লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:58 AM, Hits: 1276
পুরাতন কম্পিউটার মুদ্রণ না থাকায় ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ নূতন করে মুদ্রণ করতে হয়েছে। নূতন মুদ্রণে পূর্বের লেখার বিষয়বস্তুতে কোন প্রকার পরিবর্তন আনি নি। তবে বানান ও ভাষাগত ক্ষেত্রে কিছু সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন সাধন করেছি। এছাড়া কয়েকটি জায়গায় তথ্য বা ঘটনার বিবরণগত ত্রুটি সংশোধন করেছি।
এছাড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করেছি অধ্যায়ের ক্ষেত্রে। প্রকাশিত গ্রন্থে অধ্যায়গুলির শুধু নম্বর ছিল। কিন্তু ওয়েব সংস্করণে প্রতিটি অধ্যায়ের সংখ্যা বা নম্বরসহ আলোচনার বিষয়বস্তু অনুযায়ী শিরোনাম দেওয়া হয়েছে। এর ফলে কোন অধ্যায়ে কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয়েছে সে সম্পর্কে পাঠক প্রথমেই ধারণা করতে পারবেন। যেহেতু বিষয়বস্তুতে হাত দিই নি সেহেতু ১৯৯৬ সালে লেখার সময় অনুযায়ী যে সকল ঘটনা এবং তথ্য দেওয়া আছে তাতেও কোন পরিবর্তন ঘটাই নি। যেমন ঐ সময় (১৯৯৬) পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যক্তি সম্পর্কে যে বিবরণ দিয়েছি তাতে তাঁদের সাম্প্রতিক সময়ের (২০০৬ সালে যখন এই ওয়েব সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছে) অবস্থান বা পরিচিতি অন্তর্ভুক্ত হয় নি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও কোন পরিবর্তন ঘটাই নি। আশা করি পাঠক পাঠের সময় এ দিকটা বিবেচনায় রাখবেন।
এই গ্রন্থে বিশেষত ষাটের দশকের বামপন্থী আন্দোলনের ভিতরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলা হয়েছে যেগুলোর অনেক কিছু এতদিন অপ্রকাশিত কিংবা অজ্ঞাত ছিল। এই গ্রন্থে উল্লেখিত তথ্যসমূহ বহুজনের সাক্ষাৎকার, আলোচনা, বিভিন্নজনের প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রবন্ধ এবং পত্র-পত্রিকার সাহায্যে বহুভাবে যাচাই করার চেষ্টা করেছি। ২০০২ সালে গ্রন্থটি প্রকাশের পর এ পর্যন্ত দুইটি তথ্য সম্পর্কে আপত্তি বা সংশোধনী এসেছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়ী বা জুম্ম জনগোষ্ঠীর কেউ অংশগ্রহণের সুযোগ পান নি বলে নবম অধ্যায়ে (২০০২-এর ব-দ্বীপ প্রকাশিত গ্রন্থের ১৫৯ পৃষ্ঠায়) আমি যে বক্তব্য দিই সে সম্পর্কে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির বর্তমান সহ-সভাপতি রূপায়ণ দেওয়ান উল্লেখ করেন যে, যেহেতু খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের বিগত চেয়ারম্যান যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরাসহ কিছু সংখ্যক পাহাড়ী যুবক ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সেহেতু আমার বক্তব্য সংশোধন করা উচিত। যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা নিজেও আমাকে এই তথ্য জানান। সুতরাং মূল লেখায় মুক্তিযুদ্ধে কয়েকজন জুম্ম বা পাহাড়ী যুবকের অংশগ্রহণের বিষয়টি সংযোজন করেছি।
এছাড়া ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থে একাধিক জায়গায় আমি বলেছি যে, পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এ প্রসঙ্গে সাবেক কমিউনিস্ট নেতা আমজাদ হোসেনের বক্তব্য হচ্ছে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা হচ্ছে ঐক্যের তথা ঐক্যবদ্ধ পার্টি গঠনের; যোগদানের নয়। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ১৯৬৯-এর মে মাসে। এই তথ্য তিনি তাঁর তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস’-এ সন্নিবেশও করেছেন।
আমজাদ হোসেনের বক্তব্য হচ্ছে আমার বক্তব্য তাঁর গ্রন্থে উল্লেখিত বক্তব্য বিরোধী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, আমজাদ এই অর্থে সঠিক যে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ঐক্যের। এটার অর্থ হতে পারত উভয় সংগঠন কর্তৃক যৌথ সম্মেলনের মাধ্যমে নূতন পার্টি গঠনের। কিন্তু বাস্তবে ১৯৬৯-এর মে মাসে এই সিদ্ধান্ত যেভাবে কার্যকর হয় তাতে সেটা বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন কর্তৃক পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান হয়ে দাঁড়ায়। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের দুইজন সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করে এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করা হয়। ফলে এটা যোগদান ছাড়া বাস্তবে আর কিছু ছিল না।
বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন যখন আমার উদ্যোগে ঐক্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন প্রক্রিয়াগত কারণে এই যোগদানের বিষয়টা আমার নিকট স্পষ্ট ছিল। এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে, যে সভায় পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেই সভায় আমি বলেছিলাম যে, বাস্তবে আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করতে যাচ্ছি। কারণ ঘটনা সেটাই ঘটবে। এ ব্যাপারেও অবশ্য আমার কোন আপত্তি ছিল না। কেন ছিল না সেটা আর এক আলোচনার বিষয় যা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। যাইহোক, এই বাস্তবতার কারণে আমজাদের আপত্তি ও বক্তব্য এখানে গ্রহণ করে ২/১ জায়গায় যোগদানের সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ঐক্যের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এভাবে উল্লেখ করলেও ঐক্যের ঘটনাটাকে আমি সাধারণভাবে যোগদান হিসাবেই উল্লেখ করেছি। কারণ ঘটনা সেটাই ছিল। তাছাড়া ঐক্যের অর্থ ঐক্যবদ্ধ পার্টি গঠনের পরিবর্তে যোগদানও হতে পারে।
ওয়েব সংস্করণের ভূমিকা শেষ করার পূর্বে, এই গ্রন্থ রচনা এবং প্রকাশের পর থেকে আজ অবধি যাঁরা এর উপর তাঁদের মতামত জানিয়েছেন তাঁদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তবে এ প্রসঙ্গে কাজী জাফর আহমদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার তাগিদ অনুভব করছি।
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী কাজী জাফর আহমদ বহুকাল ধরে আমার থেকে বহু দূরের মানুষ। কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর কাছে আমার যে ঋণ আছে সে কথা আমি এই গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি। আজ সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঐ সময়টুকুকে খুব সামান্য মনে হলেও আমি জানি ঐ সামান্য সময়ে ঋণের পরিমাণটা কত বিরাট। সেই ঋণ তিনি আরও বাড়িয়েছেন ১৯৯৭ সালে যখন আমি আমার পাণ্ডুলিপি তাঁকে পড়তে দিই তথ্য যাচাই এবং মতামতের জন্য সেই সময়।
বহুকাল ধরে আমরা দুইজন দুই বিপরীত মেরুর মানুষ। সুতরাং আমার কিছু মৌল ধারণা বা তত্ত্ব সম্পর্কে, যেমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি তাঁর দ্বিমত জানিয়েছিলেন। কিন্তু যে মনোযোগ তিনি দিয়েছিলেন আমার লেখাটার প্রতি এবং আমার তথ্যে যাতে ভুল না থাকে সেই জন্য অনেক দিন ধরে যেভাবে অনেক সময় এবং যত্ন সহকারে পুরাতন স্মৃতি ঝালাই করেছিলেন তার জন্য তাঁর প্রতি আমার ঋণ স্বীকার করা উচিত ছিল ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটির মুখবন্ধেই।
এটা ঠিক যে, এই গ্রন্থ রচনার পর তথ্য যাচাই এবং মতামতের জন্য আমি বহুজনের সাক্ষাৎকার যেমন নিয়েছিলাম তেমন পাণ্ডুলিপির ফটোকপিও অনেককে পড়তে দিয়েছিলাম। বিশেষত সাক্ষাৎকারে দীর্ঘ সময় দিয়েছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও শ্রমিক নেতা বাশার ভাই এবং ওয়ার্কাস পার্টির নেতা রনো ভাই। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আরও অনেকে আমাকে সময় দিয়ে ঋণে আবদ্ধ করেছেন। কিন্তু আজ এ প্রসঙ্গে জাফর ভাইয়ের কথাই বিশেষভাবে মনে হচ্ছে।
১৯৯৮ থেকে তার সঙ্গে আমার আর কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি আর কতকাল বাঁচবেন তা বলা কঠিন। কারণ তাঁর দুইটা কিডনিই নষ্ট। আমাদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক পার্থক্য ও দ্বন্দ্বের কারণে হয়ত আর দেখাও হবে না। তবু একদিন যে মানুষটার ভিতর অনেক বড় একটি মন দেখেছিলাম এবং পরবর্তীকালেও মাঝে মাঝে যার কিছু হলেও বিচ্ছুরণ দেখেছিলাম এই গ্রন্থের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য সেই মানুষ জাফর ভাইয়ের প্রতি বিলম্বে হলেও আমার কৃতজ্ঞতা বিশেষভাবে প্রকাশ না করলে এই ভূমিকা অসম্পূর্ণ থেকে যেত বলে আমি মনে করি।
শামসুজ্জোহা মানিক
১৮ এপ্রিল, ২০০৬
ঢাকা