ্রন্থ রচনার কাল-প্রেক্ষিত অপরিবর্তিত রয়েছে। ১৯৯৬-এর ১২ জুন নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যে সময়টাতে আমি এই গ্রন্থ রচনায় হাত দিই সেই সময় পর্যন্ত কালটা আমার আলোচনা ও পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তার পরবর্তী ঘটনাধারার বিচার বা মূল্যায়ন করি নি। আশা করি পাঠক এই কালপ্রেক্ষিতের বিষয়টি মনে রেখে গ্রন্থটি পাঠ করবেন।
বর্তমান কালপ্রেক্ষিত অনুযায়ী গ্রন্থটি পুনর্লিখনের চেষ্টা করি নি। কারণ এটি বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়ে এমনভাবে লিখিত যে, ভিন্ন সময়ের উপযোগী করে এটি পুনর্লিখন করতে গেলে গ্রন্থের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য দুই-ই নষ্ট হত বলে আমার ধারণা। গ্রন্থ রচনার কাল তথা ১৯৯৬ পর্যন্ত ঘটনাধারার পর্যালোচনার ভিত্তিতে যেসব রাজনৈতিক মূল্যায়ন ও করণীয় নির্ধারণ করেছি সেগুলির তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা আজ অবধি নষ্ট হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ গতিধারার যে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম তার কতটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে কিংবা তা কতটা বাস্তবানুগ হয়েছে সেটা পাঠক সহজেই নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যাচাই করতে পারবেন।
এখানে আর একটি কথা বলা দরকার বলে মনে করি। তা হচ্ছে বইটি বাজারে প্রকাশ করতে দেরী হলেও এই দীর্ঘ সময়ে প্রথমে হাতে লেখা এবং পরবর্তীতে মুদ্রিত পাণ্ডুলিপির কিছু সংখ্যক ফটোকপি অনেকে পড়েছেন। তাঁদের অনেকে আমাকে বিভিন্ন সময়ে মতামত ও পরামর্শ দিয়ে এই গ্রন্থের মানোন্নয়নে সাহায্য করেছেন। তাঁদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ। এ ছাড়াও এ গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা-উৎসাহ দিয়েছেন প্রকাশকসহ তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
ঢাকা, ১৯ মার্চ ২০০২
শামসুজ্জোহা মানিক