লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:57 AM, Hits: 1613
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে বাম ধারা এবং আওয়ামী লীগ ধারার মধ্যে যে বিতর্কগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার নূতন করে দেখা দিয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোই আমার কাছে শুধু নিষ্ফল নয় উপরন্তু বিভ্রান্তিকরও মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এগুলোর অধিকাংশই আমাদের চিন্তা-চেতনাকে পুরাতন বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে মাত্র। অথচ আসল প্রয়োজনটা হল এই বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে আমাদের সমস্ত রাজনীতি ও চিন্তা-চেতনাকে পুনর্বিন্যস্ত করা। একুশ বৎসর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। এর যে একটা তাৎপর্য আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও সেটা কতখানি তা সময়ই বলে দিবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু বক্তব্য এবং পদক্ষেপ ইতিমধ্যে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এগুলোর ফলাফল কি হবে অথবা আওয়ামী লীগ সরকার কতদূর যাবে বা যেতে পারবে সেটা বোঝার জন্য আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ বিতর্ক জমে উঠেছে। স্বভাবতই তার অতীত ভূমিকা এবং ইতিহাস বারবার এসবে উঠে আসছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখায় কয়েক মাস ধরে বাম ধারা থেকে যেমন আওয়ামী লীগের সমালোচনায় বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তেমন আওয়ামী লীগ ধারার বুদ্ধিজীবীরাও বাম ধারার সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন। এবং প্রাসঙ্গিকভাবে সবার অতীত আসছে।
ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠনের আহ্বান দিলেন। তার তাৎপর্য ও স্বরূপ নিয়ে এক বিতর্ক শুরু হল। অত:পর জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে তিনি দেশ পরিচালনার প্রয়োজনের কথা বললেন। সেটা নিয়েও সঙ্গত কারণেই বিতর্ক শুরু হল। কারণ জাতীয় ঐক্যমত বললেই হল না। সেটা কিসের ভিত্তিতে হবে সেটাও তো নির্দিষ্ট করার প্রশ্ন আছে।
বস্তুত আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিপক্ষে বিতর্ক এবং শেখ হাসিনার জাতীয় ঐক্যমতের আহ্বান আমার মনে যে প্রশ্নগুলো তুলেছে সেগুলোর উত্তর পাওয়াটা এখন জরুরী মনে করছি। বিশেষ করে বামপন্থী ধারা এবং আওয়ামী লীগ এই যে মৌল দু’টো ধারায় এ দেশের রাজনীতি চল্লিশ বৎসর পূর্বে বিভক্ত হয়েছিল আমি তার পটভূমিতেই আজকের বিতর্ক উদ্ভূত প্রশ্নগুলো উথাপন করতে চাই। তাহলে আমাদের আজকের অনেক বিতর্কের স্বরূপ বুঝতে সুবিধা হবে। কারণ এ দেশে বাঙ্গালী জাতির রাজনীতির বিভক্তিটি ঘটে মূলত ১৯৫৭-তে যখন আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং আওয়ামী লীগ এই দুই রাজনৈতিক সংগঠনে। সেই বিভক্তির ফলে এ দেশের রাজনীতিতে এমন অনেক জটিল ঘটনাপ্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে যা আজ বোঝা দু:সাধ্য হতে পারে যদি আমরা সেই বিভক্তির প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে না পারি।
আমার দৃষ্টিতে আজকের রাজনীতির প্রয়োজন অতীতের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া নয়, বরং সেখান থেকে বেরিয়ে আসা। এবং আমার কাছে এ দেশে রাজনীতির সমস্যা হল পুনর্বিন্যাসের সমস্যা। আমাদের সমগ্র রাজনীতিকেই নূতনভাবে বিন্যস্ত করতে হবে। আর তা করতে হলে আমাদের অবশ্যই বর্তমান ও অতীত গতিধারা ও সমস্যাগুলো বুঝতে হবে। আর তার প্রয়োজনে আমি সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত এ দেশের দুই ধারার দুই প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তির বক্তব্যের সূত্র ব্যবহার করব। আসলে তাঁরা বা তাঁদের বক্তব্য আমার লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ্য মাত্র। এটা আমার আলোচনাকে একটা জীবন্ত প্রেক্ষিত দান করার প্রয়োজন বোধ থেকেই করছি। এই দুইজনের একজন হলেন রাশেদ খান মেনন। বর্তমানে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। তিনি এ দেশে বাম ধারার একজন প্রধান প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’-এর ১৩ আগস্ট, ’৯৬ তারিখে ‘শিষ্টাচারই যথেষ্ঠ নয়, গণতন্ত্রের প্রতিই অনুগত হতে হবে’ এই শিরোনামে তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হয়। মেননের ঐ লেখার জবাবে একই সংবাদপত্রের ২২ আগস্ট, ’৯৬ তারিখে আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলাম ‘গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার, ফ্যাসিবাদ এবং সুবিধাবাদী বিশ্লেষণ’ এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়। আবদুল গাফফার চৌধুরী বর্তমানে লন্ডন নিবাসী। তিনি একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী। আমার নিকট তিনি লীগ ধারার বুদ্ধিবৃত্তির একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি। তাঁর লেখাটি আওয়ামী লীগ রাজনীতির সমর্থনে লেখা।
কিন্তু আমার আলোচনার শুরুতেই বলে রাখা ভাল যে, আমার আলোচনার বিষয়বস্তু ঐ দুইজনের ঐ দুইটি লেখার বিষয়বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। আসলে এ ধরনের অনেক বিতর্কই আমাকে এই নূতন ও ভিন্নধর্মী আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে অনুপ্রাণিত করেছে। তবু আমি ঐ দুই লেখকের অতি সামান্য কিন্তু আমার বিচারে খুব মৌল কিছু বক্তব্য আমার আলোচনায় আনতে চাই। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা দরকার যে, আমার একটা রাজনৈতিক অতীত আছে। অতীতে এক সময় আমি দীর্ঘকাল বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এই আলোচনায় সেটা সবটা না হলেও প্রাসঙ্গিকভাবে অনেকটা উঠে আসবে। আমার নিজ অভিজ্ঞতার আলোয় আমি এ দেশের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা ও সঙ্কটের স্বরূপ বিচার ক’রে রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে আমার ধারণা উপস্থিত করতে চেষ্টা করব। আর আমার অভিজ্ঞতা থেকে এমন অনেক বিষয় এই গ্রন্থে উল্লেখ করব যার বহুকিছুই সাধারণ পাঠকদের নিকট এতকাল অজানা থেকেছে। এগুলো প্রকাশ করলে দেখা যাবে যে, অনেক ভ্রান্ত কিংবা মিথ্যা ধারণা দিয়ে এ দেশে ইতিহাসের এক বিরাট সত্যকে সম্পূর্ণরূপে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। আমি এখন সেই মিথ্যাটাকে ভেঙ্গে ফেলে সত্যটাকে সবার চোখের সামনে আনতে চাই। আজ জাতির জীবনে যে ক্রান্তি লগ্ন এগিয়ে আসছে তাতে আর দেরী করা সমীচীন মনে করি না।
এখন রাশেদ খান মেননের বক্তব্য দিয়েই মূল আলোচনায় প্রবেশ করছি। বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ সাংসদদের উদ্দেশ্যে ‘চুপ্, বেয়াদব’ বলে যে ধমক দেন তার সমালোচনা করতে গিয়ে ‘শিষ্টাচারই যথেষ্ট নয়, গণতন্ত্রের প্রতিই অনুগত হতে হবে’-তে মেনন বলছেন, ‘কিন্তু এই অশিষ্ট শব্দ ও আচরণের প্রতিযোগিতায় সংসদ ও গণতন্ত্র নিয়ে যতখানি না আশঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে, তার চেয়ে কারণ আছে যে সকল মন্তব্য ও বক্তব্যের সূত্র ধরে এ সকল অশিষ্ট আচরণ সে সকল মন্তব্য ও বক্তব্য নিয়ে।’
আসলে মেননের এই বক্তব্যে খালেদা জিয়া বা বিএনপি-এর তুলনায় আওয়ামী লীগ যে, সংসদ ও গণতন্ত্রের জন্য বড় বিপদ এই ধারণা প্রকাশ পায়। কিন্তু বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের বক্তব্য ও আচরণ কি বিএনপি-এর অতীত ও বর্তমান ভূমিকা ও আচরণের তুলনায় বেশী শঙ্কা সৃষ্টি করে? আমি আওয়ামী লীগ করি না। তার প্রচুর সমালোচনাও আছে। কিন্তু বামপন্থীদের আওয়ামী লীগের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষের এই প্রকাশ কি এ দেশের রাজনীতিতে সুস্থ ধারার বিকাশে সহায়ক হয়েছে এই প্রশ্ন আমি করতে চাই। কারণ রাশেদ খান মেননের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এ দেশে বামপন্থীদের আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি-এর প্রতি দুর্বলতা এবং বিএনপি-এর তুলনায় আওয়ামী লীগের প্রতি বিরোধিতা। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝি আওয়ামী লীগের প্রতি এক অন্তর্গত ঘৃণা ও বিদ্বেষ যে কোনও মুহূর্তে বামপন্থীদের দিকভ্রান্ত করতে পারে এবং তাদেরকে সঠিক ভূমিকা নেবার বদলে অধিকতর প্রতিক্রিয়ার শক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশেষ করে আজ যখন মুক্তিযুদ্ধ এবং সেকিউলারিজম ও গণতন্ত্রের সপক্ষের সকল শক্তির মধ্যে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী তখন বিএনপি-এর তুলনায় আওয়ামী লীগের প্রতি শঙ্কা প্রকাশ আরও বেশী শঙ্কা জাগায়। কারণ বাম ধারা থেকে আগত মানুষ হিসাবে এটা কোন মনস্তত্ত্বের প্রকাশ এবং কোন মনস্তাত্ত্বিক উৎস থেকে এই ধরনের বক্তব্য আসে এবং এই মনস্তত্ত্ব কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা আমার সম্ভবত ভালই জানা এবং দেখা আছে।
আমি যতদূর বুঝি বামপন্থীরা প্রধানত দু’টো কারণে আওয়ামী লীগকে মনের দিক থেকে গ্রহণ করতে পারে না। একটা কারণ হল ১৯৫৬-’৫৭-তে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীন জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি ও ২১ দফা কর্মসূচীকে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে এবং শূন্য যোগ শূন্য সমান শূন্য এই বক্তব্য দিয়ে বিসর্জন দান। এই প্রশ্নে মওলানা ভাসানী এবং তাঁর সঙ্গেকার বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে সংখ্যালঘু হলে তাঁরা আওয়ামী লীগ ত্যাগ ক’রে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। এইভাবে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল ধারা সোহরাওয়ার্দী-মুজিব এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন দু’টো ধারায় বিভক্ত হল। এই ভাঙ্গন উভয়কে প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের চিরস্থায়ী শত্রুতে পরিণত করল। স্থূলভাবে বললে বলা যায় ’৬০-এর দশকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর এই দ্বন্দ্ব ভাসানী-মুজিব দ্বন্দ্বে রূপ নেয়।
অপর কারণটা হল ষাটের দশকের শেষে এবং বিশেষত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ফলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় শেখ মুজিব নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিকট ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এবং বামপন্থীদের হেরে যাওয়া। এটা ঠিক যে, ’৭০ থেকে বামপন্থীদের অনেকে ন্যাপ এবং ভাসানীকে ছেড়ে যেতে শুরু করে এবং আলাদাভাবে বা কমিউনিস্ট হিসাবে গোপন প্রক্রিয়ায় যার যার মত অবস্থান নেয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে, তারা এক অর্থে ভাসানীর উত্তরাধিকারী ছিল এবং তারা ভাসানীর প্রতি দুর্বল থেকে গিয়েছিল। কৃষক বিপ্লবের যে স্বপ্ন তারা দেখত এবং যার ছায়া তারা দেখতে পেত ভাসানীর ভিতরেও তাকেই তারা মূর্ত করতে চেয়ে তখন সরে গেছে যখন ভাসানী আর সেটাকে মূর্ত করতে পারেন নি। এদের অনেকে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে চাইত। আবার আবদুল হকের মত অনেকে ছিল যাদের কাছে জাতীয় প্রশ্ন ছিল অর্থহীন; সুতরাং তারা ছিল তত্ত্বগতভাবে পাকিস্তানপন্থী যদিও তার জন্যও তারা লড়তে রাজী ছিল না। কারণ কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও কৃষক বিপ্লবের বাইরে আর কোনও ভাবনা তাদের ছিল না।
ভাসানী-মুজিব দ্বন্দ্বের যে গতিধারাকে আমি এখানে দেখাতে চাইছি সেটাকে অবশ্য যান্ত্রিক এবং একরৈখিকভাবে দেখা ঠিক হবে না। এই দ্বন্দ্বে দু’টো কারণ ছাড়াও আরো কারণ আছে বৈকি। তবে আমাদের এই আলোচনায় সেগুলো অপ্রধান। অন্যদিকে ভাসানী এবং মুজিব কেউই নিজ নিজ ধারার সব কিছুর নিয়ামক বা স্রষ্টা নন। এমন কি এমন অনেক কিছুর অধীনস্থও তাঁরা হয়েছেন যেগুলো ভিন্নভাবে বেড়ে উঠে তাঁদের আশ্রয় নিয়েছে বা সঙ্গী হয়েছে। ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ধারা থেকে অজস্র ছিটকে পড়া ধারা বা উপধারার দিকে দৃষ্টি দিলে এটা আরও স্পষ্ট হয়। আসলে আমার এই আলোচনায় আমি ভাসানী এবং মুজিবকে পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের দু’টো মোটা দাগের রাজনৈতিক স্রোতধারার প্রতীক হিসাবে উল্লেখ করছি যাঁরা অনেক মৌলিক বিষয়ে খুব কাছাকাছি হলেও মূলত দু’টো পরস্পর বৈরী ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করেন এবং এই দুই ধারার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এ দেশের রাজনীতিকে অনেক বেদনাদায়ক জটিলতা ও বিকৃতির আবর্তে নিক্ষেপ করেছে।
আমি ১৯৪৯-এ আওয়ামী লীগ গঠনের পর থেকে মূলত ’৬৫ পর্যন্ত ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ধারায় প্রগতিশীলতার উপাদানকে সংগতিপূর্ণভাবে প্রাধান্যে দেখি। ১৯৫৬-’৫৭-তে সোহরাওয়ার্দী-মুজিব যে পথ নেন তা তাঁদেরকে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানী পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার সহায়ক করে। ১৯৫৮-তে সামরিক আইন জারী হয়। ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের যে নবধারা সূচিত হয় তাতে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ উভয় দলই অংশ নেয় এবং নেতৃত্ব দেয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ন্যাপ এবং আওয়ামী লীগ উভয়ের ভূমিকা ছিল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অনেকখানিই সমান্তরাল এবং পরস্পরের সহযোগী বা পরিপূরক।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্রমবিকাশ তৎকালীন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ক্রমশ জোরালো করে। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান শক্তি বা অগ্রবাহিনী ছিল ছাত্র সম্প্রদায়। একদিকে ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ, অপর দিকে ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্কিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্র লীগ বেড়ে উঠছিল মূলত পাশ্চাত্য অনুসারী বুর্জোয়া বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধারায় আর ছাত্র ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধারায়।
ন্যাপের সমস্যা বোঝার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন বিকাশ প্রক্রিয়া বোঝাটা জরুরী। তবে বহু কিছু আলোচনার সুযোগ এখানে না থাকলেও কিছু ঘটনা উল্লেখ করব তখনকার সমস্যা বুঝতে। ’৬২ থেকে ’৬৫ পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়নের বিকাশ ছিল বিস্ময়কর এবং অবিশ্বাস্য গতিময়। এই বিকাশ ন্যাপকে ব্যাপক শক্তি যোগায়। ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের মূল প্রবণতা ছিল সমাজতন্ত্রের দিকে। কমিউনিস্ট পার্টির গোপন অস্তিত্ব ছিল এই ধারার ভিতর একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। এই পার্টি ছিল মস্কোপন্থী, আপোসমুখী এবং ধীরগতি।
কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্রমবিকাশ ছাত্র ইউনিয়নকে দ্রুতগতি, সাহসী এবং জাতীয় রাজনীতির প্রশ্নে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তুলেছিল। যারা দ্রুত এগোতে চাইছিল এবং অধিকতর সাহসী পদক্ষেপ দিতে চাইছিল তাদের আটকাতে চাইল গোপন কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ নেতৃত্বের এক বড় অংশ। এই পরিস্থিতিতে ’৬৫-তে ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া চৌধুরী এবং রাশেদ খান মেনন এই দুইজনের নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে দু’টো সংগঠনে পরিণত হল। যাঁরা এই বিভাগকে জানেন চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের ফল হিসাবে তাঁরা কিন্তু ভুল করেন। এই বিভক্তির কালটাতে আমার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এবং ভূমিকার কারণে এই বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট। তবে এখানে অনেক ঘটনা সম্পর্কে আলোচনার অবকাশ নেই। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে, নূতন গতিশীলতায় ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙ্গন অনিবার্য হয়ে ওঠে। চীন-সোভিয়েত বা পিকিং-মস্কো দ্বন্দ্ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আমাদের দেশে এলে তখনকার মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)-কে মোকাবিলা করতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখানে এই তথ্যও জানানো বোধ হয় গুরুত্বপূর্ণ হবে যে, প্রথম পর্যায়ে ন্যাপ নেতৃত্বেরও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর প্রতি সমর্থন ছিল না। এর পর ক্রমে ন্যাপ এবং কমিউনিস্ট পার্টিও ভাঙ্গে। এবং এ দেশের বামপন্থী বা সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ১৯৬৬ সাল থেকেই স্পষ্টভাবে মস্কো-পিকিং এই দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ এই বিষয়টা বুঝতে হবে যে, ছাত্র-তরুণ শক্তির অভ্যুদয় ও অগ্রগমন এই ভাঙ্গন ঘটায়। গোপন কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপের পুরাতন নেতৃত্বের যাঁরা নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন অথবা এই অগ্রগামী শক্তিকে সঙ্গে পেতে চাইলেন তাঁরা পিকিং-এর লাইন নিলেন। ন্যাপে মস্কোপন্থীরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তাঁরা ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা ন্যাপ গঠন করলেন।
১৯৬৫-এর সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানকে চীন সমর্থন দিলে পিকিংপন্থী ধারা আইয়ুব সরকারের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অবশ্য প্রক্রিয়াটা শুরু হয় সেপ্টেম্বরের আগে থেকেই যখন পাকিস্তান চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে থাকে। তবে চীন সমর্থক বামপন্থী নেতৃত্বের আইয়ুবের প্রতি দুর্বলতা স্পষ্ট হয় পাক-ভারত যুদ্ধের সময় থেকে। এটা সবার জানা। সুতরাং সেসবের বর্ণনায় এখানে যাব না। শুধু অনেকের কাছে একটা অজানা সত্য তুলে ধরতে চাই যে, আমার মত ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর ব্যাপক সংখ্যক কর্মী এবং সমর্থক ছিল প্রচণ্ডভাবে আইয়ুব-বিরোধী এবং সেই সঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে আপোসহীন। ন্যাপের কাছে তাদের তীব্র দাবী ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে একটা বলিষ্ঠ এবং স্পষ্ট কর্মসূচী।
কিন্তু সমস্ত পিকিংপন্থী বাম নেতৃত্ব তখন ব্যস্ত ছিল চীনের মিত্র আইয়ুব সরকারকে সময় দিতে এবং বিরক্ত না করতে। একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করব সেই সময়ে আমাদের যন্ত্রণাটা বোঝাবার জন্য।
রাশেদ খান মেনন তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর সভাপতি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাশেদ খান মেনন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী বক্তব্য এমনভাবে দেওয়া শুরু করেন যে, আইয়ুব-বিরোধী বক্তব্য দেওয়া একেবারে বন্ধ। আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন করা দূরের কথা ১৯৬৫-এর শেষ দিক থেকে প্রকৃতপক্ষে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁদের পক্ষ থেকে। আমরা তখন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ন্যাপ ও কমিউনিস্ট নেতৃত্বসহ রাশেদ খান মেননের উপর। আমরা ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন কর্মী একত্রে বসে ঠিক করলাম যে, এই প্রসঙ্গে মেনন এবং তাঁর তখনকার রাজনৈতিক গুরু কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। সেই সময় কাজী জাফর আহমদ পুরাতন ঢাকার উর্দূ রোডে একটা কামরায় ভাড়া নিয়ে ছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৬৫-এর শেষ দিক অথবা ১৯৬৬-এর গোড়ার দিক। তাঁর বাসায় আবুল কাসেম ফজলুল হক (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক) এবং আমি গেলাম। সেখানে কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন এবং হায়দার আকবর খান রনো তিনজনই ছিলেন। কথা মূলত আমি বলি।
আমি সেই সময় পিকিংপন্থী নেতৃত্বের মনস্তত্ত্বটা বুঝতাম। আইয়ুবের প্রতি তাদের কারো প্রকাশ্য এবং কারো গোপন সমর্থন বা দুর্বলতার পিছনের যুক্তিটা আমার জানা ছিল। সেটা হল আইয়ুব সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী একটা অবস্থান নিয়েছেন এবং তিনি জাতীয় বুর্জোয়া। যাইহোক আলোচনা ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। আমি কাজী জাফরকে স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করলাম, ‘জাফর ভাই! আমাদের স্পষ্ট উত্তর দরকার। আপনি কি আইয়ুবকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনে করেন?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘হাঁ, আমি আইয়ুবকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনে করি।’ এরপর আমি হায়দার আকবর খান রনোকে প্রশ্ন করলাম, ‘রনো ভাই! আপনি কি আইয়ুবকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনে করেন?’ তিনি উত্তরে বললেন, ‘না, আমি আইয়ুবকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মনে করি না।’ এরপর আমি তাকালাম মেননের দিকে এবং একই প্রশ্ন করলাম তাঁকে। তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি বলতে পারব না।’ আমি নাছোড়বান্দার মত আবার বললাম, ‘আপনার তো একটা মত আছে আইয়ুব সরকারের প্রশ্নে!’ মেননের উত্তর ছিল, ‘এসব ব্যাপারে আমার কোন মত নাই।’
আমার মনে হয় তাঁদের এই উত্তরের মধ্যে এ দেশের তৎকালীন বাম আন্দোলনের ভবিষ্যৎ লেখা ছিল। তিন জন তিন রকম উত্তর দিলেও মূল উত্তরটা কিন্তু জমা ছিল কাজী জাফর আহমদের কাছে যা তিনি উচ্চারণও করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কাজী জাফর যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটির উৎস ছিল তৎকালীন অবিভক্ত মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরকার চীনা লাইন গ্রহণকারী নেতা আবদুল হক এবং তৎকালীন সাপ্তাহিক ‘জনতা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনোয়ার জাহিদ প্রমুখ পিকিংপন্থী গোপন ও প্রকাশ্য নেতৃবৃন্দ।
আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর অগ্রণী কর্মী গোষ্ঠী ছিলাম তারা কিন্তু আইয়ুব-বিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনকে এক এবং অভিন্ন হিসাবে মনে করতাম। আমাদের বক্তব্য ছিল এই দেশে সাম্রাজ্যবাদ পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার সরকারের অর্থাৎ আইয়ুব সরকারের মাধ্যমেই তার নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য রক্ষা করছে। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদকে আঘাত করতে হলে আইয়ুব সরকারকে আঘাত করতে হবে। এর সঙ্গে আমাদের মধ্যে জোরালো ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা। বিশেষ করে ১৯৬৬-তে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচী দেবার পর উন্নততর একটা জাতীয় কর্মসূচী দেবার জন্য আমরা বাম নেতৃত্বের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করি। কিন্তু সেসব ছিল অরণ্যে রোদন।
এটা ঠিক যে, বাম রাজনীতি ছিল বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এটাকে একটা অভিন্ন ধারা হিসাবে দেখাটাও ভুল। এই ভুলটাই অচেতনভাবে বা সচেতনভাবে অনেকে করেন যখন তাঁরা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তোলার এবং তাতে অংশ নেবার ক্ষেত্রে বিরাট সংখ্যক বামপন্থীর বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবময় ভূমিকাকে অস্বীকার করেন। তাঁরা তখন আত্রাইয়ের ওহিদুর রহমান, রৌমারির আবদুল মজিদ, নরসিংদির আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, পাবনার টিপু বিশ্বাসসহ অসংখ্য বাম কর্মীর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা নাকচ করেন।
বিশেষত সবচেয়ে বড় ভুল হয় তখন যখন ষাটের দশকে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-কে অবলম্বন করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য উদগ্রীব যে বিশাল ছাত্র-তরুণ শক্তির অভ্যুদয় ঘটে তাকে পুরাতন বাম নেতৃত্বের সঙ্গে এক করে দেখে তার নিজস্ব গতিধারাকে বুঝতে চাওয়া হয় না। এই শক্তিরই একজন আমি ছিলাম। আমাদের বিকাশ কিন্তু মূলত কমিউনিস্ট পার্টি বা ন্যাপ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটেছিল। এবং পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব আমাদের সব সময়ই কম বেশী থেকে গিয়েছিল। আমাদের এই বিকাশ প্রক্রিয়া ও ভূমিকা না বুঝলে বাংলাদেশের উদ্ভব ও তার আজকের সমস্যাগুলোকেও বোঝা যাবে না বলে আমার ধারণা। সে সম্পর্কে আজ সংক্ষেপে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করব।
বাম নেতৃত্ব বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ভয় ও ঘৃণার চোখে দেখতেন। ফলে জাতীয়তাবাদী চেতনার অধিকারী ষাটের দশকের বিশাল ছাত্র-তরুণ গোষ্ঠী ছিল তাদের কাছে ভয় ও ঘৃণার বস্তু। এই ছাত্র-তরুণরা ছিল এমন এক প্রবল, প্রচণ্ড শক্তি যাদের হাত ছাড়া করলেও বিপদ আবার রাখলেও বিপদ। কারণ হাতছাড়া করলে নেতৃত্ব শক্তিবিহীন হয়ে পড়ত। আবার সঙ্গে রাখাও ছিল বিপদের। কারণ নেতৃত্বের পক্ষে তাদেরকে পোষ মানানো বা নিজেদের পথে পরিচালনা করা ছিল দু:সাধ্য এমন কি অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব ব্যাপার।
কিন্তু এই তরুণ শক্তি বাম নেতৃত্বের সঙ্গে থেকে পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিচ্ছিল। একদিকে ১৯৬৬ থেকে আওয়ামী লীগের ৬ দফার প্রতি ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলছিল। অপর দিকে ১৯৬৮-’৬৯ থেকে এই তরুণ প্রজন্মের স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার উদাত্ত আহ্বান পূর্ব পাকিস্তান ধারণার মধ্যেই যে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তার বিদারণ ঘটিয়ে বাঙ্গালীর সেকিউলার জাতীয়তাবাদের চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটিয়ে চলেছিল। সর্বোপরি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য ছাত্র-তরুণ প্রজন্মের এই ডাক সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামের ঐতিহ্যবিহীন এক জনগোষ্ঠীর চেতনাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছিল।
এইভাবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য বাম ছাত্র আন্দোলন হয়ে উঠেছিল বাস্তবে আওয়ামী লীগের ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পরিপূরক। আকাঙ্ক্ষা যার যাই থাক বাস্তব বিচারে একদিকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং জয় বাংলা ধ্বনি, অন্যদিকে এই বামপন্থী ছাত্রদের স্বাধীনতা ও সশস্ত্র সংগ্রামের ধ্বনি একটি অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেটা হল বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যে রাষ্ট্র হবে সেকিউলার এবং অসাম্প্রদায়িক।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ-বিরোধী পুরাতন বাম নেতৃত্ব এই বিষয়টা খুব ভাল বুঝতেন। তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন একে রুখতে। কিন্তু ভাসানীকে ঘিরে থাকা বাম নেতৃত্বের সাধ্য হয় নি তরুণ প্রজন্ম দ্বারা সৃষ্ট এই জোয়ারকে রোধ করার। ছাত্রদের মধ্যে শুরু হয়ে এই জোয়ার-শ্রমিক-কৃষক সহ প্রায় সমগ্র বাম আন্দোলনকে নূতন অভিমুখ দান করে। এই অবস্থায় ’৭১-এ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ’৬৮ থেকে শুরু হয়ে ’৭১ পর্যন্ত এই যে এক চেতনার জোয়ার বিস্তৃত হল তাতে ৬ দফার ভূমিকাকে আমি খাটো করছি না। তবে ৬ দফা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটা নূতন চেতনার ঢাল বা আবরণ স্বরূপ। তার আড়ালে সমাজে যে নূতন শক্তি মাথা তুলছিল সেই বিশেষ শক্তির নিজস্ব একটা গুরুত্ব ও ভূমিকাকে আমি এখানে তুলে ধরছি। এই শক্তির অভ্যুদয়ের মুখে পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত বাম নেতৃত্বের আতঙ্কগ্রস্ত আচরণ আমার আজো মনে পড়ে; সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রগুলোও। এবং যে তরুণ প্রজন্ম ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ এই ধ্বনিতে সারা দেশ কাঁপিয়ে তুলছিল তাদের অনেক ভুলও।
প্রকৃতপক্ষে আমাদের সেই প্রজন্ম ছিল নেতৃত্বহীন। আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করার মত কোন নেতৃত্ব সেদিন এ দেশে ছিল না। আমাদের নিজেদের নেতৃত্ব দেবার মত যোগ্যতা, বুদ্ধি, ক্ষমতা এবং সর্বোপরি অভিজ্ঞতা ছিল না। একদিকে তখন বাম ধরার গণ-রাজনীতিতে ভাসানী দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মত বিশাল আয়তন ও উচ্চতা নিয়ে যাঁকে ডিঙ্গিয়ে গিয়ে গণ-রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী দিয়ে স্বাধীনভাবে আমরা এগিয়ে যাব সে সাধ্য আমাদের ছিল না। অপর দিকে ছিল ন্যাপে ক্রিয়াশীল পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব, যা তখন এ দেশের বামপন্থার উপর চীনের প্রবল প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমাদের এগোনোকে সুকঠিন করে তুলেছিল। এই পরিস্থিতিতে ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে থেকেই আমরা আমাদের চিন্তাকে আমাদের বুদ্ধি ও ক্ষমতা মত ছড়িয়ে দিচ্ছিলাম। তবে আমরা ’৬৮ সালের প্রথমার্ধেই হক-তোয়াহা-সুখেন্দু নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর সঙ্গে আমাদের যেটুকু সম্পর্ক ছিল সেটুকুও ছিন্ন করি এবং ১৯৬৮-এর শেষ দিকে দেবেন শিকদার-আবদুল মতিন-আলাউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে তাতে যোগ দিই ’৬৯-এর প্রথমার্ধে।
হাঁ, এইটুকুই তাঁদের দরকার ছিল। আমাদের প্রজন্মের শক্তিকে সাথে পাওয়া। কিন্তু পূর্ব বাংলার জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যে আন্তরিকতা ও যোগ্যতার দরকার ছিল তার কোনটারই প্রমাণ তাঁরা দিতে পারেন নি। তখনও তাঁরা ন্যাপের মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী দিতে পারতেন। ভাসানী রাজী না হলে তাঁরা স্বাধীনভাবে কর্মসূচী নিয়ে অগ্রসর হতে পারতেন। সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং প্রভাব তাঁদের কিছুটা হলেও ছিল। সেই সঙ্গে থাকত গোপন সংগঠন হিসাবে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যে কর্মসূচী। কিন্তু আসলে তাঁরা তখন ব্যস্ত ছিলেন মুজিব ও জাতীয়তাবাদের জোয়ার ঠেকাতে। আর তাই জাতীয় আন্দোলনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমরা হলাম তাঁদের নানান চক্রান্তের শিকার এবং সেই সঙ্গে ক্রমে তাঁদের অনেক ভ্রান্তির অংশীদার ও ফলভোগীও।
তবু তাঁরাও আমাদের প্রতিহত করতে পারেন নি। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে তাঁদের ‘এপারেটাস’ ও প্রতিষ্ঠা ব্যবহার করেই আমরা আরো ব্যাপ্ত পরিসরে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম সারা দেশে। একদিকে তরুণ প্রজন্মের ভিতর সিরাজ শিকদারের উত্থান প্রতিহত করা এবং অপর দিকে মওলানা ভাসানী ও বাম নেতৃত্বের পরিচালনায় গড়ে উঠা গণ-সংগঠন ও আন্দোলনের তৎকালীন বিশাল ‘এপারেটাস’-কে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা ছিল আমাদের তাদের সাথে যোগদানের উদ্দেশ্য। আমার ধারণা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইনি। কিন্তু আমরা আমাদের উদ্দেশ্য গোপনও করি নি। অর্থাৎ আমাদের দিক থেকে ষড়যন্ত্র ছিল না। সিরাজ শিকদার পুরাতন সমস্ত বাম নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা থেকে তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে একা এগোতে গিয়ে আরো ভয়ঙ্কর ভুল ও আত্মঘাতী পথে পা দিলেন। এই পথ তাঁকে গণ-লাইন বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদের দিকে নিয়ে গেল। নিজের যোগ্যতা ও বুদ্ধি সম্পর্কে অতিরিক্ত আস্থাশীল অনভিজ্ঞ সিরাজ শিকদার সম্ভবত আমাদের প্রজন্মের জন্য আরো অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারতেন যদি আমরা তাঁর অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করতে না পারতাম সেদিন গণ-আন্দোলনের বাম নেতৃত্বকে সাথে নিয়ে। কিন্তু ১৯৬৮-তে স্বাধীনতার চেতনার বিকাশে তাঁর অবদানকে আমি অস্বীকার করি না।
আমার ধারণা প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বহীন হলেও বামপন্থী আন্দোলনের ভিতর এই যে তরুণ প্রজন্ম জেগে উঠেছিল সাহস, তেজ এবং উদ্দীপনা নিয়ে সেটা প্রভূত পরিমাণে নির্মাণ করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। কারণ সমাজে পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলেই পরিবর্তন আসে না, যদি এই পরিবর্তন সংগঠনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সমাজে না থাকে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ১৯৫৪-এর ২১ দফা এবং ১৯৬৬-এর ৬ দফাকে যদি আমরা পাশাপাশি মেলাই তবে উভয় কর্মসূচীর একটি মৌলিক মিল দেখে আমরা অবাক হব। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে উভয় কর্মসূচী মূলত অভিন্ন। কিন্তু ২১ দফা ব্যর্থ হয়েছিল। অথচ যাঁরা ৬ দফা দিয়েছিলেন তাঁরাও ২১ দফা দিয়েছিলেন কিংবা তার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু সেদিন তাঁরা সরে যেতে পেরেছিলেন ২১ দফার প্রতি অঙ্গীকার থেকে। কারণ ২১ দফাকে বাস্তবায়নের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত যে জংগী সামাজিক শক্তির প্রয়োজন ছিল সেটা সেদিন ছিল না। ৬ দফার সময় এই শক্তি এতই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, ৬ দফা থেকে সরা তো সম্ভবই ছিল না উপরন্তু তার চেয়েও অনেক বেশী কিছু করতে হয়েছিল।
ষাটের দশকের এই তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে হয় যে, এরাও ছিল মুক্তিযোদ্ধা। আর এমন মুক্তিযোদ্ধা যারা দীর্ঘ প্রয়াসে, চিন্তায়, সাধনায়, সাহসে, ত্যাগে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল। এরা সেইসব মুক্তিযোদ্ধার কাতারে পড়ে না যারা ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা পরিচালনার দিন পর্যন্ত মনে-প্রাণে পাকিস্তানী থেকে এবং পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়ে হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিল। না, ঘটনাচক্রে পড়ে হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা তারা হয় নি।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ঘটনার ধাক্কায় যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের অবদানকে নাকচ করতে হবে। বরং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকের অবদান আমাদের স্বীকার করতে হবে। তা না হলে আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ আর জাতির মুক্তিযুদ্ধ থাকে না। অথচ মুষ্টিমেয় দালাল এবং কিছু বিভ্রান্ত মানুষ ছাড়া এটা ছিল গোটা জাতির মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যার যেটুকু পাওনা সেটুকু তাকে দিতে হবে। ঘটনার ধাক্কায় যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়, কিংবা এই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পিছনে থাকে না দীর্ঘ প্রয়াস ও সাধনা তাদেরকে যদি তাদের যা পাওনা তার চেয়ে অনেক বেশী দিয়ে বসানো হয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের আসনের সামনের সারিতে আর পিছনে ঠেলে সরানো হয় সচেতন প্রয়াস ও সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা মানুষদের তবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা পাবে কিভাবে? কষ্টার্জিত নয় বলে এই মর্যাদার মূল্য তাদের কাছে থাকে না।
আমার মনে হয় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সঠিকভাবে বুঝতে না পারা, বিশেষ করে তার বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার অভাব আমাদের অনেক সমস্যার জন্য দায়ী। এই জন্য এটা অনেকের কাছে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। যেমন ’৭১ সম্পর্কে বহু মানুষকে আমি বলতে শুনেছি এবং আজো শুনি ‘গণ্ডগোলের বছর’। যাদের কাছে এটা শুধু গণ্ডগোলের বছর তারা ঐ গণ্ডগোলের উপরে বা সামনে কার কি ভূমিকা ছিল সেইটুকুই দেখে। কিন্তু গণ্ডগোলের ভিতরে কয়জনই বা যেতে চায়!
আসলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে যার যেখানে যতটুকু ভূমিকা ছিল সেসবেরই প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়া দরকার। আওয়ামী লীগ যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের প্রধান শক্তি সেটা বাস্তব। সেটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে, তার সীমাবদ্ধতা কতটুকু সেসবের বিশ্লেষণ হতে পারে। কিন্তু তার জন্য আওয়ামী লীগের ভূমিকার গৌরব যেটা ছিল সেটাকে অস্বীকার করে আর যা-ই হোক আমরা মুক্তিযুদ্ধের ফসলকে রক্ষা করতে পারি না। আওয়ামী লীগের নিশ্চয় অনেক ভুল ও ত্রুটি আছে। সেগুলো না থাকলে বিগত ২৫ বৎসর দেশের এই বিরাট ব্যর্থতা এবং এই অন্ধকার কাল আমাদের দেখতে হত না। তবে সে আলোচনায় আমি আর একটু পরে যাব। আমার এখানে বক্তব্য হল আওয়ামী লীগ বা তার সমর্থকরা যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের একক ব্যাপার হিসাবে দেখেন বা দেখাতে চান তখন গোটা ঘটনাটাকে দলীয় করে ফেলেন। ফলে বিভিন্ন বিচার থেকে আওয়ামী লীগ বিরোধী হয়েও যারা বাঙ্গালীর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছিল বা নানানভাবে তাতে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে হয় অসহায় ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন নয় জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রুদের দিকে ঠেলে দেন।
বামপন্থীদের অনেক ভুল ছিল সত্য। কিন্তু বাঙ্গালী জাতির মুক্তির জন্য তাদের বিরাট অংশের মনে যে তীব্র আর্তি ছিল সেটাকে অস্বীকার করা এক নিদারুণ ভুল। শুধু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার ক্ষেত্রে নয় উপরন্তু ’৭১-এ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর তাতে অংশ নেবার ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা নগণ্য ছিল না। আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই এ কথা বলছি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একজন সাধারণ কর্মী হয়েও আমি তখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ঘুরেছিলাম। পার্টির নেতা আমি ছিলাম না। কারণ পার্টি নেতৃত্বের দৃষ্টিতে আমার মত পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীর (ঐ বিশেষণটাই ছিল আমার জন্য নির্ধারিত) পার্টির নেতৃত্বে থাকাটা বিপদজনক ছিল। কিন্তু বাস্তবটা হল আমার মত বিপুল সংখ্যক কথিত পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তির প্রধান অংশটা তৈরী করেছিল। যাইহোক, আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি যে, যুদ্ধ আমাদের বিরাট অংশের বিভ্রান্তি দূর করেছিল এবং পুরাতন নেতৃত্বের হাত থেকে নেতৃত্ব খসে পড়ছিল। আমরা তখন দুই ফ্রন্টে লড়াইয়ের তীব্র বিরোধী এবং পাকিস্তানকে আমাদের শত্রু এবং আওয়ামী লীগ এবং বিশেষ করে তার নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনীকে মিত্র চিহ্নিত করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। যুদ্ধ আর কিছুদিন চললে এই পরিবর্তন আনতে বেশী সময় লাগত না বলে আমার ধারণা। কিন্তু জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত শেষ হলে সেই সুযোগ আর পাওয়া যায় নি। পুনরায় পুরাতন নেতৃত্ব নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। সেই সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের কৌশলহীন, আক্রমণাত্মক ও হঠকারী আচরণ। ফলে আমরা আর সফল হই নি। ১৯৭২-এর এপ্রিলেই আমরা কিছু সংখ্যক কর্মী পার্টির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে বাধ্য হই। এবং আমরা পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা বাংলাদেশকে আমাদেরও সংগ্রাম ও সাধনার একটা ফসল হিসাবে গণ্য করি।
এই কথাগুলো বলছি এইটুকু বোঝার জন্য যে, ঘটনার উপরটাই সব নয়। তার ভিতরেও থাকে আরো অনেক ঘটনা, অনেক সময় যেগুলোর কোনওটা উপরের ঘটনার চেয়েও অনেক সময় অনেক গুণে বড় এবং জোরালো হতে পারে। এ যেন হিমশৈলের মত যার ৯ ভাগের ৮ ভাগই থাকে পানির নীচে এবং বাকি মাত্র ১ ভাগ থাকে উপরে। এখন এই ভিতরের ঘটনার শক্তিগুলোকে না জানলে বা বুঝলে, অনেক বেশী প্রবল এবং নির্ধারক অথচ বিভিন্ন কারণে উপরে উঠে আসতে না পারা শক্তিগুলোর ভূমিকা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া না জানলে বা বুঝলে এইসব শক্তিকে সঠিকভাবে খাতবাহিত বা নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয় না।
এটা ঠিক যে, পিকিংপন্থীরা সামগ্রিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী ছিল। যুদ্ধের সময় তাদের অনেকে দেশের ভিতরে থেকে নানান মত ও পথে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করছিল। তাদের কারো কারো কার্যকলাপ ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধিতার নামে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধী। কিন্তু সবার নয়। ভারতে গিয়েও বামপন্থীদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। আবুল বাশার, দেবেন শিকদার, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন এঁরা সবাই তখন ভারতে থেকে মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার। স্বয়ং মওলানা ভাসানী তখন ভারতে। সুতরাং শত বিভ্রান্তি ও ভুল সত্ত্বেও বামপন্থী কিংবা সাবেক পিকিংপন্থীদের এক বৃহৎ অংশ তখন দেশের ভিতরে থেকে হোক অথবা ভারতে থেকে হোক মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার ছিল।
দেশের ভিতরের বামপন্থীদের কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু ভারতে এই যে বহু সংখ্যক বামপন্থী নেতা ও কর্মী গেলেন এবং সেখান থেকে বাংলাদেশের ভিতরে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজ করলেন তাঁদের অনেকের অতীত ভুল-ভ্রান্তি যা-ই থাক মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে তাঁদের অংশ গ্রহণ করাবার কাজটা আওয়ামী লীগ কতোটা করেছিল? এমন কি মস্কোপন্থীদেরকেও কতটুকু সুযোগ দেওয়া হয়েছিল? অথচ তাঁরা তো দীর্ঘকাল ধরে আওয়ামী লীগ রাজনীতির অনুসারী ছিলেন।
হয়তো বলা হবে জনগণের ভোটের রায় ছিল নিরঙ্কুশভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি পাকিস্তান ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের ভোটের রায় পেয়েছিল? সেই রায় কিন্তু ছিল ৬ দফার জন্য। কাজেই রায় অনুযায়ীই যদি যুদ্ধ করতে হয় তবে সেটা ৬ দফার জন্যই করতে হত।
বাস্তবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ৬ দফা আর ইস্যু থাকে নি। এই অবস্থায় ভোটের রায় কারা পেয়েছে শুধু সেটা দিয়েই কি নেতৃত্ব নির্ধারণ করাটা সমীচীন ছিল? বাস্তবটা হচ্ছে এই যে, জনগণ যুদ্ধের জন্য ভোট দেয় নি। আমার মনে আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন আমি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য ঘুরছিলাম তখন অনেক লোকের মুখে শুনতাম, ‘যদি জানতাম নৌকায় ভোট দিলে এমন গণ্ডগোল হবে তাহলে কি আর নৌকায় ভোট দিতাম?’ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা ও জনসমর্থন সবকিছু মাথায় রেখেই কথাটা বলছি। কারণ এটাও সত্যের আর এক দিক। অর্থাৎ নির্বাচন আর যুদ্ধ যেমন এক জিনিস নয় তেমন ভোটার আর মুক্তিযোদ্ধাও এক জিনিস নয়। সুতরাং তখন আওয়ামী লীগের উচিত ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল শক্তিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তোলা।
আসলে আমি যতটুকু বুঝি ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার যেভাবে চেয়েছিল প্রধানত সেভাবেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল। কংগ্রেস সরকার চাইলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে বামরাও যথাযথ অংশ পেতেন। কিন্তু কংগ্রেস সরকারের সেটা চাইবার কারণ ছিল না। কারণ ভারতের কংগ্রেস সরকার তার ঘরের পাশে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতে দেবার মত বোকা ছিল না। সমাজতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে ব্যবহার করা আর সমাজতন্ত্র চাওয়া এক নয়।
এ কথা কিন্তু ভাবা ঠিক হবে না যে, আমি বলতে চাইছি ভারত সরকার তখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে অন্যায় করেছে। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের বিরাট অবদান আছে বলে মনে করি। ভারত সরকার তার স্বার্থেই সেটা করেছে। তবু সেটা আমাদের জন্য বিরাটভাবে প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু কংগ্রেস সরকারের সেই সময়কার কর্মনীতির কতকগুলো দিকের সমালোচনাও আমাদের রাখা দরকার যেগুলো মুক্তিযুদ্ধের সুস্থ বিকাশের পথে বিরাট বাধা হয়েছে। আমি আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেটুকু বুঝি তাহল ভারত সরকার তার প্রধান শত্রু পাকিস্তানকে ভাঙ্গার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে ব্যবহার করতে হয় সেভাবে করেছিল। এখানে সেকিউলার জাতীয়তাবাদ কিংবা সমাজতন্ত্র এসবের বিকাশের জন্য তার কোনও রকম মাথা ব্যথা ছিল না।
অবশ্য কংগ্রেস সরকার যা-ই চেয়ে থাকুক এ ব্যাপারে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বও একেবারে কম ছিল না। কংগ্রেস সরকারের সর্বাত্মক সমর্থন ও সাহায্য পেয়ে তাঁরা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের উপর নিজেদের নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করেন এবং অন্যদের অংশগ্রহণকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন।
তাঁরা হয়তো বলবেন এক সময় তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সেদিন তাঁরা যে ভারতের আশ্রয় ও সাহায্য নিয়েছিলেন এক সময় কি তাঁরা সেই ভারতের কম বিরোধী ছিলেন? ভারত-বিরোধিতার জন্য তাঁদের অতীতের শূন্যতত্ত্ব তখন কোথায় ছিল? এমন কি ১৯৬৫ পর্যন্ত আমরা তাঁদের তীব্র ভারত-সোভিয়েত বিরোধিতা দেখতে পেতাম। কিন্তু তাঁরা তখন সেসব ভুলে গিয়েছিলেন। একইভাবে ভারতও তাঁদের অতীত ভূমিকার কথা মনে রাখে নি। কারণ উভয়েরই প্রয়োজন ছিল উভয়কে। আসলে শুধু রাজনীতিতে নয়, বরং সকল ক্ষেত্রেই জীবনে চলার পথে বন্ধু এক সময় শত্রু হতে পারে, শত্রুও বন্ধু হতে পারে। সেদিন আওয়ামী লীগ যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হত তাহলে কিন্তু সকল পন্থারই বামদেরকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখত না, এমন কি তাদের অনেকের প্রতিই শত্রুর মত আচরণ করত না। বরং অভিন্ন শত্রুর শক্তিকে যত বেশী সম্ভব খর্ব করার জন্য সব বিদ্বেষকে গৌণ করে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করত।
আজ মনে পড়ে তাদের কথা যারা মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে নিহত হয়েছিল। এমনই একজন রংপুরের কলেজ ছাত্র শফিক। তৎকালীন পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সে ছিল বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তার বোন ছিল ছয়জন। অত্যন্ত আদর্শবান, নম্র এবং বুদ্ধিমান এই ছেলেটি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে চলে যায় এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। যুদ্ধের গোড়ার দিকে পাটগ্রাম সেক্টরে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় মুক্তি বাহিনীর আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাকে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। তার অপরাধ সে এক সময় পিকিং ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সুতরাং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যে মরতে প্রস্তুত ছিল তাকে মরতে হয় যাদের নেতৃত্বে সে শত্রুর বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে লড়ছিল তাদেরই হাতে। হাঁ, আরও অনেক ভিন্ন সত্যের মত এটাও এক সত্য।
বামপন্থীদের অনেক ভুল-ত্রুটি ছিল নিশ্চয়, কিন্তু আর একটা দিকের ভুলের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে বৈকি! বামদের ভুলের দিক বিবেচনার সময় আমাদের সব সময় যে বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত তা হল শত সীমাবদ্ধতা থাকলেও এরা কিন্তু বেশীর ভাগই ছিল আদর্শবান, সৎ এবং দেশ ও জনগণের জন্য উৎসর্গিত। এটা যে কত বড় গুণ তা যদি বিগত ২৫ বৎসরের অভিজ্ঞতার পরেও আমাদের বোঝা না হয় তাহলে আমাদের কপালে আরও অনেক বেশী দু:খ লেখা আছে। তারা ভুল করেছিল অনেক। কিন্তু কুউদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে যারা ভুল করে নি তাদের ভুলগুলোকে সহানুভূতির সঙ্গে যেমন বিচার করা উচিত তেমন খুঁজে বার করার চেষ্টা করা উচিত কেন তারা ভুলগুলো করেছিল এবং সেই সঙ্গে দেখতে হবে তাদের কাজের কোনও সুফল আছে কিনা, নাকি শুধুই ফলহীন ভুল।