লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:55 AM, Hits: 2472
কমিউনিস্ট মতাদর্শের মূল কথাটা হল শিল্প শ্রমিক বা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বুর্জোয়া সমাজ বা পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ সাধন এবং এইভাবে শ্রেণীহীন, শ্রেণীদ্বন্দ্বহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সকল মানুষের মহা মিলন, না, মহা মিলন শুধু নয় এটাকে বলা উচিত অনন্ত মিলন, হাঁ, এই অনন্ত মিলনের স্বপ্নস্বর্গ প্রতিষ্ঠা করা। এই স্বপ্নস্বর্গের নাম হল কমিউনিস্ট সমাজ, আর তা অর্জনের জন্য মার্কস-এঙ্গেল্স্ যে মতবাদ দিয়েছেন তার নাম মার্কসবাদ। কমিউনিস্ট সমাজের এই আদর্শটি কমিউনিজম। এতে ধরে নেওয়া হয়েছে ব্যক্তিগত সম্পত্তিই মানুষের স্বার্থপরতা এবং শ্রেণীদ্বন্দ্বের মূল কারণ। তার মতে উৎপাদনের উপায়সমূহের উপর ব্যক্তির মালিকানা থাকা ও না থাকাকে কেন্দ্র করে সমাজে যে গোষ্ঠী বা শ্রেণী বিভাজন ঘটে তা সমাজে শাসক ও শাসিত, শোষক ও শোষিত এই দুই শ্রেণীর উদ্ভব ঘটায়। আর এইভাবে সমাজে দেখা দেয় এমন এক শ্রেণী দ্বন্দ্ব যা মানুষের অপরিমেয় দু:খের কারণ হয়।
তবে মার্কসবাদের মতে আদিম সমাজ থেকে আধুনিক ও শিল্প সমাজ পর্যন্ত এগিয়ে আসার জন্য ব্যক্তির স্বাধীন ভূমিকা ও তার মালিকানা অপরিহার্য ছিল, যেহেতু তাছাড়া উৎপাদন শক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ অসম্ভব হত ফলে অসম্ভব হত শিল্প বিপ্লব ও শিল্প সমাজ প্রতিষ্ঠা। তার মতে শিল্প বিপ্লবের যুগে এসে মানুষের উৎপাদন শক্তি ও চেতনার এমন বিকাশ হয়েছে যখন ব্যক্তির স্বাধীন ভূমিকা ছাড়াই অর্থাৎ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছাড়াই সমাজের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় মানুষের সকল অভাব ও প্রয়োজন দূর করা সম্ভব। সুতরাং সমাজের অগ্রযাত্রার জন্য ব্যক্তি মালিকানা এবং এই ব্যক্তি মালিকানাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণী দ্বন্দ্বের যে প্রয়োজন ছিল তা ফুরিয়েছে। আর এইভাবে মার্কসবাদ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসান ঘটিয়ে মানুষকে স্বার্থবোধ এবং স্বার্থবোধ জনিত সকল দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছে। এর ফলে তা ব্যক্তির নিজস্ব সত্তার স্বাধীন ভূমিকা ও তাৎপর্যকে অস্বীকার করেছে। ভেবেছে ব্যক্তি মালিকানা থাকাতেই যাবতীয় সমস্যা।
সুতরাং কমিউনিজমের স্বপ্নস্বর্গে ব্যক্তি মালিকানার স্থান নেই। তবে কমিউনিজমের স্বপ্নস্বর্গে পৌঁছবার প্রথম শর্ত হল প্রথমে শিল্প বিপ্লব সম্পন্ন হতে দেওয়া কিংবা তা সংগঠিত করা। ফলে এই পর্যায়টুকুতে ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকার ও ব্যক্তির ভূমিকা মেনে নেওয়া হয়েছে এবং সেটা অবশ্যই শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। মার্কসবাদ বা কমিউনিজমের স্বপ্নস্বর্গ সম্পর্কে যে প্রশ্নই তোলা যাক তা মানব জাতিকে দিয়েছে পুরাতন ও ব্যাধিগ্রস্ত সমাজ পরিবর্তনের দু’টি অমূল্য হাতিয়ার -- একটি শ্রেণী সংগ্রাম এবং অপরটি বস্তুবাদ বা ইহলোকবাদী চেতনা। এই দুই হাতিয়ার দিয়ে মানব জাতি যে অসাধ্য সাধন করেছে প্রধানত তা দিয়ে মার্কসবাদের বাস্তব ভূমিকার প্রকৃত বিচার হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।
যাইহোক, মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিজমে পৌঁছবার উপায় হিসাবে শিল্প শ্রমিক বা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের ধারণা উপস্থিত করেন। লেনিন আবার শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির ধারণার বিকাশ সাধন করেন। এখন মার্কস-এঙ্গেলস যে লক্ষ্য নিয়েই কমিউনিজমের ধারণাকে সূত্রবদ্ধ করে থাকুন না কেন এটা বাস্তবে এমন একটি মতবাদে পরিণত হয় যা রাশিয়া, চীনের মত পশ্চাৎপদ ও প্রায় মধ্যযুগীয় সমাজগুলির আধুনিকায়নের হাতিয়ার হয়। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব বাস্তবে একদল আদর্শবান, ত্যাগী, সংগ্রামী এবং জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মীর একনায়কত্বিক বা কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ হিসাবে দেখা দেয়। একটা এককেন্দ্রীভূত কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ায় শিল্প বিপ্লবের কাজটা সম্পন্ন করে।
রাশিয়ায় তখন পুঁজি ছিল অববিকশিত। যা ছিল তা ছিল প্রধানত পশ্চিম ইউরোপের নিয়ন্ত্রণে। পুরাতন সামন্ত ব্যবস্থা, ধর্ম এবং জারের মধ্যযুগীয় স্বৈরতন্ত্রের চাপে ভিতর থেকে শিল্প পুঁজি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী মাথা তুলতে পারছিল না। শ্রমিক, কৃষক এবং জনগণের সাহায্যে বিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্ট পার্টি এই বাধাটাকে ভেঙ্গে ফেলে; এবং একটা আধুনিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের অধীনে শিল্প বিপ্লবের কাজটা সম্পন্ন করে, যেখানে পুঁজি ব্যক্তির হাত থেকে সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের হাতে চলে যায়। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি ছিল জনগণের মধ্যে তবু এর গঠন পদ্ধতি ছিল প্রকৃতপক্ষে আমলতান্ত্রিক এবং বিপ্লবের পর তা ক্রমে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচালক হিসাবে আমলাতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক পার্টিতে পরিণত হয়।
কমিউনিস্ট মতাদর্শ ব্যক্তি মালিকানা ও স্বাতন্ত্র্যের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের লক্ষ্যাভিমুখী হওয়ায় কমিউনিস্ট পার্টিতে এই মতাদর্শের যে প্রতিফলন ঘটে তা একটি অতি কেন্দ্রীভূত বা এককেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক পার্টির উদ্ভব ঘটায়। যদিও সমাজে ব্যক্তি মালিকানার আধুনিক রূপের বিদ্যমান ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই মাত্র এই নূতন ও আধুনিক মতাদর্শ ও তার সংগঠনের উদ্ভব ঘটতে পারে এবং ঘটে তবু সমস্ত রকম ব্যক্তি মালিকানার প্রতি তার অন্তর্গত ঘৃণা তাকে ঐ জায়গায় নিয়ে যায়। এইভাবে ব্যক্তির স্বাধীন সত্তায় অবিশ্বাসী কমিউনিস্ট মতাদর্শ প্রকৃতপক্ষে একটি এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক মতাদর্শ।
এই রকম এক মতাদর্শ দ্বারা লেনিন রাশিয়ায় শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের সূত্রপাত করেন। মাও সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক আক্রান্ত মধ্যযুগীয় চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে একটা নূতন ধারণা সংযোজন করেন। নয়া গণতন্ত্রের ধারণা। এই ধারণা অনুযায়ী সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি গঠনকে লক্ষ্য হিসাবে উপস্থিত করা হলেও একটা অন্তর্বর্তী পর্যায় হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জাতীয় বুর্জোয়াদের নেওয়া হল এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যেই ব্যক্তিমালিকানা নির্ভর পুঁজিবাদী বা বুর্জোয়া অর্থনীতি গড়ে তোলা হল। মূলত কমিউনিস্ট পার্টির অধীনে সীমিত আকারে হলেও বুর্জোয়া অর্থনীতি সংগঠনের এই ব্যবস্থা জন-গণতন্ত্র বা জনগণের গণতন্ত্র নামেও পরিচিত।
এটা মাও-এর ঐতিহাসিক অবদান। এর ফলাফল হল যুগান্তকারী। এর ফলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি রুশ পার্টির মত নিরংকুশভাবে এককেন্দ্রিক হতে পারে নি। বরং সভপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কেন্দ্র করে সংগঠনে ক্ষমতার একটা বিভাজন ঘটেছে, যার ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটা চীনের পার্টিতে বিকাশ লাভ করতে পারে। এটা প্রকৃতপক্ষে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রবেশ।
অবশ্য মাও-এর চিন্তা গ্রহণের পূর্বে কমিউনিস্ট পার্টিকে বিপুল মূল্য দিতে হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ৯০% শক্তি ধ্বংস হবার পরই মাত্র মাও-এর রাজনৈতিক কর্মনীতি ও ধারণাগুলি চীনা পার্টি গ্রহণ করে। মাও ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন কৃষক নেতা। কমিউনিস্ট নেতা হলেও তাঁর উত্থান ঘটে কৃষক আন্দোলন ও বিপ্লবের সংগঠক ও নেতা রূপে। চীনে অধিকার বঞ্চিত কৃষকের ব্যক্তি মালিকানা অর্জন তথা ভূমি স্বত্বের অধিকার লাভের আকাঙ্ক্ষার ভিতরে বুর্জোয়া অর্থনীতি সংগঠনের যে সম্ভাবনাটি নিহিত ছিল মাও তাকে অবলম্বন করেও চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বুর্জোয়া বিপ্লবের উপাদানটি সংযুক্ত করেন।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে মাও-এর অপর একটি যুগান্তকারী অবদান হল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব কমিউনিস্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হলেও এর মূল কাজটা হয়ে গেছে কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতান্ত্রিক চরিত্র অর্জনের প্রবণতাকে চূর্ণ করা। বিশেষত কনফুসিয়াসের মতাদর্শের প্রভাবে চীনে হাজার হাজার বৎসর ধরে প্রাচীন বেসামরিক আমলাতন্ত্রের যে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভাবাদর্শিক ভিত্তিটা গড়ে উঠেছিল আমলাতান্ত্রিক প্রবণতা অভিমুখী কমিউনিস্ট পার্টির জন্য সেটা ছিল এক চমৎকার ভিত্তি। মাও সর্বহারার মহা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শকে আঘাত করতে গিয়ে এই ভিত্তিটাকে বিধ্বস্ত করেছেন এবং একই সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতান্ত্রিক প্রবণতাকেও বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। এর ফলে প্রকৃত কমিউনিস্ট মতাদর্শ এখন নাম কা ওয়াস্তে আছে। সেখানে কমিউনিজমের আদর্শ নিয়েই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলছে বুর্জোয়া সমাজ ও অর্থনীতি। এইভাবে সেখানে সমাজতন্ত্র অর্থাৎ রাষ্ট্রের উপর একটা কমিউনিস্ট দলের নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এই সমগ্র ব্যবস্থাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার।
এর একটা স্ববিরোধ বা আত্মদ্বন্দ্ব নিশ্চয় আছে। তার প্রকাশ মাও-এর চিন্তায়ও ঘটেছে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবেও ঘটেছে। যেখানে সব কিছু সঙ্গতিপূর্ণ এবং এক রকমের হবে, সমাজের সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধের অবসান ঘটবে, সব রকম শ্রেণী বিভাজন দূর হবে এমন এক সমাজ কল্পনার লক্ষ্যাভিমুখী কমিউনিজমের সঙ্গে তাঁর ‘শত ফুল ফুটতে দাও’-এর চেতনার দ্বন্দ্ব অমীমাংসেয় এবং অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। মাও কমিউনিজমকে শুধু যে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন তা নয়, তাতে তাঁর একটা বিশ্বাসও নিশ্চয় ছিল। কিন্তু তিনি ব্যবহারিক ছিলেন। মতান্ধ ছিলেন না। আর তাই তিনি সফল বিপ্লবী ছিলেন। মতান্ধরা কোনদিন সফল হয় না। যখন তিনি বাস্তবকে তত্ত্বের সঙ্গে মেলাতে পারেননি তখন তত্ত্বটার একটা বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা করে নিয়েছেন অথবা মূল তত্ত্বের একটা অংশ বাদ দিয়ে তাঁরটা সেখানে সংযোজন করে দিয়েছেন।
লেনিনও সফল বিপ্লবী ছিলেন। কারণ তিনিও মতান্ধ ছিলেন না। আর তাই বিপ্লবের পর তিনি নয়া অর্থনৈতিক নীতি (New Economic Policy) দিতে পেরেছিলেন। এটাই প্রকৃতপক্ষে মাও-এর নয়া গণতন্ত্র কিংবা জন-গণতন্ত্রের আদিরূপ। লেনিন বেশী দিন বাঁচেন নি। বাঁচতে পারলে যে আমরা ভিন্ন সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখতাম সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে এটা তো শুধু ব্যক্তির ইচ্ছার ব্যাপার নয়। সে কালের রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বৈরী পরিস্থিতিই তাঁকে বাঁচতে দেয় নি। গুলিবিদ্ধ হয়ে অসুস্থ থেকে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন। আসলে রাশিয়ার মধ্যযুগীয় এক ভয়ঙ্কর বর্বর সমাজের দ্রুত আধুনিকায়নের জন্য এবং সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের ঘেরাওয়ের মধ্যে থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এক মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের উথানের জন্য এক বিপ্লবী বর্বরতার শক্তির লৌহ কঠিন হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল। লেনিনের মত কমিউনিজমের আবরণে থাকা এক বিপ্লবী বুর্জোয়া ভদ্রলোকের পক্ষে এই প্রয়োজনটা পূরণ করা হয়তো সম্ভব ছিল না। তাই তিনি গেছেন। এবং মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন পূর্বে তিনি শেষ ইচ্ছাপত্র মারফৎ তাঁর সহকর্মীদের প্রতি যে ‘রূঢ়’, ‘অমার্জিত’ এবং ‘অবিবেচক’ স্তালিনকে পার্টির দায়িত্ব থেকে অপসারণের আহ্বান জানান সেই স্তালিন তাঁর উত্তরাধিকারী হন।
চীনের শুধু চার হাজার বৎসরের উন্নত সভ্যতার ধারাবাহিকতা ছিল না, সেই সঙ্গে ছিল সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে প্রতিহত করে দাঁড়িয়ে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের ছত্রছায়া। সুতরাং সেখানে সম্ভব হয়েছে মাও-এর মত এক গণতান্ত্রিক ও মানবিক বিপ্লবী নেতার অভ্যুদয়।
যাইহোক, খুব সংক্ষেপে বললে বলতে হয় আমাদের দেশের প্রেক্ষিতটা ভিন্ন ছিল। এখানে দুর্বল হলেও একটা বুর্জোয়া অর্থনীতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরাই গড়ে দিয়ে গিয়েছিল, এবং গড়ে দিয়ে গিয়েছিল একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। বিশেষত পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল উদীয়মান। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী অর্থনীতিও গড়ে উঠছিল। অবশ্য এই পুঁজি ছিল সাম্রাজ্যবাদ এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত। দেশী বাঙ্গালী পুঁজি ছিল খুব দুর্বল। তবু সব মিলিয়ে একটা বুর্জোয়া অর্থনীতি ছিল এবং একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল। কিন্তু সমস্যাটা ছিল এখানে যে, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চাপে এবং ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতার চাপে এই সবই ছিল নিদারুণভাবে সীমাবদ্ধ, অববিকশিত। সেই সঙ্গে ছিল পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম-সংস্কৃতির প্রবল নিয়ন্ত্রণ ও নিপীড়ন, যার ফলে আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিসত্তার জাগরণ ছিল প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত।
এই কারণে এ দেশে একটা জাতীয় বিপ্লব দরকার ছিল যা প্রকৃতপক্ষে একটা বুর্জোয়া বিপ্লব। এই বিপ্লবের লক্ষ্য উৎপাদনশীল ও বুর্জোয়া ব্যক্তি মালিকানার উচ্ছেদ নয়, বরং তার বিকাশ। অর্থাৎ এই বিপ্লবের লক্ষ্য নিরঙ্কুশ সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম নয়। বরং এখানে বিপ্লব এবং সমাজতন্ত্র একটি গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ নির্মাণের অধীনস্থ। কমিউনিজমের নামে একটা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যাভিমুখী হবার পরিবর্তে স্পষ্টভাবেই একটা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া ব্যবস্থার লক্ষ্যাভিমুখী হওয়া উচিত ছিল এখানে বিপ্লব প্রয়াস। কিন্তু এ দেশে পাকিস্তান আমলে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল তা আকাঙ্ক্ষায় বুর্জোয়া হলেও তার একটি বিশেষ সীমাবদ্ধতার দিক আমাদের বুঝতে হবে। এমন কি যারা বুর্জোয়া অর্থনীতির সংগঠক হিসাবে গড়ে উঠছিল তাদেরও। সেটা হল সাম্রাজ্যবাদ এবং বাইরের নিপীড়ক ও লুণ্ঠক পুঁজি ও রাষ্ট্র কর্তৃক সংগঠিত হওয়ায় এবং পশ্চাৎপদ স্বৈরতান্ত্রিক ধর্মকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠায় তারা মূলত ছিল মুৎসুদ্দি ও লুম্পেন চরিত্রের এবং পশ্চাৎপদ ও স্বৈরতান্ত্রিক। অর্থাৎ ইউরোপে সামন্তবাদ ও গীর্জার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে সেখানকার বুর্জোয়ার যে উৎপাদনশীল, সংগ্রামী, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, সেকিউলার এবং গণতান্ত্রিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল এখানকার বুর্জোয়ার চরিত্র ছিল তার বিপরীত। এই লড়াইয়ের ফলে ইউরোপে উদীয়মান বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত যেমন কৃষক এবং শ্রমিকের সঙ্গে সংযুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিকশিত হয় এখানে তেমনটা হয় নি সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনে তা গড়ে ওঠায়।
এই রকম অবস্থায় উৎপাদনশীল, পরিশ্রমী, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, সেকিউলার অথবা সেকিউলার প্রবণতাসম্পন্ন এবং গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণী ছিল অববিকশিত ও নিপীড়িত। আসলে অর্থনৈতিকভাবে এই শ্রেণী কতটা বিকশিত ছিল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল এমন একটা বুর্জোয়ার আকাঙ্ক্ষা বা সম্ভাবনা যে শ্রেণী বা যাদের মধ্যে ছিল তারাই ছিল অবদমিত, নিপীড়িত, ফলে ছিল ক্ষুব্ধ। মার্কসীয় পরিভাষা ব্যবহার করলে আমরা এদেরকে জাতীয় বুর্জোয়া বলতে পারি।
এই উৎপাদনশীল ও স্বাধীনচেতা বুর্জোয়ার সবচেয়ে বড় উৎস ছিল কৃষক। অর্থাৎ কৃষকদের মধ্য থেকে প্রকৃতপক্ষে একটি নবীন ও উৎপাদনশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর উথানের বাস্তবতা সবচেয়ে বেশী ছিল। কিন্তু কৃষকের প্রয়োজনীয় আধুনিক জ্ঞান, চেতনা ও প্রযুক্তি বিদ্যা ছিল না যা দিয়ে তা বুর্জোয়া হয়ে উঠতে পারে। এগুলি ছিল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং সমাজের সবচেয়ে প্রবল ও সংগঠিত শক্তি ছাত্রদের মধ্যে যারা কৃষকের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা প্রকৃত উৎপাদনশীল, সংগ্রামী ও মর্যাদাবান তথা স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, সেকিউলার ও জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী গড়ে তুলতে পারত। ফলে কৃষক তার আকাঙ্ক্ষার অগ্রদূত হিসাবে দেখতে পেত ছাত্র সম্প্রদায়কে। অন্যদিকে কৃষকের বুর্জোয়া আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তার ছিল পুঁজির স্বল্পতা এবং ভূমি সংস্কারের প্রয়োজন। একটা সমাজতান্ত্রিক ধরনের রাষ্ট্র তার পুঁজি এবং ভূমির প্রয়োজন পূরণ করতে পারত। বিশেষত রাষ্ট্রের কাছ থেকে তার প্রয়োজনীয় পুঁজির প্রত্যাশা ছিল খুব বেশী। ফলে তার বুর্জোয়া বিকাশের আকাঙ্ক্ষা থেকেও সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শের প্রতি তার এক অন্তর্গত আকর্ষণ ছিল। কিন্তু এই সমাজতন্ত্র কমিউনিজম অভিমুখী নয় বরং একটি গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ অভিমুখী -- সুতরাং সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ন্যাপের ভিতর কৃষক তার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখতে পেত।
বুর্জোয়া হতে চাওয়া কিংবা বুর্জোয়া সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষী কৃষক চেতনার প্রতিভূ ভাসানী তাই বিপ্লবের প্রয়োজন বোধ থেকে সেকিউলার চেতনার অগ্রদূত এবং শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের জাগরণের অগ্রদূত কমিউনিস্ট পার্টিকে তাঁর মিত্র হিসাবে দেখেছিলেন; এবং মিত্র হিসাবে কাছে টেনে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের শিকার হয়েছিলেন।
অন্যদিকে ছাত্ররা ছিল প্রকৃতপক্ষে বুর্জোয়া সমাজ নির্মাণের অগ্রবাহিনী। আর এই নির্মাণের প্রয়োজনে তারাও যখন বিপ্লবের প্রয়োজন বোধ করেছে তখন কৃষক, শ্রমিককে সংগঠিত করতে চেয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও তার পার্টিকে দেখেছে তাদের মিত্র হিসাবে। আর ছাত্র-তরুণরাই তো বিপ্লবের প্রকৃত ভবিষ্যৎ নেতা। সুতরাং বিপ্লবে নেতৃত্বকারী শক্তির ভূমিকা পালন করতে চেয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেছে এবং সেই সঙ্গে শুধু যে আত্মদ্বন্দ্বের শিকার হয়েছে তাই নয়, উপরন্তু সমাজের বিদ্যমান বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা থেকেও বিযুক্ত হয়েছে একটা ভিন্ন ধরনের মতবাদের কাঠামোতে যাবার কারণে।
বাম কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় বুর্জোয়া হিসাবে যদি বা কখনও ভাসানীকে বিবেচনা করেছে কিন্তু এই সমাজে জাতীয় বুর্জোয়ার যে নেতৃত্বকারী ভূমিকা রয়েছে সেটাকে অস্বীকার ও নাকচ করতে গিয়ে ভাসানীকে নাকচ ও অস্বীকার করেছে। এবং যতদিন একত্রে থেকেছে ততদিন ভাসানীকে খর্ব ও পঙ্গু করে রাখতে চেষ্টা করেছে। একই কাজ তারা করেছে এ দেশে বিপ্লবী বুর্জোয়া হিসাবে যে ছাত্ররা ভূমিকা পালন করেছে তাদের ক্ষেত্রেও। সামাজিক শক্তি হিসাবে তাদের বাস্তব ভূমিকা অস্বীকার করতে পারে নি বলে এবং তাদের ছাড়া এগোতে পারে নি বলে তাদেরকে কাছে নিয়েছে। তবে সেটা করেছে তাদেরকে পঙ্গু করে রাখার জন্য, যাতে বিপ্লবটা যদি কখন হয় তবে সেটা যেন তাদের মার্কসবাদ এবং রাশিয়া, চীনের দেওয়া তত্ত্ব অনুযায়ী হয়। আসলে বাস্তবটা তাদের কাছে ছিল মূল্যহীন। তত্ত্বটাই ছিল সবকিছু। কমিউনিজমে অন্ধ বিশ্বাস তাদের মতান্ধ করেছিল এবং আরও সঠিকভাবে বললে তাদের মানসিক প্রতিবন্ধী করেছিল।
কিন্তু এতক্ষণ আমি যেভাবে সমস্যাটিকে উপস্থিত করলাম তা প্রধানত অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাখ্যার প্রয়াস। কিন্তু এটি নিদারুণ ভাবে খণ্ডিত রয়ে যাবে যদি এই সমস্যাটিকে রাজনৈতিক দিক থেকেও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা না করা হয়। এবং সম্ভবত আমাদের দেশে সেটিই অর্থনৈতিক দিকটির চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
হাঁ, অর্থনীতিতে বুর্জোয়া কতটা আছে না আছে তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল এ দেশের রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়ার ভূমিকা পালনের সুযোগ কতটা আছে বা না আছে সেটা। যতই সীমাবদ্ধ হোক এ দেশে ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে কিংবা অনুমোদনে ধীরে ধীরে একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ করে দিয়ে গেছে। শুধু যে নির্বাচনের সুযোগ আছে তা না, প্রকাশ্যে রাজনৈতিক ভূমিকারও সুযোগ আছে। এর ফলে গোপন ও বিপ্লবী যে কোন রাজনীতির জন্য এ দেশের পরিস্থিতিটা রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঐ সব দেশে ভয়ানক রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও সংগঠনের নিরঙ্কুশ এককেন্দ্রিকতা ও প্রচণ্ড দৃঢ়বদ্ধতা যেভাবে মধ্যবিত্তকে আকৃষ্ট করেছে এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত সমাজের কাছে বুর্জোয়া বিপ্লব অথবা শিল্পায়নের জন্য একমাত্র পথ হিসাবে দেখা দিয়েছে এখানে তা হয় নি।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও প্রকাশ্য আন্দোলনের সুযোগের কম-বেশী উপস্থিতির ফলে এ দেশে মধ্যবিত্তের একটা নিজস্ব রাজনৈতিক ভূমিকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে সকল সীমাবদ্ধতার ভিতরেও বুর্জোয়া হিসাবে তার ভিতরে একটা বোধ বা অনুভূতি সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু বৈরী রাষ্ট্র, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, পশ্চাৎপদ ও নিপীড়ক ধর্মীয় নিগড়, ভূমি ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা এগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার আকাঙ্ক্ষাও তার ভিতরে জাগ্রত হয়েছিল। ক্রমে লড়াইয়ের প্রয়োজন তাকে জনগণের কাছে নিয়েছে। কিন্তু সেটা মধ্যবিত্তের মধ্যে বুর্জোয়া উচ্ছেদের চেতনাটাকে কখনও নিরঙ্কুশ কিংবা ব্যাপক করতে পারে নি। কারণ তা বুর্জোয়া হিসাবেই নিজ ভূমিকা পালন করতে চেয়েছে। এবং বৃহত্তর জনগণও সেই আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করেছে। কারণ সেটা তাদের নেতৃত্বের শক্তি মধ্যবিত্ত ধারণ ও উপস্থিত করেছে।
যেহেতু নিয়মতন্ত্রের রাজনীতি দ্বারা শাসক শ্রেণী এই মধ্যবিত্তকে ক্ষমতার সঙ্গে দেনদরবার করার কিংবা তাকে অংশত হলেও ব্যবহার করার সীমাবদ্ধ সুযোগ দিয়েছে সেহেতু মুৎসুদ্দি অথবা সীমাবদ্ধ আকাঙ্ক্ষার মধ্যবিত্ত বা বুর্জোয়া রাজনীতিকরা নিয়মতন্ত্র ও আপোসের সীমাবদ্ধ ও সহজ পথটি বেছে নিয়েছে। এর জন্য তারা পাশ্চাত্য প্রভুদের কাছ থেকে একটা তৈরী বুর্জোয়া মতাদর্শও পেয়েছে। নূতন করে এবং স্বাধীনভাবে মতাদর্শ গড়ার কষ্টসাধ্য কাজটাও করতে হয় নি।
কিন্তু মধ্যবিত্তের যে অংশটি স্বাধীন ও উৎপাদনশীল এবং সেহেতু বিপ্লবী বুর্জোয়া হিসাবে দাঁড়াতে চেয়েছিল তাদের একটা বিপ্লবী বুর্জোয়া মতাদর্শের অভাব ছিল। সুতরাং এই অভাব পূরণের জন্য এবং অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিপ্লবী মতাদর্শভিত্তিক কমিউনিস্ট পার্টিকে কাছে পেতে চেয়েছিল। আর তখনই দেখা দিল এক জটিল ও অমীমাংসেয় দ্বন্দ্ব।
উৎপাদনশীল ও বিপ্লবী বুর্জোয়ারা তাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল শ্রমজীবী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং সংগঠিত করে। আর এই কাজে তাদের তত্ত্ব ও শক্তির অভাবটা পূরণ করতে চেয়ে যখন কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টিকে কাছে টেনেছে তখন পার্টি এই বুর্জোয়াদের উত্থান রোধ করতে চেয়ে জাতীয় প্রশ্ন বাদ দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব দিয়ে জনগণকে কেড়ে নিয়েছে এই বুর্জোয়াদের কাছ থেকে। কারণ কমিউনিস্টের রাজনীতির উদ্দেশ্য বুর্জোয়ার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা নয়, বরং ‘সর্বহারার’ নেতৃত্ব ও একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। ছাত্র ইউনিয়নকে মস্কোপন্থীরা ভাঙ্গল কেন? কারণ তার ভিতর দিয়ে মূর্ত হচ্ছিল বিপ্লবী বুর্জোয়া শক্তির উত্থান সম্ভাবনা। একই কারণে তারা ভাসানীকে ত্যাগ করল। কিন্তু তারা মুজিবকে সমর্থন দিল কেন? এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল মস্কোপন্থী পার্টির নেতৃত্ব যাঁদের হাতে ছিল তাঁরা ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত। এই কারণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম সংখ্যাগুরু পূর্ব বাংলার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। অন্যদিকে তাঁদের ছিল অতীত বিপ্লব প্রচেষ্টার ভয়ানক ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা। এই সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাঁদের পক্ষে এ দেশে নিজেদের নেতৃত্বে বিপ্লব সংগঠন কিংবা অন্য কোনভাবে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা ছিল না। আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা তখন সর্বহারা। সুতরাং এই সর্বহারাগণ প্রচলিত আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোর ভিতর যেটুকু অর্জন হয় তাতেই তুষ্ট ছিলেন। তাঁদের বৃহৎ কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না বলে এবং ভীতি ছিল বলে তাঁরা প্রচলিত ধারায় যে মুৎসুদ্দি এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে পাকিস্তানী শাসকদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখতে পেয়েছিলেন সেটাকে সমর্থন দিয়েই ধীর গতিতে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন। এবং এ ক্ষেত্রে তাঁদের মতাদর্শিক উপকরণ আসত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে, বিশেষত মস্কো থেকে।
সুতরাং তাঁরা যতদিন পেরেছেন নিজেদের বলয়ের ভিতর থেকে কোন স্বাধীন শক্তির সুতরাং বিপ্লবী শক্তির উদ্ভব ঘটতে দেন নি, যাতে মুৎসুদ্দি ও আপোসকামী কিংবা নিয়মতান্ত্রিক বুর্জোয়া নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনও শক্তির উত্থান না ঘটে। এই প্রয়োজন থেকে তাঁরা ছাত্র ইউনিয়নকে বিভক্ত করেছেন। যখন দেখেছেন তরুণ শক্তির অভ্যুদয় ভাসানী এবং ন্যাপের শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং সেখানে থেকে তাঁদের পক্ষে আর বিপ্লবী বুর্জোয়ার উত্থান রোধ করা সম্ভব নয় তখন তাঁরা ভাসানী এবং ন্যাপকে পরিত্যাগ করে গেছেন। কিন্তু ভাসানীর প্রতি তাঁদের খর্বকারী ভূমিকাটা দূর থেকে পালনের প্রয়োজনে ১৯৬৭-এর ১৭ ডিসেম্বরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ নামে আর একটি দল খাড়া করলেন।
যখন তরুণ শক্তির অভ্যুদয় রোধ করা গেল না এবং ভাসানী নেতৃত্বকারী ভূমিকা নিয়ে এগোতে চাইলেন তখন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধানত মুসলমান সম্প্রদায় থেকে আগত নেতারা পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলেন। এঁরা এবার বিপ্লবী হলেন। মুসলমান পটভূমি থাকায় নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন তাঁদের জন্য সহজতর হল। কারণ তাঁদের সামাজিক প্রভাব ও সংযোগ অনেক বেশী। কিন্তু বিপ্লবের কথা মুখে বললেও তাঁদের আকাঙ্ক্ষা এবং ক্ষমতাটা ছিল ঐ কমিউনিস্ট হওয়া এবং থাকা পর্যন্ত। ফলে বিপ্লবী জাতীয় বুর্জোয়া হিসাবে ভাসানী কিংবা ছাত্রদেরকে তাঁরা আর বাঞ্ছিত ভূমিকা পালন করতে দিলেন না।
হাতের কাছে পাওয়া ভাসানী এবং ছাত্র-তরুণদের তাঁরা না হয় খর্ব করলেন, বিপ্লবী বুর্জোয়ার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া বিপ্লবের পথটাও তাঁরা না হয় রোধ করলেন, কিন্তু আপোস ও নিয়মতন্ত্রের পথ ধরে ওঠা এবং তাঁদের নাগালের বাইরে থাকা মুজিবের উত্থান তাঁরা ঠেকাবেন কিভাবে? সুতরাং বিরোধিতায় নেমে পড়লেন। ওটাই চালালেন। চালাতেই থাকলেন। কারণ বিপ্লব তো তাঁদের কাছে বড় কথা নয়। বড় কথা হল কমিউনিস্ট হওয়া এবং কমিউনিস্ট থাকা! তাঁদের বিশ্বাসের শুচিতা নষ্ট না হলেই হল! এবং কর্মীদের শ্রেণী চরিত্রটা (!) ঠিক রাখতে পারলেই হল!
আসলে কি তাঁরা মুজিব ঠেকাতে চেয়েছিলেন? না, মুজিব ঠেকানোও তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। কারণ সেটা যে সম্ভব নয় তা তাঁরা ভালভাবে জানতেন। তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের সীমাবদ্ধ ও পঙ্গু আকাঙ্ক্ষার গাঁয়ের মোড়লি মার্কা রাজনীতি চালাবার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিটাকে নিজেদের হাতে ধরে রাখা। হাতে পাওয়া শক্তিগুলো যাতে হাত ফসকে তাঁদের একেবারে নিরুপায়, অক্ষম, এতিম করে দিয়ে না যায় সেইজন্য যখন যেটা বলার এবং করার দরকার ছিল তখন সেটাই বলতেন এবং করতেন। আমরা তাঁদের অতীত কার্যকলাপ যদি পর্যালোচনা করি তবে এটা স্পষ্ট হয় যে, প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতর নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচন-কেন্দ্রিক রাজনীতি, যেটা হল মুৎসুদ্দি রাজনীতি গড়ে তোলার প্রধান পদ্ধতি, সেটাকে মোকাবিলা করার সাধ বা সাধ্য কিছুই ছিল না বলে তাঁরা খুব যত্ন সহকারে যে কাজটা করেছেন তা হল নির্বাচন ও নিয়মতন্ত্রের অধীনস্থ এই ধারার বাইরে যে বিপ্লবী রাজনীতিটা ন্যাপ এবং ভাসানীকে অবলম্বন করে বা সামনে রেখে গড়ে উঠছিল সেটাকে বিনষ্ট করা।
এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে যে, পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের বৃহত্তর অংশ শেষ পর্যন্ত স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা তথা স্বাধীনতার কর্মসূচী দিতে পারল অথচ তারা কেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী দিল না বা দিতে দিল না। বস্তুত এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে আমরা দেখতে পাব এই কমিউনিস্টদের ভাসানী এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতমূলক এবং খর্বকারী ভূমিকাকে। যারা স্বাধীনতার কর্মসূচী দিয়েছিলেন সিরাজ শিকদার বাদে তারা আর সবাই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপকে তাদের এই রাজনীতি প্রচারের প্রকাশ্য মঞ্চে পরিণত করেছিলেন। অথচ ন্যাপের মাধ্যমে তারা যেটা করতে পারতেন সেটা তারা কখনই করেন নি বা কাউকে করতে দেন নি।
কারণ এই কমিউনিস্ট নেতারা জানতেন যে, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী দিলে ন্যাপ এবং সেই সঙ্গে ভাসানী প্রকাশ্য জাতীয় আন্দোলনে অপ্রতিরোধ্য বিশাল নেতা হয়ে উঠবেন। পরবর্তী কালে যখন স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলন ও যুদ্ধে পরিণত হবে তখন সেটা ঘটবে একটি প্রকাশ্য গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে, যে গণ-অভ্যুথানের প্রধান নেতৃত্বকারী শক্তি কমিউনিস্ট পার্টি না হয়ে হবে ন্যাপ এবং প্রধান নেতা কমিউনিস্টরা না হয়ে হবেন মওলানা ভাসানী।
এটা ঠিক যে, কমিউনিস্টরা এর ফলে ন্যাপের মূল নিয়ন্তা হিসাবে লাভবান হত। কিন্তু সেটা মতাদর্শিকভাবে নয়। কারণ এর ফলে যে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা ঘটত সেটা ব্যক্তিমালিকানা বিলোপবাদী কমিউনিস্ট সমাজ গঠনের দিকে না গিয়ে যেত একটা জাতীয় গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ গঠনের দিকে। অর্থাৎ তাদের মতাদর্শ বা তত্ত্বের দাবী যা-ই থাক বাস্তবে তাদেরকে প্রতিনিধিত্ব করতে হত জাতীয় বুর্জোয়া বিপ্লবকে। এবং এই বিপ্লবে ভাসানীসহ জাতীয় বুর্জোয়াদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ থাকার ফলে সর্বহারার একনায়কত্বের নামে কমিউনিস্ট মতাদর্শ এবং পার্টির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হত না।
এই বিষয় জানা দরকার যে, কমিউনিস্ট নেতৃত্ব যে ন্যাপে কাজ করত সেটাকে নিজেদের প্রকৃত সংগঠন মনে করত না। ফলে তারা জাতীয় বুর্জোয়া সংগঠন হিসাবে ন্যাপের ক্ষমতা দখলে আগ্রহী ছিল না। অর্থাৎ তারা প্রকৃতপক্ষে এ দেশের বাস্তবতায় জাতীয় জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবে আগ্রহী ছিল না, যেমন তারা বিশ্বাসী ছিল না ভাসানী এবং সেই সঙ্গে জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে ক্ষমতার অংশীদারিতে, যাতে মতাদর্শিক ও কর্মসূচীগতভাবে জাতীয় বুর্জোয়ারাই প্রাধান্যে থাকবে।
তাদের এই মনস্তত্ত্ব থেকে তারা ন্যাপকে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন-কেন্দ্রিক কোন জাতীয় কর্মসূচী গ্রহণ করতে দেয় নি। অথচ তাদের মধ্যকার দেবেন-মতিন নেতৃত্ব ১৯৬৮-তে প্রাথমিকভাবে এবং ১৯৬৯-এ পূর্ণাঙ্গভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যাখ্যা হল যে, এদের একাংশ এই কর্মসূচীর প্রতি আন্তরিক ছিল না যে কথাটা আগেও বলেছি। এটা ছিল মূলত ছাত্র-যুব সমাজকে ধরে রাখার কৌশল। অপর অংশ প্রকৃতপক্ষেই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চাইত। কিন্তু তারাও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলে সেটাকে গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে একটা জাতীয় বিপ্লবী যুদ্ধে পরিণত করায় আগ্রহী ছিল না। কারণ তারা জানত যে, এই প্রক্রিয়ায় ভাসানী এবং তার সঙ্গেকার জাতীয় বুর্জোয়াদেরকে তারা যেমন নাকচ করতে পারবে না তেমন তারা তাদের ফর্মুলা অনুযায়ী ব্যক্তিপুঁজিহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজও গঠন করতে পারবে না। সুতরাং এমন বিপ্লবে তাদের কী লাভ? কাজেই স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক কর্মসূচীর সাহায্যে তারা গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুথানের রাজনীতি না গড়ে একবারে হঠাৎ করে স্বাধীনতার কর্মসূচী দিল। এইভাবে তারা তাদের গড়ে তোলা শ্রেণী সংগ্রামকে সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে পরিণত করে সর্বহারার একনায়কত্বের নামে কমিউনিস্ট পার্টির একক নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিপ্লবের রাজনীতির পথটা গড়তে চাইল। এই অংশের নেতা হলেন দেবেন শিকদার-আবুল বাশার।
অর্থাৎ দেবেন-বাশার গোষ্ঠীর কাছেও শ্রেণীহীন সমাজের নামে ব্যক্তি মালিকানাহীন সমাজ গঠনের রাজনীতি মূল বিবেচ্য বিষয়, বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতি নয়। বাঙ্গালীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা ছিল তাঁদের নিকট একটি কৌশলগত বিষয় মাত্র। তাই তাঁরা জাতীয় আন্দোলনের একান্ত প্রাথমিক করণীয়গুলোকে এভাবে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন, যেমন ন্যাপের পক্ষ থেকে জাতীয় কর্মসূচী প্রদানের দায়িত্ব। আসলে এ দেশে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মূল একটা সমস্যা ছিল বাঙ্গালী জাতি গঠনের তাৎপর্য বুঝতে না পারা বা না চাওয়া। এ উপমহাদেশ এবং এ দেশের সমাজ বিপ্লবের সমস্যা যে জাতি গঠনের সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত সেটা তাঁরা তাঁদের মতাদর্শিক অন্ধত্বের কারণে কখনই বুঝতে পারেন নি। এবং এই জাতি গঠনের প্রয়োজনে যে, এ দেশে ব্যক্তি পুঁজির এবং জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপ্লবী এবং প্রগতিশীল ভূমিকা থাকতে পারে সেটাও তাঁরা বোঝেন নি।
আসলে ষাটের দশকে আমাদের দেশের জাতীয় বিপ্লবের সামনে যে সমস্যা দাঁড়িয়েছিল তা শুধু কতগুলো মতান্ধ ব্যক্তির নয়, ওটা একটা যুগেরও সমস্যা ছিল। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যে বদ্ধমূল ধারণাটি সে কালে বিপ্লবের পথ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে এ দেশে কারো পক্ষেই খুব ভিন্ন কিছু করা সম্ভব ছিল না বলে সেটা করা যায় নি। রাশিয়া, চীন এসব দেশের চেনা ও জানা পথের বাইরে এ দেশে যাওয়াটা ছিল দু:সাধ্য। নূতন কিছু বললে তখন কে শুনত? নূতন বা দেশোপযোগী, যুগোপযোগী তত্ত্বের কথা বললেই তো হল না! শুধু পার্টির নেতারা নয়, এ দেশের শিক্ষিত সমাজতন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবীরা বসে ছিল না তত্ত্বের বিশুদ্ধতাকে পাহারা দিতে? একদিকে পাশ্চাত্য নির্ভর, সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকদের সহযোগী পাশ্চাত্যমনা তথাকথিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রী বুদ্ধিজীবীরা, যারা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি পঙ্গু, বিকৃত ও মুৎসুদ্দি গণতন্ত্রের প্রচারক, ছিল সমাজ বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে, অপর দিকে মার্কসবাদী অথবা সমাজতন্ত্রী বুদ্ধিজীবীরাও ছিল এ দেশে নিজস্ব বিপ্লবের পথ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড প্রতিবন্ধক। কারণ এতটুকু বাস্তব অভিজ্ঞতা সংগ্রহের প্রয়োজন বোধ না করলেও পুস্তক পড়ার গুণে এইসব ঘরে বসে থাকা আর মাঝে মাঝে সভায়, সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়া মার্কসবাদের ‘কোরানে হাফেজ’ বুদ্ধিজীবীরা ছিল এ দেশের বিপ্লবের এক একটা ‘অথরিটি’। পার্টির ভিতরে নেতা আর বাইরে বুদ্ধিজীবী এই সবাই মিলে মতান্ধতার এক চমৎকার বাতাবরণ সৃষ্টি করে রেখেছিল! সর্বোপরি ছিল জনসমাজের নিদারুণ পশ্চাৎপদতা ও পরনির্ভরতা।
এই অবস্থায় দেশের প্রায় সম্পূর্ণ মাথাটাই ছিল বিদেশ নির্ভর, সুতরাং মুৎসুদ্দি। কেউ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নামে পাশ্চাত্যের, কেউ সমাজতন্ত্রের নামে রাশিয়া-চীনের। চেতনাটা স্বাধীন না হলে জাতীয় বিপ্লব হবে কিভাবে? আমি তো আমার নিজ অভিজ্ঞতায় দেখেছি ষাটের দশকে নূতন চিন্তার প্রকাশ অথবা অভিজ্ঞতার আলোয় বাস্তব পন্থাটা তুলে ধরা কত কঠিন এমন কি অসম্ভব ছিল! চারপাশের চাপে নূতন ও বাস্তবমুখী চিন্তা মাথা তোলারই অবকাশ পেত না। শুধু তাই নয়, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পূর্ব পর্যন্ত এসব চিন্তা করার, বলার বা শোনার লোকের কি নিদারুণ অভাব ছিল তাও তো দেখেছি! বস্তুত, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর থেকে একটা স্বাধীন চেতনার শক্তির দাঁড়াবার মত একটা স্থান এ দেশে তৈরী হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে এতে ক্ষুব্ধ হবারও কিছু নেই। কারণ একটা জাতির স্বাধীন চিন্তার শক্তি একদিনে আসে না; একজনের চেষ্টায়ও নয়, অভিজ্ঞতায়ও নয়। এটা বহু মানুষের চেষ্টা ও অভিজ্ঞতার
ফসল। ষাটের দশক এবং বিশেষত ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির জন্য এক বিশাল অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। পরবর্তী ২৫ বৎসরেও আমাদের কম অভিজ্ঞতা হয় নি। এই সবেরই একটা বিরাট মূল্য আছে।
বরং আমি তো আমাদের এই জাতি, এই জনসমাজের একটু অতীতের দিকে যখন দৃষ্টি ফেরাই তখন আমাদের এই এতটুকু সময়ের অর্জনের কথা ভেবে বিস্ময়াভিভূত হই! কি ছিল আমাদের? এক দল অজ্ঞ-মূর্খ চাষাভূষা, বনে-বাদাড়ে-জলায় বেড়ে ওঠা, জমি চষা, মাছ ধরা, নৌকায় ঘুরে বেড়ানো, জমিদার আর আমলা-পুলিশের ভয়ে তটস্থ, পৃথিবীর যাবতীয় কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস বয়ে বেড়ানো এই মানুষেরা আমরা কত দ্রুত, কি অবিশ্বাস্য গতিতে জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামের পথ ধরে এতটা পথ এগিয়ে এসেছি এ কথা ভাবলেই তো অবাক হই। আমাদের অতীতটা কি ছিল? রাজনীতি, রাষ্ট্র, নগর সভ্যতা ওসব দেখবার ও জানবার অভিজ্ঞতা আমাদের কয় প্রজন্মের? সুতরাং বিরাট অর্জনের জন্য কিছু মূল্য দিব না এ হয় না। সব জাতিকে জাতি হবার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়। এটাই নিয়ম।
সুতরাং ষাটের দশকের অভিজ্ঞতার যখন পুনর্মূল্যায়ন করতে বসি তখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, বিপ্লব পন্থায় পৃথিবী জুড়ে রাশিয়া-চীনের প্রবল প্রভাবের ঐ কালে এ দেশে বামপন্থী কর্মীরা যা করেছিল তার বেশী কিছু করার উপায় তাদের ছিল না। বরং আজ যদি নির্মোহভাবে অতীত অভিজ্ঞতার বিচার করা যায় তবে দেখা যাবে যত ভুল থাকুক ঐ কালের ন্যাপ, কমিউনিস্ট আন্দোলন ও তার প্রভাব বলয়ের ভিতরটাতে ছিল এ দেশের বিপ্লবের প্রকৃত শক্তি ও অভিজ্ঞতা। আর এটা আমাদের হাতের কাছে পাওয়া মার্কসবাদী তত্ত্বের অবদান। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের জাতীয় বিপ্লবের শত্রু ছিল সাম্রাজ্যবাদ। এ দেশে তার সহায়ক বা ভিত্তি ছিল যেমন পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরতন্ত্র তেমন আর একটি জিনিস জনগণের ভিতরই রাখা ছিল, সেটি হল নিয়মতান্ত্রিক-নির্বাচনী রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের মতাদর্শের নামে মুৎসুদ্দি গণতন্ত্রের ভাবাদর্শ।
এমন অবস্থায় পশ্চাৎপদ, অনভিজ্ঞ এই জাতি বিপ্লব করতে গিয়ে এবং সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিহত করতে গিয়ে যে মার্কসবাদ ও সোভিয়েত-চীনকে আদর্শিক ও মানসিকভাবে অবলম্বন করবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। এবং এটাও ঠিক যে, সকল সীমাবদ্ধতা নিয়েই মার্কসবাদ এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন পৃথিবীর চেহারাটা এভাবে বদলে দিয়েছে। এবং যতই কঠোর সমালোচনা করা যাক সে যুগে কমিউনিস্ট আন্দোলন এ দেশের চেহারায় এতটা বদলের সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ ছিল। এর ভিতর এমন এক আদর্শিক প্রেরণা ছিল এবং এমন কিছু ব্যবহারিক পদ্ধতি ছিল যা বিপুল সংখ্যক কর্মী ও জনতাকে যেমন আকৃষ্ট করেছিল তেমন অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে যাবার শক্তিটাও দিয়েছিল। আর এর ফলে আমরা পেয়েছি অমূল্য অনেক অভিজ্ঞতা, যা ছাড়া সঠিক পথের দিশা কোন দিন আসে না।
এখন আমরা যদি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সে কালে আমাদের করণীয় কি ছিল সেটা ঠিক করতে পারি তবে ভবিষ্যতের করণীয় বের করাটাও আমাদের জন্য সহজতর হবে। সে কালে আমাদের প্রয়োজন ছিল গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য একটা বিপ্লবী বুর্জোয়া পার্টির, যা গড়ে তুলত একটা বিপ্লবী বুর্জোয়া শ্রেণীকে। এই শ্রেণীর প্রধান অগ্রবাহিনী সে কালে ছিল ছাত্র-যুব শক্তি, যা কৃষক-শ্রমিক ও নারীসহ শ্রমজীবী ও নিপীড়িত জনতার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে নিজেরা যেমন প্রকৃত বিপ্লবী বুর্জোয়া শ্রেণী হত তেমন সংগঠিত করত একটা বৃহত্তর বিপ্লবী বুর্জোয়া শ্রেণী ও তার বাহিনী। এই শ্রেণী যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করত তখন প্রতিষ্ঠিত হত বাঙ্গালী জনগণের একটি সেকিউলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ।
এই রকম একটি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তা কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও অভিজ্ঞতা থেকে নিতে পারত সেকিউলারিজম তথা ইহবাদ বা লোকবাদ এবং শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা ও পদ্ধতি। কিন্তু তার লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল কমিউনিজমের পরিবর্তে একটি গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ গঠন। এই রকম এক বিপ্লবী পার্টির রূপ সম্পর্কে সহজ ভাষায় উপমা দিয়ে বলা যায় যে, তার মাথাটা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়ার কিন্তু শরীরটা কমিউনিস্টের। হাঁ, বাস্তবে তার মডেলটা ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। কিন্তু কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দিতে চেয়ে ঐ মাথাটাকে ভেঙ্গে দিয়ে নিজেরাও মরেছে, বিপ্লবকেও মেরেছে। কারণ বিপ্লব সম্পর্কেই এক ধার করা, অন্ধ, যান্ত্রিক ধারণা। বিপ্লবের রূপ যে দেশে দেশে কালে কালে ভিন্ন হয়, হতে পারে সেই বোধই তাদের ছিল না। ফলে আমাদের জাতীয় বিপ্লবের জন্য যে নিজস্ব আদর্শ গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল সে কাজটাকেই আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় নি।
আসলে আমাদের প্রয়োজন ছিল একটা উন্নত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শের। কেননা এই আদর্শের বন্ধন ছাড়া বুর্জোয়াও হয়ে ওঠে লুম্পেন। এবং আদর্শ ছাড়া জনগণও উন্নত চেতনার অধিকারী হয় না, জাগে না; মুক্তির পথে তাদের সংগঠিত করা যায় না। ফলে বিপ্লবী বুর্জোয়ার, গণতান্ত্রিক ও সেকিউলার বুর্জোয়ারও উত্থান সম্ভব হয় না। বস্তুত নূতন এক বিপ্লবী আদর্শ সংগঠনের এই প্রয়োজনটাই এখনও রয়ে গেছে। কারণ প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে এবং এখন প্রয়োজন দ্বিতীয় বিপ্লবের। শুধু প্রয়োজন নয়, সেই বিপ্লবটাই অনিবার্য ও আসন্ন হয়ে উঠছে। কিভাবে উঠছে সেই কথাটাও কিছু পরে আলোচনা করব।
কিন্তু এই দ্বিতীয় বিপ্লবকে সফল করতে হলে আমাদের চাই পুরাতন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিপ্লবী তত্ত্বের পুনর্সংগঠন। অর্থাৎ এ দেশে বিপ্লবের জন্য আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটা নূতন তত্ত্ব। এই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। আমাদের সমাজের চেহারাও আর অনেক দিক থেকেই আগের মত নেই। ফলে অনেক কিছুকেই এখন আমাদের নূতনভাবে দেখতে ও বুঝতে পারতে হবে।
অবশ্য প্রশ্ন আসবে তত্ত্বের জন্য কি আমাদের বসে থাকতে হবে? মোটেই তা নয়। বস্তুত খোলা চোখে ও মনে পুরাতন অভিজ্ঞতার পুনর্মূল্যায়ন করলেই আমরা দেখতে পাব কিভাবে আমাদের বিপ্লবের তত্ত্ব বেরিয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে সেকালের ন্যাপের ছত্র ছায়ায় গড়ে ওঠা বাম আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এ দেশে বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের সূচনাটা ঘটানো সম্ভব হবে। তত্ত্ব মানেই পূর্ণাঙ্গ ও অচল-অনড় কিছু এই ধারণাটাই বা আমরা কেন করব? আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনের মতই এর জন্ম আছে, বৃদ্ধি আছে, বার্ধক্য এবং মৃত্যুও আছে। আর এইভাবে যুগে যুগে কালে কালে মানুষ নূতন নূতন তত্ত্ব, আদর্শ, মতবাদ, ধ্যান-ধারণাকে অবলম্বন করে এগিয়ে যায়। সুতরাং তত্ত্বের কোনও কল্পস্বর্গ বা ইউটোপিয়ার প্রয়োজন আমাদের নেই। আমাদের চাই ধারণার একটা হাতিয়ার, যা আমাদের নূতন পথে যাত্রাটা শুরু করাবে।
এটাই আমাদের সেই ষাটের দশকে আমাদের দেশের উপযোগী করে ছিল না। থাকবে কি করে? হাজার বছরের এই পঙ্গু সমাজে কয়টা কৃষক বিদ্রোহ, কয়টা গণ-বিপ্লব হয়েছে যেখান থেকে আমরা অভিজ্ঞতার নির্যাস টেনে বের করে নিতে পারতাম? এমন কি এই সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসটাই বা কি? হাজার হাজার বৎসরের অলোক-পরলোকবাদী ধর্ম শাসিত এই উপমহাদেশে আত্মসমর্পণ আর অহিংসার রূপটাই তো সর্বদা চোখের সামনে থেকেছে। যেসব বিদ্রোহ হয়েছে সেসবের চিত্রই বা পাওয়া যাবে কতটুকু? প্রাচীন কাল থেকে যে উপমহাদেশে ইতিহাস লেখারই চল প্রায় ছিল না বলা চলে সেখানে ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নিব সেটাই বা কি করে সম্ভব? হাঁ, জানা ইতিহাস তো প্রায়শ ঐ একটাই, ধর্মের নামে ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ আর অন্ধ ভক্তির বন্যায় ভেসে যাওয়া! হাজার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য শাসিত, শূদ্র ও বান্দা চেতনা সমাচ্ছন্ন এমন এক বিশাল উপমহাদেশের এক কোণে জলাভূমিময় এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে ভারতবর্ষের আধুনিক কালের ইতিহাসের প্রথম জাতীয় গণ-বিপ্লব যে আমরা সম্পন্ন করতে পেরেছি এ কি আমাদের কম গৌরবের? আর সে কারণে এখন আগামী বিপ্লব শুরুর তত্ত্বের জন্য ইউরোপ, রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা আর কারো কাছে আমাদের দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াতে হবে না। নিশ্চয়, সকলের, সারা পৃথিবীরই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবার প্রয়োজন আমাদের আছে এবং সব সময়ই থাকবে। কিন্তু তবু এখন আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভাণ্ডার, একটা নিজস্ব ভিত্তি আছে, যা এক কালে ছিল না। হাঁ, এখন আমাদের বহুকিছু নিজস্ব হবে। শুধু তত্ত্ব নয়, যে বুর্জোয়া বিপ্লবের কথা বললাম শুধু সেটাই নয়, এমন কি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে বুর্জোয়া তৈরী হবে সেই বুর্জোয়াও হবে আমাদের নিজস্ব। ঐ বুর্জোয়া ইউরোপের, আমেরিকার নয়, এমন কি চীনেরও নয়। আমরা আজও জানি না যখন তা বিকশিত হবে তখন তার পূর্ণাঙ্গ রূপটি কেমন হবে। আমাদের এখন তা জানার প্রয়োজনও নেই। ইউরোপের বিপ্লবের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বুর্জোয়ার যে একটা ধারণা পেয়েছি, মাত্র সেইটুকু নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু। কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, বিপ্লবের বিকাশের মধ্য দিয়ে, আগামী সমাজের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের যে নিজস্ব বুর্জোয়ার রূপটি দেখতে পাব তা যে আমাদের এতকালের চেনা ও জানা বুর্জোয়ার রূপ থেকে অনেক ভিন্ন হবে সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই। তখন না হয় তার একটা নূতন নাম দেওয়া যাবে। আপাতত যাত্রা শুরুর জন্য ঐ নামটাই থাকুক না! তাতে ক্ষতি কি?
আমার বিবেচনায় আজ আমাদের নিজস্ব তত্ত্বের একটি জীবন্ত ও গতিশীল সূচনার প্রয়োজন। এর সহজ মানেটা হল যারা এ দেশে ষাটের দশকে বাঙ্গালী জনগণের সেকিউলার ও গণতান্ত্রিক জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ন্যাপের বলয়ে থেকে বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের আজ পুনর্সংগঠিত হতে হবে। অনেকেই আর ফিরবেন না।
অনেকেই মৃত অথবা হারিয়ে গেছেন। অনেকেই আসতে চেয়েও আসতে পারবেন না। তবু অনেকে আছে যাঁরা ফিরতে চাইলেই ফিরতে পারবেন। কারণ তাঁদের ফেরার জায়গা আছে। এবং সেটা আর সকলের চেয়ে সবচেয়ে বেশী আছে। সেটা হল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যেটা তাঁরা সুদীর্ঘ কালের শ্রমে, সাহসে ও আত্মদানে গড়ে তুলেছিলেন। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক তারাই। আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, এমন কি পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) প্রত্যেকেরই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে, পাকিস্তানী দু:শাসন থেকে জনগণের মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোনভাবে অবদান রয়েছে। বিশেষত নেতৃত্বকারী ভূমিকায় ছিল সেদিন আওয়ামী লীগ। কিন্তু এর পরেও আমি বলব জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তিটা সেদিন ছিল ভাসানী এবং সেই সঙ্গে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম।
তাদের পক্ষে সেদিন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না। এমন কি চাইলেও না। বাম কমিউনিস্ট নেতৃত্বকে ঝেড়ে ফেলার পরেও না। কারণ তখনকার দিল্লী সরকার এবং তার আশ্রয়ে থাকা আওয়ামী লীগের ভূমিকা। ই্িন্দরা সরকার সেদিন ভাসানীকে কি অবস্থায় রেখেছিল? তাঁকে কি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হয়েছিল? অথবা তরুণ বিপ্লবী প্রজন্মকে? রংপুরের সেই বিধবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তানের দুর্ভাগ্যের কথা বলেছি। আমারই অবস্থাটা কি ছিল? হাঁ, আমার নিজের কথাটাই বলি। আমি তো দুই ফন্সন্টে লড়াইয়ের তত্ত্বের বিরোধী ছিলাম। তবু আমার মাথার উপর একদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট এবং অন্যদিকে দিল্লী সরকার এবং আওয়ামী লীগের ওয়ারেন্ট ঝুলছিল। কি ঝুঁকি নিয়ে যে তখন আমি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার চেষ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছিলাম সেটা আমি জানি। বিভিন্ন বিপদের কথা এখানে থাক। তবে একটা ঘটনা বললে আমার মত সাধারণ কর্মীরও বিপদের পরিমাণটা বোঝা যাবে। সেটা এখন বলি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের একজন অতি সাধারণ সমর্থক ছিল যার ডাক নামটা ছিল মানিক। তার বাড়ী ছিল ঠাকুরগাঁও-এ। যুদ্ধের সময় আরও অনেকের মত সেও পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় নেয়। শুধু তার মানিক নামের কারণে তাকে ভারত সরকারের পুলিশ গ্রেফতার করে। আমি জানি না সে বাঁচতে পারত কিনা যদি সাথে সাথে ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে বাঁচাবার জন্য হস্তক্ষেপ না করতেন। তারপরেও শুধু মানিক নাম হবার অপরাধে তাকে প্রায় ৭ মাস ভারত-রাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী থাকতে হয়। আমার নামের সঙ্গে তার নামের এই মিলের কারণে দুর্ভোগের জন্য পরবর্তী কালে আমার উপর তার যে ক্ষোভ আমি দেখেছিলাম জানি না আজও সেটা রয়েছে কিনা।
আমি অস্বীকার করব না পার্টি নেতৃত্বের ভুলের দায় আমার উপরে কিছু হলেও এসে পড়তে পারে। আর একটা ভুল নেতৃত্বের সঙ্গে থেকে আমিও সব ভুলের ঊর্ধ্বে উঠতে পারি নি, এমন কি অনেক কিছু বোঝার পরেও পারি নি। চাইলেও ওটা ঐ সময় সম্ভব ছিল না। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে তো আমার নিজের মনে করেছিলাম এবং তা দ্রুত আমাকে ভুলের বন্ধন থেকে মুক্ত করেছিল। এবং এই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তোলার কাজ করতে চেয়ে যদি আমি সেদিন আওয়ামী লীগের কাছে যেতাম তবে তা আমার কি পরিণতি ঘটাত? পশ্চিম বাংলায় তখন সিপি (এম)-এর ভয়ানক দু:সময় যাচ্ছিল। কিন্তু সেই রকম এক দু:সময়ের ভিতরেও যদি সিপি (এম) না দাঁড়াত তবে শুধু ন্যাপের পরিচয় থাকার কারণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে কত মানুষকে যে নির্যাতনের শিকার হতে হত অথবা এমন কি বেঘোরে প্রাণ দিতে হত সেটা কারও কৌতূহল হলে এখনও অনেকের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।
হাঁ, এটাই বাস্তব। এ দেশে বামপন্থীদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালনের কোনও রকম সুযোগ দেওয়া হয় নি। কেউই দেয় নি। শুধু পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব এর জন্য দায়ী নয়। আওয়ামী লীগ এবং দিল্লী সরকার কেউই দেয় নি। আর এটাই বাংলাদেশের এত দুর্ভাগ্যের সবচেয়ে বড় কারণ।
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ভাসানী ও ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ভূমিকার তাৎপর্য আরও স্পষ্ট করার জন্য আমি পুনরায় বলি তারা না থাকলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধটা হত না। হাঁ, হয়তো বাংলাদেশ নামে একটা রাষ্ট্র হত। কিন্তু ওটার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হত না। যেমন ইংরেজ ভারতবর্ষ ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানও অনেকটা সেইভাবে পূর্ব বাংলাকে ছেড়ে দিয়ে যেতে বাধ্য হত। তৎকালে পূর্ব বাংলায় যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন, বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে চেতনার বিস্তার হচ্ছিল এবং বিশেষত আওয়ামী লীগ ৬ দফা দেবার পর এই চেতনা যেভাবে সংহত হচ্ছিল তাতে এখানে পাকিস্তানের টিকে থাকার বাস্তবতাই আর ছিল না। ধরা যাক ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথান হল না। আসলে এই গণ-অভ্যুথান না হলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে কোনও বস্তু আমাদের দেখতে হত না। তবু ধরে নেওয়া যাক গণ-অভ্যুথান হল না। কিন্তু সে অবস্থায়ও ’৭০-এ না হোক পরবর্তী সময়ে হোক ইয়াহিয়া সরকারকে আর ইয়াহিয়া না এলে আইয়ুব সরকারকেই একটা নির্বাচন দিতে হত। হয়তো তার আগে সিরাজ শিকদার একটা অকাল গর্ভপাত ঘটিয়ে দিয়ে যেতেন। সেটাও হত আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের জন্য পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির শক্তি বাড়াবার চমৎকার হাতিয়ার। কারণ তার একটা প্রভাব জনমনে পড়তই। যুদ্ধের শক্তিটা ধ্বংস হলেও তার উত্তাপটা গণ-আন্দোলনে কম-বেশী ছড়াত। আজাদ হিন্দ্ ফৌজের পরাজয়ের পরে ব্রিটিশ ভারতের অবস্থাটার দিকে দৃষ্টি দিলেই সেটা বোঝা যায় আরও ভালভাবে।
অথবা ধরে নেওয়া যাক সিরাজ শিকদার এলেন না। তবু আন্দোলন একটা হতই। যেমন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ’৬৮-তে ছাত্র আন্দোলন হল। পূর্ব পাকিস্তানেও আন্দোলন একটা হত। সেটা যেমনই হোক। ফলে যে সরকারই থাক বা আসুক তাকে নির্বাচন দিতে হত। আর এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতত, কারণ সেই সময় প্রকাশ্য রাজনীতিতে ৬ দফার মত কর্মসূচী আর কারো ছিল না। জেতার পরই সঙ্কট দেখা দিত যেমন দেখা দিয়েছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা সংখ্যাগুরু বাঙ্গালীদেরকে আর যা-ই হোক পশ্চিম পাকিস্তানের উপর আধিপত্য করতে দিত না। অন্যদিকে সেখানেও পাঞ্জাবীদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সিন্ধী, বালুচ, পাঠানদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছিল। সুতরাং তারাও এই অবস্থায় হাত মেলাত আওয়ামী লীগের সঙ্গে। শুধু যে উচ্চাভিলাষী পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা ভুট্টো এই অবস্থা চাইতেন না তা-ই নয়, উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক শাসক শ্রেণীর নিকটও পূর্ব পাকিস্তান দায় হয়ে উঠত।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৩ সালে ২১ দফা কর্মসূচী দেবার পর থেকেই পাকিস্তানে রাজনৈতিক শাসনের ভিত্তিটা নষ্ট হয়েছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সোহরাওয়ার্দী-মুজিব অংশ অঙ্গীকার ভঙ্গ না করলে পূর্ব বঙ্গ আর বেশী কাল পরাধীন থাকত না। যাইহোক, সব মিলিয়ে ১৯৭০-এর দিকে পাকিস্তানে সামরিক শাসন অব্যাহত রাখার বাস্তব অবস্থাটা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়ত এবং পড়ছিলও। এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ঐক্যবদ্ধ কিংবা এককেন্দ্রিক পাকিস্তানের আর কোনও ভিত্তি রাখে নি।
এই রকম অবস্থায় যেটা ঘটত সেটা হল এই যে, এখানে সেখানে কিছু সংঘাত, রক্তপাত হলেও পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তরের মাধ্যমে ধীর গতিতে শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যেত। আওয়ামী লীগ হয়তো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বাইরে যেত না। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রাম করার জন্য ব্রিটিশ শাসনকালের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মতই পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) তৈরী ছিল না? কেউ না থাকলে ওরাই শ্রেণী সংগ্রামের নামে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করত যেটাকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আওয়ামী লীগ চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে পারত।
যাইহোক, অবস্থাটা এমন হত যে, এবং সেটা দুই অঞ্চলের চাপেই হত, একটা সময়ে পাকিস্তানের কর্তৃত্বকারী শক্তি সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো এবং পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের নিকট ক্ষমতা বাটোয়ারার একটা ব্যবস্থা করত। হয়তো প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হত না। একটা ফেডারেশন জাতীয় কিছু হত। যাইহোক, ইংরেজ যেমন অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে একভাগ নেহরু অপরভাগ জিন্নাহর হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের শাসনের ব্যবস্থাটা অক্ষুণ্ণ রেখে যেতে পেরেছিল এখানে তেমন কিছু একটা হত। আর ভারত-রাষ্ট্র নিশ্চয় তার শত্রু পাকিস্তানকে এভাবে দ্বিখণ্ডিত করার কাজে মুজিবের সহায়ক হত। কারণ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে সেটাই ছিল তার জন্য বাঞ্ছিত। হয়তো যুদ্ধ একটা হত। তবে সেটা বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ নয়, বরং পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ। সেক্ষেত্রে ১৯৭১-এর মত বাঙ্গালীর জাতীয় যুদ্ধ থেকে পাক-ভারতের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ ঘটত না। বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বর্জিত এই রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক শক্তির বিপর্যয় অথবা শক্তিক্ষয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন কিংবা বিচ্ছিন্নতার জন্য বিপুলভাবে সহায়ক হত। মনে রাখতে হবে ৬ দফা ছিল এক অর্থে পাক-ভারত যুদ্ধের একটা ফলও। অথবা ঐ সময়ে ঐ ভাবে তার উপস্থাপনা সম্ভব হয়েছিল ১৯৬৫-তে পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে। তেমন আর একটা পাক-ভারত যুদ্ধ হয়তো স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতা যে কোনও একটা দিকে পূর্ব বাংলাকে প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে নিয়ে যেত।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভারত শাসনের সবচেয়ে বড় এক হাতিয়ার ছিল সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের ভাগে রেখে যাওয়া সেই সেনাবাহিনীর অংশটুকু এবার ভাগ-বাটোয়ারার কাজটা সম্পন্ন করত। এবং শেষ পর্যন্ত ধীরে ধীরে হোক আর তাড়াতাড়ি হোক আপোসে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যেত। তার নাম বাংলাদেশ হোক আর যা-ই হোক।
শেখ মুজিবও হয়ত এমন একটা ব্যবস্থাই চেয়েছিলেন, আর তাই যুদ্ধ না করে পাকিস্তানের হাতে ধরা দিলেন। হয়তো ভেবেছিলেন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিটা খতম হলে ঐ রকমই একটা বাটোয়ারার ব্যবস্থা করে নিবেন। কিন্তু বাঙ্গালী জাতির সৌভাগ্য যে তেমনটা হয় নি। বরং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধই ধ্বংস করল এখানে পাকিস্তানকে এবং সেই সঙ্গে অন্তত নয় মাসের জন্য ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের গড়া এবং পাকিস্তানীদের রাখা গোটা সামাজিক-রাষ্ট্রিক কাঠামো এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানের ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শিক কাঠামো তছনছ হল। আর এইভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠল শুধু বাংলার নয় সমগ্র উপমহাদেশের প্রথম বিশাল গণ-বিপ্লব, জাতীয় বিপ্লব।
যাইহোক, আমার একটা স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, ষাটের দশকের এক স্বাধীন প্রজন্মের অভ্যুদয়ের তাৎপর্য না বুঝলে এ দেশের রাজনীতির গতি- প্রকৃতি, সঙ্কট এ সব কিছুই বোঝা যাবে না। আসলে ইউরোপের শ্রমিক আর চীনের কৃষক দিয়ে এ দেশের সামাজিক শক্তিগুলোর ভূমিকা বুঝতে চাওয়ায় যত গণ্ডগোল। এমন কি ষাটের দশকের মত স্বাধীন প্রজন্মের উথানের পুনরাবৃত্তিও আর আমাদের দেশে দ্বিতীয় বার ঘটে নি। ওটা ছিল এক স্বাধীন প্রজন্ম। স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা। সুতরাং যখন তা নিজেকে মাওবাদী বলেছে তখনও তা অন্ধ চীনপন্থী নয়, বরং বিভিন্ন প্রশ্নে চীনের সমালোচক থেকেছে। আসলে মাওবাদও ছিল তার কাছে একটা হাতিয়ার মাত্র, যাকে সৃজনশীলভাবেই এ দেশে ব্যবহার করে একটা নিজস্ব ও স্বাধীন বিপ্লবী তত্ত্ব গড়ে তুলতে চাওয়া হয়েছিল।
ঐ স্বাধীন বিপ্লবী প্রজন্মকে যদি বর্শা হিসাবে কল্পনা করা যায় তবে বলতে হবে যে তার অগ্রফলকের মূল অংশটি একটা রূপ নিয়েছিল পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনে। তার দলিলগুলো আজ নেই। তবে সেগুলোর কিছু স্মরণ করলে দেখা যাবে যে, এই সংগঠনের বক্তব্য ও কর্মসূচীতে গণতান্ত্রিক জাতীয় বুর্জোয়া বিপ্লবের চেতনা ও মর্মবস্তু ছিল প্রবল।
আসলে সেকালে আমাদের প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন ছিল স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্র করে প্রথমে একটি প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচীর। সেটির জন্য প্রয়োজন ছিল একটি জাতীয় রাজনৈতিক পার্টি ও নেতৃত্বের। সেটা গঠনের ক্ষমতা তখন আমাদের ছিল না। এই অবস্থায় সিরাজ শিকদারকে মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রথমেই গোপন কমিউনিস্ট সংগঠন নির্মাণের এক নিদারুণ বিপদের দিকও ছিল। কমিউনিস্ট হতে গিয়ে আমরাও জাতীয় প্রশ্ন বিবর্জিত শ্রেণী সংগ্রামের পথে চলে যেতে পারতাম। কিংবা প্রকাশ্যে না পেরে গোপন পথে জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে চেয়ে সিরাজ শিকদারের পরিণতিতে ভিন্ন পথ ধরে পৌঁছতে পারতাম।
একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলে বোঝা যাবে ঐ প্রজন্মের কয়েকজন প্রতিনিধির চেতনা তখন কেমন ছিল। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে, যারা এর সংগঠক তারা কেউই এর পূর্ণ সদস্য নয়। অর্থাৎ কমিউনিস্ট হিসাবে কাউকে সদস্যপদ দেওয়া হয় নি। প্রস্তাবটা আমার ছিল। হয়তো আমার অনুভবটা সবার ছিল না। কিন্তু প্রস্তাবটা সবাই গ্রহণ করেছিল আনুষ্ঠানিকভাবেই। সিদ্ধান্তটা হাস্যকর মনে হতে পারে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ভিতর নিহিত ছিল এক বিপুল তাৎপর্য। যেন একদল বিপ্লবী বুর্জোয়া গণতন্ত্রী কমিউনিস্ট না হয়েই গঠন করেছিল একটা কমিউনিস্ট সংগঠন তাদের অধীনস্থ সংগঠন হিসাবে যেটার সদস্য তারা নয়। এখানে এটা উল্লেখ করা যায় যে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সদস্যদের সংগঠনের সদস্যপদ দান করা হয়। অর্থাৎ আমরা তখন নিজেদেরকে কমিউনিস্ট হিসাবে ঘোষণা করি। আসলে ঐ কালে ওটা ছিল একটা প্রজন্মের শক্তির স্বাধীন বিপ্লবী শক্তি হিসাবে উঠে দাঁড়াবার এবং নূতন পথ খুঁজে পাবার প্রয়াস। এ দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাটা সম্ভবত ঐ প্রয়াসের ভিতরেই নিহিত ছিল।
হাঁ, জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে আমাদের ধারার তরুণ প্রজন্মের উঠে দাঁড়াবার এটাই ছিল ঐ কালে শেষ প্রয়াস। যখন বোঝা গেল আমাদের একার পক্ষে জাতীয় রাজনীতিতে এখন দাঁড়ানো সম্ভব নয় তখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে অবলম্বন করে আমরা ন্যাপে ঢুকলাম। না, নেতৃত্বের শক্তি হলাম না। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের চেতনার শক্তি তখন ন্যাপকে ভিতর থেকে দখল করল। ভাসানীর নেতৃত্বে এই শক্তি ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের জোয়ারটাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিল। আর এইভাবে এই চেতনার শক্তিটা সারা জাতির চেতনার শক্তিতে পরিণত হল।
বস্তুত ঐ দশকের প্রজন্মের শক্তি ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র লীগ কোনটাতে কত ছিল সেটাও বড় কথা নয়। বড় কথা এক প্রজন্মের উত্থান। মুজিব সেটা বুঝেছিলেন। তিনি তাঁর মত করে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন এই প্রজন্মের শক্তিকে। বামপন্থী নেতারা তাঁদের নিজেদের মত করে। কিন্তু নূতন এই প্রজন্মের ভিতরেই ছিল স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রাখা এক স্বাধীন চেতনার শক্তি, যার গোপন ভ্রূণটি রূপ নিয়েছিল পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনে। হাঁ, আর একটি ছিল সেটি হল সিরাজ শিকদারের প্রথমে পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন ও পরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। তাদেরটা ছিল গণ-বিচ্ছিন্ন, সন্ত্রাসবাদী। সুতরাং ওটা জনগণের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তি হতে পারত না। কিন্তু আমাদের পথ ছিল গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুথান এবং সশস্ত্র সংগ্রাম বা গণ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করে বাঙ্গালীর একটি সেকিউলার, গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার।
অতীতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আজ আমার মনে হয় যদি আওয়ামী লীগের সমান্তরালে ন্যাপেরও একটা জাতীয় কর্মসূচী থাকত তবে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের ভিতর থেকেই সম্ভবত আমরা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিটাকে সরাসরি বের করে নিতে পারতাম। অর্থাৎ ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনকে মোকাবিলা করতে পারতাম একটা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটিয়ে। আর এর ফলে শেখ মুজিব যেভাবে ’৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় নেতা হয়ে ওঠেন সেটা আর হত না। ফলে দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রধান দু’টো ধারা থাকত। একটা বামদের নেতৃত্বে কিংবা ন্যাপের ছত্রছায়ায় সংগঠিত সশস্ত্র এবং অপরটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিয়মতান্ত্রিক।
’৭০-এ নির্বাচন বর্জন করে বামপন্থীরা ভুল করেছিল এটা আমি কোনও দিন মনে করি নি এবং আজও মনে করি না। তাদের ভুলটা ছিল পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে প্রকাশ্য বাস্তবসম্মত, উন্নত এবং বলিষ্ঠ কর্মসূচী না দেওয়া। ১৯৮৬-তে এরশাদের সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন আওয়ামী লীগ কর্তৃক গ্রহণ এবং বিএনপি কর্তৃক বর্জনের ফলে কার কি লাভ-ক্ষতি হয়েছিল তার একটা প্রমাণ তো ১৯৯১-এর নির্বাচনে পাওয়া গিয়েছিল।
যাইহোক, নিয়মতান্ত্রিক ধারার প্রতিনিধি হলেও ঐ কালেও সম্ভবত আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যেতে বাধ্য হত যেভাবে ’৭১-এ বাধ্য হয়েছিল এবং ভারত-রাষ্ট্রের সাহায্যে যুদ্ধের প্রধান নেতৃত্বকারী শক্তি হিসাবেই দাঁড়াত। কিন্তু একচ্ছত্র হত না যেমনটা হল। ফলে এ দেশের পরবর্তী গতিধারা সবটা না হলেও অনেকটা ভিন্ন হতে পারত। মোট কথা, সে কালে একটা প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচীর অভাব আমাদের প্রজন্মকে অনেক ভুল ও জটিলতার আবর্তে নিক্ষেপ করেছিল। এইভাবে নেতৃত্বের ভুলের অনেক দায় আমাদেরকে টানতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও আমাদের প্রজন্ম যে সে কালে এ দেশের ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্যতম নির্ধারক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়েছিল তেমনটাই আমার ধারণা। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংগঠিত শক্তিটি ছিল এ ক্ষেত্রে সম্ভবত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভ্রূণটি নেতৃত্বকারী শক্তি হিসাবে বেড়ে ওঠার অবকাশ পায় নি। অর্থাৎ ঐ প্রজন্মের শক্তিও। সবচেয়ে বড় কথা তার জন্য প্রয়োজনীয় তত্ত্ব বা ধারণা তখনও ছিল না। অন্তত আমার নিজের কথা বলতে পারি। এ বিষয়ে আজ বেশী কিছু আলোচনা করব না। তবে একটা কথা বলি। সেটা হল মার্কসবাদের কিছু দিকের সীমাবদ্ধতা ছাত্র জীবন থেকেই আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ সে কালে ছিল না। আমার সে কালের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু আমজাদ হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় একদিন বলেছিলাম যে, কমিউনিজম আমাদের আজকের দ্বন্দ্ব, সঙ্কট ও দু:খ থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে যাবার জন্য একটা দিক চিহ্ন মাত্র, তার বেশী কিছু নয় এবং কমিউনিজম কোন দিন আসবে না। কারণ সমাজে দ্বন্দ্বের রূপ বদলাবে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব চিরকাল থাকবে। ফলে দ্বন্দ্বমুক্ত কমিউনিস্ট সমাজ একটা কল্পনা মাত্র। তবু এর প্রয়োজন আছে আজকের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য। আমার কথাটা ছিল প্রাচীন কালের জাহাজের নাবিক যেমন অকূল সাগরে রাতের আঁধারে দিক ঠিক করার জন্য ধ্রুব তারার সাহায্য নিত, কমিউনিজমও ঠিক তেমন ধ্রুব তারার মত, যা আমাদের নিজেদের পথটা চিনতে সাহায্য করে মাত্র। আমজাদকে কবিতার মত করে বলা আমার সেদিনের শেষ কথাটা চিরকাল আমার মনের গভীরে গানের সুরের মত বেজেছে, হয়তো বা সেটা বিষাদের সুর, ‘ধ্রুবকে যেমন পাওয়া যায় না, কমিউনিজমকেও তেমন পাওয়া যাবে না।’
আমজাদ সাধারণত মন্তব্য করত না এসব আলোচনায়। হয়তো তখন সে কমিউনিস্ট হিসাবে আমার উপর আস্থা হারিয়েছিল। আসলে এসব কথা সে কালে বলার বা আলোচনার অর্থ ছিল নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা অথবা কর্মীদের হতাশ করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডকে বিনষ্ট করা। ভাবতাম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসবে আমাদের পথ, আমাদের বিপ্লবের নিজস্ব তত্ত্বও।
হয়তো সকলে আমরা মত করে চিন্তা করত না। তবু বলব ঐ প্রজন্মের বিপ্লবী শক্তির ব্যাপকতর অংশ অনেক কাল পর্যন্ত মতান্ধ ছিল না। আমাদের সঙ্কটটা প্রকৃতপক্ষে ঘটে ১৯৬৯-এ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবার পরে। কিন্তু ঐ কালে আমাদের পক্ষে নেতৃত্বকারী বা স্বাধীন সংগঠক হিসাবে ভূমিকা নেবার অবস্থাই ছিল না। ৬ দফার চাপ, সিরাজ শিকদারের চাপ, দেশের দ্রুত অগ্রগমন এইসব ঘটনা আমাদেরকে পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের একাংশের সাহায্য নিয়ে নূতন চেতনার শক্তিটাকে রক্ষা ও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় এবং সেই কাজটা আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের সাহায্য নিয়ে ন্যাপের ভিতরে থেকে করতে চেষ্টা করি। কাজেই দেখা যাচ্ছে লড়াইটা শুধু দু’টো আদর্শের মধ্যে নয়, উপরন্তু দু’টো প্রজন্মের মধ্যেও। প্রাচীন ও নবীনের এই লড়াইয়ে প্রাচীন প্রজন্মের প্রধান শক্তিটা দিল্লীর সহায়তা পেয়েছিল বলে এভাবে নবীন যে প্রজন্মটা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি গড়ে তুলেছিল তাকে অস্বীকার ও নাকচ করতে পেরেছে।
প্রাচীন প্রজন্মের অপর একটা শক্তি ছিল বামপন্থী নেতৃত্ব। তারা বিপ্লবী আন্দোলনের ভিতরে থেকে নবীন প্রজন্মের উত্থান রোধ করতে চেষ্টা করেছে। না, ভাসানী এদের মধ্যে পড়েন না। তিনিও প্রাচীন প্রজন্মের মানুষ। কিন্তু নিয়মতন্ত্রী অথবা কমিউনিস্ট তিনি নন। সুবিধাবাদ অথবা ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষার অনেক ঊর্ধ্বের এক মানুষ। তিনি তাঁর কালের সমাজ ও জাতিরও আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার ঊর্ধ্বের এক মানুষ। হয়তো অনেক প্রজন্মানুক্রমে সঞ্চিত এক প্রাচীন মানবিক, উন্নত ও মর্যাদাবান কৃষক চেতনার তিনিই ছিলেন শেষ প্রতিনিধি, শেষ স্ফুরণ। এ দেশের ব্যতিক্রমী এক কৃষক বিপ্লবী। তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন মুক্তিকামী কৃষক সমাজের, যারা পথ চেয়ে ছিল তরুণ প্রজন্মের আগমনের অপেক্ষায়।
এটা বুঝি তখন যা ঘটেছিল সেটা কতকগুলো ঘটনার যোগফল হিসাবে অনিবার্য ছিল। কিন্তু এই বিষয়টা দু:খজনক যে, শুধু ৬ দফার কারণে এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনে জেতার কারণে বামপন্থীদের সকল অংশের সকল অবদান আওয়ামী লীগ এবং তার অনুসারীরা অস্বীকার করে, এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের একক দাবীদার হতে চায়। আমি মনে করি পরবর্তী আলোচনায় যাবার পূর্বে আরও কয়েকটি বিষয়ে আমার মত এখানে স্পষ্ট করে বলা দরকার। আওয়ামী লীগের দাবী ’৭০-এর নির্বাচনে জয় লাভের ফলে জাতিকে নেতৃত্ব দেবার একমাত্র দাবীদার তারাই। এ কথা অবশ্য পূর্বেও বলেছি যে, ’৭০-এ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেছিল স্বাধীনতার দাবী নিয়ে নয়। বরং ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছিল। ওটা স্বায়ত্তশাসনের একটা কর্মসূচী, সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যার তাৎপর্য ঐ কালে বিপুল ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বাধীনতার কর্মসূচী যেমন ছিল না তেমন সশস্ত্র সংগ্রামেরও কোনও কর্মসূচী বা প্রস্তুতি ছিল না।
সেক্ষেত্রে মুজিব যদি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিক হতেন তবে নির্বাচনে জয়লাভের পর কি করতেন? যেহেতু তার পূর্বেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচী ঘোষণা করেছে সেহেতু তাদেরকে ডাক দিতেন ঐক্যের জন্য। হাঁ, এটা বুঝি যে, জাতীয় আন্দোলনের বিকাশের একটা পর্যায়ে, তুঙ্গ মুহূর্তে জাতীয় কর্মসূচীর আবরণটা বিদারিত হবার সময়টিতেই মাত্র এই ধরনের কর্মসূচী প্রকাশ্যে ঘোষণা করাটা যুক্তিযুক্ত। বামদের প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ৬ দফা ছিল। যখন স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরুর মুহূর্ত এসে গেল তখন কি ছাত্রদের ঐ কর্মসূচীই তাঁর পরবর্তী পর্যায়ের মূল কর্মসূচী হয় না? অবশ্য যদি তিনি আন্তরিক হন। আর সেক্ষেত্রে যারা ওটা গড়ে তুলেছে, হাঁ, কর্মসূচী শুধু কাগজে লেখার ব্যাপার নয়, তখন তারাই কি তাঁর প্রধান অবলম্বন, মূল শক্তি হয়ে ওঠে না? মাটির তলার কমিউনিস্টদের না হয় তিনি ডাকলেন না, কিন্তু সব ভেদাভেদ ভুলে তাদের কেন ডাকলেন না?
আবার বলি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার জন্য নির্বাচনে জেতাটা কোন ঘটনাই নয়। ১৯৬২-তে যে ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল সেটা কোন নির্বাচনের রায় অনুযায়ী হয়েছিল? কিংবা তারও আগের ভাষা আন্দোলন? ’৬৯-এ ভাসানী যে গণ-অভ্যুথানটা ঘটালেন এবং তাতে নেতৃত্ব দিলেন সেটাই বা কোন্ ভোটের রায় অনুযায়ী? না, মুক্তিযুদ্ধের জন্য কোনও নির্বাচনে জেতা পার্টির প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশে দু’দু’টো তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের অভিজ্ঞতার কথা না হয় বাদই দিলাম।
বরং এ দেশের বাস্তবতায় কোনও নির্বাচনের পার্টির পক্ষেই যুদ্ধ গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। একমাত্র তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতার চেতনা এমন একটা যুদ্ধকে অনিবার্য করতে পারত। আর ঐ চেতনা ধারণকারী শক্তির প্রতিনিধি স্বরূপ সেদিন যে ছাত্র সংগঠন এ দেশে প্রকাশ্যে বাঙ্গালী জনগণের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্মসূচী প্রথম ঘোষণা করল তা-ই কি এ দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধেরও প্রথম ঘোষক হয় না? তাহলে স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা কাদের? না, আমি মুজিবের ভূমিকা অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটাও ৬ দফা পর্যন্ত। তার বেশী নয়। তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে কি বলেছিলেন? বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ খুব ভাল কথা। ঐ কথা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু তাঁর স্বাধীনতা কার জন্য, কার বিরুদ্ধে সেটা কি স্পষ্ট করে বলেছিলেন? আর শুধু কি বলাটাই যথেষ্ট হত? তখন তাঁর কি করা উচিত ছিল? ধরে নিলাম আওয়ামী লীগ যেহেতু ১৯৭০-এর নির্বাচনে জনগণের ভোটের রায় পেয়েছে সেহেতু এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবারও অধিকার তাঁর। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকার যখন সংসদ অধিবেশন ডাকতে অস্বীকার করল তখন মুজিব নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে পাল্টা সরকার গঠন করলেন না কেন?
ঠিক আছে, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে আর কারো ভূমিকা তিনি মানতে রাজী নন। ভাল কথা। সুতরাং তিনি স্বাধীনতার পক্ষের সকলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবেন না। যদিও সেটাই নিয়ম। কিন্তু তিনি কি পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার জন্য একটি সরকার গঠন করতে পারতেন না? ঠিক আছে, প্রথমেই যুদ্ধ ঘোষণা করার দরকার নেই। পাকিস্তান সরকার আক্রমণ অভিযান শুরু করা মাত্র স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতেন। তা না। হঠাৎ দেখা গেল ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের সময় তিনি বাড়ী বসে থেকে শত্রু সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিলেন। এবং ছত্রখান হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ভারতে আশ্রয় নিল।
হাঁ, সেখানে গিয়ে তাঁরা আর সরকার গঠন করতে দেরী করেন নি। কিন্তু যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হল তখন এ দেশে প্রকৃতপক্ষে কাদের কর্মসূচীটা জাতির মুক্তিযুদ্ধের কর্মসূচী হয়ে ওঠে? পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দেওয়া যাক। যদিও ওটার খুব বড় অংশ এমন কি নেতৃত্বের একটা অংশ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কখনই হয় নি। তবু ঐ পার্টিকে বাদ দিতে বলছি। আগেই বলেছি ওটা মাটির নীচে থাকে। চোখে দেখা যায় না। কিন্তু ঐ যে পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচী সেদিন ঘোষণা করল যে ছাত্র-যুবক-তরুণেরা তাদেরও কি চোখে পড়ল না? অথচ তারা কি নূতন যুদ্ধের নেতা হয়ে ওঠে না? কিন্তু তাদের কি তখন খোঁজ নেওয়া হয়েছে? নাকি কোণঠাসা করে রাখবার কিংবা এমন কি হত্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে? এটা কি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলবাজী নয়? জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কি শুধু একটা দলের? এইভাবে দলীয়করণ করায় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে বিভক্ত করার দায়টা কাদের উপর সবচেয়ে বেশী এসে পড়ে? ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের তাঁরা যখন প্রধান নেতা তখন এই বিভক্তির দায়টা কি তাঁদের উপরই বর্তায় না? আসলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে তাঁরা ১৯৭১-এ প্রথম বিভক্ত করেন নি। ২১ দফার চেতনাকে যাঁরা দলিত করে ১৯৫৭-তে আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করেছিলেন সেদিনই কি তাঁরা জাতিকে, জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রথম বিভক্ত করেন নি? হাঁ, জাতির মুক্তিযুদ্ধকে বিভক্ত করাটাই তাঁদের ইতিহাস।
অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া নেতা যদি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতা হবার দাবীদার হন তবে হাসি পাবারই কথা। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একদিনে গড়ে ওঠে না। ওটা দীর্ঘ সাধনার ফসল। এর জন্য জাতিকে দীর্ঘ সময় ধরে আদর্শিক, মানসিক ও সাংগঠনিকভাবে তৈরী করতে হয়। আওয়ামী লীগের সেই সাধনা বা প্রস্তুতি থাকে নি বলে তার নেতৃত্ব মেনে কেউই সেদিন পাকিস্তানী আক্রমণের মুখে দাঁড়াতে পারে নি বেশী সময়। এই কারণে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশের বাঙ্গালী সদস্যরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হঠাৎ আক্রমণের প্রথম ধাক্কাতেই পরাস্ত হয়ে দলে দলে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু প্রায় খালি হাতে, কিছু পাখি মারা বন্দুক হাতে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে বামপন্থী তরুণ বিপ্লবীরা সেদিন দেশের ভিতর বাহিনী গড়ার কাজটাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়েছে। হাঁ, নেতৃত্বকে কোনও পরোয়া না করেই। এবং আর কিছুকাল মুক্তিযুদ্ধ চললে এ দেশের বাম রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নূতন বিপ্লবী ধারা সূচিত হত তখন। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ তছনছ করে দিচ্ছিল মার্কসবাদের মতান্ধতার কাঠামো। আমি অন্তত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কথা বলতে পারি। হয় পার্টি তার পুরাতন পথ বদলাত নয় আমরা যুদ্ধের ভিতরই নূতন এক জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পার্টি গঠন করতাম। কারণ তখন সেটাই ছিল সময়ের দাবী। এবং সেই সময় পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়ে বামপন্থীরা স্বাধীনভাবে জাতীয় যুদ্ধ গড়ে তুলছিল। কিন্তু ভারত-রাষ্ট্রের প্রবল চাপের কারণে সেই সময় এবং সুযোগ কোনটাই আর মেলে নি।
না, আমি দিল্লীর অবদানও অস্বীকার করি না। এবং যুদ্ধে সেই সময় আওয়ামী লীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছিল তার গুরুত্বকেও অস্বীকার করি না। কিন্তু আমি এ কথাটা বলতে চাই এত যে মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ করে অনেকে চীৎকার করেন সেটা কি তার তাৎপর্য বুঝে করেন, নাকি না বুঝে করেন? তাহলে তাঁরা সেদিন বাম আন্দোলনের সকলের ভূমিকাটা অস্বীকার করেন কেন? বিশেষত বাম আন্দোলনের ভিতরকার যে বিশাল অংশটা সে কালে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটা গড়ে তুলেছিল তাদের ভূমিকাটা মেনে নিতে তাঁদের এত অনীহার কারণ কি?
ঘটনাটা কি এই রকম না? আওয়ামী লীগ লাগিয়েছিল কাঁঠাল গাছ। ৬ দফা ধরুন তেমন কিছু। তা গাছে তো কাঁঠালই ফলবে! আম হবে কি করে? জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ভিন্ন বস্তু। ওটা ৬ দফা নয়। ওটা গুণগতভাবেই আলাদা। ওটা অহিংস আন্দোলন থেকেও হয় না। ওটা আসে দীর্ঘ সহিংস আন্দোলনের প্রস্তুতি থেকে, যার ভিতরে থাকে স্বাধীনতার লক্ষ্য ও তার সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী। সুতরাং ধরা যাক এটা আম গাছ। এটা থেকে আমই ফলে। কাঁঠাল নয়। এখন কাঁঠাল এবং আম দু’টোরই দাবীদার হয়ে যদি একজন বলে কাঁঠালটা যে গাছ থেকে আমটাও সে গাছ থেকে তবেই আপত্তি!
আচ্ছা, এই উপমা দিয়ে হয়তো সবটা পরিষ্কার হবে না। সুতরাং কাক-কোকিলের একটা উপমা দিই। যদিও এ সবই উপমা মাত্র এ দিয়ে প্রকৃত বস্তু বা তার সত্য ঠিকভাবে যে বোঝা যায় তা নয়। তবু আমাদের ধারণাকে সত্যের কাছাকাছি নিতে পারে।
এবার উপমাটা দিই। ১৯৬২-তে একটা স্বাধীন প্রজন্ম জন্ম নিয়েছিল, যা আইয়ুব বিরোধী ও পাকিস্তান বিরোধী হয়ে স্বাধীনতার জন্য বিকশিত হচ্ছিল। এই প্রজন্ম বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র চাইছিল। এটা হল ভবিষ্যৎ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভ্রূণ কিংবা এটাকে ডিম বলা যাক। কিন্তু এই ডিমের জন্য দরকার ছিল একটা জাতীয় আন্দোলনের উত্তাপ, যার নীচে থেকে বা ভিতরে থেকে এটা পুষ্ট ও বিকশিত হবে। বাইরে বা প্রকাশ্যে তো আর স্বাধীনতার কর্মসূচী দিয়ে জাতীয় আন্দোলন গড়া সম্ভব ছিল না। কাজেই স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে একটা পূর্ণাঙ্গ জাতীয় কর্মসূচীর প্রয়োজন ছিল, যা ঐ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ও চেতনা বা কর্মসূচী যা-ই বলা যাক সেটাকে বিকশিত করবে। এখন ন্যাপ সেই কর্মসূচী দিল না। তা, যেমনই হোক আওয়ামী লীগের ৬ দফা নামে একটা কর্মসূচী ছিল যেটাতে জাতির তখনকার কেন্দ্রীয় দাবী স্বায়ত্তশাসন ছিল।
এখন স্বাধীনতার গোপন আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের প্রকাশ্য আন্দোলন আপাত দৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী অবস্থান থেকে হলেও পাশাপাশি বেড়ে উঠল। এখন স্বাধীনতা আন্দোলনের শক্তি তথা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তি তো প্রথমেই বড় হবে না। ওটা প্রথমে খুব ক্ষুদ্রই হবে। তরুণ প্রজন্ম এই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে শক্তিটাকে সংহত করল সেটাকে ডিমের সঙ্গেই তুলনা করা যাক। সুতরাং ধরা যাক তরুণ প্রজন্ম জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডিমটা পাড়ল। ওটাতে তা দেবার শক্তি ছিল না তার নিজস্ব বলয়ে। কারণ সেখানে মার্কসবাদ-কমিউনিজমের বাধা। বাম কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ওটাতে তা দিবে না, কাউকে দিতেও দিবে না। কোকিল যেমন ডিম পাড়তে পারে, কিন্তু সেটাকে ফোটাবার দায়িত্ব নেয় না অবস্থাটা সেই রকম দাঁড়াল আর কি। তা, বুড়ো ভাসানী ওটাকে ’৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে ৬ দফার নীচে তা দেবার জন্য রেখে দিয়ে এলেন। এইবার ৬ দফার তাপে ডিমটার ভিতরে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শিশুটা বেড়ে উঠল। যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল বাচ্চাটা ডিম ফুটে বেরোল। এখন বাচ্চাটা কার? বাচ্চাটা বড় হলে কার কাছে যাবে? তা বড় হবার আগেই ইন্দিরা, মুজিব আর বাম নেতারা সকলে মিলে যা করলেন!
এটা উপমা মাত্র। তবে মুজিব ছিলেন বুদ্ধিমান। তিনি বিপ্লবের, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ধাত্রী হতে যাবেন কোন দু:খে? তিনি বুঝেছিলেন যে বাচ্চাটা তাঁর হবে না। তিনি যে ৬ দফা, তারপর অহিংস-অসহযোগ ইত্যাদি গান্ধীমার্কা রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন সে সবের সঙ্গে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর লক্ষ্যটা স্পষ্ট। পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হওয়া। অন্তত চেষ্টা করা। এবং সম্ভবত জানতেন যে, ইতিহাসের গতি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার দিকে। সেটা তিনি নিয়মতন্ত্রের পথ ধরে ধীর গতিতে করতেন। কিন্তু মাঝখান থেকে বুড়ো ভাসানী তাঁর সঙ্গে দেশময় এক দঙ্গল চ্যাংড়া জুটিয়ে এমন কীর্তি করে বেড়ালেন যে, তখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে শুধু জয় বাংলা স্লোগান দিয়েও আর রক্ষা নেই। বাঙ্গালীর এক সেকিউলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা সারা জাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ এই রাষ্ট্র ভোটের মাধ্যমে করা যায় না। আর যে পথে করা যায় সেই সশস্ত্র সংগ্রামের চেতনাটাও ততদিনে সমস্ত জাতির চেতনায় পরিণত হতে চলেছে। নিয়মতন্ত্রের পথে ভোটের মাধ্যমে মন্ত্রী হওয়া, দেন-দরবার করা, দর কষাকষি করা, কিছু সুযোগ নেওয়া, কিছু সুযোগ দেওয়া এইভাবে ধীর গতিতে রয়ে সয়ে প্রচলিত সামাজিক-রাষ্ট্রিক কাঠামোটাকে ঠিকঠাক রেখে পূর্ব পাকিস্তানকে প্রয়োজন ও সময় বুঝে আলাদা করে নেওয়া এসব কথা বোঝার ও মানার ধৈর্য সেকিউলার ও স্বাধীন বাঙ্গালী জাতি হয়ে উঠতে চাওয়া জনগণের তখন কোথায়? জনগণ তখন চাইতে শুরু করেছে আমূল পরিবর্তন, দ্রুত পরিবর্তন।
সে এক জটিল অবস্থা! গোঁড়া মার্কসবাদীরা তখন মার্কসবাদের খোলার ভিতরে ঢুকে সব বাদ দিয়ে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণী চরিত্র অর্জনের কঠোর সাধনায় নিয়োজিত। কারণ লক্ষ্য তো সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পথ ধরে কমিউনিজমের স্বর্গ লাভ! কমিউনিজমই যদি না হল তাহলে বিপ্লবটা আবার কি বস্তু! ওটা তো তাদের কাছে বিপ্লব নয়! ওটা তখন তাদের কাছে উগ্র জাতীয়তাবাদ! সুতরাং তখন তাদের কাজ একটাই তা হল মার্কসবাদের জাল ফেলে বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী ও জাতীয়তাবাদী কর্মীদের মাছের মত ধরে ধরে খালোইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা। যারাই ভাবত মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিপ্লবের একমাত্র পথ এবং সেখানেই সব সত্য ঠাসা আছে আর কমিউনিজম মুক্তির একমাত্র পথ তারা সবাই ঐ খালোইয়ের ভিতর ঢুকে মোক্ষ লাভ করত! ভাগ্যিস, ভাসানী মার্কসবাদীও হন নি আবার নিয়মতন্ত্রও পুরোপুরি বোঝেন নি! আর ভাগ্যিস, ছাত্র-তরুণরাও মার্কসবাদের বিশেষ কিছু বুঝত না! বোঝার মত জ্ঞান-গম্যিই তখন ছিল না তাদের ঐ বয়সে। সমাজতন্ত্র, বিপ্লব এসব তাদের কাছে একটা আকাঙ্ক্ষার নাম মাত্র, যে আকাঙ্ক্ষাটা ছিল সমগ্র জাতির মুক্তির চেতনা সম্ভূত। আর তাই ভাসানী হতে পেরেছিলেন তাদের নেতা। কিন্তু ভাসানী আর বেশী কিছু কি করবেন? বামপন্থী নেতাদের ঐ রকম এক কঠোর সাধনায় তাঁরও হাত-পা বাঁধা। সুতরাং মুজিব ছাড়া জাতির সামনে আর কে তখন? তিনি যতই সামলাতে চান, কে শোনে তাঁর কথা! তাঁর অবস্থা তখন ১৮৫৭-এর ইংরেজ শাসন-বিরোধী মহা বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সিপাহীদের হাতে বন্দী বেচারা বাহাদুর শাহর মত। অক্ষম, অথর্ব, ক্ষমতাহীন, বাদশাহ পদবীধারী বুড়ো সম্রাট যতই বোঝান ইংরেজ-বিরোধী যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া তাঁর কর্ম নয়, তবু তাঁকেই সবাই মিলে ধরে ওটার নেতা বানালো!
না, মুজিব অত বোকা নন। তিনি যতই ‘জয় বাংলা’ বলুন, হাঁ, ওটা ছিল ঐ সময় ঠিক সঠিক ধ্বনি যা গোটা বাঙ্গালী জাতিকে এক করেছিল, তিনি তো জানেন যুদ্ধ করা তাঁর কর্ম নয়। তিনি করেছেন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তাঁর পথ নির্বাচনের। তার বাইরে কিছু নয়। এর জন্য পুলিশের মার, জেল এসব হবে। কিছু লোক গুলিতে প্রাণও দিবে। কিছু মারপিট, ভাঙচুরও হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ? তার প্রস্তুতি কোথায়? একটা সুসংগঠিত আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত শক্তিশালী বাহিনীকে বললেই মোকাবিলা করা যায়? অস্ত্র প্রথমে লাগে না। ওটা এসে যায়। সময় হলেই আসে। সময় এলেই সেনাবাহিনী, ইপিআর আর পুলিশের কাঠামো ভেঙ্গে দলে দলে যোদ্ধা আসে নি কি? কিন্তু যেটা লাগে সেটা হল দীর্ঘ মানসিক-ব্যবহারিক প্রস্তুতি, একটা সাংগঠনিক প্রস্তুতি, একটা পাল্টা ‘চেইন্ অব্ কমান্ড্’। এই চেইন অব্ কমান্ড না থাকলে দলে দলে সৈনিক পেলেই হল? যখনই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভিতরের বাঙ্গালী সৈনিকেরা বিদ্রোহ করবে তখন তাদের ভিতর যত মেজর আর কর্ণেল থাকুক, গোটা চেইন অব কমান্ডটাই ভেঙ্গে পড়বে। তখন কি আর যুদ্ধ হয়? এই পাল্টা চেইন অব কমান্ড হল একটা বিপ্লবী সংগঠন। আর এটা থাকলেই এক চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা সৈনিক আর অফিসাররা দাঁড়াবার, প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাবার শক্তিটা পায়।
আচ্ছা, চেইন অব কমান্ড না হয় থাকল। কিন্তু যুদ্ধটা হবে কোথায়? শহরে? কয়দিন? পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মত একটা দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীকে শহরে নূতন চেইন অব কমান্ডের অধীনে কেবল গড়ে উঠতে থাকা বিদ্রোহী সেনাবাহিনী কয়দিন প্রতিরোধ করবে? সুতরাং তারা কোথায় গিয়ে আশ্রয় নিবে যেখান থেকে দীর্ঘ মেয়াদী যুদ্ধটা চালাবে? সেটা হল গ্রাম। তা, গ্রামে যাব বললেই তো হল না। সেখানে সংগঠন কোথায়, কৃষকের অংশগ্রহণটা হবে কিভাবে? এগুলো কি রাতারাতি হয়? এসব কাজ কি আওয়ামী লীগ জীবনে করেছে? না, আমি ১৯৫৭-এর আগের আওয়ামী লীগের কথা বলছি না। সেটা তো ভাসানীর আওয়ামী লীগ। আমি বলছি ১৯৫৭-এর পরের আওয়ামী লীগের কথা যেটা সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের আওয়ামী লীগ। না, এঁদেরও কোন ঐতিহ্য নেই তা আমি বলছি না। মুজিবের গুরু সোহরাওয়ার্দীর অবশ্য সশস্ত্র সংগ্রামের এক বিরাট ঐতিহ্য আছে! তিনি ১৯৪৬-এর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং-এর মহানায়ক! হাঁ, সশস্ত্র সংগ্রাম না হয় তাঁরা জানেন মানলাম, যদিও ওটা কি বস্তু তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু গ্রামে যাবার কি হবে? চাইলেই হুট করে যাওয়া যায়?
হাঁ, বলা যেতে পারে কেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির কৃষক সংগঠন, আন্দোলন একেবারে কিছু কি ছিল না? সেখানেও যাওয়া যায়। আর তারা তো দীর্ঘ কাল ধরে মুজিব ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ পূজারী এবং ঐ রাজনীতিটারও এরাই এ দেশে সবচেয়ে বড় দার্শনিক। এদের সম্পর্কে কি আর বলব! এদের দৃষ্টিটা এত দূর প্রসারী যে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে অনেক যুগ যুগান্তের পথ পাড়ি দিতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য যে হাজার সালা মহাপরিকল্পনা নিয়ে তারা অগ্রসর হয়েছে তাতে ঐ লক্ষ্যে পৌঁছতে একটা মানুষকে অন্তত পঁচিশ বার জন্ম নিতে হবে। তাতে অবশ্য জন্মান্তরবাদের গৌরব বাড়ে!
এরা যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে তখন পেট ফেটে হাসি আসে ওদের অতীতটার কথা মনে করে। বন্দুক ধরা দূরের কথা বন্দুক দেখলেই যাদের হাঁটু কাঁপে তারা গড়বে মুক্তিযুদ্ধ! তাদের সঙ্গে ছাত্র জীবনে রাজনীতি করেছি না? এক সময় তো তারাই আমাদের নেতা ছিল। যতদিন তাদের হাতে নেতৃত্ব্ ছিল ততদিন ছাত্র ইউনিয়নের কাজ ছিল আইয়ুবের গুণ্ডা ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর হাতে বেধড়ক মার খাওয়া আর লাঞ্ছিত হওয়া। মনে আছে, ১৯৬৩-তে তখন কাজী জাফর জেলে, মার খাবার পর সন্ধ্যারাতে ছাত্র ইউনিয়নের এক কর্মী সভায় গোপন নেতা মোহাম্মদ ফরহাদের ভাষণের কথা যেখানে তিনি সান্তবনা দিলেন, ‘মার খাওয়ারও ভাল দিক আছে। মার খেলে লোকে ভাল ছেলে বলে।’ ঐ সভায় যাঁরা ছিলেন আশা করি তাঁর সেই গান্ধীবাদী অমর বচন আজো স্মরণ করতে পারবেন। ১৯৬৫-এর এপ্রিলে যে দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হল সম্ভবত সেদিন অথবা তার পরদিনই এনএসএফ-এর গুণ্ডাদের প্রথম মার দেওয়া হল ঢাকা হলের নিকট। আর ১৯৬৮-এর শেষ দিকে এনএসএফ-এর গুণ্ডা পাসপাত্তুকে হত্যা না করলে ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের সূচনাকারী শক্তিটাকে ভাসানী কোথা থেকে পেতেন? পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) না থাকলে তাদের সেদিন কে হত্যা করত আর এইভাবে গণ-অভ্যুথানের মূল চালিকা শক্তি ছাত্রদের রাহুমুক্ত করত?
তাদের আন্দোলনের দৌড় তো গান গাওয়া, সাহিত্য পাঠ আর মিছিল করা পর্যন্ত। না, গান গাওয়া আর সাহিত্য চর্চাকে আমি এতটুকু অবজ্ঞা করি না। এগুলো বাদ দিয়ে কোনদিন মানুষ উন্নত মানুষ হয়? কিন্তু ভীরু-কাপুরুষতাকে আমি দারুণ ঘৃণা করি। আসলে এ দেশে মস্কোপন্থীরা ছিল নিবীর্য শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির এক আধুনিক সংস্করণ। এরা হল পিকিংপন্থীদের উল্টোটা। এক দলের কাছে সঙ্গীত, অভিনয়, সাহিত্য চর্চা, জ্ঞান সাধনা হল অতীব নিন্দার ও ভীতির বস্তু আর এক দলের কাছে এগুলোই সব আর সাহস, তেজ, শত্রুর যুদ্ধের শক্তিকে পাল্টা যুদ্ধ দিয়ে মোবাবিলার শক্তি গড়ে তোলার সাধনা এ সবই অতীব নিন্দার ও ভীতির বস্তু। এই এক দেশ যেখানে যারা যোদ্ধা হবে তারা হবে বর্বর, অমানুষ, হৃদয়হীন, সংস্কৃতিহীন আর যারা জ্ঞান সাধনা করবে, সাহিত্য চর্চা করবে তারা হবে নিবীর্য, ভীরু, কাপুরুষ অথবা সুযোগ সন্ধানী, সঙ্কীর্ণ মনা ও মেরুদণ্ডহীন। যারা শ্রম করবে তারা হবে মস্তিষ্কহীন, মেধাহীন, বোধ-বুদ্ধিহীন। আর যারা বুদ্ধিচর্চা, জ্ঞান চর্চা করবে তারা হবে শ্রম বিযুক্ত, আয়েশী, নিরাপদ জীবনে অভ্যস্ত অথবা অতি ধূরন্ধর, স্বার্থান্ধ, মতলববাজ। যারা মহত্তের সাধনা করবে তারা হবে জীবন বিমুখ, সমাজ-সংসার বিমুখ, শুধুই ত্যাগী। যারা জীবন-সমাজ-সংসার সাধনা করবে তারা হবে স্বার্থান্ধ, আত্মসর্বস্ব, শুধুই ভোগী। এও এক আশ্চর্য বর্ণজাতিভেদ ঠিক শূদ্র-ব্রাহ্মণ ব্যবস্থার মত। কারো সঙ্গে কারো যোগ নেই। সব খণ্ডিত মানুষ। আর তাই বিকৃত মানুষ। পূর্ণাঙ্গ মানুষের সাধনাটাই এ দেশে দাঁড়াবার জমি পায় না। পাবে কিভাবে? এ দেশের সমাজই তো সেটা চায় না। আর তাই সমাজটাকেই বদলাবার এত বেশী প্রয়োজন।
আমি কোনওকালে বুঝিনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, মধুসূদন, বঙ্কিম, শরৎ, মানিক, তারাশঙ্কর, নজরুল, টলস্টয়, পুশকিন, ডস্টয়ভস্কি, গোর্কি, কালিদাস, শেক্সপীয়ার নিজ দেশ ও পৃথিবীর এই সব মহৎ রচয়িতার সাহিত্য পাঠ ছাড়া জীবনের গভীর অনুভব কিভাবে জন্ম নেয়? সঙ্গীত, নৃত্য আরো সব শিল্পকলার চর্চা ছাড়া উন্নত যন্ত্র-মানুষ, উন্নত মিস্ত্রী-মানুষ তৈরী হতে পারে, কিন্তু উন্নত মানুষ তৈরী হয় এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি বলি না একজনের জীবনে সবকিছু সমান তালে করা সম্ভব। ওটা সম্ভব নয়। একজনকে একটা প্রধান দিক অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু তার পাশে জীবনের আরও কিছু দিক জানতে, বুঝতে এবং তাতে অংশ নিতে চেষ্টা করতে হয়। এবং সবচেয়ে বড় কথা তার ক্ষেত্রের বাইরে যারা যার যার ক্ষেত্রে থেকে মানুষ, সমাজ ও সভ্যতার কল্যাণে, মুক্তিতে অবদান রাখে তাদের শ্রদ্ধা করতে জানতে হয়।
এটা ঠিক সব কর্মীর পক্ষে এত দিক জানা ও বোঝা সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর। আর নেতা যারা হবে তাদের তো এই দৃষ্টিভঙ্গীটা সবচেয়ে বেশী থাকতে হবে এবং কিছু খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করতে হবে। বরং উল্টোটা। আর আমাদের দেশে যে কোনও ভিন্নতাকে অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা করার সংস্কৃতিটা বোধ হয় সবচেয়ে প্রবল। একদল বান্দা সাংস্কৃতির। আর একদল মার্কসবাদী সংস্কৃতির মানুষ। বিশেষত মার্কসবাদীদের নিয়ে সমস্যা হল যে, এঁরা নিজেদের খুব আধুনিক, উন্নত মনে করেন। এবং বাস্তবে সমাজের উন্নত সংস্কৃতি যেটুকু আছে সেটার হাল যেভাবেই হোক এদের হাতেই অনেক বেশী ধরা। আর এদের মধ্যে অন্যকে পুরোপুরি নাকচ করা, অবজ্ঞা করার মনোভাব প্রবল। সবাইকেই তো দেখলাম। মস্কো হোক আর পিকিং হোক এক অর্থে সবাই এক জিনিস। শুধু বর্ণজাতির এক এক জায়গায় অবস্থান। পিকিংপন্থীরা হয়তো আধুনিক ক্ষত্রিয়। সেও তো শূদ্রদেহ আর ব্রাহ্মণ মস্তিষ্কেরই দূরবর্তী বাহু মাত্র।
তবে আর একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে যে, মস্কোপন্থীরা যেমন সোভিয়েত মনস্ক আধুনিক শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির প্রতিনিধি, পিকিংপন্থীরা তেমন চীন মনস্ক আধুনিক বান্দা সংস্কৃতির প্রতিনিধি। বান্দা, ক্ষত্রিয়ে খুব একটা প্রভেদ নেই বলে ভারতবর্ষে এত শতাব্দী বান্দা সংস্কৃতি শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির উপর আধিপত্য করতে পেরেছে। বর্ণজাতি ব্যবস্থার ক্ষত্রিয়ের দুর্বলতাটা বান্দারা পূরণ করেছে। এখন তো মধ্যযুগীয় শূদ্র-ব্রাহ্মণ-বান্দা কারোরই আধিপত্য করার উপায় নেই। তাই ইংরেজের কর্তৃত্বে একটা আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে এদের সবারই। ভারত-রাষ্ট্রের আধুনিক শূদ্র-ব্রাহ্মণরা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এমনই এক আধুনিক শূদ্র-ব্রাহ্মণ-বান্দা সংস্কৃতির সমন্বয়ে খিচুড়ি পাকিয়ে সবাইকে তা ভক্ষণ করাচ্ছে। ভারত-রাষ্ট্রের রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি আর বোম্বাই ফিলমের চেহারাটা দেখলেই বোঝা যায় এই খিচুড়ির গুণ ও স্বাদ কেমন!
তা, যে কথা বলছিলাম, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যটা যাদের সহস্র বার্ষিকী মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত এবং সশস্ত্র সংগ্রামের কল্পনাতেই যাদের ভূমিকম্পের মত হৃদকম্প হতে থাকে সেই মস্কোপন্থীদের কৃষক আন্দোলন হবে সশস্ত্র সংগ্রামের ভিত্তি? তাহলেই হয়েছে। ওটা হল মাকাল গাছে আম ফলাতে চাওয়া। তা মুজিব যাবেন কোথায়? তাঁর না আছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের কল্পনা, না আছে তার কর্মসূচী ও প্রস্তুতি, না প্রকৃত গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রের কর্মসূচী। তাঁর সামনে তখন দু’টো পথ, হয় ধরা দেওয়া, নয় ভারতে আশ্রয় নেওয়া। না, ভারতে আশ্রয় নেওয়াকেই আমি দোষণীয় মনে করি না। ওটা এ দেশের একদল অজ্ঞ, গোঁয়ার-গোবিন্দ পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট মনে করত। যদিও আমি মনে করি না যে, ভারত-রাষ্ট্রের আশ্রয়ে থেকে পুরো মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুললে সেটা আর প্রকৃত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে। যাইহোক, শেখ মুজিবের সামনে তখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করতে চাইলে দু’টো পথ। একটা হল বামপন্থীদের জাতীয় যুদ্ধ শুরুর জন্য ডাক দেওয়া এবং তাদের নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা। হাঁ, সেই সদিচ্ছা যদি তাঁর থাকত তাহলে দেখতেন কমিউনিস্ট নেতাদের অস্বীকার করে কিভাবে হাজার হাজার ছাত্র-তরুণ কর্মী লক্ষ লক্ষ কৃষক আর শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগ দিত এবং সম্ভবত তাদের সবার সামনে দেখতে পেতেন ভাসানীকে। আর একটা হল ভারত-রাষ্ট্রের আশ্রয় কিংবা সাহায্য নিয়ে যুদ্ধটা গড়া। যেমনটা আওয়ামী লীগ করেছে। সেখানে থেকেও তিনি নয়টা মাস তাজউদ্দিনের জায়গায় থেকে অন্তত বুঝতেন যুদ্ধ কি জিনিস। আর ভারত-রাষ্ট্রের আশ্রয় পছন্দ না হলে তিনি ইউরোপেও চলে যেতে পারতেন। না, সেখানেও যাবেন না তিনি। কাজেই যেখানে যাবার তিনি সেখানেই গেলেন। তবু তিনি মুক্তিযুদ্ধের নেতা! দুর্ভাগ্য এই জাতির!
মুজিব ধরা দিলেন কেন? কারণ সবাই মিলে ঠেলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের যে ডিমটাকে ৬ দফার পেটের নীচে ঢুকিয়ে এখন সেটাকে ফোটাবার ব্যবস্থা করছে তিনি আর সেটা হতে দিতে রাজী নন। তিনি আওয়ামী লীগকে এবং সেই সঙ্গে জাতিকে ফেলে রেখে চললেন। এখন যে যা পারে করুক!
না, ডিম ফোটাবার কথাটা একটা উপমা মাত্র। আর মুজিব ধরা দিতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ধরা দেয় নি। তা যুদ্ধ করেছে। আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে-ই সৃষ্টি করুক তখন সেটা গোটা জাতির হয়ে উঠেছে। সুতরাং লেনিনের মত করে বললে বলতে হয় আওয়ামী লীগ নূতন জাতির ধাত্রী হয়ে উঠছিল। কিন্তু ধাত্রীর পিছনে আর এক ধাত্রী ছিল না? আরও অনেক বড় ও প্রবল এক ধাত্রী! তিনি হলেন ইন্দিরা গান্ধী। তিনি কি করলেন সে তো আমরা দেখেছিই! তবু ভাল বাংলাদেশ স্বাধীন হল!
আর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হল বলে বাংলাদেশকে আর পুরোপুরি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান বানানো গেল না। তবে এটা স্বাধীন পূর্ব বাংলাও হল না। কারণ স্বাধীন, গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার চেতনাটা যারা গড়ে তুলেছিল তারা এর নেতৃত্বকারী শক্তি হতে পারে নি।
এইবার একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভাসানী এবং ষাটের দশকের প্রজন্মের প্রকৃত ভূমিকাটা কি ছিল। তবু এটাই বাস্তব যে, নয় মাস ধরে যে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল তার প্রধান স্রোতটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছিল। এবং অনুপস্থিত শেখ মুজিবের নামেই যুদ্ধটা চালানো হল। কিন্তু তার প্রকৃত নেতা তখন কে? তিনি কি তাজউদ্দিন নন? আর এই তাজউদ্দিনকে শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিলেন। তারপর থেকে আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস হল তাজউদ্দিনের নাম জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ইতিহাস। কারণ সকলের গড়ে তোলা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেই নয় মাসে সবচেয়ে বেশী যে নেতা ধারণ করতে পেরেছিলেন তিনি হলেন তাজউদ্দিন। অনুমান করি কি বিপুল সীমাবদ্ধতার মধ্যে সেদিন তাঁকে কাজ করতে হয়েছিল!
হাঁ, তাজউদ্দিন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঐ নয় মাস সবচেয়ে বেশী ধারণ করেছিলেন। কিন্তু ঐটুকুই। শুধু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করলেই হল? জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিটা কোথায়? সেটা কি তাঁর সাথে ছিল? হঠাৎ তাড়া খেয়ে মুক্তিযোদ্ধা হতে চাইলেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, চেতনায় ও বাস্তবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়, যদি তার পিছনে না থাকে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া? তবু তিনি যুদ্ধ করেছেন। তাঁর অবস্থা তখন এ দেশের বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী তরুণ প্রজন্মের মত, যারা বন্দী ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী, গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ-বিরোধী নেতৃত্বের কাঠামোতে। তাঁর বাধা দুই দিক থেকে। একদিক থেকে লীগ নেতৃত্বের কাঠামো এবং তার চেয়েও বড় বাধা দিল্লী সরকার। স্বাধীনভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ চললে আওয়ামী লীগের ঐ কাঠামো অনিবার্যভাবে ভেঙ্গে পড়ত। কিন্তু দিল্লী তা হতে দিবে কেন? হাঁ, দিল্লী কোন অবস্থাতেই বাঙ্গালীর একটি জাতি-রাষ্ট্র চাইতে পারে না। কোন দু:খে চাইবে?
সুভাষকে ওরা কেন দাঁড়াতে দেয় নি? সবচেয়ে বড় কারণ সুভাষ ছিলেন বাঙ্গালী এবং সেই সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী চেতনার অধিকারী যিনি উপনিবেশবাদী ইংরেজদের গড়া রাষ্ট্রিক-সামাজিক কাঠামোটিকে ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন এবং একটি সমাজতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গড়তে চেয়েছিলেন। সুভাষের ভুল ছিল। তিনি বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বটা বুঝতে পারেন নি। ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে একটা সর্বভারতীয় ঐক্যের প্রয়োজন নিশ্চয় ছিল। কিন্তু বাঙ্গালী হিসাবে তাঁর প্রথম করণীয় ছিল বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বভারতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে বিবেচনা করা। একজন মাত্র বাঙ্গালী নেতা এই বিষয়কে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। কিন্তু সে কালে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমান সকলেই ছিল সর্বভারতীয় এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। ঐ স্বপ্নের পথ ধরেই মুসলমানরা গড়েছিল পাকিস্তান, যা হল মুসলমানের সর্বভারতীয় রাষ্ট্র মাত্র। বাঙ্গালীর ঐ এক বুদ্ধিভ্রংশতার কালে চিত্তরঞ্জন তাঁর দাঁড়াবার জায়গাটা আর পান নি। হয়তো সেটা ছিল তাঁর অকাল মৃত্যুর কারণ, এবং তাঁর সঙ্গেই তাঁর স্বপ্নেরও অবসান হয়েছিল। সুতরাং সুভাষ এ ক্ষেত্রে তাঁর সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর সাধারণ চেতনাকে ধারণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন আরও অগ্রবর্তী। কংগ্রেসের চেয়েও। আর মুসলিম লীগের তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু বলব সুভাষের সবচেয়ে বড় অপরাধ তিনি বাঙ্গালী ছিলেন। গান্ধী-নেহরুর নেতৃত্বে যে হিন্দী ভাষী বলয়ের সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করত তারা সুভাষের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীকে দেখতে ও বুঝতে পারত। তারা জানত এই বাঙ্গালী জাতি তাদেরকে কোথায় নিবে! অমন এক সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিবর্তনের তারা ছিল ঘোর বিরোধী। সুতরাং তারা বিপ্লবী হয়ে উঠতে থাকা বাঙ্গালী জাতিকে দাঁড়াতে দিতে চায় না। এই কাজে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ-কমিউনিস্ট পার্টি সব এক। ঐ যে আগেই বলেছি ওরা সব শূদ্র-ব্রাহ্মণ অথবা বান্দা। কংগ্রেস ব্রিটেন মনস্ক শূদ্র-ব্রাহ্মণের প্রতিনিধি। মুসলিম লীগ ব্রিটেন মনস্ক বান্দার প্রতিনিধি। আর কমিউনিস্ট পার্টি? ওটা হল সোভিয়েত মনস্ক শূদ্র-ব্রাহ্মণের প্রতিনিধি।
না, এই তুলনা আমি পরিহাস করে দিচ্ছি না। এসব রসিকতা নয়। এটাই এদের প্রকৃত স্বরূপ বিচার। আমি মনে করি আজ গোটা ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন হওয়া অত্যন্ত জরুরী। ঐ সব শূদ্র-ব্রাহ্মণ, বান্দাদের ইতিহাস দর্শন আমাদের চোখের দৃষ্টিটাকে এতকাল ঘোলাটে করে রেখেছে। এখন ওদের পরানো রঙ্গীন চশমাটা খুলে ফেলে খোলা চোখে আমাদের ইতিহাসের পুনর্বিচার করতে হবে।
আমরা জানি কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতায় ও সহায়তায় গড়া। সুতরাং ওদের নিয়ে হয়তো সমস্যাটা কম। ওদের বোঝা যায়। কিন্তু এ দেশে সে কালে বিপ্লবীদের মধ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রচারে কাদের সবচেয়ে বেশী উৎসাহ ছিল সেটা কি আমরা জানি? কৌতূহল হলে এখনও যে কেউ জেনে নিতে পারেন ১৯৩০-’৪০-এর দশকে কারাগারে বন্দী বিপ্লবীদের হাতে কিভাবে ইংরেজ শাসক কমিউনিস্ট সাহিত্য পৌঁছে দিত। আসলে ইংরেজ জানত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এ দেশের বিপ্লবীরা বিপ্লবের নিজস্ব তত্ত্ব উদ্ভাবন করে নিবে আর তাতে হয়তো মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অভিজ্ঞতাকেও তারা নিজেদের মত করে কাজে লাগাবে। কিন্তু স্বাধীন বিপ্লবী তত্ত্বের উদ্ভব যাতে না হয় সেই জন্য অতি ধুরন্ধর সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকেরা মার্কসবাদী দর্শন ও রাজনীতি জেলের ভিতরে বিপ্লবীদের গেলানো শুরু করে। ইংরেজ শাসকেরা জানত ঐ পথে এ দেশে বিপ্লব হবে না। দেশটাকে তারা খুব ভাল বুঝত। তা না হলে কখনও প্রায় বিনা যুদ্ধে আর কখনও এত অল্প যুদ্ধে ওরা কিভাবে এক বিশাল উপমহাদেশকে দখল করতে পারল? অতি ধুরন্ধর ঐ সাম্রাজ্যবাদীরা তাই এ দেশে মার্কসবাদ প্রচারের পৃষ্ঠপোষক হল।
শত্রু যদি অমৃতও দেয় তবু সেটা অতি সন্দেহের সঙ্গে নিতে হয়। বুঝতে হয় এর ভিতর কোথায়ও গরল লুকানো আছে অথবা এটা হল সেই ওষুধের মতো যার এতটুকু বেশী কিংবা ভুল প্রয়োগে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। আসলে বাইরের, বিশেষত শত্রুর কোনটাই হুবহু এবং অবাধে নিতে নেই। তাকে বুঝে, ভেঙ্গে, খুলে নিজের মতো করে অতি সতর্কভাবে নিতে হয়। তা না হলে ভিতরে ঢুকে যায় ট্রয়ের ঘোড়া। আর সাম্রাজ্যবাদ সেদিনও যেমন আমাদের শত্রু ছিল তেমন আজও আছে। শুধু তার রূপ আর কৌশল বদলেছে।
চীন যে আজ মার্কসবাদ নিয়েও এতটা উন্নতি করেছে তা তাদের ঐ ঐতিহাসিক জাতি সচেতনতার কারণে এবং ঐতিহাসিকভাবেই বিদেশের প্রতি, বাইরের প্রতি সদা সতর্ক মনোভাবের কারণে। যাঁরা চীনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদি পর্ব সম্পর্কে কিছু জানেন তাঁরা বোধ হয় জানেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যাঁরা গঠন করেন তাঁদের প্রায় সকলের মার্কসবাদী বইপত্র সম্পর্কে জ্ঞান কত সীমাবদ্ধ ছিল। বস্তুত মার্কসবাদ সম্পর্কে একান্ত প্রাথমিক ধারণা নিয়েই তাঁদের অধিকাংশের যাত্রা শুরু। চৌ এন লাই-এর মতো যাঁরা বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন তাঁরা হয়তো অনেক জানতেন বা তাঁদের পড়া ছিল অনেক কিছু। কিন্তু সে আর কয়জন? যাঁরা চীনে থেকে লেখাপড়া করেছিলেন তাঁরা জানবেন কিভাবে? মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের অতি অল্প সংখ্যক বই কিংবা সেগুলোর চীনা অনুবাদ তখন পাওয়া সম্ভব ছিল। এবং তার পরেও তাঁরা ভুল করেছেন। কিন্তু ঐ স্বাধীন বিকাশের ফল মাও। এবং এই স্বাধীন বিকাশের ফল হচ্ছে চীনের আজকের এই অভাবিত উন্নতি। সমাজতান্ত্রিক বা জনগণের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ ধরেও যে কি অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে দেশের উন্নয়ন সম্ভব তার প্রমাণ আজ চীন এবং ভিয়েতনাম। এই দু’টো দেশের প্রবৃদ্ধির হার এখন পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। এটা হল স্বাধীন ও উন্নত চেতনার ফল।
তা বাঙ্গালীর জাতিবোধ কোন কালে ছিল যে, তা সতর্ক হবে? বরং তারা সব বাদ দিয়ে সর্বভারতীয় হতে চাইল। সুভাষ বুঝলেই বা কি করতে পারতেন একা? তবু যেটুকু বুঝেছিলেন সেটুকুর জন্য হিন্দী-উর্দূ-ইংরাজী বলয়ের সকলে মিলে তাঁকে দাঁড়াতে দেয় নি ভারতের মাটিতে। হাঁ, তিনি ছিলেন সেকালে বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, শ্রেষ্ঠ বীর-নেতা। তিনি সেকালের সকল শূদ্র-ব্রাহ্মণ-বান্দার পরিবর্তে একমাত্র স্বাধীন বাঙ্গালী নেতা। ভারতের হিন্দী-উর্দূ বলয়ের নেতৃত্ব জানত তার মধ্য দিয়ে উঠে আসবে নূতন বাঙ্গালী এবং সেই সঙ্গে নূতন ভারতবাসী।
এ কথা আমাদের ভোলা উচিত নয় যে, দিল্লীর সঙ্গে বাঙ্গালীর একটা ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব থেকেই গেছে সুদীর্ঘ কাল ধরে। ইংরেজ শাসন কালেও বাঙ্গালী ছিল ভারতবর্ষের হিন্দী-উর্দূ ভাষীদের সবচেয়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী জাতিসত্তা। সুতরাং ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালীর শক্তি ছিল হিন্দী-উর্দূ বলয়ের নেতৃত্বের জন্য ভীতিকর। এমন অবস্থায় স্বাধীন ভারত-রাষ্ট্র ও দিল্লী সরকারের জন্য বাংলাদেশে বাঙ্গালীর একটা সেকিউলার জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কল্পনাটা ছিল আতঙ্কজনক। এটা অনিবার্যভাবে প্রভাবিত করত পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙ্গালী চেতনাকে।
আমি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যাঁরা ভারতে বিভিন্ন প্রদেশে গিয়েছিলেন তাঁদের একটু অতীতটা স্মরণ করতে বলব। পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরায় তাঁরা যে গভীর ভালবাসা, মমতা এবং প্রবল সমর্থন পেয়েছিলেন সেটা কি তাঁরা অন্যত্র পেয়েছিলেন? এমন কি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার অভিজ্ঞতাও কি তাঁদের ছিল না? অতো কথা কেন, আসামে তাঁদের কি অভিজ্ঞতা ছিল?
দিল্লী সরকার পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য বা ব্যবহার যা-ই বলা যাক করেছিল। কিন্তু পশ্চিম বাংলার ও ত্রিপুরার ব্যাপক বাঙ্গালী জনগণ কি শুধু সেই জন্য অমন হৃদয় নিঙ্ড়ানো ভালবাসা আর সহযোগিতা সেদিন দিয়েছিল? তারা ছাড়া আর কে সেদিন প্রায় এক কোটি মানুষের অতো বড় বোঝা স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে নিয়েছিল? তাদের স্বপ্ন ছিল এখানে বাঙ্গালীর এক স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, যা তাদেরকেও সাহস, আত্মমর্যাদাবোধ, গৌরব ও শক্তি যোগাবে।
দিল্লী সরকার এতো বোকা নয় যে, তেমন একটা বাংলাদেশ হতে দিবে? বাঙ্গালী জাতি ও জনগণের মুক্তিযুদ্ধের মূল ও প্রকৃত শক্তিকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হল নয় মাস। থাকল শুধু একটা চেতনা। বলা যায় এই চেতনার নাম দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ, অশ্রু আর বেদনার বিনিময়ে এক নির্দয় খেলা হল। সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা, কর্মী এবং মুষ্টিমেয় নেতা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সেদিন ভারত-রাষ্ট্রে বসে থেকে কি করেছিল সেই ইতিহাস সবার জানা।
আর যারা মুক্তিযুদ্ধ করল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিটাকে বাদ দিয়ে তারা জাতির মুক্তিযোদ্ধা হবে? পশ্চিম পাকিস্তানীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে যোদ্ধা হওয়া এক জিনিস আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী যোদ্ধা হওয়া আর এক জিনিস। ওটা হঠাৎ নয় মাসে হয় না। সঠিক রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা ছাড়া এটা শুধু ধ্বংসের শক্তিও হতে পারে। যখন সামনে শত্রু থাকবে না তখন এই শক্তি কি হবে? তাই হয় নি কি? প্রথম কয়দিন আবেগ থাকে। তারপর? ১৯৭২-এর শুরু থেকে বাংলাদেশের দিনগুলো যাঁদের স্মরণ আছে তাঁরা স্মরণ করুন তো!
বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হল। একদল ধর্ষণকারী বাহিনী নয়টা মাস বাংলাদেশকে ধর্ষণ করে তাকে লাঞ্ছিত, বেআব্রু, অশক্ত নারীর মতো ফেলে রেখে গেল, নিরাপদে দিল্লীর গাড়ীতে চেপে। সেখান থেকে তাদেরকে ইসলামাবাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। আর একদল নূতন ধর্ষণকারী নেমে এল পালে পালে দলে দলে ঐ ধর্ষিতার শরীরের উপর নূতন করে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এবং শেখ মুজিব বিমানে চেপে পাকিস্তান থেকে লন্ডন, দিল্লী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে নেমে এসে পা রাখলেন।