লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:57 AM, Hits: 1343
এবার আমি ষাটের দশকের বিপ্লবী আন্দোলনের সেই জটিল গ্রন্থিটা খুলতে যাচ্ছি যার দ্বারা এ দেশের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের বৃহত্তর অংশের সকল গতিধারাকে চূড়ান্তভাবে অবরুদ্ধ করে তাকে বিরাট ধ্বংসের পথে যেতে বাধ্য করা হল। আমি মনে করি এই গ্রন্থি খুলতে পারলে এক মহান প্রজন্মের জট পাকানো অবশিষ্ট শক্তিটা অবরুদ্ধতা থেকে মুক্ত হবে এবং এই জাতির পুনরুজ্জীবনের এক শক্তি হয়ে দেখা দিবে।
বিশেষত এই অধ্যায়ের প্রকৃত ঘটনা জানা এবং তার তাৎপর্য বোঝা দরকার আমাদের প্রজন্মের বিপুল সংখ্যক মানুষের, যাঁরা শুধু উপরের ঘটনাটুকু জানেন, কিন্তু এর ভিতরের ঘটনা এবং চক্রান্তগুলো জানেন না। যদি আমি তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র না দিই তবে কেন চারু মজুমদারের লাইন এল, কিভাবে এল, কারা এটাকে কিভাবে একটা বিপ্লবী প্রজন্মের শক্তির সম্ভাবনাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করল এবং বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের এই শক্তির যথাযথ ভূমিকা থেকে বাঙ্গালী জাতি এবং এ দেশের জনগণকে বঞ্চিত করল সে সমস্তই অজ্ঞাত থেকে যাবে।
আমার আজকের আলোচনা হয়তো অনেক কিছুর উত্তর দিবে না। তবে মূল বিষয়টাকে স্পষ্ট করবে বলে আশা করি। বিশেষত এই বিষয়টা আজ আমি স্পষ্ট করতে চাই একটা চক্রান্তকে উদ্ঘাটিত করার জন্য, যে চক্রান্তের শিকার হয়েছে শুধু আমাদের প্রজন্ম নয় সেই সঙ্গে জাতির ভবিষ্যতও। আমি কতকগুলো ঘটনা জোড়া দিয়ে দেখাব কিভাবে ষাটের দশকের প্রজন্মের বিশাল কর্মী বাহিনীকে একটা ভ্রান্ত লাইনে ইচ্ছাপূর্বক ও কৌশলে ঠেলে দিয়ে তাদের বিপর্যস্ত করা হয়েছে, তাদের আত্মবিশ্বাস বিনষ্ট করা হয়েছে এবং জাতির নিকট তাদের হেয় করা হয়েছে। ঘটনাগুলো অবশ্য প্রায় সবই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যাঁরা সেকালে নানানভাবে সম্পর্কিত ছিলেন তাদের অনেকেরই কম-বেশী জানা। আমি শুধু এখন সূত্রবদ্ধ করে সেগুলোকে সাজিয়ে দিতে চাই।
তবে এই আলোচনায় যাবার সময় আমার নিজের কিছু ভূমিকার কথা না বললে হয়তো অনেক কিছুই পাঠকের কাছে অস্পষ্ট থাকবে। সেই কারণে নিজের ভূমিকার কিছু কথা বলতে হচ্ছে। তবে এর মধ্যে কোনো রকম বাড়াবাড়ি বা মিথ্যা আছে কিনা কিংবা আমি নিজেকে বড় করে দেখাবার জন্য এসব বলছি কিনা সেটা সেই কালে যাঁরা বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন কিংবা এমন কি এখানে আমি যাঁদের সমালোচনা করেছি তাঁদের কাছেও যে কেউ জেনে নিতে পারেন। এবং এই সঙ্গে এ কথাও বলব আমারও অনেক ভুল ও সীমাবদ্ধতা ছিল। যদিও হয়তো মূল অনেক বিষয় আমার কাছে অনেকের চেয়ে স্পষ্ট ছিল তবু অনেক বিষয়ে আমি বিভ্রান্তি এবং জিজ্ঞাসায় ভুগতাম। এবং আমার সেই যোগ্যতা ও ক্ষমতা ছিল না যা দিয়ে আমি আমার নিজের এবং সেই কালের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারতাম। সুতরাং আমার সেই কালের সীমাবদ্ধতা ও ভুলগুলোকে মাথায় রেখেই আমার ভূমিকার একটা দিক আজ উন্মোচন করব যা না জানলে একটা রাজনীতির সংকীর্ণতা, ষড়যন্ত্র ও ভ্রান্তি কিভাবে অনেক সম্ভাবনাকে নষ্ট করে হয়তো তা বোঝা যাবে না।
আমরা ১৯৬৯-এর প্রথমার্ধে* পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই। তবে এখন এর পটভূমিটা আর একটু স্পষ্ট করি। আমি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য ১৯৬৬ সালে ঢাকা থেকে গ্রামে যাই। তখন আমি বর্তমান পঞ্চগড় জেলার এক গ্রামে থাকতাম এবং কৃষক সংগঠন করতাম। তবে মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতাম। এখানে আমার যোগাযোগটা ছাত্রদের সঙ্গেই বেশী থাকত।
_______________________________________________________________________________________________
* আমজাদ হোসেন তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা’য় বলেছেন, ‘১৯৬৯ সনের মে মাসে ঢাকার কাকরাইলে অনুষ্ঠিত উভয় সংগঠনের নেতাদের এক বৈঠকে এই একত্রীকরণ সম্পন্ন হয়।’ অর্থাৎ আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের সময় ১৯৬৯-এর মে মাস।
আমি ১৯৬৮-এর প্রথম দিকে ঢাকায় এসে দেখি সিরাজ শিকদার তখন তাঁর গোপন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার বক্তব্য দিয়ে ছাত্রদের মধ্যে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। আমি বরাবর গণ-লাইনের পক্ষে ছিলাম। এ নিয়ে ’৬৭-তেও তাঁর সঙ্গে আমার মতপার্থক্য হয়। আমি মনে করতাম গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে পূর্ব বাংলায় জাতীয় বিপ্লব করতে হবে। তবে কৃষক বিপ্লব ছাড়া এই সংগ্রাম সফল হবে না বলে আমার ধারণা ছিল। এই ধারণা থেকে গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়তে গিয়েছিলাম।
যাইহোক, ১৯৬৮-তে ঢাকায় এসে আমি বুঝতে পারলাম সমস্ত ছাত্র-তরুণ প্রজন্ম কী ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কারণ সিরাজ শিকদারের পথ কোথায় নিয়ে যাবে সে সম্পর্কে আমার সংশয় ছিল না। আমার সঙ্গে একমত হলেন আবুল কাসেম ফজলুল হক ও মাহবুব উল্লাহসহ আরো কয়েকজন।
তখন ন্যাপসহ সমস্ত প্রচলিত বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি ব্যাপক বাম ছাত্র সমাজ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। কারণ দীর্ঘদিন ধরে ন্যাপের পূর্ব বাংলার জন্য জাতীয় আন্দোলনের কোনও কর্মসূচী ছিল না। অথচ আওয়ামী লীগের ছিল ৬ দফা কর্মসূচী। এই রকম পরিস্থিতিতে সিরাজ শিকদারের গণ-আন্দোলন বর্জিত এবং গোপন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লাইনের প্রতি বামপন্থী ছাত্র সমাজ প্রবলভাবে আকৃষ্ট হচ্ছিল। সে সময় যাঁরা ঢাকায় বাম ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁরা অনেকেই হয়তো আজো অবস্থাটা স্মরণ করতে পারবেন। কিন্তু, আমরা কয়েকজন সিরাজ শিকদারের রাজনৈতিক পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমি বুঝলাম এতোদিনে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে স্পষ্টভাবে রেখে একটি গোপন সংগঠন গঠনের সময় হয়েছে। এবং গণ-আন্দোলন বর্জিত সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি যা অনিবার্যভাবে গণ-বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসবাদের দিকে নিবে তাকে প্রতিহত করতে হলে এই মুহূর্তে তা গঠন করতে হবে। সুতরাং আমি নূতন কমিউনিস্ট সংগঠন গঠনের উদ্যোগ নিলাম। আমাকে এর খসড়া ঘোষণাপত্র এবং কর্মসূচী তৈরীর ভার দেওয়া হলে আমি ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচী’ খসড়া আকারে প্রস্তুত করলাম।* ঘোষণাপত্রে আমাদের বিপ্লবকে জাতীয় জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসাবে চিহ্নিত করলাম এবং এই ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে আমরা পাঁচজন মিলে ১৯৬৮-এর এপ্রিল মাসে ‘পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন’ নামে একটি গোপন সংগঠন গঠন করলাম। এর সংগঠনী কমিটির সদস্য হলেন (১) আবুল কাসেম ফজলুল হক (২) মাহবুব উল্লাহ (৩) আমজাদ হোসেন (৪) নূরুল হাসান এবং (৫) শামসুজ্জোহা মানিক। সম্পাদক নির্বাচিত হন আবুল কাসেম ফজলুল হক।
_______________________________________________________________________________________________
* ‘পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন’ সম্পর্কে আমজাদ হোসেন এক সময় এক জায়গায় (সম্ভবত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য়) লেখেছিলেন যে, এটা গঠিত হয় ১৯৬৮-এর জানুয়ারীতে। কিন্তু তার ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা’য় (প্রকাশক : পড়ুয়া, প্রকাশকাল : মার্চ ১৯৯৭) তিনি লেখেছেন যে, এটা গঠনের প্রক্রিয়া চলছিল ১৯৬৮-এর ফেব্রুয়ারী থেকে এবং এটা গঠিত হয় ১৯৬৮-এর এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে। আমার এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল যে, পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের গঠনের মাসটা ছিল জুন। গোটা প্রক্রিয়ার মূল উদ্যোক্তা এবং সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীরও মূল প্রণেতা আমি হলেও কোনও দলিলপত্র না থাকায় মাসের ব্যাপারটা এখন অনিশ্চিত অনুমানের ব্যাপার মাত্র। তবে আমজাদ তার সাম্প্রতিক তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা’য় যেভাবে সময়টাকে উপস্থিত করেছেন আমার মনে হয় সেটাকে মেনে নেওয়াই আমার উচিত হবে। সুতরাং আমিও পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠনের সময় হিসাবে ১৯৬৮-এর এপ্রিল মাস উল্লেখ করেছি।
_______________________________________________________________________________________________
তবে কয়েক দিন পরে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মাহবুব উল্লাহ এবং আমার এক তিক্ততাপূর্ণ বৈঠকে নূরুল হাসান আমাদের সংগঠনে সিরাজ শিকদারের এজেন্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে আমরা তাকে বাদ দিই।
যাইহোক, সিরাজ শিকদারের তখনকার সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন-এর রাজনীতির সঙ্গে আমাদের রাজনীতির দু’টো পার্থক্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, আমরা প্রকাশ্য ও গোপন কাজের সমন্বয় চেয়েছিলাম। এই দুই পদ্ধতির সমন্বয়ের মাধ্যমে গণ-অভ্যুথানকে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করে আমরা স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলাম। দ্বিতীয়ত, আমরা পাকিস্তানবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলাম। অর্থাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুধু বাঙ্গালীর উপর জাতিগত নিপীড়নের কারণে নয় একই সঙ্গে তার ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিটাকে ধ্বংস করে একটা সেকিউলার সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনবোধ থেকেও। এই কারণে খসড়া ঘোষণাপত্রে আমরা ‘পাকিস্তানবাদ’ শব্দটা ব্যবহার করলাম।
পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠন করার ফলে সিরাজ শিকাদারের সংগঠনের বিস্তার রোধ হলেও বিপদটা থেকেই গিয়েছিল। এবং সবচেয়ে বড় কথা প্রকাশ্যে জাতীয় রাজনীতি তথা ন্যাপে কোনও ভূমিকা রাখতে না পারলে কিংবা নিজেরা ঢাকা থেকে এই ধরনের কোনও উদ্যোগ নিতে না পারলে তরুণ প্রজন্মকে আমরা রক্ষা করতে পারব কিনা সে ব্যাপারে আমি খুব সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু সে ধরনের কোনও ভূমিকা নিতে কিংবা উদ্যোগ নিতে পারার অবস্থাটাও দেখছিলাম না। সম্পাদকের পদ গ্রহণ করলেও আবুল কাসেম ফজলুল হক থাকতেন নিষ্ক্রিয়। তরুণ আমজাদ হোসেন তখন যশোরে কৃষক সংগঠনের কর্মী। আমি বৃহত্তর দিনাজপুরে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলায় ব্যস্ত। একা তরুণ ছাত্র নেতা মাহবুব উল্লাহর পক্ষে এত প্রতিকূলতার ভিতর টিকে থাকা যে দুরূহ হবে আমার তা মনে হচ্ছিল।
সুতরাং ১৯৬৮-এর শেষ দিকে দেবেন-মতিন-আলাউদ্দিন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলে আমি আমাদের সংগঠনের সম্মতি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং আলোচনা শুরু করলাম। এখানে বলে রাখা ভাল আবদুল মতিন এবং আলাউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আমার অনেক পূর্ব থেকেই পরিচয় এবং সম্পর্ক ছিল। এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যও ছিল। যাইহোক, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা এবং কৃষি বিপ্লব এই দুই মূল নীতিতে মতৈক্য হলে আমরা তাঁদের সঙ্গে ঐক্যের সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ১৯৬৯-এর মে-তে। এবং তাঁরা তখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির খসড়া ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচী তৈরী করেন আমাদের নিয়ে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তাঁরা আমাদের চারজনের মধ্যে আমজাদ হোসেন এবং মাহবুব উল্লাহকে তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে যে প্রক্রিয়ায় আমাদের ঐক্য সম্পন্ন হয় তাতে সেটা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আমাদের যোগদানে পরিণত হয়।
এরপর থেকে আমি আর খুব বেশী জাতীয় রাজনীতির বিষয়ে মাথা ঘামাবার সুযোগ পাই নি। ঢাকার ছাত্রদের সঙ্গে আমার যোগাযোগও কমে আসে। কারণ নেতারা সেটা ভয়ানক অপছন্দ করতেন এবং তা জানাতেন। আমি তখন বৃহত্তর রংপুর জেলায় কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম এবং তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৬৯-এর ১৭ জুলাই দেবেন শিকদার গ্রেপ্তার হন* এবং আবদুল মতিন তখন পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমার তখন যোগাযোগটা মূলত তাঁদের সঙ্গেই হত। কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমার ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল না। তবে যখন যোগাযোগ হত তখন আমি বিভিন্ন প্রশ্নে প্রধানত আলাউদ্দিন আহমদ এবং আবদুল মতিনকে আমার মতামত জানাতাম। বিশেষ করে আলাউদ্দিন আহমদকে। কারণ আবদুল মতিনের মাধ্যমে সমগ্র পার্টিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতেন তিনি। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছিলাম যে, আবদুল মতিনকে নীতিগত প্রশ্নে কোনো কিছু বলাটা ছিল অর্থহীন। আলাউদ্দিন আহমদ যা বলতেন তা হত।
যাইহোক, নেতৃত্বের সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য সব সময়ই ছিল এবং বিভিন্ন প্রশ্নে আমার মত বিশেষত আলাউদ্দিন আহমদকে জানাতাম। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, আমার অনেক দ্বিধা ও সংশয় থাকলেও আমাকে কাজ করতে হত নেতাদের তৈরী কাঠামোর ভিতর। কাজ করতাম। কি পরিমাণে করতাম সেটা সেকালে আমাকে যাঁরা জানতেন তাঁরা জানেন। এই সঙ্গে আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করব যে, জাতীয় রাজনীতির মূল স্রোত বিশেষ করে রাজধানী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘ কাল গ্রামে থেকে আন্দোলন ও রাজনীতি করায় আমার চিন্তার স্বচ্ছতাও এই সময় কমে আসছিল। বিশেষত বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে আমার ভিন্ন মত নেতারা জানতেন বলে আমার প্রতি তাঁদের এমন এক আক্রমণাত্মক মনোভাব বিভিন্ন সময়ে ব্যক্ত করতেন যা আমাকে খুব আহত করত। এর ফলে ধীরে ধীরে আমার আত্মবিশ্বাসও এই সময় কমছিল এ কথাও স্বীকার করব। নেতৃত্বের সততা ও আন্তরিকতায় বিশ্বাস করতাম বলে আমি তাঁদেরকেই শুধু বোঝাতে চাইতাম। পার্টির নীচের দিকে কাউকে বুঝতে দিতে চাইতাম না। কারণ ঐ সময় আমি মনে করতাম এমন কিছু বলা বা করা উচিত নয় যা পার্টির কর্মীদের হতাশ করতে এবং পার্টিতে ভাঙ্গনের সম্ভাবনা উপস্থিত করতে পারে।
তবে আমার সেই সময় এক বিরাট আনন্দ ছিল এইটি যে, ন্যাপের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোকে আমরা তখন ঝড়ের গতিতে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে বিস্তৃত করতে এবং সেগুলোকে স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ছাড়বার কাজে ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। আমরা বলতে এখানে আমি ষাটের দশকের বামপন্থী ছাত্র-তরুণ প্রজন্মের কথা বোঝাচ্ছি।
এর পর এল ১৯৭০-এর জুলাই। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস**। তখনকার পাবনা জেলার গ্রামাঞ্চলে। জয়নগরে। সেখানে আমি উপস্থিত হলাম।
_______________________________________________________________________________________________
* আমজাদ হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা। পৃ: ৮১।
**আমজাদ হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের রূপরেখা। পৃ: ৮২।
_______________________________________________________________________________________________
অবস্থা তখন সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফাও তখন আওয়ামী লীগের ৬ দফার জোয়ারে তলিয়ে গেছে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের কর্মসূচী নেই। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচী বাস্তবে স্লোগান ছাড়া আর কিছু ছিল না। মূলত অর্থনৈতিক দাবী ভিত্তিক যেসব আন্দোলন ও সংগঠন পার্টির নির্দেশে ও পরিচালনায় গড়ে তোলা হয়েছিল সেগুলো তখন গতিহীন। সামনে এগিয়ে আসছে সাধারণ নির্বাচন। আসলে তখন পার্টির মূল কাজ হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা। তবে ছাত্র-তরুণ প্রজন্ম এরই পাশে ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ স্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছিল।
শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনেও অবস্থাটা তাই। এটা আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবীভিত্তিক আন্দোলনেরই গতিবেগ বাড়াচ্ছিল এবং তার মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা সঞ্চারিত করছিল। বস্তুত ’৭০-এর জুলাইতে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে উপস্থিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমিও সঙ্কটটা বুঝলাম।
একটা বিষয়ে আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, পার্টির গণ-ভিত্তিকে বিশেষত কৃষক ভিত্তিকে গণ-অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অবস্থায় নেবার কোনো বাস্তবতা নেই। আমাদের পার্টির অবস্থা এমনই স্থবির। এই বিষয়টাও আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, সমগ্র জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে চলে গেছে। নেতারা যতই বাগাড়ম্বর করুন এটা আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, পার্টি জাতীয় আন্দোলনের উপর সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এর জন্য যে নেতৃত্বের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বা চক্রান্ত কাজ করছিল তা অবশ্য ভাবি নি। আসলে নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা ও অযোগ্যতার অনেক দিক আমার কাছে স্পষ্ট থাকলেও তাঁদের উদ্দেশ্যের সততায় আমার বিশ্বাস ছিল।
কিন্তু আমি বুঝলাম যে নেতৃত্ব যে পথে পার্টিকে নিয়ে গেছেন তার পরিণতি হবে চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা। পার্টির লক্ষ্য স্বাধীনতা হলেও জাতীয় কর্মসূচী ব্যতিরেকে কৃষক-শ্রমিকের পেশাভিত্তিক শ্রেণী সংগ্রামের অর্থনীতিবাদী প্রয়োগটাই নেতৃত্ব বুঝতেন। সেইভাবে তাঁরা পার্টিকে ইতিমধ্যে গুছিয়েছেন।
আমি পার্টির ভবিষ্যৎ দেখতে পেলাম। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় গোটা পার্টি এবং তার বিশাল সংগঠনিক কাঠামো মূলত নিষ্ক্রিয় রইবে। কারণ আলাউদ্দিন-মতিন মুখে যা-ই বলুন আওয়ামী লীগের জোয়ার ঠেকাবার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না।
আর একটা বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, শ্রেণী সংগ্রামের নামে পার্টি অর্থনীতিবাদী পদ্ধতিতে যে গণ-সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলেছে তা একটা বিপ্লবী যুদ্ধ শুরুর পথে এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই বিষয়ও আমার কাছে স্পষ্ট হল যে, যদি এই ধরনের গণ-ভিত্তি থেকে পার্টিকে মুক্ত করা না যায় এবং তাকে যুদ্ধের জন্য পুনর্সংগঠিত করা না যায় তবে এই পার্টি যুদ্ধে যাবে না এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় গণ-সংগঠনের বিরাট নেটওয়ার্কটাকে চালু করে বিপ্লবের নামে অসংখ্য কর্মীকে পথভ্রষ্ট করে চলবে এবং এ দেশে বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে থাকবে।
এই সময় চারু মজুমদারের কয়েকটা লেখা পড়ে আমি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে পার্টিকে নিয়ে যাবার একটা পথ দেখতে পেলাম। এখানে বলে রাখা ভাল যে, ইতিপূর্বে ১৯৭০ সালের এপ্রিল মাসে হক-তোয়াহা নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) গণ-লাইন বর্জন করে এবং ন্যাপ সহ সকল প্রকাশ্য সংগঠন থেকে সরে যায়। এবং এরপর তারা চারু মজুমদারের শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন অনুযায়ী সংগঠন গড়ে তোলার কাজ চালাচ্ছিল। তবে আমি ১৯৭০-এর জুলাইতে পার্টি কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে দেশের রাজনীতি ও পার্টির সামগ্রিক পরিস্থিতি বোঝার পূর্ব পর্যন্ত এই ধরনের লাইনের ঘোর বিরোধী ছিলাম।
আমি পার্টি কংগ্রেসে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চারু মজুমদারের পদ্ধতিকে আমাদের দেশের বাস্তবতায় কিভাবে প্রয়োগ করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তোলা যেতে পারে সে সম্পর্কে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিলাম। আমি বললাম কৃষক-শ্রমিকের গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে আমাদের পক্ষে আর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা সম্ভব নয়। সুতরাং গণ-সংগঠনের প্রকাশ্য কাজ আমাদের বন্ধ করার কথা ভাবতে হবে।
আমি বললাম জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমাদেরকে ঘাঁটি এলাকা তৈরী করতে হবে। এই কাজ করার জন্য এত দিনকার কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় যারা কৃষক জনগণের ঘৃণ্য শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে এবং জনগণ যাদের মৃত্যু চাইবে শুধুমাত্র তাদেরকেই হত্যা করা যাবে। এবং কৃষকের বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে এখানে বলা দরকার যে, বিশেষত ১৯৬৯-এর কৃষক অভ্যুথানে আমার নিজের অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলাম যে, গ্রামাঞ্চলে কৃষক জনগণ যাদেরকে শত্রু মনে করে তারা জোতদার-মহাজন হবে এমন নয়। তারা বরং গরুচোর, ডাকাত, দুর্বৃত্ত, অত্যাচারী জোতদার-মহাজন, অত্যাচারী চেয়ারম্যান-মেম্বার, ঘুষখোর ও অত্যাচারী পুলিশ ইত্যাদিকে শত্রু মনে করে। আমি এদেরকে কৃষকের শ্রেণী শত্রু হিসাবে উল্লেখ করলাম। অর্থাৎ শ্রেণীর অর্থনৈতিক দিকটা আমার কাছে মুখ্য ছিল না।
এখানে আর একটু বলা দরকার যে, এ দেশে কৃষকের শ্রেণী সংগ্রামের এই বৈশিষ্ট্যের দিকটা আমি আমাদের নেতৃত্বের সামনে বিভিন্নভাবে তুলে ধরতাম। কিন্তু তাঁরা কখনই আমার বক্তব্যকে গুরুত্ব দেন নি। বরং আমার ধারণাকে নানানভাবে নাকচ করার চেষ্টা করতেন। আসলে যাঁরা ১৯৬৯-এর কৃষক আন্দোলন করেন নি, ঐ সময় একটি কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা দূরের কথা তৈরী আন্দোলনেও অংশ নেন নি তাঁরা কিভাবে ’৬৯-এর কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিবেন? তাঁরা তো ছিলেন উপর তলার নেতা। সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা জোতদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষকদের স্থানীয় পর্যায়ের আন্দোলনের বাইরে আর কোনও আন্দোলনকে শ্রেণী সংগ্রামের মর্যাদা দিতে রাজী ছিলেন না। সুতরাং ১৯৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মধ্যে গরুচোর-ডাকাত এবং গ্রামীণ দুর্বৃত্ত ও অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা দেশে বিস্ফোরিত কৃষক জনগণের সংগ্রামের প্রতি তাদের একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। এটা খুব লক্ষণীয় যে, ’৬৯-এর কৃষক অভ্যুথান সেইসব এলাকাতেই মূলত সংঘটিত হয়েছিল যেসব এলাকায় ঐতিহ্যিক কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন ছিল না অথবা থাকলেও অত্যন্ত দুর্বল ছিল। অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণহীন জায়গাগুলোতেই কৃষক অভ্যুথান স্থানীয় অত্যাচারী-দুর্বৃত্ত ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পূর্ণ রূপ নিতে পেরেছিল।
আমার দৃষ্টিভঙ্গী অবশ্যই ঐ ধরনের কমিউনিস্টদের মত ছিল না। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের মধ্য থেকে আমি শিক্ষা নিতে চেয়েছিলাম। আমি ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানে তখনকার দিনাজপুরের গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুললে একটি সীমান্ত এলাকায় ইপিআর বাহিনীর দীর্ঘ দিনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে এবং ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষ বাধে। সুতরাং আমার অভিজ্ঞতার বিচারে কৃষকের শ্রেণী শত্রুই যদি কাউকে বলতে হয় তবে সেই এলাকায় সেটা ছিল ঐ ইপিআর-রা।
যাইহোক, অনেক কাল হয়ে গেলেও সেদিন ঐ পার্টি কংগ্রেসে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের অনেকে হয়তো কৃষকের শ্রেণীশত্রু সম্পর্কে আমার বিস্তারিত ব্যাখ্যাগুলো এবং তাদের বিরুদ্ধে খতমের পদ্ধতি প্রয়োগ সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা কিছুটা হলেও আজো স্মরণ করতে পারবেন। এবং নিশ্চয় স্মরণ করতে পারবেন যে, আমি সমস্ত লাইন বা কর্মনীতিকে উপস্থিত করলাম জাতীয় রাজনৈতিক লাইনের অংশ হিসাবে যার কেন্দ্রবিন্দুটা হল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।
আমি আরো বলাম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কৃষকের যুদ্ধও শ্রেণী সংগ্রামেরই শুধু অংশ নয়, উপরন্ত সেটাও এক রূপের শ্রেণী সংগ্রাম। আমি বলাম কৃষক যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তখন সেটা শ্রেণী সংগ্রাম। সুতরাং জাতীয় সংগ্রাম শ্রেণী সংগ্রামের বিপরীত কিছু নয়।
শ্রেণী সংগ্রাম এবং জাতীয় সংগ্রামের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পর্কে আমি মাও-এর বক্তব্যও তুলে ধরলাম যেখানে তিনি জাতীয় সংগ্রামকে শ্রেণী সংগ্রামের অংশ বলেছেন।
সেদিন যাঁরা ঐ কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা আশা করি পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য একটা পদ্ধতির প্রয়োগ সম্পর্কে আমার কিছু কথা আজো স্মরণ করতে পারবেন। আসলে ঐ সময় আমার সামনে এই পার্টিকে জাতীয় যুদ্ধে নিয়ে যাবার আর কোনও পথ খোলা দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাজেই চারু মজুমদারের লাইনকে আমি জাতীয় যুদ্ধ শুরুর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যায় কিনা সেটা ভাবতে বললাম।
আসলে ঐ পার্টি নেতৃত্ব শ্রেণী এবং শ্রেণী সংগ্রাম এই শব্দ দু’টো ছাড়া আর কিছু বুঝতেন না। এবং সেটাও অর্থনীতিবাদী এবং সম্পূর্ণ কেতাবী যার সঙ্গে আমাদের দেশের বাস্তবতার সম্পর্ক অতি ক্ষীণ অথবা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এবং তাঁদের এই ধারণার বিস্তার ঘটিয়ে তাঁরা পার্টিকে অনেকাংশেই আচ্ছন্ন করেছেন, যদিও জাতীয় সংগ্রামের চেতনাকে ভেঙ্গে ফেলতে পারেন নি। সুতরাং আমি বুঝলাম যে, শ্রেণী ছাড়া যাঁরা আর কিছু বোঝেন না এবং গোটা পার্টিকেও সেইভাবে গড়ে তুলেছেন তাঁদেরকে জাতীয় যুদ্ধে নিতে হলে চারু মজুমদারকে হাতিয়ার করতে হবে। বিশেষ করে সেই সময় চারু মজুমদারের ব্যাপক প্রভাব আমাদের দেশের বাম আন্দোলনে এসে পড়েছে। নকশালবাড়ী কৃষক অভ্যুথানের পর চীন তাঁকে সমর্থন দেওয়ায় সেটা হয়েছিল খুবই প্রবল। সুতরাং চীনাপন্থী হওয়ায় পার্টি নেতৃত্বের পক্ষে সঙ্কট ও ক্ষোভের সেই সময় চারু মজুমদারের লাইনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সুকঠিন ছিল। আর এই বাস্তবতায় আমি চীনের প্রতি অন্ধত্বকে মোকাবিলা করার এবং বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে ঠেলে দেবার হাতিয়ার হিসাবে চারু মজুমদারের লাইনকে দেখতে পেলাম।
তবে ঐ কংগ্রেসে চারু মজুমদারের লাইনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হল না। বিষয়টাকে আমরা বিবেচনার জন্য রাখলাম।
যাইহোক, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের প্রায় সোয়া এক বৎসর পর ঐ কংগ্রেসে আমি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হই।
ইতিমধ্যে ১৯৭০-এর নির্বাচন ঘনিয়ে এল। নির্বাচন হয় ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর। পার্টি সিদ্ধান্ত নিল যে, তা নির্বাচন বানচাল করবে। তখন আমি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আমি বললাম যে, এটা অবাস্তব সিদ্ধান্ত। আমরা বড়ো জোর নির্বাচন বর্জন করতে পারি। আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জিতবে। সেটা ঠেকানো সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। পার্টি নেতৃত্ব আমার উপর অসন্তুষ্ট হতেন। আমার এখন ধারণা পার্টির মূল নিয়ন্তা আলাউদ্দিন আহমদ সেটা বুঝতেন না তা নয়। কারণ যেমন অর্থেই হোক তাঁর তীক্ষ্ম বুদ্ধি ছিল। সুতরাং আমার ধারণা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কর্মীদের সম্পর্ককে অধিকতর তিক্ত করা এবং তাদেরকে একটা অর্থহীন কাজে ব্যস্ত রেখে সময় কাটানো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
যাইহোক, ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বরে নির্বাচন হয়ে গেলে আমি নিশ্চিত হলাম যে, এখন পাকিস্তানের সঙ্গে বাঙ্গালী জাতির যুদ্ধ অত্যাসন্ন অথবা অত্যাসন্ন করা সম্ভব। কিংবা বলা উচিত আমি সেটাকে আমাদের পার্টির নেতৃত্বে অনিবার্য করতে চেয়েছিলাম। সুতরাং আমি পার্টি নেতৃত্বকে আর সময় দিতে চাইলাম না। এবং তাকে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার হাতিয়ার হল চারু মজুমদারের লাইন। আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আমজাদ হোসেন সমর্থন দিলেন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, পার্টির জুলাই কংগ্রেসে চারু মজুমদারের লাইনের প্রশ্নে তিনি আমাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। এবার আমার উদ্যোগে ব্যাপক কর্মীদের মধ্যে বিদ্রোহ ঘটলে প্রচণ্ড চাপের মুখে নেতৃত্ব এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য পার্টির বিশেষ কংগ্রেস ডাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ কংগ্রেস গোপনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হল ১৯৭০-এর ৩০, ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারী এই তিন দিন। এই বিশেষ কংগ্রেসে আমি জাতীয় যুদ্ধ শুরুর উদ্দেশ্যে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণ করার দাবী জানালাম।
কিন্তু আমজাদ হোসেন অন্ধভাবে চারু মজুমদারের লাইনকে সমর্থন করলেন। তিনি বিশেষ কংগ্রেসে বললেন, ‘একলব্য যেমন দ্রোণাচার্যকে না দেখেও তাঁকে গুরু মেনে তাঁর কল্পিত মূর্তির ধ্যান করে ধনূর্বিদ্যা শিখেছিল আমরা তেমন চারু মজুমদারের লাইন অনুসরণ করে এ দেশে বিপ্লব করব।’
আমার দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে আমজাদের পার্থক্য ছিল মৌলিক। আমার কাছে চারু মজুমদারের লাইন ছিল তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাবার হাতিয়ার। ঐ পদ্ধতির সাময়িক ও সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে আমি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলাম। আর আমজাদের কাছে ছিল সেটা শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনার হাতিয়ার যার সঙ্গে জাতীয় সংগ্রামের আর কোনও সম্পর্ক ছিল না। অন্যদিকে তিনি চেয়েছিলেন চারু মজুমদারকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে। তবু ঐ সময় পার্টির অর্থনীতিবাদী ও সংস্কারবাদী পন্থাকে আঘাত ও বিনষ্ট করাকেই আমার জন্য প্রধান করণীয় মনে করেছিলাম। যে কারণে ঐ মুহূর্তে আমজাদের সঙ্গে ঐক্য বিনষ্ট না করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর পন্থা হিসাবে পার্টিতে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণ করানোকেই প্রধান করণীয় মনে করেছিলাম। ফলে অন্তত বিশেষ কংগ্রেসে আমজাদের সঙ্গে চারু মজুমদারের লাইনের প্রশ্নে বিতর্কে যেতে চাই নি। কারণ তা হলে পার্টির নেতারা চারু মজুমদারের লাইনকে প্রতিহত করার সুযোগ পেতেন।
পার্টি নেতৃত্বের মূল অংশ গণ-লাইন অব্যাহত রাখতে চাইলেন। কিন্তু প্রচণ্ড চাপের মুখে পাশে চারু মজুমদারের লাইনও গ্রহণ করলেন। বিশেষ কংগ্রেসে এই আপোস ফর্মুলা অনুযায়ী এক পার্টিতে দু’টো সম্পূর্ণ পরস্পর-বিরোধী লাইন গ্রহণ করা হল। তবে আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হল। আলাউদ্দিন আহমদ আমাকে সভায় বললেন, ‘আমি মনে করি আপনি এখনও ছাত্র আছেন। আপনার কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা উচিত নয়। আপনার আরও কিছু দিন সাধারণ কর্মী হিসাবে রাজনীতি শেখা উচিত।’ আমি তাঁর কথা বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলাম। নেতৃত্বের জন্য নিজেকে তুলে ধরার স্বভাবটা আমার মধ্যে ছিল না। তবে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ম হল, যে ব্যক্তির লাইন পার্টিতে গৃহীত হয় তাকে পার্টির নেতৃত্ব দেওয়া। যাইহোক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আমজাদ হোসেনকে চারু মজুমদারের লাইন প্রয়োগের মূল দায়িত্ব দেওয়া হল। এবং যারা এই লাইন সমর্থন করবে তাদেরকে নিজ নিজ এলাকায় সেটা করতে বলা হল। পার্টির সম্পাদক থাকলেন আবদুল মতিন।
এখানে আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা উল্লেখ করা দরকার যে, এই বিশেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েকদিন পূর্বে ১৯৭০-এর ২৩ ডিসেম্বরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অজান্তে এবং পার্টির মূল নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্ত বলে অথবা তাঁদের জ্ঞাতসারে ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসাবে নির্বাচিত পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আহমদ রফিককে হত্যা করা হয়। অথচ তাঁরা তখনও এই লাইনের বিরোধী ছিলেন এবং পার্টিতেও এই লাইন গৃহীত হয় নি। আমি ১৯৭০-এর জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হবার পর ক্রমে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণের উপর জোর দিলেও তাঁরা তার বিরোধিতা করতেন। অথচ তাঁরা আমার এবং আমজাদের চাপে বিশেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক দিন আগে আমাদের অজান্তে আহমদ রফিককে হত্যা করান।
এই হত্যাকাণ্ডে পার্টিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এই ঘটনা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রমিক নেতা আবুল বাশারসহ অনেককেই মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করে। আমজাদ এবং আমি ক্রুদ্ধভাবে আলাউদ্দিন আহমদের নিকট এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানালাম। কিন্তু তাঁর ভাষায় নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আহমদ রফিক শ্রেণীশত্রু। পাঠক খেয়াল করবেন তাঁরা কিন্তু তখনও চারু মজুমদারের লাইনের বিরুদ্ধে রয়েছেন।
এখন নিম্নলিখিত ঘটনা কয়টির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক :
(১) ১৯৬৯-এর মে মাসে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আমরা অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন যোগ দিলে আমজাদ হোসেন এবং মাহবুব উল্লাহকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেওয়া হল। কিন্তু আমাকে বাদ রাখা হল।
(২) ১৯৬৯-এর জুলাইতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক দেবেন শিকদার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে গেলেন।
(৩) ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঢাকার প্রকাশ্য জনসভায় স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। এবং তার কিছু দিন পর ’৭০-এর ২১ মার্চে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ পুলিশের হাতে বন্দী হয়ে কারারুদ্ধ হন। ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, স্বাধীনতার এই কর্মসূচী ঘোষণার ফলে সামরিক আদালত কাজী জাফর আহমদ এবং রাশেদ খান মেননকে সাত বৎসর এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার এবং সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহকে এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে। মাহবুব উল্লাহ ধরা পড়ে জেলে গেলেও বাকীরা আত্মগোপন করেন। এই অবস্থায় ১৯৭০-এর ২৪ এপ্রিল তারিখে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারীরা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান করে এবং সেখানে সংগঠনের নামকরণ করা হয় পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন। সেখানে কারারুদ্ধ মাহবুব উল্লাহকে সভাপতি এবং নাজমুল হক নান্নুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়।
(৪) ১৯৭০-এর জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় যুদ্ধ গড়ে তোলার একটা পদ্ধতি হিসাবে চারু মজুমদারের লাইনকে সৃজনশীলভাবে ব্যবহারের তাৎপর্য তুলে ধরলাম। এবং কেবলমাত্র সেই সময় আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেওয়া হল।
(৫) ১৯৭০-এর ২৩ ডিসেম্বর মূল নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আহমদ রফিককে শ্রেণীশত্রু চিহ্নিত করে হত্যা করলেন যাঁরা তখন পর্যন্ত চারু মজুমদারের শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন বিরোধী ছিলেন।
(৬) পার্টির বিশেষ কংগ্রেসে ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারীতে চারু মজুমদারের লাইনকে পার্টির অন্যতম লাইন হিসাবে নেওয়া হল এবং আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হল এবং যে আমজাদ হোসেন আমাকে প্রথমে মাত্র সমর্থন করেছিলেন এবং পরে চারু মজুমদারের লাইনকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে চাইলেন তাঁকে পার্টির নেতৃত্ব নিজেরা এই লাইনের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখলেন এবং তাঁকে এই লাইন প্রয়োগের মূল দায়িত্ব দিলেন।
এখন আমি বহুকাল পর এই ঘটনাগুলোর মধ্যে খুব সংক্ষেপে একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে চেষ্টা করব।
(১) দেবেন-মতিন-আলাউদ্দিন আমার ভূমিকার কথা জানতেন। বিশেষ করে মতিন-আলাউদ্দিন দীর্ঘকাল ধরে আমার পরিচিতি ছিলেন। তাঁরা আমার স্বাধীন চিন্তা এবং তরুণ প্রজন্মের উপর আমার প্রভাব সম্পর্কে অবগত ছিলেন। এবং এই প্রজন্মকে মূলত আমি তাঁদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। তাঁরা জানতেন বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমার সংকল্পের দৃঢ়তার কথা। এবং তাঁরা এও জানতেন যে, আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাখা হলে আমি আমার চিন্তা ও ভূমিকা দিয়ে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করব। সুতরাং তাঁরা আমাকে প্রথমেই বাদ দিলেন।
(২) দেবেন শিকদার পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্পাদক। তিনি ছিলেন পুরাতন শ্রমিক নেতা। তিনি সুদীর্ঘ কাল আত্মগোপন করে থেকে চট্টগ্রামের শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনা করতেন। তাঁরা যোগ্যতা, শিক্ষা এবং রাজনৈতিক সততা সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করব না। তবে তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন। ১৯৬৯-এর প্রথমার্ধে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির খসড়া ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচী তৈরী হলে তাতে স্বাধীনতার প্রশ্ন জোরালোভাবে এসেছিল। এর কয়েক মাস পর তিনি গ্রেফতার হন। স্বাভাবিকভাবে আবদুল মতিন পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন, যাঁকে চালাতেন আলাউদ্দিন আহমদ। এইভাবে পার্টির নিয়ন্ত্রণ মূলত আলাউদ্দিন আহমদের হাতে চলে গেল।
(৩) মাহবুব উল্লাহ জেলে যাবার এবং মোস্তফা জামাল হায়দার গ্রেফতারী পরোয়ানা ও কারাদণ্ডাদেশের কারণে আত্মগোপন করার ফলে স্বাধীনতকামী বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলন মূলত নেতৃত্বহীন হল। পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন নাজমুল হক নান্নু। তিনি ছিলেন পাবনার স্থানীয় ছাত্র নেতা এবং আলাউদ্দিন আহমদের বাছাই। তাঁকে আলাউদ্দিন-মতিন পাবনা থেকে এনে পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন। ফলে পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন এখন পুরোপুরি আলাউদ্দিন-মতিনের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল। অন্যদিকে এই ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আর এক দফা বিভক্ত হল। কারারুদ্ধ মাহবুব উল্লাহর নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর অংশ গঠন করল পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন এবং আত্মগোপনকারী মোস্তফা জামাল হায়দার নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্রতর অংশ গঠন করল বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন।
(৪) ১৯৭০-এর জুলাই পর্যন্ত প্রায় সোয়া এক বৎসর পার্টির নেতারা আমার গুরুত্ব বুঝলেন না। কিন্তু আমি যখন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তোলার জন্য একটা পদ্ধতি হিসাবে চারু মজুমদারের লাইনকে বিবেচনায় নিতে বললাম এবং আমার বক্তব্য ও যুক্তি দিয়ে গোটা কংগ্রেসকে প্রভাবিত করলাম তখন তাঁরা আমার গুরুত্ব বুঝলেন এবং বুঝলেন যে আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির বাইরে রাখা তাঁদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। সুতরাং তাঁরা নূতন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবে আমার নাম প্রস্তাব করলেন। হয়তো এই সম্ভাবনার কথা তাঁরা ভেবেছিলেন যে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেয়ে আমি খুশী হয়ে বসে থাকব এবং পার্টিকে জাতীয় যুদ্ধে নেবার চেষ্টা আর করব না।
(৫) ঐ রকম এক মুহূর্তে আহমদ রফিকের মত একজন গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করার পরিণতি কি হতে পারে এটা না বোঝার মত নির্বোধ পার্টির নেতারা ছিলেন না। তাঁরা জানতেন পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাপক ও বিশাল কর্মী বাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার জন্য অস্থির হয়ে আছে। সুতরাং তাঁরা আসন্ন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেই এমন একটা কাজ করলেন যাতে বামপন্থী আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কটা এমন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছায় যাতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তির বিভক্তির ফলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ না ঘটে আর ঘটলেও যাতে সেটা দুর্বল ও খর্ব হয়।
(৬) ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারীতে পার্টি নেতৃত্ব চারু মজুমদারের লাইনকে পার্টির অন্যতম লাইন হিসাবে নিলেন ঠিকই তবে সেটা পার্টিকে বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। আর এই কারণে তাঁরা আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরিয়ে দিলেন এবং আমজাদকে এই লাইনে কাজ করার দায়িত্ব দিলেন।
এখানেই শেষ নয়। জাতীয় যুদ্ধের ভিতর ১৯৭১-এর জুন মাসে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক বর্ধিত সভায় চারু মজুমদারের লাইনকে পার্টির একমাত্র লাইন হিসাবে গ্রহণ করা হল এবং আমজাদকে পার্টির সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়া হল এবং সম্পূর্ণ অবৈধভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির গুটি কয়েক ব্যক্তি সহ কয়েকজন (সম্ভবত তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন পাঁচজন। যুদ্ধ শুরু হলে দেবেন শিকদার, আবুল বাশার প্রমুখ ভারতে যান এবং স্বতন্ত্রভাবে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ গড়ার কাজ শুরু করেন) পার্টির নাম বদল করলেন এবং তার নাম রাখলেন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এইভাবে যেটা হতে পারত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পার্টি সেটাকে তাঁরা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে বিভক্ত করার পার্টিতে পরিণত করলেন। ফলে এল দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের নীতি।
তাঁরা জানতেন যে, এই পথে পার্টি ধ্বংস হবে। তাঁরা নেতৃত্ব দেবার ক্ষেত্রে আমজাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কথা পূর্ব থেকেই জানতেন। সুতরাং তাঁরা তাকেই পার্টি ধ্বংসের হাতিয়ার করলেন। এইভাবে আমার কৈশোরের বন্ধু আমজাদ যাকে আমি স্কুল জীবন থেকেই বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতাম এবং যাকে নিয়ে সেই যুগে অতি বিপদজনক এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনেক গোপন পরিকল্পনা করতাম এবং আমার জীবনের অনেক শ্রম ও সময় যার পিছনে দীর্ঘ কাল ব্যয় করেছিলাম তাকে তার সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা দাঁড় করালেন আমাদের সেই অভিন্ন স্বপ্নের বিরুদ্ধে এবং আমারও বিরুদ্ধে। পার্টিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে নেওয়া আর হল না। ভ্রান্ত রাজনীতির পরিণতিতে পার্টি ধ্বংস হল। কিন্তু পরবর্তী কালে সমস্ত ভ্রান্তি আর ধ্বংসের দায় মূলত এনে ফেলা হল আমার উপর।
সঙ্গত কারণেই বাইরের সবার সেটা বিশ্বাস করার কারণ ছিল। কারণ পার্টিতে এই লাইন যে, শুধু আমিই প্রথম উথাপন করি তা-ই নয়, উপরন্তু আমার উদ্যোগ ও ভূমিকার ফলেই এই লাইন পার্টির বিশেষ কংগ্রেসে ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারীতে গৃহীত হয়। কিন্তু যে বিষয়টা অজ্ঞাত রইল সেটা হল এই লাইনকে কেন, কোন পরিস্থিতিতে, কিভাবে এবং কতটুকু প্রয়োগ করতে আমি বলেছিলাম এবং চেয়েছিলাম সেটা। কারণ সেই সুযোগ আমার আর তখন থাকে নি যখন পার্টি নেতৃত্ব আমাকে পার্টির কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়ে এই লাইনের প্রতি অন্ধ আমজাদকে তা প্রয়োগের দায়িত্ব দিলেন। এরপর বস্তুত আমি পার্টির ভিতর সমস্ত ঘটনাধারার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাই এবং মূলত একা হয়ে পড়ি। তবু আমি পার্টিকে জাতীয় যুদ্ধে নেবার প্রচেষ্টা শুরু করি। এই উদ্দেশ্যে আমি ১৯৭১-এ তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভ্রমণ করি।
’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আমি তাকে পাকিস্তানের তুলনায় এক বিরাট অগ্রগমন হিসাবে বিবেচনা করি এবং পার্টির লাইন পরিবর্তনের দাবী জানাই। তখন আমি পার্টির রংপুর জেলা কমিটির সম্পাদক। জেলা কমিটি এই ব্যাপারে আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থন জানায়। আমি দাবী করি আমার এবং জেলা কমিটির বক্তব্য পার্টিতে প্রচার করা হোক। এর উত্তরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) আমাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করার কথা ঘোষণা করে এবং রংপুর জেলা কমিটিকে বাতিল করে।
তবে এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, আমি যে পার্টির সদস্য ছিলাম সেটাকে আমি মনে করতাম পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। আমার কাছে ঐ পার্টির মৃত্যু হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে ঐ দিন যেদিন ’৭১-এর জাতীয় যুদ্ধের মধ্যে অধিকাংশ সদস্য ও কর্মীদের সম্মতি ছাড়াই পাবনা-কুষ্টিয়া-যশোর জেলার মুষ্টিমেয় কয়েকজন দ্বারা পার্টির নাম পরিবর্তন করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) করা হয় এবং শুধু শ্রেণী শত্রু খতমের জন্য অন্ধভাবে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণ করা হয়। অর্থাৎ আমার নিজের কাছে পার্টির প্রকৃতপক্ষে আর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তা নিজেই নিজেকে বিলুপ্ত করেছিল। বস্তুত তার সূচনা ছিল ’৭১-এর ১ জানুয়ারী যেদিন পূর্ব বাংলার মুক্তির জন্য জাতীয় সংগ্রামের লক্ষ্য ব্যতিরেকে চারু মজুমদারের লাইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যে আমাকে পার্টির কেন্দ্র থেকে বাদ দেওয়া হয় সেইদিন।
অনেকেই হয়তো সেই স্কুল শিক্ষকের গল্প জানেন যিনি গ্রামের মূর্খদের সভায় প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে ইংরাজী জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় I don’t know-এর সহজ মানেটা সহজভাবে ‘আমি জানি না’ বলায় ইংরাজী না জানার কলঙ্কের বোঝা নিয়ে স্কুল ছেড়ে চলে গেলেন। আমাকে সেই I don’t know-এর মানে বলা শিক্ষকের মত একটা কলঙ্কের বোঝা নিয়ে কমিউনিস্ট রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হল। ধূর্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর কূট বুদ্ধির কাছে আমি হেরে গেলাম। সেই সঙ্গে হারল একটা প্রজন্মও।
এইবার আমরা যদি উপরের ঘটনাগুলোকে মেলাই তবে দেখতে পারব ষাটের দশকে বাম আন্দোলনের নেতৃত্বের ভিতর থেকে কি নিপুণ এক চক্রান্তের জাল বিছানো হয়েছিল এ দেশে বাঙ্গালীর গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তির উথানের বিরুদ্ধে।
কিন্তু তবু আমি আমার উদ্দেশ্য সাধনে এক দিক থেকে সফল ছিলাম বলে বিবেচনা করি। সেটা হল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করায়। যদিও যুদ্ধটা আমাদের পার্টির নেতৃত্বে ঘটানো যায় নি তবু পার্টিতে ঐ মুহূর্তে চারু মজুমদারের লাইন নেবার এক অনিবার্য পরিণতি হল ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ এই হল আমার ধারণা। এই লাইন নেবার ফলে পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে মুজিব-ইয়াহিয়া আপোসের সকল সম্ভাবনা বিনষ্ট হয় এবং একদিকে পাকিস্তানের পক্ষে যেমন বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযান শুরু করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে অপর দিকে তেমন আওয়ামী লীগের পক্ষেও তার মোকাবিলায় জাতীয় যুদ্ধে অংশ নেওয়া ও তাতে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিভাবে, সেটাই এখন সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখাতে চেষ্টা করব। আর তখন দেখা যাবে আমি পার্টিতে হেরে গিয়েও জিতে গেছি।
মনে রাখতে হবে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তখন কার্যত পূর্ব বাংলার বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টি এবং স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী বিশেষত বিপ্লবী ছাত্র-যুব শক্তির ব্যাপকতম অংশটি তখন এই পার্টির নিয়ন্ত্রণে অথবা প্রভাব বলয়ে অবস্থিত। ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ এবং তার সঙ্গেকার ছাত্র, কৃষক ও শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে তা তখন গণ-রাজনীতিতে এক বিশাল শক্তি হিসাবে আবির্ভূত। এই সংগঠনের ভিতর থেকে ঐ রকম এক ক্রান্তিলগ্নে আমরা তার হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থককে বলছি গণ-আন্দোলন বর্জন করে গোপনে চলে যেতে এবং পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে জনযুদ্ধ শুরু করার জন্য শ্রেণীশত্রু খতম করে গ্রামাঞ্চল মুক্ত করতে এবং জনগণের সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে। চারদিকে তখন স্লোগান উঠছে ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’, ‘শ্রেণী শত্রু খতম করো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’ ‘গণবাহিনী গঠন করো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’।
এরই সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছিল কাজী আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির স্বাধীনতার সপক্ষের কার্যকলাপ। তাঁরাও ছিলেন ন্যাপে। অন্যদিকে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে কিছু এলাকায় ছিল তাঁদের উল্লেখযোগ্য শক্তি ও প্রভাব। তাঁরা গণ-সংগঠন বর্জন কিংবা চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণ না করলেও স্বাধীনতার দাবীতে তাঁরাও তখন সোচ্চার ছিলেন, যা স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে যুদ্ধের দিকে নেবার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
যাইহোক, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণের তাৎপর্য স্পষ্ট করার জন্য আমাদের আর একটি বিতর্কের বিষয়ে যেতে হবে। সেটা হল প্রধান দ্বন্দ্বের প্রশ্ন। পার্টিতে একটা দীর্ঘ বিতর্ক ছিল প্রধান দ্বন্দ্বের প্রশ্নে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আমাদের যোগদানের কিছু দিন পর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং শ্রমিক নেতা আবুল বাশার পার্টিতে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসাবে জাতীয় দ্বন্দ্বকে উপস্থিত করেন। আসলে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে প্রধান দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ সিরাজ শিকদার প্রথম উথাপন করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল পূর্ব বাংলায় জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান। সুতরাং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় সংগ্রামের কাজ প্রধান এবং শ্রেণী সংগ্রাম অপ্রধান ও জাতীয় সংগ্রামের অধীনস্থ।
আমার কাছে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য মূল সমস্যা ছিল কৃষকদের সমর্থন ও অংশগ্রহণ নিয়ে গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী গঠন করা এবং গ্রামাঞ্চল মুক্ত করা। সুতরাং আমার বক্তব্য ছিল যে, গণ-অভ্যুথানের মাধ্যমে এই বাহিনী গঠনের সময় যখন পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সংঘাত শুরু হবে সেই মুহূর্তে শ্রেণী দ্বন্দ্ব জাতীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। ফলে তখন জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান হবে।
আসলে আবুল বাশার পার্টিতে জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান বলায় আমি সিরাজ শিকদারের পরিণতিতে আমাদেরও যাবার বিপদটা দেখতে পাই। আবুল বাশার মূলত সঠিক ছিলেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী থাকলে সঠিক। যেমন আওয়ামী লীগের ছিল ৬ দফা। অর্থাৎ প্রকাশ্যে স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রিক জাতীয় কর্মসূচী দিলে তাঁর কথা মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু গণ-রাজনীতিতে জাতীয় কর্মসূচী না রেখে গোপন কমিউনিস্ট পার্টিতে জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান ধরলে কি হত? বিশেষত যে পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য জাতিকে তৈরী করছিল তার জন্য বিপদটা হত অনিবার্য। সিরাজ শিকদার যে ফাঁদে গিয়ে পড়েছিলেন আমরাও তো সেখানে গিয়েই পড়তাম একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতেই।
আমার যতদূর মনে আছে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির রাজশাহী-খুলনাসহ উত্তর বঙ্গের আঞ্চলিক কর্মীসভায় আবুল বাশার জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করলে আলাউদ্দিন-মতিন তাঁর যুক্তির সামনে অসহায় বোধ করছিলেন। তখন আমি শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধানের সপক্ষে আমার যুক্তি উপস্থিত করি। আমার কৃষক-শ্রমিক গণ-অভ্যুথান সংক্রান্ত ধারণাকে শ্রেণী দ্বন্দ্বের সপক্ষে ব্যাখ্যা করি। মনে রাখতে হবে আমি তখনও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নই। যাইহোক, আমি চেয়েছিলাম পার্টিতে সিরাজ শিকদারের লাইনের প্রবেশ রোধ করতে। অবশ্য সেই সময় আমি জাতীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূর গ্রাম এলাকায় পশ্চাৎপদ কৃষকদের মধ্যে পড়ে থেকে কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় আমার চিন্তায়ও পশ্চাৎপদতা ও অস্বচ্ছতা প্রবেশ করছিল। বিশেষত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা পালনের কোনও সুযোগ না থাকায় আমি জাতীয় রাজনীতি নিয়ে তেমন একটা ভাবার অবকাশও পেতাম না। আর নেতারাও আমার প্রতি সতর্ক ও বিরূপ দৃষ্টি রাখতেন এবং আমার বিভিন্ন মতামতের কারণে তাঁরা ছিলেন আমার কঠোর সমালোচক এবং আমার প্রতি বৈরী। তবু সেই সময় আমার বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান করার পরিণতি ঠেকাতে চেয়েছিলাম শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধান বলেই।
কিন্তু শ্রেণী-দ্বন্দ্ব প্রধান বললেই তো হল না। শ্রেণী অভ্যুথানও তো চাই! ওটা কি প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী ও রাজনীতি ছাড়া সম্ভব? আর সেখানে ছাত্র ও যুব শক্তির নেতৃত্বমূলক ভূমিকা ছাড়া কি সেটা সম্ভব? আর এদের ভূমিকার প্রশ্নে পার্টিতে নেতাদের সঙ্গে আমার যে বিতর্ক ও মতপার্থক্য হত সেগুলো তাঁদের ভোলার কথা নয়।
এ প্রসঙ্গে আমি আমার সেকালের ধারণা এবং সেই সঙ্গে আমার সমস্যা তুলে ধরার জন্য আমার এক টুকরো অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন অল্প দিন হল আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছি। আমি সেই সময় পর্যন্ত ঢাকায় ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য গ্রাম থেকে ২/৩ মাসে একবার করে হলেও সাধারণত আসতাম। ১৯৬৯-এর মাঝামাঝি কোনও এক সময় হবে। আমি ঢাকায় এলে আলাউদ্দিন আহমদ আমাকে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি কেন এত ঘন ঘন ঢাকায় আসেন? আর ছাত্রদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ রাখার কী এত দরকার? এলাকায় থেকে কৃষকদের মধ্যে কাজ করতে পারেন না?’
আসলে তাঁরা ছাত্রদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখাটা খুব অপছন্দ করতেন। যাইহোক, আমি উত্তরে বললাম, ‘আমি ঢাকায় আসি ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পারি দেশ, জাতি কোন্ দিকে যাচ্ছে, দেশের রাজনীতি কোন্ দিকে যাচ্ছে। আমার কাছে ছাত্ররা সবচেয়ে সচেতন ও অগ্রণী রাজনৈতিক শক্তি। তাদের মাধ্যমে আমি জাতির ভবিষ্যৎ দেখতে পাই।’ একটু থেমে বললাম, ‘আমি মনে করি ছাত্ররা জাতির আয়না।’
আলাউদ্দিন আহমদ রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘কী বললেন, কথাটা আবার বলেন!’ আমি পুনরুক্তি করলাম, ‘আমি মনে করি ছাত্ররা জাতির আয়না।’
এরপর স্বাভাবিকভাবে পার্টির নেতাদের প্রয়োজন ছাড়া আমার ঢাকায় আসা বন্ধ হয়ে যায়। অন্তত ১৯৭০-এর শেষ দিক পর্যন্ত।
যাইহোক, ঐ নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতির তাৎপর্য এবং ছাত্র-যুব শক্তির ভূমিকার গুরুত্ব যেমন বুঝত না তেমন অর্থনীতিবাদী ও পেশাভিত্তিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ড ছাড়াও আর কিছু বুঝত না। এই অবস্থায় পার্টিতে স্বাধীনতার লক্ষ্য থাকায় প্রকাশ্য পেশাভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে পার্টির ব্যাপক বিকাশ হলেও জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ’৬৯-এর শেষ এবং ১৯৭০-এর গোড়ার দিকে প্রায় পুরোপুরি আওয়ামী লীগের হাতে চলে যায়। বিশেষত ’৭০-এর মাঝামাঝি সময়ে পার্টি স্থবির হয়ে পড়ে। এই রকম সময় পার্টির প্রথম কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে আমি বিপদটা বুঝতে পারি এবং এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয় যে, পার্টি নেতৃত্ব সময় কাটাতে চাইছে এবং শেষ পর্যন্ত অতীতের কমউিনিস্ট পার্টির মতই দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তার সংস্কারবাদী রাজনীতির ধারাকেই জিইয়ে রাখবে যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি।
এ ক্ষেত্রে চারু মজুমদারের লাইনকে আমি পার্টির অর্থনীতিবাদী-সংস্কারবাদী রাজনীতির অবসান এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর হাতিয়ার হিসাবে দেখতে পাই। অন্তত আমার সামনে তখন আর কোনও বিকল্প ছিল না। ১৯৭০-এর জুলাই কংগ্রেসের পর থেকেই আমি চারু মজুমদারের লাইন নেবার গুরুত্বের কথা বলতে থাকি। আমি তখন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সুতরাং সুবিধা তো একটা ছিলই। এবং নেতৃত্বের অনীহার কারণে ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের পর হুমকি দিই যে, যদি পার্টিতে অনতিবিলম্বে চারু মজুমদারের লাইনকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পদ্ধতি হিসাবে না নেওয়া হয় তবে আমরা পার্টি ভেঙ্গে আলাদা পার্টি গঠন করব। আমজাদ আমাকে সমর্থন দেয়। তবে সে তখন ছিল চারু মজুমদারের লাইনের অন্ধ সমর্থক। যাইহোক, আমার হুমকি এবং চাপের ফলে এবং আমার প্রতি ছাত্র ও তরুণ কর্মীদের ব্যাপক অংশের সমর্থনের ফলে পার্টির নেতৃত্ব বিশেষ কংগ্রেস ডাকতে বাধ্য হন। ইতিপূর্বে বলেছি যে তা ১৯৭০-এর ৩০, ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত হয়।
বিশেষ কংগ্রেসে পার্টির নেতৃত্বের প্রধান অংশ গণ-লাইনের নামে সংস্কারবাদী-অর্থনীতিবাদী এবং জাতীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়তাবাদী কর্মপন্থা বহাল রাখতে চাইলেন। এই ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন, মতিন এবং আবুল বাশার একদিকে ছিলেন। তাঁরা সংখ্যাগুরু হলেন। সক্রিয়তাবাদী ও উদ্যোগাকাঙ্ক্ষী তরুণ কর্মীরা ছিল ব্যাপকভাবে চারু মজুমদারের লাইনের পক্ষে। তবে কংগ্রেসে তারা সংখ্যালঘু হল। নেতৃত্ব একটা আপোস পন্থা হিসাবে গণ-লাইনের পাশে চারু মজুমদারের লাইনকে অন্যতম লাইন হিসাবে গ্রহণ করলেন এবং যারা এই লাইন অনুসরণ করতে চায় তাদেরকে সেই স্বাধীনতা দিলেন। আমাকে তাঁরা কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে সরিয়ে দিলেন ঠিক, কিন্তু আমার বিচারে যে মুহূর্তে তাঁরা চারু মজুমদারের লাইনকে পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত করলেন সেই মুহূর্তে আমার এক ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পূর্ণ হল ঐ পার্টির ভিতর।
এত কাল ধরে তৈরী এবং সজ্জিত জাতীয় যুদ্ধের চেতনার বিশাল শক্তিটাকে আমি সেই মুহূর্তে চারু মজুমদারের লাইন তথা শ্রেণী যুদ্ধের নামে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম, যখন সারা দেশে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ও আবেগের উত্তাল জোয়ার বইছে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ঘটেছে। এবং এইভাবে নিজেদের নেতৃত্বে জাতীয় যুদ্ধ শুরু করতে কিংবা সেটা শুরু হলে তাতে পার্টির একটা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রাখতে চেয়েছিলাম। বস্তুত পার্টিকে নিষ্ক্রিয়তামুক্ত করে জাতীয় যুদ্ধ শুরুর উদ্যোগ হাতে তুলে নেবার সেটা ছিল এক চূড়ান্ত ও মোক্ষম মুহূর্ত।
এটা ঠিক যে, চারু মজুমদারের লাইন ছিল ভুল। কিন্তু আমার ধারণা যে, একটা ভুল পার্টিকে সম্ভবত সঠিকভাবে ঐ ভুলটা দিয়েই আমি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করায় ইতিহাসের এক অচেতন অস্ত্রে পরিণত করতে পেরেছিলাম। এর ফলে আওয়ামী লীগের আপোসের সব পন্থা বন্ধ হয়ে গেল। কারণ শ্রেণী যুদ্ধের নামে জাতীয় যুদ্ধের বিকল্প বিশাল স্রোতের মুক্ত হবার সময় এসে গেল। যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে গেল। প্রশ্ন হল এই যুদ্ধে কে নেতৃত্ব দিবে? পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, না কি আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই যুদ্ধ শুরু ও পরিচালিত হলে তাতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকা গৌণ হয় ঠিক, কিন্তু বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের প্রথম জাতীয় যুদ্ধটা তো হয়! এবং সেটাই হয়েছে।
হাঁ, পার্টির নেতারা আমার উদ্দেশ্যটা ঠিকই বুঝেছিলেন। কারণ আমার বক্তব্য ছিল, যে মুহূর্তে রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক জনগণের সংঘাত হবে সেই মুহূর্তে শ্রেণী দ্বন্দ্ব জাতীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। কর্মীরা কিন্তু এই চেতনা থেকে আমার দেওয়া লাইন প্রথমে গ্রহণ করে। নেতারা বুঝেছিলেন আমি পার্টিকে কোথায় কোন্ কৌশলে নিতে চাচ্ছি। সুতরাং শ্রেণী যুদ্ধের লাইন জাতীয় যুদ্ধে পরিণত হতে না পারে সেই জন্য ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারী তারিখে পার্টির বিশেষ কংগ্রেসে যখন তাঁরা পার্টিতে ঐ লাইনকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হলেন তখন তাঁরা আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিলেন।
আজকে অবস্থাটা চিন্তা করা যাক। যদি ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঐভাবে আক্রমণ শুরু না করত তবে কি হত! শ্রেণীশত্রু খতম ও গ্রামাঞ্চল মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী বা গেরিলা দলসমূহ গড়ে উঠত। ফলে অনিবার্যভাবে কোথাও না কোথাও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত দেখা দিত। তখন জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান এবং জাতীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছে এই বোধ থেকে কি কর্মীদের আর সরিয়ে রাখা যেত? জাতীয় যুদ্ধ বিরোধী নেতারা সব ভেসে যেত।
নেতারা ভালভাবে জানতেন আমার যুক্তিগুলো কি! শ্রেণীর ব্যাখ্যা কি! কৃষকের সব শত্রুই তো ছিল আমার বিচারে শ্রেণীশত্রু। গরুচোর, ডাকাত, গ্রামীণ দুর্বৃত্ত, অত্যাচারী জোতদার, মহাজন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত। আর কর্মীদেরও অনেকে আমার ব্যাখ্যা জানত। হয়তো সবাই মানত না। কারণ কেতাবে এ সব লেখা নেই। তা না থাক, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য শ্রেণী ও শ্রেণী-সংগ্রামের দৃষ্টি থেকে অমন একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাবার পর তাদের জাতীয়তাবাদী আবেগকে রোধ করার আর কোনও উপায়ই তো পার্টির রইল না! আমি অনুমান করি পার্টিতে ঐ একটি লাইন জাতীয় যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। যদি ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আক্রমণ না করত কিংবা আওয়ামী লীগ জাতীয় যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে না চাইত তবে যুদ্ধের নেতৃত্ব কমিউনিস্টদের হাতে চলে যেত। আর যেভাবেই হোক জাতীয় যুদ্ধ যদি একবার পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে শুরু হয়ে যেত তবে জাতীয়তাবাদের জোয়ারের মধ্যে শুরু করা ঐ যুদ্ধ কি সমগ্র জনগণকে টেনে নিত না? শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হয়ে কি এই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারতেন? কি করতেন মুজিব?
হাঁ, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে ঐ মুহূর্তে চারু মজুমদারের লাইন নেবার অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। সেটা যত দেরীতেই হোক।
আমি অনুমান করি যে, এমন একটা মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে এবং মুজিবের সম্মতিতে অথবা জ্ঞাতসারে পাকিস্তানী সেনাবহিনী কাল বিলম্ব না করে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুজিব কিছুদিন আগেই জানতেন কি ঘটতে যাচ্ছে। তা না হলে ৭ মার্চের ভাষণে ও সব কথা কেন? ‘আমি যদি হুকুম দিবার না পারি...’ ইত্যাদি? তবে ’৭১-এর এমন জনযুদ্ধটা তাঁর হিসাবে ছিল বলে মনে হয় না।
যাইহোক, এটাই সঙ্গত মনে হয় যে, স্বাধীনতার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির চারু মজুমদারের লাইনের নামে জাতীয় যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতির হুমকি ঐ মুহূর্তে সারা দেশে আওয়ামী লীগসহ সবাইকে এমন এক নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয় যা যুদ্ধকে অনিবার্য করে। যেহেতু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে জনগণের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হল সেহেতু সঙ্গত কারণেই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি হেরে গেল। জাতীয় যুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে চলে যাওয়ায় এবং আওয়ামী লীগের বিভাজনবাদী ও আক্রমণাত্মক ভূমিকার কারণে পার্টি নেতৃত্ব্ নিজেদের জাতীয়তাবাদ বিরোধী চক্রান্তের ফাঁদে পার্টিকে আটকে রাখতে পারল। আওয়ামী লীগ জাতীয় যুদ্ধটা আগেই শুরু করায় ঐ পার্টির কাছে জাতীয় যুদ্ধটাই অচ্ছুৎ হল। আসলে ঐ পার্টি তো ব্রাহ্মণ! অচ্ছুৎ বা হরিজন আওয়ামী লীগ যা ছোঁয় তা-ই অচ্ছুৎ হয়ে যায়!
তবু সম্ভবত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হত না। কিন্তু তার তাতে নেতৃত্ব দেবার সামর্থ্য বা ইচ্ছা ছিল না। অথচ এই যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েই তার জন্ম ও বিকাশ। ফলে যুদ্ধ শুরু করিয়ে দেবার কাজ সম্পূর্ণ হলে তার প্রয়োজন আর থাকবার কথা নয়। এই বিচারে এটা এমন এক শক্তি যার প্রয়োজনটা ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিস্তারের জন্য। ইতিবাচক দিক তার এইটুকু। অর্থাৎ চেতনার ক্ষেত্রে, আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে; কাজের ক্ষেত্রে নয়। কাজের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা প্রধানতই নেতিবাচক। অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে। সেখানে তা জাতি খণ্ডনকারী, জাতি বিভক্তকারী।
এটা দুর্ভাগ্য যে, মাত্র ২/১ জন নেতা একটা পার্টির হাজার হাজার কর্মীর ভুল পথে যাবার কারণ হয়েছে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আমি কাছে থেকে দেখি নি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর নেতৃত্বকে আমি কাছে থেকে দেখেছি। তা থেকে আমি বুঝেছি ঐ পার্টির কলকাঠি নাড়তেন মূলত আবদুল হক। পার্টির সম্পাদক ছিলেন সুদীর্ঘ কালের আত্মগোপনকারী এবং ত্যাগী নেতা সুখেন্দু দস্তিদার। আবদুল হক তাঁর ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করতেন এবং সেই সঙ্গে তোয়াহারও। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মূল নিয়ন্তা ছিলেন দেবেন শিকদার এবং সেই সঙ্গে আলাউদ্দিন আহমদও। দেবেন শিকদার জেলে যাবার পর পার্টির মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল আলাউদ্দিন আহমদের হাতে। কিন্তু আব্দুল মতিনের ভাবমূর্তি ছিল বলে তাকে সামনে রেখেছিলেন। দেবেন শিকদারের পর সম্পাদক ছিলেন আব্দুল মতিন। কিন্তু নীতি নির্ধারণ করতেন এবং পার্টি চালাতেন আলাউদ্দিন আহমদ। আমি এ কথা ভেবে অবাক হয়েছি যে, ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন আলাউদ্দিন আহমদের হাতের পুতুল।
এইভাবে আমার অভিজ্ঞতায় বুঝেছি গোটা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এ দেশে মূলত ২/১ জন চক্রান্তকারীই চালিয়েছে। তবে প্রশ্ন করা যাবে আর কি ভাল লোক ছিল না? ভাল লোকের সংখ্যাই খুব বেশী ছিল। নেতৃত্বের অধিকাংশই ছিলেন ত্যাগী, সৎ ও আদর্শবান। কিন্তু কোনো দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, মুক্ত মনের অধিকারী এবং মেধাবী মানুষ উপরে উঠতে পারত না। ২/১ জন ধূর্ত অথচ ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষার নেতার অন্ধ অনুগত অথবা মতান্ধ মানুষদের নিয়ে গঠিত হত নেতৃত্ব। গোপন পার্টি হওয়ায় বাইরে থেকে অনেক কিছু বোঝা যেত না। আর সৎ, সাহসী, অধ্যয়নশীল, জ্ঞানী ও বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন বিপ্লবী কর্মীরা নীচে পড়ে থাকত। এবং দীর্ঘ কাল এই রকম এক বদ্ধ ও সংকীর্ণ কাঠামোয় থেকে, নীচে পড়ে থেকে নিজেরাও বিচার বুদ্ধিহীন ও যন্ত্র মানুষে পরিণত হত। আর কেবলমাত্র তখনই তারা নেতৃত্বের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার সুযোগ পেত। এই হল এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পরিণতি। এবং এটাই ছিল এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ ঐতিহ্য। আমাদের প্রজন্মের বিপ্লবীরা সজ্ঞানে হোক অজ্ঞানে হোক এই ফাঁদটাকে ধ্বংস করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে এ দেশে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক যে প্রয়োজন ছিল তা শেষ হওয়ায়। ’৭১ এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ এই প্রয়োজন শেষ করল। কিন্তু কাঠামোটার প্রয়োজন শেষ হলেও তার ভিতরের শক্তিটাকে কি এই জাতির প্রয়োজন ছিল না?
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এ দেশে স্বাধীনতা ও জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে চেতনা ছড়িয়েছিল তার মূল্য যেমন অপরিমেয় তেমন আমার বিচারে হক-তোয়াহা নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি কৃষকের এই দেশে ভূমি সংস্কার ও জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে চেতনা ছড়িয়েছিল তারও মূল্য কম নয়। এই যে সবাই মিলে এ দেশে নিপীড়িত, পশ্চাৎপদ জাতি ও জনগণের মনে নবচেতনার বীজ বপন করে চলেছিল তার কি কোনই মূল্য ছিল না? পথ ভুল হতে পারে। কিন্তু তার দায় কেন কর্মীরা নিবে যাদের ভিতরে লোভ ছিল না, পদ মর্যাদার চিন্তা ছিল না এবং যারা ছিল এ দেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি নিবেদিত?
দু:খটা হয় সেই বিপুল সংখ্যক সৎ ও আদর্শবান, সাহসী ও বীর কর্মীর জন্য যারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নূতন দেশ, জাতি ও জনগণ নির্মাণের তুলনাহীন হাতিয়ার হতে পারত মুজিব তাদেরকেই দলে দলে হত্যা ও ধ্বংস করলেন। অথচ গুটি কয়েক নেতা বাদে আর কাউকেই কি তিনি পেতেন না?
পৃথিবীতে যাঁরা মহৎ জাতি বা রাষ্ট্র নির্মাণ করেছেন তাঁরা কি এমন করেছেন? লেনিন কি তাঁর গুটিকয়েক অন্ধ অনুসারী নিয়েই রুশ বিপ্লবকে সফল করেছিলেন? ট্রটস্কি কি প্রথম থেকে তাঁর অনুসারী ছিলেন? তিনি কি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদেরকেও সঙ্গে নেন নি? মাও-এর অভিজ্ঞতা কি বলে? কিংবা হো চি মিনের? আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো দুনিয়ার হর্তাকর্তা! এই রাষ্ট্রের নির্মাতা জর্জ ওয়াশিংটন কত বিভিন্ন ধরনের লোক নিয়ে, কত ভিন্নমুখী প্রবণতা নিয়ে, কত বিরোধিতাকে মেনে নিয়েই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার রাষ্ট্র বিপ্লবে নেতৃত্ব দিলেন তার খবর আমরা কতটুকু রাখি? অত কথা কেন, ইঁদুরের আয়তন ও শক্তি নিয়ে যে কিউবা এতগুলো যুগ ধরে হাতির মত আয়তন ও শক্তির অধিকারী যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার নির্মাতা ক্যাস্ট্রোর ইতিহাস থেকেও কি আমাদের শিক্ষা নেবার নেই?
ফিদেল ক্যাস্ট্রো পূর্বে কোনও দিন সমাজতন্ত্রী বা মার্কসবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী। তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীকে নিয়ে স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার পর বিপ্লবকে রক্ষা করার প্রয়োজনে তিনি কিউবার সমাজতান্ত্রিক নামের মাকর্সবাদী দলটাকে কাছে টেনে নিলেন। অথচ এই পার্টি ছিল তাঁর বিরোধী এবং বাতিস্তার সমর্থক। তিনি যখন বিপ্লব রক্ষার আহ্বান দিলেন তখন নেতাদের সাধ্য হয় নি কর্মীদের ঠেকিয়ে রাখার। গোটা পার্টি তাঁর কাছে চলে এল। তাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি গঠন করলেন কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি। আমার যতদূর মনে পড়ে পার্টিকে ভ্রান্ত পথে নেবার অপরাধের জন্য তিনি দুইজন কমিউনিস্ট নেতাকে ফাঁসি দেন। আর এ দেশে নেতারা বেঁচে গেলেন। কিন্তু কর্মীরা দলে দলে মৃত্যু বরণ করল, ধ্বংস হল, নির্যাতনের শিকার হল। আসলে মুজিব কি ছিলেন? তিনি কি চেয়েছিলেন? তবে সেই আলোচনায় যাবার আগে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গী এবং মওলানা ভাসানীর সমস্যার উপর একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিতে চাই। কারণ এ ছাড়া ষাটের দশকের বিপ্লবী বা বামপন্থী আন্দোলনের সমস্যা ঠিকভাবে বোঝা যাবে না।